রূপাদের বাড়ি থেকে একটা মাছ এসেছে। তার আকৃতি হুলস্থূল ধরনের। মাছ বললে এই জলজ প্রাণীটির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হয় না। মৎস্য বললে কিছুটা হয়। সেই মৎস্য দুজন ধরাধরি করে বারান্দায় এনে রাখল। আমাদের বাসার সবারই হতভম্ব হয়ে যাওয়া উচিত ছিল—কেউ হতভম্ব হলাম না। বরং সবাই এমন ভাব করতে লাগলাম, যেন খুব বিরক্ত হয়েছি। আমাদের বাসার অলিখিত নিয়ম হচ্ছে–রূপাদের প্রতিটি কার্যকলাপে আমরা বিরক্ত হবো। রূপাদের কোনো আত্মীয় টেলিফোন করলে আমরা শুকনো গলায় বলব, এখন কথা বলতে পারছি না, খুব ব্যস্ত, পরে করুন। এরপর আর টেলিফোন করা উচিত নয়। তবু যদি লজ্জার মাথা খেয়ে কেউ করে, তখন বলা হয়, বাসায় নেই। কখন ফিরবে বলা যাচ্ছে না।

রূপার চাচা কিছুদিন আগে এসেছিলেন। তাঁকে বসার ঘরে একা একা ঘণ্টখানিক বসিয়ে রাখা হল। আমাদের কাজের ছেলের হাতে চা পাঠিয়ে দেয়া হল। শেষ পর্যন্ত বাবা অবশ্যি দেখা করতে গেলেন। কয়েকবার হাই তুলে বললেন, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। প্রেসার বেড়েছে। আজ আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। আরেকদিন আসুন। চ-টা খেয়েছেন তো?

প্রকাণ্ড পাংগাশ মাছ বারান্দায় পড়ে আছে। সবাই বিরক্ত মুখে দেখছে। শুধু আমাদের বেড়ালটা মনের আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না, লাফঝাঁপ দিচ্ছে। বেড়ালটাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি যে ও বাড়ির কোনো কিছুতেই এত আনন্দিত হতে নেই। আমার মা ক্রু কুঁচকে বললেন, এই মাছ এখন কে কাটবে?

যে লোক মাছের সঙ্গে এসেছে, সে হাসিমুখে বলল, আম্মা, মাছ কাটার লোক সঙ্গে নিয়ে এসেছি, বটিও এনেছি। আগে সবাই দেখুন, তারপরে কাটার ব্যবস্থা হবে।

মাছ কাটার লোক কোথায়?

গাড়িতে বসে আছে আম্মা, সবাইকে ডাকুন, সবাই দেখুক।

মা বললেন, এত দেখাদেখির কি আছে? বড় মাছ কি আমরা আগে দেখিনি?

লোকটি হাত কচলাতে কচলাতে বলল, অবশ্যই দেখেছেন আম্মা, অবশ্যই দেখেছেন। এই মাছটার ওজন হল এক মণ। এক সের কম এক মণ। ঊনচল্লিশ সের। আপাকে ডাকেন। আপা দেখুক, স্যার বলে দিয়েছেন। আপাকে না দেখিয়ে মাছ যেন কাটা না হয়।

রূপাকে ডাকা হল। সে মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ, কি অদ্ভুত সুন্দর! রূপার পাতের মতো ঝিকমিক করছে।

আমি দোতলায় উঠে এলাম। ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, মানুষের সৌন্দর্যবোধের নানা দিক আছে। মাছের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে কেটেকুটে আমরা খেয়ে ফেলছি। এর কোনো মানে হয়!

রাতে খেতে বসে রূপা বলল এ কি, বড় মাছটা রান্না হয়নি?

মুনিয়া বলল, না।

না কেন?

ডীপ ফ্রীজে রেখে দেয়া হয়েছে। পরে রান্না হবে। আমাদের নিজেদের বাজার রান্না করা হয়েছে।

রূপা আর কিছু বলল না, কিন্তু তার মুখ থেকে বিস্ময়ের ভাবটা দূর হল না। বড় মাছটা রান্না হয়নি, এটা সে যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আমি বললাম, পাংগাশ মাছ কি তোমার খুব প্রিয়?

রূপা বলল, পাংগাশ মাছ প্রিয় হবে কেন? কোনো মাছই আমার প্রিয় না। ইলিশ মাছের ডিম খানিকটা প্রিয়।

তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে মাছটা রান্না না হওয়ায় আপসেট হয়ে পড়েছ।

আপসেট হবার কারণ আছে বলেই আপসেট হচ্ছি। তুমি যদি শোন, তুমিও আপসেট হবে। এই জন্যেই তোমাকে শোনাব না। কেন আপসেট হচ্ছি, পরশু বলব।

এখনি বলে।

না।

রূপা খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল। তার মন খারাপ ভাব স্থায়ী হল না। ঘরে ঢুকেই গান চালিয়ে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সাজগোজ করলে কেমন হয়? আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, রাত এগারোটায়!

হুঁ। রাত এগারোটায় সাজা যাবে না, এমন তো কোনো আইন নেই। আর এ রকম আইন থাকলেও আমি মানতাম না। আচ্ছা শোন, তুমি কি মানবেন্দ্রের ঐ গানটা শুনেছ, ওগো সুন্দরী আজ অপরূপ সাজে, সাজো সাজো সাজো…

না।

আমি যখন ছোট ছিলাম অর্থাৎ কলেজে যখন পড়তাম, তখন এই গানটা বাজাতে বাজাতে সাঙ্খতাম। আমার তখন মনে হতো কি জানো? মনে হতো আমার জন্যেই যেন গানটা লেখা হয়েছে। অবশ্যি এই ব্যাপারটা এখনো আমার মধ্যে আছে, কোনো কোনো গান শুনলেই মনে হয় এই গান আমার জন্যে লেখা, অন্য কারো জন্যে নয়। তোমার কি এরকম মনে হয়?

না।

তুমি ক্যামেরাটা নিয়ে এসো তো, আমার সাজগোজ শেষ হলে একটা ছবি তুলবে।

ক্যামেরায় ফিল ছিল না বলে ছবি তোলা গেল না। রূপা করুণ গলায় বলল, দোকানপাট নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে, এত রাতে কি আর ফিল্ম পাওয়া যাবে?

পাওয়া না যাবারই কথা।

এসো তাহলে শুয়ে পড়ি, কি আর করা।

আমরা ঘুমুতে গেলাম বারোটার দিকে। বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করামাত্র রূপা বলল, মাছের ব্যাপারে কেন আপসেট হয়েছিলাম তোমাকে বলেই ফেলি।

তোমার বলতে ইচ্ছা না হলে বলার দরকার নেই।

ইচ্ছা হচ্ছে। আজ থেকে বাইশ বছর আগে বাবা বিশাল একটা পাংগাশ মাছ এনেছিলেন। মাছ নিয়ে ঘরে ঢোকামাত্র বাবা আমার জন্মসংবাদ পেলেন। মাছটা রূপার মতো চকচক করছিল। মাছের রূপালি রঙ থেকে রূপা নাম নিয়ে বাবা আমার নাম রাখলেন। সেই থেকে অলিখিত নিয়মের মতো হয়ে গেল, আমার জন্মদিনে বাজারের সবচে বড় মাছটা আসবে। গতবার এসেছিল চিতল মাছ। লম্বায় প্রায় আমার সমান।

আজ কি তোমার জন্মদিন?

ইয়েস স্যার। তুমি ইচ্ছে করলে শুভ জন্মদিন বলতে পার।

শুভ জন্মদিন রূপা।

থ্যাংক ইউ।

তোমার জন্ম কি দেশে হয়েছিল?

হ্যাঁ। মিটফোর্ড হাসপাতালে।

আমার ধারণা, তোমার জন্য বিদেশে।

যতই দিন যাবে, দেখবে, আমার সম্পর্কে তোমার বেশির ভাগ ধারণাই ভুল।

আজ যে তোমার জন্মদিন আগে বললে না কেন?

আগে বলব কি করে? আমার নিজেরই মনে ছিল নাকি? মাছ দেখে মনে পড়ল।

রূপা তরল গলায় হাসল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। আমার মন আসলেই খারাপ হয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারছি আজ রাতে আর ঘুম হবে না। এপাশ-ওপাশ করে কাটাতে হবে। জন্মদিনের খবরটা কাল ভোরে দিলেও অনিদ্রার হাত থেকে বাঁচতাম।

রূপার বাবা ভদ্রলোককে যতটা খারাপ শুরুতে ভাবছিলাম এখন মনে হচ্ছে ভদ্রলোক হয়তো ততটা খারাপ নন। জন্মদিন মনে রাখছেন, বিশাল মাছ পাঠাচ্ছেন। তবে আমার ধারণা, ভদ্রলোকের সীমা ঐ মাছ পর্যন্তই। কন্যার প্রতি ভালবাসার আর কোনো কোনো লক্ষণ এখনো তিনি দেখাননি। বেশির ভাগ সময়ই তার কাটে দেশের বাইরে। কিছু দিনের জন্যে দেশে আসেন। টেলিফোন করেন। মেয়ের সঙ্গে খুবই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা হয়। এই পর্যন্তই।

আমাদের বাড়িতে রূপাকে কেউ পছন্দ করে না। শুধু লাবণ্য পছন্দ করে। রূপার মতো লাবণ্যেরও ঘুম-রোগ আছে। ঘুম পেলেই সে রূপার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়বে।

আমাদের বাড়িতে রূপাকে সবচে বেশি অপছন্দ করে মতির মা। সে সবসময়ই গলা নিচু করে মাকে কিংবা মুনিয়াকে রূপ সম্পর্কে গুজগুজ করে কি সব যেন বলে। একদিন আমি খানিকটা শুনলাম আম্মা, গরীব মানুষ, আপনেরে একটা কথা কই কিছু মনে নিয়েন না। দোষ হইলে ক্ষ্যামা দিয়েন। কথাটা হইল নয়া বৌরে নিয়া।

মা গম্ভীর গলায় বললেন, কি কথা?

নয় বৌ-এর সাথে জ্বীন থাকে আম্মা। দুনিয়ায় যারা খুব সুন্দর মাইয়া তারার সাথে দুইটা তিনটা কইরা পুরুষ জ্বীন থাকে।

চুপ কর তো।

জানি আম্মা, আমার কথা শুনলে রাগ হইবেন। কিন্তু কথা সত্য। জ্বীনের সব লক্ষণ নয়া বৌ-এর আছে—এই যে রাইত দিন ঘুমায়, এর কারণ কি? কারণ একটাই। কইন্যা ঘুমের মইধ্যে থাকলে জ্বীন ভূতের জন্যে খুব সুবিধা।

এই জাতীয় কথা দাঁড়িয়ে শোনা অসম্ভব। আমি বাকিটা শুনিনি। তবে মা নিশ্চয়ই শুনেছেন। কিছুটা বিশ্বাসও করেছেন। মানুষ সত্যের চেয়ে অসত্যকে সহজে বিশ্বাস করে। মুনিয়ার কথাই ধরা যাক, সে একটি চমৎকার মেয়ে। তার স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। লোকজনকে বলেছে স্ত্রীর চরিত্রহানি ঘটেছিল, সম্পর্ক ছিল অন্য একজনের সঙ্গে। লোকজন এই অসত্যটাই বিশ্বাস করেছে। শুধু লোকজন কেন, আমাদের নিকট আত্মীয়স্বজনদেরও সে-রকম ধারণা। অসত্য বৃক্ষের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। অসত্য বৃক্ষকে সে কারণেই সহজে উপড়ে ফেলা যায় না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ