আমার ধারণা বাসররাতে স্ত্রীকে কী কী কথা বলবে সব ছেলেই তা ঠিক করে রাখে। কয়েকবার রিহার্সেলও দেয়। মূল সময়ে সব গুবলেট করে ফেলে। আমার বন্ধু ফরহাদ বাসররাতে স্ত্রীকে শুনিয়ে মুগ্ধ করার জন্যে একটি দীর্ঘ কবিতা মুখস্থ করে রেখেছিল। তার স্ত্রীর নাম ঝরনা। সে মুখস্থ করেছিল সত্যেন্দ্রনাথের ঝর্ণা কবিতাটি। আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন, ঐ যে—

ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা
তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্ণা
অঞ্চল সিঞ্চিত গৌরিক স্বর্ণে
গিরিমল্লিকা দুলে কুন্তল কর্ণে।

ঝাড়া মুখস্থ করা এই কবিতা বেচারা ফরহাদ বাসররাতের উত্তেজনায় পুরোপুরি ভুলে গেল। সে পুরো রাত কাটিয়ে দিল কবিতাটা মনে করার চেষ্টা করতে করতে। শীতের রাতেও তার কপাল দিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়তে লাগল। তার স্ত্রী লজ্জা ভুলে গিয়ে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল, আপনার কি শরীর খারাপ?

আমি আর দশজন মানুষের মতো না। আমি যা ঠিক করি তা করি। বাসররাতে রূপাকে কী বলব সব আমি গুছিয়ে রাখলাম। তার রূপা নামটা পাল্টে দিতে হবে। রূপ থেকে রূপা। এই নাম চিৎকার করে বলে–আমি রূপবতী।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক উপন্যাসের নায়কের নাম যেমন ছিল ‘রাজকুমার’। নামটাই বলে দিচ্ছে মানুষটা অসম্ভব রূপবান। আপনি কি উপন্যাসটা পড়েছেন? উপন্যাসের নাম ‘চতুষ্কোণ’। এই একটি মাত্র উপন্যাস পড়েই কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার রাজকুমার হতে ইচ্ছা করেছিল। আপনি উপন্যাসটা না পড়ে থাকলে আপনাকে দিতে পারি। আপনি পুরোপুরি নিয়ে যেতে পারেন। আমার কাছে দু’টা কপি আছে। প্রথমটা হারিয়ে গেছে ভেবে আরেকটা কিনেছিলাম। কেনার পর পরই হারানো কপি ফিরে পেয়েছি। একই বইয়ের দু’টা কপি ঘরে রাখার কোনো মানে হয় না।

মূল গল্পে ফিরে যাই। রূপাকে কী বলব সব গুছিয়ে ফেললাম। প্রথমে নাম বদল, তারপর…

আমার বন্ধু ফরহাদের যেমন সব আউলে গিয়েছিল আমারও সে-রকম হলো। আমার আউলে গেল ভিন্ন কারণে। আমি দেখলাম রূপা কেমন করে যেন তাকাচ্ছে আমার দিকে। টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর শাঁ শাঁ শব্দ করছে। আমি বললাম, শব্দ কিসের?

সে বলল, আমার এলার্জির সমস্যা আছে।

আমি বললাম, এলার্জির সমস্যা থাকলে শাঁ শাঁ শব্দ হয়?

সে বলল, এলার্জির অ্যাটাক হলে শ্বাসনালি ফুলে যায়, তখন নিঃশ্বাসে কষ্ট হয় আর শাঁ শাঁ শব্দ হয়।

নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে?

হুঁ।

এর চিকিৎসা নেই?

ইনহেলার নিলে কমবে। আমি ইনহেলার আনতে ভুলে গেছি।

আমি আনিয়ে দিচ্ছি।

রহমত মিয়াকে ইনহেলার আনতে পাঠিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি রূপা স্বাভাবিক হয়েছে। সহজভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

আমি বললাম, ঘটনা কী? সেরে গেছে?

হুঁ।

আবার হবে?

জানি না।

গরম চা কিংবা কফি খাবে?

না।

আমি খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, তোমার রূপা। নামটা আমি বদলে দেব। এই নাম আমার পছন্দ না। নতুন নাম দেব।

কী নাম?

এখন থেকে তোমার নাম দস্তা।

কী নাম?

দস্তা। Zinc.

রূপা অবাক হয়ে বলল, দস্তা নাম কেন?

আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, দস্তা আমার পছন্দের নাম। তাছাড়া একজন বিখ্যাত কবি তাঁর প্রেমিকাকে দস্তা-কন্যা সম্বোধন করেছেন।

দস্তা-কন্যা?

হ্যাঁ। আমেরিকান কবি। কবির নাম রবার্ট ফ্রস্ট। রবার্ট ফ্রস্টের নাম নিশ্চয়ই জানো। তুমি সাহিত্যের ছাত্রী।

রবার্ট ফ্রস্টের নাম জানি। কিন্তু তিনি তাঁর প্রেমিকাকে দস্তা-কন্যা ডাকতেন তা জানতাম না।

তিনি ডেকেছেন Zinc Lady নামে। আমি বঙ্গানুবাদ করলাম।

কবিতাটা কি আপনার মনে আছে? হ্যাঁ আছে। পুরোটা মনে নেই, কয়েক লাইন আছে—

Out of grave I come to tell you this,
Out of grave I come to quench the kiss
Oh my Zinc Lady.

দস্তা-কন্যা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। শা শাঁ শব্দ আবারো শোনা যাচ্ছে। আমি বললাম, পানি খাবে?

দস্তা-কন্যা ক্ষীণ স্বরে বলল, হ্যাঁ।

আমি বললাম, তুমি তো বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থ।

সে বলল, আমি সবসময় এরকম থাকি না। মাঝে মাঝে শরীর বেশি খারাপ করে।

তখন কী কর? শুয়ে থাক?

না, আধশোয়া হয়ে থাকি। আধশোয়া হয়ে থাকলে কষ্ট কম হয়।

তাহলে থাক আধশোয়া হয়ে।

দস্তা-কন্যা বাকি রাতটা খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে কাটিয়ে দিল। আমি এক ঘুম দিয়ে জেগে উঠে দেখি সে ঠিক আগের জায়গায় বসে আছে। শা শাঁ শব্দ হচ্ছে। তার চোখ চকচক করছে। মনে হয় একটু আগে কেঁদেছিল। এখন কান্না নেই কিন্তু কান্নার ছায়া চোখে লেগে আছে। দস্তা-কন্যার এই হতাশ ক্লান্ত রূপ দেখেই হয়তো আমি সেই রাতে তার প্রেমে পড়েছিলাম।

ভাই, আমি আমার প্রেমের গল্পটাই আসলে আপনাকে বলছি।

সবার প্রেম কি এক রকম হয়? একেকজনের প্রেম হয় একেক রকম। কেউ প্রেমে পড়লে প্রেমিকাকে নিয়ে পার্কে চলে যায়। এক ঠোঙা বাদাম কিনে। বাদাম ভেঙে ভেঙে প্রেমিকার হাতে তুলে দিয়ে গদগদ গলায় বলে, আজকে তোমাকে কী যে সুন্দর লাগছে!

আবার আরেক দল আছে…

আচ্ছা থাকুক, আমি প্রেম-শাস্ত্রের গবেষক না। আমি আমার নিজের প্রেমের গল্পটাই গুছিয়ে বলার চেষ্টা করি। তার আগে আমার অতি প্রিয় প্রেমের কবিতার কয়েকটা লাইন শুনবেন?

Love strong as death is dead
Come let us make his bed
Among the dying flowers;
A green turf at his head;
And a stone at his feet,
Whereon we may sit
In the quiet evening hours.

আজ থেকে দেড় শ’ বছর আগে ক্রিস্টিনা রোসেটি নামের এক তরুণী এই কবিতাটি লিখেছেন। আমি তার বঙ্গানুবাদ করেছি। ও আচ্ছা, আপনাকে বলা হয়। নি, আমার কবিতা-রোগ আছে। চার ছ’লাইনের কবিতা (কিংবা পদ্য) মাঝেমধ্যে লিখি। গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করে বানরগুলোকে শোনাই। এরা কবিতা পাঠের সময় ঝিম ধরে থাকে এবং অতি দ্রুত চোখ পিটপিট করতে থাকে। মজার ব্যাপার না?

যাই হোক, ক্রিস্টিনা রোসেটির কবিতার অনুবাদ কেমন হয়েছে দেখুন তো–

মৃত্যুর মতো প্রগাঢ় প্রেম কিন্তু মৃত
এসো সেই শবদেহের জন্যে একটা বিছানা করি।
ছড়িয়ে দেই কিছু শুকনো ফুল,
একটা সবুজ চাদর থাকুক তার মাথার পাশে
আর পায়ের কাছে একটা প্রস্তরখণ্ড।
আমরা দু’জন বসব সেই পাথরে।
কাটিয়ে দেব অলস বিকেলের শান্ত সময়।

ভাই, কী বললেন, আবার বলুন, আমি বুঝতে পারি নি। ও আচ্ছা আচ্ছা যে সমস্যা সমাধানের জন্যে বিয়ে করেছি সেই সমস্যার সমাধান হয়েছিল কি না। বিয়ের পরেও নারীকণ্ঠ শোনা যেত কি যেত না। তাই তো?

না, সমস্যার সমাধান হয় নি। হঠাৎ হঠাৎ নারীকণ্ঠ শুনতাম। বিয়ের পর প্রথম যেদিন নারীকণ্ঠ শুনলাম সেদিনের কথা বলি। দস্তা-কন্যা ঢুকেছে। বাথরুমে। শাওয়ার ছেড়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে সে গোসল করবে। আমি বসে আছি বারান্দায় বানরগুলির জন্যে অপেক্ষা করছি। কিংবা অপেক্ষা ছাড়াই বসে আছি। হাতে বই আছে। ইচ্ছা হলে দু’এক পাতা পড়ব, ইচ্ছা না হলে পড়ব না। সময় কাটছে আরামদায়ক আলস্যে। ক্রিস্টিনা রোসেটির কবিতার মতো—‘কাটিয়ে দেব অলস বিকেলের শান্ত সময়’।

তখন খুব কাছ থেকে কে যেন বলল, কী করছেন? আমি এতই চমকালাম যে হাত থেকে বই পড়ে গেল। ভয়ঙ্করভাবে চমকানোর প্রধান কারণ হলো–নারীকণ্ঠটা এখন চেনা। দস্তা-কন্যার গলা এবং এতে কোনো ভুল নেই। দস্তাকন্যা বাসররাতে আমার সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বললেও এখন ‘তুমি’ করে বলে। নারীকণ্ঠ বলছে ‘আপনি’ করে। প্রভেদ বলতে এইটুকুই।

আমি সারা বিকাল ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে সন্ধ্যা নাগাদ একটা মোটামুটি সমাধান দাঁড় করিয়ে ফেললাম। আমি আমার সমাধানটা আপনাকে বলছি। এই বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে সেটা পরে শুনব।

আমার ব্যাখ্যা হলো মানুষের মস্তিষ্ক অপরিচিত কোনো জিনিস বেশিক্ষণ সহ্য করে না। নানানভাবে সে চেষ্টা করে অপরিচিত জিনিসটাকে পরিচিত করতে। একটা লম্বা দাগের দু’পাশে দু’টা ফুটা আঁকলে মস্তিষ্ক সেটাকে মানুষের আদল দিতে চেষ্টা করে। আমার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটছে। তরুণী-কণ্ঠকে সে পরিচিত করার ব্যবস্থা করছে।

তরুণী-কণ্ঠ দ্বিতীয়বার শুনলাম এক মধ্যরাতে। হঠাৎ পানির পিপাসায় ঘুম ভেঙে গেছে। দস্তা-কন্যা হাত-পা গুটিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে। আমি খুব সাবধানে তার ঘুম না ভাঙিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। পাশের ঘরে গেলাম। ফ্রিজ খুলে ঠাণ্ডা পানির বোতল বের করে পর পর দু’গ্লাস বরফ-শীতল পানি খেলাম। হঠাৎ করে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পানি খাওয়ার জন্যেই হয়তো ঘুম পুরোপুরি কেটে গেল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাবার পর যদি ঘুম না আসে, তাহলে বেশিরভাগ মানুষই খুব আপসেট হয়ে পড়ে। আমার কিন্তু ভালোই লাগে। নীরব সুনসান রাতে চুপচাপ বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ। দিনের বেলায় হৈচৈ কোলাহলে জেগে থাকার চেয়ে রাতের জেগে থাকা শ্রবণেন্দ্রিয়ের জন্যে আনন্দময়। মানুষের কান পঁয়ত্রিশ ডেসিবেলের চেয়ে উঁচু শব্দ শুনলে কষ্ট পায়। রাতের বেলায় শব্দমাত্রা নিশ্চয়ই পঁয়ত্রিশ ডেসিবেলের নিচে।

আমি লাইব্রেরি ঘরে ঢুকলাম। শেলফের কাছে গিয়ে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়ালাম। যে বইটা হাত দিয়ে প্রথম ছোঁব সেটাই পড়ব। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে যে পড়া ধরব তা না। ইজিচেয়ারে শুয়ে বই খুলব (চোখ তখনো বন্ধ)। যে পৃষ্ঠাটা খোলা হবে সেখান থেকেই পড়া শুরু করব। এটা আমার একটা খেলা। শিশুরা যেমন বড়দের মতো কিছু খেলার চেষ্টা করে, বড়রাও সে-রকম শিশুদের কিছু খেলা খেলে।

বই পড়তে শুরু করেছি। হাতে এসেছে মার্কেজের লেখা ‘দ্য স্টোরি অফ এ শিপরেকড সেইলার’-এর ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন- রেনডলফ হোগান। বই পড়তে যাব, তখন নারীকণ্ঠ শুনলাম–ঘুমাচ্ছেন না কেন?

আমি অন্যদিনের মতো এদিক ওদিক তাকালাম না। চোখ বন্ধ করে বললাম, ঘুম আসছে না, তাই ঘুমাচ্ছি না। বলেই অপেক্ষা করতে লাগলাম কী জবাব আসে তা শোনার জন্যে। কোনো জবাব এলো না। আমি যখন মোটামুটি নিশ্চিত যে জবাব আসবে না, তখন পায়ের শব্দ শুনলাম। কেউ যেন এগিয়ে আসছে। এই তো লাইব্রেরি ঘরে ঢুকল। এগুচ্ছে আমার দিকে। এই তো আমার ইজিচেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার প্রচণ্ড ইচ্ছা হচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখার। অনেক কষ্টে সেই ইচ্ছা দমন করলাম। যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে দেখি সে কথা বলে কি-না।

সে কথা বলল। অবিকল দস্তা-কন্যার গলায় কিছুটা আদুরে ভঙ্গিতে বলল, কী পড়ছেন?

বই।

কী বই?

দ্য স্টোরি অফ এ শিপরেকড সেইলার।

শব্দ করে পড়ন না। আমিও শুনি।

তুমি কে?

নারীকণ্ঠ জবাব দিল না। খিলখিল করে হাসল। সে সম্ভবত হাত নাড়িয়েছে। কারণ তার হাতে চুড়ির শব্দ শুনলাম। কাচের চুড়ি। এটা একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য। দস্তা-কন্যা কাচের চুড়ি, সোনার চুড়ি–কোনো চুড়িই পরে না। চুড়ির টুং টাং শব্দ তার ভালো লাগে না।

তোমার নাম কী?

(আবারো হাসি)

হাসছ কেন?

নাম জিজ্ঞেস করছি, নাম বলো।

আমার নাম কাঁসা।

কাঁসা মানে?

কাঁসা চেনেন না? তামা এবং দস্তা মিলিয়ে হয় কাঁসা। (আবারো হাসি)

আমি যদি এখন পেছন দিকে ফিরি, তাহলে কি তোমাকে দেখতে পাব?

দেখতে পেতেও পারেন, আবার নাও পেতে পারেন। (হাসি)

আমি সাবধানে চোখ খুললাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। পেছনে কেউ নেই। শুধু দরজার পর্দা কাঁপছে। বলাই বাহুল্য, বাতাসে কাঁপছে। তবে কেউ যদি ভাবতে চায় কাঁসা নামের মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে পর্দা সরিয়ে এই দরজা দিয়ে চলে গেছে–তাও ভাবতে পারে।

কোলের উপর রাখা বই পড়ছি। প্রতি মুহূর্তে ভাবছি মেয়েটি আবারো আসবে। সে এলো না। আমি বইটা ইজিচেয়ারে রেখে ঘুমুতে গেলাম। যদি ঘুম আসে–আবারো বই পড়তে আসব।

দস্তা-কন্যা ঠিক আগের ভঙ্গিতেই ঘুমুচ্ছে। ভালো করে লক্ষ করে দেখি, তার হাতভর্তি কাচের চুড়ি। যে চুড়ি পছন্দ করে না সে হঠাৎ করে হাতভর্তি চুড়ি কেন পরল? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। বাতি নিভিয়ে আমি কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। চেষ্টা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ব।

একটু আগে যে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেছি সে আর কেউ না–সে আমার মস্তিষ্কের কল্পনা। আমি নিজে আমার নিজের সঙ্গে কথা বলেছি। মেয়েটির হাতভর্তি চুড়ি দেখেছি–এরও একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে। দস্তা-কন্যা আজ চুড়ি পরেছে। আমার চোখে তা পড়েছে। অস্পষ্টভাবে পড়েছে। চুড়ির টুংটাং শব্দ কানে এসেছে। মস্তিষ্ক টুং টাং শব্দের অংশটা স্মৃতিকোষে জমা করে রেখেছে। সে এই শব্দ নিয়েই খেলা করেছে।

মানুষের মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে, বিভিন্ন স্মৃতিকোষে জমা করে রাখা স্মৃতি নিয়ে নিজের ইচ্ছামতো ঘটনা সাজায় এবং স্মৃতির ফাক ভর্তি করে। একে বলে কনফ্যাবুলেশন, বাংলায় ‘মিথ্যা-স্মরণ’। সাইকোসিসের রোগের শুরুটা হয় এইভাবে। এক পর্যায়ে সে বাস্তবের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক হারিয়ে মনগড়া জগতে বাস করতে থাকে।

আমার বেলাতেও হয়তো এরকম কিছু ঘটবে। আমি দস্তা-কন্যা এবং কাঁসাকন্যা দুজনের সঙ্গে জীবনযাপন করতে থাকব। দু’জনের ভেতর থেকে একজনকে বেছে নেব। সেই একজন দস্তা-কন্যা হতে পারে, আবার কাসাকন্যাও হতে পারে।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ঘুম আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শুধু শুধু বিছানায় গড়াগড়ির কোনো মানে হয় না। বরং বইটা পড়া যেতে পারে। বই পড়ার সময় কাঁসা-কন্যা যদি উপস্থিত হয় তাহলেও মন্দ হয় না।

লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে আমাকে ধাক্কার মতো খেতে হলো। ইজিচেয়ারে রাখা বইটা নেই। বইটা শেলফে সাজিয়ে রাখা।

কাজটা কে করেছে? দোতলায় কেউ আসে না। এই নিয়ম অনেক দিনের। কাজের মানুষরা কেউ এ নিয়ম ভাঙবে না। তাহলে ইজিচেয়ার থেকে বইটা নিয়ে শেলফে কে রাখল? কাঁসা-কন্যা? না-কি এই কাজটা আমি নিজেই করেছি! তারপর ভুলে গেছি। এই স্মৃতি মস্তিষ্কে নেই।

মস্তিষ্ক কিছু কিছু স্মৃতি মুছে ফেলছে। সে এই কাজ যখন করা শুরু করবে তখন থেমে থাকবে না। স্মৃতি মুছবে, স্মৃতি এলোমেলো করে সাজাবে।

আমি ইজিচেয়ারে বসলাম। এবার আমার হাতে বই নেই। চুপচাপ বসে থাকার জন্যেই বসে থাকা। আমার শীত শীত লাগছে। শীত লাগার কি কথা? না-কি শারীরিক অনুভূতির ব্যাপারেও সমস্যা দেখা দিয়েছে?

তুমি এখানে কী করছ?

কাঁসা-কন্যার গলা। সে ঠিক আগের মতো পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম না। যেভাবে বসেছিলাম সেভাবেই বসে রইলাম। আমার দৃষ্টি শেলফে রাখা বইটার দিকে।

কাঁসা-কন্যা আবারো বলল, তুমি কী করছ?

বই পড়ছি।

তোমার হাতে তো বই নেই। বই পড়ছ কীভাবে?

ও আচ্ছা তাই তো! বই পড়ব বলে ভাবছি। তুমি কি নীল রঙের ঐ বইটা এনে দেবে? শেলফ থেকে একটু বের হয়ে এসেছে।

কাঁসা-কন্যা ইজিচেয়ারের পেছন থেকে সামনে চলে এলো। আমি দেখলাম কাঁসা-কন্যা না। যে আমার সামনে এসেছে সে রূপা, আমাদের দস্তা।

সে বই এনে আমার হাতে দিতে দিতে বলল, ঘুম ভাঙার পর খুব ভয় পেয়েছি।

কেন?

তুমি পাশে নেই, আমি ভয় পাব না? তোমাদের এই বিশাল বাড়ি। সারাক্ষণই এদিকে ওদিকে ভৌতিক শব্দ হয়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তুমি কি রাতদুপুরে সত্যি সত্যি বই পড়বে?

পড়ব।

তাহলে আমি তোমার পাশে বসে থাকি। আমি একা শুয়ে থাকতে পারব না।

দস্তা শোন, তোমার একা শুয়ে থাকার অভ্যাস করতে হবে। আমি প্রায়ই ছাদে চলে যাই। ছাদে পাটি পেতে শুয়ে থাকি।

কেন?

আমার কিছু বিচিত্র অভ্যাস আছে। বিচিত্র অভ্যাসের একটি হলো, ছাদে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থেকে আকাশের তারা দেখা।

তুমি যখন ছাদে যাবে অবশ্যই ঘুম ভাঙিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে। আমিও ছাদে তোমার সঙ্গে শুয়ে থাকব। তারা দেখব।

আমি চুপ করে থাকলাম। দস্তা আগ্রহের সঙ্গে বলল, এখন ছাদে যাবে? চল যাই।

আমি বললাম, এখন যেতে ইচ্ছা করছে না।

দস্তা বলল, ইচ্ছা না করলে যেতে হবে না। এখন কি তোমার বই পড়তে ইচ্ছা করছে?

আমি বললাম, আমার ঠিক কী ইচ্ছা করছে বুঝতে পারছি না।

দস্তা বলল, আমার কী ইচ্ছা করছে বলব?

বলো।

আমার ইচ্ছা করছে তোমার সঙ্গে গল্প করতে। তোমার যেমন রাতে ঘুম ভেঙে গেলে একা একা ছাদে চলে যাবার অভ্যাস, আমারও সে-রকম গল্প করার অভ্যাস।

কার সঙ্গে গল্প করতে?

সাথী আপার সঙ্গে। আমরা তিনবোন বড় একটা খাটে এক সঙ্গে ঘুমোতাম। আমি মেজ বলে আমি মাঝখানে, বাকি দুজন দু’পাশে। গরমের সময় মাঝখানে শুলে চাপাচাপি হয়। এই জন্যে পরে ঠিক করা হলো–ঘুমুতে যাবার আগে লটারি করা হবে। লটারিতে যার নাম উঠবে সে শুবে মাঝখানে। আমার এমনই কপাল যে লটারিতে সবসময় আমার নাম উঠত। আচ্ছা আমি যে বকবক করছি তুমি বিরক্ত হচ্ছ না তো?

না।

এখন বিরক্ত না হলেও পরে হবে। আমি যে কী পরিমাণ কথা বলতে পারি তুমি জানো না। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে আমার নাম ছিল—‘কথা সাগর’। সেকেন্ড ইয়ারে নাম হয়ে গেল—‘কথা মহাসাগর’।

আমি তাকিয়ে আছি দস্তা-কন্যার দিকে। সে ইজিচেয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছে। তার হাত ইজিচেয়ারের হাতলে। চোখ বড় বড় করে গল্প করছে–দেখতে ভালো লাগছে।

দস্তা-কন্যা বলল, কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এসেছি। আসল কথাটা বলা হয় নি।

আসল কথা কোনটা?

ঐ যে তোমার যেমন ঘুম ভাঙলে ছাদে চলে যাওয়ার অভ্যাস আর আমার হলো ঘুম ভাঙলে কথা বলার অভ্যাস। সাথী আপার ঘুম খুব পাতলা তো–আমার ঘুম ভেঙে গেলে আমি বিছানায় উঠে বসতাম। সঙ্গে সঙ্গে সাথী আপা উঠে বসে বলত, তোর কী হয়েছে? শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না তো? আমি বলতাম, না। আপা এসো গল্প করি। তখন গল্প শুরু করতাম। এক সময় ছোটনকে ডেকে তুলতাম। ছোটন কে বুঝতে পারছ তো? আমার ছোট বোন। তখন শুরু হতো তিনজনের ম্যারাথন গল্প। আচ্ছা তুমি কি সাথী আপার উপর রাগ করে আছ?

রাগ করে থাকব কেন?

ঐ যে তোমাকে বিয়ে করে সরে গেল।

রাগ করি নি।

সাথী আপার ধারণা তুমি খুব রাগ করে আছ। এই জন্যেই সে এ বাড়িতে আসে না। যেহেতু সে আসে না, ছোটনও আসে না। আমাদের তিনবোনের এক সঙ্গে হওয়া হয় না। তুমি কি একটা মজার কথা শুনবে?

শুনব।

কথাটা তোমাকে বলা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছি না। তুমি অন্য কিছু ভাবতে পার। আচ্ছা থাক বলেই ফেলি–আমরা তিনবোন মিলে ঠিক করেছিলাম তিনজন একটা ছেলেকে বিয়ে করব। যাতে সারা জীবন আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি। অদ্ভুত ব্যাপার কী দেখেছ, আমার বড়বোনের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছে, তারপর হলো আমার সঙ্গে। এক সময় হয়তো দেখা যাবে ছোটনের সঙ্গেও তোমার বিয়ে হয়েছে। তুমি আমার কথা শুনে রাগ করছ না তো?

না।

সত্যি রাগ করছ না?

না।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি রাগ করেছ। কারণ তোমার ভুরু কুঁচকে আছে।

আমি রাগ করি নি। বরং খানিকটা মজা পেয়েছি।

তাহলে ভুরু কুঁচকে আছ কেন? মজা পেলে কেউ ভুরু কুঁচকে থাকে না।

ভুরু কুঁচকে আছি কারণ আমি একটা বইয়ের নাম মনে করার চেষ্টা করছি। বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস। সেখানে তিনবোন একটা ছেলেকে বিয়ে করে।

দস্তা-কন্যা হাসিমুখে বলল, বইটার নাম ‘ইছামতি। তোমার কি তিন বোনের নাম মনে আছে? ওদের নাম তিলু, বিলু, নীলু। এখন দয়া করে তোমার ভুরু ঠিক কর। ভুরু কুঁচকে আছে এমন মানুষ দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে। কারণ কী জানো? কারণ আমার বাবা সারাক্ষণ ভুরু কুঁচকে থাকেন। তাকে দেখে। মনে হয় তিনি শুধু যে জগৎ-সংসারের উপর বিরক্ত তা না, তিনি পুরো সৌরমণ্ডলের উপর বিরক্ত। এই, চা খাবে?

না।

খাও না একটু চা। আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে। আমরা তিনবোন যখন গল্প করে রাত কাটাতাম তখন ঘনঘন চা খেতাম। চা বানাব?

বানাও।

তুমি আমার সঙ্গে এসো। আমি চা বানাব, তুমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। তুমি বোধহয় জানো না আমার সারাক্ষণ তোমার পাশে থাকতে ইচ্ছে করে। কিছুক্ষণ তোমাকে না দেখলে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?

হ্যাঁ।

না, তুমি বিশ্বাস করছ না। তুমি অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে আছ।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম, দস্তা-কন্যার চোখ পানিতে ভরে গেছে। শুধু তাই না–ইজিচেয়ারের হাতলে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পড়ল। আমি আবার ভুরু কুঁচকে ফেললাম। চোখের পানি নিয়ে টেনিসনের বিখ্যাত কবিতা আছে। কবিতাটা মনে করার চেষ্টা করছি–

Come not, when I am dead,
To drop thy foolish tears upon my grave.

আমার মৃত্যুর পর তুমি এসো না,
তোমার নির্বোধ অশ্রু আমার কবরে যেন না পড়ে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ