০৮.

মল্লিকার বাড়ি থেকে ফেরার পথে একেনবাবু ভাবছিলেন অর্থ আর শক্তি কী ভাবে সমাজের বাধা-নিষেধের পাঁচিলগুলো ভেঙে দিচ্ছে! মল্লিকার কথাবার্তায় শিক্ষাদীক্ষার ছাপ। কাচের আলমারিতে কিউরিওগুলোর নীচে বেশ কয়েকটা বইয়ের মধ্যে সঞ্চয়িতা আর গীতবিতান একেনবাবুর নজর এড়ায়নি। এ-রকম একটা মেয়ে রতনের মতো অশিক্ষিত গুন্ডা ক্যারেক্টারের শয্যাসঙ্গিনী ভাবতেও ওঁর খারাপ লাগছিল। এখন তো গুন্ডাদেরই রাজত্ব। দাউদ ইব্রাহিম থেকে শুরু করে পাড়ার বিশু গুন্ডা। এইসব লোকেদের হাতেইপৃথিবী!

আসলে একেনবাবু মুখে যতই বলুন, মানুষ স্যার, মানুষ, উনি ক্লাস সিস্টেমে প্রবল বিশ্বাসী। ভদ্রলোক’ আর ‘ছোটোলোক’ –এই দুইয়ের মেলামেশায় ওঁর প্রচণ্ড সমস্যা হয়। কে ‘ভদ্রলোক আর কে ‘ছোটোলোক’ তার একটা ডেফিনেশনও ওঁর মাথায় আছে, যেটা আবার স্থান-কাল-পাত্রে একটু পালটায়। যেমন, ম্যানহাটানে প্লাম্বারের সঙ্গে কলেজ প্রফেসরের প্রেম বা বিয়ে– একটু খুঁতখুঁত করলেও সেটা চলে। তা বলে দেশে? কলের মিস্ত্রির সঙ্গে শিক্ষিত অধ্যাপিকা ঘর করছে, এটা কি মানা যায়? একেনবাবুর সঙ্গে এ নিয়ে আমার আর প্রমথর প্রায়ই লাগে। তর্কে কোণঠাসা হয়ে একেনবাবু তাঁর শেষ অস্ত্র ছাড়েন, “যাই বলুন স্যার, তেলেজলে মিশ খায় না।”

নাকতলা থেকে বেরিয়ে রাজা সুবোধ মল্লিক রোড ধরতে গিয়ে একেনবাবু দেখলেন অ্যাকসিডেন্টে রাস্তা জ্যাম।

“বাইপাস ধরা যাবে?” ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন একেনবাবু।

ড্রাইভারটি রাস্তাঘাট ভালো চেনে। অন্য একটা সহজ পথ ধরে পাটুলির রাস্তায় নিয়ে এসে বাইপাসে পড়ল। একটু ঘুরপথ হবে, তবে সময় মনে হয় কমই লাগবে।

“আজ দুপুরের মেনু কী?” একেনবউদিকে মোবাইল থেকে ফোন করলেন।

“ডাল, পাঁচমেশালি তরকারি, আলু-পটল দিয়ে মাছের ঝোল, একটা ভাজা। ভাজা কী হবে এখনও ঠিক করিনি। কখন আসছ তুমি?”

“আধঘণ্টার মধ্যেই এসে যাব। কীসের ডাল?”

“ভাজা মুগের।”

“বাড়িতে গন্ধরাজ লেবু আছে?”

“না। খেতে ইচ্ছে করলে নিয়ে এসো।”

“দেখি।”

এই গন্ধরাজ লেবুটা ম্যানহাটানে মেলে না। একেনবাবু অনেক খুঁজেছেন, পাননি। হয়তো আছে, চাইলে তো লোকে বলে বাঘের দুধও নিউ ইয়র্কে পাওয়া যায়।

“একবার গড়িয়াহাট বাজারে একটু থামবেন।” ড্রাইভারকে বললেন একেনবাবু।

“গন্ধরাজ লেবু তো মুকুন্দপুর মার্কেটেই পেয়ে যাবেন, শুধু শুধু পার্কিং-এর পয়সা দেবেন কেন?”

চোখ-কান খোলা ড্রাইভার, তার ওপর একেনবাবুর পয়সা বাঁচাচ্ছে। খুশি হলেন একেনবাবু।

“তাহলে সেখানেই চলুন।”

.

এ দিকটায় বহুবছর একেনবাবু আসেননি। তদন্তের কাজে একবার আসতে হয়েছিল। বাইপাস দিয়ে মুকুন্দপুরে ঢোকার রাস্তাটা তখনও পাকা হয়নি। টিনের চালের নীচে ঘুপচি সাইজের একটা থানা ছিল। সেখানে বসে গাদা গাদা মশার কামড় খেয়েছিলেন এখনও মনে আছে। রাস্তার ধারে যে থানাটা এখন দেখলেন, আগের তুলনায় সেটা প্রাসাদ। মুকুন্দপুরও সে মুকুন্দপুর নেই। লোকসংখ্যা প্রচুর বেড়েছে। ডেভালপমেন্ট হচ্ছে দ্রুত গতিতে। সব কিছু যে খুব প্ল্যান করে হচ্ছে তা নয়। রাস্তার দু-ধারে যেসব দোকান, বেশির ভাগই মনে হয় জবরদখল করা জমি। থানার গা-ঘেঁষেই দরমা দিয়ে ঘেরা কয়েকটা দোকান। সেখানে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ চা খাচ্ছে। সেগুলো পার হতেই একটা বড়ো স্পেশালিটি হাসপাতাল। লবিতে ঢোকার মুখে বিশাল কাচের দরজা। দারুণ মডার্ন আর্কিটেকচার, দেখার মতন বাড়ি! সেটা পার হলে পর পর বেশ কয়েকটা বাড়ি বা গেস্ট হাউস। তারপর আরেকটা বিশাল হাসপাতাল। সেই হাসপাতালের পাশ দিয়ে রাস্তাটা ডানদিকে ঘুরে গেছে। ঘোরার মুখে একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, তার প্রায় পাশ দিয়েই বাজারে ঢোকার গলি। ড্রাইভার অবশ্য বাজারের মুখ পর্যন্ত গেল না। তার আগেই বাঁদিকে যে ছোটো রাস্তাটা গেছে সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একেনবাবুকে বলল, “ওই গলি দিয়ে ঢুকে যান। ঢুকেই ডানদিকে গেলে বাঁ-দিকে সজির দোকান পাবেন।

আলু-পেঁয়াজের একটা দোকানের পর বেশ কয়েকটা সজির দোকান। সজির চেহারাগুলো সত্যি চমৎকার, একেবারে চকচকে ফ্রেশ। নিউ ইয়র্কে চায়না টাউনেও এত ফ্রেশ জিনিস দেখেননি একেনবাবু। গন্ধরাজ লেবুও মিলল। দুটো লেবু কিনে যখন পয়সাদিচ্ছেন, তখন পাশে দাঁড়ানো এক বয়স্ক খরিদ্দার দোকানিকে বললেন, “হ্যাঁরে ভোলা, এই বেগুন-টম্যাটোতে আর কত রঙ লাগাবি?”

“আমরা কোনো রঙ লাগাই না, কাকু।” ভোলা প্রতিবাদ করল।

“তুই লাগিয়েছিস তো বলছি না। যার কাছ থেকে কিনেছিস, সে লাগিয়েছে।”

ভোলা কোনো উচ্চবাচ্চ্য করল না।

ভদ্রলোক একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে অযাচিত ভাবেই বললেন, “বুঝলেন, সব ভেজাল। এইসব টক্সিক রং-টং লাগানোর কী দরকার? মেট্রো-তে যান, ওখানে এসব পাবেন না। টম্যাটো দেখলে ম্যাড়ম্যাড়ে লাগবে, কিন্তু খাঁটি জিনিস। জার্মান মাল্টি ন্যাশেনাল, ওরা এইসব রিস্ক নেয় না।”

‘মেট্রো’ কী একেনবাবুর কোনো ধারণাই নেই। অন্য সময় হলে একেনবাবু জ্ঞানটা বাড়িয়ে নিতেন, আজকে দাঁড়ালেন না। বাইপাসে ঢুকে গড়িয়াহাট কানেক্টারের দিকে একটু এগোতেই ডানদিকে একটা দোকানের সামনে হলুদ শালুতে লেখা, এই মাসে সব কিছু ২৫% ছাড়–৩ টাকায় ৪ টাকার জিনিস কিনুন। পাছে ২৫% কেউ যদি না বোঝে– তাই সেটা ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছে। দোকানটা এক তলা কিন্তু বিশাল। ওপরে লেখা ‘মেট্রো’– একদিকে ইংরেজিতে, অন্যদিকে বাংলায়। মেট্রো! এটাই কি সেই জায়গা?

ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে বলল, “সুপার স্টোর, সবকিছু পাওয়া যায়। তবে সবাইকে ঢুকতে দেয় না।”

“কেন?”

“তা ঠিক জানি না, কীসব আইন আছে।”

ড্রাইভারটি তার বেশি কিছু জানে না। একেনবাবুর মনে হল নিশ্চয় আমেরিকার ‘বিজে-স’ বা কস্টকো’-র মতন কোনো দোকান, মেম্বারশিপ থাকলে সস্তায় জিনিস কেনাযায়।

.

কলকাতায় আসার একটা বড়ো আকর্ষণ হল খাওয়াদাওয়া। দই-মিষ্টির কথা বাদই দেওয়া যাক। এখানকার তরিতরকারি বা মাছের যা স্বাদ, তার সঙ্গে আমেরিকার শাকসজি বা মাছের তুলনা হয় না। তবে হ্যাঁ, মুরগি আর গোট মিট, মানে পাঁঠার মাংসের ব্যাপারে আমেরিকা কিন্তু টপে। খান মার্কেট থেকে কেনা গোট মিটের কোয়ালিটি এখন পর্যন্তকলকাতায় কোথাও দেখেননি। কলকাতায় যেদিন এলেন সেদিন বিকেলে মাসতুতো শালি দোলা-র বাড়িতে খেতে গিয়েছিলেন। ভায়রা একেনবাবুকে ইম্প্রেস করার জন্যে টেরিটি বাজারের কোন এক চাচাজির দোকান থেকে পাঁঠার মাংস এনেছিলেন। নো কম্পারিজন। মুরগির প্রসঙ্গ না তোলাই ভালো। আমেরিকায় মুরগির রোস্ট, ফ্রাই ইত্যাদি খাবার পর কলকাতার চিকেন মুখেই তোলা যায় না। এসব অবশ্য একেনবাবুর পার্সোনাল মত। কিন্তু তাতে একেনবউদির সুবিধা। তিনি নিজে মাংস পছন্দ করেন না। বাড়িতে শুধু মাছই হচ্ছে।

দুপুরের খাওয়াটা দিব্বি হল। আজকে দুপুরে আর বিশ্রাম নয়। একেনবাবুর আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। প্রথমে বিকাশ সেনের প্রাইভেট সেক্রেটারি নীলাঞ্জনা মিত্রের সঙ্গে। রাখাল দত্ত নীলাঞ্জনাকে জানিয়েও রেখেছেন একেনবাবু যাবেন বলে। তারপর সময় থাকলে মনীষা সেনের সঙ্গে আরেকবার কথা বলতে হবে।

রাখাল দত্তকে ফোন করে বিকাশ সেনের অফিসের ঠিকানাটা নিয়ে নিলেন একেনবাবু। শেখর চৌধুরীকে কবে কথা বলার জন্য পাওয়া যেতে পারে, সেই খোঁজটাও নিতে বললেন। ইতিমধ্যে ড্রাইভার লাঞ্চ খেয়ে চলে এসেছে।

.

বিকাশ সেনের অফিসটা পূর্ণদাস রোডে, একটা মাল্টি-স্টোরি বিল্ডিং-এর এক তলায় কয়েকটা ঘর নিয়ে পাবলিক রিলেশন্স-এর ফার্ম। কিছুদিন আগেও এ ধরনের ফার্মের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। পাবলিক রিলেশন্স ব্যাপারটা ঠিক কী, একেনবাবুর এখনও স্পষ্ট ধারণা নেই। কোম্পানিগুলোর জনসংযোগ করার কাজ তো অ্যাড এজেন্সির। মক্কেলদের প্রডাক্টগুলোর জন্য বিজ্ঞাপন বানিয়ে তারা পত্র-পত্রিকায় ছাপায়। এক কালে তো এটা কিনুন, ওটা কিনুন বলে রাস্তার থামে থামে পোস্টারও সেঁটে দিত, এখন হোর্ডিং বানায়। পুরো ব্যাপারটাই নাকি আর্টের পর্যায় চলে গেছে, যাকে বলে ক্রিয়েটিভ আর্ট। এক-একটা অ্যাড ক্যাম্পেনের পিছনে নাকি অনেক গবেষণা থাকে! কী এত গবেষণা কে জানে!

একেনবাবুর দূর সম্পর্কের এক ভাগ্নে অ্যাড এজেন্সিতে কাজ করত। দিদির সর্বদা অভিযোগ ছেলে নাকি রাত তিনটের আগে বাড়ি ফেরে না! জামাইবাবু বাইরে পোস্টেড, কলকাতায় কী হচ্ছে কিছুই খোঁজ রাখেন না। একেনবাবু তখন কলকাতা পুলিশে। কী একটা কাজে গড়িয়াহাটে গিয়েছিলেন। কাছেই ভাগ্নের অ্যাড এজেন্সির অফিস, ভাবলেনএকবার ‘হ্যালো’ বলে যাবেন। তিনটে বাজে, অফিসে প্রায় কেউই নেই। কাছেই এক কফিহাউসে ভাগ্নের সাক্ষাৎ পেলেন। কয়েকজন মিলে সিগারেট ফুঁকছে, আর কফি খাচ্ছে। একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কীরে, তুই এখানে! তোদের অফিস টাইম কখন?”

“টাইম একটা আছে, কিন্তু সেই টাইমে কাজ হয় না।”

“তার মানে?”

“আমরা ক্রিয়েটিভ কাজ করি মামা, রাত ন’ টা-দশটার আগে ক্রিয়েটিভ জুস-ই ফ্লো করে না।”

ভেরি ইন্টারেস্টিং! ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ এযুগে জন্মাননি! তখন মেন্টালিটি বোধহয় অন্য রকম ছিল, নইলে এত লিখতেন কী করে? শান্তিনিকেতনে তো তখন ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না, হ্যারিকেনের আলো। ন’টা-দশটার আগেই নিশ্চয় শুয়ে পড়তেন। এই ভাগ্নেটির ক্রিয়েটিভ কাজ অবশ্য একেনবাবু দেখেননি। তার আগেই জামাইবাবু ছোঁড়াকে নিজের কোম্পানিতে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন। এখন টাকা-পয়সার হিসেব কষে।

যাক সে কথা। পাবলিক রিলেশন্সের কাজটা ঠিক কী, বিকাশ সেনের অফিসে ঢুকে জানা গেল। লবিতে বড়ো বড়ো পোস্টারে পরিষ্কার করে লেখা –রেপুটেশন ম্যানেজমেন্ট, কর্পোরেট কম্যুনিকেশন, মিডিয়া রিলেশন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলোর ইংরেজি ব্যাখ্যাও রয়েছে, একেনবাবুর মাথায় সবগুলো ঢুকল না। যাদের বোঝার দরকার তারা নিশ্চয় বোঝে। ঝাঁ চকচকে অফিস তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

রিসেপশনিস্টকে নিজের পরিচয় দিয়ে নীলাঞ্জনা মিত্রের খোঁজ করতেই ভিতরের কোনো একটা ঘর থেকে নীলাঞ্জনা বেরিয়ে এলেন। ফ্যাশানেবল সালোয়ার কামিজ পরা লম্বা একটি মেয়ে, চোখটা কটা ঠিক বাঙালি বাঙালি চেহারা নয়। একেনবাবুকে নিয়ে রিসেপশানিস্টের ডেস্ক থেকে একটু দূরে লবির একটা কোণে দাঁড়ালেন। নীলাঞ্জনার হাবভাবে একেনবাবু বুঝলেন বিকাশবাবু সম্পর্কে কিছু বলার ইচ্ছে তাঁর নেই। ইংরেজিতে বললেন, “অফিসের কনফারেন্স রুমে ক্লায়েন্ট আছে, বিকাশ সেনের পুরোনো অফিস ঘরেও একটা মিটিং চলছে, সুতরাং প্রাইভেটলি কথা বলার কোনো জায়গা নেই।”

একেনবাবু বললেন, “ঠিক আছে ম্যাডাম, কখন মিটিং শেষ হবে বলুন, আমি তখন আসব।”

“কখন মিটিং শেষ হবে বলা শক্ত।” আবার ইংরেজিতেই বললেন নীলাঞ্জনা।

“কালকে আপনার সময় হবে?”

“দেখুন, আমি সব সময়েই ব্যস্ত। আর এ ব্যাপারে আমার কিছু বলারও নেই।”

একেনবাবু তখন অন্য পথ ধরলেন। বললেন, “ম্যাডাম, আপনি যদি কিছু না বলতে চান, বলবেন না। তবে তদন্তটা খুনের। আপনার নাম কিন্তু জড়াবে, আপনি চান বা না চান।”

এই কথায় নীলাঞ্জনার বোধহয় টনক নড়ল। এবার বাংলায় বললেন, “আমার সংসারে অনেক সমস্যা হয়েছে, সেটাকে আর বাড়াতে চাই না।”

“নিশ্চয় ম্যাডাম,” একেনবাবু নীলাঞ্জনাকে আশ্বস্ত করলেন। “সত্যি কথা বলতে কী, আপনার সঙ্গে বিকাশবাবুর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কী ছিল, সে নিয়ে আমার চিন্তা নেই।”

“তাহলে?”

“যেটা আমি বোঝার চেষ্টা করছি ম্যাডাম, বিকাশবাবুর খুন হওয়ার সঙ্গে সেই সম্পর্কটা জড়িত কিনা।”

একেনবাবুর এই কথাগুলো নীলাঞ্জনা পছন্দ হল না। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “আপনি কী ইমপ্লাই করছেন?”

“কিছুই না ম্যাডাম, শুধু বোঝার চেষ্টা করছি।”

এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “এখানে আমি কোনো কথা বলতে পারব না।”

“বেশ ম্যাডাম, তাহলে কোথায় বলতে পারবেন বলুন। আপনার বাড়িতে আসতে

“না না বাড়িতে নয়।” আপত্তি জানাল নীলাঞ্জনা।

একেনবাবু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

 “ঠিক আছে, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি অফিসে বলে আসছি।”

খানিক বাদে একটা চাবি হাতে ফিরে এসে নীলাঞ্জনা বললেন, “দোতালায় আমাদের স্টোর রুম আছে, সেখানে কিছুক্ষণ বসতে পারি।”

ঘুপচি স্টোর রুম। ফাইলপত্র, কাগজ আর পোস্টারে ঠাসা। তারই মাঝখানে একটা টেবিল আর গুটিকতক চেয়ার।

“বসুন,” বলে একটা চেয়ার টেনে নীলাঞ্জনাও বসলেন।

“কী জানতে চান বলুন?”

“বিকাশবাবুর সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গতা হয়েছিল ম্যাডাম?”

“উনি আমার বস ও বন্ধু দুই-ই ছিলেন। অন্তরঙ্গ কথাটা ব্যবহার করতে চাই না।”

“আপনি কিন্তু বললেন ম্যাডাম, আপনার সংসারে এ নিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে…।”

একেনবাবুকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না নীলঞ্জনা। “হ্যাঁ, হয়েছে। তার কারণ আমার স্বামী একটু সন্দেহপ্রবণ। মাঝে মাঝে কাজের সূত্রে আমার বাড়ি যেতে দেরি হত বা ডিনার খেয়ে বাড়ি ফিরতাম, ওর তাতে অসুবিধা হত।”

“আই সি। একটা প্রশ্ন করি ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না, বিকাশবাবু কি আপনার বন্ধুত্বের সুযোগ নেবার চেষ্টা করেছিলেন, আই মিন…।”

আবার একেনবাবুকে থামিয়ে দিলেন নীলাঞ্জনা। “একবারই চেষ্টা করেছিল, বাট আই নিপড ইট ইন দ্য বাড। আফটার দ্যাট হি নেভার ট্রায়েড।”

“আপনার স্বামী কি সেটা জানতেন?”

“না, এটা গল্প করার কোনো ব্যাপার নয়।”

“আর কারোর কাছে কি উনি শুনে থাকতে পারেন?”

“কার কাছ থেকে শুনবে! আর শোনার মতো তো কিছু ঘটেনি! কিছু যদি ও শুনতে পেত আমায় বলত।”

“দাঁড়ান ম্যাডাম, আমার একটু গুলিয়ে যাচ্ছে। এই ‘নিপড ইন দ্য বাড’ কথাটা বললেন, এটা কতদিন আগেকার ঘটনা?”

“আমার মনে নেই।” একটু বিরক্তিভরে নীলাঞ্জনা উত্তরটা দিলেন।

“আই সি,” মাথা চুলকোলেন একেনবাবু। “কিন্তু তারপর থেকে ম্যাডাম আপনি সময় মতোই বাড়ি ফিরছেন, তাই তো?”

“না, তা ঠিক না। আপনি ঠিক কী জানতে চাইছেন বলুন তো?”

“আসলে ম্যাডাম, আমি বোঝার চেষ্টা করছি। আপনার স্বামীর সন্দেহটা গেল কী ভাবে! আপনি তো সেই দেরি করেই বাড়ি ফিরছেন, বাইরে ডিনারও খাচ্ছেন!”

“তার কারণ আমি ওকে বলেছি, ও যা মাইনে পায় তা দিয়ে সংসার চলবে না। আই নিড দিস জব আমাদের দুজনের জন্যেই। আর এটা একটা ডেস্ক জব নয়। এই চাকরিতে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে ডিনার খেতে হবে, কাজের চাপ বেশি পড়লে রাত্রি পর্যন্ত কাজও করতে হবে। হি উইল হ্যাভ টু ট্রাস্ট মি।”

“বুঝেছি ম্যাডাম, উনি সেটা মেনে নিয়েছেন।”

“মেনে নেওয়া মানে আমার চাকরির সমস্যাটা অন্তত বুঝেছেন।”

“বিকাশবাবুর বিরুদ্ধে তো সেক্সয়াল হ্যারাসমেন্টের চার্জও আছে?”

“তা আছে, কিন্তু সেটা আমার তরফ থেকে নয়।” তারপর একটু চুপ করে বললেন, “লোকটা মরে গেছে, অনেক কিছুই এখন অবান্তর। ও যে নিষ্পাপ শুদ্ধ চরিত্রের লোক কখনোই আমি বলব না, তবে মনে রাখবেন এক হাতে তালি বাজে না। তালে তাল না দিয়েও যে লোককে ম্যানেজ করা যায় তার প্রমাণ আমি।”

 “তা তো বটেই ম্যাডাম। ভালো কথা, যেদিন বিকাশবাবু মারা যান, সেদিন কি আপনি ওঁর সঙ্গে ডিনার মিটিং-এ গিয়েছিলেন?”

“না।”

“ওঁর নাকি অফিশিয়াল ডিনার ছিল সেদিন?”

“থাকতে পারে। ওর সব অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা আমি জানতাম না।”

“কিন্তু ম্যাডাম, আপনি তো ওর প্রাইভেট সেক্রেটারি!”

“তা বলেই আমি সব কথা জানব সেটা কেন ভাবছেন? হয়তো ওটা একটা কনফিডেনশিয়াল মিটিং, ইচ্ছে করেই আমাকে জানায়নি।”

“আই সি।” আবার মাথা চুলকোলেন একেনবাবু।

“আর কী জানতে চান?”

“ও হ্যাঁ, বিকাশবাবুর সঙ্গে কারো কোনো গণ্ডগোল চলছিল টাকা-পয়সা বা অন্য কোনো ব্যাপারে?”

“তেমন তো কিছু শুনিনি। আর কিছু?” নীলাঞ্জনা মনে হল এবার অধৈর্য হয়ে পড়েছেন।

“এক্ষুনি আর কিছু নয়, ম্যাডাম। শুধু একটা কথা, পয়লা এপ্রিল বা জানুয়ারির চার তারিখে এমন কি কিছু ঘটেছিল যার সঙ্গে বিকাশবাবু জড়িত?”

নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে তাকালেন। একটু ভেবে বললেন, “না, তেমন তো কিছু মনে পড়ছে না।”

“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইয়োর টাইম।”

নীলাঞ্জনার কাছ থেকে ফেরার পথে ওঁর একটা কথা একেনবাবুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল– ‘এক হাতে তালি বাজে না। তালে তাল না দিয়েও ম্যানেজ করা যায়। নীলাঞ্জনার দাবি বিকাশ সেন মেড অ্যাডভন্সেস, নীলাঞ্জনা স্টপড দ্যাট। সত্যিই কি তাই? বাধা পেয়েই কি বিকাশ সেন সুবোধ বালক হয়ে গিয়েছিলেন না সেই সম্পর্ক তলে তলে চলছিল সতর্কভাবে? স্বামী আর বিকাশ সেন– দু-জনকেই ম্যানেজ করে তিনি চালাচ্ছিলেন। একটা জিনিস পরিষ্কার, সোজাসুজি অকপট ভাবে স্বামীর সঙ্গে বিকাশবাবুকে নিয়ে ওঁর আলোচনা হয়নি। হয়ে থাকলে নিজের বাড়িতে একেনবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে এত আপত্তি হত না। দ্যাট মেকস সেন্স, কিন্তু তাতে ধাঁধার উত্তর মিলছে না। জেলাস হাসব্যান্ড হিতাহিত শূন্য হয়ে স্ত্রীর প্রেমিককে খুন করতে পারে, কিন্তু সেই বডি টেনে নিয়ে সোনাগাছিতে ফেলে আসা অবিশ্বাস্য! সেটা করতে পারে একমাত্র কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার। নীলাঞ্জনার স্বামী যদি সে-রকম চরিত্রের হতেন তাহলে এ ব্যাপার নিয়ে শুধু অশান্তি করে এতদিন কাটিয়ে দিতেন না। নীলাঞ্জনাও অক্ষত থাকতেন না।

এখন পর্যন্ত একেনবাবু স্কুলেস। শুধু নীলাঞ্জনা নয়, মল্লিকার কাছ থেকেও তেমন কোনো তথ্য উদ্ধার হয়নি যার থেকে খুনের মোটিভটা আঁচ করা যায়। মল্লিকার প্রেগন্যান্ট হবার ব্যাপারটাই ধরা যাক। ঠিক আছে, বিকাশ সেন না হয় তার দায়িত্ব এড়াচ্ছিলেন, তাহলেও মলয় বা আর কাউকে দিয়ে এভাবে খুন করে লাভটা কী? গাত্রদাহ মেটানো? নাঃ, তাতে অঙ্কটা ঠিক মেলে না। সন্তান বড় করার জন্যে মল্লিকার প্রয়োজন অর্থের। এতে কোনো অর্থপ্রাপ্তি নেই। বিকাশবাবুকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা মল্লিকা হয়তো করেছিল বন্ধু মলয়কে দিয়ে, এই পর্যন্তই। মাথাফাটা রতনের দিক থেকেও বিকাশবাবুকে মারার কোনো কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। হ্যাঁ, একজনই শুধু আর্থিক দিক থেকে লাভবান হয়েছেন তিনি হলেন বিকাশ সেনের স্ত্রী মনীষা। আড়াই কোটি টাকা আজকের যুগে এমন কিছু বড়ো অঙ্ক নয়। বিকাশবাবু খতম হলে প্রেমিককে পাওয়া যাবে সেটা নিশ্চয় আর একটা ইনসেন্টিভ। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই তো দিব্বি পরকীয়া চালাচ্ছিলেন, অসুবিধাটা কোথায়? যদি বিকাশবাবুকে ছেড়ে প্রেমিকের ঘর করতে চাইতেন, তাহলে তো আইনের পথেও এগোতে পারতেন! তবে জানা নেই মনীষা সেন ডিভোর্স চেয়েছিলেন কি না, আর বিকাশবাবুর তাতে আপত্তি ছিল কিনা। সেক্ষেত্রেও সোনাগাছির ব্যাপারটা মিলছে না। নাঃ, একেনবাবু সত্যিই কনফিউসড।

[আমি প্রতিদিনই যতটুকু লিখি রাত্রে খাবার সময় প্রমথকে শোনাই। প্রমথ শোনে, তবেভাব দেখায় আমি যেন ওর সময় নষ্ট করছি!

একদিন রাগ করে বললাম, “শুনতে চাস, না চাস না?”

“চাই না, তবু শুনব একেনবাবুর কথা ভেবে। তুই যাতে ওঁকে না ডোবাস সেটা তো কাউকে দেখতে হবে।”

এতদিন পর্যন্ত নিজের থেকে কোনো মন্তব্যই প্রমথ করেনি। আজকে হঠাৎ বলল, “এই যে তুই লিখেছিস, একেনবাবু ব্লুলেস, কী করে জানলি? একেনবাবু তোকে বলেছেন?”

“ওটা পোয়েটিক লাইসেন্স, একেনবাবু ঠিক কী ভাবছেন, সেটা কী করে জানব?”

“তোর পোয়েটিক লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া উচিত। হ্যাঁ, তুই এগুলো ভাবতে পারিস, কারণ তোর মাথায় আর যাই থাক গ্রে ম্যাটারের অভাব আছে। কোনো ইন্ট্যালিজেন্ট লোক এভাবে জিনিসটাকে অ্যানালাইজ করবে না।”

“চুপ কর! এ অবস্থায় তুই কী ভাবতিস?”

“নাম্বার ওয়ান, তুই লিখেছিস… নীলাঞ্জনার স্বামী যদি সে-রকম চরিত্রের লোক হতেন’… কী করে একেনবাবু জানলেন নীলাঞ্জনার স্বামীর চরিত্র? একেনবাবুকে যদ্দুর জানি, ভালো করে যাচাই না করে কারোর সম্পর্কে কোনো ধারণা উনি করেন না। নীলাঞ্জনার সঙ্গে কথা বলেই স্বামীর চরিত্র উনি বুঝে গেলেন? আরও লিখেছিস নীলাঞ্জনাও অক্ষত থাকতেন না”। কী আশা করেছিলি তুই, নীলাঞ্জনার সারা গায়ে কালশিটে থাকবে, না ছুরির কাটা দাগ? নাম্বার টু, তোর মনে হয়েছে বিকাশ মারা গেলে মল্লিকার অর্থ-প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই, আর সেটা তুই একেনবাবুর নামে চালিয়েছিস। কেন নেই? ডি-এন-এ অ্যানালিসিস করিয়ে ছেলের পিতৃত্ব প্রমাণ করিয়ে তার জন্যে ও ভরণপোষণ দাবি করতে পারত! বিকাশ বেঁচে থাকলে বরং সেটা করানো সহজ হত না। নাম্বার থ্রি, মনীষার মতো মহিলার ক্ষেত্রেও আড়াই কোটি টাকা তুচ্ছ করার মতো ব্যাপার নয়। আর আড়াই কোটি তো শুধু ইন্সিওরেন্সের টাকা। এ ছাড়াও বাড়ি ও অন্যান্য অ্যাসেট নিশ্চয় আছে। এই টাকা প্লাস যদি প্রেমিককে পাওয়া যায়, তাহলে মন্দ কি? ডিভোর্স করে বিকাশকে ছেড়ে প্রেমিককে বিয়ে করা মানে এর অনেকটাই হারাতে হবে!”

প্রমথর যুক্তি অস্বীকার যায় না। তবে হার মানতে আমি রাজি নই। জিজ্ঞেস করলাম, “হোয়াট অ্যাবাউট সোনাগাছি?”

“দোজ আর ডিটেলস,” বলে প্রমথ শুতে চলে গেল!]

.

০৯.

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একেনবাবু চায়ে একটা চুমুক দিতে যাচ্ছেন, মোবাইল বেজে উঠল। রাখাল দত্ত।

“স্যার, আপনি এখন কোথায়?”

“বাড়িতে।”

“একটু ওয়াটগঞ্জ এরিয়াতে আসতে পারবেন?”

“এখন?”

“হ্যাঁ স্যার, আরেকটা মার্ডার!”

“আমার গাড়ি তো দশটার সময় আসবে।”

“আপনি স্যার, একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসুন। বডিটা সরানোর আগে আপনাকে দেখাতে চাই।”

“ঠিক আছে ভাই, আসছি।”

“সোজা ওয়াটগঞ্জ থানায় আসুন স্যার, আমি অপেক্ষা করছি।”

থানায় পৌঁছোতেই রাখাল দত্ত বললেন, “আমি স্যার, ডিসি সাহেবের পারমিশন নিয়ে নিয়েছি আপনার সঙ্গে কনসাল্ট করবার জন্যে। আপনি এখন সেমি-অফিশিয়ালি এই তদন্তে আছেন, মানে কাগজপত্রে কিছু সই থাকছে না, কিন্তু লুকোচুরি করে কিছু করতে হবে না।”

“বাঃ, এটা তো গুড নিউজ। এবার বলো কী ব্যাপার?”

“গাড়িতে উঠুন স্যার, বলছি।”

পুলিশের জিপটা সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভার একেনবাবুর পরিচিত। লম্বা একটা সেলাম ঠুকল। একেনবাবু আর রাখাল দত্ত পিছনে বসলেন। ড্রাইভারের পাশে বসলেনওয়াটগঞ্জ থানার এক সাব-ইনস্পেক্টর। রাখাল দত্ত বললেন, “মনে হচ্ছে বিকাশ সেনের আইডেন্টিক্যাল কেস। ২২ ক্যালিবারের হ্যান্ডগান দিয়ে মাথায় গুলি করে খুন করা হয়েছে। ডেডবডি পাওয়া গেছে ওয়াটগঞ্জের লালবাতি এলাকায়। হয়তো সোনাগাছিতেই বডিটা ফেলে আসার প্ল্যান ছিল, কিন্তু গত আট দিন হল সোনাগাছিতে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ টহল চলছে।”

“ইন্টারেস্টিং। কিন্তু সোনাগাছিতে বডি ফেলে আসবে ভাবছিলে কেন?”

“বলছি। তার আগে বলি, যিনি খুন হয়েছেন তার নাম তন্ময় দত্ত। খুনটা কোথায় করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। তবে ঘড়ি, মোবাইল, পয়সাকড়ি সবকিছুই হাওয়া। খুনি বা খুনিরা, অথবা অন্য কেউ পরে ওগুলো সরিয়েছে। ভাগ্যক্রমে প্যান্টের একটা গুপ্ত পকেটে রাখা ক্রেডিট কার্ড, লাইব্রেরি কার্ড আর ড্রাইভার্স লাইসেন্স সবার চোখ এড়িয়ে গেছে। যাইহোক, খোঁজখবর করে এখনও পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে, সেটা হল ভদ্রলোক একজন এন.আর.আই। নিউ ইয়র্কের কোনো একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। যাদবপুরের ফার্মাসি ডিপার্টমেন্টে ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে মাস ছয়েক আগে এসেছিলেন।”

“এর মধ্যেই এতগুলো খবর জেনে ফেললে? যাই বলল ভাই, অ্যামেজিং!”

“তা নয় স্যার। ওয়াটগঞ্জ থানার ওসি-র সঙ্গে যাদবপুরের এক মাস্টারমশাইয়ের খুবই চেনাজানা। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি কার্ড দেখে ওসি সেই মাস্টারমশাইকে ফোন করেন। লাকিলি সেই মাস্টারমশাই তন্ময় দত্তকে চিনতেন। তাঁর কাছ থেকেই খবরগুলো পাওয়া গেছে।”

“তিনি কি বডি আইডেন্টিফাই করেছেন?”

“না, এখনও করেননি। কেন, আপনি কি ভাবছেন তন্ময় দত্তের আইডেন্টিটি কেউ ডেডবডির পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে?”

“সবই সম্ভব। তন্ময়বাবু ম্যারেড না সিঙ্গল?”

“বোধহয় ম্যারেড, কিন্তু মাস্টারমশাই সে ব্যাপারে শিওর নন। কোথায় কার সঙ্গে থাকতেন তার খোঁজ চলছে। যেটা মোস্ট ইন্টারেস্টিং, সেটা হল বুকপকেটে একটা কাগজ পাওয়া গেছে তাতে লেখা ‘your number 1/2’।”

“1/2? বিকাশ সেনের পকেটে তো 1/4 পাওয়া গিয়েছিল!”

“এক্সাক্টলি। সেই একই ভাবে কাগজ থেকে কেটে সংখ্যাগুলো আঠা দিয়ে সাঁটা হয়েছে। ছাপা অক্ষরগুলো দেখতে একই রকম, তবে কাগজের কোয়ালিটি মনে হয় আলাদা।”

 “কোন কাগজের কোয়ালিটি? যে কাগজের টুকরো আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে, না যার ওপর লাগানো হয়েছে?”

“যেগুলো লাগানো হয়েছে। আগের কাগজের কোয়ালিটি ভালো ছিল। এটা কাটা হয়েছে সাধারণ কোনো কাগজ থেকে, সম্ভবত জেরক্স করা কাগজ।”

“ইন্টারেস্টিং। ধরে নিচ্ছি এই কাগজেও কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওনি।”

“না, পাওয়া যায়নি। গুলিটা ব্যালিস্টিক টেস্টের জন্যে পাঠানো হয়েছে, বিকাশ সেন আর তন্ময় দত্তকে একই হ্যান্ডগান দিয়ে খুন করা হয়েছে কিনা জানতে।”

“আই সি, তা তুমি এখন কী ভাবছ?”।

“ভাবছিলাম কপিক্যাট মার্ডার হতে পারে কিনা, সেইজন্যেই বলছিলাম সোনাগাছির কথা৷৷”

“কপিক্যাট মার্ডার ভাবছ কেন? কাগজ থেকে কেটে আঠা দিয়ে সংখ্যা আটকানোর ব্যাপারটা তো বাইরের লোকদের জানার কথা নয়, ভিতরের লোক হলে অবশ্য অন্য কথা। যাইহোক, ব্যালিস্টিক টেস্টের রেজাল্ট পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এখন বলো, টাইম অফ ডেথ কখন?”

“রাত্রে কোনো একটা সময়,” এবার সামনে বসা সাব-ইনস্পেক্টরটি উত্তর দিলেন। “ভোর পাঁচটা নাগাদ বডিটা দেখতে পেয়ে লোকাল চায়ের দোকানের একটা ছেলে আমাদের ফোন করে। এসে দেখি রাইগার শুরু হয়ে গেছে, তারমানে অন্তত ঘণ্টা তিন চার আগে মারা গেছে।”

“ছেলেটা ওখানে কী করছিল?”

“সকালে ওই সময়ে এসে নোংরা কাপ-ডিশগুলো পোয়, একটু ঝাঁট-ফাট দেয়। মালিক আসে ছ’টা নাগাদ।”

এইসব কথাবার্তার মধ্যেই ওঁরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছোলেন। রাখাল দত্তের সঙ্গে একেনবাবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন লাশটাকে। দামি ড্রেস শার্ট আর প্যান্ট পরা বছর পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে একজন লোকের দেহ রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে নোংরা একটা গলিতেনর্দমার পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মাথার পিছনে চাপ চাপ রক্ত জমাট বাঁধা, সেখানে মাছি ভনভন করছে। এক পায়ে জুতো নেই। জুতোটা একটু দূরে রাস্তার ধারে পড়ে আছে। কাছেই রক্তের কালো কালো দাগ। বড়ো রাস্তা থেকে ডেডবডিকে টেনে এনে নর্দমার পাশে ফেলা হয়েছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আশেপাশের লোকদের ইতিমধ্যেই পুলিশ অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, অস্বাভাবিক কিছুই পাওয়া যায়নি। চায়ের দোকানের মালিকের ছোটো ভাই দোকানেই ঘুমোয়। গভীর রাত্রে সে নাকি একটা গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল, লোকের পায়ের আওয়াজও। কিন্তু এ-রকম আগেও দু-একবার শুনেছে, তাই উঠে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। কখন গাড়ির আওয়াজ শুনেছে অবশ্য বলতে পারেনি, তবে সে ঘুমাতে গেছে রাত এগারোটা নাগাদ। অতএব, গাড়িটা তার পরে এসেছিল।

বডিটা যে তন্ময় দত্তের সেটা পুলিশ সেই দিন দুপুরেই নিশ্চিত হল। ওয়াটগঞ্জের ওসি-র পরিচিত সেই অধ্যাপক মর্গে এসে দেহটা শনাক্ত করে গেলেন। তন্ময় দত্তের মোবাইল নম্বর অধ্যাপক জানতেন। মোবাইল কোম্পানির রেকর্ড দেখে জানা গেল ওটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ টলি ক্লাবের কাছাকাছি কোনো জায়গায়। তারপর থেকে সেটা আর চালু করা হয়নি। টলি ক্লাবের কাছাকাছি কোথাও খুন করা হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে মনে হয় একাধিক দুস্কৃতি এর সঙ্গে জড়িত। নালার ধারে যেখানে বডি ফেলা হয়েছে, সেখানে কাদায় কয়েকটা জুতোর ছাপ। তবে ভিড় করে আসা জনতার পায়ের চাপে সেগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তার মধ্য থেকেই অন্তত দুটো আলাদা জুতোর ছাপ পুলিশ উদ্ধার করেছে। ছাপগুলো গভীর। এখন পর্যন্ত পুলিশের যা থিওরি– সেটা হল বডিটা সম্ভবত দু-জন দুষ্কৃতি মিলে চ্যাংদোলা করে নিয়ে নালার ধারে ফেলেছে। বডির এক্সট্রা ভারে তাদের জুতো কাদার মধ্যে বেশি ডেবে গেছে। দলে হয়তো আরও একজন ছিল, গাড়ির চালক। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না, কেন বডিটা টেনে নিয়ে অত দূরে ফেলার অকারণ রিস্কটা ওরা নিল! গাড়ি থেকে নেমে অন্তত কুড়ি-পঁচিশ গজ দূরে যেতে হয়েছে। রাস্তায় ফেলে দিলেই তো চুকে যেত! তা না করে অতগুলো বস্তিঘরের পিছনে আবর্জনা ভর্তি নোংরা নালায় কেন ফেলতে হল! ঘরগুলোতে যৌনকর্মীরা খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করে। গভীর রাতেও সেখানে অনেক সময়ে খদ্দের থাকে। কারোর নজরে পড়ে যাওয়ারখুবই সম্ভাবনা। একেনবাবু এখন প্রায় নিশ্চিত হলেন এটা কপিক্যাট মার্ডার নয়, রিস্কটা বাড়াবাড়ি রকমের বেশি।

.

সন্ধ্যার সময়ে রাখাল দত্তের ফোন পেলেন একেনবাবু। ব্যালিস্টিক টেস্ট পজিটিভ। অর্থাৎ একই হ্যান্ডগান দিয়ে বিকাশ সেন আর তন্ময় দত্তকে খুন করা হয়েছে। আর কাগজে ছাপা অক্ষরে যে সংখ্যাদুটো পাওয়া গেছে, সেগুলোর সঙ্গে বিকাশ সেনের পকেটে পাওয়া ছাপা অক্ষরগুলোর কোনো তফাৎ নেই। মনে হয় জেরক্স করা হয়েছে একই ম্যাগাজিন বা কাগজ থেকে। অর্থাৎ সন্দেহ নেই যে দু-জনেই খুন হয়েছেন একই দলের হাতে। কিন্তু 1/4 আর 1/2 –এই দুটো ভগ্নাংশের অর্থটা কী? বোঝাই যাচ্ছে একটা মেসেজ, কিন্তু কী মেসেজ? এটা তারিখ নয়, বাড়ির ঠিকানাও নয়। ইংরেজি অক্ষর A-কে 1, B-কে 2, ইত্যাদি ধরলে 1/4 আর 1/2 হবে A/D আর A/B। কী অর্থ হতে পারে সেগুলোর?একেনবাবু আকাশ-পাতাল ভেবেও হদিশ পেলেন না।

.

পরদিন থেকে টিভি এবং দৈনিক পত্রিকাগুলোতে এই নিয়ে তুমুল আলোড়ন শুরু হল। তন্ময় দত্ত নিরীহ অধ্যাপক, বইপত্র ও ছাত্রদের নিয়ে সময় কাটাতেন। চোদ্দ বছর বিদেশে ছিলেন। সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো, বিবাহ, অধ্যাপনা–সবকিছু। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে ছিল বছরে একবার কয়েক সপ্তাহের জন্য মা-কে দেখে যাওয়া। এইবারই মা খুব অসুস্থ বলে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি থেকে স্যাবাটিক্যাল নিয়ে যাদবপুরে ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে এসেছিলেন। আমেরিকান বউ, দুই ছেলেকে নিয়ে নিউ ইয়র্কেই আছেন। পুলিশ করছেটা কী? বুঝছে না যে, কলকাতার লালবাতি অঞ্চল এখন শুধু রমরমিয়ে দেহব্যবসা, চোলাই মদের ঠেক আর গুন্ডা-বদমায়েশদের রাজত্ব নয়, বিকৃতমনস্ক খুনিদেরও তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে! খুনির দলের একটা নামকরণও হয়ে গেল, ‘রেডলাইট কিলারস’। এদের টার্গেট বিকাশ সেন, তন্ময় দত্তের মতো স্বচ্ছল সফলপ্রতিষ্ঠিত বাঙালি যুব সমাজ।

মাত্র দুটো খুন থেকে এতবড়ো সিদ্ধান্তে কী ভাবে আসা হল, সে নিয়ে অবশ্য দু একজন প্রশ্ন তুললেন। তাদের উলটে প্রশ্ন করা হল, প্রথমে 1/4, তারপর 1/2–এই সংখ্যাগুলোর অর্থ কী? এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে অশনি সংকেত! এইসব চেঁচামেচির যাস্বাভাবিক ফল সেটাই হল, রাখাল দত্ত অস্বাভাবিক চাপের মধ্যে পড়লেন। মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রসচিব, কমিশনার, ডিসি সবাই চাপ দিচ্ছেন, কয়েকদিনের মধ্যে দোষীকে অ্যারেস্ট করতে হবে বাস্তবে যেটা অসম্ভব!

এরমধ্যে তন্ময় দত্তের স্ত্রী লিজ দত্তের ছবি বড়ো করে কয়েকটা পত্রিকায় উঠল। প্লেন থেকে নামছেন, স্বামীর শেষকৃত্য ও অন্যান্য করণীয় কাজগুলি করতে। একাই এসেছেন, বাচ্চাদের দাদু-দিদিমার কাছে রেখে। পরদিন একটা পত্রিকায় ছোট্ট ইন্টারভিউও ছাপা হল। লিজের কোনো সময়েই কলকাতা ভালো লাগত না। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে শুধু একবার এসেছেন। এবার দ্বিতীয়বার এবং নিঃসন্দেহে এটাই শেষ। লিজের বক্তব্য, একমাত্র মায়ের টানেই তন্ময় আসত, কলকাতার প্রতি ওরও কোনো আকর্ষণ ছিল না।

এটা কতটা সত্য না স্বামীকে সদ্য হারিয়ে শোকার্ত স্ত্রীর বিলাপ, কে বলতে পারে! একেনবাবুর মাথায় এখন ঘুরছে… প্রতি বছরই তন্ময় দত্ত আসতেন, মাকে দেখতেই নিশ্চয় আসতেন। এসে আর কী করতেন, যার জন্যে ওঁর এই পরিণতি হল? বিকাশ সেনের হত্যাকাণ্ড আর তন্ময় দত্তের খুন হওয়া কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, না এর মধ্যে যোগ আছে? সেক্ষেত্রে ওঁদের পরিচিত জগতে কে বা কারা আছে যারা দু-জনকেই চিনত! এ নিয়ে নিশ্চয় পুলিশ খোঁজখবর শুরু করেছে, পরে রাখাল দত্তের কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে। আপাতত একেনবাবুর প্রথম কাজ হল তন্ময় দত্তের মা-র সঙ্গে যোগাযোগ করা। ঠিকানাটা রাখালবাবুর কাছে পেয়ে গেলেন।

.

তন্ময় দত্তের মা একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে একেবারেই ভেঙে পড়েছেন। হার্টের রুগী, তার ওপর কোমর ভেঙে প্রায় এক বছর ধরে শয্যাশায়ী। ছেলের মৃত্যুর নিদারুণ সংবাদ ছাড়াও নিজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথা ভেবে তিনি প্রায় বাকশক্তি রহিত। একেনবাবু ওঁর কাছে যতক্ষণ ছিলেন, প্রায় পুরো সময়টাই উনি কেঁদে গেলেন। অসংলগ্ন ভাবে ছেলের স্মৃতিচারণ করলেন। ছোটোবেলায় স্বামী জোর করে ছেলেকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তারপর বেনারসে ফার্মাসি পড়তে চলে গেল। সেখান থেকে আমেরিকা। ছেলেকে কাছে পাননি সারা জীবন। নাতি-নাতনিকেও শুধু একবারই দেখেছেন বৃদ্ধা। হিন্দুস্থান পার্কে যে বাড়িতে বৃদ্ধা আছেন, সেটা উনি ছেলেকে গিফট করে দিয়েছেন গত বছর। পুরোনো আমলের বেশ বড়ো দোতলা বাড়ি। আশেপাশে সবগুলোই এখন চারতলা অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে গেছে। মায়ের শরীরের কথা ভেবে তন্ময় দত্ত বাড়িটাকে প্রোমোটারের কাছে দেওয়ার কথা ভাবেননি। ছেলের বউ এখন কী করবে কে জানে! বউ লিজ দত্ত কলকাতায় এসেছে সেটা বৃদ্ধা শুনেছেন। তবে কলকাতায় এসে লিজ শাশুড়িরসঙ্গে একবারও দেখা করেননি। আছেন একটা ফাইভ স্টার হোটেলে।

হিন্দুস্থান পার্ক থেকে একেনবাবু যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে গেলেন। সেখানে তন্ময় দত্তের বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা হল। সকলেই শল্ড। শুনলেন উনি সকাল সকাল ইউনিভার্সিটিতে আসতেন, নিজের রিসার্চ আর পড়ানো নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। অন্যান্য অধ্যাপকদের সঙ্গে মিশতেন না তা নয়। বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায় তা কারোর সঙ্গেই ছিল না। একজনের কথায় হি ওয়াজ এ লোনার। ইউনিভার্সিটির বাইরে কী করতেন, কেউই জানে না। তবে মাঝে মাঝে বাড়িতে বেশ দেরি করে ফিরতেন, সেটা ওঁর মায়ের থেকে একেনবাবু উদ্ধার করেছিলেন। কোথায় যেতেন মা জানতেন না। নিশ্চয় কোনো বন্ধু-টন্ধু হবে। তবে ইউনিভার্সিটির কেউ নয়, সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এটাই একেনবাবুর মনে হল। ওঁর আন্ডারে রিসার্চ করছিল একটি ছাত্রী, বেশ মিষ্টি চেহারা। তাকেও প্রশ্ন করলেন কিছুক্ষণ। স্যারের প্রশংসা ছাড়া আর কিছুই উদ্ধার হল না। ট্রাভেল এজেন্সি থেকে গাড়ি ভাড়া করলে জানা যেত কোথায় কোথায় ওঁর যাতায়াত ছিল। কিন্তু উনি ঘুরতেন ট্যাক্সি নিয়ে।

রাখালবাবু অনুরোধ করলেও তন্ময় দত্তের মৃত্যু নিয়ে একেনবাবু মাথা ঘামাতেন না। উনি এসেছেন বিকাশ সেনের হত্যাকারীকে খুঁজে বার করতে, কলকাতা পুলিশের সমস্যা মেটাতে নয়। ঘটনাচক্রে এখন যা মনে হচ্ছে দুটো রহস্যের সমাধানই হয়তো এক। একটা ব্যাপার নিয়ে একেনবাবু এতদিন তেমন ভাবেননি। তন্ময় দত্তের খুনের পরে সেটা নিয়েও ভাবনা চিন্তা শুরু করলেন। হিন্দুস্থান পার্কের মতো প্রাইম লোকেশনে একটা বাড়ি থাকা মানে প্রোমোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। অসাধু প্রোমোটারদের এখন রমরমা। তন্ময় দত্তের মৃত্যুতে প্রোমোটারদের হাত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তন্ময়বাবুর মায়ের অবশ্য ধারণা কোনো প্রোমোটারের সঙ্গে তন্ময়বাবুর যোগাযোগ হয়নি। সব কথা ওঁর পক্ষে জানা বা এই অবস্থায় মনে রাখা সম্ভব নয়। প্রোমোটারদের সঙ্গে কথা না হলেও জমি-বাড়ির মালিককে খুন করে সেটা দখল করার ঘটনা আগে ঘটেছে। তন্ময় দত্তকে সরিয়ে দিলে তার বিদেশি বউ জমিবাড়ি দখল নিয়ে কলকাতায় এসে কোর্টকাছারি করতে পারবে না, এটা যে-কেউ বুঝবে। এখন প্রশ্ন হল, বিকাশ সেনের মৃত্যুর সঙ্গেও কি কোনো প্রোমোটার যুক্ত? কিন্তু সেক্ষেত্রে সোনাগাছি বা ওয়াটগঞ্জের নিষিদ্ধ পাড়ার ব্যাপারটা আসছে কেন? পুলিশকে ভুল পথে চালাবার চেষ্টা?

এদিকে একেনবউদি ভীষণ রেগে গেছেন। কলকাতায় এসে পর্যন্ত একেনবাবু নিজের কাজে দৌড়োদৌড়ি করছেন, একদিন থিয়েটার দেখা ছাড়া একসঙ্গে কোথাও বেড়াতেও বেরোননি।

“আজ তুমি সন্ধ্যায় কোথাও যাবে না। আমার সঙ্গে বেরোবে।”

“কোথায়?”

“অরবিন্দ অ্যাসোসিয়েশনের মেলায়।”

“অন্য কোথাও চলো না!”

“না, মেলায়।”

 মেলা-টেলায় যেতে একেনবাবু একেবারেই পছন্দ করেন না। একেনবউদির একটা স্বভাব আছে মেলায় গেলেই বাড়ি সাজানোর জন্যে টুকিটাকি নানান জিনিস কেনা। কেন ওগুলো কিনতে হয় অনেক ভেবেও একেনবাবু তার সদুত্তর পাননি। আলমারি, আলমারির মাথা, ড্রেসিং টেবিল, দেয়াল, বই রাখার তাক– যেখানেই রাখার এতটুকু জায়গা আছে, সেখানেই একটা না একটা কিছু হ্যাঁন্ডিক্র্যাফট শোভা পাচ্ছে! নতুন যা আসবে সেখানেই গুঁতোগুতি করে রাখতে হবে। তাতে একেনবাবুর কোনো সমস্যা নেই। হাবিজাবির মধ্যেও তিনি দিব্বি শিব হয়ে থাকতে পারেন। মুশকিল হল ধুলোবালি নিয়ে। কয়েকদিনের মধ্যেই জিনিসগুলোর উপরে ধুলোর একটা আস্তরণ পড়ে যায়। একেনবউদির ঘর সাজানোর জিনিস বলে কাজের মেয়েটি ওগুলো মুছতে ভয় পায়। বিরক্ত হয়ে শেষে একেনবউদিই কাজটা করেন। যেদিন সে কর্মকাণ্ডটি হয় সেদিনটা একেনবাবুর কাছে ভয়াবহ। একেনবউদি একেবারে ফায়ার হয়ে থাকেন। ভাগ্যক্রমে এখন নিউ ইয়র্কে আছেন বলে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা কম। কলকাতায় থাকার সময়ে দু-একবার মোছামুছির ব্যাপারে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন, তাতে ভালোর থেকে মন্দ হয়েছিল বেশি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে একেনবাবুকে ‘সি’ গ্রেডের বেশি দেওয়া যায় না, আর একেনবউদি চান ‘এ-প্লাস’ গ্রেড-এর হেল্পার।

একেনবউদিকে সন্তুষ্ট করতেই ছ’টা নাগাদ বউদিকে নিয়ে একেনবাবু মেলার দিকে রওনা দিলেন। জায়গাটা খুব দূরে নয়। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা থাকলে গাড়িতে বড়োজোর মিনিট কুড়ি। যাবার পথেই শুনলেন দোলা ওখানে একটা বুটিকের দোকান দিয়েছে, সেটাকে পেট্রোনাইজ করতে হবে। একেনবাবু ওঁর এই মাসতুতো শালি দোলাকে পছন্দ করেন, ভারি হাসিখুশি। উৎসাহে সবসময়ে টগবগ করছে আর অজস্র কথা বলে। স্বামী অনির্বাণ ঠিক তার উলটো, ঘরে আছে কি নেই বোঝা যায় না। অনির্বাণ ব্যাঙ্কে ভালো চাকরি করে। দোলার কোনো কাজ না করলেও চলত। আগে দোলা শুধু সমাজসেবাই করত, এখন বেলতলা রোডে নিজের বাড়ির একতলায় একটা বুটিক খুলেছে। ডিজাইন ওর, কিন্তু দুঃস্থ মেয়েদের দিয়ে শাড়ি, ব্লাউজ, কামিজ, টেবিল সেটিং হরেক রকমের জিনিস তৈরি করায়। দোলা যে আজকাল মেলাতেও দোকান দিচ্ছে সেটা একেনবাবু জানতেন না।

মেলার বেশির ভাগ দোকানই মাঠে। বাঁশের কাঠামোর ওপর ত্রিপল খাঁটিয়ে দোকানগুলো সাজানো। কয়েকটা দোকান পাকা দালানের ভেতরে, খেয়াল না করলে সেগুলো চোখে পড়বে না। দোলার দোকানটা ওই পাকা দালানের একটা কোণের ঘরে। দোকানটা সাজিয়েছে চমৎকার। পিছনে সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের দুলাই টাঙানো। ওটাই নাকি দোলার স্পেশালিটি। সামনের টেবিলে থরে থরে ন্যাপকিন, ক্যারি ব্যাগ, টেবিল ক্লথ, প্লেসম্যাট ইত্যাদি রয়েছে। বাচ্চা ও বড়োদের কিছু কামিজ, ফ্রক আর ব্লাউজও চোখে পড়ল। কিন্তু বাজে লোকেশনের জন্যে মেলার আসল ভিড়টা মনে হয় পাচ্ছে না।

“দেখতে খুব ভালো লাগছে তোর দোকানটা, বিশেষ করে পিছনের দুলাইগুলোর জন্য,” একেনবউদি বললেন।

“ওই সাজিয়েছে,” ওর হেল্পার মেয়েটিকে দেখাল দোলা। “আমার হাত অতদূর যায় না। কিন্তু এত সাজিয়ে লাভটা কী হচ্ছে দিদি?”

“কেন, একেবারেই বিক্রি হচ্ছে না?”

দোলার কথা শুনে একেনবাবু বুঝলেন, একেবারেই যে কিছু বিক্রি হচ্ছে না, তা নয়। তবে স্টল নিতে যে ভাড়াটা গুনতে হয়েছে, সেটা উঠবে কিনা তা নিয়ে বেচারা চিন্তিত। একেনবউদি দোলার দোকান থেকে একটা ন্যাপকিন সেট আর একটা দুলাই কিনলেন। জিনিসগুলো দোলার জিম্মায় রেখে দু-জনে দালান বাড়ি থেকে নেমে মেলার মাঠের দিকে এগোলেন। এমন সময়ে একেনবাবুর চোখে পড়ল কাছেই একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে হাত-ভাঙা একটি লোকের সঙ্গে কথা বলছে। মেয়েটির মুখ চেনা চেনা। একেনবাবুর সঙ্গে মেয়েটির চোখাচোখি হতেই থতমতো খেয়ে চকিতে সেখান থেকে অদৃশ্য হল। আরে, মেয়েটা তো মল্লিকা! ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে মল্লিকাকে ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করার সুযোগ একেনবাবু পেলেন না। লোকটিও অন্যদিকে হাঁটা দিয়েছে। যে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা কথা বলছিল, সেটা একটা জামাকাপড়ের বুটিক। দোকানে মধ্যবয়সি একজন মহিলা বসে। পাশের বেঞ্চে একটি বাচ্চা ছেলে, খাতার ওপর কী-সব আঁকিবুকি কাটছে! পিছনে দাঁড়িয়ে চেক-শার্ট পরা যে ছেলেটি জামাকাপড় গুছিয়ে তুলে রাখছিল, তার বয়সও বেশি নয়। একেনবাবু মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম। একটু আগে এখানে দাঁড়িয়ে যে দু-জন গল্প করছিলেন, তাঁদের আপনি চেনেন?”

“কার কথা বলছেন?”

“ওই যে ভদ্রলোক যাঁর হাত ভাঙা।”

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন। দোকানের হেল্লার ছেলেটি সামনে এগিয়ে এল, “কার খোঁজ করছেন, মলয়দার?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওঁর সঙ্গে আমার একটা দরকার ছিল। আমি এদিকে আসতে আসতেই উনি চলে গেলেন। তুমি জানো ভাই, কোথায় ওঁর দেখা পাব?” ছেলেটা বয়সে অনেক ছোটো বলেই ‘স্যার কথাটা মুখে এল না।

“আমাদের পাড়াতেই থাকতেন। ক’দিন হল চলে গেছেন।”

“কোথায় গেছেন?”

“স্তা তো জানি না।”

“পাড়ার কেউ কি জানেন কোথায় গেছেন?”

“বলতে পারব না, বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আজকে অনেকক্ষণ এখানে ঘোরাঘুরি করছিলেন, হয়তো আবার আসবেন। যদি অপেক্ষা করেন এখানেই দেখা পেয়ে যাবেন।”

“বাড়িওয়ালার ঠিকানাটা কী ভাই?”

“বাড়ি চিনি, ঠিকানা তো বলতে পারব না।”

“রাস্তার নামটা?”

 যে রাস্তার নামটা ছেলেটি বলল, সেই রাস্তার ঠিকানাই মল্লিকা দিয়েছিল।

.

একেনবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন মলয়কে খোঁজার চেষ্টা করবেন না। এখন মনে হচ্ছে করতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে হঠাৎ করে মল্লিকার সঙ্গে মলয়ের এখানে দেখা হয়নি। নইলে একেনবাবুকে দেখে মল্লিকা এভাবে অদৃশ্য হত না, মলয়ও নয়। মল্লিকার জন্যেই মলয় এখানে অপেক্ষা করছিল। কেন? এর উত্তরটা জানা দরকার। এইসব কথাবার্তার ফাঁকে একেনবাবু খেয়াল করছিলেন বাচ্চা ছেলেটা বারবার ওঁর দিকে তাকাচ্ছে আর টুকটুক করে কী জানি খাতায় লিখছে। একটু মজাই লাগল, কী লিখছে ছেলেটা! মুখ ফিরিয়ে ভালো করে ওর দিকে তাকাতেই খাতা নিয়ে ছুট লাগাল।

“দেখ তো কোথায় পালাল? ছেলেটাকে এনে হয়েছে এক জ্বালা!” দোকানি মহিলা একটু বিরক্ত হয়ে একেনবাবুকে এক ঝলক দেখে হেল্পার ছেলেটিকে বললেন।

“দেখছি মাসিমা,” বলে সেও ছুটল।

একেনবাবু একটু অপ্রস্তুত হলেন। ও ভাবে বাচ্চাটার দিকে তাকানোটা বোধহয় ঠিক হয়নি।

এইসবের মধ্যে একেনবউদি কোথায় চলে গেছেন কে জানে! ভিড়ের মধ্যে তাঁকে খুঁজে পেতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। তারপর দুজনে মিলে দোকানে দোকানে কিছুক্ষণ ঘুরলেন। এক জায়গায় গান-বাজনা হচ্ছিল সেখানেও দাঁড়ালেন। বেশ কিছু চেয়ার ফাঁকা পড়েছিল।

“বসবে নাকি? একেনবউদিকে জিজ্ঞেস করলেন।

“না। চলো, জিনিসগুলো নিয়ে বাড়ি যাই।”

দোলার দোকানে জিনিসগুলো তুলতে এসে দেখলেন দোকানের সামনে একটি লোকও দাঁড়িয়ে নেই। কাজের মেয়েটিও অদৃশ্য। বুথে অবশ্য দোলা একা নয়। পাশে যে বসে আছে, তাকে দেখে একেনবাবু আশ্চর্য হলেন! খাতা হাতে সেই ছোট্ট ছেলেটি! একেনবাবুকে দেখা মাত্র ছেলেটা আবার পড়ি কি মরি করে দৌড় লাগাল!

“ছেলেটা কে?”

“বুনুদি-র ছেলে। মাথায় একটু গোলমাল, কিন্তু ভারি লক্ষ্মী। ছবি আঁকতে ভালোবাসে বলে বুনুদি ওর দোকানে আজ নিয়ে এসেছে। এক জায়গায় বসিয়ে রাখে কার সাধ্যি!”

“পালাল যে! হারিয়ে যাবে না তো?”

“হারাবে কেন, ওই তো ছোটোন ওর পিছন পিছন গেল।”

ছোটোন হয়তো সেই হেল্পার ছেলেটি। এ নিয়ে আর ভাবলেন না একেনবাবু। শালিকে জিজ্ঞেস করলেন, “একেবারে একা যে ম্যাডাম দোলা, তোমার কাজের মেয়েটি গেল। কোথায়?”

“খেতে গেছে।”

“বিক্রিবাটা কিছু হল?”

“কিছু বিক্রি হচ্ছে না, জামাইবাবু। দু-হাজার টাকা দিয়ে স্টল ভাড়া করেছি, আপনাদের কেনাটা বাদ দিয়ে সারা দিনে আটশো টাকার জিনিস বিক্রি হয়েছে কিনা সন্দেহ।”

“ওরে বাবা, স্টলের জন্যে দু-হাজার টাকা দিতে হয়!” এত টাকা দিয়ে স্টল ভাড়া করতে হয় একেনবাবুর ধারণাই ছিল না।

“তাও তো এখানে কম।”

“টাকা ওঠে কী করে, কত টাকার জিনিস বেচতে হয়?”

“অন্তত সাত-আট হাজার টাকার। নইলে কিছুই হাতে থাকে না, পরিশ্রমই সার। তিনটে বড়ো বড়ো স্যুটকেসে মাল নিয়ে ট্যাক্সি করে এসেছি। যেগুলো বিক্রি হবে না, সেগুলো নিয়ে আবার ট্যাক্সি করে ফিরতে হবে। দুটো মেয়ে পালা করে আমার সঙ্গে এখানে বসে, তাদের টাকা দিতে হবে। এবার অনির্বাণ ভীষণ রাগারাগি করবে। বার বার আমায় বলে মেলায় দোকান না দিতে।”

“ঠিকই তো বলে, দিস কেন?” একেনবউদি বোনকে একটু বকলেন।

“কী যে বলো দিদি, মাস তিনেক আগে বিজয়গড়ের মেলায় কী দারুণ বিক্রি হয়েছিল বিশ্বাস করতে পারবে না!

“কত হয়েছিল?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

“প্রথম দিনই পনেরো হাজার টাকার ক্যাশ-সেল, একটা চার হাজার টাকার হ্যান্ড

বিস্মিত একেনবউদি বললে, “সেকি রে, তুই এত দামের কামিজ এইসব মেলায় বিক্রি করার জন্য আনিস?”

“বিক্রির জন্য আনি না, আনি ডিসপ্লে করার জন্য। এক ভদ্রলোক দেখে বললেন, এটা কার ডিজাইন?” বললাম, “আমার। একটু খ্যাপা লোকটা। বললেন, সত্যি বলছেন?” তখন সত্যি কথাটাই বললাম, “ডিজাইনটা আমি পেয়েছি দুঃস্থ আশ্রমের এক মেয়ের কাছ থেকে। জিজ্ঞেস করলেন, কত দাম?’ বাড়িয়েই বললাম, “চার হাজার টাকা। ভেবেছিলাম দাম শুনে পালাবে। মোটেও না। ক্যাশ টাকা দিলেন, তবে সেই সঙ্গে আরও প্রশ্ন। মেয়েটি কোথায় থাকে?’ বললাম, “সে আর বেঁচে নেই। কোথায় থাকত?’ নারী-উদ্ধার আশ্রমে। ‘আপনাকে কেন ডিজাইনটা দিল?’– এইরকম কত যে প্রশ্ন, বিশ্বাস করবে না।”

“একটা কামিজ কিনতে এত প্রশ্ন?” একেনবউদি একটু অবাক হয়ে বললেন।

“কত রকমের লোক যে আসে দোকানে! আর চার হাজার টাকা দিয়ে কিনছে, একটু না হয় বললামই কথা তার সঙ্গে।”

“তা এই মহিলাটি কে, যার দৌলতে তুই চার হাজার টাকার কামিজ বিক্রি করতে পারলি?”

“রাস্তা থেকে তুলে আনা এক এইডসের রোগিণী, একেবারে শেষ অবস্থায় ছিল। নারী উদ্ধার আশ্রমে যখন ভলেন্টিয়ারি করতাম, তখন মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে গিয়ে গল্প করতাম যাতে কষ্ট ভুলে থাকতে পারে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমি বুটিকের জিনিস তৈরি করি শুনে বলল, “আমার কাছে একটা সুন্দর ডিজাইন আছে, তোমাকে সেটা দিতে পারি। একটা কামিজের উপর হ্যান্ড-পেন্ট করা ডিজাইন। কামিজটা বহু পুরোনো। কিন্তু যত্ন করে রাখা ছিল বলে ডিজাইনটা নষ্ট হয়নি। সেটাই কপি করে কামিজটা বানাই। কেউ যে চার হাজার টাকা দিয়ে ওটা কিনবে কল্পনাই করিনি!”

একেনবউদি বললেন, “টাকা থাকলে, অনেক কিছুই করা যায়। আমাদের নেই বলেই পারি না। কামিজের কথা ছেড়ে দে, চার হাজার টাকার শাড়ি পরতে কি ইচ্ছে হয় না?”

দোলা বলল, “কেন চার হাজার টাকার শাড়ি নিশ্চয় জামাইবাবু তোমায় একটা দিতে পারে।”

একেনবাবু দেখলেন, ব্যাপারটা একটু গোলমেলে মোড় নিচ্ছে। একেনবাবুর বহু জুনিয়র কলিগ কারণে অকারণে বউদের ঢালাও উপহার দেয়। একেনবাবুর সে ক্ষমতা নেই। কেন নেই, সেটা একেনবউদি জানেন না তা নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে কষ্ট পান যখন দেখেন জুনিয়ার অফিসারের বউয়ের গলায় ঝকঝকে হিরের নেকলেস। ওঁর তো বিয়েতে পাওয়া সেই সিকি ভরি সোনার হার।

ভাগ্যিস এই সময়ে রাখাল দত্তের একটা ফোন আসায় ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়ল। আবার মার্ডার! এবার খুন হয়েছেন রেস্টুরেন্টের এক মালিক, ইনিও বয়সে ইয়াং। ক’দিন অন্তর অন্তর কলকাতায় উচ্চবিত্ত যুবকরা খুন হচ্ছে, অথচ অপরাধীদের ধরা যাচ্ছে না। রাখাল দত্ত বলতে গেলে একেবারে ‘অ্যাট হিস উইটস এন্ড’।

“আপনি এখন কোথায়?”

“একটা মেলায়।”

“কখন বাড়ি ফিরছেন?”

ফোনের মুখে হাত রেখে একেনবাবু কাঁচুমাচু মুখে একেবউদিকে জিজ্ঞেস করলেন, “কখন আমরা বাড়ি ফিরছি?”

“কেন?”

“রাখাল জানতে চাইছে।”

“দেখছিস তো, এই হল ওর মেলায় আসা!” দোলাকে কথাটা বলে একেনবাবুকে বললেন, “বলো আমরা আসছি।”

“আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরছি।” রাখালকে জানিয়ে দিলেন একেনবাবু।

“তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমি ডিনার সেরে আপনার ওখানে একবার ঢু মারব।”

দোলা একটা ব্যাগে দুলাই আর ন্যাপকিন সেটটা ভরে রেখেছিল। সেটা নিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দু-জনে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।

.

[রাত্রে যখন প্রমথকে এই পরিচ্ছেদটা শোনালাম ও বলল, “তুই এখনও ঝেড়ে কাশতে শিখলি না। লিখলেই পারতিস একেনবাবুর সমস্যাটা আর্থিক নয়, ঘুষ না নিয়েও উনি বউকে হিরের হার কিনে দিতে পারেন। সমস্যা হল উনি হাড় কেন! আরেকটা কথা, তুই লিখেছিস মেলা হচ্ছে বাড়ি থেকে কুড়ি মিনিটের পথ। একেনবাবুর বাড়ি কোথায় সেটা তো কোথাও লিখিসনি।”

“লেখার দরকার আছে কি? আমি তো আগেই বলেছি, জায়গার নাম পালটেছি, একটার ঘাড়ে আরেকটা চাপিয়েছি।”

“ননসেন্স! তাহলে তো সবকিছু নিউ ইয়র্কে ঘটছে লিখলেই পারতিস। এদিকে সবিস্তারে মেলার বর্ণনা দিচ্ছিস, লিখছিস কে কোথায় থাকে, কোথায় একেনবাবু গেলেন, অথচ একেনবাবুর বাড়ি কোথায়, কোত্থেকে তিনি নানান জায়গায় যাচ্ছেন পাঠকদের জানার উপায় নেই। এটা তো ফান্ডামেন্টাল ফ্ল। ভালোকথা, অরবিন্দ অ্যাসোসিয়েশনের মেলাটা কোথায় হচ্ছিল?”

“অরবিন্দ সামথিং, অ্যাসোসিয়েশন কিনা মনে নেই। তবে মেলাটা হচ্ছিল রিজেন্ট পার্কে, ডায়েরিটা একবার চেক করতে হবে।”

“ঠিক আছে, চেক করে সেটা লেখ। আর সেই সঙ্গে লিখে দে, একেনবাবু মনোহর পুকুরে থাকেন। ঠিকানা না দিতে চাস, দিস না।”

আমি কিছু বললাম না, কিন্তু বয়েই গেছে ওর কথা শুনতে।]

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত