নীলা ফুপুর চোখ লাল। মুখ ফোলা। তিনি গত দুদিন ধরে ঘরে আছেন। ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। রাতে মনে হয় ঘুমাচ্ছেনও না। কাল রাত তিনটার সময়ও দেখেছি তার ঘরে বাতি জ্বলছে। অসুখ-বিসুখ নিশ্চয়ই না। অসুখ হলে চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে থাকতেন। মাথা টিপে দেবার জন্যে কিংবা মাথায় পানি ঢালার জন্যে আমার ডাক পড়ত। এখনো ডাক পড়ছে না। বড় কোনো ঘটনা হয়তো ঘটেছে। নাটক থেকে বাদ পড়েছেন। কিংবা মুকুল ভাই আরো কোনো কাণ্ড ঘটিয়েছেন। সন্ধ্যাবেলায় আমি তাঁর ঘরে উঁকি দিলাম। তিনি চাদর গায়ে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। আমাকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসলেন। ভাঙা গলায় বললেন, কী চাস?

আমি বললাম, কিছু চাই না। তোমার গলা ভাঙল কীভাবে?

ফুপু বললেন, হুট হাট করে ঘরে ঢুকবি না।

চলে যাব?

চেয়ারে বোস।

আমি চেয়ারে বসলাম। ঘরে বাতি জ্বালানো হয় নি। জানালা বন্ধ। ঘর অন্ধকার। ভ্যাপসা গরমে ফুপু গায়ে চাদর জড়িয়ে রেখেছেন। আমি বললাম, তোমার জ্বর না-কি?

জানি না। তুই একটা কাজ করে দে, আমাকে ঘুমের ওষুধ কিনে এনে দে। পঞ্চাশটা কিনবি, ইউনিকট্রিন। নাম মনে থাকবে?

না।

আমি লিখে দিচ্ছি। একটা ফার্মেসি থেকে এতগুলি দিবে না। বিভিন্ন ফার্মেসিতে যাবি, ঘুরে ঘুরে কিনবি। পারবি না?

পারব।

এতগুলো ঘুমের ওষুধ দিয়ে কী করব জিজ্ঞেস করলি না?

খাবে। ঘুমের ওষুধ দিয়ে মানুষ আর কী করে?

এতগুলা ওষুধ একসঙ্গে খেলে আমার অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছিস?

একসঙ্গে খাবে?

অবশ্যই একসঙ্গে খাব। এ ছাড়া আমার কোনো গতি নেই।

ফুপু, বাতি জ্বালাব?

না।

মুখ দেখতে পাচ্ছি না তো! এইজন্যে কথা বলে আরাম পাচ্ছি না।

গাধার মতো কথা বলিস না। আর পা দোলাচ্ছিস কেন? পা দোলাবি না। গাধা!

আমি পা দোলানো বন্ধ করলাম। অন্ধকার চোখে সয়ে গেছে। ফুপুর চেহারা দেখা যাচ্ছে। তাঁকে খুবই সুন্দর লাগছে। মানুষের চেহারার এই এক অদ্ভুত ব্যাপার। সব আলোয় সব মানুষকে একরকম দেখা যায় না। কাউকে দুপুরের খটখটা আলোয় ভালো লাগে। কাউকে ভালো লাগে সকালে, আবার কাউকে আধো আলো আধো অন্ধকারে।

বাবলু!

বল শুনছি।

তোকে পা দোলাতে নিষেধ করেছি, তুই তো দুলিয়েই যাচ্ছিস।

ফুপু আমি পা দোলাচ্ছি না।

ড্রয়ার খুলে দেখ টাকা আছে, একশ টাকার একটা নোট নিয়ে যা। আমার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট আনবি।

তুমি সিগারেট খাও?

হঠাৎ হঠাৎ খাই। আমাদের অভিনয়ের লাইনে অনেকেই খায়। চন্দনা বলে যে মেয়েটা আছে, মডেলিং করে, সে তো চেইন স্মোকার। চন্দনাকে চিনেছিস?

না।

চকলেটের অ্যাড করেছে। সুন্দর অ্যাড। বয়স কত শুনলে চমকে উঠবি–ত্রিশ। সে অবশ্যি মুখে বলে আঠারো। মেকাপ ছাড়া চন্দনাকে দেখলে তোর ইচ্ছা করবে গালে থাপ্পড় মারতে। গিরগিটির শরীরের মতো উচা-নিচা চামড়া। বিরাট বিরাট গর্ত। পেনকেক দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হয়।

পেনকেকটা কী?

পেনকেক কী তোকে বলতে পারব না। সিগারেট আনতে বলছি আন। মালবরো লাইট আনবি।

এইটা কি তোমার ব্র্যান্ড?

আমার কোনো ব্র্যান্ড-ফ্রেন্ড নেই। আমি তো চন্দনার মতো চেইন স্মোকার না যে আমার ব্র্যান্ড লাগবে। যখন যেটা পাই খাই। মালবরোটা ভালো। আমেরিকান সিগারেট। রোস্টেড টোবাকো।

রোস্টেড টোবাকো কী জিনিস?

এতকিছু তোকে বলতে পারব না।

আমি সিগারেট কিনে এনে দেখি ঘরে বাতি জ্বলছে। ফুপুর গায়ে চাদর নেই। তিনি হাত-মুখ ধুয়েছেন। মনে হয় কাপড়ও বদলেছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বাইরে যাবার জন্যে তৈরি। তাঁর ভাঙা গলাও ঠিক হয়ে গেছে। তিনি সিগারেটের প্যাকটটা হাতে নিতে নিতে বললেন, আমার জন্যে কড়া করে এক কাপ চা নিয়ে আয়। সিগারেট শুধু শুধু খেয়ে আরাম পাওয়া যায় না। চায়ের সঙ্গে খেতে হয় কিংবা ড্রিংকসের সঙ্গে।

তুমি ড্রিংকসের সঙ্গে কখনো খেয়েছ?

দুএকবার পাল্লায় পড়ে খেয়েছি। জিন এন্ড লাইম। এক ধরনের ককটেল। জিন সামান্যই থাকে।

খেতে কেমন?

শরবতের মতো একটু তিতা ভাব আছে। তোর কি খেতে ইচ্ছা করছে না

হুঁ।

খবরদার! এইসব জিনিসের ধারে কাছে যাবি না। তুই গাধা আছিস গাধাই থাকবি। ঘোড়া হতে যাবি না।

ফুপু, গাধা নিয়ে একটা জোক আছে। তোমাকে বলি? খুবই মজার।

ফুপু চোখ সরু করে তাকিয়ে আছেন। জোক শোনার ব্যাপারে তাঁর ভালোই আগ্রহ আছে। তবে বেশিরভাগ জোকই তিনি ধরতে পারেন না। সবাই যখন হাসে তখন তিনি করুণ মুখ করে সবার দিকে তাকান। মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে হাসেন। হাসার পর তার মুখ আরো করুণ হয়ে যায়।

আমি জোক শুরু করলাম— ফুপু শোন। একবার এক ছেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে মাকে বলছে, মা, আজ আমাদের স্কুল টিচার আমার খুব প্রশংসা করেছেন। ছেলের মা বললেন, উনি কী বলেছেন? ছেলে বলল, স্যার আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সবাই গাধা। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আর এই রটা সবচে বড় গাধা!

ফুপু হাসতে শুরু করেছেন। তার হাসি বিখ্যাত। বেশিরভাগ সময়ই হাসতে হাসতে তাঁর হেঁচকি উঠে যায়। তিনি বিষম খান। একবার তো খাট থেকে মাটিতে পড়ে ভালো ব্যথাও পেয়েছিলেন।

ফুপু হাসছেন। তার হাসির মিটারের কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে উপরের দিকে উঠছে। আমি তাঁকে হাসন্ত অবস্থায় রেখে তার জন্যে চা আনতে গেলাম। আমি নিশ্চিত ফিরে এসে দেখব তার হাসি তখনো বন্ধ হয় নি। হাসির সঙ্গে হেঁচকি যুক্ত হয়েছে।

সে রকম দেখা গেল না। ফুপু আগের অবস্থায় ফিরে গেছেন। বসে আছেন খাটে। গায়ে চাদর। ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছেন। তবে বাথরুমের বাতি জ্বলছে। বাথরুমের দরজা সামান্য খোলা বলে বাথরুমের আলো এসেছে। ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় ভর্তি। চা বানিয়ে আনার অতি অল্প সময়ে তিনি কয়েকটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছেন বলে আমার ধারণা। ফুপু চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, চন্দনা মেয়েটা কী যে বিপদে পড়েছে! মেয়েটার ভালো বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ইউরোপিয়ানদের মতো চেহারা। লম্বা, ফর্সা, খাড়া নাক। একদিন চন্দনার সঙ্গে শুটিং-এ এসেছিল দেখেছি। সেই বিয়ে বাতিল।

কেন?

চন্দনার একটা বাজে ভিডিও বাজারে রিলিজ হয়েছে।

তার মানে কী?

ফুপু হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে নতুন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, চন্দনা একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করেছিল সেই ভিডিও গোপনে করা হয়েছে। তারপর ছেড়ে দিয়েছে ইন্টারনেটে। সেখান থেকে নিয়ে ভিডিও কোম্পানি সিডি বের করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। সিডির নাম নাইট কুইন চন্দনা। তবে কভারে তারা চন্দনার একটা নরম্যাল ছবি দিয়েছে। শাড়ি পরা ছবি। এই ছবি দেখলে বোঝাই যাবে না ভেতরে কী আছে।

আমার ক্ষীণ সন্দেহ হলো এরকম একটা সিডি ফুপুকে নিয়েও বের হয়েছে। তাঁর নিঘুম রাত কাটানো, ঘুমের ওষুধ কিনতে চাওয়ার পেছনে আর কোনো কারণ থাকার কথা না। আমি সাহস করে বলে ফেললাম, ফুপু, তোমারও কি সিডি বের হয়েছে?

ফুপু কঠিন চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাঙা গলায় বললেন, তোকে কে বলেছে? জহির?

আমি বললাম, আমাকে কেউ বলে নি। আমি অনুমান করেছি। লিলুয়া বাতাস-৬

থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব, আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা? অবশ্যই তোকে জহির বলেছে। সে না বললে তুই জানবি কীভাবে? জহির ভিডিওর দোকানের মালিক হয়ে বসেছে। আজেবাজে ভিডিও বিক্রি করে পয়সা কামাচ্ছে। ছোটলোক কোথাকার!

ফুপু হাউমাউ কান্না শুরু করলেন। তার কান্নাও হাসির মতো বিখ্যাত। একবার শুরু হলে থামে না। চলতেই থাকে। তাকে এই অবস্থায় রেখে ঘর থেকে বের হলাম। কিছুক্ষণ ছাদে হাঁটলাম। এই বাড়ির ছাদ বিপজ্জনক ছাদ। রেলিং দেয়া হয় নি। বর্ষায় শ্যাওলা পড়ে ছাদ পিচ্ছিল হয়ে থাকে। এমন একটা পিচ্ছিল ছাদের ধার ঘেঁসে একজনই হাঁটতে পারে, তার নাম জহির। জহির ভাই প্রতি বর্ষায় দুতিনবার এই কাজটা করেন। তাঁর নাকি মজা লাগে।

ছাদের ঠিক মাঝখানে এগারোটা ফুলের টব আছে। টবগুলির মালিক ফুপু। তার জন্ম এগারো অক্টোবর বলে এগারো তার লাকি সংখ্যা। এইজন্যে ফুলের। টবের সংখ্যা এগারো। ফুপু তাঁর টবগুলির কোনো যত্ন নেন না। সব গাছই কিছুদিনের মধ্যে মরে যায়। তখন আবার কেনা হয়। ফুপু ঠিক করে রেখেছেন তার গায়েহলুদ হবে ছাদে। তাঁর চারদিকে তখন থাকবে এগারোটা ফুলের টব। এগারো সংখ্যাও নাকি অতি রহস্যময়। নিউমারোলজি মতে এগারো হচ্ছে দুই। এক এবং এক যোগ করে দুই। নিউমারোলজি মতে ফুপুর জুডায়িক সাইন লিব্রা। এদিকে জন্মতারিখ হিসেবেও তাঁর জুডায়িক সাইন লিব্রা। এটাও নাকি বিরাট ব্যাপার। ব্রিার পাওয়ার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল। এইসব হিসাব নিকাশ মুকুল ভাই করে দিয়েছেন। তিনি শুধু যে বিখ্যাত পরিচালক তা-না, তিনি আবার পামিস্ট্রি নিউমারোজি, এসট্রলজি এইসবও জানেন।

ফুপু মুকুল ভাইয়ের আদিভৌতিক ক্ষমতায়ও মুগ্ধ। তার প্রসঙ্গ উঠলে ফুপু চোখ বড় বড় করে বলেন— টেলেন্টেড লোক, বুঝলি! হাত দেখে এমন হড়হড় করে তোর অতীত বলবে যে তুই টাসকি খেয়ে যাবি। হিপনোসিসও উনি জানেন। তবে করতে চান না। ব্রেইনে চাপ পড়ে তো এইজন্যে। হিপনোসিস করে উনি যে-কোনো মানুষকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন। অভিনেতা মাহফুজ ভাই অনেক বড় বড় কথা বলেছিলেন, মুকুল ভাই একদিন তার সামনে বসিয়ে কয়েকটা পাস দিলেন। মাহফুজ ভাই মুখ হা করে ঘুমাতে লাগল। অন রেকর্ড আছে। স্টিল ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ছবি তোলানো হয়েছে। যাতে মাহফুজ ভাই পরে অস্বীকার করতে না পারেন। অবশ্যি মাহফুজ ভাই ঠিকই অস্বীকার করেছেন। তিনি সবাইকে বলেছেন, আমি আসলে ঘুমাই নি, ঘুমের ভাণ করেছি।

আমি ছাদ থেকে নামলাম বৃষ্টি শুরু হবার চার-পাঁচ মিনিট পর। এই চারপাঁচ মিনিট আমি ফুপুর সাজানো এগারোটা টবের মাঝখানে বসে রইলাম। মাঝখানটা ফুপু সাদা রঙ দিয়ে বৃত্ত দিয়ে রেখেছেন। তিনি যখন এখানে বসেন তখন না-কি গাছগুলি থেকে একধরনের এনার্জি পান। আমি কোনো এনার্জি পাই নি। এগারো সংখ্যা আমার জন্যে না, হয়তো এ কারণেই। তাছাড়া এগারোটি টবের মধ্যে মাত্র চারটাতে গাছ আছে। বাকিগুলির গাছ মরে গেছে। এটাও একটা কারণ হতে পারে।

ফুপুর ঘরে আরেক দফা উঁকি দিলাম। আমার প্রধান উদ্দেশ্য ফুপুর কান্না থেমেছে কি-না দেখা, অপ্রধান উদ্দেশ্য টবের গাছগুলি মরে গেছে এই খবর জানানো। চারা কিনতে হলে এখনি কিনতে হবে। বৃক্ষমেলা চলছে। এবারের বৃক্ষমেলার স্লোগান গাছ জীবনের জন্যে।

বাবলু, দরজা ফাঁক করে উঁকি দিবি না। এইসব আমার পছন্দ না। ঘরে ঢোক।

আমি ঘরে ঢুকলাম।

তুই একজনকে একটা চিঠি দিয়ে আসতে পারবি?

মুকুল ভাইকে?

কাকে দেব সেটা পরে বলব। তুই পারবি কি-না সেটা বল। যাওয়া আসার রিকশাভাড়া ছাড়াও আলাদা দুশ টাকা পাবি।

এখন দিতে হবে?

হ্যাঁ, এখনই দিতে হবে। তুই চিঠি নিয়ে যাবি, যদি দেখিস উনি বাসায় নেই, তাহলে রাস্তায় অপেক্ষা করবি। যত রাতই হোক অপেক্ষা করবি। চিঠি উনার হাতে দিতে হবে। অন্যের হাতে দেয়া যাবে না।

চিঠি লিখে রেখেছ?

হ্যাঁ। তোর অন্যের চিঠি খুলে পড়ার অভ্যাস নেই তো?

আমি জানি নেই। তারপরেও জিজ্ঞেস করলাম। এই চিঠি তুই যদি পড়িস তাহলে রোজ হাশরের দিনে দায়ী থাকবি।

ফুপু আমার হাতে চিঠি দিলেন। খামের ওপর লেখা পরম শ্রদ্ধাভাজন মুকুল ভাই।

দুশ টাকা দেয়ার কথা ছিল, আরো একশ দিলাম। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

রোজ হাশরে দায়ী থাকার বিষয়টা আমার তেমন ভয়াবহ মনে হলো না। ফুপুর ঘর থেকে বের হয়েই চিঠি খুলে পড়লাম

মুকুল ভাই,

আপনি আমার কাছে দেবতা। না না, ভুল বললাম, দেবতার চেয়েও বড়। আপনি আমার সব। আপনি যা বলেছেন আমি তাই করেছি। ভবিষ্যতেও করব। যতদিন বাঁচব ততদিন করব। এখন আমার মহাবিপদ। এখন আপনি বলে দিন, আমি কী করব? আমি কি ঘুমের ওষুধ খাব? নাকি সিলিং ফ্যানে ফাস নিব? আপনি যা বলবেন তাই হবে।

আমার ওপর তুফান বয়ে যাচ্ছে, আর আপনি শুনলাম হোতাপাড়ায় প্রজাপতির মন নাটকের শুটিং শুরু করেছেন। খবরটা প্রথম বিশ্বাস করি নি। ইতি আপার কাছে টেলিফোন করে নিশ্চিত হয়েছি।

মুকুল ভাই, আপনার-আমার এই ভিডিওটা কে তুলেছে? আপনি কি বের করতে পেরেছেন? মনে হয় না আপনার সেই চেষ্টা আছে। কারণ ভিডিওতে আপনাকে চেনা যায় না। আপনি বেশির ভাগ সময় আড়ালে ছিলেন, যে কয়বার ক্যামেরার সামনে এসেছেন আপনার মুখ দেখা যায় নি। আর আমি ছিলাম পুরোপুরি ক্যামেরার সামনে। আমাকে সবাই চিনবে। আমার সঙ্গের পুরুষ মানুষটাকে কেউ চিনবে না।

মুকুল ভাই, আমি কী করব আপনি বলে দিন। প্লিজ প্লিজ প্লিজ! আরেকটা কথা, প্রজাপতির মন নাটকে আপনি আমাকে একটা রোল দিবেন বলেছিলেন। নায়িকার সৎবোন আমার করার কথা ছিল। অথচ সেই রোল এখন ইতি করছে। আমার কপাল এত খারাপ কেন মুকুল ভাই? আমার আরো অনেক আগেই মরে যাওয়া উচিত ছিল। কেন এখনো বেঁচে আছি? হে দয়াময়, তুমি আমার মৃত্যু দাও। মৃত্যু দাও। মৃত্যু দাও।

ইতি–
আপনার কাছের এক অভিমানী
নীলা

 

চিঠির শেষে অনেকগুলি ক্রস চিহ্ন। সাংকেতিক কোনো ভাষা। কয়েকটা আবার বৃত্ত দিয়ে ঢাকা।

সময় কাটানোর জন্যে আমি চলে গেলাম দি ইমেজ-এ। রাত করে বার। ফিরতে হবে। ফুপুর কাছে প্রমাণ করতে হবে আমি অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষ। করে মুকুল ভাইয়ের হাতে চিঠি দিয়েছি। লুকিয়ে থাকার জন্যে দি ইমেজ ভালো জায়গা। জহির ভাই জাহাজ ভাঙা ফার্নিচারের দোকান থেকে লোহার একটা বাথটাব কিনেছেন। সেটা এখনো দেখা হয় নি। নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে।

জহির ভাই জঞ্জাল কিনে বাড়ি ভর্তি করার মানুষ না।

জহির ভাই বাথটাবেই ছিলেন। আধশোয়া হয়ে বই পড়ছেন। বইটার নাম— The Spiral Staircase। কভারে একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটা পার্কের বেঞ্চে বসে বই পড়ছে। ইদানীং জহির ভাইয়ের বই পড়া রোগ হয়েছে। যখনই তার ঘরে যাই দেখি তিনি বই পড়ছেন। তাঁর শোবার ঘর ভর্তি করে ফেলেছেন বই দিয়ে।

বাথটাবটা দেখে তেমন ভালো কিছু মনে হলো না। বাথটাব হয় লম্বা, এটা গোল ধরনের। নিচে চাকা আছে। তিনটা চাকা। চাকার কারণে এটাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঠেলে নেয়া যায়। এখন বাথটাবটা জহির ভাইয়ের শোবার ঘরে। বিছানার সঙ্গে লাগানো।

জহির ভাই আমাকে দেখে বললেন, খবর কী রে?

আমি বললাম, খবর নেই।

আজ দুপুর থেকে বাথটাবে বসা। মাঝখানে দুবার উঠে শুধু বাথরুমে গিয়েছি।

বাথটাবে কতক্ষণ থাকবে?

বুঝতে পারছি না। সারারাত থাকতে পারি, আবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে উঠে যেতে পারি।

জহির ভাই হাতের বই বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে হঠাৎ গম্ভীর গলায় বললেন, তোর ফুপুর খবর কী বল তো? সে কি স্বাভাবিক আছে? নাটক করে বেড়াচ্ছে?

মোটামুটি স্বাভাবিক।

একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার হাতে দে। বাথটাবে শুয়ে থাকলে একটাই সমস্যা, ভেজা হাতে সিগারেট ধরানো যায় না।

আমি সিগারেট ধরিয়ে দিলাম। জহির ভাই সিগারেট টানতে টানতে বললেন, তোর ফুপু বাংলাদেশের সবচে বোকা মহিলা। ঠিক বলেছি কি-না বল!

ঠিক বলেছ।

তাকে তুই একটা কথা বলতে পারবি?

পারব।

তাকে বলবি যে, তার ব্যাপারটা আমি দেখছি। এর বেশি কিছু বলতে হবে। এইটুকু বললেই বুঝবে।

আচ্ছা বলব। আজই বলব।

তোর বাবার খবর কী?

জানি না। অনেক দিন দেখা হয় না।

উনার মামলা কোর্টে কবে উঠবে?

জানি না।

খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবি। ঐদিন কোর্টে থাকব।

আচ্ছা।

আর আমার মার খবর কী?

ভালোই আছে।

ভূত-প্রেত এখনো দেখছেন?

হুঁ। একটা ভূত না-কি তাঁর বুড়া আঙুলে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছে!

জহির ভাই হাসতে শুরু করেছেন। নীলা ফুপুটাইপ হাসা। হেসেই যাচ্ছেন। হাসি থামছে না।

হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়েই বোধহয় শিয়ালমুত্রা চলে এলেন (তিনি এখন দি ইমেজেই থাকেন)। শিয়ালমুত্রার গায়ে ঘাগরা জাতীয় একটা ঝলমলে পোশাক। তার চেহারায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনের কারণ মাথার চুল। চুল রঙ করিয়ে সোনালি করা হয়েছে। চোখের পাতাতেও সোনালি রঙ দিয়েছেন। তিনি মুখে যে রঙ-চঙ মেখেছেন তাতে বোধহয় কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। মুখের দাঁত আরো ভেসে উঠেছে। এমন চেহারা মুকুল ভাইয়ের চোখে পড়লে কাজ হতো। মুকুল ভাই তাঁকে অবশ্যই রোল দিতেন— নায়িকার ভ্যাম্প মা টাইপ রোল। ভূতের নাটক হলে পেত্নীর রোল।

শিয়ালমুত্রা জহির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খুকিদের মতো গলায় বললেন, তাহলে কিন্তু আমি একটা কাণ্ড ঘটাব। ঘড়ি ধরে দশ মিনিট। এই এখন থেকে শুরু হলো। আমি ঠিক দশ মিনিট পরে টাওয়েল-হাতে আসব।

জহির ভাই বিছানায় রাখা বই আবার টেনে নিলেন। তিনি দশ মিনিটের মধ্যে উঠবেন কি উঠবেন না এটা বোঝা যাচ্ছে না।

শিয়ালমুত্রা এবার আমার দিকে তাকিয়ে মধুর গলায় বললেন, খোকা, তুমি একটু আমার সঙ্গে এসো তো! তোমার সঙ্গে কথা আছে। তোমার নাম যেন কী?

বাবলু।

বাবলু এসো।

আমি বাধ্য ছেলের মতো তার পেছনে পেছনে গেলাম। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন ভিডিও কাউন্টারে। ভিডিও কাউন্টারে লোকজন নেই। টিভিতে কী একটা হিন্দি ছবি চলছে। শিয়ালমুত্রা রিমোট কন্ট্রোলে ছবি বন্ধ করলেন। তার গলার স্বর থেকে কোমল ভাব দূর হয়ে গেল। তিনি খসখসে গলায় বললেন, তোমার ফুপু যে একজনের সঙ্গে সেক্স করেছে আর সেই ছবি সিডিতে এসেছে, এইটা জানো?

আমি বললাম, জানি।

বাহ্‌বা। বিরাট লায়েক ছেলে তুমি। দেখেছ সেই ছবি?

না।

দেখ নাই কেন? আত্মীয়স্বজনের সেক্স দেখতে ভালো লাগে না? অন্যেরটা দেখতে ভালো লাগে? সবসময় এইখানে ঘোরাঘুরি করো কেন? যাও, বাড়িতে যাও। আর যদি কখনো এখানে তোমাকে দেখি থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব। যাচ্ছ না যে, ব্যাপার কী?

এখন যেতে পারব না। রাত এগারোটার দিকে যাব।

তোমার সাহস তো কম না! তুমি এক্ষণ যাবে। এক্ষণ। আমি বললাম এক্ষণ, এক্ষণ।

শিয়ালমুত্রার হিস্টিরিয়ার মতো হয়ে গেল। শরীর কাঁপতে কাঁপাতে তিনি বলেই যাচ্ছেন— এক্ষণ, এক্ষণ, এক্ষণ। তাঁর বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখ লাল। আমি ঘর থেকে বের না হলে এই মহিলা অবশ্যই মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। আমি বের হয়ে গেলাম।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ