দ্বিতীয় আলো পত্রিকায় ‘দি ইমেজ’ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রথম পৃষ্ঠায় লিড নিউজ হয়েছে। সংবাদের শিরোনাম রাজধানীর কেন্দ্রে আবারো নৃশংস খুন। একজন নিজস্ব সংবাদদাতা ঘটনার এমন নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন যা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। হত্যাকারীর সঙ্গে হত্যার মোটিভ নিয়ে কথাবার্তাও হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য থেকে জানা গেল, জহির ভাই বেঁচে আছেন। তাঁর ডান পা এবং ডান হাতে গুলি লেগেছে, তবে ডাক্তাররা তাকে শঙ্কামুক্ত ঘোষণা করেছেন। এবং কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হবে। পুলিশের ধারণা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে দি ইমেজের ম্যানেজার মোহম্মদ নাসিম। হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগেই দি ইমেজের মালিকের সঙ্গে তার বচসা হয় এবং চাকরি চলে যায়। মোহম্মদ নাসিম বর্তমানে পলাতক আছে। পুলিশ তার সন্ধানে আছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই সব রহস্যের সমাধান হবে।

আওয়ামী লীগ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দি ইমেজের মালিক ফারুক এবং তার বন্ধু জহির দুজনই আওয়ামী যুবলীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। ক্ষমতাসীন সরকার ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী কর্মীদের হত্যা করে যাচ্ছে। ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে যাওয়া এই খুনি সরকারের পতনের জন্যে মুক্তিযুদ্ধের সকল স্বপক্ষ শক্তিকে এক হতে আহ্বান জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় কর্মীদের ওপর এই বর্বর আক্রমণের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ আগামী বৃহস্পতিবার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে।

এদিকে বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, এই দুজনই জিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত যুবদলের কর্মী। একজন (মোহম্মদ ফারুক) যুবদল নগর কমিটির ক্রীড়া পরিষদের সদস্য। বিরোধী দল দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির জন্য পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের সমুচিত জবাব দেয়া দেশপ্রেমিক জনতার কর্তব্য। বিএনপি উন্নয়নের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী না।

জহির ভাই আওয়ামী লীগের লোক না-কি বিএনপির লোক আমি জানি না। একটা জিনিস জানি, তাঁকে দেখতে যাওয়া দরকার। ভাইয়ার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেই যেতে হবে। কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে উপস্থিত হতে হবে। তিনি কোথায় আছেন এই তথ্য এখন জানি। পত্রিকায় লিখেছে।

 

জহির ভাই খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমাকে দেখে একপলক তাকিয়ে আবার কাগজ পড়ায় মন দিলেন। তার ডান হাতে ব্যান্ডেজ। একহাতে পত্রিকা ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। ফ্যানের বাতাসে পত্রিকা এলোমেলো হচ্ছে। সামলানো যাচ্ছে না। জহির ভাইকে রাখা হয়েছে কেবিনে। কেবিনের দরজার সামনে একজন বন্দুকধারী পুলিশ। সে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। যার ইচ্ছা জহির ভাইয়ের কেবিনে ঢুকছে, বের হচ্ছে।

আমি খাটের পাশে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, কেমন আছ?

জহির ভাই বললেন, কাগজ পড়ছি দেখছিস না! পড়া শেষ করি, তারপর আলাপ।

আমি কি কাগজটা ধরব? তুমি তো একহাতে কাগজ ধরতে পারছ না?

জহির ভাই জবাব দিলেন না। আমি কেবিনের সাজসজ্জা দেখায় মন দিলাম। ঘরটা বেশ বড়। সঙ্গে এটাচড টয়লেট। টয়লেট থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। হাসপাতালের কেবিনের টয়লেটে পানির কল নষ্ট থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি যে কয়বার হাসপাতালের কেবিনে গিয়েছি, প্রতিবারই এই জিনিস দেখেছি।

খাটের মাথার দিকে সাদা রঙ করা লোহার টেবিল। যেখানে যেখানে রঙ উঠে গেছে সেখানে লোহায় মরিচা পড়ে গেছে। টেবিলে কমলা এবং আঙুর রাখা আছে। বাংলাদেশে ফলের ব্যাপারে বিপ্লব হয়ে গেছে। সারা বছরই কমলা, আঙুর, আপেল পাওয়া যায়। রোগী দেখতে লোকজন কমলাই বেশি নিয়ে যায়। আমি এখন পর্যন্ত কাউকে আম নিয়ে রোগী দেখতে যেতে দেখি নি। রোগীদের জন্যে আম কি নিষিদ্ধ? আমের কথায় মনে পড়ল, বড়খালার জন্যে খিরসাপাতি আম কিনতে হবে। তিনি টাকা দিয়ে দিয়েছেন। খিরসাপাতি আমের কেজি কত টাকা করে কে জানে?

জহির ভাই পত্রিকা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন।

আমি বললাম, হাসপাতালে সিগারেট খেতে দেয়?

জহির ভাই বললেন, দিবে না কেন? হাসপাতাল তো আর মসজিদ না, যে, কোনো নেশা করা যাবে না।

তুমি আছ কেমন?

ভালো। ইচ্ছা করলে আজই রিলিজ নিয়ে চলে যেতে পারি। যাচ্ছি না, ঠিক করেছি কিছু দিন রেস্ট নেব। রেস্ট নেবার জন্যে হাসপাতাল খারাপ না।

খাওয়া কি হাসপাতাল থেকে দেয়?

দেয়। খাওয়া সুবিধার না, আমি হোটেল থেকে খাওয়া আনাই। এখানে ডাক্তারদের একটা ক্যান্টিন আছে, তারা দুপুরে ভালো বিরানি বানায়। দুপুর পর্যন্ত থাক, বিরানি খেয়ে যা।

আচ্ছা। জহির ভাই, তোমাকে কিন্তু সুন্দর লাগছে। কয়েকদিন শেভ না করায় খোঁচা খোঁচা দাড়ি বের হওয়ায় চেহারা বদলে গেছে।

সাধু সাধু চেহারা হয়েছে না?

হুঁ।

চা খাবি?

খাব।

না-কি কফি খাবি? ক্যান্টিনে কফিও পাওয়া যায়। দশ টাকা কাপ।

কফিও খেতে পারি।

জহির ভাই শোয়া থেকে আধশোয়া হলেন। তাঁর হাতে সিগারেট। তিনি খুবই আরাম করে সিগারেট টানছেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সব মানুষের আলাদা কিছু বিশেষত্ব থাকে। তোর বিশেষত্ব কী জানিস?

না।

তোর বিশেষত্ব হচ্ছে, তুই কোনো কিছুতেই না বলতে পারিস না। বিরানি খেতে বললাম, তুই রাজি। চা খেতে বললাম রাজি। কফি খেতে বললাম তাতেও রাজি। তুই কি না বলতে পারিস না?

না।

তুই অনেকক্ষণ হয়েছে আমার কাছে এসেছিস। এখনো একবারও জিজ্ঞেস করিস নি, ঐ রাতে কী ঘটেছিল। এটাও তোর একটা বিশেষত্ব।

তোমার বিশেষত্ব কী?

আমারটা আমি বলব কেন, তুই বলবি। এক্ষুনি বলতে হবে না। চিন্তা ভাবনা করে বের কর, তারপর তোর কাছ থেকে জেনে নেব। টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে মানিব্যাগ বের কর। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট পুলিশ ভাইজানকে দে, তিন কাপ কফি নিয়ে আসবে। সে নিজে এককাপ খাবে। আর পনেরশ টাকা তোর। ধার নিয়েছিলাম, ধার শোধ করলাম। ঐ রাতে মরে গেলে তো ধার শোধ হতো না।

জহির ভাই হাসছেন। একটা মানুষের হাসি এত সুন্দর! এখন কেবিনে শুধু আমরা দুজন। পুলিশ ভাইজান কফি আনতে আগ্রহের সঙ্গেই গিয়েছেন। জহির ভাইয়ের কাছে শুনেছি, সে কোনো বাজার সদাইয়ের কাজ খুব আগ্রহের সঙ্গে করে, শুধু টাকা ফেরত দেয় না। একশ টাকার নোট দিয়ে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট আনতে তাকে পাঠালে সে সিগারেট আনবে। সঙ্গে দুটা দেয়াশলাই আনবে, শুধু বাকি টাকাটা ফেরত দেবে না। এমন ভাব করবে যেন এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এবং দুটা দেয়াশলাইয়ের দাম কাঁটায় কাঁটায় একশ টাকা।

বাবলু!

জি জহির ভাই।

আজকের কাগজে বিনোদন পাতা ছাপা হয়েছে। সেটা পড়েছিস?

না।

নীলার ছবি ছাপা হয়েছে বিনোদন পাতায়।

তাই নাকি?

পরিচালক মুকুল সাহেব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এরকম একটা ছবি। নীলা আছে পরিচালকের পাশে, সে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। পরিচালক সাহেবের কথা গিলছে এমন ভাব। পেপারটা হাতে নিয়ে ছবিটা দেখ।

আমি ছবি দেখলাম। জহির ভাই ভুল বলেন নি। নীলা ফুপু সত্যি সত্যি বিকট হাঁ করে আছে। নীলা ফুপু জহির ভাইয়ের চেয়ে এক দুবছরের ছোট। জহির ভাই তাকে সে জন্যেই নাম ধরে ডাকে। সম্পর্ক হিসেবে জহির ভাইয়েরও উচিত তাকে ফুপু ডাকা। তা সে ডাকবে না। আমার ক্ষীণ সন্দেহ, জহির ভাই নীলা ফুপুকে খুবই পছন্দ করে। যদিও এই পছন্দের ব্যাপারটা সে কখনো বলে নি। একবার ফুপুর অ্যাপেন্ডিস অপারেশন হয়। তাঁকে সারারাত হাসপাতালে থাকতে হলো। জহির ভাইও সারারাত কাটালেন হাসপাতালের বারান্দায়।

জহির ভাই দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, বাবলু শোন, নীলার কি ঐ পরিচালক সাহেবের সাথে খুব ভাব?

মনে হয় ভাব।

তোদের বাসায় আসে মাঝে-মধ্যে?

আমি কখনো আসতে দেখি নি। বোধহয় আসে না।

নীলা যদি চা খাবার দাওয়াত দেয় তাহলে আসবে না? বাসায় আসল, চা কেক চানাচুর খেল। আমি তার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলাম।

তোমার পরিচয় করার দরকার কী?

বিখ্যাত একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালো না?

জহির ভাই হাসছেন। এই হাসি আগের হাসির মতো সুন্দর না। যে মানুষ সুন্দর হাসি হাসে, সে অসুন্দর হাসিও হাসে। কিন্তু সে নিজে কি সেটা জানে?

জহির ভাই, তোমাকে একটা প্রশ্ন করব। উত্তর দিতে চাইলে দেবে। দিতে চাইলে নাই।

কঠিন প্রশ্ন?

না, প্রশ্নটা সোজা, তবে উত্তর বেশ কঠিন।

তুই হেঁয়ালিতে কথা বলা শুরু করেছিস কবে থেকে? প্রশ্ন কর।

দি ইমেজের মালিককে তুমি গুলি করেছ, তাই না?

হ্যাঁ। আর কে করবে? তুই বুঝলি কী করে?

তোমার ডানহাতে গুলি লেগেছে, সেখান থেকে বুঝতে পেরেছি। তুমি লেফট হ্যান্ডার। পিস্তল থাকবে তোমার বাঁ হাতে। নিজেকে যদি গুলি কর তাহলে ডান হাতেই গুলি করবে।

Good logical deduction. ফেলুদার বই আজকাল বেশি বেশি পড়ছিস–কি?

পুলিশ ভাইজান কফি নিয়ে এসেছে। কফির সঙ্গে সে নিজ থেকেই এক প্যাকেট নোনতা বিসকিটও এনেছে। জহির ভাই কফিতে বিসকিট ভিজিয়ে বেশ মজা করে খাচ্ছেন। চায়ে বিসকিট ভিজিয়ে লোকজন খায়। কফিতে বিসকিট ভিজিয়ে কেউ খায় বলে আগে শুনি নি।

জহির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কি ম্যাকবেথ ভাইজানকে চিনিস?

না-তো!

না চিনলেও চলবে। ম্যাকবেথ ভাইজান জীবন সম্পর্কে কী বলেছেন মন দিয়ে শোন।

Life is a tale
Told by an idiot, full of sound and fury,
Signifying nothing.

বুঝেছিস কিছু?

সারকথাটা হলো, জীবন চিল্লাফাল্লা ছাড়া কিছু না। জীবন নিয়ে চিন্তা ভাবনার কিছু নাই। যা তুই এখন বিদেয় হ। আমি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমাব।

দুপুরে বিরানি খাব না?

আরেকদিন এসে খেয়ে যাবি। টেবিলের উপর দেখ, হলুদ রঙের ট্যাবলেট আছে, দে। খেয়ে ঘুম দেই।

ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হবে কেন? ওষুধ না খেয়েই বা ঘুমাতে হবে কেন?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। কেবিন থেকে বের হবার সময় পুলিশ বলল, ছোটভাই, আবার আসবেন।

 

খিরসাপাতি আম মুখ দিয়ে বড়খালা খুব রাগ করলেন। আমার দিকে আগুন আগুন চোখে তাকিয়ে বললেন, এটা খিরসাপাতি?

খিরসাপাতি না?

না মিষ্টি, না টক— এটা কী? তুই খেয়ে আনিস নাই?

না।

অন্যের পয়সা নষ্ট করছিস, এইজন্যে খেয়ে আনিস নাই। অন্যের পয়সা নষ্ট করতে মজা লাগে? যা আম ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে আয়।

এরা ফেরত নিবে না। গরিব মানুষ। এরা রাস্তার পাশে ঝুড়ি নিয়ে বসে। বিক্রি করা আম ফেরত নিলে এদের পোষে না।

তুই ফুটপাত থেকে খিরসাপাতি আম কিনে এনেছিস? এটা ফুটপাতের আম? যা, আম নিয়ে বিদায় হ। ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে আয়। এক্ষুনি যা।

যে আমের অর্ধেকটা তুমি খেয়েছ সেটা তো ফেরত নিবে না।

অবশ্যই ফেরত নিবে। তার বাপ ফেরত নিবে।

খুবই আশ্চর্যের কথা, আমওয়ালা আম ফেরত নিল। আমাকে বলল, কেন ফেরত নিব না? আপনে রইদে ঘামতে ঘামতে আসছেন। চউখ-মুখ লাল হয়ে গেছে— আমি ফেরত নিব না— এটা কেমন কথা! তবে বাবা, এই আম কি? আসল খিরসাপাতি। মধুর চেয়ে মিষ্ট। নেন একটা খান। কোনো দাবি নাই। একটা দুটা যে কটা ইচ্ছা খান।

আমি আম খেলাম। আমওয়ালা কথা ভুল বলে নি। আসলেই মধুর মতো মিষ্টি। বড়খালার কাছে পানশে লাগল কেন কে জানে।

আমার নাম রমজান। বাপে রোজার মাসের নামে নাম রাখছে বইল্যা মিথ্যা বলতে পারি না। মিথ্যা ব্যবসাও করতে পারি না। নামের কারণে ধরা খাইছি। আম মিষ্টি কিনা বলেন?

অবশ্যই মিষ্টি।

আমের মিষ্টি কিন্তু মূল না। চিনিও মিষ্টি। চিনি কি আম? আমের আসল স্বাদ ঘেরানে। একটা আম আছে দিনাজপুর এলাকায় হয়, নাম কদমখাস। খুবই অল্প পরিমাণ হয়। পাওয়া যায় না বললেই হয়। কদমখাস যে একবার খাইছে তার মুখে অন্য আম রুচবে না। হিমসাগর, গোপালভোগ মুখে নিয়া থু কইরা ফেলবে।

কী নাম বললেন?

কদমখাস।

কদমখাস আম খেতে ইচ্ছা করছে।

এক সপ্তাহ পরে খোঁজ নিয়েন। দেখি খাওয়াইতে পারি কিনা। আল্লাহপাকের হুকুম হইলে খাওয়াইতে পারব। হুকুম না হইলে উপায় নাই। এই যে এত ভালো আম আপনে ফেরত আনছেন— আল্লাহপাক হুকুম করেছেন বলে ফেরত আনছেন।

আম ফেরত আনার মতো তুচ্ছ বিষয়েও আল্লাহপাক হুকুম দিবেন?

অবশ্যই। যিনি সব কিছু হিসাবের মধ্যে রাখেন তার কাছে কোনো কিছুই তুচ্ছ না। নেন, এই আমটা খান। দাবি ছাড়া দিতেছি। আপনের সাথে আমিও একটা খাব।

এই আমটার নাম কী?

অনেকে অনেক নামে ডাকে, আসল নাম মধুমুখা।

মধুমুখা?

জি মধুমুখা। এই আমের মুখ মধুর মতো মিষ্টি মুখ থাইকা যতই নিচে নামবেন ততই চোকা হবে। এইটা আরেক মজা।

দুজন দুটা মধুমুখা খেয়ে শেষ করলাম। রমজান মিয়া ঝুড়ি বেছে আরো দুটা আম বের করল, নাম সন্ন্যাসীভোগ।

খান খান, কোনো দাবি নাই। আপনের উছিলায় আমি খাইতেছি। আল্লাহপাক হুকুম করেছেন–আমার এই দুই পিয়ারা বান্দা আষাঢ় মাইস্যা রইদে বইসা আম খাবে। আম খায়া মজা পাবে। এই দুই বান্দার মজা দেইখা আমি খুশি হবো। উনার হুকুমেই আমরার খাইতে হইতেছে। নিজের ইচ্ছায় তো কিছু করার উপায় উনি রাখেন নাই। উনি আজিব একজন।

আমরা মহানন্দে আম খেয়ে যাচ্ছি। আগুনঝরা রোদ উঠেছে। কাক রোদবৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামায় না, আজ তারাও ছায়া খুঁজছে। কয়েকটা কাক কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে ঝিমাচ্ছে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। আকাশ নীল কাচের মতো ঝকঝকে। আকাশের দিকে তাকালে দৃষ্টি ঠিকরে আসে।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, লু হাওয়ার মতো গরম হাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ কোত্থেকে যেন শীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। যতবারই এই হাওয়া লাগছে ততবারই আমি চমকে উঠছি। রমজান মিয়া গামছা দিয়ে মুখে লেগে থাকা আমের রস মুছতে মুছতে বলল, এই যে ঠাণ্ডা হাওয়া হঠাৎ কইরা আহে, এই হাওয়ার নাম লিলুয়া বাতাস। আল্লাহপাক তাঁর রহমতের জানালা মাঝেমধ্যে খোলেন, তখন এই হাওয়া আহে। আইজ আমাদের উপরে আল্লাহর রহমত নাজেল হইছে। সোবাহানাল্লাহ।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ