১০.

রাত ন’টা নাগাদ রাখাল দত্ত এলেন। তার আগেই অবশ্য একেনবাবু খুনের খবরটা টিভি তে পেয়ে গেছেন। ভবানীপুরে কদমতলা বাইলেনে একজন খুন হয়েছে। কে খুন হয়েছে এখনও জানা যায়নি। কারণ খুন হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ এসে জায়গাটা ব্লক করে দিয়েছে, কোনো রিপোর্টারকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। বডি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সম্ভবত যিনি খুন হয়েছেন, মিডিয়ার কাছে তিনি অপরিচিত নন। সেইজন্যেই এই লুকোচুরি। তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলা হবে না। কাল সকালে একটা প্রেস রিলিজ দেওয়া হবে।

এরমধ্যে মহানাগরিক সমিতির এক কর্তা জ্বালাময়ী ইন্টারভিউ দিয়েছেন। পর পর তিনটে খুন, আর আমাদের লালবাজারের পুলিশ এখন পর্যন্ত হাত গুটিয়ে বসে আছে– শেম, শেম! নিষ্কর্মা পুলিশেরা জেনে রাখুক, জনগণ এটা বরদাস্ত করবে না। দুটো খুনের পর থেকে ওদের ওপর অভিযোগের যে ঝড় শুরু হয়েছে, সেটা এবার ভয়াবহ কালবৈশাখী হয়ে দাঁড়াবে। পুরো লালবাজার কাঁপবে, পুলিশের বহু কর্তা গদি হারাবেন, মন্ত্রীরাও ছাড় পাবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি।

রাখাল দত্ত যে প্রচণ্ড স্ট্রেসের মধ্যে আছেন বুঝতে অসুবিধা হয় না। চুল উশকোখুশকো, চোখ লাল। ওঁর ওই বিধ্বস্ত চেহারা দেখে একেনবাবু বললেন, “করেছ কী ভাই, ইনভেস্টিগেশন শেষ করার আগে, তুমিই তো ফিনিশ হয়ে যাবে। বসো বসো, একটু চা খাও।”

“এই রাতে চা খাব না, বরং এক গ্লাস জল দিন বউদি।”

পুরো এক গ্লাস জল ঢক ঢক করে খেয়ে রাখাল দত্ত বসলেন।

.

“যিনি খুন হয়েছেন তাঁর নাম অরূপ চৌধুরী। অরূপ ওয়াজ এ সাকসেসফুল ম্যান। বয়স বছর আটতিরিশ। তিন-তিনটে রেস্টুরেন্টের মালিক, তারমধ্যে একটা হল ‘দ্য নাইট’– পার্ক স্ট্রিটে কলকাতার নামিদামি লোকদের রাঁদেভর জায়গা। ডিজি সাহেবও তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে বহুবার সেখানে খেতে গেছেন। অরূপকে উনি পার্সোনালি চেনেন। তাই আমাদের ওপর হুকুম সাত দিনের মধ্যে খুনিকে ধরা চাই। বলুন স্যার, এটা কি সম্ভব! যাকে তাকে তো খুনি বলে ফাঁসিতে লটকানো যায় না!”

“এখন বুঝছি ভাই, মিডিয়া নয়– এটাই হল তোমার আসল সমস্যা।” সহানুভূতি দেখিয়ে একেনবাবু বললেন।

রাখাল দত্ত চুপ করে রইলেন।

“ডিজি সাহেবের সঙ্গে অরূপবাবুর এত চেনাজানা হল কী করে?”

“ঠিক বলতে পারব না, মনে হয় আলাপ হয়েছিল ওই রেস্টুরেন্টেই। রেস্টুরেন্টের পাশেই অরূপের অফিস। প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই রেস্টুরেন্টে অরূপ বসত।”

‘বসতেন’ না বলে বসত? খটকা লাগল একেনবাবুর। নামের পিছনে বাবু’ বাদ দিলেও রাখাল দত্ত এ-রকম ভুল করে না। কিন্তু সে নিয়ে মাথা ঘামালেন না। বললেন, “আই সি। কদমতলা বাইলেন রাস্তাটা কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে। ওখানে অরূপবাবু। কী করতে গিয়েছিলেন জানো?”

“জায়গাটার কাছেই ওর আরেকটা রেস্টুরেন্ট ‘গরম ভাত’। সেটা অবশ্য ‘দ্য নাইট’ এর মতো ফ্যান্সি নয়।”

“গরম ভাত’ মিস্টার চৌধুরীর! আমি তো ওটা দেখেছি, হাজরা আর নফর কুণ্ডু লেনের মোড়ে, তাই না?”

“এক্সাক্টলি। কদমতলা বাইলেন নফর কুণ্ডু লেন থেকে বেরিয়েছে।”

“ওই রেস্টুরেন্টে কি উনি নিয়মিত আসতেন?”

“যদ্দুর জানি, না। গরম ভাত’-এর দুটো ব্রাঞ্চ। একটা ভবানীপুরে, আরেকটা বেহালায়। দুটোই দেবু বলে এক ম্যানেজার চালান। তাঁকেও এইমাত্র জেরা করে এসেছি। যেটুকু উদ্ধার করেছি, সেটা হল ‘গরম ভাত’ নিয়ে অরূপ খুব একটা মাথা ঘামাত না। ক্যাশ-ট্যাশগুলো দেবুই হ্যাঁন্ডেল করতেন। প্রতি শনিবার সকালে দেবু অরূপের পার্ক স্ট্রিটের অফিসে গিয়ে হিসেবপত্র বুঝিয়ে দিয়ে আসতেন। তবে অরূপ কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ করে হাজরা বা বেহালায় গিয়ে ওয়েটার, কুক, দারোয়ান সবার সঙ্গেই আলাদা ভাবে কথা বলত। দেবুকে কাজের ভার দিলেও অরূপ অবভিয়াসলি ‘ট্রাস্ট বাট ভেরিফাই’-তে বিশ্বাসী ছিল।”

“আই সি। এটাও কি সে-রকম একটা সারপ্রাইজ ভিসিট ছিল?”

“তাই তো মনে হয়। অরূপ যে আসছে দেবু জানতেন না। দেবু নিজেও হাজরায় ছিলেন না, ছিলেন বেহালা ব্রাঞ্চে।”

“সেটা সত্যি কিনা খোঁজ নিয়েছ?”

“এখনও নেওয়া হয়নি, তবে নিচ্ছি। অবশ্য মনে হয় না দেবু মিথ্যে কথা বলছেন বলে।”

“ইন্টারেস্টিং। তারপর?”

“অরূপ রেস্টুরেন্টে ঢোকেনি। রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে নামতেই, একটা কালো রঙের টাটা সুমো উলটো দিক থেকে পাশে এসে দাঁড়ায়। সেই গাড়ির ভেতর থেকেই কেউ ওকে গুলি করে। মাটিতে পড়ে যেতেই গাড়ি থেকে দু-জন নেমে ধরাধরি করে ওকে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছিল। দূরে দুটো ছেলে দাঁড়িয়েছিল, তারা চেঁচিয়ে ওঠে। সেই শুনে লোকদুটো বডি ফেলে রেখে গাড়িতে উঠে চম্পট দেয়। ঠিক ওই সময়ে হাজরা রোড থেকে একটা পুলিশ পেট্রল নফর কুণ্ডু লেনে ঢুকছিল। তারা যখন কদমতলার মোড়ে আসে, গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

“গাড়ির নম্বর পাওয়া গেছে?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

“না। অন্ধকারে দূর থেকে নম্বরটা দেখা যায়নি। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য নম্বর দেখেও বিশেষ লাভ হয় না। তবে গাড়িটা কালো রঙের টাটা সুমো, সে বিষয়ে দুটো ছেলেই নিশ্চিত। পুলিশের পেট্রল কার থেকে ফোন পেয়ে ভবানীপুর থানার লোক এসে সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা কর্ডন করে। আমি গিয়ে জায়গাটা ভালো করে দেখেছি। এবার কোনো এভিডেন্স নষ্ট হয়েছে বলে মনে হয়নি।”

“কী বোঝা যাচ্ছে এখন পর্যন্ত?”

“অরূপের মার্ডারের সঙ্গে আগের দুটো মার্ডারের এক দিক থেকে কোনো তফাৎ নেই। আততায়ী ২২ ক্যালিবারের হ্যান্ডগান ব্যবহার করেছে। গুলিটা সাইড থেকে মাথায় লেগেছে। আমার ধারণা একই হ্যান্ডগান থেকে গুলি করা হয়েছে, তবে ব্যালিস্টিক টেস্টের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কনফার্ম করা যাবে না। অবভিয়াসলি খুনিরা এবার ডেডবডি ডাম্প করার সুযোগ পায়নি। উদ্দেশ্য নিশ্চয় সেটাই ছিল, নইলে মৃতদেহটা গাড়িতে তোলার চেষ্টা করেছিল কেন!”

“পুলিশ যখন কাছে গেল ভদ্রলোক কি তখনও বেঁচে ছিলেন?”

“কয়েক মিনিট বেঁচে ছিল, তবে কথা বলার শক্তি ছিল না।”

“ধরে নিচ্ছি এবার কোনো কাগজ পাওয়া যায়নি।”

“না স্যার, পাওয়া গেছে। তবে পকেটে নয়, কাছেই রাস্তার ওপরে। সেটাই আমি খুঁজছিলাম, পেয়েও গেলাম। আগের মতো একই ভাবে কাগজ কেটে লাগানো। তাতে লেখা ‘your number 75’। তাড়াহুড়োতে খুনিরা পকেটে ঢোকাতে পারেনি। গাড়ি নিয়ে পালাবার সময় ফেলে দিয়ে গেছে।”

“এটা তো কনফিউসিং ভাই, 75 কেন?”

“আমিও তাই ভাবছি স্যার। ভগ্নাংশ থেকে একেবারে দু-অঙ্কের সংখ্যা!”

“মেসেজ কিছু একটা নিশ্চয় আছে। কিন্তু কী, সেটাই প্রশ্ন। এই শেষ সংখ্যাটাই কেমন জানি গুলিয়ে দিচ্ছে।”

“আগের দুটোতে কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন নাকি স্যার?”

“মনে হচ্ছিল, এখন বুঝছি সেটা ভুল। ফ্র্যাঙ্কলি আমি লিটল কনফিউসড। ভালোকথা, তোমাদের ক্রাইম ল্যাব থেকে কোনো খবর পেয়েছ, কোত্থেকে আগের কাগজগুলো কাটা হয়েছে?”

“না স্যার, এখন পর্যন্ত কিছুই পাইনি।” উত্তরটা রাখালবাবু দিলেন ঠিকই, তবে ঠিক বুঝলেন না সেটা জেনে লাভ কী! ওঁর মাথায় তখন অন্য দুশ্চিন্তা।

“মাত্র সাত দিন সময় আছে স্যার। আমাদের এই ডিজি সাহেব যা লোক, তারপরেই জঙ্গলমহলে ট্রান্সফার।”

“দাঁড়াও ভাই, একটু ভাবি। বিকাশ সেনের হত্যাকাণ্ড আর শেষের এই দুটোও তো মনে হচ্ছে একই সূত্রে বাঁধা। একটার কিনারা হলে সুতো ধরে টান দিলে সবগুলোই বেরিয়ে আসবে। একটা জিনিস করবে ভাই?”

“বলুন।”

“একটু খোঁজ নিয়ে দেখো তো বিকাশ সেনের কোনো বাড়ি বা জমিজমা কলকাতায় আছে কিনা?”

“আপনি ভাবছেন, খুনের সঙ্গে প্রোমোটার জড়িত?”

“হয়তো নয়। তবু সম্ভাবনাটা বাদ দেবার আগে একটু খতিয়ে দেখা দরকার।”

“হয়তো নয় কেন?” উত্তরটা রাখাল দত্ত বোধহয় জানেন, তাও প্রশ্নটা করলেন।

“কারণ এই কাগজে লেখা সংখ্যাগুলো। প্রোমোটার এইভাবে কাগজে নম্বর সেঁটে খুন। করতে যাবে কেন?”

“তা ঠিক। কিন্তু খুনি প্রোমোটার যদি আমাদের ধোঁকা দিতে চায়, তাহলে তো এই রকম কিছু একটা করেই ভুল পথে নিয়ে যাবে।”

 “এটা মন্দ বলোনি ভাই,” মাথা নাড়লেন একেনবাবু। “একেবারে মোক্ষম বলেছ! ভুল পথে নিয়ে যাবার জন্য ভালো অস্ত্র। যাইহোক, যে-তিনটে কাগজ পাওয়া গেছে, সবগুলো আমায় দেখাতে পারবে?”

“কালকেই নিয়ে আসব। কপি হলে চলবে?”

“আগে কপিটাই আনো। দরকার হলে পরে তোমাদের ক্রাইম ল্যাবে গিয়ে অরিজিন্যালটা দেখে আসব। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা– কলকাতায় কতগুলো কালো রঙের টাটা সুমো আছে?”

“সেটার খোঁজ করা হচ্ছে। তবে গাড়িটার রেজিস্ট্রেশন কলকাতার নাও হতে পারে।”

“ট্রু” একেনবাবু মাথা নাড়লেন। “আর একটা কাজ করো তো ভাই, খোঁজ নাও এই ধরনের গাড়ি কেউ সোনাগাছি বা ওয়াটগঞ্জ এরিয়াতে দেখেছে কিনা।”

“সেটার খোঁজও করছি। মুশকিল হল, ওখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এখন পর্যন্ত প্রায় কিছুই জানা যায়নি। মনে হয় না বিশেষ কিছু জানা যাবে বলে। আসলে পুলিশের ওপর ওদের আস্থা নেই। কেউ যদি কিছু দেখেও থাকে, ভয়ে ভয়ে বলবে না, পাছে পুলিশ তাকে ফাঁসিয়ে দেয়।”

“যে-সব এন.জি.ও ওই এলাকাতে কাজ করে তাদের সাহায্য নাও না। তাদের কেউ যদি কিছু জানাতে পারে।”

রাখাল দত্ত এটা ভাবেননি। “ঠিক আছে স্যার, কয়েকটা গ্রুপকে চিনি –তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।”

“আর কী জেনেছ অরূপ চৌধুরী সম্পর্কে?”

“অরূপ সম্পর্কে অনেক খবর জানি,” রাখাল দত্ত বললেন। “এমনিতে মিশুকে লোক ছিল, কিন্তু তেমন ভাবে গভীর ঘনিষ্ঠতা কারোর সঙ্গে ছিল না। বাইপাসের উপর একটা মাল্টিস্টোরি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে একা থাকত। বিয়ে করেছিল, কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় কয়েক বছরের মধ্যেই ডিভোর্স হয়ে যায়। রেস্টুরেন্টের ব্যবসায় নেমেছিল বছর পাঁচেক আগে, তার আগে ইন্সিওরেন্স বেচত। ‘দ্য নাইট’ রেস্টুরেন্টটা এক সময়ে ওর মাসি-মেসোর ছিল। নামেই মাসি-মেসোর, আসলে মেসোর। মেসো ছিলেন বিহার ক্যাডারের আইপিএস অফিসার। টু-পাইস নিশ্চয় কামিয়েছিলেন, নইলে কলকাতায় ওরকম একটা ফাইভ-স্টার রেস্টুরেন্ট খোলার ক্ষমতা অরূপের হত না। যাইহোক, মাসির কোনো ছেলেপুলে না থাকায়, মাসির অংশটা অরূপকে দান করেন। মেসো বেশ কয়েক বছর হল রিটায়ার করেছেন। এখন বৃদ্ধ মাসি-মেসো কলকাতার লেক টাউনে একটা বাড়ি করে রয়েছেন।”

“আমি সত্যিই মুগ্ধ,” একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন। “এর মধ্যেই তুমি এত সব খবর জেনে ফেলেছ!”

“তার কারণ ওঁর এক্স-ওয়াইফ ললিতা রায়কে আমি বিয়ের আগে থেকেই চিনি। আমাদের পাড়ায় এক সময়ে থাকত। প্রেম করে ওদের বিয়ে হয়েছিল। ডিভোর্সের পরে ওরা কেউই আর বিয়ে করেনি। ললিতা সল্টলেকে পৈতৃক বাড়িতেই আছে। বেচারা খুবই আপসেট। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও, ওদের মধ্যে খুব একটা তিক্ততা ছিল না।”

“ডিভোর্স হবার পরেও ভালো রিলেশন! সচরাচর এটা বেশি দেখা যায় না। ডিভোর্স হয়েছিল কেন?”

“মিউচুয়াল কনসেন্ট।” রাখাল দত্ত একেনবউদি কাছাকাছি আছেন কিনা দেখে একটু ইতস্তত করে বললেন, “আমার ধারণা অরূপ ওয়াজ ইম্পোটেন্ট।”

“ইম্পোটেন্ট!”

“কথায় কথায় ললিতা একবার ওরকমই একটা হিন্ট দিয়েছিল– ফিজিক্যাল নয়, সাইকোলজিক্যাল কোনো প্রব্লেম।”

“তোমার সঙ্গে তো ভাই এই ললিতা ম্যাডামের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মনে হচ্ছে!” একেনবাবু একটু ফাজলামি করেই বললেন। রাখাল দত্ত লজ্জা পেলেন। “স্যার, আমরা ছোটোবেলা থেকে বন্ধু।”

“তারমানে তুমি অরূপকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনো।”

“চিনি মানে…।”

“উত্তর দিতে না চাইলে দিও না ভাই।”

“আসলে স্যার,” রাখাল দত্ত আবার একটু ইতস্তত করলেন, “ললিতা যখন অরূপের সঙ্গে প্রেম করা শুরু করেছিল, তখন আমি ওর জীবন থেকে একটু সরে গিয়েছিলাম। ওর ডিভোর্সের পর আবার যোগাযোগ হয়।”

“আই সি।” একেনবাবু এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে রাখাল দত্তকে বিব্রত করলেন না। বললেন, “অরূপ চৌধুরীর বিয়ের আগের জীবন সম্পর্কে কিছু জানো?”

“ললিতার কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি, অরূপ খুব ছোটো বয়সেই বাবা-মাকে হারায়। ওর স্কুল কলেজ সব কিছু কলকাতার বোর্ডিং স্কুল আর হস্টেলে থেকে। খরচ জোগাতেন মেসো। ছুটি-ছাটাতে ওঁদের কাছে গিয়ে অরূপ থাকত। মাসি-মেসো নিজের ছেলের মতো করেই ওকে বড়ো করেছিলেন। বাবা-মাকে হারানোর জন্যেই বোধহয় ছেলেবেলার স্মৃতি নিয়ে কোনো কথাই অরূপ বলত না।”

একেনবাবু কিছু বললেন না, চোখ বুজে পা নাচাতে লাগলেন।

“ও আরেকটা ব্যাপার,” রাখাল দত্ত বললেন। “তবে মনে হয় না তেমন ইম্পর্টেন্ট বলে।”

“কী?” পা নাচানো থামিয়ে একেনবাবু চোখ খুললেন।

“ললিতার সঙ্গে অরূপের মাসি-মেসোর এখনও খুব যোগাযোগ আছে। মেসো বোধহয় ডিমেনশিয়া বা ওরকম কিছুতে ভুগছেন। ক্ষণে ক্ষণেই সব ভুলে যান। হঠাৎ ভীষণ ভয় পেতে শুরু করেছেন উনি খুন হবেন ভেবে। এরমধ্যে লেক টাউনের পুলিশকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন। কেন এই অহেতুক ভয়, সেটা অবশ্য বলতে পারেননি। ললিতাকেও ওঁর ভয়ের কথা জানিয়েছেন।”

উনি খুন হবেন বলে ভয় পাচ্ছেন, অথচ খুন হলেন শালির ছেলে! দ্যাটস ইন্টারেস্টিং, বাট মেকস নো সেন্স!” একেনবাবু আবার পা নাচাতে শুরু করলেন।

“হ্যাঁ, তাই বলছি ব্যাপারটা মনে হয় আন-রিলেটেড। ডিমেনশিয়া বা ওই ধরনের রোগে ভুগলে অনেক সময়ে লোকে প্যারানয়াতেও ভোগে, ভাবে কেউ কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।”

“আমিও তাই শুনেছি। তাছাড়া যাঁরা খুন হয়েছেন সবাই এক বয়সি। অরূপবাবুর মেসো ডাজ নট ফল ইন দ্য সেইম ক্যাটেগোরি অফ ভিক্টিমস।” বলে চেয়ার থেকে উঠে সামনের দেরাজ খুলে একটা সিগারেট প্যাকেট নিয়ে এলেন একেনবাবু। একটা সিগারেট বের করে সেটা ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে বললেন, “ব্যাড হ্যাবিট ভায়া, ওদেশে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখানে এসে আবার একটা-দুটো খাচ্ছি।”

রাখাল দত্ত সিগারেটের ধোঁয়া একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। ধোঁয়ার সামনে থেকে মুখটা সরালেন, তাও কাশি এল।

একেনবাবু সেটা দেখে বললেন, “বদার করছ ভাই, তাই না?”

রাখাল দত্ত ভদ্রতা করে কিছু বললেন না।

“নাঃ, আর খাব না। নিউ ইয়র্কে গেলে তো সেই ছাড়তেই হবে। একটা শেষ টান দিয়ে একেনবাবু অ্যাশট্রেতে সিগারেটটা খুঁজতে খুঁজতে বললেন, “দেয়ার হ্যাস টু বি এ কানেকশন… এবারেও যদি ব্যালিস্টিক অ্যানালিসিসের রেজাল্ট এক হয়, তারমানে সবাই। এক হ্যান্ডগানের গুলিতেই মারা গেছে… ভাই রাখাল, উই আর মিসিং সামথিং… মিসিং সামথিং বিগ! খুনগুলোর মধ্যে কানেকশনটা কোথায়? সেটা বার করতেই হবে। ভালোকথা, অরূপবাবুর মেসো-মাসি মারা গেলে ওঁদের বাড়িটা কে পাবে?”

“ললিতার কাছে যা শুনেছি, তাতে বেঁচে থাকলে অরূপই পেত। ললিতার সঙ্গে অরূপের ছাড়াছাড়ি হবার পর ওঁরা একটা নতুন উইল করেছেন, তাতে ললিতার জন্যে কিছু ক্যাশ টাকার প্রভিশন আছে। বাদবাকি সব অরূপের।”

“নাউ হি ইজ গন, এখন কী হবে?”

“হয়তো নতুন করে একটা উইল করবেন। কে বলতে পারে?”

“আচ্ছা এই তিনজন– বিকাশ সেন, তন্ময় দত্ত আর অরূপ চৌধুরী— এঁরা কি সবাই বন্ধু?”

“সেটাই খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি। ললিতা বলেছে অরূপ বিকাশকে চিনত। ছেলেবেলায় যখন ও ছুটিতে মাসি-মেসোর কাছে যেত, তখনই হয়তো পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু বিকাশকে ও পছন্দ করত না, বলত বাজে ক্যারেক্টার। তাই দুই পরিবারের মধ্যে কোনো যোগাযোগ হয়নি।”

“বাজে ক্যারেক্টার মানে?”

“সেটা ললিতা জানে না।”

“হাউ অ্যাবাউট তন্ময় দত্ত?”

“না, ওঁর কথা ললিতা শোনেনি।”

“মনীষা সেনকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছ?”

“এখনও করিনি। তবে আমি ভাবছি, যদি ওঁরা বন্ধুও হন, সো হোয়াট? আমাদের দরকার ওঁদের শত্রুর।”

 “এটা মন্দ বলোনি ভাই, সো হোয়াট,” একেনবাবু পা নাচাতে নাচাতে বললেন। “যেটা ইন্টারেস্টিং সেটা হল বিকাশবাবু আর অরূপবাবু দুজনের মধ্যে ছেলেবেলায় হলেও একটা পরিচয় ছিল, যদিও পরে যোগাযোগটা আর থাকে না। কিন্তু তন্ময় দত্তের সঙ্গে ওঁদের কোনো যোগাযোগের সূত্র তো মিলছে না।”

“ঠিক।”

“কিন্তু জানো রাখাল, তুমি যা বললে সেটাই ঠিক।”

“তার মানে?”

“খুঁজতে হবে এঁদের কমন শত্রু। এঁরা পরিচিত না অপরিচিত বড়ো কথা নয়।”

 রাখাল দত্ত চলে যাবার পর একেনবাবু ভাবতে থাকলেন ১/৪, ১/২, ৭৫– তিনটে সংখ্যার মধ্যে মিলটা কোথায়? বহু ভেবেও কূল কিনারা পেলেন না। নম্বরগুলো মাথার মধ্যে তালগোল পাকাতে লাগল।

“দেখেছ কাণ্ড!” একেনবউদির কথায় সম্বিত এল।

“কী কাণ্ড?”

“দোলা যে ব্যাগটা দিয়েছে তার মধ্যে একটা এক্সারসাইজ খাতা চলে এসেছে।”

“দেখি।”

খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলেন সেখানে কাঁচা হাতে পেন্সিল দিয়ে চিত্র-বিচিত্র ছবি আঁকা। নিশ্চয় সেই বাচ্চা ছেলেটার আঁকা ছবি। দোলার কাছে যখন এসেছিল, নিশ্চয় ব্যাগের ওপর খাতাটা রেখেছিল। ব্যাগটা তোলার সময়ে সেটা ভেতরে ঢুকে গেছে। অন্যমনস্ক ভাবেই ছবিগুলো দেখতে লাগলেন একেনবাবু। হঠাৎ একটা ছবিতে এসে ওঁর চোখ আটকে গেল। হাওয়াই শার্ট পরা রোগা বেঁটে খাড়া খাড়া চুল একটা লোক চেক শার্ট পরা চশমা চোখে একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। আরে, এতো মনে হচ্ছে ওঁকে আঁকা হয়েছে! হেল্পার ছেলেটাকে যখন মলয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন তার স্কেচ! উচ্চ স্তরের আঁকা নয়, তবে বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটিয়েছে ঠিক। আগের পাতাটা খুললেন একেনবাবু। একজন মেয়ে হ্যান্ডব্যাগ খুলে টাকা বার করছে বা ঢোকাচ্ছে। হাতে প্লাস্টার করা একটা ছেলে সামনে। যে হাতে প্লাস্টার নেই, সে হাতটা এগিয়ে ধরা। মাই গড! এটা নিশ্চয় মলয় আর মল্লিকার ছবি! হয় মল্লিকা মলয়কে টাকা দিচ্ছে অথবা মলয় দিচ্ছে মল্লিকাকে। মোস্ট ইন্টারেস্টিং!

.

গভীর রাতে নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন এল। অবনী গুপ্তের ফোন। কদুর প্রোগ্রেস হয়েছে জানতে চাইলেন। বিশেষ কিছু এগোয়নি, জানালেন একেনবাবু। তবে আরও দুটো খুনের জন্যে শুধু বিকাশ সেনকে নিয়ে পত্র-পত্রিকা মাথা ঘামাচ্ছে না। অ্যাটেনশানটা আপাতত শেষ খুনের ওপর। অবনী গুপ্তের পক্ষে সেটা অবশ্যই স্বস্তির কথা। ফোন শেষ হতেই ‘দুত্তোর’ বলে একেনবাবু শুয়ে পড়লেন। শুলেন বটে, কিন্তু রাত্রে ভালো ঘুম হল না। নানান চিন্তায় মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে গেল। সকালের দিকে চেষ্টা করলেন কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে, যদি একটু ঘুম আসে। কিন্তু কলকাতায় কি সেটা হবার জো আছে! সকাল থেকে রাস্তায় চেঁচামেচি, বাড়িতে কাজের লোকদের তাণ্ডব, গাড়ির হর্ন, ফেরিওয়ালাদের চিৎকার। এক কালে হয়তো এর মধ্যেও ঘুমোতে পারতেন। ম্যানহাটানে কয়েক বছর থেকে সে অভ্যাস চলে গেছে।

.

১১.

[একেনবাবুর সঙ্গে আমাদের ফোনে প্রায়ই কথা হত আগেই বলেছি। ফোনটা আমরাই করতাম সাধারণত। নিউ ইয়র্কের রাত্রে ফোন করলে কলকাতায় সেটা সকাল। একেনবাবু তন্ময় দত্ত সম্পর্কে আমাদের খোঁজখবর নিতে বলেছিলেন। উনি নিউ ইয়র্কের সেন্ট জন’স ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন, সেটা আগেই বার করেছিলাম। যেটা নতুন আবিষ্কার সেটা হল নিউ ইয়র্ক স্টেট বোর্ড অফ ফার্মাসির একজন মেম্বার ছিলেন তন্ময় দত্ত। এই বোর্ডের কাজ হল ওষুধপত্রের দোকানগুলোর ওপর নজরদারি করা এবং যারা ওষুধগুলো বিক্রি করছে, তাদের যোগ্যতা যাচাই করা। সেই সূত্রে অবনী গুপ্তের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। একেনবাবুকে রাত্রে ফোন করলাম। মনে হল একেনবাবু খবরটা জেনে খুশি হলেন। বার বার জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি শিওর স্যার?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে স্যার, আমি একটু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে ফোন করি।” বলে হঠাৎ লাইনটা কেটে দিলেন।]

.

সকালে চা নিয়ে বিকাশ সেনের ব্যাপারটা একেনবাবু নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। এরমধ্যে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে একটু কথা হল। মারাত্মক একটা খবর! অবনী গুপ্তের দুটো ওষুধের দোকানে নানা রকম অনিয়ম ধরা পড়েছে। পুলিশ স্টেট বোর্ড অফ ফার্মেসির সঙ্গে যোগাযোগ করে এ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে কিছুদিন আগে। বোর্ড থেকে যিনি এ ব্যাপারে পুলিশের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করেছিলেন তিনি হলেন তন্ময় দত্ত। ক্রেতাদের অভিযোগ পেয়ে বোর্ডের তরফ থেকে উনিই প্রথম তদন্ত শুরু করেন। এ ব্যাপারে তিনিই প্রধান সাক্ষী। ব্যাপারটা কোথায় গড়াবে এক্ষুনি বলা যায় না, তবে যতদূরই গড়াক, অবনী গুপ্তের পক্ষে সেটা প্রীতিপ্রদ হবে না। তন্ময় দত্তের মৃত্যুতে অবনী গুপ্তের কিছুটা সুবিধা নিশ্চয় হল। কিন্তু তন্ময় দত্তের খুনে অবনী গুপ্তের হাত থাকা! একটা উদ্ভট চিন্তা। নিউ ইয়র্কে বসে অবনী গুপ্ত কলকাতায় তিন-তিনটে লোককে মারতে যাবেন কেন? বিকাশ সেন ওঁর কোম্পানিকে এখানে প্রোমোট করছে। তাঁকে মেরে লাভ কী? আর সোনাগাছিতে বডি ফেলে আসার যুক্তিটাই বা কী?

আচ্ছা, তন্ময় দত্তর কি অবনী গুপ্তের ওপর কোনো রাগ আছে– আগের কোনো একটা ব্যাপারে, যার জন্য এত উদ্যম নিয়ে তন্ময়বাবু এই সব অনিয়ম খুঁজতে শুরু করেছিলেন? ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট কি একটু খোঁজ নিয়ে জানাবেন? সেই অনুরোধটাই করলেন একেনবাবু। আর কিছু না হোক, দু-জনের রেসিউমি পেলে অন্তত বোঝা যাবে আগে কোথাও এদের যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল কিনা। যাইহোক, এই মুহূর্তে এটা অবশ্য এমন কিছু ইম্পর্টেন্ট নয়।

এসব ভাবনা চিন্তার মাঝখানেই বাইরে কে জানি হর্ন বাজাল। একেনবাবু জানলা দিয়ে দিয়ে দেখলেন ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে গেছে। তখন মনে পড়ল, বড়োপিসি অসুস্থ হয়ে ভবানীপুরের এক নার্সিং হোমে। খবরটা রাত্রে যখন এসেছিল ভিজিটিং আওয়ার্স তখন বন্ধ হয়ে গেছে। ফোন করে সকাল সকাল উনিই গাড়িটাকে আসতে বলেছিলেন। আমাদের ফোন পেয়ে আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে কথা বলে সেটা বেমালুম ভুলে গেছেন!

জামাকাপড় পরে যখন রেডি হচ্ছেন, তখন একেবউদি বললেন, “তুমি যখন ওদিকে যাচ্ছ, তাহলে আরেকটা কাজ করো। দোলার কাছ থেকে দু-বছরের বাচ্চা মেয়ের জন্য সুন্দর দেখে একটা ফ্রক নিয়ে এসো।”

এই ধরনের অনুরোধকে একেনবাবু সবচেয়ে ভয় পান। প্রথমত সাইজ সম্পর্কে ওঁর কোনো ধারণাই নেই, আর সৌন্দর্যবোধও ওঁর স্ট্রং পয়েন্ট নয়। “ফ্রক নিয়ে কী করবে?”

“টুলুর মেয়ের জন্মদিন।”

টুলু কে? একেনবাবু ঠিক মনে করতে পারলেন না। “টাকা দিয়ে দিলে হত না? ওরা পছন্দমতো কিনে নিত।”

“টাকা দিলে আজকাল দুশো-তিনশো দেওয়া যায় নাকি? আর কিনবে তো দোলার কাছ থেকে, ও কম করে দাম নেবে।”

এই চালে একেনবাবু মাত হলেন।

“তোমায় ভাবতে হবে না, আমি দোলাকে বলে দিয়েছি, ও নিজে পছন্দ করে তোমাকে একটা কিছু দিয়ে দেবে। তুমি শুধু নিয়ে আসবে। পয়সা আমি পরে দিয়ে দেব।”

বাঁচা গেছে! একেনবাবু নিশ্চিন্ত হলেন। “তা এটা বললেই তো পারতে –দোলার বাড়িতে গিয়ে একটা জিনিস নিয়ে এসো।”

“বললে তো তুমি কত শোনো! প্রমথবাবুর পাঠানো ছবিটা তো এখনও টাঙিয়ে উঠতে পারলে না!”

“এই যাঃ, একেবারেই খেয়াল ছিল না।”

“আমি ওটাকে বাইরের ঘরে টেবিলের ওপরে রেখে দিচ্ছি.. যাতে তোমার খেয়াল হয়।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে,” বলে একেনবাবু বেরিয়ে গেলেন।

.

নার্সিং হোমটা আশুতোষ মুখার্জী রোডে, বেলতলা আর হাজরা রোড ক্রসিং-এর মাঝামাঝি জায়গায়। পিসি ঘুমোচ্ছেন। পিসতুতো দুই ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে একেনবাবু হাজরা রোড ধরে দোলার বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। পথেই পড়ল নফর কুণ্ডু লেন। গাড়িটা সেখানে ঘুরিয়ে রাস্তায় দাঁড় করাতে বললেন একেনবাবু। গরম ভাত’ রেস্টুরেন্টের সাইনটা বড়ো করে টাঙানো। রেস্টুরেন্টের সামনে রাস্তায় গোটা দুই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অরূপ চৌধুরীর মৃত্যুর পর রেস্টুরেন্টটা বন্ধ ছিল বলে পত্রিকায় পড়েছিলেন। হয়তো আবার খুলেছে। একেনবাবু ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাড়ে এগারোটা। একটু না হয় দেরিই হবে দোলার ওখানে যেতে। গাড়ি দুটোর পিছনে ড্রাইভারকে গাড়ি রাখতে বলে একেনবাবু নেমে পড়লেন। কাচের বড়ো দরজা। ভেতরটা দেখা যাচ্ছে, বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একেনবাবু সামনে যেতেই পাশে দাঁড়ানো দারোয়ান দরজা খুলে দিল। ভালো করে ব্রেকফাস্ট করে একেনবাবু বেরিয়েছেন খাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাও ঢুকে পড়লেন।

টেবিল বেশি নেই। সেগুলো হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায় মতন করে সাজানো, একটার ঘাড়ে আরেকটা নয়। ওয়েটার মেনু দিতে যাচ্ছিল সেটা হাতে না নিয়ে শুধু কফি অর্ডার করলেন। রেস্টুরেন্টটা একেবারেই ফাঁকা। দূরে কোণের টেবিলে এক কপোত-কপোতি বসে আছে, ব্যাস। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের বয়স বড়োজোর বছর পঁচিশেক হবে। নাম সত্যব্রত, কথা বলতে ভালোবাসে। নিজেই এগিয়ে গল্প জুড়ল একেনবাবুর সঙ্গে।

“আপনি আগে এসেছেন এখানে?”

একেনবাবু মাথা নাড়লেন, “না। আসলে স্যার, বাইরে থেকে দেখে বেশ লাগল, তাই ঢুকে পড়লাম। খুব সাজানো গোছানো ভেতরটা।”

“আমাদের খাবার স্যার আরও ভালো। আরেকদিন এসে খেয়ে দেখবেন ঠিক বললাম কিনা। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সব কিছুই পাবেন।”

“আসব স্যার, আসব। আপনিই এটার ম্যানেজার?”

“না, না, আমি অ্যাসিস্টেন্ট। তবে আমিই এটা চালাই।” কথায় গর্বের ভাব।

একেনবাবু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন দেখে, ছেলেটি বলল, “ক’দিন রেস্টুরেন্টটা বন্ধ ছিল। আজকে যে ভোলা হচ্ছে অনেকেই জানেন না, ভিড়টা তাই কম। নইলে এখানে সকাল থেকেই হাউস-ফুল।”

“তাহলে তো আমি লাকি স্যার, বেশ ফাঁকায় ফাঁকায় খাচ্ছি। আচ্ছা, রেস্টুরেন্টটা বন্ধ ছিল কেন?”

“সেকি, আপনি শোনেননি! আমাদের মালিক অরূপ চৌধুরীর খুন নিয়ে তো হইচই চলছে এখন!”

“ও মাই গড! হ্যাঁ, হ্যাঁ, পত্রিকায় পড়েছিলাম বটে,” একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন। “ভেরি স্যাড ব্যাপার।”

“আমরা তো ভয় পাচ্ছিলাম রেস্টুরেন্ট উঠেই যাবে, কিন্তু কালকে অর্ডার এল রেস্টুরেন্ট চালু রাখতে হবে।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান স্যার, আপনাদের মালিক তো নেই– তাহলে অর্ডারটা কে দিলেন?”

“দেবু-দা, মানে দেবু সেন– উনিই আমাদের ম্যানেজার। স্যার ‘দ্য নাইট’ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, এখানে বা বেহালায় খুব একটা আসতেন না। ঘুরে ঘুরে দুটো রেস্টুরেন্ট দেখাশোনা দেবু-দাই বরাবর করেছেন।”

“বেহালা!” একেনবাবু অবাক হওয়ার ভান করলেন।

 “‘গরম ভাত’-এর একটা ব্রাঞ্চ বেহালাতে আছে।”

“আই সি। কিন্তু আমি একটু কনফিউসড স্যার। দেবুবাবু আপনাদের বস বুঝতে পারছি, কিন্তু আপনাদের আসল মালিক এখন কে?

“দেবু-দা সেটা ভালো বলতে পারবেন। আমি যা শুনেছি এই রেস্টুরেন্টগুলোর মালিকানা স্যারের আর স্যারের মেশোর। “

“স্যারের মেসাও কি এখানে মাঝে মাঝে আসেন?”

“না স্যার, উনি শুনেছি খুব অসুস্থ। সত্যি কথা বলতে কি, আমি ওঁকে চিনিও না। দেবু-দাকে গতকাল ওঁর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। দেবু-দা বললেন, ওসব নিয়ে মাথা না ঘামাতে। আমার তাতে কোনো অসুবিধা নেই। স্যার’ যখন ছিলেন তখনও দেবু-দার সঙ্গেই ডিল করতাম। ক্যাশ কালেকশন থেকে মাইনেপত্র দেওয়া, সব কিছু দেবু-দাই দেখাশোনা করতেন।”

“তা এখন আপনার কী মনে হচ্ছে? রেস্টুরেন্টটা ঠিকঠাকই চলবে, উঠে যাবে না তো?”

“না, না, উঠে যাবে কেন, দেবু-দা তো আছেন। আমাদের সবাইকে ডেকে ভরসা দিয়ে গেছেন, নট টু ওয়ারি। আসলে দেবু-দার অনেক কানেকশন আছে। এই দেখুন না, রেস্টুরেন্টে কত ছবি টাঙানো আছে, এঁরা সব এখানে খেয়ে গেছেন। দেবু-দা সবাইকে চেনেন।”

“বাঃ,” একেনবাবু উঠে ছবিগুলো দেখলেন। বহু খ্যাতনামা লোক — সিনেমা স্টার, পলিটিশিয়ান, আর্টিস্টদের রেস্টুরেন্টে বসে খাবার ছবি। একটা ফটোতে যাঁকে দেখলেন, তাঁকে কিন্তু দেখবেন বলে আশা করেননি। তন্ময় দত্ত!

ছবিটা দেখিয়ে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ইনি কে?”

“এঁকে ঠিক চিনতে পারছি না। আসলে অনেক কাস্টমারের ছবি এখানে আছে, সবাই। ফেমাস নন।”

“এগুলো কি স্যার পুরোনো ছবি?”

“হ্যাঁ, আমার এখানে আসার আগে থেকেই আছে।

“তা আপনি স্যার এখানে কতদিন আছেন?”

একেনবাবুর ‘স্যার স্যার’ শুনে ছেলেটি বোধহয় অস্বস্তি বোধ করছিল। এবার বলেই ফেলল, “আমাকে বার বার ‘স্যার’ বলছেন কেন স্যার?”

“ওটা আমার অভ্যাস স্যার, চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারি না। ও হ্যাঁ, যা বলতে যাচ্ছিলাম… এত সুন্দর করে রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছেন, আপনি কত বছর এখানে আছেন?”

“এই রেস্টুরেন্টে কাজ করছি মাস তিনেক। তার আগে পর্ণশ্রীর রেস্টুরেন্টের ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার ছিলাম। সেখানেও মাত্র এক বছর ছিলাম। এত তাড়াতাড়ি হঠাৎ প্রোমোশন পেয়ে যাব আশাই করিনি।” আবার বেশ গর্বের সঙ্গে ছেলেটি বলল।

ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার কথাটা একেনবাবু আগে শোনেননি। তবে কিনা ইংরেজিতে ডেপুটি, জয়েন্ট, অ্যাসিস্টেন্ট আর অ্যাসোসিয়েট দিয়ে পারমুটেশন কম্বিনেশন করে অনেক পদই বার করা যায়। ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট, অ্যাসিস্টেন্ট ডেপুটি, অ্যাসোসিয়েট ডেপুটি, অ্যাসোসিয়েট অ্যাসিস্টেন্ট ইত্যাদি।

“ওয়ান্ডারফুল স্যার, এক বছরের মধ্যে ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট’ থেকে ‘অ্যাসিস্টেন্ট’! আপনি স্যার নিশ্চয় খুব কম্পিটেন্ট ম্যানেজার!”

“আসলে সবই ভাগ্য।” ছেলেটি বলল। “আগে এই ব্রাঞ্চটার অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার ছিলেন মিস মল্লিকা। স্যার হঠাৎ খোঁজ পেলেন ওঁর ক্যারেক্টার খারাপ।”

“খারাপ”

“কল গার্ল। দিনে রেস্টুরেন্ট চালাতেন, রাত্রে লোকদের… বুঝতে পারছেন তো স্যার কি বলছি?”।

একেনবাবু সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।

“আমার ধারণা এখানকার খরিদ্দারদেরও কেউ কেউ রাতে মিস মল্লিকার খদ্দের ছিলেন। সেই নিয়ে একদিন স্যারের সঙ্গে মিস মল্লিকার ফাটাফাটি হয়ে যায়। স্যার সঙ্গে সঙ্গে ওকে বরখাস্ত করে দেবু-দাকে বলে আমাকে এখানে নিয়ে আসেন।”

একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “মিস মল্লিকার পুরো নামটা জানেন স্যার?”

“না, পদবি-টা জানি না। মল্লিকা ম্যাডাম বলেই সবাই এখানে চিনত।”

“এখানে আর কেউ আছেন স্যার, যিনি সেই সময়ে এখানে কাজ করতেন?”

“না, আমি আসার পর ‘স্যার’-এর হুকুমে সবাইকে ছাঁটাই করতে হয়। বহু কর্মচারী মিস মল্লিকাকে পছন্দ করত। সেই জন্যেই মনে হয়। দেবু-দা অবশ্য সবার জন্যেই ‘স্যার’-এর কাছে তদবির করেছিলেন, স্যার’ কাউকে রাখতে রাজি হননি।”

“যারা আগে এখানে ছিল, তাদের কাউকে আপনি চেনেন স্যার?”

“একজনকে চিনি। হাজরার রোডের উলটোদিকে যে ধাবাটা আছে, সেখানে ছেলেটা কাজ করছে।”

“কী নাম?”

“বলরাম। ছেলেটা ভালো, মাঝে মাঝে আসে আমার কাছে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।” একেনবাবু কফির দাম চুকিয়ে উঠে পড়লেন।

.

‘গরম ভাত’ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ি করে হাজরা রোডের সেই ধাবার সামনে গিয়ে নামলেন। বাবার মালিককে নিজের পুরোনো পুলিশি পরিচয় দিয়ে খোঁজ করলেন বলরামের। কয়েক মিনিটের মধ্যে বছর কুড়ি বয়সের একটি ছেলে বাইরে বেরিয়ে এল। বলরামের কাছ থেকে যা উদ্ধার করলেন, তা একটু আগে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের কাছেই শুনেছিলেন। বলরাম শুধু যোগ করল, মল্লিকা ম্যাডামও ছেড়ে কথা বলেননি। বসকে বলেছিলেন এর ফল ভোগ করতে হবে।

“মল্লিকা ম্যাডামকে তুমি কতদিন চেনো ভাই?”

“প্রায় দু-বছর। ম্যাডাম আমাকে চাকরি দিয়েছিলেন। আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। স্যার ওঁকে মিথ্যে মিথ্যে তাড়িয়েছিলেন। আমার মনে হয়, অন্য কোনো কারণ ছিল।”

“কী কারণ?”

“তা বলতে পারব না। আমি চলি বাবু, বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে মালিক রাগ করবেন।” একেনবাবুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলরাম চলে গেল।

.

ফিরে এসে গাড়িতে উঠে দোলার বাড়ির দিকে যেতে যেতে একেনবাবু ভাবতে লাগলেন, মল্লিকাকে যে-রকম সোজা সহজ ভেবেছিলেন, মোটেই তা নয়। অরূপ চৌধুরী আর বিকাশ সেন, দু-জনের ওপরেই যে মল্লিকার রাগ ছিল সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মল্লিকার নিজের পক্ষে এদের একজনকেও খুন করা সম্ভব নয়। কিন্তু নিজের মোহিনী শক্তি দিয়ে অন্য কাউকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা নিশ্চয় তার আছে। মাথাফাটা রতনও এর মধ্যে জড়িত থাকতে পারে। আর মলয়ের সঙ্গে টাকার লেনদেনের যে ব্যাপারটা মেলায় ঘটল, সেটা কী? মলয়কেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় না। হোয়াট অ্যাবাউট দেবু সেন? মল্লিকাকে নিশ্চয় সেই নিযুক্ত করেছিল। সেও কি মল্লিকার বন্ধু? আগে না হলেও রেস্টুরেন্টের সূত্রে নিশ্চয় ভালোই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দেবু সেনের একটা ফাইনানশিয়াল ইন্টারেস্ট থাকতে পারে অরূপ চৌধুরীকে খতম করার। অরূপ চৌধুরীর মেসোকে টাকাকড়ি নিয়ে ধোঁকা দেওয়া নিশ্চয় অপেক্ষাকৃত সহজ। খোঁজ নিতে হবে ‘দ্য নাইট’-ও এখন দেবু সেন দেখছে কিনা! সত্যিকারের ইনকাম তো সেখান থেকেই। সমস্যা হল তিনটে খুন মেলাতে গেলেই জটিলতা। হ্যাঁ, মল্লিকাকে ‘কল গার্ল’ বলার প্রতিশোধ নিতে ডেডবডি দুটোকে সোনাগাছি বা ওয়াটগঞ্জ এলাকায় ফেলে আসার মধ্যে একটা প্রতীকি ব্যাপার থাকতে পারে, যদিও তাতে ধরা পড়ার রিস্কটাও বহুগুণ বেশি। তর্কের খাতিরে না হয় সেটা মানা গেল। কিন্তু তন্ময় দত্তকে খুন করার কী মোটিভ থাকতে পারে মল্লিকা দেবু সেনের? তন্ময় দত্ত যে ‘গরম ভাত’-এ খেতে এসেছেন রেস্টুরেন্টের একটা ফটো তার প্রমাণ। তন্ময়ের সঙ্গে কি মল্লিকার প্রথম আলাপ এই ‘গরম ভাত’-এই হয়েছিল? দুজনের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল? তন্ময় দত্ত যে দেরি করে বাড়ি ফিরতেন, তার সঙ্গে কি মল্লিকা জড়িত? প্রশ্ন অনেক, অভাব উত্তরের। তবে এই তিনটি মৃত যুবকের কমন লিঙ্ক যে মল্লিকা, সেই সন্দেহ এখন জোরদার হচ্ছে।

চিন্তায় ছেদ পড়ল। আবার রাখাল দত্তের ফোন।

“স্যার আপনি কোথায়? আমি দুটো নাগাদ আপনার বাড়ি আসছি ক্রাইম সিন-এ পাওয়া কাগজগুলোর কপি নিয়ে।”

“আমি এখন বাড়ি নেই, কিন্তু তুমি আসার আগেই চলে আসব।”

“একটা বড়ো খবর দিই, ওয়াটগঞ্জ এলাকার এক এন.জি.ও জানিয়েছে এক সেক্স ওয়ার্কার অনেক রাতে দু-জন লোককে কালো গাড়ি থেকে বড়োসড়ো কিছু টেনে নামাতে দেখেছিল, কিন্তু এক খদ্দের এসে পড়ায় কী নামাচ্ছে দেখেনি! পরের দিন সকালে জেনেছে ওটা একটা বডি ছিল।”

“এতদিন কথাটা বলেনি কেন?”

“কারণ ওর বাড়িওয়ালী মাসি ঝামেলা করবে বলে পুলিশকে কিছু জানায়নি।“

“গাড়ির নম্বর কী বা কী ধরনের গাড়ি কিছু বলতে পেরেছে?”

“না, মেয়েটা গাড়ি-টাড়ি চেনে না। তবে এর সঙ্গে আরেকটা খবর হল হায়দ্রাবাদের এক কনট্র্যাক্ট কিলার রমেশবাবু দিন পঁচিশ হল কলকাতায় এসে আস্তানা গেড়েছে। ওর বিরুদ্ধে অন্ধ্রপ্রদেশে অনেক খুন-খারাপির অভিযোগ রয়েছে, কোনোটাই প্রমাণ করা যায়নি। এখানে এসে সে একটা কালো টাটা সুমো ভাড়া করেছে। অরূপ চৌধুরীর মৃত্যুর সঙ্গেও টাটা-সুমো জড়িত। এখন খোঁজ করছি বিকাশবাবু যেদিন মারা যান, সেদিন সোনাগাছিতে কেউ কালো টাটা সুমো দেখেছে কিনা। না দেখে থাকলেও মনে হচ্ছে দাদা, উই আর গেটিং ক্লোজ টু সলভিং দ্য মিস্ট্রি।”

“আমি অবশ্য ভাই এখনও কনফিউসড।”

“কেন দাদা?”

“ধরলাম, রমেশবাবুর দলই খুনগুলো করছে। কিন্তু এই রমেশবাবুকে কাজে লাগিয়েছে। কে? কেনই বা লাগিয়েছে?”

“মানছি স্যার, সেটাই বার করতে হবে। রমেশবাবুর গতিবিধির উপর আমরা নজর রাখছি।”

“গুড। তবে আরও দুটো জিনিস করো ভাই। এক হল, তন্ময় দত্তের একটা ছবি নিয়ে হাজরা রোডে ‘গরম ভাত’ রেস্টুরেন্টের কাছে যে ধাবাটা আছে, সেখানে যাও। ওখানে বলরাম বলে যে ছেলেটি কাজ করে, সে তন্ময় দত্তকে ‘গরম ভাত’ রেস্টুরেন্টে কখনও দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করো। সেই সঙ্গে মল্লিকাকেও জেরা করতে হবে তন্ময় দত্তকে সে চিনত কিনা।”

“কী ব্যাপার দাদা, মনে হচ্ছে আপনি কিছু একটা আঁচ করছেন?”

একেনবাবু সংক্ষেপে ‘গরম ভাত’-এর অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের সঙ্গে ওঁর কথাবার্তার কথা জানালেন। তারপর বললেন, “তন্ময় দত্ত, অরূপ চৌধুরী আর বিকাশ সেনের মধ্যে একটা যোগ নিশ্চয় আছে। হয়তো সেটা মল্লিকার সূত্রেই।”

রাখাল দত্তের সঙ্গে কথা শেষ হতে হতেই একেনবাবু দোলার বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। দোলা ফ্রকটাকে প্যাক করেই রেখেছিল, কিন্তু একেনবাবু সহজে মুক্তি পেলেন না। কালকে ও পাটিসাপটা বানিয়েছে। চা সহযোগে সেটা খেতে হল। চমৎকার খেতে, তার ওপর ফ্রকের দাম নিল মাত্র ষাট টাকা!

“এত কম!”

“দিদির কাছ থেকে আবার মজুরি নেব নাকি?” তারপরেই একটা বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে দোলা বলল, “আপনাকে এই বইটা কিনতে হবে।”

বিনা পয়সায় পাটিসাপটা আর ষাট টাকায় ফ্রক পাবার পর এ ব্যাপারে আপত্তি করা যায় না। বইটা হাতে নিয়ে একেনবাবু বললেন, “কত দাম?”

“আড়াইশো টাকা। আমাদের নারী-উদ্ধার আশ্রমের বই। বিক্রির টাকা ভালো কাজে লাগবে।”

আড়াইশ! মাই গড! ফ্রক কিনতে এসে এ-রকম প্যাঁচে পড়বেন একেনবাবু ভাবেননি। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। আগে খেয়াল করেননি, এখন দেখলেন টিভি-র পাশে একটা টেবিলে স্তূপ করে সাজানো গুচ্ছের বই। ওঁর হাতে তারই একটা কপি।

সেটার দিকে আঙুল দেখিয়ে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “এতগুলো বই তুমি বিক্রি করবে?”

“হ্যাঁ, আমাদের ফান্ডরেইসিং চলছে। ওগুলোর কয়েকটা নিয়ে এখন বেরোব। আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আমায় একটু প্রিয়া সিনেমার কাছে নামিয়ে দেবেন?”

“বেশ, চলো।”

দোলা যখন কাপড়চোপড় পালটাচ্ছে, একেনবাবু সদ্য কেনা বইয়ের পাতা ওলটালেন। আশ্রমে আসা মেয়েদের কাহিনি, সবগুলোই খুব কষ্টের। একটি কমবয়সি বিধবা মেয়েকে তার দূর সম্পর্কের দেওর ফুসলিয়ে শহরে নিয়ে এসে ক’দিন ফুর্তি করে একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর পাঁচ হাত ঘুরে যখন বেচারি রাস্তায় দিন কাটাচ্ছিল, তখন কেউ দয়া পরবশ হয়ে আশ্রমে নিয়ে আসে। আরেকটি মেয়ে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষিতা হয়। মেয়েটিকে অচৈতন্য অবস্থায় জঙ্গল থেকে কয়েকজন গ্রামবাসী থানায় নিয়ে আসে। কিন্তু সেখান থেকে সে আবার পাচার হয়ে যায়। অর্থাৎ রক্ষকই ভক্ষক। চোদ্দ বছর বয়সের একটি মেয়েকে বিনাপয়সায় নার্সিং ট্রেনিং-এর বন্দোবস্ত করে দেবে বলে বস্তির এক কাকা বাড়ি থেকে নিয়ে যায়, গর্ভবতী অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয় এক পতিতাপল্লী থেকে। যাদের নিয়ে এই সংস্থার কাজ তাদের জীবনের ছোটো ছোটো নানান কাহিনি। কৃপণ হলেও একেনবাবু হৃদয়শূন্য নন। আড়াইশো টাকায় যদি এইসব মেয়েদের কিছু উপকার হয়, সেটা তো খুবই ভালো কথা। আর দোলা যে এদের জন্য এত ভাবনা চিন্তা করছে, বাস্তবিকই প্রশংসনীয়।

দোলার কফি টেবিলে চোখে পড়ল মেট্রো-র একটা রঙিন বিজ্ঞাপন। এটাই তো বাইপাসের ওপর সেদিন দেখেছিলেন! কয়েক পাতা ধরে কী কী জিনিস সেল হচ্ছে তার ফিরিস্তি। সেল প্রাইসের ওপর আবার সেল! ২৫ পার্সেন্ট অফ স্ট্যান্ডার্ড সেল প্রাইস! দেখে যা মনে হচ্ছে দামগুলো খুবই ভালো।

দোলা ঘরে আসতেই একেনবাবু বিজ্ঞাপনটা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, “এই যে দোলা ম্যাডাম, তুমি এসব পাও, আমরা তো পাই না।”

“দিদি মেম্বার নয় বলে পায় না। ওখানে যেতে গেলে ট্রেড লাইসেন্স থাকতে হয়। আপনি যাবেন? আমার সঙ্গে যেতে পারবেন।”

“একদিন গেলে মন্দ হয় না।”

.

বাড়ি ফিরে দোলার দেওয়া ফ্রকের প্যাকেটটা একেনবউদিকে দিয়ে স্নান করে তাড়াতাড়ি খেয়েও নিলেন। মেট্রো-র বিজ্ঞাপন ওঁর মাথায় একটা চিন্তা ঢুকিয়েছে। দুটোর একটু আগেই রাখাল দত্ত এসে হাজির।

“কাগজগুলোর কপি এনেছ?”

“হ্যাঁ, কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটা খবরও দিই। অর্ধেন্দুদা জানতে পেরেছে বছর কুড়ি আগে একটা ভদ্রঘরের মেয়ে গ্যাং-রেপড হয়েছিল, অচৈতন্য মেয়েটিকে গ্রামবাসীরা থানায় নিয়ে গিয়েছিল। মেয়েটির পরিচয় কেউ জানত না আর মেয়েটাও কোনো এফ-আই-আর না করে চলে যায়। এতে বিকাশ সেন জড়িত বলে একটা কানাঘুষো ছিল, এই পর্যন্তই। অনেক সময় ভিক্টিমের ফ্যামিলিই এই নিয়ে জলঘোলা করে না, সমঝোতা করে নেয়।”

“দ্যাটস এ শেইম, ভাই। ঠিক আছে এখন কাগজগুলো দেখি।”

প্রথমেই 75 লেখা কাগজটা পরীক্ষা করলেন একেনবাবু। 75-এর আগে ওপরের দিকে যেন একটা ছোট্ট ফুটকি রয়েছে। ঠিক দেখছেন কি? ওটার পাশে আঙুল রেখে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “রাখাল, এটা কী?”

“মনে তো হচ্ছে একটা ফুটকি।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং ভাই। পয়েন্ট সেভেন ফাইভ আর সেভেন ফাইভ-এ অনেক তফাৎ।”

“তা তো বটেই।”

“.75 তে দশমিকে, তার ভগ্নাংশ কী?”

 রাখাল দত্ত-র অংকের হিসেবে একটু গোলমাল লাগে, তাই চিন্তা করতে হল।

“3/4?”

“এক্সাক্টলি। প্রথম কাগজে ‘your number’-এর পরে ছিল 1/4, দ্বিতীয় কাগজে 1/2, অর্থাৎ 2/4; আর এই কাগজে .75 মানে 3/4।”

“আরে, মেসেজ তো পরিষ্কার!

“ঠিক, আর আমার তো মনে হচ্ছে এবার আরেকটা হত্যাকাণ্ড হতে চলেছে, তাহলেই /4 পূর্ণ হয়।”

“মাই গড! কিন্তু এবার কে?”

একেনবাবু উত্তর দিলেন না। একটা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস নিয়ে লেখাগুলো পড়লেন কয়েকবার। “Your number’– এ-রকম টাইপফেস কলকাতায় দেখেছ?”

“না।”

একেনবাবু চোখ বুজে পা নাড়তে নাড়তে বললেন, “বুঝলে ভাই, ভেরি ইন্টারেস্টিং। এ-রকম ছাপা অক্ষর আমি কিন্তু আগে দেখেছি। এখানে নয় নিউ ইয়র্কে, নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিনে। অবশ্য আরও অনেক ম্যাগাজিনে নিশ্চয় একই ফন্ট-ফেস ব্যবহার করা হয়।”

“খুনির কাছে ওই ম্যাগাজিনটা ছিল, এটা বুঝতে পারছি স্যার। কিন্তু এর থেকে কী প্রমাণ হয়, বিদেশের নানা ম্যাগাজিন তো পার্ক স্ট্রিটের রাস্তাতেও পাওয়া যায়!”

“তা যায়।” একটু অন্যমনস্ক ভাবে একেনবাবু বললেন। তারপর বললেন, “আরেকটা কাজ করবে ভাই, মল্লিকার সঙ্গে তন্ময় দত্তের কোনো যোগাযোগ ছিল কিনা সেটার তো খোঁজ করছ। তার সঙ্গে, অরূপ চৌধুরী এবিজি নার্সিং হোমের সঙ্গে কোনো ভাবে যুক্ত ছিলেন কিনা দেখো তো।”

“এবিজি নার্সিং হোম, মানে যার সঙ্গে বিকাশ সেন যুক্ত ছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

রাখাল দত্ত একটু অবাক হয়ে একেনবাবুর দিকে তাকালেন, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করলেন না।

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত