২.

প্রমথ আমাদের সঙ্গে যাবে বলেছিল, শেষ মুহূর্তে কাটল। আমি অবশ্য আশ্চর্য হইনি। রবিবার ওকে পাওয়া কঠিন… গার্ল ফ্রেন্ড ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে সময় কাটায়। তাও আগে থেকে বলবে তো!

.

পেন্টহাউসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এর আগে একবারই হয়েছিল। সেবার গিয়েছিলাম ম্যানহাটানের রিয়েল এস্টেট ম্যাগনেট বিপাশা মিত্রের কাছে। পেন্ট-হাউস কী সবাই হয়তো জানেন না… অন্তত আমি এদেশে আসার আগে জানতাম না। হাইরাইজ বিল্ডিং এর সবচেয়ে উঁচু তলার অ্যাপার্টমেন্টকে বলা হয় পেন্টহাউস। এগুলোই সাধারণত হয় সবচেয়ে দামি আর লাজুরিয়াস।

প্রীতমের মামার অ্যাপার্টমেন্ট অবশ্য বিপাশা মিত্রের বাড়ির মতো বড় নয়, কিন্তু অনেক ছিমছাম। লোকেশনটাও ভালো, হাডসন নদীর লাগোয়া ব্যাটারি পার্কের ঠিক পাশে! তিরিশ তলায় পেন্টহাউসে ওঠার জন্য সার্ভিস এলিভেটর বাদ দিয়ে তিন তিনটে এলিভেটর বা লিফট! সেইসঙ্গে সিঁড়ি তো আছেই ফায়ার কোড-এর জন্যে। বাড়িতে আগুন লাগলে ফায়ার-প্রুফ সিঁড়ি দিয়ে লোকে যাতে নেমে আসতে পারে।

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম প্রীতমের বড়মামা তখন অফিসঘরে দরজা বন্ধ করে কাজে ব্যস্ত। প্রীতমই আমাদের লিভিংরুমে নিয়ে গিয়ে বসাল। বিশাল লিভিং রুম। আমি বলব চওড়ায় প্রায় কুড়ি ফুট, লম্বায় তো কম-সে-কম পঞ্চাশ ফুট হবে! সামনে একটা লম্বা টেরাস আর দু’দিকে দুটো ব্যালকনি বা বারান্দা। এখানে বলেই ফেলি– টেরাস আর ব্যালকনির তফাৎটা আগে ঠিক বুঝতাম না। ভুলের মধ্যে সেটা একদিন বলে ফেলে প্রমথর কাছে গাল খেয়েছি।

“এটাও জানিস না! টেরাস হল ছাত, তার নীচে ঘরটর থাকে। ব্যালকনির নীচের একটা দিকে অন্তত কিছু থাকে না।”

প্রমথ অবশ্য অনেক সময়েই সবজান্তার মতো অনেক উলটো পালটা বলে। এটা সম্ভবত ভুল নয়।

.

খানিক বাদেই আন্টি ঘরে এলেন। প্রীতমের কাছে শুনেছিলাম আঙ্কল গুরুগম্ভীর লোক। অফিসের লোকেরা তো ওঁর ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। আন্টি কিন্তু একেবারেই উলটো, হাসিখুশি, ঘরোয়া… ভারী স্নেহশীলা।

আমাদের জন্যে দেখলাম ঢালাও অ্যাপেটাইজারের বন্দোবস্ত করেছেন যার টেন পার্সেন্টও আমরা শেষ করতে পারব না। এটা নাও, ওটা নাও’ করতেই থাকলেন। যতটা পারলাম খেলাম। অ্যাপেটাইজারের ধাক্কাটা কাটলে একেনবাবু বললেন, “সত্যি ম্যাডাম, এত উঁচুতে এত বড় বাড়ি, একেবারে অ্যামেজিং!”

“বাড়িটা দেখবে?” আন্টি ভদ্রতা করেই মনে হল প্রশ্নটা করলেন।

একেনবাবু হ্যাংলার মতো বললেন, “দেখাবেন ম্যাডাম, এমন বাড়ি দেখার সুযোগ আর কবে পাব?” বলেই আমাকে তাড়া দিলেন, “চলুন স্যার, চলুন!

সত্যি, একেনবাবুকে নিয়ে আর পারা যায় না!

আন্টি আমাদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখালেন। প্রীতমও আমাদের সঙ্গ দিল। মোট চারটে জাম্বো সাইজের বেডরুম, প্রত্যেকটাই উইথ অ্যাটাচড বাথ আর টেরাস। দুটো টেরাস পশ্চিম দিকে মুখ করে। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে চোখে পড়বে হাডসন নদী। স্পীড-বোট, ক্রুজার, ক্যাটামারান, যাত্রীবাহী স্টিমার, কী নেই সেখানে! নদীর এদিকে ব্যাটারি পার্ক, অন্যদিকে জার্সি সিটির নতুন কাঁচে ঢাকা আলোয় ঝলমল হাই রাইজগুলো। ওই টেরাসে বসেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো যায়।

.

ডাইনিং রুমটাও খুব বড়। যে টেবিলটা সেখানে পাতা, সেখানে গোটা বারো চেয়ার সাজানো আছে দেখলাম। কিন্তু হাত পা ছড়িয়ে জনা কুড়ি গেস্ট সেখানে বসতে পারে। পাশেই প্রশস্ত কিচেন। সাদা কোট পরা একজন রান্না করতে ব্যস্ত, মাথায় শেফের ক্যাপ। কিচেনের লাগোয়া একটা প্যানট্রি আর তার পাশে বোধহয় হাবিজাবি জিনিসপত্র রাখার স্টোর রুম। সেটা বন্ধ।

ডাইনিং রুমের একদিকে মোটা কাঁচের দেয়াল। তার মাঝখানে বিশাল স্লাইডিং দরজা, টেরাস গার্ডেনে যাওয়ার জন্য।

এত বিশাল বাড়ি, অথচ থাকেন মাত্র ওঁরা দু’জন! একমাত্র মেয়ে বল্লরী ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, বাড়িতে আসে শুধু কোয়ার্টার ব্রেকে। আন্টির কথাবার্তা শুনে যা মনে হল রাতেও ওঁরা একাই থাকেন থাকেন, কোনও গার্ড বা হেল্প থাকে না। দিনের বেলায় একজন কুক আর একটি হাউসকিপার আসে। আন্টির বাগানের শখ বলে একজন গার্ডনার মাঝেমাঝে এসে টেরাস গার্ডেন তদারক করে যায়। একটা ছোট্ট গ্লাস-হাউসও ওখানে আছে। নিশ্চয় টেম্পারেচার কনট্রোলড… নইলে কি আর শীতকালে গাছ পালা বাঁচবে?

আন্টি বললেন, কয়েকটা গোলাপি আর হলুদ লেডিজ স্লিপার অর্কিড ফুটেছে গ্লাসহাউসে। সেটা শুনে একেনবাবু সুপার এক্সাইটেড। একেনবাবুর ওই অবস্থা দেখে আন্টি প্রীতমকে বললেন, একেনবাবুকে গ্লাসহাউসটা দেখিয়ে দিতে। প্রীতম ওঁকে নিয়ে গেল। অর্কিডে আমার এ্যালার্জি নেই, কিন্তু একেনবাবুর মতো ওরকম উৎসাহও নেই। আমি আন্টির সঙ্গে ডাইনিং রুমে বসে গল্প করতে লাগলাম। এমন সময়ে আঙ্কল ঘরে ঢুকলেন।

আন্টি পরিচয় করিয়ে দিতেই বললেন, “আমি একটা ফোন এক্সপেক্ট করছি। চলো, অফিস-ঘরে তোমার সঙ্গে কথা বলি।”

“তোমরা যাও, আমি লাঞ্চের ব্যাপারটা একটু দেখি।” বলে আন্টিও উঠে গেলেন।

.

আঙ্কলের অফিস-ঘর বেডরুমগুলোর তুলনায় ছোটো, কিন্তু লোকেশনটা চমৎকার — একেবারে কর্নারে। দুটো দেয়াল পুরো কাঁচের। উলটো দিকের দুই দেয়ালে দুটো দরজা, একটা হলে যাবার, অন্যটা মনে হয় বাথরুমের। এক্সিকিউটিভ অফিস ডেস্কটা ওই দুটো দেয়ালে কোনাকুনি এমন ভাবে বসানো যে পেছনে চেয়ার বসেই হাডসন নদী পরিষ্কার দেখা যায়। ডেস্কের সামনে দুটো চেয়ারের একটাতে বসলাম। ডেস্কে কাগজপত্রের জঞ্জাল ঘাঁটতে ঘাঁটিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আছি?

এ ধরণের প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না। তবে বুঝলাম আমরা কে কী করি, এ ব্যাপারে খোঁজখবর কিছু নিয়েছেন। আমি উত্তরে বলার চেষ্টা করলাম, পড়াতে আমার ভালো লাগে।

তখন জিজ্ঞেস করলেন, আগে অন্য কিছু করেছি কি না।

যখন বললাম ‘না’, তখন বললেন তাহলে সেটা যে আরও ভালো লাগবে না, কী ভাবে বুঝলাম? তারপর একটা লেকচার ঝাড়লেন। যার সার কথা, অ্যাডভেঞ্চারাস না হলে পৃথিবীতে কিছু পাওয়া যায় না। ভাগ্যিস প্রমথ সঙ্গে ছিল না। সঙ্গে থাকলে পাওয়া যায় না’ বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন… সেই নিয়ে সাত রকম তর্ক জুড়ত। ফলে বিচ্ছিরি ভাবে ব্যাপারটা শেষ হত। আমি ‘রা’ কাড়লাম না বলেই বোধহয় আমার ওপর একটু করুণা হল। বললেন, “না, তোমাদের মতো ভালো শিক্ষকের প্রয়োজন আছে। মানুষ তো তোমরাই গড়বে। কিন্তু কিপ ইওর মাইন্ড ওপন, অপরচুনিটি একবারই আসে জীবনে।”

ঠিক কী অপরচুনিটি সেটা অবশ্য পরিষ্কার হল না। এরপর যতক্ষণ ওঁর ঘরে ছিলাম, নিজের জীবনের কথাই বললেন। কী ভাবে বিজনেসটা বড় করে তুলেছেন, কোম্পানিকে ডাইভার্সিফাই করতে কত রিস্ক নিতে হয়েছে, কাট-থ্রোট কম্পিটিশনের ভয়ে পিছিয়ে যাননি, ইত্যাদি। কিন্তু রিস্ক নিয়েছেন বলে রিওয়ার্ডও এসেছে। আধঘণ্টা বাদে আন্টি যখন খেতে ডাকলেন, তখন পিঠটা চাপড়ে বললেন, “উই আর ডুইং গড’স ওয়ার্ক, কিপ ইট আপ!” অর্থাৎ একেবারে ১৮০ ডিগ্রি উলটো!

.

এই অদ্ভুত আচরণের কারণটা পরে প্রীতমের কাছে জেনেছিলাম। ওঁর একমাত্র ছেলে বাপের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও বিজনেসে না ঢুকে মিউজিক নিয়ে পড়াশুনো করে স্কুলের টিচার হয়েছিল। ভালো বেহালা বাজাত। পরে কোনও দুর্ঘটনায় মারা যায়। সেটা শুনে আর একটা ব্যাপার ক্লিয়ার হল। আঙ্কলের অফিস ঘরে একটা শো-কেসে বেশ কয়েকটা জিনিস চোখে পড়েছিল। এখন বুঝলাম সেগুলো পরলোকগত ছেলের স্মৃতি চিহ্ন। কয়েকটা তারের যন্ত্র। ছোটোটা বেহালা, অন্য দুটো একটু বড় সাইজের। একটা তো মনে হল ভায়োলা, আরেকটা নিশ্চয় চেলো– একটা এন্ড পিনের ওপর দাঁড় করানো। উনি আমাকে বসিয়ে রেখে কয়েক মিনিটের জন্যে বাথরুমে গিয়েছিলেন। তখন উঠে শো কেসটা ভালো করে দেখছিলাম। শেষ প্রান্তে একটা ভেলভেটের বাক্স, নিশ্চয়ই দামি কিছু আছে সেখানে। আর একবারে শেষে আরেকটা বেশ পুরোনো বেহালা। শো-কেসে কোনও লক নেই। তবে জিনিসগুলো সিকিওরড, একটা সিকিউরিটি ক্যামেরা দেখলাম ওদিকে তাক করে আছে। হয়তো একাধিক ক্যামেরা নানান দিকে লুকিয়ে আছে, বড়ো লোকদের ব্যাপার।

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত