মোবারক সাহেবের খাস কামরা

অফিসে মোবারক সাহেবের দু’টা খাস কামরা। একটা হলঘরের মতো বিশাল। ওয়াল টু ওয়াল ধবধবে সাদা কর্পেটে মোড়া। এক কোণায় দশ ফুট বাই ছ’ফুটের মেহগনি কাঠের কালো একটা টেবিল। টেবিলের ওপাশে মোবারক সাহেবের নিচু রোলিং চেয়ার। দেয়ালে বেশ কিছু পেইনটিং। পেইনটিঙের ফ্রেমগুলোও কালো মেহগনি কাঠের। ইন্টারন্যাল ডিজাইনার মেঝের সাদা কার্পেটের সঙ্গে কালো ফার্নিচারের একটা কম্বিনেশন করেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন–কম্পোজিশন ইন ব্ল্যাক এন্ড হেয়াইট। এই ঘরে যে চায়ের কাপে চা দেয়া হয় তার রং পর্যন্ত কালো। পিরিচগুলো সাদা।

এই খাস কামরা মোবারক সাহেব সচরাচর ব্যবহার করেন না–তিনি ব্যবহার করেন বাড়ির চিলেকোঠার খাস কামরা। তুলনামূলকভাবে ঘরটা ছোট-তবে কোনো আসবাব নেই বলে ছোট ঘরও অনেক বড় মনে হয়। বসার জন্যে ঘরে ছোট ছোট কাপেট পাতা আছে। ইটালিয়ান পার্লার মার্কেলের মেঝেতে হালকা নীল রঙের কার্পেট। ঘরে কোনো টেবিল নেই–শুধু মোবারক সাহেবের সামনে মারোয়াড়ি দোকানের ক্যাশ বাক্সের মতো ছোট্ট একটা মার্কেলের টেবিল। বড় বড় কাচের জানালায় পর্দা নেই বলেই ছাদের গোলাপ বাগান চোখে পড়ে। সেই বাগান দর্শনীয়।

আজমল তরফদার জুতা পায়ে মোবারক সাহেবের এই ঘরে ঢুকে দারুণ অপ্ৰস্তুত হয়ে গেলেন। মোবারক সাহেব হাসিমুখে বললেন, এত অপ্ৰস্তুত হবার কিছু নেই। জুতা পায়ে অনেকেই ঢুকে পড়ে। আমি নিজেও কতবার ঢুকেছি।

মেঝেতে ময়লা লেগে গেল।

লাগুক না। মেঝের ময়লা পরিষ্কার করা যায়। আসুন, বসুন আমার সামনে। মেঝেতে বসে অভ্যাস আছে তো? চেয়ার-টেবিল আসার পর থেকে বাঙালি মেঝেতে বসা ভুলে গেছে।

আজমল তরফদার এসে বসলেন। তিনি বসে আরাম পাচ্ছেন না। জিনসের প্যান্টে আঁটসাঁট লাগছে। মোবারক সাহেব বললেন, কী খাবেন বলুন?

এক কাপ চা খেতে পারি।

দুপুরে লাঞ্চের আগে চা খেয়ে খিদে নষ্ট করবেন কেন? শরবত খান। তেঁতুলের একটা শরবত আছে–আমার খুব প্রিয়। আপনার পছন্দ হলে রেসিপি দিয়ে দেব।

থ্যাংক য়্যু স্যার।

এখন ছবির বিষয়ে বলুন।

কী বলব স্যার?

আপনাকে নিশ্চয়ই বলা হয়েছে। আমি একটা ছবি বানাতে চাই।

জ্বি লোকমান সাহেব আমাকে বলেছেন।

সেই প্রসঙ্গে বলুন।

আজমল তরফদার কী বলবেন ভেবে পেলেন না। তাঁর প্রচণ্ড সিগারেটের তৃষ্ণা হচ্ছে কিন্তু এই ঘরের যে অবস্থা তাতে মনে হয় না। এখানে সিগারেট খাওয়া যাবে। ভদ্রলোক শরবতের কথা বলেছেন। অথচ কাউকে শরবত দিতে বলেন নি। ভুলে গেছেন বোধহয়। ঠাণ্ডা এক গ্লাস শরবত পেলে ভালোই হতো।

ছবির কোন ব্যাপার জানতে চান?

সবই জানতে চাই।

কী পরিমাণ টাকা লাগবে তা দিয়ে শুরু করি?

করুন।

ছবির জগতে আপার লিমিট বলে কিছু নেই। কেউ ইচ্ছা করলে একটা ছবি বানাতে পাঁচ কোটি টাকাও খরচ করতে পারে।

আপার লিমিট না থাকলেও লোয়ার লিমিট নিশ্চয়ই আছে?

জ্বি তা আছে। জিনিসপত্রের দাম–আর্টিস্টদের পেমেন্ট যে হারে বেড়েছে তাতে স্যার একটা ছবির পেছেন প্ৰায় এক কোটি টাকা লগ্নি করতে হয়।

এক কোটি টাকায় ছবি হয়ে যাবে?

জ্বি হবে। একটু টাইট বাজেটে করতে হবে। হাত-পা খেলিয়ে করা যাবে না।

হাত-পা খেলিয়ে করতে কত লাগবে?

তার সঙ্গে আরো পঞ্চাশ লাখ যোগ দিন।

বেশ, আমি এক কোটি পঞ্চাশ লাখ খরচ করব।

আজমল তরফদার কিছুটা হকচাকিয়ে গেলেন। কিছু কিছু মানুষের হাতে টাকা আছে তা তিনি জানেন। সেই টাকা কোন পর্যায়ে আছে তা জানেন না। কালো টাকাকে সাদা করার জন্যে অনেকে ছবি করে। এই ভদ্রলোকের কালো টাকার পরিমাণ কত? ধন্যবান ব্যক্তিদের গা থেকে একটা আলগা চাকচিক্য ঝিলিক দেয়, ইনার তা নেই। সাদামাটা চেহারা–মুখের চামড়ায় ভাজ। পায়জামা পাঞ্জাবি পরে থাকায় স্কুল টিচার স্কুল টিচার বলে মনে হচ্ছে।

স্যার আপনি কী ধরনের ছবি করতে চান? কমার্শিয়াল ছবি, না। আর্ট ছবি?

পার্থক্য কী বুঝিয়ে বলুন।

মানিকদার ছবি হলো–আর্ট ছবি।

মানিকদাটা কে?

সত্যজিত রায়। টালীগঞ্জে একটা ছবি করতে গিয়েছিলাম, তখন উনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমাকে খুব স্নেহ করতেন।

ও আচ্ছা।

‘পথের পাঁচালী’ টাইপ ছবি হলে নাম হবে, তবে হলে ছবি চলবে না। ইন্টারভ্যালের আগেই দর্শক বের হয়ে চলে আসবে। লগ্নি করা টাকা উঠে আসবে না। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া যাবে। বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবি যাবে, ছবির সঙ্গে সঙ্গে ছবির প্ৰযোজক হিসেবে আপনিও যাবেন। এই পর্যন্তই…

আজমল তরফদারের কথার মাঝখানেই শরবত চলে এল। বড়ো সাইজের গ্লাসঈষৎ সবুজাভ রঙের পানীয়, উপরে বরফের টুকরা ভাসছে। শরবত এসেছে। একজনের জন্যে। মোবারক সাহেব বললেন, নিন শরবত নিন।

আপনি খাবেন না স্যার?

জ্বি না। আর্ট ছবি সম্পর্কে তো বললেন, এখন কমার্শিয়াল ছবি সম্পর্কে বলুন।

বলার কিছু নেই স্যার। ধুমধাড়াক্কা টাইপ ছবি। নাচ-গান-যৌনতা, যাত্রা ঢঙের অভিনয়, কিছু ভাঁড়ামি, কিছু চোখের পানি … বারমিশালি খিচুড়ি।

লোকজন খিচুড়ি খাচ্ছে?

না খেলে এত ছবি বানানো হবে কেন? খিচুড়ি খাচ্ছে। যারা সিনেমা হলে যাচ্ছে তারা খিচুড়ি ছাড়া অন্য কিছুই খাবে না।

ছবি বানানো হচ্ছে কাদের জন্যে?

রিকশাওয়ালা, গ্রামের চাষী, কুলি, মজুর। এদের জন্যে–এদের বাড়িতে টিভি নেই, বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই–সারাদিন পরিশ্রম করে সিনেমা হলে এসে সিটি বাজিয়ে একটু আরাম পায়। ছবি বানিয়ে ব্যবসা করতে হলে এদের জন্যে ছবি বানাতে হবে। এখন স্যার ঠিক করতে হবে। আপনি কাদের জন্যে ছবি বানাবেন?

আমি ব্যবসায়ী মানুষ। দেড় কোটি টাকা যখন আমি ইনভেষ্ট করব তখন আশা করব। তিন কোটি টাকা প্ৰফিট।

অবশ্যহ করবেন।

এখন আপনি বলুন আমার এই ছবি পরিচালনা করতে আপনি কত টাকা নেবেন?

আমার এখন পর্যন্ত কোনো ছবি নরম যায় নি। সব ছবি ব্যবসা করেছে। লাস্ট তিনটা ছবির তিনটাই সুপারহিট হয়েছে। আগে আমি তিন লাখ করে নিতাম। লাস্ট দু’টা ছবিতে সাত লাখ নিয়েছি। আপনিও তাই দেবেন।

শরবত খেতে কেমন লাগল?

আজমল তরফদার একটু হকচাকিয়ে গেলেন। হঠাৎ শরবতের প্রসঙ্গ চলে এল কেন বুঝতে পারলেন না।

শরবত খুব ভালো লেগেছে। ঝঁজ আছে।

রেসিপিটা হচ্ছে–এক জগ পানিতে এক ছটাক তেঁতুল এবং এক টেবিল চামচ সৈন্ধব লবণ, কুচিকুচি করে কাটা দু’টা কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, কয়েক দানা জিরা চব্বিশ ঘণ্টা না নেড়ে রেখে দিতে হবে। চব্বিশ ঘণ্টা পর ছেকে আলাদা করতে হবে। তার সঙ্গে পরিমাণ মতো চিনি মিশিয়ে আধা পেগ ভদকা দিতে হবে।

এর মধ্যে ভদকা আছে?

হ্যাঁ সামান্য আছে, আধা পেগেরও কম। আপনি মদ্যপান করেন না?

তেমন অভ্যোস নেই। মাঝেমধ্যে হঠাৎ … ছবির আলাপটা স্যার শেষ করি। আমার আরো কিছু জরুরি কাজ আছে।

মোবারক সাহেব শান্ত গলায় বললেন, ছবির আলাপ অবশ্যই শেষ করবেন–আমি একটু শুধু ইন্টারফেয়ার করব–আপনি যে বললেন সাত লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেন; শেষ দু’টা ছবিতে তাই নিয়েছেন তা তো ঠিক না। আমি খোঁজখবর নিয়েই কথা বলার জন্যে আপনাকে ডেকেছি। এখন পর্যন্ত কোনো ছবিতেই আপনি তিন লাখ টাকার বেশি পারিশ্রমিক পান নি। শেষ ছবিতেই চার লাখ টাকায় কনট্রাক্ট সাইন করেছেন। পেয়েছেন দুলাখ। দু লাখ এখনো পান নি। না পাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। আমি একজন ব্যবসায়ী, দেড় কোটি টাকার একটা প্রজেক্টে হাত দেব–ভালোমতো খোঁজখবর না করেই এগুব তা ভাবলেন কীভাবে? আপনি কি আরেক গ্লাস শরবত খাবেন?

জ্বি স্যার খাব।

এখন বলুন ছবি শেষ করতে আপনার কতদিন লাগবে?

আজমল তরফদারের চিন্তাভাবনা একটু এলোমেলো হয়ে গেছে। স্কুল টিচারের মতো দেখতে এই লোক সহজ লোক না। কঠিন লোক। কঠিন লোকের হয়ে কাজ করায় আনন্দ আছে। এরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়।

আজমল তরফদার আরেকটা ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করছেন। দ্বিতীয়বার শরবতের কথা তাকে বলা হয়েছে কিন্তু খবরটা ভেতরে দেয়া হয় নি। তারপরেও আজমল তরফদারের ধারণা যথাসময়ে শরবতের গ্লাস চলে আসবে। যদি আসে তাহলে ধরে নিতে হবে মোবারক হোসেন নামের এই লোক শুধু কঠিন ব্যক্তি না–সূক্ষ্ম চালের ক্ষমতা আছে এমন এক ব্যক্তি।

মোবারক সাহেব বললেন, আপনার বোধহয় সিগারেট খাবার অভ্যাস আছে। অভ্যাস থাকলে খেতে পারেন। আমিও মাঝেমধ্যে খাই।

তিনি তাঁর সামনে ছোট্ট ডেস্ক টাইপ টেবিলের ড্রয়ার খুলে অ্যাশট্রে বের করে সামনে রাখলেন। আজমল তরফদার ভুরু কুঁচকে ফেললেন। কথাবার্তার ঠিক এই পর্যায়ে ড্রয়ার থেকে অ্যাশট্রে বের করা হবে এটা কি আগেই ঠিক করা?

মোবারক সাহেব একটু ঝুকে এসে বললেন, আমি আপনাকে দিয়ে ছবি বানাব বলে ঠিক করে রেখেছি। আপনার রেমুনারেশন হিসেবে আমি পাঁচ লাখ টাকা ভেবে রেখেছি। এই অ্যামাউন্টের টাকার একটা চেক তৈরি করা আছে। আপনি রাজি থাকলে আজই আপনাকে দিয়ে দেব।

পুরোটা একসঙ্গে দিয়ে দেবেন?

হ্যাঁ। এবং ছবি যদি সুপারহিট হয় তাহলে আপনাকে আরো দু লাখ দেয়া হবে। আপনি কি রাজি আছেন?

রাজি আছি।

কতদিনে ছবি তৈরি করে দেবেন?

আমি ছ’মাসে ছবির সেন্সরপ্রিন্ট দিয়ে দেব। এবং ইনশাআল্লাহ্ ছবি সুপারহিট করবে। তবে একটা শর্ত–ছবি আমার মতো করে বানাতে দিতে হবে।

তা দেব। শুধু টাকা-পয়সা আমার লোকজন হ্যান্ডেল করবে। এবং নায়িকা হিসেবে আমার পরিচিত একটি মেয়ে থাকবে। আপনি তাকে চেনেন। আপনার বর্তমান ছবিতে কাজ করছে। রেশমা।

রেশমা?

হ্যাঁ।

আপনি স্যার দেড় কোটি টাকা খরচ করছেন, ইচ্ছে করলে বর্তমানের সবচে’ হিট নায়িকা নিতে পারেন।

আমি ঐ মেয়েটিকে নিতে চাচ্ছি।

স্যার কিছু মনে করবেন না। ওর চেহারায় গ্ল্যামার নেই। ছবির জগতটাই হলো গ্ল্যামারের।

ফিল্ম লাইনের মেকআপ দিনকে রাত করতে পারে। সামান্য গ্ল্যামার আনতে পারবেন না?

সে রকম মেকআপম্যান স্যার আমাদের নেই।

না থাকলে বাইরে থেকে নিয়ে আসুন। মাদ্রাজ থেকে আনুন, বোম্বে থেকে আনুন। প্রয়োজন মনে করলে হলিউড থেকে আনুন।

শরবত চলে এসেছে। আজমল তরফদার অস্বস্তির সঙ্গে শরবতের গ্রাস হাতে নিলেন। তাঁর কাছে মনে হলো–পাঞ্জাবি গায়ে বসে থাকা ছোটখাটো মানুষটা আসলে মাকড়সার মতো। সূক্ষ্ম জাল ফেলে রাখে। সে জাল চোখে দেখা যায় না। জালে জড়িয়ে পড়ার পরই শুধু জালটা স্পষ্ট হয়।

আজমল সাহেব।

জ্বি স্যার।

এই নিন। আপনার চেক।

টেবিলের ড্রয়ার থেকে চেক বের হলো। আজমল তরফদার হাত বাড়িয়ে যন্ত্রের মতো চেকটা নিলেন। চাপা গলায় বললেন, আপনার সঙ্গে আমার আবার কবে দেখা হবে?

আর দেখা হবে না। আমার লোক আপনার সঙ্গে সাৰ্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে।

যদি বিশেষ কোনো প্রয়োজন পড়ে?

প্রয়োজন পড়লে আমি আছি। আমি তো দেশেই থাকি। তবে নানান কাজে ব্যস্ত থাকি।

ছবির গল্প কি আমিই সিলেক্ট করব?

অবশ্যই আপনি করবেন।

আপনাকে দেখানোর কোনো দরকার নেই?

না।

এফডিসির ক্যামেরা না নিয়ে প্রাইভেট পার্টির ক্যামেরা দিয়ে যদি কাজ করি আপনার আপত্তি আছে? জার্মানির এরি থ্রি ক্যামেরা। নতুন এসেছে। এরা টাকা একটু বেশি নেবে কিন্তু কাজ হবে খুব ভালো।

আপনি কাজ করবেন স্বাধীনভাবে। আমি বা আমার লোকজন কখনোই আপনার স্বাধীন কাজে বাধা দেবে না।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

আজমল তরফদার উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পা সামান্য টলছে। সম্ভবত পার পর দু’পেগ ভদকার জন্যে এটা হয়েছে। ভদকা হঠাৎ করে ‘কিক’ দেয়। এটা কি ভদকার কিক, না অন্য কিছু? স্কুল টিচারের মতো দেখতে এই লোকটা তাকে নার্ভাস করে দিয়েছে।

স্যার।

বলুন।

আর্টিস্টদের সঙ্গে কি যোগাযোগ করব?

স্টোরি লাইন ঠিক হবার আগে আর্টিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন কীভাবে?

এদিকের নিয়ম হচ্ছে স্যার–আগে আর্টিস্ট ঠিক করা হয় তারপর স্টোরি লাইন।

নিয়ম যা তাই করবেন। তবে রেশমা মেয়েটিকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি ডিসিশান বদলাতেও পারি।

যদি কিছু মনে না করেন স্যার তাহলে ডিসিশান বদলানো ভালো হবে। সম্পূর্ণ নতুন মেয়ে নেয়া এক কথা আর দিনের পর দিন এক্সটার রোল করছে এমন একজনকে নেয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। নতুন একজন নায়িকার জন্যে দর্শকদের কৌতুহল আছে। এক্সট্রা মেয়েদের জন্যে দর্শকদের কৌতুহল নেই। স্যার যাই।

মোবারক সাহেব জবাব দিলেন না। আজমল তরফদারের পা সত্যি সত্যি টলছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি প্রয়োজনের চেয়েও বেশি বার ‘স্যার’ ‘স্যার’ করেছেন। এত ‘স্যার’ ‘স্যার’ করার কোনো দরকার ছিল না। এটা তো আর  মিলিটারি একাডেমি না যে স্যারের উপর দুনিয়া চলবে।

 

মোবারক সাহেব ঘরে একা বসে আছেন। আজমল তরফদার নামের সিনেমায় এই লোক তাকে খুব বিরক্ত করেছে। লোকটার চোখে কোনো অসুখ আছে। টকটকে লাল চোখ। তিনি লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হচ্ছিলেন। বিরক্তি অনেক বাড়ল যখন সে মিথ্যা কথা বলে তার পাওনা বাড়াতে চাইল। লোভীর মতো লোকটির চেক নেয়াটাও চোখে লেগেছে।

পৃথিবীর সবচে’ অসুন্দর দৃশ্য হলো লোভে চকচক করা চোখ। আর সবচে’ সুন্দর দৃশ্য গভীর মমতায় আর্দ্র প্রেমিকার চোখ। তিনি দীর্ঘদিন লোভে চকচক করা চোখ দেখছেন। দেখে দেখে তিনি খানিকটা ক্লান্ত। তবে লোভী মানুষদের একটা ভালো দিক আছে। কোনো লোভী মানুষই আত্মহত্যার কথা ভাবে না। লোভ তাদের বাঁচিয়ে রাখার প্রেরণা জোগায়। তিনি লোভী হলে ভালো হতো, বেঁচে থেকে আনন্দ পেতেন। এখন বেঁচে থেকে কোনো আনন্দ পান না। আনন্দের জন্যে অতি নিম্নস্তরের কিছু কাণ্ড তিনি করছেন। তাতে তেমন লাভ হচ্ছে কি?

লোকমান উঁকি দিল। তিনি সহজ গলায় বললেন, কিছু বলবে লোকমান?

লোকমান বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আপনি ডাক্তার সাহেবকে আসতে বলেছেন, উনি এসেছেন।

এখানে নিয়ে এস।

দুপুরের খাবার কি স্যার এখানে দেব?

দাও। ডাক্তারকেও আমার সঙ্গে খেতে বলেছিলাম।

জ্বি স্যার জানি।

ডাক্তার আবদুর রশীদ ইএনটি স্পেশালিস্ট। মোবারক সাহেবের নাক-কান-গলার কোনো সমস্যা নেই। তবু রশীদ সাহেবকে তিনি প্রায়ই খবর দিয়ে আনেন কথা বলার জন্যে। রশীদ সাহেব ভদ্রলোকের অনেক ক’টা বিলিতি ডিগ্রি আছে কিন্তু প্র্যাকটিস নেই। ইএনটি স্পেশালিস্টরা রোগী সামলাতে হিমশিম খান। রশীদ সাহেবের সেই সমস্যা নেই। তার বেশিরভাগ সময় কাটে খবরের কাগজ পড়ে। তিনি চারটি খবরের কাগজ রাখেন। চেম্বারে বসে চারটা খবরের কাগজ পড়ারই তাঁর সময় হয়।

এই মানুষটির বিস্মিত হবার ক্ষমতা অসাধারণ। মোবারক সাহেব মাঝেমধ্যে তাকে খবর দিয়ে আনেন। সামান্য ব্যাপারে ভদ্রলোককে বিস্মিত হতে দেখেন। তার ভালো লাগে। মেডিকেল কলেজের একজন নামি অধ্যাপক–তাকে তো আর যখন তখন খবর দিয়ে আনা যায় না। অসুখের একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে খবর দিতে হয়। রোগ দেখানোর পর অবিশ্বাস্য অঙ্কের একটা চেক তাঁর হাতে দেয়া হয়। তিনি চেকটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ খুব হৈচৈ করেন–করেছেন কী! পত্রিকাওয়ালারা জানলে তো নিউজ করে ফেলবে। অসম্ভব, এই চেক আমি নিতে পারি না। আপনার যদি টাকা বেশি হয়ে থাকে এবং দান করতে যদি কষ্ট হয় তাহলে দয়া করে টাকাগুলো পুড়িয়ে ফেলুন। আমাকে নষ্ট করবেন না। আমি এমনিতেই নষ্ট।

ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত চেকটা নেন। এবং ছেলেমানুষের মতো বলে ফেলেন–চেকটা পেয়ে খুব উপকার হয়েছে, প্র্যাকটিস বলতে কিছুই নাই। চেম্বারে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট রেখেছিলাম, তিন মাস বেতন না দেয়ায় চলে গেছে। শুধু হাতে যায় নি, আমার ইন্সট্রুমেন্ট বক্স নিয়ে পালিয়ে গেছে। ত্রিশ-পঁয়ত্ৰিশ হাজার টাকা দামের ইন্সট্রুমেন্ট।

রশীদ সাহেব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, মোবারক সাহেব, আবার আপনার কী হলো?

ঢোক গিলতে ক’দিন ধরে সমস্যা হচ্ছে।

টনসিলাইটিস নাকি?  হাঁ করুন তো।

এক্ষুণি হাঁ করব না। খানিকক্ষণ গল্পগুজব করুন তারপর হাঁ করি।

আরে সর্বনাশ! এগুলো কি গোলাপ নাকি। আপনি করেছেন কী–ছাদে দেখি আমার আগুন লাগিয়ে ফেলেছেন! দু’টা মিনিট সময় দিন আমি একটু বাগানটা দেখে আসি।

রশীদ সাহেব গভীর আনন্দে গোলাপ দেখে বেড়ান। মোবারক সাহেব তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। রশীদ সাহেবকে তিনি ব্যবহার করেন। ঠিক একইভাবে তিনি আরো অনেককে ব্যবহার করেন। কিন্তু তারপরেও তাঁর কিছুই ভালো লাগে না। পর পর দু’বার তিনি তিনতলার বারান্দা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়তে গিয়ে পড়েন নি। আরো একবার একরকম কিছু হবে। সেই বার তিনি হয়তো সত্যি সত্যি লাফিয়ে পড়বেন।

জীবনের বৈচিত্র্যের জন্যে টেপীর মতো মেয়েদের তিনি মাঝে মাঝে নিয়ে আসেন। তাদের কেউ কেউ অদ্ভুত সব কাণ্ড করে। কিছুক্ষণের জন্যে জীবনটা ইন্টারেস্টিং মনে হয়–তারপর আবার সেই ক্লান্তিকর দীর্ঘ দিবস। দীর্ঘ রাজনী। একবার বাইশ-তেইশ বছর বয়সী একটি মেয়ে এসেছিল। সে ভয়ে এবং লজ্জায় মরে যাচ্ছে। বিছানার এক কোণায় বসেছিল। মোবারক সাহেবকে দেখেই চট করে উঠে দাঁড়াল। হড়বড় করে বলল, আমি ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারি না। আমি কিন্তু কাপড় খুলব না।

সেদিন তিনি প্ৰাণ খুলে হেসেছিলেন। মেয়েটিকে কাপড় খুলতে হয় নি। তিনি তাকে কফি বানিয়ে খাইয়েছেন। যতদূর মনে পড়ে তাকে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তাকে বলেছিলেন, তোমার যখনই টাকা-পয়সার সমস্যা হবে তুমি আমার কাছে আসবে, টাকা নিয়ে যাবে।

মেয়েটি আর আসে নি। তিনি খবর নিয়েছিলেন। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। সে স্বামীর সঙ্গে জামালপুরে থাকে। সে সুখেই আছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই সুখে থাকে। অল্প কিছু লোক থাকে অসুখী–তারা শুধু সুখী মানুষ খুঁজে বেড়ায়।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ