দি আল মদিনা রেস্টুরেন্টের মালিক গত দুদিন ধরে উত্তেজনাময় সময় কাটাচ্ছে। সে সার্বক্ষণিকভাবে সফিকদের সঙ্গে আছে। দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করছে। তার খুবই ভালো লাগছে। সবাই তার নাম দিয়েছে হংস বাবু। এতেও সে খুব মজা পাচ্ছে। হংস বাবু ডাকলেও সবাই যে তার মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এতেই সে আনন্দিত। লেখাপড়া জানা শিক্ষিত সব ছেলে। এমএ, বিএ পাস। তার মতো মূর্খ হোটেল মালিকের সঙ্গে এদের কথা বলারই কথা না। অথচ কী আশ্চর্য কথা! গুরুত্বপূর্ণ যে-কোনো সিদ্ধান্তের সময় তার মতামত জানতে চাওয়া হচ্ছে।

টেলিভিশনওয়ালারা ছবি তুলতে এসেছিল। সেখানে তারা অনেকের সঙ্গে তাকেও প্রশ্ন করেছে। সে ঠিকঠাক মতো জবাব দিয়েছে। সফিক ভাই বলেছেন। জবাব ভালো হয়েছে। টেলিভিশনওয়ালারা জিজ্ঞেস করেছে— আপনার নাম কী?

খায়রুল বলেছে, জনাব, আমার নাম খায়রুল। আমি আল মদিনা হোটেলের মালিক।

এদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?

খায়রুল ফ্যাসফ্যাসে গলায় কিন্তু স্পষ্ট করেই জবাব দিয়েছে। সে বলেছে, জনাব, আমি প্রথমে মজা দেখতে আসছিলাম। পরে দেখলাম বড়ই জটিল ঘটনা। আর যাইতে পারলাম না।

জটিল ঘটনা বলছেন কেন?

একটা শিক্ষিত জোয়ান ছেলে গায়ে আগুন লাগায়ে মরে যাবে। জটিল ঘটনা না?

আজ এক তারিখ ঘোষণা অনুযায়ী আগামীকাল রাত বারটা এক মিনিটে হারুনের গায়ে আগুন লাগাবার কথা। সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। সফিক মোটামুটি নিশ্চিত ছিল— আজ দিনের মধ্যেই সরকার পক্ষের কেউ না কেউ আসবে। সরকার বেকার সমস্যার সমাধানের জন্যে যে-সব গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা জ্বালাময়ী ভাষায় বলবে। গায়ে আগুন দেয়াটা ধামাচাপা দেয়া যাবে। এখন পর্যন্ত সে-রকম কিছু ঘটে নি। যুব মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন আজ সকালে আসবেন। এখন জানা গেছে তিনি তার এলাকায় গেছেন। দুদিন থাকবেন।

বিরোধী দলের কেউ এগিয়ে এলেও হতো। তাদের জন্যে এটা ভালো সুযোগ। এই ইস্যুতে তারা সরকারকে ধুয়ে ফেলতে পারবে। এমন একটা মারাত্মক ইস্যু কিন্তু বিরোধী দলের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। শেষ ভরসা কবি-সাহিত্যিকদের কেউ।

মহসিন গিয়েছিল কবি শামসুর রাহমান সাহেবের কাছে। হাতে-পায়ে ধরে তাকে যদি রাজি করানো যায়। তিনি আসবেন, আবেগময় ভাষায় কিছু কথা বলবেন। তারপর হারুনকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাবেন। মহসিন ফিরে এসেছে। কবি খুবই অসুস্থ। আসতে পারবেন না।

বিকেল থেকেই লোক জমতে শুরু করেছে। এমন জনসমাগমে খুশি হওয়া উচিত। সফিক খুশি হতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে লক্ষণ ভালো না। আজই এত লোক, আগামীকাল না জানি কত হবে। পাবলিক মজা দেখার জন্যে আসবে। তাদেরকে ঠিকমতো মজা দিতে না পারলে সমস্যা আছে।

ষণ্ডাগুণ্ডা ধরনের এক লোক এসে হারুনকে বলেছে, আগুন কি সত্যই দিবেন? ভাওতাবাজি না তো? ফুটবেন না তো?

লোকটার কথার ধরনে কলিজা শুকিয়ে যাবার কথা। হারুন অবশ্যি শান্ত গলায় বলেছে, আগামীকাল রাত বারটা এক মিনিটে অবশ্যই আগুন দেয়া হবে। ক্যামেরা আছে? না থাকলে মনে করে ক্যামেরা নিয়ে আসবেন, ছবি তুলে রাখবেন।

চা-ওয়ালা, বাদামওয়ালা, ফুচকাওয়ালারা চলে এসেছে। লোকজন ফুচকা খাচ্ছে। সবার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারা মজার কোনো ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছে। বিদেশী দুই সাহেবও এসেছেন। তারা ছোট ভিডিও ক্যামেরায় প্রচুর ছবি তুলেছেন। ছবি তোলার পর তারা চলে গেলেন না। খুবই মজা করে ফুচকা খাচ্ছেন।

খায়রুল সফিককে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল— সফিক ভাই, অবস্থা তো খুব খারাপ।

সফিক বলল, খারাপ বলছেন কেন?

আগামীকালের কথা চিন্তা করে কলিজায় পানি চলে এসেছে। মানুষ এখন পিশাচ হয়ে গেছে। গায়ে আগুন না দেখে এরা যাবে না।

সফিক চিন্তিত গলায় বলল, সে-রকমই তো মনে হচ্ছে।

খায়রুল বলল, প্রয়োজনে এরা নিজেরা হারুন ভাইয়ের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দিবে।

সফিক বলল, পালায়ে যাওয়া যায় না?

খায়রুল চিন্তিত গলায় বলল, পালাইতে গেলে শক্ত মাইর খাওয়ার সম্ভাবনা।

সফিক বলল, কথা ভুল বলেন নাই। সব সাইকোলজি বোঝা মুশকিল। দেখা যাবে আমাদের সবার গায়েই কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দিয়েছে। সবাই এক সঙ্গে কয়লা হয়ে গেলাম।

এক পত্রিকা থেকে হারুনের ইন্টারভিউ নিতে এসেছে। চিড়িং বিড়িং টাইপ বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে। চোখেমুখে কথা বলে। হারুন ইন্টারভিউ দিচ্ছে। কী বলতে কী বলে ফেলে এই ভয়ে মহসিন তাকে সাহায্য করতে গিয়েছিল। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বলেছে, আপনিও কি আত্মাহুতিতে আছেন?

মহসিন বলল, না। মেয়েটি বলল, তাহলে আপনি কথা বলবেন না। যেদিন আপনিও আত্মাহুতির সিদ্ধান্ত নেবেন সেদিন আপনার ইন্টারভিউ নেব।

এই ধরনের মেয়েরা প্যাচে ফেলে অনেক গোপন কথা বের করে ফেলে। কিন্তু হারুন বেশ সহজভাবেই কথা বলছে। তাকে পঁাচে ফেলা যাচ্ছে না।

আপনি নিশ্চিত যে আগামীকাল রাত বারটা এক মিনিটে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেবেন?

হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।

গায়ে আগুন দেবার আগে যে কথাগুলি সবার উদ্দেশে বলবেন সেগুলি কি এখন বলবেন? আমি লিখে নিতে পারি।

তখন কী বলব তা তো জানি না।

আপনার বাবা আপনার মা— তারা এই ব্যাপারটা কীভাবে নিচ্ছেন?

আমি জানি না। তাদের জিজ্ঞেস করুন।

আমার কাছে কিন্তু মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটাই সাজানো নাটক। আগামীকাল সন্ধ্যার পর থেকে আপনাকে এখানে পাওয়া যাবে না।

আপনার কী মনে হচ্ছে না হচ্ছে সেটা আপনার ব্যাপার।

কী খাচ্ছেন?

চা খাচ্ছি। আলুর চপ খাচ্ছি। আমি অনশন করছি না। আমার খেতে বাধা নেই। আপনি চা খাবেন? দিতে বলি?

সফিক দূরে দাঁড়িয়ে বলল, খাল কেটে কুমীরের বদলে পাবলিক নিয়ে এসেছি। কুমীর সামলানো যায়। পাবলিক যায় না। আমাদের সামনে মহাবিপদ।

 

মুহিব তার বাবার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘর তালা দেয়া। সে চিন্তিত বোধ করল না। নিউ হোমিও হল খোলা আছে। এখানে আসার পথে চোখে পড়েছে। বুড়ো এক চশমা পরা ভদ্রলোক কুঁজো হয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। তার কাছে গেলেই খোঁজ পাওয়া যাবে।

ডাক্তার সাহেবের নাম হাবীবুল্লাহ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। তিনি খবরের কাগজ থেকে একবার চোখ তুলে মুহিবকে দেখলেন। সে কী জন্যে এসেছে তা শুনলেন। হাত ইশারায় তাকে বসতে বলে আবারো কাগজ পড়তে লাগলেন। মুহিব কাঠের বেঞ্চে চুপচাপ বসে রইল। সকালবেলার বাসি খবরের কাগজ সে এর আগে কাউকে এত আগ্রহ করে পড়তে দেখে নি।

এক সময় তাঁর কাগজ পড়া শেষ হলো। তিনি মুহিবের দিকে কঠিন চোখে তাকালেন।

শামসুদ্দিন সাহেব তোমার পিতা?

জি।

পিতার খোঁজে এসেছ?

জি।

কে বলেছে যে আমি তার খোঁজ জানি?

আপনি জানেন না?

জানলেও বলব না।

বলবেন না?

না। বৃদ্ধ পিতা। অসুস্থ, জ্বরে কাতর। তাকে বাড়ি থেকে পুলিশ দিয়ে বের করে দিয়েছে। জ্বরের কারণে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না— আর আজ তুমি এসেছ পিতার খোঁজে? ফিটফাট বাবু সেজে এসেছ, গলায় টাই।

মুহিব চুপ করে আছে। বৃদ্ধকে রাগ কমানোর সময় দিতে হবে। খুব যারা রাগী তাদের রাগ ঝপ করে পড়ে যায়। তখন তাদের প্রতিটি কথা মায়ায় ড়ুবানো থাকে। এই বৃদ্ধের রাগ এক্ষুণি পড়বে।

তোমার নাম কী?

মুহিব।

ও! তাহলে তোমার নামই হুঁ-বাবা?

জি।

তোমার পিতা একবার খুবই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আজরাইলে-মানুষে দড়ি টানাটানি। আমি রোজ সন্ধ্যায় তোমার বাবার বিছানার পাশে বসে থাকতাম তখন তো তোমাকে দেখি নাই। কোথায় ছিলা? ফূর্তি করতে ছিলা?

আমি খবর পাই নি। আমি সব সময় যে বাবার কাছে আসি তা-না। হঠাৎ হঠাৎ আসি।

তুমি তো দেখি বিরাট লায়েক পুত্র। হঠাৎ হঠাৎ আস। দরকার কী হঠাৎ হঠাৎ আসার? গলায় টাই বেঁধে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াও। মদ খাও না তুমি? অবশ্যই খাও। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে মদ খাওয়া লালটু চেহারা। তোমার সঙ্গে কথা বলা মানে সময় নষ্ট। মনের শান্তি নষ্ট। তুমি বিদায় হও।

মুহিব বসে রইল। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, বৃদ্ধের রাগারাগি শুনতে তার ভালো লাগছে। বৃদ্ধের গলায় রাগ আছে কিন্তু চোখে মায়া চলে এসেছে।

হুঁ-বাবা, আমার কথা মন দিয়ে শোন তোমার পিতা কোথায় আছেন আমি জানি না। তিনি বলেছেন কোনো একটা থাকার জায়গা খুঁজে বের করে আমাকে জানিয়ে যাবেন। বুঝতে পেরেছ?

জি।

আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। তাহলেই খোঁজ পাবে। তোমার সঙ্গে আমি খারাপ ব্যবহার করেছি, মনে কষ্ট নিও না। তুমি হলে বন্ধুপুত্র, বন্ধুপুত্র পুত্রের মতো। তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার অধিকার আছে। আছে কি-না বলো।

জি আছে। চাচা আমি উঠি।

কিছু মুখে না দিয়ে উঠবে মানে কী? গরম সিঙাড়া দিয়ে চা খাও, তারপর যেখানে ইচ্ছা যাও। চড়ে বেড়াও।

গরম সিঙাড়া কোথায়?

বাসা থেকে আসবে। আমার বড় বৌমা নিজের হাতে বানিয়ে পাঠায়। একটা সিঙাড়া খেলে স্বাদ বাকি জীবন মুখে লেগে থাকবে।

মুহিব চুপচাপ বসে আছে। বসে থাকতে ভালো লাগছে। বৃদ্ধ চেয়ারে পা তুলে আরাম করে বসেছেন। এতক্ষণ চোখে চশমা ছিল না। এখন চশমা পরেছেন। তীক্ষ্ণ চোখে মুহিবকে দেখছেন।

তোমার বাবা সব সময় বলত— আমার ছোট ছেলে গ্রিক দেবতা এপোলোর। চেয়েও সুন্দর। তার কথাকে তেমন গুরুত্ব দেই নাই। বাবা-মারা নিজের সন্তানদের সম্পর্কে এই ধরনের কথা সব সময় বলে। কিন্তু এখন দেখছি তোমার বাবার কথায় অতিরঞ্জন থাকলেও বেশি না। আমি তোমার মতো সুন্দর চেহারার ছেলে একটা দেখেছিলাম। আখাউড়া রেলস্টেশনে। সে কমলা কিনছিল। সেই ছেলের চেহারা এখনো চোখে ভাসে। তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি— এটা মনে পুষে রাখ নাই তো?

জি না।

আমি নিজের রাগ কমানোর অনেক চেষ্টা করছি। হোমিওপ্যাথিতে একটা ওষুধ আছে থুজা। এর দুইশ পাওয়ার আমার মতো মানুষদের রাগ কমায়। ওষুধ খাচ্ছি, কাজ হচ্ছে না। নিজের ওষুধ নিজের উপর কাজ করে না।

মুহিব বলল, চাচা, রাগ বাড়ানোর কোনো ওষুধ কি আছে?

বৃদ্ধ বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?

মুহিব বলল, রাগ বাড়ানোর ওষুধ থাকলে আমি খেতাম। আমার মধ্যে কোনো রাগ নেই। বাবার কোনো স্বভাব আমি পাই নি, এই একটা স্বভাব পেয়েছি। বাবার যেমন রাগ নেই, আমারও নেই। একটু রাগ থাকলে ভালো হতো।

বৃদ্ধ মুহিবের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখ মমতা এবং ভালোবাসায় আর্দ্র।

 

সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এমন বৃষ্টি যে মাথায় ছাতা ধরতেও ইচ্ছা করে না, আবার ছাতা ছাড়া হাঁটতেও ভালো লাগে না। মুহিব বৃষ্টির ভেতর হাঁটছে। ঝুম বৃষ্টির সময় রিকশা বেবিটেক্সি কিছুই পাওয়া যায় না। টিপটিপ বৃষ্টির সময় একটু পরে পরে খালি রিকশা এসে পাশে থামে। রিকশাওয়ালা আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়— কই যাবেন? পারলে জোর করে রিকশায় তুলে নিবে এমন অবস্থা।

মুহিব কোথায় যাবে সে জানে। নোরার কাছে যাবে। নোরা হিপনোটাইজ না কী যেন করবে। কিন্তু মুহিবের মনে হচ্ছে নোরার কাছে যাবার আগে তাকে অন্য কোথাও যেতে হবে। সেটা কোথায় তা মনে পড়ছে না। চেতন মন অবচেতন মনের কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই। সে কোথায় যাবে তা অবচেতন মনে আছে, চেতন মনে নেই।

তার কি মার কাছে যাবার কথা? মাকে সে-রকম কোনো কথা দিয়ে এসেছে? না-কি বড়চাচার কাছে যেতে হবে? বড়চাচা তাকে কিছু কিনতে দিয়েছেন, সে ভুলে গেছে। পাথরের হামানদিস্তা ধরনের কিছু। দি আল মদিনা হোটেলের খায়রুলের সঙ্গে কি ফার্নিচার কিনতে যাবার কথা দিয়ে ভুলে গেছে? কোনো কিছুই মনে পড়ছে না। তার কি আলজেমিয়ার্স ডিজিজ হতে যাচ্ছে? হলে মন্দ হয় না। ক খ গ ঘ থেকে শুরু করা।

নোরাদের বাড়িতে যাবার জন্যে রিকশায় ওঠা মাত্র মুহিবের মনে পড়ল তার আসলে যাবার কথা যূথীদের বাড়িতে। এই সিদ্ধান্ত সে নিজে নেয় নি। কেউ তাকে নিতেও বলে নি। সিদ্ধান্তটা মনের গভীরে কোনো এক অন্ধকার কোণায় লুকিয়ে ছিল। হঠাৎ বের হয়ে এসেছে।

 

দরজা খুলল যূথী।

মুহিব বলল, আমার নাম মুহিব। আপনি আমার খোঁজ করছিলেন।

যূথী কিছু বলল না। সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি স্থির। মুহিব বলল, আপনি বোধহয় আমাকে চিনতে পারছেন না?

যূথী বলল, চিনতে পারব না কেন? আসুন, ভেতরে আসুন।

মুহিব ঘরে ঢুকল। যূথী বেতের সোফার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, বসুন এখানে। যূথীর গলার স্বর কঠিন তবে শান্ত। মুহিব বসল। যূথী বসল ঠিক তার সামনের চেয়ারে। চাইনিজ হোটেলগুলি যেমন অন্ধকার অন্ধকার থাকে, বসার ঘরটাও সেরকম অন্ধকার। যদিও দুটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। ঘরে মনে হচ্ছে কোনো লোকজনও নেই। যূথী একা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানেও শব্দ নেই।

যূথী বলল, আমি আপনাকে খুঁজছিলাম। আপনি যে সত্যি সত্যি আসবেন আমি ভাবি নি। আপনাকে আসতে দেখে আমি অবাকই হয়েছি। বাবাকে এখান থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে যে কাণ্ড করেছেন তারপর আমাদের মুখ দেখানোর কথা না। আপনি সাহসী মানুষ।

মুহিব বসে আছে। তাকিয়ে আছে যূথীর দিকে। তার খুবই পানির পিপাসা হচ্ছে। বুক-গলা শুকিয়ে কাঠ। পানির কথাটা যূথীকে কখন বলবে বুঝতে পারছে না।

যূথী বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মনে হয় সে নিজেকে সামলাচ্ছে। ঐ রাতে মেয়েটাকে তেমন রূপবতী মনে হয় নি। আজ মনে হচ্ছে। রেগে গেলে কোনো কোনো মেয়েকে সুন্দর লাগে। এই মেয়েটি মনে হয় সেই রকম। মেয়েটি যাকে বিয়ে করবে তার উচিত হবে সারাক্ষণ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেয়েটিকে রাগিয়ে রাখা। মুহিব বলল, আমাকে কেন ডেকেছেন?

যূথী বলল, আপনাকে ডেকেছি বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবার জন্যে। ঐ রাতের ঘটনার পর বাবার মাথায় কোনো কিছু হয়েছে। এলোমেলো কথা বলেন। মাঝে মাঝে আমাকেও চিনতে পারেন না। পিজির একজন সাইকিয়াট্রিস্ট বাবার চিকিৎসা করছেন। পিজির ঐ সাইকিয়াট্রিস্ট প্রফেসর রহমতউল্লা আপনাকে খবর দিয়ে আনতে বলেছেন।

কেন?

কারণ, বাবা শুধু আপনার কথা বলেন। আপনার ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকে গেছে। তার কথা শুনে মনে হয় এই পৃথিবীতে আপনি ছাড়া তার কোনো প্রিয়জন নেই।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

বাবার সঙ্গে কথা না বললে বুঝবেন না। ঐ রাতে প্রথম যখন আপনি আমাদের বাসায় ঢুকলেন, বাবা আপনাকে দেখে কী কারণে জানি খুবই খুশি হয়েছিলেন। আপনাকে তার অত্যন্ত আপনজন মনে হয়েছিল। ঐ অংশটাই বাবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর সব ধুয়ে মুছে গেছে।

উনি কোথায়?

বাবা বাসায় আছেন।

উনার সঙ্গে দেখা করে আমাকে কী বলতে হবে?

আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আপনি শুধু তার কথা শুনবেন। তার প্রতিটি কথায় সায় দিয়ে যাবেন। তারপর যেখান থেকে এসেছেন সেখানে চলে যাবেন।

ঠিক আছে।

আপনাকে আরেকটা কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি।

বলুন।

আপনার মতো খারাপ মানুষ আমি আমার জীবনে দেখি নি। কোনো দিন দেখব এরকম মনে করি না। আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতেও আমার ঘেন্না লাগছে।

আমি এক গ্লাস পানি খাব।

বাবার সঙ্গে দেখা করে আপনি চলে যাবেন। আমি আপনাকে পানি এনে দেব না।

 

অতি রুগ্ন একজন মানুষ বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। জাগ্রত মানুষ মূর্তির মতো শুয়ে থাকতে পারে না। সে সামান্য হলেও নড়াচড়া করে। মানুষটা তা করছে না। তাকে দেখে মনে হবে যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতায় মানুষটা শবদেহ সেজেছে। প্রতিযোগিতায় সে ফার্স্ট প্রাইজ জিতে নেবে এমন সম্ভাবনা আছে। যূথী শবদেহের কাছে গিয়ে বলল–বাবা, মুহিব সাহেব এসেছেন।

শবদেহে সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ সঞ্চার হলো। আরজু সাহেব হাতে ভর দিয়ে বিছানায় উঠে বসে অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বলল, কখন এসেছ মুহিব?

মুহিব বলল, এই তো কিছুক্ষণ আগে।

আরজু বললেন, সেই কবে তোমার চা খেতে আসার কথা। আমি রোজ দুই তিন বার করে যূথীকে জিজ্ঞেস করি, মুহিব এসেছে? যূথী বলে–না।

মুহিব বলল, আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম বলে আসতে পারি নি।

ভদ্রলোক আনন্দিত গলায় বললেন, আমি যূথীকে ঠিক এই কথাই বলেছি। আমি বলেছি মুহিব ঢাকার বাইরে আছে। ঢাকায় থাকলে অবশ্যই আসত। কথা দিয়ে কথা রাখবে না মুহিব এমন ছেলে না। আমি তার নাড়ি-নক্ষত্র চিনি। মুহিব, আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তুমি যূথীকে জিজ্ঞেস কর।

মুহিব বলল, আপনার কথা বিশ্বাস হবে না কেন? অবশ্যই বিশ্বাস হচ্ছে।

না না, কোনোরকম সন্দেহ থাকা উচিত না। যূথী তুই বল আমি তোকে বলেছি না মুহিব ঢাকায় নেই?

যূথী যন্ত্রের মতো গলায় বলল—হ্যাঁ, বলেছ।

মুহিব বলল— যূথী, আপনি চা নিয়ে আসুন। আপনার বাবার সঙ্গে বসে চা খাই।

আরজু সাহেব বললেন, এখন কী চা খাবে? রাত নটা বাজে। রাত নটার সময় কেউ চা খায়? তুমি ভাত খেয়ে যাবে।

যূথী বলল— বাবা, উনাকে খেতে দেবার মতো কিছু ঘরে নেই।

আরজু সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, মুহিবকে খাওয়ানোর জন্যে কি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কালিয়া লাগবে? সে ঘরের ছেলে। যা আছে তাই খাবে।

যূথী কঠিন গলায় বলল— বাবা, ঘরে কিছুই নেই।

শুকনা মরিচ আছে? শুকনা মরিচ ভেজে পেঁয়াজ দিয়ে ডালের ভর্তা বানিয়ে দে। আমি আর মুহিব শুকনা মরিচ দিয়েই ভাত খাব। ডাল যদি থাকে তো ভালো। না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই।

মুহিব বলল, আরেকদিন এসে খেয়ে যাব। আজ আমার একজনের সঙ্গে দেখা করতে যেতেই হবে। কথা দিয়ে রেখেছি। সে অপেক্ষা করে আছে।

ভদ্রলোক বললেন, কথা দিয়ে থাকলে যাও। কথার বরখেলাপ আমার পছন্দ। কাজ সেরে চলে এসো। রাত একটা দুটা তিনটা কোনো অসুবিধা নেই। আমার শরীরটা ভালো না। রাতে এমনিতেই ঘুম হয় না। বলতে গেলে সারারাত জেগেই থাকি। ডাক্তারদের ধারণা মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। চিকিৎসা হচ্ছে। বাবা, তুমি কিন্তু চলে আসবে। যদি রাত বেশি হয়ে যায়, খাওয়া-দাওয়া করে এখানেই শুয়ে থাকবে। আলাদা ঘর আছে। আরাম করে ঘুমাবে।

যূথী মুহিবকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে চাপা গলায় বলল, আপনি অবশ্যই আসবেন না। অবশ্যই না। আপনাকে খবর দিয়ে আনাই আমার ভুল হয়েছে। বাবাকে সুস্থ করার জন্যে আমার আপনার মতো দুষ্ট মানুষের প্রয়োজন নেই।

মুহিব কিছু বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। যূথী তীব্র গলায় বলল, এত বড় অন্যায় করার পরেও আপনি কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্ষমা চান নি।

আপনার বাবার কাছে ক্ষমা চাওয়া ঠিক হবে না। ক্ষমা চাইলেই পুরনো ঘটনা মনে পড়ে যেতে পারে।

একটু দাঁড়ান। পানি খেতে চেয়েছিলেন, পানি নিয়ে আসি।

আমার পানির তৃষ্ণা চলে গেছে। পানি লাগবে না।

মুহিব সিড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। একবার পিছন ফিরে তাকাল। যুথী মেয়েটা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা কাঁদছে। রাগে-দুঃখে কাঁদছে। কাঁদলেও কি মেয়েটাকে সুন্দর দেখায়? নিশ্চিত হবার জন্যে আরেকবার তাকানো দরকার। মুহিব তাকাল না। রাস্তায় নেমে এলো।

বৃষ্টি বেড়েছে। এখন বড় বড় ফোঁটা পড়ছে। সামান্য বাতাসও দিচ্ছে। রাত বেশি হয় নি, মাত্র নটা বাজে। বৃষ্টি বাদলার কারণে রাস্তায় লোক চলাচল কম। মনে হচ্ছে অনেক রাত। মুহিব মন স্থির করতে পারছে না। সরাসরি নোরাদের বাড়িতে চলে যাবে নাকি প্রেসক্লাব হয়ে তারপর যাবে।

মুহিব রিকশা নিল। রিকশাওয়ালা রিকশার হুড তুলতে গেল। মুহিব বলল, লাগবে না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাব। রিকশাওয়ালা সন্দেহ ভরা চোখ নিয়ে তাকাচ্ছে।

অনেক অনেক কাল আগে ময়মনসিংহ শহরে সে একবার তার বাবার সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামল। শামসুদ্দিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো হুঁ বাবা, বৃষ্টিতে ভিজবি? মুহিব বলল, হুঁ।

তিনি রিকশার হুড নামিয়ে দিলেন। দুজন বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে রিকশায় বসে আছে। লোকজন দেখে মজা পাচ্ছে। শামসুদ্দিন সাহেব ছেলেকে বললেন, হা করে বৃষ্টির পানি খা। ফ্রেস ওয়াটার। বৃষ্টির পানির টেস্টই অন্যরকম। চলন্ত রিকশায় বসে পিতাপুত্র দুজনই হা করে বৃষ্টির পানি খাওয়ার চেষ্টা করছে। আহারে, কী সুন্দর দৃশ্য!

মুহিব রাগী মেয়েটাকে বলেছিল পানির তৃষ্ণা মরে গেছে। কথাটা সত্যি না। তার তৃষ্ণা ভালোই আছে। সে শৈশবের মতো হা করে বৃষ্টির পানি খাবার চেষ্টা করছে।

রিকশাওয়ালা ঘাড় ফিরিয়ে চিন্তিত মুখে দৃশ্যটা দেখল। বিড়বিড় করে বলল, আপনে যাইবেন কই?

মুহিব বলল, কোথায় যাব সেই সিদ্ধান্ত এখনো নিতে পারি নি। প্রথমে প্রেসক্লাবে যেতে পারি আবার অন্য কোথাও যেতে পারি।

আমি ঐ দিকে যামু না। আপনে নামেন।

মুহিব শান্ত গলায় বলল, না গেলে যেও না। আমি কিন্তু রিকশা থেকে নামব না। তোমার রিকশাটা আমার পছন্দ হয়েছে।

রিকশাওয়ালা ভীত গলায় বলল, স্যার আমি গরিব মানুষ।

মুহিব বলল, আমিও গরিব মানুষ। গরিবে গরিবে কাটাকাটি। ঝামেলা না করে রিকশা চালাও। আমার কাছে শেষ পঞ্চাশটা টাকা আছে। পঞ্চাশ টাকায় যতটুক যাওয়া যায় যাবে। তবে শেষ দফায় এইখানে নিয়ে আসবে। যাত্রা যেখান থেকে শুরু সেখানেই শেষ।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। মুহিবের ভিজতে ভালো লাগছে।

 

সফিকদের পুরো দলটা এখন আছে খায়রুলের ফ্ল্যাট বাড়িতে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া হারুন অসুস্থ। তার জ্বর এসে গেছে, চোখ লাল। কথাবার্তাও কেমন অসুস্থ। সে চাদর গায়ে দিয়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। দলের সবাই প্রথমে এই ঘরেই ছিল। সিগারেটের গন্ধে হারুনের বমি আসছে বলে তারা অন্য ঘরে।

সফিক বলল, আমরা আর প্রেসক্লাবের সামনে ফিরে যাচ্ছি না। আত্মাহুতির কথা সবাই ভুলে যাও। যা করা হয়েছে যথেষ্ট করা হয়েছে। খামাখা গায়ে আগুন

মহসিন বলল, আমাদের পাবলিসিটি যা হয়েছে রাস্তায় আর নামা যাবে না। পাবলিক আমাদের দেখলেই ফটকাবাজ বলে গায়ে পেট্রোল ঢেলে দেবে।

সাবের বলল, পাবলিক আমাদের পাবে কোথায়? আমরা হাইবারনেশনে চলে যাব। খায়রুল ভাইয়ের একটা ভালো জায়গা পাওয়া গেছে। এইখানেই থাকব। এইখানেই ঘুমাব।

খায়রুল বলল, কোনো অসুবিধা নাই। যত দিন ইচ্ছা থাকেন।

মহসিন তার বিশেষ হাবিজাবি তৈরি করেছে। হাবিজাবির নাম খবর আছে। নরমালটা না, এক্সট্রা পাওয়ার। দুগ্লাস খেলেই খবর হয়ে যাবে বলেই নাম খবর আছে। কয়েকদফা শরবত খাওয়া হয়ে গেছে। এইসব হাবিজাবি খায়রুলের খাওয়ার অভ্যাস ছিল না। দলের সঙ্গে পড়ে পরপর তিন গ্লাস খেয়েছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এই জীবনে এত আনন্দ সে পায় নি। শিক্ষিত বিএ এমএ পাস ছেলেরা তার মতো মানুষের বাড়িতে সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে। দেখতেই ভালো লাগছে। খায়রুল বলল, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কি করব?

সফিক বলল, খাওয়ার ব্যবস্থার দরকার নেই। আজ সারারাত শুধু দাওয়া।

খায়রুল বলল, দাওয়া কী?

মহসিন বলল, যে জিনিস খাচ্ছেন তার নাম দাওয়া। আপনি তিনটা খেয়েছেন। চার নম্বর পেটে পড়লে বুঝবেন দাওয়া কাকে বলে।

খায়রুল বলল, এইসব খেয়ে মরে যাব না তো ভাইজান?

মহসিন বলল, মরে গেলে মরে যাবেন। বেঁচে থেকে লাভ কী?

খায়রুল বলল, কোনো লাভ নাই।

তৌফিক বলল, আপনি যে মাথার ঘাম পেয়ে ফেলে এত কষ্ট করে টাকাপয়সা করেছেন, লাভটা কী হয়েছে? মনের কষ্ট কি দূর হয়েছে?

জি-না, দূর হয় নাই।

তাহলে এসব রেখে লাভ কী? খবর আছে শরবত আরো দুই গ্লাস খান তারপর আসেন সবাই মিলে আপনার ফ্ল্যাট বাড়িতে আগুন দিয়ে দেই।

খায়রুল গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, আপনারা যা ভালো মনে করেন।

সাবের বলল, কোথাও না কোথাও আগুন দেয়া আমাদের জন্যে ফরজ হয়ে গেছে। গায়ে আগুন দিতে না পেরে হারুন বেচারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বড় কোনো আগুন দেখলে যদি তার মনটা ভালো হয়।

‘খবর আছে’ শরবত শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। মহসিন অতি ব্যস্ত হয়ে দ্বিতীয় দফা বানাচ্ছে। একজনকে পাঠানো হয়েছে বরফ আনতে।

মহসিন বলল, এইবার যে জিনিস বানাব তার নাম আগুন ধিকি ধিকি। চুমুকে চুমুকে শরীরে আগুন জ্বলবে।

ইয়াকুব বলল, আগুন ধিকি ধিকি নামটা ভালো লাগছে না। আগুন শব্দটা কেমন ম্যাড়া ম্যাড়া। পাওয়ার নেই। বরং অগ্নি ধিকিধিকি ভালো নাম। অগ্নি যুক্তাক্ষরের শব্দ। ফোর্সফুল হয়।

নীরব ঘাতক সাবের বলল, অগ্নি ফগ্নি কিছুই চলবে না। ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে নাম দিতে হবে। যেমন— Fire ধিকিধিকি।

মহসিন বলল, ফায়ার ছাড়া আগুনের আর কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ আছে?

ইয়াকুব বলল, নেই। ইংরেজি তো আর বাংলার মতো না। ওরা একটা শব্দ নিয়েই খুশি আর আমাদের আছে— আগুন, অগ্নি, অনল, বহি।

সফিক বলল, তোরা কী প্যাচাল শুরু করলি? নাম কোনটা সিলেক্ট হয়েছে? আগুন ধিকি ধিকি না-কি ফায়ার ধিকিধিকি?

মহসিন বলল, আমার কাছে কেন জানি ফায়ার ধিকিধিকিটা বেশি ভালো লাগছে।

সফিক বলল, তুই হচ্ছিস মূল কারিগর। তোর যদি ফায়ার ধিকিধিকি নাম ভালো লাগে তাহলে এই নামই থাকবে। এখন তাড়াতাড়ি জিনিস তৈরি কর।

মহসিন বলল, বরফ আসুক।

সাবের বলল, ফায়ার বানাতে বরফ লাগবে এটা কেমন কথা?

সফিক বলল, শুধু কথা। শুধু কথা। আমার কাছে অসহ্য লাগছে। বরং জিনিস আনতে আনতে গান-বাজনা হোক। খায়রুল ভাই, আপনার ফ্ল্যাটবাড়িতে গান-বাজনা করলে অসুবিধা আছে?

খায়রুল রাগী গলায় বলল, কীসের অসুবিধা? আমার নিজের টেকায় কিনা বাড়ি। কারো বাপের টেকায় কিনি নাই।

সাবের বলল, খায়রুল ভাইয়ের অবস্থা দেখেছিস? জিনিস মাত্র তিনটা পেটে পড়েছে, এর মধ্যেই গলা পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রতিটা শব্দ বোঝা যাচ্ছে।

সফিক গান শুরু করল—

আমরা পুতুলওয়ালা, পুতুল বেচে যাই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গানের কথাবার্তায় কিছু রদবদল হলো।

আমরা আগুনওয়ালা, আগুন দিয়ে যাই
কে নিবি ভাই
কার আগুন চাই
আমরা আগুনওয়ালা।

গানের মাঝামাঝি সময়ে মুহিব এসে উপস্থিত হলো। সফিক গান থামিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, তোর এতক্ষণে সময় হলো? ছিলি কোথায়?

মুহিব জবাব দিল না।

সফিক বলল, শরীর খারাপ নাকি? শরীর খারাপ লাগলে হারুনের সঙ্গে গিয়ে শুয়ে থাক।

মুহিব বলল, শরীর ঠিক আছে।

সফিক বলল, গায়ের কাপড় তো সব ভিজা। কাপড় বদলাবি না?

মুহিব বলল, না।

সে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল।

রাত দুটার দিকে সবার পেটেই কিছুটা ফায়ার ধিকিধিকি পড়ল। জিনিসটা সুস্বাদু। টক মিষ্টি ঝাল। তবে ঝাঁজ আগুনের মতোই। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে গেল। নীরব ঘাতক সাবের বলল, ফায়ার ধিকিধিকি খাওয়া হচ্ছে আগুন ছাড়া এটা কেমন কথা? টিন ভর্তি কেরোসিন তো আছেই। ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে কেমন হয়?

খায়রুল জড়ানো গলায় বলল, না তো ভাইজান করি নাই। দেন লাগায়ে। জ্বলেপুড়ে যাক।

মহসিন বলল, রোম নগরী যখন পুড়ছিল তখন নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিল।

সফিক বলল, একটা ফ্ল্যাট বাড়ি পুড়িয়ে কী হবে? পুরো দেশটা পুড়িয়ে দিতে পারলে মন শান্ত হতো।

সাবের বলল, দেশটা তো পুড়িয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সাধ্যে যা আছে তা করি। ফ্ল্যাটটায় আগুন লাগিয়ে পগার পার হয়ে যাই।

ফায়ার ধিকি ধিকির জগ শেষ হলো রাত তিনটায়। তিনটা দশ মিনিটে টিন ভর্তি কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে তারা শান্ত ভঙ্গিতে নিচে নেমে এলো। চারদিকে হৈচৈ চেঁচামেচি হচ্ছে। শুনতেও ভালো লাগছে। আগুন ভালোমতো ধরে গেছে। তিনতলার ফ্ল্যাট বাড়ির জানালা দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই দৃশ্যও সুন্দর।

সাবের বলল, কন্যার বাপে হুক্কা খায়, বুনকা বুনকা ধোয়া যায়।

সাবেরের ছড়া বলা শেষ হবার আগেই মুহিব চেঁচিয়ে বলল, হারুন ভাই কোথায়? হারুন ভাই তো নিচে নামে নাই। সর্বনাশ!

মুহিব ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। তার পেছনে পেছনে বন্ধুরাও উঠছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ