চার তালা বিল্ডিংটার সামনে একটা চা-বিস্কুটের দোকান। জালাল সেই দোকানটার সামনে চুপচাপ বসে আছে। দুপুরবেলা সে একটা বনরুটি আর একটা কলা খেয়েছে। গরম ভাত খাওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সে বিল্ডিংটার সামনে থেকে নড়তে চাচ্ছিল না, তখন তাদেরকে অন্য কোথাও নিয়ে গেলে সেটা সে জানতে পারবে না। চার তালা বিল্ডিংয়ের কয় তালায় তাদেরকে রেখেছে জালাল প্রথমে বুঝতে পারেনি–কিন্তু উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে কয়েকবার জরিনি খালাকে দোতালার বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছে–সেখান থেকে আন্দাজ করতে পারছে যে মায়া আর জেবাও নিশ্চয়ই দোতালাতেই আছে। বিল্ডিংয়ের সামনে কোলাপসিবল গেট সেখানে বিশাল একটা তালা ঝুলছে তাই মনে হতে পারে ভেতরে ঢোকার বুঝি কোনো উপায় নেই। তবে জালাল চায়ের দোকানের সামনে বসে থেকেও ভেতরে ঢোকার আরো তিনটা পথ বের করে ফেলল। প্রথম পথটা হচ্ছে বিল্ডিংয়ের পাশের নারকেল গাছটা দিয়ে। এই গাছটা বেয়ে সে দোতালার কার্নিশে উঠে যেতে পারে। সেখান থেকে দোতালার বারান্দায়। দুই নম্বর পথটা হচ্ছে জানালাগুলো দিয়ে। জানালাগুলো নিচু, এই জানালায় পা দিয়ে সে উপরে উঠে যেতে পারবে, সেখান থেকে দোতালায়। এই জানালার থেকে আরো অনেক বিপজ্জনক জানালায় পা দিয়ে সে যখন খুশি তখন চলন্ত ট্রেনে উঠে যায় কাজেই তার জন্যে এটা পানির মতো সোজা। তিন নম্বর পথটা হচ্ছে পানির পাইপ। পাইপগুলো বেয়ে সে খুব সহজেই দোতালার জানালায় উঠে যেতে পারবে। জানালার কাঁচ ভেঙে ভেতরে ঢোকা খুব কঠিন হবার কথা নয়।

জালাল অবশ্যি তার কোনোটাই এখন করতে পারবে না। চারিদিকে দিনের আলো, এখন সে যদি বানরের মতো খিমচে খিমচে দোতালায় ওঠার চেষ্টা করে, তা হলে কারো না কারো চোখে পড়ে যাবে, তারপর যা একটা কাণ্ড হবে সেটা আর বলার মতো না।

কাজেই জালাল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। অপেক্ষা করতে করতে সে দেখল এই বিল্ডিংয়ের মাঝে আরো একজন মহিলা আরো একটা বাচ্চার হাত ধরে ঢুকল। মহিলাটার চেহারা মোটেও জরিনি খালার মতো নয় কিন্তু তারপরেও কোথায় যেন দুজনের মাঝে একটা মিল রয়েছে। বাচ্চাটি একটা ছোট গরিব ধরনের ছেলে এবং তার সাথেও মায়ার কোথায় জানি একটা মিল আছে।

বিকেলবেলার দিকে জালাল দেখল বিল্ডিংয়ের সামনে রাখা ট্রাকটার ভেতরে একজন মানুষ এসে খড় বিছাতে শুরু করেছে। ট্রাকে করে যখন গরু নেয় তখন সেখানে এভাবে খড় বিছায়। বেশ পুরু করে খড় বিছিয়ে তার উপর চট বিছানো হল, তারপর পুরোটা একটা তেরপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। খালি একটা ট্রাক তেরপল দিয়ে কেন ঢেকে দেওয়া হল জালাল সেটা বুঝতে পারল না।

অন্ধকার নামার পর জায়গাটা হঠাৎ করে কেমন যেন নির্জন হয়ে গেল। মনে হয় এলাকাটা ভালো না, লোকজন দিনের আলোয় সাহস করে যাওয়া-আসা করেছে, রাতেরবেলা আর সাহস পাচ্ছে না।

রাত একটু গম্ভীর হওয়ার পর জালাল ঠিক করল সে পাইপ বেয়ে বিল্ডিংটার দোতালায় উঠে যাবে। দোতালায় উঠে কী করবে সে এখনো জানে না। মানুষগুলো যদি ভালো হয় তা হলে পাইপ বেয়ে ওঠার অপরাধ নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবে। আর মানুষগুলো যদি খারাপ হয় তা হলে তাদের সামনে পড়া ঠিক হবে না। একনজর দেখেই আবার পাইপ বেয়ে নেমে যেতে হবে।

জালাল পাইপ বেয়ে খুব সহজেই উপরের জানালা পর্যন্ত উঠে গেল। জানালা ভেতর থেকে বন্ধ, কাঁচ ভেঙেও লাভ নেই কারণ ভেতরে লোহার গ্রিল। জালাল তখন কার্নিশে পা দিয়ে সাবধানে এগিয়ে এসে বারান্দার দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে গেল। সামনে একটি ঘর, ভেতরে আলো জ্বলছে, মানুষ আছে কী নেই। বোঝা যাচ্ছিল না। জালাল খুব সাবধানে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল। ছোট একটা ঘর, একটা টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার। একপাশে একটা পুরোনো আলমারি, দরজা খোলা, ভেতরে নানা ধরনের ময়লা আধা ময়লা জিনিসপত্র। মেঝেতে কয়েকটা কার্টন, একটা খোলা বাক্স। বাক্সে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না।

ঘরটায় কেউ নেই ব্যাপারটাতে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে জালাল যখন ভেতরে ঢুকতে যাবে ঠিক তখন পাশের একটা ঘরে পানি ফ্লাশ করার শব্দ হল আর একজন মানুষ তার প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘরে ঢুকল। মানুষটা মাঝবয়সী, উঁচু কপাল, ভাঙা গাল, চোখ দুটি কোটরে ঢুকে আছে। চেয়ারে বসে সে কয়েকবার কাশল, তারপর ডাকল, “মন্তাজ মিয়া।”

মন্তাজ মিয়া নামের মানুষটা কাছাকাছি কোথাও ছিল সে পা ঘষতে ঘষতে ভেতরে এসে ঢুকল। মানুষটা কালো এবং মোটা, খাটো একটা লুঙি এবং লাল রঙের একটা গেঞ্জি পরে আছে। দুপুরবেলা জরিনি খালার সাথে সেও আটকে রাখা বাচ্চাগুলোকে ভয় দেখিয়ে এসেছিল।

মন্তাজ মিয়া তার বগল চুলকাতে চুলকাতে বলল, “ডাকছেন ওস্তাদ?”

“হ্যাঁ।” গালভাঙা মানুষটা বলল, “সবকিছু রেডি?”

“জে ওস্তাদ। ট্রাক রেডি। রাইতেই ডেলিভারি দিমু।”

“কেমনে নিবি?”

“ট্রাকের নিচে খড় বিছায়া দিছি। উপরে চট। সেইখানে সবগুলানরে শোয়াইয়া দিমু। উপরে তেরপল দিয়ে ঢাকা।”

“ট্রাক চালাইব কে?”

“কাদের।”

“হেল্পার?”

“মাজহার।”

“রাস্তা ঠিক আছে?”

“জে। রাস্তা ক্লিয়ার। তারপরেও ধরেন কাঁদেরের কাছে কিছু ক্যাশ টাকা থাকব। যদি ইমার্জেন্সি হয় পুলিশ-বিডিআর ঝামেলা করে তা হলে সাপ্লাই দিব।”

“গুড।” গালভাঙা মানুষটা সম্ভষ্টির ভান করে বলল, “ছেলেমেয়েগুলোরে ট্রাকে তুলবি কখন?”

“ধরেন রাত দশটার মাঝে রওনা দিমু। সবগুলারে বান্ধাবান্ধি করতে ধরেন বিশ মিনিট। তুলতে ধরেন আরো পনেরো মিনিট।”

জালাল খুব সাবধানে বুকের ভিতর থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। মানুষগুলো আসলেই ছেলেধরা। জালাল বুকের ভিতর ভয়ের একটা কাঁপুনি অনুভব করে।

গালভাঙা মানুষটা কিছু একটা চিন্তা করল, বলল, “ঠিক আছে।” তারপর পকেট থেকে একটা ছোট কাঁচের শিশি বের করে টেবিলে রাখল। বলল, “এইটা হচ্ছে মার্কেটের সবচেয়ে ভালো মাল। এক ফোঁটা যদি খায় জোয়ান মানুষ টানা আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুমাবে। ছোট পোলাপানের জন্যে আধা ফোঁটা। মনে থাকবে?”

মন্তাজ মিয়া নামের কালো মোটা মানুষটা মাথা নাড়ল, “মনে থাকব। একজন আধা ফোঁটা, তার মানে দুইজনে এক ফোঁটা।”

“হ্যাঁ। আধা লিটারের পানির বোতলে দশ ফোঁটা মাল দিবি। ভালো করে ঝকাবি। তারপর সবাইরে দুই চামুচ করে খাওয়াবি।”

“ঠিক আছে ওস্তাদ।

“মনে রাখিস কিন্তু এই বোতলের মাল অসম্ভব কড়া। একটু বেশি হলে কিন্তু ফিনিস।”

“মনে থাকব ওস্তাদ। আপনি কুনো চিন্তা কইরেন না।”

ভাঙা গালের মানুষটা বলল, “এই যে এই শিশি এইখানে রাখলাম।”

জালাল দেখল শিশিটা টেবিলের উপর রেখেছে। ছোট কাঁচের একটা শিশি। ভেতরে স্বচ্ছ পানির মতো তরল ভয়ংকর ধরনের একটা ঘুমের ওষুধ!

এরকম সময়ে পাশের ঘর থেকে একজন মহিলা এসে ঢুকল। চেহারা দেখা যাচ্ছিল না বলে জালাল প্রথমে চিনতে পারেনি কথা বলতেই জালাল বুঝতে পারল, মহিলাটি হচ্ছে জরিনি খালা। জালাল শুনল জরিনি খালা বলছে, “ওস্তাদ, আমারে কিন্তু টাকা কম দিছেন।”

“টাকা কম দেই নাই।”

“আমি দুইটা মাইয়া আনছি। মাইয়ার রেট বেশি।”

“একটা বেশি ছোট।”

“ছোট হইছে তো কী হইছে? মাইয়া হইছে মাইয়া। দেখতে দেখতে বড় হইয়া যাইব।”

ভাঙা গালের ওস্তাদ বলল, “ছোট হইলে ঝামেলা বেশি। কাস্টমার নিতে চায় না।”

“তয় আমারে ফেরত দেন।”

“তুই কী করবি?”

“বগার কাছে বেচুম। বগা লুলা বানাইয়া বিক্রি করব।”

ওস্তাদ বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে তোকে না হয় আরও এক হাজার টাকা দিই।”

“দুই হাজার।”

“এক।”

“দুইয়ের এক পয়সা কম হলে হবি না। আপনি বলেন ওস্তাদ আমি কতোদিন থেকে আপনার জন্যে কাম করি।”

“ঠিক আছে দেড়। আর কথা বলিস না। নগদ দিয়ে দিচ্ছি।”

জরিনি খালা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে এইবার রাজি হলাম। সামনের বার কিন্তু রাজি হমু না।”

জালাল দেখতে পেল গালভাঙা ওস্তাদ পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বের করে সেখান থেকে কিছু টাকা বের করে জরিনির হাতে ধরিয়ে দিল, জরিনি টাকাগুলো গুনে নিজের কোমরে গুঁজে নিল।

গালভাঙা ওস্তাদ বলল, “যা, এখন মন্তাজের সাথে হাত লাগা। পোলা মাইয়াগুলানরে খাওয়া দিয়েছিস?”

“জে দুপুরে একবার দিছি। কেউ আর খাইতি চায় না। ভয় পাইছে তো। খালি কান্দে।”

“জোর করে খাওয়া-আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে কিন্তু খাওয়া নাই।”

“ঠিক আছে ওস্তাদ।”

গালভাঙা ওস্তাদ দাঁড়িয়ে বলল, “আয় দেখি, পোলা-মাইয়াগুলারে একটু দেখে আসি।”

“চলেন।”

তিনজন ঘর থেকে সামনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। হঠাৎ করে জালাল বুঝতে পারল, সে ছোট একজন মানুষ। কিন্তু তার উপর এখন অনেক বড় দায়িত্ব। তাকে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু সে কী করবে?

জালাল পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে, অনেকগুলো বাচ্চাকে নেওয়া খুব সোজা, ঘুম পাড়িয়েই নিতে হবে। কিন্তু যদি ঘুম পাড়িয়ে না দেওয়া যায়, সবাই যদি চিৎকার চেঁচামেচি করে তা হলে বাঁচার একটা উপায় আছে। ঘুমের ওষুধটা যদি

পানি দিয়ে পাল্টে দেওয়া যায় তা হলে মনে হয় একটা সুযোগ হবে।

জালাল সাবধানে ঘরের ভেতর ঢুকল। টেবিল থেকে শিশিটা নিয়ে সে পাশের বাথরুমে ঢুকে যায়। শিশিটা খুলে ভেতরের তরল পদার্থটা সিংকের মাঝে ঢেলে ফেলে দেয়–হালকা একটা ঝাঁঝালো গন্ধ তার নাকে এলো। ট্যাপ খুলে পানি দিয়ে শিশিটা একটু ধুয়ে নিয়ে সেখানে পানি ভরে শিশিটার মুখ বন্ধ করে আবার ঘরটাতে ফিরে এসে টেবিলের উপর রেখে দেয় তারপর খুব সাবধানে পা টিপে টিপে পাশের ঘরে ঢুকল। ঘরটা ছোট, মাঝখানে একটা খাট। খাটের উপর নেতিয়ে থাকা তোষক এবং ময়লা চাদর। একটা সবুজ রঙের মশারি উপর থেকে ঝুলছে। জালাল খাটের নিচে ঢুকে গেল।

খাটের নিচে থেকে অন্যপাশের ঘরটা দেখা যাচ্ছে, দরজা খোলা, ভেতরে ওস্তাদ, জরিনি খালা আর মন্তাজ মিয়া ঢুকেছে। তাদের গলার স্বর ছাপিয়ে ছোট বাচ্চাদের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যেতে থাকে।

জালাল শুনতে পেল মন্তাজ মিয়া একটা হুংকার দিয়ে বলল, “চোপ! না হলে কল্লা টেনে ছিঁড়ে ফেলমু।”

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা সাথে সাথে থেমে গেল।

এবারে ওস্তাদের গলার শব্দ শোনা গেল, সে সবাইকে গুনছে, গোনা শেষ করে বলল, “উনিশজন।”

জরিনি খালা বলল, “হ্যাঁ।”

ওস্তাদ বলল, “কুড়িজন ডেলিভারি দিবার কথা। একটা শর্ট পড়ল।–”

জরিনি খালা বলল, “পরের বার একটা বেশি দিলেই হবি।” তারপর নিচু গলায় কী যেন বলল, সেটা শুনে সবাই হেসে উঠল।

কিছুক্ষণ পর খোলা দরজা দিয়ে প্রথমে ওস্তাদ পিছু পিছু মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা বের হয়ে এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওস্তাদ বলল, “আমি গেলাম।”

জরিনি খালা বলল, “আমিও যামু।”

“তুই থাক। মন্তাজরে সাহায্য কর। একলা পারব না। কাল ভোরে যাবি।”

“ঠিক আছে।”

তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে তিনজন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মানুষগুলো সরে যেতেই জালাল খাটের নিচ থেকে বের হয়ে এলো, সে যেটা দেখতে এসেছিল সেটা দেখে ফেলেছে। জরিনি খালা মায়ের মতো আদর করে বড় করার জন্যে মায়া আর জেবাকে আনেনি, তাদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এনেছে বিক্রি করার জন্যে। বাজারে যেভাবে গরু-ছাগল বিক্রি হয় তাদেরকে ঠিক এভাবে বিক্রি করা হচ্ছে।

যেভাবে পাইপ বেয়ে উপরে উঠেছিল ঠিক সেইভাবে এখন পাইপ বেয়ে তাকে নেমে যেতে হবে, তারপর বাইরে কাউকে খবর দিতে হবে। তার কথা কেউ শুনতে চাইবে না কিন্তু তাকে জোর করে কথা শোনাতে হবে। যেভাবে হোক।

পা টিপে টিপে বের হবার আগে জালাল হঠাৎ থেমে গেল। ঐ বন্ধ ঘরটাতে উনিশটা বাচ্চা নিশ্চয়ই ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বেচারি মায়া আর জেবা নিশ্চয়ই এখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার কী একবার ভেতরে ঢুকে তাদের বলা উচিত না যে–ভয় পাওয়ার কিছু নেই–সে বাইরে গিয়ে পুলিশকে খবর দিবে। পুলিশ তাদেরকে উদ্ধার করে নেবে।

জালাল আবার পা টিপে টিপে আগের ঘরে ফিরে এলো। খুব সাবধানে ছিটকিনি খুলে সে দরজাটা একটু ফাঁক করে ভেতরে মাথা ঢোকায়। একটা বড় খাটের উপরে এবং নিচে জড়াজড়ি করে অনেকগুলো বাচ্চা বসে আছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। জালালকে দেখে হঠাৎ সবাই চুপ করে তার দিকে তাকাল।

জেবা অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইছিল জালাল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বলল, সাথে সাথে জেবা চুপ করে গেল। জালাল পা টিপে টিপে কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, “ডরাইস না।”

“তুই কোত্থেকে আইছস?”

“আমি তোগো পিছ পিছ আইছি। কথা কওনের সময় নাই। আমি বাইরে গিয়া পুলিশরে খবর দিমু।”

সবগুলো বাচ্চা চোখ বড় বড় করে জালালের দিকে তাকিয়ে রইল। জালাল সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “কুনো ভয় নাই। আমি পুলিশরে খবর দিমু।”

মায়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন জালাল শুনতে পেল বাইরে মন্তাজ মিয়া বলছে, “এই জরিনা, দরজা খোলা কেন?”

জরিনি খালা বলল, “হেইডাতো জানি না।”

“ভিতরে কে ঢুকছে?”

ধড়াম করে দরজা খুলে মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা ভেতরে ঢুকল। দুইজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়। মন্তাজ মিয়া বলল, “পোলা-মাইয়া ছাড়া তো আর কাউরে দেখি না।”

জরিনি খালা বলল, “গুনে দেখ, বেশি আছে কি না।”

মন্তাজ মিয়া গুনতে শুরু করে, উনিশজন ছিল, গুনে দেখা গেল একজন বেশি। গুনতে ভুল করেছে কী না সেটা ভেবে মন্তাজ মিয়া আরেকবার গুনতে শুরু করেছিল তার আগেই জরিনি খালা জালালকে হঠাৎ চিনে ফেলল, চিৎকার করে বলল, “আরে! তুই জালাইল্যা না?”

জালাল কিছু বলার আগেই মন্তাজ মিয়া লাফ দিয়ে এসে জালালের ঘাড় ধরে তাকে টেনে উপরে তুলে ফেলে একটা ঝাঁকুনি দিল। জালালের মনে হল তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।

জরিনি খালা হি হি করে হেসে বলল, “ওস্তাদরে মিস কল দে! বলতি হবি একটা শর্ট ছিল এখন আর শর্ট নাই। পুরা বিশজন ডেলিভারি দিবার পারমু। একটা বেকুবের বেকুব নিজে আইসা ধরা দিছে।”

জরিনি খালার হাসি আর থামতে চায় না।

.

১১.

মন্তাজ মিয়া জালালকে পাশের ঘরে নিয়ে মারতে চাচ্ছিল জরিনি খালা তাকে থামাল, বলল, “মারিস না। তোর হাতে মাইর খাইলে ভর্তা হইয়া যাইব। এরে যদি ইন্ডিয়া পাঠাবার চাই তাজা রাখন দরকার।”

জরিনি খালার কথায় যুক্তি আছে, তাই মন্তাজ মিয়া চুলের মুঠি ধরে দুই চারটা ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই ঢুকলি কেমনে?”

জালাল বলল, বিল্ডিংয়ের পিছনে পাইপ বেয়ে উঠেছি। মন্তাজ মিয়া হুংকার দিয়ে বলল, “মিছা কথা কইবি না। তুই কি টিকটিকির বাচ্চা যে পাইপ বায়া উঠবি?”

জালাল সত্যি কথাটা বলল। সে আসলেই পাইপ বেয়ে উঠেছে। সে যে কোনো দেয়াল, গাছ বা পাইপ বেয়ে যখন খুশি উঠতে পারে। মন্তাজ মিয়া তখন জানতে চাইল সে কেমন করে এই বিল্ডিংটার খোঁজ পেয়েছে তখন জালাল আবার সত্যি কথাটা বলল, সেই স্টেশন থেকে ট্রেনে তাদের পিছু পিছু এসেছে, বাসে পিছু পিছু এসেছে রিকশায় পিছু পিছু এসেছে। মন্তাজ তখন জানতে চাইল, সে কেমন করে বুঝতে পারল বিল্ডিংয়ের দোতালায় উঠতে হবে। জালাল সত্যি কথাটি বলল, নিচে থেকে সে জরিনি খালাকে এই দোতালার বারান্দায় দেখেছে। মন্তাজ মিয়া তখন জানতে চাইল জরিনি খালা ঢুকেছে বিকালে সে এতোক্ষণ কোথায় ছিল। জালাল আবার সত্যি কথাটা বলল, সে অন্ধকার হয়ে চারিদিক নির্জন হয়ে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল। অন্ধকার হবার পর পাইপ বেয়ে উঠেছে। মন্তাজ মিয়া তখন জানতে চাইল সে কখন পাইপ বেয়ে ঢুকেছে? জালাল তখন প্রথম একটা মিথ্যা কথা বলল, “আমি এইমাত্র ঢুকছি। কাউরে না পাইয়া ইদিক-সিদিক হাঁটছি–এই দরজাটা বন্ধ দেইখা এইটা খুইলা ঢুকছি।”

মন্তাজ মিয়া চুল ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দেয়ালে তার মাথাটা ঠুকে হুংকার দিয়ে বলল, “সত্যি কইরা কথা ক।”

জালাল কাতর গলায় বলল, “সত্যি কইতাছি। খোদার কসম। আল্লাহর কিরা।” একটা মিথ্যা কথা বলে আল্লাহ্ এবং খোদাকে নিয়ে কিরা আর কসম কাটার জন্যে সে মনে মনে খোদার কাছে মাফ চেয়ে নিল।

মন্তাজ মিয়া শেষ পর্যন্ত জালালের কথা বিশ্বাস করে তাকে ঘাড় ধরে এনে দরজার ছিটকিনি খুলে ভেতরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।

দরজাটা বন্ধ হবার সাথে সাথে মায়া আর জেবা এবং তার সাথে সাথে অন্যরাও তাকে ঘিরে ধরল। মায়া ফ্যাস ফ্যাস করে কাঁদছে। চোখের পানি নাকের পানিতে তার মুখ নোংরা হয়ে আছে। জেবার চোখে-মুখে আতঙ্ক, মুখ ফ্যাকাসে এবং রক্তহীন। শুকনো মুখে বলল, “অহন কী হইব আমাগো?”

জালাল গরম হয়ে বলল, “তোদের জন্যে এই অবস্থা। আমি একশবার তোগো কই নাই জরিনি খালা ছেলেধরা? আমার কথা তোরা বিশ্বাস করলি না। এই বদমাইস বেটির পিছে পিছে ঢাকা চইলা আইলি?”

জেবা কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রইল। মায়া ফ্যাস ফ্যাস করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “জরিনি খালা কইল আমাগো নতুন জামা দিব, পেরতেক দিন বিরানি খাইতি দিব, সোন্দর সোন্দর বিছানা-বালিশ দিব, আদর করব”

জালাল দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আর তুই সেই কথা বিশ্বাস করলি? বেকুবের বেকুব–”

জেবা দুর্বল গলায় বলল, “অহন গাইলমন্দ কইরা লাভ কী?”

কাছাকাছি বসে থাকা আরেকটা মেয়ে বলল, “আমাগো কী করব?”

জালাল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “নিচে একটা ট্রাক খাড়ায়া আছে, আমাগো সেই ট্রাকে তুলব, ট্রাকে কইরা ইন্ডিয়া নিব।”

জেবা বলল, “আমরা তহন চিল্লাফাল্লা করমু।”

“তেরপল দিয়া ঢাইকা রাখব। ট্রাকের ইঞ্জিনের অনেক শব্দ, কেউ শুনবার পাইব না।”

কাছাকাছি বসে থাকা মেয়েটা বলল, “মানুষগুলান খুব খারাপ, আমাগো জানে মাইরা ফালাইব।”

জেবা বলল, “ইন্ডিয়া নিলে কি আমাগো বাঁচাইয়া রাখব? যেই অত্যাচার করব তার থাইকা মাইরা ফালাইলেই ভালা।”

আশেপাশে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো নিশ্বাস ফেলে। দুই-একজন কাঁদতে শুরু করে। জালাল বলল, “কান্দিস না। আমাগো এখনো চেষ্টা করতি হবি।”

“কেমনে চেষ্টা করমু?”

“আমি বলি, তোরা হুন।”

সবাই তখন একটু কাছাকাছি এগিয়ে আসে। বেশির ভাগই মেয়ে-বয়স মায়ার থেকে ছোটও আছে আবার জেবার থেকে এক-দুই বছর বেশিও আছে। বেশিরভাগই গরিবের বাচ্চা তবে এক-দুইজনকে দেখে মনে হল বড়লোকের ঘর থেকে এসেছে-এখন আর সেইটা নিয়ে খোঁজ-খবর নেওয়ার সময় নাই।

জালাল বলল, “আমি যেই কথাটা কই সবাই মন দিয়া শুন। কথা বলার বেশি সময় নাই। বাঁচনের একটা উপায়-হগগলের একসাথে থাকন লাগব। বুঝছ সবাই?”

সবাই মাথা নাড়ল। জালাল তখন তাদেরকে বলল খুব কড়া একটা ওষুধ খাইয়ে তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হবে-কিন্তু সে সেই ওষুধটা ফেলে সেখানে পানি ভরে রেখেছে, তাই ওষুধটা খাওয়ালেও তারা আসলে ঘুমিয়ে পড়বে না। যখন তাদের ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করবে তখন সবাই যেন ভান করে তারা এটা খেতে চায় না কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেন খেয়ে নেয়। এটা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর তাদের ঘুমিয়ে পড়ার কথা তাই তারা যেন একটু পরে ঘুম ঘুম ভান করে। ওদেরকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জানলে তারা আর তাদের নিয়ে মাথা ঘামাবে না–তখন তারা সবাই মিলে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে।

জালালের কথা শুনে সবাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তাদের চোখ চকচক করতে থাকে–দুই-একজনের মুখে হাসি পর্যন্ত ফুটে ওঠে। জালাল মুখ গম্ভীর করে বলল, “খবরদার কেউ হাসবি না। সবাই মুখ কালা করে রাখবি। তারা যেন টের পায় আমাগো মাথার মাঝে অন্য বুদ্ধি। বুঝলি?”

সবাই মাথা নাড়ল এবং মুখে ভয় আতঙ্ক হতাশা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। জালাল নিচু গলায় বলল, “একটু পরে আমাগো খাবার দিব। তোরা ভান করবি তোগো খাওয়ার ইচ্ছা করছে না–কিন্তু সবাই ঠিক করে খাবি। পেট ভরে খাবি। যদি মাইরপিট করতে হয় দৌড়াদৌড়ি করতি হয় তা হলে শরীলের মাঝে জোর থাকতি হবি।”

সবাই আবার মাথা নাড়ল। গোলগাল চেহারার একটা মেয়ে জেবার থেকে এক-দুই বছরের বড় হতে পারে একটু এগিয়ে এসে জালালের হাত ধরে বলল, “তোমার নাম কী?”

“জালাল।”

“জালাল, ভাইটি আমার। তুমি আমারে কথা দাও, তুমি আমারে বাঁচাবে। কথা দাও।”

জালাল অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল, কী বলবে বুঝতে পারল না, একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমার কুনো ভয় নাই। আমি তোমারে বাচামু। খোদার কসম।”

গোলগাল মেয়েটি জালালের হাত ধরে রাখল আর তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়তে থাকে।

.

কিছুক্ষণ পর জরিনি খালা আর মন্তাজ মিয়া অনেকগুলো খাবারের প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকল। মেঝের মাঝে বাক্সগুলো রেখে বলল, “এই আবাগীর বেটাবেটি। খা। যদি ঠিক কইরা না খাস ঠ্যাং ভাইঙা দিমু।”

কেউ কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে রইল।

মন্তাজ মিয়া খেঁকিয়ে উঠল, “কী হইল? কথা কানে যায় না? খা কইলাম।”

এবারে বাচ্চাগুলো একটু নড়েচড়ে বসে। জেবা সাবধানে একটা প্যাকেট নিজের দিকে টেনে আনে। জরিনি খালা বলল, “দুইজনে একটা কইরা প্যাকেট। কুনো খাবার যেন না থাকে। সব খাবার শেষ করতি হবে। খা।”

বাচ্চাগুলো প্যাকেটগুলো নেয় এবং খেতে শুরু করে। জরিনি খালা বিছানায় বসে তীক্ষ্ণ চোখে সবাইকে দেখে। এদের সবাইকে অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, পরের বার কোথায় খাবে কী খাবে জানা নেই। এখনই ভালো করে খাওয়া দরকার। তা ছাড়া এদেরকে যে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হবে সেটা খুব খারাপ একটা ওষুধ, খালি পেটে খেলে সমস্যা হতে পারে।

জরিনি খালা আর মন্তাজ মিয়া ভেবেছিল বাচ্চাগুলো খেতে পারবে না–কিন্তু যখন দেখল সবাই চেটেপুটে খেল তখন তারা বেশ অবাক হল, খুশি হল আরো বেশি। খাওয়ার পরই তারা আধ লিটারের একটা ছোট পানির বোতল নিয়ে আসে, বোতলটা ভালো করে ঝাঁকিয়ে জরিনি খালা একটা চা চামুচে পানিটা ঢালল। মন্তাজ মিয়া তখন হাতের কাছে যে বাচ্চাটাকে পেল সেটাকে খপ করে ধরে নিয়ে বলল, “হা কর।”

বাচ্চাটি খুব ভালো করে জানে কেন তাকে হা করতে বলা হয়েছে, তারপরও সে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “ক্যান? হা করমু ক্যান?”

মন্তাজ মিয়া উত্তর দেওয়ার কোনো চেষ্টা না করে তার লোহার মতো শক্ত আঙুল দিয়ে তার দুই গালে এতো শক্ত করে চেপে ধরল যে তার মুখটা হা করে খুলে গেল। জরিনি খালা তার চায়ের চামুচ দিয়ে দুই চামুচ পানি তার মুখে ঢেলে দিল। মন্তাজ মিয়া তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “খা। গিলে খা।”

বাচ্চাটি ঢোক গিলল, মন্তাজ মিয়া সন্তুষ্ট হয়ে তখন পরের জনকে ধরে আনল। এই বাচ্চাটিও দুর্বলভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা মিলে তার মুখেও দুই চামুচ ওষুধ ঢেলে দিয়ে তাকে দিয়ে সেটা ঢোক গিলে খেয়ে ফেলতে বাধ্য করল।

মিনিট দশেকের মাঝেই সবগুলো বাচ্চাকে দুই চামুচ করে ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হল–অন্তত মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা তাই ভাবল। বাচ্চাগুলো জানে এখন তাদের ভান করতে হবে যে তাদের ঘুম পেতে শুরু করছে। তারা সবাই কম-বেশি অভিনয় শুরু করল। একজন ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল, আরেকজন হাঁটুতে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করল। কয়েকজন মেঝেতে শুয়ে পড়ল। কয়েকজন অন্যজনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল।

মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা একটু অবাক হয়ে বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। মন্তাজ মিয়া বলল, “এই ওষুধের তেজ দেখি অনেক বেশি। ওস্তাদ কইছিল দশ-পনেরো মিনিট পরে ঘুম পাড়ব। এরা তো দেখি সাথে সাথে ঘুম যাচ্ছে।”

জরিনি খালা বলল, “বয়স কম, সেই জন্যে মনে লয়।”

“বেশি ঘুমাইলে ট্রাকে ভোলা সমিস্যা হতি পারে। এখনই ট্রাকে ভোলা শুরু করতি হবে।”

জরিনি খালা মাথা নাড়ল, বলল, “দেরি করা যাবি না। আমি পাহারা দেই তুমি দুইটা দুইটা কইরা নামাও।”

মন্তাজ মিয়া চওড়া এক রোল টেপ নিয়ে আসে, সেখান থেকে খানিকটা ছিঁড়ে তাদের মুখে লাগাল যেন কথা বলতে না পারে তারপর আরো খানিকটা ছিঁড়ে তাদের দুই হাত পিছনে নিয়ে সেখানে লাগাল যেন হাত দুইটা ব্যবহার করতে না পারে। হাত পিছনে বাঁধা থাকলে হঠাৎ করে কেউ দৌড় দিতে পারে না।

মন্তাজ মিয়া তারপর বাচ্চা দুইজনের ঘাড় ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনে। লাইট নিভিয়ে সবকিছু অন্ধকার করে রাখা আছে তার মাঝে বাচ্চা দুইজনকে ট্রাকে তুলে দেওয়া হল। ট্রাকের ভেতরে একজন বসেছিল সে দুইজনকে ট্রাকের মাঝে উপুড় করে শুইয়ে দিল। বাচ্চা দুটো নড়াচড়া করল না, চুপচাপ শুয়ে রইল। মন্তাজ মিয়া বলল, “এক নম্বর ওষুধ। আধা ফোঁটা ওষুধেই কলাগাছের মতোন ঘুম।”

ট্রাকের ভেতরে বসে থাকা মানুষটা বলল, “কথা ভুল কও নাই। সত্যি কথা ছোট পুলাপান বড় যন্ত্রণা করে। একবার ঘুমাইলে শাস্তি।”

যে দুইজনকে নিয়ে তারা কথা বলছিল সেই দুইজন কিন্তু আবছা অন্ধকারে চোখ পিট পিট করে সবাইকে দেখছে। তাদের চোখে কোনো ঘুম নেই তারা পুরোপুরি সজাগ হয়ে কিছু একটা করার জন্যে অপেক্ষা করছে।

দুইজন দুইজন করে বিশটি বাচ্চাকে নামিয়ে আনা হল এবং সবাইকে ট্রাকের ভেতরে খড়ের উপর চটের বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। শুইয়ে দেওয়ার পর তাদের মুখের আর হাতের টেপ খুলে দেওয়া হল–সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে গভীর ঘুমে অচেতন। এখন এগুলোর আর দরকার নেই।

মন্তাজ মিয়া আবছা অন্ধকারে সারি বেঁধে শুয়ে থাকা বাচ্চাগুলোকে একনজর দেখে শেষবারের মতো গুনে ট্রাক ড্রাইভারকে বলল, “কাদের ভাই, এই যে তোমারে আমি কুড়িটা বাচ্চা বুঝায়া দিলাম। এরা যে ঘুম দিছে আগামী চব্বিশ ঘণ্টায় সেই ঘুম ভাঙব না। এখন দায়-দায়িত্ব তোমার।”

“এক-দুইটা মইরা যাইব না তো?”

“হেইডা আমি জানি না।”

“মরলে কিন্তু আমার দোষ নাই।”

মন্তাজ মিয়া মাথা নাড়ল, “না তোমার দোষ নাই। তুমি ওগো ওষুধ খাওয়াও নাই। ওষুধ খাওয়াইছি আমরা। মরলে দায়ী আমরা। যাও। আল্লাহর নাম নিয়া রওনা দাও।”

কাদের ড্রাইভার একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আল্লাহর নাম নিয়া রওনা দিমু? মন্তাজ তোমার কী ধারণা এই বাচ্চাগুলানরে আমরা ইন্ডিয়া পাচার করতাছি হেইডা দেইখাও আল্লাহ্ কী আমাগো দিকে থাকব?”

মন্তাজ মিয়া ধমক দিয়া বলল, “বড় বড় কথা কওনের দরকার নাই। রওনা দেও। আল্লাহর নাম নিতি না চাইলে নিও না। যাও।”

তেরপল দিয়ে ট্রাকটা ভালো করে ঢেকে দেওয়ার পর ভেতরের অংশটা কুচকুচে অন্ধকার হয়ে গেল। ট্রাকটা না ছাড়া পর্যন্ত সবাই চুপচাপ শুয়ে রইল, যেই ট্রাকটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করে সাথে সাথে সবাই উঠে বসে যায়। জালাল ফিস ফিস করে বলল, “সবাই ঠিক আছ?”

সবাই গলা নামিয়ে বলল, “আছি।”

অন্ধকারের ভেতর কেউ একজন বলল, “এখন আমরা কী করমু?”

“প্রথমে তেরপলটা একটু খুলতে হবে যেন ভেতর থেকে বের হতে পারি। তারপর অপেক্ষা করতি হবে। যখন ট্রাকটা কুননা জায়গায় থামব আমরা নাইমা দিমু দৌড়।”

“ট্রাকটা কখন থামবি?”

“হেইডা তো জানি না।”

“যদি না থামে?”

“থামবি। নিশ্চয়ই থামবি।”

অন্ধকারে কেউ একজন বলল, “টেরাক ডেরাইভাররা টেরাক থামাইয়া সবসময় চা খায়।”

আরেকজন বলল, “হ। খালি চা না হেরা বাংলা মদও খায়।”

জালাল বলল, “একটা কথা হুনো সবাই।”

“কী কথা?”

“আমরা চেষ্টা করুম গোপনে নামবার। কিন্তু যদি মনে কর তারা দেখি ফেলে তা হলে সবাই দৌড় দিবা।”

“ঠিক আছে।”

“সবাই একদিকে দৌড় দিবা না। একেকজন একেক দিকে।”

“ঠিক আছে।”

“পিছন দিকে তাকাবা না। আল্লাহ্র নাম নিয়া দৌড় দিবা।”

“ঠিক আছে।”

ট্রাকটা গর্জন করে যেতে থাকে। কোন দিক দিয়ে যাচ্ছে বোঝার কোনো উপায় নেই। কিন্তু হর্নের শব্দে, হঠাৎ হঠাৎ ব্রেক করা দেখে তারা অনুমান করতে পারে এটা এখনো শহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে ভেতর থেকে তারা তেরপলটা খোলার চেষ্টা করতে থাকে। ভারী শক্ত তেরপল বাইরে দিয়ে বাঁধা, তাই খোলা প্রায় অসম্ভব। চারিদিকে চেষ্টা করে টানাটানি করে ডানদিকের মাঝামাঝি তারা একটা জায়গায় খানিকটা ফাঁক করতে পারল। অনেক চেষ্টা করে তারা খানিকটা তেরপল সরিয়ে মোটামুটি বের হবার মতো খানিকটা জায়গা করে ফেলতে পারল।

এখন শুধু অপেক্ষা করা কখন ট্রাকটা থামবে। কিন্তু ট্রাকটা থামল না যেতেই থাকল, যেতেই থাকল। ভেতরে এক ধরনের ভ্যাপসা গরমের মাঝে বাচ্চাগুলো বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। তাদের কারো চোখে ঘুম নেই-সবার বুকের ভেতর চাপা আতঙ্ক। শেষ পর্যন্ত তারা সত্যিই পালাতে পারবে তো?

.

১২.

কাদের ড্রাইভার একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “বুঝলি মাজহার কামটা ঠিক কি না বুঝবার পারি না।”

মাজহার নামের হেল্পার ড্রাইভারের পাশে বসে বসে ঝিমাচ্ছিল, কাদের ড্রাইভারের কথা শুনে জেগে উঠল। জিজ্ঞেস করল, “কোন কামটা ওস্তাদ?”

“এই যে ছোটো ছোটো পোলাপানদের ইন্ডিয়া পাচার করি।”

মাজহার তার ময়লা দাঁত বের করে হি হি করে হাসল, বলল, “কী বলেন ওস্তাদ। এই পোলাপানগুলি কি বড় হইয়া জজ-বেরিস্টর হইব? এরা তো চোর ডাকাইত ফকিরনিই হইব। তয় এইটা এই দেশে হইলেই কী আর ইন্ডিয়াতে হইলেই কী? মাঝখানে আমাগো কিছু ইনকাম।”

কাদের ড্রাইভার স্টিয়ারিং ধরে একটা লক্কর-ঝক্কর বাসকে বিপজ্জনকভাবে ওভারটেক করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “তারপরেও জানি কেমন কেমন লাগে। মনে হয় কামটা ঠিক হইল না।”

মাজহার কিছু বলল না। তার ওস্তাদের অনেক কথা সে বুঝতে পারে না। তাদেরকে কিছু মাল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে বলেছে–তারা নিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে কোন জিনিসটা অন্যায়? এখন সেই মালটা কী গরুর বাচ্চা না মানুষের বাচ্চা সেইটা নিয়ে তার চিন্তা করতে হবে কেন? ইন্ডিয়ার গরু যখন ট্রাকে করে আনে তখন তো তার ওস্তাদ মন খারাপ করে না।

কাদের ড্রাইভার আরেকটা বাসের পিছন পিছন যেতে যেতে বলল, “তারপর মনে কর পুলিশ

“পুলিশের কী হইছে ওস্তাদ?”

“যদি ধরে?”

“সেইটা তো আমাগো চিন্তা না। পুলিশরে তো আগে থেকে রেডি কইরা রাখা হইছে। ওগো টাকা-পয়সা দিছি-ওরা আমাগো ধরব ক্যান?”

“মাজহার–তোরে একটা জিনিস বলি। সব জিনিস টাকা-পয়সা দিয়া হয় না। এই পুলিশের মাঝেও ভালো পুলিশ আছে–তাগো হাতে যদি ধরা পড়ি তখন টাকা-পয়সা দিয়া ছুটবার পারবি না। তখন জন্মের মতো শেষ।”

মাজহার তার ময়লা দাঁত বের করে হাসল। বলল, “হেইডা নিয়া আপনার চিন্তা করনের কিছু নাই। তারা আমাগো ধরব না। হেইডা বড় বড় ওস্তাদের দায়িত্ব। আমরা ধরা খাইলে তারা কি আর ছুঁইটা যাইব? তারাও ধরা খাইব।”

কাদের ড্রাইভার তার সিগারেটে টান দিয়ে বলল, “চায়ের তিয়াশ হইছে।”

“সামনে লাকি রেস্টুরেন্ট। ফাস্ট ক্লাশ চা বানায়।” মাজহার জিজ্ঞেস করল, “থামবেন?”

“আয় থামি।”

কিছুক্ষণের ভেতরে তারা লাকি রেস্টুরেন্টের সামনে পৌঁছে গেল। এই রেস্টুরেন্টটা তৈরি হয়েছে ট্রাক ড্রাইভারদের জন্যে। বেশ কয়েকটা ট্রাক সামনে ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে। কাদের ড্রাইভার একটা ট্রাকের পিছনে তার ট্রাকটা পার্ক করল। তারপর ট্রাক থেকে নেমে ট্রাকটার চারিদিকে ঘুরে এল। তারপর মাজহারকে বলল, “আয়। চা খাই।”

“আমি কি ট্রাক পাহারা দিমু?”

“এই ট্রাক পাহারা দিয়ে কী করবি। পোলাপান ঘুমায়–চব্বিশ ঘণ্টার আগে এরা উঠব না।”

“ঠিক আছে।” তারপর দুইজন হাঁটতে হাঁটতে লাকি রেস্টুরেন্টে চা খেতে গেল।

.

ঠিক তখন ট্রাকের ভেতরে সবগুলো বাচ্চা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জালাল বলল, “এখন বাইর হতি হবে। দেরি করা যাবে না।”

একজন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “বাইর হইয়া কই যামু?”

জালাল তেরপল থেকে মাথা বের করে চারপাশে দেখল, তারপর বলল, “সামনে চায়ের দোকান-ঐদিকে যাওয়া যাবি না। রাস্তা পার হয়া পিছন দিকে যাবি-ঐখানে গাছের পিছনে লুকাবি। কেউ যেন না দেখে। প্রথম কে বের হবি?”

কেউ একজন বলল, “আমি।”

“ঠিক আছে। বের হ–”

দেখা গেল বের হওয়া খুব সোজা না। তেরপলটা টেনে বের হওয়ার জন্যে যেটুকু জায়গা করা হয়েছে সেই জায়গাটা খুব বেশি না–খানিকটা গিয়ে ছেলেটা আটকে গিয়ে যন্ত্রণার মতো শব্দ করতে থাকে।

জালাল বলল, “আস্তে! চিল্লাইস না–” তারপর উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে তাকে নামানোর চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত ছেলেটা ছোট ফুটো দিয়ে বের হয়ে ধুপ করে নিচে পড়ল। পেটের ছাল উঠে গিয়েছে কিন্তু সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সময় নাই।

জালাল জিজ্ঞেস করল, “কেউ দেখে নাই তো?”

“না।”

“তুই একটু খাড়া–ছোট একটারে নামাই।”

তারপর ছোট একজনকে উপর থেকে ধরে আস্তে আস্তে নিচে নামাল। ট্রাকটা অনেক উঁচু কাজেই একসময় ছেড়ে দিতে হল এবং বাচ্চাটা ধুপ করে নিচে পড়ল। জালাল শুনতে পেল নিচে পড়ে বাচ্চাটা যন্ত্রণার একটা শব্দ করল-সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না–চাপা স্বরে বলল, “পালা।”

দুইজন তখন রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এরপর একজন একজন করে বের হতে থাকে, বের হওয়ার সাথে সাথেই না চলে গিয়ে একজন পরের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে–তাকে টেনে নামাতে সাহায্য করে। বের হওয়ার গর্তটা ছোট তাই মাঝে মাঝেই একজন-দুইজন সেখানে আটকে যাচ্ছিল তখন অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ভেতর থেকে চা খেয়ে যখন ট্রাক ড্রাইভাররা তাদের ট্রাকে ফিরে আসছিল তখনো তারা বের হচ্ছিল না। অন্য ট্রাক ড্রাইভারদের বিশ্বাস করা যাবে কি না তারা বুঝতে পারছিল না-তাই কোনো ঝুঁকি নিল না।

যখন সবাই বের হয়ে গেছে শুধু জালাল বাকি ঠিক তখন দেখা গেল কাদের ড্রাইভার আর মাজহার চা খেয়ে লাকি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসছে। ট্রাকের পাশে এইমাত্র বের হয়ে যে মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “ড্রাইভার আসছে।”

জালাল বলল, “পালা।”

মেয়েটা দ্রুত পালিয়ে গেল কিন্তু জালাল বের হতে পারল না, ট্রাকের মাঝে আটকা পড়ে গেল।

কাদের ড্রাইভার আর মাজহার দুইজনে মিলে পুরো ট্রাকটা আবার ঘুরে দেখে। তেরপলের যে অংশে একটু জায়গা করে সবাই বের হয়েছে সেখানে এসে কাদের ড্রাইভার আর মাজহার দাঁড়িয়ে গেল। কাদের ড্রাইভার বলল, “এইখানে ফাঁকা কেন?”

মাজহার বলল, “মনে হয় ঠিক করে বান্ধি নাই।” সে একটু উঁকি দিয়ে দেখল, তারপর তেরপলটা টেনে বের হওয়ার জন্যে যে জায়গাটা ফাঁক করা হয়েছিল সেটা বন্ধ করে দিল। ভেতরে বসে থেকে জালালের মনে হল সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদে।

কাদের ড্রাইভার আর মাজহার ট্রাকে ওঠে। জালাল শুনতে পেল ইঞ্জিনটা স্টার্ট হয়েছে, ট্রাকটা একটা ঝাঁকুনি দিল তারপর আস্তে আস্তে নড়তে শুরু করে। হঠাৎ করে জালাল বুঝতে পারল সে যদি এখনই ট্রাক থেকে বের হতে না পারে তা হলে আর কোনোদিন বের হতে পারবে না।

জালাল লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, বের হওয়ার যে অংশটুকুতে তেরপলটা টেনে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জালাল সেখানে হাত ঢুকিয়ে ধাক্কা দিয়ে বের হবার রাস্তা করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমে মনে হয় সে বুঝি পারবে না, কিন্তু শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দেবার পর একটুখানি তেরপল সরে যায়–জালাল চলন্ত ট্রাক থেকে নিচের রাস্তাটা দেখতে পেল। দেখতে দেখতে ট্রাকের বেগ বাড়তে থাকে–কিছুক্ষণের মাঝে ট্রাকটা এতো জোরে যেতে থাকবে যে বের হওয়ার রাস্তা থাকলেও সে আর বের হতে পারবে না।

জালাল আর দেরি না করে ফাঁকা অংশটি দিয়ে তার শরীর বের করে দেয়, ঘাড় আর মাথা আটকে গিয়েছিল ধাক্কা দিয়ে সেটি ছুটিয়ে নিতে চেষ্টা করে, শেষ পর্যন্ত ছুটিয়ে এনে সে বের হয়ে আসে, কোনোমতে সে তেরপলটা ধরে ঝুলে থাকে। শরীরের নিচ দিয়ে রাস্তাটা ছুটে যাচ্ছে, হাতটা ছাড়লেই সে রাস্তায় পড়বে এবং সাথে সাথে ট্রাকের পিছনের চাকা তাকে পিষে ফেলবে। কাজেই তাকে শুধু নিচে রাস্তায় পড়লেই হবে না ছিটকে ট্রাকের নিচ থেকে সরে আসতে হবে যেন ট্রাকের চাকা তাকে পিষে ফেলতে না পারে।

জালাল বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিল তারপর একটা ঝটকা দিয়ে লাফ দিল, চেষ্টা করল রাস্তায় পড়ার সাথে সাথে গড়িয়ে সরে যেতে। প্রচণ্ড জোরে সে রাস্তার মাঝে আছাড় খেয়ে পড়ে, মাথার এক আঙুল কাছ দিয়ে ট্রাকের চাকাগুলো পার হয়ে গেল, তার মাঝে জালাল গড়াতে গড়াতে রাস্তার কিনারে একটা গাছের সাথে। ধাক্কা খেয়ে থামল। জালালের মনে হল সে নিশ্চয়ই মরে গেছে। কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পারল সে মরেনি, তখন মনে হল সে নিশ্চয়ই মরে যাবে। আরো কয়েক সেকেন্ড পরে দেখল সে মরেনি এবং তখন প্রথমবার তার মনে হতে লাগল সে হয়তো এবারে বেঁচে যাবে। জালাল মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে তার হাত-পা নিশ্চয়ই ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেছে। সে সাবধানে তার হাত নাড়ল, পা নাড়ল এবং তখন সে বুঝতে পারল অনেক ব্যথা পেলেও আসলে তার হাত-পা ভাঙেনি শুধু শরীরের ছাল-চামড়া উঠে গেছে।

ঠিক তখন সে অনেকগুলো ছোট ছোট পায়ের শব্দ শুনতে পেল এবং দেখতে দেখতে সবগুলো বাচ্চা তাকে ঘিরে দাঁড়াল। কে একজন তার উপর ঝুঁকে পড়ে ভাঙা গলায় ডাকল, “জালাল, এই জালাল–”

জালাল গলার স্বর শুনে চিনতে পারল, জেবা তাকে ডাকছে।

কে একজন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “মরে গেছে–মরে গেছে-”

জেবাও এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “জালাল–এই জালাইল্যা তুই মরিস না–আল্লাহর কসম লাগে।”

জালাল উঠে বসার চেষ্টা করে বলল, “মরি নাই। আমি মরি নাই।”

“মরে নাই–মরে নাই–” সবাই মিলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “জালাল মরে নাই।”

কয়েকটা গাড়ি চলে যাবার পর জালাল জেবার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তা থেকে নিচে নেমে আসে, অন্য সবাই তখন সেখানে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। হঠাৎ করে সবার মন ভালো হয়ে গেছে, ফিসফিস করে নিজেদের ভেতর কথা বলছে, খিক খিক করে হাসছে, হাসতে হাসতে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিচ্ছে, ধাক্কা দিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। এরা চব্বিশ ঘণ্টা আগেও কেউ কাউকে চিনত না, এখন এরা সবাই একে অন্যের প্রাণের বন্ধু।

জালাল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাগো মনে হয় এইখানে থাকন ঠিক না।”

জেবা জানতে চাইল, “ক্যান?”

“হেরা যখন দেখব ট্রাকের ভেতরে কেউ নাই তখন আমাগো খুঁজতে আসব না?”

জালালের বয়সী একটা ছেলে বলল, “আইতে দাও। আমি যদি কল্লাটা না ছিঁড়ি।”

সবাই হইহই করে উঠল, “কল্লা ছিড়া ফালামু। কল্লা ছিড়া ফালামু।”

কারো ভেতরে কোনো ভয়ডর নেই এবং তাদেরকে দেখে জালালের ভেতরের ভয়ডরও আস্তে আস্তে উঠে যেতে শুরু করল।

.

কাদের ড্রাইভার তার ট্রাকটাকে রাস্তার পাশে দাঁড়া করাল। অন্ধকারে একজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল সে তার টর্চ লাইটটা কয়েকবার জ্বালাল আর নিভাল। তারপর ট্রাকটার দিকে এগিয়ে এল।

কাদের ড্রাইভার ট্রাকের জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল, “ভাইয়ের নাম কী?”

“মিজান।”

“মিজান বকশ?”

“হ্যাঁ।”

“উঠেন।”

মাজহার দরজা খুলে একটু সরে মিজান বকশকে বসার জায়গা করে দিল। মিজান বকশ মাজহারের পাশে বসে বলল, “চলেন। আমাদের বস মাল ডেলিভারি নেবার জন্যে বসে আছেন।”

কাদের ড্রাইভার তার ট্রাক স্টার্ট করল, মিজান বকশ বলল, “সামনে বামে মোড় নিবেন।”

কাদের ড্রাইভার সামনে গিয়ে বাম দিকে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়ল। ছোট রাস্তা তাই কাদের ড্রাইভার সাবধানে তার ট্রাকটি চালিয়ে নেয়। মিজান বকশ কখনো ডানে কখনো বামে যেতে বলতে থাকে এবং মিনিট পনেরো পর একটা অন্ধকার বাড়ির সামনে থামল। বাইরে বড় গেট, কোনো একজন গেটটা খুলে দিল কাদের ড্রাইভার তখন ট্রাকটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে আসে।

ইঞ্জিনের স্টার্ট বন্ধ করতেই ট্রাকের হেডলাইট নিভে গিয়ে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তখন একজন মানুষ ট্রাকটার দিকে এগিয়ে আসে। কাদের ড্রাইভার ট্রাক থেকে নেমে মানুষটির দিকে এগিয়ে যায়-অন্ধকারে তার চেহারা ভালো দেখা যায় না। খসখসে গলায় মানুষটি বলল, “রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয় নাই তো?”

“জে না।”

“গুড। কয়জন আনছেন।”

“বিশজন।”

“আধমরা দুর্বল রোগী আনেন নাই তো?”

কাদের ড্রাইভার মাথা নাড়ল, “জে না। পোলাপাইন সবগুলাই মোটামুটি তেজী।”

মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, “গুড।” তারপর মাজহারের দিকে তাকিয়ে বলল, “খোল দেখি তেরপলটা। পোলাপানগুলারে দেখি।”

মাজহার দড়ির বাঁধন খুলে তেরপলটা টেনে সরিয়ে দিল। খসখসে গলার স্বরের মানুষটা তার টর্চ লাইটটা ট্রাকের ভেতর ফেলল। ভেতরে কেউ নেই–একেবারে ফাঁকা। মানুষটা তার টর্চ লাইটটা বন্ধ করে থমথমে গলায় বলল, “ভেতরে কেউ নাই।”

কাদের ড্রাইভার আর মাজহার ইলেকট্রিকশক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। বলল, “নাই?”

“না।”

তারা মানুষটার কথা বিশ্বাস না করে নিজেরা ট্রাকের ভেতর তাকাল, সত্যিই ভেতরটা ফাঁকা। পুরোপুরি ফাঁকা। কাদের ড্রাইভার হা করে তাকিয়ে থাকে, তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না। বিশটা বাচ্চাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এখানে শুইয়ে রাখা হয়েছিল–আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে তাদের ঘুম থেকে জেগে ওঠার কথা না! একজনও নেই! কাদের ড্রাইভার আমতা আমতা করে বলল, “কই গেল ওরা?”

“প্রশ্নটার উত্তর আপনিই দেন। কই গেল?”

মাজহার ট্রাকটার আরো কাছে গিয়ে চটটাকে টেনে একটু নাড়াচাড়া করল, তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল চটটা একটু টানাটানি করলে তার নিচে লুকিয়ে থাকা বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসবে।

খসখসে গলার মানুষটা একটু নিশ্বাস ফেলে বলল, “এর অর্থটা কী বুঝেছেন ড্রাইভার সাহেব?”

“কী?”

“এর অর্থ এর মাঝে পুলিশ র‍্যাব বর্ডার গার্ড সব জায়গায় খবর চলে গেছে। এর অর্থ পুলিশ র‍্যাব বর্ডার গার্ড আপনাকে আর আপনার বসকে খুঁজতে শুরু করেছে। আপনাদের মতো কাঁচা কাজ যারা করে তারা ধরা পড়ে জেলখানার ভাত খেলে আমার কিছু বলার নাই। কিন্তু আপনাদের কাঁচা কাজের জন্যে আমার সমস্যা হলে আমার খুব মেজাজ খারাপ হয়।”

কাদের ড্রাইভার বলল, “কিন্তু কিন্তু–”

খসখসে গলার মানুষটার গলা আরও খসখসে হয়ে গেল। বলল, “আমি মানুষটা হাসিখুশি–আমার সহজে মেজাজ খারাপ হয় না। আজকে মেজাজ খারাপ হল। শেষবার যখন আমার মেজাজ খারাপ হয়েছিল তখন এক ডজন লাশ পড়ছিল। এইবার তার থেকে বেশি পড়তে পারে–”

কাদের ড্রাইভার আবার কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হল না। ফ্যাকাসে মুখে দেখল খসখসে গলার স্বরের মানুষটা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে।

.

ইভা ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিছু একটা পড়ে। এটা তার বহুদিনের অভ্যাস। আজকেও সে একটা বই পড়ছিল, নতুন একজন লেখকের উপন্যাস, পড়া শেষ করে শুয়ে পড়বে করতে করতেই বেশ রাত হয়ে গেল। যখন প্রায় জোর করে বইটা বন্ধ করে বালিশে মাথা রাখল ঠিক তখন তার টেলিফোনটা বেজে উঠল।

এতো রাতে কে ফোন করতে পারে ভেবে সে টেলিফোনটা টেনে নেয়, অপরিচিত একটা নম্বর। ফোনটা ধরবে কী ধরবে না ভাবতে ভাবতে সে টেলিফোনটা ধরল, “হ্যালো।”

“দুই টেকি আপা?”

ইভা চমকে উঠল–তাকে দুই টেকি আপা ডাকে স্টেশনের বাচ্চারা। এতে রাতে স্টেশনের একটা বাচ্চা তাকে কেন ফোন করবে? ইভা বিছানায় সোজা হয়ে বসল, বলল, “তুমি কে?”

“আপা, আমি জালাল।”

“জালাল? তুমি এতো রাতে?”

“আপা, আমাদের অনেক বড় বিপদ হইছে।”

“কী বিপদ?”

“আপা ছেলেধরা আমাগো বিশজনকে ধইরা ইন্ডিয়া পাঠাইতে লাগছিল–”

ইভা চমকে উঠল, “কী বলছ তুমি?”

“সত্যি বলছি আপা। আমরা অনেক কষ্ট কইরা পালাইয়া আইছি।”

ইভা বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, “থ্যাংক গড। এখন তোমরা কোথায়?”

“সবাই একটা খেতের মাঝে লুকাইয়া আছি-আমি একটা দুকান থাইকা আপনেরে ফোন করতে আসছি।”

“তোমরা পুলিশের কাছে যাও না কেন? থানাটা খুঁজে বের করে এক্ষুনি পুলিশের কাছে যাও।”

জালাল টেলিফোনের অন্যপাশে চুপ করে রইল। ইভা বলল, “কী হল?”

“আপা”

“বল।”

“পুলিশের কাছে গিয়া আমাগো কোনো লাভ নাই। আমাগো কেউ বিশ্বাস করে না। দূর দূর কইরা দৌড়াইয়া দেয়। আর ছেলেধরার লগে পুলিশের মনে হয় খাতির আছে। আমাগো যদি আবার ছেলেধরার কাছে ফেরত দেয়?”

“কী বলছ তুমি?”

“সত্যি কথা কইতাছি আপা। আমরা গরিব মানুষ, রাস্তার পোলাপান আমাগো কোনো কথা কেউ বিশ্বাস করে না। মনে করেন এই যে ফোন করতাছি–”

“হ্যাঁ, কী হয়েছে ফোনের?”

“কেউ আমাগো একটা ফোন পর্যন্ত করতে দেয় না। দূর দূর কইরা দৌড়ায়া দেয়। অনেক কষ্ট কইরা ফোন করতাছি”

“ঠিক আছে জালাল, তোমরা এখন কোথায়?”

“জানি না আপা। মনে লয় বর্ডারের কাছে।”

“তুমি যার ফোন থেকে কল করেছ তাকে দাও দেখি–”

“দেই আপা।”

ইভা তখন সেই মানুষটার সাথে কথা বলল, জায়গাটা কোথায় সেটা কোন থানায় পড়েছে এই বিষয়গুলো জেনে নিল। তারপর আবার জালালের সাথে কথা বলল। জালালকে বলল, “তোমার কোনো চিন্তা নেই। তোমরা যেখানে আছ সেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাক। আমি সব ব্যবস্থা করছি।”

“কী ব্যবস্থা করবেন আপা?”

“পুলিশ র‍্যাব যেটা দরকার সেটা পাঠাব।”

“আমাগো কুনো সমিস্যা হবি না তো?”

“না। তোমাদের কোনো সমস্যা হবে না। এমনিতে তোমরা ভালো আছো তো?”

জালাল বলল, “জে আপা।”

“কেউ ব্যথা পায় নাই তো?”

“আমি একটু পাইছি।”

“সর্বনাশ! কেমন করে–”

“ট্রাক থেকে লাফ দিছিলাম–একটুর জন্যে ট্রাকের নিচে পড়ছিলাম।”

ইভা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। বাচ্চা পাচারকারীর হাতে ধরা পড়ল কেমন করে, ছাড়াই বা পেল কেমন করে কে জানে। সে এখন আর সেটা জানতে চাইল না, জালালকে বলল, “তুমি অন্যদের সাথে গিয়ে বস। আমি ব্যবস্থা করছি।”

ঠিক আছে আপা। তারপরে লাইন কেটে গেল।

জালাল যখন হেঁটে হেঁটে অন্য সবার কাছে ফিরে যাচ্ছে ইভা তখন টেলিফোনে নানা মানুষের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে।

ইভার যোগাযোগ খুব ভালো, ভোর হওয়ার আগেই জালাল আর সব বাচ্চা কাচ্চাকে উদ্ধার করা হল, কাদের ড্রাইভার আর মাজহারসহ ট্রাকটাকে আটক করা হল। তারা খুব অবাক না হলেও জরিনি খালা আর মন্তাজ মিয়াকে যখন ধরা হল তারা একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। পরদিন পত্রিকায় বিশটি বাচ্চা এবং পিছনে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় জরিনি খালা, মন্তাজ মিয়া, কাদের ড্রাইভার আর মাজহারের ছবি ছাপা হল। বাচ্চারা সবাই খবরের কাগজে ছাপা হওয়া সেই ছবিটা দেখেছিল, টেলিভিশনে তাদের যে সাক্ষাৎকারটা প্রচারিত হয়েছিল সেটা অবশ্যি তারা কেউ দেখতে পায়নি। তারা দেখার জন্যে টেলিভিশন কোথায় পাবে?

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল