শুরুতেই আপনি আমাকে পাগল ভাববেন না।

শুরুতে পাগল ভাবলে আমার গল্পটা আপনি মন দিয়ে শুনবেন না। আর শুনলেও তেমন গুরুত্ব দেবেন না। জগতের কোনো মানুষ পাগলদের কথা মন দিয়ে শোনে না। এমনকি সাইকিয়াট্রিস্টরাও না। অথচ পাগলদের কথা তাদেরই সবচে’ মন দিয়ে শোনার কথা। ঠিক না?

সাইকিয়াট্রিস্টরা যে পাগলদের কথা মন দিয়ে শুনেন না–তা কী করে টের পেলাম জানেন? আমার স্ত্রী একবার আমাকে এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেল। সে আগে আমাকে বলে নি কার কাছে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু বলেছে তার দূরসম্পর্কের ভাই। আমাদের বিয়ের সময় তিনি দেশে ছিলেন না বলে দেখা হয় নি। এখন দেশে ফিরেছেন। তার সঙ্গে দেখা করা সামাজিক দায়িত্ব।

আমার স্ত্রীর ধারণা ছিল আগে থেকে সাইকিয়াট্রিস্ট বললে আমি হয়তে যেতে চাইব না। যাই হোক, আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে ভদ্রলোকের বাসায় গেলাম। মধ্যবয়স্ক একজন লোক। প্রচুর টাকা-পয়সা আছে বলে মনে হলো। বসার ঘর সুন্দর করে সাজানো। রেনওয়ার কিছু ছবির সুন্দর রিপ্রডাকশন দামি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। দেখে হঠাৎ করে মনে হবে অরিজিনাল না।

ভদ্রলোক আমাদের যত্ন করে বসালেন। আন্তরিকভাবে কথা বলা শুর করলেন। আমি ছবি নিয়ে কথা বলছি; ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন, এক সেকেন্ড একটা জরুরি টেলিফোন করে আসি, কিছু মনে করবেন না। রাত আটটার টেলিফোন করার কথা। ন’টা বেজে গেছে, আগে খেয়াল করি নি। সরি, সরি।

তিনি টেলিফোন করতে গেলেন, বিশ মিনিট পর ফিরে এসে বললেন তারপর বলুন–আমরা কোথায় ছিলাম যেন?

আমি বললাম, আমরা গত বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে কথা বলছিলাম। জার্মান ফুটবলার বেকেনবাওয়ারকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।

ও আচ্ছা, বলুন…।

আমি বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। অথচ আগে ছবি নিয়ে কথা বলছিলাম। প্রসঙ্গ পরিবর্তন ভদ্রলোক ধরতেই পারেন নি, কারণ তিনি গুরুত্ব দিয়ে কিছু শুনছিলেন না।

আমার স্ত্রী আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিল, কারণ বিয়ের পরপরই তার ধারণা হলো–আমার মাথায় কোনো সমস্যা আছে। এই ধারণা তার হতো না, হয়েছে আমার পারিবারিক ইতিহাসের কারণে। পাগলামির ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে আছে। চল্লিশ বছর বয়সে আমার বাবার মস্তিষ্কবিকৃতি হয়। তার চার বছর পর ঢাকার একটা মেন্টাল হোমে তার মৃত্যু ঘটে। আমার দাদিও পাগল ছিলেন। গভীর রাতে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আমাদের গ্রামের বাড়ির ছাদে চক্রাকারে দৌড়াতেন। এবং খুবই আনন্দিত গলায় চেঁচাতেন–আমি ন্যাংটা, আমি ন্যাংটা।

আমাদের গ্রামের বাড়িটি পাকা এবং চারদিকে উঁচু দেয়াল। তারপরেও দূর থেকে ছাদের দৃশ্য দেখা যায়। কাজেই আমার দাদা পারিবারিক আব্রু বজায় রাখার জন্যে ছাদের রেলিং অনেক উঁচু করে দিলেন।

এ জাতীয় পারিবারিক ইতিহাসের কারণে আমার স্ত্রী যে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে সেটাই স্বাভাবিক। তার সেই সন্দেহ আরো গাঢ় হলো যখন সে। দেখল, আমার আচার-আচরণ অন্য দশজনের মতো না, খানিকটা আলাদা। যেমন প্রায়ই গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমি নিঃশব্দে ছাদে চলে যাই। ছাদে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকি। তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকার আনন্দ অধিকাংশ মানুষ জানে না বলে তারা এই কাজটা করে না। এর মধ্যে পাগলামি কিছু নেই। অথচ আমার স্ত্রীর ধারণা–আমার মাথা এলোমেলো। মাথা এলোমেলো না হলে কেউ কি তার নবপরিণীতা স্ত্রী ফেলে ছাদে শুয়ে থাকে?

এক রাতে কী হয়েছে শুনুন। আমি ছাদে শুয়ে আছি, নেমেছে বৃষ্টি। কুকুরবেড়াল টাইপ বৃষ্টি। আমাদের ছাদটা ঢাকার রাস্তার মতো, সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। আমি নাক ভাসিয়ে পানিতে শুয়ে আছি আমার স্ত্রী এসে উপস্থিত। আমাকে দেখে সে আঁতকে উঠে বলল, এসব কী হচ্ছে? আমি বললাম, এসো, আমার পাশে শুয়ে পড়।

সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কেন?

আমি বললাম, নাক ভাসিয়ে বৃষ্টির পানিতে শুয়ে থাকলেই বুঝবে–কী হচ্ছে। খুবই মজা হচ্ছে।

সে কী যে অবাক হয়েছিল। তার সেই অবাক দৃষ্টি আমার এখনো মনে আছে। কাউকে অবাক করতে পারলে আমার ভালো লাগে।

বিয়ের পর পর লক্ষ করলাম, আমার স্ত্রী আমাকে খানিকটা ভয় করতে শুরু করেছে। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি। মনে করুন, সে আমার জন্যে চা নিয়ে এসেছে। তখন যদি তার নাম ধরে ডাকি সে এমন চমকে উঠবে যে হাত থেকে চায়ের কাপ উল্টে যাবে। কয়েকবার এরকম হয়েছে। একবার তো গরম চা পড়ে হাতে ফোসকা পড়ে গেল।

আমাদের বারান্দাটা অনেক বড়। সেই বারান্দায় আমি একবার একটা দড়ি সিলিং থেকে লাগাচ্ছি। কাজটা করছি চেয়ারে দাঁড়িয়ে। লক্ষ করলাম রূপা (রূপা আমার স্ত্রীর নাম, আপনাকে এখনো মনে হয় তার নাম বলি নি। না বলার কিছু কারণ আছে বলেই বলি নি। কারণটা একটু পরে বলি?) দূর থেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করছে। এক সময় সে কাছে এসে বলল, কী করছ? আমি। বললাম, দড়ি ফিট করছি।

কেন?

ফাঁসিতে ঝুলব বলে ভাবছি। আজ দিনটা শুভ। শুক্রবার। ঝুলে পড়ার জন্য। এরচে’ ভালো দিন হয় না।

রূপা আঁ আঁ করে বিকট চিৎকার করে ফিট হয়ে পড়ে গেল। আমি তাকে। বলার সুযোগই পেলাম না যে কাজটা করছি একটা দোলনা টানানোর জন্যে। বেতের আসবাবপত্রের দোকানে সুন্দর চেয়ার পাওয়া যায়, যা দড়িতে ঝুলিয়ে দিলে ঝুলন্ত চেয়ার হয়। আমার ধারণা হয়েছিল গল্পের বই নিয়ে ঝুলন্ত চেয়ারে বসতে রূপার ভালো লাগবে।

তখনো আমি বুঝতে পারি নি রূপা আমাকে পুরোপুরি পাগল ধরে নিয়েছে। দড়িটা যে আমি চেয়ার ঝুলানোর জন্যে টানিয়েছি–তা কিছুতেই তাকে বিশ্বাস। করানো গেল না। সে ধরেই নিল আমার মূল পরিকল্পনা ছিল ফাঁসিতে ঝুলা। শেষটায় মত পরিবর্তন করে আমি চেয়ার ঝুলিয়ে দিয়েছি।

আমার জীবনযাপন পদ্ধতি আর দশজন মানুষের মতো না, তা ঠিক। আর দশজন মানুষের মতো না হওয়ার পেছনে যুক্তিও আছে। আর দশটা মানুষ অফিস করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে। আমি কিছুই করি না। দিন-রাত ঘরে থাকি। দিনরাত যে ঘরে বসে থাকে তার মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার খেলা করবে এটাই তো স্বাভাবিক। কথায় আছে না—

‘আলসের চোখে কিলবিল করে আইডিয়া
উইপোকা বলে চল ভাই তারে খাই গিয়া।’

আপনি যদি বুদ্ধিমান হন তাহলে নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে ধরে ফেলেছেন যে আমার অর্থবিত্ত প্রচুর আছে। আমাদের দেশের খুব কম মানুষেরই গ্রামের বাড়িতে দালান আছে। আমার যে আছে তা তো আগেই বলেছি। সে দালানও দেখার মতো। হুলুস্থুল ব্যাপার। গ্রীক আর্কিটেকচার টাইপ বিশাল বিশাল খাম্বা। আপনি রাজি হলে একবার আপনাকে দেখিয়ে নিয়ে আসব। আমার বাবা ব্যবসা করতেন। তিনি ছিলেন ভাগ্যবান ব্যবসায়ী। যাতে হাত দিয়েছেন তাই ফুলে ফেপে একাকার হয়েছে। তার বিপুল বিত্তের বড় অংশই তাঁর মাথা খারাপ হবার পর আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। তবে যা পাওয়া যায় তাও কম না। ঢাকা। শহরে দু’টি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স আছে, আমি যার মালিক। ব্যাংকে নগদ অর্থের পরিমাণও কম না। সেই অর্থে যেহেতু হাত দেয়া হয় না, তা দিনে দিনে বেড়ে একটা হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি করছে। হুলুস্থুল’ শব্দটা আমি ঘনঘন ব্যবহার করি। কিছু মনে করবেন না। এটা আমার মুদ্রাদোষ। মুদ্রাদোষটা পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। তিনি বলতেন–’হুলুসতুলুস’।

আমি থাকি পুরনো ঢাকায় আমার দাদাজানের আদি বাড়িতে। বাড়িটি ছোট এবং দোতলা, তবে অনেকখানি জায়গা নিয়ে। গাছ-গাছরায় জঙ্গলের মতো হয়ে থাকে। সেই গাছগুলিতে চারটা বাদর থাকে। বাঁদরগুলির সঙ্গে গল্প করে আমার অনেকটা সময় কাটে।

আমার কথাবার্তা এরা বেশ আগ্রহ নিয়ে শোনে এবং আমার ধারণা এরা। খানিকটা বুঝতেও পারে। মানুষের সঙ্গে আমরা যখন গল্প করি তখন কী হয়? যে শ্রোতা সে কিছুক্ষণ পর পর ‘হুঁ’ দিয়ে গল্পটা চালিয়ে নিতে সাহায্য করে। আমার বাঁদর-বন্ধুরাও তাই করে। গল্প বলার সময় খানিকক্ষণ পর পর ‘হু’ জাতীয় শব্দ করে এবং মাথা নাড়ে। এদের সময় দেয়াটাও রূপা আমার পাগলামির প্রকাশ বলেই ধরে নিল। যখন আমি বাঁদরের সঙ্গে গল্প করতাম, সে জানালা দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখত। আমি তাকালেই জানালার পর্দা ফেলে দিত।

বেঁচে থাকার জন্যে যাকে কোনোরকম কাজকর্ম করতে হয় না, তার জীবনযাপন পদ্ধতি একটু আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক। রূপার কাছে এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক বলে মনে হলো। সে বাস করতে লাগল ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে। আমি তেমন গুরুত্ব দিলাম না। আমার ধারণা ছিল সে দ্রুত আমার আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আমি তার মনের সন্দেহ দূর করার তেমন চেষ্টাও করলাম না, তবে লক্ষ করলাম আমাকে সুস্থ করে তোলার প্রবল চেষ্টা সে চালাচ্ছে। যেমন, এক রাতে ঘুমুতে যাবার সময় সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, এই ট্যাবলেটটা খেয়ে ঘুমাও।

আমি বললাম, কী ট্যাবলেট?

ফ্রিজিয়াম। খেলে আরামে ঘুমুবে। এক ঘুমে রাত কাবার হয়ে যাবে।

আমার ঘুমের তো কোনো সমস্যা নেই। আমি এক ঘুমেই রাত কাবার করে ফেলি। শুধু রাত না, দিনেরও খানিকটা অংশ কাবার করি। সকাল নটার আগে ঘুম থেকে উঠি না। কাজেই তুমি নিশ্চিত থাকতে পার যে আমার ঘুমের কোনো সমস্যা নেই।

সমস্যা আছে। প্রায়ই তুমি রাতে ছাদে শুয়ে থাক।

ঘণ্টাখানিক বা ঘণ্টা দুই শুয়ে থাকি। তাতে আমার কোনো অসুবিধা তো হয়। দিনে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেই।

প্লিজ খাও না।

আমাকে ট্যাবলেট খাওয়ানোর বুদ্ধি তোমাকে কে দিয়েছে? তোমার বড় আপা?

রূপা চুপ করে রইল। তার মানে রূপার বড় বোন সাথী এই কাণ্ড করেছে।

রূপারা তিন বোন। বড় বোন ডাক্তার। মিটফোর্ড হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। সবচে’ ছোটটিও ডাক্তার হবার চেষ্টায় আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। রূপা পড়েছে ইংরেজি সাহিত্য। এরা নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবারের। বাবা পোস্টাল সার্ভিসে ছিলেন। বর্তমানে রিটায়ার করেছেন। মালিবাগে তাদের ছোট্ট দোতলা বাড়ি আছে। যার দোতলাটা ভাড়া। সংসার চলছে পেনশনের টাকায় এবং বাড়ি ভাড়ার টাকায়। বিয়ের পর ঐ বাড়িতে আমি মাত্র দু’বার গিয়েছি। তৃতীয়বার যাবার রুচি হয় নি। ওরাও আমাকে নিতে চায় নি। সম্ভবত রূপার মতো তাদের পরিবারের সবার ধারণা আমি উন্মাদ বিশেষ। শেষবারের মতো যখন ও বাড়িতে গেলাম, আমার শ্বশুরসাহেব সারাক্ষণ তটস্ত হয়ে রইলেন। সাপুড়ে সাপের খেলা দেখাবার সময় দর্শকরা সাপের দিকে যেমন চোখে তাকায়, শ্বশুরসাহেবের দৃষ্টিও সে-রকম। তিনি অনেক ইতস্তত করে বললেন, বাবা, তুমি শুনলাম দিনরাত বাড়িতে থাক। কখনো বের হও না…।

আমি বললাম, ঠিকই শুনেছেন। বাইরে বেরুবার প্রয়োজন হয় না বলে বের হই না। তা ছাড়া ভিড় হৈচৈ আমার পছন্দ হয় না। মাথা ধরে যায়।

তবু লোকজনের সঙ্গে মিশলে মন প্রশান্ত থাকে। আমার মন প্রশান্তই আছে।

তা ঠিক। অবশ্যই ঠিক–তবে জানো কি বাবা, বাইরে ঘোরাঘুরি করলে শারীরিক পরিশ্রম হয়, তাতে রাতে সুন্দ্রিা হয়। সুন্দ্রিা আমাদের জন্যে প্রয়োজন।

আমার দ্রিা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, আমার সুদ্রিা হয়।

রূপা বলছিল রাতে তুমি ছাদে বসে থাক।

ঠিক বলে নি। রাতে ছাদে অল্প কিছু সময় কাটাই। তাও বসে থাকি না। শুয়ে থাকি।

কেন?

এমনি। কোনো কারণ নেই।

রূপা বলছিল তুমি না-কি বাঁদরের সঙ্গে কথা বলো।

মাঝে মাঝে বলি।

কী কথা বলো?

নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলি না। যখন যা মনে আসে বলি।

ও আচ্ছা।

আপনি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?

না।

আমার শ্বশুরসাহেব পুরোপুরি ঝিম মেরে গেলেন। তাঁর ঝিমন্ত ভাব আরো বাড়াবার জন্যে বললাম, শ্রোতা হিসেবে বাদর খুব ভালো।

শ্বশুরসাহেব বিড়বিড় করে বললেন, তাই না-কি?

আমি বললাম, জি। এরা খুব মন দিয়ে কথা শোনে।

শ্বশুরসাহেব ঝিম ধরা গলায় বললেন, ও আচ্ছা। ভালো।

 

কর্মহীন মানুষ নিজেদের ব্যস্ত রাখার জন্যে নানান ধরনের কাজ খুঁজে বের করে। আমার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে আমি অনেক কিছুই করতাম। বাঁদরের সঙ্গে গল্প করার কথা তো আগেই বলেছি। আমার অফুরন্ত অবসরের একটা বড় অংশ বই পড়ে কাটত। তার পরেও হাতে প্রচুর সময়। এই সময়টা একেক সময় একেক কাজে লাগাতাম। বাইরের মানুষের। কাছে এই কাজগুলিকে পাগলামি মনে হতে পারে। রূপার তাই মনে হতো। হয়তোবা আপনারও তা মনে হবে। একটা উদাহরণ দেই–একবার বইয়ে। পড়লাম ইউপাস ট্রির কথা। অতি বিষাক্ত গাছ। মাত্র আড়াই ফুট লম্বা হয়। পাওয়া যায় জাভা দ্বীপে। গাছগুলি এতই বিষাক্ত যে এ গাছ যেখানে জন্মায় তার আশপাশের দু’মাইলের ভেতর কোনো বড় গাছ তো দূরের কথা, ঘাসও জন্মাতে পারে না। জীবজন্তু, পশুপাখি কেউ এর ধারে কাছে আসতে পারে না। বিষের জ্বালায় মৃত্যুবরণ করে। এই গাছের চারপাশ ধুধু মরুভূমি হয়ে যায়।

আমার মাথায় খেয়াল চাপল এরকম গাছ একটা পাওয়া গেলে কেমন হয়! খোঁজ-খবর করে জানলাম সেটা সম্ভব নয়। ভাবলাম পরিচিত কোনো গাছকে বিষাক্ত করা যায় না? কিছুদিন সেই চেষ্টা চলল, নানান জাতের বিষ এনে পানিতে গুলে টবে রাখা গাছে দিয়ে দি। দিন চারেকের মধ্যে গাছগুলি মরে যায়। মানুষের জন্যে ক্ষতিকর বিষ দেখা গেল গাছের জন্যেও ক্ষতিকর। সেখান থেকে মাথায় চিন্তা এলো–গাছকে পানির বদলে মানুষের রক্ত দিলে কেমন হয়? এতে গাছের কি কোনো পরিবর্তন হবে? যদি হয় তাহলে কী জাতীয় পরিবর্তন হবে? সমস্যাটা নিয়ে বেশ কিছু দিন ভাবলাম। দেখা গেল মানুষের রক্ত দেয়ার কিছু সমস্যা আছে। প্রধান সমস্যা, রক্ত জমাট বেঁধে যায়। জমাট বাঁধা রক্ত পানির মতো মাটির ভেতর যেতে পারে না। দ্বিতীয় সমস্যা, রক্ত পাব কোথায়? দু’টি সমস্যারই সুন্দর সমাধান বের করলাম। ব্ল্যাডব্যাংকের রক্ত। টাকা দিয়ে কিনলেই হয়। এই রক্ত প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা থাকে। এন্টিকোয়াগুলেন্ট দেয়া থাকে বলে রক্ত জমাট বাঁধে না। টাকা এবং যোগাযোগ থাকলেই এই রক্ত পাওয়া কোনো সমস্যা নয়। দুটোই আমার আছে।

রক্তের এক লিটারের দশটি ব্যাগ কিনে আনলাম। টবে পোতা একটা। পেয়ারা গাছের গোড়ায় রোজ এক লিটার করে বি পজিটিভ রক্ত দেই। তৃতীয়। দিনের দিন রূপা জিজ্ঞেস করল, এইসব কী?

আমি বললাম, রক্ত। মানুষের রক্ত।

রূপা হতভম্ব গলায় বলল, রক্ত গাছে দিচ্ছ কেন?

দেখছি–গাছের কোনো পরিবর্তন হয় কি-না।

রূপার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, তুমি অসুস্থ। তুমি অসুস্থ।

আমি মোটেই অসুস্থ না। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ।

রূপা বলল, তুমি ভয়ঙ্কর অসুস্থ। এবং তুমি তা জানো না।

আমি রূপাকে কিছুতেই বুঝতে পারলাম না যে আমি মোটেই অসুস্থ নই। মানুষ হিসেবে আমি বুদ্ধিমান এবং দয়ালু।

রূপা বলল, আমার মনে হয় না, আমি তোমার সঙ্গে বাস করতে পারব।

আমি বললাম, তুমি অবশ্যই আমার সঙ্গে বাস করতে পারবে। তোমার কোনো সমস্যাই হবে না।

এই পরীক্ষা যদি বন্ধ না কর, আমি থাকব না।

আমি পরীক্ষা বন্ধ করে দিলাম। রূপা চলে যাবে এই ভয়ে যে বন্ধ করলাম তা না। পঞ্চম দিনের দিন গাছটা মরে গেল। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, গাছটা চতুর্থ দিনে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল–পাতাগুলি হয়েছিল নীলচে এবং কাণ্ডটা হয়ে গেল ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের। রক্তের কারণে যে গাছ মরে গেছে তা কিন্তু না। বরং গাছটাকে অনেক বেশি সজীব লাগছিল। গাছটা মারা গেল পিঁপড়ার আক্রমণে। রক্তের লোভে ঝাকে ঝাকে পিঁপড়া এসে গাছটাকে আক্রমণ করল। গাছের শিকড় কেটে লণ্ডভণ্ড করে দিল।

আমি ঠিক করলাম এই পরীক্ষাটা আমি আবার করব। এইবার করব এমনভাবে যেন পিপড়া গাছ আক্রমণ করতে না পারে। টমেটো গাছ নিয়ে পরীক্ষা করা হবে। কনট্রোলড এক্সপেরিমেন্ট। আটটা গাছ থাকবে। চারটায় পানির বদলে রক্ত দেয়া হবে। চারটায় পানি। টমেটো হবার পর খেয়ে দেখা হবে–টমেটোর স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি-না।

গাছের পরীক্ষার পর পর রূপা আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেল, যে কথা আপনাকে শুরুতে বলেছি। ভদ্রলোক নানান প্রশ্ন-ট্রশ্ন করলেন। খুব চালাকি ধরনের প্রশ্ন, যাতে আমি বুঝতে না পারি ব্যাপারটা কী। আমি প্রতিটি প্রশ্নের এমন জবাব দিলাম যে ভদ্রলোক মোটামুটি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। ভদ্রলোকের প্রশ্নের এবং আমার উত্তরের কিছু নমুনা দেই।

প্রশ্ন : আপনি কি দুঃস্বপ্ন দেখেন?

উত্তর : হ্যাঁ।

প্রশ্ন : প্রতি রাতেই দেখেন?

উত্তর : হ্যাঁ।

প্রশ্ন : একই দুঃস্বপ্ন ঘুরে ফিরে দেখেন, না একেকদিন একেক দুঃস্বপ্ন?

উত্তর : একই দুঃস্বপ্ন ঘুরে ফিরে দেখি।

প্রশ্ন : কী দেখেন?

উত্তর : দেখি আমি মাছ কুটছি। মাছটা পরিচিত মনে হচ্ছে। আমি খুব চিন্তিত–মাছ আবার পরিচিত হবে কী করে? ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। এটা আসলে মাছ না। আমি একটা মানুষকে কেটে কুচি কুচি করছি। সেই মানুষটা আর কেউ না, আমি নিজে। আমি খুব ঘাবড়ে যাই। তারপর রান্না চড়াই। নিজেকেই নিজে রান্না করি। তারপর খেতে বসি। নিজেকেই নিজে খাই। খেতে গিয়ে দেখি টেস্ট পাচ্ছি না। রান্না ভালো হয় নি। লবণ বেশি হয়েছে।

প্রশ্ন : আমার মনে হচ্ছে এই স্বপ্নটা আপনি বানিয়ে বানিয়ে বললেন।

উত্তর : ঠিক ধরেছেন।

প্রশ্ন : এটা কেন করলেন?

উত্তর : খুব অদ্ভুত কিছু দুঃস্বপ্ন আমি দেখতে চাই কিন্তু দেখতে পারি না। সাধারণ দুঃস্বপ্ন দেখি। এই জন্যেই মাঝে মাঝে আমি দুঃস্বপ্ন কল্পনা করি।

প্রশ্ন : সাধারণ দুঃস্বপ্ন বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

উত্তর : সেটা আপনাকে বলব না ভাই। বললে আপনি হাসবেন।

প্রশ্ন : আপনি কি অন্ধকারকে ভয় পান?

উত্তর : না, পাই না। আলো ভয় পাই।

প্রশ্ন : আলো ভয় পান মানে?

উত্তর : দিনের বেলা কেমন জানি ভয় ভয় করে। সূর্য ডোবার পর ভয়টা কেটে যায়।

প্রশ্ন : আপনার স্ত্রী বলছিলেন আপনি বাঁদরের সঙ্গে কথা বলেন। এটা কি সত্যি?

উত্তর : অবশ্যই সত্যি। সে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবে কেন? রূপা মিথ্যা কথা বলার মেয়ে না।

প্রশ্ন : বাদরের সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলেন?

উত্তর : বেশিরভাগ সময় জোকস বলি। এরা জোকস ধরতে পারে। হাসে।

প্রশ্ন : বাঁদর হাসে?

উত্তর : অবশ্যই হাসে। বাঁদরের সঙ্গে মানুষের মিল সবচে’ বেশি, ওরাও মানুষের মতো কাঁদে এবং হাসে। বাঁদরের হাসি খুবই অদ্ভুত। এরা শরীর দুলিয়ে হাসে। হাসার সময় একজন আরেকজনের গায়ে ধাক্কা দেয়। বাঁদরের হাসি কখনো শুনেছেন?

সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, না।

আমি বললাম, শুনতে চান?

তিনি বললেন, হ্যাঁ শুনতে চাই।

আমি বললাম, তাহলে কোনো একদিন আমার বাসায় চলে আসুন। আমি আপনাকে বাঁদরের হাসি শুনিয়ে দেব।

ভদ্রলোক বললেন, অবশ্যই আসব। আমার ছোট ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব। সে মজা পাবে।

আমি বললাম, ভাবিকেও সঙ্গে নিয়ে আসুন। উনিও মজা পাবেন। জন্তুদের কাণ্ডকারখানা দেখলে মহিলারাই সবচে বেশি মজা পান।

সাইকিয়াট্রিস্ট বুঝতেও পারলেন না যে আমি এখন প্রশ্ন করা শুরু করেছি এবং তিনি উত্তর দিচ্ছেন। পাশার দান উল্টে গেছে।

আমি : বাঁদর ছাড়াও আরো একটা প্রাণী হাসতে পারে, তার নাম জানেন?

সাইকিয়াট্রিস্ট : না।

আমি : প্রাণীটার নাম বাঘ। জিম করবেট তার শিকারের বইয়ে বাঘের হাসির কথা বলেছেন। রানীক্ষেতের মানুষখেকো বাঘিনীর অংশে লেখা আছে। জিম করবেট পড়েছেন?

সাইকিয়াট্রিস্ট : না।

আমি : জিম করবেটের নাম শুনেছেন?

সাইকিয়াট্রিস্ট : না।

আমি : জিম করবেট পড়তে চাইলে আমি আপনাকে দিতে পারি। আমার লাইব্রেরিতে আছে। দেব এনে?

সাইকিয়াট্রিস্ট : আচ্ছা।

কথাবার্তার শেষে ভদ্রলোক আমাকে এক গাদা ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিলেন। বিছানাতে যাবার এক ঘণ্টা আগে দু’টা করে ট্যবলেট খেতে হবে।

আমি বললাম, ভাই, আমার তো ঘুমের কোনো সমস্যা নেই। বিছানায় যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি। ইচ্ছা-মৃত্যুর মতো আমার হলো ইচ্ছা-ঘুম। ঘুম আমার সমস্যা না।

তিনি বললেন, সমস্যা না হলেও খাবেন।

আমি বললাম, আপনি যখন খেতে বলছেন তখন অবশ্যই খাব।

আপনার নার্ভ যাতে ঠাণ্ডা থাকে, নিউরোলজিক্যাল কানেকশানসে যেন গণ্ডগোল না হয় তার জন্যে এই ওষুধগুলি দিয়েছি।

আমি বললাম, থ্যাংক য্যু।

ডাক্তার সাহেব বললেন, আমি আমার মোবাইলের একটা নাম্বার দিচ্ছি। যে-কোনো সমস্যায় টেলিফোন করবেন। আমি কখনো মোবাইল অফ করি না।

রাতেও টেলিফোন করতে পারব?

অবশ্যই পারবেন।

গভীর রাতে টেলিফোন করলে বিরক্ত হবেন না তো?

কী আশ্চর্য কথা, বিরক্ত হবে কেন?

রাতে ঘুম ভেঙে টেলিফোন ধরতে হলে অনেকেই বিরক্ত হন। সবচে’ বেশি বিরক্ত হন ডাক্তাররা।

আমি কখনো বিরক্ত হই না। কারণ পেশেন্টের কথা শোনা আমার ডিউটি।

দ্রলোক সত্যি সত্যি বিরক্ত হন কি-না তা দেখার জন্যে আমি সেই রাতেই টেলিফোন করলাম (সময় দু’টা দশ মিনিট)।

অনেকবার রিং হবার পর ভদ্রলোক টেলিফোন ধরলেন। ঘুম ঘুম গলায় বললেন, কে?

আমি বললাম, ভাই, আমার নাম ফখরুদ্দিন চৌধুরী। আজ সন্ধ্যায় রূপা আমাকে নিয়ে আপনার বাসায় গিয়েছিল। রূপা অবশ্যি বলেছিল আপনি তাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। এখন বুঝতে পারছি ঘটনা তা না। আপনি একজন পাগলের ডাক্তার।

পাগলের ডাক্তার এ ধরনের কথা বলবেন না। পাগল বলে কিছু নেই। মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে পাগল বলা সামাজিক অপরাধ।

সরি।

বলুন কী ব্যাপার? এত রাতে টেলিফোন করেছেন কেন? সমস্যা কী?

আপনি বলেছিলেন আমি যে-কোনো সময় আপনাকে টেলিফোন করতে পারি। আপনি বিরক্ত হবেন না।

কী জন্যে টেলিফোন করেছেন কাইন্ডলি বলুন। ঘুম থেকে উঠে টেলিফোন ধরেছি।

ঘুম-বিষয়ক একটা প্রশ্ন ছিল।

কী প্রশ্ন?

মানুষের জন্যে ঘুমের ওষুধ আছে। গাছের জন্যে কি এ ধরনের ওষুধ আছে?

কী বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না।

এমন কোনো ওষুধ কি আছে যা খেলে গাছ ঘুমিয়ে পড়ে? গাছ যে ঘুমায় তা আমরা জানি। কিছু কিছু গাছ যেমন তেঁতুল সন্ধ্যাবেলায় পাতা বন্ধ করে দেয়। আমি জানতে চাচ্ছি এমন কোনো ওষুধ কি আছে যা খেলে দিনেদুপুরে গাছ ঘুমিয়ে পড়বে?

এইটাই আপনার প্রশ্ন?

জি।

এই প্রশ্ন করার জন্যে রাত দু’টার সময় টেলিফোন করেছেন?

জি।

আমি এই প্রশ্নের জবাব জানি না।

বলেই ভদ্রলোক টেলিফোন লাইন কেটে দিলেন।

আমি রাত সাড়ে তিনটার দিকে আবার টেলিফোন করলাম। আমার ধারণা ছিল ভদ্রলোক টেলিফোন ধরবেন না। মোবাইলে আমার নাম্বার দেখেই সাবধান হয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি ধরলেন। আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ভাই, ভালো আছেন?

তিনি জড়ানো গলায় বললেন, কে?

আমার নাম ফখরুদ্দিন। রূপার সঙ্গে সন্ধ্যায় আপনার বাসায় গিয়েছিলাম।

কী ব্যাপার?

একটা প্রশ্ন ছিল।

আপনি দয়া করে ঘুমুতে যান।

প্রশ্নটার উত্তর জানার জন্যে মনের ভেতর খুঁতখুঁতানি তৈরি হয়েছে। ওটা দূর। হলে ঘুম আসবে না।

কী প্রশ্ন বলুন।

গাছ-বিষয়ক একটা প্রশ্ন। গাছের জীবন আছে এটা তো আমরা জানি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন পাগল হয়ে যায়, গাছের বেলায় কি সে-রকম হতে পারে? আমবাগানের একটা আম গাছ পাগল হয়ে গেল–এরকম। দশটা আম গাছ ভালো, একটা আম গাছ বদ্ধ উন্মাদ। কিংবা আপনাদের পরিভাষায় মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত।

ভদ্রলোক টেলিফোন অফ করে দিলেন। রাত চারটার দিকে আবার করলাম, তখনো টেলিফোন অফ। ভোর পাঁচটায় করলাম, তখনো অফ। রবার্ট ব্রুসের মতো অসীম ধৈর্যে আমি টেলিফোন করেই যেতে থাকলাম। এক সময় না এক সময় তিনি তার মোবাইল অন করবেন, তখন যেন তার সঙ্গে কথা বলা যায়।

সকাল সাড়ে নটায় তিনি টেলিফোন ধরলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, কে?

আমি বললাম, ভাই, আমার নাম ফখরুদ্দিন চৌধুরী। রূপাকে নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায়…

বাক্য শেষ করার আগেই ভদ্রলোক টেলিফোন লাইন কেটে দিলেন। সারাদিনে তিনি আর টেলিফোন চালু করলেন না। আমি অবশ্যি সারাদিনই চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। কর্মহীন মানুষদের ধৈর্য ভালো হয়। যে-কোনো তুচ্ছ কাজে তারা লেগে থাকতে পারে। এরা খুব ভালো বর্শেল হয়। ছিপ ফেলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে পারে। পুকুরে মাছের ঘাই শুনে বলে দিতে পারে–কী মাছ, কত বড় মাছ।

কর্মহীন মানুষ বার্ডওয়াচার হয়। দুরবিন হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। মা-পাখি শিশুদের খাওয়াচ্ছে। দিনে ক’বার খাওয়াচ্ছে, কী খাওয়াচ্ছে সব তারা জানে। তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন, বলুন তো দেখি, একশ্রেণীর বক আছে যাদের থুতনিতে ছাগলের দাড়ির মতো দাড়ি। দাড়িওয়ালা বকদের নাম কী? তারা সঙ্গে সঙ্গে বলবে নাম–মেছো বক।

এরা আমার মতো বইপড়া জ্ঞানী হয়। রাজ্যের বই পড়ে পড়ে মাথার স্মৃতিকোষ অর্থহীন জ্ঞানে বোঝাই করে রাখে। কেউ দর্শনের বই পড়ে পড়ে হয়। দার্শনিক। কেউ গাছপালার বই পড়ে পড়ে শখের বোটানিস্ট। ইউনিভার্সিটির পাস করা বোটানিস্টকে যদি জিজ্ঞেস করেন–আচ্ছা স্যার, ভুইআমলা গাছের নাম জানেন? তাঁরা ভুরু কুঁচকে বলবেন–ভুইআমলা? দেশী গাছ? সাইন্টিফিক নাম কী বলুন তো?

একজন শখের স্বশিক্ষিত বোটানিস্টকে জিজ্ঞেস করুন; তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে বলবেন- ও আচ্ছা, ভূমিআমলা–ভূমি আমলকির কথা বলছেন? কেউ কেউ আবার একে বলেন ভুধাত্রী। অন্য আরেকটা নাম আছে–তমালিকা। Euphorbiaceae পরিবারের গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Phyllanthus freteratus. কেন চিনব না?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ