।। ৬ ।।

বারুইপুরে পৌঁছে একটু ঘোরাঘুরির পর গন্তব্যস্থল খুঁজে পেলাম। একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত কলোনির ছোট্ট বাড়ি। বয়স্ক এক ভদ্রলোক বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন।

আমাদের দেখে পত্রিকাটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা?”

একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, আপনাদের একটু বিরক্ত করতে এসেছি। এটাই কি মিস শর্মিলার বাড়ি?”

শর্মিলার নামটা শুনে ভদ্রলোকের মুখটা কী রকম জানি হয়ে গেল। বললেন, “ছিল, কিন্তু সে তো আর বেঁচে নেই।”

“জানি স্যার। তাঁর খুনিকে ধরবার জন্যেই আমরা চেষ্টা করছি।”

“আপনারা কি পুলিশ?”

“না স্যার।”

“পত্রিকার লোক?”

“তাও না স্যার।”

“তাহলে!” ভদ্রলোকের চোখে বিস্ময় ও বিরক্তি।

আমি তখন এগিয়ে গিয়ে একেনবাবুর পরিচয় দিলাম। একটু ফলাও করেই দিলাম।

ভদ্রলোক চুপ করে শুনলেন।

“আমি শর্মিলার দাদু।”

একেনবাবু বললেন, “আমাদের দুয়েকটা প্রশ্ন ছিল স্যার, মিস শর্মিলা সম্পর্কে।”

“দেখুন, প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি। আমার মেয়ে এ নিয়ে আর কারোর সঙ্গে কথা বলছে না।”

“বুঝতে পারছি স্যার আপনাদের বেদনার কথা। কিন্তু শুধু দু-একটা প্রশ্নই করব।”

ভদ্রলোক পত্রিকাটা পাশে সরিয়ে রাখলেন। “বেশ, করুন।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আচ্ছা এই খুনের ব্যাপারে আপনাদের কাউকে সন্দেহ হয়?”

“না। আমার দিদিভাইয়ের কোনো শত্রু থাকতে পারে আমি কল্পনাও করতে পারি না।”

“কলকাতার মিস শর্মিলার বন্ধুবান্ধবদের কাউকে চেনেন?”

“না, তেমন কারও কথা তো আমরা শুনিনি।”

“মিস নন্দিতার কথা?”

“নন্দিতা, নন্দিতা..” একটু ভাবলেন ভদ্রলোক। “একজন নন্দিতা তো খুন হয়েছে কিছুদিন আগে, তার কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“না, তার কথা দিদিভাইয়ের কাছ থেকে শুনিনি। আপনি কি ভাবছেন ওদের মৃত্যুর মধ্যে কোনো যোগ আছে?”

“জানি না স্যার। তবে আর একটা অনুরোধ করছি, মিস শর্মিলার কোনো ফোটো আছে কি আপনাদের কাছে?”

“আছে। কিন্তু দিতে পারব না।”

“আমাদের দিতে হবে না স্যার, শুধু ছবিটা একটু দেখতে চাই।”

“বাইরের ঘরেই আছে। দরজা দিয়েই দেখতে পারবেন।” ভদ্রলোক দরজার দিকে আঙুল দেখালেন।

দরজা খোলাই ছিল। দরজার উলটোদিকের দেওয়ালে ঝুলছে মালা দেওয়া একটা ফোটো। কী আশ্চর্য এরকম ফোটো তো আগেও দেখেছি!

“অনেকটা নন্দিতার মতো চেহারা না?”প্রমথ চাপাস্বরে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল।

“অথবা ফেসবুকে বীর রায়ের সঙ্গে যে মেয়েটা, তার ছবি!” আমিও গলা নীচু করে বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাটা বললাম।

একেনবাবু দেখছি মাথা চুলকাচ্ছেন। “ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।”

তারপর বৃদ্ধ ভদ্রলোককে বললেন, “আর বিরক্ত করব না স্যার, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”

ভদ্রলোক কিছু বললেন না। মুখের ভাবটা যেন আরেকটা আপদ বিদায় হল!

গাড়িতে উঠতে উঠতে প্রমথ বলল, “মনে হচ্ছে উই আর ফেসিং এ ডেঞ্জারাস সিরিয়াল কিলার! আপনার কী মনে হয় একেনবাবু?”

“সেই কিলার কি বীর রায় হতে পারে?” আমি প্রশ্ন তুললাম।

যাকে প্রশ্নটা করা সারাটা পথ তিনি একটা কথা বললেন না।

“দুত্তোর” বলে আমরা অন্য গল্প করতে লাগলাম।

গল্প করতে করতে যখন গোলপার্কে এসে পৌঁছেছি, একেনবাবু হঠাৎ বললেন, “চলুন স্যার, মিলনী কাফেতে মোগলাই খাই।”

“খাই মানে কি? খাবেন না খাওয়াবেন?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

“দুটোই স্যার।”

“কী ব্যাপার বলুন তো? এই তো সেদিন খাওয়ালেন!”

“কেন স্যার, আমি কি আপনাদের দু’দিন খাওয়াতে পারি না?”

“তা অবশ্যই পারেন, কিন্তু সেটা আপনার ক্যারেক্টারের সঙ্গে খাপ খায় না।”

“তুই চুপ কর তো!” আমি প্রমথকে ধমক লাগালাম। তারপর একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম। “কবে যেতে চান?”

“এখনি।”

“এখনি মানে! বউদি?”

“ফ্যামিলি গেছে দিদির বাড়িতে, খেয়েদেয়ে রাত্রে ফিরবে।”

“বুঝতে পারছি আপনার বাড়িতে খাবার নেই, কিন্তু একা গেলে তো খরচা কম পড়বে!” প্রমথ টিপ্পনি কাটল।

“একসঙ্গে খাবার আনন্দ তো পাব না স্যার!” এইরকম উতোর-চাপান চলতে চলতে আমরা মিলনী কাফেতে পৌঁছে গেলাম।

আমাদের দেখে মৃত্যুঞ্জয়বাবু কাউন্টার থেকে উঠে এসে বললেন, “আমার সৌভাগ্য আবার আপনারা এলেন!”

“কী যে বলেন স্যার, মোগলাইয়ের স্বাদ যা পেলাম, ওটা কি একবার খেয়ে মন ভরে!”

“বেশ, আর কী খাবেন বলুন?”

“স্রেফ চা আর মোগলাই।” প্রমথই আগ বাড়িয়ে অর্ডার দিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বেশি খসাতে চাই না একেনবাবুকে।”

“কী মুশকিল স্যার, আরেকটা কিছু নিন!”

“আমি নেব না, বাপি তুই?”

“আমিও না।”

“তাহলে সবার জন্যে তাই হোক স্যার। ভালো কথা স্যার, আপনার ভাই মনোজবাবুর একটু সাহায্য লাগবে। ওঁর নম্বরটা আছে আপনার কাছে?”

“নিশ্চয়, দাঁড়ান আমি লিখে দিচ্ছি।”

একটা কাগজে নম্বরটা লিখে আমাদের চা আর মোগলাই পরোটার অর্ডার নিয়ে মত্যুঞ্জয়বাবু চলে গেলেন।

একেনবাবু দেখলাম চারিদিকে তাকাচ্ছেন।

“কাকে খুঁজছেন?”

“আপনার সেই রতনকে তো স্যার দেখছি না।”

“ছুটিতে নিশ্চয়।”

“তাই হবে।”

খানিকবাদে যে ছেলেটি আমাদের খাবার দিতে এল, সেই বোধ হয় হরি।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “রতন কোথায়?”

চারিদিকে তাকিয়ে একটু চাপা গলায় বলল, “রতনকে বাবু তাড়িয়ে দিয়েছেন?”

“সে কী! কাজে ফাঁকি দিচ্ছিল?”

ছেলেটি কোনো উত্তর দিল না।

“ও কী করছে এখন জানো?”

“না। তবে ফটিকদা বলতে পারবে, ওর দোকানে আসে।”

ফটিকের দোকান আমি চিনি। পাশের রাস্তায় একটু দূরে একটা পানের দোকান ছিল ফটিকের। এখনও যে দোকানটা আছে জানতাম না।

খেয়ে দেয়ে একেনবাবু বললেন, “চলুন স্যার, একবার ওই ফটিকবাবুর দোকানে যাওয়া যাক।”

“কী ব্যাপার! রতনের এত খোঁজ কেন?”

একেনবাবু উত্তর দিলেন না।

.

আমাদের ভাগ্য বলতে হবে। ফটিকের দোকানে গিয়ে দেখি রতন বাইরের টুলে বসে আছে।

“কী রে তোকে নাকি মৃত্যুঞ্জয়বাবু তাড়িয়ে দিয়েছেন! কী করেছিলি?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

আমাদের বিশেষ করে একেনবাবুকে দেখে রতনের মুখ সাদা হয়ে গেছে। ভীতভাবে একেনবাবুকে বলল, “বাবু আপনাকে কী বলেছেন জানি না, আমি কিন্তু চুরি করিনি বাবু।”

একেনবাবু সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “একটা কাজ করতে পারবে?”

“পারব বাবু, যা করতে বলবেন তা-ই করব।”

“ছেলেটা ভালো,” ফটিক রতনের হয়ে ওকালতি করল।” কেউ ওকে ফাঁসিয়েছে!”

“তাহলে এসো,” বলে একটু দূরে গিয়ে রতনকে কিছু একটা দেখালেন, একেনবাবু।

আমরাও যাচ্ছিলাম কী বলছেন শুনতে, কিন্তু ফটিক আটকাল, “আপনাদের জন্যে একটা ইস্পেশাল পান বানাচ্ছি। দারুন মশলা, খেয়ে দেখুন।”

ফটিকের পান এমনিতেই দুর্ধর্ষ। তার ওপর ইস্পেশাল মশলা! আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম।

সেখান থেকেই একেনবাবু কথা অস্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

“এরকম চেহারা?”

রতন দেখলাম মাথা নাড়ছে।

“কোথায় থাকে?”

মাথা নাড়া দেখে মনে হল জানে না।

আরও কিছু প্রশ্ন করলেন একেনবাবু। প্রশ্নগুলো শুনতে পেলাম না। মাথা নাড়া দেখে মনে হল দুয়েকবার ‘হ্যাঁ’ বলছে, কিন্তু বেশির ভাগ উত্তরই মনে হল রতনের জানা নেই।

ফেরার পথে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী দেখালেন রতনকে?”

“মিস নন্দিতার ছবি।”

“কী বলল?”

“বলল, আরও একটা মেয়েকে দেখেছে, ওই ধরণের চেহারার।”

“হয়তো শর্মিলার কথা বলছে।” প্রমথ বলল।

“অথবা অন্য কোনো মেয়ে,” একেনবাবু বললেন। “আজকাল স্যার সাজাগোজের জন্যে অনেকের মধ্যেই মিল খুঁজে পাওয়া যায়।”

“বীর রায়ের সেই মেয়েটা হতে পারে কি?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“কিছুই অসম্ভব নয় স্যার।”

“কী করে হয়? আমরা তো সবার ছবিই দেখলাম কালকে।”

“হয়তো সবার ছবি দেখিনি স্যার।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং। মিস শর্মিলার ছবি অ্যাপ্লিকেশন থেকে খুলে নেওয়া হয়েছিল সেটা তো দেখেছি। আপনি কি মনে করেন, এই মেয়েটির অ্যাপ্লিকেশনের পুরো ফর্মটাই ফোল্ডার থেকে কেউ সরিয়ে রেখেছিল!”

প্রমথ সোজাসুজি বলল, “কোচিং ক্লাসের মালিক ওই ধ্রুব দত্তকে আমার মোটেই পছন্দ নয়। ওর মধ্যে কিছু গোলমাল আছে। আই থিঙ্ক এ ব্যাপারে হি ইজ ইনভলভড।”

একেনবাবু শুধু বললেন, “এ মেয়ে যদি অন্য কেউ হয়, তাহলে আমাদের মেয়েটিকে খুঁজে বার করতে হবে স্যার।”

আমি বললাম, “সিরিয়াল কিলার যদি এই চেহারার মেয়েদের ধরে ধরে খুন করে, তাহলে তো শি ইজ ইন ডেঞ্জার!”

“সেটাই ঠেকাতে হবে স্যার।”

“কী করে?”

“ভাবার চেষ্টা করছি স্যার।”

“আপনি ভাবুন, আমি চললাম,” প্রমথ বলল। “সেই সকাল থেকে দৌড়াদৌড়ি! নিউ ইয়র্ক যাবার আগে এক গন্ডা জিনিস কিনতে হবে, ফালতু সময় নষ্ট হচ্ছে!” প্রমথ কখন ক্ষেপে যায় প্রেডিক্ট করা কঠিন।

আমার অপেক্ষা না করেই একটা ট্যাক্সি ধরে প্রমথ অদৃশ্য হল।

“আপনি কোথায় যাবেন, বাড়ি?” একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম।

“না স্যার, ফ্যামিলির ফিরতে এখনও দেরি। অধীর তো কাছেই থাকে, ওকে এই ব্যাপারটা জানিয়ে আসি। যদি মেয়েটার কোনো হদিশ করতে পারে।”

“চলুন, পৌঁছে দিই।”

“আরে না স্যার, এই তো কাছেই –হেঁটেই যাব।”

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত