দরজা খুলে রূপাকে দেখে রাজুর মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটে উঠল। প্রায় চিৎকার করে বলল, “রূপা! তুমি চলে এসেছ!”

রূপা বলল, “তুমি এত অবাক হচ্ছ কেন? আমাদের সবারই তো আজকে আসার কথা!”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি। আমি অবাক হইনি। আমি খুশি হয়েছি। আসো, আসো।–”

রাজু দরজা বন্ধ করতে করতে চিৎকার করে বলল, “আম্মু, দেখে যাও আমাদের রূপা চলে এসেছে।”

রূপা তার বাসার সাথে পার্থক্যটা ধরতে পারল, সে কোনোদিন তার আম্মুর সাথে এই ভাষায় কথা বলতে পারবে না।

রাজুর আম্মু উঁকি দিলেন, চশমা চোখে হাসিখুশি একজন মহিলা, চুলের মাঝখানে খানিকটা অংশ সাদা! তার আম্মুরও চুলে পাক ধরেছে, আম্মু অনেকখানি খাটাখাটুনি করে রং দিয়ে সেটা কালো রাখার চেষ্টা করেন। রাজুর আম্মুর পাকা চুল নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই বলে মনে হল।

রাজুর আম্মু হাসিমুখে বললেন, “এসো মা এসো! রাজুর মুখে তোমাদের কথা শুনি, তোমাদের এখনো সামনা-সামনি দেখা হয়নি।”

রূপা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল, ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। রাজু তাদের সম্পর্কে কী বলে কে জানে।

রাজু বলল, “বুঝলে আম্মু আমাদের রূপা হচ্ছে স্যার-ম্যাডামদের ত্রাস।”

“ত্রাস?” রাজুর আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “এই সুইট মেয়েটা ত্রাস হতে যাবে কোন দুঃখে?”

“আমাদের স্যার-ম্যাডামরা যদি ভুল-ভাল পড়ায় রূপা তখন কাঁক করে ধরে ফেলে! কাউকে ছাড়ে না।”

রাজুর আম্মু বললেন, “ওমা! স্যার-ম্যাডামরা ভুল পড়াবে কেন?

“পড়ায় আম্মু পড়ায়। তুমি জানো না।”

রাজুর আম্মু মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “বুঝি না বাপু তোদের কথা। স্যার ম্যাডামেরা ভুল পড়ায় জন্মেও শুনিনি।” রাজুর আম্মু সুর পাল্টে বললেন, “পড়ালে পড়াক। তারা তাদের মতো পড়াবে, তোরা তোদের মতো শিখবি। তা হলেই তো ঝামেলা মিটে যায়। তাই না রূপা?”

রূপা মাথা নাড়ল। বলল, “জি। আমরা তাই করি। তা ছাড়া–”

“তা ছাড়া কী?”

“আমাদের স্যার-ম্যাডামেরা এত বোরিং, একটুও ক্লাশ করতে ইচ্ছে করে না। তাই যখন ভুল-ভাল পড়ান তখন ক্লাশটা ইন্টারেস্টিং হয়।”

রূপার কথা শুনে রাজুর আম্মু হি হি করে হাসতে লাগলেন যেন সে খুব একটা মজার কথা বলেছে। রূপা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, সে তার নিজের আম্মুকে এরকম একটা কথা বলার কথা চিন্তাও করতে পারে না। আর যদি সে বলেও ফেলে তার আম্মু শুনে কোনোদিন এভাবে হি হি করে হেসে উঠবেন না। উল্টো তাকে বকে বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবেন।

রাজু বলল, “আম্মু আমরা আমার রুমে বসছি। তুমি একটা কিছু খেতে দেবে আমাদের?”

রূপা তাড়াতাড়ি বলল, “আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি, আমার কিছু লাগবে না।”

“বাসা থেকে তো খেয়েই আসবে, তাই বলে এখানে কিছু খাবে না?” রাজুর আম্মু বললেন, “তোমাদের বাড়ন্ত শরীর, এখন অনেক খেতে হবে।”

রাজুর পিছু পিছু রূপা তার ঘরে গেল, বাসাটা একটু এলোমেলো, বড়লোকদের এক ধরনের সাজানো-গোছানো বাসা থাকে যেখানে মনে হয় কিছু ধরা যাবে না, ধরলেই কিছু একটা পড়ে ভেঙে যাবে, এখানে সেরকম কিছু নেই। বাসাটার মাঝে কেমন যেন শান্তি শান্তি ভাব। প্রত্যেকটা ঘরে বড় বড় বইয়ের তাক, সেই তাক ভর্তি শুধু বই আর বই। দেখে মনে হয় এটা বুঝি কারো বাসা না, এটা বুঝি একটা লাইব্রেরি।

রূপা বলল, “বাবারে বাবা! তোমাদের বাসায় কত বই!”

রাজু বলল, “বেশি না কি?”

“হ্যাঁ। অনেক বেশি, কারো বাসায় এত বই থাকে না।”

“বেশিরভাগই অখাদ্য! পড়া যায় না, কঠিন কঠিন প্রবন্ধ। আব্বু-আম্মু পড়ে যে কী মজা পায় কে জানে!”

রাজুর ঘরের মেঝেতে বসে তার ছোট ভাই-বোন খেলছিল, তাদের দেখে মুখ তুলে তাকাল, একজনের ফোকলা দাঁত, সে ফোকলা দাঁত বের করে হাসল। তার ভাই-বোনের সাথে রাজুর চেহারার মিল নেই, রাজুর এত ছোট ভাই-বোন আছে সে জানত না। তার একজন আঁতেল ধরনের বড় বোন আছে সেটাই শুধু শুনেছে।

ফোকলা দাঁতের ভাইটি একটা কাগজের প্লেন তৈরি করছিল, রাজুকে দেখিয়ে বলল, “ভাই দেখো, প্লেন।”

“ভেরি গুড।”

“এটা কী উড়বে ভাই?”

“উড়িয়ে দেখো।”

রূপা লক্ষ করল সে যে শুধু ক্লাশে তাদের সাথে তুমি তুমি করে কথা বলে তা নয়, ছোট ভাই-বোনদের সাথেও তাই করে।

ছোট ভাই প্লেনটা ছুঁড়ে দিল, নাক নিচের দিকে দিয়ে সেটা ডাইভ দিয়ে পড়ে গেল। ছোট বোনটি আনন্দে হাততালি দিল, “উড়ে না! উড়ে না!”

রাজু টেবিল থেকে দুইটা কাগজ হাতে দিয়ে বলল, “আবার বানাও-বানিয়ে বারান্দায় উড়াও। যাও।”

ভাই-বোন দুজন বাধ্য ছেলেমেয়ের মতো কাগজ হাতে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে যাচ্ছিল, রাজু থামাল, বলল, “কী হল? আমাদের বাসায় একজন গেস্ট আছে তাকে কিছু বললে না?”

সাথে সাথে দুইজন কপালে হাত দিয়ে বলল, “স্লামালিকুম আপু।”

“ওয়ালাইকুম সালাম। তোমাদের কী নাম?”

ফোকলা দাঁত বলল, “আমার নাম ইদরিস আর ওর নাম জাহানারা।”

“ভেরি গুড।” রূপা মাথা নাড়ল, সে ভেবেছিল রাজুর ছোট ভাই-বোনের নাম আরো আধুনিক হবে। রূপম আর মৌমিতা কিংবা অনিক আর মৌটুশী।

বাচ্চা দুইজন চলে যাবার পর রাজু এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “ভালো হয়েছে তুমি আগে এসে গেছ। মিম্মি আর সঞ্জয় আসার পর সোহেলের ব্যাপার নিয়ে কথা বলা যাবে না।”

“কী খবর সোহেলের?”

“ভালো না।”

“কেন, কী হয়েছে?”

“দেখে কেমন যেন ভয় লাগে। আমাদের ক্লাশের ছেলে কিন্তু মনে হয় চিনি না। বাসা থেকে সকালবেলা স্কুলে যাবার কথা বলে বের হয়ে যায় বই-খাতা হাতে নিয়ে। স্কুলে আসে না, কোথায় কোথায় জানি ঘুরে বেড়ায়।”

“এখন কী করব?”

“সেইটাই তো চিন্তা করে পাচ্ছি না। বড় কোনো মানুষের সাথে কথা বলব কী না বুঝতে পারছি না।”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “বড় কোন মানুষ?”

“বড় আপু।”

“তোমার বড় আপু কত বড়?”

“মেডিকেলে পড়ে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বড় আপু মহা আঁতেল। তাকে বললেই সে একটা আঁতেল আইডিয়া নিয়ে আসবে।”

“তা হলে আর কে আছে বড়?”

“আবু-আম্মু।”

রূপা অবাক হয়ে তাকাল, “তুমি বলতে পারবে?”

“কেন পারব না? আব্বু-আম্মু ঠিক ঠিক বলতে পারবে, কিন্তু—”

”কিন্তু কী?”

”আবু-আম্মু, আপু এদেরকে বলতে চাই না।”

রূপা মাথা নাড়ল, সে বুঝতে পারছে কেন রাজু বাসায় কাউকে বলতে চায়। সোহেল তাদের ক্লাশের ছেলে তার সম্পর্কে এরকম একটা কথা বলা অনেকটা নিজেদের সম্পর্কে বলার মতো। রূপা একটু চিন্তা করে বলল, “বিজ্ঞান ম্যাডামকে বললে কেমন হয়?”

রাজু মাথা নাড়ল, “আমিও চিন্তা করছিলাম। কিন্তু ম্যাডাম তো মাত্র এসেছেন এখনই বলতে কেমন লাগে।”

“তা ঠিক।”

 রাজু বলল, “আমি কী ভাবছিলাম জান?”

“কী?”

“আমরা নিজেরা ব্যাপারটা একটু ভালো করে দেখি। লুকিয়ে সোহেলের পিছু পিছু ঘুরে ঘুরে দেখি সে কোথায় যায়, কার সাথে মেশে। কী করে। তারপর না হয় বড়দের সাথে কথা বলব।”

“এখন ব্যাপারটা শুধু তুমি আর আমি জানি। আমরা কী এইটা আর কাউকে বলব না? মিম্মিকে? সঞ্জয়কে?”

রাজু হি হি করে হাসল, “মিম্মিকে বলা আর পত্রিকায় হেডলাইন দিয়ে ছাপিয়ে ফেলা তো একই ব্যাপার!”

“কিন্তু আমরা পাঁচজন এক গ্রুপে, আমাদের আগে হোক পরে হোক বলতে তো হবেই। যদি এরা পরে জানে আমরা জেনেও তাদেরকে বলিনি তা হলে খুব রাগ হবে।”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক।”

রূপা বলল, তুমি অবশ্যি ঠিকই বলেছ, আমাদের ব্যাপারটা আরো ভালো করে বোঝা দরকার। সোহেল কী ড্রাগ খায়, সেই ড্রাগ খেলে কী হয় এইসব।”

রাজু মাথা নাড়ল, দুইজনে বসে আরো কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করল কিন্তু কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেল না। তারা অবশ্যি খুব বেশিক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করতে পারল না, প্রথমে সঞ্জয় তারপর মিম্মি এসে হাজির হল। সঞ্জয় বাসা বোঝাই বইগুলো দেখে বলল, “এতগুলো বই! কোনটা কোথায় আছে কেউ জানে?”

রাজু হাসল, “জানবে না কেন? গল্পের বই এক জায়গায়, কবিতার বই এক জায়গায়, মুক্তিযুদ্ধের বই এক জায়গায়

“যদি একটা বই এই হাজার হাজার বইয়ের মাঝে হারিয়ে যায় তখন কী করবে?”

“হারাবে কেন?”

“মনে কর কবিতার একটা বই কেউ প্রবন্ধের বইয়ের সাথে রেখে দিল-তখন কী হবে?”

“কী আর হবে?”

সঞ্জয় চোখ বড় বড় করে বলল, “তোমাদের কখনো হয়নি যে একটা বই সকালবেলা খোঁজা শুরু করেছ, সারাদিন খুঁজেও পাওনি?”

“সবসময় হয়। আমাদের বাসার এইটা হচ্ছে খুবই সাধারণ ঘটনা। কেউ না কেউ কিছু না কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। একজন আরেকজনকে দোষ দিচ্ছে!”

মিম্মি সরু চোখে রাজুর ছোট ভাই-বোন দুইজনকেই খুব ভালো করে লক্ষ করল। তারপর রূপার কাছে এসে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “বুঝলি, রূপা–এই দুইটা বাচ্চা আসলে-”

রূপা বলল, “কী বলবি জোরে জোরে বল, সবাই শুনুক।”

মিম্মি থতমত খেয়ে বলল, “না-না-কিছু বলছি না।”

রাজু বলল, “কিছু হয়েছে মিম্মি?”

মিম্মি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না, কিছু হয়নি।”

রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয় বসে বসে ম্যাডামের বলে দেওয়া প্রজেক্টগুলো নিয়ে আলোচনা করল। আলোচনাগুলো হল অবশ্যি রূপা আর রাজুর মাঝে। মিম্মি সারাক্ষণই চোখের কোনা দিয়ে এদিক-সেদিক দেখতে লাগল। সঞ্জয় প্রজেক্ট নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি না–যখনই কেউ কিছু বলছিল সে মাথা নেড়ে বলতে লাগল, “ফার্স্ট ক্লাশ! ফার্স্ট ক্লাশ!”

কিছুক্ষণের ভেতরেই রাজুর আম্মু ওদেরকে খাবারের জন্যে ডাকতে এলেন, বললেন, “চলে এসো! অনেক কাজ হয়েছে এখন কিছু একটা খাও।”

রূপা দ্রতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সঞ্জয় তোক করে লাফ দিয়ে উঠে আনন্দের একটা শব্দ করল। রূপা তখন আর কিছু বলতে পারল না, সবার পিছু পিছু বের হয়ে এলো। খাবারঘরে একটা বড় ডাইনিং টেবিল, টেবিলে নানারকম খাবার। সঞ্জয় মহা উৎসাহে মাঝামাঝি একটা চেয়ারে বসে গেল, সেখান থেকে সবগুলো ডিশ নাগাল পাওয়া যায়। রাজুর আম্মু রূপাকে আর মিম্মিকে পাশাপাশি বসালেন। রাজু এক মাথায় বসল আর তার দুই পাশে বসল তার ছোট দুই ভাই-বোন।

রাজুর আম্মু তাদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগলেন, গরম গরম ডালপুরি দেখেই রূপার জিবে পানি এসে গেল। রাজুর আম্মু বললেন, “তোমরা লজ্জা করো না–অনেক আছে।”

রাজুর আম্মুর কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই মনে হয় ভেতর থেকে কাজের মহিলাটি একটা প্লেটে আরো অনেকগুলো ডালপুরি নিয়ে এলেন। রাজু ডালপুরিতে কামড় দিয়ে বলল, “ময়না খালা, আজকে আপনার ডালপুরি স্পেশাল হয়েছে। ফ্যান্টাস্টিক।”

সঞ্জয় মাথা নাড়ল, মুখে খাবার নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, “হ্যাঁ ফাটাফাটি, ফ্যান্টাস্টিক।” মুখে খাবার থাকার কারণে সঞ্জয়ের কথাটা ভালো বোঝা গেল না।

রূপা কনুই দিয়ে সঞ্জয়কে একটা গুতো দিয়ে বলল, “মুখে খাবার নিয়ে কথা বলিস না, গাধা কোথাকার।”

সঞ্জয় হি হি করে হেসে বলল, “ঠিক আছে আর বলব না। কথা না বলে আগে খাই।”

রাজুর আম্মু বললেন, “হ্যাঁ। সেটাই ভালো। আগে খাও।”

রাজুর ছোট ভাই হঠাৎ করে ডালপুরিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল, টেবিলের উপর রাখা চমচমের প্লেটটা দেখিয়ে বলল, “চমচম খাব।”

রাজু তার প্লেটে একটা চমচম তুলে দিয়ে বলল, “পুরোটা খেতে হবে কিন্তু।”

সে ফোকলা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “হ্যাঁ পুরোটা খাব।”

এরকম সময় কাজের মহিলাটি বড় এক বাটি বোঝাই চটপটি এনে টেবিলে রাখল। সঞ্জয় আবার আনন্দের শব্দ করল। রাজু বলল, “ময়না খালার চটপটি ওয়ার্ল্ড ফেমাস। একবার খেলে ভুলবে না।”

রাজুর ছোট ভাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আম্মুর চটপটি সবচেয়ে ভালো! ময়না খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না আম্মু?”

ময়না খালা বললেন, “থাক! নিজের মায়ের এত প্রশংসা করতে হবে না!”

রূপা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, যে বাচ্চা দুটোকে এতক্ষণ রাজুর ছোট-ভাই বোন ভেবে এসেছে তারা আসলে রাজুদের বাসার কাজের মহিলার ছেলেমেয়ে! এই জন্যেই চেহারায় মিল নেই, এই জন্যে নামগুলো অন্যরকম। এই বাসায় কাজের মহিলার বাচ্চাগুলোকে একেবারে নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করা হচ্ছে। কী আশ্চর্য! রূপা মুগ্ধ হয়ে একবার বাচ্চাগুলোর দিকে তাকাল একবার তার মায়ের দিকে তাকাল, পুরোটা কী স্বাভাবিক। কী চমৎকার।

রূপার সাথে সাথে সঞ্জয় আর মিম্মিও হঠাৎ করে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে, রূপা একটু ভয়ে ভয়ে থাকল, তারা হঠাৎ করে এটা নিয়ে বোকার মতো কিছু একটা বলে ফেলে কী না। কপাল ভালো দুইজনের কেউ কিছু বলল না।

নাস্তা করে যখন তারা চা খাচ্ছে তখন বাইরের দরজা শব্দ করল আর সাথে সাথে ছোট দুইজন আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “আপু! আপু!”

তাদের ধারণা সত্যি, দরজা খুলে একুশ-বাইশ বছরের একটা মেয়ে এসে ঢুকল, চেহারা দেখেই বোঝা গেল নিশ্চয়ই রাজুর বড় বোন। ছোট দুইজন চেয়ার থেকে নেমে ছুটে গিয়ে দুই দিক থেকে তাকে ধরে ফেলল, চিৎকার করতে লাগল, “আপু? আপু!”

রাজুর বোন বলল, “ব্যাস অনেক হয়েছে। তোদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমাকে আগে দেখিসনি!” ছোট দুইজন তখন আবার চিৎকার করতে করতে তাদের চেয়ারে গিয়ে বসল।

রাজু বলল, “আপু আমার ক্লাশের বন্ধুরা এসেছে।”

“তাই তো দেখছি। সত্যি দেখছি না সব কল্পনা?”

“কেন? কল্পনা কেন হবে?”

“তোর আবার বন্ধু আছে সেটাই তো জানতাম না।”

“কেন? আমার কেন বন্ধু থাকবে না?”

“তার কারণ তুই হচ্ছিস রোবট। তুই সবাইকে আপনি আপনি করে কথা বলিস। মানুষ যখন ছোটাছুটি করে তখন তুই রবীন্দ্র রচনাবলি পড়িস। সেই জন্যে কেউ তোর কাছে আসে না। সেই জন্যে তোর কোনো বন্ধু নেই।”

“আমার অনেক বন্ধু আছে।” রাজু রূপার দিকে তাকাল ”তাই না রূপা?”

রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “অনেক না হলেও কিছু আছে।”

রাজুর বোন একটা খালি চেয়ারে বসে তাদের তিনজনকে দেখল তারপর বলল, “আমি রাজুর বড় বোন মিথিলা। মেডিকেলে পড়ি।”

রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “জি! বুঝতে পেরেছি।”

“সঞ্জয় বলল, আপনাদের চেহারা একদম একরকম।”

“মোটেও না।” মিথিলা বলল, “রাজুর নাক বোঁচা। আমার নাক মোটেও বোঁচা না।”

রাজুর আম্মু বললেন, “নাক নিয়ে আর ফাইট করতে হবে না। হাত-মুখ ধুয়ে এসে কিছু খা।”

“হ্যাঁ, আম্মু খাব। খিদে লেগেছে।” টেবিলের নানারকম খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল, “ময়না খালা তার স্পেশাল চটপটি আর ডালপুরি বানিয়েছে মনে হয়?”

“বানিয়ে লাভ কী? বাচ্চারা তো কেউ কিছু খায়নি।”

রূপা বলল, “খালাম্মা, ওভাবে বলবেন না। আমাদের সঞ্জয় আপনার কথা বিশ্বাস করে আসলেই খেতে শুরু করবে।”

রূপার কথা শুনে সঞ্জয় হি হি করে হাসতে শুরু করে। রূপা বলল, “কী হল? তুই বোকার মতো হাসতে শুরু করেছিস কেন?”

সঞ্জয় হাসতে হাসতে একবার হেঁচকি তুলল, রাজুর বোন মিথিলা একটু ভয় পেয়ে বলল, “কী হল? কী হল তোমার?”

রূপা বলল, “কিছু হয়নি। সঞ্জয়ের মাথার ক্রু ঢিলা। যখন-তখন এইরকম বোকার মতো হাসতে থাকে।”

সঞ্জয় হি হি করে হাসতে হাসতে কোনোভাবে বলল, “আমি মোটেও বোকার মতো হাসতে থাকি না।”

রাজুর বড় বোন মিথিলা হাত-মুখ ধুয়ে তাদের পাশে এসে বসে। একটা বাটিতে খানিকটা চটপটি নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের কাজ হল?”

মিম্মি বলল, “সব এখনো শেষ হয়নি।”

“তোমাদের কী কাজ সেটা একটু শুনি।”

মিম্মি মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমরা সবাই সায়েন্স প্রজেক্ট করব তো, সেই জন্যে আলাপ-আলোচনা করছি।”

মিথিলা চোখ মটকে বলল, “তোমাদের আলোচনা কী ফলপ্রসূ হয়েছে?”

মিম্মি ঠাট্টাটা ঠিক ধরতে পারল না, বলল, “জি। ফলপ্রসূ হয়েছে।”

মিথিলা হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “গুড! আমাদের রোবট ভাই রাজু দ্বিপাক্ষিক-ত্রিপাক্ষিক আলোচনা করতে শিখেছে সেটা খারাপ কী?”

রাজু বলল, “আপু, আমাকে যদি রোবট বল, তা হলে তুমি কী? তুমি তো রোবট থেকেও কাঠখোট্টা!”

মিথিলা হঠাৎ করে মুখটা গম্ভীর করে ফেলল, বলল, “সেটা ঠিকই বলেছিস। ডাক্তারি পড়তে পড়তে কাঠখোট্টা হয়ে যাচ্ছি। প্রথম প্রথম যখন দেখতাম কোনো একজন রোগী মারা গেছে কয়েক রাত ঘুমাতে পারতাম না। এখন দেখি সহজভাবে নেই। আজকে যেরকম–”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “আজকে কী হয়েছে?”

“একজন অ্যাকসিডেন্ট করে এসেছে, বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই তার কিছু হয়েছে। রেসিডেন্ট ডাক্তার পরীক্ষা করে এসে বললেন, বাঁচবে না। আগে হলে শুনে আধাপাগল হয়ে যেতাম, আজকে দেখি মেনে নিলাম! কী আশ্চর্য!”

রাজু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “আপু তুমি আসলেই মেশিন হয়ে যাচ্ছ।”

“ছোট বাচ্চাদের কিছু দেখলে অবশ্যি এখনো সহ্য করতে পারি না। হাসপাতালে একটা পেশেন্ট এসেছে বয়স তেরো-চৌদ্দ থেকে বেশি হবে না। ড্রাগ ওভারডোজ।”

রাজু চমকে উঠল, “কী ওভারডোজ?”

“ড্রাগ। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না স্কুলের বাচ্চারাও ড্রাগস নিচ্ছে। কী সর্বনাশ!”

রূপা আর রাজু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “স্কুলের বাচ্চারা?”

“হুঁশ। তোমাদের বয়সী বাচ্চারা। অবিশ্বাস্য।”

মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “ড্রাগ খেলে কী হয়?”

“অনেক কিছু হয়। কোন ড্রাগ নিচ্ছে তার উপর নির্ভর করে কী ভয়ংকর অবস্থা হতে পারে। মাসখানেক আগে একজনকে এনেছে–সে ড্রাগ খেত, জোর করে তাকে ড্রাগ খাওয়া বন্ধ করেছে তাই মানুষটা ছটফট করতে করতে মরে গেল।”

“মরে গেল? মানে সত্যি মরে গেল?”

“হ্যাঁ, সত্যি মরে গেল।”

মিমি জিজ্ঞেস করল, “ড্রাগ বন্ধ করলে মানুষ মরে যায়?”

“অনেক ড্রাগ আছে যেটা খেলে শরীর অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন যদি হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন শরীর বিদ্রোহ করে, এটাকে বলে ড্রাগ উইথড্রয়াল সিনড্রোম, ভয়ংকর রিঅ্যাকশন হয়, মানুষ চোখের পলকে মরে যায়।”

“কী সর্বনাশ!”

মিথিলা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, কী সর্বনাশ। এই ড্রাগগুলো যে কী ভয়ংকর। কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। না বুঝে এক-দুইবার খেয়ে এডিক্ট হয়ে যায়। তখন আর কোনো মুক্তি নাই। ফ্যামিলির পর ফ্যামিলির সর্বনাশ হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায়।”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “ড্রাগ খেলে কী হয়?”

“সেটা নির্ভর করে ড্রাগের উপর। এখানে যেটা বেশি খায় সেটার লোকাল নাম বুলবুলি, খেলে হার্টবিট বেড়ে যায়, ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়, চোখের পিউপিল ডায়লেট করে, ঘামতে থাকে, টেম্পারেচার বেড়ে যায়, বক বক করে কথা বলতে থাকে, মনে হতে থাকে খুব আনন্দ হচ্ছে। যদি ভোজ বেশি খায় তা হলে হেলুসিনেট করে, আজব আজব জিনিস দেখে, জেগে থাকে দুঃস্বপ্ন দেখার মতো—” মিথিলা হাত নেড়ে থেমে যায়।

“তারপর কী হয়?”

“শুকিয়ে কাঠি হয়ে যায়। খিদে থাকে না, রাতে ঘুমাতে পারে না–যদিবা ঘুমায় ভয়ংকর ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। সারারাত বসে থাকে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কাউকে বিশ্বাস করে না। ড্রাগসের নেশা ভয়ংকর নেশা–তার জন্যে টাকার দরকার। নিজের টাকা না থাকলে টাকা চুরি করে। ছিনতাই করে, ডাকাতি করে। নিজের ফ্যামিলির মানুষকে মারধর করে। দেখবে পুরোপুরি সুস্থ সমর্থ ভালো একজন ছেলে বা মেয়ে শুধুমাত্র ফূর্তি করার জন্যে একবার একটু ড্রাগ খেয়ে পুরোপুরি এডিক্ট হয়ে গেছে। কিছু বোঝার আগে পুরোপুরি ভালো একটা ছেলে একেবারে হার্ডকোর ক্রিমিনাল হয়ে গেছে।”

রাজু জিজ্ঞেস করল, “আপু কেউ যদি ড্রাগ এডিক্ট হয়ে যায় তা হলে তাকে আর ভালো করা যায় না?”

“অনেক কষ্ট হয়। ড্রাগ রিহেবিটেলিশান সেন্টারে নিতে হয়, ডাক্তারদের চোখে চোখে রাখতে হয়–চিকিৎসা করতে হয়। ফ্যামিলি আর বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে যদি সাহায্য করে পাশে থাকে, সাপোর্ট দেয় তা হলে হয়তো বের হয়ে আসতে পারে।”

রাজু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মিথিলা সেটা দেখে বলল, “তুই এরকম হতাশ হয়ে যাচ্ছিস কেন? তোর কে ড্রাগ খাচ্ছে?”

রাজু আর রূপা একসাথে বলল”না, না, কেউ খাচ্ছে না। তারা দুইজন একসাথে এত জোরে একই কথা বলল যে সবাই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকাল।

.

বিকেলবেলা যখন রূপা, মিম্মি আর সঞ্জয় বিদায় নিয়ে চলে আসছে ঠিক তখন রাজুর আব্বু তার কাজ থেকে ফিরে এলেন। কাঁচা-পাকা চুল, চোখে চশমা। সবাইকে দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন”কী ব্যাপার? আমি আসছি আর তাই তোমরা চলে যাচ্ছ?”

মিম্মি মাথা নাড়ল, “না চাচা। আমরা অনেকক্ষণ ছিলাম।”

রূপা বলল, “বাসায় বলে এসেছি অন্ধকার হবার আগেই চলে আসব।”

“ঠিক আছে যাও। আবার এসো।”

“জি চাচা।”

রাজুর আব্বু রাজুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী হল, তুই তোর বন্ধুদের বাসায় পৌঁছে দিবি না?”

রূপা আর মিম্মি বলল, “না, না, লাগবে না। আমরা নিজেরা যেতে পারব।”

“সেটা তো পারবেই। একশবার পারবে। তাই বলে রাজুর একটা দায়িত্ব আছে না? যা, রাজু তুই বন্ধুদের বাসায় পৌঁছে দে।”

কাজেই রাজুও ওদের সাথে বের হল। রাজু তখন ওদের সাথে গেল বলে ওদের পুরো ব্যাপারটাই সেদিন থেকে একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল।

.

০৬.

চারজন একসাথে বের হবার পর থেকে মিম্মি কিছু একটা বলার জন্যে উশখুশ করছিল কিন্তু রাজু সাথে রয়েছে তাই বলতে পারছিল না! বড় রাস্তার মোড়ে এসে মিম্মি আর সঞ্জয় দুইজন দুইদিকে চলে গেল। সে কী বলতে চাইছিল তাই সেটা আর কেউ শুনতে পেল না।

রূপা তখন রাজুকে বলল, “রাজু আমি এখন একা একা চলে যেতে পারব। তুমি যাও।”

রাজু বলল, “তোমাকে আরেকটু এগিয়ে দিই।”

রূপা বলল, “তোমার আপুর কাছ থেকে ড্রাগের গল্পগুলো শুনে আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছিল।”

“ঠিকই বলেছ।”

“এখন সোহেলের কী হবে?”

“বুঝতে পারছি না। কী করব বুঝতে পারছি না।”

রূপা বলল, “আমার মনে হয় কী জান?”

“কী?”

“প্রথমে ওর আব্বুকে বলা দরকার। তারপর মনে হয় ওর আম্মুকে ফোন করা দরকার–”

হঠাৎ রাজু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “শ-স-স-স।”

রূপা রাজুর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায়। দূরে সোহেল, হন হন করে হেঁটে আসছে। রাজু বলল, “চল লুকিয়ে যাই, দেখি কোথায় যায়।”

দুইজন তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে একটা দোকানের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল, না দাঁড়ালেও তাদের দেখত বলে মনে হয় না। সোহেল তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে থাকে, এলোমেলো চুল, কুঁচকানো একটা টি-শার্ট। মুখটা শুকনো আর চোখের দৃষ্টি কেমন কেমন উদভ্রান্ত।

রূপা ফিসফিস করে বলল, “কোথায় যাচ্ছে?”

“জানি না।” রাজু সোহেলের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তুমি বাসায় যাও। আমি দেখি সোহেল কোথায় যায়, কী করে।”

“আমিও আসি তোমার সাথে।”

“না। দুইজন গেলে দেখে ফেলতে পারে। আমি একাই যাই।”

রূপা রাজি হল। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে এখন যদি সোহেলের পিছু পিছু যায় বাসায় যেতে আরো দেরি হয়ে যেতে পারে। রূপা তার বাসার দিকে রওনা দিল, রাজু দূর থেকে সোহেলের পিছু পিছু হেঁটে যেতে লাগল।

সোহেল বড় রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে চৌরাস্তার মোড়ে এসে একটু দাঁড়াল, এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর বাজারের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। বাজারের কাছে একটা ভিডিওর দোকানের সামনে দাঁড়াল, এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর ভিতরে ঢুকে গেল।

রাজু ঠিক বুঝতে পারল না এখন সে কী করবে, বাইরে অপেক্ষা করবে না কী ভেতরে ঢুকবে। তাকে অবশ্যি বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হল না, তার কারণ সোহেল প্রায় সাথে সাথেই বের হয়ে এলো, আবার এদিক-সেদিক তাকাল, মনে হচ্ছে সে কাউকে খুঁজছে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে আবার হাঁটতে থাকে। রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানের ভেতর সে উঁকি দিল। হঠাৎ করে মনে হল সে যাকে খুঁজছে তাকে পেয়ে গেছে। লম্বা লম্বা পা দিয়ে সে ভেতরে ঢুকে গেল আর একটু পরেই সে আরেকজনের সাথে বের হয়ে এলো।

যার সাথে বের হয়ে এলো তার বয়স আঠারো-উনিশ বছরের বেশি হবে না, খুবই টাইট একটা জিন্সের প্যান্ট আর কালো একটা টি-শার্ট পরে আছে। টি-শার্টে মানুষের নরমুণ্ডুর একটা ছবি। ছেলেটির মাথায় বাহারি চুল, গলায় একটা চেন।

রাজু দূর থেকে দেখল সোহেল এই ছেলেটার সাথে কথা বলছে। ছেলেটা সোহেলকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে, সোহেল বুঝতে চাইছে না। খানিকক্ষণ দুইজন কথা বলল, কিংবা বলা যেতে পারে তর্কবিতর্ক করল তারপর মনে হল সোহেল হাল ছেড়ে দিল। ছেলেটা তখন হাত পাতল, সোহেল পকেট থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে গুনে গুনে কিছু টাকা ছেলেটার হাতে দিল। ছেলেটা তখন আবার টাকাগুলো গুনে গুনে পকেটে ঢোকাল। তারপর ছেলেটা চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। রাজু তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কোথাও কোনো সন্দেহজনক কিছু নেই নিশ্চিত করে ছেলেটা পকেট থেকে ছোট একটা প্যাকেট বের করে, সেখান থেকে আরেকটি ছোট প্যাকেট বের করে সোহেলের হাতে ধরিয়ে দিল।

সোহেল প্যাকেটটা খুলে ভালো করে দেখল তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। ছেলেটার সাথে আবার কিছুক্ষণ কথা বলল তারপর যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিক দিয়ে হন হন করে হেঁটে যেতে শুরু করে।

রাজু তাড়াতাড়ি আরেকটা দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল। সোহেল চলে যাবার পর রাজু বের হয়ে আসে, রাস্তার অন্য পাশে টাইট জিন্স আর কালো টি শার্ট পরা ছেলেটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। রাজু একটু চিন্তা করল এখন সে কী করবে, সোহেলের পিছু পিছু যাবে না কী এই ছেলেটা কী করে সেইটা বের করবে। সোহেল নিশ্চয়ই এখন বাসাতেই যাবে কাজেই তার পিছু পিছু গিয়ে সে নতুন কিছু জানতে পারবে না। কিন্তু এই ছেলেটার পিছু পিছু গেলে সে নতুন কিছু জানতেও পারে।

ছেলেটা একটা সিগারেট ধরাল, তারপর লম্বা একটা টান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ধোঁয়া ছাড়ল তারপর উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে।

রাজু তখন রাস্তা পার হয়ে ছেলেটার খুব কাছাকাছি চলে এলো, ছেলেটা তাকে লক্ষ করল না। রাজু বেশ কয়েক পা পিছনে থেকে তার পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকে।

ছেলেটা হেঁটে হেঁটে রাস্তার পাশের খোলা একটা চায়ের দোকানে ঢোকে। যে মানুষটা চা তৈরি করছে তাকে জিজ্ঞেস করল, “বকর আইছে?”

মানুষটি চা তৈরি করতে করতে বলল, “আইছে।”

“কই?”

রাজু বকরের গলা শুনতে পেল, “এই যে! আমি এইখানে।”

রাস্তার পাশে একটা দেয়াল, বকর নামের মানুষটা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছিল। প্রস্রাব শেষ করে প্যান্টের জিপ লাগিয়ে কাছে এসে বলল, “ব্যবসাপাতি কেমন চলছে?”

“ভালো না। রেগুলার কাস্টমার ছাড়া নতুন কেউ নেই।”

“এমনি এমনি কাস্টমার হয় না আক্কাইস্যা। কাস্টমার বানাতে হয়।”

“সেইটা তো চেষ্টা করছি, কিন্তু মালদার কাস্টমারের অভাব। সখ আছে মালপানি নেই।”

মানুষ দুটি মাথা ঘুরিয়ে রাজুকে দেখল তাই রাজুকে ভান করতে হল সে এই খোলা চায়ের দোকানে কোনো একটা কারণে এসেছে। সে বকর এবং আক্কাস নামের দুইজন মানুষকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে দোকানিকে বলল, “একটা সিংগারা দিবেন।”

দোকানি এক টুকরো খবরের কাগজে মুড়ে তাকে একটা সিংগারা দিল। রাজু দাম মিটিয়ে সিংগারাটা হাতে নিয়ে হেঁটে চলে আসে। এক্ষুনি বাসা থেকে এত কিছু খেয়ে এসেছে এখন এই সিংগারা খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। রাস্তার মোড়ে উদাস মুখে একটা ছোট বাচ্চা ধুলো দিয়ে খেলছে, তার মা কোথায় কে জানে। রাজু বাচ্চাটাকে সিংগারাটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে এলো।

সোহেল তার ড্রাগস কার কাছ থেকে কিনে, কোথায় কিনে সেটা অন্তত আজকে জানতে পেরেছে। অন্তত দুইজন মানুষ আছে যার একজনের নাম বকর অন্যজন আক্কাস।

.

০৭.

রূপা বলল, “তোদের এখন খুবই জরুরি একটা কথা বলা হবে, তোরা কাউকে এই কথাগুলো বলতে পারবি না।”

দুপুরের ছুটিতে স্কুলের মাঠে রূপা আর রাজু, সঞ্জয় আর মিম্মিকে নিয়ে বসেছে। অন্য সময় হলে চারজনকে মাঠের মাঝে বসে থাকতে দেখলেই অন্যেরাও এসে বসে যেত। এখন সবাই জানে বিজ্ঞান ম্যাডাম সবাইকে বিজ্ঞানের প্রজেক্ট দিয়েছেন সবাই নিজের টিম নিয়ে বসে আলাপ-আলোচনা করছে। সবাই ধরেই নিয়েছে তারা তাদের প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে বসেছে। আসলে রূপা আর রাজু ঠিক করেছে অন্য দুইজনকে সোহেলের কথাটা বলবে।

মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কী কথা?”

“আগে বল কাউকে বলবি না।”

“কাউকে বলব না।”

“যদি বলিস তা হলে তোদের জিব খসে যাবে কিন্তু।”

সঞ্জয় অধৈর্য হয়ে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে বাবা। কী বলবি বল।”

“রূপা মুখ গম্ভীর করে বলল, আমাদের পাঁচজনের টিম হচ্ছে মিরূসোরাস কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা হচ্ছি মিরূরাস-সোহেল নেই।”

মিম্মি বলল, “আমি তখনই বলেছিলাম সোহেলকে নিয়ে কাজ নেই।”

“তুই বলিসনি।”

“ভেবেছিলাম বলব। শেষ পর্যন্ত বলা হয়নি।”

সঞ্জয় বলল, “সোহেলের মাথা তো আউলে গেছে।”

রূপা মাথা নাড়ল, “আসলে মাথা আউলে যায়নি। সেইটাই বলতে যাচ্ছি।”

“বল।”

রূপা একটু গলা খাকারি দিয়ে বলল, “সোহেল এখন ড্রাগ এডিক্ট।”

মিম্মি আর সঞ্জয় চোখ বড় বড় করে তাকাল, তাদের কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে রূপা কী বলছে। সঞ্জয় কয়েকবার চেষ্টা করল, ড্রা-গ-এ-ডি-ক্ট?”

“হ্যাঁ।”

মিম্মি বলল, “তা হলে সে আমাদের সাথে প্রজেক্ট করবে কেমন করে?”

রাজু বলল, “আসলে আমরা প্রজেক্ট নিয়ে চিন্তা করছি না। আমাদের এখন চিন্তা কেমন করে সোহেলকে বাঁচানো যায়।”

মিম্মি বলল, “এক্ষুনি হেডস্যারকে বলতে হবে। হেডস্যার পুলিশকে ফোন করে দিলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে–”

রূপা বলল, “সোহেলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে?”

“নেওয়াই তো উচিত। ধরে নিয়ে শক্ত পিটুনি দেওয়া দরকার। পিটুনি হচ্ছে ড্রাগিদের সবচেয়ে ভালো ওষুধ।”

রূপা বলল, “আসলে আমরা তোদর ডেকেছি অন্য একটা কারণে।”

“কী কারণ?”

“আমরা ড্রাগ ডিলারদের ধরে পুলিশকে দিতে চাই।”

সঞ্জয় আর মিমি চোখ বড় বড় করে রূপার দিকে তাকাল।

মিম্মি বলল, “তুই ড্রাগ ডিলারদের চিনিস?”

রূপা বলল, “আমি চিনি না। রাজু চেনে।”

“তা হলে পুলিশকে বলে দিচ্ছিস না কেন?”

রাজু বলল, “আমি আসলে মাত্র দুইজনকে দেখেছি। দলে মনে হয় আরো অনেকে আছে। আমি যে দুইজনকে দেখেছি সেই দুইজন ফালতু টাইপের, যেটা লিডার সেইটাকে খুঁজে বের করে তারপর পুলিশে খবর দিতে হবে।”

সঞ্জয় ভুরু কুঁচকে বলল, “কেমন করে খুঁজে বের করবে?”

রাজু মাথা চুলকে বলল, “সেইটা নিয়ে তোদের সাথে কথা বলতে চাই। তোদের কোনো আইডিয়া আছে কী না।”

সঞ্জয় ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে থাকে, কিন্তু তার চিন্তা করার খুব বেশি অভ্যাস নেই তাই একটু পরেই হাল ছেড়ে দিল। বলল, “তোদের কোনো আইডিয়া আছে?”

রূপা বলল, “সবার আগে আমাদের সোহেলের সাথে কথা বলতে হবে।”

“সোহেলের সাথে?”

“হ্যাঁ।”

“কী বলবি?”

“আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করব, দেখব সে কী বলতে চায়।”

মিম্মি সরু চোখে একবার রূপার দিকে আরেকবার রাজুর দিকে তাকাতে লাগল। রূপা বলল, “মিম্মি–”

“কী?”

“তুই কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারবি না।”

“বলব না।”

“আমার গা ছুঁয়ে বল।” রূপা তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। ”বল গা ছুঁয়ে।”

“গা ছুঁয়ে বললে কী হয়?”

“সেটা আমি জানি না, কিন্তু গা ছুঁয়ে বল।”

মিম্মি রূপার গা ছুঁয়ে বলল, “কাউকে বলব না।”

বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর চারজন সোহেলের বাসায় হাজির হল। দরজায় শব্দ করার পর আবার সেই মহিলা দরজা খুলে দিল। রূপা জিজ্ঞেস করল, “সোহেল আছে?”

“আছে।”

“আমরা সোহেলের সাথে কথা বলতে এসেছি।”

“হে মনে হয় ঘুমায়।”

“ঘুমালেও সমস্যা নেই, আমরা ডেকে তুলব।”

“মনে হয়, শরীরটা বেশি ভালা না।”

“সেইটাও আমরা দেখব।”

“তয় যান। বারান্দার শেষ ঘরটা।”

রাজু বলল, “আমরা চিনি। আমরা আগে আরেকবার এসেছিলাম। মনে নেই?”

মহিলাটা মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে।”

বারান্দার শেষ মাথায় গিয়ে রূপা দরজাটা ধাক্কা দিল। দরজাটা বন্ধ, ভেতর থেকে তারা সোহেলের গলার স্বর শুনতে পেল, “কে?”

সঞ্জয় বলল, “আমরা। দরজা খোল।”

ভেতরে সোহেল হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল। সঞ্জয় আবার বলল, “কী হল? দরজা খুলিস না কেন?”

খুট করে দরজা খোলার শব্দ হল, সোহেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী চাস?”

রূপা বলল, “ভেতরে ঢুকতে দে।”

“কেন?”

“তোর সাথে কথা আছে।”

“কী কথা?”

রাজু বলল, “আমাদের সায়েন্স প্রজেক্টের টিমের তুই একজন মেম্বার। প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে হবে।”

সোহেল কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সরে দাঁড়াল, বলল, “আয়।”

চারজন সোহেলের ঘরে ঢুকল। আগেরবার ঘরটা যত এলোমেলো ছিল এখন ঘরটা তার থেকে বেশি এলোমেলো, অনেক বেশি নোংরা। সঞ্জয় বলল, “তোর ঘরটা পরিষ্কার করা দরকার।”

সোহেল এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, ““।

রাজু বলল, “আমরা একটা সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। তুমি আমাদের টিমে আছ। তুমি আর আমরা চারজন।”

সোহেল বলল, “হু–”

রাজু বলল, সায়েন্স ম্যাডামের কাছে আমাদের আইডিয়াটা কালকে জমা দিতে হবে। সেই জন্যে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি।”

সোহেল বলল, “হু–”

রূপা বলল, আমাদের তিনটা আইডিয়া আছে–অদৃশ্য আলো, স্মোক বম্ব আর আলোর সংমিশ্রণ। তোর কোনটা পছন্দ?”

সোহেল ভুরু কুঁচকে বলল, “হু–””কোনটা পছন্দ?”

“জানি না।”

সঞ্জয় বলল, “আমার ইচ্ছা স্মোক বম্ব। যখন ফাটাবি তখন ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে ধোয়া দিয়ে। লাল-নীল ধোয়া।”

সোহেল বলল, “হুঁ“।

রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “খালি হু হু করবি না। কথা বল।”

“কী কথা বলব?”

“আমরা কিন্তু তোর সব কথা জানি।”

সোহেল কেমন যেন চমকে উঠল, দেখতে দেখতে তার মুখটা শক্ত হয়ে উঠল, রূপার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কী কথা জানিস?”

মিম্মি বলল, “তুই ড্রাগ এডিক্ট।”

সোহেল ঝট করে ঘুরে মিম্মির দিকে তাকাল, বলল, “কী বললি? কী বললি

রূপা বলল, “ঠিকই তো বলেছে।”

সোহেল বলল, “খুন করে ফেলব তোদের সবাইকে।”

রাজু সোহেলের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, তুমি কেন মিছামিছি খেপে উঠছ। শান্ত হয়ে একটু বসো দেখি। বসো শান্ত হয়ে।”

সোহেল ঝটকা মেরে রাজুর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “বের হয়ে যা তোরা। বের হয়ে যা এক্ষুনি।”

রাজু শান্ত গলায় বলল, “মিছামিছি রাগ করো না সোহেল। আমরা তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।”

সোহেল চিৎকার করে বলল, “আমার কারো সাহায্য দরকার নেই। তোরা বের হয়ে যা আমার রুম থেকে।”

“শোন সোহেল। খুব ইম্পরট্যান্ট। খুবই ইম্পরট্যান্ট।”দরকার নেই আমার ইম্পরট্যান্ট কথার। কোনো দরকার নেই।”

রূপা গলা উঁচিয়ে বলল, “আছে। শোন সোহেল, তুই খুব বিপদের মাঝে আছিস। ড্রাগ খুব ভয়ংকর জিনিস-এর থেকে বের হওয়া খুব কঠিন। বের না হলে তুই মরে যাবি।”

“আমার বেঁচে থেকে কী হবে?” হঠাৎ সোহেল হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আম্মা গো, ও আম্মা–তুমি কোথায় গেলে আমাকে ছেড়ে কোথায়-”

সোহেলের দিকে তাকিয়ে রূপার চোখে পানি এসে গেল।

.

রাজু বলল, “এই যে ভিডিওর দোকান আছে, সোহেল প্রথমে এখানে ঢুকেছিল।”

রাজু তিনজনকে নিয়ে এসেছে ড্রাগ ডিলারদের আস্তানাটা দেখানোর জন্যে। সোহেলকে অনেক কষ্ট করে শান্ত করে এসেছে। ওকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাজি করিয়েছে সে যেন আবার স্কুলে আসা শুরু করে। স্কুলে নতুন ম্যাডাম খুব ভালো, ক্লাসে মোটেও বকাবকি করেন না। সোহেল আসতে রাজি হয়েছে কিন্তু আসলেই আসবে কী না কে জানে।

রাজু বলল, “ভিডিওর দোকানের পাশে যে রেস্টুরেন্টটা আছে সোহেল সেইখানে ড্রাগ ডিলারটাকে খুঁজে পেয়েছিল। সোহেল তার কাছ থেকে ড্রাগ কেনার পর ড্রাগ ডিলারটা ঐ খোলা চায়ের দোকানে গিয়েছে সেইখানে তার একটা পার্টনার আছে। মনে হয় এই চায়ের দোকানের মানুষটাও একই দলের।”

মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “এখন আমরা কী করব?”

“এই জায়গাটাকে চোখে চোখে রাখলে মনে হয় ড্রাগ ডিলারকে পেয়ে যাব।”

“আমরা কীভাবে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখব? আমাদের স্কুল আছে না? বাসা আছে না?”

রাজু মাথা চুলকাল, “সেইটাই তো মুশকিল।”

রূপা বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

“কী আইডিয়া?”

“এইখানে বসে না থেকেই আমরা এইখানে নজর রাখতে পারব। যদি-”

“যদি কী?”

“আমাদের কাছে দুইটা মোবাইল ফোন থাকে।”

মিম্মি মুখ বাঁকা করল, “দুইটা মোবাইল ফোন?” আমার বাসায় আমাকে মোবাইল ফোন ধরতেই দেয় না।”

রাজু বলল, “আপুকে বললে আপু আমাকে ব্যবহার করতে দিতে পারে।”

রূপা বলল, “আমার আপুরও একটা মোবাইল ফোন আছে। আমাকে কখনো ব্যবহার করতে দিবে না। কিন্তু—”

মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”

“সোজা পথে না দিলে বাঁকা পথে চেষ্টা করলে দোষ কী?”

সঞ্জয় মাথা নাড়ল, “কোনো দোষ নেই। সোজা পথে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই, বাঁকা পথে যা।”

.

০৮.

তিয়াশা যখন বাথরুমে গেল তখন রূপা তিয়াশার ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সেটা খুলে ব্যাটারি বের করল। তারপর ছোট এক টুকরো স্কচ টেপ ব্যাটারির ধাতব টারমিনালে লাগিয়ে আবার ব্যাটারিটা ভেতরে ঢুকিয়ে মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে তিয়াশার ব্যাগে রেখে দিল। এখন চেষ্টা করলেও মোবাইল ফোনটা আর চালু করা যাবে না।

তিয়াশা সেটা লক্ষ করল ঘণ্টা দুয়েক পর। মোবাইল ফোনটা কয়েকবার টেপাটেপি করে বলল, ‘আরে! আমার মোবাইল ফোনটা অন হয় না কেন?”

রূপা শুনেও না শোনার ভান করে চোখের কোনা দিয়ে তিয়াশাকে লক্ষ করতে লাগল। তিয়াশা ফোনটা কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কী হল! কী মুশকিল!”

এবারে রূপা বলল, “কী হয়েছে?”

“আমার মোবাইল! অন হচ্ছে না।”

“চার্জ শেষ। চার্জ কর। তা হলেই চালু হবে।”

“উঁহু। পুরা চার্জ ছিল।”

“তা হলে তোমার টাকা শেষ।”

তিয়াশা বিরক্ত হয়ে বলল, “টাকা শেষ হলে ফোন অফ হবে কেন?”

“দেখি আমার কাছে দাও দেখি!” রূপা তিয়াশার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল। ব্যাটারিটা বের করল, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল তারপর আবার ভেতরে ঢুকিয়ে টেপাটেপি করে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভান করে বলল, “নাহ! কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।”

“এখন কী হবে? আমার ইম্পরট্যান্ট ফোন করার ছিল।”

“একদিন ফোন না করলে কী হয়?”

“এখন কেমন করে ঠিক করব?”

“সকালে আমাকে দিও আমি ঠিক করিয়ে আনব।”

“কোথা থেকে ঠিক করবি?”

“আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে পড়ে নাম সঞ্জয়, সে হচ্ছে মোবাইলের এক্সপার্ট। যে কোনো মোবাইল ঠিক করে ফেলতে পারে। তাকে দিলে সে ঠিক করে দেবে।”

“তোদের ক্লাসের ছেলে? মোবাইল ঠিক করতে পারে?”

মিথ্যা কথা বলা বেশ কঠিন রূপা প্রথমবার টের পেতে শুরু করল।

সরল মুখ করে বলল, “হ্যা–”

”কেমন করে শিখেছে?”

একটা মিথ্যা কথা বললে সেটাকে রক্ষা করার জন্যে আরো দশটা মিথ্যা বলতে হয়। কাজেই রূপাকেও আরো মিথ্যা বলতে হল, “ওর আব্বুর মোবাইলের দোকান আছে, সেখান থেকে শিখেছে।”

তিয়াশা ভুরু কুঁচকে তাকাল তাই রূপাকে আরো মিথ্যা বলতে হল, “সঞ্জয় খুবই ব্রিলিয়ান্ট, বড় হলে নির্ঘাত ইঞ্জিনিয়ার হবে।”

“এমনি এমনি ঠিক করে দেবে?”

“দেবে না? আমাদের ক্লাসের ছেলে আমাদের মোবাইল ফোন ঠিক না করলে কার ফোন ঠিক করবে?”

তিয়াশাকে এবারে একটু চিন্তিত দেখাল, “কিন্তু কাল তো শুক্রবার। স্কুল বন্ধ।”

“আমাদের প্রজেক্টের মিটিং আছে, সঞ্জয়ের সাথে দেখা হবে, তখন ঠিক করে দিতে পারবে।” রূপা পুরো ব্যাপারটা আরো বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে বলল, “তোমার যদি সঞ্জয়কে বিশ্বাস না হয় তুমি মোবাইলের দোকানেও নিতে পার। চৌরাস্তার মোড়ে একটা দোকান আছে। কালকে শুক্রবার মনে হয় বন্ধ।”

“ঠিক আছে আমি তোকেই দেব। দেখি তোর বন্ধু ঠিক করতে পারে কী না।” তিয়াশা মনমরা হয়ে তার ফোনটাকে নানাভাবে ঝাঁকি দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকে।

.

সন্ধ্যেবেলা যখন তাদের বাসার সবাই হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসেছে তখন সুলতানা চুপি চুপি রূপার ঘরে এলো। রূপাকে জিজ্ঞেস করল, “কী কর, আফা?”

“আফা না, আপা।”

“একই কথা।” সুলতানা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল।

”কী হয়েছে তোমার?”

“কিছু হয়নি।” সুলতানা রূপার বিছানায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসল, “মনটা ভালো লাগে না।”

“কেন?”

“কাল রাতে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম।”

“কী স্বপ্ন?”

“মায়েরে সাপে কাটছে আর মা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে।”

রূপা হাসার ভান করল, “ধুর! স্বপ্ন দেখে কেউ মন খারাপ করে? স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্ন তো আর সত্যি না।”

“কিন্তু স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল একেবারে সত্যি। ভোরবেলার স্বপ্ন না কি সত্যি হয়।”

“স্বপ্ন বলে দিলে সেটা আর সত্যি হয় না। তুমি আমাকে বলে দিয়েছ এখন আর সত্যি হবে না।”

“সত্যি বলছ?”

“হ্যাঁ। সত্যি বলছি।”

সুলতানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “কতদিন মায়েরে দেখি না।”

রূপা বলল, “একবার বাড়ি যাও। মাকে দেখে আস।”

“যেতে তো চাই। কিন্তু খালাম্মা ছুটি দিতে চায় না।”

রূপা কী বলবে বুঝতে পারল না। সুলতানা শেষবার কবে তার বাড়ি গেছে সে মনে করতে পারে না। ঠিক এরকম সময় তার নাকে একটা পোড়া গন্ধ এসে লাগল।”নাক কুঁচকে বলল, কিছু একটা পুড়ছে না কি?”

অমনি সুলতানার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “সর্বনাশ! চুলায় ডেকচিটা রেখে আসছি।”

সুলতানা রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল কিন্তু ততক্ষণে পোড়া গন্ধ রান্নাঘর থেকে বাইরের ঘর পর্যন্ত চলে এসেছে। হিন্দি সিরিয়াল থেকে আম্মুর মনোযোগ রান্নাঘরের পোড়া গন্ধের দিকে চলে গেল। সিরিয়ালের মূল চরিত্র জাসিন্দর আর আনিলার একটা গভীর আবেগময় দৃশ্যের মায়া কাটিয়ে আম্মুও সুলতানার পিছু পিছু রান্নাঘরে গেলেন।

রূপা তার ঘর থেকে প্রথমে আম্মুর চিৎকার তারপর প্রচণ্ড মারধোরের শব্দ শুনতে পেল। মনে হল আম্মু বুঝি সুলতানাকে খুন করে ফেলবেন। প্রথম প্রথম সুলতানার একটা-দুইটা অনুনয়-বিনয় শুনতে পেল কিন্তু আম্মুর হিংস্র চিৎকারে সব চাপা পড়ে গেল। প্রচণ্ড মারধোরের মাঝে সুলতানার কাতর চিৎকার ভেসে আসতে লাগল। রূপা আর সহ্য করতে পারছিল না। যখন প্রায় ছুটে যাচ্ছিল তখন আব্বু গিয়ে আম্মুকে থামালেন। বললেন, “অনেক হয়েছে। এখন ছেড়ে দাও।”

“ছেড়ে দেব? এই হারামজাদিকে ছেড়ে দেব?” আম্মু চিৎকার করে বললেন, “কি করেছে দেখেছ? সবকিছু পুড়িয়ে শেষ করেছে। আরেকটু হলে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিত।”

“যাই হোক, আগুন তো লাগেনি।”

“তুমি এদের চেনো না। এরা হচ্ছে ছোটলোকের জাত। এদের রক্তের মাঝে দোষ আছে। এদের লাই দিলে এরা মাথায় ওঠে। এদের জুতো দিয়ে পিটিয়ে সিধে রাখতে হয়।”

গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেল তখন রূপা চুপি চুপি রান্নাঘরে গেল। সুলতানা মেঝেতে বসে আছে, হাত দিয়ে মেঝেতে আঁকিবুকি কাটছে। রূপা ফিসফিস করে ডাকল, “সুলতানা।”

সুলতানা কোনো কথা না বলে মাথা তুলে তাকাল। রূপা বলল, “তুমি মন খারাপ করো না। আমি আমি–”

“তুমি কী?”

“আমি যখন বড় হব তখন আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। তুমি আর আমি থাকব। তখন তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না।”

সুলতানা হাসার চেষ্টা করল। ঠোঁটটা ফেটে গেছে তাই হাসার চেষ্টা করার সময় এক ফোঁটা রক্ত বের হয়ে এলো। রূপা বলল, “তুমি বিশ্বাস করছ না আমার কথা?” সুলতানা মাথা নাড়ল, বলল, “করেছি।” তোমার কথা বিশ্বাস করি দেখেই তো আমি বেঁচে আছি। তা না হলে কী আর বেঁচে থাকতাম? আমার কী খুব বেঁচে থাকার সখ?”

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল