আমার নামে কখনো কোনো চিঠি আসে না। কে আমাকে চিঠি লিখবে? যারা লেখার তারা তো আশেপাশেই আছে। তারপরেও আশ্চর্য, পোস্টাপিসের পিওন এসেছে আমার খোঁজে। সে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি নিয়ে এসেছে। রেজিস্ট্রি উইথ অ্যাকনলেজমেন্ট। দস্তখত করে চিঠি নিতে হবে। রেজিস্ট্রি করা চিঠি আমাকে কে লিখবে? খামের লেখাও অপরিচিত। খাম খুলে দেখি বাবার দীর্ঘ চিঠি।

My dear Sun,

তোমাকে Son না বলিয়া Sun বলিলাম। এই Sunএর অর্থ সূর্য, দিবাকর। তুমি আমার নিকট দিবাকর।

বাবা, তুমি কেমন আছ? দীর্ঘদিন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইতেছে না। বিগত পাঁচ তারিখে তোমাদের বাসার সম্মুখ দিয়া বেশ কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করিয়াছি। পরিকল্পনা ছিল তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তোমাকে নিয়া একসঙ্গে কিছুক্ষণ বসিতাম। দুর্ভাগ্য তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নাই। পরে ঠিক করিলাম নীলার মোবাইল নাম্বারে টেলিফোন করিয়া সংবাদ নেই। তাহার টেলিফোন নাম্বার হারাইয়া ফেলিয়াছি বলিয়া ইহাও সম্ভব হয় নাই।

বাসার সংবাদ কী? তোমার মাতা আমার বিরুদ্ধে মামলা করিয়াছে। এই সংবাদ নিশ্চয়ই পাইয়াছ। মামলার ফলাফল তোমার মাতার জন্য শুভ হইবে না। কিন্তু ইহা তাহাকে কে বুঝাইবে? মিলমিশ করিয়া থাকাতে যে আনন্দ সেই আনন্দ অন্য কোথাও নাই। তোমার মাতার সহিত একান্তে বসিয়া কিছু কথা বলিতে পারিলে সমস্যার সুরাহা হইবার সম্ভাবনা আছে। কীভাবে একান্তে বসা যায় তা নিয়া আমি ভাবিতেছি। মাথায় তেমন কোনো পরিকল্পনা আসিতেছে না।

মালতীর ইচ্ছা সে একদিন তাহার শিশু সন্তানকে কোলে নিয়া তোমার মাতার কাছে যাইবে। এবং তোমার মাতার পা জড়াইয়া ধরিয়া বসিয়া থাকিবে। এই বুদ্ধিও খারাপ না। স্ত্রীলোকের মাথায় মাঝে মধ্যে ভালো বুদ্ধি খেলা করে। স্ত্রীলোকেরা পা ধরাধরির বিষয়টাও পছন্দ করে। মালতী যদি এক পা জড়াইয়া ধরে এবং যূথী যদি অন্য পা জড়াইয়া ধরে, (যূথীকে শিখাইয়া পড়াইয়া নিলে সে এই কাজ অবশ্যই করিবে) তাহা হইলে তোমার মাতার হৃদয় নরম হইবার সম্ভাবনা আছে। তোমার কী ধারণা? সাক্ষাতে আমরা এইসব নিয়া আলাপ করিব। বাবা, তুমি একবার আস।

আগামী ১৭ তারিখ সন্ধ্যায় যূথীর চতুর্থ জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হইবে। ইহা তাহার মায়ের ইচ্ছা। তোমার পক্ষে কি এই দিন আসা সম্ভব? উৎসব তেমন কিছু না। উন্নত মানের খাদ্য কেক মিষ্টি ইত্যাদি। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। বড় কিছু করা সম্ভব না। সঞ্চিত টাকাপয়সা একত্র করিয়া তোমার মায়ের নামে দুইটি এফডিআর করাইয়া দিয়াছিলাম। একটি এফডিআর চলতি মাসের ১১ তারিখে ম্যাচিউরড হইয়াছে। তোমার মাতা এই এফডিআর হইতে দশ লক্ষ টাকা পাইবেন। এই অর্থের কিছু আমাকে দিলে আমার উপকার হইত। তোমার মাতাকে যে এই বিষয়ে অনুরোধ করিব সেই সুযোগও পাইতেছি না। আল্লাহ পাকের উপর ভরসা। দেখি উনি আমার জন্য কী ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন।

বাবা বাবলু, পত্রপাঠ সম্পন্ন হইবা মাত্র ছিড়িয়া কুটিকুটি করিয়া ফেলিবে। এই পত্র তোমার মায়ের হাতে পড়িলে বিপদের সম্ভাবনা।

দোয়াগো
তোমার হতভাগ্য পিতা
তোফাজ্জল হোসেন

সতেরো তারিখ সন্ধ্যায় আমি যূথীর জন্মদিন পালন করতে গেলাম। যূথীর জন্য এক প্যাকেট চকলেট এবং একটা হাতি কিনলাম। যূথী তার পছন্দের একটা হাতির কথা বলছিল, এইটাই সেই হাতি কি-না কে জানে।

দরজার কড়া নাড়তেই মালতী দরজা খুলে দিলেন। এই মহিনে ১৩ ডাকাটা ঠিক হচ্ছে না। ছোট মা ডাকতে পারলে ভালো হতো। তাও পারছি।

মালতী দরজা খুলে একপাশে সরে গিয়ে নিচু গলায় বললেন, কে আছ বাবা?

আমার মনে হয় তিনি যে এই বাক্যটি বলবেন তা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। বাক্যটা বললেন যন্ত্রের মতো গলায়। বলেই মাথাও নিচু করে ফেললেন। আমি বললাম, ভালো আছি।

তুমি যূথীর সঙ্গে গল্প কর। তোমার বাবা ঘুমাচ্ছেন।

অসময়ে ঘুমাচ্ছেন কেন?

উনার জ্বর।

জ্বর কি বেশি?

বেশি। পাঁচদিন ধরে জ্বর। ডাক্তারের কাছে যেতে বলি—— যায় না। আমার মনে হয় ডেঙ্গু হয়েছে। শরীর ফুলে ফুলে গেছে। তার মাথায়ও যন্ত্রণা। ডেঙ্গু হলে মাথায় যন্ত্রণা হয়। বাবা, তোমাকে একটু চা করে দেই, চা খাবে?

খাব।

জন্মদিনের কোনো আয়োজন করতে পারি নাই। উনি অসুস্থ, বাজার কে করবে! শুধু পুডিং করেছি। কেক আনা হয়েছে। তোমার বাবা ঘুম থেকে উঠলে কেক কাটা হবে।

জি ঠিক আছে।

তিনি রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। আমি বসলাম যূথীর পাশে। জন্মদিন উপলক্ষে যুথীকে নতুন ফ্রক পরানো হয়েছে। বেণি করে চুল বাঁধা হয়েছে। আগের দিনের মতোই যূথী দুনিয়ার খেলনা নিয়ে বসেছে। আমি বললাম, যূথী, তুমি কি আমাকে চিনেছ?

যূথী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

বলো তো আমি কে?

বাবলু।

হয়েছে। তোমার অনেক বুদ্ধি।

আজ আমার জন্মদিন। তুমি জানো?

জানি। তোমার জন্য গিফট নিয়ে এসেছি।

কী গিফট?

কেক কাটা হোক। তারপর তোমাকে দেব।

আচ্ছা। জিতুর মা চলে গেছে, তুমি জানো?

না। চলে গেছে না-কি?

হুঁ। মার গয়না আর বাবার মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেছে। পরশু সকালবেলা গেছে।

বলো কী?

হুঁ সত্যি কথা। বাবার মানিব্যাগে কত টাকা ছিল তুমি জানো?

না।

এক হাজার তিনশ ছাব্বিশ টাকা।

অনেক টাকা ছিল তো?

হুঁ। মার কী কী গয়না নিয়েছে তুমি জানো?

না।

তোমাকে বলব? বলো।

দুটা কানের দুল, একটা চেইন, চারটা চুড়ি। মা সারাদিন কেঁদেছে। মার মনে কষ্ট হয়েছে এইজন্য কেঁদেছে। কষ্ট হলে কাঁদতে হয়।

তুমি কাঁদ?

হুঁ। পেটে ব্যথা হলে কাঁদি। আর যদি খেলনা হারিয়ে যায় তাহলে কাঁদি।

চারটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কাটা হলো। সেই কেকের এক টুকরা মুখে দিয়ে বাবা বললেন, অসাধারণ কেক। দি বেস্ট। বলেই বমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেললেন।

আমি বললাম, বাবা, তোমার অবস্থা তো খুবই খারাপ।

বাবা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, হুঁ খারাপ।

চোখ টকটকে লাল, ডেঙ্গু হয় নাই তো?

হতে পারে।

হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছ না কেন? এখন যাবে? নিয়ে যাব তোমাকে?

রুগি নিয়ে গেলেই তো ভর্তি করায় না। ধরাধরি আছে, টাকা-পয়সা খাওয়া খাওয়ি আছে। হাতে টাকা-পয়সা নাই। জিতুর মা মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়েছে। মালতীর গয়না নিয়েছে। ক্রিমিন্যাল মেয়ে।

বাবা চল যাই হাসপাতালে ভর্তি করানো যায় কি-না দেখি।

ঠিক আছি। আমি ঠিক আছি। বমি করার পর শরীরটা ফর্মে চলে এসেছে। তুই বাসায় চলে যা। বাসায় গিয়ে সাবান ডলে গরম পানি দিয়ে একটা গোসল দিবি। নয়তো দেখা যাবে তোকেও ধরেছে। ভাইরাস মারাত্মক জিনিস, একবার ধরলে জান বিলা করে দেয়।

যূথীর মনে হয় আমার আনা হাতিটা খুব মনে ধরেছে। হাতিটা সে জড়িয়ে বুকের কাছে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে হাত টান করে সে হাতিটা তার চোখের সামনে আনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, আবার বুকে চেপে ধরে। আমি বললাম, যূথী, তোমার কি হাতি পছন্দ হয়েছে? সে প্রশ্নের জবাব দিল না। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। তার ভুবনে আকাশী রঙের হাতিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি বললাম, যূথী, যাই? সে শুধু ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। কিছুই বলল না।

আমার কাছে পনেরশ টাকা ছিল। হাতির পেছনে নয়শ টাকা খরচ হয়েছে। এতগুলি টাকা সামান্য একটা তুলা ভরা খেলনার পেছনে খরচ করতে মায়া লাগছিল— এখন ভালো লাগছে। এই বাচ্চামেয়েটি বড় হবে। সে তার সমগ্র জীবনে অসংখ্য উপহার নিশ্চয়ই পাবে, কিন্তু কোনো উপহারই হাতিটার স্থান নিতে পারবে না। এই মেয়েরও একদিন মেয়ে হবে। তার জন্মদিন হবে। জন্মদিনের মেয়েকে তার মা বলবে, আমি যখন তোর মতো ছোট ছিলাম তখন আমি জন্মদিনে একটা হাতি পেয়েছিলাম। পৃথিবীর সবচে সুন্দর হাতি।

বাচ্চামেয়েটি আগ্রহ করে জানতে চাইবে, কে দিয়েছিল?

যূথী বলবে, বাবলু দিয়েছিল।

বাবলু কে?

আমার ভাই। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন।

আচ্ছা আমি কি মেয়েটিকে স্নেহ করি? হয়তো করি। স্নেহ না করলে এত টাকা দিয়ে হাতি কিনব কেন। আবার এও হতে পারে যে স্নেহ-ট্রেহ কিছু না, আমি ঘটনা দেখতে আসি। বড়খালা ভিডিওতে ঘটনা দেখে মজা পান। আমি বাস্তবের ঘটনায় মজা পাই।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ