আমাদের বারান্দায় দুটি ইজিচেয়ার ছিল। দুটি ইজিচেয়ারের একটি আমি আমার ঘরে নিয়ে এসেছি। বিয়ের পর আমার শোবার ঘরের পরিবর্তনের মধ্যে এই পরিবর্তনটা হয়েছে। ও আচ্ছা, আরেকটা পরিবর্তন হয়েছে ইজিচেয়ারের পাশে বড় একটা টেবিল ল্যাম্প। এই টেবিল ল্যাম্প রূপাদের বাড়ি থেকে এসেছে। রূপার বাবা দেশে ফিরেই তাঁর কন্যার ব্যবহারী শাড়ি, গয়না, কিছু ফার্নিচার একটা পিক আপ ভর্তি করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে আধ পৃষ্ঠার একটা চিঠি। ব্যক্তিগত চিঠি—তাঁর কন্যাকে লেখা। আমার পড়ার কথা না, পড়া উচিতও না। যেহেতু চিঠি দু দিন ধরে আমার টেবিলে পড়ে আছে কাজেই আমি পড়েছি।

মা রূপা,

তোমার শাড়ি, গয়না, পাস বই, চেক বই পাঠালাম। ছোট স্যুটকেসটায় কসমেটিকস। তোমার ড্রেসিং টেবিলে যা পেয়েছি সবই দিয়ে দিয়েছি। কাজগুলি দ্রুত করতে হয়েছে, কারণ আমি আবার মাস তিনেকের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। বাড়ি তালাবন্ধ থাকবে। চাবি তোমার রহমান চাচার কাছে থাকবে। প্রয়োজনে তার কাছ থেকে নিতে পার। তবে তাকে পাওয়া এক সমস্যা। তোমার ব্যবহারী জিনিসপত্র তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি, তার মানে এই নয় যে হুঁট করে তুমি যে কাণ্ডটি করেছ তা ক্ষমা করা হয়েছে। তোমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল, তার থেকে বাঁচার জন্য বিয়ে নামক ব্যপারটি ব্যবহার করেছ। বিয়ে সমস্যা থেকে বাঁচার কোনো ব্যবস্থা নয়। তোমার মাও সমস্যা এড়াবার জন্যে আমাকে বিয়ে করে অনেক বড় সমস্যা তৈরি করেছিলেন। আমি দুঃখিত হয়ে লক্ষ করছি, তোমার মা যেসব ভুল তার। জীবনে করেছিল, তুমিও একে একে তাই করতে যাচ্ছ। তোমার মা এক একটা ভুল করত, আর সেই ভূলকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার হাস্যকর চেষ্টা করত। তুমিও হয়তো তাই করবে। যে ছেলেটিকে তুমি ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করলে সে কেমন ছেলে আমরা পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তুমিই ভাল বলতে পারবে। তার সঙ্গে দুদিন। আমার দেখা হয়েছে। সামান্য কথা হয়েছে। আমার কাছে তাকে নির্বোধ বলে মনে হয়েছে। কে জানে, হয়তো নির্বোধ ছেলেই তোমার কাম্য।

ভাল থাক, এই শুভ কামনা। সব বাবার মতো আমিও তোমার মঙ্গল কামনাই করছি। তোমার বাইশ বছরের জীবনে আমি তোমার প্রতি ভালবাসার কোনো অভাব দেখাইনি। আমাকে তোমার অসহ্য বোধ হয়েছে জানার পর আমি তোমাকে অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তোমার মার মৃত্যুর পর আমি অনায়াসে। আরেকটি বিয়ে করতে পারতাম। তা করিনি। তোমার অযত্ন হবে, অবহেলা হবে, এই ভেবেই করিনি। তুমি আমার সেই ভালবাসা তুচ্ছ করেছ। এই স্বভাবও তুমি পেয়েছ তোমার মার কাছ থেকে। তোমার মা বেঁচে থাকলে হয়ত সে বলত—রূপা, তুমি যা করেছ ভালই করেছ। আমি তা বলতে পারছি না। যাই হোক, শেষ কথাটি বলছি—আমার বাড়ির দরজা তোমার জন্যে সব সময় খোলা থাকবে তোমার সব আশ্রয় নষ্ট হবার পর যদি ফিরতে ইচ্ছা করে ফিরতে পারবে।

–তোমার বাবা।

প্রথমে ভেবেছিলাম, রূপা ইচ্ছা করেই এই চিঠি টেবিলে ফেলে রেখেছে যাতে আমি পড়তে পারি। সেই ধারণা ঠিক না। রূপার স্বভাবই হচ্ছে এলোমেলো অগোছালো। গোসলখানায় গোসল করতে গিয়ে সে গলার হার খুলে রেখে এসেছিল। মুনিয়া তাতে খুব হৈচৈ করছিল। রূপা অবাক হয়ে বলেছে–সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত হৈচৈ কেন? মুনিয়া বলল, ঘরে তিনটা কাজের লোক, যদি চুরি হত? রূপা বলল, চুরি হলে কি আর করা। এম্নিতেও তো অনেক সময় হারায়। হঠাৎ গলা থেকে খুলে পড়ে।

দামী একটা হার হঠাৎ গলা থেকে খুলে পড়বে?

দামী হার গলা থেকে খুলে পড়তে পারবে না এমন কোনো আইন তো নেই মুনিয়া। মানুষ পর্যন্ত হারিয়ে যায়, আর সামান্য গলার হার।

মুনিয়ার ধারণা, এসব হচ্ছে রূপার চালবাজি কথা। আমি জানি চালবাজি কথা না। সে যা ভাবছে তাই বলছে। মন রেখে কথা বলার বিদ্যা এখনো বোধহয় শিখে উঠতে পারেনি।

আমি ইজিচেয়ারে বসে আছি। হাতে গতকালকের পত্রিকা। পত্রিকা রেখেছি। পড়ার জন্যে না। মুখ আড়াল করে রাখার জন্যে। মুখ আড়াল করে আমি রূপার কথা শুনছি।

রূপা লাবণ্যের সঙ্গে লুডু খেলতে খেলতে কথা বলছে। ভাঙা ভাঙা কথা, যা একমাত্র ছোটদের সঙ্গেই বলা যায়।

লাবণ্য সোনা, এই নাও চার চাললাম। ওয়ান টু থ্রী ফোর। তোমার দুই হয়েছে, তুমি দুই চালবে। উঁহু, তুমি উল্টোদিকে চলেছ। সব খেলার নিয়ম আছে। যে খেলার যে নিয়ম সেই খেলা সেই ভাবে খেলতে হয়। উল্টো খেলা যায় না। আমি কি বলছি তুমি কি বুঝতে পারছ লাবণ্য?

পারছি।

ভেরি গুড। ছোটরা খুব সহজে জটিল জিনিস বোঝে। বড়রা বুঝতে চায় না। বুঝিয়ে দিলেও ভাব করে যে বোঝেনি। ছোট থাকাই ভাল। তাই না?

হ্যাঁ।

তুমি কি ছোট থাকতে চাও?

চাই।

কিন্তু ছোট থাকার সমস্যাও আছে। ছোটরা নিজেদের পছন্দমতো জিনিস কখনো পায় না। তাদের চলতে হয় বড়দের পছন্দে। যেমন ধর, আমি এখন চা খাব। তুমি খাবে না।

আমিও পিরিচে ঢেলে চা খাব।

আচ্ছা, দেয়া হবে। যাও, চায়ের কথা বলে আস।

লাবণ্য চায়ের কথা বলতে উঠে গেল। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, গতকাল সন্ধ্যায় তোমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা হল। ছাদে গিয়েছিলাম, সে রীতিমতো ধমক দিল—গাল ফুলিয়ে বলল, এখানে কি করছেন?

আমি বললাম, হাঁটছি।

সে বলল, সন্ধ্যাবেলা হাঁটছেন কেন?

আমি বললাম, সন্ধ্যাবেলা হাঁটা কি নিষিদ্ধ?

ছাদে হাঁটা নিষেধ। আমার ডিসটার্ব হয়। পড়াশোনা করছি—এক মাসও নেই। পরীক্ষার। ছাদে কেউ এলেই আমি ডিসটার্বড ফিল করি।

আমি বললাম, আমি ছাদে হাঁটতে এসেছি, আপনি পড়ছেন—এতে আমিও ডিসটার্বড ফিল করছি। ঠিকমতো হাঁটতে পারছি না। আপনি বরং এক কাজ করুন, বই নিয়ে নিচে চলে যান, আমার হাঁটা শেষ হলে আবার আসবেন।

আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমি মুনিয়ারও ছোট।

ও আচ্ছা। বুড়োদের মত দেখাচ্ছে বলে আপনি বলছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি সবার বড়।

আমার গত ডিসেম্বরে ২৫ হয়েছে।

ডিসেম্বরের কত তারিখ?

২৩শে ডিসেম্বর।

ঠিক আছে, পড়াশোনা করতে থাক, আমি নিচে যাই। এই বলে আমি নিচে চলে এলাম। তোমরা ছিটগ্রস্ত পরিবার। তোমার ভাইয়েরও তোমার মতো ব্রেইন এলোমেলো।

আমি বললাম, আমার ব্রেইন কি এলোমেলো?

হ্যাঁ। এক ঘণ্টা ধরে বাসি একটা খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে আছ। সারাক্ষণ দেখি ইজিচেয়ারটায় বসে আছে। কি আছে এই চেয়ারটায়?

কিছু নেই।

তাহলে বসে থাক কেন?

বসে থাকতে ভাল লাগে, তাই বসে থাকি।

তোমার এই উত্তর আমার পছন্দ হয়েছে। যা করতে তোমার ভাল লাগে তা। অবশ্যই করবে। কে কি বলছে বা বলছে, না তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কারণ। একটা জিনিস মনে রাখবে—তুমি আছ বলেই এই পৃথিবী টিকে আছে। তুমি নেই পৃথিবীও নেই।

আমার কাছে নেই। অন্যের কাছে তো আছে।

অন্যের কাছে থাকলে তোমার কি? তোমার কিছু যাচ্ছে আসছে না। শোন, তোমার যা ভাল লাগে তুমি করবে। আমি কখনো বাধা দেব না। ঠিক একইভাবে আমি আশা করব আমি যা করব তা আমাকে করতে দেবে। বাধা দেবে না। এই একটা ব্যাপার ঠিক করে নিলে আমাদের কখনো কোনো সমস্যা হবে না।

এইসব কথা তুমি কি তোমার মার কাছে শিখেছ?

হ্যাঁ। তিনি কি সব সময় তোমাকে উপদেশ দিতেন?

মোটেও উপদেশ দিতেন না। তিনি তাঁর সব উপদেশ একদিন দিলেন। তাঁর উপদেশ দেয়ার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। শুনতে চাও?

চাই।

আমার তখন বয়স বার। ঘুমুচ্ছি। রাত দুটার মতো বাজে। মা এসে আমাকে ডেকে তুললেন। আমি বললাম, কি ব্যাপার? মা বললেন–কফি খাবার জন্য ডাকলাম। আমি বললাম, রাত-দুপুরে কফি খাব কেন? মা বললেন, রাত-দুপুরে কফি খাওয়া যাবে না, এমন তো কোনো কথা নেই লিটল ডার্লিং।

আমি মার সঙ্গে কফি খেলাম। দুজন খানিকক্ষণ বারান্দায় হাঁটলাম। মা আমাকে উপদেশ দিতে শুরু করলেন। ঘণ্টাখানিক উপদেশ দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তখন মার স্বাস্থ্য খুব খারাপ ছিল। কোনো পরিশ্রম করতে পারেন না। সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না। তাঁকে ধরে ধরে দোতলায় তুলতে হয়।

পরদিন ভোরবেলা শুনলাম ঘুমের মধ্যে মা মারা গেছেন। হার্ট ছিল দুর্বল, অতিরিক্ত ঘুমের অষুধ খেয়েছিলেন। শরীর সহ্য করতে পারেনি।

যদিও আমার ধারণা এটা আত্মহত্যা, নয়তো আমাকে রাত দুটায় ঘুম থেকে তুলে উপদেশ দিতেন না। তোমার কি মনে হয় আমার অনুমান ঠিক আছে? খবরের কাগজ হাতে আমি রূপার দিকে তাকিয়ে আছি। কোনো রকম দ্বিধা ছাড়া সে এই গল্প কি করে করল! লাবণ্যও পাশে বসে হাঁ করে কথা শুনছে।

আমি কিছু বলার আগেই মুনিয়া চা নিয়ে ঢুকল এবং গম্ভীর গলায় বলল, ভাবী, লাবণ্যকে তুমি কিন্তু চা দেবে না। ও আজেবাজে সব অভ্যেস করছে। আর শোন দাদা তুই একটু নিচে যা।

আমি বললাম, কেন?

সফিক ভাই এসেছে। তোকে চাচ্ছে।

বলে দে বাসায় নেই।

একটু আগে বলেছি, তুই বাসায় আছিস।

এখন বলে দে—আমি বাসায় নেই।

মিথ্যা আমি বলতে পারব না দাদ তুই নিজে গিয়ে বলে আয় যে তুই বাসায় নেই।

মুনিয়া শুকনো মুখে চলে গেল। রূপা বলল, আমি বলে আসি। উনি আসলে আমাকে দেখতেই এসেছেন। প্রতি দশ থেকে বারো দিন পরপর উনি আমাকে দেখতে আসেন। এই চক্রটা আমি হিসেব করে বের করেছি। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে এগারো দিন আগে।

রূপা নিচে নেমে গেল। আমি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বসে রইলাম। লাবণ্য বলল, মামী লুডু খেলবে?

আমি বললাম, না।

একটু খেল মামা। তুমি কালো আমি লাল।

না।

খেল মামা, খেল। খেলতেই হবে।

আমি ইজিচেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বেশ জোরেই তার গালে একটা চড় বসালাম। মেয়েটা মুহূর্তৈ বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল। মুনিয়া ছুটে এসে বলল, কি হয়েছে?

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, তেমন কিছু হয়নি। চড় মেরেছি। বড় বিরক্ত করছিল।

মুনিয়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, এইভাবে তাকিয়ে থাকিস মুনিয়া। তোকে কালো টিকটিকির মতো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তোর চোখ ঠিকরে বের হয়ে আসবে।

ঠিক করে আমাকে বল তো দাদা, কেন মারলি?

আমাকে লুডু খেলতে বলছিল। খেলব না বলছি, তারপরেও জোর করছে। চড় মারার ফলে ভবিষ্যতে আর কখনো জোর খাটাতে আসবে না। একই সঙ্গে বুঝতে পারবে পৃথিবী জোর খাটানোর জায়গা নয়।

তোর মাথা খারাপ। তোর চিকিৎসা হওয়া দরকার।

আমি আবার খবরের কাগজ চোখের সামনে মেলে ধরলাম। মুনিয়া হিসহিস করতে করতে বলল, আমাকে কালো টিকটিকি কেন বললে, গায়ের রঙ কালো বলে?

হুঁ।

ফর্সা রঙ দেখে মাথা আউলা হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীকে এখন কালো লাগছে।

সারা পৃথিবীকে লাগছে না, তোকে লাগছে।

মুনিয়া দরজা ধরে কাঁদতে লাগল। আমি যা করেছি তা ঘোরতর অন্যায়। আমার কথায় মুনিয়া যে কাঁদছে, তাতে তাকে দোষ দেয়া যায় না। যে কেউই কাঁদবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার সামান্য হলেও অনুশোচনা এবং গ্লানি বোধ করা উচিত–তা করছি না। বরং ইচ্ছা করছে এ বাড়ির প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীকে কাঁদিয়ে দিতে।

মাকে খুঁজে বের করে তাঁর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঝগড়া করলে কেমন হয়। না, ঝগড়া না, এই জিনিস আমি পারি না। মাকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে আসা যায়। কিংবা দোতলায় উঠে বাবুকে বলে আসা যায়–বাবু শোন, তুই আসলে মহামূখ। কিছু জটিল ইকোয়েশন মুখস্থ করার বিদ্যা ছাড়া পরম কুরুণাময় ঈশ্বর তোকে আর কিছু দেননি। তোকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে ফিজিক্সের একটা শুকনো বই বানিয়ে।

আমি ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠলাম। যার সঙ্গেই প্রথম দেখা হবে, তাকে কিছু কথা। বার্তা বলব। বাবার সঙ্গে দেখা হলে বাবাকে।

দেখা হল র সঙ্গে। এই মহিলা বারান্দায় বসে আছেন। মতির মা চিরুনি দিয়ে তাঁর মাথার উকুন এনে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কাজটিতে দুজনই খুব আনন্দ পাচ্ছে। প্রাণীহত্যা আনন্দজনক কাজ তো বটেই। প্রাণী যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন তাকে। হত্যায় আনন্দ আছে। উকুন এবং মশা প্রাণী হিসেবে কাছাকাছি–দুজনই রক্ত খায়। তারপরেও উকুন মারার আনন্দ বেশি, কারণ এরা শব্দ করে মারা যায়। নখ দিয়ে এদের ফুটানো হয়।

মা বললেন, রঞ্জু, বৌমা কার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলছে?

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, সফিকের সঙ্গে।

যার তার সঙ্গে তার এত কি কথা?

আমি আবার হাই তুললাম, কোন লাইনে শাকে আক্রমন করা যায় ঠিক বুঝতে পারছি না। মার ধারণা, মানুষ হিসেবে তিনি প্রথম শ্রেণীর। দয়ামায়ায় তাঁর অন্তর পূর্ণ। নামাজ রোজা করছেন। প্রয়োজনের বেশি করছেন। শুক্রবারে ফকির এলে ভিক্ষা না নিয়ে বিদেয় হয় না। মার নির্দেশ, শুক্রবারে ভিক্ষা চাইলে ভিক্ষা দিতে হবে। তাঁর সঙ্গে একবার গাড়ি করে পল্লবীর দিকে যাচ্ছি। সোনারগা হোটেলের কাছে লাল লাইটে গাড়ি থামল। দুটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এল ফুল বিক্রি করতে। আমি গলার স্বর যথাসম্ভব কর্কশ করে বললাম, ভাগে।

মা অবাক হয়ে বললেন, ভাগে ভাগো বলছিস কেন? গরিব মানুষ না? শীতের সময় খালিগায়ে ফুল বিক্রি করছে আহা রে! তিনি ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে দুজনকে দুটা টাকা দিলেন। গরিবের দুঃখে কাতর এই মার অন্য একটি ছবিও আছে, সেই ছবিও সবার চেনা, কিন্তু সেই ছবি কারো চোখে পড়ে না। জাহেদা নামে আমাদের একটা কাজের মেয়ে ছিল। কোলের একটা বাচ্চা নিয়ে সে কাজ করতে এসেছিল। বাচ্চাটা বেশির ভাগ সময় কাঁদত। খিদের যন্ত্রণাতেই কাঁদত। জাহেদা মাঝে মাঝে চুরি করে দুধ নিয়ে বাচ্চাটাকে খাওয়াত। একদিন ধরা পড়ে গেল। মা রেগে আগুন। বিদায় হও। এক্ষুণি বিদায় হও। ঘরে চোর পুষছি। কি সর্বনাশের কথা! জাহেদা মার পা জড়িয়ে ধরল। দুগ্ধপোষ্য একটি শিশু নিয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ পাওয়া তার সহজ হবে না।

মার মন গলল না। তাঁর এক কথা–বাড়িতে আমি চোর রাখব না। আমাদের পরম করুণাময়ী মাতা চোর বিদায় করে দিলেন।

চোর বিদায়ের কথা তুলব, না অন্য কোনো প্রসঙ্গ তুলব বুঝতে পারছি না। চোর বিদায়ের প্রসঙ্গ তোলা ঠিক হবে না, কারণ এতদিন আগের কথা মার মনে নেই। তাঁর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ। নামতা পৰ্য্যন্ত মনে থাকে না। ঐ দিন কি একটা জিনিসের দাম ঠিক করতে গিয়ে নামতা গণ্ডগোল হয়ে গেল। আমাকে বললেন, সাত আট কত রে রঞ্জু? আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম বাহান্ন। মা বাহান্ন স্বীকার করেই চলে গেলেন। কাজেই চুরির প্রসঙ্গ থাক। অন্য কোনো প্রসঙ্গে আক্রমণ শুরু করা যাক।

মা বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঐ মোড়টায় বোস না।

আমি বসলাম। মা বললেন, তোর বাবা ঐ দিন বলছিলেন, রঞ্জুর যা স্বভাব, ও কোনো চাকরি-বাকরি করবে বলে তো মনে হয় না। ওকে একটা ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়। কি রে, করবি ব্যবসা? বিয়েটয়ে করেছিল, এখন রোজগারের কথা চিন্তা করবি না? তোর শ্বশুর তো বিরাট পয়সাওয়ালা লোক, ওঁকে বল তোকে কোন একটা ব্যবসা শুরু করিয়ে দিতে।

আমি গম্ভীর ভঙ্গিতে বললাম, শিগগিরই বলব।

কোনো একটা ব্যবসা-টবসা শুরু করলে মন ভাল থাকবে। দিন-রাত ইজিচেয়ার শুয়ে থাকা তো কাজের কথা না।

তা তো ঠিকই।

তোর বাবা বলছিলেন—বিনা কারণে একটা মানুষ দিন রাত শুয়ে থাকে কি ভাবে?

আমি শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, বিনা কারণে শুয়ে থাকিনা তো। শুয়ে শুয়ে ভাবি। কি ভাবিস?

একটা খুন করার কথা ভাবছি।

কি বলছিস তুই?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, সত্যি কথা বলছি মা।

কাকে খুন করবি?

সেটা এখনো ফাইনাল করিনি।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ