মহিলার নাম রওশন আরা। বিজলী রওশন আরার সাথে যোগাযোগ করল এবং আয়েশা গার্মেন্টস নামে একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে তার চাকরি হয়ে গেল। চাকরির থেকে বড় কথা গার্মেন্টসের আরো কয়েকজন মেয়ের সাথে তার থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো।

রওশন আরা বিজলীর জন্যে সাবান, তোয়ালে, টুথপেস্ট, এর সাথে সাথে দুই জোড়া সালোয়ার-কামিজ কিনে এনেছে। প্রথম দিন বিজলীকে তার নতুন জায়গায় তুলে দেবার সময় গার্মেন্টসের মেয়েরা বিজলীর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, কিন্তু এইখানে তো আমরা শুধু মেয়েরা থাকি। ছেলেদের আলাদা মেস আছে–

বিজলী একটু হেসে বলল, আপু আমারে একটু সময় দেও, আমি মেয়ে হয়ে যাব!

মেয়েগুলো বিভ্রান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বিজলী বলল, আমি আসলে মেয়ে! রাস্তাঘাটে থাকতাম সেই জন্যে ছেলে হয়ে ছিলাম।

রওশন আরা হেসে বলল, বিজলী মেয়ে হলেও তার তেজ কিন্তু ছেলেদের থেকে বেশি। একটা পাজি ছিনতাইকারী আমার ব্যাগ ছিনতাই করতে গিয়েছিল, বিজলী তাকে এমন একটা ঘুষি দিল যে এক ঘুষিতে সেই সন্ত্রাসী ধড়াম করে পড়ে গেল!

মেয়েগুলো অবাক হয়ে রওশন আরাকে ঘিরে দাঁড়াল এবং রওশন আরাকে তখন পুরো কাহিনীটা আরো একবার শোনাতে হলো।

.

বিজলী বাথরুমে ঢুকে বহুদিন পরে সারা শরীরে সাবান ঘষে পানি দিয়ে ভালোভাবে গোসল করল। ছেলে হয়ে থাকার এটাই ছিল সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা, কখনো সে ঠিক করে গোসল করতে পারেনি। গোসল শেষ করে সে বহুদিন পর সালোয়ার-কামিজ পরে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল। মাথায় ছোট ছোট চুল থাকার পরও অনেকদিন পরে আজকে সে পুরোপুরি মেয়ে! বিজলী একটা ছোট আয়নায় অনেকক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক কী কারণ জানা নেই আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার চোখে পানি এসে গেল।

.

আয়েশা গার্মেন্টসে কাজ শুরু করার পর বিজলীর জীবনটা পাল্টে গেল। সবাইকে নিয়ে সে দলবেঁধে কাজ করতে যায়। সেই ভোরবেলা থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে। দুপুরে খাবার সময় আয়েশা গার্মেন্টসের সাততলা ছাদে বসে সে সবার সাথে খায়। সবার মাঝে বিজলী সবচেয়ে ছোট, তাই অন্য মেয়েগুলোও তাকে নিজের বোনের মতো আদর করে। রাস্তাঘাটের জীবন থেকে এই জীবনটা একেবারেই অন্যরকম। ছুটির দিনে বিজলী অন্য মেয়েদের সাথে ঘুরতে যায়। কখনো সিনেমা দেখে, কখনো নিউমার্কেটে কেনাকাটা করে, কখনো চিড়িয়াখানায় যায়। প্রায় সবারই বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের মাসে মাসে সেখানে টাকা পাঠাতে হয়। বিজলীর কেউ নেই, তার টাকা খরচ করারও কোনো জায়গা নেই। যখন রাস্তাঘাটে থাকত তখন টাকাগুলো তার প্যান্টের ভেতরে সেলাই করে লুকিয়ে রাখত। এখন সে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছে, ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। যখন খোকনের সাথে দেখা হবে তখন সে খোনকে সাইকেল কিনে দেবে। নতুন জামাকাপড় কিনে দেবে। প্লেনে করে খোকনকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যাবে। কক্সবাজার যাবার আগে সে একটা ক্যামেরা কিনবে, তারপর খোকনকে নিয়ে সে ছবি তুলবে। অনেক অনেক ছবি।

খোকনকে খুঁজে পাওয়ার পর সে কী করবে তার খুঁটিনাটি সবকিছু সে চিন্তা করে রেখেছে কিন্তু খোকনকে সে খুঁজে পায়নি–শুধু যে খুঁজে পায়নি তা নয় তাকে কীভাবে খুঁজে পাবে, সেটাও সে জানে না। আয়েশা গার্মেন্টসে কাজ শুরু করার পর সে আর খোকনকে খুঁজতে পারছে না। এখন তাকে অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কাজে যেতে হয়, তাই সে আর খোকনের খোঁজে স্কুলে স্কুলে যেতে পারে না। সে আবার কেমন করে খোকনকে খোঁজা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। গোপনে সে অন্য জায়গায় কাজ খুঁজছে, যেখানে দেরি করে কাজে যেতে পারবে। কিন্তু সে যে কোনো হিসেবে একটা বাচ্চা মেয়ে, তাকে রওশন আরা এই চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছে, সে চেষ্টা করলেই অন্য জায়গায় চাকরি পাবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু হঠাৎ করেই বিজলী খোকনকে খোঁজার সুযোগ পেয়ে গেল। কিন্তু যেভাবে সুযোগটা এল সেটা এতই অভাবনীয় ছিল যে বিজলী তার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।

.

আয়েশা গার্মেন্টসে একটা অর্ডার এসেছে, সেটা সময়মতো শেষ করতে না পারলে ঝামেলা হবে। সেজন্যে অনেককে ওভারটাইম কাজ করতে হচ্ছে। তাদের মাঝে বিজলীও একজন। একটা মেশিন দিয়ে সে শার্টের বোতাম লাগিয়ে যাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই কাজ।

রাত দশটার দিকে তারা আধাঘণ্টার বিশ্রাম পেল, হোটেল থেকে খাবারের প্যাকেট আনা হয়েছে, সবাই ছাদে বসে খাওয়া শেষ করে আবার চারতলায় নেমে এসেছে। তখন তাদের একজন নাক কুঁচকে বলল, কিসের গন্ধ?

আরেকজন জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল, কই? আমি তো কোনো গন্ধ পাই না।

সবাই তখন আবার কাজে লেগে গেল এবং কয়েক মিনিট পর সবাই একসাথে একটা পোড়া গন্ধ পেল। একজন উঠে গেল গন্ধটা কোথা থেকে এসেছে দেখবার জন্যে এবং সিঁড়ির কাছে গিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখল সিঁড়ি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আসছে। সে চিৎকার করে দরজাটা বন্ধ করে ছুটে এসে বলল, আগুন!

তখন একসাথে সবাই লাফ দিয়ে উঠে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। কয়েকজন আবার গিয়ে দরজাটা খুলে বোঝার চেষ্টা করল আগুনটা কোথায়, সিঁড়ি দিয়ে তারা নেমে যেতে পারবে কি না। কিন্তু এবারে দরজা খোলার সাথে শুধু কুচকুচে কালো ধোয়া নয় আগুনের হলকা দেখতে পেল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবার কোনো উপায় নেই।

।একটি মেয়ে ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, আর সিঁড়ি নাই?

আছে, পিছনে আরেকটা সিঁড়ি আছে।

এবারে সবাই পেছনে ছুটে গেল, কিন্তু সিঁড়ির দরজাটা বাইরে থেকে তালা মারা, তারা বৃথাই কয়েকবার লাথি দেয় সেটাকে ভাঙার চেষ্টা করল। কোনো লাভ হলো না।

এবারে বেশ কয়েকজন ডুকরে কেঁদে উঠল। কয়েকজন জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী হচ্ছে। রাস্তায় অনেক মানুষ জড়ো হয়ে বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু কী বলছে বোঝার কোনো উপায় নেই।

অনেকগুলো মেয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে থাকে। বাইরে আগুনের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ঘরের ভেতর দেখতে দেখতে গরম হয়ে উঠছে। সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামতে পারবে না, উপরেও উঠতে পারবে না, দেখতে দেখতে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে–হঠাৎ করে সবার ভেতরে একধরনের মৃত্যুভয় ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই চিৎকার করে খোদাকে ডাকতে থাকে। কেউ যখন মৃত্যুভয়ে খোদাকে ডাকাডাকি করে তার চাইতে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না।

বিজলী মাথা ঠান্ডা রাখল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবে না, আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ার আগে তাদেরকে অন্য কোনোভাবে নেমে যেতে হবে। পেছনে বারান্দা আছে কিন্তু সেখানে গ্রিল দেয়া, সুলতানার সাথে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাবার পর থেকে সে কোনো গ্রিল দেখলেই সেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, চাপ দিয়ে খুলে ফেলা যায় কিনা পরীক্ষা করে। এই বিল্ডিংয়ের বারান্দার গ্রিলটাও সে পরীক্ষা করেছে। গ্রিলটা খুবই দুর্বল, কোনো কিছু দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। একটা খন্তা হলে খুব ভালো হতো, কিন্তু এখানে কোনো খন্তা নেই।

বিজলী একটু চিন্তা করল।

তাদের টেবিলের উপর ভারী কিছু যন্ত্রপাতি আছে, ধরাধরি করে সেগুলো নিয়ে সেটা দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলে নিশ্চয়ই গ্রিল খুলে আসবে। বিজলী দেরি করল না, চিৎকার করে বলল, আপুরা কয়েকজন আস আমার সাথে।

একজন আতঙ্কিত মুখে জিজ্ঞেস করল, কেন?

বারান্দার গ্রিল ভাঙতে হবে। তাড়াতাড়ি।

বিজলী টেবিলের উপর রাখা একটা দামি মেশিনের পাওয়ার কর্ডটা খুলে ফেলল। চিৎকার করে বলল, ধরো।

বেশ কয়েকজন সেটা ধরাধরি করে বারান্দায় নিয়ে আসে, তারপর সেটাকে দিয়ে প্রাণপণে গ্রিলকে ধাক্কা দিল। দুইবার ধাক্কা দিতেই এক পাশ থেকে গ্রিলটা ছুটে আসে। তখন উৎসাহ পেয়ে আরো কয়েকজন হাত লাগাল। সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত গ্রিলের অনেকখানি খুলে গেল। এবারে বেশ কয়েকজন গ্রিলটাকে টেনে অনেকখানি জায়গা করে নেয় যেন সেদিক দিয়ে একজন মানুষ বের হয়ে যেতে পারে।

সবাই তখন বারান্দায় এসে ভিড় করে ঠেলাঠেলি শুরু করেছে, কিন্তু চারতলার বারান্দা থেকে কীভাবে নিচে নামবে কেউ বুঝতে পারছে না।

বিজলী তখন সবার দিকে তাকালো। বেশির ভাগের পরনে সালোয়ার কামিজ, কয়েকজন মাত্র শাড়ি পরে এসেছে। তাদের শাড়িগুলো দরকার। বিজলী চিৎকার করে বলল, আপুরা, যারা সুতি শাড়ি পরে আছ, শাড়ি খুলে দেও। তাড়াতাড়ি!

একজন চোখ কপালে তুলে বলল, আর আমি কী পরে থাকব?

ব্লাউজ পেটিকোট আছে না? উপরে একটা কোট পরে নাও, মেম সাহেবদের মতো।

এরকম বিপদের মাঝে কে কী পরে আছে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না, ঝটপট দুইটা শাড়ি চলে এল। বিজলী প্রথমে দুইটা শাড়ি গিঁট দিয়ে সেটাকে লম্বা করে নেয়। তারপর এক পাশে একটা বড় ফঁসের মতো করল যেন একজন সেখানে বসতে পারে। এখন একজন একজন করে সেখানে বসিয়ে তাকে উপর থেকে ঝুলিয়ে নিচে নামিয়ে দেয়া হবে।

যখন এখান থেকে বের হবার কোনো উপায় ছিল না তখন সবাই। আতঙ্কে চিৎকার করছিল। এখন যখন দেখতে পেল বেঁচে যাওয়ার একটা পথ তৈরি হয়েছে, তখন হঠাৎ করে সবার মাঝে একটা সাহস ফিরে এসেছে। তারা চিৎকার থামিয়ে এবারে অপেক্ষা করতে থাকে।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, কে আগে নামবা?

সবাই আগে নামতে চায় আবার কেউই এই বিপজ্জনক ফাঁসে প্রথম বসতে চায় না। চার-তলার উপর থেকে এভাবে কেউ নামতে সাহস পায় না, ভয়ার্ত চোখে নিচে তাকিয়ে থাকে। বিজলী আবার চিৎকার করে বলল, দেরি করলে হবে না, একজন একজন করে সবাইরে নামতে হবে!

শেষ পর্যন্ত একজন সাহসী মেয়ে রাজি হলো। তাকে শাড়ির ফাঁসটাতে বসিয়ে সাবধানে গ্রিলের ফুটো দিয়ে বের করা হলো। তখন সবাই মিলে শাড়িটার অন্য পাশে ধরে তাকে নিচে নামাতে থাকে। নামার সময় সে মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিল, এ ছাড়া কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই সে বেশ সহজেই নিচে পৌঁছে গেল।

প্রথম মেয়েটি নেমে যাবার পর সবার সাহস একটু বেড়ে গেল। এবারে অনেকেই নামতে রাজি। প্রথমবার যে ছোটখাটো সমস্যা হয়েছিল পরেরবার তার কিছুই হলো না। নামার সময় ঝুলন্ত অবস্থায় ঘুরপাক পর্যন্ত খেল না। বারান্দার নিচে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে তখন আশেপাশে জমা হয়ে থাকা মানুষও সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। তারা নিচে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল এবং কাছাকাছি আসতেই মেয়েগুলোকে ধরে ধরে নামাতে লাগল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলো তাড়াহুড়ো করল না। প্রাণ বাঁচানোর জন্য একজনের আগে আরেকজন নামার চেষ্টা করল না। যারা খুব বেশি ভয় পেয়েছিল সবাই মিলে তাদেরকেই আগে নামিয়ে দিল। প্রথম প্রথম সবাই মিলে শাড়িটা ধরে রেখে খুব সাবধানে একেকজনকে নামাচ্ছিল, আস্তে আস্তে তাদের সাহস বাড়তে থাকে। শাড়িটাকে গ্রিলের সাথে দুইবার প্যাচিয়ে নেবার পর একজনই একজনকে নামাতে পারছিল। শাড়িটাকে একটুখানি ঢিলে দিলে মানুষটা নামতে থাকে, আবার টেনে ধরলেই আটকে যায়। হঠাৎ করে কেউ হাত পিছলে পড়ে যাবে তার ভয় নেই। নিচে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা ধরে ফেলবে।

মাঝে মাঝে হঠাৎ একজন বের হয়ে যায় যে আতঙ্কে নড়ার সাহস পায় না। তখন চিৎকার করে, ঠেলে, জোর করে তাকে শাড়িটার ফঁসে বসিয়ে নিচে নামাতে হয়। নিচে অনেক মানুষ দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেছে মোটামুটি কাছাকাছি এলে কিছুটা উপর থেকেই খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়া যাচ্ছে, যারা নিচে আছে তারা সবাই মিলে তখন তাকে ধরে ফেলছে।

যখন বেশির ভাগ মেয়ে নেমে গিয়েছে তখন হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করল, যে সবচেয়ে শেষে নামবে তারে কে নামাবে?

বিজলী বলল, তার নিজে নিজে নামতে হবে।

নিজে নিজে? নিজে নিজে কীভাবে নামবে?

শাড়িটা গ্রিলের সাথে বেন্ধে সেটা ধরে পিছলে পিছলে নামবে।

সব্বোনাশ! যদি হাত ছুটে যায়?

বিজলী বলল, ছুটবে না। আমি নাম সবার শেষে।

বিল্ডিংটাতে তখন আগুন অনেকখানি ছড়িয়ে গেছে। সিঁড়ির দরজার নিচ দিয়ে ধোঁয়া এসে পুরো ঘরটা ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে। সবাই খক খক করে কাশছে। এতক্ষণ ইলেকট্রিসিটির আলো ছিল, হঠাৎ করে আলোটা নিভু নিভু হয়ে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। দরজার নিচ দিয়ে আগুনের আভা ছাড়া আর কোনো আলো নেই। পুরো ঘরটা ভয়ংকর গরম, সবাই দরদর করে ঘামছে। ধোঁয়ায় একেকজনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

ধীরে ধীরে প্রায় সবাই নেমে গেছে, শুধু বিজলী আর একটি মেয়ে বাকি, তখন হঠাৎ করে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে সিঁড়ির দরজাটা খুলে সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ঘরের ভেতর দাউ দাউ আগুন, তার প্রচণ্ড তাপে বিজলীর সমস্ত শরীর যেন ঝলসে গেল।

বিজলী চিৎকার করে বলল, আর দেরি করা যাবে না। এখনই শাড়ি ধরে নামতে হবে।

বিজলী আর মেয়েটি মিলে তাড়াতাড়ি শাড়িটা গ্রিলের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে গিটটা পরীক্ষা করে প্রথমে অন্য মেয়েটি শাড়িটা ধরে ঝুলে পড়ে। আগুনের ফুলকি ছুটে আসছে, প্রচণ্ড তাপে সে মনে হয় প্রায় ঝলসে গেল! বিজলী দেখল অন্য মেয়েটি সর সর করে নেমে যাচ্ছে। মেয়েটি একেবারে নিচে পৌঁছানো পর্যন্ত বিজলী অপেক্ষা করল না। তার আগেই সে শাড়িটা ধরে নামতে শুরু করে। একসাথে দুজনের ওজন শাড়িটা সহ্য করতে পারবে কি না বিজলী জানে না কিন্তু এখন সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। বিজলী কাপড়টা ধরে প্রায় পিছলে নিচে নামতে থাকে, মনে হয় হাতের তালুর ছাল উঠে গেল, কিন্তু সে শাড়িটা ছাড়ল না। বিজলী এত তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল যে সে নিচের মেয়েটিকে ধরে ফেলল, তার পায়ের ধাক্কায় মেয়েটির হাত ছুটে যায়, মেয়েটি ভয়ে চিৎকার করে ওঠে কিন্তু ততক্ষণে সে প্রায় নিচে নেমে এসেছে। নিচে যারা ছিল তারা মেয়েটিকে ধরে ফেলল। বিজলী দুই হাত দিয়ে কাপড়টা ধরে ঝুলতে থাকে। বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে আগুনের ফুলকি নিচে এসে পড়ছে, যারা নিচে ছিল তারা ভয় পেয়ে সরে যেতে থাকে। বিজলী তখনো ঝুলে আছে, দুই পা দিয়ে শাড়িটা ধরে রাখার চেষ্টা করল, তারপর আবার পিছলে নিচে নেমে এল। উপর থেকে আবার বিস্ফোরণের একটা শব্দ এল এবং তখন দাউ দাউ করে পুরো চারতলাটি জ্বলতে শুরু করল। বিজলী এবারে তার হাতটি ছেড়ে দিয়ে বেশ উপর থেকে নিচে এসে পড়ল।

কে যেন জিজ্ঞেস কলল, সবাই নেমেছে?

আরেকজন উত্তর দিল, হ্যাঁ।

আরেকজন বলল, খোদা মেহেরবান।

চিৎকার-চেঁচামেচিতে এরপর আর কারো কথা বোঝা গেল না।

.

ঠিক তখন জ্বলন্ত বিল্ডিংয়ের পাশে একটা সাদা মার্সিডিজ গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়ি থেকে আয়েশা গার্মেন্টসের মালিক রায়হান সিদ্দিকী কোনোভাবে নেমে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে জ্বলন্ত বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। একজন মানুষ তার কাছে ছুটে এসে কাঁপা গলায় বলল, স্যার শেষ হয়ে গেল। সব শেষ হয়ে গেল।

ভেতরে কয়জন ছিল?

একজনও নাই স্যার।

রায়হান সিদ্দিকী আর্তনাদ করে উঠল, একজনও নাই? সবাই মারা গেছে?

মানুষটা বলল, না না স্যার! আমি সেটা বলি নাই। আমি বলেছি ভেতরে একজনও নাই। সবাই বের হয়ে আসছে। একজনও মারা যায় নাই স্যার।

রায়হান সিদ্দিকী অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল, জিজ্ঞেস করল, সবাই বের হতে পেরেছে? সবাই?

জি স্যার সবাই। উপর থেকে শাড়ি ঝুলিয়ে—

সবাই? সবাই বেঁচে আছে? সবাই?

জি স্যার সবাই।

একজনও মারা যায় নাই?

না স্যার। একজনও মারা যায় নাই।

রায়হান সিদ্দিকী তার দামি স্যুট পরা অবস্থাতেই নোংরা ফুটপাথে বসে পড়ল। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর দুই হাতে নিজের মাথাটা ধরে বিড়বিড় করে বলল, থ্যাংক ইউ খোদা। থ্যাংক ইউ।

.

পরদিন ভোরবেলা বিজলী গিয়ে কয়েকটা খবরের কাগজ কিনে এনেছে। সব পত্রিকায় গত রাতে আয়েশা গার্মেন্টস পুড়ে যাওয়ার খবর ছাপা হয়েছে। বিজলী যখন তার মেসের মেয়েদের খবরের কাগজ থেকে খবরটা পড়ে শোনাচ্ছে তখন নিচ থেকে দারোয়ান এসে খবর দিল একজন মানুষ বিজলীকে খুঁজছে।

বিজলী একটু অবাক হয়ে নিচে নেমে এসে দেখল তাদের মেসের সামনের সরু গলিটাতে একটা বড় সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীকে দেখে গাড়ি থেকে একজন বয়স্ক মানুষ বের হয়ে এল। বিজলীকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম বিজলী? তুমি আয়েশা গার্মেন্টসে কাজ করো?

বিজলী মাথা নাড়ল। মানুষটা বলল, আমি আয়েশা গার্মেন্টসের মালিক, আমার নাম রায়হান সিদ্দিকী।

বিজলী হাত তুলে সালাম দিল। আয়েশা গার্মেন্টসের সবাই রায়হান সিদ্দিকীর নাম শুনেছে, কেউ তাকে আগে দেখেনি। রায়হান সিদ্দিকী কিছুক্ষণ বিজলীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি এত ছোট একটা মেয়ে আমার ফ্যাক্টরির সবগুলো মেয়ের জান বাঁচিয়েছ?

বিজলী কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রায়হান সিদ্দিকী বলল, আমি যে তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না।

বিজলী এবারেও কোনো কথা বলল না।

রায়হান সিদ্দিকী বলল, আমি মায়ের নামে এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিটা দিয়েছি। যদি গত রাতে সেখানে কেউ পুড়ে মারা যেত তাহলে আমার মায়ের নামটিতে একটা অভিশাপ পড়ে যেত। আমি তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। তোমার জন্যে আমি আমার মায়ের সম্মানটা বাঁচাতে পেরেছি।

বিজলী প্রথমবার কথা বলার চেষ্টা করল, বলল, কিন্তু আপনার তো অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে গেল–

রায়হান সিদ্দিকী হাত দিয়ে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, টাকা কোনো ব্যাপার না। টাকা আসে যায়। এইবার গিয়েছে আরেকবার আসবে। মানুষের প্রাণ গেলে আর আসবে না। যাই হোক মা, আমি এই সকালে তোমার কাছে এসেছি বলার জন্যে যে তোমার এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। তবু যদি কিছু একটা পারি তাহলে চেষ্টা করব। বলো তোমাকে আমি কী দিতে পারি।

বিজলী বলল, আমার কিছু লাগবে না।

সেটা তো হতে পারে না, বলো কিছু একটা।

কিছু লাগবে না।

রায়হান সিদ্দিকী বলল, কী বলছ কিছু লাগবে না। তোমার বয়সে, আমার কত কী শখ ছিল! কিছু একটা বলো।

বিজলী লাজুক মুখে বলল, বলব?

হ্যাঁ, বলো।

যখন আবার ফ্যাক্টরি চালু হবে তখন কি আমি দুই ঘণ্টা পরে কাজে আসতে পারি? বিকেলবেলা আমি বাড়তি দুই ঘণ্টা কাজ করে দিব–

রায়হান সিদ্দিকী চোখ বড় বড় করে বিজলীর কথা শুনল তারপর হঠাৎ হা হা করে হাসতে শুরু করল।

বিজলী অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, রায়হান সিদ্দিকী কেন হাসছে সে বুঝতে পারল না। রায়হান সিদ্দিকী একসময় হাসি থামিয়ে বলল, তুমি যখন খুশি কাজে এসো আর যখন খুশি চলে যেয়ো। তোমাকে কেউ কিছু বলবে না! তোমাকে আমি আমার আয়েশা গার্মেন্টসের এম্বাসাডার বানিয়ে দেব। তুমি ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবে। পারবে না?

বিজলী কী বলবে বুঝতে না পেরে লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে যেটা চেয়েছিল সেটা সে পেয়ে গেছে। সে আবার খোকনকে খোঁজা শুরু করতে পারবে।

.

পরদিন থেকে বিজলী আবার খোকনের খোঁজে স্কুলে স্কুলে যেতে শুরু করল।

*

আয়েশা গার্মেন্টস দুই মাসের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যারা এখানে কাজ করে তারা মহাখুশি, কারণ ঘোষণা করা হয়েছে এই দুই মাস সবাইকে বেতন দেওয়া হবে। কেউ এরকম কিছু জন্মেও শোনেনি যে কাজ না করেও কেউ বেতন পেতে পারে। অনেকেই এটা বিশ্বাসই করতে পারছে না, গোপনে বলাবলি করছে এটা আসলে সবাইকে ছাঁটাই করার ফন্দি!

যেহেতু দুই মাসের ছুটি, সবাই বাড়ি চলে গেল–এখন বিজলী পুরো মেসে একা। সেটা নিয়ে তার নিজের কোনো সমস্যা নেই। সে প্রায় এক বছর সময় রাস্তায় কাটিয়েছে, তার জন্যে একটা মেসে একা থাকা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু দেখা গেল একদিন একজন মানুষ তাকে নিতে চলে এসেছে। বিজলী অবাক হয়ে বলল, কোনখানে যেতে হবে আমাকে?

স্যার আপনার জন্য একটা অ্যাপার্টমেন্ট রেডি করেছেন।

বিজলীকে এর আগে কেউ কখনো আপনি করে বলেনি। এই প্রথম। সে জিজ্ঞেস করল, কোন স্যার?

রায়হান সিদ্দিকী স্যার।

আমার জন্য?

হ্যাঁ।

বিজলী অবাক হয়ে বললেন, কেন?

আপনি এখানে একা আছেন শুনে স্যার একটু দুশ্চিন্তা করছেন।

আমি এইখানে একলা আছি স্যার সেইটা কেমনে জানলেন?

মানুষটা হাসল, বলল, স্যার সব সময় আপনার খোঁজ রাখেন। আপনাকে স্যার খুব স্নেহ করেন।

বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে আসলেই যাইতে হবে?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে। তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করেন, আমি আমার জিনিসগুলা গুছায়ে নেই।

মানুষটা বলল, ঠিক আছে। কিন্তু কিছু না নিলেও কোনো সমস্যা হবে না।

কিছু না নিলেও সমস্যা হবে না?

না।

বিজলী তারপরেও তার কিছু জিনিসপত্র একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিল। নিচে খুব সুন্দর একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে। মানুষটা তাকে গাড়িতে তুলে নিল, ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?

মানুষটা তাকে একটা ঠিকানা বলে দিল।

রাস্তায় অনেক ভিড় তাই তাদের পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেল। বড় রাস্তা থেকে ছোট রাস্তা হয়ে একটা ছিমছাম রাস্তাতে তাদের গাড়ি থেমে গেল। বিজলী মানুষটার সাথে রাস্তার পাশে একটা বিল্ডিংয়ের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান মানুষটাকে একটা লম্বা সালাম দিল।

মানুষটা বিজলীকে নিয়ে একটা লিফটে করে পাঁচ-তলায় উঠে এল। বিজলী এই প্রথমবার একটা লিফটে উঠেছে, ছোট একটা লোহার ঘর মানুষজনকে নিয়ে উপরে উঠে যায়, নিচে নেমে আসে, কী আশ্চর্য!

লিফট থেকে নেমে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে মানুষটা ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চাবিটা বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, এই যে এইটা আপনার চাবি। এইটা আপনার অ্যাপার্টমেন্ট।

বিজলী মাথা ঘুরিয়ে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখল। এক বেডরুমের ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট। এক পাশে একটা কিচেন। দুটি বাথরুম। সামনে এক চিলতে বারান্দা। এতদিন সে তিনজন মেয়ের সাথে একটা ঘরে থেকে এসেছে, এখন থেকে তার নিজের জন্যে আস্তো একটা অ্যাপার্টমেন্ট?

বিজলী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এইটার ভাড়া কত?

মানুষটা হাসল। বলল, এটা স্যারের বিল্ডিং। স্যারের স্টাফরা এখানে থাকে। এটায় কোনো ভাড়া নাই।

আ—আ–আমার ভাড়া দিতে হবে না?

না। মানুষটা হাসল। বলল, আমি ভেবেছিলাম ফার্নিচার ফ্রিজ এই সব কিনে দিই, স্যার না করলেন। স্যার বললেন এগুলো আপনি আপনার পছন্দমতো কিনে নেবেন। নিজে নিজে কিনতে নাকি বেশি মজা!

বিজলী কোনো কথা বলল না, অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে নিজে নিজে ফার্নিচার ফ্রিজ কিনবে? ফ্রিজ কী সে জানে না। কখনো দেখেনি। ভেতরে খাবার ঠান্ডা থাকে বলে শুনেছে। সেই ফ্রিজ সে নিজে কিনে ফেলবে?

মানুষটা বলল, আমি এখন যাই। তারপর পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বিজলীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এইটা আমার কার্ড। কোনো কিছু লাগলে আমাকে ফোন করবেন।

তারপর একটু এগিয়ে রান্নাঘরের কেবিনেটের একটা ড্রয়ার খুলে ভেতরে দেখিয়ে বলল, এইখানে কিছু টাকা আছে, আপনার কেনাকাটার জন্যে। আর একটা মোবাইল ফোন। সিমে আমার নাম্বারটা ঢোকানো আছে। আফজাল হোসেন নামে। যেকোনো দরকারে আপনি আমাকে ফোন করবেন। স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আপনাকে দেখেশুনে রাখার জন্য।

বিজলী অনেকক্ষণ থেকে যে কথাটা বলতে চাইছিল সেটা শেষ পর্যন্ত বলে ফেলল, আমারে আপনি করে বলছেন কেন? আমি তো অনেক ছোট–

মানুষটি হাসল, বলল, হ্যাঁ আমারও খুব কষ্ট করে আপনি বলতে হচ্ছে। কিন্তু স্যার আপনাকে খুব স্নেহ করেন, সেই জন্যে আপনি বলছি। তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমি তুমি করে বলতে পারি।

বিজলী বলল, জি জি আফজাল চাচা আপনি আমারে তুমি করে বলবেন।

মানুষটা বলল, হ্যাঁ, বলব মা। তুমি আমার মেয়ের বয়সী। তারপর বিজলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুমি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করো না। স্যার আমাকে বলেছেন তোমাকে দেখেশুনে রাখতে। স্যার না বললেও আমি তোমাকে দেখেশুনে রাখতাম।

মানুষটা চলে যাবার পর বিজলী অনেকক্ষণ বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে রইল। কী কারণ কে জানে তার চোখে একটু পরে পরে পানি চলে আসছিল। খোকনকে যখন খুঁজে পাবে তখন তাকে নিয়ে সে ফার্নিচার আর ফ্রিজ কিনবে। খোকনের যা যা পছন্দ সবকিছু কিনবে। ড্রয়ারে টাকার বান্ডিলটা অনেক বড়। তার গুনে দেখতেও ভয় করছে।

.

বিজলী পরের দিন ভোর থেকেই খোকনকে খুঁজতে শুরু করে দিল। একটা স্কুলে ছেলেমেয়েরা আসা শুরু করার আগেই সে সেই স্কুলের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়, তারপর যে ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে দূর থেকে তাদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দুই বছর আগে খোকন তার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এই দুই বছরে খোকন নিশ্চয়ই বড় হয়েছে, কত বড় হয়েছে কে জানে। চেহারা তো নিশ্চয়ই আগের মতো আছে, বড় হওয়ার জন্যে একটুখানি বদলাতে পারে কিন্তু খুব বেশি নিশ্চয়ই বদলাবে না। তার চিনতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না।

.

বিজলী পুরো এক মাস প্রত্যেক দিন সকালবেলা এক একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তখন ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল এইভাবে খোনকে খুঁজে বের করা খুবই কঠিন, বলা যেতে পারে প্রায় অসম্ভব। শহরে একটি-দুটি স্কুল নেই, একেবারে হাজার হাজার স্কুল। প্রত্যেকটা স্কুলে একদিন করে গেলেও পাঁচ-ছয় বছর লেগে যাবে। স্কুলের সময় যখন সব বাচ্চা এসে হাজির হয় তখন একটা সময় এক সাথে অনেক বাচ্চা হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকে। সব বাচ্চাকে তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাও যায় না। কাজেই যে স্কুলে খোকন লেখাপড়া করে সেই স্কুলে গিয়েও তাকে খুঁজে নাও পেতে পারে। কিংবা সত্যি সত্যি হয়তো বিজলী ঠিক স্কুলে হাজির হয়েছে কিন্তু সেদিন খোকন আসেনি, তাহলেও তাকে আর জীবনেও খুঁজে পাবে না।

স্কুল শুরু হওয়ার সময় সে ঘণ্টাখানেক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, প্রত্যেকটা ছেলেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। যখন সব বাচ্চা ভেতরে ঢুকে যায় তখন সে একা একা পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়, খোকনকে কীভাবে খুঁজে বের করবে চিন্তা করে। অনেক চিন্তা করে বিজলী একসময় বুঝতে পারল সে নিজে নিজে এভাবে আসলে খোকনকে খুঁজে বের করতে পারবে না। তাকে বড় মানুষদের সাহায্য নিতে হবে। এখন পর্যন্ত কাউকে সে খোকনের কথা বলেনি। কেন বলেনি সে নিজেও জানে না। এখন সে অন্যদের খোকনের কথা বলবে। প্রথমে বলবে আফজাল চাচাকে। আফজাল চাচা মানুষটা খুব ভালো, বিজলীকে একেবারে নিজের মেয়ের মতো আদর করেন। আফজাল চাচা দরকার হলে আয়েশা গার্মেন্টসের মালিক রায়হান সিদ্দিকীর সাথে কথা বলবেন। তারা নিশ্চয়ই সেলিনা জাহানকে খুঁজে বের করতে পারবে। তখন সেলিনা জাহানকে নিয়ে যেতে হবে হ্যাপি চাইল্ডে। সেখানে সেই রাক্ষুসী নাজনীনের সাথে দেখা করে তার কাছ থেকে খোকনের ঠিকানা নিতে হবে। সে নিজে যখন খোকনের ঠিকানা জানতে চেয়েছিল তাকে ঠিকানাটা বলেনি। কিন্তু যখন বড় বড় মানুষ নাজনীনের কাছে খোকনের ঠিকানা জানতে চাইবে তখন সে আর না বলতে পারবে না। খোকনের ঠিকানা দিতেই হবে।

বিজলী পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দোকানটিতে নানা রকম শার্ট ঝুলছে। কী সুন্দর শার্ট, এরকম একটা শার্টে খোকনকে কী সুন্দর মানাবে! বিজলী দাঁড়িয়ে গেল, অনেক দরদাম করে সে শার্টটা কিনে নিল। যখনই বাইরে যায় তখনই সে খোকনের জন্যে কিছু কিনে ফেলে। শার্ট, প্যান্ট, জুতো, বই, খাতা, কলম এমনকি একটা ফুটবলও কিনে রেখেছে। খোকন কোথায় ফুটবল খেলবে সেটা অবশ্যি বিজলী জানে না কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। বিজলীর মনে আছে তারা যখন চরে ছিল তখন বাচ্চারা সবাই মিলে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলত! খোকনকে আর জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতে হবে না। সত্যিকারের ফুটবল দিয়ে সে খেলতে পারবে।

আফজাল সাহেবকে খোকনের কথা বলতে গিয়েও বিজলী বলতে পারে না, ঠিক কেন সে বলতে পারে না, সে নিজেও জানে না। আগে হোক পরে হোক তার বলতে হবে, যে কয়দিন বলছে না সে কয়দিন তখনো সে স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিজলীকে অবশ্যি আফজাল সাহেবকে কিছু বলতে হলো না, কারণ দুই দিন পর সে নিজেই খোকনের দেখা পেয়ে গেল।

.

স্কুলটা শহরের সবচেয়ে ভালো একটা স্কুল, যারা এখানে পড়তে আসে সবাই গাড়িতে করে আসে। স্কুল শুরুর সময়টাতে পুরো এলাকাতে একটা ট্রাফিক জ্যাম লেগে যায়। বিজলী গেটের কাছে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিল। গেটের দারোয়ান মাঝে মাঝেই তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে, আগে হলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত এখন সে ভালো কাপড় পরে থাকে, মুখটা শক্ত করে রাখে, তাই তাড়িয়ে দিতে সাহস পায় না।

স্কুলের বাচ্চাদের ভিড় যখন সবচেয়ে বেশি তখন একটা নীল রঙের গাড়ি থামল। গাড়ির পেছনের দরজা খুলে একটা ছেলে বের হলো, ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে ড্রাইভারকে কিছু একটা বলল, তারপর ব্যাকপেকটা পেছনে ঝুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং তাকে দেখে বিজলী একটা চাপা আর্তনাদ করল। ছেলেটি খোকন।

.

খোকন একটুখানি বড় হয়েছে, কিন্তু তার চেহারা ঠিক আগের মতো আছে। গায়ের রং হয়তো আগের থেকে একটুখানি ফর্সা হয়েছে, স্বাস্থ্যটাও হয়তো একটুখানি ভালো হয়েছে কিন্তু এ ছাড়া সবকিছু আগের মতো। বিজলীর মনে হলো সে বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, কোনোমতে দেয়ালটা ধরে সে হাঁ করে খোকনের দিকে তাকিয়ে রইল। একবার মনে হলো সে চিৎকার করে থোকনের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে। কিন্তু সে ছুটে গেল না, তাকে গিয়ে জাপটে ধরল না। খোকন যতক্ষণ পর্যন্ত গেটের ভেতরে ঢুকে না গেল ততক্ষণ বিজলী দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে ঢুকে যাবার পর সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকে, কোনদিকে হাঁটছে সে নিজেই জানে না। সে এখনো ভালো করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না, এখনো কেমন জানি একটা ঘোরের মাঝে রয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে দেখল খোকনের নীল গাড়িটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, ট্রাফিক জ্যামের জন্যে বেরিয়ে যেতে পারছে না। বিজলী একটু এগিয়ে গাড়ির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ড্রাইভার চাচা, খোকনের স্কুল ছুটি হবে কখন?

ড্রাইভার অবাক হয়ে গেল, উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

আমি বিজলী।

বিজলী ভেবেছিল তার নামটা বলামাত্র ড্রাইভার তাকে চিনে ফেলবে। খোকন নিশ্চয়ই অনেকবার তার কথা সবাইকে বলেছে। সবাই নিশ্চয়ই এত দিনে তার নাম জেনে গেছে। কিন্তু ড্রাইভার তাকে চিনল না। জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কী করো?

বিজলী হঠাৎ করে বুঝতে পারল এই ড্রাইভার তার নাম শোনেনি। এই ড্রাইভার জানে না খোকন তার আপন ভাই এবং অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত সে খোকনকে খুঁজে পেয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী এখন হঠাৎ করে যদি জানে সে বিজলী, খোকনের আপন বোন তখন এই ড্রাইভার মানুষটা ঘাবড়ে যেতে পারে। তাই তাকে এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। ড্রাইভার আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কী করো?

আমি একটা গার্মেন্টসে কাজ করি। আয়েশা গার্মেন্টস।

ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, যেখানে আগুন লেগেছিল?

হ্যাঁ। বিজলী মাথা নাড়ল, আমি তখন ভেতরে ছিলাম।

ড্রাইভার এতক্ষণ আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে আসছে, এবারে সামনে ফাঁকা, প্যাডেলে চাপ দিয়ে বের হয়ে যাবে। বিজলী জিজ্ঞেস করল, কখন ছুটি হবে খোকনের স্কুল?

এই তো ছুটির সময় বারোটা। কিন্তু তুমি কেন জানতে চাইছ?

বিজলী হাসল, বলল, আমার একটা কাজ আছে। আপনি আবার খোকনকে নিতে আসবেন না?

হ্যাঁ।

তখন দেখবেন।

ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। বিজলী কিছুক্ষণ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। এখন সকাল আটটা। বারোটা বাজতে আরো চার ঘণ্টা বাকি। তাকে এখন চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। এই চার ঘণ্টা সময় সে কেমন করে কাটাবে?

বিজলী ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে। খোকন তাকে দেখে কী করবে? চিৎকার করে তাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চয়ই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকবে। নিশ্চয়ই কাঁদতে কাঁদতে বলবে, বিজলীবু তুমি বলেছিলে, তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না। তুমি কেন তাহলে চলে গেলে।

তখন সে খোকনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে, এই তো আমি আবার চলে এসেছি! তোকে খুঁজে খুঁজে বের করেছি! বের করেছি কি না?

আসলে সে মনে হয় কিছু বলতে পারবে না। খোকনকে জড়িয়ে ধরে সেও নিশ্চয়ই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকবে। রাস্তা দিয়ে যারা যাবে-আসবে তারা নিশ্চয়ই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারা কী ভাববে কে জানে। যা ইচ্ছে ভাবুক, এতদিন পর সে তার নিজের ভাইকে খুঁজে পেয়েছে, সে তার ভাইয়ের সাথে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। কার তাতে কী আসে যায়?

বিজলী পথে পথে ঘুরে বেড়াল, খোকনের জন্যে একটা চকলেট কিনল। যখন কান্নাকাটি থামবে তখন সে এটা খোনকে খেতে দেবে। অনেক দামি বিদেশী চকলেট, খোকন নিশ্চয়ই পছন্দ করবে।

বারোটার অনেক আগেই বিজলী স্কুলের সামনে পৌঁছে গেল। স্কুল ছুটির পর বাচ্চাদের নিতে গাড়িগুলো এখনো আসতে শুরু করেনি। বিজলী গেটের কাছাকাছি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনায় তার বুকটা ধুকপুক করছে। খোকন আসলেই কি চিৎকার দিয়ে তার দিকে ছুটে আসবে? নাকি এতদিন পর দেখা হয়েছে বলে একটুখানি লজ্জা পাবে? দুই বছরে তার নিজের চেহারা কি অনেক পাল্টে গেছে? তাকে দেখে যদি না চেনে? বিজলী জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিল, যতই তার চেহারা পাল্টে গিয়ে থাকুক, তাকে চিনবে না এটা হতেই পারে না! সে একেবারে এইটুকুন থেকে খোকনকে বুকে ধরে বড় করেছে।

খোকন তাকিয়ে দেখল একটি একটি করে গাড়ি এসে থামছে এবং একটু পরে খোকনের নীল গাড়িটাও এসে থামল। বিজলী গাড়িটার দিকে এগিয়ে যায় এবং তখন লক্ষ করল পেছনের সিটে একজন মহিলা বসে আছে। মহিলাটি মিলি, বিজলী তাকে কখনো দেখেনি। মিলিকে দেখে বিজলী হঠাৎ করে বুঝতে পারল তার খোকন এখন আর পুরোপুরি তার নেই। সে যেরকম আদর করে খোকনকে বড় করেছে এখন অন্য একজন মহিলাও খোকনকে আদর করে বড় করছে। হঠাৎ করে বিজলীর বুকটা কেমন জানি ধ্বক করে ওঠে।

পেছনের সিটে বসে থাকা মিলি গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এল এবং গাড়ির ড্রাইভারও অন্য পাশ থেকে বের হয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার ইদ্রিস মিয়া বাসায় গিয়ে মিলিকে বিজলীর কথা বলেছে, একজন অচেনা মেয়ে খোকনের খোঁজখবর নিচ্ছে শুনে মিলি নিজেই চলে এসেছে। মিলি দেখতে চায় কে খোকনের খোঁজ করেছে। কেন খোঁজ করেছে।

বিজলী গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল, মিলির কাছাকাছি পৌঁছানোর পর ড্রাইভার ইদ্রিস মিয়া বলল, ম্যাডাম, এই যে, এই মেয়েটা খোকনের খোঁজ নিচ্ছিল।

মিলি বিজলীকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখল, তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি খোকনের খোঁজ নিচ্ছিলে কেন?

বিজলী বলল, আমি বিজলী। খোকন আমার ছোট ভাই।

মিলি ভয়ানকভাবে চমকে উঠল, কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারল না। নিজেকে সামলে নিতে তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল, তারপর বিজলীর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, তোমার নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে। খোকনের কোনো বোন নেই।

বিজলী হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, কাঁপা গলায় বলল, আছে। এই যে আমি। আমি খোকনের বোন। খোকন কখনো আপনাদের কাছে আমার কথা বলে নাই?

না। মিলি মাথা নাড়ল, খোকন কখনো তোমার কথা বলে নাই। সে কখনো বলে নাই যে তার অন্য কোনো ভাইবোন আছে।

বিজলী অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য!

এর মাঝে আশ্চর্যের কিছু নেই। তুমি কিছু একটা ভুল করেছ। তুমি যে খোকনের কথা বলছ নিশ্চয়ই এই খোকন সেই খোকন নয়। অন্য কোনো খোকন।

না। বিজলী শুকনো গলায় বলল, আমি অনেকদিন থেকে খোকনকে খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত আজকে খোকনকে পেয়েছি। খোকনকে আমি চিনি, আমি তাকে বড় করেছি।

মিলি একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, তুমি এত ছোট একটা মেয়ে তুমি কেমন করে খোকনকে বড় করবে? তোমার কিছু একটা ভুল হয়েছে। আমি খুব ভালো করে জানি খোকনের কোনো ভাইবোন নেই।

বিজলী কেমন যেন অসহায় অনুভব করে। কী বলবে বুঝতে পারে না, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, ঠিক আছে। খোকন আসুক–সে আমাকে দেখলে চিনবে।

না। মিলি মাথা নাড়ল, বলল, আমি চাই না তুমি খোকনকে কিছু বলো। আমরা জানি এবং খোকন জানে তার কেউ নেই। মা বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই। এখন হঠাৎ করে তুমি যদি তাকে বোঝাতে শুরু করো যে তুমি তার বোন, সেটা মোটেও ভালো হবে না। আমি তোমাকে সেরকম কিছু করতে দেব না। তুমি যাও।

বিজলীর মাথাটা ঘুরে উঠল, এত কষ্ট করে সে খোকনকে খুঁজে বের করেছে এখন তার সাথে সে একবার কথাও বলতে পারবে না? হঠাৎ করে বিজলীর শরীরটা শক্ত হয়ে ওঠে, সে কঠিন গলায় বলল, আমি যাব না। আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলব।

ঠিক তখন স্কুলের ভেতর ছুটির ঘণ্টা পড়ল এবং স্কুলের ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতে করতে গেট দিয়ে বের হতে থাকল। বিজলী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তীক্ষ্ণ চোখে গেটের দিকে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ করে খোকনকে দেখা গেল, সে এদিক-সেদিক তাকাল, তার নীল গাড়িটা চোখে পড়ল, তখন রাস্তা পার হয়ে খোকন গাড়িটার দিকে ছুটে আসতে থাকল। বিজলীও ছুটে গেল, খোকনকে মাঝপথে

আটকে সে চিৎকার করে ডাকল, খোকন!

খোকন ঘুরে তাকালো, বিজলীকে এক নজর দেখল, তাকে চিনতে পারল না। বিজলীকে পাশ কাটিয়ে সে তার মায়ের দিকে ছুটে যেতে থাকে। বিজলী হকচকিত হয়ে খোকনের পিছু পিছু ছুটে যেতে যেতে আবার চিৎকার করে ডাকল, খোকন! আমি বিজলী। তোর বিজলীবু।

খোকন আবার বিজলীর দিকে তাকালো, কিন্তু তাকে এবারেও চিনতে পারল না, তার চোখে-মুখে হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক ফুটে ওঠে, সে ছুটে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইল।

বিজলীর মনে হলো তার চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবীটা বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে, সে ভাঙা গলায় বলল, খোকন, সোনা, ভাইটি আমার–তুই আমারে চিনতে পারছস না? আমি বিজলী! তোর বিজলীবু?

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি তোমাকে চিনি না। তুমি যাও।

বিজলী হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, বলল, খোকন! তুই আমারে চিনতে পারছস না? চিনতে পারছস না?

মিলি খোকনকে নিয়ে টেনে গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। কঠিন গলায় বিজলীকে বলল, আমি তোমাকে বলেছি মেয়ে। খোকন তোমার ভাই না। তুমি তো দেখছ সে তোমাকে চেনে না। এখন এখানে সিন ক্রিয়েট করো না। তুমি যাও! তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, ইদরিস মিয়া গাড়ি চালাও।

বিজলী তখনো হাল ছাড়ল না, ছুটে গিয়ে জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, খোকন, তোর মনে নাই, তোরে নিয়া সারারাত গাছের উপর বসে থাকলাম? মনে নাই সাইক্লোন এসে আমাদের উড়ায়ে নিচ্ছিল, তুই আর আমি সারারাত গাছ ধইরা ঝুলে রইলাম? তোর মনে নাই বাতাসে গাছের ডাল এসে তোরে আর আমারে চাবুকের মতো মারতে লাগল? মনে নাই?

খোকন কেমন যেন থর থর করে কাঁপতে থাকে, ফিসফিস করে বলল, না, আমার মনে নাই। আমার কিছু মনে নাই। তুমি যাও। প্লিজ। তুমি যাও।

বিজলী ভাঙা গলায় বলল, মনে নাই তুই আর আমি সারাদিন বালুর উপর শুয়ে রইলাম? সেলিনা আপা এসে আমাদের হাসপাতালে নিল? মনে নাই?

খোকন তার মায়ের শরীরে মুখ লাগিয়ে বলল, না, মনে নাই। তুমি যাও। যাও।

মিলি ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে বলল, কী হলো? তুমি গাড়ি ছাড়ছ কেন?

ইদরিস ড্রাইভার বলল, মেয়েটা ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে রেখেছে, যেতে পারছি না।

মিলি বিজলীর মাথাটা ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করার চেষ্টা করতে করতে ধমক দিয়ে বলল, কী করছ তুমি? সরে যাও। সরে যাও বলছি।

বিজলী সরে গেল না, চিৎকার করে বলল, খোকন, তোর মনে নাই তুই আর আমি হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম! মনে নাই সমুদ্রের পার দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতাম? মনে নাই তুই একবার বই পুরস্কার পাইলি, ছোটদের মহাপুরুষ? মনে নাই?

খোকন দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে থর থর করে কাঁপতে থাকে। মিলি ধাক্কা দিয়ে বিজলীকে সরিয়ে দিল এবং সাথে সাথে ইদরিস ড্রাইভার প্যাডেলে চাপ দিয়ে গাড়িটা ছুটিয়ে নিতে থাকে। বিজলী গাড়ির জানালা ধরে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে আছড়ে পড়ল এবং সেইভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

কয়েকজন বিজলীর কাছে ছুটে এসে তাকে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার? কী হয়েছে মেয়ে?

বিজলীর চারপাশে মানুষের ভিড় জমে যায়। বিজলী মাথা নেড়ে বলল, না, কিছু হয় নাই। আমার কিছু হয় নাই। আপনারা যান। যান আপনারা।

তারপর ভিড় ঠেলে সে বের হয়ে আসে। তার চারপাশের জগত্তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে? কী করবে সে এখন? কোথায় যাবে? রাস্তা দিয়ে বিশাল একটা দোতলা বাস আসছে? সে কি এখন ছুটে গিয়ে বাসের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে? পড়বে ঝাঁপিয়ে?

বিজলী ফুটপাথে বসে পড়ে আকুল হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

*

বাসায় এসে খোকন কিছু খায়নি। নিজের ঘরে বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। তার মাথার ভেতরে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। কিছু একটা ঘটছে, কী ঘটছে সে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে বুঝি পাগল হয়ে যাবে।

মিলি খোকনের সামনে কারো সাথে কথা বলেনি। খোকন তার ঘরে ঢুকে যাবার পর প্রথমে রায়হানকে ফোন করে তার সাথে কথা বলেছে। তারপর হ্যাপি চাইল্ডে ফোন করে, নাজনীনের সাথে কথা বলেছে। তাকে জিজ্ঞেস করেছে, আপনি কি জানেন, খোকনের কি বিজলী নামে কোনো বোন আছে?

নাজনীন হঠাৎ কেমন জানি বিপদের গন্ধ পেল, প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, আপনি এটা কেন জিজ্ঞেস করছেন? কে বিজলীর কথা বলেছে?

আজকে খোকনের স্কুলে হঠাৎ একটা মেয়ে এসে হাজির। পনেরো ষোল বছর বয়স। সে বলছে খোকন তার ছোট ভাই?

তাই নাকি? নাজনীন অবাক হবার ভান করল, খোকন কী বলছে?

খোকন মেয়েটিকে চিনতে পারছে না।

নাজনীন বুকের ভেতর আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা বের করে দিয়ে বলল, খোকন যদি চিনতে না পারে তাহলে সে কেমন করে তার বোন হতে পারে? এই মেয়ে নিশ্চয়ই কোনো ধরনের ক্রিমিনাল–আপনাদের ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে। কোনো পাত্তা দেবেন না। থানায় একটা জিডি করে রাখেন।

মিলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু মেয়েটা এত ইমোশনাল হয়ে গেল, কথাবার্তা এত রিয়েলিস্টিক যে আমার কাছে মনে হচ্ছিল সত্যি বুঝি তার আপন বোন। আমি খুবই আপসেট।

নাজনীন হা হা করে হাসল, বলল, না, না, মোটেও আপসেট হবেন না। আপনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন। খোকনের কোনো ভাইবোন নেই, আপনি চাইলে আমি আমাদের রেকর্ড দেখাতে পারি।

মিলি বলল, না, না। আপনাকে রেকর্ড দেখাতে হবে না। আপনি বললেই আমি বিশ্বাস করব। কিন্তু মেয়েটি এমনভাবে কথা বলছিল যে আমার মনে হচ্ছিল সত্যি বুঝি খোকনের বোন।

না না, মোটেও না। নাজনীন জোর দিয়ে বলল, মোটেও খোকনের বোন না। মেয়েটা নিশ্চয়ই আমাদের শেল্টারে ছিল, খোকনের সাথে পরিচয় করে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছে–এখন আপনাদের সামনে ভাণ করছে সে খোকনের সবকিছু জানে! একধরনের ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা। একেবারে পাত্তা দেবেন না। আপনি বরং আমাকে বলেন মেয়েটা কোথায়। আমি পুলিশকে জানিয়ে রাখতে পারি, পুলিশে আমার পরিচিত মানুষ আছে। দেখামাত্র অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।

মিলি অন্যমনস্কের মতো বলল, না। অ্যারেস্ট করাতে হবে না। বাচ্চা একটা মেয়েকে অ্যারেস্ট করাব কেন?

.

রায়হান অফিস থেকে আসার পর মিলি আর রায়হান মিলে খোকনকে বিছানা থেকে তোলার চেষ্টা করল কিন্তু খোকন উঠতে রাজি হলো না। বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে রইল। মিলি অবাক হয়ে দেখল একটু পরে পরে তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মিলি অনেকক্ষণ তার মাথায় শরীরে হাত বুলাতে লাগল কিন্তু খোকন কাঁপতেই থাকল। রাত্রে খোকন কিছু খেলো না।

খোকন অস্থির অনুভব করে। দুপুরবেলা স্কুলে যে মেয়েটাকে দেখেছে কিছুতেই সেই মেয়েটার কথা ভুলতে পারছে না। সে মেয়েটাকে চিনে না, কিন্তু কী আশ্চর্য, তবু তার মনে হচ্ছে সে মেয়েটাকে আগে দেখেছে। মনে হচ্ছে তার খুব কাছাকাছি মেয়ে। মেয়েটা সাইক্লোনের কথা বলছিল, খোকন সত্যি সত্যি মনে করতে পারে সে একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলেছিল, সাথে আর কেউ ছিল কি না সেটা তার মনে নেই কিন্তু এখন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ছে যে তখন আরো কেউ তার সাথে ছিল। বিজলী নামটা খুবই পরিচিত একটা নাম, কিন্তু যতবার এই নামটা মনে করতে চায় ততবারই মনে হয় খুব বড় একটা বিপদ হয়ে যাবে। কেউ একজন কাউকে খুন করে ফেলবে। কে কাকে খুন করবে? কেন খুন করবে?

খোকন কিছু মনে করতে পারে না, অস্থির হয়ে সে ছটফট করতে থাকে।

মিলি অনেক রাত পর্যন্ত খোকনের মাথার কাছে বসে রইল, একসময় মনে হলো খোকন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সে নিঃশব্দে উঠে নিজের বিছানায় শুতে গেল। মিলি একা একা বিছানায় শুয়ে রইল, সে কিছুতেই বিজলী নামের সেই বিচিত্র মেয়েটার কথা ভুলতে পারছিল না। মেয়েটার কথাবার্তার মাঝে কিছু একটা ছিল যেটা চট করে ভুলে যাওয়া যায় না। মিলি বিছানায় ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে গেল।

গভীর রাতে মিলির ঘুম ভেঙে যায়। কেউ একজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে ঝট করে বিছানায় উঠে বসে। তারপর বিছানা থেকে নেমে সে দ্রুত পায়ে খোকনের ঘরে গেল। খোকন তার বিছানায় বসে আছে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

মিলি মশারি তুলে ভেতরে ঢুকে খোকনের মাথায় হাত রাখল, নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবা?

খোকন মিলিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার সব মনে পড়েছে মা।

কী মনে পড়েছে।

বিজলীবুয়ের কথা।

মিলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর বলল, বিজলী তোমার বোন?

হ্যাঁ।

তাহলে কোনোদিন বিজলীর কথা বললে না কেন?

ম্যাডাম বলেছিল বিজলীবুয়ের কথা বললে তাকে খুন করে ফেলবে।

কোন ম্যাডাম বলেছিল?

নাজনীন ম্যাডাম। সেই জন্যে আমি এত ভয় পেয়েছিলাম যে কিছু বলি নাই। তারপরে কীভাবে জানি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম। বিজলীবুয়ের কথা বললেই মাথার ভেতর কেমন যেন উল্টাপাল্টা হয়ে যেত। মনে করতে পারতাম না।

মিলি নিঃশব্দে খোকনের মাথায় হাত বুলাল।

খোকন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বিজলীবুকে নাজনীন ম্যাডাম খুন করতে পারে নাই। বিজলীবু বেঁচে আছে–

হ্যাঁ বেঁচে আছে।

কিন্তু বিজলীবুকে তো আর খুঁজে পাব না। কোনোদিন খুঁজে পাব না! খোকন হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

মিলি বলল, কে বলেছে খুঁজে পাব না। একশবার খুঁজে পাব।

খোকন কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকালো, তুমি বিজলীবুকে খুঁজে বের করতে পারবে?

হ্যাঁ।

কখন?

এখন।

এখন?

হ্যাঁ। তুমি জামা কাপড় পর, আমরা এখনই বিজলীকে খুঁজতে বের হব।

মিলি শোয়ার ঘরে গিয়ে রায়হানকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলল। রায়হান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?

উঠো।

কেন?

বিজলীকে খুঁজে বের করতে হবে?

কাকে?

মিলি বলল, বিজলীকে।

কেন?

খোকনের সবকিছু মনে পড়েছে। বিজলী আসলেই তার বোন।

রায়হান কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তারপর বলল, কিন্তু এত রাতেই কেন খুঁজে বের করতে হবে?

মিলি ড্রয়ার খুলে তার একটা শাড়ি বের করতে করতে বলল, তার কারণ আমি এই বাচ্চা মেয়েটার উপর অনেক বড় অবিচার করেছি। আমার তাকে খুঁজে বের করে তার হাত ধরে মাফ চাইতে হবে।

রায়হান কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে রইল। মিলি বলল, ইদরিসকে ফোন করো। ইদরিস জানে মেয়েটা কোন গার্মেন্টসে কাজ করে। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। উঠো তাড়াতাড়ি।

রায়হান বিছানা থেকে উঠল।

.

বিজলী ঘরের দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছে। অনেক রাত হয়েছে। সে ঘুমাতে পারছে না। ঘুমানোর চেষ্টাও করেনি, চুপচাপ বসে আছে। সে এখন কী করবে? খোকন যদি তাকে চিনতে না পারে তাহলে সে বেঁচে থেকে কী করবে? কী নিয়ে সে বেঁচে থাকবে! দিনের পর দিন সে পথেঘাটে বেঁচে থেকেছে শুধু একদিন খোকনের সাথে দেখা হবে সেই আশায়। এখন যদি সেই আশাটাও না থাকে তাহলে সে বেঁচে থেকে কী করবে?

তার এই ছোট অ্যাপার্টমেন্টটা বড় রাস্তার পাশে। সারাদিন গাড়ি বাস টেম্পোর শব্দ শুনতে পায়। রাত হলে ভারী ট্রাকের গর্জন শুনে। এখন কোনো শব্দ নেই। সবাই তার কাজ শেষ করে ঘুমুতে গেছে। শুধু বিজলীর চোখে ঘুম নেই। সাইক্লোনের রাতে গাছের ডালে বসে সে যেরকম সারারাত ছটফট করেছে, আজকেও সে সেরকম ছটফট করছে। শুধু এখন সাথে খোকন নেই।

বিজলী একটা গাড়ির শব্দ শুনল। মনে হলো তার বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়িটা থেমেছে। এত রাতে কে এসেছে? তার মতো আজ রাতে আর কার চোখে ঘুম নেই?

কেউ একজন নিচে দারোয়ানের সাথে কথা বলছে। মনে হলো বিল্ডিংয়ে কয়েকজন এসে ঢুকল। বিজলী সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পায়ের শব্দ তার দরজার সামনে এসে থেমে গেল। তারপর কেউ একজন তার দরজায় শব্দ করল। টুক টুক টুক।

বিজলী উঠে দাঁড়াল, ঘরের আলো জ্বালিয়ে সে দরজাটি খুলে দিল। বাইরে খোকন দাঁড়িয়ে আছে। তার খোকন। খোকনের হাত ধরে তার নতুন মা। পেছনে মনে হয় আরো কয়েকজন, বিজলী তাদের দেখল না।

খোকনের হাত ধরে রাখা তার নতুন মা নরম গলায় বলল, বিজলী মা। তোমার ছোট ভাইকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।

বিজলী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরের দরজায় আবছা অন্ধকার, খোকনের চেহারাটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। বিজলী তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়। খোকন এসে বিজলীর হাতটা ধরল, বিজলী টের পেল খোকন সেই হাতটা শক্ত করে ধরেছে যেন আর কোনোদিন ছুটে না যায়। বিজলী তখন খুব ধীরে ধীরে খোকনকে নিজের কাছে টেনে আনে, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে। খোকনের মাথার চুলের মাঝে নিজের মুখটা ডুবিয়ে দিয়ে বিজলী ডুকরে কেঁদে উঠল। কতদিন সে এভাবে কাঁদেনি।

মিলি, রায়হান, আফজাল সাহেব, ইদরিস ড্রাইভার এবং বিল্ডিংয়ের দারোয়ান দেখতে পেল দুটি ভাইবোন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে।

কেউ তাদের থামানোর চেষ্টা করল না। কাঁদুক। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদুক।

যতক্ষণ ইচ্ছা কাঁদুক।

*

দরজা খুলে রায়হান মাথা ঢুকিয়ে বলল, আসতে পারি?

নাজনীন তার ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকালো। রায়হানকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আরে! রায়হান সাহেব, কোনো খবর না দিয়ে চলে এসেছেন? আসেন আসেন।

রায়হান ভেতরে ঢুকল, বলল, খবর না দিয়ে এসেছি, কিন্তু খবর না নিয়ে আসিনি। আমার সাথে আরো অনেকে আছে!

নাজনীনকে কেমন জানি ভীত দেখাল। ইতস্তত করে বলল, কোথায়?

আসছে। সবাই আসছে।

প্রথমে খোকনের হাত ধরে মিলি ভেতরে ঢুকল। তারপর বিজলীর হাত ধরে সেলিনা জাহান। তাদের পেছনে আফজাল সাহেব।

নাজনীন সবার দিকে একবার তাকালো এবং মুহূর্তের মাঝে সবকিছু বুঝে গেল।

সেলিনা জাহান একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি সকালের ফ্লাইটে এসেছি, বিকালের ফ্লাইটে চলে যাব।

নাজনীন কিছু বলল না। সেলিনা জাহান জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছি জানেন?

নাজনীন দুর্বল গলায় বলল, কিছু একটা মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। ইনফরমেশন গ্যাপ–

সেলিনা জাহান আরো এক পা এগিয়ে এসে বলল, না। কোনো মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়নি। কোনো ইনফরমেশন গ্যাপ নেই। সবকিছু আপনার পরিকল্পনামতো হয়েছিল, শুধু আপনি বিজলীকে চিনতে পারেননি। এই বাচ্চা মেয়েটাকে আপনি আন্ডারএস্টিমেট করেছেন। এই বাচ্চা মেয়েটা সাইক্লোনের রাতে টাইডাল ওয়েভের মাঝে তার ভাইটিকে ধরে রেখেছিল। ছুটে যেতে দেয়নি। কিন্তু আপনি সেই ভাইটিকে ছুটিয়ে আলাদা করে এই মেয়েটাকে পথে বের করে দিয়েছেন। মেয়েটার জীবন ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, মেয়েটা ধ্বংস হয়ে যায়নি। সেলিনা জাহান একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তাই আমরা আপনাকে শুধু একটা কথা বলতে এসেছি।

নাজনীন দুর্বল গলায় বলল, কী কথা?

আপনি আসলে মানুষ না। আপনি রাক্ষুসী। আপনার মানুষের সাথে থাকার কথা না। আপনার অন্য রাক্ষস অন্য রাক্ষুসীর সাথে থাকার কথা। আমি আপনাকে বলতে এসেছি যে আমি সেই ব্যবস্থা করে দেব। খোদার কসম।

নাজনীনের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে যায়, সে কারো চোখের দিকে তাকাতে পারে না, মাথা নিচু করে ফেলে।

মিলি খোকনের হাত ধরে রেখে বলল, চল, আমরা যাই। এখানে আমি এক সেকেন্ডও থাকতে পারব না।

খোকন বলল, হ্যাঁ। চল।

আমাদের আজকে অনেক প্রোগ্রাম। নতুন বইয়ের দোকানটা আমাদের এখনো দেখা হয়নি, মনে আছে? এসো বিজলী।

যেভাবে সবাই ঢুকেছিল, সবাই সেভাবে বের হয়ে গেল। করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিজলী দাঁড়িয়ে গেল। সেলিনা জাহান জিজ্ঞেস করল, কী হলো?

এক সেকেন্ড। আমি নাজনীন ম্যাডামকে একটা জিনিস বলে আসি।

সেলিনা বিজলীর হাত ছেড়ে দিল। বিজলী দৌড়ে নাজনীন ম্যাডামের অফিসের দিকে ছুটে যায়।

দরজা খুলে অফিসে ঢুকতেই নাজনীন অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকালো। বিজলী ঘুরে দরজাটা বন্ধ করে তার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। নাজনীন ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হচ্ছে, দরজাটা বন্ধ করছ কেন?

বিজলী তার ওড়নাটা কোমরে প্যাচিয়ে নেয়। তারপর ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নাজনীনের দিকে এগিয়ে যায়। নাজনীন ভয় পেয়ে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। শুকনো গলায় বলল, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?

বিজলী ফিসফিস করে বলল, আপনার জন্যে আমাকে এক বছর থেকে বেশি রাস্তায় থাকতে হয়েছে। আমি ছেলে সেজে দিনের পর দিন ফুটপাথে ঘুমিয়েছি। রাস্তায় অন্যদের সাথে মারামারি করেছি। আমি এখন খুব ভালো মারামারি করতে পারি। একটা ঘুষি দিয়ে আমি একজনকে মাটিতে ফেলে দিতে পারি।

নাজনীন কাঁপা গলায় বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

যাওয়ার আগে আমি আপনাকে দুইটা ঘুষি মারব যেন বাকি জীবন আপনার আমার কথা মনে থাকে। প্রথম ঘুষিটা আমার ভাইকে আমার থেকে আলাদা করে দেওয়ার জন্য! আর দুই নম্বর ঘুষিটা আমাকে পুলিশের কাছে দেওয়ার জন্য–

বিজলীর চোখ থেকে আগুন বের হতে থাকে। সে হিংস্র মুখে এক পা এগিয়ে যায়।

নাজনীন পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, ভীত মুখে বলল, কী বলছ। পাগলের মতো–

এর জন্যে আবার যদি আমায় জেলে যেতে হয় আমি জেলে বিজলী আরো এক পা এগিয়ে গেল, এবারে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে এই রাক্ষুসীর মুখে ঘুষি মারবে, তার নাকটা ভেঙে গল গল করে রক্ত বের হয়ে আসবে। সে হাত উপরে তুলল।

ঠিক তখন নাজনীন ধপ করে নিচে পড়ে বিজলীর পা ধরে ফেলল, বলল, প্লিজ! প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। মাফ করে দাও–আল্লাহর কসম লাগে–

বিজলী বিস্ফারিত চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। একটু আগেও এই মহিলাটি একজন মানুষ ছিল। এখন সে একটা তেলাপোকার মতো, একটা কেঁচোর মতো, একটা কেন্নোর মতো। বিজলী ইচ্ছা করলেই তাকে এখন পা দিয়ে পিষে ফেলতে পারবে। সে একটা মানুষকে পিষে ফেলতে এসেছিল, তেলাপোকা কিংবা কেঁচোকে কিংবা কেন্নোকে পিষে ফেলতে আসেনি। ঘেন্নায় হঠাৎ তার সারা শরীর ঘিন ঘিন করতে থাকে।

বিজলী নিজের পা ছাড়িয়ে পেছনে সরে এল। কয়েক সেকেন্ড মাটিতে পড়ে থাকা কুৎসিত প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে সে বাইরে বের হয়ে আসে। সেলিনা জাহান তার জন্যে করিডোরে অপেক্ষা করছে। তাকে দেখে বলল, কথা হয়েছে?

হ্যাঁ। হয়েছে।

কোনো সমস্যা?

না।

চলো তাহলে যাই।

চলেন।

সেলিনা জাহান নিচু গলায় বলল, বিজলী, তোমাকে যেদিন চর থেকে তুলে এনেছিলাম তোমাকে কী বলেছিলাম মনে আছে?

বিজলী সেলিনা জাহানের দিকে তাকালো, মাথা নেড়ে বলল, কী বলেছিলেন?

বলেছিলাম খোদা তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন কেন জান? কারণ তোমাদের দিয়ে অনেক বড় কোনো কাজ করাবেন।

বিজলীর মনে পড়ল। সে মাথা নাড়ল।

তাই তুমি খুব বড় কিছু করার জন্য রেডি হও। বুঝেছ? তোমাকে আবার স্কুলে যেতে হবে। লেখাপড়া করতে হবে। ঠিক আছে?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

.

খোকন আর বিজলীকে নিয়ে ছোট দলটি হেঁটে যেতে থাকে। বিজলী দেখল একটু পরে পরে খোকন হি হি করে হাসছে। কী নিয়ে হাসছে কে জানে!

বিজলী নিজেও হেসে ফেলল! কেন হাসছে সেও জানে না। সব সময় সবাইকে সবকিছু জানতে হবে কে বলেছে?

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল