যখন আমাদের ক্লাসে ভর্তি হল সম্পূর্ণ অন্যরকম একজন যার কারণে আমাদের পুরো ক্লাসটাই হয়ে গেল একটু অন্যরকম

আমরা ক্লাসে বসে আছি, বাংলা স্যার রোল কল শেষ করে বইটা হাতে নিয়েছেন তখন আমরা দেখতে পেলাম করিডোর ধরে নতুন ম্যাডাম হেঁটে আসছেন। তার পিছনে একজন মানুষ আর মানুষটার পিছনে একটা মেয়ে। মেয়েটা নিশ্চয়ই একটু

নেকু টাইপের, এতো বড় হয়েছে কিন্তু এখনো তার আব্বুর হাত ধরে হাঁটছে।

নতুন ম্যাডাম আমাদের ক্লাসের দরজার পাশে দাঁড়ালেন, বললেন, “আমরা ভেতরে আসতে পারি?”

বাংলা স্যার মাথা ঘুরিয়ে নতুন ম্যাডাম, তার সাথে বাবা আর মেয়েকে দেখে ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আসেন। আসেন।”

নতুন ম্যাডাম, বাবা আর সেই মেয়েটি ক্লাসে এসে ঢুকল। মেয়েটা এখনো তার বাবার হাত ধরে রেখেছে। খুব সুন্দর কাপড় পরে আছে, দেখে মনে হল একটু অহংকারী। কেউ নতুন জায়গায় এলে চারিদিকে তাকায়, সবাইকে লক্ষ করে–এই মেয়েটা সেরকম কিছুই করল না, কেমন জানি সোজা সামনে তাকিয়ে রইল।

নতুন ম্যাডাম আমাদের সবাইকে মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখলেন, তারপর বললেন, “তোমাদের ক্লাসে একজন নতুন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। আমি তাকে নিজে নিয়ে এসেছি। সাথে তার বাবাও আছেন।”

।বাবা তখন একটু হাত নেড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। ম্যাডাম বললেন, “ছাত্রীটির নাম মাইশা হাসান। ডাকনাম আঁখি। আঁখি তোমাদের দশজনের থেকে একটু অন্যরকম। আমি ইচ্ছে করলে আগে থেকে তোমাদের সেটা জানাতে পারতাম-ইচ্ছে করে জানাইনি। তোমাদের ক্লাসে তোমরা আঁখিকে ঠিকভাবে গ্রহণ কর।”

আমরা ম্যাডামের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। তাকে দেখে মোটও অন্যরকম মনে হচ্ছে না-বাড়তি হাত-পা নেই একেবারে স্বাভাবিক। ক্লাসে ভর্তি হয়েছে সে আর দশজনের মতো ক্লাস করবে–তাকে আবার গ্রহণ করব কেমন করে? তার গলায় কি ফুলের মালা দিতে হবে? না কি তার জন্যে গান গাইতে হবে?

নতুন ম্যাডাম মেয়েটার বাবাকে নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন। বাংলা স্যার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, মেয়েটাও ক্লাস রুমের দিকে তাকিয়ে রইল। স্যার গলা খাকারি দিয়ে বললেন, “যাও। বস।”

মেয়েটা বলল, “কোথায়?”

শান্তা একটু সরে তার পাশে জায়গা করে দিয়ে বলল, “এইখানে।”

মেয়েটা তার ব্যাগটা খুলে সাদা মতো কী একটা বের করল, সেটা ছেড়ে দিতেই খুলে একটা সাদা লাঠি হয়ে গেল। মেয়েটা সেই লাঠিটা মেঝেতে লাগিয়ে ডানে-বামে একটু নাড়িয়ে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে শান্তার বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল এবং তখন হঠাৎ করে আমরা সবাই বুঝতে পারলাম এই মেয়েটা চোখে দেখতে পায় না। নিজের অজান্তেই আমরা সবাই একটা চাপা শব্দ করলাম। করলাম এই

মেয়েটা খুব শান্ত ভঙ্গিতে এসে শান্তার পাশে বসে পড়ল, তারপর হাতের সাদা লাঠিটা ভাজ করে তার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো কিছু দেখছে না কিন্তু তাকিয়ে আছে, কী আশ্চর্য!

বাংলা স্যারও কেমন যেন অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমরা যেরকম জানি না এই স্যারও জানেন না–তাই খানিকক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে আমতা আমতা করে বললেন, “তু-তু-তুমি অন্ধ?”

মেয়েটা বলল, “আমি চোখে দেখতে পাই না।” কথা শুনে মনে হল অন্ধ আর চোখে দেখতে না পাওয়া দুটি পুরোপুরি ভিন্ন জিনিস। উচ্চারণটা খুব সুন্দর মনে হয় কেউ টেলিভিশনে খবর পড়ছে।

বাংলা স্যার বললেন, “তুমি যদি চোখে না দেখো তা হলে পড়ালেখা করবে কেমন করে?”

“ব্রেইল বই পাওয়া যায়।”

“কী বই?”

“ব্রেইল। হাত দিয়ে ছুঁয়ে পড়তে হয়।”

“পরীক্ষা? পরীক্ষা দিবে কেমন করে?”

“আমি বলব আর একজন লিখে দেবে।”

স্যারের মুখে বিদঘুটে একটা হাসি ফুটে উঠল, “খ্যাঁক” ধরনের একটা শব্দ করে বললেন, “ধুর। এইভাবে লেখাপড়া হয় না কি! আর তোমার লেখাপড়া করে কী লাভ? তুমি কী ডাক্তার হবে না ইঞ্জিনিয়ার হবে? ভালো মানুষেই চাকরি পায় না কানা ল্যাংড়া লুলা মানুষকে কে চাকরি দিবে?”

আমি তখন বুঝতে পারলাম কেন নতুন ম্যাডাম গ্রহণ করার কথা বলেছিলেন। বাংলা স্যার যেটা করছেন সেটা যেন না হয় সেইটাই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। যেটা করার কথা না বাংলা স্যার ঠিক সেইটাই করছেন। তাকে কেমন করে থামানো যায় বুঝতে পারলাম না। স্যার মনে হল আরো নিষ্ঠুর হয়ে গেলেন, হাত-পা নাড়িয়ে বললেন, “চোখ হাত-পা ঠ্যাং আছে এরকম ছেলেমেয়েদের পড়াতেই আমার জান তামা হয়ে যায় এখন যদি চোখ হাত-পা ঠ্যাং নাই কানা ল্যাংড়া আঁতুড়কে পড়াতে হয় তা হলে আমি কেমন করে পড়াব? আমার কি এতো সময় আছে?”

আমরা সবাই দেখলাম নতুন মেয়েটার দুই গাল লজ্জায় অপমানে লাল হয়ে উঠল। আমাদেরও মনে হল লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাই। স্যার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “বোবা কালা অন্ধদের স্পেশাল স্কুল আছে না?”

মেয়েটা মাথা নাড়ল, “আছে।”

“তুমি সেই স্কুলে পড় না কেন?”

“আমি সেইরকম স্কুলেই পড়তাম। কিন্তু—”

”কিন্তু কী?”

“এখন সারা পৃথিবীতেই সব রকম প্রতিবন্ধীদের সাধারণ স্কুলে পড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সেই জন্যে–”

বাংলা স্যার কেমন যেন খেপে উঠলেন, বললেন, “সেই জন্যে এইটা আমাদের স্কুলে শুরু করতে হবে? যতরকম পাগলামি-ছাগলামি সব এই স্কুলে? সব ঝামেলা আমাদের উপর? আমাদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই?” স্যার একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, “আমি যখন ক্লাসে পড়াব তুমি সেটা কেমন করে ফলো করবে?”

“আমি সেটা শুনতে পাই। তা ছাড়া আমি রেকর্ড করি–”

“কী কর?”

“আমার একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আছে, আমি সেটাতে সবকিছু রেকর্ড করি।”

বাংলা স্যার এবারে কেন জানি একটু থতমত খেয়ে গেলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “বেকর্ড কর?”

“হ্যাঁ।”

“আমি যখন ক্লাস নেওয়া শুরু করব তখন তুমি রেকর্ড করা শুরু করবে?”

“আমি ক্লাসে আসার পরই রেকর্ড করা শুরু করেছি।”

বাংলা স্যার এবারে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে আমি এতক্ষণ যা যা বলেছি সব রেকর্ড হয়ে গেছে?”

“জি স্যার।” মেয়েটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল, “আসলে স্যার আমি এই স্কুলে আসতে চাইনি। আমি আমাদের স্কুলেই খুব ভালো ছিলাম। কিন্তু ডক্টর রাইসা জোর করলেন তাই এসেছি। রাইসা ম্যাডাম বলেছেন ছয় মাস দেখতে। যদি ছয় মাসে ঠিকভাবে কাজ না করে তা হলে আমার স্কুলে ফিরে যাব।“

মেয়েটা তার ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা ছোট লাঠিটা বের করল, ছেড়ে দিতেই সেটা লম্বা হয়ে গেল। লাঠিটা মেঝেতে ছুঁইয়ে সে বলল, “স্যার আসলে ছয় মাস লাগবে না, আমি কিছুক্ষণেই বুঝে গেছি এটা কাজ করবে না। আপনি যদি অনুমতি দেন তা হলে আমি যাই।”

বাংলা স্যার আমতা আমতা করে বললেন, “আর ইয়ে-মানে রেকর্ডিং-”

“সেটা শুনলে কেউ আর আমাকে জোর করবে না।”

মেয়েটা তার ব্যাগটা নিয়ে দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমার আব্বু নিশ্চয়ই এখনো চলে যান নাই।” মেয়েটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সরি যে আমার জন্যে তোমাদের এতো সময় নষ্ট হল। প্লীজ তোমরা কিছু মনে কোরো না।”

মেয়েটা যখন ঠিক দরজার কাছে গিয়েছে তখন আমার কী হল কে জানে আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে বললাম, “দাঁড়াও।”

আর কী আশ্চর্য, পুরো, ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “দাঁড়াও। দাঁড়াও!”

রিতু, শান্তা আর মামুন মেয়েটার দিকে ছুটে গেল। রিতু খপ করে মেয়েটার হাত ধরে বলল, “না তুমি যেতে পারবে না। তুমি আমাদের সাথে পড়বে।”

শান্তাও তাকে ধরে ফেলল, বলল, “হ্যাঁ পড়বে। আমাদের সাথে পড়বে। তোমাকে আমরা যেতে দেব না।”

ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হুড়মুড় করে ছুটে যেতে থাকে, চারিদিক দিয়ে মেয়েটাকে ঘিরে ফেলল, সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করে বলতে লাগল, “যেতে দেব না। যেতে দেব না। আমাদের সাথে পড়তে হবে। পড়তে হবে।”

আমি খুব কাছে থেকে মেয়েটার দিকে তাকিয়েছিলাম, মেয়েটার চোখ দুটো কী সুন্দর, একেবারে ঝকঝক করছে, কিন্তু সে এই চোখ দুটো দিয়ে তাকাতে পারে কিন্তু দেখতে পারে না। আমি দেখলাম তার চোখ দুটোতে পানি টলটল করছে, সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে ফিসফিস করে বলল, “থ্যাংকু। তোমাদের অনেক থ্যাংকু।”

মেয়েটা হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু ছেলেমেয়েরা তাকে আটকে রাখল, রিতু বলল, “আমরা তোমাকে যেতে দেব না। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না,

আমরা তোমার সবকিছুতে সাহায্য করব। তোমার কোনো সমস্যা হবে না।”

শান্তা বলল, “আমরা তোমার পাশে বসব, স্যারেরা বোর্ডে কিছু লিখলে সেটা তোমাকে পড়ে শোনাব।”

সুজন বলল, “পরীক্ষার সময় তুমি বলবে আমি লিখে দিব।”

মেয়েটা বলল, “কিন্তু আমি তো এখানে থাকতে পারি না।”

সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, “কেন? কেন পার না?”

“তোমরা তো জান কেন পারি না। তোমরা তো দেখেছ, শুনেছ। তোমরাই বল, এরপর আমি কি এখানে থাকতে পারি? থাকা উচিত?”

আমরা কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমাদের মাঝে রিতু সবচেয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে সবাই তার দিকে তাকালাম, তখন রিতু মেয়েটার হাত ধরে বলল, “কিন্তু তুমি আমাদের কথাটা একটু ভাববে না? তুমি যদি আজকে চলে যাও সারাটা জীবন আমাদের মনে কষ্ট থাকবে যে তোমার মতোন একটা সুইট মেয়েকে আমরা আমাদের ক্লাসে রাখতে পারিনি। বল, তুমি কি একজনের জন্যে আমাদের সবার মনে সারা জীবন কষ্ট দিবে? বল?”

মেয়েটা কোনো কথা বলল না। আমার মনে হল রিতুর পা ধরে সালাম করে ফেলি, রিতুর মতোন পুঁচকে একটা মেয়ে এতো সুন্দর করে কথা বলা শিখল কেমন করে? সুজন গলা নামিয়ে বলল, “দরকার হলে তুমি থাকবে। আমরা ঐ স্যারকে বিদায় করে দিব।”

অনেকেই সুজনের কথা শুনে মাথা নাড়ল, মাসুম বলল, “আমার কানের পর্দা ফাটিয়েছিলেন মনে নাই? এতোদিন কিছু বলি নাই, এখন দরকার হলে হাইকোর্টে মামলা করে দিব।”

বাংলা স্যার একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না, ঠিক কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে তোমরা সবাই নিজের জায়গায় গিয়ে বস–”

আমরা নিজের জায়গায় বসার কোনো আগ্রহ দেখালাম না, মেয়েটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমাদের ক্লাসের হট্টগোল শুনে পাশের ক্লাস থেকে স্যার আর ম্যাডামরা বের হয়ে এলেন, ছাত্রছাত্রীরা উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। তখন রিতু আর শান্তা মেয়েটাকে দুই পাশ থেকে ধরে রীতিমতো টেনে ক্লাসের ভেতর ফিরিয়ে আনল।

বাংলা স্যার তার শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বললেন, “ব্যস অনেক হয়েছে। এখন সবাই চুপ কর। চুপ।”

আমরা চুপ করলাম না, ক্লাসের ভেতরে নিজেদের ভিতরে গুনগুন করে কথা বলতে লাগলাম। স্যার আবার দুর্বল গলায় বললেন, “চুপ।” কিন্তু কেউ চুপ করল না।

তখন রিতু উঠে দাঁড়াল, বলল, “স্যার।”

সাথে সাথে সারা ক্লাস চুপ করে গেল। স্যার একবার ঢোক গিলে বললেন, “কী হয়েছে?”

“আজকে আমাদের সাথে একজন নতুন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। স্যার সে মন খারাপ করে চলে যাচ্ছিল। আমরা অনেক কষ্ট করে তাকে ফিরিয়ে এনেছি।”

“তাতে কী হয়েছে?”

“আমরা চাই না সে মন খারাপ করে থাকুক।”

ক্লাসের অনেকেই মাথা নাড়ল। বলল, “জি স্যার, চাই না।”

“তা হলে কী করতে হবে?”

“আমরা স্যার নিরিবিলি তার সাথে কথা বলতে চাই।”

স্যার একবার ঢোক গিললেন, “নিরিবিলি?”

রিতু মাথা নাড়ল, বলল, “জি স্যার। আমরা আমরা নিজেরা। আপনি স্যার এই পিরিয়ডটা ছুটি দিয়ে দেন।”

“ছুটি?” স্যার চোখ কপালে তুলে বললেন, “ছুটি?”

আমরা সবাই বললাম, “জি স্যার ছুটি।”

স্যার এবারে কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন, তখন সুজন দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার আপনি যদি চান তা হলে আমরা হেড ম্যাডামের কাছ থেকে পারমিশান আনতে পারি। ক্লাসে কী হয়েছে সেটা বললেই ম্যাডাম নিশ্চয়ই রাজি হবেন–”

স্যার এবারে কেমন যেন খাবি খাওয়ার মতো ভান করলেন, বললেন, “না-না তার দরকার নাই। আ-আমি ছুটি দিচ্ছি। কিন্তু তোরা ক্লাসে কোনো গোলমাল করতে পারবি না।”

আমরা সবাই একসাথে চিৎকার করে প্রচণ্ড গোলমাল করে বললাম, “করব স্যার। গোলমাল করব না।”

স্যার হাত তুলে বললেন, “আস্তে আস্তে!” তারপর টেবিল থেকে রেজিস্টার খাতা, বই, চক আর ডাস্টার নিয়ে বের হয়ে গেলেন। আমরা তখন আরো একবার আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।

স্যার ক্লাস থেকে বের হওয়া মাত্রই রিতু ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “সবাই চুপ। কোনো গোলমাল করবি না।”

আমরা এবারে চুপ করে বসে পড়লাম, রিতু তখন মেয়েটার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে সামনে নিয়ে আসে। তারপর বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলল, “প্রিয় ভাই ও বোনেরা। আজকে আমাদের সাথে একজন নতুন ছাত্রী পড়তে এসেছে। আরেকটু হলে সে মন খারাপ করে চলে যাচ্ছিল। আমরা অনেক কষ্ট করে তাকে ফিরিয়ে এনেছি। আমরা এখন আমাদের এই নতুন বন্ধুকে আমাদের উদ্দেশে কিছু বলতে বলব।”

মেয়েটা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, বলল, “বলব? আমি?”

‘“হ্যাঁ।”

“কী বলব?”

“তোমার যেটা ইচ্ছা।”

“আমি কখনো এভাবে কিছু বলি নাই। আমি কিছু বলতে পারব না।”

“পারবে। পারবে।” আমরা টেবিলে থাবা দিয়ে বললাম, “শুরু কর।”

মেয়েটা একটু ইতস্তত করে তখন শুরু করল, “ইয়ে মানে আমার নাম হচ্ছে–মাইশা হাসান। আমার ডাকনাম হচ্ছে আঁখি।” মেয়েটা একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, “আঁখি মানে হচ্ছে চোখ। আমার আব্লু-আম্মু যদি আগে জানত তা হলে আমার মনে হয় কখনোই আমার নাম আঁখি রাখত না। অন্য কিছু রাখত।”

সুমি সাধারণত কথা বলে না, হঠাৎ করে সে বলল, “তোমার চোখগুলো দেখতে খুব সুন্দর। আঁখি নামটা মনে হয় ঠিকই আছে।”

সুজন বলল, “তোমার চোখ তো এক্কেবারে ঠিক আছে। তুমি সত্যি দেখতে পাও না?”

“না।”

“একটুও না? হালকা হালকা?”

“না।”

“খুব দামি চশমা কিনে দিলে-”

আঁখি হেসে ফেলল, বলল, “আমার চোখের সবকিছু ঠিক আছে। যেটা নষ্ট হয়েছে সেটা হচ্ছে অপটিক নার্ভ। রেটিনা থেকে কোনো সিগন্যাল ব্রেন পর্যন্ত যায় না। সেই জন্যে আমি কিছু দেখি না।”

“কোনো চিকিৎসা নাই?”

“যেটুকু ছিল করা হয়েছে। লাভ হয়নি।”

ক্লাসের সবাই জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করল, কেউ নিশ্বাস ফেলল, যাদের মায়া বেশি, তারা বলল, “আহারে।” আঁখি হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে, সে মুখ তুলে বলল, “তোমরা আমার জন্যে কিছু একটা করতে চাইছ?”

আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ।”

“আমি কী চাই, তোমাদেরকে বলব?”

“বল।”

“আমি চাই তোমরা সবাই ভুলে যাও যে আমি চোখে দেখতে পাই না। আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিংবা অন্ধ অথবা রাইড। আমি চাই তোমরা আমাকে অন্য আরেকজনের মতো নাও! আমি চাই তোমরা কেউ আমার জন্যে আলাদা করে কিছু না কর–”

শান্তা জিজ্ঞেস করল, “তা হলে তোমার ঝামেলা হবে না?”

“হবে। অনেক ঝামেলা হবে। অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু যখন কেউ আমাকে মায়া করে, আমাকে দেখে দুঃখ পায়, আহা উঁহু করে তখন আমার আরো অনেক বেশি কষ্ট হয়।”

আমরা সবাই চুপ করে বসে রইলাম, এরকম একটা ব্যাপার থাকতে পারে আমরা কখনোই চিন্তা করিনি। কেন জানি ধরেই নিয়েছিলাম সবসময়ই বুঝি সবাইকে গায়ে পড়ে সাহায্য করতে হয়। কখনো কখনো কাউকে সাহায্য না করাটাই হচ্ছে তাকে সাহায্য করা। কী আশ্চর্য!

রিতু বলল, “ঠিক আছে আঁখি, আমরা সবাই ভুলে যাব যে তুমি চোখে দেখতে পাও না! আমরা সবাই সবসময় তোমার সাথে এমন ব্যবহার করব যেন তুমি আমাদের মতো একজন!”

“ভেরি গুড। থ্যাংকু।”

“ঠিক আছে।” রিতু সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা সবাই ভুলে যা। ওয়ান টু থ্রি!”

আমরা সবাই বললাম, “ওয়ান টু থ্রি।” তারপর ভান করলাম আমরা ভুলে গেছি। রিতু তখন আঁখির দিকে তাকিয়ে বলল, “আঁখি, তুমি আমাদের ক্লাসে ভর্তি হয়েছ এখন তোমার এই ক্লাসের ছেলেমেয়ের সাথে পরিচয় হওয়া দরকার। সবার আগে আমার সাথে পরিচয় হোক। আমাকে দেখছ?”

আঁখি বলল, “দেখছি।”

“বল দেখি আমি দেখতে কী রকম?”

“তুমি কালো এবং মোটা এবং তোমার নাকের নিচে ছোট ছোট গোঁফ।”

আমরা সবাই হি হি করে হাসতে লাগলাম, রিতু হাসল সবচেয়ে বেশি এবং হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। সুজন দাঁড়িয়ে বলল, “আমি কী রকম?”

“তোমার মাথা ন্যাড়া। তোমার গলায় সোনার চেন।”

সুজনের সাথে সাথে আমরা সবাই হি হি করে হাসতে লাগলাম।

শান্তা বলল, “আমি?”

“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার নাকের উপর দিয়ে একটা ট্রাক চলে গিয়েছে–তাই নাকটা চ্যাপ্টা।”

আমরা সবাই হি হি করে হাসতে লাগলাম তখন রিতু আবার আমাদের থামাল, বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আঁখি যে খুবই ভালো দেখতে পায় সেটা নিয়ে এখন আমাদের কারো কোনো সন্দেহ নেই। এখন তোমার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। এই যে আমি, কালো মোটা এবং নাকের নিচে গোঁফ আমার নাম হচ্ছে রিতু। মনে থাকবে? রি-তু।”

“মনে থাকবে।”

শান্তা বলল, “আমার নাম শান্তা।”

সুমি বলল, “আমার নাম সুমি।”

সুজন বলল, “আমার নাম সুজন।”

এভাবে সবাই তার নাম বলল আঁখি খুব মনোযোগ দিয়ে নামগুলো শুনল। আমি যখন বললাম, “আমার নাম তিতু।” তখন সবাই চিৎকার করে বলতে লাগল, “তিতা তিতা।”

আঁখি তাদের চিৎকারে কান দিল না, বলল, “তিতু।”

.

টিফিনের ছুটিতে আমরা ক্লাস থেকে বের হয়েছি তখন উঁচু ক্লাসের একটা ছেলে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এই, তোদের ক্লাসে না কি একটা অন্ধ মেয়ে ভর্তি হয়েছে?”

আমি অবাক হওয়ার ভান করলাম, “তাই না কি?”

“তুই জানিস না?”

“একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু অন্ধ কী না সেটা খেয়াল করি নাই।”

ছেলেটা মামুনকে জিজ্ঞেস করল, “তুই জানিস না?”

 মামুন ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “নাহ্। জানি না তো।”

.

রাতে খাবার টেবিলে আমি বললাম, “আজকে আমাদের ক্লাসে নতুন একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছে।”

সবাই আমার দিকে তাকাল, এরপরে কী বলব সেটা শোনার জন্যে। আমি বললাম, “মেয়েটা খুবই ফানি। রিতুকে দেখে বলে সে না কী কালো আর মোটা আর নাকের নিচে গোঁফ।” আমি কথা শেষ করে হি হি করে হাসলাম।

ভাইয়া জিজ্ঞেস করল, “রিতু মেয়ে না? মেয়েদের গোঁফ থাকে না কি?”

“নাই। রিতু চিকন-চাকন ফর্সা।”

“তা হলে?”

“বললাম না মেয়েটা খুব ফানি।”

ভাইয়া কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুই খুবই আজব।”

আব্বু আর আম্মু কিছু বললেন না, কিন্তু তাদের মুখ দেখে বোঝা গেল তারাও সেটাই ভাবছেন। আমি খুবই আজব!

.

০৪.

যখন আমরা অভ্যস্ত হলাম আঁখির সাথে আর আঁখি অভ্যস্ত হল আমাদের সাথে

আমরা কয়েকদিনের মাঝেই আঁখিকে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। প্রথমদিন বাংলা স্যার তার সাথে যেরকম খারাপ ব্যবহার করেছিলেন অন্য কোনো স্যার আর ম্যাডাম তার সাথে এরকম ব্যবহার করার চেষ্টা করেননি। অন্য স্যার-ম্যাডামেরা খুব ভালো তা নয়–কেউ কেউ আরো অনেক বেশি ভয়ংকর ছিলেন কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের নতুন ম্যাডাম ব্যাপারটা টের পেয়ে আগে থেকে সবাইকে ভালো মতোন টিপে দিয়েছিলেন। ক্লাসে এসে সবাই ভান করতে লাগলেন চোখে দেখতে পায় না এরকম একটা মেয়ে ক্লাসে থাকা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

আঁখি সবসময় সামনের বেঞ্চে বসত, আমি সবসময় বসতাম পিছনে। পিছনে বসলে স্যার-ম্যাডামের চোখের আড়ালে থাকা যায়, তাদের যখন হঠাৎ হঠাৎ প্রশ্ন করার ঝোঁক হয় তখন সামনের জনের পিছনে লুকিয়ে যাওয়া যায়। একদিন একটু আগে ক্লাসে এসে দেখি এর মাঝে আঁখি এসে তার জায়গায় বসে পা দুলাচ্ছে। আমি ঢুকতেই বলল, “তিতু, আজ এতো সকালে এসেছ?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুমি কীভাবে বুঝলে আমি তিতু।”

আঁখি হাসল, “এটা হচ্ছে খোদার এক ধরনের খেলা–চোখে যখন দেখতে দিচ্ছি না তা হলে কানে বেশি করে শুনতে দেই।”

“কিন্তু আমি তো কোনো কথা বলি নাই।”

“তাতে কী হয়েছে! আমি পায়ের শব্দ শুনতে পাই। নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।”

আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম, “তুমি আমার পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পেরেছ আমি কে?”

“হ্যাঁ তুমি যেভাবে শব্দ করে পা ঘষতে ঘষতে হাঁটো তোমার হাঁটার শব্দ শুনলে যে কেউ দুই মাইল দূর থেকে বুঝতে পারবে তুমি কে।”

আমি কখনো জানতাম না যে আমি শব্দ করে পা ঘষতে ঘষতে হাঁটি। আঁখি হাসি হাসি মুখ করে বলল, “পিছনে গিয়ে বসবে?”

“হ্যাঁ।”

“সাহসী বীর।”

“তুমি ভাবছ আমি সামনে বসতে ভয় পাই?”

“বসে দেখাও।”

কাজেই আমাকে সামনের বেঞ্চে বসতে হল। আমি আঁখির পাশেই বসলাম। আঁখির পাশে বসে আমি আবিষ্কার করলাম সে যদিও চোখে দেখতে পায় না কিন্তু কানে আশ্চর্য রকম সূক্ষ্ম শব্দ শুনতে পায়। যেরকম বজলু ক্লাসে ঢোকার অনেক আগেই সে বলল, “বজলু আসছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুমি কেমন করে বুঝলে?”

“ওর জ্যামিতি বক্সটা ঝুনঝুন শব্দ করে।” আমি বজলুর পাশে থেকেও তার জ্যামিতি বক্সের ঝুনঝুন শব্দ শুনতে পেলাম না। যখন শান্তা ক্লাসে ঢুকল তখন আঁখি বলল, “শান্তা চুইংগাম খাচ্ছে।” মানুষ চুইংগাম খেলে যে শব্দ হয় আমি সেটাও আগে জানতাম না। আমি সবচেয়ে অবাক হলাম যখন তার সাথে কথা বলতে বলতে দেখলাম হঠাৎ তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”

“মা পাখিটা এসেছে।”

“মা পাখি? কোথায়?”

“আমি পিছনের জানালায় একটু চাল রেখেছি। মা পাখিটা তার বাচ্চাকাচ্চাকে নিয়ে সেগুলো খেতে এসেছে।”

“চাল? তুমি চাল এনেছ?”

“হ্যাঁ পাখির শব্দ শুনেছিলাম তো, তাই ব্যাগে করে প্রত্যেক দিন একটু চাল নিয়ে আসি। জানালার কাছে রাখি। একটা মা পাখি আর তার দুইটা বাচ্চা সেটা খেতে আসে।”

আমি আঁখির কথা বিশ্বাস করলাম না, তাই উঠে জানালার কাছে গিয়ে দেখতে হল, সত্যিই কয়েকটা পাখি কিচিরমিচির করছে। এর মাঝে কোনটা মা পাখি কোনটা বাচ্চাকাচ্চা পাখি বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখে পাখিগুলো শব্দ করে উড়ে গেল।

আমি যখন আঁখির কাছে ফিরে এলাম সে জানতে চাইল, “পাখিগুলো দেখতে কীরকম?”

“কালো রংয়ের। লম্বা লেজ।”

“বাচ্চাগুলো কত বড়?”

“কী জানি–কোনটা বাচ্চা কোনটা মা বুঝতে পারলাম না।”

“ঠোঁটগুলো কী রঙের?”

“খেয়াল করিনি।”

আঁখি তখন ছোট একটা নিশ্বাস ফেলল এবং আমি বুঝতে পারলাম আমি একটা জিনিস দেখেও সেটা লক্ষ করি না, আর বেচারি আঁখি সেটা কোনোদিন দেখতে পাবে না, আমার মুখ থেকে সেটা জেনেই সন্তুষ্ট হতে চায়। সেটাও আমি ঠিক করে করলাম না।

আমি তখন আঁখির এই নতুন ব্যাপারটা আবিষ্কার করলাম। শুধু শব্দ শুনে সে অনেক কিছু বুঝে ফেলে কিন্তু অনেক কিছু আছে যেগুলোর কোনো শব্দ নেই-আঁখি সেগুলোও জানতে চায়। নিজে থেকে সে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে না, কিন্তু যদি তাকে বলা হয় সে খুব আগ্রহ নিয়ে শোনে। আমি যখন তার পাশে বসেছিলাম তখন বাংলা স্যার ঢোকার পর সে আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আজকে কী রঙের কোট পরে এসেছেন?”

“সবুজ।”

“আজকেও সবুজ?”

“হ্যাঁ।”

“আহা বেচারা। একটা মাত্র কোট–তাও সবুজ রঙের।”

কিংবা যখন অঙ্ক ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেন তখন জিজ্ঞেস করল, “কী রঙের শাড়ি?”

আমি বললাম, “কী জানি। অনেক রকম রং আছে। ফুল টুল অনেক কিছু।”

“ব্লাউজটা কী রঙের?”

“বেগুনি। না কী নীল-”

“কপালে টিপ আছে?”

“নাই।”

“চশমা?”

“আছে।”

মাঝে মাঝে আমি নিজে থেকে তাকে কিছু কিছু জিনিস বলে দিই–যেরকম সমাজবিজ্ঞান ক্লাসে আমাদের কিছু একটা লিখতে দিয়ে যখন স্যার টেবিলে পা তুলে বসে রইলেন আমি আঁখিকে ফিসফিস করে বললাম, “এই যে স্যার এখন নাকের নোম ছেঁড়ার চেষ্টা করছেন। প্রথম চেষ্টা ফেইল। সেকেন্ড চেষ্টা–ওয়ান টু থ্রি পাস। লোমটা এখন খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছেন। মুখে হাসি।” শুনে আঁখিও হাসে।

যখন ক্লাসের ফাঁকে ছেলেপিলেরা নিজেদের মতো বসে থাকে তখন আমিও সেটা আঁখিকে শোনালাম, “বজলু ডান হাতের কেনে আঙুল কানের ভিতরে ঢুকিয়ে চুলকাচ্ছে একশ মাইল স্পিডে শই শাঁই শাই–” কিংবা ”মামুন একটা হাই তুলেছে, বিশাল হাই আলজিহ্বা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে–” কিংবা, “শান্তা নিজের মনে মনে কথা বলছে, চোখ পাকালো আবার নরমাল আবার চোখ পাকালো–”

খুবই সাধারণ জিনিস কিন্তু আঁখি খুবই আগ্রহ নিয়ে শোনে! আঁখিকে বলতে গিয়ে আমিও আবিষ্কার করলাম আমাদের চারপাশে যা কিছু হতে থাকে সেগুলো খুবই সাধারণ কিন্তু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যায় তার মাঝেই অসাধারণ ফাটাফাটি জিনিস লুকিয়ে আছে। যেমন ইংরেজি স্যারের ডান চোখটা যে মাঝে মাঝে চিড়িক চিড়িক করে নড়ে ওঠে সেটা আমি আগে কখনোই লক্ষ করিনি। আঁখি শোনার পর খুবই গম্ভীর হয়ে বলল, “এটার নাম টিক। নার্ভাস মানুষদের না কী এগুলো হয়।” আমি একবারও ভাবিনি আমাদের এতো গুরুগম্ভীর ইংরেজি স্যার আসলে নার্ভাস।

আমরা যেরকম আঁখিকে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি আঁখিও মনে হয় এই নতুন স্কুলে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে স্কুলে আসে বেশ আগে, সাধারণত তার আব্বু নামিয়ে দিয়ে যান। ক্লাসে এসে টেবিলে বই রেখে প্রায় সময়ই সে বের হয়ে স্কুলের পিছন দিকে চলে যায়। সেখানে বড় বড় কয়েকটা গাছ আছে, সেই গাছগুলোতে পাখির কিচিরমিচির শোনা তার খুব প্রিয় একটা কাজ। ছোট ক্লাসের বাচ্চাগুলো সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে। তাদের গলার স্বর শুনে শুনে সে প্রায় সবগুলো বাচ্চাকে আলাদা করতে পারে-কারো নাম জানে না, কখনো দেখেনি শুধু গলার স্বর দিয়ে আলাদা আলাদা করে চেনা কাজটা মোটেও সোজা না–কিন্তু আঁখির কাছে সেটা কোনো ব্যাপারই না।

দুপুরবেলা আমরা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলতাম-আমাদের প্রিয় খেলা ছিল ক্রিকেট না হয় সাতচাড়া। স্কুলের লাইব্রেরিটা চালু হবার পর আমরা খুব উৎসাহ নিয়ে লাইব্রেরিতে বই পড়তে যেতাম-যখন আবিষ্কার করেছি লাইব্রেরিটা প্রত্যেক দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত খোলা, আমরা যখন খুশি লাইব্রেরিতে যেতে পারি, যে কোনো বই নিতে পারি–সবচেয়ে বড় কথা হঠাৎ করে আবার লাইব্রেরিটা বন্ধ হয়ে যাবে না–তখন আমরা আবার মাঠে ছোটাছুটি করে খেলতে শুরু করলাম। আমাদের এই দুইটা প্রিয় কাজ আঁখি করতে পারত না। লাইব্রেরিতে গিয়ে বইয়ে হাত বুলানো ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। মাঠে ক্রিকেট কিংবা সাতচাড়া খেলার কোনো প্রশ্ন আসে না। আমরা যখন মাঠে ছোটাছুটি করে খেলি আঁখি তখন বারান্দায় পা দুলিয়ে বসে আমাদের খেলা উপভোগ করে। চোখে না দেখেও যে এতো মজা করে কেউ খেলা উপভোেগ করতে পারে আঁখিকে না দেখলে আমরা সেটা বিশ্বাস করতাম না। আমাদের খুব ইচ্ছে করত আঁখিকে নিয়ে কোনো একটা কিছু খেলতে কিন্তু সে রকম কিছুই ভেবে বের করতে পারিনি। একমাত্র খেলা হতে পারে কানামাছি ভোঁ ভোঁ-সেই খেলায় কেউ নিশ্চয়ই আঁখিকে হারাতে পারবে না–কিন্তু আমরা সবাই তো বড় হয়ে গেছি এখন আমরা কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলি কেমন করে?

.

এর মাঝে একদিন নতুন ম্যাডাম আমাদের ক্লাস নিতে এলেন। আমাদের ভূগোল স্যারের বাবা মারা গেছেন, স্যার তাই বাড়ি গেছেন। প্রথম দিন ক্লাসে কেউ এল না তাই আমরা মহা ফূর্তি করে কাটালাম। আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন হচ্ছে আশরাফ, সে খুবই ভালো একজন ক্লাস ক্যাপ্টেন, আমরা যখন ক্লাসে হইচই করি তখন সে শুধু চোখ পাকিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ভয় দেখায়, “খবরদার গোলমাল করবি না, গোলমাল করলেই কিন্তু নাম লিখে স্যারদের দিয়ে দিব। পিটিয়ে তোদের বারোটা বাজিয়ে দেবে!” কিন্তু সে কখনোই আমাদের নাম লেখে না। মাঝে মাঝে সে ভান করে কারো একজনের নাম লিখে ফেলছে–আসলে শুধু হিজিবিজি লিখে রাখে। আমরা সবাই এতদিনে বুঝে গেছি আশরাফের মনটা খুবই নরম, সে কোনোদিন আমাদের কারো বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারবে না। তা ছাড়া আমরা জেনে গেছি আমাদের স্কুলে স্যার-ম্যাডামরা আর আমাদের মারতে পারবে না। নালিশ করলে তারা বড়জোর বকাবকি করতে পারে-বকাবকিকে কে আর ভয় পায়? তাই আমাদের ক্লাসে যদি কোনো স্যার-ম্যাডামের আসতে একটু দেরি হয় তা হলে ক্লাসের ভিতরে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে যায়–বাইরে থেকে যে কেউ মনে করতে পারে ভিতরে বুঝি কাউকে মার্ডার করা হচ্ছে। প্রথম দিন যখন স্যার এলেন না তখন আমরা এতো গোলমাল করলাম যে আশেপাশের ক্লাস থেকে নিশ্চয়ই সবাই নালিশ করেছিল, তাই পরের দিন ক্লাস শুরু হতেই আমাদের নতুন ম্যাডাম এসে হাজির হলেন। তাকে দেখে আমরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। নতুন ম্যাডাম আমাদের চিৎকার করতে দিলেন, তারপরে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “ব্যাপারটা কী? তোমাদের চিৎকারের জন্যে আমাদের স্কুলটাকে না আবার নিষিদ্ধ করে দেয়।”

সুজন দাঁত বের করে হেসে বলল, “দোষটা তো আপনারই ম্যাডাম।”

ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, “দোষ আমার?”

“জি ম্যাডাম। আপনি সবগুলো বেত পুড়িয়ে স্কুলে পিটাপিটি তুলে দিয়েছেন। এখন কেউ আর কোনো কিছুকে ভয়ডর পায় না। সবাই খুবই আনন্দ করে, দুষ্টুমি করে, গোলমাল করে।”

ম্যাডাম বললেন, “তা হলে কি তুমি বলছ আমি বাজার থেকে বেত কিনে এনে আবার নতুন করে পিটাপিটি শুরু করে দেব?”

আমরা সবাই দুই হাত ছুঁড়ে মাথা নেড়ে চিৎকার করে বললাম, “না-না-না। কক্ষনো না।”

“তা হলে চুপ করে বস সবাই-কথা বলি তোমাদের সাথে।”

আমরা সবাই তখন সাথে সাথে চুপ করে বসলাম। ম্যাডাম পুরো ক্লাসের দিকে একনজর তাকিয়ে বললেন, “আমি কয়েকদিন থেকে ভাবছিলাম তোমাদের ক্লাসে একবার আসি–কিন্তু সবকিছু নিয়ে এত ব্যস্ত যে একেবারে সময় করতে পারি না।” ম্যাডাম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “তোমাদের ক্লাসে কেন আমি আসতে চাচ্ছিলাম তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?”

আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, রিতু বলল, “জি ম্যাডাম। আপনি দেখতে চাচ্ছিলেন আমরা কি আঁখিকে জ্বালাচ্ছি না কি আদর যত্ন করছি!”

“ঠিক বলেছ।” ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, “আমি খুব বড় একটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম, তোমরা কেউ কিছু জান না তার মাঝে আমি আঁখিকে পাঠিয়ে দিলাম। যদি কিছু একটা গোলমাল হত-যদি আঁখি অ্যাডজাস্ট করতে না পারত, যদি মন খারাপ করত—”

আমরা সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করলাম, “ম্যাডাম গোলমাল হয়েছিল”

“সর্বনাশ হয়েছিল” “বাংলা স্যার যা খারাপ খারাপ কথা বলছিলেন” “নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর!” “ভয়ংকর অবস্থা” “পুরা বেইজ্জতি” “কী লজ্জা!”

ম্যাডাম হাত তুলে আমাদের থামালেন, বললেন, “আমি জানি। আমি সব খবর পেয়েছি। তোমরা ব্যাপারটা যেভাবে সামলে নিয়েছ তার কোনো তুলনা নেই।”

ম্যাডামের প্রশংসা শুনে আমরা সবাই আনন্দে দাঁত বের করে হাসলাম। ম্যাডাম বললেন, “কিন্তু যদি উল্টো ব্যাপারটা ঘটত? তোমাদের স্যার ঠিকভাবে নিতেন আর তোমরা নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে?”

আমরা প্রবল বেগে মাথা নাড়লাম, “না, না ম্যাডাম, আমরা কখনোই নিষ্ঠুর হতাম না।”

ম্যাডাম বললেন, “ছোট বাচ্চারা না বুঝেই অনেক সময় নিষ্ঠুর হয়ে যায়। গরু কোরবানি দেখলে আমাদের বয়সী মানুষের ভয়ে হার্ট ফেল হয়ে যায়, দেখবে ছোট ছোট বাচ্চারা অবলীলায় গরু জবাই দেখছে।”

ম্যাডামের কথা শুনে আমরা অনেকেই মাথা নাড়লাম, আমাদের অনেকেই গরু জবাই দেখেছি, এটা দেখে যে বড় মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায় আমরা জানতাম না। ম্যাডাম বললেন, “আমার একজন লেখক বন্ধু আছে তার খুব শখ বাচ্চাদের জন্যে বই লিখবে। সে তাই একটা বই লিখে বাচ্চাদের পড়তে দিয়েছে। পড়া শেষ হলে বাচ্চাদের কাছে জানতে চেয়েছে বইটা কেমন হয়েছে। বাচ্চারা কী বলেছে জান?”

“কী বলেছে?”

“বলেছে–এইটা আপনি কী লিখেছেন? পড়ে বমি এসে গেছে!”

আমরা সবাই হি হি করে হেসে উঠলাম। ম্যাডামও হাসলেন, একসময় হাসি থামিয়ে বললেন, “বাচ্চাদের কথা শুনে আমার সেই লেখক বন্ধু মনের দুঃখে লেখালেখিই ছেড়ে দিল।”

শান্তা বলল, “যে লেখা পড়লে বমি এসে যায় সেটা ছেড়ে দেওয়াই তো ভালো।”

ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, “এগুলো খুবই আপেক্ষিক ব্যাপার। কোনো একটা লেখা পড়ে হয়তো একজনের বমি এসে যাচ্ছে আরেকজনের হয়তো সেই লেখাটাই খুব ভালো লাগবে। তবে সেটি কথা নয়, কথা হচ্ছে এভাবে সেটা সোজাসুজি বলে ফেলাটা। শুধুমাত্র একটা ছোট বাচ্চাই এরকম নিষ্ঠুরের মতো সত্য কথা বলতে পারে। বড়রা পারে না। বড়রা সবসময় ভদ্রতা করে মিষ্টি করে কথা বলে।”

এরকম সময় আঁখি হাত তুলল, ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “আঁখি, তুমি কিছু বলবে?”

“জি ম্যাডাম।”

“বল।”

“আপনারা সবাই আমাকে নিয়ে কথা বলছেন। তা হলে কী আমাকে একটু জিজ্ঞেস করবেন না আমি ভালো আছি না খারাপ আছি? হয়তো আমি খুবই খুবই খারাপ আছি, হয়তো এরা সবাই আমাকে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জ্বালাতন করে, হয়তো আমার জান খারাপ করে দেয়, হয়তো আমার টিফিন চুরি করে খেয়ে ফেলে-”

ম্যাডাম একটু এগিয়ে এসে আঁখির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “খায় না কি?”

“এখনো খায় নাই।”

“তা হলে?”

”সেই জন্যেই তো রাগ করছি। আমার একেবারে খেতে ইচ্ছে করে না। কেউ চুরি করে খেলে কত ভালো হত-”

আমরা সবাই হি হি করে হাসলাম, সুজন বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে এখন থেকে চুরি করে খাব। কোনো চিন্তা নাই।”

বজলু বলল, “তোমার আম্মুকে বল ভালো ভালো নাস্তা বানিয়ে দিতে!”

ম্যাডাম বললেন, “এমনিতে সবকিছু ঠিক আছে আঁখি?”

“আছে ম্যাডাম।”

“নতুন স্কুলে ভালো লাগছে?”

“লেখাপড়া ছাড়া আর সবকিছু ভালো লাগছে।”

আমরা হি হি করে হাসলাম। ম্যাডাম বললেন, “ভেরি গুড! আমি সেটাই চাই। লেখাপড়া ছাড়া আর সবকিছু ভালো লাগুক। পৃথিবীতে এমন কোনো ছাত্রছাত্রী নেই যার লেখাপড়া ভালো লাগে। যদি দেখা যায় কারো লেখাপড়া ভালো লাগছে তা হলে বুঝতে হবে তার মাথায় গোলমাল আছে।”

আমাদের মাঝে রাজু লেখাপড়ায় সবচেয়ে ভালো, প্রতিবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। আমরা তার দিকে আঙুল দেখিয়ে আনন্দে চিৎকার করতে লাগলাম, “মাথায় গোলমাল! মাথায় গোলমাল!” বেচারা রাজু লজ্জা পেয়ে লাল নীল বেগুনি হতে লাগল। মুখ গোঁজ করে বলল, “আমি কি কখনো বলেছি লেখাপড়া করতে ভালো লাগে? করতে হয় তাই করি।”

আমরা রাজুকে আরো জ্বালাতন করতাম কিন্তু ম্যাডাম আমাদের থামালেন, বললেন, “আমাদের লেখাপড়ার স্টাইলটা খুব খারাপ সেই জন্যে তোমাদের এতো খারাপ লাগে। যখন আমরা স্টাইলটা ঠিক করব তখন দেখো এতো খারাপ লাগবে না!”

আমি ঠিক বুঝলাম না, লেখাপড়ার আবার স্টাইল কী। আর যদি থেকেও থাকে তা হলে সেটা আবার ঠিক করবে কেমন করে? আমি তাই হাত তুলে জিজ্ঞেস করলাম, “ম্যাডাম! লেখাপড়ার স্টাইল ঠিক করে কেমন করে?”

“যেমন মনে কর এই ক্লাস রুমটাবেঞ্চগুলো সারি সারি সাজানো-যারা সামনে বসেছে তারা আমাকে কাছে থেকে দেখছে কাছে থেকে কথা শুনছে। যারা পিছনে তারা দূর থেকে দেখছে দূর থেকে শুনছে। হয়তো সবসময় ভালো করে শুনছেও না। ক্লাসে স্যার-ম্যাডামরা কথা বলে যায়–তোমাদের নিশ্বাস বন্ধ করে শুনতে হয়। কিন্তু ক্লাস রুমটা মোটেও এরকম হবার কথা না–”

“কীরকম হবার কথা ম্যাডাম?”

ম্যাডামের চোখে-মুখে কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব ফুটে উঠল। হাত দিয়ে দরজাটা দেখিয়ে বললেন, “ঢুকতেই এখানে একটা অ্যাকুরিয়ামে থাকবে কিছু মাছ, ছোট ছোট কচ্ছপ। ওখানে একটা খরগোশের ফ্যামিলি। এখানে একটা কম্পিউটার।” দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখানে সারি সারি তাক, সেই তাক ভরা রাজ্যের বই। রঙের বাক্স। কাগজ কলম রং পেন্সিল। যন্ত্রপাতি ক্রু ড্রাইভার সায়েন্স কিট। ক্লাসের দেয়ালে চারিদিকে ব্ল্যাকবোর্ড। তোমরা বসবে ছোট ছোট গ্রুপে-একটা টেবিলের চারপাশে।” ম্যাডাম হাত দিয়ে দেখালেন, “এখানে কয়েকজন, ওখানে কয়েকজন। মেঝেতে কোথাও হয়তো কার্পেট, কেউ কেউ হয়তো সেখানেই বসবে। আর আমরা যারা পড়াব তারা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না পড়িয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াব, কখনো এখানে কখনো ওখানে। আমি হয়তো কিছুক্ষণ পড়ালাম তারপর তোমরা কথা বললে। নিজেরা নিজেরা আলোচনা করলে। পড়তে পড়তে হয়তো উঠে গেলে ওখানে টবে হয়তো গাছ লাগিয়েছ সেগুলোতে পানি দিলে। জানালার ওখানে হয়তো পাখি কিচিরমিচির করছে তাদের কিছু খেতে দিলে!” ম্যাডাম একটা নিশ্বাস ফেলে থামলেন, তার মুখটাতে কেমন যেন দুঃখ দুঃখ ভাব চলে এল। আমাদের এরকম একটা ক্লাস রুম দিতে পারছেন না–মনে হল সেই জন্যে তার মন খারাপ হয়ে গেছে।

আমি হাত তুলে বললাম, “ম্যাডাম।”

“বল।”

“আপনি যেগুলো বলেছেন তার কোনোটাই আমাদের নাই কিন্তু একটা আছে।”

“কোনটা আছে?”

“পাখি। আমাদের এখানে পাখি আসে, আর আঁখি সবসময় তাদের খেতে দেয়।”

“সত্যি?”

আঁখি একটু হেসে বলল, “জি ম্যাডাম।”

“কী পাখি জান?”

“আগে একটা ফিঙে আসত তার দুইটা বাচ্চা নিয়ে। এখন কয়েকটা চড়াই পাখিও আসে। দুপুরের দিকে তিনটা শালিক পাখি আসে।

“বাহ!” ম্যাডাম খুশি হয়ে বললেন, “কী সুইট!”

রিতু বলল, “আস্তে আস্তে অন্যগুলোও হয়ে যাবে ম্যাডাম। আপনি দেখবেন–”

“নিশ্চয়ই হবে। ক্লাস রুমটা অন্যরকম হতে একটু সময় লাগলে ক্ষতি নেই কিন্তু আমাদের–আই মিন শিক্ষকদের সবার আগে অন্যরকম হতে হবে! সেটা যতক্ষণ না হবে ততক্ষণ লাভ নেই।”

আমাদের ভূগোল পড়ানোর কথা ছিল কিন্তু ম্যাডাম পুরো ক্লাস গল্প করে কাটিয়ে দিলেন। নানারকম গল্প–কোনো কোনোটা শুনে আমরা হেসে কুটি কুটি হলাম, কোনো কোনোটা শুনে আমাদের চোখ ছলছল করে উঠল, কোনো কোনোটা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম আবার কোনো কোনোটা শুনে রাগে আমাদের রক্ত গরম হয়ে উঠল।

যখন ক্লাসের ঘণ্টা বাজল তখন আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেল। ম্যাডাম চক ডাস্টার নিয়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছিলেন আমরা তখন বললাম, “ম্যাডাম, আপনি এখন থেকে আমাদের এই ক্লাসটা নেন। প্লীজ ম্যাডাম!”

ম্যাডাম বললেন, “এটাই নিতে পারব কী না জানি না কিন্তু কোনো একটা ক্লাস নেব। নিশ্চয়ই নেব।”

সুজন বলল, “যদি না নেন তা হলে কি হবে বুঝতে পারছেন?”

“না বুঝতে পারছি না। কী হবে?”

“আমরা সবাই দোয়া করতে থাকব যেন–”

”যেন কী?”

“যেন আমাদের অন্য সব স্যার-ম্যাডামদের বাবা মারা যেতে থাকেন!” ম্যাডাম চোখ পাকিয়ে বললেন, “দুষ্ট ছেলে!”

আমরা সবাই হি হি করে হাসতে লাগলাম। ম্যাডাম ক্লাস থেকে বের হতে হতে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরা খুব একটা স্পেশাল ক্লাসে–তার কারণ এখানে স্পেশাল একজন ছাত্রী আছে। তোমরা সবাই মিলে তাকে দেখেশুনে রাখবে কিন্তু।”

আমরা সবাই একসাথে চিৎকার করে বললাম, “রাখব ম্যাডাম!”

.

এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে ঠিক করে দেখেশুনে রাখা নিয়ে যা একটা ব্যাপার ঘটল সেটা বলার মতো নয়!

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল