দেয়ালে পিঠ দিয়ে বিজলী বসে ছিল। তার মাথার ভেতরে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। সে ভালো করে কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছে না। খোকনকে কোনোদিন আর সে দেখতে পারবে না, চিন্তা করলেই তার মাথাটা ঘুরে উঠছে। সাইক্লোনের রাতে সে যখন খোকনকে ধরে গাছে বসেছিল, বন্যার পানি একটু পরপর যখন তাদের টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল তখনো সে এরকম অসহায় বোধ করেনি।

গার্ডগুলো তাকে এই ঘরে ঢুকিয়ে পিটিয়েছে। বিজলী হাত দিয়ে যেটুকু সম্ভব নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে, পারেনি। সারা শরীরে ব্যথা। কপালের উপর আর ঠোঁটের কোনা কেটে গিয়েছে, মুখে নোনা রক্তের স্বাদ। বিজলী অবশ্যি সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। খোকন তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, এই চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতে পারছে না, তাই শরীরের ব্যথাটাও ভালো করে টের পাচ্ছে না।

কতক্ষণ সে এই ঘরটার মাঝে বসেছিল নিজেই জানে না। একসময় খুঁট করে দরজাটা খুলে গেল। দরজার সামনে কয়েকজন মহিলা পুলিশ। একজন বলল, এই মেয়ে। তুমি বের হয়ে এসো।

একজন গার্ড বলল, হাতে হাতকড়া লাগিয়ে নেন। না হলে সমস্যা হতে পারে। এই মেয়ে খুব ডেঞ্জারাস।

মহিলা পুলিশ বলল, সেইটা আমরা দেখব। তারপর আবার বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, এসো। বের হয়ে এসো।

বিজলী উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, সারা শরীরে ব্যথা, সে দেয়াল ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। মহিলা পুলিশটা এসে তাকে ধরে সাহায্য করে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসে। গার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা এর গায়ে হাত দিয়েছেন? মারপিট করেছেন?

গার্ড বলল, মেরে তক্তা করে ফেলা দরকার ছিল।

মহিলা পুলিশটা বলল, কাজটা ঠিক হয় নাই।

বিজলী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমাকে কোথায় নিচ্ছেন। হাজতে?

তোমার বয়স কম। তোমাকে হাজতে নেয়া হবে না।

তাহলে?

তোমার বিরুদ্ধে অনেক বড় কমপ্লেন হয়েছে। তাই তোমাকে আমাদের হাতে দেওয়া হয়েছে।

এইখানে আমার ছোট ভাই ছিল, এরা তাকে কোথায় জানি সরিয়ে নিয়েছে।

মহিলা পুলিশ বলল, অনর্থক কথা বলো না। কোনো লাভ হবে না।

বিজলী চুপ করে গেল। হঠাৎ করে তার মনে হলো কিছুতেই আর কিছু আসে যাবে না।

.

নানা জায়গায় ঘুরিয়ে, নানা অফিসে বসিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত তাকে একটা বড় বিল্ডিংয়ে আনা হয়েছে। সেখানে একজন মহিলা একটা কলাপসিবল গেট খুলে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। একটা সরু সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে একটা বড় হলঘরে এসে পৌঁছাল। সেখানে মেঝেতে সারি সারি বিছানা। অনেকগুলো নানা বয়সী মেয়ে সেই বিছানাগুলোতে শুয়ে-বসে আছে।

বিজলীকে দেখে একজন বলল, হায় খোদা! এরা তো দেখি একটা দুধের বাচ্চারে ধরে নিয়ে আসছে!

আরেকজন হি হি করে হেসে বলল, আজকালকার মাইয়া জন্ম হওয়ার সাথে সাথে পাকনা মরিচ!

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, কী করছিলা? চুরি চামারি নাকি অন্য কিছু?

বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে সে হাঁটুতে মাথা রাখল। শুনল একজন বলছে, পিটাইছে মনে হয়।

হ। শক্ত পিটান দিছে–

নিষ্ঠুর চেহারার একজন মহিলা তার শাড়ির গোজ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে সেটাতে একটা টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে বলল, এই মেয়ে তোর নাম কী?

বিজলী হাঁটু থেকে মাথা তুলে নিচু গলায় বলল, বিজলী।

কই ছিলি? কী করছস?

বিজলী সিগারেট মুখে মেয়েটির দিকে তাকালো, তার সাথে তুই তুই করে কথা বলছে, মনে হয় মেয়েটা অন্যভাবে কথা বলতেই জানে না। কথা বলার ভঙ্গি যত খারাপই হোক গলায় স্বরে একটু সমবেদনা আছে। বিজলী বলল, মাথার ঠিক ছিল না, তাই একজনরে মারতে গেছিলাম।

কারে?

ডিরেক্টর না হলে চেয়ারম্যান হবে।

কী জন্যে?

আমার ছোট ভাইটারে কোথায় জানি দিয়ে দিছে। আমারে জানায় নাই। কথা শেষ করে বিজলী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা মেয়েগুলো কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। তারপর একজন উঠে এসে তার পিঠে হাত রেখে বলল, কান্দিস না। দুনিয়াটাই এই রকম।

সিগারেট মুখে মেয়েটি এক মুখ ধোয়া ছেড়ে বলল, ঐ ডিরেক্টররে মাইর দিতে পারছিলি? ব্যাড়া মানুষরে মাইর দেওয়া খুব সোজা। দুই ঠ্যাংয়ের মাঝখানে খালি শক্ত একটা লাথি দিবি

বিজলী বলল, ডিরেক্টর, পুরুষ না। মহিলা।

এবারে সবাই একটু সোজা হয়ে বলল। একজন বলল, মাইয়া মানুষ? মাইয়া মানুষরে মাইর দিছস?।

সবাই তখন খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল সে ঠিক কীভাবে তাকে মেরেছে। বিজলী অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, সে খুব বিস্ত রিতভাবে পুরো ঘটনাটার বর্ণনা দিল এবং সেটা শুনে সবাই আনন্দে হি হি করে হাসল।

নাজনীনকে ধাওয়া করে নেওয়ার সময় সে যখন আছাড় খেয়ে পড়েছে সেই অংশটি তাকে দুইবার বলতে হলো। এবং দুইবারই সবাই হেসে গড়াগড়ি খেল।

শুধু একটা মেয়ে না হেসে একবার একজনের মুখের দিকে আরেকবার আরেকজনের মুখের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকাতে লাগল, মনে হলো সে বিজলীর কিংবা অন্য কারো কোনো কথা বুঝতে পারছে না।

বিজলী কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝে গেল মেয়েগুলো অন্যরকম। তাদেরকে নানা জায়গা থেকে ধরে আনা হয়েছে। যারা আছে তারা সবাই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো ঝামেলা করে এসেছে। কয়েকজন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। একজন মহিলা পকেটমার। কয়েকজন দাবি করল তারা খারাপ মেয়েলোক, তার অর্থ কী বিজলী পরিষ্কার বুঝতে পারল না। যে মেয়েটি অন্যদের সাথে হাসিতে যোগ দেয়নি সে ইন্ডিয়ান মেয়ে, কীভাবে কীভাবে এই দেশে এসে আটকা পড়েছে। বাংলা বোঝে না কিন্তু ইংরেজি জানে। একটি মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে এবং মুখ শক্ত করে বলেছে সে আর বাড়ি ফিরে যাবে না। জায়গাটা একটা জেলখানার মতো, কিন্তু এখানে কারো কোনো বিচার হয় না, এখান থেকে কেউ কখনো জেলেও যায় না। সবাই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এখানে আটকা পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে কেউ চেষ্টা তদবির করে কাউকে ছুটিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে কোনো মহিলা সংগঠন এসে কাউকে কাউকে ট্রেনিং দেয়, তারপর তাকে কোথাও নিয়ে কাজে লাগিয়ে দেয়। অন্যেরা দিনের পর দিন এখানে আটকা থাকে।

.

কয়েক দিন কেটে যাবার পর বিজলীর সুলতানার সাথে পরিচয় হলো। সুলতানা কথা বলে খুব কম এবং সবার থেকে সব সময় একটু আলাদা থাকে। বয়স বিজলীর সমান কিংবা এক-দুই বছর বেশি। একদিন বিজলীকে জিজ্ঞেস করল, তুই লেখাপড়া জানিস?

বিজলী বলল, ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি।

সুলতানা তখন তার কামিজের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, এইখানে কী লেখা পড়ে শুনাবি।

বিজলী কাগজটা হাতে নিয়ে দেখল, সেটা একটা চিঠি। রুলটানা কাগজে ভুল বানানে কাঁচা হাতে লেখা লম্বা একটা চিঠি। সুলতানার মা চিঠিটা লিখেছে। বাড়িতে নানা ধরনের সমস্যার কথা দেওয়া আছে। সুলতানার ছোট বোনের লেখাপড়ার কথা আছে। ছোট ভাইয়ের দুষ্টুমির কথা আছে। চিঠির শেষে সুলতানার বাবার কথা লেখা আছে, তাকে বাজারে মাঝে মাঝে দেখা যায়, বাড়িতে আসে না।

চিঠি পড়া শেষ হলে সুলতানা চিঠিটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাড়ি যাইতে হবে।

কেমন করে যাবে?

সুলতানা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, পালাব।

বিজলী চমকে উঠল, পালাবে?

হ্যাঁ।

কেমন করে? তোমারে তো চব্বিশ ঘণ্টা এইখানে তালা দিয়া রাখে।

উপায় বার করা লাগবে। তারপর হঠাৎ বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যাবি আমার সাথে?

আমি? বিজলী চমকে উঠল, আমি যাব তোমার সাথে?

হ্যাঁ।

বাইরে থাকব কই? খাব কী?

থাকবি রাস্তায়। সবাই যে রকম থাকে। খাওয়ার জন্যে কাম কাজ করবি, ভিক্ষা করবি, চুরি করবি-সমস্যা কী? লাখ লাখ বাচ্চা রাস্তায় থাকে। মেয়ে হওয়ার জন্যে একটা সমস্যা, কিন্তু সেইটারও রাস্তা আছে।

কী রাস্তা?

আমার সাথে যদি যাস তাহলে বলব।

বিজলী মাথা নাড়ল, তার সাহস হয় না। এইখানে মাথার ওপর একটা ছাদ আছে, দুই বেলা খাবার আছে। যদি কোনোভাবে সেলিনা জাহানের নাম ঠিকানা জোগাড় করে তাকে একটা চিঠি লেখা যায় তাহলে সেলিনা আপা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে দেবে। এখান থেকে পালিয়ে সে কোথায় যাবে? কী করবে?

.

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজলী ঠিক করল সেও সুলতানার সাথে পালিয়ে যাবে। মেয়েদের এই আশ্রয়কেন্দ্রটা আসলে ভয়াবহ একটা জায়গা। প্রতি রাতেই সেখানে ভয়ানক ঘটনা ঘটে, পুরুষ মানুষ ঢুকে মেয়েদের টানাটানি করে। চিৎকার-চেঁচামেচি হতে থাকে। একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করে, মারামারি করে। যদি সেরকম কিছু নাও হয় তবু বিজলী ঘুমাতে পারে না। এখানকার সবগুলো মেয়ের জীবনে একধরনের ভয়ংকর কষ্ট আছে, তারা সারাদিন সেগুলো নিজেদের মাঝে চেপে রাখে কিন্তু গভীর রাতে যখন ঘুমিয়ে যায় তখন ঘুমের ভেতর সেগুলো তাদের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। ঘুমের মাঝে এক একজন ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে। বিড়বিড় করে কথা বলে। রক্তশীতল করা গলায় চিৎকার করে ওঠে। সে নিজেও নিশ্চয়ই এরকম কিছু করে, কারণ কয়েক রাতে সুলতানা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে, বলেছে চিৎকার বন্ধ করতে।

বিজলী যখন সুলতানাকে বলল, সেও তার সাথে পালিয়ে যাবে তখন সুলতানা কিছুক্ষণ বিজলীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, পরে কিন্তু আমারে দোষ দিতে পারবি না।

দিব না।

মনে রাখবি, মানুষ কিন্তু খুব খারাপ।

বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি।

লুতুপুতু হলে এক রাতও টিকতে পারবি না। কিন্তু তুই মারপিট করতে পারিস–তুই পারবি। সেই জন্যে তোরে বলেছি।

বিজলী একটু হাসল, সে কখনোই চিন্তা করেনি যে সে মারপিট করতে পারে, একদিন সেরকম একজন মানুষ হিসাবে পরিচিত হবে।

.

আশ্রয়কেন্দ্রের মেয়েদের দিনে একবার কয়েক ঘণ্টার জন্য বিল্ডিং থেকে বের হতে দেয়। বাইরে খোলা জায়গায় তখন তারা হেঁটে বেড়াতে পারে। পুরো কম্পাউন্ডটা বড় দেয়াল দিয়ে ঘেরা, গেটে তালা মারা থাকে, তাই এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। মেয়েরা তখন কেউ কেউ মাটি কুপিয়ে গাছের চারা লাগায়, সেখানে পানি দিয়ে গাছগুলো বড় করে। কেউ বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। কেউ হাঁটাহাঁটি করে। কমবয়সী কয়েকজন টেনিস বল দিয়ে সাতচাড়া খেলে। আশ্রয়কেন্দ্রের একজন মানুষ এক কোনায় একটা টুলে বসে তাদের পাহারা দেয়।

এর মাঝে সুলতানা একটা প্যান্ট আর একটা শার্ট চুরি করে ফেলল। কোনো একজন মানুষ সেগুলো ধুয়ে শুকাতে দিয়েছিল। কেউ যখন লক্ষ করছে না তখন সুলতানা খুবই শান্ত ভঙ্গিতে প্রথমে শার্টটা টেনে এনে তার কামিজটা উপরে তুলে শরীরে প্যাচিয়ে ফেলল। তারপর ধীরে-সুস্থে ঘরের ভেতর গিয়ে সেটা খুলে এসে একই কায়দায় প্যান্টটাও শরীরে প্যাচিয়ে ফেলল। বিজলী বুঝতে পারল না সুলতানা পুরুষ মানুষের শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবে। সুলতানাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবা?

সুলতানা রহস্যের ভঙ্গি করে বলল, সময় হলে দেখবি।

কিছুক্ষণের মাঝেই শার্ট এবং প্যান্ট চুরি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ধরা পড়ল। যে মানুষটির শার্ট-প্যান্ট চুরি হয়েছে সে এখানে রান্না করে। মানুষটি ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করল এবং সুলতানা তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে তার চেঁচামেচিটি উপভোগ করতে থাকে। শুধু তাই না, কে চুরি করে থাকতে পারে একটু পরে পরেই সেটা নিয়ে মতামত দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এখানে যে মেয়েরা থাকে তাদের অনেকেই চুরি চামারি করে এখানে এসেছে, তবুও কেউই কোনো মেয়েকে সন্দেহ করল না। একটা মেয়ে পুরানো শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবে?

পরের দিন একই কায়দায় সুলতানা দুই নম্বর শার্ট আর প্যান্টটাও চুরি করল। সেটা যখন ধরা পড়ল তখন কম্পাউন্ডের ভেতর একটা তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। ভেতরে যে কয়জন পুরুষ মানুষ থাকে তাদের একজন আরেকজনকে সন্দেহ করে বড় ধরনের ঝগড়াঝাটি শুরু করে দেয়। আরেকটু হলে একটা মারামারি শুরু হয়ে যেত, অনেক কষ্টে সেটাকে থামানো হলো। পুরো সময়টাতে মানুষগুলোর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সুলতানা ব্যাপারটা উপভোগ করছিল!

.

দুদিন পর গভীর রাতে সুলতানা বিজলীকে নিয়ে পালিয়ে গেল।

সেই রাতে ঘুমানোর সময়ও বিজলী অনুমান করেনি যে আজকেই তারা পালিয়ে যাবে। গভীর রাতে সুলতানা তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে ফিস ফিস করে বলল, আয়, যাই?

বিজলী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোনখানে?

পালাব।

এখন?

হ্যাঁ। এখন। আয়। বলে সে বিজলীর জন্যে অপেক্ষা না করে অন্ধকারে হাঁটতে থাকে।

বিজলী কী করবে বুঝতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত সুলতানার পিছু পিছু যেতে থাকে। ঘরের বাইরে বিশাল কলাপসিবেল গেটে বড় বড় তালা, সুলতানা কীভাবে বের হবে বিজলী বুঝতে পারল না। সুলতানা অবশ্যি বাইরের দরজার দিকে গেল না, করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে হাজির হলো।

বিজলীকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে সুলতানা বাথরুমের জানালাটার দিকে এগিয়ে গেল। গ্রিলের রড ধরে ঝাঁকুনি দিতেই একটা রড বাঁকা হয়ে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়, এখন এর ভেতর দিয়ে সহজেই একজন মানুষ বের হয়ে যেতে পারবে।

বিজলী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি জানতা এখান দিয়ে বের হওয়া যায়?

সুলতানা মাথা নাড়ল, বলল, অনেক দিন ঠেলাঠেলি করে এইটা ছুটাইছি। আয় যাই। তুই আগে যাবি নাকি আমি?

বিজলীর বুকটা ধ্বক ধ্বক করছিল, বলল, আমি যাই?

যা।

জানালা দিয়া বাইর হওয়ার পর পয়লা কার্নিশের উপর দাঁড়াবি, তখন তোর হাতে এই আমি পলিথিনের পোটলাটা দিমু। তুই সেইটা সাবধানে নিচে ফেলে দিবি।

কী আছে পোটলার ভিতরে?

সময় হলেই দেখবি। তারপর তুই নামবি। সাবধান, শব্দ করিস।

ঠিক আছে।

বিজলী জানালার ফুটো দিয়ে সাবধানে বের হয়ে এল, শরীরটা নিচু করে সে সাবধানে কার্নিশের উপরে দাঁড়াল। ভেতর থেকে তখন সুলতানা তার হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ ধরিয়ে দেয়। বিজলী সুলতানার কথামতো ব্যাগটা সাবধানে নিচে ফেলে দিল। তারপর কার্নিশ ধরে ঝুলে পড়ে নিচে নেমে এল।

কয়েক মিনিটের মাঝেই সুলতানাও নিচে নেমে এল। সুলতানা ব্যাগটা হাতে নিয়ে সাবধানে একটু এগিয়ে যায় তারপরে দেয়ালের আড়ালে একটা জায়গায় ব্যাগটা রেখে ফিসফিস করে বলল, বস!

আমরা বাইর হব না?

বাইর হইবার আগে রেডি হইতে হবে।

কীভাবে রেডি হবে বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না কিন্তু কোনো কথা না বলে সে বসে পড়ল। এর মাঝেই সুলতানের উপর তার অনেক বিশ্বাস জন্মে গেছে। তার বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে শুধু, মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ একজন এসে তাদেরকে ধরে ফেলে।

সুলতানাকে অবশ্যি মোটেও নার্ভাস দেখা গেল না। সে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কাচি বের করল। সেটা বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, নে। কেটে দে।

বিজলী অবাক হয়ে বলল, কী কাটব?

চুল। আমার চুল কাইটা দে। দেখে যেন মনে হয় ছেলে।

বিজলীর কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে, তারপর জিজ্ঞেস করল, চুল কাইটা দেব? ছেলেদের মতো করে?

হ্যাঁ। এইখান থেকে মাইয়া হয়ে বের হওয়া খুব বিপদের। আমরা যখন বাইর হমু তখন আমরা দুইজনই ছেলে হয়ে বাইর হমু। তোর নাম বিজলী তুই হইয়া যাবি বজলু। আমি হমু সুলতান।

হঠাৎ করে বিজলী বুঝতে পারল সুলতানা কেন শার্ট আর প্যান্ট চুরি করেছে।

সুলতানা বলল, দেরি করিস না। কাট।

বিজলী কাঁচিটা হাতে নিয়ে বলল, আমি কখনো চুল কাটি নাই!

তোর চুল কাটা জানতে হবে না। খালি ছোট করে দে।

সুলতানার মাথা ভর্তি চুল, কাটতে বিজলীর মায়া লাগছিল তারপরও নিষ্ঠুরের মতো সে তার সুন্দর চুলগুলো কাটল। কাটার পর দেখা গেল মাথা ভর্তি খোঁচা খোঁচা চুল, এখানে সেখানে খাবলা খাবলা চুল উঠে আছে। দেখে বিজলীর খুব খারাপ লাগছিল কিন্তু সুলতানা একটুও মাথা ঘামাল না। কাটা চুলগুলো সে একটা পলিথিনের ব্যাগে যত্ন করে তুলে রাখল। তারপর কাঁচিটা হাতে নিয়ে বিজলীকে বলল, আয় এখন তোরটা কাইটা দিই।

বিজলী নিজের মাথাটা এগিয়ে দিল, সুলতানা ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে চুল কাটতে লাগল। কিছুক্ষণের মাঝেই বিজলীর মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে!

চুল কাটা শেষ হলে তারা নিজেদের কাপড় বদলে শার্ট প্যান্ট পরে নিল। বিজলী ভেবেছিল তারা এই ঢলঢলে শার্ট প্যান্ট পরেই থাকবে কিন্তু সুলতানা কাঁচি দিয়ে প্যান্টগুলো হাঁটুর উপরে কেটে হাফ প্যান্টের সাইজ করে ফেলল। বিজলী দুর্বলভাবে একটু আপত্তি করতে চেষ্টা করল, কিন্তু সুলতানা ধমক দিয়ে বলল, আমাগো বয়সের ছেলেরা এই রকম ঢলঢলা প্যান্ট পরে না।

শুধু যে প্যান্টটা কেটে ছোট করল তা না, শার্টগুলোর হাতাও কাটল এবং নিচেও কেটে ছোট করে নিল। তারপর নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, আয় যাই।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, দেয়াল পার হবা কেমনে! উপরে কাঁচ দিয়া রাখছে দেখছ?

জানি! তুই আমার সাথে আয়।

বিজলী সুলতানার পিছু পিছু গেল, সুলতানা দেয়াল ধরে ধরে এগিয়ে একটা জায়গায় থেমে গিয়ে উপরে তাকাল। তারপর থেমে গিয়ে বলল, এইখানে।

এইখানে কী?

এইখানে কাঁচগুলো ভাইঙা রাখছি। কিন্তু উপরে কিছু একটা বিছাইতে হবে।

কী বিছাবা?

আমাগো কাপড়গুলা। আমি একটা তোয়ালেও আনছি।

অন্ধকারে দুইজন দেয়াল ঘেষে দাঁড়াল। সুলতানা বলল, প্রথমে আমি উঠি। তুই এখানে দাঁড়া। আমি তোর ঘাড়ে উঠুম। আমাকে ঘাড়ে নিতে পারবি তো?

পারব।

তুই দেয়ালটা ধরে বস।

বিজলী দেয়ালটা ধরে বসল। সুলতানা বিজলীর ঘাড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল, এখন তুই আস্তে আস্তে খাড়া।

বিজলী নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়ালটা ধরে আস্তে আস্তে দাঁড়াল। সুলতানা তার ব্যাগ থেকে তাদের কাপড়গুলো, তোয়ালেটা বের করে দেয়ালের উপর রেখে ধারালো কাঁচগুলো ঢেকে ফেলল। তারপর হাতে ভর দিয়ে উপরে উঠে গেল।

সাবধানে একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে সুলতানা তার হাতটা নিচে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এখন তুই উইঠা আয়।

বিজলী সুলতানার হাত ধরল, সুলতানা তখন তাকে উপরে টেনে তুলতে থাকে। বিজলী দেয়ালের এবড়ো থেবড়ো জায়গায় পা রেখে অন্য হাত দিয়ে টেনে নিজেকে ওপরে তুলে ফেলল।

সুলতানা খুশি হয়ে বলল, কাম হয়া গেছে। এখন নামতে হবে।

অন্য পাশে লাফিয়ে নামার জন্য দেয়ালটা একটু বেশি উঁচু, তারপরও বিজলী সাহস করে লাফ দিল। সুলতানা তার হাতে তাদের পোটলাটা ধরিয়ে দিয়ে সহজেই লাফ দিয়ে নেমে এল। একটা ছোট নালা পার হয়ে তারা রাস্তায় উঠে আসে।

টুং টাং শব্দ করে একটা রিকশা আসছে, বিজলীর মনে হলো এখনই দৌড়ে তাদের কোথাও লুকিয়ে যেতে হবে, কিন্তু সুলতানা একটুও উত্তেজনা না দেখিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রিকশাওয়ালা গুন গুন করে একটা গান গাইতে গাইতে চলে গেল, তাদের দিকে একবার ফিরেও তাকালো না।

সুলতানা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আয় হাঁটি। এই জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।

বিজলী বলল, হ্যাঁ। যদি বুঝে যায় তাহলে হইচই শুরু হয়ে যাবে।

কাল সকালের আগে কেউ বুঝবে না। রাত্রে কেউ খেয়াল করবে না।

সুলতানা আর বিজলী রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে, অনেক রাত তারপরেও মাঝে মাঝেই একটা দুইটা চায়ের দোকান খোলা।

হাঁটতে হাঁটতে তারা রাস্তার পাশে একটা ময়লা ফেলার ঢিবি পেল। সুলতানা তখন তার পলিথিনের ব্যাগটা সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, এখন আর কেউ আমাগো খুঁইজা পাবে না।

বিজলী বলল, শুধু বাথরুমে গেলে বুঝে যাবে আমরা বাথরুমের জানালা দিয়ে বাইর হইছি।

সুলতানা বলল, উহঁ। আমি রডটা আবার সোজা করে দিয়া আসছি, দরজাটাও খুলে আসছি। কেউ বুঝতে পারবে না আমরা কোন দিক দিয়া পালাইছি।

বিজলী বলল, কী মজা।

সুলতানা দাঁত বের করে হেসে বলল, বিশাল একটা হাউকাউ লাইগা যাবে। মনে হয় এক দুইজনের চাকরিও চইলা যাবে!

সত্যি?

সত্যি না তো মিথ্যা নাকি?

সুলতানা আপন মনে কিছুক্ষন হাসল। তাকে দেখে মনে হলো কারো চাকরি চলে যাওয়াটা বিশাল একটা আনন্দের ব্যাপার। একটু পরে বলল, আয় বজলু যাই। মনে আছে তো, তুই এখন থেকে বজলু।

বিজলী বলল, হ্যাঁ সুলতান ভাই। মনে আছে।

তারপর দুজন পুরোপুরি একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।

*

স্কুল থেকে বের হয়েই খোকন দেখল মিলি দাঁড়িয়ে আছে। খোকনের নতুন মা। সে অবশ্যি এখনো মিলিকে মা বলে ডাকা শুরু করেনি। তার কেমন জানি লজ্জা করে। খোকন বুঝতে পারছে তার নতুন মা খুব করে চাইছে সে যেন তাকে মা বলে ডাকে, কিন্তু এখনো সে কিছু না ডেকে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে।

খোকনকে দেখে মিলি এগিয়ে এলো, তার হাত ধরে বলল, খোকন সোনা, তোমার স্কুলটা আজকে কেমন ছিল?

খোকন বলল, ভালো।

আজকে তার দ্বিতীয় দিন। প্রথম দিন থেকে অনেক ভালো তবুও আজকেও পুরো সময়টা তার ভয় ভয় লেগেছে। স্কুলের সব ছেলেমেয়ে সুন্দর সুন্দর স্কুলের পোশাক পরে এসেছে। তারও সুন্দর পোশাক। ধবধবে সাদা শার্ট, নেভি ব্লু প্যান্ট, গলায় টাই। টাইটা গলায় কীরকম জানি ফাঁসের মতো আটকে থাকে, গলায় একটু খসখস করে, এছাড়া কোনো সমস্যা নাই। স্কুলের স্যার ম্যাডামেরা কেউ বকাবকি করে না, সব সময় আদর করে কথা বলে। সবাই অবশ্যি ইংরেজিতে কথা বলে। সেজন্যে কে কী বলছে বুঝতে তার সমস্যা হয়। মিলি বলেছে কয়দিন পরে অভ্যাস হয়ে যাবে।

মিলি জিজ্ঞেস করল, তোমার নাশতা খেতে পেরেছিলে?

খোকন মাথা নাড়ল। সে যখন চরে থাকত তখন শুধু ভাত খেয়েছে। ভাতের সাথে শুঁটকি মাছ। কখনো কখনো শাক কিংবা ডাল। নাশতা বলে যে কিছু আছে সে জানতই না। মিলিদের বাসায় এসে সে আবিষ্কার করেছে কত হাজারো রকম নাশতা আছে। বেশির ভাগ খাবারের সে নামই জানে না, আর খেতে কী মজা! কিন্তু প্রত্যেকবার নাশতা খাবার সময় তার বিজলীবুয়ের কথা মনে পড়ে। তখন তার কান্না পেয়ে যায়, সে আর খেতে পারে না। বিজলীবুয়ের কথা সে কাউকে বলতে পারবে না, যখনই সেটা মনে পড়ে তখনই তার কেমন জানি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মাথাটা কেমন জানি এলোমেলো হয়ে আসে।

মিলি খোকনের হাত ধরে বলল, চলো, বাসায় যাই।

খোকন বলল, চলো।

মিলিদের ড্রাইভার তাদের নীল রঙের গাড়িটার দরজা খুলে দাঁড়াল। প্রথমে খোকন গাড়িতে উঠল, তারপর মিলি। গাড়ির ভেতর কী আরাম আরাম ঠান্ডা!

গাড়ি করে খোকন তার নতুন মায়ের সাথে তার নতুন বাসায় যেতে থাকে। তাদের চরে গাড়ি দূরে থাকুক একটা রিকশাও ছিল না। হেঁটে হেঁটে বাজারে গেলে সেখানে রিকশা কিংবা টেম্পো দেখা যেত। প্রথম গাড়ি দেখেছে হাসপাতালে এসে। হাসপাতালের জানালা দিয়ে যখন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকত তখন দেখত রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। ছোট-বড় নানা রকম গাড়ি, নানা রকম শব্দ। এখন সে নিজেই প্রত্যেকদিন গাড়ি করে স্কুলে যায়। এটা তার নতুন মা আর নতুন বাবার গাড়ি। তার মানে এটা তার গাড়ি। খোকনের কী অবাক লাগে, কয়দিন আগে তার কিছু ছিল না, এখন তার সবকিছু আছে। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, স্কুল আছে। কিন্তু তার বাবা নাই, মা নাই, বিজলীবু নাই। বিজলীবুর কথা মনে হতেই তার বুকের মাঝে জানি কেমন করতে থাকে, তার মাথার মাঝে কেমন জানি সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। বিজলীবুয়ের কথা কাউকে বলা যাবে না। কাউকে বললেই বিজলীবুকে মেরে ফেলবে। খোকনের শরীরটা হঠাৎ কাঁপতে থাকে।

খোকনের নতুন মা খোকনের দিকে তাকালো, তারপর আদর করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, কী হয়েছে সোনা আমার? তোমার কী হয়েছে?

কিছু হয় নাই। খোকন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, আমার কিছু হয় নাই।

মিলি আদর করে খোকনকে জড়িয়ে ধরে রাখে। এইটুকুন একটা বাচ্চা না জানি কত বড় কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। মিলির বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে।

বাসায় এসে খোকন গোসল করল। তার কী সুন্দর বাথরুম, উপর থেকে বৃষ্টির মতো পানি পড়ে। পানিটাকে গরম করা যায় আবার ঠান্ডা করা যায়। গোসল করার সময় নব ঘুরিয়ে খোকন পানিটাকে কুসুম কুসুম গরম করে নেয়। কত রকমের সাবান, চুলের জন্য কত রকম শ্যাম্পু! কী সুন্দর গন্ধ। গোসল করতে কী আরাম। গোসল করে সে বড় তোয়ালে দিয়ে শরীর মোছে। নরম তুলার মতো তোয়ালে, জিলজিলে গামছার মতো না! গোসল শেষ করে ধোয়া কাপড় পরে নেয়, প্রত্যেকদিন নতুন ধোয়া কাপড়! কী আশ্চর্য, সে জানতই না গোসল করে প্রত্যেকদিন নতুন কাপড় পরতে হয়।

সে বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় তার নতুন মা বাথরুমে উঁকি দিল, বলল, বাবা, দাঁড়াও আগেই কাপড় পরো না। আমি তোমার শরীরে একটু লোশন মাখিয়ে দিই!

তখন খোকন দাঁড়িয়ে রইল, আর তার নতুন মা তার সারা শরীরে আদর করে লোশন মাখিয়ে দিল। সাইক্লোনের রাতে তার সারা শরীর ফালা ফালা করে কেটে গিয়েছিল, এখনো তার শরীরে সেই দাগ আছে। তার নতুন মা সেই দাগগুলোতে চুমু খেয়ে বলে, আহারে! আমার সোনা কত কষ্ট করেছে।

খোকন কিছু বলে না। তার নতুন মায়ের সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে। আবার ভালোও লাগে। তার নতুন মা তাকে এত আদর করে–আর কেউ তাকে এরকম আদর করে নাই। বিজলীবু ছাড়া–আবার বিজলীবুয়ের কথা মনে হতেই থোকনের বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। কাউকে সে বিজলীবুয়ের কথা বলতে পারবে না! কাউকে না। বললেই বিজলীবুকে মেরে ফেলবে, মাথার ভেতরে আবার সবকিছু কেমন জানি এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। তার শরীরটা অল্প অল্প কাঁপতে থাকে।

খোকনের নতুন মা বিষয়টা লক্ষ করে, তখন তাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে রেখে, মাথায় হাত বুলায়। হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে, ভয় কী সোনা? ভয় কী? আমরা আছি না তোমার সাথে?

খোকন মাথা নাড়ে, হ্যাঁ। তার নতুন মা আছে তার সাথে। তার ভয় নাই। বিজলীবুয়ের কথা যদি কাউকে না বলে তাহলে বিজলীবুয়েরও কোনো ভয় নাই।

পরিষ্কার কাপড় পরে সে তার মায়ের সাথে খেতে বসে। তার নতুন মা প্লেটে খাবার তুলে দেয়। যখন চরে ছিল তখন খাওয়ার কিছু ছিল না। ভাত আর ছোট মাছ। না হলে শুঁটকি। বড়জোর অর্ধেকটা ডিম–এখন কত কী খাবার। প্রত্যেকদিন মাছ আর গোশত থাকে। কী আশ্চর্য!

তার নতুন মা তাকে সবজি খেতে দেয়, সবজি খেলে শরীরের কত উপকার হয় সেগুলো বলে! খাওয়ার পর দই না হলে মিষ্টি থাকে। বিজলীবু মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করত–খোকন জোর করে তার মাথা

থেকে বিজলীবুয়ের চিন্তাটা সরিয়ে দিল, না হলে আবার তার মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাবে।

খাবার পর খোকন তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই নিয়ে বসে। ইংরেজি বইগুলো সে এখনো পড়তে পারে না, শুধু ছবি দেখে। বাংলা বইগুলো সে পড়ে। কী মজার মজার বই! অ্যাডভেঞ্চারের বই। ভূতের বই। কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়বে সে ঠিক করতে পারে না।

বই পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তার নতুন মা বিকেলবেলা তাকে ডেকে তুলেছে। বিকেলবেলা ঘুমিয়ে গেলে যখন ঘুম ভাঙে তখন সবকিছু অন্যরকম মনে হয়। আজকেও খোকনের সবকিছু অন্যরকম মনে হলো। সে কোথায় আছে কেন আছে সেটা বুঝতেই তার অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল। যখন বুঝল সে কোথায় আছে তখন তার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেল, বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল।

খোকনের নতুন মা তাকে ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে নিয়ে গেল, নিজেই তার হাতমুখ ধুয়ে দিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে এল। সেখানে ডাইনিং টেবিলে বসে খোকন একটুখানি অরেঞ্জ জুস খেলো। ছোট থাকতে একবার সে কমলা খেয়েছিল, কিন্তু কমলা চিপে যে রস বের করে সেই রস খাওয়া যায় সেটা সে জানতই না।

খাওয়ার পর কাপড় জামা বদলে তার নতুন মা তাকে নিয়ে বের হলো। তাকে একটা কারাটে স্কুলে নিয়ে সেখানে তাকে ভর্তি করে দিল। খোকন এর আগে কখনো কারাটে স্কুল দেখেনি, তার বয়সী ছোট ছোট বাচ্চা সাদা কাপড় পরে হাইয়া হাইয়া করে হাত-পা ছুড়ছে, দেখে খোকনের কেমন যেন হাসি পেয়ে যায়।

সন্ধ্যেবেলা খোকন বসে বসে তার হোমওয়ার্ক করল। অল্প কয়েকটা হোম ওয়ার্ক, দেখতে দেখতে সেগুলো করা হয়ে গেল। তখন সে বসার ঘরে তার নতুন মায়ের পাশে বসে টেলিভিশন দেখল। সে যখন চরে থাকত তখন সে টেলিভিশনের নাম শুনেছিল কিন্তু কখনো টেলিভিশন দেখেনি। এখন তার নিজের বাসায় কত বড় টেলিভিশন। কী সুন্দর তার রং। খোকন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

টেলিভিশনে খোকন বসে একটা কার্টুন দেখল, একটা বিড়াল একটা ইঁদুরকে নানাভাবে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু কখনোই ধরতে পারে না। ইঁদুরটার অনেক বুদ্ধি, সব সময় বিড়ালটাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। দেখে খোকনের হাসি পেয়ে যায়।

খোকন যখন বসে বসে টেলিভিশন দেখছিল তখন রায়হান এসে ঢুকল। রায়হান তার নতুন বাবা। খোকনকে দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, ইয়াংম্যান! কেমন আছো তুমি? তোমার নতুন বাসা কেমন লাগছে?

খোকন বলল, ভালো।

রায়হান তার হাতের ব্যাগটা খুলে সেখান থেকে একটা ফুটবল বের করে সেটা সে খোকনের দিকে ছুঁড়ে দিল। খোকন দুই হাত দিয়ে সেটা ধরে ফেলে। রায়হান হাসি হাসি মুখে বলল, গুড ক্যাচ! তুমি ফুটবল খেলো?

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, খেলি!

সে যখন চরে থাকত তখন চরের ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলত। তাদের অবশ্যি ফুটবল ছিল না। একটা জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে ফুটবল খেলত। খোকন হাতের ফুটবলটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল! সত্যিকারের ফুটবল, কেমন জানি একটা চামড়া চামড়া গন্ধ। তার নতুন বাবা গতকালকেও তার জন্যে একটা রঙের বাক্স এনেছে, আজকে একটা ফুটবল। প্রত্যেকদিনই তার জন্যে নতুন একটা উপহার, কী আশ্চর্য!

ওরা তিনজন মিলে রাতের খাবার খেলো। খোকন অবাক হয়ে দেখল ভাতগুলো কী সুন্দর ধবধবে সাদা, কী সুন্দর তার ঘ্রাণ। মনে হয় শুধু লবণ দিয়েই সে ভাত খেয়ে ফেলতে পারবে। খোকনকে অবশ্য শুধু লবণ দিয়ে খেতে হলো না। টেবিলে আছে ইলিশ মাছের ভাজা, গরুর গোশত আর ডিম ভুনা। সাথে ঘন ডাল। ডাল খাওয়ার সময় খোকনের মনে পড়ল, যখন চরে থাকত তখন তার মা তাদের জন্যে পাতলা জিলজিলে এক ধরনের ডাল রাঁধত।

খাওয়া শেষ হবার পর খোকন একটুখানি পায়েশ খেলো। তারপর আবার একটুখানি টিভি দেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কী নরম একটা বিছানা, মনে হয় বিছানার মাঝে সে ডুবে যাবে। খোকনের নতুন মা বাতি নিভিয়ে দিল। জানালা দিয়ে হালকা একটা আলো আসছে, এই আলোতে সবকিছুকে কেমন জানি স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। শুয়ে শুয়ে সে দেখে এক পাশে একটা এসি থেকে কুলকুল করে ঠান্ডা বাতাস বের হচ্ছে। ঘরের ভেতর কী আরাম আরাম ঠান্ডা। খোকন নরম একটা কম্বল শরীরের উপর টেনে নিয়ে চোখ বন্ধ করল। খোকন একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সে সব সময় বিজলীবুয়ের সাথে ঘুমাত–ঘুমের মাঝে সে বিজলীবুয়ের ওপর পা তুলে দিত, বিজলীবু কখনো সেজন্যে বিরক্ত হতো না! ছোট একটা বিছানায় দুজনে গাদাগাদি করে ঘুমাত–কিন্তু এখন বিজলীবুয়ের কথা কিছুতেই মনে করা যাবে না। কিছুতেই মনে করা যাবে না। হঠাৎ খোকনের মাথাটা কেমন জানি এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে।

গভীর রাতে মিলির ঘুম ভেঙে গেল। খোকনের ঘর থেকে অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ কাঁদছে। মিলি একটু ভয় পেয়ে বিছানা থেকে নেমে খোকনের ঘরে এল। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল খোকন বিছানায় ছটফট করছে, তার মুখ থেকে যন্ত্রণার মতো একধরনের শব্দ হচ্ছে।

মিলি ঘরের লাইট জ্বালাল, খোকন তার মাথা এপাশ ওপাশ করছে। চোখ আধখোলা, কিন্তু কিছু দেখছে বলে মনে হয় না। মিলি প্রায় ছুটে গিয়ে মশারি তুলে খোকনকে জড়িয়ে ধরল, তাকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল, বাবা সোনা আমার, কী হয়েছে?

খোকন বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে ছটফট করে, কান্নার মতো শব্দ করে। মিলি তাকে বুকে চেপে ধরে ব্যাকুল হয়ে বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে সোনা?

খোকন চোখ খুলে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, পানি! পানি! পানি আসছে। ভাসিয়ে নিবে, ভাসিয়ে নিবে–

কোথায় পানি? মিলি নরম গলায় বলল, পানি নেই সোনা। পানি নেই। আমি আছি।

খোকন জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? বি–বি– বিজলীবু বলতে গিয়ে খোকন থেমে গেল। বিজলীবুয়ের কথা বলা যাবে না। কিছুতেই বলা যাবে না। বললেই বিজলীবুকে মেরে ফেলবে।

মিলি বুকে চেপে ধরে বলল, আমি তোমার মা।

খোকন মিলিকে চেপে ধরে বলল, ভয় করে মা। আমার খুব ভয় করে।

মিলি একধরনের শিহরণ অনুভব করে। তার এই সন্তানটি তাকে মা বলে ডেকেছে।

ভয় নেই বাবা, তোমার কোনো ভয় নেই।

খোকন কাঁপা গলায় বলল, মা, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?

না বাবা। মিলির চোখে পানি চলে এল, খোকনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, না বাবা, আমি তোমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাব না। কোনোদিন ছেড়ে যাব না।

খোকন দেখল তার বিজলীবু আস্তে আস্তে নতুন মা হয়ে যাচ্ছে। বিজলীবু বলে এখন কেউ নেই, এখন আছে তার মা। তার এই মা এখন তাকে বুকে চেপে রাখবে।

.

ঠিক তখন বিজলীর ঘুম ভেঙে গেল। স্টেশনের মেঝেতে তার বয়সী অনেকগুলো ছেলেমেয়ের সাথে সে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ করে একটা পুলিশ এসে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে বিজলী অন্য বাচ্চাদের সাথে ছুটতে থাকে। পুলিশ যেন তাকে ধরতে না পারে। কিছুতেই যেন ধরতে না পারে।

*

সেলিনা তীক্ষ্ণ চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল, জিজ্ঞেস করল, আপনি কী বলছেন?

আমি কী বলেছি আপনি শুনেছেন। ছেলেটিকে এডপশানে দেয়া হয়েছে।

সেলিনা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, বোনটিকে ভাই থেকে আলাদা করে ফেলেছেন?

বোন বড় হয়ে গেছে। তাকে কে এডপশানে নেবে?

সেলিনা প্রায় চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমি কি পরিষ্কার করে বলিনি দুই ভাইবোনকে আলাদা করা যাবে না। কিছুতেই আলাদা করা যাবে না?

আমাদের রেকর্ডে সে রকম কিছু নেই। নাজনীন ড্রয়ার থেকে কিছু কাগজ বের করে সেলিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বিশ্বাস না হলে দেখেন।

সেলিনা কাগজগুলো দেখার কোনো আগ্রহ দেখাল না। একটু ঝুঁকে নাজনীনকে জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা এখন কোথায় আছে?

সেটা বলা যাবে না। যাদেরকে এডপশানে দিই তাদের ঠিকানা কাউকে বলার নিয়ম নেই। সরি।

সেলিনা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করল, আর মেয়েটি?

মেয়েটি? নাজনীন হাসির মতো শব্দ করল, বলল, শি ইজ আ ক্রিমিনাল। তাকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।

পুলিশে? সেলিনা কী বলবে বুঝতে পারল না।

নাজনীন হাসি হাসি মুখে বলল, আমি গত সপ্তাহে খোঁজ নিয়েছিলাম, সে কাস্টডি থেকে পালিয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ইনোসেন্ট অসহায় কিছু বাচ্চা দেবেন। আপনি তা না দিয়ে আমাকে হার্ডকোর ক্রিমিনাল ধরিয়ে দিয়েছেন? কেমন করে এটা করতে পারলেন?

সেলিনা চোখ বড় বড় করে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারল না, সে কী একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে, নাকি একটা রাক্ষুসীর দিকে তাকিয়ে আছে।

*

রাস্তার মোড়ে গাড়িগুলো ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে। বিজলী হাতের বইগুলো নিয়ে গাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। বইগুলো বাচ্চাদের জন্যে লেখা, রংচঙে বই, তাই যে গাড়িতে বাচ্চারা থাকে সেই গাড়িতে বিজলী বইগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করে। বেশির ভাগ গাড়ির জানালার কাঁচ তুলে রাখায় তার কথা গাড়ির ভেতর পর্যন্ত পৌঁছায় কি না সে জানে না, তারপরও সে চেষ্টা করে, জানালার কাছে মাথা লাগিয়ে বলে, আন্টি একটা বই নিয়ে যান আপনার বাবুর জন্য। কী সুন্দর বই দেখেন। বিজলী যখন বই বিক্রি করার চেষ্টা করে তখন যতটুকু সম্ভব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে, শুধু তাই না মাঝে মাঝে একটা দুইটা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, পাখির বই আছে, মাছের বই আছে, ফলের বই আছে। কী সুন্দর বই, বিউটিফুল বুক! আপনার বাবু সব পাখির নাম শিখে যাবে। এই দেখেন মাছরাঙা পাখি, কিংফিশার, কী সুন্দর রং দেখেন–একটা বই নিয়ে যান আন্টি!

গাড়ির ভেতরে যারা বসে থাকে, বেশির ভাগ সময় তারা বিজলীর দিকে ঘুরে তাকায় না, এরকম হলে বিজলী তাদের সাথে বেশি সময় নষ্ট করে না, অন্য গাড়িতে চলে যায়। কেউ যদি তার দিকে তাকায় তাহলে সে আবার নতুন উৎসাহে তার বই বিক্রি করার চেষ্টা করে। গাড়িতে যদি ছোট বাচ্চা থাকে তাহলে বিজলী মা-বাবাকে না দেখিয়ে সরাসরি বাচ্চাটাকে বইগুলো দেখায়। কপাল ভালো হলে বাচ্চাগুলো বই কেনার বায়না ধরে বসে, ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। বাবা-মা তখন অনেক সময় বিরক্ত হয়ে বই কিনে দেয়! বিজলী তখন বইগুলোর দাম অনেক বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলে–ঘ্যানঘ্যানে ধরনের বাচ্চা হলে তার লাভ।

দামি একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরের বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বিজলী তার বইটা নাড়াচাড়া করে, বলে, বাবু এই বইটা নিবে? দেখো

কী সুন্দর বই-কাঠঠোকরার ছবি দেখো! কাঠঠোকরা মানে উডপেকার, মাছরাঙা মানে কিংফিশার–

বাচ্চাটার মা জানালার কাঁচ নামিয়ে ধমক দিয়ে বলল, এই ছেলে! বিরক্ত করো না। যাও–

বিজলী আজকাল এই ছেলে– শুনে চমকে ওঠে না। মনে হয় সে নিজেই ভুলে গেছে যে সে আসলে একটা মেয়ে। সে এখন পাকাপাকিভাবে ছেলে, তার নাম বজলু। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালিয়ে আসার কয়েকদিন পর সুলতানা তাকে একদিন রেলস্টেশনে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। যাবার আগে পথে-ঘাটে থাকার কিছু নিয়ম শিখিয়ে দিয়ে গেছে। সুলতানার শেখানো নিয়মগুলো বিজলীর অনেক কাজে লেগেছে। পথে-ঘাটে থাকতে থাকতে সে নিজেও কিছু নিয়ম শিখেছে। প্রথম নিয়ম হচ্ছে বড়লোকদের গালাগাল ধৈর্য্য ধরে সহ্য করতে হবে কিন্তু পথেঘাটে তার মতো অন্যরা যারা থাকে তাদের গালাগাল ধাক্কাধাক্কি সহ্য করা যাবে না–টিকে থাকার জন্য তখন তাকে পাল্টা গালাগালি, পাল্টা ধাক্কাধাক্কি কিংবা পাল্টা মারপিট করতে হবে। বিজলী সেই নিয়মটা মেনে চলছে, তার সাথে সাথে সে নিজেও আরো নতুন নতুন কিছু নিয়ম বের করেছে।

বিজলী এতদিনে জেনে গেছে যে সে পথেঘাটে যতদিন ইচ্ছা বেঁচে থাকতে পারবে। তবে বিজলী নিজে যেটা বুঝতে পারছে না সেটা হচ্ছে নিজে না জেনেই সে ধীরে ধীরে কেমন জানি হিংস্র হয়ে উঠছে। পথেঘাটে বেঁচে থাকা অনেকটা জঙ্গলে থাকার মতো। জঙ্গলে বাঘ-ভালুকের মাঝে বেঁচে থাকতে হলে নিজেকে বাঘ-ভালুক হয়ে যেতে হয়। এখানেও তাই, পথে ঘাটে বেঁচে থাকতে হলে নিজেকে হিংস্র হয়ে যেতে হয়। কখনো হাল ছেড়ে দিতে হয় না।

কাজেই এবারেও বিজলী হাল ছাড়ল না। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো বাবু কত সুন্দর বই। তারপর একটা দুইটা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দিল, বিউটিফুল বুক! বিউটিফুল বার্ডস!

বিজলীর ইংরেজিতে কাজ দিল, বাচ্চাটা এবারে নাকি সুরে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিল, আম্মু বই কিনব! বই। হ্যাঁ এ্যা।

বাচ্চাটার মা ধমক দিয়ে বলল, অনেক বই আছে বাসাতে। আর বই লাগবে না।

বাচ্চাটা এবারে কাঁদতে শুরু করল, বই। বার্ডের বই। এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ…

মা আরো জোরে ধমক দিল, চুপ। খবরদার কাঁদবে না।

বিজলী এবারে তার মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করল, একটা বই জানালা দিয়ে সরাসরি বাচ্চাটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও! বাবু এই যে বই।

মা বিজলীর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, এটা কী হচ্ছে? এই ছেলে তোমাকে আমি বই দিতে বলেছি? বলেছি?

বিজলী হাসি হাসি মুখে বলল, না আন্টি। আমি বাবুকে এটা গিফট দিয়েছি।

বাচ্চাটির মা এবারে থতমত খেয়ে গেল, কী বলবে বুঝতে পারল না। বিজলী হাসি হাসি মুখে বলল, বাবুটা এত সুইট। এত মায়া লাগে। তারপর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, এনজয় দা বুক। তারপর ঘুরে পাশের গাড়ির দিকে চলে গেল, যদিও কান খাড়া করে রাখল। এই মহিলা একেবারে বাড়াবাড়ি ছোটলোক না হলে এখন তাকে ডাকবে। সত্যি সত্যি মহিলার গলা শোনা গেল। এবারে গলার স্বর যথেষ্ট নরম, এই ছেলে! এই ছেলে! বিজলী এবারে চেহারায় একটু বিব্রত ভাব ফুটিয়ে বলল, জি আন্টি।

তোমার বইয়ের দাম কত?

বিজলী জিবে কামড় দিয়ে বলল, না, আন্টি! এইটা বাবুর জন্যে গিফট। আমি দাম নিতে পারব না।

মহিলা তার ব্যাগ খুলে বলল, বলো কত দাম।

আন্টি, আপনার এত সুইট বাবুটাকে আমি গিফট দিতে পারব না? প্লিজ আন্টি! আমরা এই বইগুলো অনেক কমিশনে পাই।

তারপর মোক্ষম আরেকটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করল, বিলিভ মি!

মহিলা ভুরু কোঁচকাল, তুমি লেখাপড়া করো।

ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি–এখন একটা ঝামেলার মাঝে আছি, তাই বন্ধ আছে। আবার শুরু করব।

তোমার ফ্যামিলি?

কেউ নাই। যারিনা সাইক্লোনে সবাই ভেসে গেছে।

মহিলা এবারে জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। ব্যাগ থেকে একটা বড়সড় নোট বের করে বিজলীর দিকে এগিয়ে দিল। বিজলী মাথা নিচু করে বলল, থ্যাংক ইউ আন্টি। কিন্তু আমি সত্যি বাবুকে এই গিফটটা দিয়েছি। আমরা রাস্তাঘাটে থাকি, আমাদের কোনো আপনজন নাই। মাঝে মাঝে আমাদেরও তো কাউকে গিফট দিতে ইচ্ছে করে।

মহিলাটি এবারে পুরোপুরি দ্রবীভূত হয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে বিজলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, নাও থোকা। আমি তোমার বইয়ের দাম দিচ্ছি না। আমিও তোমাকে গিফট দিচ্ছি।

বিজলীর হঠাৎ করে নিজেকে অপরাধী মনে হয়, সে ছোটখাটো অভিনয় করে মহিলাকে এভাবে নরম করে দিয়েছে। এটা একধরনের প্রতারণা। সে আগে তো এরকম প্রতারক ছিল না, পথে থাকতে থাকতে সে প্রতারণা করা শিখে গিয়েছে। বিজলী কেমন যেন কুণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মহিলাটা হাত বাড়িয়ে বলল, নাও বাবা। ছেলে থেকে বাবাতে নেমে এসেছে, বিজলী ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নোটটা হাতে নিল। আজকে সারা দিনের ব্যবসা এটা দিয়েই হয়ে গেছে। এখন আর গাড়ি থেকে গাড়িতে দৌড়াদৌড়ি না করলেও চলবে।

সামনে ট্রাফিক সিগন্যাল লাল থেকে সবুজ হয়েছে, গাড়িগুলো নড়তে শুরু করেছে। বিজলী মহিলার দিকে তাকিয়ে হাত তুলে সালাম দিয়ে সরে এল।

বিজলী চলন্ত গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে ফুটপাথে উঠে এল। হঠাৎ শুনতে পেল তার পাশে দাঁড়িয়ে কে যেন চাপা গলায় বলল, হারামজাদা।

বিজলী মাথা ঘুরে তাকালো, তার মতোই কিছু বই নিয়ে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের দৃষ্টিতে আগুন বের হচ্ছে। মানুষটা কেন খেপে আছে বিজলী বুঝে গেল, কিন্তু সে না বোঝার ভান করল, কী হয়েছে?

তুই কী করছস মনে করছিস আমি দেখি নাই?

কী করছি?

হারামজাদা। ঢং করার জায়গা পাস নাই?

খবরদার মুখ খারাপ করে কথা বলবা না।

বললে তুই কী করবি? লোকটা এবারে আরো খারাপ ভাষায় বিজলীকে তার মা-বাবা তুলে গালি দিল।

বিজলী অবলীলায় মানুষটাকে তার মা-বাবা তুলে একই ভাষায় একই ভঙ্গিতে গালি দিল। মানুষটা প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না যে এইটুকুন একটা ছেলে তার মতো একজন বড় মানুষকে এই ভাষায় গালি দিতে পারে। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, এইটা আমার জায়গা। এই জায়গায় তুই কুনো জিনিস বেচবার পারবি না।

বিজলী বলল, এইটা তোমার বাপের জায়গা না। এইটা গভর্মেন্টের জায়গা। এইখানে যার খুশি সে আসতে পারব।

মানুষটা বলল, এইটা আমার জায়গা, ভাগ এখান থেকে। ভাগ। বলে মানুষটা কুৎসিত একটা গালি দিয়ে বিজলীকে ধাক্কা দিল।

বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলল, এখন আর পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে হবে। সে খুবই শান্তভাবে তার হাতের টাকাগুলো পকেটে রাখল। বইগুলো মাটিতে রেখে কোমরে হাত দিল, বলল, তুমি কী বলো?

মানুষটা এবারে শুধু যে ধাক্কা দিল তা না, তার মুখে একটা চড় মারার চেষ্টা করল। বিজলী সময়মতো মাথা সরিয়ে নিয়ে মানুষটাকে একটা ঘুষি দিল। মানুষটা প্রস্তুত ছিল না, ঘুষি খেয়ে পিছিয়ে গেল এবং তাল হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিল। দুই হাত ছড়িয়ে নিজেকে সামলাতে গিয়ে তার হাতের সবগুলো বই নিচে ছড়িয়ে পড়ে গেছে। বিজলী একটা বইকে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে আবার মানুষটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

দেখতে দেখতে তাদের ঘিরে একটা ভিড় জমে গেল এবং বিজলীর সাথে মানুষটার একটা তুমুল মারামারি শুরু হয়ে যায়। মানুষটা বড়, গায়ে জোর বেশি। বিজলী ছোট গায়ে জোর কম কিন্তু সে মানুষটার থেকে অনেক বেশি ক্ষিপ্র। পথে থাকতে থাকতে সে অনেক কিছু শিখেছে, মারামারিতে গায়ের জোর থেকে অনেক বেশি জরুরি হচ্ছে সাহস আর মনের জোর।

মারামারিতে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে সেটা অবশ্যি দেখার সুযোগ হলো না কারণ তার আগেই যারা দর্শক তাদের অনেকে গিয়ে দুজনকে সরিয়ে দিল। একজন পুলিশও এসে দুজনকে ধমকাধমকি করতে থাকে কিন্তু বোঝা গেল সহানুভূতিটা বিজলীর জন্যই বেশি। মানুষটা গজরাতে গজরাতে নিচ থেকে তার বইগুলো তুলতে থাকে। কয়েকজন মিলে বিজলীকে ধরে রাখল এবং সে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করতে করতে মানুষটার দিকে ছুটে আসার ভাণ করতে লাগল।

ট্রাফিকের লাল সিগন্যাল হওয়ার পর যখন গাড়িগুলো আবার থেমে গেল তখন কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে বিজলী আবার তার রংচঙে বই নিয়ে গাড়ি থেকে গাড়িতে দৌড়াতে লাগল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি মানুষটি অত্যন্ত কঠিন মুখে রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে চলে গেল। বোঝা গেল তার এলাকাতে সে বিজলীর দখলদারি মেনে নিয়েছে।

সন্ধ্যেবেলা বিজলী যখন ফুটপাথে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে তখন তার পাশে একটা ছেলে এসে বসল। সে আশেপাশে থাকে, কখনো তাকে রাস্তায় কিছু বিক্রি করতে দেখা যায়নি কিন্তু দেখেই বোঝা যায় তার দিনকাল ভালোই কাটে। লোকজন চাপা গলায় বলাবলি করে সে নাকি ড্রাগের ব্যবসা করে।

ছেলেটি কানে আটকে রাখা একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে একটা ম্যাচের বাক্স থেকে একটা কাঠি বের করে ফস করে সিগারেটটা ধরিয়ে সিগারেটে টান দেয়। তারপর ধোয়াটা নাক দিয়ে বের করে সিগারেটটা বিজলীর দিকে এগিয়ে দেয়।

বিজলী মাথা নাড়ল, সে এখনো সিগারেট খাওয়া শুরু করে নাই। ছেলেটা সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল, নাম কী?

বিজলী বলল, বজলু।

তুই পারবি।

কী পারব?

মাইর পিট করতে।

বিজলী একটু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো। সে মারপিট করতে পারবে এরকম প্রশংসা অন্যের মুখে শুনতে পাবে আগে কখনো কল্পনা করেনি।

ছেলেটা বলল, তোর সব ঠিক আছে। সাহস আছে। ফাস্ট আছস। খালি হাত চালাস মাইয়া মানুষের মতো।

বিজলী চমকে উঠল, ছেলেটা বলে কী? সে মেয়েদের মতো হাত চালায়? ছেলেটা বুঝে গেছে নাকি যে সে মেয়ে?

ছেলেটা তার সিগারেটে আরো একটা লম্বা টান দিল, তারপর বলল, তোর সমস্যা হচ্ছে মাইরের সময় তুই ঘুষি মারিস হাত দিয়া।

বিজলী একটু অবাক হয়ে বলল, ঘুষি তো হাত দিয়াই মারতে হয়।

উঁহু। ঘুষি দিতে হয় পুরা শরীর দিয়া। হাতটা খালি ব্যবহার করতে হয় ঘুষিটা জায়গা মতোন লাগানোর জন্য।

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, বুঝলাম না।

আয় দেখাই। বলে ছেলেটা দেখাল কীভাবে শুধু হাতের শক্তি ব্যবহার না করে পুরো শরীরের শক্তি ব্যবহার করে কাউকে ঘুষি দিতে হয়। শুধু তাই না কীভাবে শুধু এক হাত দিয়ে ঘুষি না মেরে দুই হাত ব্যবহার করতে হয়। মারামারি করার সময় কীভাবে সবদিকে নজর রাখতে হয়। কেউ চাকু মেরে দিবে কিনা সেটা কেমন করে আন্দাজ করতে হয়।

বিজলী মারপিট-সংক্রান্ত ব্যাপারে ছেলেটার জ্ঞান দেখে মোটামুটি মুগ্ধ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তুমি এইগুলা কেমনে শিখছ?

আমার ওস্তাদ শিখাইছে।

তোমার ওস্তাদ কে?

বখতিয়ার ভাই।

বখতিয়ার ভাই কই থাকে?

মাটির নিচে।

বিজলী অবাক হয়ে তাকালো, মাটির নিচে?

ছেলেটা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। খরচা হয়া গেছে।

কীভাবে?

ক্রসফায়ার। ছেলেটা হাত দিয়ে তার খরচা হয়ে যাওয়া ওস্ত দিকে সালাম দিয়ে বলল, আমার ওস্তাদ ছিল একেবারে আসল বাঘের বাচ্চা বাঘ। তারপর জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। ছেলেটা যেহেতু আর কোনো কথা বলল না তাই বিজলী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। দুজন চুপচাপ বসে রইল।

সিগারেট শেষ করে ছেলেটা সেটা ফুটপাথে ঘষে আগুন নিভিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কই থাকিস?

রাস্তায়। ইস্টিশনে।

বাড়ি থেকে পালাইছস?

না।

বাপ মা?

নাই। সাইক্লোনে ভেসে গেছে।

কী করবি ঠিক করছস?

বিজলী মাথা নাড়ল। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়া।

কী করবি?

আমার একটা ভাই আছে, আমারে না জানাইয়া তারে পালক দিয়া দিছে। তারে খুঁজে বের করমু।

ছেলেটা বিজলীর দিকে তাকাল, তারপর হা হা করে হেসে ফেলল, বলল, ঢাকা শহরে দুই কোটি লোক থাকে। দুই কোটি লোকের মাঝ থেকে তুই তোর ভাইরে খুঁজে বের করবি?

বিজলী মাথা নাড়ল, মুখ শক্ত করে বলল, হ্যাঁ। খুঁজে বের করমু। খোদার কসম।

কীভাবে?

সেইটা এখনো ঠিক করি নাই, কিন্তু বের করমুই করমু। তারে যদি খুঁজে বের করতে না পারি তাহলে আমার বাঁইচা থাকার কোনো দরকার নাই।

ছেলেটা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ঠিক আছে।

দুজনে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল, ছেলেটা পিচিক করে ফুটপাথে থুতু ফেলে বলল, তুই যদি আমার লগে কাজ করতে চাস তাহলে বলিস।

তোমার কী কাজ?

এখন বলা যাবে না। যদি কাজ করবার চাস তখন বলুম।

বিজলী বলল, ঠিক আছে।

.

শুধু হাত দিয়ে ঘুষি না দিয়ে পুরো শরীরের শক্তি ব্যবহার করে ঘুষি দেওয়ার টেকনিকটা দুই দিন পরেই বিজলীর কাজে লাগল।

বিজলী একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেক দিনই সকালবেলা যখন মায়েরা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায় সে তখন কোনো একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটা বাচ্চাকে লক্ষ করে। খোকনকে নিশ্চয়ই তার পালক বাবা-মা কোনো একটা স্কুলে ভর্তি করে দেবে। সেই স্কুলে নিশ্চয়ই সকালবেলা খোকনকে নামিয়ে দেবে। কাজেই একটা একটা করে সে যদি প্রত্যেকটা স্কুলে সকালে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে কোনো না কোনোদিন নিশ্চয়ই খোকনকে খুঁজে পাবে। বিজলী তাই ভোরবেলা কোনো একটা স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

আজকেও বিজলী দাঁড়িয়ে ছিল, যখন শেষ গাড়িতে শেষ মা তার ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল তখন বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফিরে যেতে থাকে।

রাস্তার মোড়ে একজন মহিলা দাঁড়িয়েছিল, বাচ্চাকে নামিয়ে নিজের গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে ঠিক তখন রাস্তার উল্টো দিক থেকে একটা মোটরসাইকেল ছুটে এল, মোটরসাইকেলের সামনে কালো চশমা পরা একজন মানুষ, পেছনে আরেকজন। চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে পেছনের মানুষটা খপ করে মহিলার হাতব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। মহিলা তাল সামলাতে না পেরে রাস্তার মাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। মোটরসাইকেলটা বাঁকা হয়ে ঘুরে গিয়ে আবার সোজা হয়ে গর্জন করে ছুটে যেতে থাকে। মোটরসাইকেলটা ঠিক যখন বিজলীর সামনে চলে এসেছে, তখন কী করবে বুঝতে না পেরে বিজলী খপ করে ছিনিয়ে নেওয়া হাতব্যাগটা ধরে ঝুলে পড়ল। মোটরসাইকেলটা কিছুদূর বিজলীকে টেনে নিল, তারপর তাল হারিয়ে কাত হয়ে গেল এবং পেছনের মানুষটা মোটরসাইকেল থেকে নিচে পড়ে গেল। পুরো মোটরসাইকেলটাই কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কালো চশমা পরা মানুষটা কোনোভাবে তার পা দিয়ে সামলে নিল।

যে মানুষটা ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়েছিল সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা ছোট ছেলে এরকম কাণ্ড করতে পারে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। পড়ে গিয়ে মানুষটার হাত-পা ছড়ে গিয়েছে, সে দাঁত কিড়মিড় করে বিজলীর দিকে তাকালো। তারপর ব্যাগটা এক হাতে ধরে রেখে অন্য হাতটা পকেটে ঢুকিয়েছে। বিজলী জেনে গিয়েছে পকেটে মানুষ হাত ঢোকায় অস্ত্র বের করার জন্য, কাজেই কখনো সেই সুযোগ দিতে হয় না। সে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে হিংস্র ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, তারপর কয়েকদিন আগে শেখা সমস্ত শরীর দিয়ে ঘুষি মারার টেকনিক ব্যবহার করে মানুষটার মুখে একটা ঘুষি মারল। বিজলী অবাক হয়ে দেখল তার ঘুষি খেয়ে মানুষটা কাটা কলাগাছের মতো নিচে পড়ে গেছে! বিজলী তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাগটা টেনে নিজের হাতে নিয়ে নেয়।

যে মানুষটা মোটরসাইকেলে বসেছিল, সে চিৎকার করে উঠল। তখন নিচে পড়ে থাকা মানুষটা কোনোমতে উঠে দাঁড়াল, টলতে টলতে কোনোমতে ছুটে গিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে গিয়ে বসে। মোটরসাইকেলটা তখন গর্জন করে ছুটে যেতে থাকে।

বিজলী পেছনে পেছনে ধর ধর বলে চিৎকার করতে করতে ছুটতে লাগল। হাতের ব্যাগটা ঘুরিয়ে সে মানুষটাকে মারার চেষ্টা করল। মানুষটার মাথায় কোথাও ব্যাগটা লেগেও গেল, তারপরেও কোনোভাবে তারা পালিয়ে গেল।

মোটরসাইকেলটা মোড়ে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর বিজলী প্রথমবার ঘুরে তাকালো, যে মহিলার ব্যাগ নিয়ে এত ঘটনা সেই মহিলা ফুটপাথ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার চোখে বিস্ময় এবং অবিশ্বাস। বিজলী ব্যাগটা মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন। আপনার ব্যাগ।

মহিলা ব্যাগটা হাতে নিতে ভুলে গেল, চোখ বড় বড় করে সে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, বাবা, তোমার কী মাথা খারাপ।

বিজলী হাসার চেষ্টা করল, বলল, না আন্টি। আমার মাথা ঠিক আছে।

তুমি এটা কী করলে? তোমার এত সাহস? এই সন্ত্রাসীদের সাথে তুমি মারামারি করতে গিয়েছ? তোমাকে তো খুন করে ফেলত!

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, না, করবার পারে নাই।

তুমি এত বড় মানুষটাকে এভাবে মার দিলে? ঘুষি মেরে নিচে ফেলে দিলে?

বিজলী কোনো কথা বলল না, হাসার চেষ্টা করল। হাতের ব্যাগটা সে মহিলাটার হাতে দিয়ে বলল, নেন আপনার ব্যাগ।

মহিলা ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল, থ্যাংক ইউ। এই ব্যাগটা নিয়ে গেলে আসলেই আমি খুব বিপদে পড়ে যেতাম। ব্যাগে টাকাপয়সা বেশি নাই, কিন্তু অনেক দরকারি কাগজপত্র আছে। তুমি আমার অনেক উপকার করেছ, বাবা।

বিজলী কোনো কিছু বলল না, আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। তারা অবাক হয়ে এখন বিজলীর দিকে তাকিয়ে আছে।

বিজলী যখন চলে যাচ্ছে, মহিলাটি আবার তাকে ডাকল, বলল, বাবা, তুমি এইটুকুন ছেলে, তোমার এত সাহস হলো কেমন করে?

বিজলীর কী মনে হলো কে জানে, হঠাৎ করে সে মহিলাটার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি আসলে ছেলে না। আমি মেয়ে।

মহিলাটি চমকে উঠল, মুখে হাত দিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলল, কী বললে?

বিজলী দ্বিতীয়বার কথাটি না বলে শুধু মাথা নাড়ল।

মহিলাটি খপ করে তার হাত ধরে ফেলল, চাপা গলায় বলল, তুমি ছেলে সেজে আছো কেন?

বিজলী এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, আমি পথেঘাটে থাকি তো সেই জন্যে। মেয়েদের পথেঘাটে থাকলে অনেক বিপদ।

মহিলাটি কেমন যেন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি লেখাপড়া জানো?

ক্লাস নাইন পর্যন্ত।

তুমি চাকরি করতে চাও?

আমাকে কে চাকরি দেবে?

আমি ব্যবস্থা করে দিব। গার্মেন্টসে। করবে?

বিজলী উত্তেজিত হয়ে বলল, করব। অবশ্যই করব।

মহিলাটি তার ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করে বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, এই যে কার্ডটা রাখো। তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করবে। ঠিক আছে?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

কার্ডটা হারিও না যেন।

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, না, হারাব না।

আমি তোমাকে নিজেই নিয়ে যেতাম কিন্তু এখন আমার খুব একটা জরুরি কাজে যেতে হবে। তুমি যোগাযোগ করবে।

বিজলী বলল, করব।

বিজলী কার্ডটা শক্ত করে ধরে রাখল, এর আগে তাকে কার্ড দিয়েছিল সেলিনা জাহান। সেই কার্ডটা নাজনীন ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বলে তার পুরো জীবনটা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। এবার সে এই মহিলার দেওয়া কার্ডটা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। কিছুতেই না।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল