মনোয়ারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। নিজের ছেলেকে তাঁর অচেনা লাগছে। ফিটফাট সাহেব। সাদা প্যান্টের উপর হালকা সবুজ রঙের ফুলহাতা শার্ট। গলায় টাই ঝুলছে। টাইটার রঙও সবুজ। সবুজের উপর সবুজ দেখতে এত ভালো লাগছে। টাইপরা অবস্থায় মুহিবকে তিনি আগে দেখেন নি। মনোেয়ারা অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কী রে?

মুহিব বলল, তোমাকে সালাম করতে এসেছি।

সালাম কী জন্যে?

চাকরিতে জয়েন করব। আজই জয়েন করার কথা।

মনোয়ারা অবিশ্বাসী গলায় বললেন, সত্যি চাকরি পেয়েছিস? বেতন কত?

মুহিব নিচু গলায় বলল, পনেরো-বিশ হাজার হবে। মাস শেষ হোক। বেতনটা হাতে পাই তারপর বোঝা যাবে।

আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস না তো?

না।

মুহিব নিচু হয়ে মার পা ছুঁয়ে সালাম করল।

মনোয়ারা সন্দেহ মিশ্রিত গলায় বড় মেয়েকে ডাকলেন, বুলু, শুনে যা। মুহিব বলছে সে চাকরি পেয়েছে। স্যুট-টাই পরে সাহেব সেজে এসেছে।

বুলু রান্নাঘরে রান্না করছিল। সেখান থেকে গলা উঁচিয়ে ডাকল, মুহিব, শুনে যা এদিকে।

মুহিব রান্নাঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল। ভেতরে ঢুকল না। রান্নাঘর ধোয়ায় অন্ধকার। গরম এবং ধোঁয়ার মধ্যে ঢোকার কোনো অর্থ হয় না।

বুলু বলল, তুই চাকরি পেয়েছিস?

মুহিব বলল, হুঁ। জয়েন করতে যাচ্ছি, আজই জয়েনিং ডেট।

চাকরির কথা আগে কোনো দিন শুনলাম না। আজ একেবারে জয়েনিং ডেট। এগুলি কেন করছিস, মাকে খুশি করার জন্য? যাতে মা মনে করে আমার ছেলে চোর না। চাকরি-বাকরি করে। অফিসার সেজে অফিসে যায়। এতদিন শুনেছি চোরের মার বড় গলা। এখন দেখি চোরের তার চেয়েও বড় গলা।

মুহিব বলল, চুরির ব্যাপারটা শুনেছ?

বুলু বলল, কেন শুনব না? তুই কি ভেবেছিলি চুরির ব্যাপার নিয়ে কেউ আলোচনা করবে না? আমি তো চিন্তাই করতে পারি নি কেউ তার ভাইয়ের টাকা চুরি করতে পারে।

অন্যের টাকা চুরি করার চেয়ে ভাইয়ের টাকা চুরি করা ভালো না? টাকা সংসারেই থাকল। বাইরে গেল না।

বুলু রাগী গলায় বলল, চুরির পক্ষে যুক্তি দেয়াও শুরু করেছিস? লজ্জাও করছে না? লায়েক তো ভালোই হয়েছিস। আমাকে এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনার ভাইরা কী করে? আমি কী বলব? এক ভাই ব্যাংকের এজিএম, আরেক ভাই প্রফেসর, সবচেয়ে ছোটটা চোর। শ্বশুরবাড়িতে আমার মুখ বলে কিছু আছে? নিজের বাবা সম্পর্কেও কাউকে কিছু বলতে পারি না। ঘেন্না লাগে। ঐ দিন দেখি বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। সঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধ করে দিয়েছি।

বাবা তোমার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করে?

মাসে এক দুইবার করে। লজ্জাহীন মানুষ হলে যা হয়।

মুহিব বলল, আপা যাই।

বুলু বলল, চা-টা কিছু খাবি? নাশতা করে এসেছিস?

মুহিব বলল, চা খাব না। নাশতাও করে এসেছি।

এখন যাচ্ছিস কোথায় ঠিক করে বল তো?

মুহিব জবাব দিল না।

বুলু বলল, তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে— এটা কি সত্যি? নিজের ভাই বাড়ি থেকে বের করে দেয়— কী লজ্জার কথা! না-কি তোর লজ্জা লাগছে না।

মুহিব বলল, আমিও খানিকটা বাবার মতো লজ্জাহীন। আপা, আমি যাচ্ছি।

মুহিবের ঘড়িতে বাজছে সাড়ে সাতটা। হাতে অনেক সময় আছে। মতিঝিল পৌঁছতে আধ ঘণ্টার মতো লাগবে। প্রেসক্লাবের সামনে কিছুক্ষণের জন্যে থামলে কেমন হয়? মুহিব এই চিন্তাকে প্রশ্রয় দিল না।

একবার নামলে আটকা পড়ে যেতে হবে। অফিস থেকে সরাসরি প্রেসক্লাবের সামনে ফিরলেই হবে। তারচে বরং বাবার সঙ্গে দেখা করে আসা যায়। মাকে সালাম করা হয়েছে। বাবাকে সালাম করা হয় নি। বন্ধুত্বের উপর কবি ইয়েটস-এর দু লাইন কবিতা লিখিয়ে নিয়ে আসতে হবে। জটিল কবিতা, দুলাইন শুনলে মুখস্থ হবে— এমন স্মৃতিশক্তি তার নেই।

প্রেসক্লাবের সামনে যাবে না যাবে না ভেবেও মুহিব সেখানেই আগে গেল। শুধু বাবাকে না, সফিককেও সালাম করতে ইচ্ছা করছে।

 

প্রেসক্লাবের সামনে সফিক একা বসে আছে। হারুন যে সতরঞ্জির উপর বসে ছিল সেটা খালি। তবে পোস্টারে পোস্টারে চারদিক ছয়লাপ। ছোট একটা তবুও খাটানো হয়েছে। প্লাস্টিকের চেয়ারগুলি এখন তাঁবুর ভিতর। সফিক অসম্ভব বিরক্ত। গত দুদিনে শেভ করে নি বলে খোঁচা খোঁচা দাড়ি বের হয়ে তাকে দেখাচ্ছে পুরোপুরি জংলির মতো।

সফিক মুহিবের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল, তোর ঘটনা কী? এখানে কত সিরিয়াস ব্যাপার, আর তুই ড়ুব মারলি? রাতে একবার আসবি না? দোকানদার একটাকে পাঠিয়ে দিয়েছিস খায়রুল না বায়রুল কী যেন নাম— গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, তারপরেও সারাক্ষণ কথা। সে তো এসেই হারুনকে মিরপুরে তার কোন শাড়ির দোকানে চাকরি দিয়ে দিল। এইসব বেকুব তুই কোত্থেকে জোগাড় করিস?

মুহিব কিছু বলল না।

তুই না-কি ঐ বেকুবের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিস? কেন? বাড়ি থেকে লাথি দিয়ে বের করে দিয়েছে?

ব্যাপারটা সে-রকমই।

ভালোই হয়েছে, রাতে আড্ডা দেবার একটা জায়গা হয়েছে।

সফিক সিগারেট ধরাল। তার মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে এটা বোঝা যাচ্ছে। সে নরম গলায় বলল, তোর কি আজ চাকরিতে জয়েনিং? সাজসজ্জা সে-রকমই মনে হচ্ছে।

মুহিব বলল, জি।

চাকরিতে জয়েনিং, তাহলে এখানে এসেছিস কেন? প্রথম দিনেই অফিসে দেরি করে যাবি? আমাদের কথা এখন একেবারেই মাথায় রাখবি না। মন দিয়ে চাকরি করবি।

মুহিব এগিয়ে এসে সফিকের পা ছুঁয়ে সালাম করল। সফিক বিরক্ত গলায় বলল, এইসব কী? নিজের বাবা মাকে সালাম করেছিস?

মাকে করেছি।

একটা বেবিটেক্সি নিয়ে এক্ষুণি তোর বাবার কাছে যা। তাঁকে সালাম কর। আমি একটা থার্ড গ্রেড ড্রাগ এডিক্ট, মাতাল। আমাকে তুই সালাম করছিস কী মনে করে? তোর কি ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বেবিটেক্সি নিয়ে বাবার কাছে চলে যা। বেবিটেক্সি ভাড়া আছে?

আছে।

সত্যি আছে তো?

জি আছে। সফিক ভাই, হারুন কোথায়?

আরে ঐ গাধার কথা বলিস না। সে বাথরুম করতে নিজের বাড়িতে গেছে। তার না-কি অপরিচিত জায়গায় বাথরুম হয় না। এইসব ইডিয়টদের নিয়ে আমার চলতে হয়। আত্মাহুতি যে দেবে সে আরাম করে হাগু করার জন্যে বাসায় চলে গেছে। আমি একা দোকান খুলে বসে আছি। একটার পর একটা যন্ত্রণা পার করছি। অসহ্য লাগছে। কেরোসিনের টিন কিনেছিলাম— হাপিশ।

হাপিশ মানে?

দশ মিনিটের জন্যে সিগারেট কিনতে গিয়েছি। টিনটা তাঁবুর ভিতর রেখে গেছি, ফিরে এসে দেখি নাই। আবার একটা কেরোসিনের টিন কিনতে হবে। কেরোসিনের টিন বড় একটা পাবলিসিটি। সবাই হারুনকে যতক্ষণ দেখে তার চেয়ে বেশি দেখে কেরোসিনের টিনটাকে। হারুনের যে কটা ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সবকটা ছবির বেস-এ কেরোসিনের টিনটা আছে।

লোকজন কেমন আসছে?

ভালোই আসছে। Response খুবই ভালো। ফিল্ম লাইন থেকে নায়ক রিয়াজ এসেছিলেন। চারদিকে ভিড় হয়ে গেল। হারুনের সঙ্গে পাঁচ মিনিটের মতো বসেছিলেন। এত বড় স্টার, কিন্তু কোনো অহঙ্কার দেখলাম না। আমাকে বললেন, দেখি ভাই একটা সিগারেট দিন তো। আরে এমনই আমার কপাল, সিগারেট দিতে পারলাম না।

কেন?

প্যাকেটটা খুলে দেখি প্যাকেট খালি। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। রিয়াজ সাহেব নিজেই অ্যাসিসটেন্ট পাঠিয়ে সিগারেট আনালেন। নিজে একটা খেলেন। সবাইকে দিলেন। যাবার সময় প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে গেলেন। নিখুঁত ভদ্রলোক। তুই দেখি হা করে গল্পই শুনছিস। বিদেয় হ। ভালো কথা। যূথী নামের মেয়েটার সঙ্গে কি তোর যোগাযোগ হয়েছে?

না।

ঐ মেয়ে প্রেসক্লাবের সামনে গতকাল তিনবার এসেছে। তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়। খুব নাকি জরুরি। আমি বলে দিয়েছি মুহিব রাজশাহী গেছে তার এক ভাগ্নির বিয়েতে। চার পাঁচ দিন পরে ফিরবে। এই বলে কাটান দিয়েছি। যাই হোক, যূথীর ব্যাপার নিয়ে তোক চিন্তা করতে হবে না। তুই তোর কাজ কর। এখন মাথার ভেতর যূথী-যূথী ঢোকালে সমস্যা আছে।

 

শামসুদ্দিন সাহেবের বাড়ির সব দরজা-জানালা খোলা। বাড়ির উঠানে টুল পাতা। টুলে মাথা কামানো গুণ্ডা টাইপ চেহারার এক লোক বসে আছে। মুহিবের দিকে তাকিয়ে সেই লোক বলল, কারে চান?

মুহিব বলল, এই বাড়িতে যিনি থাকতেন তাকে চাচ্ছি।

আপনি তার কে হন— কুটুম্ব?

আমি উনার ছেলে।

যান, ভিতরে যান।

আপনি কে?

আমি কে তা দিয়া আপনার প্রয়োজন নাই। যারে প্রয়োজন তার কাছে যান।

মুহিব ঘরে ঢুকে দেখল তার বাবা তোক বিহীন বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। ঘরের সব জিনিসপত্র বাধাছাদা করা হয়েছে। শামসুদ্দিন সাহেব ছেলেকে দেখে অবাকও হলেন না, খুশিও হলেন না। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলেন। মুহিব বলল, ঘটনা কী বাবা? এই বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছ?

শামসুদ্দিন সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, হুঁ। কয়টা বাজে দেখ তো!

আটটা চল্লিশ।

দশটার ভেতর ছেড়ে দিতে হবে। না হলে অসুবিধা আছে।

কী অসুবিধা?

শামসুদ্দিন জবাব দিলেন না। মুহিব বলল, বাবা তোমার কি শরীর খারাপ?

সামান্য জ্বর আছে।

মুহিব গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠে বলল, সামান্য কোথায়? জ্বর তো অনেক। এই জ্বর নিয়ে যাবে কোথায়? কিছু ঠিক করেছ?

না। আপাতত কোনো হোটেলে উঠব।

কোন হোটেলে?

কিছু ঠিক করি নাই। তুই দুশ্চিন্তা করিস না।

বাবা, তোমার অবস্থা দেখে আমার খুবই খারাপ লাগছে। তোমার শরীর অসম্ভব খারাপ। আমি কী বলছি না বলছি তাও মনে হয় তুমি বুঝতে পারছ না।

শামসুদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, বুঝতে পারছি।

মুহিব বলল, বাবা, আমি একটা চাকরি পেয়েছি। ভালো বেতনের ভালো চাকরি। আমি এসেছি তোমাকে সালাম করতে। তুমি আজকের দিনটা এ বাড়িতে থাক। আমি সন্ধ্যার আগে আগেই তোমাকে নিয়ে যাব।

কোথায় নিয়ে যাবি?

সেটা তখন ঠিক করব। আজ দিনটা এ বাড়িতে তোমাকে থাকতে দেবে না?

দিবে।

বাবা, তুমি খুব মন দিয়ে শোন, আমি কী বলছি। তুমি অনেক কষ্ট করেছ, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।

তোর বৌ তো রাগ করবে রে ব্যাটা।

বাবা, তোমার মাথা তো মনে হয় এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি এখনো বিয়ে করি নি।

এক সময় তো করবি।

যখন করব তখন দেখা যাবে। বাবা, আমি তোষক বিছিয়ে দিচ্ছি। তুমি চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক। আমি অফিস শেষ করে তোমাকে এসে নিয়ে যাব।

আচ্ছা। তুই আমার জ্বর নিয়ে চিন্তা করিস না। আমার জ্বর বেশিক্ষণ থাকে না।

আশেপাশে কোনো ডাক্তার বসেন? তাহলে আমি তাকে বলে যেতে পারি তোমাকে এসে দেখে যাবেন।

নিউ হোমিও হলের ডাক্তার সাহেব আছেন। আমার বন্ধু মানুষ। উনাকে বলে গেলেই হবে।

আমি তাকে বলে যাচ্ছি।

শামসুদ্দিন সাহেব ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, তুই এত দুশ্চিন্তা করছিস কেন? আমার জ্বর কমে যাচ্ছে।

নিউ হোমিও হল বন্ধ। দশটার আগে খুলবে না। মুহিব ঘড়ি দেখল।

নয়টা দশ বাজে। আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। অফিসের সময় হয়ে গেছে। জয়েনিং এর দিনে এক ঘণ্টা দেরি করে উপস্থিত হলে খবর আছে। মুহিব একটা বেবিটেক্সি ভাড়া করল। বেবিটেক্সিতে উঠার পর পরই তার মনে হলো অফিসে পৌঁছানোর পর সে দেখবে চিচিং ফাঁক। চাকরি নেই। বস শ্রেণীর কেউ গম্ভীর গলায় বলবেন, সরি, কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো না এই জন্যে নতুন রিক্রুটিং আপাতত বন্ধ। মাস ছয়েক পর খোঁজ নেবেন। বুঝতেই পারছেন World wide রিসিশান যাচ্ছে। প্রচুর লে অফ হচ্ছে। বলুন কী খাবেন? চা—কফি।

সে চা খেতে চাইবে। যে বেয়ারা চা নিয়ে আসবে সে সিরিয়াস ধরনের মুখের ভঙ্গি করে রাখবে। তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটের কোণায় থাকবে। তবে তা ঠিক ধরা যাবে না। চা শেষ করে অফিস থেকে বের হবার সময় সবাই বিশেষ চোখে একবার করে হলেও তার দিকে তাকাবে। কেউ হয়তো বা বলবে— টাই লাগিয়ে মাঞ্জা দিয়ে চলে এসেছে। মাঞ্জায় কাজ হবে না রে বাবা।

 

জয়েন করতে মুহিবের কোনো সমস্যা হলো না। শিকদার নামের এক ভদ্রলোক তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ওয়েলকাম। থ্যাংকয়ুর উত্তরে ওয়েলকাম বলতে হয়। ওয়েলকামের উত্তরে কী বলতে হয়? বোকার মতো হাসা কি ঠিক হচ্ছে? মুহিব পরিষ্কার বুঝতে পারছে— তার ঠোঁটের কোণায় বোকা বোকা টাইপ একধরনের হাসি ঝুলে আছে।

ঘরের মেঝে অতিরিক্ত মসৃণ। মুহিবের কেবলই মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহূর্তে সে পা পিছলে উল্টে পড়ে যাবে। অফিসের সবার জন্যে দৃশ্যটা অবশ্যই মজার হবে। একেকজন একেক রকম শব্দ করে হাসবে। হাঁটাহাঁটি না করে কোনো একটা ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে পারলে হতো। আচ্ছা এরা কি তাকে আলাদা কোনো ঘর দেবে? মনে হয় না। চাকরির পোস্টটা কী তা এখনো জানা হলো না। সে কি শিকদার সাহেবকে জিজ্ঞেস করবে? আগ বাড়িয়ে এত উৎসাহ দেখানো কি ঠিক হবে? একজন কেউ যদি থাকত যে বলে দেবে কী ঠিক হবে কী ঠিক হবে না।

মুহিব তার নিজের ঠাণ্ডা ঘরে বসে আছে। কোনো অফিসের উপরের দিকের অফিসারদের ঘরের মতো ঘর। পিসি, টেলিফোন, ইন্টারকম, রিভলভিং চেয়ার সবই আছে। মুহিব জবুথবু হয়ে বিভলভিং চেয়ারে বসে আছে। তার সামনে শিকদার সাহেব। ভদ্রলোক হাস্যমুখী। মুখে সারাক্ষণ হাসি। শব্দহীন হাসি। মুহিব কোথায় যেন পড়েছিল যে পুরুষ নিঃশব্দে হাসে তাহার বিষয়ে সাবধান।

মুহিব সাহেব।

জি।

এই আপনার ঘর। ঘরের ইন্টেরিয়র যদি চেঞ্জ করতে চান, করবেন। পছন্দের কোনো পেইনটিং লাগাতে চাইলে লাগাতে পারেন।

জি আচ্ছা।

আজ আপনার কোনো কাজ নেই। নিজেকে ধাতস্ত করুন। সবার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করুন। টেলিফোনে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথা বলুন। রিলাক্স করুন।

জি আচ্ছা।

আমার কাছে কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

মুহিব বলল, আমার কাজটা কী?

শিকদার সাহেব বললেন, আপনার কাজ হলো চেয়ারে বসে থাকা। হা হা হা।

ভদ্রলোক এই প্রথম শব্দ করে হাসছেন। কাজেই শব্দ করে হাসার ব্যাপারটা ভদ্রলোক যে জানেন না তা-না। যারা মাঝে মাঝে শব্দ করে হাসে তাদের বিষয়ে নিশ্চয়ই সাবধান হবার কিছু নেই।

আপনার পোস্টটা যে কী তা আমি নিজেও ঠিক জানি না। আমাদের অফিসের শাখা চিটাগাং-এ আছে, খুলনায় আছে। আমি উড়াউড়া যা শুনেছি তাতে মনে হচ্ছে আপনাকে খুলনা অফিসে দিয়ে দেয়া হবে। ঢাকা ছেড়ে বাইরে যেতে অসুবিধা নেই তো?

জি-না।

বড় সাহেব এখনো অফিসে আসেন নি। তিনি সাধারণত লাঞ্চ করে আসেন। বড় সাহেব এলে তার সঙ্গে দেখা করবেন। আপনার পোস্ট কী, দায়িত্ব কী তিনি বুঝিয়ে বলবেন। আমি এখন বিদায় নিচ্ছি। লাঞ্চের সময় আপনাকে ডেকে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

আপনাকে টেনসড মনে হচ্ছে। টেনসড হবার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি। রিলাক্স করুন। ইন্টারকমে নাম্বার থার্টি টুতে ক্যান্টিন পাবেন। চা-কফি কিছু খেতে চাইলে ওদের বললেই হবে।

জি আচ্ছা।

আপনাকে যে পিওন দেয়া হয়েছে সে পুরনো লোক। অফিস সম্পর্কে যেকোনো তথ্য আপনি তার কাছে পাবেন। হ্যাভ ফান।

মুহিব কোনো ফান পাচ্ছে না। তার হাঁসফাঁস লাগছে। গলায় টাই এঁটে বসেছে। কোনো কারণে কি গলা ফুলে গেছে? সকালে টাইটা ফাঁসের মতো লাগে নি। এখন লাগছে। এসি মনে হয় অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় দেয়া আছে। শীতে শরীর জমে যাচ্ছে। বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে এসি কমাতে বলবে? বেয়ারা নিয়ে একটা বড় সমস্যা হয়েছে। বেয়ারার নাম শামসুদ্দিন। তার বাবার নামে নাম। মুহিব নিশ্চয়ই বলতে পারে না— থুকু শামসুদ্দিন নামের কোনো বেয়ারা থাকলে আমি খেলব না। আমাকে অন্য নামের বেয়ারা দিতে হবে।

মুহিব বেল টিপল। কিছুক্ষণ কথা বলা যাক শামসুদ্দিনের সঙ্গে।

স্যার, ডেকেছেন?

জবাব না দিয়ে মুহিব তাকিয়ে আছে। লোকটার নামই যে তার বাবার মতো তা না। চেহারার মধ্যেও খানিকটা মিল। লম্বা ফর্সা। দাঁড়িয়েও আছে খানিকটা কুঁজো হয়ে।

ঠাণ্ডা পানি খাওয়াতে পারবে?

অবশ্যই পারব স্যার।

এসিটা একটু কমিয়ে দাও, ঘর বেশি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আর শোন, তোমার ডাক নাম কী?

স্যার আমার একটাই নাম। শামসুদ্দিন।

সমস্যা কী হয়েছে জানো? আমার বাবার নাম শামসুদ্দিন। কাজেই শামসুদ্দিন শামসুদ্দিন বলে তোমাকে ডাকা আমার জন্যে কঠিন হয়ে পড়বে।

স্যার, আমাকে দুলাল ডাকবেন?

দুলাল কি তোমার ডাক নাম?

জি-না। আমার ডাক নাম শামছু।

তাহলে দুলাল ডাকব কেন? দুলাল কে? আচ্ছা থাক, কে জানার দরকার নেই। তোমাকে আমি দুলাল ডাকব না। আমি চেষ্টা করব নাম না ডেকে পার করা যায় কি-না।

শামসুদ্দিন এসির ঠাণ্ডা কমিয়ে দিল। জগভর্তি ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এলো।

স্যার, আর কিছু লাগবে?

না, আর কিছু লাগবে না।

খবরের কাগজ এনে দেব স্যার পড়বেন?

আমি খবরের কাগজ পড়ি না।

মুহিব টেলিফোন সেটটা কাছে টানল।

একটা টেলিফোন নাম্বারই সে জানে। নোরার নাম্বার। চাকরিতে জয়েন করার ব্যাপারটা নোরাকে জানানো দরকার।

হ্যালো নোরা?

নোরা যথানিয়মে বলল, আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি?

মুহিব।

নোরা ঝলমলে গলায় বলল, ও আচ্ছা তুমি। খুব ভালো সময়ে টেলিফোন করেছ। আমি মনে মনে তোমাকে খুঁজছিলাম।

মুহিব বলল, কেন বলো তো?

নোরা বলল, কোনো কারণ নেই, এমনি। হোমোসেপিয়ানসরা প্রাণী হিসেবে খুবই লজিক্যাল, তারপরেও তারা বেশিরভাগ কাজ করে কোনো কারণ ছাড়া।

তোমাকে একটা ভালো খবর দেয়ার জন্যে টেলিফোন করেছি।

খবরটা দিও না। আমাকে আন্দাজ করতে দাও। তুমি চাকরি পেয়েছ? হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে। দশে দশ পেয়েছ। আজ আমি চাকরিতে জয়েন করেছি।

একসেলেন্ট! কনগ্রাচুলেশনস। এক কাজ কর, আজ সন্ধ্যার পর বাসায় চলে এসো। কী চাকরি কী ব্যাপার শুনব।

আচ্ছা।

হিপনোসিসের ব্যাপারটাও তোমার উপর চেষ্টা করে দেখব। আমি নিশ্চিত যে হবে।

হলে তো ভালোই।

মুহিব শোন, আমি তোমার বন্ধু হারুনকে দেখতে গিয়েছিলাম। যে আগুনে পুড়ে মরে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

কী দেখলে?

আমি আমার জীবনে এমন হাস্যকর ঘটনা দেখি নি। হারুন নামের মানুষটা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বসে আছে। উৎসব উৎসব ভাব। দলের একজন লিডার আছে, তার নাম সফিক। সে এসে আমাকে বলল, ম্যাডাম, আমরা একটা গণসঙ্গীতের আয়োজন করেছি। সেখানে আপনি যদি আপনার উড়ালপখি গানটা গেয়ে দেন খুব ভালো হয়।

তোমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে?

অবশ্যই হাস্যকর। সত্যি করে বলো তো, তোমার বন্ধু কি আসলেই গায়ে আগুন দেবে?

মুহিব জবাব দিল না। নোরা বলল, তোমার বন্ধুকে মাথা থেকে উদ্ভট চিন্তা দূর করতে বলো। সে চাইলে সিলেটের চা-বাগানে আমি তার জন্যে চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি।

মুহিব আগ্রহের সঙ্গে বলল, চা-বাগানে তোমার চেনাজানা আছে?

নোরা বলল, আমাদের একটা ছোটখাট চা-বাগান আছে।

বলো কী?

তোমার বন্ধুকে আমার প্রপোজাল দিয়ে দেখ।

মনে হয় না সে রাজি হবে। কারণ সে তো তার নিজের চাকরির জন্যে আত্মাহুতি দিচ্ছে না। সে কাজটা করছে For a cause.

তোমার ধারণা সে টিভি ক্যামেরার সামনে গায়ে আগুন দেবে? লাইভ টেলিকাস্ট হবে?

মুহিব জবাব দিল না। নোরা বলল, কথার জবাব দিচ্ছ না কেন?

ভাবছি।

কী ভাবছ?

সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছি। আমার মনে হঠাৎ একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নোরা শোন, আমি এই যে চাকরিটা পেয়েছি তার পেছনে তোমার কি কোনো হাত আছে?

নোরা শান্ত গলায় বলল, এই প্রশ্ন আসছে কেন? এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার পেছনে কারণ কী?

কোনো কারণ নেই। তুমি তো বলেছ হোমোসেপিয়ানসরা বেশির ভাগ কাজই করে কোনো কারণ ছাড়া। আচ্ছা নোরা, দ্য এরনস কোম্পানিটা কি তোমাদের?

নোরা শান্ত গলায় বলল, আমার বাবা এই কোম্পানির মেজর শেয়ার হোল্ডার। আমি চারজন ডিরেক্টরের একজন।

তার মানে চাকরিটা পাওয়ার পেছনে তোমার অবদান আছে?

যদি থাকে তাতে কোনো সমস্যা আছে?

না কোনো সমস্যা নেই।

মুহিব শোন, তোমার চাকরি পাওয়ার পেছনে আমার সামান্য ভূমিকার কারণে যদি তোমার ভেতর কোনো গ্লানিবোধ তৈরি হয় সেটা আমি দূর করে দেব। খুব সহজেই দূর করে দেব।

কীভাবে? হিপনোসিসের মাধ্যমে? হিপনোটিক সাজেশান?

হ্যাঁ।

তাহলে তো ভালোই হয়। শুধু গ্লানিবোধ কেন? আমার মনে আরো অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত বোধ আছে। সব দূর করে দাও।

টেলিফোন রেখে মুহিব তার গলার টাই সামান্য আলগা করে দিল। গলায় ফঁসের মতো লাগছিল, এখন আরাম লাগছে। খানিকটা ঘুম ঘুমও পাচ্ছে। সোফাজাতীয় কিছু থাকলে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া যেত।

দুপুরে শিকদার সাহেব মুহিবকে নিয়ে অফিসের ক্যান্টিনে লাঞ্চ খেতে গেলেন। বিদেশী কায়দার লাঞ্চ। একটা স্যান্ডউইচ, একটা আপেল, এক বাটি স্যুপ। টক-ঝাল স্যুপটা খেতে অসাধারণ।

শিকদার সাহেব বললেন, চাকরি কেমন লাগছে?

মুহিব বলল, ভালো লাগছে। শিকদার সাহেব বললেন, এই কোম্পানির চাকরি মোটামুটি আরামের, কাজের চাপ কম। তবে শুনতে পাচ্ছি বিদেশী কোনো এক কোম্পানির সঙ্গে নাকি যুক্ত হবে। তখন কী হবে কে জানে।

মুহিব বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। ফাকি দিতে চাইলে একটা না একটা বুদ্ধি আপনি নিশ্চয়ই বের করতে পারবেন।

শিকদার সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন ধরতে পারছি না।

মুহিব বলল, আমি কিছু বুঝাতে চাচ্ছি না। রসিকতা করছি। আপনাদের অফিসে রসিকতা করা যায় তো?

আপনাদের অফিস বলছেন কেন? অফিসটা তো আপনারও।

মুহিব বলল, না। আমার অফিস না। আমি আপনাদের বড় সাহেবের জন্যে অপেক্ষা করছি। উনি এলেই রেজিগনেশন লেটার উনার হাতে ধরিয়ে পগারপার হয়ে যাব।

রেজিগনেশন লেটার দেবেন কেন? কারণটা কী?

মুহিব হাসিমুখে বলল, হোমোসেপিয়ানসরা খুবই বিচিত্র প্রাণী। তারা বেশির ভাগ কাজ করে কোনো কারণ ছাড়া। এটা আমার কথা না। আপনাদের অফিসের চারজন ডিরেক্টর-এর একজনের কথা।

আপনি কি সত্যি চাকরি করবেন না?

না।

শিকদার সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মুহিবের কথাগুলো তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছেন না। মুহিব বলল, আমি আরেকটা স্যুপ খাব।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ