।। ৭ ।।

প্রমথর মতো আমারও বেশ কিছু কেনাকাটা ছিল। দু’টো দিন সেইসব জিনিস খুঁজে খুঁজে কিনতেই কাটল। এরমধ্যে একেনবাবু বা প্রমথ কারোর সঙ্গেই কথা হয়নি। একেনবাবুকে কয়েকবার ধরার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সব সময়েই ওঁর ফোন বিজি। শেষমেশ ধরতে পারলাম।

“কী ব্যাপার, আপনাকে তো ধরতেই পারা যায় না আজকাল!”

“কী যে বলেন স্যার আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।”

“কেন বলুন তো?”

“বিকেলে কয়েকজনকে আসতে বলেছি মিস নন্দিতার ব্যাপারে। আপনি প্রমথবাবুকে নিয়ে আসুন স্যার কেসটা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাবে।”

“আলোচনা মানে? রহস্যের কিনারা করে ফেলেছেন না কি?”

“একটু প্রোগ্রেস তো হয়েছে। কিন্তু কনফিউশনও কিছু আছে। সবার সাহায্য নিয়ে যদি ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে ফেলা যায়।”

“ঠিক আছে আসব। দেখি, প্রমথকে ধরতে পারি কি না।”

“কোথায় আসবেন, সেটা তো বলিনি স্যার।”

“কোথায়?”

“মিলনী কাফের ওপরে স্পোকেন ইংলিশ স্কুলে স্যার।”

“স্পোকেন ইংলিশ স্কুল!”

“হ্যাঁ স্যার, ওখানে অনেককে ডেকেছি। অধীরবাবুও থাকবেন।”

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন দেখি, একেনবাবু আর অধীরবাবু মিলনী কাফের সামনে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে কী জানি আলোচনা করছেন। সামনে আসতেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে চিনতে পারলাম শর্মিলার সেই দাদু! আমাদের দেখে একেনবাবু কথাবার্তা থামিয়ে বললেন, “চলুন স্যার, ওপরে যাওয়া যাক।”

ওপরে যাবার সিঁড়ি মিলনী কাফের পাশ দিয়ে। উঠে ল্যান্ডিং-এর ডানদিকে একটা মিটিং রুম। ইতিমধ্যেই সেখানে শুভেন্দু, মনোজবাবু, মৃত্যুঞ্জয়বাবু, ধ্রুব দত্ত এবং একজন অপরিচিত ভদ্রলোক বসে আছেন। রতনকেও দেখলাম বসে আছে একটা টুলের ওপর।

অধীরবাবু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মিস নন্দিতার মৃত্যুর খুনের ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত গোয়েন্দা একেনবাবুকে আমি অনুরোধ করেছি। তিনি এ ব্যাপারে কতগুলো প্রশ্ন আপনাদের করতে চান। সেইজন্যেই আপনাদের এখানে ডাকা হয়েছে।”

একেনবাবু কোনো ভনিতা না করেই শুরু করলেন, “দিন দশেক আগে মনোজবাবুর কাছে খবর পেয়ে শুভেন্দুবাবু আমার কাছে এসেছিলেন তাঁর বোন মিস নন্দিতার খুনিকে খুঁজে বার করতে।” এইটুকু বলে শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক কি না স্যার?”

শুভেন্দু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

“শুভেন্দুবাবু আমাকে বলেছিলেন, মিস নন্দিতার খোঁজ করতে উনি প্রথমে মিস নন্দিতার বিশেষ পরিচিত সমুদা মানে সমুবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। শুভেন্দুবাবু কি আমাকে ঠিক বলেছিলেন স্যার?”

অপরিচিত মাঝবয়সি যে ভদ্রলোক বসে ছিলেন তাঁকে উদ্দেশ্য করে একেনবাবু প্রশ্নটা করলেন। বুঝলাম উনিই হচ্ছেন সমুবাবু।

সমুবাবু মনে হল প্রশ্নটা শুনে একটু অস্বস্তি বোধ করছেন, কিন্তু ‘হ্যাঁ’ বলে মাথা নাড়লেন।

“তারপর আপনি আর শুভেন্দুবাবু মিস নন্দিতার ঘরে ঢুকে ওঁর মৃতদেহ আবিষ্কার করলেন। অর্থাৎ এর আগে স্যার আপনি জানতেন না যে মিস নন্দিতা মারা গেছেন। এটা কি ঠিক?”

সমুবাবু মাথা নাড়লেন।

“মনে হয় আপনি ঠিকই বলছেন স্যার, কারণ কোনো একটা কারণে মারা যাবার কয়েকদিন আগে থেকে মিস নন্দিতার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল না। কারণটা একটু বলবেন স্যার?”

সমুবাবুর মুখটা দেখলাম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চেয়ারের হাতলের ওপর রাখা হাতটা নার্ভাসনেসে একটু একটু কাঁপছে।

“ঠিক আছে স্যার, সে নিয়ে পরে আলোচনা হবে– অধীরবাবুই সেটা করবেন।”

এই কথায় সমুবাবু দেখলাম হাতলটা চেপে ধরে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছেন। একেনবাবু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে স্পোকেন ইংলিশ অ্যাকাডেমির মালিক ধ্রুব দত্তকে নিয়ে পড়লেন, “মিস নন্দিতা তো আপনাদের এখানে পড়তেন ধ্রুববাবু, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি কি ওঁকে ভালো করে চিনতেন স্যার?”

“হ্যাঁ, এখানে যারা পড়ে তাদের যেমন করে চিনি, সেরকমভাবেই চিনতাম।”

“আই সি। এখানে যাঁরা পড়েন স্যার, তাঁদের সবাইকে কি আপনি নিয়মিত রেস্টুরেন্টে নিয়ে যান?”

“দূর দূর থেকে অনেকে এখানে পড়তে আসে। তাদের অনেকেই পড়ার পর নীচে মিলনী কাফে বা কাছাকাছি রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। মাঝেমধ্যে আমিও তাদের সঙ্গে খাই।”

“সে তো অবশ্যই স্যার, তবে বিশেষ কারও কারও সঙ্গে কি ঘন ঘন খান?”

“কী বলতে চান আপনি?” ধ্রুববাবু আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বললেন।

প্রশ্নটা উপেক্ষা করে একেনবাবু মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে বললেন, “আপনি পুরো রেস্টুরেন্ট সামলাতে ব্যস্ত থাকেন সবার দিকে তাকানোর সময় আপনার থাকে না, তাই রতনকেই জিজ্ঞেস করি।”

একেনবাবু রতনকে কাছে ডাকলেন। তারপর নন্দিতার ছবিটা দেখিয়ে বললেন, “রতন, এঁকে তুমি আগে দেখেছ?”

“হ্যাঁ বাবু, নন্দিতাদি।”

“এঁর সঙ্গে কি ধ্রুববাবু মিলনী কাফেতে খেতে আসতেন?”

“হ্যাঁ বাবু।”

“মাঝেমধ্যে আসতেন, না প্রায়ই আসতেন?”

“প্রায় প্রতিদিনই আসতেন বাবু।”

“যতদিন এখানে মিস নন্দিতা পড়তেন ততদিন আসতেন?”

“না বাবু, শেষের দিকে আর আসতেন না।”

“আই সি। ঠিক আছে, তুমি যাও।”

একেনবাবু মাথাটা একটু চুলকোলেন। “আচ্ছা, আমাকে একটু বলুন তো স্যার, মিস নন্দিতার সঙ্গে কি আপনার ঝগড়া হয়েছিল?”

“এগুলো আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাকে আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই।” ধ্রুববাবু বিরক্ত মুখে বললেন।

“স্যার, মিস নন্দিতা খুন হয়েছেন। আপনার সঙ্গে যদি ওঁর ঝগড়া হয়ে থাকে, তাহলে আপনি তো রাগবশত ওঁকে খুনও করতে পারেন, পারেন না?”

“কী উন্মাদের মতো কথা বলছেন আপনি, কারোর সঙ্গে খাচ্ছি না বলে তাকে আমি খুন করব!” ধ্রুব দত্ত রেগে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। “আর আমি তো পুলিশকে আগেই জানিয়েছি সেই রাত্রে আমি কোথায় ছিলাম!”

“ও হ্যাঁ স্যার, আমি তো সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। তাছাড়া আরও একজন খুন। হয়েছেন যাঁর নাম মিস শর্মিলা। তিনিও আপনার এই স্কুলে পড়তেন। তাঁর সঙ্গে তো আপনি বেশি খেতেনও না, তাই না?”

ধ্রুব দত্ত উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন। কিন্তু বুঝলাম রাগে ফুঁসছেন।

“ঘাবড়াবেন না স্যার, মিস নন্দিতার খুনের সঙ্গে আপনি জড়িত বলে মনে হয় না। আসলে স্যার, আপনার আর সমুবাবুর ব্যাপারটা একটু আলাদা। আপনারা খুনি নন ঠিকই, কিন্তু আপনাদের আচরণের মধ্যে যে সব রহস্য জড়িত সেগুলোও ক্লিয়ার হওয়া দরকার। অধীরবাবু সেগুলো নিয়ে পরে মাথা ঘামাবেন, আমাকে সেই কাজের ভার দেওয়া হয়নি। আমাকে বলা হয়েছেমিস নন্দিতার খুনিকে ধরতে সাহায্য করতে। আমি স্যার অন্যদিকে যাবই না, বরং এই খুনটা নিয়েই একটু ভাবি। মিস নন্দিতাকে খুন করা হয়েছে গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে। তারপর খুনি ছুরিও চালিয়েছে। এতে কোনো সমস্যা নেই স্যার, কিন্তু মিস নন্দিতার গলায় দড়ির ফাঁসও লাগানো ছিল। সেটা কেন? দিস ট্রাবলড মি স্যার, ট্রাবলড মি এ লট!”

“তারপর জানলাম আরও একজন প্রায় একইভাবে খুন হয়েছিলেন। তিনি হলেন মিস শর্মিলা। তাঁকেও শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। পরে গলায় একটা দড়ির ফাঁস লাগানো হয়। শর্মিলা কিন্তু শ্বাসরোধের সঙ্গে সঙ্গে মরেননি। মারা গিয়েছিলেন হাসপাতাল যাবার পথে। দ্বিতীয়বার মনে হয় খুনি সেই চান্সটা নিতে চায়নি, মৃত্যু নিশ্চিত করতে সেই সঙ্গে ছুরিও চালিয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই খুনি ভিকটিমের পরিচিত, নইলে দরজা না ভেঙে ঘরে ঢুকে গলা টিপে হত্যা করা সম্ভব হতো না। দুটো ক্ষেত্রেই শরীরের অনাবৃত অংশে অত্যাচারের চিহ, দুজনের ওপরেই খুনির একটা তীব্র রাগ ও ঘৃণা যেন প্রকাশ পেয়েছে। যাঁরা খুন হয়েছেন তাঁদের কল্পনাতেও আসেনি খুনির এই মনোভাবের কথা।

আরেকটা দিক স্যার খুবই ইন্টারেস্টিং –মিস শর্মিলা আর মিস নন্দিতার চেহারা অনেকটা একই ধরণের, একজনকে দেখলে আরেকজনের কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। তখনই আমি বুঝলাম স্যার, আমরা এখানে একজন খুনির খোঁজ করছি যে হল ‘মিশন ওরিয়েন্টেড কিলার’। এ ধরণের খুনিরা মনে করে, এক ধরণের চেহারার মানুষের পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার নেই! কেন সেটা মনে করে, তার নানান রকমের সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যা থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে মিস নন্দিতা বা মিস শর্মিলার চেহারা দেখে তাদের প্রতি খুনির একটা তীব্র বিদ্বেষ নিঃসন্দেহে জেগে উঠেছিল। কিন্তু কেন, সেটাই আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তখন আমার মনে পড়ল, বাপিবাবুই তো চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে সেটা দেখিয়েছিলেন!”

কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে একেনবাবুর দিকে তাকালাম!

“হ্যাঁ স্যার, আপনি। আপনি ফেসবুক থেকে বীর রায়ের পাতাটা দেখালেন, যেখানে বীর রায় তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই বান্ধবীর চেহারা দেখে আপনি ভেবেছিলেন মিস নন্দিতা। না তিনি মিস নন্দিতা ছিলেন না। কিন্তু কে এই বীর রায়? মনোজবাবুকে ফোন করে জানলাম আবীর রায়ের ডাক নাম ছিল বীর। আবীর রায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন যখন তাঁর বান্ধবী তাঁকে ছেড়ে দিয়ে চলে যান।”

এবার একেনবাবু মৃত্যুঞ্জয়বাবুর দিকে তাকালেন।

“স্যার, একমাত্র সন্তানের মৃত্যুশোক এমনিতেই বিষম শোক, আরও অসহনীয় হয় যখন সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। আপনি শুধু ভেঙে পড়েননি স্যার, আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ। আপনার সন্তানের মৃত্যুর জন্যে দায়ী করছেন শুধু সেই বান্ধবীকে নয়, তার মতো চেহারার প্রত্যেকটি মেয়েকে। সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে চলেছেন। তাদের হত্যা করে, গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে, অত্যাচার করে! কোন অছিলায় আপনি ঢুকেছিলেন জানি না, কিন্তু দুটি মেয়েই আপনাকে স্নেহশীল কাকা বা জ্যাঠা ভেবে ঘরে ঢুকতে দিয়েছিল…।”

মৃত্যুঞ্জয়বাবু দেখলাম উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওঁর নির্লিপ্ত মুখটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে কী নৃশংস কাজ উনি করেছেন! বিচিত্র এই পৃথিবী, বিচিত্র এই মানুষের মন!

.

৷৷ পরিশিষ্ট ৷৷

আমি একেনবাবুকে বললাম, “আমি তো বুঝতেই পারিনি কেন সেদিন আপনি মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কাছে মনোজবাবুর ফোন নম্বর চাইছিলেন? কিন্তু শিওর হলেন কী করে যে মৃত্যুঞ্জয়বাবুই খুনি?”

“স্যার, আবীরবাবু আর মনোজবাবুর মুখের মধ্যে একটা আদল আছে। তারপর যখন জানলাম ওঁর ডাকনাম বীর। তখন অধীরকে দিয়ে খুঁজে বার করলাম মৃত্যুঞ্জয়বাবুর ব্লাডগ্রুপ।”

“খুঁজে বার করলেন মানে?”

“সে কী স্যার, মনে নেই রেস্টুরেন্টে ডাকাতির সময় ওঁর গুলি লাগে! গুলি বার করতে যখন ওঁর সার্জারি হয়, হাসপাতালে রুটিন ব্লাড টেস্ট করা হয়েছিল। ব্লাড গ্রুপটা মিস নন্দিতার বিছানায় পাওয়া রক্তের সঙ্গে ম্যাচ করল। এখন ডিএনএ-র বেজাল্ট পেতে হবে কেসটা ফুল-প্রুফ করার জন্যে।”

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত