মোবাইল ফোনটা মাঝখানে রেখে চারজন সেটার চারদিকে বসে আছে। ফোনটা লাউড স্পীকার মোডে আছে তাই যে কথাই আসুক সেটা চারজনে শুনতে পাবে। এই মোবাইল ফোনটা রাজুর বড় বোন মিথিলার। এই মুহূর্তে মিথিলার ফোনটা থেকে তিয়াশার ফোনে ডায়াল করা হয়েছে। তিয়াশার ফোনটা রয়েছে ড্রাগ ডিলারদের চায়ের দোকানে। সেখানে কোনো কথাবার্তা হলে তারা এখানে বসে শুনতে পাবে-সেটাই ছিল পরিকল্পনা।

পরিকল্পনাটা কাজে লাগবে না সেটা তারা বুঝতে শুরু করেছে। প্রথম কারণ হচ্ছে টাকা-পয়সা, মিথিলার ফোনে শ খানেক টাকা ছিল সেই টাকাটা ধীরে ধীরে খরচ হয়ে যাচ্ছে। যখন পুরো টাকা খরচ হয়ে যাবে তখন লাইন কেটে যাবে–কাজেই এই সময়ের ভিতরে যদি কোনো কথাবার্তা না হয় তা হলে তারা সেটা শুনতে পাবে না। দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে ফোনটার অবস্থান। তারা অনেক বুদ্ধি করে ফোনটার উপরে শক্ত টেপ দিয়ে ফ্যাসেনার লাগিয়েছে। সেই ফ্যাসেনারের অন্য অংশ আছে চায়ের দোকানের বেঞ্চের নিচে। সেগুলো দিয়ে তিয়াশার ফোনটা বসানো হয়েছে বেঞ্চের নিচে। বেঞ্চে কেউ বসলে নাড়াচাড়া করলে তারা সেই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পায় কিন্তু যখন কেউ কথা বলে সেটা অস্পষ্ট শোনা যায়। তারপরেও তারা যে কথাবার্তা একেবারেই শুনতে পায় না তা না। মাঝে মাঝেই একটা-দুইটা কথা শুনতে পায় কিন্তু সেই কথাগুলো খুবই সাধারণ কথা, কেউ একজন এসে চায়ের অর্ডার দিচ্ছে, সিঙ্গারা কিনছে, সিগারেট কিনছে এরকম।

সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় আছে রূপা। যদি দোকানের লোকগুলো কোনোভাবে ফোনটা খুঁজে পেয়ে যায় তা হলে মহা বিপদ হয়ে যাবে। তিয়াশার ফোনটা তা হলে তারা আর ফেরত পাবে না, তখন তিয়াশাকে কী জবাব দেবে সেটা সে চিন্তাও করতে চায় না। রূপা তাই একটু পরে পরে ঘড়ি দেখছিল, মোবাইলের টাকা শেষ হবার পর চায়ের দোকানের বেঞ্চের নিচ থেকে মোবাইল ফোনটা উদ্ধার না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাচ্ছে না।

মোবাইল ফোনটায় তখন একটু কথা শোনা গেল, চারজনই তখন কান পাতল। কথাগুলো খুব আস্তে কিন্তু তারপরেও বোঝা যাচ্ছে। একজন বলল, “আজকে কিন্তু বড় ডেলিভারি।”

আরেকজন বলল, “ঠিক আছে।” গলার স্বর শুনে মনে হল চায়ের দোকানদার।”আপনারা বুঝছেন তো আমার কত বড় রিক্স।”

“কীসের রিক্স?”

“পুলিশের।”

“পুলিশের কোনো রিক্স নেই। আমরা মাসে মাসে টাকা দেই না!”

“সব পুলিশকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। কিছু ত্যাড়া পুলিশ থাকে।” দোকানদার বলল, “আপনাদের এত বড় বড় ডেলিভারির জন্যে আমার এই ভাঙাচুরা দোকান ব্যবহার করেন–আমার ভয় লাগে।”

“ভয় নেই। আমরা আছি না?”

“জে আছেন।”

“শোনো তা হলে, খুব বড় ডেলিভারি। এক পার্টি তোমারে ডেলিভারি দিব। তুমি মাল তোমার কাছে রাখবা। তোমারে মাল ডেলিভারি দিবার সময় বলবে মিঠা পানি, লুনা পানি। বুঝেছ?”

“বুঝেছি। মিঠা পানি, লুনা পানি।”

“হ্যাঁ, আর তোমার কাছ থেকে আরেক পার্টি সেই মাল নিয়ে যাবে।”

“কখন?”

“আজকেই নেবে।”

“কে আসবে?”

“সেইটা কী তোমারে বলে দেব? বলব না। গোপন পার্টি। দেখে বুঝতেই পারবে না। কিন্তু তার কথা শুনে বুঝবে সে গোপন পার্টি।”

“কী কথা বলবে?”

“বলবে গিলা-কলিজার বাটি।”

“গিলা-কলিজার বাটি? হে হে হে!”

“হ্যাঁ। হাসির কিছু নেই। গোপন কথা–গোপন।”

“ঠিক আছে। কেউ এসে যদি বলে গিলা-কলিজার বাটি তারে আমি মাল দিয়ে দেব?”

“হ্যাঁ। যদি সন্দেহ হয় তা হলে বলবে পরিষ্কার করে বলেন। তখন সে বলবে, বরফের মতো গরম আগুনের মতো ঠাণ্ডা। বুঝেছ?”

“বরফের মতো গরম?”

“হ্যাঁ, আর আগুনের মতো ঠাণ্ডা। মনে থাকবে?”

“মনে থাকবে।”

“আরেকটা বিষয়। খুব জরুরি–” মানুষটা যখন খুব জরুরি কথাটা বলতে শুরু করল ঠিক তখন লাইনটা কেটে গেল। মিথিলার ফোনের টাকা শেষ।

ওরা চারজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। রাজু চোখ বড় বড় করে বলল, “দেখেছ? ড্রাগ ডিলাররা কেমন করে কাজ করে?”

সঞ্জয় বলল, “হ্যাঁ। গোপন পাসওয়ার্ড!”

মিম্মি বলল, কী আজব। গিলা-কলিজার বাটি! এইটা একটা পাসওয়ার্ড হল? ভালো কিছু বলতে পারে না?”

“এইটাই তো যথেষ্ট ভালো। কেউ কী কখনো চিন্তা করতে পারবে পাসওয়ার্ড হচ্ছে গিলা-কলিজার বাটি”-সঞ্জয় হি হি করে হাসতে শুরু করতে যাচ্ছিল কিন্তু সবাই এমনভাবে তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল যে সে সুবিধা করতে পারল না।

মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “আমরা এখন কী করব?”

সঞ্জয় বলল, “পুলিশকে খবর দেব।”

রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু! শুনিসনি ওরা পুলিশকে মাসে মাসে টাকা দেয়। পুলিশের কাছে যাওয়া যাবে না।”

“সব পুলিশ তো খারাপ না। শুনিসনি ত্যাড়া পুলিশ আছে”

“তুই দেখে বুঝবি কোন পুলিশ ভালো আর কোন পুলিশ ত্যাড়া?”

সঞ্জয় মাথা নাড়ল, বলল, “না–”

রাজু বলল, আমাদের মনে হয় এখন বড়দের জানানোর সময় হয়েছে। ব্যাপারটা আমাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।”

“কাকে জানাবি?”

“আপুকে দিয়ে শুরু করি। আপু যখন দেখবে তার মোবাইলের সব টাকা খরচ করে ফেলেছি তখন আমার কাছে জানতে চাইবে কোথায় এত লম্বা ফোন করেছি। তখন বললেই হবে।”

রূপা বলল, “তোমার আপুর ফোনের টাকা–আর আমার আপুর ফোনটা আনতে হবে। যদি ফোনটা হারায় তা হলে আমি শেষ।” কথা শেষ করে রূপা গলায় পোচ দেবার ভঙ্গি করল।

রাজু মাথা নাড়ল, “ঠিক বলেছ। চল আগে গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসি।”

চায়ের দোকানটার কাছাকাছি গিয়ে ওরা থেমে গেল। রাজু বলল, “আমাদের সবার যাওয়ার দরকার নেই। দুইজন যাই।”

“কোন দুইজন?”

“মোবাইল ফোনটা বেঞ্চের তলায় ফিট করেছিল রূপা। কাজেই রূপাকে যেতে হবে। সাথে আরেকজন।”

রূপা বলল, “মিম্মি, তুই আয়। দুইজনই মেয়ে হলে সন্দেহ কম করবে।”

“আমি?” মিম্মি কেমন জানি ভয়ে ভয়ে তাকাল।

“হ্যাঁ। সমস্যা কী? আমরা গিয়ে বেঞ্চের উপর বসব। তুই চা-সিংগারা অর্ডার দিবি, কথা বলবি, মানুষটাকে ব্যস্ত রাখবি। আমি বেঞ্চের তলায় হাত দিয়ে মোবাইলটা খুলে নেব।”

মিম্মি বলল, “ঠিক আছে।” তারপর বিড়বিড় করে বলল, “গিলা-কলিজার বাটি।”

রূপা বলল, “কী বললি?”

“না কিছু না। মনে নেই গোপন পাসওয়ার্ড? হঠাৎ মনে পড়ল। এইখানে এই পাসওয়ার্ড বলে ড্রাগ ডেলিভারি নিবে। মনে নেই?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে আছে।”

“ডেঞ্জারাস জায়গা।”

“তোর ভয় লাগছে?”

“না, না। ভয় লাগবে কেন?” বলে মিম্মি দুর্বলভাবে হাসল। বিড়বিড় করে বলল, “গিলা-কলিজার বাটি! কী আজব।”

রূপা আর মিম্মি হেঁটে হেঁটে খোলা চায়ের দোকানটার কাছে যায়। দোকানি মানুষটা তার কেতলিতে গরম পানি ঢালছিল, তাদের দুইজনকে দেখে মুখ তুলে তাকাল।

চায়ের দোকানে আর কেউ নেই, দুইজনে তাদের বেঞ্চে গিয়ে বসে। রূপা সাবধানে হাত দিয়ে বেঞ্চের তলাটা পরীক্ষা করে। দোকানি মানুষটা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা কনুই দিয়ে মিম্মিকে একটা খোঁচা দিল, দৃষ্টিটা তার দিকে সরানোর দরকার। মিম্মি বলল, “আমাদের দেন দেখি

“কী দেব?”

মিম্মি হঠাৎ করে বলে বসল, “গিলা-কলিজার বাটি–” কথাটা শুনে রূপা পাথরের মতো জমে গেল, সিংগারা বলতে গিয়ে বলে ফেলেছে গিলা-কলিজার বাটি। কী সর্বনাশ। দোকানি মানুষটাকে দেখে মনে হল তার মাথার উপর বাজ পড়েছে। সে মুখ হাঁ করে মিম্মির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে।

মিম্মি নিজেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না কী ঘটে গেছে। রূপা টান দিয়ে মোবাইল ফোনটা খুলে নিয়েছে এখন আর এখানে থাকার দরকার নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবে। দোকানি মানুষটা কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “তো-তোমরা? তোমরা?”

মিম্মি বোকার মতো মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ আমরা।”

“তোমরা গিলা-কলিজার বাটি! কি আশ্চর্য!”

রূপা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল মিম্মি।”

“দাঁড়াও দাঁড়াও। তোমরা এসেই চলে যেও না। তোমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছ। এইটাই সেই জায়গা। খালি বল দেখি এর পরেরটা কী?” রূপা বলল, “বরফের মতো গরম আগুনের মতো ঠাণ্ডা।”

দোকানি মানুষটা বোকার মতো মাথা নাড়তে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় তার ঘাড়ের সাথে মাথার অংশটা ঢিলে হয়ে গেছে। মানুষটা তার ময়লা দাঁত বের করে হাসল তারপর টেবিলের তলা থেকে কার্ডবোর্ডের একটা বাক্স বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দিল।

রূপা বুঝতে পারল এখন আর তাদের পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। সে হাত বাড়িয়ে বাক্সটা হাতে নিল তারপর আর একটা কথা না বলে হাঁটতে শুরু করে।

রাস্তার অন্য পাশে রাজু আর সঞ্জয় দাঁড়িয়ে ছিল তারা তাদের দিকে এগিয়ে আসে, রাজু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “এইটা কী?”

রূপা বলল, “এখন কথা বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি হাঁট।”

রাস্তার পাশে মোড় নিয়ে ডান দিকে চলে যাবার আগে রূপা চোখের কোনা দিয়ে দেখল চায়ের দোকানের মানুষটা এখনো মুখ হাঁ করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

কিছুক্ষণ আগে যেরকম তারা চারজন মিথিলার মোবাইল ফোনটাকে মাঝখানে রেখে চারজন চারদিকে বসে ছিল এখন প্রায় ঠিক সেইভাবে মাঝখানে কার্ডবোর্ডের বাক্সটা রেখে চারজন চারদিকে বসে আছে। সবাই বাক্সটার দিকে তাকিয়ে আছে এবং তাদের দেখে মনে হয় তারা ঠিক বাক্সের দিকে নয় তারা বুঝি একটা মরা মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। সঞ্জয় বলল, “তোরা কেমন করে এটা করলি?”

মিম্মি মুখ কাচুমাচু করে বলল, “হঠাৎ করে মুখ ফসকে বের হয়ে গেল। আমি কী করব?”

“মুখ ফসকে অন্য কিছু বের হতে পারল না? ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়্যার?” সঞ্জয় চোখ লাল করে বলল, “তোকে গিলা-কলিজার বাটিই বলতে হল!”

রাজু বলল, “থাক। থাক। যা হবার হয়ে গেছে। এখন ঠিক করতে হবে আমরা কী করব?”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী করব?”

মিম্মি বলল, “এই বাক্সটা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারি। বলতে পারি ভুল হয়ে গেছে, সরি।”

“মাথা খারাপ?” আমাদেরকে পেলে এখন খুন করে ফেলবে।”

“পুলিশকে দিতে পারি।” সঞ্জয় বলল, মোড়ে যে পুলিশ বক্সটা আছে সেখানে গিয়ে তাদেরকে এই বাক্সটা দিয়ে বলতে পারি এটা রাস্তায় পড়েছিল, আমরা পেয়ে ফেরত দিতে এসেছি।”

“আর যখন খুলে দেখবে ভেতরে ড্রাগস তখন আমাদের এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? রিমান্ডে নিয়ে এমন টর্চার করবে–”

সঞ্জয় বলল, “এর ভেতরে ড্রাগস আছে কেমন করে জান? হয়তো অন্য কিছু।”

রাজু ভুরু কুঁচকে বলল, “অন্য কিছু কী?”

“কোনো মানুষের কাটা মাথা–”

মিম্মি পিছনে সরে গিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কাটা মাথা?”

“দেখিসনি? সিনেমায় থাকে? বাক্সের ভেতরে কাটা মাথা?” রা

জু বলল, “খুলে দেখি কী আছে ভেতরে।”

মিম্মি বলল, “কাটা মাথা থাকলে আমি ফিট হয়ে যাব।”

“আগেই কারো ফিট হওয়ার দরকার নেই।”

.

বাক্সটা মোটা টেপ দিয়ে খুব ভালো করে লাগানো, হাত দিয়ে টেনে খোলা গেল না। রাজু রান্নাঘর থেকে একটা চাকু আনল, টেপ কেটে বাক্সটা সাবধানে খোলা হল। ভেতরে ভেঁড়া খবরের কাগজ দিয়ে প্যাকিং করা আছে সেগুলো সরানো হলেই দেখা গেল সারি সারি অনেকগুলো বয়াম আর প্রত্যেকটা বয়ামের ভেতর ছোট ছোট লাল রঙের ট্যাবলেট।

রূপা একটা কাঁচের জার হাতে নিতে যাচ্ছিল ঠিক তখন দরজা খুলে রাজুর আম্মু ঢুকলেন। রূপা খুব শান্তভাবে কিছুই হয়নি এরকম ভান করে বাক্সটার ঢাকনা বন্ধ করল যেন রাজুর আম্মু ভেতরে দেখতে না পারেন।

রাজুর আম্মু তাদের মুখের দিকে তাকালেন তারপর একটু অবাক হয়ে বললেন, “কী ব্যাপার? তোমাদের কী হয়েছে? এরকম মুখ কালো করে সবাই বসে আছ কেন?”

রূপা বলল, “না খালাম্মা। কিছু না।”

“বাক্সের মাঝে কী?”

রূপা এক মুহূর্তের জন্যে ভাবল সত্যি কথাটা বলে দেবে কী না। কিন্তু মনে হল এখনই বলা যাবে না–ফলটা ভালো না হয়ে খারাপ হতে পারে। কাজেই মিথ্যা কথা বলতে হল। সে যেহেতু আগেও বলেছে তাই সে নিজেই দায়িত্বটুকু নিল। বলল, “কেমিক্যালস।”

“কেমিক্যালস?”

“জি।”

“কীসের কেমিক্যালস?”

“আমাদের সায়েন্স প্রজেক্টের। আমরা ঠিক করেছি স্মোক বম্ব বানাব। সেই জন্যে কেমিক্যালস দরকার, সেগুলো জোগাড় করেছি।”

“ও আচ্ছা। কিন্তু তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোমরা বুঝি একটা ব্যাংক ডাকাতি করতে যাচ্ছ।”

“না। না। আসলে কীভাবে করব, চিন্তা করছিলাম তো তাই।”

“ঠিক আছে!” রাজুর আম্মু হাসলেন, বললেন, “বেশি চিন্তা করলে আবার খিদে পেয়ে যায়। টেবিলে তোমাদের জন্যে নাস্তা দিচ্ছি। তোমরা খেতে এসো।”

রাজু বলল, “আসছি আম্মু।”

রাজুর আম্মু ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই মিম্মি রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই বড় হয়ে নিশ্চয়ই ক্রিমিনাল হবি।”

রূপা চোখ পাকিয়ে বলল, “কেন?”

“কী রকম চোখের পাতি না ফেলে মিথ্যা কথা বলে দিলি! ঘাগু ক্রিমিনাল না হলে পারে না।”

রূপা রেগে উঠল, “এত যদি সত্যি কথা বলার ইচ্ছে তা হলে গিয়ে বলে দিচ্ছিস না কেন? আমরা ড্রাগ ডিলারদের ড্রাগ বোঝাই একটা বাক্স নিয়ে এসেছি। এখন ড্রাগ ডিলাররা আমাদের খুঁজছে মার্ডার করার জন্যে? বলিসনি কেন?”

রাজু বলল, “আহা-হা-রাগ করছ কেন?”

“তা হলে কী খুশি হব? আমাকে তোরা মিথ্যাবাদী বলবি আর আমি আনন্দে লাফাব? আমি কী ইচ্ছে করে মিথ্যা কথা বলেছি? আমি কী আমার নিজের জন্যে মিথ্যা বলেছি?”

রাজু বলল, আহা-হা-প্লীজ রূপা। শান্ত হও।”

রূপার প্রায় চোখে পানি এসে গেল। বলল, “রাজু আমি তোমার আম্মুর কাছে মিথ্যা কথা বলতে চাই না। তাই যে কয়টা কথা বলেছি তার সবগুলো করতে হবে, যেন কোনো কথাই মিথ্যা না হয়। বুঝেছ?”

“বুঝেছি।”

“স্মোক বম্ব বানাবার জন্যে যেই সব কেমিক্যালস লাগে আমাদের সেই কেমিক্যালস কিনতে হবে। আমাদের সায়েন্স প্রজেক্টে সেটা বানাতে হবে। বুঝেছিস সবাই?” রূপা প্রায় হিংস্র গলায় বলল, “বুঝেছিস?”

সবাই মাথা নাড়ল। মিম্মি ভয়ে ভয়ে বলল, “বুঝেছি।”

রাজু জিজ্ঞেস করল, “আর এই ড্রাগসগুলো?”

“যা ইচ্ছে তা করতে পার।”

রাজু বলল, “পরে ঠিক করব কী করা যায়, আপাতত লুকিয়ে রাখি।”

রাজু বাক্স থেকে কাঁচের বয়ামগুলো বের করে তার বইয়ের শেলফে বইয়ের পিছনে রেখে দিল।

ময়না খালার বাচ্চা দুটো এ সময় ঘরে ঢুকে বলল, ভাই তোমার বন্ধুদের নিয়ে নাস্তা খেতে এসো। সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তা না হলে।

অনেক মজার মজার খাবার কিন্তু তারা এমনভাবে সেগুলো খেতে লাগল যে দেখে মনে হতে থাকে খাবার নয়, শুকনো খবরের কাগজ খাচ্ছে। ব্যাপারটা রাজুর আম্মুর চোখ এড়াল না, জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার? তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে তোমরা বেশ ডিস্টার্বড়!”

রূপা যেহেতু মিথ্যা কথা বলার দায়িত্বটি নিয়ে নিয়েছে তাই সে আবার দায়িত্ব নিল, তবে এবারে একটু অন্যভাবে বলল, “না খালাম্মা, আসলে আমার মনটা একটু খারাপ ছিল তো সেই জন্যে মনে হয় অন্যদেরও মন খারাপ হয়েছে।”

রূপা রাজুর কাছে শুনেছিল তার আম্মু কী একটা মহিলা সংগঠনে কাজ করেন। কয়দিন থেকে ভাবছিল তার সাথে সুলতানার ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবে। এখন তার একটা চেষ্টা করা যায়। সে বলল, খালাম্মা, আমাদের বাসায় একটা মেয়ে কাজ করে, তার নাম সুলতানা। বেচারি সুলতানার ফ্যামিলির খুব অভাব-অনেক বড় ফ্যামিলি। কিছুতেই বেচারি টাকা জমাতে পারছে না। বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারে না।

রাজুর আম্মু কিছুক্ষণ রূপার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপরে বললেন, “আমাদের দেশের কাজের মানুষের সমস্যা অনেক বড় সমস্যা। তারা চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে, তাদের কোনো ছুটি নেই। অল্প কিছু বেতন পায় অনেক ফ্যামিলিতে ‘অত্যাচার করে কিন্তু কেউ সেটা দেখে না। দেশে তাদের জন্যে কোনো আইন নেই। তুমি এত ছোট একটা মেয়ে এদের ব্যাপারটা লক্ষ করেছ, সেটা খুব চমৎকার। কংগ্রাচুলেশনস।”

“ওদের জন্যে কী করা যায় খালাম্মা?”

“সবচেয়ে সহজ হচ্ছে বাসার কাজ থেকে সরিয়ে অন্য কোনো কাজে লাগিয়ে দেওয়া। বাসার কাজে তো কোনো সম্মান নেই। সত্যিকার কাজে সম্মান আছে।”

“কী ধরনের কাজ?”

“যাদের লেখাপড়া নেই, ট্রেনিং নেই তাদের জন্যে তো সুযোগ খুব বেশি নেই! গার্মেন্টসের কাজ হতে পারে। বড় বড় শহরে বিশাল বিশাল গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি, এখানে সেরকম নেই। কিন্তু একটা-দুইটা আছে।

“রূপা আগ্রহ নিয়ে বলল, এরকম একটা গার্মেন্টসে কী সুলতানা কাজ করতে পারবে?”

“বয়স কত?”

“আমার মতো।”

“তা হলে তো অনেক ছোট।”

“আরেকটু বড়ও হতে পারে।”

“যাই হোক শিশু শ্রমের ব্যাপার আছে। তারপরেও চেষ্টা করতে পারি। তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ, যদি রাজি থাকে তা হলে বল। আমার পরিচিত কিছু গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি আছে।”

“বলব। খালাম্মা, আপনাকে বলব।”

.

১০.

বিজ্ঞান ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কী খবর?”

ক্লাশের ছেলেমেয়েরা বলল, “ভালো ম্যাডাম। খুব ভালো।”

“ভেরি গুড। তোমাদের বিজ্ঞান প্রজেক্ট কেমন এগোচ্ছে?”

এবারে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ভেতর থেকে নানা ধরনের উত্তর শোনা গেল। কিছু জোরে, কিছু আস্তে, কিছু উৎসাহের, কিছু হতাশার, কিছু আনন্দের এবং কিছু দুঃখের। ম্যাডাম সবকিছু বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে মাথা নাড়লেন, বললেন, “বুঝেছি।”

মাসুক জিজ্ঞেস করল, “কী বুঝেছেন ম্যাডাম?”

“তোমাদের চাপ দিতে হবে। তা না হলে তোমরা প্রজেক্ট শেষ করবে না।”

“চাপ?”

“হ্যাঁ। একটা ডেডলাইন দিতে হবে।” ম্যাডাম মনে মনে কী একটা হিসাব করলেন তারপর বললেন, “তোমাদের এক সপ্তাহ সময় দিলাম, পরের শুক্রবার সায়েন্স ফেয়ার।”

ক্লাসের অনেকেই চমকে উঠল, “পরের শুক্রবার? এত তাড়াতাড়ি?”

“হ্যাঁ। এত তাড়াতাড়ি। তার কারণ এইটা শেষ হবার পর আরেকটা প্রজেক্ট হবে তারপর আরেকটা তারপর আরেকটা এভাবে চলতেই থাকবে! বুঝেছ?”

“বুঝেছি ম্যাডাম।”

“এবারে সবার প্রগ্রেস রিপোর্ট শুনি।” ম্যাডাম ব্যাগ থেকে কাগজ বের করলেন, “প্রথমে হচ্ছে টিম দুর্বার। টিম দুর্বার তোমরা বল তোমাদের কাজ কতদূর অগ্রসর হয়েছে?”

টিম দুর্বারের সদস্যদের খুব দুর্বার মনে হল না, মুখ কাচুমাচু করে জানাল সৌর বিদ্যুৎ প্রজেক্টের জন্যে তাদের সোলার প্যানেল আর ব্যাটারি জোগাড় করার কথা, এখনো জোগাড় হয়নি তাই প্রজেক্ট থেমে আছে। ম্যাডাম তখন কীভাবে সোলার প্যানেল, ব্যাটারি এসব জোগাড় করা যায় সেটা বলে দিলেন।

এরপরের টিমের নাম টিম গ্যালিলিও, তাদের একটা টেলিস্কোপ তৈরি করার কথা। তারা জানাল টেলিস্কোপ একটা তৈরি হয়েছে কিন্তু এখনো দুটি সমস্যা। প্রথমত, সবকিছু ঝাঁপসা দেখা যায় এবং উল্টো দেখা যায়। তাদের কথা শুনে ক্লাসের অনেকে হেসে উঠলেও ম্যাডাম হাসলেন না, ঝাঁপসাকে কেমন করে পরিষ্কার করা যায় আর উল্টোকে কেমন করে সিধে করা যায় সেটা বলে দিলেন।

এর পরের টিমের নাম টিম রোবটিক্স, টিম লিডার মাসুক। তার উৎসাহের শেষ নেই কিন্তু তার টিমের অন্য মেম্বারদের কেমন যেন নেতিয়ে পড়া ভাব। মাসুক বলল, “ম্যাডাম আমরা আমাদের প্ল্যানটা একটু অন্যরকমভাবে করেছি।”

“কী রকম করেছ?”

“সত্যিকারের রোবট বানানো তো সোজা না, এক সপ্তাহের মাঝে তৈরি করা যাবে না, তাই আমরা ঠিক করেছি আমরা নিজেরাই রোবট সেজে ফেলব। কার্ডবোর্ড কেটে মাথার মাঝে লাগিয়ে রোবটের ভাষায় কথা বলব।”

বিজ্ঞান ম্যাডাম কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন, “রোবটের ভাষা? সেটা কী রকম?”

মাসুক তখন নাক দিয়ে কাটা কাটা এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ করল। সেটা শুনে ক্লাশের সবাই হেসে উঠল এবং ম্যাডাম আরেকটু হকচকিয়ে গেলেন, একটু ইতস্তত করে বললেন, “রোবট বানানো আর রোবট সাজা কিন্তু এক ব্যাপার না।”

রোবট বানানোটা ধর বিজ্ঞানের কাজকর্ম হতে পারে, কিন্তু রোবট সাজাটা হবে নাটক-থিয়েটারের কাজকর্ম।”

মাসুককে এবারে একটু হতাশ দেখা গেল, বলল, “রোবট বানানো খুবই কঠিন। ইন্টারনেটে একটু দেখেছিলাম কিছুই বুঝি না।”

ম্যাডাম বললেন, “পৃথিবীর কোনো জিনিসই কঠিন নয়। একসাথে পুরোটা কঠিন মনে হতে পারে কিন্তু সেটাকে যদি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নাও দেখবে কোনোটাই কঠিন নয়। কাজেই পুরো রোবট একবারে তৈরি না করে রোবটের একটা অংশ তৈরি কর। হাতের মডেল কিংবা একটা আঙুল।”

মাসুককে এবারে কেমন যেন আতঙ্কিত দেখা গেল, “শুধু আঙুল?”

ক্লাশের ছেলেমেয়েরা মাসুকের হাহাকার শুনে হি হি করে হেসে ফেলল ম্যাডামও হাসলেন, বললেন, “ঠিক আছে তা হলে তোমরা রোবটই সেজে আস! আমরা বলব এটা হচ্ছে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার পদক্ষেপ।”

মাসুককে এবারে আবার উৎসাহী দেখা গেল, বলল, “ঠিক আছে ম্যাডাম আপনি দেখবেন একবারে ফাটাফাটি রোবট বানাব। আসল রোবটের বাবা।”

বিজ্ঞান ম্যাডাম এরপর টিম সহজ-সরল-এর সাথে কথা বললেন, তারপর টিম ব্ল্যাকহোল তারপর টিম মিরূসোরাস। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, টিম মিরূসোরাসের পক্ষ থেকে কে কথা বলবে?”

রূপা দাঁড়িয়ে বলল, “আমি বলতে পারি।”

“বল তোমাদের কাজের কতটুকু হয়েছে?”

রূপা মাথা চুলকে বলল, “আমরা ঠিক করেছি স্মোক বম্ব বানাব–কিন্তু এখনো কিছু জিনিস নিয়ে ঝামেলার মাঝে আছি।”

“কী ঝামেলা?”

“ইন্টারনেট থেকে কী কী কেমিক্যাল লাগবে বের করেছি কিন্তু কোথা থেকে পাওয়া যায়, কত দাম এগুলো বুঝতে পারছি না।”

“কী কেমিক্যাল লাগবে বল দেখি?”

”পটাশিয়াম নাইট্রেট, চিনি, ঐন্সিয়াম সল্ট, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড”

বিজ্ঞান ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, বললেন, “এর সবগুলো তোমাদের এখনই লাগবে না। কিছু কিছু লাগবে। ক্লাসের পর আমার সাথে দেখা কর আমি তোমাদের বলে দেব এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে।”

সঞ্জয় বলল, “ম্যাডাম এইটা কী আসলেই বম্ব? মানে বোমা?”

বিজ্ঞান ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “তার মানে তুমি জানতে চাইছ এটা বিশাল শব্দ করে বিস্ফোরণ হয় কি না?”

সঞ্জয়ের চোখ উৎসাহে চক চক করতে থাকে, “জি ম্যাডাম! এটা কি ফাটবে?”

“না, এটা সেরকম বোমা না। এটা স্মোক বম্ব, ধোঁয়ার বোমা। এটাতে আগুন ধরিয়ে দিলে গলগল করে ধোঁয়া বের হতে থাকে। তাই এটা তোমরা ঘরের ভিতরে করতে পারবে না। এটা করতে হবে ঘরের বাইরে। মাঠে।”

“ঘরে করলে কী হবে?”

“ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে।”

শুনে সঞ্জয়ের চোখ আবার আনন্দে চকচক করতে থাকে। বিজ্ঞান ম্যাডাম বললেন, “তোমাদের টিমের নাম মিরূসোরাস। কিন্তু ‘সো’ কে এখনও দেখিনি, সে কোথায়?”

রূপা, মিম্মি, রাজু আর সঞ্জয় তখন সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না। রাজু বলল, “ম্যাডাম, সোহেল অসুস্থ। তা ছাড়া তার আবার পারিবারিক কিছু সমস্যা হয়েছে সেটার জন্যে সে স্কুলে আসতে পারছে না।”

“তোমরা খোঁজ নিয়েছ?”

“জি ম্যাডাম। আমরা ওর বাসাতেও গিয়েছি। কয়েকবার।”

“কী ধরনের অসুস্থ।”

রাজু মাথা চুলকাল, কাজেই রূপাকে আবার উত্তর দিতে হল। যেহেতু মিথ্যে কথা বলা শুরু করেছে মনে হয় মিথ্যে কথা বলার দায়িত্বটা এখন থেকে পাকাঁপাকিভাবে তার ঘাড়েই এসে পড়বে। রূপা বলল, “কারণটা ঠিক করে ধরা যাচ্ছে না। খুব দুর্বল।”

বিজ্ঞান ম্যাডামের মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল, বললেন, “এরকম কম বয়সী ছেলে সে দুর্বল কেন হবে?”

“আরও কিছু সমস্যা আছে ম্যাডাম। আপনাকে ক্লাসের পরে বলব।”

ম্যাডাম কিছু একটা বুঝে গেলেন। বললেন, “ঠিক আছে ক্লাসের পর বল।” তারপর চলে গেলেন টিম আলোকবর্তিকার কাছে।

.

ডাইনিং টেবিলে বসে রূপা টের পেল আম্মুর মেজাজটা খুব খারাপ। কারণটাও কিছুক্ষণের মাঝে বোঝা গেল। হিন্দি সিরিয়ালের জাসিন্দর আর আনিলার মাঝে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছে তাদের সম্পর্ক প্রায় ভেঙে যাবার অবস্থা। আব্বুর ধারণা দোষটা আনিলার, আর আম্মুর ধারণা দোষটা জাসিন্দরের। সেটা নিয়ে আব্বু আম্মুরও একটা ঝগড়া হয়ে দুজনেই এখন মেজাজ খারাপ করে আছেন। সুলতানা টেবিলে খাবার এনে রাখছে। সবজিতে লবণ একটু কম হয়েছে সেই জন্যে আম্মু সুলতানাকে যাচ্ছেতাইভাবে গালাগাল করলেন। সুলতানার হয়েছে মুশকিল আম্মুর ব্লাড প্রেসার সেই জন্যে কম করে লবণ খাবার কথা, সুলতানাকে দিনে দশবার করে বলে দেওয়া হয় যেন কম লবণ দিয়ে রাধে। সে যখন সত্যি সত্যি কম লবণ দেয় তখন তাকে গালাগাল করা হয় লবণ কম দেবার জন্যে। প্রথম প্রথম সুলতানা ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করত তাতে লাভ না হয়ে বরং ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টাকে এক ধরনের বেয়াদবী হিসেবে ধরে সুলতানার উপর অত্যাচার আরও বেড়ে যেত। সুলতানা এখন আর কিছু বলে না, মুখ বুজে গালমন্দ সহ্য করে।

খানিকক্ষণ নিঃশব্দে খাবার পর মিঠুন বলল, “আমরা যদি লবণকে চিনি বলতাম আর চিনিকে লবণ বলতাম তা হলে কী হত?”

খুবই গাধা টাইপের প্রশ্ন কিন্তু প্রশ্নটা পরিবেশটাকে একটু সহজ করে দিল। তিয়াশা বলল, “তা হলে আমরা লবণ দিয়ে চা খেতাম।”

আম্মু বললেন, “সুলতানা সবজিতে চিনি বেশি দিত না হয় কম দিত!” রূপা বলল, “আমরা যখন ঘামতাম তখন শরীর থেকে চিনির সিরা বের

রূপার কথা শুনে সুলতানা থেকে শুরু করে আব্বু পর্যন্ত সবাই হি হি করে হেসে উঠল। তিয়াশা খেতে খেতে একটু বিষম খেয়ে বলল, “রূপাটা যে কী ফানি কথা বলে! ওফ!”

পরিবেশটা একটু সহজ হওয়ার পর রূপা কাজের কথায় এলো। বলল, “আমাদের স্কুলে সামনের শুক্রবার সায়েন্স ফেয়ার।”

আম্মু বললেন, “সেটা আবার কী?”

“সবাই তাদের সায়েন্স প্রজেক্ট দেখাবে।”

মিঠুন জিজ্ঞেস করল, “ছোট আপু তোমার সায়েন্স প্রজেক্ট কী?”

“স্মোক বম্ব।”

“বম্ব?” আম্মু ভুরু কুঁচকালেন, “তোরা বোমা বানাচ্ছিস?”

রূপা হাসার ভান করল, “সত্যিকারের বোমা না আম্মু। ধোঁয়ার বোমা।”

“তারপরেও তো বোমা। স্কুলে বোমা বানানো শেখায়?”

রূপা বলল, “বোমা না আম্মু। এখান থেকে গলগল করে ধোয়া বের হবে। এটা ভয়ের না, মজার।”

আম্মু অপছন্দের ভঙ্গি করে মাথা নাড়লেন। রূপা বলল, “সবাইকে কিছু না কিছু বানাতে হবে। সবার আব্বু-আম্মুকে দাওয়াত দেওয়া হবে।”

আম্মু বললেন, “অ–”

রূপা এবারে তার আসল কথায় এলো, কাচুমাচু করে বলল, “আমাদের এই প্রজেক্টটা বানানোর জন্যে কিছু কেমিক্যাল কিনতে হবে। সেই জন্যে কিছু টাকা লাগবে আম্মু।”

“টাকা!” আম্মু রীতিমতো চমকে উঠলেন, তার গলার স্বর শুনে মনে হল টাকা নয় রূপা যেন মানুষ খুন করার কথা বলেছে।

“হ্যাঁ আম্মু। আমার একটু টাকা লাগবে।”

কত টাকা লাগবে আম্মু সেটা জানতেও চাইলেন না। জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, “টাকা কী গাছে ধরে? এইসব পোলাপানের খেলাধুলার জন্যে টাকা নষ্ট করত হবে?”

রূপা প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, “আম্মু এটা পোলাপানের খেলাধুলা না–এটা সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট!”

“তুই যখন সায়েন্স পড়বি না তা হলে সায়েন্স নিয়ে এত নাটক-ফাটক করা শুরু করেছিস কেন?”

রূপা চোখ কপালে তুলে বলল, “কে বলেছে আমি সায়েন্স পড়ব না?”

আম্মু মুখে একটু খাবার তুলে বললেন, “এর মাঝে আবার বলাবলির কী আছে? কেউ এখন সায়েন্স পড়ে না।”

“কে বলেছে সায়েন্স পড়ে না? সব ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা সায়েন্স পড়ে। আমিও পড়ব।

“শুধু যারা গাধা তারা সায়েন্স পড়ে।”

“গাধা?”

“হ্যাঁ। দশজন প্রাইভেট টিউটর লাগে। ছয়টা কোচিং সেন্টার লাগে। তাই বড়লোকেরা সায়েন্স পড়ে। এইটা হচ্ছে বিলাসিতা।”

“কী বলছ আম্মু?”

“মাথার মাঝে ঐ সব বড়লোকী চিন্তা আনবি না। অন্য দশজন যা করে তুইও তাই করবি। কমার্স পড়বি।”

“না আম্মু, আমি সায়েন্স পড়ব।”

আম্মু চোখ পাকিয়ে বললেন, “ কী বললি? সায়েন্স পড়বি?”

“হ্যাঁ আম্মু।”

“তোর শখ দেখে আমি বাঁচি না!” আম্মু বিদ্রুপের হাসির মতো একটা শব্দ করলেন, তারপর মুখ শক্ত করে বললেন, “এই বাসায় কেউ সায়েন্স পড়তে পারবে না। দেখি তুই কেমন করে সায়েন্স পড়িস। এই বাসায় যদি থাকতে চাস তা হলে আমরা যেটা বলি তোকে সেটা করতে হবে। বুঝেছিস?”

কথা বলে কোনো লাভ নেই তাই রূপা কোনো কথা বলল না। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে একটু পরে বলল, “আর আমার সায়েন্স প্রজেক্টের জন্যে টাকাটা?”

“ভুলে যা। এতো সহজে টাকা গাছে ধরে না।”

রূপার চোখে পানি চলে এলো, সে মাথা নিচু করে ফেলল যেন কেউ দেখতে না পায়।

সবাই ঘুমিয়ে যাবার পরও রূপা জেগে রইল। কাল স্কুলে গিয়ে কী বলবে সেটা ভেবে পাচ্ছিল না। তার কোনো একটা কিছু আছে কী না যেটা সে বিক্রি করতে পারে সেটা চিন্তা করছিল তখন মশারির পাশে একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল, মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল, “রফ-রূফালী? ঘুম?” সুলতানার গলার স্বর!

“না এখনও ঘুমাইনি।”

“এই যে নাও।” বলে সুলতানা মশারির ভেতর দিয়ে তার হাতটা ঢুকিয়ে তাকে কিছু একটা দেওয়ার চেষ্টা করল।

রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী?”

“টাকা। আমার এখন দরকার নাই। তুমি রাখ। পরে দিয়ে দিও।”

রূপা বলতে গেল, না না, লাগবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না, টাকাগুলো নিয়ে বলল, “থ্যাংকু। আমি সামনের মাসে স্কলারশিপের টাকা পেলে দিয়ে দেব।”

সুলতানা ফিসফিস করে বলল, “কোনো তাড়াহুড়া নাই।”

.

১১.

সুলতানা হি হি করে হেসে বলল, “দেখো দেখো ছ্যামড়াটারে দেখো!”

রূপা তাকিয়ে দেখল, রাস্তার পাশে গাবদা-গোবদা একটা ছোট বাচ্চা বসে আছে। খালি পা, পেট মোটা, গলায় তাবিজ, মাথা ন্যাড়া এবং মুখে দর্শনিকের মতো একটা উদাসীন ভাব। এই বাচ্চাটাকে দেখে এভাবে হাসিতে গড়িয়ে পড়ার কিছু নেই কিন্তু সুলতানা হাসতে হাসতে খুন হয়ে গেল। হাসি মনে হয় সংক্রামক এবং একটু পর রূপাও হি হি করে হাসতে লাগল। সে ছোট বাচ্চাটিকে জানাতেও পারল না যে, তার শিশু মুখে নিপাট গাম্ভীর্য দেখে দুইজন হাসিতে ভেঙে পড়েছে।

সুলতানা সামনে এগিয়ে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে দেখতে দেখতে বলল, “কি মায়া লাগে, তাই না রূফ-রূফালী?”

রূপা মাথা নাড়ল, ছোট বাচ্চা দেখলেই সুলতানার মায়া লাগে, তার মনটা খুব নরম।

আরেকটু এগিয়ে একটা ছাগলকে দেখে সুলতানা আবার হাসিতে ভেঙে পড়ল। বলল, “দেখো দেখো-বেকুব ছাগলটারে দেখো। রাস্তার মাঝখানে খাড়ায়া কাঁঠাল পাতা খায়।”

রূপা আগে কখনো ছাগল দেখে হাসেনি, কিন্তু তাকে স্বীকার করতেই হল, একটা ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যদি একটা ছাগল গম্ভীরভাবে কাঁঠাল পাতা চিবুতে থাকে তা হলে তার মাঝে একটু কৌতুকের চিহ্ন থাকতে পারে। আরেকটু এগিয়ে সুলতানা যখন একটা মোটা মানুষকে দেখে একটু বিপজ্জনকভাবে হাসতে শুরু করল তখন রূপা বুঝতে পারল যে আসলে সুলতানার মনটার মাঝে ফুরফুরে আনন্দ তাই সে কারণে-অকারণে হাসছে।

সুলতানা চব্বিশ ঘণ্টা বাসার ভেতরে আটকে থাকে, তার শুক্র-শনিবার নেই, ছুটিছাটা নেই, রাতের কয়েক ঘণ্টা ঘুম ছাড়া বাকি সময়টা তাকে একটানা কাজ করতে হয়। একজন মানুষের পক্ষে এত কাজ করা সম্ভব সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তার জীবনে আনন্দের কিছু নেই। হঠাৎ হঠাৎ করে সে বাসার বাইরে যাবার সুযোগ পায় যখন আম্মু খুব বিশেষ একটা কারণে তাকে বাজার করতে পাঠান। আজকে সেরকম একটা দিন, বাসায় হঠাৎ করে কিছু জিনিস শেষ হয়ে গেছে তাই আম্মু সুলতানাকে বাজারে পাঠিয়েছেন। ঠিক যখন সুলতানা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হয়েছে তখন রূপার মনে হয়েছে তারও একটু দোকানে যাওয়া দরকার পোস্টার পেপার কেনার জন্যে। আম্মু সুলতানার সাথে যেতে আপত্তি করেননি তাই দুইজন একসাথে বাইরে।

সুলতানা যখন একজন বদরাগী মহিলাকে দেখে হাসতে শুরু করতে যাচ্ছিল, রূপা তাকে থামাল, বলল, “সুলতানা, তুমি যখন একা একা বাজারে যাও তখন এইভাবে সবকিছু দেখে হাস? হাসতে হাসতে যাও?”

সুলতানা বলল, “ধুর। মানুষ কী:একা একা হাসতে পারে? একা একা হাসলে মানুষ পাগল বলবে না?”

“আজকে সাথে আমি যাচ্ছি সেই জন্যে এত হাসছ?”

সুলতানা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। সেইটা সত্যি।”

“তোমার হাসতে ভালো লাগে?”

“হ্যাঁ। আমি যখন গেরামে থাকতাম দিন-রাত হাসতাম। আমার মায়ে বলত আমারে জিনে পাইছে!”

রূপা বলল, “সেইটা মনে হয় তোমার মা ঠিকই বলত। তোমারে মনে হয় আসলেই জিনে পেয়েছে।”

“বাসায় যখন থাকি তখন তো হাসতে পারি না, আজকে বাইরে এসে তাই একটু হাসি-তামাশা করছি।”

“ভালো।” রূপা বলল, “যারা বেশি হাসে তাদের অসুখ-বিসুখ হয় না, বেশিদিন বাঁচে।”

“সর্বনাশ! তা হলে আমার এক্ষুনি হাসা বন্ধ করা দরকার।”

“কেন? তুমি বেশিদিন বাঁচতে চাও না?”

“আমার মতো মানুষ বেশিদিন বেঁচে কী করবে? বেশিদিন বাঁচবে তোমাদের মতো মানুষ।” বলে সুলতানা একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।

তারা দুইজন কোনো কথা না বলে পাশাপাশি কিছুক্ষণ হেঁটে যায়। একসময় সুলতানা মুখ তুলে তাকাল, রাস্তার অন্যপাশে একটা বিল্ডিং, সেখানে অনেক মানুষের ভিড় বেশিরভাগই কমবয়সী মেয়ে। দেখে বোঝা যায়, মেয়েগুলো গরিব ফ্যামিলির। সুলতানা বলল, “এতগুলা শুকনা শুকনা মেয়ে এইখানে কীসের মিটিং করে?”

“জানি না।”

“কোনো কামকাজ নাই, সকালে এসে রাস্তার মাঝে হইচই!”

রূপা তাকিয়ে দেখল বিল্ডিংয়ের উপর বড় বড় করে লেখা জানে আলম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি-এই মেয়েগুলো নিশ্চয়ই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সে মাথা নাড়ল, বলল, “গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। এরা এখানে কাজ করে।”

সুলতানা ভুরু কুঁচকে বলল, “যদি কাজ করে তা হলে ভেতরে ঢুকে না। কেন?”

“ঢুকবে। দরজা খুললেই ঢুকবে।”

“উঁহু। এরা কাজ করে না। কাজ করলে পোলাপান নিয়ে আসত না।”

রূপা তাকিয়ে দেখল সুলতানার কথা সত্যি, অনেক মেয়ে, অনেক মহিলা অনেকের কোলে বাচ্চাকাচ্চা। মেয়ে আর মহিলারা লাইনে দাঁড়ানোর জন্যে ঠেলাঠেলি করছে। হঠাৎ করে রূপার একটা কথা মনে হল, হয়তো আজকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে লোক নেবে-সবাই চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। রূপা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে গেল, সুলতানা বলল, “কী হল?”

“চলো দেখে আসি।”

“কী দেখবা?”

“ওখানে কী হচ্ছে।” সুলতানা কিছু বলার আগে রূপা রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে গেল, ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী হচ্ছে?”

“গার্মেন্টসে লোক নিবে।”

“তার ইন্টারভিউ?”

মহিলাটা মাথা নাড়ল। রূপা জিজ্ঞেস করল, “ইন্টারভিউ দিতে হলে কী করতে হবে?”

মহিলাটা রূপার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলল, “এইখানে লাইনে দাঁড়াতে হবে।”

“আর কিছু লাগে?”

“না। গায়ে-গতরে জোর থাকা লাগে। পেটে ভুখ থাকা লাগে আর কিছু লাগে না।”

সুলতানা ততক্ষণে হেঁটে রূপার কাছে এসেছে। জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”

রূপা কিছুক্ষণ সুলতানার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “সুলতানা।”

“কী?”

”ইন্টারভিউ দেবে?”

সুলতানা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কী করব?”

“গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে লোক নিচ্ছে। তুমি ইন্টারভিউ দিতে চাও?”

“আমি?” সুলতানা ভাবল রূপা ঠাট্টা করছে তাই ঠাট্টার উত্তর দেবার মতো করে হি হি করে হাসল।

রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। সিরিয়াসলি বলছি।”

এবারে সুলতানা অবাক হয়ে রূপার দিকে তাকাল বলল, “তুমি সত্যি বলছ?”

“হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। বাসায় তোমাকে যত কষ্ট করতে হয় তার কোনো মানে নাই। গার্মেন্টসে কাজ করলে তুমি স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে।”

“স্বাধীনভাবে?”

“হ্যাঁ। বাসার কাজে কোনো সম্মান নাই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমাকে কাজ করতে হয়। আম্মু তোমাকে খালি বকে না, তোমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলে। তোমার এখানে থাকা ঠিক না।”

সুলতানা খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে রূপার দিকে তাকিয়ে রইল। রূপা বলল, “তুমি লাইনে দাঁড়িয়ে ইন্টারভিউ দাও।”

সুলতানা এতক্ষণে নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে, একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “বলা খুব সোজা।”

“কেন? বলা সোজা কেন?”

লাইনে কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে তুমি জান? তারপর বাসায় গেলে খালাম্মা আমারে আস্ত রাখবে?”

রূপা বলল, “তুমি বাজারের জিনিসটা আমারে দাও। আমি বাজার করে আনি। তুমি এইখানে দাঁড়াও, ইন্টারভিউ দাও।”

সুলতানা হি হি করে হাসল, বলল, “তুমি বাজার করবে?” তা হলেই হইছে।”

“কেন? আমি দুই-তিনটা জিনিস কিনতে পারব না?”

সুলতানা লম্বা লাইনটার দিকে তাকাল তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “নাহ্! এই লাইন অনেক লম্বা। রাত পোহায়ে যাবে।”

রূপা প্রথম যে মহিলার সাথে কথা বলেছিল সে কাছেই দাঁড়িয়ে তাদের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে হঠাৎ করে সুলতানাকে বলল, “তুমি চাইলে আমার সামনে দাঁড়াতে পার। তা হলে বেশিক্ষণ লাগবে না।”

সুলতানা বলল, “আপনার সামনে দাঁড়াব?”

“হ্যাঁ।”

রূপা বলল, “যারা পিছনে আছে তারা রাগ হবে না?”

“কিছু রাগ তো হবেই। এত রাগ-গোসা দেখলে হয়?”

“কিন্তু কাজটা কী ঠিক হবে? লাইন ভেঙে সামনে–”

“বেঁচে থাকতে হলে ঠিক-বেঠিক সব কাজ করতে হয়।” মহিলা সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলল, “খাড়াও।”

সুলতানা তখন সুরুত করে লাইনে ঢুকে গেল। পিছন থেকে একটা শশারগোল হল কিন্তু মহিলাটি কোমরে হাত দিয়ে পিছনে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, “কে আওয়াজ দেয়?”

পিছনের শোরগোলটা হঠাৎ করে থেমে গেল।

আধঘণ্টা পর সুলতানা একটা খোলা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল তারপর কয়েক মিনিটের ভেতরেই বের হয়ে এলো, হাতে একটা কাগজ আর মুখে হাসি।

রূপা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হল সুলতানা? কী হল?”

সুলতানা কাগজটা রূপার দিকে এগিয়ে দেয়, “এই যে! চাকরি হয়ে গেছে। আমি এখন জজ-ব্যারিস্টার অফিসার। আট ঘণ্টার শিফট, দুই হাজার টাকা বেতন।”

রূপা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “সত্যি?”

“সত্যি।”

রূপার তখনো বিশ্বাস হয় না, “খোদার কসম?”

“খোদার কসম।”

রূপা তখন সুলতানাকে জড়িয়ে ধরল। সুলতানার হি হি করে হাসার কথা কিন্তু সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।

.

আম্মু ঢোক গিলে বললেন, “কী বললি?”

সুলতানা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর কাজ করমু না।”

আম্মু কঠিন গলায় বললেন, “কাজ করবি না? তা হলে খাবি কী? থাকবি কোথায়?”

“আমি গার্মেন্টসে কাজ করমু।”

মনে হল আম্মু কথাটা বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “কীসে কাজ করবি? গার্মেন্টসে?”

“জে?”

আম্মু খলখল করে হাসলেন, বললেন, “তোর ধারণা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিকেরা তোরে চাকরি দেওয়ার জন্যে বসে আছে? চাকরি করা এত সোজা? তুই যাবি আর তোরে হাজার টাকা বেতনে চাকরি দিয়ে দেবে?”

সুলতানা বলল, “আমি চাকরি পেয়ে গেছি।”

মনে হল আম্মু একটা ইলেকট্রিক শক খেলেন।

কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “চাকরি পেয়ে গেছিস?”

“জে।”

“কো-কোথায়?”

“জানে আলম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। আট ঘণ্টার শিফট। দুই হাজার টাকা বেতন।”

আম্মু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সুলতানার দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বললেন, “দু-দুই হাজার টাকা?”

“জে।”

“কেমন করে পেলি?”

সুলতানা এবারে কোনো কথা বলল না। আম্মু তখন রেগে গেলেন, “কেমন করে পেলি? বাড়ি এসে তোকে চাকরি দিয়ে গেছে?”

সুলতানা মাথা নাড়ল।

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “তা হলে?”

“যেদিন বাজারে গিয়েছিলাম সেদিন ইন্টারভিউ দিছি।”

“রূপা তোর সাথে ছিল না?”

সুলতানা রূপাকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, বলল, “রূফা জানে না। পোস্টার কাগজ কিনতে গেছিল আমি তখন দিছি।”

আম্মু চোখ লাল করে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। আম্মু হঠাৎ তার গলায় একেবারে মধু ঢেলে বললেন, “পাগলি মেয়ে! তোর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ভদ্রঘরের মেয়েরা কখনো গার্মেন্টসে কাজ করতে যায়?”

আম্মুর গলার স্বর শুনে সুলতানা একেবারে ভড়কে গেল, অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। আম্মু গলায় আরও মধু ঢেলে বললেন, “তুই গার্মেন্টসে কাজ করতে যাবি, কোথায় থাকবি, কী খাবি, কখন কোন বিপদে পড়বি, আমি কী শান্তিতে থাকতে পারব? আমার একটা দায়িত্ব আছে না?”

সুলতানা এবারেও কিছু বলল না। আম্মু মুখে আঠা-আঠা এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে বললেন, “মাথা থেকে এই সব পাগলামি চিন্তা ঝেড়ে ফেল মা! এইখানে থাকতে তোর কষ্ট কীসের? নিজের বাড়ি মনে করে থাকবি। আমরা কী তোর নিজের ফ্যামিলির মতো না? আমাদের ছেড়ে তুই চলে যেতে পারবি?”

সুলতানা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আম্মু তাকে বলতে দিলেন না। হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে আহ্লাদী স্বরে নেকি নেকি গলায় বললেন, “আমি তোর কোনো কথা শুনব না। তুই আমার ফ্যামিলির, তোকে আমি যেতে দিব না। তুই এখানে থাকবি।”

সুলতানা আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আম্মু আবার হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, “যা এখন। একটু চা বানিয়ে আন, আমার জন্যে এক কাপ। তোর নিজের জন্যে এক কাপ!”

রাতেরবেলা আরো ভয়ংকর ব্যাপার ঘটল, আম্মু-আব্বু, তিয়াশা আর মিঠুন মিলে যখন হিন্দি সিরিয়াল দেখছে তখন আম্মু মধুর গলায় ডাকলেন, “সু-ল-তা-না!”

সুলতানা ছুটে এলো, “জি খালাম্মা।”

“তুই কী করছিস?”

“তরকারি গরম করছি।”

“পরে করবি। এখন এখানে বস।”

সুলতানা ঢোক গিলে বলল, “বসব?”

“হ্যাঁ, আমাদের সাথে এই সিরিয়ালটা দেখ। অসাধারণ। নায়কের নাম জাসিন্দর, একটিং দেখলে তোর চোখে পানি এসে যাবে।”

সুলতানা শুকনো গলায় বলল, “আমার দেখতে হবে না খালাম্মা। হিন্দি কথা আমি বুঝি না।”

“বুঝবি না কেন? একেবারে বাংলার মতোন। একটু শুনলেই সব বুঝতে পারবি।”

“ভাত-তরকারি গরম করতে হবে। সালাদ কাটতে হবে–”

“পরে করবি। এখন এইখানে বস। বসে দেখ কী অসাধারণ একটিং।”

আম্মু জোর করে সুলতানাকে বসালেন, সুলতানা কাঠ হয়ে বসে রইল।

.

ভোরবেলা রূপা, তিয়াশা আর মিঠুন স্কুলে চলে যাবার পর সুলতানা আবার আম্মুর কাছে এলো। বলল, “খালাম্মা, আমারে বিদায় দেন, আমি যাই। আজকে গার্মেন্টসে আমার কাজ শুরু করার কথা।”

আম্মুর চোখ ধক করে জ্বলে উঠল। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বললেন, “তোকে না বলেছি না যেতে।”

“আমারে যেতে হবে খালাম্মা। আমি আর বাসায় কাম করতে চাই না।”

“বাসায় কাজ করতে চাস না?”

“না খালাম্মা।”

“আমার কী হবে? বাসা কেমন করে চলবে?”

“আপনি কাউকে পেয়ে যাবেন খালাম্মা।”

আম্মু হিংস্র মুখে তাকালেন, “তুই আমার সাথে নিমকহারামি করবি?”

“এইটা নিমকহারামি না খালাম্মা। আমি একটা ভালো সুযোগ পাইছি, সেই সুযোগটা নিতে চাই। আপনি আমার জন্যে দোয়া করে দেন।”

“তোর জন্যে দোয়া করব? হারামজাদি।” আম্মু হিসহিস করে বললেন, “তোর গলা দিয়ে যেন রক্ত বের হয়। কুষ্ঠ রোগে তোর যেন নাক খসে পড়ে। তোর চৌদ্দ গুষ্টি যেন রাস্তায় ভিক্ষা করে। বের হয়ে যা বাসা থেকে বের হয়ে যা–”

“আমার জিনিসপত্র। গত তিন মাসের বেতন?”

“কী! গত তিন মাসের বেতন?” আম্মু এবারে ভয়ংকর আক্রোশে সুলতানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এর আগে আম্মু যতবার সুলতানার গায়ে হাত তুলেছেন সুলতানা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে মার খেয়েছে, আজ প্রথমবার ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিল। বলল, “অনেক মাইর খাইছি খালাম্মা। আর খামু না।”

আম্মু চিৎকার করে বললেন, “বের হয়ে যা হারামজাদি। বের হয়ে যা এক্ষুনি।”

রূপা দরজা খুলে বের হতে হতে বলল, “কয়েকদিনের জন্যে রান্না করে গেছি খালাম্মা। ফ্রিজে আছে। খালি ভাতটা বেঁধে নিবেন।”

“চুপ কর হারামজাদি”

“কাপড়গুলো ধুয়ে নেড়ে দিছি, বিকালে তুলে নিতে হবে–”

“বের হয়ে যা তুই-দূর হয়ে যা।”

সুলতানা বের হলে গেল।

.

১২.

এলুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মোড়ানো কালচে জিনিসটা উপরে তুলে রূপা বলল, “এই হচ্ছে আমাদের তৈরি প্রথম স্মোক বম্ব।”

মিম্মি সন্দেহের চোখে স্মোক বম্বটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটাকে মোটেও বোমার মতো মনে হচ্ছে না, দেখে মনে হচ্ছে খাবার জিনিস। পিৎজার সুইস।”

রাজু বলল, “উঁহু, এইটা খাবার জিনিস না। এইটা স্মোক বম্ব।”

সঞ্জয় উত্তেজিত গলায় বলল, “আয় টেস্ট করি। আগুন ধরিয়ে দেই।”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় টেস্ট করব?”

“কেন? এই বারান্দায়।”

তারা টিফিন ছুটিতে তাদের প্রথম স্মোক বম্ব তৈরি করেছে। সায়েন্স ফেয়ার নিয়ে সবার ভেতরে উত্তেজনা, অনেক ছেলেমেয়েই অনেক কিছু তৈরি করেছে, সেগুলো নানাভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। কাজেই এর মাঝে টিম মিরূসোরাস যদি তাদের স্মোক বম্বটা পরীক্ষা করে দেখে তা হলে কেউ কিছু বলবে বলে মনে হয় না। তারপরও রূপা সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বলল, “আমরা আমাদের স্মোক বম্ব টেস্ট করছি। কেউ কাছে আসবে না।”

আশেপাশে যারা ছিল তারা দূর থেকে এবারে কাছে চলে এলো ভালো করে দেখার জন্যে। রূপা তাদের ঠেলে সরানোর একটু চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে সঞ্জয়কে বলল, “সঞ্জয় আগুন দে।”

সঞ্জয় পকেট থেকে ম্যাচ বের করে তাদের স্মোক বম্বে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করল, আগুনটা জ্বলে উঠেই নিভে গেল। রাজু চিন্তিত মুখে বলল, কী হল? আগুন ধরছে না?”

সঞ্জয় বলল, “জানি না। আবার দেখি।” সে আবার ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে স্মোক বম্বের এক কোনায় ধরে রাখে এবারে হঠাৎ করে আগুন ধরে যায় তারপর চিড়চিড় শব্দ করে সেটা পুড়তে থাকে আর স্মোক বম্ব থেকে গলগল করে ধোয়া বের হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলে। যারা স্মোক বম্ব ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা আনন্দে চিৎকার করে আরো কাছে এগিয়ে আসে।

স্মোক বম্বের ধোয়া একতলার বারান্দা থেকে দোতলায় উঠে যায়, দোতলা থেকে তিনতলায়, সেখান থেকে পাশের বিল্ডিংয়ে। শুধু ধোঁয়া নয় ধোয়ার সাথে এক ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধে চারদিক ভরে গেল।

“আগুন আগুন” বলে চিৎকার করতে করতে দোতলা থেকে কয়েকজন মেয়ে চিৎকার করে ছুটে আসতে থাকে। অফিস ঘর থেকে স্যার-ম্যাডামরা উদ্বিগ্ন মুখে বের হয়ে আসেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে”ফায়ার ব্রিগেড ফায়ার ব্রিগেড” বলে চিৎকার করতে থাকেন।

স্কুলের দপ্তরি এক বালতি পানি নিয়ে ছুটে আসতে থাকে। সে আসতে আসতে স্মোক বম্ব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে, মেঝের মাঝে কালচে একটু অঙ্গার ছাড়া আর কিছুই নেই। বালতি হাতে সে অবাক হয়ে এদিক-সেদিক তাকায়, “কোথায় আগুন? কোথায়?”

রূপা বুঝতে পারল তারা অত্যন্ত সফল একটা স্মোক বম্ব তৈরি করেছে কিন্তু সেই জন্যে একটা মহা গাড্ডার মাঝে পড়েছে। স্যার-ম্যাডামের বকাবকি কিংবা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের শাস্তি থেকে উদ্ধার পাবার কোনো উপায় ছিল না কিন্তু বিজ্ঞান ম্যাডাম তাদের রক্ষা করলেন। সবাইকে বোঝালেন এটি কোনো সত্যিকারের আগুন নয়, অত্যন্ত নিরীহ একটা স্মোক বম্ব। কিছু ধোঁয়া তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই করে না। নিচে জড়ো হওয়া স্যার, ম্যাডাম আর প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললেন, “এদের কোনো দোষ নেই। দোষটা আমার, ওদের বলতে ভুলে গেছি বারান্দায় টেস্ট না করে মাঠের মাঝখানে বা ভোলা জায়গায় টেস্ট করতে হবে।”

সত্যিকারের কোনো আগুন নয় একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা শুনে স্যার ম্যাডামরা তাদের অফিসে ঢুকে গেলেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম গজগজ করে বললেন, “কী করছ না করছ সেটা একটু ভেবে দেখবে না?”

রূপা মাথা চুলকে বলল, “আমরা বুঝতে পারিনি। আর হবে না ম্যাডাম।”

“হ্যাঁ। আর যেন ভুল না হয়।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চলে যাবার পর সঞ্জয় খুশিতে হাতে কিল দিয়ে বলল, “একেবারে, ফাটাফাটি আবিষ্কার! সায়েন্স ফেয়ারের সময় একসাথে দশটা জ্বালিয়ে দিয়ে সারা স্কুল ধোয়া দিয়ে অন্ধকার করে দেব।”

মিম্মি বলল, “আমরা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যাব। তাই না?”

রূপা বলল, “শুধু ধোয়া হলে সেটা তো এমন কিছু না। সিগারেট ধরালেও তো ধোঁয়া বের হয়। আমাদের এখন এই ধোঁয়াকে রং করতে হবে। লাল, নীল, বেগুনি ধোয়া যদি বানানো যায় তা হলে মজা হবে।”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। শুধু আরো কিছু কেমিক্যাল দরকার। জোগাড় করতে পারলে হয়।”

সবাই মাথা নাড়ল। কেমিক্যালস বেশ দামি। সব পাওয়াও যায় না। রূপা বলল, “আরেকটা কাজ করলে কেমন হয়?”

“কী কাজ?”

“আমরা যদি আরো একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড়া করি!”

“কী এক্সপেরিমেন্ট?”

“ফিল্মের খালি কৌটার ভেতর একটুখানি খাবার সোডার মাঝে ভিনেগার ঢেলে কৌটাটা বন্ধ করে দেব, ভেতরে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা হয়ে একটু পরে ফটাশ করে ফেটে যাবে!”

মিম্মি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”

রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “সত্যি। বানানো খুব সোজা-খাবার সোডা আর ভিনেগার, বাসাতেই আছে। শুধু ফিল্মের প্লাস্টিকের কৌটা লাগবে।”

রাজু বলল, “আমাদের বাসার কাছে একটা ফটো স্টুডিও আছে, আমি সেখান থেকে কাল ফিল্মের কৌটা নিয়ে আসব।”

সঞ্জয় হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফাটাফাটি সায়েন্স ফেয়ার হবে তাই না? আমরা মনে হয় ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যাব, তাই না?”

রূপা বলল, “ধুর গাধা। শুধু ধুমধাম শব্দ করলে কেউ ফার্স্ট প্রাইজ পায় না, ফার্স্ট প্রাইজ পেতে হলে সায়েন্সটা বুঝতে হয়। তুই কিছু বুঝিস? আরেকজনকে বোঝাতে পারবি?”

সঞ্জয় চিন্তিত মুখে বলল, “বোঝাতে হবে?”

“হ্যাঁ বোঝাতে হবে।” বোঝাতে না পারলে আবার সায়েন্স ফেয়ার কীসের?”

.

বিকেলবেলা বাসায় এসে রূপা খবর পেল সুলতানা চলে গেছে। তার একই সাথে খুবই মন খারাপ আর অনেক আনন্দ হল। খুবই মন খারাপ হল কারণ বাসায় সুলতানা ছিল তার এক নম্বর বন্ধু, এখন থেকে তার কোনো বন্ধু থাকল না। আনন্দ হল যে সুলতানা এই দোজখ থেকে মুক্তি পেয়েছে–যেখানেই থাকুক যত কষ্টে থাকুক তাকে আর এই দোজখে থাকতে হবে না।

বাসার অন্য সবাইকে দেখে অবশ্যি মনে হল সুলতানা চলে গিয়ে খুব বড় একটা অপরাধ করেছে। এই অপরাধের জন্যে থানায় পুলিশের কাছে জিডি করে রাখা দরকার। আম্মুর মুখ থমথম করছে। সুলতানা চলে যাবার কারণে বাসাটা যে অচল হয়ে গেছে সেটা তিনি টের পেলেন খাবার টেবিলে। সুলতানা আগামী কয়েকদিনের জন্যে রান্না করে গিয়েছে। শুধু ভাতটা রান্না করে নিতে হবে। দেখা গেল আম্মু সেই ভাতটাও ঠিক করে রান্না করতে পারলেন না।

ডিসে করে যে ভাত দেওয়া হল তার মাঝে একই সাথে গলে যাওয়া ভাত এবং অসিদ্ধ কটকটে চাউল পাওয়া গেল। আব্বুর মতো মানুষ যে আম্মুকে রীতিমতো ভয় পান, তিনি পর্যন্ত মুখে ভাত দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে ফেললেন, “এইটা কী বেঁধেছ? ভাত না চাউল ভাজা?”

আম্মু হিংস্র মুখে বললেন, “পছন্দ না হলে তুমি নিজে বেঁধে নাও।”

আব্বু বললেন, “দরকার হলে রাঁধব। কিন্তু একবেলা সিম্পল ভাত পর্যন্ত রাঁধতে পার না–এটা কী রকম কথা?”

তারপর আম্মু আর আব্বু খুব খারাপভাবে ঝগড়া করলেন। খাওয়া শেষ হবার পর এতদিন সবাই উঠে যেত, সুলতানা টেবিল পরিষ্কার করত, থালা-বাসন ধুত, খাবার তুলে রাখত। আজকে সেগুলো করার কেউ নেই–আম্মু করার চেষ্টা করলেন, রূপা আর তিয়াশা সাহায্য করার চেষ্টা করল, দেখা গেল সবকিছু শেষ করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। সুলতানা একা একা এত কাজ কেমন করে করত কে জানে?

খাবার পরে আব্বু-আম্মু টেলিভিশন দেখতে দেখতে চা খেতেন–আজ আর খাওয়া হল না। চায়ের কৌটাই কেউ খুঁজে পেল না। রাতে ঘুমানোর সময় হঠাৎ করে সবাই আবিষ্কার করল মশারিগুলো কেমন করে লাগানো হয় সেটা কেউ জানে না। রূপা অনেক কষ্ট করে মশারিটা টানানোর পর আবিষ্কার করল সেটা প্রায় তার নাকের উপর ঝুলে আছে।

ঘুমানোর আগে আম্মু ব্লাড প্রেসারের ওষুধ খান, তার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা তাই ওষুধ খাবার আগে আধা গ্লাস দুধ খান। প্রতিরাতে সুলতানা গাসে করে আধা গ্লাস দুধ টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখত-আজকে আম্মুর নিজের দুধ গরম করে আনতে হল। একটুখানি অসতর্ক হয়েছিলেন বলে দুধ উপচে পড়ে রান্নাঘর মাখামাখি হয়ে গেল, সারা বাসায় একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। দুধের ডেকচি নামাতে গিয়ে আম্মুর হাতে ছ্যাকা লেগে গেল এবং আম্মু সেটা নিয়ে সারাক্ষণ আহা-উঁহু করতে লাগলেন।

ঘুমাতে গিয়ে কেউ তাদের ঘুমানোর কাপড় খুঁজে পেল না। সুলতানা প্রতিদিন সেগুলো ভাঁজ করে বিছানার উপর রাখত আজকে কিছু নেই। অনেক খুঁজে পেতে কিছু একটা বের করে সেটা পরে তাদের ঘুমাতে যেতে হল। আম্মু প্রতি নিশ্বাসে সুলতানাকে গালি দিতে লাগলেন-ব্যাপারটা এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল যে শেষ পর্যন্ত আব্বু বিরক্ত হয়ে বলে ফেললেন, “অনেক হয়েছে। এখন থামো।”

তখন আবার আল্লু আর আম্মুর মাঝে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রূপা ভেবে পেল না আগামীকাল দিনটা কেমন করে শুরু হবে। সুলতানা একা এই বাসার সবকিছু করেছে এখন কে করবে? কীভাবে করবে? আম্মু যদি কোনোভাবে জানতে পারেন যে রূপাই সুলতানাকে চলে যাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে তা হলে মনে হয় তাকে খুনই করে ফেলবেন। শুয়ে শুয়ে রূপা মুখ টিপে হাসল, মনে মনে বলল, সুলতানা! তুমি যেখানে থাকো ভালো থাকো।

.

সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর রূপা শুনতে পেল আম্মু রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ করছেন। রূপা রান্নাঘরে গিয়ে দেখল আম্মু নাস্তা বানানোর চেষ্টা করছেন, তার চেহারা কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো। মনে হয় একদিনে বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে, চোখের নিচে কালি, চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। রান্নাঘর লণ্ডভণ্ড। এদিক-সেদিক থালা-বাসন পড়ে আছে। রূপা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু তোমার কোনো সাহায্য লাগবে। আমি কিছু করব?”

আম্মু চিৎকার করে বললেন, “সাহায্য করবি? আয়। বটি দিয়ে কোপ মেরে আমার মাথাটা আলাদা করে দে।”

রূপা উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না।

খাবার টেবিলে সবাই নিঃশব্দে নাস্তা খাওয়ার চেষ্টা করল। কয়েকটা পোড়া টোস্ট এবং কয়েকটা পরোটা। পরোটাগুলো আসলেই পরোটা না কী তেলে ভেজা রুটি বোঝা যাচ্ছে না। সেগুলো গোল নয়, দেখে মনে হয় কোনোটা অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ, কোনোটা আফগানিস্তানের ম্যাপ! কয়েকটা ডিম ভাজা হয়েছে, তার মাঝে ডিমের খোসা রয়ে গেছে। ডিমের এক অংশে লবণের তেতো অন্য অংশে লবণের চিহ্ন নেই। মুখে দিলে উগলে দিতে ইচ্ছে করে। আব্বু গম্ভীর মুখে পরোটাটা টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “বাসার কাজের জন্যে একজন বুয়া না পেলে মুশকিল।”

আম্মু দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “কেন? আমাকে বুয়া হিসেবে পেয়ে তোমাদের মন ভরছে না?”

আল্লু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “না আমি সেটা বলিনি। তুমি কেন বুয়া হতে যাবে?”

“বুয়া তো হয়েই গেছি। বুয়া হইনি? এই বাসায় চব্বিশ ঘণ্টা কে বুয়ার কাজ করে? কে? আর তোমরা লাটসাহেবরা কী করো? নবাবের বাচ্চার মতো কে বসে থাকে?”

আম্মু কিছুক্ষণ চিৎকার করলেন, তারপর আব্বুও চিৎকার শুরু করলেন। তারপর আবার দুইজন ঝগড়া শুরু করে দিলেন।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল