আমার মার নাম আফিয়া বেগম। এমন কোনো বড় নাম না, তারপরেও এই নামটা ছোট করে বাবা ডাকতেন আফি। ই-কারের টান যখন দীর্ঘ হতো তখন বোঝা যেত বাবার মেজাজ শরিফ। এখানেই শেষ না, নাম নিয়ে বাবার দুটা ছড়াও ছিল। যেমন—

আফি আফি
করতে হবে মাফি

আফি আফি
You are কাফি

প্রথম ছড়াটা বাবা বেশি বলতেন। মার চোখে মুখে তখন আনন্দ ঝরে পড়ত। মা হচ্ছেন স্বামীর প্রতিভায় মুগ্ধ হওয়া গোত্রের মহিলা। এই জাতীয় মহিলাদের চোখে একধরনের অদৃশ্য চশমা থাকে। যে চশমা স্বামীদের যাবতীয় ত্রুটি ফিল্টার করে রেখে দেয়। তাদের চোখে স্বামীদের গুণাবলিই শুধু ধরা পড়ে।

আমরা যখন ভাড়াবাড়িতে থাকতাম তখন বাবা প্রথম মিল্লাত কোম্পানির একটা সিলিং ফ্যান কিনলেন। সেই ফ্যান বসার ঘরে লাগানো হলো। সুইচ টেপার পর ফ্যান থেকে বৃদ্ধ মানুষদের ধারাবাহিক কাশির মতো ঘড়ঘড় আওয়াজ হতে লাগল। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। ভাইয়া বলে ফেলল, এত শব্দ! মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ফ্যানে একটু আধটু শব্দ তো হবেই। হাওয়া কত এটা দেখবি না? ঝড়-তুফানের মতো হাওয়া।

বাবা বললেন, ফ্যানটা বদলায়ে নিয়ে আসি?

মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তুমি আবার কষ্ট করে গরমের মধ্যে ফ্যান নিয়ে যাবে! কোনো দরকার নেই। ফ্যানে শব্দ হওয়া ভালো, বোঝা যায় একটা জিনিস চলছে।

মার প্রতি বাবার প্রেমও চোখে পড়ার মতোই। যে দোতলা বাড়িতে আমরা বাস করছি (তিনতলার ফাউন্ডেশন, দোতলা) তার নাম আফিয়া মহল। বাড়ির গেটে শ্বেতপাথরে বাড়ির নাম লেখা আছে। বাবার ঝোক হচ্ছে সস্তায় কাজ করানো। শ্বেতপাথরের নামফলকটাও তিনি অতি সস্তায় করিয়েছেন বলে এক বছরের মাথায় আফিয়ার অ এবং মহলের ম উঠে গেল।

এখন আমাদের বাড়ির নাম—

আফিয়া হল

যেদিন বাড়িতে শ্বেতপাথরের নাম লাগানো হলো সেদিন বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় ঘোষণা করলেন, সম্রাট শাহজাহান তাজমহল বানিয়ে ছিলেন, আমি বানালাম আফিয়া মহল। ইনশাল্লাহ আমি আগামী দুই এক বছরের মধ্যে তিন তলাটা কমপ্লিট করে দেব। তিনতলার আলাদা নাম হবে—

আফিয়া আলয়

পুরা তিনতলা হবে আফিয়ার একার সংসার। তার শোবার ঘর, তার বসার ঘর, সাজের ঘর এবং নামাজ ঘর। আফিয়ার অনুমতি ছাড়া তিনতলায় কেউ যেতে পারবে না। এমনকি আমি যদি যাই আমারও অনুমতি লাগবে।

বাবার কথাবার্তায় আমাদের হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু মা কেঁদে কেটে অস্থির।

বাড়ি দোতলা পর্যন্ত হবার পর বাবা মানত রক্ষার জন্যে মাকে নিয়ে আজমির শরিফ গেলেন। পথে দিল্লিতে তারা তাজমহল দেখলেন। তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ফটোগ্রাফারদের দিয়ে ছবি তুললেন। সেই ছবিও অনেক কায়দার ছবি। দুজন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছেন। দুজনের হাতের ফাঁক দিয়ে তাজমহল দেখা যাচ্ছে। এই ছবি বাঁধাই করে আমাদের বসার ঘরে f

সেই ছবিটা গতকাল সকালে সরানো হয়েছে। শুধু এই ছবি না, বাবার সব ছবিই নামানো হয়েছে। মার ঘরে বাবার তিনটা ছবি ছিল। তিনি ব্যবসার জন্যে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন, তখন তোলা ছবি। প্রতিটি ছবিতে তাঁর চোখে কালো চশমা ঠোঁটে পাইপ।

মার ঘরে বিশেষ ভঙ্গিমায় তোলা এই ছবিগুলি শুধু যে নামানো হলো তা, কাজের মেয়েকে বলা হয়েছে শিল-পাটার শিল দিয়ে ছবির কাচগুলি ভাঙতে। সে কাচ ভাঙতে গিয়ে নিজের হাতও কেটেছে। এমনই কেটেছে যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে স্টিচও করাতে হয়েছে।

বাবার বিষয়ে ভাইয়া এবং মা মিলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা হলো

১. এই বদলোক কখনো বাড়িতে ঢুকতে পারবে না।

২. এই বদের নাম বাড়িতে কেউ উচ্চারণ করতে পারবে না।

৩. বদটার নামে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিবাহ এবং নারী নির্যাতন আইনে মামলা করা হবে। [মামলা করা হয়ে গেছে।]

৪. বদটাকে জেলের ভাত খেতে হবে।

মার পক্ষে যে উকিল মামলা পরিচালনা করছেন তার নাম মোহম্মদ কায়েস উদ্দিন তালুকদার। এই কায়েস উদ্দিন সাহেবের হাবভাব চোরের মতো। তিনি স্থির হয়ে কারো দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারেন না। সারাক্ষণ এদিক-ওদিক করেন। তাঁর মুদ্রাদোষ হচ্ছে প্রতিটি কথার আগে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলবেন— এখন তাহলে একটা কথা বলি?

তালুকদার সাহেব মাকে বললেন— এখন তাহলে একটা কথা বলি? ভাবি সাহেব শুনেন, আমি যদি আপনার স্বামীকে সাত বছর জেলখানার লাবড়া না খাওয়াতে পারি তাহলে আমি বাকি জীবন ভাত খাব না। পাঞ্জাবিদের মতো রুটি খাব। বড়বোন হিসেবে আপনার কাছে এই আমার ওয়াদা।

মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আপনার স্বামী আপনার স্বামী করছেন কেন? সে কি আমার স্বামী?

তালুকদার সাহেব বললেন, এখন তাহলে একটা কথা বলি? উনি এখনো আপনার স্বামী। আপনি ডিভোর্স করলে স্বামী থাকবে না। তবে এখন ডিভোর্স করা ঠিক হবে না। মামলা দুর্বল হয়ে যাবে।

মা বললেন, মামলা দুর্বল হয় এমন কিছুই আমি করব না। ঐ বদটা সারাজীবনের জন্যে জেলে থাকতে পারে কি-না সেটা দেখেন।

আপা, সেটা সম্ভব হবে না। সাত বছরের বেশি আমি পারব না। ঐ গ্যারান্টি আপনাকে আমি দিচ্ছি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে মামলা চালাই। বিনা গ্যারান্টিতে মোহম্মদ কায়েস উদ্দিন তালুকদার মামলা নেয় না।

বাবার মতো ঘড়েল লোক তালুকদারের প্যাচে পড়ে সাত বছরের জন্যে জেলে যাবেন লাবড়া খেতে, এটা আমার কখনোই মনে হয় নি। মামলার প্রথম তারিখেই আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলো। মা যে বাবাকে অনেক আগেই দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি দিয়েছেন সেই কাগজ (নোটারি পাবলিক দিয়ে নোটিফাই করানো। সঙ্গে ওয়ার্ড কমিশনারের কাগজ, যে দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতির বিষয়টি তার জানা আছে) জমা দিলেন।

আমাদের উকিল সাহেব মাকে বললেন, তাহলে একটা কথা বলি? আপনার দুষ্ট হ্যাসবেন্ড যে এরকম একটা স্টেপ নিবে তা আমার হিসাবের মধ্যে আছে। সব রোগের যেমন চিকিৎসা আছে, এই রোগেরও চিকিৎসা আছে। দেখেন কী করি?

মা বললেন, কী করবেন?

মামলার কাগজপত্রের নকল নিয়ে এসেছি। আপনার সই জাল করা হয়েছে এটা প্রমাণ করব, ওয়ার্ড কমিশনারের চিঠিও যে জাল তাও প্রমাণ করব। এতে আমাদের মামলা আরো শক্ত হবে–সাত বছরের জায়গায় আট-ন বছরের বাসস্থান উনার জোগাড় হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।

মা কোর্টের কাগজপত্র দেখে শুকনা মুখে বললেন, সই তো জাল না। সই আমার।

কখন সই করলেন?

কখন সই করেছি মনে নাই। তবে সাদা কাগজে সই করেছি। ঐ বদ নানান সময়ে কাগজপত্রে আমার সই নিয়েছে। এই বাড়ি তো আমার নামে, বাড়ির ট্যাক্স দিতে হবে, হেনতেন বলে সই করিয়েছে।

আপা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। এই হিসাবও আমার আছে। আমি বিনা হিসাবে কাজ করি না। একজন সাধারণ মানুষ ঘুঘু দেখলে ফাঁদ দেখে না। ফঁদ দেখলে ঘুঘু দেখে না। আমি আপনাদের দশজনের দোয়ায় দুটাই একসঙ্গে দেখি। ব্যবস্থা নিচ্ছি।

কী ব্যবস্থা?

যথাসময়ে জানবেন। প্রথমে যেটা দেখতে হবে— বাড়িঘর এখনো আপনার নামে আছে, না-কি এখানেও কিছু দুই নম্বরি করা হয়েছে। এক সপ্তাহের ভেতর আপনি বাড়িঘরের টু পিকচার পাবেন। এখন আপনাকে একটা কথা বলি, ধৈর্য ধরুন।

বদটা জেলে যাবে তো?

অবশ্যই।

সাত বছর?

মিনিমাম সাত। বেশিও হতে পারে। আপাতত জেলের চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে হবে। প্রায়োরিটি বেসিসে কাজ করতে হবে। বাড়িঘর ঠিক আছে কি-না আগে দেখতে হবে। প্রায়োরিটি লিস্টে এটা নাম্বার ওয়ান।

এক সপ্তাহের মধ্যে জানা গেল, বাড়িঘর ঠিক ঠাক আছে। আফিয়া মহল মার নামেই আছে। তার নামেই নাম জারি করা হয়েছে। মিউনিসিপ্যালটি ট্যাক্সও তার নামেই দেয়া হচ্ছে।

বাবার সাম্প্রতিক খবরে বিন্দুমাত্র বিচলিত যিনি হলেন না, তিনি বড়খালামাজেদা বেগম। তিনি বিচলিত লোডশেডিং নিয়ে। আমার সঙ্গে এই নিয়ে তার দীর্ঘ আলাপ হয়। তিনি হতাশ গলায় বলেন, এটা কী অবস্থারে বাবলু? এক ঘণ্টা কারেন্ট না থাকা সহ্য করা যায় দেড় ঘণ্টা দুঘণ্টা এসি ছাড়া মানুষ বাঁচবে কীভাবে?

ঠিকই বলেছ, এসি ওয়ালাদের বিরাট দুর্ভোগ।

ভোল্টেজ কী রকম উঠানামা করে দেখেছিস? যে-কোনোদিন কম্প্রেসার জ্বলে যাবে। তখন উপায় কী হবে?

আরেকটা এসি কিনবে। তোমার তো টাকার অভাব নেই।

সেইটা যখন জ্বলে যাবে তখন?

তখন আরেকটা।

উন্মাদের মতো কথা বলিস না তো বাবলু। তোর কথাবার্তা বদ্ধ উন্মাদের মতো। আমি একটার পর একটা কিনতেই থাকব? তুই আছিস নিজেকে নিয়ে। অন্যের দুঃখ-কষ্ট তোর মাথায় ঢোকে না। পরশু রাতে কী হয়েছে জানিস?

না। বলো।

রাতে আরাম করে ঘুমাচ্ছি। ঘর ঠাণ্ডা। এসি চলছে। হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম, এসিটা বাস্ট হয়েছে। সেখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি ঘর থেকে বের হতে গেলাম, দেখি আমার প্যারালিসিসের মতো হয়েছে, বিছানা থেকে নামতে পারা দূরের কথা, শোয়া থেকে উঠে বসতেও পারছি না। এদিকে এসির আগুন বাড়ছে। গায়ে আগুনের আঁচ লাগছে। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তখন ঘুম ভাঙল। দেখি এসি বন্ধ। লোডশেডিং না কী যেন হয়েছে কে জানে! ঘরের ভেতরে অসহ্য গরম। আমি মাথায় পানি ঢাললাম, সারা গায়ে পানি ঢাললাম, বিছানায় পানি ঢাললাম, তাতেও গরম কমে না। কারেন্ট এলো ভোর চারটা তেইশ মিনিটে, তখন ঘুমাতে গেলাম। বুঝলি অবস্থা?

তোমার জন্যে অবস্থা যে খারাপ এটা বুঝতে পারছি।

তুই এসির লোককে খবর দে তো। সার্ভিসিং করে দিক।

গত মাসে তো একবার সার্ভিসিং করল।

আরেকবার করুক। সার্ভিসিং যত করবি তত ভালো।

আচ্ছা খবর দেব।

এখন তুই ঘর থেকে যা, আমার গরম বেশি লাগছে। গায়ের কাপড়-চোপড় খুলে গায়ে এসির ঠাণ্ডা বাতাস মাখব। বনের পশুরা কী আরামে থাকে, একবার ভেবেছিস? কাপড় পরতে হয় না…

বাবার বিষয় নিয়ে আরো একজন নির্বিকার। তিনি নীলা ফুপু। বাসায় কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে ফুপুর মাথাব্যথা নেই। তাঁর ধ্যান-স্বপ্ন প্যাকেজ নাটক। পরিচালক মুকুল ভাই, নাটকের লোকজন অভিনেতা, অভিনেত্রী, ক্যামেরাম্যান, মেকাপম্যান, লাইটম্যান। বাসায় তিনি যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ তার হাতে মোবাইল টেলিফোন থাকে। তিনি হাঁটতে হাঁটতে নাটকের সঙ্গে যুক্ত কারো না কারো সঙ্গে গল্প করেন।

কে, মারুফ ভাই? শট দিচ্ছেন? তাহলে পরে টেলিফোন করব। কার নাটক? ও বিশু ভাইয়ের? মেগা সিরিয়েল না-কি সিঙ্গেল? মেগা? বিশু ভাইকে বলেন না, আমাকে কোথাও ঢুকিয়ে দিতে। আমি ফ্রি আছি।

লুনা আপু! খবর পেয়েছি ঐদিন আপনি খুব মজা করে জন্মদিন করেছেন। আমার কথা তো মনে পড়ল না। আপনার জন্যে একটা গিফট রেখে দিয়েছি ফেস ওয়াশ। বেলজিয়ামের তৈরি। কৌটাটা খুব কিউট। আমি এসে বাসায় দিয়ে যাব। কবে আসব বলুন।

হ্যালো, কে, ফরিদ ভাই? ভালো আছেন ফরিদ ভাই? ভাবি ভালো আছেন? আপনার মেয়েটার যে হাম হয়েছিল, হাম কমেছে? ছোটবেলায় আমার একবার হয়েছিল, যা কষ্ট দেয়। একটু কাজের কথা বলি ফরিদ ভাই? আপনারা আমাকে যে রোলটা দিয়েছেন সেটা না-কি আমার আগে আরো দুজনকে আপনারা অফার দিয়েছেন। তারা রিজেক্ট করেছে। সেই রোল আমাকে দিয়েছেন। যাদের অফার করেছেন তারাই আমাকে বলেছে। আচ্ছা ফরিদ ভাই, আমি কি এতই ফেলনা? হ্যাঁ, আমি করব। করব না কেন? আপনাদের পার্টির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আলাদা। আমরা জয়েন্ট ফ্যামিলির মতো, তাই না? ফরিদ ভাই, আমি একদিন আপনাদের বাসায় যাব। ভাবির সঙ্গে গল্প করব আর আপনার মেয়েটাকে দেখে আসব। আপনার মেয়েটা কী যে সুইট হয়েছে ফরিদ ভাই। আপনার মেয়ের জন্যে আমি এক প্যাকেট চকলেট আলাদা করে রেখেছি।

 

নীলা ফুপুর সঙ্গে গত বুধবারে আমি শুটিং দেখতে গিয়েছিলাম। ফুপু আমাকে জোর করে নিয়ে গেল। নায়কের সঙ্গে তাঁর না-কি সিরিয়াস অ্যাকটিং আছে। দেখার মতো জিনিস হবে।

আমি বললাম, তুমি নায়িকা না-কি?

না, আমি নায়িকা না। নতুন একটা মেয়ে নায়িকা। অভিনয়ের অ জানে। চেহারাও বান্দরীর মতো। প্রডিউসারের সাথে ইটিস-পিটিশ আছে, এইজন্যে তাকে নিয়েছে।

তুমি তাহলে নায়কের সঙ্গে কী করবে?

সিকোয়েন্সটা তোকে বলি। পার্কের সিকোয়েন্স। আমি একটা গাছে হেলান দিয়ে বাদাম খাচ্ছি, এমন সময় নায়ক রিয়াজ ভাই আসবে। আমাকে দূর থেকে দেখে মনে করবে, আমিই তার নায়িকা। রিয়াজ ভাই পা টিপে টিপে এসে আমার পাশে বসবে, মাথায় টোকা দেবে। আমি চমকে রিয়াজ ভাইয়ের দিকে তাকাব। রিয়াজ ভাই বলবেন, Sorry, I made a mistake. তারপর উঠে চলে যাবেন।

তোমার কী ডায়ালগ?

আমার কোনো ডায়ালগ নেই। ক্লোজ ট্রিটমেন্টের সিকোয়েন্স তো। এইসব সিকোয়েন্সে ডায়ালগ দিলে সিকোয়েন্স পড়ে যায়। এইসব সিকোয়েন্স হলো এক্সপ্রেশনের খেলা।

তুমি কী এক্সপ্রেশন দেবে?

আমার সঙ্গে চল। নিজের চোখে দেখবি। এই ধরনের সিকোয়েন্স দেখার মধ্যেও মজা আছে। নানান দিক থেকে লাইট করবে। ব্যাক লাইট দিবে। ব্যাক লাইট কি জানিস?

না।

পেছন থেকে যে লাইট দেয় তাকে বলে ব্যাক লাইট। ব্যাক লাইট দিলে চেহারা ফুটে উঠে। আমার পেছনে যখন ব্যাক লাইট দিবে তখন দেখবি চেহারা কেমন বদলে যায়। আমাকে রাজকন্যার মতো লাগবে।

নীলা ফুপুর অভিনয় দেখতে না যাওয়াই ভালো ছিল। পরিচালক সাহেব (মুকুল ভাই না, অন্য একজন) এমন ধমক শুরু করলেন। ধমকের ভাষাও খারাপ— এই গাধী মেয়েকে কে এনেছে? হাত-পা শক্ত করে বসে আছে। কেউ একজন এর গালে একটা থাপ্পড় দাও তো। এই মেয়ে, তুমি আগে আগে মাথা ঘোরাও কেন? আবার যদি আগে আগে মাথা ঘোরাও ঘাড় মটকে দেব। গাধীর গাধী!

পরিচালক সাহেবকে আমি দোষ দিতে পারি না। নীলা ফুপু আসলেই কিছু পারছে না। অ্যাকশান বলার আগপর্যন্ত ঠিক আছে। অ্যাকশান বলার পরপরই উনার হাত-পা-মুখ সব শক্ত। নিঃশ্বাসও বন্ধ। জীবন্ত মানুষ থেকে হঠাৎ তিনি মূর্তি হয়ে যাচ্ছেন। নায়ক তার পেছনে দাঁড়ানো মাত্রই তিনি আড়চোখে তাকাবেন। তাকিয়ে শরীরে ছোট্ট ঝাঁকি দেবেন।

শেষপর্যন্ত টেক ওকে হলো। তবে পরিচালকের মন মতো হলো না। তিনি তার অ্যাসিসটেন্টকে বললেন, এই গাধীকে আবার যদি কল দিয়ে আনো, তোমাকে আমি কানে ধরে উঠবোস করাব। ত্রিশ সেকেন্ডের সিকোয়েন্সে একঘণ্টা খেয়ে ফেলেছে।

নীলা ফুপু বেশ স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয় নি। তিনি তার নিজের জন্যে এবং আমার জন্যে দুকাপ চা নিয়ে নিলেন। চাপা গলায় বললেন, প্রডাকশনের লেবু চা, খেয়ে দেখ মজা পাবি। দুপুরে এফডিসির খানা আসবে। মিনিমাম দশ পদের ভর্তা থাকবে। সঙ্গে মাছ গোশত। মাছ গোশত দুটাই কেউ পাবে না। যারা গোশত নিবে তারা মাছ পাবে না। শুধু ডিরেক্টর সাহেব এবং নায়ক-নায়িকা মাছ-গোশত দুপদই পাবে। এটাই নিয়ম। দুপুর পর্যন্ত থাক, খেয়ে যা।

আমি বললাম, তোমার কি আরো সিকোয়েন্স আছে?

আর নেই। তবু থাকতে হয়। একটা ইউনিটের সঙ্গে আছি, কাজ নেই বলে চলে যাওয়া তো ঠিক না।

তুমি বরং চলেই যাও। ডিরেক্টর সাহেব যেমন রেগেছেন। তোমাকে মারবেন।

তুই কী যে বলিস! টেক-এর সময় উনি সবাইকে ধমকা ধমকি করেন। সিকোয়েন্স শেষ হয়ে গেলে আবার মাটির মানুষ। সবার সঙ্গে হাসি খুশি জোক বলছেন, মজা করছেন। আর তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।

কোনো দরকার নেই।

দরকার আছে। তার ধারণা হয়েছে, উনি আমার ওপর রেগে আছেন। ধারণাটা কত ভুল এক্ষুনি প্রমাণ পাবি।

আমার প্রমাণের দরকার নেই।

আয় তো।

নীলা ফুপু আমার হাত ধরে প্রায় টেনেই ডিরেক্টর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি মুখভর্তি করে পান খাচ্ছিলেন। এক হাতে আবার চায়ের কাপ। পান এবং চা কি একসঙ্গেই খাচ্ছেন? অসম্ভব না। এরা তো আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ না।

স্যার, এ আমার ভাইয়ের ছেলে। এর নাম বাবলু।

ডিরেক্টর সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বিনীতভাবে বললাম, স্যার, স্লামালিকুম। ডিরেক্টর সাহেব সালামের জবাব না দিয়ে নীলা ফুপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কাজ শেষ না?

নীলা ফুপু বললেন, জি স্যার। তা

হলে এখনো ঘুরঘুর করছ কেন? বাড়ি যাচ্ছ না কেন?

 

আমরা ট্যাক্সি ক্যাবে ফিরছি। ট্যাক্সিতে উঠে নীলা ফুপু সামান্য কান্নাকাটি করলেও এখন স্বাভাবিক। শাহবাগের কাছে এসে আমাকে বললেন, তুই এখানে নেমে যা। আমি একটু মুকুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। দশটা টাকা রাখ, রিকশা ভাড়া।

দশ টাকা বলে যে নোটটা তিনি আমার হাতে গুঁজে দিয়েছেন সেটা একটা একশ টাকার নোট। আমি বললাম, ফুপু, তুমি ভুলে একশ টাকার নোট দিয়েছ।

ফুপু বললেন, দিয়েছি যখন রেখে দে।

ফেরত দিতে হবে না?

তুই কি গাধা নাকি?

ট্যাক্সি থেকে নেমে হঠাৎ করে মনে হলো, আমি আমার এই ফুপুকে খুবই পছন্দ করি। কেন করি? উনি বোকা বলে কি পছন্দ করি? বুদ্ধিমান মানুষদের কেউ পছন্দ করে না। মানুষ পছন্দ করে বোকাদের। তবে বড়খালাকে আমি কেন পছন্দ করি না? উনি তো যথেষ্টই বোকা। এদিকে জহির ভাইকে আমার বেশ পছন্দ। জহির ভাই অসম্ভব বুদ্ধিমান। তাহলে কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে, মানুষ বোকাদের পছন্দ করে, এই থিওরি ভুল?

নীলা ফুপু মাঝে মধ্যেই পাঁচটা টাকা রাখ বলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দেন কিংবা দশটা টাকা রাখ বলে একটা একশ টাকার নোট দেন। এই কারণেই কি উনাকে পছন্দ করি? পছন্দটা কি অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত? তাও তো ঠিক না। জহির ভাই কখনো আমাকে টাকা-পয়সা দেন না। তারপরেও তো তাকে আমার খুবই পছন্দ।

জহির ভাই টাকা-পয়সা দেন না, তার মূল কারণ অবশ্যি উনার কাছে টাকা-পয়সা নেই। উনি নিজেই চলেন এর তার কাছে হাত পেতে। এখন অবশ্যি তাঁর অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি দি ইমেজএ স্থায়ী হয়েছেন। ভালোভাবেই স্থায়ী হয়েছেন। ফারুক ভাইয়ের স্ত্রী (নাসরিন, দেখতে শাকচুন্নির মতো। দাঁত ভাসা, চুলের রঙ প্রায় লাল) না-কি জহির ভাইকে অনুরোধ করেছেন মৃত বন্ধুর ব্যবসা দেখাশোনা করতে। তাঁর বিশ্বাসী কেউ নেই। জহির ভাই ভরসা। জহির ভাই রাজি হয়েছেন। এখন তিনিই ভিডিও ব্যবসা দেখেন। শাকচুন্নি মহিলাকে আগে কখনো দি ইমেজে দেখা যায় নি। এখন তিনি প্রায়ই আসেন। বিহারি মেয়েদের মতো ঝলমলা শাড়ি পরেন। গালে কী যেন মাখেন— এতে গাল আপেলের মতো লাল টুকটুক হয়ে যায়। তারপরেও এই মহিলার দিকে তাকানো যায় না। ভিডিও দোকানের স্টাফরা আড়ালে তাকে দুটা নামে ডাকে। এক, ঘোড়ামুখী। এই নামকরণ ঠিক আছে। সাইড থেকে দেখলে তাঁর মুখের সঙ্গে ঘোড়ার মুখের মিল আছে। তবে তাঁর আরেকটা নাম হলো শিয়ালমুত্রা। এই নামের পেছনের কারণ কী জানি না। কোনো একদিন জিজ্ঞেস করে জেনে নিব।

শিয়ালমুত্রার সঙ্গে একদিনই আমার কথা হয়েছে। উনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি জহির সাহেবের ভাই না? সারাদিন তোমাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখি, স্কুলে যাও না?

স্কুল বন্ধ।

এখন কিসের স্কুল বন্ধ? বাংলাদেশের সব স্কুল খোলা, তোমারটা বন্ধ এর মানে কী? আমার সঙ্গে বাইচলামি কর?

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি তো, এই জন্যে স্কুল বন্ধ।

ও আচ্ছা তাই বলো। তুমি কি এখান থেকে ভিডিও নিয়ে যাও?

জি।

তুমি দেখ, না আর কেউ দেখে?

আমার বড়খালা দেখেন।

এক্স রেটেড ছবি নাও না তো? ঐ যে ছেলেমেয়ের কুকর্মের ছবি?

জি-না।

আমি কিন্তু রেজিস্টার চেক করে দেখব। যদি দেখি ট্রিপল এক্স বা ডাবল এক্স ছবি নিয়েছ— তাহলে কিন্তু তোমার খবর আছে। তোমার বাসায় কমপ্লেইন করা হবে। বুঝেছ তো?

জি।

আরেকটা কথা তোমাকে বলব। এই কথাটা উঁচাগলায় বলতে পারব না। চাপাগলায় বলব। আমি চাই না বাইরের কেউ শুনুক।

আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। শিয়ালমুত্রা ফিসফিস করে বললেন, এতক্ষণ ধরে তোমার সঙ্গে কথা বলছি, তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও নাই। তাকিয়ে ছিলে আমার বুকের দিকে। সেই দিনের বাচ্চাছেলে, মুখের দুধের গন্ধ এখনো যায় নাই, এর মধ্যেই মেয়েছেলের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকা শিখেছ! যাও সামনে থেকে।

আমি ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম না, এটা ঠিক। তবে আমি তার বুকের দিকেও তাকিয়ে ছিলাম না। আমি তাকিয়ে ছিলাম তার দাঁতের দিকে।

জহির ভাইয়ের সঙ্গে এই মহিলার সম্পর্ক কোন পর্যায়ের আমি এখনো জানি। জহির ভাই তাকে ডাকেন রুবি। মনে হয় রুবি এই মহিলার ডাকনাম।

একদিন জহির ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, দি ইমেজ-এর ম্যানেজার কাদের সাহের গম্ভীর গলায় বললেন, বাবলু, এখন যেও না। ম্যাডাম জহির ভাইয়ের সঙ্গে আছেন। ঘণ্টাখানিক পরে এসো।

বলতে ভুলে গেছি, কাদের সাহেবকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও পরে ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত হয়েছে। কিছু টাকা খরচ হয়েছে, তার পরিমাণও অল্প।

কাদের সাহেব লোক ভালো। গাট্টাগোট্টা চেহারা। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তাকে দেখলেই মনে হয় ফুটবল কোচ বা এই ধরনের কেউ। তিনি সব সময় ভুরু কুঁচকে রাখেন। মনে হয় গভীর কোনো চিন্তার মধ্যে থাকেন। তিনি কারো সঙ্গেই বিশেষ কথাবার্তা বলেন না— তবে আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা বলেন।

জহির ভাইয়ের ঘরের সামনে থেকে ফিরছি, কাদের সাহেব বললেন, বাবলু, কোক ফান্টা এইসব কিছু খাবে?

আমি বললাম, জি-না।

তোমাদের রেজাল্ট কবে হবে?

এখনো জানি না।

আমি শুনলাম তুমিও তোমার বড়ভাইয়ের মতো ভালো ছাত্র, সত্যি না-কি? তুমিও তো ফার্স্ট সেকেন্ড হবে?

এখন তো কেউ আর ফাস্ট সেকেন্ড হয় না। এখন গ্রেডিং হয়।

তা ঠিক, খুবই বাজে সিস্টেম। ফার্স্ট সেকেন্ড হলে ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়। ছবি দেখে অন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কম্পিটিশনের ভাব আসে। ঠিক না?

জি।

ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাবা-মার ছবিও ছাপা হয়। এতে বাবা-মাদের মনে আনন্দ হয়। তাদের আনন্দেরও তো প্রয়োজন আছে। আছে না?

জি।

তোমার বাবার বিষয়ে উড়াউড়া কিছু খবর শুনি। সেটা সত্যি?

জি সত্যি।

ভেরি স্যাড। পিতামাতা হলো সন্তানের আদর্শ। সেই পিতামাতা যদি এরকম করে তাহলে সন্তান আর কী করবে? যাই হোক, মন খারাপ করবে না। পিতামাতা যা ইচ্ছা করুক, তুমি তোমার কাজ করে যাবে। তোমার কাজ পিতামাতাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা। ঠিক বলেছি না?

জি।

আইসক্রিম খাবে? একটা আইসক্রিম আনিয়ে দেই?

জি-না।

আচ্ছা যাও। ফি আমানিল্লাহ। তোমার জহির ভাইয়ের সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন থাকলে পরে আরেকবার এসো।

জি আচ্ছা।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ