২১.

মঙ্গলবার মে ৩১, ২০১১

ঘুম থেকে উঠতেই প্রমথ বলল, “কোথায় ছিলি কাল রাত্রে, ডঃ দাস তোকে ধরার চেষ্টা করছিলেন।”

ডঃ বিমল দাস কলাম্বিয়াতে ইকনমিক্স পড়ান, খুব সিনিয়র লোক। ওঁর বড় মেয়ে ডাক্তার, অনেকদিন বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটো মেয়ে ইন্দ্রাণী প্রায় আমাদের বয়সি। এমবিএ করে একটা কোম্পানিতে ভালো চাকরি করছে।

“কই আমি তো কোনও ফোন পাইনি!”

“কারণ তোর ফোন অফ ছিল। তোর ফোন অফ রাখার হ্যাবিটটা গেল না। মোবাইল ফোন রেখেছিস কেন?”

এ অভিযোগটা আমি অস্বীকার করতে পারি না। মিটিং বা সেমিনার থাকলে অনেক সময় ফোনটা বন্ধ করে রাখি, পরে চালু করতে ভুলে যাই।

“কেন ফোন করেছিলেন জানিস?”

“ডিনারে নেমন্তন্ন করার জন্যে।”

“কবে ডেকেছেন?”

“এই শুক্রবার।”

“তার মানে তো তোরশু, এত শর্ট নোটিস?”

“আমার ধারণা কেউ বোধহয় শেষ মুহূর্তে ক্যানসেল করেছে, তাই আমরা চান্স পেয়েছি।”

“এমনি ডাকছেন, না কোনও বিশেষ কারণে?”

“তুই ফোন করে জিজ্ঞেস কর না, মনে যখন প্রশ্ন জেগেছে?”

“স্টুপিডামো করিস না। যখন ফোন করলেন, তখন নেমন্তন্নের কারণটা জানতে চাইলি না! হয়তো বিবাহবার্ষিকী বা ওই ধরনের কিছু। সেই মতো একটা গিফট তো নিয়ে যেতে হবে।”

“বিগ ডিল। একটা ওয়াইনের বোতল নিয়ে যাব, চুকে যাবে।”

“ব্যাড আইডিয়া”, বলে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কী মত?”

একেনবাবু সোফার এক কোনে চোখ আধ বোজা করে কিউটিপ দিয়ে কান চুলকোচ্ছিলেন। আমার প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে বললেন, “আমার আবার কী মত স্যার, আপনাদের মত-ই আমার মত।”

“সেইজন্যেই তো আপনাকে প্রশ্ন করা, আমাদের তো মতের মিল হচ্ছে না।”

“তাহলে তো মুশকিল হল স্যার,” একেনবাবু কিউটিপটা কান থেকে বার করে বললেন, “কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল?”

“আপনি মশাই সামথিং, কোন জগতে থাকেন?” প্রমথ একটা ধমক লাগাল।

একেনবাবু অসহায় মুখ দেখে আমি বললাম, “ডঃ দাস শনিবার ডিনারে নেমন্তন্ন করেছেন, ওঁদের জন্য কী নিয়ে যাব, সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে।”

“এবার বুঝলাম স্যার, তা আপনি কী বলেন?”

“আমি বলেছি, কেন ডেকেছেন সেটা আগে জানা দরকার। তারপর গিফট কেনার কথা ভাবা যাবে।”

“এ তো স্যার খুবই যুক্তিযুক্ত কথা।” আমার কথায় সায় দিয়ে প্রমথকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন স্যার, এটা আপনি মানেন না?”

“খুবই মানি, কিন্তু বাপি ফোন করে নেমন্তন্নের কারণটা জানতে রাজি নয়।”

“তাহলে তো স্যার মুশকিল।”

“এক কাজ করুন না, আপনি তো একজন গোয়েন্দা–কেন ডেকেছেন, সেই রহস্যটা ভেদ করুন।”

.

ভাগ্যক্রমে ঠিক এই সময়ে অ্যান্ডি গুহর ফোন এল। অ্যান্ডির আসল নাম অনিন্দ্য, এখানে এসে ওটাকে অ্যান্ডি বানিয়ে নিয়েছে। কলকাতায় আমাদের সঙ্গেই কলেজে পড়ত। তারপর সিপিএ করে একটা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম খুলেছে। সেই সঙ্গে ডাঃ দাসের ছোটো মেয়ে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে প্রেম করছে। অ্যান্ডির কাছে নেমন্তন্নের কারণটা জানা গেল। ডাঃ দাসের এক ভাইপো কয়েকদিন আগে নিউ ইয়র্কে এসেছে। আমাদের ইউনিভার্সিটির ম্যাথম্যাটিক্স ডিপার্টমেন্টে অ্যাডমিশন পেয়েছে। ওর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যেই এই নেমন্তন্ন।

অ্যান্ডি অবশ্য ফোন করেছিল অন্য কারণে। ও ইন্ডিয়া যাবে, ভালো একজন ট্র্যাভেল এজেন্ট খুঁজছে। প্রমথকে মুরুব্বি ঠাউরেছে। প্রমথ নানান ব্যাপারে খোঁজখবর রাখে ঠিকই, কিন্তু যা জানে তার থেকেও বেশি বিজ্ঞতা জাহির করে।

.

২২.

শুক্রবার জুন ৩, ২০১১

ডাঃ দাসের বাড়িতে আজ বাইরের কেউ নেই। আমরা তিনজন, ডাঃ দাস আর মিসেস দাস, অজয় (ডাক্তার দাসের ভাইপো) আর ইন্দ্রাণী। সাধারণত ওঁদের বাড়ির পার্টিতে অসংখ্য অতিথি আসে। তাঁদের সামাল দিতে ওঁরা হন্তদন্ত থাকেন, কথা বলার তেমন ফুরসত থাকে না। আজকে এই প্রথম রিল্যাক্সড হয়ে বসে আমাদের সঙ্গে দু’জনে গল্প করলেন। ডাঃ দাস গল্প করতে ভালোবাসেন, তবে মাঝেমাঝেই স্থান কাল পাত্র একটু গুলিয়ে ফেলেন। মিসেস দাসের একেবারে স্টিল ট্র্যাপ মাইন্ড, সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে থাকে। স্ত্রী ভুল ধরিয়ে দিলে আবার হেসে ফেলেন। ‘আঃ ডিটেলস নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন, গল্পের রসটা তো ঠিকই আছে।’ মিসেস দাস তখন ধমক দেন, ‘একজনের কথা আরেকজনের ঘাড়ে চাপাচ্ছ, ওরা তো তোমাকে চেনে না, লোকদের ভুল বুঝবে।’

.

খানিকবাদে অ্যান্ডিও এল। কথায় কথায় বেরল যে মিসেস দাস প্রমথর মাকে চিনতেন। এরপর যা হয় শুরু হল– একে চিনি কি না, ওকে চিনি কি না। ডাঃ দাস বহু লোককে চেনেন, যাঁদের ব্যক্তিগত ভাবে না চিনলেও নামে চিনি। শুধু চেনেন তাই না, অনেকের সঙ্গে ওঁর যথেষ্ট বন্ধুত্বও আছে। বহু সেলিব্রেটি নিউ ইয়র্কে এসে ওঁর বাড়িতে থেকে গেছেন শুনলাম। তবে সবচেয়ে অবাক হলাম যখন শুনলাম উনি বিপাশা মিত্রের বাবা সুজয় মিত্রকে চিনতেন। কথাটা অবশ্য উঠল ওঁর বন্ধুদের মধ্যে কতজন দেয়ালে ছবি হয়ে গেছেন সেই প্রসঙ্গে।

“বুঝলে, আমার এখন লাস্ট অয়েল চেঞ্জ চলছে,” ডাঃ দাস বললেন।

“তার মানে কী স্যার?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

“গাড়ির মাইলেজের সঙ্গে যদি মানুষের জীবন তুলনা কর, এক হাজার মাইল হচ্ছে এক এক বছর, তাহলে বড় জোর আর বছর দশেক বাকি আছে আমার জীবনের। পরের অয়েল চেঞ্জের সময় আসার আগেই গাড়ি বিকল।”

“বাবা, তুমি এত বাজে কথা বলতে পার, ইন্দ্রাণী রাগ করল।

“আরে, আমার চেনা জানার সংখ্যা তো প্রতি বছর কমছে। এ বছরই তো দু’জন মারা গেল।” তারপর আঙ্গুল গুণে গুণে কে কে মারা গেছে শুরু করলেন। ইন্দ্রাণী রাগ করে অ্যান্ডিকে নিয়ে অন্য একটা ঘরে চলে গেল। ডাঃ দাস যখন মোটর অ্যাকসিডেন্টে রিয়েল এস্টেট কিং সুজয় মিত্রের মৃত্যুর কথা বললেন, তখন প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি বিপাশা মিত্রের বাবার কথা বলছেন?”

“ও ছাড়া আর কে রিয়েল এস্টেট কিং আছে?”

“আপনার সঙ্গে ওঁর কী সূত্রে পরিচয়?”

“সে এক দীর্ঘ কাহিনি।” তারপর মিসেস দাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মনে আছে?”

“থাকবে না, প্রিয়াঙ্কার সেকেন্ড বার্থডে ছিল।”

“এক্সাক্টলি, ১৯৭৪ সালের পয়লা নভেম্বর।”

“তোমার মাথাটা একেবারে গেছে, নিজের মেয়ের জন্মদিন মনে রাখতে পার না। ১৯৭৪ নয়, ১৯৭৫।”

“আরে যাহা বাহান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন। মোটকথা বহুদিন আগে, আমরা তখন দিল্লীতে। মেয়ের জন্মদিনে বেশ কয়েকজন বন্ধুকে ডেকেছিলাম। তখন ধ্রুবর সঙ্গে সুজয় মিত্র এসেছিল।”

“ধ্রুব নয়, বিজনবাবুর সঙ্গে।”

“ওই হল। বিজনের বাড়িতে উনি গেস্ট ছিলেন। বাড়িতে একা না রেখে বিজন ওকে নিয়ে এসেছিল, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নিউ ইয়র্কের এক বিজনেসম্যান হিসেবে। বেশিক্ষণ অবশ্য ছিল না। সুজয় তার পরের দিন নিউ ইয়র্ক ফিরে যাচ্ছে। ওরা চলে যাবার পর আমরা হাসাহাসি করছিলাম বিজনের সঙ্গেই সব বিজনেসম্যানদের বন্ধুত্ব বলে।”

মিসেস দাস ব্যাপারটা বিশদ করলেন, “বিজনবাবু ছিলেন কাস্টমসের একজন বড় অফিসার। কিন্তু সেটার জন্যে নয়, সুজয় ছিলেন বিজনের দূর সম্পর্কের ভাই।”

“এর কয়েক মাস বাদে আমি কলাম্বিয়াতে পড়াতে আসি। তখন বিজনের সূত্রেই নতুন করে সুজয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ওর বিয়েও আমরা অ্যাটেন্ড করেছি।”

“সেকেন্ড বিয়ে,” মিসেস দাস বললেন।

“ওঁর প্রথম স্ত্রীকে কি স্যার আপনারা দেখেছেন?”

“না,” মিসেস দাস উত্তর দিলেন। তিনি মারা যাবার পর উনি ইন্ডিয়া যান। গল্প করতে করতে একবার বলেছিলেন, দুঃখ ভুলতে মেয়েকে বাবার কাছে রেখে মাস কয়েক ইন্ডিয়াতে গিয়ে ছিলেন।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার, আমি জানতাম না ওঁর সঙ্গে ইন্ডিয়ার এত যোগাযোগ ছিল,” একেনবাবু বললেন।

“মনে হয় না তেমন ছিল বলে,” ডাঃ দাস বললেন। “এর পরে তো আর কখনো যায়নি।”

.

২৩.

শনিবার জুন ৪, ২০১১

সকালে বিপাশা মিত্রের ফোন এল। একেনবাবু ছিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর কাজটা কী রকম এগোচ্ছে?

“উত্তরটা একেনবাবু ভালো দিতে পারবেন,” আমি বললাম, “তবে কাজ চলছে আমি জানি।”

“ঠিক আছে, আমায় ফোন করতে বলবেন।” বলে ফোন ছেড়ে দিলেন।

একেনবাবু আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরলেন। প্রমথ বলল, “কী মশাই, গায়ে হাওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছেন, আর বিপাশার হ্যাপা সামলাতে হচ্ছে বেচারা বাপিকে!”

“ম্যাডাম ফোন করেছিলেন বুঝি?”

“হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করলেন ফটো চুরির ব্যাপারটার ফয়সালা হয়েছে কিনা।”

একেনবাবু সোফায় বসে প্রমথকে বলল, “একটু কফি পেলে স্যার আলোচনা করা যেত।”

“বেশ তো বানিয়ে নিন না। জল আছে, কফি আছে, দুধ-চিনি সবই আছে।”

“তা বানানো যায় অবশ্যি।”

“আপনি বসুন, আমি বানাচ্ছি।” বলে আমি উঠতে যাচ্ছি, “থাক,” বলে প্রমথ আমায় থামিয়ে দিল। “তুই বানালে ওটা গেলা যাবে না।”

.

কফি খেতে খেতে একেনবাবু বললেন, “ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য দিলেন স্যার। ইন্দ্রবাবুদের পোকার টিমের এড গুয়ান্সিয়াল এক কালে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যাম্বলিং জয়েন্ট চালাতেন। ইল্লিগ্যাল গ্যাম্বলিং-এর কারবার চালাবার জন্যে কিছুদিন জেল খেটেছিলেন। তার মানে মিস সীমার অবসার্ভেশন খুব একটা ভুল নয়।”

“এরকম একটা লোককে দেবরাজ সিং চাকরি দিলেন! আই অ্যাম রিয়েলি সারপ্রাইজড,” প্রমথ বিস্ময় প্রকাশ করল।

“জেল-খাটা লোকদেরও তো কাজ করে খেতে হবে স্যার। উনি নাকি এখন খুব ভালো কুক। জেলে থাকতে থাকতেই ফ্রেঞ্চ রান্না শিখেছিলেন। এ দেশের জেলে তো এসব অনেক ট্রেনিং পোগ্রাম আছে।”

“গ্যাম্বলিং-এর হ্যাবিট তো লোকটা ছাড়েনি। সম্ভবত অশোককেও নেশাটা ধরিয়েছিল।”

“কিন্তু স্যার, অশোকবাবু তো এই পোকার খেলার দলে ছিলেন না?”

“এক দিন তো খেলেছিল আর জিতেও ছিল। তাছাড়া আপনি কেন ভাবছেন গুয়ান্সিয়ালের ওই একটাই ঠেক ছিল? জুয়ারিরা কি সপ্তাহে এক দিন খেলেই সন্তুষ্ট থাকে? আমি শিওর অন্য জায়গাতেও আসর বসাত। সেখানে অশোক থাকতে পারে না?”

এটা মন্দ বলেননি, স্যার। সেইজন্যেই ইন্দ্রবাবুর পোকার টিমের তিনজন –মিস্টার এড, শেখরবাবু আর মিস্টার জিমের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।”

“কবে বলবেন?”

“আজ বিকেলে। আমি ইন্দ্রবাবুকে ফোন করে জেনেছি সবাইকে আজ বিকেলে হোটেলে পাব।”

“তা তো বুঝলাম, তারা কথা বলবে?”

“তা বলবেন, স্যার। দেবরাজবাবু সবাইকে কো-অপারেট করতে বলেছেন।”

“গুড,” আমি বললাম।” এবার বলুন, চুরির ব্যাপারে বিপাশাকে কী বলবেন?”

“সন্দেহের একটা তীর তো অশোকবাবুর দিকে থেকেই যাচ্ছে।”

“আপনার কথার সুরে কনভিকশনের একটু অভাব দেখছি।” প্রমথ টিপ্পনী কাটলো।

“কে জানে স্যার!”

“আমার তো এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই,” প্রমথ বলল, “দেখুন, অশোক ওর কাজের জন্য কিংবা সম্ভবত এই এড গুয়ান্সিয়াল বা দলের কারোর জুয়োর দেনা মেটাবার টাকা জোগাড় করে উঠতে পারছিল না। এই সময়ে ও বিপাশার একটা ফাংশন অর্গানাইজ করতে বিপাশার বাড়ি যায়। সেখানে গিয়ে নিশ্চয় একটা খাম ওর নজরে পড়ে, যার স্ট্যাম্পটা দামি ও জানত। খামটা পকেটে পুরে স্ট্যাম্পটা বিক্রি করতে প্রথমে গিয়েছিল ফিলাটেলিস্ট কর্নারে। সেখানে অবশ্য খদ্দের মেলে না। তবে আমার ধারণা পরে অন্য কাউকে ভালো দামেই বিক্রি করেছিল।”

“সেটা কী করে বুঝলি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“সীমার কথা থেকে। অশোক সীমাকে ফোন করে জ্যাকপট হিট করার কথা বলেনি? তার মানে কি? হঠাৎ লাকি হয়ে যাওয়া না? আনফরচুনেটলি সেই টাকা পাওয়াটাই ওর কাল হল। কেউ জানত যে অনেক ক্যাশ নিয়ে ও বাড়ি যাচ্ছে। কে জানে, হয়তো এই এড গুয়ান্সিয়ালই জানত। সেই হয়তো ওকে বাড়িতে রাইড দেবার নাম করে মার্ডারড হিম ফর দ্য মানি। পরে নির্জন জায়গায় বডিটা ডাম্প করে ইন্দ্রর বাড়িতে পোকার খেলতে যায়।”

জাম্পিং টু কনকুশনে প্রমথর জুরি নেই। আমি বললাম, “কিন্তু টাইমিংটা তো মিলছে না। টাইম অফ ডেথ হল আটটা থেকে দশটা। তার আগেই তো ইন্দ্রবাবুর বাড়িতে এড চলে এসেছে।”

“আরে রাখ তোর টাইমিং। ফরেন্সিক সায়েন্স অতোটা প্রোগ্রেস করেনি যে, এক আধ ঘণ্টার এদিক ওদিক হবে না।”

“তাহলে আমি বলব, শুধু টাকার জন্যে কেন, এড যদি জানত অশোক পাঁচ হাজার ডলারের স্ট্যাম্প নিয়ে ঘুরছে, তাহলে স্ট্যাম্পের জন্যেও তো খুন করতে পারত।”

“আলবত পারত, ওটা হল আরেকটা সিনারিও।”

“তোর কথা ঠিক হলেও, বিপাশার সমস্যা মিটছে কিন্তু এতে না। ওর ফটো বা চিঠি কার কাছে তার কোনও হদিশ এতে নেই।”

“গুলি মার বিপাশার সমস্যা। এখন চিন্তা কর অশোকের মৃত্যু নিয়ে। দ্বিতীয় সিনারিওটা ঠিক হলে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সাহায্য নিয়ে একেনবাবুকে বার করতে হবে, নিউ ইয়র্কে কে ওই স্ট্যাম্পটা রিসেন্টলি কিনেছে, যে কাজটা একেনবাবু ইতিমধ্যেই শুরু করেছেন। ঠিক কিনা?” প্রমথ একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল।

একেনবাবুর কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার, হঠাৎ যে মৌনীবাবা হয়ে গেলেন?”

প্রশ্নটা একেনবাবু এবার বোধহয় শুনলেন। “আমি একটু কনফিউসড স্যার।”

“কী নিয়ে?”

“হঠাৎ সুজয় মিত্র দেশে গেলেন কেন?”

“সেটা তো প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা, তার সঙ্গে এই ছবির কী সম্পর্ক?”

“তা নেই স্যার। হঠাৎ মনে পড়ল, তাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। তারপর মাথাটা চুলকোতে চুলকোতে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের মনে প্রশ্নটা জাগেনি স্যার?”

“না জাগেনি, আর জাগলেও উত্তর যিনি দিতে পারতেন তিনি তো আর নেই। তবে চিন্তায় ছটফট না করে বিপাশাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন না?” প্রমথর সুরে শ্লেষটা স্পষ্ট।

“কী যে বলেন স্যার, তিনি তো তখন বেবি ছিলেন।”

“আপনিও তো তখন বালক ছিলেন। খামোকা ওটা ভেবে আর শরীর খারাপ করবেন না।”

“ঠিকই বলেছেন স্যার। এটা আমার একটা বদভ্যাস, মাথায় কিছু ঢুকলে যেতে চায় না। দেখুন না স্যার, এই নীলা নিয়ে কী ভুগেছি!”

“সেটা আমরা সবাই হাড়ে হাড়ে জানি।” প্রমথ বলল।

“তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায় অশোকবাবুর ব্যাপারে।”

“কী ব্যাপারে?”

“এই যে আপনি বললেন স্যার, অশোকবাবু স্ট্যাম্পটা বিক্রি করার চেষ্টা করছিলেন?”

“সে ব্যাপারে আপনার সন্দেহ আছে নাকি?”

“তা স্যার, একটু আছে।”

“কেন বলুন তো?” এবার আমি প্রশ্ন করলাম। “আপনি আমি দু’জনেই গিয়েছিলাম স্ট্যাম্পের দোকানটাতে। দোকানিই তো বলল অশোক দুবে যে স্ট্যাম্পটা বিক্রি করতে এসেছিল, তার খরিদ্দার পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, তার আগেও একজন আমাকে কফি কর্নারে অশোক ভেবে স্ট্যাম্পের খরিদ্দার পাওয়া গেছে বলেছিল।”

“তা ঠিক স্যার, কিন্তু অশোক দুবে স্ট্যাম্প বিক্রি করতে এসে ভুল ফোন নম্বর দিলেন কেন?”

“উনি হয়তো ঠিক নম্বর দিয়েছিলেন, দোকানদারই ভুল টুকেছিল। এটা কি অবভিয়াস নয়?”

একেনবাবু আর উচ্চবাচ্য করলেন না। মাথার পেছনটা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “ভাবছি স্যার, একবার ম্যাডাম প্যামেলা জোনসের সঙ্গে দেখা করলে মন্দ হয় না।”

এই নামটা আগে শুনিনি। জিজ্ঞেস করলাম, “প্যামেলা জোনস কে?”

“মিস্টার জন হেক্টারের সেক্রেটারি।”

“তার সঙ্গে স্ট্যাম্পের সম্পর্ক কি?”

“না স্যার, আমি একটু অন্য জিনিস ভাবছিলাম।”

“কী অন্য জিনিস?”

“মিস্টার ক্যাসেল কেন সেদিন বললেন, অ্যাডভান্স না নিয়ে কিছু করবেন না।”

“এর সঙ্গে আবার বব ক্যাসেলকে জড়াচ্ছেন কেন?”

“দিস ইজ ভেরি কনফিউইসিং স্যার, ভেরি কনফিউসিং।”

“ফ্র্যান্সিস্কা ঠিকই বলে, ইউ আর অলওয়েস কনফিউসড,” বলে প্রমথ আরেক প্রস্থ কফি বানাতে গেল।

.

২৪.

শনিবার জুন ৪, ২০১১, বিকেল

বিকেল বেলা আমরা সবাই নিউ হেরিটেজ হোটেলে গেলাম। প্রথমে শেখরবাবুর খোঁজ করলাম। ইন্দ্র আগে থেকেই শেখরবাবুকে আমাদের আসার কথা জানিয়ে রেখেছিল। খবর দিতেই অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন।

ভদ্রলোক আমাদের থেকে অনেকটাই বড় হবেন। মনে হল বছর পঞ্চাশেক বয়স। কথাবার্তা বেশ হিসেব করে বলেন, ইন্দ্রের মতো হড়বড়ে নন। একেনবাবু যাই জিজ্ঞেস করেন, চোখ বুজে একটু ভেবে আকাশের দিকে তাকিয়ে যা বলার বলেন। বলতেই বলতেই চোখটা আবার বুজে ফেলেন। ভাবার সময়টা প্রশ্ন অনুসারে কম-বেশি হয়।

“ইন্দ্রবাবুর বাড়িতে কি আপনারা প্রতি বৃহস্পতিবার তাস খেলেন?”

এই সিম্পল প্রশ্নটার উত্তর এমন গভীর ভাবে চিন্তা করে দিলেন, মনে হল জীবনমরণ সমস্যার উত্তর দিচ্ছেন।

“প্রতি বৃহস্পতিবার বলা ঠিক হবে না। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে খেলা হয়। হলে বৃহস্পতিবারই হয়।”

“কী খেলেন স্যার আপনারা, পোকার?”

আবার একটু নীরবতা।

“তাও খেলি, কেন বলুন তো?”

“আসলে স্যার, অশোকবাবুর মৃত্যু নিয়ে আমরা তদন্ত করছি, ইন্দ্রবাবু আপনাকে বোধহয় বলেছেন।”

“তা বলেছেন, কিন্তু তার সঙ্গে পোকার খেলার সম্পর্কটা বুঝছি না।”

“অশোকবাবু কি স্যার আপনাদের সঙ্গে পোকার খেলতেন না?”

“না।”

“কোনও দিন খেলেননি?”

শেখরবাবু আবার চিন্তামগ্ন হলেন। তারপর বললেন, “হাঁ, একদিন খেলেছিল।”

“কবে স্যার?”

“দিনক্ষণ আমার মনে নেই, তবে বেশি দিন আগে নয়।”

“আপনারা যখন খেলতেন, তখন অশোকবাবু কী করতেন স্যার?”

“ঘরেই থাকত। হয় বই পড়ত, নয় ফোনে কথা বলত। মাঝে মাঝে আমাদের ড্রিংকস এনে দিত।”

“ওখানে আপনাদের পাশে বসে ফোন করতেন স্যার?”

“না, না, আমাদের ডিস্টার্ব করত না। ফোন করার দরকার হলে একটু দূরে গিয়ে নীচু গলাতেই কথা বলত।”

“এক জায়গায় দাঁড়িয়ে স্যার?” প্রশ্নটায় শেখরবাবু একটু বিরক্তই হলেন। আমিও বুঝলাম না, এইসব আলতু ফালতু প্রশ্ন একেনবাবু করছেন কেন!

“আমি তাস খেলতে যেতাম, অশোক এক জায়গায় না পাঁচ জায়গায় দাঁড়িয়ে ফোন করছে দেখতে যেতাম না।”

একেনবাবু আরও বোধহয় কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বাধা পেলেন। শেখরবাবু বললেন, “আমি এখন আর সময় দিতে পারব না। আপনার আর কিছু জানার থাকলে সেগুলো লিখে রেখে যান, আমি উত্তরগুলো ইন্দ্রের হাতে দিয়ে দেব।”

কথাগুলো বলে নমস্কার করে অদৃশ্য হলেন। একেনবাবুকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না।

.

জিম ভেস্পিকে পাওয়া গেল না। এড গুয়ান্সিয়াল ছিলেন। ইন্দ্র ওঁকে ডাকতে যাবার আগে আমাদের সতর্ক করে দিলেন, “এড একটু কুইক টেম্পার্ড। সাবধানে ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন।”

ইন্দ্র চলে যেতেই প্রমথ একেনবাবুকে বলল, “এডকে চটিয়ে হোটেলের এতগুলো লোকের খাওয়া মাটি করবেন না কিন্তু।”

একেনবাবু আবার হিউমার ভালো বোঝেন না। বললেন, “ছি ছি স্যার, চটাব কেন?”

.

খানিকবাদেই এড এল। দাড়ি-অলা ছ’ফুট লম্বা গাট্টাগোট্টা একটা লোক। বয়স আমাদের মতোই হবে। মাথাটা কামানো, গলায় একটা সোনালী চেন। সোজা কিচেন থেকে এসেছে বলেই বোধহয় ঘর্মাক্ত কলেবর। রুমাল দিয়ে মাথা আর ঘাড় মুছছে। দেখে মনে হল বেশ উদ্ধত টাইপ।

ইন্দ্র আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই এড বলল, “আমি ভীষণ বিজি, কথা বলার সময় নেই।”

একেনবাবু বললেন, “কখন আপনার সময় হবে স্যার, তখনই না হয় আমরা কথা বলব।”

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে এড খানিকটা ধমকের সুরেই বলল, “কী জানতে চাও?”

“স্যার, আপনি কি অশোকবাবুকে একটা পোকার খেলার বই দিয়েছিলেন?”

“ইজ দ্যাট এ ক্রাইম?”

“ক্রাইম কেন হবে স্যার, দিয়েছিলেন কিনা জিজ্ঞেস করছি।”

“দিয়েছিলাম।”

“কেন বলবেন?”

“আট ডলারের একটা বই কেন দিয়েছি, তার কারণ তোমাকে জানাতে হবে? গিভ মি এ ব্রেক!”

শেষের স্ল্যাংটার অর্থ একেনবাবু ঠিক বুঝলেন কিনা জানি না। জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি স্যার পোকার খেলার একজন এক্সপার্ট?”

“আই লাইক দ্য গেম।”

“শুধু কি ইন্দ্রবাবুদের সঙ্গে খেলেন, না অন্য জায়গাতেও খেলেন?”

“দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস।”

কোনও সন্দেহ নেই লোকটা অত্যন্ত অবনক্সাস।

প্রমথ হঠাৎ বলে ফেলল, “হাউ অ্যাবাউট অ্যান আন্ডারগ্রাউন্ড পোকার জয়েন্ট?”

“গো টু হেল!” মুখচোখ লাল করে ক্ষিপ্ত এড চলে গেল।

.

এডের চড়া গলা শুনে ইন্দ্র ছুটে এল। আমাদের কাছে ক্ষমা চাইল এডের হয়ে। তার কোনও দরকার ছিল না। আমরা ইন্দ্রের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাব-ওয়ে ধরে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “শেখরবাবুকে খেলার সময়

অশোকবাবু কী করতেন, সে নিয়ে এত প্রশ্ন করছিলেন কেন?”

“কে জানে স্যার, মনে হল মিস্টার এডের সঙ্গে অশোকবাবুর কোনও আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়তো হয়েছিল, যার জন্য এড অশোকবাবুকে খেলা শিখিয়েছিলেন। খেলার সময় ফোনের অছিলায় অশোকবাবু মিস্টার এডকে অন্যের হাত সম্পর্কে সঙ্কেত দিতেন। লাভের অঙ্ক পরে ভাগাভাগি করতেন। অশোকবাবু অবশ্য ভাগের টাকাটা সকাজেই লাগাতেন। ভালো কাজের জন্য একটু অসৎ হওয়ার মধ্যে অশোকবাবু বোধহয় অন্যায় খুঁজে পাননি। পরে এই ভাগাভাগি নিয়েই হয়তো মিস্টার এডের সঙ্গে গোলমাল হয়। এভরিথিং ইজ পসিবল স্যার, নাথিং ইজ ইমপসিবল।”

“কালকে আমাদের প্রোগ্রাম কি?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“কালকে সকালে একবার পামেলা জোনসের কাছে যাব।”

“কাল তো রবিবার!”

“উনি কাল অফিসে থাকবেন। আমার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে স্যার।”

.

২৫.

রবিবার জুন ৫, ২০১১

জন হেক্টারের অফিস চায়না টাউনে। জায়গাটা আমাদের বাড়ির কাছেই। ম্যানহাটানের এই অঞ্চল একটা টুরিস্ট স্পট। তরি-তরকারি, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স, ঘড়ি, ক্যামেরা, ইত্যাদি নানান গ্যাজেট ওখানে মেলে! দামও বেশি নয়। আমার এক চাইনিজ কলিগ, জনি চু একবার নিয়ে গিয়েছিল ওখানে। একটা ঘুপচি দোকান থেকে রোলেক্স ঘড়ি কিনেছিলাম মাত্র তিরিশ ডলারে। জেনুইন নয়, কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। সাবমেরিনার’ মডেলের সেই ঘড়ির লিস্ট প্রাইস ছিল ছ’হাজার ডলার! সেটা পরে প্রথম যেদিন কলেজে গিয়েছিলাম, আমার ডিপার্টমেন্ট হেডের তো প্রায় হার্টফেল হবার জোগাড়! এখনও ওটা আমার প্রাইজ পসেশন। তা সত্বেও বলব, চায়না টাউন যেতে আমার ভালো লাগে না। মাঝে মধ্যে যেতেই হয়। প্রমথ যখন ভীষণ মেজাজে থাকে, তখন মাছ রাঁধে। কিন্তু বাজারে কিছুতেই একা যাবে না। আমি রাঁধব তোমরা খাবে, কিন্তু হেল্প করবে না– তা তো হয় না!

ওর সঙ্গে বাজারে যাওয়াটা যে কী হেল্প, সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। যখনই কোনও মাছ কিনতে সাজেস্ট করেছি, সঙ্গে সঙ্গে ‘না’ বলেছে। ওর হেল্পারের ডেফিনিশন হচ্ছে বশংবদের মতো পেছন পেছন ঘোরা, যেটা চায়না টাউনে সহজ নয়। রাস্তাগুলো সরু সরু, ফুটপাথগুলোও অপ্রশস্ত। তার ওপর অজস্র লোক আর গাড়ির দৌরাত্মি। এক সময় ক্রাইম অঞ্চল হিসেবেও এটার কুখ্যাতি ছিল। সব জায়গা ছেড়ে এই চায়না টাউনে জন হেক্টার কেন অফিস খুলেছিলেন, কে জানে!

প্রমথকে সেটা বলতেই খ্যাঁকখেঁকিয়ে উঠল, “দু-দিনের যোগী, ভাতকে বলিস পেস্পদ! কলকাতার থেকে এখানে ভিড় বেশি? রাস্তা সরু? এদিকে তো হুনান চিকেন খেতে জিভ থেকে জল গড়ায়, তাহলে চায়না টাউনের গালমন্দ করছিস কেন?”

থাক সে সব কথা। এখন জন হেক্টারের পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট প্যামেলা জোনসের প্রসঙ্গে আসি। প্যামেলা জোনস বহুদিন ধরে জন হেক্টারের সঙ্গে কাজ করেছেন। এ বছরই রিটায়ার করার কথা ছিল। সেটা একটু আগেই ঘটে গেল। অফিসটা খুবই ছোটো। বাইরের দিকের ঘরটায় প্যামেলা জোনসের অফিস। ভিতরের ঘরে জন হেক্টার বসতেন। এ মাসের ১৫ তারিখেই অফিসটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্যামেলা ওঁর নিজস্ব জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে কার্ডবোর্ডের কয়েকটা বাক্সে ইতিমধ্যেই গুছিয়ে রেখেছেন। জন হেক্টারের জিনিস কে নেবেন, এখনও স্থির হয়নি। উনি অবিবাহিত ছিলেন। কোনও উইলও করে যাননি। দূর সম্পর্কের ভাগ্নে-ভাগ্নি আছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে তেমন কোনও যোগাযোগ ছিল না। প্যামেলা বোধহয় কয়েকদিন একা একা বসে থাকার পর আমাদের শ্রোতা পেয়ে নিজের থেকেই অনেক কিছু বলে ফেললেন। ওঁর কথা শেষ হবার পর, একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাডাম, মিস্টার হেক্টার এবার ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলেন কেন?”

“আপনারা সেটা জানেন না? এ নিয়ে তো পত্রিকাতেও লেখালেখি হয়েছে?” প্যামেলা বেশ অবাক হলেন।

“না, ম্যাডাম।”

“ওর সঙ্গে কিছুদিন আগে এশিয়া ইনস্টিট্যুটের মিস্টার আকাহাশির অনেক তর্কাতর্কি হয়েছিল ইন্ডিয়ার একটা মূর্তির ব্যাপার নিয়ে। মিস্টার আকাহাশি বলেছিলেন ওটা কম্বোডিয়ার, কিন্তু জন জানত ওটা ইন্ডিয়ার। জন তখন আকাহাশির কাছে প্রাভানেন্স চায়।”

“প্রাভানেন্স কী ম্যাডাম?”

“হিস্ট্রি অফ ওনারশিপ। কোত্থেকে মূর্তিটা এসেছে, এটা কার সম্পত্তি ছিল– তার প্রমাণ।

আকাহাশি সেটা দেখাতে অস্বীকার করেন, উলটে ওঁকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন প্রমাণ দেখানোর যে ওটা ইন্ডিয়ার জিনিস। ইন্ডিয়ায় তোলা ওই মূর্তিটার একটা ছবি জনের কাছে ছিল, কিন্তু সেটা দিয়ে কিছু প্রমাণ করা যায় না, তাই জন আরও প্রমাণ সংগ্রহ করার জন্যে ইন্ডিয়া গিয়েছিল।”

“প্রমাণ কি কিছু পেয়েছিলেন ম্যাডাম?”

“জন খুন হবার আগের দিন অফিসের দুয়েকটা কাজ নিয়ে কয়েক মিনিট কথা হয়েছিল। খুব খুশি আর উত্তেজিত মনে হচ্ছিল জনকে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওখানকার কাজ কি রকম চলছে? উত্তরে বলেছিল, চমৎকার। কাজগুলো সব হয়েছে, কিন্তু আরেকটা বড় একটা জিনিস আবিষ্কার করেছে, যেটা নিয়ে হইচই পড়ে যাবে।”

“কী সেটা ম্যাডাম?”

“সেটা বলেনি। জন মুখে কিছু না বলে একেবারে কাগজে ছাপিয়ে জানায়, এটাই বরাবর দেখেছি।”

“একটা প্রশ্ন কিন্তু রয়ে গেল ম্যাডাম।”

“কী বলুন তো?”

“উনি কাজগুলো বললেন কেন? গিয়েছিলেন তো মূর্তিটা ইন্ডিয়ার প্রমাণ জোগাড় করতে?”

“ও, সেটা তো আপনাদের বলিনি। জন একটা সিন্ডিকেটেড সিরিজ বার করে ‘আফটার দে রিটার্ন’ নামে। যেসব ক্রিমিনাল বহু বছর জেল খাটার পর মুক্তি পেয়েছে, তারা নতুন করে সমাজের স্রোতে কী ভাবে মিশতে পেরেছে বা পারেনি, তার কাহিনি। শুধু এখানকার ক্রিমিনালদের কাহিনি নয়, এর মধ্যেই ক্যানাডা, মেক্সিকো, পোল্যান্ড, ইজিপ্ট আর ইন্দোনেশিয়ায় কাহিনি ছাপা হয়েছে। এবার ইন্ডিয়াতে যখন যাচ্ছে তখন ইন্ডিয়ার একটা কাহিনি পেলে লিখবে ঠিক করেছিল।”

“তার মানে ম্যাডাম, ইন্ডিয়াতে সে রকম কারোর খোঁজ পেয়েছিলেন?”

“ইয়েস এন্ড নো।”

“বুঝলাম না ম্যাডাম।”

“একজনের খোঁজ পেয়েছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। অনেক বছর আগেই তিনি মারা গেছেন।”

“মহিলাটির নাম বোধহয় কল্পনা, তাই না ম্যাডাম?”

“দাঁড়ান, আপনি কী করে এটা জানলেন?” প্যামেলা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।

“জাস্ট এ গেস ম্যাডাম।”

প্যামেলা জোনসের বিস্ময় তাতে কাটলো না। না কাটারই কথা।

জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিও কি তাকে চেনেন?”

“মিস্টার হেক্টার কি ওঁকে চিনতেন?”

“না, জন নয়। ক’দিন আগে বার্নার্ডস কলেজের এক রিটায়ার্ড প্রফেসর জনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন আমি একটা কাজে ঘরে ঢুকি। তখনই শুনি উনি জনকে বলছেন, কল্পনা নামে ওঁর এক ছাত্রী ছিল। কিন্তু গ্রাজুয়েশনের ঠিক আগেই সে হঠাৎ দেশে ফিরে যায় আর একটা মার্ডারে জড়িয়ে পড়ে। জন বলে, ও এক কল্পনার খবর জানত। কিন্তু সেই কল্পনা যে এখানে পড়াশুনো করতে এসেছিল, সেটা জানত না। এবার গিয়ে কল্পনার খোঁজ করবে, তাকে পেলে তাকে নিয়েই ওর কাহিনি লিখবে।”

“কিন্তু তার দেখা তো পাননি।”

“সেটা ঠিকই, কিন্তু জন ওয়াজ এ গ্রেট ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার।”

কিছু বলার আগেই একেনবাবু আরেকটা প্রশ্ন করলেন, “শেষ আপনার সঙ্গে কবে মিস্টার হেক্টারের কথা হয়?”

“মারা যাবার দিন সকালে খুব অল্পক্ষণের জন্যে। আমাকে বলে পরের দিন লুফথহানসার ফ্লাইট বুক করেছে।”

“ওঁকে কোন ব্যাপারে চিন্তিত বা বিচলিত মনে হয়নি?”

“একেবারেই না।”

“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।”

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত