।। ১৬ ।।

বাড়ি ফিরে দেখি প্রমথ আড্ডা মারছে ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে। প্রমথর মুখটা হাসিখুশি দেখে বুঝলাম এক্সপেরিমেন্টের ঝামেলা মোটামুটি মিটেছে। আমাদের ঢুকতে দেখে ফ্রান্সিস্কা বলল, “কফি খাবে?”

আমি বললাম, “একেনবাবু একটু আগে খাওয়ালেন।”

প্রমথ বলল, “ তার মানে?”

“মানে আবার কি, আমরা কফি খেয়ে এসেছি।”

“সেটা তো বুঝতে পারছি, কিন্তু একেনবাবু খাওয়ালেন মানে কি?” তারপর একেনবাবুর দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, “লুকিয়ে লুকিয়ে একজনকে কফি খাইয়ে পয়সা বাঁচানোর মানেটা কি? আমাকে না হয় নাই খাওয়ালেন –বেচারা ফ্রান্সিস্কা কি দোষ করল!”

একেনবাবু বললেন, “আপনারা ছিলেন না, আমি কি করব স্যার? আপনি কঠিন কঠিন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে পড়ে থাকেন!”

“আপনার সব সময়েই একটা অজুহাত আছে। তা দুজনের যাওয়া হয়েছিল কোথায়?”

“লাইব্রেরিতে,” আমি উত্তর দিলাম। তারপর বললাম, “গেস –কার সঙ্গে পথে দেখা?”

“অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।”

“চ্যাংড়ামো করিস না!” আমি বললাম, “রোহিত রয়।”

“রোহিত রয় কে?” ফ্রান্সিস্কা জিজ্ঞেস করল।

“তুমি চিনবে না, সুভদ্রামাসির খুব পরিচিত এক ফোটোজার্নালিস্ট,” প্রমথ বলল। “আমি কিন্তু ইমপ্রেসড, তুই একজনকে একবার মাত্র দেখে আবার চিনতে পেরেছিস! কেমন আছে সে?”

“ভালোই তো মনে হল। তবে একটা কথা বললেন সুভদ্রামাসির দেওয়া ছবিটা সম্পর্কে –শুনে বেশ খটকা লেগে গেছে।”

প্রমথর চোখে প্রশ্ন।

আমি বললাম, “কে জানি ওঁকে দুটো ক্রেজি ইমেইল পাঠিয়েছে ঐ ছবিটা নিয়ে।”

“দাঁড়া দাঁড়া, একটু বুঝতে দে। কোন ছবির কথা বলছিস –তোর দিদিমা আর সুভদ্রামাসির মায়ের ছবি?”

“এক্সাক্টলি।”

“যে ই-মেইল পাঠিয়েছে –সে ছবি দেখল কোত্থেকে?”

“রোহিত রয়ের পার্সোনাল ওয়েবসাইটে ছিল –তাইতো উনি বললেন যদুর মনে পড়ছে।”

“তারপর?”

“রোহিত অবশ্য পরিষ্কার করে বলেননি ঠিক কী লেখা ছিল ই-মেইলে। কিন্তু খুব সম্ভবত সুভদ্রামাসির সোনা-রূপো মেশানো মূর্তি সম্পর্কে কিছু সেখানে ছিল।”

“হঠাৎ এই কনকুশনের কারণ?”

“আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে, কেউ সেটাকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছে মিউজিয়াম থেকে চুরি যাওয়া জিনিস বলে।”

“তুই গাঁজা-ফাজা খাচ্ছিস নাকি –কী যা-তা বকছিস! রোহিত কি বলেছেন ঐ মূর্তি সম্পর্কে কেউ লিখেছে?”

“না।”

“তাহলে?”

“কিন্তু তাছাড়া আর কি হতে পারে? মূর্তিটা ছবিতেও স্টানিং।”

“মানছি, কিন্তু তার সঙ্গে মিউজিয়াম থেকে চুরি যাওয়ার সম্পর্ক কি?”

“সুভদ্রামাসির এক পূর্বপুরুষ কুখ্যাত আর্ট-চোরের বোনকে বিয়ে করেনি!”

“তুই তোর মাথা ডাক্তারকে দেখা আর একেনবাবুর সঙ্গ কমা। কি মশাই, আপনারও এই মত নাকি?”

“কোনো সম্ভবনা কি স্যার বাদ দেওয়া যায়?”

“এটা যায়।” প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল।

সুভদ্রামাসির জিনিওলজি নিয়ে আমাদের যে-সব কথা হয়েছে –তার কিছুই ফ্রান্সিস্কা জানত না। আমাদের কাছে সব কিছু শুনে বলল, “গ্রেট স্টোরি, কিন্তু মা বলেছে ওটা নেপালের এক রাণার কাছ থেকে মায়ের দাদুর বাবা কিনেছিলেন। ওটা চুরির হবে কেন?”

“ব্যাপার বুঝছ না,” প্রমথ বলল, “বাপি যেই শুনছে, তুমি মূর্তিটা পাচ্ছো, হাজার রকম ফ্যাঁকড়া তুলছে।”

“তুমি শিওর, সুভদ্রামাসি তাই বলেছেন?” আমি ফ্রান্সিস্কাকে প্রশ্ন করলাম।

“নিশ্চয়। আর মূর্তিটার মুখ তোমরা দেখনি? টিপিক্যাল ভারতীয় মুখ –কানে ইয়াররিং, শাড়ি পরা।”

ফ্রান্সিস্কা কথাগুলো যখন বলছে, আমি বুকশেলফ থেকে অ্যালবাম খুলে দিদিমা আর সুভদ্রামাসির মা’র ছবিটা দেখছি। কথাটা ঠিক, ওই মূর্তিটা কাঠের বাক্সের উপর শোয়ানো থাকলেও শাড়ির ভাঁজগুলো সুন্দরভাবে ফুটে আছে। একটু ভালোভাবে দেখলে কানের দুলও চোখে পড়ে। আশ্চর্য, মনে মনে ভাবলাম, অতবার মূর্তিটা সুভদ্রামাসির বাড়িতে দেখেছি, কিন্তু শাড়ি খেয়াল করিনি! শাড়ি গয়নার দিকে মেয়েদের দারুণ চোখ, দেশি বিদেশিনী সবার!

বাধ্য হয়ে স্বীকার করলাম, “দেয়ার গোজ মাই থিওরি! কিন্তু এছাড়া কী নিয়ে ক্রেজি ই-মেইল আসতে পারে বলো?”

“মিস্টার রয়কে ফোন করে জিজ্ঞেস করুন না স্যার, কী বলতে চেয়েছিলেন উনি। তাহলেই তো সন্দেহ মিটে যায়।”

এবার আমার সত্যিই লজ্জা লাগল। কেন যে এই অদ্ভুত চিন্তাগুলো মাথায় এসেছিল! মূর্তি প্রসঙ্গে সেইখানেই ইতি।

.

পরদিন দুপুরবেলা আমার ক্লাস ছিল। পড়িয়ে নিজের অফিসে ঢুকে সবে চেয়ারে বসেছি, ফোন বেজে উঠল। একেনবাবু।

“স্যার একটা ট্রাজেডি হয়েছে।”

“কী ট্রাজেডি?”

“একটু আগে মাসিমার ফোন পেলাম।”

“কী হয়েছে সুভদ্রামাসির?”

“না, না, মাসিমার কিছু হয়নি। মিস্টার রোহিত রয় মারা গেছেন।”

“মারা গেছেন!”

“কথা শুনে মনে হল মার্ডারড।”

“মার্ডারড! সুভদ্রামাসি কোথায়?”

“উনি মিস সুজাতাকে নিয়ে মিস্টার রয়ের অ্যাপার্টমেন্টে আসার প্ল্যান করেছিলেন। আমি কোনোমতে নিরস্ত করেছি। বলেছি সব খোঁজখবর নিয়ে ওঁকে জানব। আমি এখনি যাচ্ছি ওখানে। আপনার ক্লাস শেষ?”

“হ্যাঁ শেষ, আমিও কি আসবে?”

“জানি না গিয়ে কি করবেন স্যার। ওখানে হয়তো বাইরের লোকদের ঢুকতেও দেবে না।”

কথাটা ভুল বলেননি একেনবাবু। উনি ঢুকবেন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কানেকশনে। আমাকে ওখানে যেতে দেবে কেন? রোহিতের আত্মীয় বা বিশেষ বন্ধু হলে খবর পেয়ে ওখানে যাওয়া এক কথা। জীবনে দুবার মাত্র দেখা হয়েছে রোহিতের সঙ্গে। সুভদ্রামাসি এলে, তাঁর সঙ্গ দেবার জন্য যাওয়ার একটা অর্থ হত।

“প্রমথ জানে?”

“ওঁকে পাইনি, একটা মেসেজ রেখেছি। আমি ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই ফিরে আসব।”

আমি সুভদ্রামাসিকে ফোন করলাম। উনি একেবারে ডিভাস্টেটেড। স্বাভাবিক। ধরাধরা গলায় এলোমেলোভাবে যা বললেন:

রোহিতের আসার কথা ছিল সকালে। আসছেন না দেখে সুভদ্রামাসি রোহিতকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাড়ির ফোন বা মোবাইল কোনোটাতেই উত্তর নেই। রোহিত এরকম কখনো করে না। তাই সুভদ্রামাসি ওঁর পুরোনো এক বন্ধু এঞ্জেলিকাকে ফোন করেন। ভদ্রমহিলাও সুভদ্রামাসির মতো বাতের রুগি। হাঁটাচলা করতে হয় খুব কষ্ট করে। তবে উনি রোহিতের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে একই তলায় থাকেন। এঞ্জেলিকা অবশ্য সুভদ্রামাসিকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে তিনি নিউজে শুনেছেন আজ সকাল আটটা থেকেই লিঙ্ক টানেল আর জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজে বিরাট জ্যাম। দু’টো বড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। তাই হয়তো দেরি হচ্ছে।

আধঘন্টা বাদে সুভদ্রামাসি যখন আবার ফোন করেন, তখন উনি ইন্টারকম-এ সিকিউরিটির লোকদের জিজ্ঞেস করেন রোহিতকে বাইরে যেতে দেখেছে কিনা। দেখেনি শুনে রোহিতের অ্যাপার্টমেন্টে যান। লক্ষ্য করেন বাইরের দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। ভিতরে উঁকি দিতেই নজরে পড়ে রোহিত সোফায় এলিয়ে পড়ে আছেন, চারিদিকে রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে সিকিউরিটিকে ডাকেন। তারাই পুলিশে খবর দেয়। এইসবের মধ্যে এঞ্জেলিকা ভুলেই গিয়েছিলেন সুভদ্রামাসিকে ঘটনাটা জানাতে। পরে খেয়াল হয়। প্রায় একঘন্টা বাদে সুভদ্রামাসিকে ফোন করেন। সঙ্গে সঙ্গেই সুভদ্রামাসি আমাদের বাড়িতে ফোন করে একেনবাবুকে জানান।

যাইহোক, রোহিতের অ্যাপার্টমেন্টে একেনবাবু গেছেন, আমি জানালাম। “আমাকে তো ঢুকতে দেবে না, তাই যাইনি। একেনবাবু ফিরে এলেই তোমাকে ফোন করব।”

“তাই কোরো।” তারপর একটু থেমে সুভদ্রামাসি বললেন, “তোমরাও সাবধানে থেকো। বাইরের দরজা-টরজা সব সময়ে লক করে রেখো। নিউ ইয়র্ক দিন-কে-দিন যা খারাপ হচ্ছে।”

“তুমি চিন্তা কোরো না, আমরা সাবধানে থাকব।”

ঘন্টা তিনেক বাদে একেনবাবু এলেন।

“বাড়িতে ফোন করে কাউকে পেলাম না স্যার, তাই ধরে নিলাম আপনি অফিসেই আছেন।”

“ভালো করেছেন এসে, আমি চিন্তায় চিন্তায় মরছি।”

“প্রমথবাবুকে ধরতে পেরেছেন?”

“নাঃ, কোথায় ডুব মেরেছে কে জানে! ফ্রান্সিস্কাকেও পেলাম না। দুজনে হয়তো কোথাও গেছে।”

“আপনার কি আর কোনো কাজ আছে?”

“আছে, কিন্তু জরুরি নয়।”

“তাহলে স্যার বাড়িতেই চলুন। যেতে যেতে আপনাকে বলি যতটুকু বুঝতে পারছি।”

.

।। ১৭ ।।

রাস্তায় বেড়িয়ে একেনবাবু বললেন, তা হল —

সামনাসামনি অল্প দূরত্ব থেকে রোহিত রয়ের কপালে গুলি করা হয়েছে। তবে কখন তা এখনো জানা যায়নি। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে অনেক কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। সেই আওয়াজে গুলির শব্দ শুনতে পাওয়াও কঠিন। বন্দুক বা হ্যান্ডগান পুলিশ খুঁজে পায়নি। সুতরাং নিঃসন্দেহে এটা হোমিসাইড বা খুন। যেখানে দেহ পাওয়া গেছে, সেখানেই হত্যাকান্ড ঘটেছে। রক্ত ছাড়া সোফার কুশনে, রোহিতের সার্ট-প্যান্টে এবং কার্পেটে কফির দাগ। একটা কফির কাপ নীচে কার্পেটে কাত হয়ে আছে। উলটোদিকের সোফায় পাশে সাইড টেবিলে কফি ভরতি একটা কাপ পাওয়া গেছে। একটা সম্ভাব্য থিওরি হল, রোহিত যখন কারুর সঙ্গে সোফায় বসে কফি খাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ ওঁকে গুলি করা হয়। খুনি সম্ভবত রোহিত রয়ের পরিচিত। নইলে সকালে এসে রোহিতের সঙ্গে কফি খাওয়ার প্রশ্ন উঠত না। প্রিলিমিনারি টেস্ট-এ দুটো কাপেই রোহিতের ফিঙ্গার প্রিন্ট ছাড়া আর কোনো ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই। রোহিতই কফি বানিয়ে অভ্যাগতকে দিয়েছিলেন। খুনি মারবে বলে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল, কাপ সে ছোঁয়েওনি। মনে হয় রোহিত যখন চুমুক দিতে কাপ মুখে তুলেছেন, তখনই খুনি হ্যান্ডগান বের করে গুলি চালিয়েছে। এগুলো সবই স্পেকুলেশন।

বাড়িতে জিনিসপত্র কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে বলে মনে হয় না। রোহিত কাজের সূত্রে নানান জায়গায় ঘুরতেন। সে-সব জায়গা থেকে নতুন পুরোনো বহু জিনিসই সংগ্রহ করে এনেছেন। সেই সংগ্রহের মূল্য খুব একটা কম নয়। তার থেকে কিছু খোয়া গেছে কিনা বলা শক্ত। আরেকটা কথা, রোহিত বোধ হয় কোথাও যাবার প্ল্যান করছিলেন। কারণ ওঁর স্যুটকেসে বেশ কিছু জিনিস ঢোকানো এবং কিছু পোয়া জামাকাপড় স্যুটকেসের পাশে রাখা, যেগুলো ঢোকানোর সময় পাননি। পুলিশ খোঁজ নিচ্ছে কোথায় ওঁর যাওয়ার কথা ছিল।

সকালে হাওয়ার্ড লংফেলো বলে একজন লোক রোহিতের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁর সন্ধান পুলিশ পেয়েছে। এখানেই জিনিসটা একটু গোলমেলে। হাওয়ার্ড পুলিশকে ফোন করেছিলেন রোহিতের মৃত্যুর কথা জানিয়ে। কিন্তু সেটা সিকিউরিটি ফোন করার প্রায় আধঘন্টা পরে, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ। সিকিউরিটির লগ অনুসারে হাওয়ার্ড রোহিতের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিলেন সকাল নটা বেজে পাঁচ মিনিট নাগাদ। তার কিছুক্ষণ পরেই তিনি বেরিয়ে যান। ঠিক কখন, সিকিউরিটি লগবুকে লেখেনি। সিকিউরিটি ডেস্কে যে দুজন ছিল, তাদের একজন এক নতুন ভিসিটারকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আর দ্বিতীয়জন ঐ অ্যাপার্টমেন্টেরই এক ভাড়াটের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিল। ফলে হাওয়ার্ড কখন গেলেন আর লেখা হয়নি। তবে পুলিশ যেটুকু জানতে পেরেছে –তা হল ন’টা-দশ থেকে ন’টা-পনেরোর মধ্যেই হাওয়ার্ড বেরিয়েছে। তর্কাতর্কি শুরু হবার একেবারে প্রথম দিকে। আরেকটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট, হাওয়ার্ড খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে যান। তর্কাতর্কির মাঝেও সিকিউরিটির দু’জনেই সেটা খেয়াল করেছে। তাহলে এতক্ষণ বাদে তিনি ফোন করলেন কেন?

আরেকটা কথা, রোহিতের অ্যাপার্টমেন্টে সিকিউরিটির ব্যবস্থা একটু ঢিলে ঢালা। চেনা মুখ হলে সিকিউরিটির লোকেরা অনেক সময়ে ভাড়াটদের ইন্টারকমে যোগাযোগ করে পারমিশন নেয় না, নামও লিখে রাখে না। সুতরাং আর কেউ সকালে রোহিতের কাছে এসেছিল কিনা, সঠিক জানার কোনো উপায় নেই।

নিউ ইয়র্ক পুলিশ দ্রুতগতিতে কাজ করে। এরমধ্যেই হাওয়ার্ডকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হাওয়ার্ড যা বলেছেন তার সঙ্গে সিকিউরিটির লোকদের কথায় খুব একটা অমিল নেই। হ্যাঁ, তিনি ন’টা পাঁচ নাগাদই রোহিত রয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু অ্যাপার্টমেন্টে এসে দেখেন রোহিত মরে পড়ে আছেন। অবভিয়াসলি হি প্যানিকড। সঙ্গে সঙ্গে নীচে যান সিকিউরিটির লোকদের বলতে। এলিভেটর থেকে নেমে যখন প্যাসেজ দিয়ে হাঁটছেন, তখন জানলা দিয়ে দেখেন ওঁর গাড়ি পুলিশ টো-ট্রাকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। একবার গাড়ি চলে গেলে ছাড়াতে দু-তিনশোর ডলারের ধাক্কা! পড়ি-কি-মরি করে পুলিশের কাছে ছুটে যেতে গিয়ে রাস্তায় পা মচকে পড়ে যান। সেখানে একটা ভাঙ্গা কাচের বোতল ছিল –তাতে ভীষণভাবে পা কেটে যায়। একটু আগে একটা মার্ডারড লোককে দেখে তারপরে নিজের এই রক্তাক্ত অবস্থা –হি ওয়াজ ইন টোটাল শক, বাস্তববুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। প্রায় সেন্সলেস হয়ে ওঁকে পড়ে থাকতে দেখে, পথচারীদের একজন অ্যাম্বুলেন্সে খবর দেয়। এমার্জেন্সি রুমে বেশ কয়েকঘন্টা কাটিয়ে ফার্স্ট এইড, স্টিচ, এক্স-রে, ইত্যাদি হয়ে যাবার পর ওঁর খেয়াল হয় –পুলিশকে ফোন করা হয়নি! তখনই পকেট থেকে মোবাইল বার করে পুলিশকে ফোন করেন।

এতটা শোনার পর আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা বলে আপনার মনে হয়?”

“হু নোজ স্যার। তবে একটা কথা ঠিক, ওঁর গাড়িটা ন’টা দশ মিনিট নাগাদ পুলিশ টো করে নিয়ে গিয়েছে পার্কিং ভায়লেশনের জন্য। আর এ-ও ঠিক যে এমার্জেন্সি রুমে কাঁচে কাটা পা নিয়ে উনি এসেছিলেন।”

হয়তো হাওয়ার্ড লোকটা সত্যি কথাই বলছে। কিন্তু তবু আমার মনে হল, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। আমি বললাম, “গাড়ি টো করার ব্যাপারটা আর পায়ে কাঁচ ঢোকা সত্যি। কিন্তু তার থেকে কি প্রমাণ হয় হাওয়ার্ড নির্দোষ?”

“তা হয় না স্যার। তবে খুনের জন্য একটা মোটিভ দরকার। সেদিকটাও ভাবতে হবে।”

“তা ঠিক। লোকটা কী করে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“স্ট্যামফোর্ডে ওঁর হ্যাঁন্ডিক্রাফট- এর একটা দোকান আছে।”

“রোহিতের কাছে কেন এসেছিল?”

“ওঁর বয়ান অনুসারে, হাতে বোনা থাইসিল্কের তৈরি স্পেশাল হ্যাঁন্ডিক্র্যাফট কাভারিং এর ডেলিভারি নিতে। মিস্টার রয় আগেও ব্যাঙ্কক থেকে ওঁর জন্য এসব এনেছেন।”

“আপনি বিশ্বাস করেন?”

“অবিশ্বাস করার খুব একটা কারণ দেখি না স্যার। কারণ মিস্টার রয়ের অ্যাপার্টমেন্টে কাগজে প্যাক করা বেশ কিছু দামি থাই সিল্কের কাপড় পুলিশ পেয়েছে।”

“রোহিত তো বেশ কিছুদিন ফিরেছে –এদ্দিন বাদে মাল নিতে এল এই লংফেলো।”

“আপনার স্যার সন্দেহটা যায়নি মনে হচ্ছে?”

“না যায়নি,” আমি স্বীকার করলাম। “সামথিং ইস স্টিল ফিশি।”

“পুলিশও সেই প্রশ্ন করেছিল। মিস্টার লংফেলোর হ্যাঁন্ডিক্রাফট-এর ব্যাবসা করলেও, ওঁর প্যাশন হচ্ছে স্যার অ্যান্টিক। এ নিয়ে উনি অনেক পড়াশুনো করেছেন। অ্যান্টিক অ্যাপ্রেইজার হিসেবে বেশ পরিচিতিও আছে। সেই সূত্রে কয়েকদিনের জন্য ওহায়ওতে গিয়েছিলেন, গতকাল ফিরেছেন। ফিরে এসে মিস্টার রয়ের মেসেজ পান।”

“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে হ্যাঁন্ডিক্রাফট-এর ব্যাবসাই হচ্ছে ওঁর হবি। দোকান ছেড়ে এইভাবে হাওয়া হয়ে গেলে তো ব্যাবসা লাটে উঠবে।”

“এটা স্যার আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে কিনা ভদ্রলোকের টাকার অভাব নেই। গ্রিনিচে বিশাল বাড়ি আছে। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের মতে বাপ-ঠাকুরদা যা রেখে গেছেন, তাতে মিস্টার লংফেলোর কয়েক পুরুষ চলে যাবে।”

আমি বললাম, “এটা জানার পরও আপনি বিশ্বাস করেন যে দু-তিনশো ডলার ফাইন বাঁচাতে লোকটা ওভাবে ছুটেছিল?”

“ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট স্যার।”

একেনবাবুর কাছে সার্টিফিকেট পেয়ে আমি উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আর কী জানলেন বলুন?”

“ও হ্যাঁ, মিস্টার রয় মাঝেমাঝে অ্যান্টিকের ব্যাপারে মিস্টার লংফেলোর মতামত নিতেন। গতকাল ফোনে যখন কথা হয়েছিল তখন ওঁকে বলেছিলেন, একটা অ্যান্টিকের ন্যায্য দাম কী হতে পারে সেটা মিস্টার রয় জানতে চান।”

“অ্যান্টিকটা কী?”

“তা মিস্টার লংফেলো জানেন না।”

“আপনার কি মনে হয়, এই অ্যান্টিকের সঙ্গে খুনের কোনো সম্পর্ক আছে?”

একেনবাবু বললেন, “এর আগেও মাঝেমধ্যে ঠিক এই ব্যাপারেই মিস্টার লংফেলোর সাহায্য মিস্টার রয় নিয়েছেন। তবে এটা স্যার আপনার প্রশ্নের সঠিক উত্তর হল না।”

“বুঝেছি, লংফেলো নিয়ে আপনি মাথাই ঘামাতে চাইছেন না।”

“তা ঠিক নয় স্যার, তবে মোটিভটা আগে বার করুন। মোটিভ ছাড়া র‍্যান্ডম কিলিং হতে পারে, কিন্তু কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার হয় না।”

.

।। ১৮ ।।

বাড়িতে ফিরে প্রথম কাজ হল সুভদ্রামাসিকে ফোন করে এদিকের খবর জানানো। যদিও জানাবার বিশেষ কিছুই ছিল না। একেনবাবু একবার সুভদ্রামাসির সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। আগামিকাল বিকেলে যেতে পারি নাকি জানতে চাইলাম। সুভদ্রামাসি বললেন বাড়িতে থাকবেন। আমি আর একেনবাবু পরের দিন বিকেল ছটা নাগাদ রওনা দিলাম। প্রমথর কাজ ছিল বলে আসতে পারল না। ফ্রান্সিস্কাও বাইরে কোথায় গেছে।

রাস্তায় বহু গাড়ি, অফিস টাইমের ভিড় তখনও কাটেনি। কিন্তু ভাগ্যক্রমে জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজে জ্যাম ছিল না। তাই সুভদ্রামাসির বাড়িতে সাতটার একটু আগেই পৌঁছে গেলাম।

বেল বাজাতেই সুভদ্রামাসির গলা শুনলাম, “দরজা খোলা, তোমার এসো।” সুভদ্রামাসি বাড়িতে একাই ছিলেন। সুভদ্রামাসির কুক-কাম-হাউসকিপার সুজাতা বাজারে গিয়েছেন তরি-তরকারি কিনতে। পাছে সুভদ্রামাসিকে আমরা এলে উঠতে হয়, তাই দরজা লক করে যাননি।

আমরা ঘরে ঢুকতেই বললেন, “সুজাতা আসুক, তারপর তোমাদের চা করে দেবে।”

“ওসব নিয়ে ভেব না,” আমি বললাম। “তুমি কেমন আছো?”

সুভদ্রামাসি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না। বুঝলাম নিজেকে একটু সামলাবার চেষ্টা করছেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “ভেবেছিলাম শরীর-মন দুটোই পাথর হয়ে গেছে, অনেক ধকলই তো সইতে হয়েছে জীবনে। কিন্তু দেখলাম এখনও হয়নি।”

সুভদ্রামাসির পাশের চেয়ারে একেনবাবু বসলেন। ঘরের কোনায় একটা শান্তিনিকেতনী মোড়া ছিল। সেটা তুলে এনে আমি সুভদ্রামাসির আরেক পাশে বসলাম। সুভদ্রামাসি ওঁর হাতটা আমার হাতের উপর রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “প্রমথ আর ফ্রান্সিস্কা এল না?”

“ওরা কোথায় জানি গেছে।”

সুভদ্রামাসি চুপ করে রইলেন।

নিরবতা ভেঙ্গে একেনবাবু বললেন, “মাসিমা, দুয়েকটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে?”

সুভদ্রামাসি বুদ্ধিমতী। জিজ্ঞেস করলেন, “রোহিত সম্পর্কে?”

একেনবাবু অনুচ্চস্বরে বললেন, হ্যাঁ, মানে আপনার যদি এখন বলতে অসুবিধা না হয়।”

“অসুবিধা কিছুই নেই, তবে মনটা বিক্ষিপ্ত –গুছিয়ে কি সব কিছু বলতে পারব!”

“একেনবাবু নিউ ইয়র্ক পুলিশকে এ ব্যাপারে সাহায্য করছেন,” আমি একেনবাবুর প্রশ্নের কারণটা বিশদ করলাম।

“সে আমি বুঝতে পারছি,” সুভদ্রামাসি বললেন। “কী জানতে চাও তুমি?”

“রোহিত সম্পর্কে যা জানেন, তাই বলুন। মানে আপনার সঙ্গে তো বহুদিনের পরিচয় –অনেক কিছুই আপনি জানেন ওঁর সম্বন্ধে।”

সুভদ্রামাসি আবার খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। “এতদিনের পরিচয় বলেই সব কিছু এলোমেলোভাবে মনে পড়ছে।”

“যেভাবে খুশি আপনি বলুন মাসিমা। বুঝতে না পারলে, আমি প্রশ্ন করব।”

সুভদ্রামাসি শুরু করলেন, “রোহিত রিচার্ডের ছাত্র ছিল। তবে রোহিতকে আমি চিনি তার অনেক আগে থেকে। ও যখন হাইস্কুলে পড়ে তখনই ওর বাবা-মার সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়। রোহিতের বাবা মোহিত রিচার্ডেরই সমবয়সি, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। মা হিলডা কাজ করত কোনো একটা ব্যাঙ্কে। আমাদের সঙ্গে মোহিত আর হিলডার বেশ বন্ধুত্বই গড়ে উঠেছিল। রোহিত স্কুলের পরে অনেক সময়ে আমার কাছে চলে আসত। রোহিত যে বছর হাইস্কুল পাশ করল, সেই বছরই রোহিতের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। তারপর কী যে হল, রোহিতকে নিয়ে হিলডা হঠাৎ জার্মানি চলে গেল। আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখল না।

রোহিত বছর দুই বাদে ফিরে এসে যেদিন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ঢোকে, সেদিনই রিচার্ডের সঙ্গে দেখা হয়। রিচার্ডের বকাবকি খেয়েই বোধ হয় আবার যোগাযোগ করে। রোহিত আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পাশ করার পর রিচার্ডই ওকে অ্যাসিস্টেন্টশিপ দেয়, অ্যান্থপলজি-তে মাস্টার্স করার জন্যে। ১৯৯২, অর্থাৎ প্রায় বছর দশেক আগের কথা বলছি। রোহিতের বয়স তখন কত হবে, বছর চব্বিশেক। পড়াশোনায় মেধাবী ছিল রোহিত, রিসার্চের কাজও মন দিয়ে করত, কিন্তু হঠাৎ কী যে ভূত মাথায় চাপল। সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।”

“অদৃশ্য!”

“হ্যাঁ, নেপালে না কোথায় তিনমাসের জন্য চলে গেল। ওর মাস্টার্স থিসিসটা তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল! সেই যে গেল, কোনো সাড়াশব্দ নেই! পরে জেনেছিলাম একটা ট্র্যাভেল ম্যাগাজিনের কাছ থেকে নামমাত্র টাকা নিয়ে নেপালের নানান জায়গায় ছবি তুলতে গিয়েছিল। নেপাল থেকে ফিরে রোহিত আমাদের সঙ্গে দেখাও করেনি। এর ওর মুখে শুনেছিলাম ওখান থেকে ড্রাগের নেশা নিয়ে এসেছে। রোহিতের এক বান্ধবী ছিল সেইসময়ে। ইজিপ্টের মেয়ে ফতেমা। সেও পড়াশুনো ছেড়ে ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হয়ে গেল। তারপর ঘটল একটা দুর্ঘটনা। রোহিত আর ফতেমা বেয়ার মাউন্টেনে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে একটা টিলার উপর থেকে পড়ে ফতেমা মারা গেল। পুলিশ কারোর বিরুদ্ধে চার্জ আনেনি। ফতেমার দাদা আব্দুল বস্টনে থাকত। সে একদিন নিউ ইয়র্কে এসে রোহিতকে কোনো একটা বার-এ হঠাৎ ছুরি নিয়ে আক্রমণ করে। রোহিতকে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। খুনের চেষ্টা করেছিল বলে পুলিশ আব্দুলের বিরুদ্ধে কেস আনে। বিচারে আব্দুল বছর পনেরোর জেল হয়। এই ঘটনাটাই রোহিতের জীবনের মোড় আবার ঘুরিয়ে দেয়। ড্রাগ রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে গিয়ে নিজেকে নেশামুক্ত করে। ছবি তোলাটাকে আরও সিরিয়াসলি নিয়ে একটা অ্যাডভার্টাইজমেন্ট এজেন্সিতে কাজ নেয়। রিচার্ডের সঙ্গেও আবার ওর যোগাযোগ হয়। এবার আর ছাত্র হিসেবে নয় –বন্ধু হিসাবে। ধীরে ধীরে রিচার্ডের, পরে নতুন করে আমারও একজন আস্থাভাজন স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠে।”

“নেপালে যাবার কতবছর পরে আবার আপনাদের যোগাযোগ হয়?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

“তা প্রায় আড়াই বছর হবে।”

“ঠিক আছে মাসিমা, বলুন।”

“আরেকটা ঘটনাও মনে পড়ছে। রোহিতের রিসার্চের কাজ চুরি করে টম ক্যাসিডি নামে একটি ছেলে তোমাদের নিউ ইউর্ক ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স প্রোগ্রামে থিসিস জমা দেয়। ঘটনাচক্রে সেই থিসিস রিচার্ডের নজরে আসে। পরে রোহিত দেখে শুধু চুরি নয়, হুবহু চুরি। ওর ডেটা, ওর অ্যানালিসিস –এমনকি ওর লেখা সেন্টেন্সগুলো পর্যন্ত টম ক্যাসিডি ব্যবহার করেছে। রোহিত তখন ওর পুরোনো কম্পিউটার থেকে ডেটা-ফাইল আর লেখাগুলো নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে জমা দেয়। যদুর আমার মনে পড়ছে, টম ক্যাসিডিকে এর পর স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।”

“এই টম ক্যাসিডি এখন কোথায় আছে জানেন?”

“আমার কোনো ধারণাই নেই।”

“রোহিতের এখনকার বান্ধবীর নাম বা যোগাযোগের ঠিকানা আপনি জানেন কি?”

“না, লন্ডনে ওর একটা বুটিক শপ আছে –এইটুকুই জানি। নাম আইলিন স্মিথ। ওকে নিয়ে কয়েকবার এসেছে আমার কাছে। ভারি মিষ্টি মেয়ে।”

এরপর আরও এলোমেলো অনেক কথা হল। একেনবাবু বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন, কিন্তু আমার খুব একটা রেলেভেন্ট মনে হল না। একেনবাবু সুভদ্রামাসির জিনিওলজির অ্যালবাম আর রিচার্ডমেসোর নোটবুকটা ফেরত এনেছিলেন। সেটা গাড়িতে ফেলে এসেছিলেন। গাড়ি থেকে এনে সুভদ্রামাসির হাতে দিতে, হঠাৎ সুভদ্রামাসি চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করল। আমি আর একেনবাবু দুজনেই ঠিক কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

সুভদ্রামাসি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “হঠাৎ মা’র কথা ভীষণ মনে পড়ল। আমাদের বিয়ের পর বাবার আপত্তিতেই মা আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখতে পারেননি। কিন্তু বাবুর মৃত্যুর খবর পেয়েই মা একটা চিঠি লিখেছিলেন। রোহিত আমার ছেলে নয়, কিন্তু ওকেও আমি ছেলের মতোই দেখতাম। আজ তাই সকাল বেলায় রোহিতের খবর পেয়ে মা’র পুরোনো চিঠি পড়ছিলাম।” মাসিমা টেবিলে বইয়ের মধ্যে গোঁজা একটা পুরোনো চিঠি বার করে দেখালেন।

নলিনী দিদিমার সেই সুদীর্ঘ চিঠি আমাদের পড়ার জন্য সুভদ্রামাসি দেননি। কিন্তু তাও আমি আর একেনবাবু কয়েকলাইন পড়ার ভান করলাম। এ অবস্থায় কি যে বলা ঠিক, আমার মাথায় খেলছিল না।

একেনবাবু বললেন, “মাসিমা আপনার মা ছিলেন গ্রেট লেডি। আপনিও তাঁরই সুযোগ্য সন্তান। আমি আর কি বলব, আপনার কাছ থেকে আমাদের শেখা উচিত শোক কী ভাবে নিতে হয়।”

আমার এই প্রথম মনে হল বাঁচাল হবার সুবিধা আছে! সুভদ্রামাসি চুপ করে রইলেন।

আমি বললাম, “এবার উঠি সুভদ্রামাসি।”

“উঠবে? ও হ্যাঁ, ঠিক আছে এসো।”

আমরা উঠে যাচ্ছি, সুভদ্রামাসিও দেখলাম উঠে আমাদের পেছন পেছন আসছেন।

একেনবাবু ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “মাসিমা, আপনি আসছেন কেন?”

একথা শুনে সুভদ্রামাসি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে কেমন যেন হয়ে গেলেন। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে ওঁর হাত ধরলাম, তারপর ওঁকে ধরে ধরে নিয়ে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। ঠিক এই সময়েই সুজাতা বাড়িতে ফেরায় আমরা খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বেরোলাম।

সুভদ্রামাসির বাড়ি থেকে ফেরার পথে আমরা অনেক্ষণ চুপ করে রইলাম। ওঁর কান্না ভরা মুখটা বারে বারে মনের মধ্যে ফিরে আসছিল। খানিকটা আত্মগতভাবেই আমি বললাম, “আজ ফ্রান্সিস্কা এলে সুভদ্রামাসির ভালো লাগত। মেয়ের মতো স্নেহ করেন ওকে।”

একেনবাবু কোনো মন্তব্য করলেন না। খানিক বাদে আমায় প্রশ্ন করলেন, “মাসিমার কথা থেকে কি বুঝলেন আপনি?”

আমি বললাম, “অন্ততঃ দু’জন লোক আছে, যাদের রোহিতকে খুন করার মোটিভ থাকতে পারে।”

“দু’জন কেন বলছেন স্যার?”

“কেন টম ক্যাসিডির কেরিয়ার তো রোহিতের জন্য নষ্ট হল।”

“মিস্টার রয়তো নষ্ট করেননি। ক্যাসিডিই চুরি করেছিলেন।”

“তা হোক, কিন্তু রোহিতের জন্যেই তো কলেজ ক্যাসিডিকে তাড়াল –যদিও এতদিন রাগ পুষে রাখাটা অস্বাভাবিক।”

“আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার।”

“আব্দুলের ব্যপারটা স্বতন্ত্র। কেউ যদি বিশ্বাস করে একজন তার বোনের মৃত্যুর জন্য দায়ী, সেই রাগ সে আজীবন পুষে রাখতে পারে। কী বলেন, পারে না?”

“পারে বইকি স্যার। প্রশ্ন হল, অপরচুনিটি বা সুযোগ স্যার। মোটিভ আছে, কিন্তু খুন করার সুযোগ কি আছে?” একটু অন্যমনস্ক ভাবেই মনে হল কথাটা একেনবাবু বললেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “স্যার আপনার মোবাইলটা একটু ব্যবহার করতে পারি?” মোবাইলটা নিয়ে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে ফোন করলেন একেনবাবু। আব্দুল আর টম ক্যাসিডির খোঁজ নিতে বললেন।

.

পরদিন কলেজ থেকে এসে আরও কয়েকটা নতুন খবর একেনবাবুর কাছ থেকে জানলাম। পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে নেই। বেশ কিছু তথ্য উদঘাটিত হয়েছে রোহিত রয়ের সম্পর্কে। সুভদ্রামাসির কাছ থেকে রোহিতের যে ছবিটা আমরা পেয়েছিলাম, সেটা পজিটিভ লাইটে। পুলিশ সবকিছু দেখেছে একটা সন্দেহের চোখ নিয়ে। রোহিতের ‘বান্ধবী আইলিন মিষ্টি হতে পারে, কিন্তু ড্রাগ অ্যাডিক্ট। ইললিগ্যাল ড্রাগ থাইল্যান্ড থেকে পাচার করার জন্য বার দুই জেল খেটেছে। রোহিতের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব এখনও টিকে আছে কিনা, সে সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত নয়। আইলিন দুদিন আগে নিউ ইয়র্কে এসেছে। কিন্তু রোহিতের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের গার্ডরা এর মধ্যে আইলিনকে দেখেনি। সবাই আইলিনকে ভালো করে চেনে, রোহিতের অ্যাপার্টমেন্টে বহুবার এসে থেকেছে। যদি কোনো কারণে রোহিতের সঙ্গে আইলিনের ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকে, তাহলে জানা দরকার কারণটা কী? রোহিত কি অন্য কোনো নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়েছে? সেটা জেনেই আইলিন ছুটে এসেছে আমেরিকাতে! ব্যর্থ প্রেমের পরিণতি অনেক সময়েই সাংঘাতিক হয়।

আরেকটা দিকও পুলিশ দেখছে। সে দিক একটু পঙ্কিল। পুলিশের সন্দেহ রোহিত একটা ব্ল্যাকমেইলিং গ্রুপের সঙ্গে ছিল। এরা টার্গেট করত বড়োেলোক ও সেলিব্রেটিদের। তাদের দুষ্কর্মের ছবি বা ভিডিও পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করে দেওয়া হবে বলে ভয় দেখাত। অনেক সময়ে প্রতারণার আশ্রয়ও নিত। যেমন, যখন ওরা আঁচ করতে পারত কোথাও ফষ্টিনষ্টি চলছে, কিন্তু অশালীন অবস্থায় ছবি তোলার সুযোগ মিলছে না। তখন সেই জায়গার ছবি আলাদা করে তুলে, পাত্রপাত্রীদের সাধারণ ছবি থেকে কম্প্রোমাইজিং পজিশনের ছবি ডিজিটালি রি-কনস্ট্রাক্ট করে সেই জায়গায় তারা বসিয়ে দিত। দুষ্কর্ম করে থাকলে অনেক সময়েই এই ধরণের ছবি দেখে লোকেরা ভয় পেয়ে যেত! রোহিত জড়িত ছিল এই ডিজিটাল রিকনস্ট্রাকশনের ব্যাপারে।

পুলিশ এই অ্যাঙ্গেলটার কথা আগে ভাবেনি। কিন্তু একটা উড়ো ফোন পেয়ে রোহিতের কম্পিউটার থেকে এই ধরণের দুয়েকটা ছবি আবিষ্কার করেছে। অসম্ভব নয় যে এই দলের সঙ্গেই কোনো কারণে বনিবনা না হওয়ায়, রোহিতকে প্রাণ দিতে হয়েছে। যাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে বা করার চেষ্টা হচ্ছে –সেও সুযোগ পেয়ে এই কাজ করতে পারে। এরকম বহু ধরণের সম্ভাবনাই চিন্তা করা যেতে পারে।

আব্দুল সম্পর্কেও কিছু তথ্য পুলিশ পেয়েছে! গুড কন্ডাক্টের জন্য আব্দুল জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে কয়েক মাস আগে। ইমিগ্রেশন অথরিটি সম্ভবত ইতিমধ্যেই ওকে ডিপোর্ট করে দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত টম ক্যাসিডির কোনও খোঁজই পাওয়া যায়নি।

.

।। ১৯ ।।

একেনবাবু যখন গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করেন, তখন ভীষণ পা নাড়ান। আমার ধারণা ওঁর চিন্তার গতির প্রোপোরশানালি পা নাড়াটা বাড়ে। সেদিন যখন ঘন ঘন পা নাড়ছেন। ওঁর ফাইল থেকে একটা কাগজ হঠাৎ নীচে পড়ে গেল। আমি পাশে বসে পরীক্ষার খাতা গ্রেড করছিলাম। পায়ের কাছে কাগজটা পড়ায়, নীচু হয়ে তুলতেই বেশ কয়েকটা নাম চোখে পড়ল। আব্দুল, টম ক্যাসেডি, হাওয়ার্ড লংফেলো… এই তিন জনের সঙ্গে আরও কয়েকটা নাম দেখে বুঝলাম, এদের সবাইকে সম্ভবত রোহিত রায়ের খুনি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

“এটা কি সাসপেক্ট লিস্ট?” বলে আমি কাগজটা এগিয়ে দিতেই একেনবাবু ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওটা ফাইলে ঢুকিয়ে ফেললেন। কিন্তু তার আগেই একটা নাম আমার চোখে পড়েছে, সেটা সুভদ্রামাসির নাম!

একেনবাবুকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম, “সুভদ্রামাসির নাম এখানে কেন?”

একেনবাবু একটু চুপ করে বললেন, “আপনাকে বলিনি স্যার, কারণ সন্দেহ আর সত্যর মধ্যে তো অনেক তফাৎ।”

“ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলুন, কেন আপনি বা পুলিশ ওঁকে সন্দেহ করছেন?”

“আমাদের কাজটা নচ্ছার স্যার। সবাইকে সন্দেহ করতে হয়।”

“আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন কথাটা। আমার নামও কি লিস্টে আছে?”

“কী যে বলেন স্যার!”

“তাহলে সুভদ্রামাসির নাম কেন আছে?”

“আপনাকে বলছি স্যার, কিন্তু আপসেট হবেন না। আপনার কাছে শুনেছি স্যার, মাসিমার ছেলে স্কুল যাবার সময়ে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। কিন্তু আপনি জানেন কিনা জানি না, সেই গাড়ি যিনি চালাচ্ছিলেন তিনি রোহিত রয়।”

“কিন্তু সে তো ষোলো বছর আগের ঘটনা… একটা অ্যাকসিডেন্ট! আর সুভদ্রামাসি রোহিত রায়কে ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। তাহলে এই সন্দেহটা আসছে কোত্থেকে?”

“মিস্টার রোহিত রয়ের মা ম্যাডাম হিলডার কাছ থেকে।”

“তার মানে?”

“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের লোক ম্যাডাম হিলডার সঙ্গে জার্মানিতে যোগাযোগ করেছেন। তাঁর বয়ান অনুসারে মাসিমা ওঁর ছেলেকে সবসময় আগলে আগলে রাখতেন। ছেলে যখন নার্সারি স্কুলে যেতে শুরু করল, তখন স্কুলে যাওয়া নিয়ে একটা সমস্যা হল। মাসিমা স্কুলবাসে ছেলেকে পাঠাতে চান না। তিনি নিজেও নিউ ইয়র্ক শহরের ভেতর গাড়ি চালাতে ভয় পান। সুতরাং রিচার্ডমেসো ছেলেকে পৌঁছে দিতেন। যেদিন পারতেন না, সেদিন ম্যাডাম হিলডা কাজে যাওয়ার পথে বাচ্চাটিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যেতেন। মিস্টার রোহিত রয় সেই সময়ে সবে গাড়ি চালানো শিখেছেন। মাসিমা বারবার করে ম্যাডাম হিলডাকে বলে দিয়েছিলেন, ওঁর ছেলে গাড়িতে থাকলে রোহিত যেন গাড়ি না চালায়। যেদিন অ্যাকসিডেন্ট হয় সেদিন মিস্টার রোহিত রয় গাড়িতে উঠে মাকে জোর করতে থাকেন তিনি গাড়ি চালাবেন। ম্যাডাম হিলডা ছেলের আবদার ফেলতে না পেরে রাজি হন। তারপরেই ঘটে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। পুলিশ যখন আসে, তখন ম্যাডাম হিলডা ছেলেকে বাঁচাতে নিজে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলেন। মাসিমা ছেলের মৃত্যুর পর পাগলের মতো হয়ে যান। কিছুদিন ওঁকে হাসপাতালেও থাকতে হয়। মিস্টার রোহিত রয়ের বাবার হার্ট অ্যাটাকও তার অল্প ক’দিনের মধ্যেই হয় এবং উনি তাতে মারা যান। তার পরপরই ছেলেকে নিয়ে ম্যাডাম হিলডা জার্মানিতে চলে যান।”

“তাহলে সে নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে কেন?”

“কারণ ম্যাডাম হিলডাকে মিস্টার রয় কয়েকদিন আগে বলেছিলেন যে উনি সুভদ্রামাসিকে সত্যটা জানাবেন।”

“কেন?”

“কারণ খুব স্পষ্ট নয়।”

“রোহিত কবে কথাটা বললেন সুভদ্রামাসিকে?”

“সেটা জানি না স্যার। আদৌ বলেছিলেন কিনা তাও জানি না।”

“তাহলে?”

“কিন্তু যদি বলে থাকেন। তাহলে পুরোনো ক্ষতটা আবার নতুন করে দেখা দেবে। রোহিত ওঁর কোলের ছেলেটির মৃত্যুর জন্য দায়ী –একথা যতই তিনি ভাববেন, ততই শোকে দিশাহারা হবেন। মাসিমার মনে হতে পারে, এই অন্যায় এবং এতদিনের এই ছলনা ক্ষমার অযোগ্য। এখন শুধু কল্পনার খাতিরেই ধরুন, মাসিমা খুব ভোরে মিস্টার রয়ের অ্যাপার্টমেন্টে আসেন।”

“সিকিউরিটি গার্ডের নজর এড়িয়ে?”

“এক সময়ে ঐ অ্যাপার্টমেন্টেটা মাসিমাদেরই ছিল। তার একটা চাবি মাসিমার কাছে থেকে যেতে পারে। সেটা ব্যবহার করে গার্ডদের চোখ এড়িয়ে স্বচ্ছন্দেই রেসিডেন্টদের স্পেশাল দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা এলিভেটরে উঠতে পারেন। সেক্ষেত্রে রোহিত সকালে মাসিমাকে দেখে অবাক হবে। তারপর কফি বানিয়ে গল্প করার জন্য বসবে। মাসিমা এই সময়ে অতর্কিতভাবে হ্যান্ডগান বার করে গুলি করে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে যাবেন। বাড়ি পৌঁছে মিথ্যে অজুহাতে ম্যাডাম এঞ্জেলিকাকে ফোন করবেন, মিস্টার রয়ের সকালে আসার কথা ছিল, কিন্তু আসেননি –এই বলে। এটা কি একেবারেই অসম্ভব?”।

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, অসম্ভব! কিন্তু হঠাৎ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল –সেদিন যখন সুভদ্রামাসির বাড়ি থেকে চলে আসছি, তখন কেমন সহজে উনি পেছন পেছন হেঁটে আসছিলেন। একেনবাবু ‘আপনি আসছেন কেন’ বলাতে থতমত খেয়ে কেমন নড়বড়ে হয়ে গেলেন! আরেকটা ব্যাপারও মনে ঝিলিক দিল, কেন সেদিন ছেলে বাবুর মৃত্যু নিয়ে সুভদ্রামাসি এত কান্নাকাটি করছিলেন? রোহিত রয়ের মৃত্যুর সঙ্গে তার আসল যোগটা কোথায়? দুজনেই সন্তানসম বলে, না ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে ইমোশনকে কন্ট্রোল রাখতে পারেননি? আরেকটা প্রশ্নও আমার মাথায় নতুন করে জাগল, কী করে সেদিন ফোন করে একেনবাবুকে বললেন রোহিত মার্ডারড হয়েছে। এটা তো সুভদ্রামাসির জানার কথা নয়! এঞ্জেলিকা যদি ওঁকে হত্যাকান্ড বলে থাকেন তাহলে অন্যকথা। কিন্তু বলেছিলেন কি?

আমাকে বিচলিত দেখে একেনবাবু বললেন, “জানি স্যার আপনি আপসেট হবেন, সেইজন্যই কিছু বলতে চাইনি।”

“যা বললেন তা আমার পক্ষে চিন্তা করাও কঠিন। আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন সুভদ্রামাসি এই মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত?”

“না স্যার। কিন্তু তদন্তের কাজে কোনো কিছুই উপেক্ষা করা উচিত নয়।”

“এবার জিজ্ঞেস করি, কেন করেন না? আপনি যা বললেন, তাতে তো আমারই বিশ্বাস টলে যাচ্ছে।”

“প্রথমত, মিস্টার রয়ের ব্যালাস্টিক টেস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী গুলিটা টোয়েন্টি-টু ক্যালিবারের, কিন্তু কপালের ক্ষতটা তার তুলনায় অনেক বড়ো। অর্থাৎ একসেন্ট্রিকভাবে চক্কর চক্কর খেতে খেতে গুলিটা ঢুকেছে এবং বুলেটে কোনো মার্কিং পাওয়া যায়নি।”

“বুলেটে দাগ থাকে নাকি?”

“সাধারণত থাকে স্যার। তার থেকে ধরতে পারা যায়, কোন হ্যান্ডগান থেকে ফায়ার করা হয়েছে। এটা স্পেশাল হ্যান্ডগান। মাসিমা পেশাদার খুনি নন যে খুন করার জন্য এরকম হ্যান্ডগান জোগাড় করবেন। দ্বিতীয়ত, হত্যাকান্ডটা সম্ভবত ঘটেছে আটটা থেকে ন’টার মধ্যে।”

“সেটা জানা গেল কি করে?”

“কারণ পাশের অ্যাপার্টমেন্টে বাথরুম রিমডেল করা হচ্ছিল। সাড়ে সাতটায় হ্যাঁন্ডিম্যানরা এসে টাইল ভাঙছিল। আটটা নাগাদ মিস্টার রয় ভীষণ আওয়াজ হচ্ছে বলে সিকিউরিটিকে কমপ্লেইন করেছিলেন। নটার সময়ে হ্যাঁন্ডিম্যানরা পনেরো মিনিটের কফিব্রেক নেয়। মিস্টার লংফেলো ন’টা-পাঁচের একটু পরে এসে ওঁকে মৃত দেখেন।” ।

একেনবাবু বলে চললেন, “যদি ধরি মৃত্যু আটটাতেই ঘটেছে। সেক্ষেত্রেও ঐ সময়ে ম্যানহাটান থেকে বেরিয়ে সুভদ্রামাসির পক্ষে সাড়ে দশটার আগে বাড়ি পৌঁছে ম্যাডাম এঞ্জেলিকাকে ফোন করা সম্ভব নয়।”

“নয় কেন?”

“কারণ ওই দিন লিঙ্কন টানেল আর জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ দুটোই জ্যাম ছিল –দু’ঘন্টার বেশি লাগছিল শুধু ব্রিজ পার হতে।”

তখন আমার মনে পড়ল ব্রিজ জ্যামের কথাটা সুভদ্রামাসিও বলেছিলেন সেদিন ফোনে।

“কিন্তু ফোন তো মোবাইল থেকেও করতে পারতেন?”

“তা পারতেন স্যার। কিন্তু ম্যাডাম এঞ্জেলিকার কাছে যে ফোনটা এসেছিল, সেটা ওঁর বাড়ি থেকে। তৃতীয়ত,…”।

আমি একেনবাবুকে থামিয়ে দিলাম, “আর বলতে হবে না। কিন্তু আমায় বলুন, সুভদ্রামাসি যদি সন্দেহের তালিকায় থাকেন, তাহলে সুভদ্রামাসির বন্ধু এঞ্জেলিকা বা রোহিতের বন্ধু আপনার সেই জিনিওলজিস্ট বাবু পিন্টো নেই কেন?”

“নেই, সেটা তো বলিনি স্যার। সন্দেহের প্রশ্ন নয়, সম্ভাবনার প্রশ্ন। পুলিশ এখন পর্যন্ত জনা পঞ্চাশ লোককে জিজ্ঞেসাবাদ করেছে। আমার লিস্টে তো অল্প নামই আছে।”

“আপনার লিস্ট আর পুলিশের লিস্ট আলাদা মানে? আমার তো ধারণা আপনি পুলিশের সঙ্গে আছেন এই ইনভেস্টিগেশনে?”

“কী যে বলেন স্যার, এটা পুলিশের ব্যাপার। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে পরামর্শ করেন –এই যা। তাও করেন, কারণ ভারতীয় কম্যুনিটি-এর মধ্যে জড়িত থাকতে পারে বলে। রোহিত রয় অবশ্য পুরো ভারতীয় নন, তবে আধা- ভারতীয় তো নিশ্চয়।”

সুভদ্রামাসির প্রসঙ্গে আর কোনো কথা হলো না। হঠাৎ আমার নজরে পড়ল একটা কার্ড। সেটাও নিশ্চয় ঐ কাগজটার সঙ্গেই মাটিতে পড়েছিল। আমি কার্ডটা তুলে দেখলাম ওটা রিচার্ডমেসোর ভিজিটিং কার্ড। কার্ডটা পুরোনো, যখন উনি ম্যানহাটানে থাকতেন। ওঁর ইউনিভার্সিটি আর ম্যানহাটানের অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা দুটোই সেখানে আছে। আমি কার্ডটা একেনবাবুকে দিয়ে বললাম, “এটাও কাগজের সঙ্গে নীচে পড়েছিল। ধরে নিচ্ছি। রিচার্ডমেসো আপনার সন্দেহের তালিকায় নেই।”

একেনবাবু রসিকতা তেমন বোঝেন না। বললেন, “ছি ছি স্যার, কি যে বলেন! ওটা যেদিন মেসোমশাইয়ের নোটবই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম, তখনই পড়ে গিয়েছিল। তুলে এই ফোল্ডারে রেখেছিলাম মাসিমাকে ফেরৎ দেব বলে, দেখুন আবার পড়ে গেল!”

“এটা না পেলেও মাসিমার খুব একটা এসে যাবে না।”

“তা হোক স্যার, একটা স্মৃতিচিহ তো বটে,” কথাটা বলেই উনি বাথরুমে চলে গেলেন।

.

৷৷ ২০ ৷৷

রোহিত রয়ের যেদিন ফিউনারেল সেদিন সকালে একেনবাবুর ফোন এল ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছ থেকে। আমরা তখন সবে কফি নিয়ে বসেছি। ফোন পেয়ে কফিটফি ফেলে কিছু না বলেই একেনবাবু বেরিয়ে গেলেন।

সাড়ে এগারোটার সময় আমি, প্রমথ, আর ফ্রান্সিস্কা যখন ফিউনারেলে যাচ্ছি তখনও উনি ফেরেননি। আমাদের ফিউনারেলে যাবার প্ল্যান ছিল না। কিন্তু সুভদ্রামাসি গতরাত্রে ফোন করে বললেন উনি ফিউনারেলে যাবেন। জানতে চাইলেন আমরা যাব কি না। তখন আর ‘না’ বলতে পারিনি, আমরা গেলে নিশ্চয় ওঁর ভালো লাগবে। সুভদ্রামাসিই ফিউনারেল হোমের ঠিকানাটা দিলেন। ম্যানহাটানে নয়, টাপান জি ব্রিজের কাছে “স্লিপি হলো” বলে একটা ছোট্ট শহরে।

ফিউনারেলে অনেক লোক এসেছে। ভিউইং হলে বসার জায়গা নেই। আমরা লবির এক পাশে এসে দাঁড়ালাম। ফ্রান্সিস্কা এরই মধ্যে ফিউনারেল হোমের এক অ্যাটেন্ডেন্টকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে চেয়ার ম্যানেজ করে সুভদ্রামাসির পাশে গিয়ে বসতে পারল। ভেতরে ইউলজি শুরু হয়েছে। সেটা শেষ হলে শেষ দর্শনের জন্য একে একে সবাই যাব। অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিলাম, কী হাবিজাবি ভাবছিলাম, নিজেরই খেয়াল নেই। হঠাৎ প্রমথ বলল, “একেনবাবুও এসেছেন।” তাকিয়ে দেখি একেনবাবু আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বাইরের দরজা দিয়ে লবিতে ঢুকছেন।

আজ এখানে সবারই বেশভূষা ফর্মাল। ছেলেরা গলায় টাই ঝুলিয়ে স্যুট পরে এসেছে। একেনেবাবুই ব্যতিক্রম। যেভাবে বাড়ি থেকে সকালে বেরিয়েছিলেন এসেছেন সেভাবেই। নস্যি রঙের সোয়েটার আর তার ওপরে হালকা খয়েরি রঙের অলওয়েদার কোট –টমেটো, মাস্টার্ড ইত্যাদির সসে রঞ্জিত হয়ে যেটা মাল্টি-কালার্ড।

আমাদের দেখতে পেয়ে একেনবাবু কাছে এসে দাঁড়ালেন। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ঢুকলেন ভিউইং হলে।

প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার? সাতসকালে হুড়মুড় করে বেড়িয়ে গেলেন?”

একেনবাবু বললেন, “আর বলবেন না স্যার, আরেকটা সমস্যা।”

“কী সমস্যা?”

“এখানে বলা যাবে না স্যার।” তারপর একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, “সবাই স্যার স্যুট-টুট পরে এসেছেন।”

“আমি স্যুট পরেছি ঠিকই, কিন্তু প্রমথ এসেছে স্পোর্টস জ্যাকেট চাপিয়ে, টাই-ফাইও লাগায়নি। আমি অবশ্য বলেছিলাম, “ফিউনারেলে যাচ্ছিস, সবাই টাই পরে থাকবে।”

ও পাত্তা দেয়নি। উলটে বলেছে, “তুই হচ্ছিস কনফর্মিস্ট, সকলের সঙ্গে তাল রেখে চলার চেষ্টা করিস।”

আমি এই সুযোগে প্রমথকে টিপ্পনি কাটার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না। একেনবাবুকে বললাম, “আপনি হচ্ছেন সত্যিকারের নন-কনফর্মিস্ট, প্রমথ শুধু মুখে তড়পায়!”

শুনে প্রমথর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “রাস্কেল।”

ভিউইং-এর লাইন শুরু হয়েছে। লম্বা লাইন, আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। আমরা গিয়ে যখন ক্যাসকেডের সামনে পৌঁছলাম তখন ঘর প্রায় ফাঁকা। রোহিত রয় শুয়ে আছেন। বলা উচিত ওঁর দেহটা শুয়ে আছে। পরণে নেভি-ব্লু স্যুট, গলায় একটা লাল রঙের নক্সা কাটা টাই। মুখটা প্রশান্ত। কপালে গুলি লেগেছিল শুনেছিলাম। কিন্তু তার কোনো চিহ নেই। মর্টিশিয়ান তার যাদুতে সবকিছু অদৃশ্য করে দিয়ে রোহিত রয়কে তাঁর পুরোনো নিখুঁত অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছে। প্রাণটাই শুধু ফিরিয়ে আনতে পারেনি।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম ক্যাসকেডের সামনে, প্রমথর ঠেলা খেয়ে এগিয়ে গেলাম। মৃতদেহ দেখা আমার থেকেও ও বেশি অপছন্দ করে।

একটু দূরে সুভদ্রামাসি আর একজন সাদা মহিলা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন। অনুমান করলাম, রোহিত রয়ের মা হিলডা। সন্তানহারা দুই নারী! ফ্রান্সিস্কা সুভদ্রামাসির একটা হাত ধরে আছে। সুজাতাও সেখানে দাঁড়িয়ে।

সুভদ্রামাসির কাছে যেতে আস্তে আস্তে বললেন, “আমি এখন বাড়ি যাব।” আমি হাত বাড়িয়ে সুভদ্রামাসির আরেকটা হাত ধরলাম। আমার আর ফ্রান্সিস্কার হাতে ভর দিয়ে উনি এগোতে থাকলেন। তারপর একমুহূর্তের জন্য থেমে হিলডাকে ডাকলেন। হিলডা কাছে আসতে আমাদের হাত ছেড়ে দিয়ে হিলডাকে জড়িয়ে ধরলেন। হিলডাও। ওঁদের আলিঙ্গন শেষ হবার পর, হিলডা বললেন, “আমি কয়েকদিন আছি, তোমার কাছে আসব।”

“এসো।” মাথা নাড়লেন সুভদ্রামাসি।

মনে হল, এক পুত্রের মৃত্যুতে ঘটেছিল যে বিচ্ছেদ, তার সমাপ্তি হল অন্য পুত্রের মৃত্যুতে!

সুভদ্রামাসিকে গাড়িতে তুলে নিজেদের গাড়ির দিকে এগোচ্ছি, দেখলাম বাবু পিন্টো গাড়িতে উঠলেন। একেনবাবু হাত নেড়ে চেঁচিয়ে বললেন, “ভালো আছেন স্যার? চিনতে পারছেন?”

একেনবাবুকে একবার যে দেখেছে, তার চিনতে না পারার কথা নয়। বাবু পিন্টো মাথা নেড়ে বললেন, “নিশ্চয়, আপনি ভালো তো?”

আমাদের গাড়িটা বাবু পিন্টোর গাড়ির কয়েকটা গাড়ি পরে। আমরা ওঁর কাছাকাছি যেতে, বাবু গাড়ির কাঁচ নামিয়ে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার গ্রেট আঙ্কেলের ব্যাপারে আর কিছু এগোল?”

“না স্যার, এখনও কিছু করতে পারিনি।”

“আমি দুয়েকটা লিড পেয়েছি। একদিন যোগাযোগ করবেন, বলে দেব।”

“সো কাইন্ড অফ ইউ স্যার, সো কাইন্ড অফ ইউ। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই যোগাযোগ করব।”

“এনি টাইম,” বলে বাবু পিন্টো চলে গেলেন। বাবু-র চোখ লাল, বেশ একটু বিধ্বস্ত মনে হল। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু, সেটাই স্বাভাবিক।

প্রমথ বাবু পিন্টোকে চিনত না। লোকটা কে বলাতে মন্তব্য করল, “টোপ।”

“তার মানে স্যার?”

“বুঝলেন না, এক টুকরো খবর দেবে। সেটা গিলে আপনি হ্যাংলার মতো আরও খবর চাইবেন। তখন বলবে পয়সা লাগবে।”

“কী যে বলেন স্যার!”

প্রমথ বলল, “ঠিকই বলি। এবার আসল কথাটা বলুন তো আজ সকালে বেড়িয়েছিলেন কেন?”

একেনবাবু বললেন, “আরেকটা মার্ডার। একই স্টাইলে।”

“তার মানে?”

“যেরকম বুলেট মিস্টার রয়ের শরীরে পাওয়া গেছে, ঠিক সেরকম টোয়েন্টি-টু ক্যালিবারের মার্কিংলেস বুলেট। ক্ষতর সাইজও সাধারণ বুলেটে যা হওয়া উচিত, তার চাইতে বেশি। একেবারে আইডেন্টিকাল কেস!”

“লোকটি কে?”

“দিলীপ পারেখ।”

“তারমানে ভারতীয়?”

“হ্যাঁ স্যার।”

“কী করত সে?”

“একটা স্পেশালিটি শপে কাজ করতেন। সেখানেই কেউ এসে খুন করেছে।”

“আজ সকালে?”

“না, মনে হচ্ছে কাল রাত্রে। দিলীপ অনেক রাত পর্যন্ত দোকানে বসে কাজ করতেন।”

এইভাবে প্রশ্ন আর উত্তর না লিখে একেনবাবুর কাছে মোটামুটি যা উদ্ধার করলাম সেটা বরং লিখি।

দিলীপ পারেখ গুজরাতের আহমেদাবাদ থেকে বছর চারেক আগে এদেশে এসেছিল। কম্পিউটার গ্রাফিক্সে ট্রেনিং ছিল, নিজের ফিল্ডে চাকরি না পেয়ে একটা স্পেশালিটি শপে সেলসম্যানের চাকরি করত। সেইখানেই রোহিত রয়ের সঙ্গে ওর আলাপ। রোহিত রয় অ্যাড-এজেন্সির জন্য ছবি তৈরি করতেন। কিন্তু সব সময়ে সেগুলো রিয়েল হত না, বিভিন্ন ছবির অংশ ব্যবহার করে কম্পোজ করা হত। এডিটিং করা হতো এমন সযত্নে যাতে খুবই ন্যাচেরাল লাগে।

দিলীপের কম্পিউটার গ্রাফিক্সের ট্যালেন্ট দেখে রোহিত ওকে কাজে লাগান। দিনের ডিউটি শেষ হলে রোহিত রায়ের ডিজিটাল লাইব্রেরি থেকে ছবি বেছে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন মাফিক ছবি দিলীপ তৈরি করত। দিলীপের কম্পিউটারে এই ধরণের বেশ কিছু হাফ-কমপ্লিট কম্পোজিশান পুলিশ পেয়েছে। ঠিক কি ধরণের ছবি পুলিশ পেয়েছে, একেনবাবু বিস্তারিত জানেন না। তবে ওঁর ধারণা, পুলিশের থিওরি হল, দিলীপও সম্ভবতঃ রোহিতের সঙ্গে ব্ল্যাকমেইলের ব্যাপারে যুক্ত ছিল। রোহিত রয়ের বাড়ির কম্পিউটারে পুলিশ যে কয়েকটা আপত্তিকর ছবি পেয়েছে, তার এডিটিং-এর কাজ মোটেই পেশাদারি নয়। দিলীপের কম্পিউটারের ছবিগুলো অনেক উচ্চস্তরের। এটা সম্ভব যে রোহিত নিজে

ভালো ছবি তুললেও, ওঁর এডিটিং-এর কাজ দিলীপই করত। উনি দিলীপকে শুধু কম্পোজিশনটা বলে দিতেন। ফিনিশিং-এর ব্যাপারটা দিলীপের হাতে থাকত। এই থিওরিটা সত্যি হলে দুজনের মৃত্যুই সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। একেনবাবু যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন আমার মনে পড়ল যে রোহিত আমাকে বলেছিলেন যে ওঁর একজন অ্যাসিস্টেন্ট আছে। সেই অ্যাসিস্টেন্টই নিশ্চয় দিলীপ।

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত