৩.

সোমবার কলেজে গেছি। ওডিন এসে বলল, “রবিবার ফোন করে ডিস্টার্ব করতে চাইনি, কিন্তু যে কাজটা দিয়ে গিয়েছিলে, সেটাতে এক জায়গায় আটকে গেছি, শেষ করতে পারিনি।”

একটা রেফারেন্স। আমারই দোষ, ভুল তারিখ দিয়েছি বলে বেচারা আর খুঁজে পায়নি।

“ফোন করলেই পারতে। আমি তো লাঞ্চ খেতে গিয়েছিলাম।”

“তা হোক, মিস্টার সিং তো খুব বিখ্যাত লোক, আমি সাহস পাইনি ওখানে ফোন করতে।”

“তুমি কি চেন ওঁদের?”

“না, না, চিনি না। তবে আমার চেনা জানা অনেকে কাজ করতেন এঁদের কোম্পানিতে। তাঁদের কাছে ওঁর কথা শুনেছি।”

“তোমার চেনা জানা লোক.. এখানকার কেউ?”

“না, আফ্রিকার।”

একটু অবাক হলাম। আমি ওডিনকে ব্ল্যাক আমেরিকান বলেই জানি। এখানেই জন্ম, এখানেই বড় হয়েছে। মিডওয়েস্টার্ন অ্যাকসেন্টে কথা বলে। হয়তো সেকেন্ড জেনারেশন।

“আফ্রিকার? আঙ্কল তো সারাজীবন আফ্রিকাতেই ছিলেন, উনি নিশ্চয় চিনবেন। প্রীতমের কাছে শুনেছি, কোম্পানির অনেক লোককেই পার্সোনালি চেনেন।”

ওডিন হাসল, “হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে ওঁদের কোম্পানিতে।”

“তা ঠিক। কিন্তু ওডিন, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি এদেশের ছেলে, তোমার সঙ্গে আফ্রিকার এত কানেকশন হল কী করে? কবে তোমার বাবা-মা এদেশে এসেছেন?”

“সে অনেক বছর।” মনে হল উত্তরটা একটু এড়াতেই চাচ্ছে। ব্যাক্তিগত ব্যাপার, আমিও আর বেশি প্রশ্ন করলাম না। এদেশে প্রাইভেসিটা সবাই মেনে চলে।

.

সামার শেষ হতে মাত্র সপ্তাহ তিনেক বাকি। অফিসে ঢুকে দেখলাম, ডেস্ক-এ একটা

নোট…

May I get a three-week break to find my roots?
Best, OS.

নোটটা ওডিনের। সবসময় OS লেখে। ওডিন আর সেকো-র প্রথম দুটো অক্ষর। যাঁরা Best’ দেখে অবাক হচ্ছেন, তাঁদের বলি, এদেশে অনেকেই ‘With best wishes’ না লিখে সংক্ষেপে ‘Best’ লেখে।

বেভকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার?” বেভ আমাদের অফিস অ্যাসিস্টেন্ট, ভালো বন্ধুও।

“ওর কী একটা জানি জরুরী কাজ, সারাদিন বাইরে বাইরে কাটাবে, তাই নোটটা লিখে রেখে গেছে।”

“Find my roots!’…আমার তো মনে হচ্ছে অ্যালেক্স হেইলির কুন্তা কান্তের কথা… নিজের পূর্ব পুরুষকে খুঁজতে যাওয়ার মতো কোনও ব্যাপার…”

একটা ফোন আসাতে বেভ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমার কথাটা ঠিক ধরতে পারল কিনা কে জানে!

অ্যালেক্স হেইলির বইটার কথা অনেকে নাও জানতে পারেন। আমি নিজেই জানতাম না। বইটার কথা প্রথম শুনেছিলাম দিনুকাকার কাছে, যিনি প্রায় চার-পাঁচ দশক ধরে এদেশে আছেন। সাতের দশকে অ্যালেক্স হেইলির Roots: The Saga of An American Family বইটা একটা আলোড়ন তুলেছিল। মার্কিন মুলুকের বেশির ভাগ কালো বা ব্ল্যাক লোকদের পূর্বপুরুষরা এসেছিল কৃতদাস হিসেবে। বইটা ছিল লেখকের পূর্বপুরুষকে খোঁজার কাহিনি। এ নিয়ে বড় একটা টেলিভিশন সিরিজও হয়েছিল। আফ্রিকান-আমেরিকান জিনিওলজি নিয়ে তখনই প্রথম একটা আগ্রহের শুরু, ঝড়ের বেগে সেটা তুঙ্গে ওঠে। তারপর যা হয়, ধীরে ধীরে সেই আগ্রহ স্তিমিত। ওডিনের নোট পড়ে মনে হল আগ্রহ স্তিমিত হলেও লুপ্ত হয়নি।

আমার কাজ মোটামুটি ভালোই এগিয়ে রেখেছে ওডিন। তিন সপ্তাহ ছুটি নিলে অসুবিধার কোনও কারণ নেই। ফিরে এসে কয়েক ঘণ্টা এক্সট্রা কাজ করলেই রিপোর্টের ডেডলাইন মিস হবে না।

বিকেলে ফিরে এসে ওডিন জানাল, একটা দরকারি কাজে ওকে বাইরে যেতে হবে। ইমেল-এ যোগাযোগ করা যাবে, কিন্তু ফোনে পাওয়া যাবে না।

“টু ফাইন্ড ইওর রু?” ওর নোট থেকেই লাইনটা বলে ওর দিকে তাকালাম।

চাইলে উত্তর দিতে পারত, কিন্তু দিল না। শুধু একটু হাসল। কেন জানি না মনে হল একটু বিষণ্ণ। এ নিয়ে আর প্রশ্ন করা উচিত নয়। শুধু জিজ্ঞেস করলাম, “সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো?”

“হ্যাঁ।”

বললাম, “ও-কে, হ্যাভ এ নাইস ট্রিপ।”

ফিরল সপ্তাহ তিনেক বাদেই, কিন্তু দেখি বেশ মনমরা। কী হয়েছে দুয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম। প্রতিবারই ওর উত্তর, ‘আই উইল বি ওকে।’

বারবার একই প্রশ্ন করা যায় না। প্রেম-ঘটিত কিছু হতে পারে। ধীরে ধীরে কথাবার্তা বলা কমাল… সব সময়েই অন্যমনস্ক। আমি ডাক্তার নই, তবে বুঝতে পারছি ডিপ্রেশনে ভুগছে।

.

বেভ ডিপার্টমেন্টের সবার হাঁড়ির খবর রাখে। ওর আকর্ষণীয় চেহারা আর ফ্লার্টি পার্সোনালিটির জন্যে অনেকেই সঙ্গ পেতে ওর কাছে আসে, হৃদয় উজার করে দেয়। বেভও ওডিন সম্পর্কে কু-লেস। একদিন ওডিন যখন ঘরে নেই, বেভ এসে বলল “ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে হেলথ সেন্টারে পাঠাও। ওকে ডাক্তার দেখানো দরকার।”

আমি উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাকে কিছু বলেছে?”

“না, বাট আই নো।”

হাউ ডু ইউ নো, জিজ্ঞেস করতে পারতাম, কিন্তু আমি নিজেও তো একই কথা ভাবছিলাম।

বেভ ইজ রাইট। সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হবে। ওডিন প্রথমে কথাটা কানেই তুলছিল না। শেষে প্রায় জোর করে ওকে ইউনিভার্সিটি হেলথ সেন্টারে পাঠালাম।

.

এদেশে ডাক্তাররা পেশেন্টদের সম্পর্কে বাইরের কাউকে কিছু বলে না। আমার এক বিশেষ পরিচিত সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টে রেসিডেন্সি শেষ করে হেলথ সেন্টারে পার্ট-টাইম ডাক্তার হিসেবে কাজ শুরু করছে। ওর কাছ থেকেও কিছু আদায় করতে পারলাম না। শুধু এটুকুই জানলাম, ওডিনের মনের মধ্যে বিস্তর জট, ডাক্তাররাও খানিকটা অন্ধকারে। তবে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খাচ্ছে।

ওষুধ কী দিয়েছে জানি না, তাতে কিছুটা ফল মনে হয় হচ্ছে। ইদানীং আবার একটু একটু কথাবার্তা শুরু করেছে। কাজকর্ম আগের মতো করতে না পারলেও পারছে।

এর মধ্যে একদিন একেনবাবু আর আমি অফিসে বসে গল্প করছি, একটু বাদে লাঞ্চে যাব। ওডিনের আজ অফ ডে, নইলে অনেক সময় ওকেও পাকড়াও করে নিয়ে যাই। হঠাৎ বেভ ঘরে ঢুকে বলল, “তোমরা জানো, ওডিন অ্যাডপ্টেড?”

বেভ মাঝে মাঝে এরকম চমক-দেওয়া খবর আনে।

“তুমি কী করে জানলে?” জিজ্ঞেস করলাম।

“ওর বাবা মিস্টার জনসন কালকে এসেছিলেন ওর খোঁজে?”

“মিস্টার জনসন?” আমি বিস্মিত চোখে বেভের দিকে তাকালাম।

“হ্যাঁ, হি ইজ হোয়াইট। সেকো’ পদবী ওডিন নিজের থেকে নিয়েছে।”

এবার বুঝলাম।

“আমার ধারণা ওডিন আফ্রিকা গিয়েছিল ওর বায়োলজিক্যাল পেরেন্টদের খোঁজে।”

আগেই বলেছি হ্যাঁনো খবর নেই বেভ রাখে না।

তাও আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কী করে জানলে?”

“মিস্টার জনসনই বলছিলেন। কয়েক বছর আগে… ওঁর স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে ওডিন মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করত, ওর বায়োলজিক্যাল বাবা-মা সম্পর্কে উনি কী জানেন? উনি সত্যিই খুব ডিটেন্স জানতেন না… জানতেন সেকো ছিল ওডিনের বাবার পদবী। যখন খুব ছোটো তখনই ওর বাবা-মা একটা বাজে ক্যানসার মেসোথেলিওমা-তে মারা গিয়েছিল। যে কাকা দেখভাল করেছিল, তারও ক্যানসার ধরে পড়ে। বলতে গেলে ও পাঁচ বছর বয়স থেকেই একেবারেই অনাথ। একটা অনাথ আশ্রম থেকে মিস্টার আর মিসেস জনসন ওকে আমেরিকা নিয়ে আসেন।”

“তা বুঝলাম, কিন্তু আফ্রিকা গেছে, সে খবরটা পেলে কোত্থেকে?”

“মিস্টার জনসনই বললেন। ওঁর এক বন্ধুর ল্যাবে ওডিন কিছুদিন কাজ করেছিল। এই বন্ধু বহুদিন নাইরোবিতে ছিলেন, ওডিনের পুরো হিস্ট্রি জানতেন। তাঁর সঙ্গে নাকি এ নিয়ে ওডিনের অনেক আলোচনা হয়েছে। তিনিই নাকি সেই অনাথ আশ্রমের সঙ্গে ওডিনের যোগাযোগ করিয়ে দেন। মিস্টার জনসন এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না, এই কিছুদিন হল জেনেছেন। ওডিন যে ওর পদবি পালটেছে, সেটাও একই সময় জেনেছেন।”

কথা শেষ করতে না করতেই বেভের ফোন বাজল, সেটা ধরতে আবার ছুটল।

আশ্চর্য! ওর রেসিউমিতে নিশ্চয় এগুলোর উল্লেখ আছে, আমি খেয়ালও করিনি। ফাইল ক্যাবিনেট থেকে ওর রেসিউমিটা বার করে চোখ বোলালাম। একেনবাবুও আগ্রহ নিয়ে দেখলেন।

“ঠিকই বলেছেন বেভ ম্যাডাম, এই তো এখানেই আছে নাম বদলানোর সার্টিফিকেট। এনারজেটিক্স ল্যাবে কাজ করার সময়। টাইমিংটাও মিলছে।”

.

সত্যি কথা বলতে কি, এই স্টুডেন্ট অ্যাসিস্টেন্টদের ব্যাপারে আমি তেমন মাথা আমি ঘামাই না। ডিপার্টমেন্ট যাকে পাঠায় তাকেই নিয়ে নিই। ভালো করে ওডিনের রেসিউমিও দেখিনি।

“আফ্রিকায় যাওয়ার ব্যাপারটা আমারও মনে হয়েছিল,” একেনবাবুকে বললাম, “কিন্তু অন্য একটা জিনিস ভেবে।”

“বুঝলাম না স্যার, তার মানে?”

“আমাকে একটা নোট লিখেছিল।”

“কী নোট স্যার?”

“এখানেই আছে সেটা।”

ডেস্ক ড্রয়ারের মধ্যে ওডিনের নোটটা ছিল। বার করে একেনবাবুর হাতে দিলাম।

নোটটা পড়ে একেনবাবু বললেন, “এইজন্যেই স্যার, মিস্টার ওডিনকে ভালো লাগে। কোনও লুকোছাপা নেই। সরাসরি লেখেন। নিজের রুক্স খুঁজতেই তো গিয়েছিলেন।”

“তা ঠিক, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম অ্যালেক্স হেইলির কথা… দেড়শো দুশো বছর আগের পূর্বপুরুষকে খুঁজতে যাওয়া… ক্রীতদাস হিসেবে যাঁদের আনা হয়েছিল। পঁচিশ তিরিশ বছর আগের কথা ভাবিনি।”

“সে তো স্যার মিস্টার ওডিনের দোষ নয়, আপনার বোঝার দোষ।” হাসিহাসি মুখে একেনবাবু বললেন।

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত