।। ১১ ।।

বন্দনা আর প্রভাসের বিয়ে নেক্সট উইকে হচ্ছে। আজকাল অনলাইনে গিফ্ট কিনে উপহার দেওয়া যায়। যদিও সেটা খুব একটা সস্তায় হয় না। আমি গিফ্ট-ইন্ডিয়া ডট কম-এ দিয়ে একটা ব্রোঞ্জের বুদ্ধমূর্তি অর্ডার করলাম। বন্দনার জন্যই ওটা কিনলাম। আমাদের বাড়িতে একটা বুদ্ধমূর্তি ছিল, নেপাল থেকে বাবা কিনে এনেছিলেন। বন্দনা সেটা খুব ভালোবাসত। পুরোনো কথা। এখন হয়তো ভুলেও গেছে। প্রমথ অবশ্য আমার থেকে অনেক বেশি দূরদর্শী। ওর মা’কে বলে এসেছিল একটা ভালো শাড়ি কিনে রাখতে। সেই সঙ্গে বলে এসেছে বিয়েটা গোপনে হচ্ছে, কাউকে যেন কিছু না বলেন, শুধু বিয়ের পরে বন্দনার হাতে যেন শাড়িটা পৌঁছে দিলেই হবে। আমি মা’কে কিছু বলিনি, পেটে কথা রাখতে পারে না বলে।

কলেজে যাবার আগে ইমেইল চেক করতে গিয়ে বন্দনার একটা মেসেজ পেলাম। ওর বাবা-মা বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। রেজিস্ট্রিটা যেমন হবার তেমন হবে। হিন্দু বিয়েটা হবে ছ’ সপ্তাহ বাদে। লিখেছে, “তোমার ওকালতি বোধ হয় কিছুটা কাজ করেছে। তার থেকেও বোধ হয় বেশি কাজ হয়েছে যখন জানিয়েছ, তুমি ওদের জামাই হতে চাও না। বন্দনা মিথ্যে বলেনি। অথচ, কথাটা সম্পূর্ণ সত্যিও নয়। এনিওয়ে, শিশিরবাবুর কোনো কথা বন্দনার চিঠিতে নেই। আশাও করিনি। ও এখন নিজের বিয়ে নিয়ে মশগুল। ফ্রাঙ্কলি, শিশিরবাবুর মৃত্যু নিয়ে প্রধান যে চিন্তাটা ছিল, সেটা দূর হওয়ায় আমিও ওসব নিয়ে বিশেষ ভাবছি না। একেনবাবুর ব্যাপারটা আলাদা। উনি সাধারণত আগবাড়িয়ে কোনো কিছুতে জড়ান না। কিন্তু একবার জড়িয়ে গেলে, জট না ছাড়া পর্যন্ত চুপচাপ থাকতে পারেন না। দুদিন আগেও দুলাল মিত্রের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছেন। গতকাল দেখলাম দুলাল মিত্রের কাছ থেকে ওঁর নামে একটা মোটা খাম এসেছে। কিন্তু খামের মধ্যে কি আছে সেটা আর জানা হয়নি, কারণ একেনবাবু এক দিনের জন্য মায়ামি গেছেন একটা কনফারেন্সে। ফিরবেন আজ বিকেলে। তখন জানতে পারব।

ফ্যান্সিস্কার ফোন এল। এই শনিবার সুভদ্রামাসির কাছে গান শিখতে যেতে চায়। জিজ্ঞেস করল, আমাদের সুবিধা হবে কিনা। তাহলে সুভদ্রামাসিকে ফোন করবে। বিনি পয়সায় ভোজে আপত্তিটা কোথায়! প্রমথ নিশ্চয় রাজি হয়েছে। একেনবাবুরও মনে হয় না আপত্তি হবে বলে। বললাম, “গো অ্যাহেড।”

একেনবাবু এলেন বিকেল বেলায়। বললাম, “আপনার একটা বড়ো খাম এসেছে দুলাল মিত্রের কাছ থেকে।”

“এসে গেছে স্যার! কই দিন।”

খামটা এগিয়ে দিতেই সেটা ছিঁড়ে একতাড়া কাগজ বার করলেন।

“কী ওগুলো?”

“যে চিঠিগুলো শিশিরবাবুর বাড়িতে মেঝেতে পেয়েছিল, তারই কপি।”

একেনবাবু চোখ বুলিয়ে চিঠিগুলো আমাকে দিলেন। গোটা আটেক পুরোনো চিঠি। লেখাগুলো কিছু কিছু জায়গায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে। অনেকদিন ভাঁজ করা অবস্থায় ছিল, ভাঁজের জায়গাগুলো ভালো পড়া যাচ্ছে না। বোঝাই যায় প্রেমপত্র। হাতের লেখা সব একই ছাঁদের। সুতরাং শিশিরবাবুর কোনো বান্ধবী হবেন। বান্ধবী বলছি, কারণ প্রভাসের কাছে শুনেছি উনি বিয়ে করেননি। তথ্যটা সঠিক কিনা জানি না।

“কোনো চিঠিতেই তারিখ নেই,” একেনবাবু বললেন।

“তারিখ জানলে সুবিধা হতো?”

“কে জানে স্যার, তবে এইটেই মনে হয় শেষ চিঠি।” একেনবাবু একটা চিঠির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আঁকাবাঁকাভাবে এক লাইনের চিঠি।

‘এটা রেখে দিও, আর কাল ভোর চারটের সময় ট্যাক্সি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা কোরো।‘

খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা। জেরক্স-এ আসল কাগজের একটা ছাপ বাইরে পড়ে। সেই ছাপ থেকে বোঝা যাচ্ছে, যে কাগজে লেখা হয়েছিল –সেটা চিঠি লেখার কাগজ নয়, এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ।

জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝছেন?”

“কে জানে স্যার, এইসব প্রেম-ফ্রেম বুঝি না। আমার আবার অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। বাবা বললেন করতে, আমি করলাম।”

“সেটা বুঝলাম। কিন্তু দুশো টাকার ডাক টিকিট লাগিয়ে ওসি সাহেব এটা পাঠালেন, কিছুই মিলল না বলছেন।”

“আপাতত নয় স্যার। তবে ভবিষ্যতের কথা আমরা কতটুকু জানি।” খামের মধ্যে চিঠিগুলো ভরতে ভরতে একেনবাবু বললেন।

আমি বললাম, “টু ব্যাড, চিঠিগুলো ছেলেদের লেখা নয়।”

“কেন বলুন তো স্যার?”

“তাহলে আপনি গিন্নীকে চিঠিগুলো কপি করে পাঠাতে পারতেন।”

“এই সব চিঠি পেলে স্যার ও হার্ট ফেল করত। ভাবত নির্ঘাৎ আমি কারোর সঙ্গে প্রেম-টেম করছি।”

প্রমথ বাড়িতে এসে চিঠিগুলো দেখল। ও আবার খুব টেকনিক্যালি সবকিছু দেখে। বলল, “দেখলি একটা বানান ভুল নেই। তুই হলে একগণ্ডা বানান ভুল লিখতি। বিশেষ করে এই ‘সরস্বতী’ আর ‘যথেষ্ট’ বানানটা।”

আমায় মানতে হবে ওই দুটো বানান আমি সবসময়ে ভুল করি, আর প্রমথ সেটা কারেক্ট করে প্রভূত আনন্দ পায়।

.

।। ১২ ।।

শনিবার সুভদ্রামাসির বাড়িতে ফ্রান্সিস্কার রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা শুরু হল। আমরা নির্বাসিত হলাম বেসমেন্টে। সুভদ্রামাসির বেসমেন্টে আগে কোনোদিন আসিনি। বিশাল বেসমেন্ট, পুরোটাই ফিনিশড। শুধু যেখানে ফার্নেস আর জলের হিটারটা আছে সেটা পার্টিশন দিয়ে ঘেরা। মেঝেটা দামি কার্পেটে ঢাকা। একদিকে পুল টেবিল, ট্রেড মিল, আর এক্সারসাইজ বাইক। নিশ্চয় রিচার্ডমেসো ওগুলো ব্যবহার করতেন। অন্যদিকে একটা ফুল ফাইভ-পিস সোফাসেট। দেয়াল জুড়ে লম্বা বিল্ট-ইন বুকশেলফ।

সেখানে সাজানো অজস্র বই।

একেনবাবু কয়েকটা বই নিয়ে সোফায় বসলেন। আমিও বই ঘাঁটতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু প্রমথ বলল, “একটু পুল খেললে মন্দ হয় না।”

তিনজনে একসঙ্গে পুল খেলা যায় না। একেনবাবু দেখলাম খেলায় খুব একটা উৎসাহী নন।

আমি পুল খেলা এদেশে এসে শিখেছি। নিয়মটা জানি এইটুকুই। প্রমথ বলল ও শুধু একদিন খেলেছে। অথচ দিব্বি আমাকে নাকানিচোবানি খাওয়াতে শুরু করল।

আমি ওর একদিন খেলার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করাতে, বলল, “চুপ কর, তোকে হারাতে আবার প্র্যাকটিস করতে হবে নাকি!”

আমি তার উপযুক্ত জবাব দেবার আগেই একেনবাবু এসে বললেন, “স্যার, টুলি অ্যামেজিং!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী পড়ছেন অত মন দিয়ে?”

“কী করে জিনিওলজি কনস্ট্রাক্ট করতে হয়। এইসব নিয়ে যে এত বই আর অর্গানাইজেশন আছে, আমার ধারণাই ছিল না!”

“মনে হচ্ছে আপনি এখন জিনিওলজির কিক্‌-এ আছেন,” প্রমথ টিপ্পনি কাটল।

“তা আছি স্যার। সত্যি দেখুন তো, এই ধরুন রবীন্দ্রনাথ। তিনি তো জন্মেছেন ১৮৬১ তে। তাঁর সম্পর্কে আমরা খুঁটিনাটি কত কিছু জানি। এবার দেখুন স্যার, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় আপনার ঠাকুরদার বাবার থেকেও বড়ো।”

এবার একটু হিসেব করতে হল। আমার বাবা জন্মেছেন ১৯৪৫ সালে। বছর পঁচিশ তিরিশ বয়সে যদি পূর্বপুরুষদের সন্তান হয়েছিল ধরা যায়, তাহলে রবীন্দ্রনাথ আর আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা এক বয়সি হওয়া কিছুই বিচিত্র নয়।

“তা হবেন সম্ভবত।”

“এবার বলুন স্যার, আপনার ঠাকুরদা কী করতেন?”

“তিনি কলেজে পড়াতেন।”

“ঠাকুরদার বাবা?”

“শুনেছি উকিল ছিলেন, খুব শিওর নই।”

“তাঁর বাবা?”

“কোনো ধারণাই নেই।”

“দ্যাটস দ্য পয়েন্ট স্যার। আমরা নিজেদের হিস্ট্রি কিছুই জানি না।”

“জানার কি খুব প্রয়োজন আছে?” প্রমথ প্রশ্ন তুলল। “ধরুন, আপনার ঠাকুরদার ঠাকুরদা ছিলেন অতি জোচ্চর, বদমাইশ লোক –দুনিয়া ঠকিয়ে খেতেন। কিংবা ধরুন তিনি ছিলেন অতি মহৎ সাধুসজ্জন এক ব্যক্তি। তাতে আপনার কী এসে গেল?”

একেনবাবু মাথা নাড়লেন, “না স্যার, রুটটা ইম্পর্টেন্ট। আপনি যাই বলুন না কেন।”

“ননসেন্স!” প্রমথ একেনবাবুর বক্তব্য খারিজ করল।

পুল খেলাটা বিশেষ জমছিল না। তাই সবাই উপরে চলে এলাম। এসে দেখি ফ্রান্সিস্কার গান শেখা পুরোদমে চলছে। ওদের ডিস্টার্ব না করে, আমরা লিভিংরুমে

এলাম। আমি ঘরের আরাম কেদারায় শুয়ে গান শুনছি, একেনবাবু নীচ থেকে বই এনে মগ্ন হয়ে পড়ছেন। প্রমথ একটু ঘুর ঘুর করে সুজাতার সঙ্গে গল্প-গুজব করতে গেল। নিশ্চয় রান্নার টিপস নিচ্ছে। ও রাঁধতে ভালোবাসে, তবে খুব লিমিটেড মেনু। সুতরাং ও যে সুজাতার সঙ্গে কথা বলছে, তাতে আমি উৎসাহিত হলাম।

শুয়ে শুয়ে একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। প্রমথর ডাকে চমক ভাঙল। “কিরে শুয়ে শুয়ে নাক ডাকছিস?”

“সেকি রে অনেকক্ষণ ঘুমোলাম নাকি!”

“তা আধঘন্টা তো হবেই।”

“সুভদ্রামাসিরা কোথায়?”

“রান্নাঘরে।”

“গান শেখা শেষ?”

“হ্যাঁ, কিন্তু এখন ওখানে যেতে পারবি না। আমাকেও তাড়িয়ে দিল।”

“তার মানে?”

“সোশিওলজিক্যাল ডিসকাশনস হচ্ছে– ইন্টার-রেশিয়াল ম্যারেজের সুফল–কুফল নিয়ে।”

অনেকদিন থেকেই আঁচ করেছি প্রমথর ব্যাপারে ফ্রান্সিস্কা এখন খুব সিরিয়াস।

চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “সুভদ্রামাসি, আমার কি ওখানে যাওয়া বারণ?”

“কেন বারণ হবে?”

“প্রমথ যে বলল।”

“ও পালাতে চাইলে আমি কি করব?”

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুভদ্রামাসি আর ফ্রান্সিস্কা আমাদের সঙ্গে এসে বসল। আমিই বললাম, “তোমরা নাকি মিক্সড ম্যারেজ নিয়ে আলোচনা করছিলে।”

“তা একটু করছিলাম।”

“আচ্ছা, সুভদ্রামাসি, তুমি যখন মেসোমশাইকে বিয়ে করবে বলে বাবা-মাকে বললে, তখন তাঁদের রিয়্যাকশন কী হয়েছিল?”

“শোনো ছেলের কথা,” সুভদ্রামাসি সস্নেহে আমার দিকে তাকালেন।

“বলো না।”

“বাবার ভীষণ আপত্তি ছিল। চিঠি লেখাই বন্ধ করে দিয়েছিল।”

“আর তোমার মা-র?”

“মা অতটা আপসেট হয়নি, যদিও আমার ভয় ছিল মা-কে নিয়েই। বাবাকে আমি একজন লিবারেল ইন্ট্যালেকচুয়াল ভাবতাম। লন্ডন-ফেরত ফিলসফির লোক। মা’র যেটুকু পড়াশুনো দেশেই, দাদু-দিদিমার ফ্যামিলি ছিল খুব কনসার্ভেটিভ। কিন্তু মা লিখেছিল, ‘তোমার বাবার সঙ্গে সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েও ওঁকে আমি ভালোবাসতে পেরেছি। তুমিও সেটা পারতে বলে আমার বিশ্বাস। তাও আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমার বন্ধুকেই যদি বিয়ে করো, আমাকে সেটা মানতেই হবে। শুধু মনে রেখো, ভালোবাসার যে উন্মত্ততা এখন অনুভব করছ, সেটা কিন্তু জিইয়ে রাখা কঠিন। দুই কালচারে দুই ধর্মের মধ্যে তোমরা বড়ো হয়েছ, সেই ব্যবধান অতিক্রম করার শক্তি তুমি যেন পাও।’।”

“মাই গড, তোমার মনে আছে কথাগুলো?”

“খুব, ওই চিঠিটা যে আমি কতবার পড়েছি!” বলে সুভদ্রামাসি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “চলো, তোমাদের নিশ্চয় খুব খিদে পেয়ে গেছে। এবার খেয়ে নেওয়া যাক।”

খেতে খেতে একেনবাবু হঠাৎ বললেন, “মাসিমা, আমি রিচার্ডমেসোকে দেখিনি, কিন্তু উনি রিমার্কেল।”

সুভদ্রামাসি হেসে বললেন, “তা তো আমি জানি, কিন্তু তুমি সেটা আবিষ্কার করলে কী করে?”

“আমি আপনাদের জিনিওলজিটা সেদিন পড়ছিলাম। আজকেও কয়েকটা পাতা উলটোলাম –কী ভাবে সব ইনফরমেশন জোগাড় করেছেন। বিশেষ করে আপনার দাদুর ঠাকুরদার খবরগুলো।”

একেনবাবুর কথা শুনে সুভদ্রামাসিকেও চিন্তা করতে হল, “কার কথা বলছ একেন?”

“কেন শিবনারায়ণ গুপ্তর কথা।”

“ওরে বাবা তুমি তো আমার গুষ্টির খবর জেনে ফেলেছ!”

“না, ম্যাডাম, মানে মাসিমা –আমি ওঁর লেখা আর নোটগুলো পড়ে মুগ্ধ!”

সুভদ্রামাসিকে বোঝালাম, “প্রমথর ভাষায় একেনবাবু এখন জিনিওলজির কিক্‌-এ আছেন।”

“আহা বেশ তো। রিচার্ড কত কষ্ট করে ওগুলো লিখেছে, একজন তো মন দিয়ে পড়ছে।”

“প্রতিটি পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি। কোথায় কোথায় ঘুরেছেন –ব্রাসেলস, প্যারিস, মিউনিক… একটা বিরাট রিসার্চ।”

“সেটা করেছে। একেবারে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল কয়েক বছর।”

“কিন্তু এতসব খবর জোগাড় করলেন কি করে?”

“রোহিতই যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল বাবু পিন্টো বলে এক জিনিওলজি কনসাল্টেন্টের সঙ্গে। রোহিতেরই বয়সি, খুব এন্টারপ্রাইজিং। সেও খুব ইন্টারেস্ট পেয়েছিল কাজটায়। রিচার্ডের সঙ্গে ইউরোপে গিয়েছিল।”

প্রমথ বলল, “ব্যাস, আপনি এবার একটা লিড পেয়ে গেলেন। বাবু পিন্টোর সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনার ফ্যামিলি ট্রি-টাও শুরু করে দিন।”

“কী যে বলেন স্যার, এসব অনেক পয়সার ব্যাপার। তবে একটু টিপস যদি পেতাম কি করে কাজটায় এগোব…”

“কথা বলে দেখতে পারো,” সুভদ্রামাসি সস্নেহে বললেন। “আমার কাছে এসেছে বাবু কয়েকবার, ছেলেটা ভালো।”

.

।। ১৩ ।।

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। এবার দেশ থেকে ফেরার সময় বাড়ির পুরোনো অ্যালবামটা নিয়ে এসেছি। সেখানে বাবার বেশ কয়েকটা ছবি আছে। মা-র খুব ইচ্ছে বাবার একটা ছবি ডিজিটালি এনহ্যান্স করি, যেরকম সুভদ্রামাসি ওঁর মা আর আমার দিদিমার ছবিটা করেছেন। আমি রোহিত রয়কে ধরব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু দেখলাম একেনবাবু আরেকজন এক্সপার্টের খোঁজ পেয়েছেন। তাকে দিয়ে বউয়ের একটা ছবি ফ্রেম করিয়ে নাইট স্ট্যান্ডের উপর রেখেছেন।

আমি বললাম, “একেনবাবু এই লোকটিকে আমারও লাগবে। বাবার কয়েকটা ছবি এনেছি।”

“নিশ্চয় স্যার।”

“কত নিল আপনার কাছ থেকে?”

একেনবাবু কিছু বলার আগেই প্রমথ বলল, “ক্ষেপেছিস, উনি গাঁটের পয়সা খরচা এসব করবেন। নিশ্চয় পরস্মৈপদী।”

“কি, সত্যি নাকি?”

“আসলে স্যার, এখনও দেওয়া হয়নি কিছু। মানে স্টুয়ার্ট সাহেবের খুব চেনা জানা লোক আর কি।”

“তাহলে বুঝে নে,” প্রমথ বলল।

“সে যাই হোক, খুব বেশি না হলেই হল। দুটো কপি করিয়ে নেব তাহলে। একটা আমার কাছে রাখব।”

“আমায় দিন না ছবি, আমি করিয়ে আনব।”

“কোন ছবিটা করি বলুন তো,” বলে আমি অ্যালবাম খুললাম। তারমধ্যে মা’কে সুভদ্রামাসির দেওয়া ছবিরও একটা কপি ছিল; কলকাতার স্টুডিও থেকে কপি করে এনেছিলাম নিজের কাছে রাখব বলে।

একেনবাবু সেটা দেখে বললেন, “যাই বলুন স্যার, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের ফোটো স্পেশালিস্টের কাজ আরও ভালো।”

আমি বললাম, “এটা কিন্তু অরিজিন্যাল নয়, অরিজিন্যালটা মায়ের কাছে।”

“না, না এটাও খারাপ নয়। কিন্তু আমার ফ্যামিলির ছবিটা খুব ন্যাচারাল হয়েছে।”

“নিজের বউয়ের ছবি তো ভালো লাগবেই। শুধু শুধু ফোটো-স্পেশালিস্টকে গালমন্দ করছেন কেন!” প্রমথ মন্তব্য করল।

“চুপ কর তো, একটা ছবি সিলেক্ট কর এখান থেকে –যেটা বড়ো করা যায়।”

“আমি বলি স্যার, অ্যালবামটা ওঁর কাছে নিয়ে চলুন। কোনটে বড়ো করলে ভালো হবে। উনি বলতে পারবেন।”

“ভদ্রলোক থাকেন কোথায়?”

“খুব দূরে নয়, থার্টি নাইন্থ স্ট্রীট আর নাইন্থ অ্যাভেনিউয়ের কাছে।”

একেনবাবু ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলেন। ঠিক হল ওখানে গিয়ে ছবিটা দিয়ে কোথাও লাঞ্চ খেয়ে আমরা ফিরব।

.

আজকে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। স্টুয়ার্ট সাহেবের ফোটো-স্পেশালিস্টকে ছবি দিয়ে কাছেই একটা ছোট স্যান্ডউইচ শপ ছিল –সেখানে ঢুকলাম। একেনবাবু প্রথমেই যা করেন –মেনুতে চোখ বুলিয়ে আর্তনাদ করলেন।

“এ একেবারে মার্ডার স্যার। এইটুকু তো দোকান, কিন্তু দামের বহর দেখেছেন?”

ফ্র্যাঙ্কলি, খুব একটা বেশি দাম মেনুতে দেখলাম না। নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে দামগুলো একটু চড়াই হয়।

“আপনি একটা কাজ করুন না, প্রমথ বলল, “মোড়ের মাথায় হট ডগের ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে চলে যান।”

“লাঞ্চ ইজ অন মি,” আমি ঘোষণা করলাম।

একেনবাবু একটু লজ্জা পেলেন, “না, না, সে কি স্যার, সব ডাচ ট্রিট।”

কথাটা একেনবাবু শিখেছেন ফ্রান্সিস্কার কাছ থেকে। ও একদিন এসেছিল, সেদিন প্রমথ বাইরে। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম বাইরে কোথাও খাওয়ার। ফ্রান্সিস্কা বলেছিল, “ও কে, কিন্তু ডাচ ট্রিট।”

একেনবাবু আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকাতে, আমি বলেছিলাম, “হিজ হিজ, হুজ হুজ।”

কথাটা খুব মনে ধরেছিল। পরে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আচ্ছা, কথাটা এল কোত্থেকে? ডাচরা কি খুব ইন্ডিপেন্ডেন্ট –কেউ কারোর কাছ থেকে কিছু নিতে চায় না।”

“আই হ্যাভ নো ক্রু। আপনি বরং ফ্রান্সিস্কাকে জিজ্ঞেস করুন।”

“নাঃ, উনি তো সুইস। ইউরোপের লোকেদের মধ্যে অনেক রাইভ্যালরি থাকে স্যার। অনেস্ট অ্যাসেসমেন্ট পাব না।”

“কেন, আপনি তো ফ্রন্সিস্কাকে খুব পছন্দ করেন। ওকে অবিশ্বাস করবেন?”

“আরে ছি, ছি, স্যার, আপনি একেবারে হিউমার বোঝেন না।”

“ঠিকই, কী করে বুঝব যে আপনি গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে হিউমারিস্ট হবার চেষ্টা করছেন।”

ডাচ ট্রিটের কথা ভেবেই বোধহয় একেনবাবু শুধু কফি আর একটা ডোনাট অর্ডার করলেন। জোর করেও ওঁকে দিয়ে অমলেট বা কোনো স্যান্ডউইচ অর্ডার করাতে পারলাম না। আমি আর প্রমথ অর্ডার দিলাম দুটো বড়ো চীজ বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের।

খেতে খেতে প্রমথ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রবীন্দ্রনাথের লেখা শীতের উপর ক’টা গান তোর মনে আছে?”

“কেন বলত?”

“কারণ অল্পই লিখেছেন। ঋতু নিয়ে ওঁর লেখায় খালি পাবি বর্ষা। হ্যাঁ, বসন্তও আছে, কিছু শরৎ আর কিছু গ্রীষ্ম –ব্যাস। বর্ষাকালে ঘরবন্দী হয়ে থাকতেন, আর এন্তার লিখতেন। ভদ্রলোক নিউ ইয়র্কে থাকলে দেখতিস কলম দিয়ে শীতের গানের ফুলঝুরি বেরত।”

প্রমথর মতো নিরস লোকের কাছে বর্ষার রূপ নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। তবে ওর লজিকের বিরুদ্ধে বড়ো কোনো আগরুমেন্ট আমার মাথায় এল না। বাস্তবিকই খেয়ে দেয়ে আবার এই ঠান্ডায় রাস্তায় বেরতে হবে ভাবতেও গায়ে জ্বর আসে।

একেনবাবু এদিকে মন দিয়ে আমাদের বাড়ির অ্যালবামের পাতা উলটে উলটে ছবিগুলো দেখছেন। মাঝে মাঝেই ‘এটা কার ছবি, তিনি কোথায়, “কি করেন, ইত্যাদি প্রশ্ন ছুঁড়ছেন। ছবিতে আমার দিদিমার কয়েকটা ছবি ছিল। কিন্তু সেগুলো বেশি বয়সের। একেনবাবু বললেন, “যাই বলুন স্যার, আপনার দিদিমা কিন্তু ওঁর সৌন্দর্য ঠিক ধরে রেখেছিলেন!”

প্রমথ বলল, “এই তেলটা আপনি বাপিকে কেন দিচ্ছেন –যাতে ও বিল পে করে?”

“না,না স্যার সিরিয়াসলি। মাসিমার দেওয়া ছবিতে যেমন দেখতে ছিলেন, প্রায় সেই একই চেহারা ধরে রেখেছেন অনেক পরে তোলা এই ছবিগুলোতে।” বলে অ্যালবামের পাতাটা আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন।

আমি একেনবাবুর সঙ্গে এ বিষয়ে একমত। সত্যি দিদিমা চিরদিনই খুব সুন্দরী ছিলেন।

“কি নাম ছিল স্যার আপনার দিদিমার?”

“নয়নতারা।”

“আপনার মা আর সুভদ্রামাসির জেনারেশন অফ ফ্রেন্ডশিপ।”

এটা প্রশ্ন না কমেন্ট বুঝলাম না। হ্যাঁ, তা ঠিক।”

“সুভদ্রামাসির মা’র নাম কী ছিল স্যার?”

“বোধ হয় নলিনী। বোধ হয় কেন, নলিনীই –এবারই মা-র কাছে শুনেছি।”

“আপনার মায়ের নাম স্যার?”

“সুরমা।”

“বাঃ।”

“তার মানে?”

“নয়নতারা-নলিনী আর সুভদ্রা-সুরমা। বেশ ন-য়ে স-য়ে মিল স্যার।”

“আপনি মশাই সামথিং!” প্রমথ বলল।

“কেন স্যার?”

“কী ফালতু জিনিস নিয়ে টাইম ওয়েস্ট করতে পারেন?”

আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, “এই, তুই আমার মা-দিদিমার নাম ফালতু বলছিস কেন?”

“তাই বলছি নাকি! শুধু একেনবাবুর এই ন-ত্ব স-ত্ব-র সমালোচনা করছি।”

এই সব আগরম বাগরম বকতে বকতে আমাদের খাওয়া শেষ হল। খাবার শেষে আমিই জোর করে বিল পেমেন্টে করলাম। একেনবাবু মাথা ঝাঁকিয়ে থ্যাঙ্ক ইউ, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’ এতবার বললেন যে সবাই নির্ঘাৎ ভাবছিল আমি ওঁকে মিলয়ন ডলার দান করেছি!

এমন সময়ে একটা বিশ্রি ব্যাপার ঘটল। আমরা রাস্তার দিকে বসে ছিলাম। দু’ জন টিনএজার এসে আমাদের দিকে তাকিয়ে অসভ্যের মতো আঙুল দেখিয়ে অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করল। প্রমথ রেগে দাঁড়িয়ে উঠতেই ওদের একজন জানলার কাঁচের উপর মার্কার পেন দিয়ে চার অক্ষরের একটা অশ্লীল শব্দ লিখে দৌড়ে পালাল। সব কিছু ঘটে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। ওয়েটারটি তখনও কাছেই ছিল। ওদের এই অসভ্যতা দেখা মাত্র ম্যানেজারকে বলাতে তিনি ছুটে বাইরে গেলেন। ছেলেগুলো ইতিমধ্যে অদৃশ্য হয়েছে। অত্যন্ত বিরক্ত মুখে ফিরে এসে ভদ্রলোক একটা স্কুইজি নিয়ে বাইরে গিয়ে লেখাটা মুছতে লাগলেন।

ওয়েটার বলল, “এটা মাঝেমাঝেই ঘটে, ইদানিং কতগুলো দুষ্টু ছেলের এটাই হচ্ছে খেলা।”

ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকতেই ক্যাশিয়ার মেয়েটি বলল, “ও ভাবে তাড়া করতে যেও না, ওদের কাছে ছুরি-টুরি থাকতে পারে।”

ম্যানেজার ভদ্রলোক তখনও রাগে গগ করছে। “নেক্সট টাইম গুলি করে ওদের খুলি উঠিয়ে দেব।”

এই সব কমিেশনের মধ্যে আমিও উঠে দাঁড়িয়েছি। একেনবাবু দেখলাম চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে কী জানি ভাবছেন।

“কি মশাই, উঠবেন?”

“হ্যাঁ স্যার, চলুন।”

“কী ভাবছিলেন এত?”

“পরে বলব স্যার।”

একেনবাবু যদি একবার বলেন পরে বলব –সেটা পরেই বলবেন। ওকে খুঁচিয়ে, বুঝিয়ে, বকে, অপমান করে –কোনোমতেই কিছু আদায় করা যাবে না।

.

।। ১৪ ।।

একেনবাবুর মাথায় যখন কিছু চাপে তখন সেটা বের করা দুঃসাধ্য। গত শনিবার গাড়িতে ওঠার সময় ওঁর হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম গোটা দুই বই নিয়েছেন পড়ার জন্য। কিন্তু আসলে সেগুলো ছিল রিচার্ডমেসোর জিনিওলজির অ্যালবাম আর নোটবুক! উনি যে এইভাবে অ্যালবাম আর নোটবুক চাইতে পারেন, তা আমি কল্পনা করিনি। হাজার হোক একটা পারিবারিক ইতিহাস, পরলোকগত স্বামীর স্মৃতিচিহ। অবভিয়াসলি এ ব্যাপারে সুভদ্রামাসি সেন্টিমেন্টাল নন, সম্ভবত জিনিওলজির ব্যাপারে ওঁর কোনো ইন্টারেস্টই নেই। রিচার্ডমেসো উৎসাহ ভরে এইসব করতেন –তাতে সুভদ্রামাসির একটা সস্নেহ প্রশ্রয় ছিল –এইটুকুই।

যাইহোক, আজ সকালে থেকে দেখি একেনবাবু নিউ ইয়র্ক টাইমসের বদলে ঐ নোটবুক আর অ্যালবাম নিয়ে মেতে আছেন। আর মাঝে মাঝেই বলে উঠছেন,… “ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট!”

কিছুক্ষণ এইরকম চলার পর প্রমথ আর থাকতে না পেরে বলল, “একজনের গুষ্টির খবর জেনে কী রস পাচ্ছেন বলুন তো? তার থেকে ধর্মের বই পড়ন আত্মিক উন্নতি হবে; আর জ্ঞান বাড়াতে চান তো এনসাইক্লোপেডিয়া ঘাঁটুন।”

–“আপনি না স্যার, সত্যি!” বলে একেনবাবু কিছুক্ষণ চুপ। তারপর বললেন, “এই দেখুন না, কী ইন্টারেস্টিং –রিচার্ড সাহেব বার করেছেন যে সুভদ্রামাসির মায়ের কাছে শুনেছিলেন তাঁর বাবার দিকে কয়েক পুরুষ আগে একজন কেউ ইউরোপিয়ান মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। এই তথ্য থেকে রিচার্ড সাহেব বার করেছেন যে সুভদ্রামাসির দাদুর ঠাকুরদা, যিনি দেওয়ান ছিলেন, তিনি বিয়ে করেছিলেন এক ফ্রেঞ্চ মেয়েকে। না, ভুল বললাম স্যার, দাদুর বাবা ছিলেন দেওয়ান। তাঁর বাবা ফ্রেঞ্চ মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। যাইহোক, সেই ভদ্রলোকের নামধাম সব আবিষ্কার করেছেন।”

সুভদ্রামাসির দাদুর বাবা দেওয়ান ছিলেন, না দাদুর ঠাকুরদা দেওয়ান ছিলেন ফ্রাঙ্কলি আই কেয়ার লেস। তিনি ফ্রেঞ্চ না জার্মান মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন সেটাও অবান্তর। কিন্তু তাও মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “কী করে করলেন?”

“ডিটেইল অবশ্য পরিষ্কার নয়। তবে এটা বার করতে সাহায্য করেছেন সেই বাবু পিন্টো–যাঁর কথা সুভদ্রামাসি সেদিন বললেন। নাঃ, এঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে হচ্ছে!”

“দেখা করে কী করবেন?” আমি একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করলাম।

“এসব লোকের সঙ্গে একটু আলাপ পরিচয় থাকা ভালো স্যার। কখন কী কাজে লাগে!”

“দেখা করতে গেলে হয়তো ভিসিটের পয়সা লাগবে। খোঁজফোজ করে তারপর যাবেন। নইলে এসে আবার ঘ্যানঘ্যান শুরু করবেন,” পত্রিকার পাতা উলটোতে উলটোতে মন্তব্যটুকু করে প্রমথ খেলার পাতায় মন দিল।

প্রমথর এটা বলার কারণ আছে। একেনবাবুর সঙ্গে এক উকিলের আলাপ হয়েছিল একটা পার্টিতে। একেনবাবুর মাথায় সেই সময়ে ইমিগ্রেশন আইন নিয়ে নানান প্রশ্ন ঘুরছে। তার দুয়েকটা করতেই ভদ্রলোক বললেন, এই ভিড়ে তো আলোচনা হয় না, আমার অফিসে আসুন।’ একেনবাবু তার পরের দিনই গিয়ে প্রশ্নে প্রশ্নে বোঝাই করে অপরিমিত জ্ঞান নিয়ে ফিরেছিলেন। পরে উকিলের কাছে থেকে বিলটা যখন এল, তখন ওঁর মুখের অবস্থা দেখার মতো।

“কথাটা মন্দ বলেননি স্যার” একেনবাবু পা নাচাতে নাচাতে বললেন। “যা ফ্যাসাদে পড়েছিলাম সেবার!”

“ফ্রেঞ্চ মহিলার নাম কি?” কোনো কারণ নেই, প্রশ্নটা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

“অ্যান্তনিয়েৎ এমিরোজিয়ল্ট,” একেনবাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন।…”অ্যান্তনিয়েৎ খুবই চলতি নাম, তাই না স্যার? এমিরোজিয়ল্ট বোধ হয় খুব একটা চলতি পদবী নয়।”

ফ্রেঞ্চ পদবী সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। জিজেস করলাম, “আপনি সেটা জানলেন কি করে?”

“জানি না স্যার। তবে নোটবুকে মাত্র তিনজন এমিরোজিয়ন্টের কথা লেখা আছে, তাই বললাম। দেখুন না, বলে নোটবুকটা এগিয়ে দিলেন। দেখলাম সেখানে লেখা,

১) দানিয়েল এমিরোজিয়ল্ট; শেফ। x

২) এবউম এমিরোজিয়ন্ট ওয়াচমেকার। x

৩) ক্যালিস্টো এমিরোজিয়ল্ট।

তবে প্রথম দুটো নামের পাশে লাল কালি দিয়ে দিয়ে ক্রস আাঁকা। নামগুলোর ঠিক নীচে লেখা

(মে ১৪, ১৮৬০ সালের প্যারিস অবসার্ভার থেকে)

কুখ্যাত আর্ট-চোর ক্যালিস্টো জেলে বসে এখন কবিতা লিখছে। পাঠকদের অজানা নয় ছ’বছর ধরে নানান মিউজিয়াম থেকে বাউশার, ব্রিউঘেল, কানাচের মত বিখ্যাত আর্টিস্টদের ছবি থেকে শুরু করে পুরোনো মূর্তি, হিরে, জহরৎ, যাবতীয় মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী চুরি করে এনে ক্যালিস্টো প্রাইভেট মিউজিয়াম গড়ে তুলেছিল। তিনমাস আগে ফরাসী পুলিশের তৎপরতায় ক্যালিস্টো প্রাইভেট মিউজিয়াম গড়ে তুলেছিল। তিনমাস আগে ফরাসী পুলিশের তৎপরতায় ক্যালিস্টো ধরা পড়ে এবং নিজের দোষ স্বীকার করে। সব কিছুই উদ্ধার হয়েছে, শুধু বেলজিয়াম মিউজিয়াম থেকে চুরি করা ‘দ্য লাইট’ নামের বিখ্যাত ডায়মন্ড আর কয়েকটা দামি মনি-মুক্তোর খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি।

ক্যালিস্টোর কবিতার বই ছাপানোর জন্য প্রকাশকের খোঁজ করছে তার উকিল ও তার। বোন। পরের লাইনটা ফ্রেঞ্চে, বোধ হয় ক্যালিস্টোর কবিতা থেকে।

“শেষ লাইনের পাঠোদ্ধার হল না স্যার,” একেনবাবু বললেন। “মিস ফ্রান্সিস্কাকে একবার দেখাতে হবে।”

“কী, দেখি?” পত্রিকা ফেলে নোটবুকটা আমার কাছ থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে ভুরুটুরু কুঁচকে প্রমথ পড়ল, “রেখে দিও মোর শূন্য চায়ের পাত্র, ব্রিজের বাঁকে বাঁকে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “তুই আবার ফ্রেঞ্চে এত ওস্তাদ হলি কবে?”

“সে খবরে তোর কী দরকার?”

“যা বললি তার কোনো অর্থ হয়?”

“আমি তো শালা লিখিনি।”

প্রমথর সঙ্গে তর্ক করা বেশির ভাগ সময়েই বৃথা।

“আর হ্যাঁ, নীচে লেখা আছে প্যারিস পাব্লিকেশন্স –এটা বুঝতে পারছিস তো? না এরও কোনো অর্থ হয় না?” প্রমথ আরেক বার খোঁচা দিল।

সেটাকে পাত্তা না দিয়ে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কী মনে হয়, ক্যালিস্টোর এই বোনকেই কি সুভদ্রামাসির পূর্বপুরুষ বিয়ে করেছিলেন?”

“পসিবল স্যার,” অন্য নামদুটোতে লাল কালি দিয়ে ঢাঁড়া দেওয়া হয়েছে। তবে স্যার আমি একটু কনফিউসড!”

“কিসের জন্য?”

“অ্যান্তনিয়েতের বাবা-মার নাম নেই কেন? মানে চার্চ বা ম্যারেজ রেজিস্ট্রির রেকর্ড থেকে যদি নাম পাওয়া যায়, তাহলে সে নামটা তো পাওয়া যাবে।”

“সেটা জানতেই আপনি ঐ জিনিওলজিস্টের কাছে যাবার প্ল্যান করছিলেন নাকি? এই তিনটে লোকের নাম বললেন, তাদের একজন তো বাবা হতে পারে।”

“হলে স্যার, ক্রস মারা থাকত না।” ভেবেছিলাম জিনিওলজির ব্যাপারটার এইখানেই পরিসমাপ্তি। তা নয়। আমাকে সোমবার লাঞ্চের সময় বললেন, “স্যার, যাবেন নাকি একবার?”

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”

“ঐ যে মিস্টার পিন্টোর কাছে।”

“মিস্টার পিন্টো!”

“আঃ, স্যার, আপনি ভীষণ ভুলে যান, জিনিওলজি স্পেশালিস্ট!”

“সত্যিই যাবেন তার কাছে?”

“স্যার, যদি একটু টিপস ফিপস পাওয়া যায়। আপনাকে কখনো বলিনি স্যার, আমারও এক পূর্বপুরুষ ইউরোপে গিয়েছিলেন –দেশে ফেরেননি। যদি তার খোঁজ জোগার করতে পারি, মন্দ হবে না।”

“কে সেই পূর্বপুরুষ?”

“স্যার, আমার ঠাকুরদার কাকা।”

জানি এগুলো ছুতো। একেনবাবু নতুন কোনো কিছু শুনতে পেলেই সে বিষয় আরও জানতে চান। বাস্তবিকই ওঁর জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল।

দেখলাম এ ব্যাপারে আমার অপেক্ষায় না থেকে উনি অনেকটাই এগিয়েছেন। অর্থাৎ বাবু পিন্টোর ফোন নম্বর সুভদ্রামাসির কাছ থেকে জোগাড় করেছেন। শুধু তাই নয়, মিস্টার পিন্টোর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও করেছেন –দুপুর তিনটে নাগাদ। উনি জানেন যে সোমবার আমার ক্লাস শুধু সকালে। ঐ দিনটাতে বাদবাকি সময় আমি বাড়িতেই থাকি। প্রমথ সোমবার সকালে যায়, ফেরে দেরিতে। একথা প্রমথ জানলে ওঁকে নিয়ে এত হাসিঠাট্টা করত, সেইজন্যেই বেছে বেছে উনি সোমবারই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছেন।

.

বাবু পিন্টোকে দেখলে দেশি বলে ভুল হবে। নিজেই জানালেন, ওঁর পূর্বপুরুষেরা এককালে ছিলেন মুম্বইয়ে বাসিন্দা। বাবুর ঠাকুরদা স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে নিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন ইজরায়েলের জন্মলগ্নে। বাবুর জন্ম, পড়াশুনো সবকিছু ইজরায়েলে। একটু তাড়াতাড়ি কথা বলেন। অ্যাকসেন্টটা এমন যে বুঝতে একটু অসুবিধা হয়। যাই হোক, রির্চাড মেসোকে খুব ভালোই মনে আছে বাবুর।

“খুবই ডিফিকাল্ট কেস,” বললেন বাবু। “কারণ ভারতবর্ষে কোথাও ভালো রেকর্ড পাওয়া যায় না। ল্যান্ড রেকর্ড খোঁজা মানে প্রাণান্ত। এদেশের চার্চে বহু রেকর্ড থাকে। হিন্দু মন্দিরে কিছুই থাকে না! খ্রীশ্চান আর ইহুদীরা ফ্যামিলি বাইবেলে পূর্বপুরুষদের পরিচয় লিখে রাখে। হিন্দুদের সেই ঘ্রাডিশন নেই। আসলে এর মূলে আপনাদের ‘লাইফ ইজ এ রিবার্থ কনসেপ্ট। যদি আবার জন্মাই, তবে এত খবর লিখে রেখে লাভ কী? পার্সোনাল রেকর্ড বাদ দিন, ভারতবর্ষের হিস্টোরিক্যাল রেকর্ডসও হিন্দুরা রাখেনি। এখন যেটুকু হচ্ছে, সবই ওয়েস্টের ইনফ্লুয়েন্সে।”

কথাটা পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু সত্যের একটা ছাপ যে নেই তা অস্বীকার করা যায় না। ভাগ্যিস প্রমথ সঙ্গে ছিল না! নিজে দেশকে উঠতে বসতে গাল দেবে, বাইরের কেউ নিন্দা করলেই তার বাপান্ত করে ছাড়বে। আজ থাকলে বাবুর সঙ্গে মাথা ফাটাফাটি হয়ে যেতো।

একেনবাবু জানতে চাইলেন, সুভদ্রামাসির ইউরোপিয়ান পূর্বপুরুষের কথা।

“ও ইয়েস,” বাবু বললেন। “ওটা বেশ ইন্টারেস্টিং। যদুর মনে পড়ছে রিচার্ডের স্ত্রীর গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার মিস্টার গুপ্তা ফ্রান্সে আসেন। হোল্ড অন…” বলে বাবু কম্পিউটারে কি সব সার্চ করতে শুরু করলেন। খানিক বাদে বললেন, “হ্যাঁ, পেয়েছি…সেখানে তিনি একটি ইউরোপিয়ান মেয়েকে বিয়ে করেন এবং ওঁদের একটি বাচ্চাও হয়। মেয়েটি বাচ্চা হবার পর কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যায়। ভদ্রলোক তার এক বছর বাদে বাচ্চাকে নিয়ে ইন্ডিয়া ফিরে যান।”

সেই বাচ্চাই হল সুভদ্রামাসির দাদুর বাবা, যিনি দেওয়ান ছিলেন। ভদ্রলোক আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। এগুলো সব নোটবুকের তথ্য। বাবু পিন্টোর এখানে আসার পথে একেনবাবু নানান বকবকানির মধ্যে এটা শুনেছি। তবে এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য বাবুর কম্পিউটারে নিশ্চয় আছে। আমি দূর থেকে কম্পিউটার স্ক্রিনটা দেখতে পাচ্ছিলাম, গুটি গুটি অজস্র ইনফরমেশনে ভরা। বাবু সেখান থেকে সংক্ষেপে বলছেন।

“এগুলো বার করলেন কোত্থেকে স্যার?” একেনবাবু মুগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করলেন।

“ওয়েল,” বলে হাসলেন বাবু, “আমার ট্রেড-সিক্রেট আপনাকে বলব কেন?” তারপর বললেন, “জাহাজের প্যাসেঞ্জার লিস্টের রেকর্ড দেখে। হাসপাতালের রেকর্ড দেখে, ম্যারেজ রেজিস্ট্রির রেকর্ড দেখে। এগুলো সহজ উত্তর। কিন্তু সেগুলো জোগাড় করলাম কোত্থেকে –সেটা হবে জটিল উত্তর।”

লোকটা অবশ্যই নিজের ব্যাবসা জানে।

“মহিলা, মানে ওঁর স্ত্রীর ব্যাকগ্রাউন্ড কী স্যার?”

“নট দ্যাট গুড। বাবা কী করত তার সন্ধান আমি পাইনি। অল্প বয়সেই মারা যায়। বড়ো ভাই আর্ট চোর, মিউজিয়াম থেকে বহু দামি দামি জিনিস চুরি করত। শেষে ধরা পড়ে জেলেই মারা যায়।”

“আপনি শিওর?”

“হয় ভাই, নয় মেয়েটার প্রাক্তন স্বামী। তবে প্রাক্তন স্বামী হলে এক্স-ওয়াইফের দ্বিতীয় বিয়েতে সাক্ষী হওয়াটা একটু আনইউজুয়াল তাই না?”

“মানে ম্যারেজ রেজিস্ট্রিটা আপনি দেখেছেন স্যার?”

উত্তরে বাবু পিন্টো মুচকি হাসলেন।

“মহিলাটি কী করতেন?”

“শি ওয়াজ এ মেড। সম্ভবত মিস্টার গুপ্টার বাড়িতেই কাজ করত। মিস্টার গুপ্টা ওয়াজ এ রিচ ম্যান।”

আমি বলে ফেললাম, “আপনার তো মনে হয় আরও অনেক ইনফরমশন আছে এদের সম্পর্কে। স্ক্রিন ভর্তি লেখা।”

“তা আছে, ইনফরমেশন রাখা আমার ব্যবসায়। ইনফরমেশন ইজ মানি।”

প্রকারন্তরে বুঝিয়ে দিলেন –যা বলছি তাই যথেষ্ট ছোকরা!

একেনবাবু ওঁর ঠাকুরদার কাকার কথা তুলতে বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম ছিল তাঁর?”

“রাধানাথ, রাধানাথ চৌধুরী।”

বাবু পিন্টোর হাত দ্রুত চলে। সঙ্গে সঙ্গে নামটা উনি কম্পিউটারে ঢোকালেন। তারপর বললেন, ওঁর কোম্পানি সাহায্য করতে পারে, কিন্তু সেটাতে যথেষ্ট খরচা আছে। যথেষ্ট খরচা কথাটায় একেনবাবুর মুখের ভাব লক্ষ্য করে, বাবু বললেন, “এগুলোতে সত্যিই খরচা অনেক। আপনি তো ডিরেক্ট ফ্যামিলি ট্রি-র খোঁজ করছেন না, খুব বেশি খরচা করতে হয়তো চাইবেন না। যদি চান, আই উইল বি হ্যাপি টু ডু ইট ফর ইউ।”

.

ফেরার পথে একেনবাবু বললেন, “বেশ কঠিন কাজ –কাগজপত্র ঘেঁটে খবরগুলো উদ্ধার করা, তাই না স্যার?”

“আপনি বাবুর সব কথা বিশ্বাস করেন, না ভাঁওতা দিয়ে টু-পাইস কামাচ্ছেন?”

“টাইমিংটা স্যার মিলছে। সুভদ্রামাসি আর তাঁর মা নলিনীদেবীর জন্মের তারিখ রিচার্ডসাহেবের ডায়েরিতে আছে ১৯৪৭ আর ১৯২২। মাসিমার দাদুর তিরিশ বছর বয়সে নলিনীদেবী জন্মালে দাদুর জন্ম ১৮৯২ সালে। একই ভাবে হিসাব করলে দাদুর বাবার জন্ম ১৮৬২ সালে। রিচার্ডসাহেবের ডায়েরিতে প্যারিস অবসার্ভারের যে খবরটা আছে, সেটা ১৮৬০ সালের। তখন হয়তো ক্যালিস্টোর বোনের সঙ্গে মাসিমার দাদুর ঠাকুরদার বিয়ে হয়েছিল বা হচ্ছে।”

একেনবাবু যে পিছনে পিছনে এত অঙ্ক কষছেন সেটা বুঝিনি।

“না স্যার, জিনিওলজি বার করার কাজটা মোটেও সহজ নয়, একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “নো ওয়ান্ডার স্যার আপনাদের রিচার্ডমেসো সুভদ্রামাসির বাবার দিকের কিছু বারই করতে পারেননি।”

“পারেননি?”

“নাঃ, ওঁর বাবার নামের পরে একটা বিরাট গোল্লা লাগিয়ে কোয়েশ্চেন মার্ক দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু মায়ের নামের পরে একেবারে A+ মার্ক। প্রচুর ইনফরমেশন আছে।”

“অধ্যাপক মানুষ, নিজেকেও গ্রেড করেছেন,” আমি হেসে বললাম। “আমার চেষ্টাতেও ঐ গোল্লাই জুটবে, স্যার,” একেনবাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন।

.

৷৷ ১৫ ৷৷

প্রমথ অনেক রাত্রে বাড়ি ফেরাতে বাবু পিন্টোর কাছে যাওয়ার গল্পটা ওকে আর জানানো হয়নি। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেও প্রমথকে দেখলাম না। দুপুরে যখন লাঞ্চ খেতে এল, তখন বাবু পিন্টোর গল্প করলাম। ভেবেছিলাম প্রমথ প্রচন্ড খ্যাপাবে। কিন্তু কিছুই বলল না। আসলে একটা এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে ও বড্ড হাবুডুবু খাচ্ছে। লাঞ্চ খেয়েই আবার ল্যাবে চলে গেল।

লাইব্রেরিতে কতগুলো বই ফেরৎ দিতে হবে, আমি সেগুলো নিয়ে বেরোলাম। রাস্তায় হঠাৎ দেখা রোহিত রয়ের সঙ্গে। প্রথমে চিনতে পারিনি। দূর থেকে দেখি একজন আমার দিকে তাকতে তাকাতে আসছে। আমারও চেনা চেনা লাগছে লোকটাকে। হঠাৎ মুখোমুখি এসে পড়তেই মনে পড়ে গেল –রোহিত, রোহিত রয়। ‘হ্যালো’ বলে হাত বাড়িয়ে দিতে আমি হ্যান্ডশেক করলাম।

রোহিত কপট গাম্ভীর্য দেখিয়ে বললেন, “আপনাকে নমস্কার করা উচিত ছিল। সরি, আই ফরগট।”

আমি হেসে ফেললাম। “ইউ আর এক্সকিউজড। তারপর কী খবর?”

একথা সেকথা হল। জিজ্ঞেস করলাম, ওঁর গার্লফ্রেন্ড ফিরে গেছেন কিনা।

“অনেকদিন আগে। এর মধ্যে আমি ইংল্যান্ড ঘুরে এলাম। থাইল্যান্ড আর ইন্ডিয়াতেও গিয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্য।”

“কী আশ্চর্য! আমরাও ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলাম বেশ কিছুদিনের জন্য। তা ইন্ডিয়াতে গেলেন কেন, বেড়াতে না কাজে?”

“বিজনেস এন্ড প্লেসার –দুটোই। ইন্ডিয়া সবসময়েই আমার কাছে প্লেজার।”

“ইন্ডিয়ার কোথায়?”

“একটা শর্ট অ্যাসাইনমেন্ট ছিল দিল্লী, জয়পুর, আর আগ্রায়। পাঁচদিন মাত্র ছিলাম। আপনারা কোথায় ছিলেন?”

“বেশির ভাগ সময়েই কলকাতা। দু’দিনের জন্য শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম।”

“দুটোই চমৎকার জায়গা।”

“আপনি গিয়েছেন?”

“ও ইয়েস। ইন ফ্যাক্ট রিচার্ডের সঙ্গেই গিয়েছিলাম –বহু বছর হয়ে গেল। তারপর আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে রোহিত প্রশ্ন করলেন, “আপনি বল্লভ শাহ- কে চেনেন?”

আমি মনে করতে পারলাম না। “কী সূত্রে চিনতে পারি বলুন তো?”

“এ বিজনেসম্যান ফ্রম গুজরাত?”

“কিসের ব্যবসা?”

“কিসের ব্যবসা নয় –হোটেলের ব্যবসা, ডায়মন্ডের দোকান, অ্যান্টিকের দোকান। আমার ধারণা ছিল এভরিবডি নোজ হিম।”

“নট এভরিবডি,” আমি হেসে বললাম।

“জাস্ট কিডিং। ভেরি ইন্টারেস্টিং ম্যান, রোহিত বললেন। “আমরা একই প্লেনে ইন্ডিয়া থেকে ফিরলাম।”

কিন্তু কেন বল্লভ শাহ এত ইন্টারেস্টিং সেটা জানতে পারার আগেই রোহিত আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, “আপনাদের সঙ্গে বাবুর দেখা হয়েছে শুনলাম?”

“বাবু পিন্টোর কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন! আপনি তো মনে হচ্ছে একেনবাবুর থেকে অনেক ভালো ডিটেকটিভ!”

রোহিত গম্ভীর ভাবে বললেন, “আই হ্যাভ সোর্সেস।” তারপর হেসে ফেললেন, “না, বাবুই আমাকে বলল। আমার খুব পরিচিত ও। ভালোকথা, এখন যাচ্ছেন কোথায়?”

“পাবলিক লাইব্রেরিতে।”

“আমাকেও ওদিকে যেতে হবে। একটু ওয়েট করতে পারবেন? এই সামনে আমার অ্যাপার্টমেন্ট, সেলফোনটা ফেলে এসেছি।”

“শিওর।”

“তাহলে আসুন,” বলে আমাকে নিয়ে যেখানে ঢুকলেন সেখানে আমি আগে এসেছি। বাবু পিন্টোর অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স।

“আপনিও এখানে থাকেন?”

“নাউ ইউ গেট দ্য কানেকশন!” রোহিত চাবি দিয়ে মেইলবক্স থেকে চিঠিপত্র বার করতে করতে বললেন। চিঠিগুলো বগলে চেপে ধরে দেখি আরেকটা মেইলবক্স খুলছেন। আমার দিকে তাকিয়ে চোখটা একটু টিপে বলল, “আরেক জনের মেইল চুরি করছি।”

“চুরি তো লুকিয়ে লুকিয়ে করতে হয় বলে জানতাম।”

“ট্রু।” রবার ব্যান্ড আটকানো চিঠির গুচ্ছ দেখিয়ে বলল, “এগুলো বাবুর। কাল বাইরে গেছে কয়েকদিনের জন্য, তাই ওর চিঠি তোলার দায়িত্ব এখন আমার।”

“আর আপনি না থাকলে উনি আপনার মেইল তোলেন?”

“রাইট। সুতরাং ওকেই খাটতে হয় বেশি।”

“আই ক্যান ইম্যাজিন,” আমি বললাম। “কিন্তু আগে থেকে জানিয়ে দিলে পোস্ট অফিসও তো ডেলিভারি না করে পিক-আপের জন্য জমা রাখে।”

“তা রাখে, কিন্তু এক মাসের বেশী নয়। আর আমি মাঝে মাঝেই পাঁচ ছ সপ্তাহের জন্য হাওয়া হই। বাবুও অনেক সময় দু’মাস ইজরায়েলে গিয়ে বসে থাকে।”

“যখন দুজনেই বাইরে থাকেন তখন কি করেন?”

“এই কমপ্লেক্সেই এক বুড়ি মহিলা আছেন, তাঁকে ধরি। কিন্তু তিনি বড় উলটোপালটা করেন। চিঠি তোলেন ঠিকই, কিন্তু গুছিয়ে কোথায় রেখেছেন সবসময়ে মনে করতে পারেন না। একবার যা সমস্যায় পড়েছিলাম!… এক মিনিট, চিঠিগুলো অ্যাপার্টমেন্টে রেখে আসি,” বলে রোহিত উপরে গেলেন।

একটু বাদেই নেমে এলেন। তারপর গল্প করতে করতে আমরা বাস-স্ট্যান্ডের দিকে রওনা হলাম। কথায় কথায় সুভদ্রামাসির মা’র ছবিটার কথা উঠল।

“কেমন হয়েছে ছবিটা?” রোহিত জানতে চাইলেন।

“চমৎকার। আমার মা-কেও এক কপি দিয়েছি, তিনি তো মুগ্ধ! প্রচুর সময় লেগেছে নিশ্চয় ওটাকে ঠিকঠাক করতে?”

“তা কিছুটা লেগেছে। তবে আমার একটা চমৎকার সফটওয়্যার আছে, আর সেই সঙ্গে একজন কম্পিটেন্ট হেল্পার।”

“আমিও দেশ থেকে একটা ছবি এনেছি। একজনকে দিলাম ডিজিটালি এনহ্যান্স করার জন্য। বলতে কি, আমার ধারণাই ছিল না, পুরোনো ছবি থেকে এত ভালো ছবি তৈরি করা যায়।”

“ওয়েল, ইট ইজ নেভার অ্যাকিউরেট। কিন্তু কে সেটা বুঝতে পারছে! যেটা মোস্ট ইম্পর্টেন্ট, সেটা হল সুভদ্রা-র ছবি পছন্দ হয়েছে, আর ভালো লাগছে আপনার মা-ও খুশি হয়েছেন দেখে। তবে ইন্টারেস্টিংলি ওই ছবি নিয়ে একজনের কাছ থেকে দুটো ক্রেজি ই মেইল পেয়েছি।”

“তাই নাকি?”

“ও ইয়েস। ছবিটা আমার ওয়েবসাইটে আছে, সেটা দেখেই পাঠিয়েছে।”

“ক্রেজি মানে?”

উত্তর শোনা হল না। হঠাৎ রোহিতের মোবাইল বেজে উঠল। রোহিত, ‘এক্সকিউজ মি, বলে ফোন ধরলেন। তারপর ‘হ্যালো, ইয়েস,’ বলে দুয়েকটা কথা বলার পর ফোন পকেটে পুরে বললেন, “আই অ্যাম সরি। একটা জরুরি কাজ এসে পড়েছে, আমাকে এখুনি ট্রাইবেকায় যেতে হবে।” বলেই হাত দেখিয়ে একটা চলন্ত ট্যাক্সি থামিয়ে, “সি ইউ সুন, “ বলে আমাকে খানিকটা হতবাক করেই তাতে উঠে পড়লেন।

পাবলিক লাইব্রেরীতে আমার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। বই ফেরত দিয়ে বেরোতেই দেখি একেনবাবুও বেরোচ্ছেন!

“আপনি এখানে কি করছিলেন?”

“এই কিছু পুরোনো পত্রিকা দেখছিলাম স্যার।”

“হঠাৎ?”

“এমনি স্যার।”

“না, এমনি তো আপনি কিছু করেন না। সব সময়েই কিছু না কিছু আপনার মাথায় ঘুরছে।”

“কি মুশকিল স্যার, আমিও তো রিসার্চ করি। আপনার মতো কঠিন অঙ্ক বা প্রমথবাবুর মতো বিদঘুঁটে কেমিক্যাল রিয়্যাকশন নিয়ে না হলেও।”

“আপনার সাহস তো কম নয়– প্রমথর রিসার্চকে বিদঘুঁটে বলছেন!”

“ওটা স্যার কমপ্লিমেন্ট –বিদঘুঁটে জিনিসকে সরল করে বোঝানোই তো পন্ডিতদের কাজ।”

“বেশ বেশ। যা খুঁজছিলেন, তার কিছু পেলেন?”

“কে জানে স্যার। তা আপনি এখানে কি করতে?”

“বই ফেরত দিতে এসেছিলাম।”

“আর কিছু না থাকলে চলুন স্যার, একটু কফি খাওয়া যাক।”

“আপনি খাওয়াবেন?”

কথাটা শুনে মনে হল একেনবাবু একটু দমে গেলেন।

“আপনাকে খ্যাপাচ্ছিলাম,” আমি বললাম, “ডাচ ট্রিট।”

একেনবাবু মানলেন না। “কী যে বলেন স্যার, আপনাকে একটু কফি খাওয়াতে পারব না!”

আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা কফিশপ-এ ঢুকলাম। কফি অর্ডার করে একেনবাবুকে রোহিত রয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার গল্প বললাম। একেনবাবু আবার গল্প খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনেন। প্রশ্ন করলেন, “ক্রেজি ইমেইল বলতে উনি কি মিন করলেন স্যার?”

“আমার কোনো ধারণাই নেই। জানার আগেই একটা ফোন আসায় ওঁকে চলে যেতে হল।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।”

“আচ্ছা আপনার কি মনে হয় ঐ মূর্তি নিয়ে কেউ কিছু লিখেছে?”

“কোন মূর্তি স্যার?”

“যেটা ছবিতে ছিল, গোল্ড-সিলভারের নারী- মূর্তি।”

একেনবাবু মাথার পেছনটা চুলকোতে চুলকোতে প্রশ্ন করলেন, “কী লিখতে পারে?”

“তা কী করে বলব। কিন্তু মূর্তিটা পুরোনো। তার একটা হিস্ট্রি থাকতে পারে।” বলতে বলতেই একটা চিন্তা ঝিলিক দিল। “আপনি কি মনে করেন মূর্তিটা কোনো মিউজিয়াম থেকে ওই ক্যালিন্সো না কার নাম বলছিলেন –সে চুরি করেছিল?”

“ক্যালিস্টো এমিরোজিয়ল্ট, আর্ট-চোর?”

“এক্সাক্টলি, তার বোনই তো সুভদ্রামাসির পূর্বপুরুষকে বিয়ে করেছিল।”

“আপনি আমার ভাত মারবেন স্যার, কিন্তু ভেরি ইন্টারেস্টিং পসিবিলিটি।”

“আজকে সুভদ্রামাসিকে ফোন করে একটু খোঁজ নেব। রোহিত রয়ের কাছেও জানতে হবে, ঠিক কী ছিল ওই ই-মেইলে।”

“গুড আইডিয়া স্যার। ভালোকথা, ক্যালিস্টোর কথা তুললেন –আজকে একটা ইন্টারেস্টিং ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। যে সব দামি দামি জিনিসের খোঁজ আর পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের হিস্ট্রি। একেবারে ফ্যাসিনেটিং স্যার। সেইখানে ‘দ্য লাইট’-এর কথাও ছিল।”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “দ্য লাইট?”

“দ্য লাইট ডায়মন্ড স্যার। মনে নেই রিচার্ড সাহবের নোটবইটাতে ছিল?”

এবার আমার মনে পড়ল। “ও হ্যাঁ, নিশ্চয় মনে আছে। আপনিই তো সেদিন বলছিলেন।”

“দ্য লাইট- এর ছবিও ছিল। এইটুকু হিরে, কিন্তু এস্টিমেটেড প্রাইস এখন দু মিলিয়ন ডলার, মানে প্রায় ন’কোটি টাকা! অকল্পনীয় স্যার।”

“দু’শো ডলার হলেও আমি কিনতাম না। লোকে কেন যে এত ফ্যাসিনেটেড হয়, আমার কোনো ধারণাই নেই।”

“আমিও একমত স্যার। তবে যে কথা বলতে যাচ্ছিলাম, মারা যাবার কয়েকদিন আগে নাকি ক্যালিস্টো এক জেলরক্ষীকে বলেছিল, ডায়মন্ডটা কোথায় আছে –বুদ্ধি থাকলে যে কেউ বুঝতে পারবে। জেলরক্ষী সেটা শুনে জেলারকে জানায়।

জেলার এসে ক্যালিস্টোকে প্রশ্ন করলে তার উত্তরে নাকি ক্যালিস্টো শুধু বলে, ‘দ্য অ্যানসার ইস ইন দ্য টাইটল।”

“তার মানেটা কী?”

“আই হ্যাভ নো ফ্লু স্যার।”

“একটা মানে আমি বুঝতে পারছি।”

“কী স্যার?”

“যেহেতু এখনও ওটা পাওয়া যায়নি, সুতরাং আমরা সবাই বুদ্ধু!”

“এটা ভালো বলেছেন স্যার।”

ওয়েট্রেস ইতিমধ্যে এসে আমাদের কফি দিয়ে গেল। কফির ব্যাপারে আমি একটু খুঁতখুঁতে, কিন্তু দেখলাম, কফি ভালোই করেছে। আমাদের সামনে একটা টিভি।

সেখানে ভারত আর চীনের শিল্পায়ন নিয়ে বিরাট আলোচনা চলছে।

একেনবাবু বললেন, “যাই বলুন স্যার, আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। এই ধরুন সাধারণ ফোন, সেগুলো পর্যন্ত ঠিকমত কাজ করে না। বাড়ির ফোনের কথা ছেড়ে দিন, বোলপুরের পুলিশ অফিসের ফোনই কাজ করছে না!”

“আপনি ফোন করার চেষ্টা করেছিলেন নাকি?”

“হ্যাঁ স্যার। না পেয়ে, শেষে মোবাইলে ধরতে হল।”

“তাহলে? মোবাইল টেকনোলজি তো পৌঁছেছে এবং কাজও করছে।”

“তা করছে। কিন্তু স্যার টেকনোলজিতে আমাদের নয়, সায়েবদের।”

“এক এক যুগে এক এক জাতি ওপরে ওঠে।”

“ওসব মন ভোলানো কথা স্যার। আমরা চিরদিনই পিছিয়ে।”

“কী বলছেন! হিন্দুরা এক সময়ে বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প –সব কিছুতেই পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছে। এই শূন্য-র কনসেপ্ট –সেটাতো হিন্দুদেরই সৃষ্টি।”

“এটা দারুন বলেছেন স্যার,” কথাটা একেনবাবুর মনে ধরল। বেশ কিছুক্ষণ তারিয়ে তারিয়ে কফি খেলেন। তারপর বললেন, “সত্যি স্যার, এমন চমৎকার সব কথা বলেন না আপনি। ঠিক সেইজন্যেই ইংরেজি অ্যালফাবেটের ‘ও’ আর শূন্য এক, কিন্তু আমাদের অক্ষরগুলো দেখুন –শূন্যের সঙ্গে অন্য কোনো অক্ষরের মিল পাবেন না।”

এই থিওরি আগে আমি শুনিনি। কিন্তু একেনবাবু আমার কথাটা মেনেছেন দেখে তৃপ্তি পেলাম।

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত