আপনাকে অনেক কথা বলে ফেলেছি। এখন আপনার কী ধারণা হচ্ছে? আমি পাগল? না-কি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পছন্দ করে এমন কেউ?

পাগলরাও কিন্তু মানুষকে বিভ্রান্ত করে মজা পায়। তারা নিজেরা বিভ্রান্ত বলেই অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করতে চায়। আমার এক বন্ধু ইসলামিয়া কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। একদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো তিনি ইজিচেয়ারে বসে পান খাচ্ছেন। আমাকে দেখেই মোটামুটি আনন্দিত গলায় বললেন, খবর শুনেছ? আমি

তো পাগল হয়ে গেছি। ব্রেইন পুরোপুরি কলাপস করেছে।

আমি বললাম, তাই নাকি!

তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, হ্যাঁ ঘটনা সে-রকম। আমার ফ্যামিলির লোকজন অবশ্যি আসল কথা ফাঁস করছে না। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে আমার সামান্য মাথা গরম হয়েছে। আমি তো জানি ঘটনা কী।

ঘটনা কী?

ঐ যে বললাম, পাগল হয়ে গেছি। লক্ষণ কী জানতে চাও?

জানতে চাই।

ঘটনা হলো–সারাক্ষণ আমার পেটে কে যেন কথা বলে। অর্ধেক বোঝা যায়, অর্ধেক যায় না। আমার পেটে কান রাখলে তুমিও শুনতে পাবে। এসো, শুনে দেখ।

বলেই তিনি পাঞ্জাবি উপরে তুলে পেট বের করলেন। তিনি যা করলেন তা হলো–আমাকে বিভ্রান্ত করলেন। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার মনে হলো–সত্যি সত্যি কেউ বোধহয় তার পেটে কথা বলছে।

রূপার সঙ্গে কীভাবে আমার বিয়ে হলো সেই গল্প শুনবেন, না-কি আমার বাড়িতে ভূতের উপদ্রবের গল্পটা শুনবেন? আমি দুটাই বলব। কোনটা আগে শুনতে চান? ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে ভূতেরটা আগে বলতে হয়, তবে ইন্টারেস্টিং বেশি বিয়েরটা। ভূত এবং বিয়ে আমার বেলায় সম্পর্কিত। ফিজিক্সে প্রথমে Cause তারপর Effect. আমার বেলায় ভূতটা Cause, বিয়ে হলো Effect.

ঠিক আছে, ভূত দিয়েই শুরু করি। যদিও ভূতের গল্পটা এখন করতে চাচ্ছিলাম না। ভূতের গল্প যত ভয়ঙ্করই হোক, দিনের বেলা পানসে লাগে। শুধু পানসে না, হাস্যকরও লাগে। যিনি দিনের বেলায় আগ্রহ নিয়ে ভূতের গল্প করেন, সবাই তার দিকে মজা পাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন সে ভূতের গল্প বলছে। না, জোকস বলছে। খুব সিরিয়াস জায়গায় নিজেকে অতিরিক্ত বুদ্ধিমান মনে করেন, এমন শ্রোতা সবাইকে হাসানোর জন্যে বলে বসেন–তারপর ভূতটা কী করল? আপনার সঙ্গে কোলাকুলি করল? যিনি ভূতের গল্প করছেন তিনি তখন রেগে যান। তিনি যতই রাগেন অন্যরা ততই মজা পায়। এই মজাটা আমি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম না।

যাই হোক, ভূত প্রসঙ্গটা দ্রুত শেষ করে বিয়ের প্রসঙ্গে আসি। এক শ্রাবণ মাসের ঘোর বর্ষার দুপুরে আমি ভূত দেখলাম। সরি, একটু ভুল হয়েছে–ভূতের কথা শুনলাম। ঘটনাটা বলি। দুপুরের খাওয়া শেষ করে বই হাতে নিয়ে বিছানায় গিয়েছি। সরি, আবারো ভুল করেছি। বই না, ম্যাগাজিন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। দুপুরের খাবার পর আমি ম্যাগাজিন পড়ি। রাতে পড়ি বই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে তুন্দ্রা অঞ্চলে বিপন্ন পেঙ্গুইনদের উপর একটা লেখা পড়ছি। সুন্দর সুন্দর ছবি। ছবিগুলি দেখতে ভালো লাগছে। খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। বিছানায় চাদর নেই বলে গায়ে চাদর দিতে পারছি না। চাদর বের করে দেবার জন্যে কাউকে ডাকতে হবে। বিছানায় শুয়ে ডাকলে হবে না, আমাকে দোতলা থেকে একতলায় নামতে হবে। কারণ আমার কোনো কাজের লোকের দোতলায় উঠার হুকুম নেই। দোতলাটা আমার একার।

যে চাদরের উপর শুয়ে আছি তারি অর্ধেকটা নিজের উপর দিয়ে পড়তে শুরু করলাম। আর্টিকেলের শুরুটা করেছে চমৎকার। জন স্টেইনবেকের উপন্যাসের নাম দিয়ে প্রবন্ধের শুরু–It was a winter of discontent.

বাক্যটা শেষ করা মাত্র পরিষ্কার মেয়েলি গলায় একজন কেউ বলল, কী পড়েন?

আমি বই নামিয়ে বললাম, কে?

তার উত্তরে নারীকণ্ঠ সামান্য হেসে আবারো বলল, কী পড়েন?

এর মধ্যে আমি দেখে নিয়েছি যে ঘরে কেউ নেই। ভয় পাই নি খুবই বিস্মিত হয়েছি। তবে অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কে কথা বলে?

এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ একজন হালকা করে নিঃশ্বাস ফেলল। জবাব দিল। আমি দীর্ঘ রচনাটা পড়ে শেষ করলাম। কোনো কথাবার্তা শুনলাম না। পর পর দু’টা সিগারেট টেনে ঘুমুতে গেলাম। ভালো ঘুম হলো। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস। বাতাসে জানালা নড়ছে। খটখট শব্দ হচ্ছে। খুবই বিরক্তি লাগছে। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ঘুমটা পুরোপুরি কাটে নি। আরো কিছুক্ষণ ঘুমানো যায়। এই সময় দুপুরের নারীকণ্ঠ আবার শুনলাম। সে মধুর গলায় বলল, আর কত শুয়ে থাকবেন?

দুপুরের নারীকণ্ঠের কথা কিছুই মনে ছিল না। হঠাৎ সবটা এক সঙ্গে মনে পড়ল। আমি হতভম্ব গলায় বললাম, একী! বিছানা থেকে নামলাম। হাত-মুখ ধুলাম। এবং খুবই স্বাভাবিকভাবে এক তলায় চলে গেলাম। রফিক সঙ্গে সঙ্গে মগভর্তি চা নিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, স্যারের কি শরীর খারাপ? আমি বললাম, না, শরীর ঠিক আছে। তার চোখ থেকে উদ্বিগ্ন ভাব দূর হলো না। রফিক আমার সঙ্গে আছে প্রায় বার বছর। বার বছর দু’জন মানুষ পাশাপাশি থাকলেই একজন আরেকজনের জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ করে। এটা জগতের অনেক গুরুত্বহীন সাধারণ নিয়মের একটি। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, রফিক, আমাদের বাড়িতে কি ভূত আছে?

রফিক সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি স্যার আছে।

তুমি কখনো দেখেছ?

জি।

ভূতটা কী করে?

কিছু করে না। হাসে কান্দে। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। মসলা পিষে।

মসলা পিষবে কেন? ভূতের কি রান্নাবান্না করার কোনো ব্যাপার আছে?

রফিক জবাব দিল না। ভীত মুখ করে দাড়িয়ে রইল। আমি চিন্তিত বোধ করলাম না, কারণ চিন্তিত বোধ করার কিছু নেই। আমার যা হচ্ছে তার নাম। হেলুসিনেশন। অডিটরি হেলুসিনেশন। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের এরকম হয়। খুব সম্ভব আমি সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আমি সম্ভবত নিউরোসিস পর্যায়ে আছি। রোগ বাড়তে দিলে সাইকোসিস পর্যায়ে চলে যাব। তখন আর কিছু করার থাকবে না। সাইকোসিস পর্যায়ে ভয়ঙ্কর কাণ্ডকারখানা ঘটতে থাকবে। তার আগেই কোনো একটা ব্যবস্থা নেয়া উচিত। নিওরোসিস এমন কোনো ব্যাপার না। পৃথিবীর বিশ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে নিওরোসিসের রোগী। এই রোগ মাথায় নিয়ে বাস করা যায়। বারমেসে সর্দির মতো বারমেসে হালকা নিওরোসিস।

এই মুহূর্তে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে ছুটে যাবার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। নিজের চিকিৎসা আমাকে নিজেকেই করতে হবে। দোতলায় বাস করতে পারবে। এমন কাউকে আমার প্রয়োজন। বইপত্রে যতদূর পড়েছি অডিটরি হেলুসিনেশনের ব্যাপারগুলি একা থাকলেই হয়।

আমি দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিলাম। রফিক ভয়ে ভয়ে বলল, জলিল সাবরে খবর দিব?

আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম। জলিল সাহেব (মোঃ আবদুল জলিল) আমাদের পারিবারিক ডাক্তার। বয়সজনিত কারণে এখন রোগী দেখা বন্ধ। করেছেন, তবে আমার চিকিৎসা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। খবর পেলেই তাঁর মরিস মাইনর গাড়ি নিয়ে ছুটে আসেন। তাঁর সমস্যা একটাই, ছোট কোনো অসুখ তিনি চিন্তা করতে পারেন না। যদি তাকে বলা হয় মাথাব্যথা। তিনি তৎক্ষণাৎ বলেন–ঘনঘন মাথাব্যথা? বলে কী! মাথায় কোনো টিউমার হয় নি। তো? বাবা, চোখে কি ঝাপসা দেখ? যদি বলি–ডান পাটা কেমন যেন ফোলা ফোলা লাগছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর গলায় বলেন–পা ফোলা তো ভালো কথা না। কিডনি ফেল করে নি তো? আজকাল ঘরে ঘরে কিডনি ফেল করা রোগী।

রফিক আবারো বলল, জলিল সাবরে খবর দেই?

আমি বললাম, খবর দিতে হবে না। আমি ভালো আছি। রফিক শোন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করব।

রফিক চমকে উঠল। সম্ভবত কিছুক্ষণ ঠিকমতো নিঃশ্বাসও নিতে পারল না। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হড়বড় করে বলল, ইফতেখার সাবরে খবর দেই?

আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, দাও।

আমার যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে লোকজন আছে। তাদের দায়িত্ব ভাগ করা। চিকিৎসাসংক্রান্ত কাজের জন্যে আছেন জলিল চাচা। পারিবারিক কর্মকাণ্ডের জন্যে আছেন শেখ ইফতেখার। সম্পর্কে মামা। আমার মায়ের খালাতো ভাই। বৈষয়িক কর্মকাণ্ডের জন্যে আছেন রহমত মিয়া। অতি অতি ধুরন্ধর লোক। দিনকে রাত করা তার কাছে ছেলেখেলা। তার কর্মপদ্ধতি যথেষ্ট জটিল। তিনি যে ফিলসফিতে বিশ্বাস করেন সেটা–অনুরোধে কাজ করব না। করাব না। ধরাধরিতেও কাজ করাব না। টাকা দিয়ে কাজ করাব। হাসিমুখে কাজ করবে, সময়মতো করবে, দেখা হলে কুকুরের মতো আনন্দে লেজ নাড়বে। মানুষ যখন আনন্দে তার অদৃশ্য লেজ নাড়ায় তখন দেখতে বড় মজা লাগে।

রহমত মিয়া মাসে একবার গাড়ি নিয়ে ভৈরব চলে যান। গাড়ি ভর্তি করে। বিশাল বিশাল মাছ নিয়ে ফেরেন। সেইসব মাছ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের বাড়িতে উপহার হিসেবে চলে যায়। রহমত মিয়া মাথা নিচু করে বলেন, বুঝলেন ভাইজান, পাঁচ হাজার টাকার একটা মাছে যে কাজ করবে পঞ্চাশ হাজার টাকা। ঘুসে সেই কাজ হবে না। দু’শটা এক বিঘৎ সাইজের কৈ মাছ দিয়ে আমি একবার দশ লাখ টাকার কাজ করিয়ে নিয়েছিলাম।

মানুষকে ঘুস দেয়া বিরাট শিল্পকর্ম। রহমত মিয়া সেই শিল্পকর্মের একজন বিপুল কারিগর। তার কথা পরে বলব, এখন ইফতেখার মামার প্রসঙ্গে আসি। বৈষয়িক লাইনে যেমন রহমত মিয়া, পারিবারিক লাইনে তেমনি ইফতেখার মামা। বিশাল কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় রুমী টুপি (এই জিনিস নাটক-সিনেমা ছাড়া আজকাল দেখি না, কিন্তু মামার কাছে আছে)। ইফতেখার মামার সঙ্গে ব্রিফকেস জাতীয় একটা ব্যাগ সবসময় থাকে। ব্যাগের ভেতর থাকে একটা জায়নামাজ, তসবি, একটা কোরান শরিফ এবং এক বোতল জমজমের পানি। কথাবার্তার এক ফাকে যখন খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে তখন তিনি অবধারিতভাবে গম্ভীর গলায় বলেন, একটু অজুর পানি দিতে হয় যে, নামাজ পড়ব। কেবলা কোন দিকে?

তিনি অনেক সময় নিয়ে নামাজ পড়েন। তসবি পাঠ করেন। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ সময় মোনাজাত করেন। নামাজ এবং মোনাজাতপর্ব শেষ হবার পর তিনি সবাইকে এক ঢোক করে জমজমের পানি খেতে দেন। সেই পানি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কেবলামুখি হয়ে (নামাজের ভঙ্গিতে বসে) খেতে হয়।

ইফতেখার মামার বোতলের জমজমের পানি কখনো শেষ হয় না। বোতল অর্ধেক খালি হতেই তিনি তার সঙ্গে মিনারেল ওয়াটার যুক্ত করেন। তিনি বিশিষ্ট আলেমদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন এতে জমজমের পানির গুণাগুণের কোনো তারতম্য হয় না।

তিনি যখন নতুন কারো সঙ্গে কথা বলেন তখন কথাবার্তার একটা পর্যায়ে বলেন–বুঝলেন জনাব, আমি অতি ক্ষুদ্র নাদান মানুষ। গুনার মধ্যে ড়ুবে আছি। মৃত্যুর পরে আল্লাহ আমাকে কী আজাব দিবেন সেই চিন্তায় অস্থির থাকি। রাতে ঘুম হয় না। গেলাম একবার হজ করতে। সেখানে কাবা শরিফ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কিছু পারি না-পারি, নবিজির একটা সুন্নত বাকি জীবন পালন করব। মিথ্যা কথা বলব না। ঝোকের মাথায় প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলাম, তারপরে যে বিপদে পড়েছি সেই বিপদের কোনো মা-বাপ নাই। মনের ভুলে যদি ফুট ফাট এক আধটা মিথ্যা বলে ফেলি, সাথে সাথে যে হাতে কাবা ছুঁয়ে ছিলাম সেই হাত অবশ হয়ে যায়। তওবা না করা পর্যন্ত হাত ঠিক হয় না। আমি কী যে মুসিবতের মধ্যে আছি সেটা আর আপনাদের কী বলব, আমার মতো বিপদে যেন কেউ না পড়ে।

এই ধরনের মানুষ অতি দ্রুত যে-কোনো পরিবেশে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ইফতেখার মামা এই কাজটি করেন।

ভাই, আপনি কী বললেন? কাবা শরিফ ছুঁয়ে সত্যি সত্যি তিনি কোনো প্রতিজ্ঞা করেছেন কি-না? আমি বলতে পারি না। তাকে কখনো জিজ্ঞেস করি নি। তবে তিনি যে সত্যি কথা বলেন এটা ঠিক।

 

ইফতেখার মামা অতি দ্রুত আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। মেয়ের নাম সাথী। সে ডাক্তার।

চমকে উঠলেন, না? আগে আপনাকে বলেছিলাম মেয়ের নাম রূপা। মেয়ে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। মেয়ের বড় বোন ডাক্তার, তার নাম সাথী। এই কারণেই শুরুতে আপনাকে আমার স্ত্রীর কী নাম সেটা বলতে চাচ্ছিলাম না। এখন ঘটনা বলব, আপনার কাছে সব পরিষ্কার হবে।

ইফতেখার মামা হলেন ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ টাইপ মানুষ। বিয়ের কথা শুরু হবার এক সপ্তাহের মধ্যে আমার বিয়ে হয়ে গেল। সেই বিয়েও বিচিত্র। আমি গিয়েছি মেয়ে দেখতে। খানিকটা প্রাচীন কায়দায় মেয়ে দেখা হচ্ছে। আমি বসে আছি তাদের বাড়ির বসার ঘরে। আমার সঙ্গে আছেন ইফতেখার মামা, ডাক্তার জলিল চাচা এবং রহমত মিয়া। ডাক্তার কন্যা জড়সড় ভঙ্গিতে ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে ঢুকল। ভীত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে অতি দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।

জলিল চাচা বললেন, মাশাল্লা, মেয়ে তো অত্যন্ত রূপবতী।

ইফতেখার মামা বললেন, মেয়ে দেখার কিছু নাই। আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছি মেয়ে আমাদের পছন্দ। আজ আমরা ছেলে নিয়ে এসেছি। ভালো করে। ছেলে দেখেন। ছেলেকে যদি জিজ্ঞাসা করার কিছু থাকে জিজ্ঞেস করেন। আড়ালে কথা বলাবলির কিছু নাই। পছন্দ না হলে মুখের উপর বলবেন, পছন্দ হয় নাই। আর পছন্দ হলেও মুখের উপর বলবেন, পছন্দ হয়েছে।

ইফতেখার মামা মেয়ের বাবার দিকে ঝুঁকে এসে তার হাত ধরলেন। মেয়ের বাবা ইতস্তত করতে লাগলেন। ইফতেখার মামা বললেন, ভাইসাহেব, বলেন–হ্যাঁ কি না। একটা কিছু না বলা পর্যন্ত আমি হাত ছাড়ব না।

সোবাহান সাহেব (সাথীর বাবার নাম) আমতা আমতা করে বললেন, ছেলের চেহারা ছবি তো খুবই সুন্দর। আমার পছন্দটা তো বড় না, আমার মেয়ে…

ইফতেখার মামা বললেন, যান, মেয়ের মতামত নিয়ে আসুন। বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যার মতটাই গুরুত্বপূর্ণ।

চট করে সে কি কিছু বলবে? মিনিমাম সপ্তাহখানেক সময় তো দরকার।

ইফতেখার মামা বললেন, ভুল কথা বলেছেন ভাইসাহেব। এইসব কাজে সময় দিতে নাই। সময় দিলেই নানান হুজ্জত শুরু হয়। লাগানি ভাঙ্গানি চলতে থাকে। আপনি ভেতরে যান। মেয়ের মতামত নিয়ে আসেন।

সোবাহান সাহেব ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন, মেয়ে। কিছু বলছে না। চুপ করে আছে।

ইফতেখার মামা বললেন, কান্নাকাটি কি করছে?

জি-না।

ইফতেখার মামা বললেন, তাহলে মেয়ের মত আছে। বাঙালি মেয়েকে। কখনো শুনছেন যে মুখ ফুটে বলবে বিয়েতে রাজি? রাজি না হলে বলবে–রাজি না। চোখের পানি ফেলবে। মেয়ে কাঁদছে না, কিছু বলছেও না–তার মানে আলহামদুলিল্লাহ। আসুন বিয়ে পড়িয়ে দেই।

সোবাহান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, বিয়ে পড়িয়ে দেবেন মানে কী?

ইফতেখার মামা হাসিমুখে বললেন, আপনাকে বলা হয় নাই, আমি একজন সরকারি কাজি। আমার কালো ব্যাগটার ভেতর কোরান শরিফ জায়নামাজ যেমন। আছে, কাবিননামার কাগজপত্রও আছে। সবসময় সঙ্গে রাখি। কখন কোন কাজে লাগে কে জানে। যান মেয়েকে অজু করতে বলেন। এজিন কাবিন হয়ে থাকুক। মেয়েকে তুলে নেয়া হবে পরে। তখন আমরা উৎসব করব।

সোবাহান সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, এইসব আপনি কী বলছেন?

ইফতেখার মামা মধুর হাসি হেসে বললেন, আজ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্র। অতি শুভ সময়। আল্লাহপাকের যদি হুকুম থাকে তাহলে আজই বিয়ে হবে। হুকুম না থাকলে কোনোদিন হবে না। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, রিজিক, ধনদৌলত–এই পাঁচ জিনিস আল্লাহপাক নিজের হাতে রেখেছেন। দেখি তাঁর মনে কী আছে।

সত্যি সত্যি সেই রাতেই বিয়ে হয়ে গেল। ইফতেখার মামা তার কালো ব্যাগ খুলে সবাইকে খোরমা খাওয়ালেন। খোরমা দেখে বুঝলাম তিনি মোটামুটি তৈরি হয়েই এসেছেন।

 

নাটক-নভেলে যেমন ঘটনা থাকে সে-রকম একটা ঘটনা ঘটল আমার বিয়ের রাতেই। আমি বাসায় চলে এসেছি। রাতে শোবার আয়োজন করেছি, এমন সময় আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে টেলিফোন। টেলিফোন করেছে আমার মেজ শালি। তার নাম রূপা। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমাদের বাড়িতে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে।

আমি বললাম, কী ঘটনা ঘটেছে?

বড় আপা খুব কান্নাকাটি করছে।

আমি বললাম, বিয়ের পর মেয়েরা কান্নাকাটি করেই থাকে।

রূপা বলল, আপনি বুঝতে পারছেন না। বড় আপা শুধু যে কান্নাকাটি করছে তা-না, সে ঘনঘন ফিটও হচ্ছে।

আমি বললাম, ফিট হচ্ছে কেন? তার কি মৃগীরোগ আছে?

রূপা বলল, মৃগীরোগ নেই। আপা হুট করে পড়ানো বিয়ে মানতে পারছে। সে বলছে এই বিয়ে যদি না ভাঙা হয় তাহলে সে হয় ছাদ থেকে লাফ দিয়ে। নিচে পড়বে আর না হয় ঘুমের ওষুধ খাবে।

তুমি তোমার আপাকে দাও, আমি কথা বলি।

আচ্ছা আপনি ধরুন, আমি আপাকে দিচ্ছি।

আমি প্রায় পনেরো মিনিট টেলিফোন কানে ধরে বসে রইলাম। পনেরো মিনিট পর রূপা এসে বলল, আপা আপনার সঙ্গে কথা বলতে রাজি না। সে দেয়ালে মাথা ঠুকে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে।

বলো কী?

আমি আপনার পায়ে পড়ছি–আপনি বিয়ে ভাঙার একটা ব্যবস্থা করুন। আপা খুবই ইমোশনাল একটা মেয়ে। বিয়ে না ভাঙলে আপাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।

আমি শান্ত গলায় বললাম, তুমি তোমার আপাকে বলো–আগামীকাল সকাল দশটার দিকে আমি ইফতেখার মামাকে নিয়ে আসব, বিয়ে ভাঙাতে হলে যা যা করণীয় তখন তা করা হবে। আমি রাতেই আসতাম, কিন্তু এত রাতে মামাকে পাওয়া যাবে না। মামা রাত বারটার পর থেকে তাহাজ্জুতের নামাজে দাঁড়ান। তখন তাঁকে ডাকা নিষেধ।

আপনি কি সত্যি সত্যি কাল সকালে আসবেন?

অবশ্যই আসব। দশটার মধ্যেই আসব।

থ্যাংক য়্যু।

থ্যাংকস দিতে হবে না। তুমি তোমার আপাকে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুতে যেতে বলো।

পরদিন তালাকের ব্যবস্থা হলো। আমি তালাকপর্বের পর হাসিমুখেই কিছুক্ষণ ঐ বাড়িতে থাকলাম। চানাচুর এবং ঘরে বানানো পায়েস খেলাম। সোবাহান সাহেবের সঙ্গে দেশের রাজনীতি নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। তিনি তার গ্রামের বাড়িতে তার দাদার হাতে লাগানো একটা পেয়ারা গাছের গল্প করলেন। সেই পেয়ারা নাকি এই ভুবনের সেরা। একবার যে ঐ পেয়ারা খেয়েছে। সে বাকি জীবনে আর পেয়ারা মুখে দিতে পারবে না। পেয়ারা মুখে দিলেই থু করে ফেলে দেবে। আমি পেয়ারার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখালাম। তিনি বললেন, ওই পেয়ারা এনে তিনি আমাকে খাওয়াবেন।

আষাঢ় মাসে তিনি সত্যি সত্যি পেয়ারা এনে আমাকে খাওয়ালেন এবং শ্রাবণ মাসে তার মেজ মেয়ে রূপার সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। তাড়াহুড়া বিয়ে না। আয়োজনের বিয়ে। গায়ে-হলুদ ফলুদ সবই হলো। বরের জুতা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া থেকে আয়নায় বর-কনের মুখ দেখাদেখি কিছুই বাদ গেল না। রূপার বড় বোন খুবই আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি অনুষ্ঠানে যোগ দিল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ