মায়া ছলছল চোখে ইভাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি বিষ্যুৎবার কইরা আর আইবা না আফা?”

ইভা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল, তারপর বলল, “না, মায়া। আমি বিষ্যুৎবার করে আর আসব না। আমাকে ঢাকাতে ট্রান্সফার করেছে।”

জেবা ক্ষুব্ধ মুখে বলল, “কীসের লাগি ট্রান্সফার করল? তুমি এইখানে চাকরি করলেই তো ভালা আছিল।”

ইভা বলল, “সারাজীবন তো এক জায়গায় থাকা যায় না–নতুন জায়গায় যেতে হয়।”

মায়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “তুমি আর আইবা না? কুনোদিন আইবা?”

ইভা সত্যি কথাটি বলতে পারল না–একটু ইতস্তত করে বলল, “আসব। মাঝে মাঝে আসব। যখন আসব তখন তোমাদের সাথে দেখা হবে।”

জেবা জিজ্ঞেস করল, “সত্যি সত্যি আসবা তো?”

ইভা বলল, “আসব।” তারপর মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “জালাল কই?”

“আছে।”

কিছুক্ষণের মাঝে জালালকে দেখা গেল। হাতে এক বান্ডিল খবরের কাগজ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসছে। ইভা জিজ্ঞেস করল, “কী খবর জালাল? তোমার শরীর কেমন?”

“আগের থাইকা ভালা। বেদনা কমছে।”

“গুড।” ইভা জালালের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ভাগ্যিস তুমি ছিলে, তা না হলে কী হত!”

জালাল কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ইভা বলল, “তুমি তো শুনেছ জালাল আমি ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছি। বৃহস্পতিবার করে আর আসা হবে না।”

জালাল মাথা নাড়ল। ইভা বলল, “আমি তোমাদের খুব মিস করব।”

কেউ কোনো কথা বলল না শুধু মায়া একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। তার চোখে পানি টল টল করছে। ইভা নরম গলায় বলল, “তোমরা সবাই মিলেমিশে থেকো। একজন আরেকজনকে দেখে রেখো।”

সবাই মাথা নাড়ল। ইভা তখন জালালের দিকে তাকিয়ে বলল, “জালাল, তুমি সবাইকে দেখে রেখো।”

জালাল নিচু গলায় বলল, “রাখমু আপা।”

“দেখবে কারো যেন কোনো বিপদ না হয়।”

“দেখমু আপা।”

“তুমি খুব অসাধারণ একজন ছেলে জালাল। এতোটুকু ছোট ছেলে হয়ে তুমি এতোগুলো ছেলেমেয়েকে এতো বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছ–এটা অবিশ্বাস্য।”

জালাল কোনো কথা বলল না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ইভা বলল, “আমি তোমাদের জন্যে ছোট কয়েকটা গিফট এনেছিলাম। ছেলেদের জন্যে টি শার্ট, মেয়েদের জন্যে ফ্রক। তোমাদের দিয়ে যাই, ভাগাভাগি করে নিও।”

জেবা বলল, “জালালের কাছে দেন, হে ভাগ কইরা দিব।”

ইভা বলল, “ঠিক আছে। আমি জালালকে দিচ্ছি।” বলে ইভা তার স্যুটকেস খুলে সেখান থেকে বড় একটা প্যাকেট বের করে জালালের হাতে দিল। অন্য যে কোনো সময় হলে প্যাকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যেত, আজকে কেউ কাড়াকাড়ি করল না।

এরকম সময় বহুদূরে ট্রেনের হুইসিল শোনা গেল, কিছুক্ষণ পরেই ট্রেনটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মায়া নিচু গলায় বলল, “টেরেন আহে।”

অন্যদিনের মতো সবাই ছোটাছুটি শুরু করল না, ইভাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। ট্রেনটা বিশাল একটা জন্তুর মতো ফোঁসফাস করতে করতে তাদের সামনে এসে থামে। প্যাসেঞ্জাররা ট্রেন থেকে নামতে থাকে, আজকে তারা কেউ তাদের ব্যাগ নেবার জন্যে কিংবা ভিক্ষা নেবার জন্যে ছোটাছুটি শুরু করল না।

প্যাসেঞ্জাররা নামার পর ইভা বলল, “এবার তা হলে আমি আসি?”

মায়া তার ফ্রকটা উপরে তুলে তার চোখ মুছে, ফ্রকটা তোলার জন্যে তার ছোট পেটটা দেখা যেতে থাকে। জালাল তার হাতের খবরের কাগজ আর ইভার দেওয়া টি-শার্ট আর ফ্রকের প্যাকেটটা জেবার হাতে দিয়ে ইভাকে বলল, “আপা, আপনার ব্যাগটা টেরেনে তুইলা দিই।”

“তোমার ভোলার দরকার কী? হালকা ব্যাগ–আমি তুলতে পারব।”

“হেইডা জানি। কিন্তু আমি তুইলা দিবার চাই।”

“ঠিক আছে। তা হলে দাও।”

জালাল তখন ইভার ব্যাগটা নিয়ে ট্রেনে তুলে দিল। ইভা জালালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “থ্যাংকু জালাল।”

“আমাগো জন্যে দোয়া কইরেন আপা।”

“করব। সবসময় করি।”

জালাল চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে বলল, “আপা, আপনেরে একটা কথা বলি?”

“বল।”

“আমি আর ভুয়া মিনারেল ওয়াটার বেচি না।”

“ভেরি গুড।”

“আর বেচমু না।”

ইভা একটু হেসে তার মাথায় আবার হাত বুলিয়ে দিল।

.

ট্রেনটা যখন ছেড়ে দেয় ইভা তখন জানালা দিয়ে মাথা বের করে তাকাল। সবগুলো বাচ্চা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। ট্রেনটা যখন চলতে শুরু করে তখন সবগুলো বাচ্চা ট্রেনের সাথে সাথে ছুটতে থাকে।

ট্রেনটা ছুটছে, বাচ্চাগুলোও ছুটছে। ট্রেনের গতি বাড়ছে বাচ্চাগুলোও আরো জোরে ছুটছে। আরো জোরে ছুটছে।

তারা কতোক্ষণ এইভাবে ছুটবে?

.

শেষ কথা

আমার ছেলেমেয়ে তখন খুব ছোট, বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব গোলমাল। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে মেয়েদের হলটির নামকরণ করা হয়েছে সে জন্যে দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীরা নানাভাবে আমাদের হুমকি দিচ্ছে–একদিন বাসায় বোমা পর্যন্ত মারল। তখন মনে হল ছেলেমেয়েদের আর আমাদের সাথে রাখা ঠিক হবে না। আমরা তখন তাদের ঢাকায় রেখে এলাম। একটা বাসায় তারা একা একা থাকে, বৃহস্পতিবার বিকেলে ট্রেনে ঢাকা যাই, ছুটির দুটি দিন তাদের সাথে কাটিয়ে শনিবার রাতে রওনা দিয়ে পরদিন ভোরে ফিরে আসি।

প্রতি বৃহস্পতিবার স্টেশনে যেতে হয়, তখন স্টেশনের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে প্রথমে আমার এক ধরনের পরিচয় হল তারপর তাদের সাথে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। এই বইটি আমার সেই বন্ধুদের নিয়ে লেখা। বইয়ের শেষ অ্যাডভেঞ্চারটি কাল্পনিক, এ ছাড়া অন্য ছোটখাট যেসব ঘটনার কথা লিখেছি তার বেশিরভাগ আমার চোখে দেখা।

প্রথম যে শিশুটির সাথে পরিচয় হয়েছিল তার নাম জালাল। তার কাছ থেকে একটা খবরের কাগজ কিনে আমি তাকে দুটো টাকা বেশি দিয়েছিলাম, সে টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে রীতিমতো ধমক দিয়ে বলেছিল, “বেশি দিচ্ছেন কেন? আমি কি ভিক্ষা করছি?”

রাতের ট্রেনে একদিন ঢাকা আসব। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ দেখি ছোট ছোট বাচ্চাদের বিশাল বাহিনী এগিয়ে আসছে। সবার সামনে বাহিনীর নেতা, ছোট একটি ছেলে তার দুই হাত পিছনে। কাছে এসে বলল, “স্যার আপনার জন্যে একটা উপহার।” তারপর পিছনে ধরে রাখা জিনিসটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। একটা চিপসের প্যাকেট। আমার জীবনে কতো উপহার, কতো পুরস্কার পেয়েছি–কিন্তু সেই চিপসের প্যাকেটটি এখনো আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড় উপহার!

যাদের নিয়ে লিখেছি তারা কোনোদিন এই বইটি পড়বে না। সত্যি কথা বলতে কী তারা কোনোদিন জানতেও পারবে না আমি তাদের নিয়ে একটি বই লিখেছি।

এই ব্যাপারটাতে এক ধরনের কষ্ট আছে মনে হয় সেই কষ্টটা থেকে আমার মুক্তি নেই।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল