প্ৰেম দেওয়ানার ডাবিং

আজমল তরফদারের ছবি ‘প্ৰেম দেওয়ানা’র ডাবিং শুরু হয়েছে। ডাবিং স্টুডিওতে জমজমাট অবস্থা। ন’টা থেকে শিফট শুরু হলেও স্টার সুপারস্টাররা দশটা-এগারটার দিকে আসেন। যিনি যত বড়ো স্টার তিনি আসবেন তত দেরিতে। গ্যালাক্সি স্টার ফরহাদের সেই হিসেবে বারটার দিকে আসার কথা। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় তিনি সকাল ন’টার সময় চলে এসেছেন। তাঁর মুডও আজ খুব ভালো। গাড়ি থেকে নেমেই চেঁচিয়ে বললেন, আজমল ভাই জস্পেশ করে চা বানান দেখি। আপনার ব্যাটেলিয়ান রেডি?

হ্যাঁ রেডি।

দেখবেন ইনশাল্লাহু চল্লিশ লুপ এক শিফটে নামিয়ে দেব। ম্যাডাম এসেছেন?

এখনো আসেন নি।

ডায়ালগ দিতে বলুন। বসে বসে মুখস্থ করতে থাকি। চা তো এখনো দিল না।

ফরহাদ সাহেব ডাবিং রুমে ঢুকে গেলেন।

আজমল তরফদারের সঙ্গে বিমল দাঁড়িয়ে আছে। সে এসেছে বিশেষ কারণে, রেশমাকে বড় সাহেবের অফিসে নিয়ে যেতে হবে। বড় সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। রেশমা’র আজ ডাবিং আছে। সে ন’টার আগেই এসে পড়ে। আজই শুধু দেরি হচ্ছে।

বিমল ফরহাদকে দেখিয়ে নিচু গলায় বলল, উনি কি আপনার ছবির হিরো?

হুঁ। যা তা হিরো না গ্যালাক্সি হিট হিরো।

আমাদের ছবিতে কি উনি থাকছেন?

হুঁ। না থাকলেই ভালো হত।

কেন?

গাধা। অভনয় জানে না।

তাহলে তাকে নিচ্ছেন কেন?

রিকশাওয়ালারা তাকে দেখতে চায়।

তাকে কি নতুন ছবির কথা বলা হয়েছে?

এখনো বলা হয় নি, তবে সে জেনে গেছে যে আমরা বড় বাজেটে নামছি। ছবি পাড়ায় খবর হয়ে গেছে। আজ যে ন’টার সময় উপস্থিত–এই কারণেই উপস্থিত।

আপনাকে খাতির করা শুরু করেছে?

হুঁ।

লুপ লাগানো হয়েছে। খণ্ড খণ্ড দৃশ্য বড় পদায় দেখানো হচ্ছে। ছবি দেখে দেখে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ডায়ালগ বলবেন, ম্যাগনেটিক ফিতায় সেই শব্দ ধরা হবে। পরে একসঙ্গে জোড়া লাগানো হবে।

বিমল বলল, ব্যাপারটা তো খুব ইন্টারেস্টিং।

কাগজে-কলমে খুব ইন্টারেস্টিং। তবে কাজ শুরু হলে দেখবে কত ঝামেলা। ঠোঁট মেলানো যায় না। ডায়ালগ যায় একদিকে ঠোঁট নড়ে অন্যদিকে।

কাজ শুরু হবে কখন?

ম্যাডাম এলেই শুরু হবে।

 

ফরহাদ সাহেব চায়ের কাপ এবং হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আজমল তরফদারের কাছে চলে এলেন।

কাজ শুরু হবে। কখন আজমল ভাই?

এই তো অল্প কিছুক্ষণ।

আপনার সঙ্গে বসে গল্পগুজব করি? নতুন বই নাকি করছেন? বিগ বাজেট মুভি।

হ্যাঁ।

স্টোরি লেখা হয়েছে?

হচ্ছে।

নায়ক-নায়িকা কয় পেয়ার? ওয়ান ওর টু?

এখনো কিছুই ঠিক হয় নি।

আর্টিস্টের ব্যাপারে কিছু ভাবছেন?

এখনো ভাবি নি।

আমার অবশ্য দম ফেলার সময় নেই। হেভি বুকিং। তারপরেও আপনার ব্যাপার অন্য।

থ্যাংক য়্যু।

আপনার ‘প্ৰেম দেওয়ানা’ও হিট করবে। ডায়ালগ মারাত্মক। হিট ডায়ালগ। ডায়ালগের জন্যে উঠে যাবে….

কথাবার্তার এই পর্যায়ে ডাবিং স্টুডিওর দরজা ফাঁক করে রেশমা তাকাল। আজমল তরফদার ফরহাদ সাহেবের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন, রেশমা এস এস।

রেশমা পুরোপুরি হকচাকিয়ে গেল। আজমল তরফদার এরকম অন্তরিক ভঙ্গিতে ডাকবেন ভাবাই যায় না। সে দেরি করে এসেছে বলেই কি রসিকতা করছেন? এখনই কুৎসিত গালি শুরু হবে? হলভর্তি মানুষের সামনে গালি শুনতে এত খারাপ লাগে। তার হাত-পা জমে যাবার মতো হলো।

দাঁড়িয়ে আছ কেন, আস? পরিচয় করিয়ে দিই— এ হলো বিমল। বিমলচন্দ্র হাওলাদার। বিমল এর নাম রেশমা।

বিমল তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছে। বিনীতভাবে সে সালাম দিল। ফরহাদ পর্যন্ত অবাক হয়ে তাকাচ্ছে।

রেশমা ইতস্তত করে বলল, বাসের চাকা পাংচার হয়ে গিয়েছিল। ঠিক করল। এই জন্যে দেরি হয়েছে।

আজমল তরফদার বললেন, নো প্রবলেম। এগারটার আগে ডাবিং শুরু হবে না। তোমার বোধহয় দু’টা লুপ। এক সময় করে ফেললেই হবে। বিমল তোমাকে নিতে এসেছে। ওর সঙ্গে একটু যাও।

কোথায় যেতে হবে, কী ব্যাপার। এইসব কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। রেশমা’র মনে হলো সে পালিয়ে যেতে পারলে বাচে।

আজমল তরফদার বললেন, রেশমা তুমি কি চা খেয়ে যেতে চাও r চা হয়ে গেছে। এক কাপ চা খেয়ে যাও।

ডাইরেক্টর সাহেবের জন্যে আলাদা সুন্দর কাপে চা আসে। আজমল তরফদার নিজেই তার চায়ের কাপ এগিয়ে ধরলেন।

রেশমা ক্ষীণ গলায় বলল, চা খাব না।

আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি ফিরে এসে চা খেয়ো, এখন বরং বিমলের সঙ্গে চলে যাও।

ডাবিং স্টুডিওর সামনে কালো রঙের বিরাট একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির জানালার কাচে পর্দা দেয়া। বিমল এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আশপাশের লোকজন কৌতুহলী চোখে তাকে দেখছে। তারচেয়েও বড় কথা আজমল তরফদার তাকে গাড়িতে তুলে দিতে এসেছেন।

 

মোবারক সাহেবের চোখে রিডিং গ্লাস। অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি চশমা। এই চশমার অসুবিধা এই যে, যার দিকে তাকানো হয়। সে চোখ দেখতে পায়। তিনি কাউকে তার চোখ দেখাতে চান না। তাঁর ধারণা শরীরের যেমন পোশাকের প্রয়োজন, চোখের তেমন পোশাক দরকার। নগ্ন চোখ নগ্ন শরীরের মতো।

মোবারক সাহেব বললেন, বোস, দাঁড়িয়ে আছ কেন?

রেশমা বসল। জড়োসড়ো হয়ে বসল। মেয়েটিকে তিনি আগে একবারই দেখেছেন। সে দেখা রাতের দেখা। দিনে কখনো দেখেন নি। এখন ঝকঝকে দিন। ঘড়িতে বাজছে বারটা একুশ। রাতের দেখা মানুষ দিনের আলোয় সম্পূর্ণ অন্য রকম হয়ে যায়। এই মেয়েটার ক্ষেত্রে সে রকম ঘটে। কিনা তাঁর জানার ইচ্ছা।

মেয়েটি সাজগোজ করে নি। ঐ রাতে বেশ সেজেছিল। কপালে টিপ ছিল। ঠোঁটে লিপস্টিক ছিল। আজ কপাল শূন্য, ঠোঁটেও লিপষ্টিক নেই। মেয়েটি কোলের উপর হাত রেখে বসেছে বলে তিনি তার হাত দেখতে পাচ্ছেন না। ঐ রাতে মেয়েটির হাতে সবুজ রঙের কাচের চুড়ি ছিল। আজ বোধ হয় চুড়ি পরে নি। চুড়ি পরলে চুড়ির টুংটং আওয়াজ কানে আসত।

তোমার নাম টেপী তাই তো?

রেশমা জবাব দিল না। চুপ করে বসে রইল। মোবারক সাহেব চোখ থেকে রিডিং গ্রাস পুরোপুরি খুলে ফেললেন। তাঁর যে শুধু কাছে দেখার সমস্যা তাই না—মায়োপিয়া আছে বলে দূরের জিনিসও ভালো দেখতে পান না। মেয়েটিকে ভালোমতো দেখার জন্যে অন্য একটা চশমা দরকার। তিনি ড্রয়ার খুললেন। চশমা বের করে পরলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকলেন।

ঐ দিন তুমি মিথ্যা করে কেন বললে তোমার নাম টেপী, বোনের নাম হ্যাপী? মিথ্যা বলার প্রয়োজন ছিল কি?

ছিল।

আসল নাম, পরিচয় কাউকে জানতে দিতে চাও না, এই তো ব্যাপার?

জ্বি।

যে তোমার সত্যিকার পরিচয় বের করতে চায় তার জন্যে তো খুব সমস্যা হবার কথা না?

কেউ সত্যিকার পরিচয় বের করতে চায় না।

তুমি চা বা কফি খাবে?

জ্বি না।

তুমি সিনেমার লাইনে, সেখান থেকে নতুন পেশায় কীভাবে চলে এলে?

আমি বলতে চাচ্ছি না।

বলতে চাচ্ছ না কেন?

বলতে ইচ্ছা করছে না। গল্প করার মতো মজার কোনো বিষয় এটা না।

আমি তো গল্প করছি না। জানতে চাচ্ছি।

জানতে চাচ্ছেন কেন?

কৌতুহল বলতে পার। তোমার এক ভাই তো জেলে আছে। ও জেলে গেল কেন?

ও জেলে আছে সেটা যখন জানেন তখন জেলে কেন সেটাও জানা আপনার জন্যে কোনো সমস্যা না।

তুমি বলতে চাচ্ছ না।

জ্বি না।

মোবারক সাহেব ইন্টারকমে বোতাম টিপে দু’গ্লাস পানি দিয়ে যেতে বললেন। পানি সঙ্গে সঙ্গে চলে এল। তিনি নিজে এক গ্লাস পানি নিলেন। রেশমার দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন।

নাও পানি খাও।

আমার তৃষ্ণা পায় নি। আমি পানি খাব না।

ঐ রাতে তুমি তো বেশ হাসিখুশি ছিলে–গল্প করছিলে, আজ এমন গভীর হয়ে আছ কেন?

ঐ রাতে আপনি আমাকে কী জন্যে ডেকে এনেছিলেন আমি জানতাম। আজ কী জন্যে এনেছেন আমি জানি না।

তোমাকে কী জন্যে আনা হয়েছে তুমি জান না?

জ্বি না।

অনুমান করতে পারছি? না তাও পারছি না?

পারছি না।

ঐ দিন তোমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলাম। টাকা ফেলে চলে গেলে কেন?

রাগ হয়েছিল। ঐ জন্যে ফেলে চলে গেছি।

তুমি যে জীবনযাপন করছ, সে জীবনে কি টাকার উপর রাগ করা মানায়?

না মানায় না। আপনার টাকা আমি নিয়েছি। সংসারে খরচ করেছি।

তুমি তোমার একটা চুলের ফিতাও ফেলে রেখে গিয়েছিলে। রেশমা চোখ তুলে তাকাল। লোকটির কাণ্ডকারখানা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। এই লোক তার কাছে কী চায়। খারাপ মেয়েদের নিয়ে নানান ধরনের মজা করতে লোকজন ভালবাসে। এও কি মজা করছে? লোকটা জানে না যে ইচ্ছে করলেই রেশমাও লোকটাকে নিয়ে মজা করতে পারে। না রেশমা পারে না। টেপী পারে। টেপী নানান ধরনের মজা করে। কিন্তু এখন সে টেপী না, সে এখন রেশমা। রেশমা মোটামুটিভাবে ভদ্র মেয়ে। আর মিতু কেমন মেয়ে? এই ভদ্রলোক জানেন না মিতু কেমন মেয়ে। শুধু মবিন ভাই জানেন।

এই লোকটার সামনে সে কি কিছুক্ষণের জন্যে মিতু হবে? লোকটা তাকে চমকে দেয়ার চেষ্টা করছে। নানান ধরনের চশমা পরে, নানানভাবে তাকাচ্ছে। চুলের ফিতার প্রসঙ্গ তুলেছে–তার মানে চুলের ফিতা সঙ্গে নিয়ে এসেছে। রেশমা সহজ হয়ে বসল। মিষ্টি করে হাসল, একটু ঝুঁকে এসে বলল, আপনি কি আমার চুলের ফিতা নিয়ে এসেছেন?

হ্যাঁ।

চুলের ফিতা ফেরত দেবার দরকার ছিল না। চুলের ফিতা আমি ইচ্ছা করে রেখে এসেছিলাম।

কেন?

উপহার। একটা খারাপ মেয়েরও তো উপহার দেবার ইচ্ছা হতে পারে। পারে না?

হুঁ পারে। কাজেই তুমি বলতে চোচ্ছ যে আমি ঐ ফিতা রেখে দিতে পারি?

হ্যাঁ। পারেন।

তুমি কথা তো খুব গুছিয়ে বলছি।

নানান ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশি। নানান রকমের কথা বলা শিখি।

আমার সঙ্গে তো বেশ কিছু সময় ছিলো। আমার কাছ থেকে কী শিখেছ?

আপনার কাছ থেকে শিখেছি মানুষকে কী করে ভয় দেখাতে হয়। আপনার কর্মচারীরা নিশ্চয়ই আপনাকে অসম্ভব ভয় পায়।

হ্যাঁ পায়।

আপনার স্ত্রীও খুব ভয় পান তাই না?

মনে হয় পায়। সে রাতে তুমি ভয় পেয়েছিলে, এখন তো মনে হয় পাচ্ছ না।

না এখন পাচ্ছি না।

পাচ্ছ না কেন?

আমার যা মনে আসছে সেটা যদি বলে ফেলি আপনি রাগ করবেন না তো?

বল, রাগ করব না।

আপনাকে ভয় পাওয়ার মতো প্রচুর লোকজন আপনি চারদিকে জড়ো করে রেখেছেন, কিন্তু আপনার কথা বলার লোক নেই। যে জন্যে আপনার লোকজন আমার মতো মেয়েদের খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসে।

আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ থেকে তোমার এই ধারণা হয়েছে?

জ্বি। অনেকের সঙ্গে মিশেছে তো। মানুষের অনেক কিছু চট করে ধরে ফেলতে পারি।

তোমার জীবনের পরিকল্পনা কী?

কোনো পরিকল্পনা নেই।

সে কী! কোনো পরিকল্পনা নেই?

না।

বিয়ে করে সংসারী হবার পরিকল্পনাও নেই?

রেশমা চুপ করে রইল। মোবারক সাহেব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছবির জগতের সঙ্গে যুক্ত আছ। তোমার কি ইচ্ছে করে না কোনো একটা ছবির নায়িকা হবে? সুপারস্টার হবে? ইচ্ছে করে?

রেশমার খুব ইচ্ছা করে। মিতুর করে না।

বুঝতে পারছি না।

বাবা আমার নাম রেখেছিলেন মিতু। আমার ছবির নাম রেশমা। আর রাতে যখন আপনাদের মতো মানুষদের কাছে যাই তখন আমি টেপী।

তোমাকে আমি কোন নামে ডাকব?

টেপী নামে ডাকবেন। টেপী নামটা খুব খারাপ লাগলে রেশমা ডাকবেন।

মিতু ডাকা যাবে না?

না। আপনি টেপীকে চেনেন। মিতুকে চেনেন না।

চা খাবে?

না।

খাও, চা খাও।

মোবারক সাহেব ইন্টারকমে চা দিতে বললেন। চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললেন। বেশিক্ষণ তিনি চোখে চশমা রাখতে পারেন না। মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হয়। তিনি চোখের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন।

ডাক্তারের ধারণা–চশমার জন্যে চোখে যন্ত্রণা হবার কোনো কারণ নেই। ব্যাপারটা মনস্তাত্ত্বিক। একজন সাইকিয়াট্রিন্টের সঙ্গে এক ফাঁকে কথা বলতে হবে।

মোবারক সাহেব চশমা ড্রয়ারে রাখলেন। সেখান থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরালেন। এটি দিনের প্রথম সিগারেট। প্ৰথম সিগারেট খেতে ভালো লাগে না। দ্বিতীয়টি ভালো লাগে। তিনি ঠিক করে ফেললেন, মেয়েটি থাকতে থাকতেই দ্বিতীয় সিগারেট ধরবেন। কফির সঙ্গে সিগারেট–ভালো লাগবে। মোবারক সাহেব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। খুব পছন্দ হয়েছে। তোমাকে চমৎকার কোনো গিফট আমি দিতে চাই। কী গিফট পেলে তুমি খুশি হবে বল?

যা চাই তাই দেবেন?

দিয়ে ফেলতেও পারি। পরীক্ষা করে দেখ।

রেশমা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি কারো কাছ থেকে গিফট নেই না।

তুমি তো ঠিক কথা বললে না টেপী। তুমিও গিফট নাও। মবিন বলে এক ভদ্রলোক তোমাকে গিফট দেন না?

রেশমা বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি সব খবর জানেন?

হ্যাঁ।

কেন?

পরে এক সময় বলা যাবে।

আজ বলবেন না?

না। একটা বেজে গেছে। একটার সময় আমার অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

স্যার আমি যাই।

আচ্ছা যাও। কোথায় যাবে নিচে গিয়ে বল গাড়ি তোমাকে পৌঁছে দেবে।

গাড়ি লাগবে না।

মোবারক সাহেব সাধারণত আধকাপের বেশি কফি খান না। আজ পুরোকাপ শেষ করলেন। কয়েকটা জরুরি টেলিফোন কল সারলেন। তবে কোথাও খুব মন বসাতে পারলেন না। ইনক্যামট্যাক্স লইয়ারকে এগারটায় আসতে বলেছিলেন। সে এসেছে, নিচে অপেক্ষা করছে–তার সঙ্গে বসতে ইচ্ছা করছে না। তাকে চলে যেতে বলতেও মন সায় দিচ্ছে না। অস্থির ভাবটা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যাব–ইনক্যামট্যাক্স লইয়ারের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করবে। সে চলে গেলে হয় কী করে। অপেক্ষা করুক। টেবিলের উপর সেক্রেটারির হাতে লেখা নোট পড়ে আছে। তাকে মনে করিয়ে দেবার জন্যে নোটগুলো লেখা। দু’টা পয়েন্টে লাল স্টার মার্ক দেয়া।

১. শিক্ষামন্ত্রী আফসারউদ্দিন খাঁ দু’বার টেলিফোন করেছেন। তিনি দু’টা পর্যন্ত দপ্তরে আছেন।
২. গুলশান থেকে আম্মা টেলিফোন করেছেন। খুব জরুরি খবর আছে।
৩. চেম্বার অব কমার্সের মিটিং সোনারগাঁ হোটেলের বলরুম—সন্ধ্যা ৭টায়।
৪. বিথোভেনের স্মরণে জার্মান দূতাবাসে ককটেল পার্টি—সন্ধ্যা ৭টায়।

এক এবং তিন নম্বর আইটেমে লাল স্টার মার্ক দেয়া।

দু’ নম্বর আইটেম মোটেই জরুরি নয়। তারপরেও মোবারক সাহেব পিএকে বললেন তার স্ত্রীকে লাইনে দিতে। সঙ্গে সঙ্গে লাইন পাওয়া গেল।

হ্যালো রেহানা! জরুরি কী খবর যেন দেবে বলেছিলে।

তোমাকে তো টেলিফোন করে করে আমি হয়রান হয়ে গেলাম। কখনোই লাইন দেয় না। তোমার সেক্রেটারির দল কি ইচ্ছা করে আমাকে এভায়েড করে?

ওদের দোষ নেই–মিটিঙে ছিলাম। জরুরি খবরটা কি বল?

তুমি যে স্বপ্নতথ্যের দু’টা বই এনেছ, দু’টা বই সম্পূর্ণ দু’রকম। একটাতে লেখা হাতি স্বপ্নে দেখলে ধন লাভ হয়। আরেকটায় লেখা হাতি স্বপ্ন দেখা বিপদের পূর্বাভাস। সম্পূর্ণ উলটা না?

তা তো বটেই।

এখন আমি কোনটা বিশ্বাস করব?

যেটা ভালো সেটা বিশ্বাস করাই তো নিরাপদ। তুমি কি হাতি স্বপ্নে দেখেছি?

না।

তাহলে হাতি দেখা নিয়ে মাথা ঘামোচ্ছ কেন? একটা বইয়ের সঙ্গে অন্যটা মিলিয়ে দেখছি–কিছু করার নেই তো… যতই ঘাটছি ততই অবাক হচ্ছি। অবশ্যি কিছু কিছু জায়গায় দু’টা বইয়ের একই অর্থ, যেমন ধর–পানি স্বপ্নে দেখলে অসুখবিসুখ হবে।

ও আচ্ছা।

আমি করছি কি যে সব স্বপ্লের অর্থ দু’টা বইয়ে একই লেখা সেগুলো সবুজ কালি দিয়ে দাগাচ্ছি।

দাগাদাগির কাজ তো সাধারণত লাল কালি দিয়ে করা হয়, তুমি সবুজ কালি ব্যবহার করছ কেন?

আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়াও দাঁড়াও এক সেকেন্ড খুব একটা জরুরি কথা, পরে বলতে ভুলে যাব–সিমির যমজ মেয়ে হয়েছে। আমি হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম–খুব সুন্দর হয়েছে।

সিমিকে মোবারক সাহেব চিনতে পারলেন না, তারপরেও যথেষ্ট উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, সিমি ভালো আছে তো?

হ্যাঁ ভালো। যমজ মেয়ে দেখে একটু মন খারাপ করেছে।

মন খারাপের কী আছে?

আগে আরো দু’টা মেয়ে আছে এই জন্যে একটু মন খারাপ।

ও আচ্ছা, আগেও তো দু’টা মেয়ে আছে–ভুলে গিয়েছিলাম। রেহানা শোন, একটু পরে তোমাকে আবার টেলিফোন করব। ইনক্যামট্যাক্সের এক উকিল এসেছে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।

মোবারক সাহেব রেহানাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। টেলিফোন নামিয়ে রেখে লাল কালি দিয়ে তাঁর সামনে রাখা নোটের দু’নম্বর আইটেম কেটে দিলেন। পিএকে বললেন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে।

শিক্ষামন্ত্রী আফসারউদ্দিন খাঁ অত্যন্ত আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, মোবারক সাহেব নাকি? আরে ভাই আপনাকে তো পাওয়াই যায় না।

খুবই ব্যস্ততার ভেতর আছি স্যার।

ব্যস্ত মানুষ ব্যস্ততা থাকবে না? তাই বলে একেবারে যোগাযোগ বাদ দিবেন। এটা কেমন কথা!

এই তো স্যার যোগাযোগ করলাম–এখন বলুন কী করতে পারি।

খেদমত আপনি কী করবেন? খেদমত করব আমরা। আমরা হলাম জনগণের খেদমতগার।

গরিবকে স্মরণ করেছেন কী জন্যে স্যার বলুন।

আমার মেজ মেয়ের বিয়ে।

বাহ্‌ বাহ্‌ খুব ভালো সংবাদ।

ভালো সংবাদ মন্দ সংবাদ জানি না। মেয়ে যখন আছে পার তো করতে হবে–আপনার ছেলেপুলে নাই–ঝাড়া হাত-পা মানুষ, ছেলেপুলের বিয়েশাদির যন্ত্রণা আপনাকে পোহাতে হচ্ছে না। You are a lucky man.

মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে যদি আপনার কোনো কাজে লাগি বলতে লজ্জা করবেন না।

আরে লজ্জা করব কেন? আপনি তো বাইরের কেউ না। আপনার ভাবি কাল রাতেও বলছে–মোবারক সাহেবকে কিন্তু টেলিফোনে দাওয়াত দেবে না। নিজে গিয়ে দাওয়াত দেবে।

আপনি কিন্তু স্যার ভাবির কথা শোনেন নি, টেলিফোনে দাওয়াত সেরেছেন।

আরো ছিঃ ছিঃ কী যে বলেন! বিয়ের খবরটা ইন অ্যাডভান্স আপনাকে দিলাম–দাওয়াতের তো কার্ডই ছাপা হয় নি।

স্যার বিয়েটা কবে?

এখানো দেরি আছে। ২৫ তারিখ শুক্রবার, সেনাকুঞ্জে।

আপনার মেয়েকে একটু জিজ্ঞেস করে দেখবেন সে চাচার কাছ থেকে কী উপহার চায়। নাকি আমি নিজেই জিজ্ঞেস করব?

সর্বনাশ ঐ কাজ করতে যাবেন না। সে গাড়ি চেয়ে বসবে। ঐ দিন সে তার মাকে বলছিল মোবারক চাচার অভ্যাস উপহার দেয়ার আগে জিজ্ঞেস করা কী উপহার চাই। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করে আমি বলব–লাল রঙের টয়োটা সিভান।

লাল রঙের টয়োটা সিভানের শখ?

আরে ভাই ছিঃ ছিঃ আমার এই পাগলি মেয়ের কথার কোনো গুরুত্ব দেবেন না। যদি কিছু দিতে হয় একটা কোরান শরিফ দেবেন। মোবারক সাহেব।

জ্বি।

মেয়ের লাল গাড়ির শখের কথা আপনাকে বলা উচিত হয় নি। আপনি তো আবার ছেলেমেয়ের শখের অত্যধিক গুরুত্ব দেন–ভাই শুনুন আমার নিজের ব্যক্তিগত ধারণা–আল্লাহপাকের পাক কালামের চেয়ে ভালো গিফট কিছুই হয় না। এখন এর কারণে আপনারা আমাকে প্রাচীনপন্থী মনে করেন বা না করেন–কিছু যায় আসে না…

আফসারউদ্দিন খাঁ সাহেবও রেহানার মতো দীর্ঘ সময় কথা বললেন। মোবারক সাহেব ছাড়া পেলেন আধঘণ্টা পর। পিএকে বললেন–নোট করে রাখুন মন্ত্রী আফসারউদিনের মেয়ের বিয়ে ২৫ তারিখ। সেনাকুঞ্জে। বিয়ের টাইমটা জেনে নেবেন। গিফট আইটেম–একটা কোরান শরিফ সুন্দর করে র‍্যাপিং পেপারে মোড়া।

কোরআন শরিফ?

হ্যাঁ।

মোবারক সাহেব মনে মনে হাসলেন। মন্ত্রী আফসারউদিনের সঙ্গে এই রসিকতা করা যায়। সে নিশ্চিত ধরে নিয়েছে লাল রঙের টয়োটা সিভান আসছে। সে জানে না। এই জগতের কোনো কিছুই নিশ্চিতভাবে নেয়া ঠিক না। জগতের কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ