১৬.

বুধবার মে ২৫, ২০১১

আজ তাড়াতাড়ি অফিসে এসে আমার পেপারটা নিয়ে পড়েছি। ওটাকে দশ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। একটা স্পেশাল ইস্যুতে পেপারটা যাচ্ছে, সাবমিশানের ডেডলাইন মিস করতে চাই না। ভাগ্যক্রমে আজ অফিসে কেউই প্রায় নেই। বেভকেও ওর ডেস্কে দেখলাম না। দরজা বন্ধ করে বেশ কয়েক ঘণ্টা কাজ করলাম। তারই মধ্যে ক্যাফেটেরিয়া থেকে একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে এলাম। বহুদিন বাদে সলিড প্রোগ্রেস হল পেপারটাতে। আজ কিশোরের সঙ্গে কফি খেতে হবে কথা দিয়েছি, নইলে আরেকটু কাজ করা যেত।

.

কিশোরকে এত রাগতে আগে আমি দেখিনি। রাগের তোড়ে বেশ কয়েকবার বলল, ‘তোর বন্ধু রামসুন্দরকে আমি খুন করব।’ কথার কথা ঠিকই, কিন্তু কফি কর্নারে, যেখানে আশেপাশে অনেকে আছে, এভাবে খুন করব’ বলাটা একেবারেই অনুচিত। আমি অনেক কষ্টে ওকে শান্ত করলাম। তারপর যেটা ওর কাছ থেকে উদ্ধার করলাম, সেটা হল রামসুন্দরের ব্যাপারটা বেভ কিশোরকে এতদিন জানায়নি। গতকাল তোবোকেনে যাবার পথে বলেছে। আমার সঙ্গে বেভের যা কথা হয়েছে তাও বলেছে।

কিশোর বলল, “স্কাউড্রেলটার আস্পর্ধা দেখ, বেভকে ভয় দেখাচ্ছে, ইন্ডিয়াতে গেলে পুলিশ দিয়ে আমাদের অ্যারেস্ট করাবে! কে কাকে অ্যারেস্ট করে দেখব। ব্যাটা জানে না যে আমার কাকা তামিলনাড়ুর ডিজি, হেড অফ পুলিশ। আমার মামা অন্ধ্রের ক্যাবিনেট মিনিস্টার, আমার মেসোমশাই দিল্লীতে…।”

“এর মধ্যে গুরুজনদের টানছ কেন, অবভিয়াসলি রামসুন্দর একটা সিলি কথা বলেছে।”

“না, আমি ওকে ছাড়ব না,” কিশোর বলল। “পরশু কাকা, নিউ ইয়র্কে আসছে, আমি জিজ্ঞেস করব রেড্ডী বলে কোনও পুলিশ অফিসার আছে নাকি। তাঁর জানা উচিত যে, তাঁর ছেলে এইসব কুকীর্তি করছে।”

প্রায় আধঘণ্টা গেল, কিশোরকে ঠাণ্ডা করতে। তারপর একথা সেকথার পর হঠাৎ বলল, “বেভ থিঙ্কস হাইলি অফ ইউ।”

আমি অবাক হবার ভান করে বললাম, “সেকি? ও তো কালকেই কমপ্লেন করল ওকে আমি ইগ্নোর করি!”

“মে বি দ্যাটস হোয়াই। এনিওয়ে, বেশি অ্যাটেনশন দিও না, কারণ উই আর গোইং টু গেট ম্যারেড সুন।”

“কংগ্রাচুলেশনস! এই দারুণ কথাটা এতক্ষণ চেপে রাখলে? সুন মানে কবে?”

“দুমাস। সেইজন্যেই আবার কাল আন্ট মিশেলের সঙ্গে দেখা করলাম। তোমাকে বলেছিলাম না, বোধহয় বেভকে নিয়ে মঙ্গলবার আন্ট মিশেলে কাছে যাব?”

“নিশ্চয় বলেছিলে, তখন খেয়াল করিনি।”

“আসলে তোমার সঙ্গে শুক্রবার যখন কথা হয়, তখনো বেভকে ফর্মালি প্রোপোজ করিনি। ঠিক করে রেখেছিলাম রবিবার করব। সোমবার কাজের জন্যে বাইরে থাকব, মঙ্গলবার ফিরে এসে বেভ আর আমি দুজনে মিলে আন্ট মিশেলকে সুখবরটা দেব। সো মেনি থিংস ক্যান হ্যাঁপেন। যতক্ষণ না বেভ বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে, ততক্ষণ বোধহয়-টা বাদ দিই কী করে?”

“তা তো বটেই।”

“আই ফিল ব্যাড যে তুমি আমার কাছে না শুনে অন্যের কাছে শুনেছ আমার প্রোপোজ করার কথা।”

“আমি এতটুকু মাইন্ড করিনি। তোমাদের এনগেজমেন্টের খবরে আন্ট মিশেল নিশ্চয় খুব খুশি হয়েছেন। উনি তো বেভের খুব ক্লোজ, তাই না?”

“হ্যাঁ, আন্ট মিশেলের কাছেই ও বড় হয়েছে। ওয়ান্ডারফুল লেডি। আশি বছর বয়েস, এখনো কী উৎসাহ নিয়ে স্যুপ কিচেন চালাচ্ছেন। প্রতিদিন প্রায় একশো লোক সেখানে খায়।”

“জাস্ট কিউরিয়াস… বেভের মা কি…”

কিশোর আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “বেভের মা মারা যান বেভ যখন এক বছরের। আন্ট মিশেলের বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি, বেভের বাবার থেকে উনি ছিলেন প্রায় কুড়ি বছরের বড়। বেতের বাবা আর বিয়ে করেননি। তাই আন্ট মিশেলই বেভকে বড় করেছেন। বাই দ্য ওয়ে, ইউ উইল হ্যাভ টু বি মাই বেস্ট ম্যান।”

“আমার থেকে বেটার কাউকে পেলে না?” আমি ফাজলামি করে বললাম।

“কেন, তুমি হবে না?”

“নিশ্চয় হব, এটা তো একটা অনার। তা বাবা-মাকে খবরটা দিয়েছ?”

“হ্যাঁ, বেভকে প্রোপোজ করার আগেই দিয়েছি। ওঁরা অবশ্য একটু অ্যাপ্রিহেন্সিভ, কোন বাড়ির মেয়ে, কী করে– সে নিয়ে তাঁদের হাজার গণ্ডা প্রশ্ন। আসলে দেশে আমার জন্যে একটি পাত্রী পছন্দ করে রেখেছেন। মেয়েটাকে চিনি, এক ধনকুবেরের মেয়ে। সেটাও একটা কারণ। যাই হোক, কাকা কী একটা কাজে ওয়াশিংটন ডিসি-তে এসেছেন। নিউ ইয়র্কেও কিছু কাজ আছে। পরশু এসে সেগুলো সেরে আমার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবেন। তাঁর কাছ থেকে শিওর ওঁরা অনেক রিপোর্ট নেবেন। তবে আমি বলে দিচ্ছি, শেষমেশ সবাই লাইনে এসে যাবে। বিয়েও অ্যাটেন্ড করবে।”

‘ওয়ান্ডারফুল।”

“কাকা এলে তোমায় ডাকব। ভেরি ইন্টারেস্টিং ম্যান। পুলিশে কাজ করেন বটে, কিন্তু ফিজিক্সে এম.এসসি করেছিলেন। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। তোমার মতো প্রফেসর হননি বলে এখনো আফশোস করেন। তুমি কি নেক্সট উইকে ব্যস্ত থাকবে? ডেটটা এখুনি বলতে পারছি না, কাকার অন্য কি প্ল্যান আছে না জানা পর্যন্ত।”

“আমি মোটেই বিজিম্যান নই। তোমার কাকার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে কোন প্রোগ্রাম থাকলেও ক্যানসেল করতে পারব।”

“থ্যাঙ্ক ইউ।”

“ভালো কথা, বেভকে বলেছিলাম ওর আন্টকে বলতে, ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। সেটা কি ও বলতে পেরেছে? আজ তো ওকে অফিসে দেখলাম না।”

“ও, হ্যাঁ, সেটাই তো তোমাকে বলতে বলেছে। ও কাল ফেরেনি, আন্ট মিশেলের সঙ্গে আজকের দিনটা কাটাবে বলে। তোমরা তো কাল সন্ধ্যার সময় যাবে? কোনও প্রব্লেম নেই। বেভ হয়তো তোমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না, কিন্তু আন্ট মিশেলের ঠিকানা, যাবার ডিরেকশন, ফোন নম্বর সবকিছু কাল তোমাকে অফিসে দিয়ে দেবে।”

“কেন আমরা যাচ্ছি জান তো?”

“হ্যাঁ, বেভ বলেছে অশোক দুবের মার্ডারের ব্যাপারে। আন্ট মিশেল ওকে খুব ভালো করে চিনতেন। খুবই শকড ওর মৃত্যু নিয়ে। বেভ বলল, তোমার এক ডিটেক্টিভ বন্ধু এটা নিয়ে ইনভেস্টিগেট করছেন। নামটা ঠিক ধরতে পারেনি। কী নাম বল তো?”

“একেন্দ্র সেন। আমরা একেনবাবু বলে ডাকি।”

“ও মাই গড, নামটা তো চেনা চেনা লাগছে। ইনিই কি ম্যানহাটানের মুনস্টোন মিস্ট্রি ক্র্যাক করেছিলেন?”

“হ্যাঁ, ইনিই। ওঁর আরও অনেক কীর্তি আছে।”

“উনি যে তোমার বন্ধু সেটা তো জানতাম না!”

“তুমি হচ্ছ আমার ছাত্র জীবনের বন্ধু। পড়া শেষ করে তো বস্টন না কোথায় পাড়ি দিলে। এখানে এসে আমার অফিসে দেখা দিলে এই সেদিন, কয়েকমাস আগে। তারপর তোমার সঙ্গে বার কয়েক যে দেখা হয়েছে, সেটা হল এই কফি কর্নারে। সেই কথাবার্তাও মূলত তোমার ভাবি পত্নী বেভকে নিয়ে। আমি অভিযোগ করছি না, প্রেমে পড়লে বিশ্বের অন্য কোনও দিকে দৃষ্টি থাকে না। আই ফুল্লি আন্ডারস্ট্যান্ড।”

“তা ঠিকই,” কিশোর একটু লজ্জা পেল।

.

১৭.

বৃহস্পতিবার মে ২৬, ২০১১

মিশেল বেসিমারকে দেখলে আশি বলে মনে হয় না। সোজা হয়ে হাঁটাচলা করেন। মুখের চামড়া এখনো কোঁচকায়নি। চোখটা হালকা নীল, একটু ঘোলাটে। কিন্তু এই বয়সেও মুখটা আকর্ষণীয়। বেভের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য আছে, হতে পারে আমার কল্পনা। অ্যাপার্টমেন্টটা ছোটো কিন্তু অ্যাসিস্টেড লিভিং ফেসিলিটির মধ্যে নয়। নিজের ঘরদোর মিশেল নিজেই সামলান। রান্নাবান্না দোকানপাট সব নিজে করেন। আমরা পরিচয় দিতেই সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা করে বসালেন।

.

বাইরের ঘরটা বেশ বড়, লিভিং কাম ডাইনিং। ডাইনিং এরিয়াতে ছ’জন বসার মতো খাবার টেবিল বেশ এঁটে গেছে। টেবিল পার হলেই কিচেন। মধ্যে কোনও দেয়াল বা দরজা নেই। লিভিং এরিয়াতে সোফাসেট, কফি টেবিল ছাড়া আসবাব বলতে একটা বড় বইয়ের আলমারি। দেয়াল জুড়ে বেভের নানান বয়সের কয়েকটা ছবি। ব্যাস।

আমরা বসার পর বললেন, “বেভ তোমাদের কথা বলে গেছে। তোমরা অশোকের মার্ডার নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করছ, তাই না?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই শুরু করলাম। “একেনবাবু অশোক দুবে সম্পর্কে দুয়েকটা জিনিস জানতে চান। সেটা জেনেই আমরা চলে যাব। বেশিক্ষণ সময় নেব না।”

“যত সময় লাগে নাও। আমার কোনও তাড়া নেই।” তারপর আমাদের আপত্তি সত্বেও জোর করে এক প্লেট কুকি টেবিলে রেখে কফি বানাতে শুরু করলেন।

একেনবাবু উঠে ওঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মিস্টার দুবেকে ম্যাডাম, আপনি কতদিন চিনতেন?”

মিশেল বললেন, “আমি বুড়ি ঠিকই, কিন্তু অতটা রেস্পেক্ট না দেখালেও চলবে। আমাকে মিশেল বলেই ডেকো।”

“ইয়েস, ম্যাডাম।” ‘ইয়েস, মিশেল,” বৃদ্ধা একেনবাবুকে শোধরাবার চেষ্টা করলেন। “সরি, ম্যাডাম।”

প্রমথ একেনবাবুকে উদ্ধার করল। “ম্যাডাম’ আর ‘স্যার’ বলা একেনবাবুর হ্যাবিট। বহু চেষ্টা করেও আমরা শোধরাতে পারিনি।”

“তাই নাকি?” মিশেল এবার একেনবাবুকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি বিয়ে করেছ?”

“ইয়েস, ম্যাডাম।”

“বউকেও ম্যাডাম বল?” ঘোলা ঘোলা চোখেও দুষ্টুমি খেলল।

একেনবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন, “কী যে বলেন ম্যাডাম!”

“ঠিক আছে, ম্যাডামই থাক। কী প্রশ্ন জানি করলে?”

“জিজ্ঞেস করছিলাম, আশোক দুবেকে আপনি কতদিন চিনতেন?”

“প্রায় দু’বছর।”

“কী ভাবে আলাপ হয়েছিল আপনার সঙ্গে?”

“দাঁড়াও, দাঁড়াও, আগে কফিটা বানাই। তারপর অশোক সম্পর্কে যা জানি, তোমাদের বলি। তারপরেও যদি প্রশ্ন থাকে, তাহলে কোরো, কেমন?”

“ইয়েস, ম্যাডাম।” বলে একেনবাবু সোফায় এসে বসলেন।

কফি খেতে খেতে মিশেল বেসিমার অশোকের কথা শুরু করলেন। দীর্ঘ কাহিনি আমি একটু সংক্ষেপ করছি।

মিশেল ব্লুমফিল্ড অ্যাভিনিউয়ে একটা স্যুপ কিচেন চালাতেন। মাইনে দিয়ে লোক রাখার সামর্থ ওঁর ছিল না, তাই মাঝেমাঝেই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতেন ভলেন্টিয়ারের খোঁজে। সেই বিজ্ঞাপন দেখেই বছর দুই আগে অশোক আসে। সপ্তাহে একদিন করে অশোক কিচেনে কাজ করত। অশোকের যে হোটেল ম্যানেজমেন্টের ট্রেনিং ছিল, সেটা উনি প্রথমে জানতেন না। জানার পর অশোকের বিদ্যে-বুদ্ধি খুব কাজে লাগলো। মেনু তৈরি করা থেকে রান্নাবান্না অর্গানাইজ করা, খাবার সার্ভ করা, সব ব্যাপারেই অশোক ওঁকে সাহায্য করা শুরু করল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এমন অবস্থা হল, অশোককে ছাড়া মিশেলের চলত না। মাস ছয়েক আগে মিশেল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলেন। তখন প্রতিদিন অশোক ওঁকে দেখতে আসত। হাসপাতাল থেকে ফিরে স্যুপ কিচেনের ডেইলি ডিউটি থেকে মিশেল ছুটি নেন, শরীর আর দিচ্ছিল না। কিন্তু অশোকের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগটা থেকে যায়। মাঝে মাঝেই অশোক মিশেলের খোঁজখবর নিতে আসত। অনেক সময়ে মিশেল অশোককে খ্যাপাতেন। বলতেন, এই বুড়িকে দেখতে না এসে তোমার বয়সি কোনও মেয়েকে দেখতে যাও না। অশোক শুনে খুব হাসত। মাঝে মাঝে মিশেলের ইচ্ছে হত বেভের সঙ্গে অশোকের আলাপ করিয়ে দিতে। ভাবতেন অশোকের মতো ছেলের সঙ্গে বেভের বিয়ে হলে বেশ হয়। যাই হোক, এরমধ্যে একটা মেয়ের সঙ্গে অশোকের ভাব হল। ভারতীয় মেয়ে। অশোক তার ছবিও মিশেলকে দেখিয়েছিল, ভারি মিষ্টি চেহারা। মেয়েটির মা নিউ ইয়র্কে মেয়ের কাছে এসেছিলেন। হয়তো মেয়েটিই মাকে আনিয়েছিল অশোকের সঙ্গে পরিচয় করাতে। তারপর প্রায় সপ্তাহ কয়েক অশোকের সঙ্গে মিশেলের দেখা হয়নি। মিশেল ভেবেছিলেন নিশ্চয় মেয়েটি আর মেয়েটির মাকে নিয়ে অশোক কোথাও বেড়াতে গেছে। দুয়েকবার ফোনও করেছিলেন অশোককে, কিন্তু ধরতে পারেননি। এরপর যেদিন অশোক আসে, ওর চেহারা দেখে মিশেল বোঝেন একটা গুরুতর কিছু ঘটেছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে অশোক বলল, মেয়েটার সঙ্গে অশোকের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। মিশেল প্রথমে ভেবেছিলেন সাময়িক কোনও ভুল বোঝাবুঝি। পরে বুঝলেন, এই ছাড়াছাড়ির মূলে অশোক নিজেই। মেয়েটিকে বিয়ে করা অশোকের পক্ষে অসম্ভব। কারণ মেয়েটির ফ্যামিলি গোঁড়া হিন্দু, এখনও জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামায়। অশোকের ওসবে বিশ্বাস নেই। মিশেল তখন জিজ্ঞেস করেন, ফ্যামিলি না হয় গোঁড়া হিন্দু, মেয়েটাও কি সেরকম? উত্তরে বুঝলেন, মুখে বলে না। কিন্তু অশোকের মানসিকতার সঙ্গে ওদের ফ্যামিলির মানসিকতার এত তফাৎ, বিয়ে করলে পরে মেয়েটা পস্তাবে। তাই অশোক নিজেই সরে এসেছে।

“আই সি। আচ্ছা ম্যাডাম, অশোকবাবু কি টাকাকড়ির অসুবিধা নিয়ে আপনাকে কিছু বলেছিলেন?”

“না, সেরকম তো কিছু শুনিনি। ও নিজে খুব সাধারণ ভাবে থাকত। তবে সেটা টাকা পয়সার অভাবের জন্যে নয়। শুনেছি ও দেশে গরীবদের জন্যে টাকা পাঠাত।”

“কিন্তু ওঁর হাজার দশেক ডলারের দরকার পড়েছিল, এমন কোনও কথা আপনি শোনেননি?”

“শুনেছি। কিন্তু সেটা ওর নিজের জন্যে নয়, কোনও একটা প্রজেক্টের জন্যে। আমি ওর প্রজেক্টে দু’শো ডলার দিতে চেয়েছিলাম, ও নিতে রাজি হয়নি।”

“শেষ পর্যন্ত কি উনি টাকাটা তুলতে পেরেছিলেন?”

“সেটা বলতে পারব না।”

.

ফেরার পথে আমি বললাম, “এই কাউ-বেল্টের লোকদের মধ্যে জাত-পাত নিয়ে এখনো যে এত সমস্যা, কল্পনা করা যায় না!”

“শুধু কাউ-বেল্টের নিন্দা করছিস কেন, বাঙালিরাও কিছু কম যায় না। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনগুলো দেখ না, বামুনের মেয়ের জন্যে কে শিডিউল্ড কাস্ট ছেলের খোঁজ করছে?” প্রমথ প্রতিবাদ করল।

“ওরকম ভাবে বিজ্ঞাপন কেন দেবে? কিন্তু কাস্ট নো বেরিয়ার’ অনেক জায়গাতেই লেখা থাকে।”

“তুই সেখানে অ্যাপ্লাই কর শিডিউল্ড কাস্ট পাত্র হিসেবে, দেখি কী রকম উত্তর পাস?”

“ডোন্ট বি অ্যান ইডিয়ট, আমার প্রশ্ন এখানে উঠছে কেন?”

“তার কারণ আমাদের মধ্যে একেনবাবুর বিয়ে হয়ে গেছে, আমিও হয়তো করে ফেলব। তোরই কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই, পাত্র-পাত্রীর অ্যাডের পাতাই তোর ভরসা।”

“আমি কিন্তু কনফিউসড স্যার,” একেনবাবু বললেন, “দুবো তো ব্রাহ্মণ বলেই জানতাম!”

“আমার কাছে তার উত্তর পাবেন না,” প্রমথ বলে উঠল, “আমি জাত-ফাত মানি না। তাও গাঙ্গুলি, ব্যানার্জি হলে বলতে পারতাম। ওটা তো খোট্টা পদবি।”

“তুই অত্যন্ত ডিস-রেস্পেক্টফুল।”

“ও, কাউ-বেল্ট বললে রেস্পেক্টফুলি বলা হয়, আর খোট্টা বললেই দোষ।”

“শ্রীমালী আমি জানি ব্রাহ্মণ,” একেনবাবু আমাদের কথা কাটাকাটি পুরো উপেক্ষা করে মন্তব্য করলেন।

প্রমথ বা আমার কারোরই এতে ইন্টারেস্ট নেই। চুপ করে রইলাম।

.

বাড়িতে ফিরে একেনবাবু দেখলাম কম্পিউটার খুলে বসেছেন।

প্রমথ বলল, “আজ আর রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। পিৎজা অর্ডার করি, কি বলিস?”

“বেশ তো, কর।”

প্রমথ ফোন করে একটা এক্সট্রা লার্জ পিজা অর্ডার করল, হাফ পেপরোনি, হাফ মাশরুম।

“তুই তো মাশরুম হেট করিস,” আমি বললাম।

“করি, কিন্তু একেনবাবুর তো ওটা না হলে চলে না।”

এই হল প্রমথ। একদিকে বাঁকা বাঁকা কথা বলবে, গালাগাল দিয়ে ভূত ভাগাবে, আবার খেয়াল রাখবে আমাদের কার কী পছন্দ বা অপছন্দ!

.

একটু বাদেই হাসি হাসি মুখে একেনবাবু বললেন, “ঠিকই বলেছিলাম স্যার। দুবে হল দ্বিবেদীর আরেকটা নাম। এঁরা হলেন সব সরফুপারের ব্রাহ্মণ, আদিবাস ছিল সরযূনদীর পাশে। শ্রীমালীরাও ব্রাহ্মণ তবে রাজস্থানের।”

“শুনে চমৎকৃত হলাম,” প্রমথ বলল। “কিন্তু এই জ্ঞানের ভাণ্ডটা আমাদের বিতরণ করে আপনার লাভ?”

“মানে আমি বলতে যাচ্ছি স্যার, শুধু ব্রাহ্মণ হলেই হয় না, বিয়ের ব্যাপারে আরও নিশ্চয় ভাগ-বিচার আছে।”

আমি বললাম, “শুনেছি সাউথ ইন্ডিয়ায় চোলিয়া ব্রাহ্মণদের অন্য ব্রাহ্মণরা নিচু চোখে দেখে। এছাড়া বিয়েতে গণ, গোত্র, কুষ্ঠী-ঠিকুজি কত কিছু দেখা হয়।”

“তোদের এই স্টুপিড কথাবার্তায় আমি সিক ফিল করছি,” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল, “কোন যুগে পড়ে আছিস তোরা?”

“শ্চটছিস কেন, আমরা তো কেউ এসব মানি না। শুধু যারা মানে, তাদের চিন্তাধারাটা ফলো করার চেষ্টা করছি।”

“দে আর নট ডিসার্ভড টু বি ফলোড। আই হ্যাভ নো ডাউট, এইজন্যেই অশোক এসব ফ্যামিলির সঙ্গে জড়াতে চায়নি। এই পরিবারে বিয়ে করলে নিশ্চিত ডিভোর্স হত।”

.

১৮.

শুক্রবার মে ২৭, ২০১১

সকালে অফিসে ঢুকতেই বেভ এসে হাজির। গত চারমাসে বেভের সঙ্গে আমার যা কথা হয়েছে গত এক সপ্তাহে তার থেকে বেশি হয়েছে।

“তোমার একটা চিঠি এসেছে,” বলে একটা চিঠি এগিয়ে দিল।

মনে হল এটা একটা ছুতো। আমার টেবিলের ওপর রেখে দিলেই চলত, আগে বরাবর তাই করেছে।

“চিঠিটা রেজিস্টার্ড চিঠি, আমি সই করে নিয়েছি, হোপ ইট ইজ ওকে উইথ ইউ।”

“নিশ্চয়।”

.

চিঠিটা ইন্ডিয়া থেকে এসেছে। একটু অবাকই হলাম। অফিসের ঠিকানায় আমায় কেউ চিঠি পাঠায় না, তার ওপর রেজিস্ট্রি করে পাঠানো। বেভের সামনেই চিঠিটা খুললাম। যাদবপুরের একটি ছেলে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে চায়। মার্কশিট, রেকমেন্ডেশন লেটার ইত্যাদি দিয়ে পাঠিয়েছে। যদি কোনও অ্যাসিস্টেন্টশিপের বন্দোবস্ত করে দিতে পারি। ছেলেটিকে চিনি না। চিনলেও এসে যেত না, এ ব্যাপারে আমার কোনও হাত নেই। উচিত ছিল অ্যাডমিশন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা। ইনফ্যাক্ট অবাকই হলাম, আজকের যুগে ইন্টারনেটে খোঁজখবর নিয়ে কেউ এরকম চিঠি পাঠাচ্ছে। তাও আবার আমার পুরোনো কলেজ যাদবপুরের ছাত্র। চিঠিটা যখন ট্র্যাশ ক্যানে ফেলতে যাচ্ছি, বেভ বলল, “লুকস লাইক সামওয়ান হ্যাঁস ওয়েস্টেড হিজ মানি।”

“ইউ আর রাইট।”

“স্ট্যাম্পটা আমি পেতে পারি?”

“তুমি স্ট্যাম্প জমাও?” আমার গলার স্বরে বিস্ময়টা চাপা রইল না। “মনে হচ্ছে তুমি অবাক হয়েছ?”

“তা একটু হয়েছি।”

“কেন জানতে পারি?”

এর উত্তরটা সত্যি করে বললে ভালো শোনাত না। স্ট্যাম্প যাদের জমাতে দেখেছি তাদের ক্যারেক্টারই আলাদা। বেভের মতো ইজি গোইং, ফান লাভিং, প্লে-ফুল নয়। এই অবস্থায় সবচেয়ে ভালো উত্তর কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে বলা “আই ডোন্ট নো।”

“খামটা আমায় দেবে প্লিজ,” বেভ হাতটা এগিয়ে দিল। “স্ট্যাম্পটা দেখে লোভ হয়েছিল, তাই তোমার ডেস্কে রেখে যাইনি। কোথাও ফেলে দিলে আর পেতাম না।”

আমি খামটা ওর হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কতদিন ধরে তুমি স্ট্যাম্প জমাচ্ছ?”

“দশ বছর বয়স থেকে। আমার বাবা জমাত। বাবা মারা যাবার পর স্ট্যাম্পের অ্যালবামগুলো পাই। বাবার ইন্ডিয়ান স্ট্যাম্পের ভালো কালেকশন ছিল। নট দ্যাট হি ওয়াজ ইন্টারেস্টেড ইন ইন্ডিয়া, বাট হি ফেল ইন লাভ উইথ ইন্ডিয়ান স্ট্যাম্পস।”

আমি এ সুযোগটা ছাড়তে পারলাম না। বললাম, “তার মেয়ে তো বাবাকে টেক্কা দিয়েছে, শি হ্যাঁস ফলেন ইন লাভ উইথ অ্যান ইন্ডিয়ান ম্যান।”

“সো ট্রু।” ঝলমল করে হাসল বেভ।

আমার হঠাৎ মনে পড়ল সিন্ধ ডাক-এর কথা। জিজ্ঞেস করলাম, “সিন্ধ ডাক স্ট্যাম্পের নাম শুনেছ?”

“ইউ মিন সিন্ডে ডক।”

“না, ওটা আসলে সিন্ধ ডাক হবে।” প্রমথর জ্ঞানটা এই সুযোগে ঝেড়ে দিলাম।

“আমি এটা জানতাম না! থ্যাঙ্ক ইউ।”

“ওটা তো দামি স্ট্যাম্প, তাই না?”

“হ্যাঁ, শুনেছি ভালো কনডিশনে থাকলে বেশ কয়েক হাজার ডলার। ইট ইজ সো সারপ্রাইজিং তুমি এই স্ট্যাম্পের কথাটা তুললে। কিছুদিন আগে জর্জ এই স্ট্যাম্পের কথাটা বলছিল।”

“জর্জ কে?”

“ফিলাটেলিস্ট কর্নার-এর মালিক।“

“তুমি ওকে চেন?”

“হ্যাঁ, আমি মাঝে মাঝে ওর কাছ থেকে স্ট্যাম্প কিনি, তবে পাঁচ দশ ডলারের। ও প্রথম যখন দোকান খোলে বাবাই ছিল ওর ফার্স্ট কাস্টমার। কিন্তু জানো, দোকানটা ও বন্ধ করে দিচ্ছে।”

“কেন?”

“মেরি এখন আরথ্রাইটিস-এ একেবারে কাবু, দোকানে বেশি বসতে পারে না। জর্জের পক্ষে একা দোকান চালানো সম্ভব নয়।”

“মেরি কে?”

“ওর স্ত্রী।”

“ওর অন্য কোনও হেল্প নেই?”

“কেভিন কাজ করত, কিন্তু এখনও ওখানে আছে কিনা জানি না। জর্জ ওকে মাইনেপত্রও সময় মতো দিতে পারছিল না। এক কালে অনেকে স্ট্যাম্প জমাত, এখন কে জমায়? দু-পাঁচ ডলারের স্ট্যাম্প বিক্রি করে ম্যানহাটানে দোকান চালানো যায় না।”

“কিন্তু অনেক স্ট্যাম্প তো একশো হাজার ডলারেও বিক্রি হয়!”

“সেগুলো অকশন হাউস বিক্রি করে, এ ধরণের স্ট্যাম্পের দোকান থেকে কেউ কেনে । তাও জর্জ লাকি, ওর দুয়েকজন পয়সাওয়ালা কাস্টমার আছে। জর্জ ভালো স্ট্যাম্পের খবর পেলে ওদের দেয়। বিক্রি হলে তার থেকে কিছু কমিশন পায়।”

“তোমায় যখন সিন্ধ ডাক-এর কথা বলেছে, মনে হচ্ছে তুমিও জর্জের সেরকম একজন কাস্টমার।”

“ভেরি ফানি!” ওর ফোনটা বাজতে শুরু করায় বেভ চলে গেল।

.

আজ আবার একটা সেমিনার ছিল। সেটা শেষ হবার পর গেস্ট স্পিকারকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খেতে গেলাম। এরকম একটা অ্যারোগেন্ট লোক বেশি দেখিনি। নিজেকে কী ভাবেন কে জানে! বাকি সবার কাজ অতি বাজে, উনিই একমাত্র বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটাই আমাকে বারবার শোনালেন। আমাদের ডিপার্টমেন্ট হেড নিশ্চয় লোকটাকে হাড়ে হাড়ে চেনেন, তাই নিজে না এসে আমার মতো চুনোপুঁটিকে লাঞ্চে পাঠিয়েছেন। সেই কারণেই মনে হল গেস্ট স্পিকার আরও চটেছেন। আমি হ্যাঁ হুঁ করে যাচ্ছিলাম, কথা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। লাঞ্চের পরে ডিপার্টমেন্ট অফিসে ওঁকে পৌঁছে দিলেই আমার ছুটি। ভদ্রলোকটির একটা গুণ, খুব তাড়াতাড়ি খান। এত বকবক করেও আমার আগেই খাওয়া শেষ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কফি বা ডেসার্ট খাবেন কিনা। সংক্ষিপ্ত উত্তর, না।

লাকিলি সেই সময়ে দেবদূতের মতো হাজির হলেন আমাদের ডিন। বুঝলাম ওঁরা দু’জন পূর্ব-পরিচিত। ডিন স্পিকারমশাইকে বললেন লাঞ্চের পরে ওঁর অফিসে আসতে। সুযোগটা ছাড়লাম না। বললাম, “আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন না। প্লিজ, ওঁর সঙ্গে যান।”

একলা বসে খাওয়া শেষ করছি। পাশে চেয়ার টানার শব্দ। প্রমথ আর ফ্র্যন্সিস্কা।

“তোরা কোথায় ছিলি?”

“ওই টেবিলটাতে, প্রমথ আঙুল দিয়ে দূরের একটা টেবিল দেখাল।

“খেয়াল করিনি তো!”

“খেয়াল হবে কেন, ইউনিভার্সিটির পয়সায় লাঞ্চ খাচ্ছিস!”

“এর থেকে নিজের পয়সায় লাঞ্চ খাওয়া ভালো। হোয়াট এ জার্ক!”

“সেটা তোমার মুখ দেখেই আমরা বুঝেছি,” ফ্রান্সিস্কা হাসতে হাসতে বলল।

“নে, আমাদের কফি আর আইসক্রিম খাওয়া, প্রমথ হুকুম দিল।

“আমি খাওয়াব কেন, তোরা নিজে খা।”

“তোকে তো খাওয়াতে বলছি না, তোর ডিপার্টমেন্টের পয়সায় খাওয়াবি। লোকটাতো চা-কফি খেল না। ওর বদলে আমাদের খাইয়ে দে, কে দেখতে যাচ্ছে?”

ফ্রান্সিস্কা সরল মনের মেয়ে, প্রমথর এইসব ফাজলামি একেবারেই পছন্দ করে না। “ডোন্ট বি সিলি, আমি তোমাদের খাওয়াচ্ছি।”

“না, সেটা তো তুমি সব সময়েই খাওয়াও। আজ বাপি খাওয়াক। একেনবাবুর সঙ্গে থেকে থেকে বাপিও কৃপণ হতে শুরু করেছে।”

“ডোন্ট বি সো মিন, ডিটেকটিভ আজ সকালে আমায় কফি খাইয়েছে।” ফ্রান্সিস্কা একেনবাবুকে পছন্দ করে, ‘মাই ডিয়ার ডিটেকটিভ’ বলে সম্বোধন করে।

“সে কি, আমায় তো বলনি?”

“কারণ ডিটেকটিভ বলেছে তোমাকে না বলতে।”

“কেন?”

“সেটা ডিটেকটিভকে জিজ্ঞেস কোরো।”

“আই সি, সেটা জানলে আমাদেরও খাওয়াতে হবে। দ্যাট মেকস সেন্স।”

“নো, নট দ্যাট। হি ওয়াজ ইন এ সিক্রেট মিশন।”

“কী সিক্রেট মিশন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“সেটা বললে সিক্রেসির আর কী থাকে?”

“তার মানে তুমি জানো, কিন্তু আমরা জানি না।”

“তাই তো দাঁড়াচ্ছে।”

“আজ থেকে হি উইল হ্যাভ টু কুক বাই হিমসেলফ। আমি অন্তত বেঁধে খাওয়াব না। তুই খাওয়াবি?” আমায় জিজ্ঞেস করল প্রমথ।

“আমি নিজেই ভালো রাঁধতে জানি না।”

“ইউ গাইজ আর রিয়েলি মিন।”

“আচ্ছা, প্রমথকে না হয় নাই বললে,” আমি বললাম। “আমাকে একটা হিন্ট দাও।”

ফ্র্যান্সিস্কা একটু চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক আছে, দিচ্ছি। খুব সম্ভব, আজ বাড়ি গিয়ে দেখতে পাবে।”

“এটা একটা হিন্ট হল?” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল, “কী খুঁজব বাড়িতে?”

এমন সময় একটা পরিচিত স্বর, একেনবাবু।

“আপনি এখানে?” আমি বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম। একেনবাবু রেস্টুরেন্ট অ্যাভয়েড করেন, বড্ড বেশি খরচা হয় বলে। বাইরে খেতে হলে ইউনিভার্সিটি ক্যাফেটেরিয়ায় কিংবা পিজ্জা বা হ্যামবার্গার জয়েন্টে লাঞ্চ সারেন।

“ম্যাডাম বলেছিলেন, ওঁরা এখানে লাঞ্চ খাবেন আজ। আপনি যে থাকবেন জানতাম না।”

‘আমি এসেছিলাম বাধ্য হয়ে। কিন্তু ম্যাডামের সঙ্গে আপনার দরকারটা কী?”

একেনবাবু উত্তর দেবার আগেই ফ্র্যান্সিস্কা সস্নেহে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাজ হল ডিটেকটিভ?”

“হল না মানে? সেইজন্যেই তো সোজা এখানে চলে এলাম! এই দেখুন,” বলে আঙুল ঘুরিয়ে ফ্রান্সিস্কাকে একটা আঙটি দেখালেন।”

“এটা কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“এটার কথাই আমি বলছিলাম,” ফ্যান্সিস্কা বলল। “ওদেরও দেখিয়ে দাও।”

“এই যে স্যার, এই সেন্টারে হল প্রমথবাবুর আর্টিফিশিয়াল নীলা, আর পাশে সব সস্তা পাথর। ম্যাডামের এক বন্ধু বানিয়ে দিয়েছেন, মাত্র দশ ডলারে।”

ফ্র্যান্সিস্কা বলল, “প্রমথ ডিটেকটিভকে বলেছে ব্যাগে ওই পাথরটাকে নিয়ে ঘুরতে। হোয়াট এ সিলি অ্যাডভাইস! তাই ডিটেকটিভকে সকালবেলা আমার এক বন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ও কস্টিউম জুয়েলরি বানায়। তারপর একেনবাবুকে বলল, “ইট লুকস ভেরি নাইস, ডিটেকটিভ।”

একেনবাবু মাথা একেবারে নুইয়ে গেল। “বিকজ অফ ইউ ম্যাডাম– অল বিকজ অফ

“নেমক হারাম, মাইরি,” প্রমথ আমায় বলল। “মালটা দিলাম আমি, আরেকজন পাচ্ছে বাহবা।”

“ইট ইজ বিকজ অফ ইওর সিলি অ্যাডভাইস,” বিজয়িনীর মতো মুখ করে ফ্রান্সিস্কা বলল।

.

১৯.

শনিবার মে ২৮, ২০১১

শনিবার সকাল সকাল কলেজে গেলাম। পেপারটা নিয়ে কাজ করা ছাড়াও কিছু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজ জমে আছে। যতটা পারি সেগুলো শেষ করতে হবে। তবে বেশ কিছুটা সময় গেল অকাজ করতে। আমার দুটো ইমেল অ্যাকাউন্ট আছে। একটা কলেজের অ্যাকাউন্ট, আরেকটা আমার পার্সোনাল হটমেল আকাউন্ট। দিন সাতেক আমি আমার হটমেল খুলিনি। বেশি ইমেল ওখানে আমি পাই না। কিন্তু আজকে হটমেল-এ ঢুকে দেখি, এক গুচ্ছের ইমেল সেখানে জড় হয়েছে। যার বেশির ভাগই আমার নয়। ভুল করে আমার ইমেল অ্যাড্রেস কোনও ই-গ্রুপে ঢুকে গেছে, তাদের নানান ই-মেলে আমার মেলবক্স ভারাক্রান্ত। সেগুলো ডিলিট করার পর সেই ই-গ্রুপ থেকে কী করে মুক্তি পাওয়া যায়, সেটা উদ্ধার করতেও কিছুটা সময় গেল। এর মধ্যেই এক সিনিয়র কলিগ ঘর খোলা দেখে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ ডিপার্টমেন্ট হেড-এর শ্রাদ্ধ করে গেলেন। যতটা কাজ করতে পারব ভেবেছিলাম, তা আর হল না। রবিবারেও আবার আসতে হবে। একেনবাবু এরমধ্যে ফোন করলেন। প্রমথ ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে উইক-এন্ড কাটাচ্ছে, সুতরাং বাড়িতে কুকিং ফ্রন্ট সামলানোর কেউ নেই, নিজেদের চরে খেতে হবে। একেনবাবু একটা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের খোঁজ পেয়েছেন লেক্সিংটন অ্যাভেনিউয়ে। মাছের ঝোল আর ভাত পাওয়া যায়। খাঁটি বাঙালি স্টাইল, খুব রিজনেবল প্রাইসে। শুধু আগে থেকে জানিয়ে রাখতে হয়। সেটা জানিয়ে রেখেছেন আপত্তি করব না ধরে নিয়ে। আমার বাঙালি বা ইন্ডিয়ান খাবার না হলেও চলে, কিন্তু একেনবাবু সবসময়েই হা-হুঁতাশ করেন ওগুলো জুটছে না বলে।

.

খাবার দোকানটা যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমাদের জন্য স্পেশাল অর্ডার, সর্ষে দিয়ে ইলিশ মাছ, যা দেখলাম মেনুতে নেই। অনেকটা ঝোল ভাতে মেখে এক গ্রাস মুখে তুলে একেনবাবু বললেন, “আঃ! যাই বলুন স্যার, সর্ষে-ইলিশের বিকল্প নেই, পৃথিবীর বেস্ট খাবার।”

‘সায়েবদের খাওয়ানোর চেষ্টা করে দেখুন না, ঝাঁঝের চোটে চোখের জলে নাকের জলে হবে।”

“ওঁদের স্যার, টেস্ট ডেভলপ করেনি।”

“বুঝলাম, তা এই কথাটা আপনার বন্ধু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে কখনো বলেছেন?”

“কী যে বলেন স্যার, এটা কি বলা যায়!”

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের প্রসঙ্গে আরও অনেক কথা এসে গেল। একেনবাবু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে আজ দেখা করেছেন বব ক্যাসেলের ব্যাপারে। পুলিশ খুন হবার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়নি, কিন্তু এখন পর্যন্ত সুইসাইড বলেই ভাবছে। এটা ভাবার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। একটা কারণ তো আমরা জানি, মায়ের চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করার দুশ্চিন্তা। যেটা জানতাম না, সেটা হল, মানসিক ভাবে বব এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে কয়েক সপ্তাহ আগে ডাক্তার দেখিয়ে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট খাচ্ছিলেন। এটা পুলিশের কাছে একটা ক্রিটিক্যাল ইনফরমেশন। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট খেলে প্রথম দিকে সুইসাইডের টেন্ডেন্সি দেখা দিতে পারে, এদেশের ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এটাই সাবধানবাণী। মিশেল ক্যাসেলের অ্যানসারিং মেশিনে ববের ফোন মেসেজের সঙ্গে যদি এই তথ্যটা যোগ করা যায় তাহলে সুইসাইড থিওরির পাল্লাই ভারী হয়।

এগুলো শুনে খারাপ লাগল। ভেবেছিলাম পুলিশি অনুসন্ধানে হয়তো কোনও ফাঁক থাকবে। বললাম, “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ক্যাথি ক্যাসেলের কেসটা একেবারেই হোপলেস।”

“তাই তো দাঁড়াচ্ছে স্যার। শুধু একটা ইন্টারেস্টিং খবর, মিস্টার ক্যাসেল আর অশোকবাবু ভালো বন্ধু ছিলেন।”

“কিন্তু সেটা তো ইন্দ্র আর সতীশ দুজনেই বলেছিলেন?”

“হ্যাঁ, সেটাই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট কনফার্ম করলেন। “শুধু তাই নয় স্যার, অশোকবাবু মারা যাবার দিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ শুধু দু’জনকে ফোন করেছিলেন, মিস সীমা আর মিস্টার ক্যাসেলকে।”

“সেটা তো আগেই শুনেছেন সীমা আর সতীশ কুমারের কাছ থেকে। পুলিশ কী করে জানল, মোবাইল ফোনের রেকর্ড দেখে?”

“রাইট স্যার।”

“কী বলেছিলেন ফোনে?”

“মিসেস সীমাকে কী বলেছিলেন সেটা তো আমরা জানি। মিস্টার ক্যাসেলকে কী বলেছিলেন পুলিশ এখনও বার করতে পারেনি।”

“দ্যাট ইজ ইন্টারেস্টিং! পুলিশ তাহলে ববকে কী জেরা করল?”

“তা তো বলতে পারব না স্যার। পুলিশ তখন হয়তো এই ফোনের কথাটা জানত না।”

“কিন্তু বব তো জানত?”

“দ্যাট ইজ পাজলিং স্যার। এক হতে পারে মিস্টার ক্যাসেল তখনও জানতেন না মেসেজটা কী। সতীশবাবু বললেন না, ওঁর ভয়েস মেল রিট্রিভ করতে পারছিলেন না।”

“হয়তো মেসেজটা রিট্রিভ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি, অথবা ইচ্ছে করেই জানাননি।”

“তাও সম্ভব স্যার।”

“আপনি কী সন্দেহ করছেন, অশোক আর ববের মৃত্যুর মধ্যে কোনও যোগ আছে?”

“না স্যার, তা বলছি না। মিস্টার ক্যাসেল হয়তো সুইসাইউহ করেছেন। তবে খবরটা জানতে পেলে অশোকবাবুর মৃত্যুর কারণ হয়তো কিছুটা আঁচ করা যেত। যাক সে কথা, আপনি কী করলেন স্যার সারাদিন?”

“কোনও এক্সাইটিং কাজ নয়, ইমেল ডিলিট করেই কাটল।”

“কেন স্যার, আপনি সব ইমেল জমিয়ে রাখেন?”

ব্যাপারটা একেনবাবুকে বোঝাতে হল। একেনবাবু আজকাল ইন্টারনেট, ইমেল ব্যবহার করেন ঠিকই, কিন্তু কোনও ই-গ্রুপ বা লিস্টসার্ভ-এ ঢোকেননি। কিছু কিছু ই-গ্রুপে কী অজস্র ই-মেল প্রতিদিন চালাচালি হয়, সে ধারণা ওঁর নেই। তবে এসব বিষয়ে জানার আগ্রহ ওঁর প্রচুর।

জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, প্রমথবাবু সেদিন একটা অটোম্যাটিক ফরোয়ার্ডিং সিস্টেমের কথা বলছিলেন। সেটা করলে নাকি আমার জি-মেল-এর অ্যাকাউন্টে কেউ ইমেল পাঠালে অটোম্যাটিক্যালি সেটা আমার হটমেল অ্যাকাউন্টে চলে যাবে!”

“তা যাবে, যদি আপনার অ্যাকাউন্ট সেটিং সেভাবে করেন।”

“তাহলে স্যার, আপনি কলেজের অ্যাকাউন্টটা সে ভাবে সেট করলেন না কেন? সেখানকার সব ইমেল অটোমেটিক্যালি আপনার হটমেল অ্যাকাউন্টে চলে যেত। হটমেল এ ঢুকলেই আপনি সব ইমেল পেয়ে যেতেন, এদিক ওদিক করতে হত না।”

“আমাদের ইউনিভার্সিটিতে সেটা করা যায় না। আমার ধারণা বড় বড় কোনও কোম্পানিতেই সেটা করতে দেওয়া হয় না।”

.

২০.

সোমবার, মে ৩০, ২০১১

কিশোরের তামিলনাড়ুর ডিজি কাকা গতকাল নিউ ইয়র্কে এসেছেন। আজ বিকেলে কিশোরের কাছে আসবেন। কিশোর আমাকে ডিনারে ডেকেছে। আমাকে বুঝিয়েছে ওর কাকা ফিজিক্সের ছাত্র ছিলেন, আমার মতো একজন ফিজিক্সের অধ্যাপকের সঙ্গ ওঁর ভালো লাগবে। হোয়াট এ লেইম এক্সকিউজ! আসল কারণ বেভ যাচ্ছে, বেভের পরিবহন সমস্যা মিটবে। কিশোর থাকে নিউ জার্সির ক্লার্ক বলে একটা শহরে। গাড়ি না থাকলে বার দুই বাস চেঞ্জ করে যেতে হয়। নিঃসন্দেহে একটা হ্যাঁ। উইক-ডে বা কাজের দিনে এক ঘণ্টা ঠেঙিয়ে কোথাও ডিনার খেয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফেরা আমার ধাতে পোষায় না। কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে রাজি হতে হয়েছে। বিশেষ করে আমার যাওয়ার উপর যখন ওর ভাবি বধূর যাওয়া নির্ভর করছে।

.

আমার গাড়িটা ইউনিভার্সিটির কাছেই একটা গ্যারাজে থাকে। তাই ঠিক করলাম ইউনিভার্সিটি থেকে আর বাড়ি ফিরব না, সেখান থেকেই সোজা কিশোরের কাছে চলে যাব।

বেভ দেখলাম খুব এক্সাইটেড। এরমধ্যেই যাবার লজিস্টিক্স নিয়ে বার কয়েক আলোচনা করে গেছে, অথচ এটা কোনও ব্যাপারই নয়। বেভ ইউনিভার্সিটির কাছেই থাকে। এখান থেকে যদি নাও যায়, স্বচ্ছন্দে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারি। দেখলাম ও মনঃস্থির করতে পারছে না। প্রথম বার বলল, বাড়ি থেকে যাবে। তারপর ঠিক করল বাড়ি না, অফিস থেকেই যাবে। তৃতীয় বার যখন আমার ঘরে ঢুকে বলল, “আমাকে তুমি বাড়ি থেকেই তুলে নিও, আমি আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব।” আমি ঠাট্টা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম, “তুমি খেয়াল করেছ, এই চার মাসে তোমার সঙ্গে যা কথা হয়েছে তার থেকে বহুগুণ বেশি কথা হয়েছে, এই ক’দিনে।”

“ইয়েস, আই নোটিস্ট।”

“এত বেশি কথা হলে কিশোর রেগে যাবে।”

“ও, দ্যাট উইল বি ফান, লেট আস ডু সামথিং টু মেক হিম জেলাস, প্লিজ প্লিজ!” পাগলাকে বলেছি সাঁকো না নাড়তে! কী বিপদ!

.

বেভ যেখানে থাকে আমার গ্যারাজ থেকে সেখানে পৌঁছতে মিনিট পাঁচেকও লাগে না। বেভ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। দেখলাম বেশ সুন্দর লম্বা হাল্কা সবুজ রঙের ইভনিং ড্রেস পরেছে। কানে সবুজ পাথরের দুল, আর ম্যাচিং হার। হাতে কালো সেকুইনের ব্যাগ, কিশোরের দেওয়া উপহার।”

গাড়িতে উঠে বেভ আমায় জিজ্ঞেস করল, “ডু আই লুক রেস্পেক্টেবল?”

“খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।”

“কিশোর বলেছে ওর আঙ্কল একটু কনসার্ভেটিভ।”

“আমি সিওর তুমি ওকে কুপোকাত করবে।”

“ইউ থিঙ্ক সো?”

“ইয়েস, শুধু তোমায় পার্সোনাল প্রশ্ন করতে চাইলে, আমায় প্রথম দিন যা বলেছিলে, সেটা যেন না বল।”

“হোয়াট ডিড আই সে টু ইউ?”

“ফরগেট ইট।”

“না সিরিয়াসলি, কী বলেছিলাম তোমাকে?”

“তোমার সেক্সলাইফ সম্পর্কে কোনও প্রশ্নের উত্তর আমায় দেবে না।”

“আই সি। তুমি বলছ, সেটা না বলে খোলাখুলি উত্তর দেওয়া উচিত।” বলেই এক ঝলক হেসে ঠিক সেদিনের মতো আমার হাতে আলতো করে একটা চাপ দিয়ে বলল, “জাস্ট কিডিং।”

.

কিশোরের আঙ্কল প্রভাকর রাওর হাবেভাবে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, উনি একজন বড় অফিসার। কিশোর দেখলাম ওঁকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। আমরা ঢাকার একটু আগেই বিয়ার অফার করে কিশোর ধমক খেয়েছ তারই জের চলছে। আমেরিকায় মুখে দেবার মতো নাকি কোনও বিয়ার তৈরি হয় না। সত্যিকারের বিয়ার শুধু জার্মানি আর অস্ট্রিয়াতেই মেলে। ইনফ্যাক্ট আমেরিকায় পাতে দেবার মতো কোনও স্পিরিটও তৈরি হয় না। তার জন্যে ইউরোপ যেতে হবে। বেচারা কিশোর! বিয়ার রেখে এসে ব্ল্যাক লেবেলের একটা বোতল নিয়ে আসতেই সেটার দিকে একটু হেলা ভরে তাকিয়ে বললেন, “ব্লেন্ডেড চলবে না, সিঙ্গল মল্ট কিছু আছে?”

.

প্রভাকর রাও গল্প করতে ভালোবাসেন, গল্পের মূল বক্তব্য সব সময়েই আমি আর আমি। পুলিশ মেডেল পাওয়া থেকে শুরু করে, রাজীব গান্ধীর সঙ্গে হ্যান্ডশেক, সন্ত্রাসবাদী এক নেতাকে (নামটা আর করলাম না) তার লুকোনো ডেরাতে গিয়ে অ্যারেস্ট করা, বলিউডের এক অভিনেত্রীকে কেচ্ছার হাত থেকে বাঁচানো, কুখ্যাত এক ডাকাতকে খালি হাতে ধরা– দীর্ঘ পুলিশ জীবনের নানান কীর্তিকাহিনি আমাদের শোনালেন। শুধু ফিজিক্স নিয়েই কোনও আলোচনা করলেন না। একেবারে প্রথমে বেভের পরিবারের একটু খবরাখবর করেছিলেন। বাবা প্লাম্বার শুনে মনে হল বেশ আশাহত। আমাদের দেশে কলের মিস্তিরিদের সামাজিক বা আর্থিক অবস্থা কোনওটাই উচ্চ নয়। এদেশে একজন প্লাম্বার আমার থেকে বেশি রোজগার করে সেটা আমি জানি। উনি জানেন কিনা জানি না। জানলেও মনোভাবের পরিবর্তন হত না হয়তো। এর পর থেকে বেভকে পুরো উপেক্ষা করে সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে গল্প করে গেলেন। আমার একটু খারাপই লাগছিল। মাঝে মাঝে বেভকে ওঁর গল্পের সোশাল আর কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড দেবার চেষ্টা করছিলাম। খানিকক্ষণ পরে বেভ নিজেই ‘এক্সকিউজ মি’ বলে উঠে চলে গেল রান্নাঘরে কিশোরকে সাহায্য করতে।

.

আঙ্কলকে ইমপ্রেস করার জন্যেই বোধহয় কিশোর বহু পদ করেছে। সবগুলোই যে দারুণ হয়েছে দেখে মনে হচ্ছে না, কিন্তু যেহেতু অনেক চয়েস আছে, বাছবিচার করে খেলে উপাদেয় খাবারেই পেট ভরানো হয়তো যাবে। ঘড়িতে দেখলাম রাত প্রায় সাড়ে দশটা। আমি সাধারণত সাতটার মধ্যেই ডিনার খেয়েনি। আমার ধারণা কিশোরও তাড়াতাড়ি খায়। কিন্তু মিস্টার প্রভাকর রাও রাত দশটা এগারোটার আগে খেতে বসেন না। কিশোর দুয়েকবার খাবার প্রসঙ্গ তোলায় উনি একটু বিরক্ত হয়েই বলেছেন, এত তাড়াতাড়ি কেন?’ শেষে আমিই কিশোরকে বলেছি, আমায় এবার উঠতে হবে। নইলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা হয়ে যাবে। বেভের মুখ দেখে মনে হল ও-ও পালাতে পারলে বাঁচে। বলল, “ইয়েস, উই শুড লিভ সুন।”

এরপর কিশোর আর অপেক্ষা করেনি, টেবিলে খাবার নিয়ে এসেছে। মিস্টার রাওর বোধহয় আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমরা খেতে বসে যাচ্ছি দেখে উনিও এসে বসলেন।

খাওয়ার মাঝখানে প্রভাকর কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন, সকাল ন’টায় ম্যানহাটানে ওঁর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। কতক্ষণ লাগবে ওখানে যেতে।

কিশোর উত্তর দিল, “ওই সময়টাতে লিঙ্কন টানেলে একটু জ্যাম হয়, ঘণ্টা দেড়েকের বেশিই লাগবে। ম্যানহাটানের কোথায় যাবেন?”

“নিউ হেরিটেজ হোটেলে। হোটেল মালিকের সঙ্গেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট।”

আমার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল, “আপনি দেবরাজ সিং-এর সঙ্গে দেখা করছেন?”

“ইয়েস, তুমি ওকে চেন?”

“একবার মিট করেছি। আমার এক ডিটেকটিভ বন্ধুর কাছে এসেছিলেন, ওঁর একজন স্টাফকে কে মার্ডার করেছে, সেটা তদন্ত করার জন্যে।”

“তুমি অশোক দুবের কথা বলছ?”

এবার আমার অবাক হবার পালা, “আপনি অশোককে চেনেন?”

“ওর বাবাকে খুব ভালো করে চিনি। প্রকাশ দুবে যখন ত্রিচি জেলের জেলার ছিলেন তখন ওখানে আমার পোস্টিং হয়। অশোককে দেখেছি ওর বাচ্চা বয়স থেকে। হোয়াট এ ট্র্যাজেডি!”

“দেবরাজ সিং-কেও কি অশোকের সূত্রেই চেনেন?”

“নট এক্সাক্টলি। কিছুদিন আগে এক আমেরিকান দেবরাজ সিং-এর ত্রিচি হোটেলে খুন হয়। আমার লোক ওখানে গিয়ে দেখে হোটেল সিকিউরিটিতে অনেক ফাঁক-ফোকর ছিল। ব্যাড পাবলিসিটি এড়াতে দেবরাজ পরের দিনই চলে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে। সিকিউরিটি জোরদার করার ব্যাপারে আমার অনেক অ্যাডভাইসও নেয়। তখনই আমায় বলে নিউ ইয়র্কে এলে আমি যেন ওর হোটেলে উঠি। আমি অবশ্য ওর হোটেলে উঠিনি, কিন্তু প্রকাশ দুবে একটা কাজ দিয়েছিলেন, সেইজন্যে কাল ওকে ফোন করেছিলাম। তখনই আমাকে ধরল ওর হোটেলে একবার আসতেই হবে। আমাকে নিউ ইয়র্ক ঘুরিয়ে বিকেলে প্লেনে তুলে দেবে।”

এ ব্যাপারে আমার কোনও ঔৎসুক্য প্রকাশ করা উচিত নয়, কিন্তু অশোক দুবের প্রসঙ্গ এসে পাড়ায় জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু মনে করবেন না, কাজটা কি অশোক সংক্রান্ত?”

“রাইট। অশোক লাখ দুই টাকা জোগাড় করছিল একটা স্কুলের জন্যে। এইটুকুই মিস্টার দুবে জানতেন। কিন্তু কোন স্কুলের জন্যে এই টাকাটা তুলছিল, সেটা জানতেন না। উনি নিজে এখন ওই টাকাটা দান করে ছেলের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে চান। কিন্তু কাকে দেবেন সেটাই জানেন না। মনে হল, দেবরাজ যদি এ ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারে। বাই দ্য ওয়ে, তোমরা এ ব্যাপারে কিছু জানো?”

“না, কিছুই জানি না। এটুকু জানি যে, উনি হাজার দশেক ডলার তোলার চেষ্টা করছিলেন। একটু খোঁজ খবর করে দেখতে পারি।”

“দেখ তো। মিস্টার দুবে একজন চমৎকার লোক। বহুদিন অবশ্য ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। জন হেক্টারের ব্যাপার নিয়ে হঠাৎ বহুদিন বাদে দেখা হয়।”

“জন হেক্টার!”

“হ্যাঁ, যে আমেরিকানটি খুন হয়।”

“উনিও কি মিস্টার দুবের বন্ধু ছিলেন?”

“তুমিও তো দেখি রিপোর্টারদের মতো প্রশ্ন শুরু করছ?” প্রভাকর রাও বললেন।

“আই অ্যাম সরি। ব্যাপারটা হল আমার বন্ধু একেনবাবু অশোকের মার্ডার নিয়ে তদন্ত করছেন। তাই অশোক সম্পর্কে কোনও খবর পেলে আমারও ইন্টারেস্ট লেগে যায়।”

প্রভাকর রাও বললেন, “এটা কিন্তু অশোকের ব্যাপার নয়, অশোকের বাবার। তদন্তে বের হয় যে, হেক্টার প্রকাশ দুবেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল কল্পনা নামে একটি মেয়ের খোঁজখবর নিতে। ইন সেভেন্টিস শি গট কনভিক্টেড ইন এ মার্ডার কেস। কল্পনাকে নিয়ে একটা বই বা আর্টিকল লিখতে হেক্টার মালমশলা সংগ্রহ করছিল। কল্পনা মারা গেছে বহুদিন হল। মিসেস দুবেও মেয়েটিকে চিনতেন। মিসেস দুবে অবশ্য এ নিয়ে হেক্টারের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি, প্রকাশও দেখা করেননি।”

“হেক্টারের খুনি কি ধরা পড়েছে?”

“এখনও পড়েনি, তবে তদন্ত চলছে। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়বেই– পালাবে কোথায়?”

.

খাওয়া দাওয়ার পর আর বসলাম । ফেরার পথে বেভ বলল, “আই ডোন্ট থিঙ্ক হি লাইকড মি।”

আমি প্রভাকর রাওকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলাম না। বললাম, “যেটা মোস্ট ইম্পর্টেন্ট, সেটা হল কিশোর তোমাকে ভালোবাসে।”

“কেন আমাকে ওঁর পছন্দ হল না বলতে পার?”

“পছন্দ হল না ভাবছ কেন, এক একজন লোক এক এক ভাবে রিয়্যাক্ট করে।”

“উনি তো আমার দিকে তাকাচ্ছিলেনও না!”

“আমিও তো তোমার দিকে বহুদিন ভালো করে তাকাইনি।”

“কারণ আমাকে তুমি হেট করতে।”

“দ্যাট্‌স নট ট্রু।”

বেভ হঠাৎ চুপ করে গেল।

“আর ইউ ওকে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ইয়েস, আই অ্যাম।”

.

এক একটা সময় আসে, যখন কথা না বলাই ভালো। এটা সেরকম একটা সময়। যখন ওর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ ঘুরে আমার গলা জড়িয়ে ধরে গালে প্রায় ঠোঁটের কাছে চুমু খেল। একটা আবছা সুগন্ধের ঝলকা নাকে এল। এত দ্রুত ঘটল ব্যাপারটা যে আমি একটু হতচকিত।

“থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্য রাইড।”

“ইউ আর ওয়েলকাম।”

আমি নেমে ওর দরজা খুলে দেবার আগেই নিজেই দরজা খুলে ঝটিতি নেমে গেল।

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত