।। ৬ ।।

শ্যামলবাবুরা এলেন প্রায় দশটার সময়। তাঁদের সঙ্গে মাস্টারমশাই শিশিরবাবুকে নিয়ে খানিকক্ষণ কথা হল। শ্যামলবাবুর স্ত্রী রিতা দেখলাম বেশ ভয় পেয়েছেন। প্রভাসকে জিজ্ঞেস করলেন, “এরকম মার্ডার এখানে হয়?”

“সচারাচর হয় না। তবে মার্ডার কিনা এখনও তো জানা যায়নি।”

“কে জানে আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে। এখানকার বাড়িগুলো আবার সব এক তলা আর আমাদের খাটও একেবারে জানলার পাশে।”

“ধ্যাৎ, তুমি বড় বেশি ভয় পাও,” শ্যামলবাবু বললেন। “আমরা এখানে এতগুলো লোক রয়েছি। কি বলেন?” আমাদের সমর্থন চাইলেন শ্যামলবাবু। সেটা কতটা স্ত্রীকে সাহস দেবার জন্য, কতটা নিজেকে আশ্বস্ত করার জন্য, সেটা প্রশ্ন।

রাত হয়ে গেছে, এঁরা আর বেশিক্ষণ বসলেন না, শুতে চলে গেলেন। একটু বাদেই ঘরের ভেতর থেকে জানলা বন্ধ করার শব্দ পেলাম। কিছু অস্পষ্ট কথাবার্তা ভেসে এল, আর তার পরই শুনলাম খাট সরানোর আওয়াজ। আমরা নিজেরা কে কখন ঘুমোলাম খেয়াল নেই। প্রমথ কম্বল মুড়ি দিয়ে গল্প করছিল। হঠাৎ সোফাতে শুয়েই নাক ডাকতে শুরু করল। প্রভাস একটা কুশন নিয়ে, সেটা মাথায় দিয়ে চৌকিতে লম্বা হল। আমি শোবার ঘর থেকে ওকে একটা কম্বা এনে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লাম।

পরদিন আমার ঘুম ভাঙল বেলা করেই। দেখলাম সবাই উঠে পড়েছে। প্রভাস বাড়ি চলে গেছে। বলে গেছে দুপুরের দিকে আবার আসবে। সবার এক প্রস্থ চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমি ওঠাতে বনমালী সবার জন্যেই আবার চা নিয়ে এল। চা শেষ করার আগেই সাইকেল করে পুলিশের একটি লোক এসে হাজির। হাতে একটা ফাইল।

“কী ব্যাপার?”

“ওসি সাহেব পাঠিয়ে দিলেন। আপনাদের স্টেটমেন্টগুলোতে সই করতে হবে।”

দু’টো স্টেটমেন্ট –একটা প্রমথর, একটা আমার। পড়ে দেখলাম, যা বলেছি তাই আছে। যদিও ইংরেজি ভাষাটাকে দুয়েক জায়গায় মার্ডার করা হয়েছে। আমার নিজের ইংরেজি জ্ঞান বিরাট সে দাবি করতে পারব না। কিন্তু তাও ভুল ইংরেজি দেখলে বড় অস্বস্তি হয়। আমি স্টেটমেন্টের উপর কলম চালাতে যাচ্ছি দেখে প্রমথ বলল, “বেশি ওস্তাদি করিস না, চটে গেলে ঝামেলায় পড়বি।” কথাটা অসঙ্গত নয়। দুজনেই স্টেটমেন্টে সই করে দিলাম।

“কিছু কিনারা হল?” প্রমথ পুলিশটিকে জিজ্ঞাসা করল।

“ওসি সাহেব জানেন,” বলে লোকটা চলে গেল।

চা-টা খেয়ে শ্যামলবাবুদের সঙ্গেই মেলায় ঘুরতে গেলাম। কাল এখানে আসার পর থেকে যে হুজুৎ গেছে! যার জন্য শান্তিনিকেতনে এসেছি –সেটাই দেখা হয়ে ওঠেনি। বড়ো রাস্তায় পৌঁছতেই দেখলাম দল বেঁধে লোকেরা মেলার দিকে যাচ্ছে। যারা হাঁটতে রাজি নয়, তারা উঠেছে সাইকেল রিকশায়। রিকশার দাপট তবু সহ্য করা যায়। কিন্তু অসহ্য লাগে যখন মোটর গাড়ি হাঁকিয়ে লোকেরা মেলায় আসে। এমনিতেই এখানে ধুলো বেশি। এক একটা গাড়ি যায়, নাকে রুমাল চেপে তার জের সামলাতে সামলাতে আরেকটা গাড়ি এসে পড়ে। মেলায় ঢুকে গাড়ির কবল থেকে অন্তত বাঁচলাম।

আজকে দেখলাম মেলার মাঠে প্রচুর জল ঢালা হয়েছে। নাকে রুমাল চেপে ঘোরার প্রয়োজন নেই। তবে কী ভিড় কী ভিড়! খাবার দোকানের স্টলগুলো করতে দেওয়া হয়েছে মেলার একপ্রান্তে। সেখানে খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে চলছে বাঙালিদের ফেভারিট পাস্ট টাইম –আচ্ছা। শুনেছি এককালে এই মেলায় আশেপাশের গ্রামের লোক আর বহু সাঁওতাল কেনা-বেচা করতে আসত। মেলা প্রাঙ্গণে বসত তাদের পসরা সাজিয়ে। এটা বাস্তবিকই ছিল একটা গ্রামের মেলা। সেরকম অল্প কয়েকজনকে মেলায় ঢোকার মুখে দেখলাম। কিন্তু সংখ্যায় তাদের হাতে গোনা যায়। মেলার ভেতরে দোকানের পর দোকান শহুরে বুটিক। আর সেই সঙ্গে ইলেকট্রনিক্স, ইন্সিওরেন্স, স্টেশনারি, মোটর সাইকেল, কীসের স্টল নেই! দোকানগুলো থেকে একটু দূরে –একটা বিশাল শামিয়ানা খাটানো। সেখানে বাউল গানের আসর বসেছে। একটা বড়ো স্টেজ জুড়ে বসেছে বাউলের দল। সামনে একটা দাঁড়ানো মাইক। সেখানে একতারা বাজিয়ে একটি কমবয়সি বাউল গাইছে, আর গুবগুবি বাজিয়ে সঙ্গ দিচ্ছে একজন বুড়ো বাউল। প্রমথ, শ্যামলবাবু, বা রিতা কেউই বাউল গানে ইন্টারেস্টেড নন। আমার ভালো লাগে। বললাম, “তোরা এগো, আমি একটু বাদেই আসছি।”

আমি মোটেই সংগীত রসিক নই, কিন্তু নাচের সঙ্গে গানগুলো মন্দ লাগছিল না। মিনিট পাঁচেকও দাঁড়াইনি, কে যেন পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত দিয়েছে। ফিরে দেখি প্রভাস। “তুমি এখানে কখন এলে?”

“এই এক্ষুণি।”

“আজ সকালে পুলিশের একটি লোক এসেছিল। আমাদের স্টেটমেন্টে সই করিয়ে নিয়ে গেল!”

“হ্যাঁ, আমি সকালে ওসি-র ওখানে গিয়েছিলাম। তখন শুনলাম যে আপনাদের কাছে স্টেটমেন্ট সই করাতে লোক গেছে।”

“রহস্যের সমাধান কিছু হল?”

“মনে হয় না কিছু হবে বলে। এগুলো হল ওদের রুটিন এনকোয়ারি। আপাততঃ ওঁদের চিন্তা পৌষমেলায় কোনো ঝামেলা যেন না হয়। অনেক ভি আই পি-রা মেলায় আসেন। তাঁদের কিছু হলে, উপর মহলে অনেক জবাবদিহি করতে হবে।”

“কিন্তু এটা তো মার্ডারও হতে পারে?”

“হতেই পারে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। তবে হ্যাঁ, উনি যদি বড়োসড়ো রাজনৈতিক নেতা বা সেলিব্রিটি হতেন –তাহলে অন্যকথা।”

“কিছু চুরি গেছে?”

“বলতে পারব না। তবে দামি যে দুয়েকটা জিনিস বাড়িতে ছিল –সেগুলোর কোনোটাই খোয়া যায় নি।”

আমার মুখে বিস্ময়ের ভাব লক্ষ্য করে প্রভাস বলল, “আমি অরিজিনাল পেন্টিংগুলোর কথা বলছি –নন্দলাল, রামকিঙ্কর আর যামিনী রায়ের আাঁকা ছবিগুলো।”

“এছাড়া অন্যকিছু?”

“ও.সি বললেন, কি ছিল না জানলে, কী চুরি হল জানা যাবে কি করে?” যাইহোক, উনি রাজি হয়েছেন আমার সঙ্গে একবার মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যাবেন। যদি অস্বাভাবিক কিছু আমার নজরে পড়ে।”

“মানে ওঁর ইন্টারেস্ট তুমি ব্যাপারটাতে ইন্টারেস্ট নিচ্ছ বলে।”

“আমার ধারণা তাই। ওসি জানেন ভাইস-চ্যান্সেলার আমাকে খুব স্নেহ করেন। ভাইস-চ্যান্সেলার আর ওঁদের আই.জি হলেন ক্লাসমেট। ওঁরা সবাই অনেক ভেবেচিন্তে চলেন!”

হয়তো এটা নিয়ে সত্যিই মাথা ঘামানোর কিছু নেই। শিশিরবাবুর মৃত্যু হয়তো স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছে। দরজা খুলে ঢুকে কোনো কারণে উলটে পড়ে মাথায় চোট লেগেছিল। তবু মনে হল, একেনবাবু আমাদের সঙ্গে এলে ভালো হত। এদিকে সম্পূর্ণ আধখ্যাপা, কিন্তু রহস্যের মধ্যে এসে পড়লেই, ওঁর মাথাটা যেন মিরাকেলের মত কাজ করে!

.

।। ৭ ।।

কলকাতায় ফিরেও শিশিরবাবুর মৃত্যুটা আমায় হন্ট করছিল। শিশিরবাবুর মৃতদেহটা যেভাবে মাটিতে পড়েছিল, তাতে মনে হয় উনি যখন বাড়িতে ঢুকছিলেন তখনই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে দরজাটা ওরকম পরিপাটি ভাবে ভেজানো থাকবে কেন? এটার কোনো সদুত্তর নেই। কেউ বাড়িতে ঢুকে হাত পেছন করে দরজা ভেজিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে না। যে-ভাবে ওঁর দেহ পড়ে ছিল, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে পড়ার আগে উনি ঘরের ভেতরের দিকে মুখ করে ছিলেন। দরজাটা ভেজিয়ে ছিটকিনি না আটকিয়ে উলটোদিকে ঘুরবেন কেন? এর একটা সম্ভাব্য উত্তর হয়তো ছিটকিনি খুলে বেরোতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কিছু একটা ভুলে ফেলে যাচ্ছেন বলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন।

কেন জানি না, এটা খুব যুক্তিযুক্ত মনে হল না। তাহলে কি কোনো আততায়ী বাড়িতে ঢুকে অপেক্ষা করছিল? কিন্তু সে বাড়ির ভেতর ঢুকল কি করে? তালা ভেঙে নিশ্চয় ঢোকেনি। সেক্ষেত্রে তালা আর চাবি ভেতরে মেঝেতে পড়ে থাকত না। তারচেয়েও বড়ো কথা, বাড়ির দরজায় তালা না দেখে কেউ বাড়িতে ঢুকেছে বলে শিশিরবাবুর নিশ্চয় সন্দেহ হত। একা একা ওভাবে ঢুকতেন না।

আর একটা সম্ভাবনাও বাদ দিতে পারি না। যদি ধরি নিই উনি বাড়িতে ঢুকছিলেন না, বেরোচ্ছিলেন, আর তখনই আততায়ী এসে দরজায় কড়া নাড়ে। উনি দরজা খুলতেই ঠেলে ভেতরে ঢুকে ওঁকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল হয়তো চুরি করা। খুনটা অ্যাকসিডেন্ট, যাকে বলা যেতে পারে ইনভলান্টারি ম্যানফ্লটার। কিন্তু কী নিতে লোকটা এসেছিল?

কলকাতা ছাড়ার দুদিন আগে প্রভাসের ফোন পেলাম। যেটুকু বুঝলাম, সেটা হল ওসি নিজেই শিশিরবাবুর মৃত্যুর তদন্ত করছেন। এর মধ্যে প্রভাসকে নিয়ে শিশিরবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন, যদি প্রভাসের চোখে পড়ে দামি কোনো জিনিস অদৃশ্য হয়েছে! কিন্তু সেরকম কিছুই প্রভাসের নজরে আসেনি। তবে একটা জিনিস দেখে ও বেশ অবাক হয়েছে। সেটা হল, একগুচ্ছ পুরোনো চিঠি খাবার টেবিলের উপর পড়েছিল। শিশিরবাবু খাবার টেবিলে কাগজপত্র কখনোই রাখতেন না। কথাটা ওসি-কে বলায় তিনি জানান যে চিঠিপত্রগুলো মেঝেতে ছিল, ওঁর লোকেরাই ওগুলো তুলে টেবিলে রেখেছে। চিঠিপত্রগুলো বাস্তবিকই পুরোনো। প্রভাস শুধু দুয়েকটা চিঠির ওপরেই চোখ বুলিয়েছে। সেগুলো প্রেমপত্র। প্রভাসের মনে হয়েছে লেখার ছাঁদ মেয়েলি। স্টাইলটাও। মনে হয় শিশিরবাবুকে উদ্দেশ্য করেই এককালে কেউ সেগুলো লিখেছিলেন। প্রশ্ন হল, চিঠিগুলো কোথায় ছিল, আর মেঝেতে পড়েছিল কেন? কেউ কি এই চিঠিগুলোর মধ্যে কোনো একটা বিশেষ চিঠির খোঁজে এসেছিল? কিন্তু এই পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে লেখা প্রেমপত্রে এমন কী কথা লুকিয়ে থাকতে পারে যার জন্য এত বছর বাদে কেউ সেটা চুরি করতে আসবে? হয়তো অন্য কোনো দরকারি কাগজ চিঠিগুলোর সঙ্গে ছিল। সেইটে বার করবার সময়েই চিঠিগুলো মাটিতে পড়ে গেছে। তালা-চাবির ব্যাপারে আমার মনের মধ্যে যে চিন্তাটা ঘুরছিল, সেটাও প্রভাতের কথায় পরিষ্কার হল। পুলিশের লোকরা বাড়ির আশেপাশে পরীক্ষা করতে গিয়ে দরজার বাইরে বারান্দার মেঝেতে একটা চাবি পেয়েছে। চাবিটা বাইরের তালার। কিন্তু বাইরের চাবিতে যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে তার সঙ্গে ভেতরের চাবির ফিঙ্গার প্রিন্টের মিল নেই। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এক একাধিক লোক শিশিরবাবুর ঘরে ঢুকেছিল এবং কোনো কাগজপত্রের খোঁজে এসেছিল। ওসি-রও ধারণা এটা সম্ভবত কোনো ইচ্ছাকৃত খুন নয়। কেউ বা কারা কিছু চুরি করতে এসেছিল। দুবর্তৃতরা বাড়িতে থাকাকালীন শিশিরবাবু ফিরে আসেন। তখন ধাক্কাধাক্কি হয় –তাতেই বৃদ্ধ পড়ে গিয়ে মারা যান। তবে মনে হল শান্তিনিকেতনের পুলিশের উপর প্রভাসের বিশেষ আস্থা নেই। সবকিছু বলার পর আমাকে জিজ্ঞেস করল, “একেনবাবু কি এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন?”

আসলে একেনবাবুর কথা একটু ফলাও করেই সেদিন প্রভাসকে বলেছিলাম। বললাম, “বলতে পারি, কিন্তু তোমাদের শান্তিনিকেতনের পুলিশ কি ওঁর কথা শুনবে?”

প্রভাস কিছু বলার আগে, বন্দনা ফোনটা ধরল। নিশ্চয় প্রভাসের কাছে বেড়াতে গেছে। বলল ওরা ঠিক করেছে সিভিল ম্যারেজ করবে। তিরিশ দিনের নোটিস দিতে হবে। ওদের দুজনেরই খুব ইচ্ছে বিয়েতে আমি সাক্ষী হই। আমি কি যাওয়াটা একটু পেছোতে পারি?

“কোনো উপায় নেই রে, আমার ক্লাস শুরু হচ্ছে। তবে আমার বেস্ট উইশেস রইল।”

বন্দনা মনে হল একটু দুঃখিত হয়েছে। কিন্তু আসলে ও বেশ বুঝদার মেয়ে।

.

।। ৭ ।।

নিউ ইয়র্কে ফিরে দেখলাম প্রমথ যে ভয়টা করেছিল –ঠিক তাই। একেনবাবু। অ্যাপার্টমেন্টটাকে একটা নর্দমা বানিয়ে রেখেছেন। সিঙ্কটায় নোংরা বাসন স্তূপ হয়ে আছে। কফি টেবিলে অন্ততঃ আট-দশ দিনের নিউ ইয়র্ক টাইমস ডাঁই করে রাখা। বসার ঘরের চারিদিকে জামা-কাপড় ছড়ানো –ওঁর শোবার ঘরের কথা বাদই দিলাম। একেনবাবুর এক্সকিউজ হল –উনি ঠিক করেছিলেন গতকাল সারাদিন বাড়ি ঘরদোর একটু গোছাবেন, কিন্তু হঠাৎ ওঁকে একটা সেমিনারে যেতে হয়েছে…।

প্রমথ বলল, “আপনি ঘর পরিষ্কার কি শুধু আমাদের জন্য করছিলেন? নিজে পিগ-এর মতো ছাড়া থাকতে পারেন না?”

“না, না, তা কেন স্যার। আসলে কি জানেন, পরিষ্কার করলেই তো আবার নোংরা হয়। তাই প্রতিদিন না করে, মাঝেমাঝে করব ভেবেছিলাম।”

প্রমথ রান্নাঘর নিয়ে পড়ল। আমি আর একেনবাবু বাইরের ঘরটা গোছাতে শুরু করলাম। তার ফাঁকে ফাঁকে একেনবাবুকে শিশিরবাবুর মৃত্যুর ঘটনাটা বিস্তারিত ভাবে বললাম।

প্রমথ রান্নাঘর থেকে খোঁটা দিল। “সলভ করুন না মিস্ট্রিটা, মুখে তো অনেক হ্যাঁনা করেছি ত্যানা করেছি বলেন।”

“আচ্ছা, দেখুন তো স্যার, কবে আমি বললাম ওসব কথা!” আমাকে সাক্ষী মানলেন একেনবাবু।

“না তা বলেননি। কিন্তু সত্যি একটু ভাবুন তো ব্যাপারটা নিয়ে।”

“আপনার কী মনে হয় স্যার?”

“আমার মনে হয় এর মধ্যে কিছু একটা গোলমাল আছে। শিশিরবাবু বড়োেলোক নন। সাধারণ চোরের পক্ষে অন্য কোনো পয়সাওয়ালা লোকের বাড়িতে হানা দেওয়াটা অনেক বুদ্ধিমানের কাজ হত।”

“তা হত স্যার। কিন্তু শিশিরবাবুর বাড়িতে ঢোকাটা যতটা সহজ ছিল, অন্য বাড়িতে হয়তো অতটা সহজ ছিল না.. মানে, আমি যা শুনলাম। বাড়ির কাজের লোকটা ছিল ছুটিতে, শিশিরবাবু নিজে লাঠি হাতে খুট খুট করে চলেন –সুতরাং, হাতেনাতে ধরা পরার সম্ভাবনাটা কম। একটু ভেবে দেখুন তো স্যার, ওঁর বাড়িতে কী থাকতে পারে যেটা খুব দামি?”

“দামি যা যা ছিল –যেমন, নন্দলাল, রামকিঙ্কর আর যামিনী রায়ের অরিজিনাল পেন্টিং, তার কোনোটাও চুরি যায়নি!”

“সেগুলোর দাম তো বেশ কয়েক লাখ টাকা, তাই না?”

“রাইট।”

“দ্যাটস কনফিউজিং!”

“কনফিউজিং বলে কনফিউজিং! এছাড়া আর কি থাকতে পারে একজন বৃদ্ধ প্রফেসরের বাড়িতে?”

“ঠিক কথা স্যার, আসুন একটু বসা যাক।” বলে একেনবাবু সোফায় গিয়ে বসলেন।

আমিও ওঁর সঙ্গে একটু বিশ্রাম নিতে বসলাম।

কিছুক্ষণ পা নাচিয়ে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, এই প্রভাসবাবু লোকটি কেমন? রিলায়বেল মনে হল?”

“কেন, আপনি প্রভাসকে সন্দেহ করছেন নাকি!”

“না না, এই সব ব্যাপারে অনেক সময়ে চেনা-পরিচিত লোকরা জড়িত থাকে কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।”

প্রমথ ইতিমধ্যে কিচেন থেকে বেরিয়ে এসেছে। “তাহলে আমাকে আর বাপিকেও সন্দেহ করুন না, আমরা এমন কি রিলায়বেল?”

একেনবাবু নির্বিকারভাবে বললেন, “আপনারা তো স্যার শিশিরবাবুর চেনা জানা নন।”

প্রমথ ছাড়ল না। “প্রভাস যদি শিশিরবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে আমাদের নিয়ে গেল কেন?”

“কী মুশকিল স্যার, এর উত্তরটা তো আপনারাই দিতে পারবেন! ভেবে দেখুন স্যার, উনি আপনাদের নিয়ে শিশিরবাবুর বাড়ি গেলেন। গিয়ে সবাই দেখলেন শিশিরবাবু ডেড। আপনারা ধরেই নিলেন যে প্রভাসবাবুও এই প্রথম ডেডবডিটা দেখছেন আর আপনারা হয়ে গেলেন তার সাক্ষী। ঐ বাড়িতে পুলিশ যদি ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়, তাহলে শুধু প্রভাসবাবুর প্রিন্ট পাবে না, আপনাদেরও পাবে। আর আপনারা তো পুলিশকে বলেইছেন আপনারা সবাই একসঙ্গে গিয়েছিলেন ওঁর বাড়িতে। কেস ক্লোজড।”

“দাঁড়ান মশাই, একটু আস্তে,” প্রমথ বলল। “প্রথমত, কোনো ছবি চুরি যায়নি। তাহলে আর কী মহামূল্য জিনিস ও বাড়িতে থাকতে পারে?”

“কেন স্যার, বই!”

“তার মানে?”

“আপনারাই তো বললেন স্যার শিশিরবাবু রিটায়ার্ড অধ্যাপক –বইপত্র নিয়ে পড়ে থাকতেন। কিছু কিছু পুরোনো বইয়ের দাম তো সাংঘাতিক হয়। হয় না স্যার?”

“কোয়েশ্চেন না মেরে উত্তরটা দিন না,” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল।

“আমার নিজেরই জানা ছিল না স্যার। সেদিন ক্রিস্টির একটা ক্যাটালগে দেখলাম স্যামুয়েল জনসনের ১৭৫৫ সালের ডিকশনারি বিক্রি হচ্ছে ২৫ হাজার ডলারে। তারমানে প্রায় পনেরো লাখ টাকা –জাস্ট একটা পুরোনো বই, এমন কি অটোগ্রাফ করাও নয়। অটোগ্রাফড বই হলে কত দাম হত ভাবুন?”

কেন জানি না, আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। পুরোনো বইয়ের মূল্য সাধারণ চোর বুঝব না, কিন্তু প্রভাসের মতো লোক বুঝবে। বন্দনা বিয়ে করবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। প্রভাস যদি সত্যিই এই খুনের সঙ্গে জড়িত থাকে… আমি ভাবতে পারছিলাম না, ঠিক কী করা উচিত হবে।

হঠাৎ শুনলাম প্রমথ বলছে, “ননসেন্স! পাশের বাড়ির ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, আমরা আসার কিছুক্ষণ আগেই শিশিরবাবু মারা গেছেন। প্রভাস আমাদের সঙ্গে সারা সকাল গল্প করছিল। সেটা কী করে হয়? এখন আপনি যদি বলেন যে ঐ ডাক্তারও প্রভাসের সঙ্গে জড়িত –তাহলে অবশ্য অন্যকথা।”

বাঁচিয়েছে, আমি মনে মনে ভাবলাম। কিন্তু হঠাৎ একটা খটকাও লাগল। কেন, প্রভাস ঘরে না ঢুকেই উধশ্বাসে পাশের বাড়ি ছুটে গেল। আর ডাক্তার চৌধুরিও কেন সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন। ওঁরও এ ব্যাপারে জড়িত থাকা কি সম্ভব?

“কমপ্লিকেটেড ব্যাপার স্যার।” একেনবাবু সোফায় বসে আবার পা নাচাতে লাগলেন। “তবে ডাক্তারবাবুকেও সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় না।”

হঠাৎ মনে হল বইয়ের জন্য কখনোই উনি খুন হতে পারেন না। একেনবাবুকে বললাম, “প্রভাসের কাছে ওঁর অনেক বই-ই রয়েছে। বইয়ের জন্য সে এমন একটা কাজ করতে যাবে কেন। চাইলেই তো উনি ওকে বই দিতেন।”

“এগুলো তো আপনার শোনা কথা স্যার, আর সবই প্রভাসবাবুর কাছ থেকে তাই?”

একেনবাবুর কথা শুনে সত্যিই দমে গেলাম।

প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “কী মশাই, সমাধান করতে পারবেন?”

“খেপেছেন স্যার, দশ হাজার মাইল দূরে বসে!”

“সেটা না পারলে কিরকম ডিটেকটিভ মশাই আপনি!”

“শুনছেন স্যার, প্রমথবাবুর কথা?”

“শুনছি, কিন্তু এখন করণীয়টা কি বলুন?”

“আপাতত এক কাপ কফি খাওয়া যাক স্যার।”

এবার আমার একেনবাবুর ওপর রাগ হল। বললাম, “দেখুন, প্রভাস বিয়ে করছে আমার অতি পরিচিত মেয়ে বন্দনাকে। ও যদি সত্যিই খুনি হয়, তাহলে এ বিয়ে হতে পারে না। আপনাকে এটা নিয়ে কাজে লাগতে হবে।”

“আরে কী মুশকিল, উনি মার্ডারার হতে যাবেন কেন?”

“সন্দেহের কথাটা তো আপনিই তুললেন!”

“স্যার, আপনাদের নিয়ে আর পারা যায় না!”

এবার প্রমথ বলল, “না সিরিয়াসলি, আপনি এই কেসটা নিয়ে একটু ভাবুন। কী, ভাববেন তো?”

“না ভাবলে কি আপনারা আস্ত রাখবেন। তাহলে আরেকবার শুনি, ভালো করে শুনি সব কিছু। তবে কফি পেলে স্যার, মাথাটা একটু খেলত।”

.

।। ৯ ।।

একেনবাবু প্রভাস সম্পর্কে এমন একটা সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে রাত্রে ভালো করে ঘুম হল না। বন্দনাকে স্বপ্ন দেখলাম। আমায় বলছে, “তুমি জেনেও আমাকে কেন সতর্ক করনি? কী দোষ করেছি তোমার কাছে?

প্রভাস কে কি পুলিশ ধরেছে? চমকে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেছে আমার। ডাক্তার চৌধুরীর একটা কথা, যেটা নিয়ে আগে ভাবিনি –সেটা মাথায় ঘুরতে লাগল। কেন উনি বললেন, ‘এই একটু আগে শিশিরবাবু মারা গেছেন।’ বললেন খানিকটা অযাচিত ভাবে। কেন? প্রকারান্তরে আমাদের জানিয়ে দিলেন যে সেক্ষেত্রে শিশিরবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে প্রভাসের যোগ থাকা অসম্ভব। কিন্তু আমাদের জানিয়ে লাভটা কি হল?

সকালে একেনবাবু উঠতেই আমি বললাম, “একটা উপকার আপনাকে করতেই হবে।”

“বলুন স্যার।”

“আপনাকে এক সপ্তাহের মধ্যে বলতে হবে, প্রভাস এর মধ্যে কোনও মতে জড়িত কিনা।”

“কী ব্যাপার স্যার, এই রকম একটা টাইম লিমিট দিচ্ছেন?”

“বিয়ের আর দিন পনেরো বাকি,” ওঁকে বললাম, “কোনোমতেই বন্দনার যেন সর্বনাশ না হয়।”

“তাতো বটেই স্যার। তবে আপনি স্যার বোধহয় অযথা দুশ্চিন্তা করছেন। যাইহোক, শান্তিনিকেতনের ওসি-র নাম মনে আছে আপনার?”

“হ্যাঁ আছে। ইনফ্যাক্ট, আমাকে উনি ওঁর একটা ভিসিটিং কার্ড দিয়েছিলেন।”

আমি আমার কার্ডের বাক্স থেকে বার করে এনে ওঁর হাতে দিলাম।

“দুলাল মিত্র! বাঃ, আমি তো ওকে চিনি। আমার কলিগ ছিল এক সময়ে।”

“সত্যি! তাহলে ওঁকে একটা ফোন করুন না।”

একেনবাবু ইতস্ততঃ করছেন দেখে বললাম, “আরে মশাই ফোন ইজ অন মি। যা ফোন করার দরকার, করুন।”

দুলাল মিত্রকে অফিসে পাওয়া গেল না। একেনবাবু নিজের পরিচয় দিতে বাড়ির নম্বরটা পাওয়া গেল। দুলালবাবু কোথায় জানি বেরোচ্ছিলেন, তাই অল্পক্ষণই একেনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারলেন। ফোন নামিয়ে একেনবাবু বললেন, “প্রভাসবাবুকে নিয়ে ভাববেন না। হি ইজ ক্লিয়ার।”

“ক্লিয়ার?”

“হ্যাঁ স্যার। আপনারা যখন শিশিরবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। তার আধঘন্টা আগে কাছেই একটা বাড়িতে শিশিরবাবু বই ফেরৎ দিতে গিয়েছিলেন। সুতরাং ওঁর মৃত্যুর অল্প পরেই আপনারা সেখানে গিয়েছিলেন।”

“বাঁচা গেল।”

“আমিও বাঁচলাম স্যার। যে-রকম একটা টাইম লিমিট চাপিয়েছিলেন ঘাড়ে!”

“ইনভেস্টিগেশনের কিছু এগিয়েছে?”

“কিছু এগিয়েছে। দুলাল মিত্র এক সময়ে ভালো ভালো ক্রাইম সলভ করেছে। কিন্তু এখন ওর উপর যা কাজের চাপ, তাতে এর পিছনে কতটা সময় দিতে পারবে জানি না।”

প্রভাস নির্দোষ জেনে অবশেষে স্বস্তি পেলাম। প্রভাস-বন্দনার বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। আশাকরি বন্দনা সুখী হবে। প্রমথ এমনিতে গানটান বিশেষ শোনে না, আজ কেন জানি একটা সিডি চালিয়েছে।

“আমারও পরাণ যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো …..
যদি আর-কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো।”

আশ্চর্য এটা কি আমারই মনের কথা!

.

।। ১০ ।।

সুভদ্রামাসির জন্য মা একটা আচারের শিশি পাঠিয়েছিল, আর সেই সঙ্গে একটা চিঠি। ভাবছিলাম সে দুটো বাক্সে পুরে পার্সেল করে পাঠিয়ে দেব। ইতিমধ্যে আমরা ফিরেছি কিনা জানতে সুভদ্রামাসি ফোন করলেন। মা’র খবর নিলেন। আচার পার্সেলে পাঠাব শুনে বললেন, “না, না, তোমরা বরং একদিন সময় করে এসো–তখন এনো৷”।

প্রমথ বা একেনবাবু কাউকেই নারাজ দেখলাম না। আমি শিওর তার কারণ সেদিন সুভদ্রামাসির কুক সুজাতার ফ্যান্টাস্টিক রান্না। শনিবারে আমার বিশেষ কাজ ছিল না। একেনবাবুও সেদিন ফ্রি! প্রমথ আর ফ্রান্সিস্কা সিনেমা যাবে প্ল্যান করছিল। আগের বার ফ্রান্সিস্কা সুভদ্রামাসির বাড়ি যাবে বলেও যেতে পারেনি। তাই এবার বলল, সিনেমা নয়, আমাদের সঙ্গেই যাবে। আমি সুভদ্রামাসিকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমরা আসছি। ফ্রান্সিস্কার কথা আগেরবার উনি শুনেছিলেন। শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন আমাদের মধ্যে অন্ততঃ একজনের গার্লফ্রেন্ড হয়েছে।

আচার পেয়ে সুভদ্রামাসি খুব খুশি হলেন। বললেন, “তোমার মা জানে লেবুর আচার আমার ভীষণ পছন্দ। মাসিমা, মানে তোমার দিদিমা, এটা অপূর্ব বানাতেন। ছেলেবেলায় মাসিমার কাছে গেলেই লেবুর আচার আমার বরাদ্দ ছিল। তোমার মাও ভালো বানায়।”

মা-র চিঠিটা দিলাম। মা খুব সেন্টিমেন্টাল হয়ে গিয়েছিল দিদিমা আর সুভদ্রামাসির মা’র কমবয়সি ছবি দেখে। পার্কিৰ্মন্স হবার পর থেকে, মা ভালো করে আর লিখতে পারে না। দুয়েকটা পুরোনো কথা তাই আমাকে দিয়ে লিখিয়েছিল। কলকাতার অনেক গল্প হল। আমাদের শান্তিনিকেতনে যাবার কথা আর শিশিরবাবুর মৃত্যুর ঘটনাও কথা প্রসঙ্গে এল। সুভদ্রামাসি বললেন, শিশিরবাবু নামটা ওঁর চেনা চেনা লাগছে, রিচার্ডের কাছেই বোধহয় শুনেছেন। কিন্তু কী সূত্রে মনে করতে পারলেন না। কলকাতায় থাকাকালীন শান্তিনিকেতনে রিচার্ড একবার বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানেই নিশ্চয় শিশিরবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।

খাবারের আয়োজন এবারও দারুণ। আমরা পরম তৃপ্তি করে খেলাম। ফ্রান্সিস্কাকে নিয়ে আমাদের একটু চিন্তা ছিল। ও শুধু সবকিছু খেল তাই নয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই সুভদ্রামাসির ফেভারিট পার্সন হয়ে গেল! খাবার পর সুভদ্রামাসি ওকে শাড়ি গয়না দেখালেন।

শাড়ি পরা শিখতে চায় শুনে, একটা শাড়ি আর একটা ব্লাউজ বার করে ওকে পরিয়েও দিলেন। ব্লাউজটা পুরোনো –সুভদ্রামাসির কমবয়সের ব্লাউজ। বেশ ফিট করে গেল ফ্রান্সিস্কার। দেশের আচ্ছাদনে সুন্দর লাগছিল ওকে দেখতে। প্রমথ বিমুগ্ধ।

একেনবাবু গম্ভীরভাবে মন্তব্য করলেন, “যাই বলুন স্যার, শাড়ির অ্যাপিলই আলাদা।”

ফ্রান্সিস্কার মা নেই, আর সুভদ্রামাসির সন্তান নেই। তাই বোধহয় একজন আরেকজনের অভাব পূরণ করল। সুভদ্রামাসি পরম উৎসাহে ওকে বাড়ি দেখাতে লাগলেন। ফ্রান্সিস্কাও ওঁর হাত ধরে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। কোন জিনিসটা কী, কত পুরোনো, কোত্থেকে এসেছে তার বিস্তারিত খবর নিল। তবে আমার মাঝে মাঝে ভয় করছিল। সুভদ্রামাসির ব্যালেন্স এখন আর ভালো নেই, যদিও ফ্রান্সিস্কা ওঁর হাত ধরে আছে। কিন্তু কাঁচের বড়ো বড়ো ফুলদানি, জার ইত্যাদি নামিয়ে যখন উনি দেখাচ্ছিলেন, ভয় করছিল হাত থেকে ফসকে রক্তারক্তি না ঘটে। একবার তো বলেই ফেললাম।

সুভদ্রামাসি হাসতে হাসতে বললেন, “ভাবিস না, যখন ব্যালেন্স ছিল তখনও ভেঙেছি, হাত-পাও কেটেছি। তবে তোরা তো আছিস, কেটে-ছড়ে রক্তারক্তি হলে বুড়ি মাসিকে না হয় একটু রক্ত-টক্ত দিস।”

আমি বললাম, “যাঃ, ঠাট্টা করো না।”

সুভদ্রামাসি দেখলাম খুব মুডে আছেন। বললেন, “কেন দিবি না নাকি?”

ওঁর আমি মুডটা নষ্ট করতে চাইলাম না। বললাম, “নিশ্চয় দেব, যদি তুমি নিতে পার।”

“পারব না কেন, রক্তের ব্যাপারে আমার মস্ত সুবিধা, আমি হলাম ইউনিভার্সাল রিসিভার।”

প্রমথ বলে উঠল, “এখন আর ইউনিভার্সাল রিসিভার কেউ নয় মাসি –আরও বহু ফ্যাক্টর নিয়ে ডাক্তারদের মাথা ঘামাতে হয়।”

ফ্রান্সিস্কা বুদ্ধিমতী। আমাদের কথাবার্তা ঠিক না বুঝলেও আমার উদ্বিগ্নতার কারণটা আঁচ করতে পারল। এরপর দেখলাম সুভদ্রামাসিকে কিছু নামাতে না দিয়ে নিজেই সাবধানে নামিয়ে নামিয়ে দেখছে। ফ্রান্সিস্কা যখন বাড়িঘর দেখতে ব্যস্ত, আমরা তিনজন ফ্যামিলি রুমে কফি নিয়ে বসলাম। কী করণে যাদবপুরের প্রসঙ্গ ওঠায়, আমি আর প্রমথ পুরোনো দিনের কথায় মশগুল হয়ে গেলাম। একেনবাবু দেখলাম উঠে গিয়ে সুভদ্রামাসিদের জিনিওলজির অ্যালবামে চোখ বোলাচ্ছেন আর মাঝে মাঝে বইয়ের আলমারি থেকে স্টুয়ার্টমেসোর কালচারাল অ্যান্থপলজির বই ঘাঁটছেন।

কিছুক্ষণ বাদে ফ্রান্সিস্কা সুভদ্রামাসিকে নিয়ে ফিরে এল আর এসেই মাসিকে বলল গান গাইতে।

সুভদ্রামাসি বললেন, “দেখো কান্ড, এখন কি আর তেমন গাইতে পারি!”

ফ্রান্সিস্কা চোখ গোল গোল করে আমাদের বলল, “তোমরা জানো, মা’র গানের রেকর্ড আছে?”

তথ্যটা জানা ছিল না। আর এও জানা ছিল না এর মধ্যেই ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে সুভদ্রামাসি মা-মেয়ের সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছেন! যাইহোক, ফ্রান্সিস্কার অনুরোধ এড়াতে না পেরে সুভদ্রা মাসি দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন। এখনও গলা অপূর্ব।

আমি বললাম, “সত্যি সুভদ্রামাসি, তুমি আর রেকর্ড করাও না কেন?”

“দূর, কবে চর্চা ছেড়ে দিয়েছি।”

তবে বুঝলাম একটু-আধটু চর্চা এখন করতে হবে, কারণ ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, প্রতিমাসে একবার সুভদ্রামাসির কাছে এসে ফ্রান্সিস্কা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখবে।

আমি বললাম, “চমৎকার আইডিয়া, আমরাও আসব।”

প্রমথ বলল, “ও কিন্তু আসবে খাবার লোভে।”

“সেটা তো আনন্দের কথা। মাসির বাড়িতে তো খেতেই আসে সবাই। ও যখন গান শিখবে, তোমরা না হয় গল্প গুজব কোরো। বেসমেন্টে একটা পুল টেবিলও আছে।”

ফেরার পথে ফ্রান্সিস্কা একেবারে উচ্ছ্বসিত। “শি ইজ সো লাভিং, বার বার বলল কথাটা। “উই জাস্ট গট কানেক্টড লাইক দ্যাট! আর বাড়িটা দেখেছো কী টেস্টফুলি ডেকোরেটেড?”

কথার পিঠে কথা বলা একেনবাবুর স্ট্রং পয়েন্ট নয়। উনি বললেন, “আপনি যে গান গান, সেটা কিন্তু জানতাম না ম্যাডাম।”

একেনবাবুর কাছে ‘ম্যাডাম’ শুনে প্রথমবার ফ্রান্সিস্কার মুখের অবস্থা হয়েছিল দেখার মতো। যদিও একেনবাবুর মোটামুটি একটা পিকচার আগে থেকেই প্রমথ ফ্রান্সিস্কাকে দিয়েছিল। প্রথম পরিচয়ের পর একাধিক বার একেনবাবুকে ‘ম্যাডাম’ বলা থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছে ফ্রান্সিস্কা। একেনবাবু প্রত্যেকবারই জিব কেটে বলেছেন, “সরি ম্যাডাম, ওটা আমার মুদ্রাদোষ হয়ে গেছে। আজকাল আমরাও যেমন ওঁর স্যার নিয়ে মাথা ঘামাই না। ফ্রান্সিস্কাও ম্যাডাম শব্দটা ইগনোর করে।

ফ্রান্সিস্কা বলল, “কলেজে আমার মিউজিক মাইনর ছিল। যদিও ফাঁকি দিয়েছি খুব।”

“আপনি ম্যাডাম, অসাধারণ ট্যালেন্টেড। স্কি, গান,পড়াশুনা –সত্যি অ্যামেজিং!”

ফ্রাড্ডিস্কা একটু লাল হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, ডিটেকটিভ!”

ফ্রান্সিস্কা একেনবাবুকে পছন্দ করে। সব সময় ডিটেকটিভ বলেই ডাকে। তারপর বলল, “আচ্ছা ডিটেকটিভ, তুমি মা-র বাড়িতে ঐ মূর্তিটা দেখেছ? ওটা অপূর্ব সুন্দর, না?”

“ইয়েস।”

“মা বললেন, ওটা চুরি হয়ে গিয়েছিল। পরে চোর ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আই ওয়াজ সো সারপ্রাইজড! ওই রকম মূর্তি যদি সত্যিই কেউ চুরি করে, তাহলে ফেরত পাঠিয়ে দেবে কেন! তোমার কি মনে হয়?”

“আমি আপনার সঙ্গে একমত। ভেরি কনফিউজিং!”

“আই থিঙ্ক ইউ শুড সলভ দিস মিস্ট্রি।”

“দাঁড়াও, দাঁড়াও,” প্রমথ বলল, “একেনবাবু দশদিন আগে একটা মার্ডার সলভ করতেই হিমসিম খাচ্ছেন –আর এটা তো ষাট বছরের আগের চুরি।”

“মার্ডার নিয়ে পুলিশ ভাবুক। বাট দিস ওয়ান ইজি সো ইন্টারেস্টিং। আমি রিয়েলি ফ্যাসিনেটেড মূর্তিটা দেখে। বাই দ্য ওয়ে, ডু ইউ নো, মা কি বলেছে?”

“না।”

“ঐ মূর্তিটা উনি আমায় দিয়ে যাবেন।” বিজয়িনীর মতো মুখ করে ফ্রান্সিস্কা বলল।

“নো ওয়ান্ডার তুমি ওকে তেল দিচ্ছিলে,” প্রমথ বলল। “মা মা বলে ডাকা, গান শিখব বলা। নাউ আই আন্ডারস্ট্যান্ড।”

ফ্রান্সিস্কা প্রমথর হাতে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল, “ডোন্ট বি সিলি!”

.

বাড়ি ফিরে প্রভাসের একটা সংক্ষিপ্ত ইমেইল পেলাম। শিশিরবাবুর ইনভেস্টিগেশনটা চলছে। ওদের বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে –ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখে। আমাকে মিস করবে বলে দুঃখ করেছে।

খবরটা জানাতেই প্রমথ অ্যাস ইউসুয়াল খোঁচা দিল, “এটা কি গুড নিউজ না ব্যাড নিউজ?”

“ডোন্ট বি স্টুপিড।”

একবার ভুল করে বন্দনার প্রতি আমার দুর্বলতার কথাটা প্রমথকে বলে ফেলেছিলাম, তার জের এখনও পোয়াতে হচ্ছে!

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত