বাড়িওয়ালা চাচা নিজামউদ্দীন

ঝুমুর দরজা খুলে দেখে বাড়িওয়ালা চাচা নিজামউদ্দীন। আজো তার হাতে দু’টো পাকা পেঁপে। তার আগের বার দিয়ে যাওয়া পেঁপে দু’টোর একটা এখনো পড়ে আছে। ফেলে দেয়াই উচিত। মিষ্টি-টিষ্টি কিচ্ছু নেই–তিতকুট স্বাদ। এত বড় একটা পাকা পেঁপে ফেলতে মায়া লাগে বলে ফেলা হয় নি।

নিজামউদ্দীন হাসিমুখে বললেন, কেমন আছ গো মা?

ঝুমুর বলল, ভালো।

আপা আছে?

জ্বি না।

ফিরবে না?

আজ রাতে ফিরবে না।

ছবির শুটিং কি সারারাত ধরেই চলে?

সব সময় চলে না, মাঝে মাঝে চলে–যখন ছবির কাজ দ্রুত শেষ করতে হয় তখন সারারাত কাজ করতে হয়।

হতে পারে। ছবির লাইনের কাজকারবার তো জানি না। তোমার আপার সঙ্গে দরকার ছিল। যাই হোক মা আছে না?

আছে। উনার শরীর ভালো না–শুয়ে আছে।

আমার কথা একটু গিয়ে বল। দু’টা কথা বলে চলে যাব। নাও পেঁপে দু’টা নিয়ে যাও।

আপনি বসুন।

নিজামউদ্দীন বসতে বসতে বললেন, ঘরে পান থাকলে আমাকে একটু পান দিও তো মা। রাতে ভাত খেয়েই বের হয়েছি।–মুখ মিষ্টি হয়ে আছে।

ঘরে পান নেই, মা পান খায় না।

তাহলে থাক। কিছু লাগবে না।

শাহেদা চাদর গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এলেন। নিজামউদ্দীন মধুর গলায় বললেন, আপার শরীরটা নাকি খারাপ?

না তেমন কিছু না। সামান্য গা গরম।

সামান্য বলে অবহেলা করবেন না। আপনার আমার যা বয়স–এই বয়সে সামান্য বলে কোনো কিছুকেই অবহেলা করতে নেই। নিজের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যাই হোক আপ–মেয়ের সঙ্গে কি কথা বলেছিলেন? ঐ যে বাড়ির বিষয়ে–বাড়িটা যে আমার লাগে।

এখানো বলি নি।

একটু যে তাড়াতাড়ি করতে হয় আপা। মাস শেষ হতে তো বাকি নেই।

ভাই সাহেব। আমাদের তো সময় দিতে হবে। বললেই তো বাসা পাওয়া যায় না। দু’টা মেয়ে নিয়ে যেখানে সেখানেও তো উঠতে পারি না।

আমি নাচার! সামনের মাসের ১ তারিখ থেকে বাড়ি আমার লাগবেই।

শাহেদা কিছু বললেন না। নিঃশ্বাস ফেললেন। নিজামউদ্দীন বললেন, মানুষের সমস্যা মানুষ ছাড়া কে দেখবে? মানুষই দেখবে। আমি তো আপনাদের সমস্যা অনেকদিন দেখলাম। এখন আপনারা আমার সমস্যা একটু দেখুন।

শাহেদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমার কোন সমস্যা দেখেছেন? আমি তো বিনা ভাড়ায় আপনার বাড়িতে থাকি নি। যথানিয়মে ভাড়া দিয়েছি। ভাড়া দিতে কখনো কখনো দেরি হয়েছে কিন্তু দেয়া হয়েছে।

ভাড়ার কথা তো আপা আসছে না। আপনাদের বাড়ি দেয়ার জন্যে কতরকম সমালোচনা সহ্য করেছি। দশজনের দশ রকম কথা।

কী কথা?

বাদ দেন, সব কথা শুনতে নাই।

না না বলুন কী কথা শুনেছেন?

এই যে ধরুন মিতু ছবিতে কাজ করে। এইসব কাজের ধরন-ধারণ তো আলাদা। রাত-বিরাত পার করতে হয়। এমনও হয়েছে–দুদিন-তিনদিন মেয়ের খোঁজ নাই। যে কাজের যে দস্তুর। সাধারণ মানুষ তো এইসব বুঝে না। অকথা-কুকথা বলে।

শাহেদা কাঁপা গলায় বললেন, আমার মেয়েকে নিয়ে কুকথা বলে? আমার মেয়েকে নিয়ে–যে মেয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যে দিনরাত খেটে মরছে সেই মেয়েকে নিয়ে কুকথা বলে?

এই তো আপা আপনি মনটা খারাপ করলেন। মন খারাপ করার কিছু নাই। দুনিয়ার এই হলো হাল। মানুষের মুখ তো আপনি বন্ধ করতে পারবেন না। এই পৃথিবীতে সবচে’ খারাপ জায়গা হলো পায়খানা। মানুষের মুখ সেই পায়খানার চেয়েও খারাপ। পায়খানার দরজা বন্ধ করা যায়, তালা দেওয়া যায়–মানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না।

শাহেদা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আমি আপনার বাড়ি ছেড়ে দেব। এক তারিখের আগেই ছাড়ব। আমার মেয়ের কারণে আপনাকে কথা শুনতে হচ্ছে এটা যদি আগে জানাতেন আগেই ছেড়ে দিতাম।

নিজামউদ্দীন খুশি খুশি গলায় বললেন, তুচ্ছ ব্যাপার আপনার কানে তুলব কেন? আমার একটা বিবেচনা আছে না। আমার তো চোখ আছে। আমি দেখছি না–একটা বাচ্চা মেয়ে সংসার টানছে? বড় ভাই মানুষ খুন করে জেলে বসে আছে। লোকে কী বলে না বলে সেটা শুনলে দুনিয়া চলত না। শোনেন একটা ঘটনা বলি। ঘটনাটা না শুনলে বুঝতে পারবেন না।

থাক ঘটনা শুনতে হবে না।

আপা শোনেন। শোনার দরকার আছে–গত জুম্মাবারে জুম্মা পড়ে বাসায় ফিরছি। ইসলাম সাহেব পথে আমাকে ধরলেন। ইসলাম সাহেব আমার ভাড়াটে-অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার। আমাকে বললেন…

আমার শরীরটা ভালো না। কিছু শুনতে ভালো লাগছে না।

থাক তাহলে। মানুষের কানকথা যত কম শোনা যায় ততই ভালো, শুনলেই বিপদ। আপা তাহলে উঠি?

জ্বি আচ্ছা।

তাহলে এই কথা রইল— মাসের এক তারিখ ইনশাল্লাহ্ ঘর খালি করে দিচ্ছেন।

বললাম তো দিব।

আলহামদুলিল্লাহ। সত্যি কথা বলতে কি আপা একশ একটা পাপ করার পর লোকে ভাড়াটে হয়। টু লেট সাইন ঝুলালে ভাড়াটে পাবেন না। যখন ভাড়াটে তুলতে যাবেন এরা উঠবে না। যেন তাদের বাপের বাড়ি…

শাহেদা বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন, রাতের রান্না কিছু হয় নি। ঝুমুরকে বলেছেন একার জন্যে চারটা চাল ফুটিয়ে ডিম ভেজে খেযে নিতে। ঝুমুর এখনো চুলা ধরায় নি। শাহেদা ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, ঝুমুর।

ঝুমুর দরজা ধরে দাঁড়াল।

তোর নিজের জন্যে দু’টা ভাত রেঁধে ফেল, আমি খাব না।

আমিও খাব না।

রাতে না খেয়ে থাকবি?

হুঁ।

করা যা ইচ্ছা। তোর আপা কি বলেছে–রাতে ফিরবে না?

না, সারারাত শুটিং চলবে। তোমার কি মাথায় যন্ত্রণা?

হুঁ।

মাথা টিপে দেব?

কিছু করতে হবে না। তুই ঘরের বাতি নিভিয়ে চলে যা।

মশারি খাটিয়ে দেব? মশা আছে তো।

যেতে বললাম না!

ঝুমুর মা’র ঘর থেকে চলে এলো। তার টেস্ট পরীক্ষা শুরু হচ্ছে ন’তারিখ থেকে। বই নিয়ে বসতে ইচ্ছা করছে না। এমনিতে সে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পারে কিন্তু বই নিয়ে বসলেই শুধু হাই ওঠে।

ঝুমুর খাটের উপর পা তুলে বসল। বই নিয়ে বসবে কি বসবে না ঠিক করতে পারল না। কারো সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে— গল্প করার মানুষ নেই। কথা শুনতে ভালবাসে এমন কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে সে বেঁচে যায়। সমস্ত পুরুষদেরকে ঝুমুর তিন ভাগে ভাগ করেছে–

এক, এরা কথা শুনতে ভালোবাসে। স্বামী হিসেবে এরা আদর্শ।

দুই, এরা কথা বলতে ভালোবাসে। স্বামী হিসেবে এরা মোটামুটি।

তিন, এরা কথা শুনতেও ভালবাসে না, বলতেও ভালোবাসে না। স্বামী হিসেবে এরা ভয়াবহ।

মবিন ভাই কোন শ্রেণীর ঐ প্রথম শ্রেণীর? পুরোপুরি না। তিনি কথা শোনার চেয়ে বলতে বেশি পছন্দ করেন। স্বামী হিসেবে মবিন ভাইকে আদর্শ বলা যাবে না। উনার বেশি বুদ্ধি। স্বামীদের কম বুদ্ধি থাকা ভালো। বেশি বুদ্ধির মানুষরা নানান ধরনের চালাকি করে।

ঝুমুর।

জ্বি।

এক গ্ৰাস পানি দিয়ে যা।

ঝুমুর উঠে গিয়ে পানির গ্লাস ভর্তি করে পানি নিয়ে গেল। বাতি জ্বালাল।

শাহেদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, বাতি নেভা। বাতি জ্বেলেছিস কেন?

অন্ধকারে পানি খাবে কীভাবে?

ঝুমুর লক্ষ করল পানির গ্লাস হাতে নিতে গিয়ে শাহেদার হাত কাঁপতে লাগল। ঝুমুর বলল, মা তোমার কি জ্বর বেড়েছে?

জানি না। বাতি নিভিয়ে চলে যা।

তুমি আমার সঙ্গে অকারণে এত রাগারগি করছ কেন? বাড়িওয়ালা চাচার কথা শুনে তুমি রেগেছ–সেই রাগ ঝাড়ছ আমার উপর। মানুষ কত কথা বলবে–তাই শুনে রেগে যেতে হবে?

কুৎসিত কথা শুনব তার পরেও রাগিব না?

কুৎসিত কথা তো আমি সারাক্ষণই শুনি–আমি কি রাগ করি? রাগ করি না। আমি থাকি আমার মতো।

তুই সারাক্ষণ কুৎসিত কথা শুনিস?

হ্যাঁ।

কে বলে?

স্কুলের মেয়েরা বলে। সেদিন জিওগ্রাফি আপা আমাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন…

কী জিজ্ঞেস করলেন?

হেনতেন নানান কথা, সংসার চলে কী করে? বড় বোন কী করে। এইসব জাবিজাবি।

কই আমাকে তো কোনোদিন কিছু বলিস নি।

তোমাকে শুধু শুধু বলব কেন? তাছাড়া আমি একজনের কথা আরেকজনকে বলি না।

ঝুমুর, তুই আমার কাছে এসে বোস।

কেন?

বসতে বলছি বোস।

তুমি এমনভাবে বলছি যে মনে হচ্ছে তুমি আমাকে মারবে।

মারব না, কাছে আয়। বোস এখানে–তোর আপার সঙ্গে তুই তো গুটিগুটি করে অনেক কথা বলিস। সে কি কখনো তোকে গোপন কিছু বলেছে?

না। আপার স্বভাব হলো চুপচাপ থাকা। বকবক যা করার আমিই করি। আপা শুধু শুনে যায়। আপা পুরুষ মানুষ হলে খুব ভালো স্বামী হত।

শাহেদা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। ঝুমুর বিরক্ত গলায় বলল, তুমি এভাবে তাকিয়ো না–তোমাকে আমাদের জিওগ্রাফি আপার মতো লাগছে।

শাহেদা চাপা গলায় বললেন, তোর আপার সঙ্গে রাতে যখন ঘুমাস সে কিছুই বলে না?

ঘুমের মধ্যে কথা বলবে কীভাবে! আপা ক্লান্ত হয়ে থাকে, মরার মতো ঘুমায়। মাঝে মাঝে…

মাঝে মাঝে কী?

মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে। দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদে।

তুই তখন কী করিস?

কিছুই করি না। ভান করি যেন মরার মতো ঘুমুচ্ছি।

ও কেন কাঁদে।

আমি কী করে জানিব কেন কাঁদে? সে যেমন রাতে মাঝে মাঝে কাদে, তুমিও কাঁদ। তুমি কেন কাঁদ সেটা যেমন আমি জানি না, আপা কেন কাঁদে সেটাও জানি না–জানতে ইচ্ছাও করে না।

শাহেদ ক্লান্ত গলায় বললেন, সেই ইচ্ছা করবে কেন? সংসারের কোনো কিছু নিয়ে তো তোকে ভাবতে হচ্ছে না। দিব্যি খাচ্ছিস, ঘুমুচ্ছিস–গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরছিস।

তুমি আমার উপর শুধু শুধু রাগ করছ। রাগ করার মতো যখন কিছু করব তখন রাগ কোরো। তোমাকে বেশি দিন অপেক্ষাও করতে হবে না। রাগ করার মতো কিছু খুব শিগগিরই করব।

সেটা কী?

টেস্ট পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে গোল্লা খাব।

শাহেদা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। ঝুমুর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, মা তোমাকে একটা কথা বলি মন দিয়ে শোন–আপা কী করে সংসার চালাচ্ছে সেটা তুমি খুব ভালো করেই জান। তুমি ভান করছ, তুমি কিছু জান না। আমিও ভান করছি আমি কিছু জানি না। এটা কি মা ঠিক হচ্ছে?

শাহেদা তাকিয়ে আছেন। পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছেন। তার হাত-পা থারথার করে কঁপিছে। ঝুমুর উঠে দাঁড়াল। শান্ত ভঙ্গিতে ঘরের বাতি নিভিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। সেখান থেকে চলে গেল বারান্দায়। বারান্দায় দেয়াল ঘেসে মোড়া পাতা। দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝুমুর বসেছে।

বাইরে সুন্দর জোছনা। খানিকটা জোছনা বারান্দায় এসে পড়েছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জোছনা নেমেছে। বারান্দায় সুন্দর পাতার নকশা। বাতাসে পাতা কাঁপছে–জোছনার নকশাও কাঁপছে। ঝুমুর সেই অপূর্ব নকশার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে।

ভেতর থেকে শাহেদা ডাকলেন, ঝুমুর, ঝুমুর।

ঝুমুর জবাব দিল না। সে চোখের পানি মুছে খালি চেয়ারটা নিজের পাশে টেনে আনল। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে –খালি চেয়ারে তার স্বামী বসে আছে। সে তাঁর পায়ের কাছাকাছি বসেছে। ঝুমুর বলল, ঘুমাবে না?

সে বলল, না।

ঘুমাবে না কেন? রাত তিনটা বাজে।

তুমি বডড বিরক্ত কর ঝুমুর। দেখছ না জোছনা দেখছি।

তুমি কি কবি যে তোমাকে হাঁ করে জোছনা দেখতে হবে?

হ্যাঁ আমি কবি।

কবিরা জোছনা দেখে না। তারা তাদের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কে বলেছে তোমাকে?

আমি জানি। এখন তুমি আমার দিকে তাকাও।

উফ! তুমি কী যে বিরক্ত কর!

আমার দিকে না তাকালে আমি আরো বিরক্ত করব।

সে ঝুমুরের দিকে তাকাল। তাকিয়েই হেসে ফেলল। এত সুন্দর করে সে হাসল যে হাসি দেখে ঝুমুরের চোখে পানি এসে গেল।

ভেতর থেকে শাহেদা আবারো ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, ঝুমুর।

ঝুমুর কঠিন স্বরে বলল, ডাকাডাকি করবে না মা, আমি আসব না।

না, ঝুমুর যাবে না। সে বারান্দায় বসে থাকবে–সারারাত বসে থাকবে। পাশে বসে থাকা মানুষটার সঙ্গে কথা বলবে। ওকে একা রেখে সে যেতে পারবে না। পাশে বসা মানুষটা বলল, পানি খাব ঝুমুর।

ঝুমুর বলল, না তুমি পানি খাবে না। পানি খাবার কথা বলে তুমি আমাকে ভেতরে পাঠাতে চাচ্ছ। ভেতরে গেলেই মা’র কাছে যেতে হবে। মা’র কাছে গেলে আমি আর আসতে পারব না। তোমার সঙ্গে গল্প করাও হবে না।

মা’কে তুমি ভালোবাস না?

না, আমি কাউকেই ভালোবাসি না।

আমার ধারণা তুমি রাগ করে এ রকম কথা বলছি–আসলে তুমি সবাইকে ভালোবাস।

তোমার ধারণা নিয়ে তুমি বসে থাক।

কী ব্যাপার, তুমি দেখি আমার উপরও রাগ করছ।

আমি সবার উপরই রাগ করছি।

কিছুক্ষণের জন্যে কি রাগ বন্ধ করা যায়?

যায়।

বেশ, রাগটা খানিকক্ষণের জন্যে ধামাচাপা দাও। ধামাচাপা দিয়ে আমার হাত ধরে বস। গল্প কর।

কী গল্প?

যে-কোনো গল্প। তোমার বাবার গল্প বল।

বাবার কোনো গল্প নেই। ভালোমানুষ ছিলেন–হঠাৎ একদিন মরে গেলেন। ব্যাস।

তোমাদের ভালোবাসতেন না?

বাসতেন?

খুব ভালোবাসতেন, না মোটামুটি?

ভাইয়াকে খুব ভালোবাসতেন। ভাইয়াকে ডাকতেন ভোম্বল সিং। ছোটবেলায় গোব্দা গোদা ছিল তো–ভোম্বল সিং নাম দিয়েছিলেন–বড় হয়েও সেই নাম। ভাইয়া কত রাগ করেছে, কান্নাকাটি করেছে, লাভ হয় নি। বাবা ভোম্বল সিং ডাকবেই।

তোমার ভাইয়া বাবাকে কেমন ভালোবাসত?

ভাইয়া ভালোবাসত টাসত না, বাবাকে এড়িয়ে চলত। বাবার খুব চিড়িয়াখানা দেখার শখ। আমরা ঢাকায় থাকতাম, উনি থাকতেন সিলেটের জঙ্গলে।। যতবার ঢাকায় আসতেন ঘ্যান ঘ্যান করতেন–ভোম্বল সিং, চল যাই চিড়িয়াখানা দেখে আসি। ভাইয়া যাবে না। কত সাধাসাদি। শেষটায় মন খারাপ করে আমাকে নিয়ে যেতেন। বাবা ঢাকা এসেছেন অথচ চিড়িয়াখানায় যান নি–এরকম কখনো হয় নি। বাবা কীভাবে মারা গোল সেটা শুনবেন?

বল।

গরমের সময় হঠাৎ ছুটি নিয়ে ঢাকা চলে এলেন। মা’কে বললেন, একা একা থাকতে অসহ্য লাগে। তোমরা এক জায়গায়-আমি অন্য জায়গায়। উপায়ও নেই, জঙ্গলের মধ্যে তোমাদের আমি কোথায় রাখব? বাচ্চাদের পড়াশোনা। মন মানে না বলে ছুটি নিয়ে চলে আসি। ভাবছি টাকা-পয়সা প্রভিডেন্ট ফান্ডে যা আছে তাই নিয়ে ব্যবসা করব। মা বলল, তাই কর। চাকরি যথেষ্ট হয়েছে।

এই বয়সে সিরিয়াস ব্যবসা তো পারব না। টাকা-পয়সা যা আছে তা দিয়ে একটা ফার্মেসি দেব। তার আয়ে সংসার চলবে। কেমন হবে বল তো?

ভালোই হবে।

ছেলেমেয়ের জন্যেই তো সংসার। সেই ছেলেমেয়েই যদি চোখের সামনে না থাকল তাহলে সংসার করে লাভ কী?

ঠিকই বলেছ।

এবার ফিরে গিয়েই চাকরি ছাড়ার ব্যবস্থা করব। যথেষ্ট হয়েছে। আর সহ্য হচ্ছে না।

চাকরি ছেড়ে দেবেন। এই সিদ্ধান্ত নেবার পর বাবা খুব খুশি। সবাইকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাবেন। মা-ও যাচ্ছেন। শুধু ভাইয়া যাবে না। জন্তু-জানোয়ার তার নাকি ভালো লাগে না। বাবা কত অনুরোধ করলেন। লাভ হলো না। শেষে মন খারাপ করে বাবা আমাদের নিয়েই গেলেন। বাঁদর দেখলেন, ময়ুর দেখলেন, হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পায়ে ব্যথা–বাবা নির্বিকার। বিকেলে চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে এসে বাবা বললেন, শাহেদা আমার শরীরটা যেন কেমন করছে।

মা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কেমন করছে মানে কী?

বুঝতে পারছি না। কী রকম যেন লাগছে–ভোম্বল সিং কোথায়?

ও গেছে বন্ধুদের বাসায়। ডাক্তার ডাকতে হবে?

বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেল কিনা, সব কেমন যেন অন্ধকার লাগছে। ধোঁয়া ধোঁয়া।

এইসব কী বলছ?

ভোম্বল সিং কোথায়? ভোম্বল?

আপা ছুটে গেল। ডাক্তার ডাকতে। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম, মা কাঁদতে লাগল। বাবা শুধু একটু পর পর বলতে লাগল–ভোম্বল কোথায়? ভোম্বল সিং?

ঠিক দু’ঘণ্টার ভেতর বাবা মারা গেলেন। আমরা হাসপাতালে নেবারও সময় পেলাম না। ভাইয়া বাসায় ফিরাল সন্ধ্যার পর। বাসায় তখন অনেক লোকজন। ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, ব্যাপার কী? কী হয়েছে?

তারপর?

তারপর আবার কী? কিছু না।

তোমার ভাইয়া বাবার মৃত্যু কীভাবে গ্রহণ করল?

জানি না। কীভাবে গ্রহণ করল। সে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ফিরে এল তিনদিন পর। বাবার এর মধ্যে কবর হয়ে গেছে। ঘরে লোকজনের ভিড় নেই। মা’র হার্টের অসুখের মতো হয়েছে–বিছানায় শোয়া। ডাক্তার তাঁকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। ঘুমের ওষুধ খায়–ঘুমুতে পারে না–ঝিম মেরে পড়ে থাকে।

ভাইয়া ফিরে এসে সংসারে হাল ধরল। তার তখন কত বয়স? বি এ ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। চাকরি বাকরির অনেক চেষ্টা করল, পেল না। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড দিয়ে ব্যবসার চেষ্টা করল। হেন ব্যবসা নেই যা সে করে নি। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পরিশ্রম। মানুষ যে কী অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারে আপনি ভাইয়াকে সেই সময় না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, এক সময় খবর পেল এফডিসিতে মালামাল সাপ্লাইয়ের ভালো ব্যবসা আছে। ইনভেস্টমেন্ট কম, লাভ বেশি। শুরু করল সেই ব্যবসা।

লাভ হলো?

মোটামুটি হলো। ভাইয়ার ভাগ্য ছিল খারাপ। খারাপ ভাগ্যের মানুষ তো খুব ভালো কিছু করতে পারে না।

উনি মানুষ খুন করলেন কেন?

সেটা আমি আপনাকে বলব না। সব কথা বলতে নেই। কিছু কিছু কথা না বলাই ভালো। হয়েছে কী জানেন? ভাইয়া তো গভীর রাতে ফেরে, সেদিন হঠাৎ দুপুরে এসে হাজির। আমাকে বলল, খুকি চিড়িয়াখানায় যাবি? ভাইয়া আমাকে ঝুমুর ডাকত না, ডাকত খুকি। ভাইয়া আমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতে চায় শুনে আমি অবাক হলাম না। কারণ আমি জানতাম বাবার মৃত্যুর পর ভাইয়া প্রায়ই চিড়িয়াখানায় যায়। বানরের খাচার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি বললাম, হ্যাঁ ভাইয়া যাব। আমি কাপড় পরে তৈরি হয়েছি। ভাইয়া বলল–না থাক। তখন আমরা মগবাজারের একটা বাসায় থাকতাম। ছোট একতলা বাসার একদিকে আমরা অন্যদিকে হাফিজ সাহেব বলে এক ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী, দুই ছেলে। সেদিন ভাইয়া সেই যে দুপুরে এসেছে আর বেরুচ্ছে না। সন্ধ্যাবেলায় মা বললেন–কী-রে তোর কি শরীরটা খারাপ?

ভাইয়া বলল, হঁ।

জ্বর-টর নাকি রে দেখি কাছে আয় তো।

ভাইয়া বলল, দেখতে হবে না। জ্বর টর কিছু হয় নি। রাতে ভাইয়া ভাত খেল না। ন’টার সময় ঘুমিয়ে পড়ল। সে বাইরের ঘরে ঘুমাল। আমি গিয়ে দেখি মশা ভিনভন করছে–এর মধ্যেই ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। আমি মশারি খাটিয়ে দিলাম। ভাইয়া রাত বারটার দিকে জেগে উঠল। নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের কেতলি বসাল। খটখট শব্দ শুনে মা জেগেছে। রান্নাঘরে ঢুকে অবাক হয়ে বলল, তুই এখানে কী করছিস, ভাইয়া হাসিমুখে বলল, চা বানাচ্ছি। তুমি খাবে মা? মা বলল, না। ভাইয়া বলল, খাও না। দেখ আমি কী সুন্দর চা বানাই! ভাইয়া চা বানোল। মা’কে নিয়ে দু’জনে মিলে চা খেল। তার কিছুক্ষণ পর দরজার কলিংবেল বাজতে লাগল। মা বললেন, কে? পাশের ঘরের হাফিজ সাহেব বললেন, খালাম্মা দরজা খুলুন। পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।

মা হতভম্ব হয়ে দরজা খুললেন। আমি তখন জেগেছি, আপা জেগেছে। আমরা বুঝতেই পারছি না। কী হচ্ছে। আমরা দেখলাম, অনেকগুলো পুলিশ বাড়িতে ঢুকাল। ওরা বিছানা, বালিশ, খাট, মিটসেফ ওলট-পালট করতে লাগল। আপা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ভাইয়া কী ব্যাপার? ভাইয়া জবাব দিল না। একজন পুলিশ অফিসার বললেন, ভয়ের কিছু নেই। রুটিন চেক। আমরা এক্ষুণি চলে যাব।

তারা কিছুক্ষণের মধ্যে চলে গেল, তবে যাবার সময় ভাইয়াকে নিয়ে গেল। আপা বললেন, ভাইয়াকে কোথায় নিচ্ছেন? পুলিশ অফিসার বললেন, থানায় দুএকটা প্রশ্নট্ৰিশ্ন জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দেব। আজ রাতেই ছেড়ে দেব। ভয়ের কিছু নেই।

পুলিশ ভাইয়াকে ছাড়ল না। এই যে ভাইয়া গেল আর বাসায় ফিরল না। পরদিন ভোরবেলা আপা আমাকে নিয়ে থানায় গেছে। ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হলো হাজতে। ভাইয়া আপার দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই। বাসায় চলে যা। আমি একটা খুন করেছি। পুলিশের কাছে স্বীকার করেছি।

ঝুমুর।

ঝুমুর পেছন ফিরল। শাহেদা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখে বিস্ময় ও ভয়। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস?

ঝুমুর বলল, কারো সঙ্গে না। নিজের মনে কথা বলছি।

আয় ঘুমুতে আয়।

ঝুমুর বলল, আমি আরো কিছুক্ষণ বসে থাকব।

দুপুররাতে একা একা বারান্দায় বসে থাকবি এটা কেমন কথা? আমার বসে থাকতে ভালো লাগছে মা। আয় লক্ষ্মীসোনা, ঘরে আয়। শাহেদা বারান্দায় এসে ঝুমুরের হাত ধরলেন। ঝুমুর আপত্তি করল না, উঠে এলো। শাহেদা বললেন, রাতে তো কিছু খাস নি। খিদে হয়েছে, কিছু খাবি? একটা পরোটা ভেজে দেব?

দাও, তোমার শরীরটা এখন ভালো লাগছে মা?

শাহেদা জবাব দিলেন না। রান্নাঘরে ঢুকলেন। পরোটা বানানো গেল না। ময়দা শেষ হয়ে গেছে। তিনি ভুলে গেছেন। ময়দার কথা মিতুকে বলা হয়েছে–ভোরবেলা সে নিয়ে আসবে।

শাহেদা বললেন, চারটা চাল ফুটিয়ে দিই?

ঝুমুর বলল, কোনো কিছু ফুটিয়ে দিতে হবে না। তুমি ব্যস্ত হয়ে না। এক গ্লাস শরবত খেতে পারি। ঘরে কি চিনি আছে মা?

শাহেদা দেখলেন চিনির কোটাও খালি। ঝুমুর বলল, একেকটা দিন খুব অদ্ভুত হয়। কিছু পাওয়া যায় না। আবার কোনো কোনো দিন আছে–সব পাওয়া যায়। সেদিন তুমি যা চাইবে তাই পাবে।

শাহেদা শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমুর। মেয়েটাকে আজ অনেক বড় বড় লাগছে। ঝুমুর বলল, মা শোন, আপার একটা কথা তোমাকে বলি–আপাকে নিয়ে মাঝে মাঝে তুমি দুশ্চিন্তা কর। আজেবাজে কথা ভাব। এইসব ভাবার কোনো কারণ নেই। আপা মরে যাবে তবুও অন্যায় কিছু করবে না।

শাহেদার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝুমুর বলল, সিনেমার কাজ, শুটিঙের কাজ–রাত দিন বাইরে থাকতে হয় বলে লোকজন আজেবাজে কথা বলে। ওদের আজেবাজে কথা বলার কোনো কারণ নেই।

শাহেদা কাপা গলায় বললেন, সেইটাই তো আমি বলি মা। আমার নিজের মেয়ে আমি তাকে জানি না?

লোকজনের আজেবাজে কথা বলার কোনো অধিকারও নেই। আপা কি সামান্য চাকরির জন্যে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে যায় নি? কেউ কি দিয়েছে তাকে কিছু জোগাড় করে? আজি কোন বড় বড় কথা বলে?

শাহেদার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখ মুছলেন। চোখ মুছতে মুছতে বললেন–তুই যে বললি ও রাতে ঘুম থেকে উঠে কাঁদে। কাঁদে কেন?

মনের দুঃখে কাঁদে। আমার মনে হয় বেশিরভাগ সময় মবিন ভাইয়ের জন্যে কাঁদে। প্রায়ই তো মবিন ভাইয়ের টিউশ্যানি চলে যায়। বেচারার প্রায় না খেয়ে থাকার মতো জোগাড় হয়। একবার কী হয়েছে জান মা? প্ৰায় দশদিন মবিন ভাই ভাত খায় নি। যে হোটেলে বাকিতে খেত তারা খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে…

থাক এসব শুনতে চাচ্ছি না।

শোন না মা—মবিন ভাই বাধ্য হয়ে চিড়া আর গুড় কিনে আনল। চিড়া পানিতে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে খায়। আপা জানতে পেরে হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে এসে খুব কাঁদছিল।

শাহেদা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ঝুমুর এসে মায়ের পাশে বসল। কোমল গলায় বলল, তুমি মবিন ভাইয়ের সঙ্গে আপার বিয়ে দাও মা। ওরা কয়েকটা দিন আনন্দ করুক।

ও বউকে খাওয়াবে কী?

চিড়া আর গুড় খাওয়াবে। তাতে কী মা? ওরা দু’জন যখন বারান্দায় বসে গল্প করবে তখন দেখো তোমার কত ভালো লাগবে।

শাহেদা দেখলেন ঝুমুরের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ