আষাঢ় মাসের উনিশ তারিখ ফুপু ঘুমের ওষুধ খেলেন। ঘটনাটা বাংলা মাসের হিসাবে লিখলাম। কারণ উনিশ তারিখ ছিল আষাঢ়ি পূর্ণিমা। আকাশ ছিল পরিষ্কার। আগের দিন ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় মেইন গ্রিড ফেইল করেছিল। অন্ধকার শহর জোছনায় ড়ুবে গিয়েছিল।

ফুপু ঘুমের ওষুধ খাবার জন্যে বেছে বেছে এই দিনটা বের করলেন। কারণ তিনি একবার একটা নাটক করেছিলেন যেখানে নায়িকা আষাঢ়ি পূর্ণিমাতে বিষ খায়। নায়িকার ডেডবডিতে জোছনার আলো পড়ে এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে গান হয়–

জোছনা আমার ভালো লাগে গো সখী
জোছনা আমার ভালো লাগে।

ফুপু তাঁর জীবনের বেশির ভাগ কাজই ঠিকমতো করতে পারেন নি। ঘুমের ওষুধ খাবার কাজটাও ঠিকমতো পারলেন না। একটা কাগজে লিখলেন— আমার মৃত্যুর জন্যে কেহ দায়ী নয়। নিচে নাম সই করতে ভুলে গেলেন। একগাদা ঘুমের ওষুধ একসঙ্গে গিলতে গিয়ে বমি করে বেশির ভাগই ফেলে দিলেন। কাজের মেয়ে কী কারণে যেন তখন তার ঘরে গেল। তিনি কাজের মেয়েকে বললেন, আমি ঘুমের ওষুধ খাচ্ছি। খবরদার, কেউ যেন এটা না জানে। কেউ জানলে আমি তোকে খুন করে ফেলব।

কাজের মেয়ে সবাইকে বলল। অ্যাম্বুলেন্স এলো, ফুপুকে মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হলো। স্টমাক ওয়াশ, ইনজেকশান, হাসপাতাল হয়ে নানান যন্ত্রণার শেষে ফুপু আধমরা হয়ে বাসায় ফিরলেন পাঁচদিন পরে। আমার সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, তেঁতুলের আচার খাওয়াতে পারবি? তেঁতুলের আচার খেতে ইচ্ছা করছে। খাওয়াতে পারবি?

ফুপু যেদিন বাসায় ফিরলেন তার তিনদিনের মাথায় ভরদুপুরে জহির ভাই খবর পাঠালেন, আমি যেন ফুপুকে নিয়ে দি ইমেজ-এ যাই। জরুরি প্রয়োজন। ফুপু কিছুতেই যাবেন না। আমিই ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাঁকে রাজি করালাম।

সোমবার দি ইমেজ-এ সাপ্তাহিক ছুটি। আজ সোমবার। দি ইমেজ-এর সদর দরজার কলাপসেবল গেট তালাবন্ধ। ফুপুকে নিয়ে গেটের সামনে। দাঁড়াতেই কলাপসেবল গেটের দরজা খুলে গেল। দরজা খুললেন ম্যানেজার। তার মুখ অন্যদিনের চেয়েও গম্ভীর। আমরা ঢুকতেই তিনি আবার গেটে তালা লাগিয়ে দিলেন।

দি ইমেজ-এর শো-রুম খালি, শুধু শিয়ালমুত্রা বসে টিভিতে হিন্দি ছবি দেখছেন। সাউন্ড ছাড়া ছবি। ছবিতে গানের দৃশ্যে নাচানাচি হচ্ছে। নিঃশব্দ নাচানাচি। আমাদের দেখে শিয়ালমুত্রা আগ্রহের সঙ্গে তাকালেন। ফুপুকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। শুধু তাই না, চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ভালো আছেন? ফুপু জবাব দিলেন না।

আমরা ঢুকলাম জহির ভাইয়ের বসার ঘরে। খাটে পা ঝুলিয়ে মুকুল ভাই বসে আছেন। তাঁর গায়ে গোলাপি রঙের হাওয়াই শার্ট। তিনি সিগারেট টানছেন, তাকে তেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তার পাশেই প্রায় গা ঘেঁসে আরেকজন বসে আছেন। তার পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। তাঁকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। ভদ্রলোকের মনে হয় হাঁপানি আছে। একটু পরপর বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। ইনার বয়স কম। অবশ্যই ত্রিশের নিচে। তবে মাথার চুল পড়ে গেছে। দরজার পাশে চেয়ারে বলশালী এক লোক বসে আছে। তার গায়ে সবুজ স্ট্রাইপের ফুল শার্ট। এই লোক কারো দিকেই তাকাচ্ছে না। সে দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে এক মনে দাঁত খোচাচ্ছে। খোলা দরজার বাইরে কে যেন হাঁটাহাঁটি করছে। সে মাঝে মাঝে দরজার সামনে থমকে দাঁড়াচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে।

ফুপু মুকুল ভাইকে দেখে হা হয়ে গেছেন। তবে মুকুল ভাই ফুপুকে দেখে কোনো রি-অ্যাকশান দেখান নি। বরং মনে হবে তিনি ফুপুকে চেনেন না।

জহির ভাই বললেন, মুকুল সাহেব, কফি খাবেন?

মুকুল ভাই বললেন, খেতে পারি।

দরজার বাইরে যে লোক হাঁটাহাঁটি করছিল সে সঙ্গে সঙ্গেই কফি নিয়ে ঢুকল। কফি নিশ্চয়ই আগেই তৈরি ছিল। জহির ভাই বললেন, কুল সাহেব, আপনার নাটকে আমাকে নেয়া যাবে? আমার চেহারা ঠিক আছে না?

মুকুল ভাই কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, শুধু চেহারায় নাটক হয় না অভিনয় জানেন?

জহির ভাই বললেন, জানি না। আপনি শিখিয়ে নেবেন।

আমার প্রতিষ্ঠান অভিনয় শেখানোর স্কুল না। আমি কাজ করি ফিনিসড প্রোডাক্ট নিয়ে।

অভিনয়ের শখ ছিল।

জেনুইন শখ থাকলে আমার অফিসে একদিন আসুন— অডিশন নিয়ে দেখি।

কবে আসব?

খোঁজখবর নিয়ে যেদিন অফিসে থাকি সেদিন আসবেন। আমি সবদিন অফিসে যাই না।

জহির ভাই বললেন, একদিন চলে যাব। এখন কাজের কথায় আসি। আপনি কি কখনো পাঠাকে খাসি করানোর প্রক্রিয়া দেখেছেন?

মুকুল ভাই তাকিয়ে রইলেন, কিছু বললেন না। তার চোখে বিস্ময়।

জহির ভাই বললেন, প্রক্রিয়াটা সহজ। পাঠার বিচি ফেলে দিয়ে রসুনের কোয়া ভরে সেলাই করে দেয়া হয়। পাঁঠা দুএকটা চিৎকার শুধু দেয়। অপারেশনের পর পরই ঘাস খেতে শুরু করে যেন কিছুই হয় নি।

মুকুল ভাই বললেন, আমাকে এসব বলার মানে কী?

জহির ভাই বললেন, আপনাকে বলার কারণ হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায় আপনাকে খাসি করা হবে। সমাজের স্বার্থে এটা করা হচ্ছে। আপনার পাশে যিনি বসে আছেন তিনি একজন পাস করা ডাক্তার। অপারেশন তিনিই করবেন। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দেয়া হবে, ব্যথা পাবেন না। আমার তো ধারণা, অপারেশনের পর ঘণ্টাখানিক বিশ্রাম নিয়ে আপনি বাড়ি চলে যেতে পারবেন। হালকা খাওয়াদাওয়া করতে পারবেন। পাঁঠা পারলে আপনি পারবেন না কেন?

রসিকতা করছেন?

নারে ভাই! আমি রসিক লোক না। রসিকতা করতে পারি না। এই, তোমরা এর কাপড় খুলে ফেল। ভালো করে খাটের সঙ্গে বাঁধ। আপনার কফি খাওয়া শেষ হয়েছে তো! না-কি আরেক কাপ খাবেন?

মুকুল ভাইয়ের চোখে-মুখে এই প্রথম ভয়ের ছায়া দেখা গেল। তবে তিনি এখনো বিশ্বাস করছেন না যে, এরকম কিছু করা হবে। তিনি কফির কাপে আরেকবার চুমুক দিলেন। জহির ভাই বললেন, আমার তেমন তাড়া নেই। আপনি আরাম করে কফি খান। আপনি যখন ইয়েস বলবেন তখনি ডাক্তার সাহেব কাজ শুরু করবেন, তার আগে না।

মুকুল ভাই চাপা গলায় বললেন, জহির না আপনার নাম?

জি।

আপনার সঙ্গে আড়ালে দুটা কথা বলতে পারি?

জি-না। আমি আড়াল-কথা শোনার লোক না।

জহির ভাই দরজার পাশে বসা লোকটির দিকে তাকালেন। তার পরপরই অতি দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটল। আমি দেখলাম মুকুল ভাই খাটের সঙ্গে বাঁধা। তার প্যান্ট এবং আন্ডারওয়্যার টেনে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। ডাক্তার সাহেব ছোট একটা কালো বক্স খুলে সিরিঞ্জ বের করছেন। মনে হয় এই সিরিঞ্জ দিয়েই লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দেয়া হবে।

জহির ভাই বললেন, মুকুল সাহেব, যে ক্যামেরাম্যান আপনার হয়ে ভিডিও ছবিগুলি নানান সময়ে তুলেছে, তার নাম লিয়াকত না?

মুকুল ভাই বললেন, আমি জানি না।

জহির ভাই বললেন, আমাদের হাতে সময় কম, উল্টা-পাল্টা জবাব না দিলে ভালো হয়। শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, তার নাম লিয়াকত না?

জি লিয়াকত। ভাই সাহেব, আমার একটা কথা শুনুন। প্লিজ! দুটা মিনিট শুধু আপনি আর আমি…

জহির ভাই বললেন, এই বদটার মুখে একটা স্পঞ্জের স্যান্ডেল দিয়ে দাও। তাহলে চিৎকার করতে পারবে না। দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরার সময় জিহ্বারও ক্ষতি হবে না।

মুহূর্তের মধ্যে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের গোড়ালির অংশ মুকুল ভাইয়ের মুখে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। জহির ভাইয়ের ইশারায় আমি ফুপুকে নিয়ে বাইরে চলে এলাম। ফুপু জম্বির মতো হয়ে গেছেন। হাঁটতে পারছেন না, কথা বলতে পারছেন না। তাঁর শরীর কাঁপছে, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে।

ফুপুকে দি ইমেজ-এর শো-রুমে এনে ফ্যানের নিচে বসিয়ে দিলাম। তার ভাবভঙ্গি ভালো না। তিনি যে-কোনো মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে যাবেন— এটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, বাসায় যাব। বাসায় যাব। ও বাবলু, বাসায় যাব। শিয়ালমুত্রা ফুপুর অবস্থা দেখে মজা পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি ফুপুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ঠাণ্ডা কিছু খাবেন?

আমাদের বেশিক্ষণ বসতে হলো না। ডাক্তার সাহেব এসে জানালেন— অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। রোগী ভালো আছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ