বেসুরো বেহালার পরের কাহিনি – একেনবাবু সমগ্র (তৃতীয় খন্ড) – সুজন দাশগুপ্ত

১.

আমার এক স্টুডেন্ট অ্যাসিস্টেন্ট আছে, নাম ওডিন সেকো। আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্র হলেও ওডিনের বয়স হয়েছে। আমার থেকে মাত্র বছর কয়েকের ছোটো। নানা ঘাটের জল খেয়ে আবার কলেজে ঢুকেছে। অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে মেরিল্যান্ডে এক এনার্জি রিসার্চ সেন্টারে ল্যাব অ্যাসিস্টেন্টের কাজ করত। বেশ কয়েক বছর ছিল সেখানে, তারপর কী মনে হয়েছে আবার ডিগ্রি কোর্সে ঢুকেছে। কথাবার্তায় ভদ্র। মন দিয়ে কাজ করে। এবার আমার গ্রান্টে ফুল-টাইম অ্যাসিস্টেন্টশিপের টাকা নেই। ফুল-টাইম অ্যাসিস্টেন্টরা সপ্তাহে কুড়ি ঘণ্টা কাজ করে, সেই সঙ্গে পড়াশুনো। আমার এ্যান্টে যা আছে, তাতে অর্ধেক দেওয়া যায়। ওই টাকায় ওর চলছিল না। প্রমথর কেম-ল্যাবের এক অ্যাসিস্টেন্ট তিনমাসের মেটার্নিটি-লিভ নিয়েছিল। ডিপার্টমেন্ট হেডের সঙ্গে কথা বলে প্রমথ ওকে আরও দশ ঘণ্টার কাজ ম্যানেজ করে দিল। ফলে আমাদের প্রতি ওডিনের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। দরকারে অ-দরকারে এগিয়ে এসে সাহায্য করে। আমার তরফ থেকে যেটা করতে পেরেছি, আমার ঘরের এক কোণে ওর জন্য ডেস্ক আর চেয়ার রাখা।

.

কিছুদিন আগের কথা। ওডিন আর আমি অফিসে কাজ করছি, আমার বন্ধু প্রীতম এল। প্রীতমের সঙ্গে কলকাতায় বি এসসি পড়েছিলাম। পাশ করেই ও আমেরিকাতে চলে এসেছিল, তবে যোগাযোগটা ছিন্ন হয়নি। আমি যখন নিউ ইয়র্কে প্রথম এলাম, প্রীতমই খোঁজখবর করে আমার সঙ্গে এসে দেখা করেছিল। অফিসের কাজে মাঝেমাঝেই ওকে এদিকে আসতে হয়, সময় থাকলে আমাকে ‘হ্যালো’ বলে যায়।

.

আমার বন্ধু হলেও প্রীতম অন্য জগতের ছেলে। থাকত আলিপুরে, অভিজাত পল্লীর একটা বিশাল বাড়িতে। অঢেল পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র সন্তান। মায়ের পরিবার আরও বড়লোক। মায়ের ঠাকুরদা, অর্থাৎ প্রীতমের দাদুর বাবা যৌবনকালে কেনিয়াতে গিয়ে একটা ছোটোখাটো দোকান খুলেছিলেন। সেখান থেকেই রকেটের গতিতে তাঁর উত্থান। ক্যাম্পর ইন্ডাস্ট্রি এখন একটা বিশাল কনগ্লমারেট অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল, প্লাস্টিক থেকে শুরু করে আইটি, বায়োটেক –কী নেই তার মধ্যে! ক্যাম্পর ইন্ডাস্ট্রির অফিস শুধু কেনিয়াতে নয়, ইউরোপ, জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রলিয়া– সব জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে! হেড কোয়ার্টার নাইরোবিতে। প্রীতম রয়েছে কোম্পানির নিউ ইয়র্ক অফিসে। দাদু মারা যাবার পর প্রীতমের বড়মামা গুরুবচন সিংই ক্যাম্পর ইন্ডাস্ট্রির প্রধান। কয়েক বছর হল নিউ ইয়র্কে এসেছেন এদিকের অপারেশনটা বাড়ানোর জন্য। আমার ধারণা প্রীতমকে ট্রেনিং দিচ্ছেন যাতে নর্থ আমেরিকার ভারটা প্রীতমকে দিয়ে যেতে পারেন। প্রীতমের মামা হবার সুবাদে উনি আমাদেরও আঙ্কল, ওঁর স্ত্রী আন্টি। ওঁরা থাকেন ট্রাইবেকা অঞ্চলে একটা পেন্টহাউসে।

.

প্রীতম এসেছিল ওঁর মামার হয়ে আমাদের নেমন্তন্ন করতে। ক্যাম্পর ইন্ডাস্ট্রির স্ট্রং রুমে রাখা কিছু কিছু গোপন নথি নাকি চুরি হচ্ছিল! কী ভাবে সিকিউরিটিকে ধোঁকা দিয়ে কাগজপত্র সরানো হচ্ছিল, সেটা খুঁজে বার করার জন্যে প্রীতমের বড়মামা প্রাইভেট ডিটেকটিভের খোঁজ করছিলেন। কারো কাছ থেকে একেনবাবুর নাম শুনে যোগাযোগ করেন। তখন অবশ্য প্রীতমের সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের কথা উনি জানতেন না। আর ব্যাপারটা এতই গোপনীয় ছিল যে প্রীতমও এই চুরির খবর জানত না। রহস্যটা উদ্মাটন করতে একেনবাবুর লেগেছিল মাত্র দু’দিন! চোরকে হাতে নাতে ধরেননি ঠিকই, কিন্তু সিকিউরিটি ব্যবস্থায় একটা বড়সড় গলদ আবিষ্কার করেছিলেন। সেই সুযোগটাই চোর নিয়েছিল সন্দেহ নেই। একেনবাবুর সাহায্য নিয়ে সিকিউরিটির সেই ফাঁকটা সুরক্ষিত হল। যেসব তথ্য চুরি হয়ে গেছে, সেগুলো তো গেছে। কিন্তু আরও চুরি হওয়া তো আটকানো গেল!

এত তাড়াতাড়ি একেনবাবু সমস্যার সমাধান করবেন প্রীতমের বড়মামা স্বপ্নেও ভাবেননি! তারপর যখন দেখলেন, একেনবাবু টাকা নিতে চাচ্ছেন না, তখন তো বিস্ময়ে হতবাক! সেই প্রথম জানলেন আমরা ওঁর ভাগ্নের বিশেষ পরিচিত! প্রীতমের আজ নেমন্তন্ন করতে আসাটা সেই সূত্রেই। দুপুরে লাঞ্চের নেমন্তন্ন, এই রবিবার। প্রীতমকে বললাম, “একেনবাবু আর প্রমথ ফ্রি আছে কি না দেখি। থাকলে তো আসবই। যাই হোক, বিকেলের মধ্যেই জানাব।”

.

প্রীতম যেতে না যেতেই একেনবাবু অফিসে এলেন। সকালে তাড়াহুড়ো করে অ্যাপার্টমেন্টের চাবি না নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরে খেয়াল হওয়াতে আমাকে ফোন। এটা নতুন কিছু নয়, প্রতি মাসেই একাধিক বার হয়। ওঁর চাবিটা সঙ্গে নিয়েই এসেছিলাম, বরাবরই তা করি। চাবিটা হাতে দিয়ে বললাম, “কয়েক সেকেন্ড আগে এলে প্রীতমের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। আপনার জন্য রবিবার সবাই লাঞ্চের নেমন্তন্ন পেয়েছি ওর মামার বাড়িতে।”

“আমার জন্য স্যার?”

“বাঃ, আপনি ক্যাম্পর ইন্ডাস্ট্রির চুরি ধরলেন যে?”

“চোর ধরলাম কই স্যার, সিকিউরিটির ফাঁকটা ধরলাম শুধু।”

“ওই হল, সেইজন্যই তো নেমন্তন্ন! আপনি ফ্রি তো?”

“আমি তো ফ্রি স্যার। কিন্তু প্রমথবাবু?”

“আমি ওকে ধরব, একটু বাদেই আসবে।”

একেনবাবুর বাড়ি যাবার তাড়া ছিল, আর বসলেন না।

.

একেনবাবু চলে যেতে ওডিন জিজ্ঞেস করল, “ক্যাম্পর ইন্ডাস্ট্রি … মানে, আফ্রিকার ক্যাম্পর ইন্ডাস্ট্রি?”

“হ্যাঁ, তুমি ক্যাম্পর ইন্ডাস্ট্রির নাম শুনেছ?”

ক্যাম্পর ইণ্ডাস্ট্রি বড় হলেও আইবিএম, জেনারেল মোটর্স বা এক্সনের মতো বিশাল নয়… ওরকম অজস্র কোম্পানি নিউ ইয়র্কে রয়েছে। কিন্তু নাম না শুনে থাকলে প্রশ্ন করবে কেন? আমার প্রশ্নটাই স্টুপিডের মতো!

ওডিন মাথা নাড়ল।

আমার একটা ক্লাস ছিল, এ নিয়ে আর কথা হল না।

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত