ঝুমুর আজ স্কুলে যায় নি 

ঝুমুর আজ স্কুলে যায় নি। বিকেল তিনটায় সে আপাকে সঙ্গে নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবে। সে সকাল থেকেই অস্বস্তি নিয়ে ঘুরছে। সেন্ট্রাল জেলের গেটে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে তার কুৎসিত লাগে। চারপাশে থাকে গাদাগাদি ভিড়। দর্শনাথীর চেয়ে বাইরের লোক বেশি। এরা এমন ভঙ্গিতে তাকায় যেন যারা দেখা করতে এসেছে তারাও অপরাধী।

সবচে’ খারাপ লাগে যখন তারা গরাদ ধরে অপেক্ষা করতে থাকে এবং কয়েদির পোশাক পরা রফিক হাসিমুখে উপস্থিত হয়। পায়ে লোহার বালা। সেই বালা থেকে ঝন ঝন শব্দ হয়। একটা বালা থেকে এমন শব্দ হয় কেন ঝুমুর জানে না। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। প্রশ্নটা হাস্যকর হবে ভেবে কখনো জিজ্ঞেস করা হয় না।

প্রতিবারই রফিককে অন্যরকম লাগে। শেষবার দেখা করতে গিয়ে ঝুমুর একটা ধাক্কা খেল–রফিকের মুখভর্তি দাড়ি। দেখে মনে হয় মাদ্রাসার বাচ্চা মওলানা। আজ গিয়ে কী দেখবে কে জানে। ঝুমুরের যেতে ইচ্ছা করছে না। তবু সে যাবে। সে না গেলে আপাকে একা একা যেতে হবে। বেচারি সবকিছু একা করবে তা কি হয়? মা কখনো যাবে না। দু’ বছরে একবারও যায় নি। মাসে একটা চিঠি লেখা যায়, সেই চিঠিও লিখবে না।

শাহেদা রান্নাঘরে থালাবাসন ধুচ্ছিলেন। ঝুমুর এসে তাঁর পাশে বসল। শাহেদা বললেন, কী হয়েছে?

ঝুমুর বলল, জ্বর জ্বর লাগছে মা।

শুয়ে থাক।

ঝুমুর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। তার ধারণা পৃথিবীর সব মা ‘জ্বর জুর লাগছে’ এই বাক্য শোনার পর সন্তানের কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখবে। শুধু তার মা শুকনো গলায় বলবো ‘শুয়ে থাক’।

ভাইয়ার জন্যে কিছু রেঁধে টেধে দেবে?

কী রাঁধব?

পায়েস বা এই জাতীয় কিছু। সবাই খাবার টাবার নিয়ে যায়—আমরা শুধু যাই খালি হাতে।

তোদের কিছু নিতে ইচ্ছে হলে নিজেরা রেঁধে নিয়ে যা।

ঝুমুর আর কিছু বলল না। তবে সে উঠে গেল না, মা’র পাশে বসে রইল। ঘরে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। আপা শুটিঙে গেছে। সে বাসায় ফিরবে না। এফডিসির গেট থেকে আপাকে তুলে নিতে হবে। জয়দেবপুর থেকে তাকে একা একা যেতে হবে এফডিসি, এটাও তার জন্যে বিরাট সমস্যা। তার সাহস একেবারেই নেই। স্কুল থেকে সে বাসায়ও একা একা আসতে পারে না। তার এক বান্ধবীর সঙ্গে আসে। সেই বান্ধবী তাকে তাদের বাসার গেট পর্যন্ত দিয়ে তারপর তার বাসায় যায়। আজ একা একা এফডিসি পর্যন্ত কী করে যাবে কে জানে। যাওয়া অবশ্য খুব সোজা। ফার্মগেটে বাস থেকে নেমে একটা রিকশা নিতে হবে। পাঁচ টাকা নেবে রিকশা ভাড়া। আপা কখনো রিকশা নেয় না। বাস থেকে নেমে সে হেঁটে হেঁটে যায়। তার পক্ষে সম্ভব না। তাকে উপায় না থাকলেও পাঁচ টাকা খরচ করতে হবে।

মা।

হুঁ।

একা একা এফডিসির গেট পর্যন্ত যাব কীভাবে?

মিতু যেভাবে যায় তুইও সেইভাবে যাবি। তোর জন্যে চৌকিদার পাব কোথায়?

মবিন ভাইকে বলব আমাকে পৌঁছে দিতে?

না।

অসুবিধা তো কিছু নেই। উনার যদি কাজ না থাকে…

তোর যাবার দরকার নেই। তোর আপা একাই যাবে।

মবিন ভাইকে তুমি এত অপছন্দ কর কেন?

পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার না, শুধু শুধু বাইরের একটা মানুষকে বিরক্ত করবি কেন?

উনি বাইরের মানুষ না, দুদিন পর বিয়ে হচ্ছে আপার সঙ্গে।

যখন হবে তখন দেখা যাবে।

ঝুমুরকে রান্নাঘরে রেখে তিনি উঠে গেলেন। বালতিতে কাপড় ভেজানো আছে। কাপড় ধুবেন। ঝুমুর একা একা বসে রইল। তার এখন ইচ্ছা করছে কলঘরে মা’র পাশে গিয়ে বসতে। সে একা একা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।

হঠাৎ ঝুমুরের মনে হলো, তার যখন বিয়ে হবে তখন তার স্বামী বেচারা খুব ঝামেলায় পড়বে। সারাক্ষণ সে স্বামীর সঙ্গে থাকবে। কে জানে সে হয়তো অফিসেও চলে যাবে। স্বামী কাজ করছে–সে তার সামনের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। ঝুমুরের এইসব ভাবতে খুব লজ লাগছে আবার না ভেবেও পারছে না। ইদানীং সে এইসব ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবে। সে যখন একা থাকে। শুধু যে তখন ভাবে তা না, যখন অনেকের সঙ্গে থাকে তখনো ভাবে। সবচে’ বেশি ভাবে ক্লাসে। আপা অঙ্ক করাচ্ছেন। সবাই বোর্ড থেকে অঙ্ক টুকছে আর সে ভাবছে অন্য কিছু। সেই অন্য কিছু মানে খারাপ কিছু না, আবার খারাপও। যেমন–আপা যখন অঙ্ক করাচ্ছিলেন তখন সে ভাবছে… ভাবছে না, পরিষ্কার চোখের সামনে দেখছে লাল রঙের একটা গাড়ি স্কুলে ঢুকল। গাড়ি থেকে একজন নামল–তার পরনে ধবধবে সাদা প্যান্ট, গায়ে চকলেট রঙের হাওয়াই শার্ট। শার্টের রঙটা কটকট করে চোখে লাগছে। তাকে দেখেই সে বের হয়ে আসছে। অঙ্ক আপা কঠিন গলায় বললেন, এই ঝুমুর কোথায় যাচ্ছ?

সে লজ্জিত গলায় বলল, আমার হাসবেন্ড আমাকে নিতে এসেছে আপা।

ও আচ্ছা যাও। তুমি কিন্তু খুব ক্লাস মিস দিচ্ছ।

না গেলে ও খুব রাগ করবে।

আচ্ছা যাও। উনাকে বলবে স্ত্রীর পড়াশোনার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। শুধু সঙ্গে নিয়ে ঘুরলে হবে না।

জ্বি, আপা বলব। সে বের হয়ে হনহন করে গাড়ির দিকে এগুল। তারপর বিরক্ত গলায় বলল, আচ্ছা তোমাকে কতবার না বলেছি। চকলেট কালারের এই শার্টটা পরবে না। তারপরেও পরেছ?

হাতের কাছে পেয়েছি, পরে চলে এসেছি।

তুমি এই শার্ট গায়ে দিয়ে থাকলে আমি কোথাও যাব না।

তাহলে শার্ট খুলে ফেলি, শার্টের নিচে স্যান্ডো গেঞ্জি আছে। স্যান্ডো গেঞ্জি পরা থাকলে যাবে?

আবার ঠাট্টা করছ?

ঝুমুরের চোখে পানি এসে গেছে। সে সবার ঠাট্টা সহ্য করতে পারে, এই মানুষটার ঠাট্টা সহ্য করতে পারে না। ঝুমুরের চোখে পানি দেখে সে লজ্জিত ভঙ্গিতে এসে তার হাত ধরল। ঝুমুর ঝটিকা মেরে সেই হাত সরিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বলল, ছিঃ এইভাবে হাত ধরলে–ক্লাসের সব মেয়েরা তাকিয়ে আছে, আপারা দেখছে।

দেখুক। তুমি কাঁদবে কেন?

আমি এক শ বার কাঁদব।

আমিও এক শ বার হাত ধরব।

এইসব ভাবতে ঝুমুরের এত ভালো লাগে! যা ভাবা হয়। সত্যিকার জীবনে তা কখনো ঘটে না। ঝুমুরের নিশ্চিত ধারণা তার বিয়েই হবে না। আর হলেও পানের দোকানদার টাইপ কারো সঙ্গে হবে। যার গায়ে সবসময়ই ঘাম আর কড়া সিগারেটের গন্ধ থাকবে।

 

দুপুরে ঝুমুর কিছু খেতে পারল না। তাকে একা একা ঢাকা যেতে হবে এই টেনশানেই তার মুখে কিছু ভালো লাগছে না। কেমন যেন গা গুলাচ্ছে। ঝুমুর বলল, মা তুমি আমাকে বাসে তুলে দিয়ে আস।

শাহেদা শান্ত গলায় বললেন, কোথাও তুলে দিতে পারব না। তুই নিজে নিজে বাস খুঁজে বের করবি। নিজে নিজে উঠবি।

আচ্ছা। ভাইয়াকে কিছু বলতে হবে?

না।

আপাকে কিছু বলতে হবে?

ঘরে চা নাই, চিনি নাই।

চা চিনি ছাড়া আর সব আছে?

শাহেদা জবাব দিলেন না।

আমি কি এই কামিজটা পরেই যাব?

তোর যা ইচ্ছা পর।

কামিজটা যা নোংরা হয়ে আছে। আপার একটা শাড়ি পরে ফেলব মা?

শাহেদা জবাব দিলেন না। কথাবার্তা তিনি এমনিতেই কম বলেন–যত দিন যাচ্ছে কথাবার্তা আরো কমিয়ে দিচ্ছেন।

ঝুমুর ঘর থেকে বের হয়ে অসীম সাহসী এক কাণ্ড করল। মবিনের মেসে যাবার জন্যে একটা রিকশা ঠিক করে ফেলল। কাজটা অসীম সাহসিক এই কারণে যে মবিনকে যদি না পাওয়া যায় তাহলে সে ঘোরতর সমস্যায় পড়বে। টাকায় টান পড়ে যাবে। ফার্মগেট থেকে নেমে এফডিসি যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। সে চিনে যেতে পারবে কিনা তাও এক সমস্যা। বাইরে একা বেরোলেই তার শুধু সমস্যা হয়। হয়তো স্যান্ডেলের স্ট্যাপ ছিঁড়ে যাবে। তাকে যেতে হবে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে। তারচে’ বড়ো সমস্যাও হতে পারেহয়তো ইতিমধ্যে মবিন ভাই তার ঘর বদলেছেন। সে দরজির দোকানের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজায় নক করল। দরজা খুলল–দেখা গেল ভয়ঙ্কর দর্শন কয়েকজন চৌকিতে বসে তাস খেলছে। সবার সামনে মদের গ্লাস। ঝুমুর কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, মবিন ভাই কি এখানে থাকেন না? একজন চাপা গলায় উত্তর দিল, জ্বি না খুকুমণি, উনি থাকেন না। তাতে কী হয়েছে আমরা তো থাকি?

সেই লোকটা তারপর মাথা ঘুরিয়ে কোণায় বসে থাকা এক লোককে বলল–ঐ যা তো মেয়েটাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দে। মুখে রুমাল ওঁজে দে। নয়তো চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে।

 

ঝুমুর দরজার কড়া নাড়ল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। মবিন বলল, ঝুমুর তুমি, ব্যাপার কি?

আমি ঢাকা যাব মবিন ভাই।

ঢাকা যাবে অতি উত্তম কথা। এটা তো ঢাকা যাবার দোতলা বাস না যে তুমি দোতলায় উঠে এলে।

আপনি আমাকে ঢাকার বাসে তুলে দেবেন।

অতি উত্তম তুলে দেয়া হবে।

শুধু তুলে দিলে হবে না। আপনাকে আমার সঙ্গে এফডিসির গেট পর্যন্ত যেতে হবে।

ব্যাপার কী?

আজ ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করার ডেট। আপা আমাকে বলেছে আড়াইটার সময় এফডিসির গেটে থাকতে। একা একা আমি কোথাও যাই না। তবু …

কোনো সমস্যা নেই, তোমাকে একা একা যেতে হবে না।

আপনি কিন্তু আমাকে নামিয়ে দিয়েই চলে যাবেন এবং আপনি যে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছেন সেটা আপাকে বলবেন না।

এত গোপনীয়তা কেন?

আপাকে বললেই আপার কাছ থেকে মা জানবে। মা খুব রাগ করবে। এই ক্ষেত্রে গোপনীয়তাই শ্ৰেয়। আড়াইটার সময় পৌঁছতে হবে?

হুঁ।

তাহলে বোস কিছুক্ষণ, আমি ভাত খেয়ে নি।

আচ্ছা।

তুমি খেয়ে এসেছ?

হুঁ।

আমার সঙ্গে চারটা খাবে?

খেতে পারি। আমি কি আপনার বিছানায় পা তুলে বসব মবিন ভাই?

অবশ্যই বসবে।

আপনার ঘরে ঢুকলেই কেমন শান্তি শান্তি ভাব হয়। কেন বলুন তো মবিন ভাই?

ঘরটা ফাঁকা তো–কোনো আসবাব নেই–একটা চৌকি, একটা চেয়ার। চৌকিতে শীতলপাটি বিছানো। শীতলপাটি মানেই শান্তি, ফাঁকা ঘর মানেই শান্তি। এই জন্যে আমার ঘরে পা দিলেই শান্তি শান্তি ভাব হয়।

আপনি কি আপার সঙ্গেও এরকম করে কথা বলেন, না আপার সঙ্গে অন্যরকম করে কথা বলেন?

এরকম করেই কথা বলি।

সে কি আপনার কথা শুনে খুশি হয়?

জিজ্ঞেস করি নি কখনো।

জিজ্ঞেস করতে হবে! মুখ দেখেই তো বোঝা যায়।

আমি তোমার আপার মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারি না।

আমিও পারি না।

মবিন খবরের কাগজ বিছাচ্ছে। টিফিন কেরিয়ারের বাটি বের করছে। ঝুমুর বলল, আমাকে কি আজ একটু অন্যরকম লাগছে না?

হুঁ লাগছে।

কেন অন্যরকম লাগছে বলুন তো?

শাড়ি পরেছ এই জন্যেই অন্যরকম লাগছে।

ও আপনি তাহলে লক্ষ করেছেন। আমি ভাবলাম বোধহয় লক্ষ করেন নি।

লক্ষ করব না কেন, করেছি।

যারা দিনরাত বই পড়ে তারা বই ছাড়া আর কিছুই লক্ষ করে না।

আমি করি।

ঝুমুর বাসায় কিছু খেতে পারে নি। এখানে একগাদা ভাত খেয়ে ফেলল। হাসিমুখে বলল, মবিন ভাই, ঘুমে এখন আমার চোখ জড়িয়ে আসছে। আপনার শীতলপাটিতে ঘুমুতে নিশ্চয় খুব আরাম।

আমার তো আরামই লাগে।

আমি একদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে আপনার শীতলপাটিতে এসে আরাম করে ঘুমুব।

বাসায় আরাম করে ঘুমুতে পার না?

না, এতটুকু একটা বিছানা, আপা আর আমি দু’জন ঘুমাই। খুব চাপাচাপি হয়। মা’র বিছানাটা বড় কিন্তু মা’র সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছা করে না। মা’র রাতে ঘুম হয় না তো–সারারাত এপাশি-ওপাশ করে। মাঝে মাঝে কাঁদে। তার গায়ের সঙ্গে গা লাগলে কী করে জানেন? ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।

ঝুমুর চল, ওঠা যাক। এখন রওনা না হলে আড়াইটার সময় পৌঁছাতে পারবে না।

ঝুমুর অনিচ্ছার সঙ্গে উঠল। মবিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে তার সব সময়ই ভালো লাগে। আজ অন্য দিনের চেয়েও ভালো লাগছে।

মবিন ভাই!

হুঁ।

আপনাদের বিয়ে কবে হবে?

বুঝতে পারছি না। চাকরি বাকরি ছাড়া বিয়ে করা ঠিক হবে না।

চাকরির আশায় বসে থাকলে আপনার আর বিয়ে হবে না।

তোমার ধারণা আমার চাকরি বাকরি হবে না?

হুঁ।

ভুল ধারণা। আমি বিরাট একটা চাকরি পাব। চা বাগানের ম্যানেজার। বাংলো টাইপ একটা বাড়ি থাকবে, মালী থাকবে, সুইপার থাকবে। চা বাগানে ঘোরার জন্যে ল্যান্ড রোভার জিপ থাকবে। বিকেলে আমাদের অফিসার্স ক্লাবে গিয়ে হাফপ্যান্ট আর টি শার্ট পরে লং টেনিস খেলিব। জোছনা রাতে বাংলোর বারান্দায় আমি আর তোমার আপা রকিং চেয়ারে বসে চুকচুক করে শেরী খাব এবং জোছনা দেখব।

শেরীটা কী? মদ?

মদ বলবে না। মদ বললে মনে হয় ধেনো মদ। শেরী হলো মিষ্টি মিষ্টি এক ধরনের পানীয় যার অল্প খানিকটা পেটে গেলে জোছনা অনেক সুন্দর মনে হয়। বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে।

শেরী যারা খায় না তাদের বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না?

বেঁচে থাকার মধ্যে পার্থক্য আছে। সব বেঁচে থাকা একরকম না।

ঝুমুর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এইসব চাকরি আপনাকে মানবে না মবিন ভাই। আপনি যা আছেন, তাই আপনাকে মানাচ্ছে। ছোট্ট সুন্দর একটা ঘর। পাটি বিছানো চৌকি …বাহ্‌।

মবিন হো-হো করে হেসে ফেলল। ঝুমুর অপ্ৰস্তুত হয়ে বলল, হাসলেন কেন?

আছে একটা কারণ। তোমাকে বলা যাবে না।

আচ্ছা ঠিক আছে বলতে না চাইলে বলবেন না–শুধু একটা সত্যি কথাই বলুন। আমাকে খুশি করার জন্যে মিথ্যা বলতে পারবেন না।

আচ্ছা যাও সত্যি কথাই বলব।

শাড়ি পরায় আমাকে কি খুব সুন্দর লাগছে?

যে সুন্দর সে যাই পারুক তাকে সুন্দর লাগবে।

আমি কি সুন্দর মবিন ভাই?

অবশ্যই সুন্দর।

আপা বেশি সুন্দর, না। আমি? সত্যি কথা বলতে হবে কিন্তু।

দু’জনের সৌন্দৰ্য দু’রকম। কোনো দু’জন রূপবতী মেয়ের ভেতর তুলনা চলে না। একেক জনের সৌন্দৰ্য একেক রকম। কেউ নদীর মতো, কেউ অরণ্যের মতো, আবার কেউ আকাশের মতো!

আমি কীসের মতো?

ঝরনার মতো।

আর আপা?

সে অরণ্যের মতো।

অরণ্য বেশি সুন্দর না ঝরনা?

কারো কারো কাছে অরণ্য সুন্দর, কারো কাছে ঝরনা।

ঝুমুর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনার কাছে অরণ্য সুন্দর তাই না? এই জন্যেই চা বাগানের চাকরি আপনার এত পছন্দ, ঠিক না?

মবিন জবাব দিল না। সে একটু অস্বস্তির সঙ্গে শাড়ি পরা মেয়েটির দিকে তাকাল।

 

ঝুমুর ঠিক আড়াইটার সময় এফডিসির গেটে এসেছে। তখন থেকেই সে অপেক্ষা করছে। আপার বেরুবার নাম নেই। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা খুব অস্বস্তিকর। একগাদা লোক দাঁড়িয়ে আছে। কোনো একটা গাড়ি এফডিসির ভেতরে ঢুকলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। নায়ক-নায়িকা কাউকে এক ঝলক দেখা যায় কিনা।

কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নায়ক-নায়িকারা আসছে পর্দ ঢাকা গাড়িতে। অনেকের গাড়ির কাচ টিনটেড। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। একগাদা মানুষের ভেতর ঝুমুর একাই মেয়ে। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন এসে জিজ্ঞেস করল সে এফডিসির ভেতর ঢুকতে চায় কিনা। ঝুমুর ভীত গলায় বলল, না।

ভিতরে যাইতে চাইলে সমস্যা নাই–নিয়া যাব।

জ্বি না, আমি যাব না।

লোকটা তবু তাকে ছাড়ছে না। তার আশপাশেই আছে। ভদ্রলোকের মতো চেহারা কিন্তু মতলববাজ তা বোঝাই যাচ্ছে–নয়তো ঝুমুরকে এফডিসির ভেতর নিয়ে যাবার ব্যাপারে তার এত আগ্রহ হবে কেন? সময় কতক্ষণ গেছে ঝুমুর বুঝতে পারছে না। তার সঙ্গে ঘড়ি নেই। লোকটাকে অবশ্যি জিজ্ঞেস করা যায়। তার হাতে বাহারি ঘড়ি।

আচ্ছা আপা কোনো কারণে বাসায় চলে যায় নি তো? যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে তো সে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে। একা একা ফিরতে হবে জয়দেবপুর। এই বদলোক নিশ্চয়ই তার পেছনে পেছনে যাবে।

ঝুমুর।

ঝুমুর চমকে তাকাল। মিতু বের হয়েছে। তার মুখে মেকআপ। ঠোঁট টকটকে লাল। তাড়াতাড়ি আসার জন্যে মেকআপ তোলারও সময় পায় নি।

তুই কি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস?

হুঁ। তোমার শাড়ি পরে চলে এসেছি। রাগ কর নি তো?

না, শুধু শুধু রাগ করব কেন? চল যাই–আয় একটা রিকশা নিয়ে নিই। একা একা আসতে ভয় লাগে নি তো?

উঁহুঁ।

বাহ্‌। তোর তো সাহস বেড়েছে। কিছুক্ষণ হাঁটতে পারবি ঝুমুর?

হুঁ পারব।

তাহলে আয় একটু হাঁটি–বাংলামোটর পর্যন্ত গেলে টেম্পো পাওয়া যাবে।

তুমি ঢাকা শহরে সব রাস্তাঘাট চেন তাই না?

মোটামুটি চিনি।

আপা, বাসায় চিনি নাই, চা নাই।

মিতু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। সেই নিঃশ্বাস ফেলা দেখে ঝুমুর নিশ্চিত বুঝল আপার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই।

তোর কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ঝুমুর?

উঁহুঁ।

হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্যেও ভালো।

তুমি তো আর স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্যে হাঁটছ না, দায়ে পড়ে হাঁটছ। গাড়ি থাকলে তুমি কি আর স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে হাঁটতে?

তাও ঠিক।

আপা, আজ খুব ভোরবেলা বাড়িওয়ালা এসেছিল দু’টা পেঁপে নিয়ে। তার বাগানের পেঁপে। মা’র সঙ্গে কথা বলল।

বাড়ি ছেড়ে দিতে বলল?

হুঁ।

বেশি ভাড়ার ভাড়াটের কাছে ভাড়া দেবে?

তা বলল না। তার নিজের জন্যেই বাড়ি দরকার। সংসার বড় হয়েছে, ছোট ছেলে হুট করে বিয়ে করে ফেলেছে–এইসব কথা।

মা কী বলল?

মা কিছুই বলে নি, শুধু শুনেছে।

হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ঝুমুর?

না।

এই তো এসে পড়েছি।

আমরা কি সত্যি সত্যি-টেম্পোতে করে একদল পুরুষের সঙ্গে গা ঘেসাঘেঁসি করে যাব? আমার তো ভাবতেই বমি আসছে।

তোকে এক কোণায় বসিয়ে দেব। তোর আর কারো সঙ্গে গা ঘেঁসে যেতে হবে না।

তোমার তো যেতে হবে।

আমার এইসব গা সহা হয়ে গেছে।

আমাদের মতো খারাপ অবস্থায় বোধহয় কেউ নেই, তাই না আপা?

থাকবে না কেন, আমাদের চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় লোক আছে। আমার পরিচিত এক মেয়ে আছে–ওর নাম টেপী। ছবিতে ছোটখাটো রোল করে। বিরাট সংসার তাকে একা টানতে হয়। ছবির পয়সায় তো হয় না–কিছু জঘন্য কাজ তাকে করতে হয়।

জঘন্য কাজটা কী?

মিতু জবাব দিল না। টেম্পোস্ট্যান্ড চলে এসেছে। সে বোনের হাত ধরে খালি টেম্পো খুঁজছে। সবার আগে উঠলে ঝুমুরকে কোণার দিকে নিরাপদ জায়গায় বসাতে পারবে।

 

রফিক দু’বোনকে দেখে হাসল। গতবার তার মুখভর্তি দাড়ি ছিল। এখন নেই। মাথার চুলও ছোট ছোট করে কাটা। তার গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। লম্বা হালকাপাতলা শরীর। জেলের বাইরে সাধারণ কোনো পোশাক পরিয়ে দিলেও তাকে দেখে সবাই বলবে, বাহু ছেলেটা সুন্দর তো! আজি তাকে মোটেই সুন্দর লাগছে না। তার চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। ঠোঁট ফ্যাকাসে। ঠোঁটের দু কোণায় ঘায়ের মতো হয়েছে। ঝুমুর কাঁপা গলায় বলল, কেমন আছ ভাইয়া?

রফিক মাথা নাড়ল। কিছু বলল না। তার স্বভাবও শাহেদার মতো। সেও কথা কম বলে।

ভাইয়া, তোমার কি শরীর খারাপ?

একটু খারাপ।

কী হয়েছে?

রাতে ঘুম হয় না।

মিতু বলল, তোমাদের জেলে ডাক্তার নেই?

আছে–ডাক্তার, হাসপাতাল সবই আছে।

ঘুম হচ্ছে না, সেটা তাহলে ডাক্তারকে বল। কতদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না?

রফিক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আগ্রহের সঙ্গে বলল, মা’র শরীর কেমন?

ভালো।

আমাকে দেখার জন্যে আসতে চায় না?

না।

এমনিতে শরীর ভালো?

হুঁ।

তোরা চলে যা, আর কী, দেখা তো হলো।

মিতু বলল, ভাইয়া তোমার শরীর কিন্তু খুবই খারাপ করেছে। তুমি ডাক্তারকে তোমার অসুখের কথা বল।

বলব।

ভাইয়া। তোমার জন্যে দুশ টাকা এনেছি। জেল গেটের জমাদার মোসাদেক আলীর কাছে দিয়েছি। তোমার কাছে পৌঁছবে তো?

অর্ধেক পৌঁছবে।

আর তোমার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট এনেছি।

সঙ্গে ম্যাচ আছে?

হ্যাঁ।

দে তাহলে একটা খাই।

রফিক সিগারেট ধরাল। নীরবে টানছে। ঝুমুর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছে। বলতে পারছে না। সে কোনোমতে বলল, জেলখানায় থাকতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না ভাইয়া?

রফিক সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, না, কষ্ট আর কী? মানুষ খুন করে জেলে আছি–ঠিকই তো আছে। অনেকে কোনো অপরাধ না করে খুনের দায়ে যাবজীবন জেল খাটছে। কষ্ট তাদের। তোরা চলে যা। মা’কে একবার ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসিস। উনার বয়স হয়েছে, হুট করে কোনোদিন মরে যাবেন, আর দেখা হবে না।

মিতু বলল, পরের বার যখন আসি নিয়ে আসব। ভাইয়া আমরা এখন যাই?

আচ্ছা যা। ঝুমুর ছয় মাসে এত বড় হয়ে গেল কীভাবে?

ঝুমুর লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি বেশি বড় হইনি ভাইয়া। শাড়ি পরেছি। এই জন্যে বড় লাগছে।

মা যদি আমার কথা জানতে চায় তাহলে বলিস। আমি ভালোই আছি। রাতে ঘুম হচ্ছে না। এইসব বলার দরকার নেই।

ফেরার পথে তারা মোটামুটি ফাঁকা বাস পেয়ে গেল। ঝুমুর জানালার পাশে বসেছে। একটু পর পর চোখ মুছছে। ভাইয়াকে দেখে ফেরার পথে সব সময় সে এরকম কাঁদে। প্ৰতিবারই ভাবে সে মা’র মতো হয়ে যাবে–কখনো দেখতে যাবে না। কখনো না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ