আঁখি এবং আমরা ক’জন – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

যখন আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাদের জীবনের কোথাও ছিটেফোঁটা আনন্দ নেই

কিছুদিন থেকে আমার দিনকাল বেশি ভালো যাচ্ছে না। আসলে শুধু কিছুদিন না–আমি যদি একটু চিন্তা করি তা হলে মনে হতে থাকে যে অনেকদিন থেকেই আমার দিনকাল বেশি ভালো যাচ্ছে না। আমি যদি সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে অনেকক্ষণ ধরে খুব গভীরভাবে চিন্তা করি তা হলে মনে হয় আমি বের করে ফেলতে পারব যে আসলে কখনোই আমার দিনকাল বেশি ভালো যায় নাই। (তবে আমি কখনোই কোনো কিছু নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি না-যে কোনো জিনিস নিয়ে একটুক্ষণ চিন্তা করলেই আমার কেমন জানি দম আটকে আসে।)

আমার যে দিনকাল ভালো যাচ্ছে না সেটা বোঝার জন্যে খুব বেশি চিন্তা করার দরকারও হয় না-চিন্তা না করেও সেটা বের করে ফেলা যায়। আমরা দুই ভাই, আমার বড় ভাইয়ের নাম টিটু আমার নাম তিতু। বড় ভাইকে সবাই ঠিক করে ডাকে টিটু, বেশিরভাগ মানুষ আমাকে তিতু না ডেকে ডাকে তিতা। যারা আবার একটু বেশি ঢং করতে চায় তারা মুখটা সুচালো করে নাকি সুরে বলে তেঁতো, তারপর এমনভাবে মুখের একটা ভঙ্গি করে যেন কেউ সত্যি সত্যি তাদের মুখে তেতো করলার রস ঢেলে দিয়েছে। আমি ঠিক করেছি বড় হওয়া মাত্রই হাইকোর্টে মামলা করে আমার নামটা বদলে ফেলব। কী নাম নেব এখনো ঠিক করি নাই–তবে সেই নাম নিয়ে কেউ যে ঢং করতে পারবে না সেটা আমি এখন থেকেই ঘোষণা দিয়ে রাখতে পারি।

আমাদের বাসায় আমরা টিটু তিতু এই দুই ভাই ছাড়াও আছে আমার আব্বু, আম্মু আর ফুলি খালা। আব্বু ব্যাংকে চাকরি করেন আম্মু একটা স্কুলে পড়ান আর বলা যেতে পারে ফুলি খালা আমাদের সবাইকে দেখেশুনে রাখেন। ফুলি খালার মেজাজ অবশ্যি খুবই গরম, দুই তিনদিন পরে পরেই চিৎকার করে বলেন, “আমি আর এই বাসায় থাকব না! এই বাসায় কোনো মানুষ থাকতে পারে না। এখানে কোনোরকম নিয়মনীতি নাই, কোনো রকম শৃঙ্খলা নাই, আমি একজন মানুষ কতো কাজ করব? বাসায় কাজ করি তার মানে কি আমি ক্রীতদাস? শপিংমল থেকে আমাকে কিনে এনেছে?”

ফুলি খালা ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছেন তাই কথাবার্তা বলেন শুদ্ধ ভাষায়। আমি ভুলভাল কথা বললে মাঝে মাঝে আমাকে শুদ্ধ করে দেন। আমাদের বাসায় আমরা সবাই ফুলি খালাকে ভয় পাই। সবচাইতে বেশি ভয় পান আম্মু আর তার থেকেও বেশি ভয় পান আব্বু। যখন ফুলি খালা কাছাকাছি থাকেন না তখন আম্মু চোখ পাকিয়ে বলেন, “এই ফুলিকে আমি বাসা থেকে বিদায় করব। কাজের বুয়া হয়ে আমাদের সাথে কী ভাষায় কথা বলে লক্ষ করেছ?”

আব্বু বলেন, “লক্ষ করি নাই আবার! সে কি ভলান্টারি কাজ করে? মোটেই। মাসের শেষে গুনে গুনে টাকা দেই। দুই ঈদে বোনাস।”

“গত ঈদে শাড়ি কিনে দিয়েছি।”

“কতো বড় সাহস–আমি রাত্রে টেলিভিশন দেখছি, আর আমাকে এসে বলে, অনেক রাত হয়েছে। টেলিভিশন বন্ধ করে ঘুমাতে যান। বলে খট করে টেলিভিশনটা বন্ধ করে দিল!”

আম্মু নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলেন। আবার যখন ফুলি খালা আশেপাশে থাকেন তখন দুইজনই একেবারে কেঁচোর মতো হয়ে যান। আম্মু আহাদি গলায় বলেন, “ফুলি, তোমার চিকেনটা আজকে যা ভালো হয়েছে কী বলব।”

আব্বু বলেন, “ইউ আর এ জিনিয়াস ফুলি। তোমার আসলে ফাইভ স্টার হোটেলের কুক হওয়া উচিত ছিল।”

আম্মু বলেন, “গ্রামের বাড়িতে তোমার সবাই ভালো আছে তো?”

আবু বলেন, “সামনের মাসে তোমাকে একটা মোবাইল টেলিফোন কিনে দেই। তা হলে যখন ইচ্ছা হবে বাড়িতে কথা বলতে পারবে।”

তখন ফুলি খালা মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন, “এর চাইতে লোহার শিক গরম করে আমার কপালে দুইটা ছ্যাকা দেন। মোবাইল ফোন আর টেলিভিশন এই দুই জিনিস আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। কে এই দুইটা জিনিস আবিষ্কার করেছিল কে জানে–তার ওপরে নিশ্চয়ই আল্লাহর গজব পড়বে।”

আবু আর আম্মু দুইজনেই ফুলি খালার কথার সাথে সাথে মাথা ঝাঁকাতে থাকেন। আম্মু বলেন, “ঠিকই বলেছ ফুলি। মোবাইল টেলিফোনে বেশি কথা বললে না কি ব্রেনের মাঝে ক্যান্সার হয়।”

আব্বু বলেন, “ইউ আর রাইট ফুলি। ইউ আর হান্ড্রেড পার্সেন্ট রাইট। পৃথিবী থেকে টেলিভিশন ব্যান করে দেওয়া দরকার! সময়ের কী ভয়াবহ অপচয়।”

এই হচ্ছে আমার আব্বু, আম্মু আর ফুলি খালা। তবে এই তিনজনকে নিয়ে আমার বেশি সমস্যা নাই–আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমার বড় ভাই টিটুকে নিয়ে। সে কিছুদিন আগেও ঠিকঠাক ছিল আস্তে আস্তে কেমন যেন আজব হয়ে গেল। এখন দিনরাত খালি সে পড়ে, পড়তে পড়তে তার চেহারার মাঝে ভালো ছাত্র ভালো ছাত্র ভাব চলে এসেছে। ঘাড়টা একটু কুঁজো, গলাটা চিকন, চোখ দুইটা গর্তের ভিতর এবং ঠোঁটের ওপর খুব হালকা গোঁফ ওঠার চিহ্ন। যতক্ষণ স্কুলে থাকে ভাইয়া কী করে আমি জানি না কিন্তু যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ সে গুনগুন গুনগুন করে নাকি সুরে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কিছু একটা মুখস্থ করে। আমি আর তার ধারেকাছে যাই না, গেলেই তার বইটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এই তিতা, দেখ দেখি আমার এই পৃষ্ঠাটা ঠিকমতোন মুখস্থ হয়েছে কি না।”

তারপর সে মুখস্থ বলে যেতে থাকে, “মহাকর্ষ বল ভর দুটির গুণফলের সমানুপাতিক এবং দুইটি ভরের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। উল্লেখ্য যে, মহাকর্ষ বল সার্বিকভাবে সংজ্ঞায়িত করার জন্যে একটি ধ্রুবক ব্যবহার করা হইয়াছে। এম কে এস পদ্ধতিতে এই ধ্রুবকের মান ছয় দশমিক ছয় সাত চার গুণন দশ ঊর্ধ্বঘাত ঋণাত্মক এগারো…”

ক্লাসের পড়া করার জন্যে আমাকেও মুখস্থ করতে হয় কিন্তু ভাইয়ার মতো দাড়ি কমাসহ মুখস্থ করতে আমি কাউকে দেখিনি। এই ব্যাপারটাতে সে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। আমার আব্বু আর আম্মু এখন ভাইয়ার উপরে খুব খুশি। বাসায় কেউ বেড়াতে এলেই আবু-আম্মু টিটুকে দেখিয়ে বলেন, “এই যে টিটু, আমাদের বড় ছেলে। লেখাপড়ায় খুব মনোযোগ। সামনের বার এসএসসি দিবে। পরীক্ষার এখনো দেড় বছর বাকি, এর মাঝে সারা বই মুখস্থ করে ফেলেছে।”

ভাইয়ার মুখে তখন অহংকারের একটা হাসি ফুটে ওঠে, সে তখন তার কুঁজো ঘাড়টা সোজা করার চেষ্টা করে। আমি সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু মাঝে মাঝেই আমাকে ডেকে আনা হয়। সামনে আসার পর আল্লু না হয় আম্মু দুজনেই হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলেন, “এই যে আমাদের ছোট ছেলে তিতু। পড়ালেখায় মনোযোগ নাই। বড় ভাইকে দেখেও কিছু শিখল না।”

যারা বেড়াতে আসেন তাদের মাঝে এক দুইজন ভালো মানুষ থাকে, তারা বলে, “আরে কী বলেন আপনি। কী ব্রাইট চেহারা তিতুর, দেখবেন একটু বড় হলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

অন্য কেউ কিছু বলার আগেই ভাইয়া বলে, “হবে না। আমি টেস্ট করেছি।”

“কী টেস্ট করেছ?”

“তিতু মুখস্থ করতে পারে না। যেমন মনে করেন একটা আস্ত পৃষ্ঠা মুখস্থ করতে আমার লাগে তেতাল্লিশ মিনিট। তিতু তিন ঘন্টাতেও পারে না। প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে।”

সবাই তখন দুশ্চিন্তায় মাথা নাড়ে। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকি। শুধু যে বাসায় কেউ বেড়াতে এলে আমাকে অপমান করা হয় তা নয়, এমনিতেই ভাইয়া সারাক্ষণ আমাকে অপমান করে যাচ্ছে। বন্ধুর কাছ থেকে হয়তো একটা ফাটাফাটি ডিটেকটিভ বই এনেছি, রাতে বসে বসে পড়ছি ওমনি ভাইয়া নাকি সুরে নালিশ করে দেবে, “আঁম্মু, তিঁতা আঁউট বঁই পড়ছে?” আম্মু এসে বইটা কেড়ে নেবেন। আমি হয়তো একটা অঙ্ক করার চেষ্টা করছি ওমনি ভাইয়া নালিশ করে দেবে, “আঁম্মু তিঁতা পঁড়ছে নাঁ।” আম্মু এসে চোখ পাকিয়ে বলবেন, “কী করছিস তিতু?”

আমি ভয়ে ভয়ে বলি, “অঙ্ক করছি।”

আম্মু বলেন, “অঙ্ক করার কী আছে? সময় নষ্ট করে লাভ কী? নোট বইয়ে সব অঙ্ক করে দেওয়া আছে। দেখে নে। এত টাকা দিয়ে নোট বই কিনে দিলাম কেন?”

তারপরেও মাঝে মাঝে বলি, “নিজে নিজে করতে চাচ্ছিলাম-”

“নিজে নিজে? নিজে নিজে করার কী আছে? তুই কি মনে করিস যারা এই নোট বইটা লিখেছে তুই তাদের থেকে বেশি জানিস?”

আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করলাম যে আমি বেশি জানি না। নোট বইটা লিখেছে একজন এক্সপার্ট হেড মাস্টার, আমি এক্সপার্ট হেড মাস্টার থেকে বেশি কেমন করে জানব?

তবে হেড মাস্টাররা যে সবসময় বেশি জানে সেইটা সত্যি নাও হতে পারে। আমাদের স্কুলের যে হেড মাস্টার আছেন সেই মানুষটা খুব বেশি জানেন বলে মনে হয় না। একদিন আমাদের বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছেন তখন মামুন জিজ্ঞেস করল, “স্যার, জলবিদ্যুৎ কেমন করে তৈরি করে?” মামুন হচ্ছে আমাদের ক্লাস সায়েন্টিস্ট। সে সবসময় সবাইকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে।

হেড মাস্টার তার দাড়ির মাঝে আঙুল চালিয়ে সেগুলো সোজা করতে করতে বললেন, “জল দিয়ে। অ্যাঁ জল মানে হচ্ছে অ্যাঁ পানি। হিন্দুরা বলে অ্যাঁ জল আমরা বলি অ্যাঁ পানি।” কথার মাঝে অ্যাঁ অ্যাঁ বলা স্যারের অভ্যাস।

“কিন্তু স্যার পানি দিয়ে ইলেকট্রিসিটি কেমন করে তৈরি হয়!”

হেড স্যার বললেন, “এইটাও জানিস না গাধা? অ্যাঁ?”

মামুন মাথা নাড়ল, “না স্যার।”

“উপর থেকে অ্যাঁ যদি পানি ফেলা হয় তখন আমরা অ্যাঁ কী দেখি? অ্যাঁ? আমরা দেখি অ্যাঁ স্পার্ক। পার্কটাই হচ্ছে বিদ্যুৎ। অ্যাঁ।”

মামুন ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু স্যার আমরা তো পানি ফেললে স্পার্ক দেখি না।”

হেড স্যার খ্যাক করে উঠলেন, “দেখি না মানে? অ্যাঁ অ্যাঁ? যখন ঝড়বৃষ্টি হয় তখন কোনোদিন অ্যাঁ বিজলি চমকাতে দেখিসনি অ্যাঁ? সেই একই ব্যাপার। অ্যাঁ। বুঝেছিস গাধা কোথাকার?”

মামুন কিছু বুঝে নাই আমরাও কেউ কিছু বুঝি নাই কিন্তু সেটা কারো বলার সাহস হল না। সবাই মাথা নেড়ে ভান করলাম যে বুঝেছি। তার কয়েকদিন পরে আমাদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠানের জন্যে একটা জেনারেটর এনেছে সেটা ভটভট করে বিকট শব্দ করে চলছিল, একজন মানুষ সেখানে কাজ করছিল, মামুন তাকে জিজ্ঞেস করল, “এইটা কী?”

মানুষটা বলল, “এইটা জেনারেটর।”

“এইটা দিয়ে কী করে?”

“ইলেকট্রিসিটি তৈরি করে।”

মামুন জ্ঞানী মানুষের মতো বলল, “জলবিদ্যুৎ তৈরি করলেই তো এইরকম ভটভট শব্দ করত না। ওপর থেকে পানি ফেললেই ইলেকট্রিসিটি তৈরি হত।”

শুনে মানুষটা খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে। মামুন গরম হয়ে বলল, “আপনি হাসেন কেন?”

“তোমার কথা শুনে।”

“আমি কী বলেছি?”

“তুমি বলেছ যে পানি ঢাললে ইলেকট্রিসিটি হয়। তা হলে তুমি যখন পিশাব করবে তখন সাবধান! অসুবিধা জায়গায় ইলেকট্রিক শক না খেয়ে যাও। হা হা। হা।” মানুষটা দাঁত বের করে হাসতেই থাকে।

মামুন বলল, “আমাদের হেড স্যার বলেছেন।”

মানুষটা তার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “তোমার হেড স্যার কাঁচকলা জানে।”

এরকম একটা বেয়াদপ মানুষের সাথে কথা বলাই ঠিক না তারপরেও মামুন চলে গেল না, জিজ্ঞেস করল, “তা হলে ইলেকট্রিসিটি কেমন করে তৈরি হয়?”

“জেনারেটর দিয়ে। চুম্বকের মাঝে কয়েলকে ঘুরাতে হয়।”

“কেমন করে ঘুরায়?”

“মোটর দিয়ে, টারবাইন দিয়ে, গায়ে জোর থাকলে হাত দিয়ে—”

মানুষটা মশকরা করছে কি না আমরা বুঝতে পারলাম না। মামুন আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কিন্তু বেয়াদপ মানুষটা আমাদের বিদায় করে দিয়ে বলল, “যাও যাও ঝামেলা কর না।”

মামুন হচ্ছে আমাদের সায়েন্টিস্ট কিন্তু সে আসলে একটু গাধা টাইপের মানুষ। পরের দিন ক্লাসে সে হেড স্যারকে বলল, “স্যার পানি ফেললে ইলেকট্রিসিটি হয় না। ইলেকট্রিসিটি তৈরি করতে হলে চুম্বকের মাঝে কয়েলকে ঘুরাতে হয়।”

হেড স্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী বললি? অ্যাঁ?”

মামুন একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “না মানে-ইয়ে–”

হেড স্যার এগিয়ে এসে বললেন, “অ্যাঁ বেশি বড় মাতবর হয়েছিস?”

মামুন চি চি করে বলল, “না স্যার হই নাই।”

হেড স্যার খপ করে মামুনের কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব অ্যাঁ বেয়াদপ ছেলে। আঁ!”

কানটা শেষ পর্যন্ত ছিঁড়েন নাই কিন্তু টেনে যে একটু লম্বা করে দিয়েছেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। মামুন বেঞ্চে বসে গজগজ করতে লাগল, ফিসফিস করে বলল, “কিছু জানেন না বুঝেন না–আর হয়েছেন হেড মাস্টার!”

কাজেই নোট বই যদিও এক্সপার্ট হেড মাস্টাররা লিখে থাকে কিন্তু তারা যদি আমাদের হেড স্যারের মতো হেড মাস্টার হয়ে থাকেন তা হলে সেগুলো পড়ে কোনো লাভ নেই, আম্মুকে সেই কথা বলাও যাবে না। বাসায় তা হলে অশান্তি শুরু হয়ে যাবে।

.

আমার বাসায় যেরকম শান্তি নেই স্কুলে সেরকম শান্তি নেই। লেখাপড়ার মাঝে কোনো আনন্দ নেই কিন্তু স্কুলে লেখাপড়া করতে হয়। লেখাপড়া মানেই হচ্ছে মুখস্থ, বেশি মুখস্থ কম মুখস্থ আর মাঝারি মুখস্থ, মনে হয় মুখস্থ করতে করতে একদিন জানটা বের হয়ে যাবে। আমাদের ক্লাসে শান্তা নামে একটা মেয়ে পড়ে। সে একদিন আমাকে বলল, “বুঝলি তিতু, আমার সবচেয়ে বেশি রাগ কার উপর?”

“কার উপর?”

”বেগম রোকেয়ার উপর।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন?”

“বেগম রোকেয়াই তো নারী শিক্ষা নারী শিক্ষা বলে আমাদের সর্বনাশ করেছে। যদি না করতো তা হলে আমাদের লেখাপড়া করতে হত না। মুখস্থ করতে হত না। ঘরে বসে দিনরাত টিভি দেখতাম। ইস ভগবান! কী মজাই না তা হলে হত।”

শান্তা মনে হয় কথাটা ভুল বলে নাই। কিন্তু ক্লাসের মেয়েগুলো বেগম রোকেয়ার কারণেই হোক আর অন্য কারণেই হোক লেখাপড়া করতে এসে আমাদের ঝামেলা করে দিয়েছে। স্যার-ম্যাডামরা যখন যে হোমওয়ার্ক করতে দেন তারা সেগুলো ঠিকঠাক করে আনে আর সেই জন্যে আমাদের বকাবকি শুনতে হয়। বকাবকি আমি মোটামুটি সহ্য করে ফেলি কিন্তু যখন খপ করে কান ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দেন কিংবা একটা বেত দিয়ে হাতের মাঝে সপাং সপাং করে মারতে থাকেন তখন সেটা সহ্য করতে পারি না, যতটুকু ব্যথা লাগে তার থেকে বেশি লাগে অপমান।

আমাদের স্কুলের বিল্ডিংটা অনেক বড়, অনেক ক্লাস রুম, অফিস, সামনে বড় মাঠ কিন্তু কোনোখানে কোনো আনন্দ নেই। একটা বড় লাইব্রেরি আছে কিন্তু সেটা সবসময় তালা মারা থাকে। জানালার ফাঁক দিয়ে আমরা মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখি, সারি সারি আলমারি বোঝাই বই, কিন্তু আমরা কোনোদিন সেই আলমারির বইগুলি ছুঁয়েও দেখতে পারিনি। একদিন আমি সাহস করে আমাদের বাংলা স্যারকে বললাম, “স্যার। আমাদের লাইব্রেরিতে আমরা যেতে পারি না স্যার?”

স্যার বললেন, “কী বললি?”

আমি আমতা আমতা করে বললাম, “লাইব্রেরি”

“লাইব্রেরি? কী হয়েছে লাইব্রেরির?”

“আমরা লাইব্রেরিতে যেতে পারি না স্যার?”

স্যার অবাক হয়ে বললেন, “কেন? লাইব্রেরিতে কেন যাবি?”

“বই পড়তে।”

“বই পড়তে? পড়ার বই নাই? তোর পাঠ্য বই নাই? গাইড বই নাই?”

“আছে স্যার। কিন্তু লাইব্রেরি থেকে অন্য বই পড়তে চাচ্ছিলাম।”

স্যার চোখ পাকিয়ে বললেন, “আউট বই? আউল-ফাউল বই?”

মামুন তখন আমাকে সাহায্য করার জন্যে বলল, “অন্য বইও পড়া যায় স্যার। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই। মহাকাশের বই।”

আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে চালাক-চতুর মেয়ে হচ্ছে রিতু, সে বলল, “কাজী নজরুল ইসলাম-রবীন্দ্রনাথের বইও পড়া যায়।“

বাংলা স্যার তো আর কাজী নজরুল ইসলাম আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে বাজে কথা বলতে পারেন না, তাই মুখ শক্ত করে বললেন, “তোদেরকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেই আর তোরা বই চুরি করে লাইব্রেরিটা শেষ করে দিস?”

আমি বললাম, “কেন স্যার? বই চুরি করব কেন?” শান্তা বলল, “আমরা বই পড়ব।”

“আমি তোদের খুব ভালো করে চিনি, তোরা হচ্ছিস পাজি বদমাইশ আর চোর। সবাই একজন করে চোর। কেউ ছোট চোর কেউ বড় চোর। সুযোগ পেলেই তোরা বই চুরি করবি।”

স্যারের কথা শুনে আমার খুবই রাগ হল, আমি বললাম, “যদি আমাদেরকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে না দেন তা হলে স্কুলে লাইব্রেরিটা আছে কেন?”

স্যার একটু থতমত খেয়ে গেলেন, তারপর প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, “যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আমার তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে লাইব্রেরিটা কেন আছে?”

আমি ভয় পেয়ে বললাম, “না স্যার-মানে স্যার–”

স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, “পাঠ্যবই পড়ার মুরোদ নাই উনি লাইব্রেরি থেকে আউট বই পড়বেন। শখ দেখে বাঁচি না। বড় হয়ে হবি একটা সন্ত্রাসী না হলে ঘুষখোর কেরানি, আর লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়বি? নিজের কাজ করে নিশ্বাস ফেলার সময় পাই না আর এখন লাট সাহেবের বাচ্চার জন্যে আমায় লাইব্রেরি খুলে দিতে হবে। বদমাইশ ছেলে। জুতিয়ে তোকে লম্বা করে দেওয়া দরকার, জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলা দরকার।

আমার কপালটা খুবই ভালো স্যার শুধু গালিগালাজ করেই শান্ত হলেন, আমাকে পিটালেন না। বাংলা স্যার যখন পিটানো শুরু করেন তখন সেটা হয় ভয়ংকর। মাসুমের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন চড় মেরে। লাইব্রেরির কথা বলা খুবই ভুল হয়েছে–আমি জন্মেও আর লাইব্রেরির কথা বলব না। মরে গেলেও না।

.

আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিটা সবসময়ই বন্ধ থাকবে। আমরা জানালার ফাঁক দিয়ে বড় বড় আলমারি বোঝাই বইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকব আর বড় বড় নিশ্বাস ফেলব।

কিন্তু একদিন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। আমরা স্কুলের মাঠে খেলছি, খেলতে খেলতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখন খেলা বন্ধ করে আমরা বাসায় রওনা দিয়েছি। হঠাৎ মাসুম বলল, “ঐ দেখ।”

আমরা মাসুমের সাথে সাথে স্কুল বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালাম। দোতলার একটা ঘরে আলো জ্বলছে-আমরা সবাই এই ঘরটাকে চিনি। এটা আমাদের লাইব্রেরি ঘর। নিচ থেকে ভালো বোঝা যায় না কিন্তু মনে হল ভেতরে একজন মানুষ ঘোরাঘুরি করছে। মামুন বলল, “লাইব্রেরির ভিতরে কে যেন ঢুকেছে।”

আমি বললাম, “মনে হয় ভূত।”

“ভূত? ভূত কেন হবে?”

“লাইব্রেরিতে ভূত ছাড়া আর কে ঢুকবে।”

মামুন একটু বৈজ্ঞানিক ধরনের হলেও অন্য সব দিকে সে গাধা টাইপের মানুষ তাই সে গাধার মতো বলল, “মনে হয় লাইব্রেরিটা পরিষ্কার করছে, এখন সেটা আমাদের জন্যে খুলে দেবে আর আমরা বই নিতে পারব।”

তার কথা শুনে আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। মাসুম বলল, “গাধা কোথাকার। ক্লাসে আমাদের ব্যাগে গল্পের বই পাওয়া গেলে আমাদের পিটিয়ে লম্বা করে দেয় আর লাইব্রেরি খুলে দেবে গল্পের বই পড়ার জন্যে? তুই আসলেই গাধা।”

মামুন মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল সে গাধা। আমরা তাই তাকে নিয়ে আর বেশি টিটকারি দিলাম না।

.

০২.

যখন নতুন ম্যাডাম এসে আমাদের স্কুলটাকে একেবারে অন্যরকম করে ফেলবেন

অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম আমাদের হেড মাস্টার নাই তার জায়গায় একজন কমবয়সী ছোটখাটো শুকনো-পাতলা হাসিখুশি মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। সোনার বাংলা গান গেয়ে জাতীয় পতাকা তোলা হল, আমরা দেখলাম, কমবয়সী ছোটখাটো হালকাঁপাতলা হাসিখুশি মহিলাটি খুব উৎসাহ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সাথে পুরো গানটা গাইলেন। কী আশ্চর্য! এর আগে আমাদের স্যার-ম্যাডামরা কখনো সোনার বাংলা গান গায়নি–পুরোটা তারা জানে কি না আমার সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।

এরপর আমাদের বাংলা স্যার একটু এগিয়ে এসে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “তোমরা হয়তো এখনো খবর পাওনি যে আমাদের হেড মাস্টার স্যার বদলি হয়ে গেছেন। তার জায়গায় দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন ড. রাইসা খালেদ। আমি রাইসা খালেদকে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে কিছু বলার জন্যে অনুরোধ করছি।”

কমবয়সী ছোটখাটো হালকাঁপাতলা হাসিখুশি মহিলাটা একজন ডাক্তার–আবার আমাদের হেড মাস্টার। কী আশ্চর্য! আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, দেখলাম মহিলাটা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, হেসে বললেন, “আমি আসলে পরশু দিন দায়িত্ব নিয়েছি–তারপর দুই দিন স্কুল বন্ধ তাই। তোমাদের সাথে দেখা হয়নি! আজকে প্রথম দেখা হল।” ভদ্রমহিলা বড় বড় চোখ করে আমাদের সবার দিকে তাকালেন, আমরাও বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকালাম। ভদ্রমহিলা বললেন, “মনে কর না আমি এই দুই দিন বসেছিলাম–আমি এই দুই দিন স্কুলটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি, দেখে অনেক কিছু আবিষ্কার করেছি।” ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বল দেখি, আমি কী আবিষ্কার করেছি?”

কী আশ্চর্য ব্যাপার! আমাদের অ্যাসেম্বলিতে কখনো এই ব্যাপারটা ঘটেনি! অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে কথা বলা মানেই বিশাল অপরাধ, সাথে সাথে কানে ধরে ভয়ংকর কোনো শাস্তি! আর এই হাসিখুশি ভদ্রমহিলা আমাদের কথা বলতে বলছেন। আমরা সবাই একসাথে কথা বলে উঠলাম, কেউ বলল তেলাপোকা, কেউ বলল মাকড়সা, কেউ বলল হ্যান্ড গ্রেনেড, কেউ বলল ফেন্সিডিল আর বেশিরভাগই বলল, তারা জানে না।

হাসিখুশি ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন, “হয়নি! আমি যেটা আবিষ্কার করেছি সেটা এখনি আমি তোমাদের দেখাব।” তখন তিনি পিছনে কাউকে ডাকলেন আর আমাদের স্কুলের দপ্তরি মানিক অনেকগুলো নানা সাইজের বেত নিয়ে এলো। স্যারদের অনেকে এই বেত হাতে নিয়ে ক্লাসে ঢোকেন, অনেকে দরকার পড়লে অফিস থেকে আনিয়ে নেন। আমরা সবাই কখনো না কখনো এই বেতগুলোর নিচে হাত পেতেছি।

মানিকের হাতে ধরে রাখা বেতগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাদের হাসিখুশি নতুন হেড মাস্টার ম্যাডামের চোখ-মুখ কেমন যেন কঠিন হয়ে গেল এবং তাকে দেখে রীতিমতো আমাদের ভয় করতে লাগল। ম্যাডাম বললেন, “ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তোলা বাংলাদেশে বেআইনি। শুধু বেআইনি না, কেউ যদি ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তোলে তা হলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার মানে বুঝেছ?”

আমরা সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। ম্যাডাম বললেন, “তার মানে হচ্ছে আমাদের কোনো শিক্ষক যদি তোমাদের গায়ে হাত তোলে, তোমাদের বেত মারে আর তোমরা যদি কমপ্লেইন কর তা হলে শিক্ষকদের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে থানায় নিয়ে যাবে–”

ছোট ক্লাস থেকে রিনরিনে গলায় একটা ছোট মেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কান ধরে টানলে?”

“কান ধরে টানাও শারীরিক শাস্তি। এটা করাও বাংলাদেশের আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাজেই আমাদের শিক্ষকদের এখন খুবই সতর্ক থাকতে হবে-আমরা ভুলেও যেন কোনো ছেলেমেয়ের গায়ে হাত না তুলি। আমি এই স্কুলে এসে এই বেতগুলো পেয়েছি–এটা খুবই বিপজ্জনক। বাইরে যদি খবর যায় তা হলে আমাদের শিক্ষকরা খুব বড় বিপদে পড়ে যেতে পারেন। আমি নিশ্চিত তারা কখনোই বেতগুলো দিয়ে তোমাদের মারেননি, শুধুমাত্র ভয় দেখানোর জন্যে এগুলো রেখেছেন—”

তখন অ্যাসেম্বলির সব ছেলেমেয়ে একসাথে চিৎকার করে উঠল, বলল–”মেরেছেন! মেরেছেন।”

ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তার মুখটা দেখতে দেখতে কঠিন হয়ে গেল, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে থমথমে গলায় বললেন, “যদি মেরে থাকেন তা হলে খুব বড় অন্যায় করেছেন। যাই হোক যেটা হয়ে গেছে আমি সেটাকে আর ফিরাতে পারব না। কিন্তু আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি এই স্কুলে আমার কোনো ছেলেমেয়ের গায়ে আর কেউ কোনোদিন হাত তুলতে পারবে না!”

আমরা সবাই তখন আনন্দে চিৎকার করতে লাগলাম। দুষ্টুমি করার জন্যে যারা সবচেয়ে বেশি পিটুনি খেয়েছে তারা আনন্দে রীতিমতো লাফাতে লাগল। আর যে স্যারেরা বেত দিয়ে আমাদের সকাল-বিকাল পিটিয়েছেন তাদের মুখ দেখে মনে হতে লাগল কেউ তাদের জোর করে আলকাতরা খাইয়ে দিয়েছে।

আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে হচ্ছে সুজন, সে হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম। এই বেতগুলো এখন কী করবেন?”

ম্যাডাম বললেন, “পুড়িয়ে ফেলব।”

অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে থাকা সব ছেলেমেয়ে আনন্দে আবার চিৎকার করে উঠল। বেতগুলো পোড়ানো হবে সেটা আমরা শুনেছি কিন্তু কেউই বুঝতে পারিনি সেগুলো এখনই আমাদের সামনে পোড়ানো হবে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ম্যাডাম মানিককে ডাকলেন, সে নিচে কয়েকটা ইট বিছিয়ে তার উপর বেতগুলো রাখল। তারপর একটা প্লাস্টিকের বোতল থেকে বেতগুলোর উপর কী যেন ঢালল, মনে হয় কেরোসিন না হয় পেট্রল। তারপর একটা ম্যাচ দিয়ে সেটাতে আগুন ধরিয়ে দিল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে আর আমরা আনন্দে চিৎকার করতে থাকি। ম্যাডাম হাত তুলে আমাদের থামালেন, তারপর বললেন, “এখন তোমরা আমাকে কথা দাও তোমরা কখনো এমন কিছু করবে না যার জন্যে তোমাদের স্যার আর ম্যাডামরা তোমাদের উপর রেগে ওঠেন–আর তারা তোমাদের গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করেন। কথা দাও।”

আমরা চিৎকার করে বললাম, “কথা দিলাম।”

“কথা দাও তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া করবে।”

আমরা বললাম, “মন দিয়ে লেখাপড়া করব।”

“একটু আধটু দুষ্টুমি করলে ক্ষতি নেই, কিন্তু কেউ বড় দুষ্টুমি করবে না। কথা দাও সবাই স্কুলের নিয়ম মেনে চলবে।”

একটু আধটু দুষ্টুমি করতে পারব শুনে আমরা সবাই খুশি হয়ে উঠলাম তাই আনন্দে চিৎকার করে বললাম, “স্কুলের নিয়ম মেনে চলব।”

ম্যাডাম খুব খুশি হয়ে উঠলেন, তারপর বললেন, “মনে থাকে যেন, তোমরা কিন্তু আমাদের কথা দিয়েছ। কথা দিলে কিন্তু কথা রাখতে হয়। তোমরা সবাই কথা রাখবে তো?”

আমরা সবাই চিৎকার করে বললাম, “রাখব ম্যাডাম, রাখব।”

ছোটখাটো দুষ্টুমি করা এমন কিছু কঠিন না, এই কথাটা তো রাখাই যায়। ম্যাডাম তখন তার হাতঘড়ি দেখলেন তারপরে বললেন, “তোমাদের ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে–এখন সবাই ক্লাসে যাও।” তখন হঠাৎ তার কী যেন একটা মনে পড়ল, আবার হাত তুলে বললেন, “আর শোনো-আমি তোমাদের স্কুল লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম! এটা কতোদিন খোলা হয়নি কে জানে–পুরো লাইব্রেরিতে আধ ইঞ্চি উঁচু ধুলো জমেছে। অনেক বই উঁই কেটে ফেলেছে! তবে সুখের কথা হল যেসব বইগুলো উইয়ে কেটেছে তার বেশিরভাগ হচ্ছে রাজনৈতিক বই! সরকারি টাকা নষ্ট করে এই বইগুলো কেনা হয়েছিল। ভালো বইগুলো কাটেনি!”

আমরা আবার আনন্দে চিৎকার করলাম। সব স্যার-ম্যাডামের সামনে দাঁড়িয়ে। অ্যাসেম্বলিতে যে এভাবে চিৎকার করা যায় সেটা আমরা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে যে এতো আনন্দ সেটাও আমরা আগে বুঝতে পারিনি।

আমাদের চিৎকার কমে আসা পর্যন্ত ম্যাডাম অপেক্ষা করলেন তারপর বললেন, “আমি তোমাদের জন্যে লাইব্রেরি খুলে দেব। তোমরা পড়ার জন্যে বই নিতে পারবে, বই পড়তে পারবে। আমাকে একটু সময় দাও, আমি নতুন নতুন মজার মজার বই দিয়ে লাইব্রেরিটা বোঝাই করে দেব!”

ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমরা আবার গলা ফাটিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।

.

আমাদের প্রথম ক্লাস বাংলা। বাংলা স্যার মুখ কালো করে ক্লাসে ঢুকলেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল কেউ বুঝি জোর করে তার গলা দিয়ে আধা গ্লাস কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে। এই স্যার আর কোনোদিন আমাদের মারতে পারবেন না, সেটা এখনো আমাদের কারোরই বিশ্বাস হতে চায় না। আমরা সবাই চোখ বড় বড় করে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্যার টেবিলে চক ডাস্টার আর রেজিস্টার খাতা রেখে আমাদের দিকে তাকালেন। আগে তার সাথে একটা বেত থাকতো–আজকে নেই। ম্যাডাম সেটা পুড়িয়ে ফেলেছেন। আমাদের ভেতরে সবচেয়ে দুষ্টু হচ্ছে সুজন, এই স্যারের হাতে সবচেয়ে বেশি মারও খেয়েছে সুজন। তাই তার আনন্দ হল সবচেয়ে বেশি। সে দাঁত বের করে হেসে স্যারকে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, ম্যাডাম যে আপনার বেতটা পুড়িয়ে ফেলেছেন সেই জন্যে আপনার কি একটু মন খারাপ হয়েছে?”

আমরা সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম, বাংলা স্যারকে কেউ এরকম একটা প্রশ্ন করতে পারে সেটা নিজের কানে শুনেও আমাদের কারো বিশ্বাস হল না। স্যার চোখ লাল করে সুজনের দিকে তাকালেন। মানুষের চোখ দিয়ে আগুন বের হবার ব্যবস্থা থাকলে সুজন এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। সুজন পুড়ে ছাই হয়ে গেল না আর আমরা সবাই বুঝতে পারলাম ভয়ংকর বাংলা স্যার এতদিন ছিলেন একটা বাঘের মতো–এখন সেই বাঘের সব দাঁত আর নখ তুলে ফেলা হয়েছে, এখন স্যার আর বাঘ নেই, বড় সাইজের বিড়াল হয়ে গেছেন। স্যারকে আর ভয় পেতে হবে না। তাই আমিও সাহস পেয়ে গেলাম, বললাম, “স্যার, আপনি বলেছিলেন আমাদের লাইব্রেরিতে যেতে দেওয়া হবে না। কিন্তু নতুন ম্যাডাম বলেছেন লাইব্রেরিটা খুলে দেবেন।”

এটা কোনো প্রশ্ন না, স্যারের উত্তর দেবার কিছু নেই তাই স্যার উত্তর না দিয়ে চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আগে হলে এই চোখের দৃষ্টি দেখে আমার হাত-পা শরীরের ভিতরে ঢুকে যেত-আজকে কিছুই হল না। আমি উল্টো জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা কখন লাইব্রেরিতে যাব স্যার? আমাদের কি আলাদা লাইব্রেরি ক্লাস হবে?”

স্যার আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে রেজিস্টার খাতাটা রোল করার জন্যে খুললেন। তখন মামুন বলল, “স্যার! ম্যাডাম বলেছেন কোনো স্যার যদি আমাদেরকে মারেন তা হলে তার জেল হয়ে যাবে। কয় বছরের জেল হবে স্যার?”

এটা মোটেও হাসির কথা নয় কিন্তু কয়েকজন নিচু গলায় খুক খুক করে হেসে উঠল। স্যার ভান করলেন যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। মামুন একটু গাধা টাইপের, সে একটা কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে। এবারেও তাই শুরু করল, আবার জিজ্ঞেস করল, “কয় বছর স্যার?”

স্যার কোনো উত্তর দেবার চেষ্টা করলেন না তাই ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিজেরাই উত্তর দেওয়া শুরু করল, রিতু বলল, “এটা নির্ভর করে কতটুকু মেরেছেন তার উপর। মনে কর কান ধরে টানলে এক বছর, চড় মারলে দুই বছর, বেত দিয়ে মারলে তিন বছর। তাই না স্যার?”

মাসুম বলল, “আর চড় দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলে?”

সারা ক্লাস চুপ করে গেল, আমরা সবাই জানি কবিতা মুখস্থ বলতে পারেনি দেখে এই বাংলা স্যার চড় মেরে মাসুমের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। কয়েক সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলল না, তখন সুজন বলল, “মনে হয় ফাঁসি হয়ে যাবে।”

বাংলা স্যারকে ফাঁসির আসামির মতো দেখাতে লাগল, আর ঠিক ফাঁসির আসামির মতোই বাংলা স্যার কাঁপা গলায় রোল কল নেওয়া শুরু করলেন।

.

প্রত্যেক দিনই আমরা ক্লাস নেবার সময় অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করি কখন টিফিন ছুটি হবে–আজকে আরো বেশি অধৈর্য হয়ে গেলাম। যখন শেষ পর্যন্ত টিফিন ছুটির ঘণ্টা পড়ল তখন আমরা রীতিমতো ছুটতে ছুটতে লাইব্রেরির সামনে হাজির হয়েছি, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না, লাইব্রেরির দরজাটা খোলা। আমরা হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে গেলাম। লাইব্রেরি ঘরের মাঝখানে বড় বড় টেবিল, সেই টেবিলের দুই পাশে চেয়ার। দেয়াল ঘেঁষে সারি সারি আলমারি, আলমারি বোঝাই বই। লাইব্রেরির এক কোনায় আমাদের নতুন ম্যাডাম দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছিলেন, আমাদের ঢুকতে দেখে মাথা ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। আমরা সবসময় দেখেছি স্যার আর ম্যাডামরা আমাদের দেখলেই তাদের ভুরু কুঁচকে ফেলেন, তাদের মুখ কঠিন হয়ে যায়, মুখ খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কী চাই?” নতুন ম্যাডামের সেরকম কিছু হল না। উল্টো তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল, হাসি হাসি মুখে বললেন, “কী খবর তোমাদের?”

আমি বললাম, “ম্যাডাম, আমরা লাইব্রেরি দেখতে এসেছি।”

ম্যাডাম বললেন, “ভেরি গুড! এসো, দেখো।”

রিতু বলল, “ম্যাডাম আমরা বই পড়তে পারব!”

ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “অবশ্যই পারবে। লাইব্রেরিতে যদি বই পড়তে পার তা হলে কোথায় বই পড়বে?”

মামুন জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম, আমরা বাসায় বই নিতে পারব?”

“পারবে। সেই জন্যে অবশ্যি একটা সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। এখনো কোনো সিস্টেম নেই–তাই দুই-একদিন সময় দিতে হবে। এখন এখানে বসে বসে পড়।”

“যেটা ইচ্ছা পড়ব?”

“হ্যাঁ। যেটা ইচ্ছা।”

“আলমারি খুলে বই বের করব? যেটা ইচ্ছা?”

ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “যেটা ইচ্ছা।”

ম্যাডামের কথা শেষ হবার আগেই সবাই চিৎকার করে আলমারিগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, টেনে টেনে বই নামাতে লাগল, কাড়াকাড়ি করে বইগুলো দেখতে লাগল। আমি ভয়ংকর একটা ভূতের বই পেয়ে গেলাম, প্রচ্ছদে মানুষের কাটা একটা মাথা, সেটা পচে ফুলে আছে, চোখের ভেতর থেকে একটা কিলবিলে পোকা বের হয়ে আসছে, বইটা দেখে আমার জিবে একেবারে পানি এসে গেল। আমি তখন তখনই একটা চেয়ার টেনে বইটা নিয়ে বসে গেলাম।

ম্যাডাম ঘুরে ঘুরে দেখলেন, তারপর বললেন, “আমাদের লাইব্রেরির জন্যে এখন কোনো স্টাফ নেই, তাই নিজেদের একটু কাজ করতে হবে। বই পড়া শেষ হলে যেখান থেকে যেটা নামিয়েছ সেটা সেখানে তুলে রেখো।”

“রাখব ম্যাডাম।”

লাইব্রেরি দেখতে আরো কয়েকজন স্যার-ম্যাডাম এসেছেন। তাদের একজন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “রাখবে না। কেউ ঠিক জায়গায় রাখবে না।”

আরেকজন আরো জোরে মাথা নেড়ে বলল, “বইয়ের পৃষ্ঠা কেটে নেবে।”

“পৃষ্ঠা কাটা কী বলছেন?” আমাদের বিজ্ঞান স্যার বললেন, “পুরো বই নিয়ে চলে যাবে। দুই দিনে লাইব্রেরি ফাঁকা হয়ে যাবে।”

ইংরেজির ম্যাডাম ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ইস! কী সুন্দর বইগুলো আলমারির মাঝে সাজানো ছিল–সবগুলো ওলটপালট করে দিল!”

নতুন ম্যাডাম ইংরেজি ম্যাডামের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর হাসতে শুরু করলেন, তার হাসি থামতেই চায় না। ইংরেজি ম্যাডাম তো হাসির কোনো কথা বলেননি-ঠিকই বলেছেন নতুন ম্যাডাম এর মাঝে এতো হাসির কী পেয়েছেন কে জানে! আমি অবশ্যি সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না, আমি ভূতের বইটার মাঝে ঝুঁকে পড়লাম, পোড়ো বাড়িতে দুইজন রাত কাটাতে এসেছে, পুরোনো সিন্দুক থেকে মাথা কাটা একটা মানুষ বের হয়ে এসেছে সেই নিয়ে ফাটাফাটি গল্প।

কীভাবে কীভাবে যে টিফিনের সময়টা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ঘণ্টা পড়া মাত্র আমি বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম। নতুন ম্যাডাম বলেছেন যেখান থেকে আমরা যে বইটা নামিয়েছি সেখানে বইটা তুলে রাখতে হবে কিন্তু তা হলে আমার বইটা আরেকজন নিয়ে নিবে। তাই আমি উঁইয়ে খাওয়া রাজনীতির কিছু বইয়ের পিছনে ভূতের বইটা লুকিয়ে রাখলাম যেন আর কেউ খুঁজে না পায়। ম্যাডাম বলেছেন আমরা ছোটখাটো দুষ্টুমি করতে পারব–এটা তার ভিতরেই পড়ে–এটা মোটেও বড় ধরনের দুষ্টুমি না। আমি যদি প্যান্টের ভিতরে খুঁজে লুকিয়ে বাইরে নিয়ে যেতাম সেটা হত বড় ধরনের দুষ্টুমি।

.

নতুন ম্যাডাম আসার কারণে আমাদের স্কুলে অনেক ধরনের পরিবর্তন হতে লাগল–কিছু ভালো কিছু খারাপ। আমরা এখন লাইব্রেরিতে বই পড়তে পারি সেটা ভালো, মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে পারি সেটা ভালো। আগে বইয়ের কয়েকটা প্রশ্ন মুখস্থ করলেই হত এখন পুরো বইটা পড়তে হয় সেটা খারাপ। আগে একজনের হোমওয়ার্ক দেখে আরেকজন নকল করে ফেলতে পারতাম এখন সবার আলাদা আলাদা করে করতে হয় সেটাও খারাপ। নতুন ম্যাডাম সম্পর্কেও আমরা নতুন নতুন জিনিস জানতে লাগলাম। আগে একজন স্যার-ম্যাডামকে দেখলে আমরা চেষ্টা করতাম দূরে দূরে থাকতে–নতুন ম্যাডাম আসার পর সেটাও পাল্টে গেছে–আমরা নিজে থেকে গিয়ে তার সাথে কথা বলি। আমাদের কথা বলার বেশি কিছু থাকে না কিন্তু মেয়েদের কথা শেষ হয় না। যেমন তারা ম্যাডামকে দেখলে বলে, “ম্যাডাম আপনার শাড়িটা কী সুন্দর!”

আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও বুঝি না শাড়ির কোন জায়গাটা সুন্দর। শাড়ি তো শাড়িই–সেটা আবার সুন্দর হয় কেমন করে? নতুন ম্যাডাম অবশ্যি মেয়েদের কথাকে গুরুত্ব দেন, হাসি হাসি মুখে বলেন, “থ্যাংকু!”

আবার কোনো কোনো মেয়ে বলে, “ম্যাডাম আপনার টিপটা কী সুন্দর!”

কপালে ছোট একটা টিপ আছে কী নেই সেইটাই আমাদের চোখে পড়ে না–মেয়েদের ঠিকই চোখে পড়ে। সেইটা না কি আবার সুন্দর! সবচেয়ে সাহস বেশি আমাদের শান্তার, সে একদিন নতুন ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম-ম্যাডাম আপনার টিপটা মাঝখানে হয় নাই।”

কী আশ্চর্য–ম্যাডাম দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, “তাই না কি?”

“জি ম্যাডাম। আরেকটু ডান দিকে যাবে।”

নতুন ম্যাডাম টিপটা খুলে নতুন করে লাগালেন, শান্তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন ঠিক আছে?”

শান্তা মাথা নাড়ল, “না ম্যাডাম বেশি ডান দিকে হয়ে গেছে।”

নতুন ম্যাডাম আবার খুলে বাম দিকে সরালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এখন?”

“উঁহু। বেশি বাম দিকে হয়ে গেছে!”

আমি নতুন ম্যাডাম হলে টিপ ছুঁড়ে দিয়ে শান্তার ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলতাম, ভাগো এখান থেকে। কিন্তু নতুন ম্যাডামের ধৈর্যের শেষ নাই, মাথাটা নিচু করে শান্তার কাছে এগিয়ে নিয়ে বলেন, “নাও। তুমি ঠিক করে লাগিয়ে দাও!”

শান্তা তখন তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ম্যাডামের কপালে টিপ ঠিক করে দেয়! এরকম কাণ্ড মনে হয় কেউ জীবনেও দেখেনি।

তবে নতুন ম্যাডামকে নিয়ে আমাদের যে কোনো সমস্যা হয় নাই সেটাও ঠিক না। প্রথম দিন আমরা শুনেছি নতুন ম্যাডাম হচ্ছেন ডক্টর রাইসা খালেদ। যার অর্থ ম্যাডাম হচ্ছেন ডাক্তার আমাদের বজলু খবর আনল যে নতুন ম্যাডাম স্টেডিয়াম মার্কেটে রোগী দেখেন, তিনশ টাকা ভিজিট। ম্যাডাম হচ্ছেন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। সুজন খবর আনল অন্যরকম, সে বলল ম্যাডামের চেম্বার এবিসি টাওয়ারে ভিজিট চারশ টাকা, স্কুলের ছেলেমেয়েদের ফ্রি দেখে দেন। সবচেয়ে বড় কথা ম্যাডাম মোটেও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ না, ম্যাডাম হচ্ছে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ। এই নিয়ে বজলু আর সুজন প্রথমে তর্ক করল, তারপর ঝগড়া করল শেষে মারামারি করল। সুজন মোটামুটি গুণ্ডা টাইপের সে বজলুকে আচ্ছামতোন পিটিয়ে দিল-মারামারির মাঝামাঝি শান্তা দৌড়ে গিয়ে নতুন ম্যাডামকে খবর দিল-নতুন ম্যাডামও দৌড়ে এসে দুজনকে থামালেন। তারপর কোমরে হাত দিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার? স্কুলের ভেতর মারামারি? তোমাদের হয়েছেটা কী?”

সুজন বলল, “বজলু আপনাকে নিয়ে মিথ্যা কথা বলছে।”

বজলু গর্জন করে বলল, “আমি মিথ্যা কথা বলি নাই–তুই বলেছিস।”

সুজন আরো জোরে গর্জন করে বলল, “তুই বলেছিস।”

ম্যাডামের সামনেই আবার ঝগড়া লেগে যায় এরকম অবস্থা। ম্যাডাম দুইজনকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী মিথ্যা কথা বলেছে?”

সুজন বলল, “বজলু বলেছে আপনি না কি চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। ভিজিট তিনশ টাকা। আসলে–”

নতুন ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে বলল, “আসলে?”

“আসলে আপনি নাক-কান-গলার ডাক্তার। আমি এবিসি টাওয়ারে আপনার নাম দেখেছি।”

বজলু গরগর করতে করতে বলল, “দেখে নাই।”

আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এই নাটকটা দেখছিলাম। আবিষ্কার করলাম ম্যাডাম হঠাৎ হাসতে শুরু করেছেন। হাসতে হাসতে বললেন, “এই ব্যাপার?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কে ঠিক ম্যাডাম?”

ম্যাডাম আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দুইজনের হাত ধরে কাছে টেনে এনে বললেন, “এর পরের বার আমাকে নিয়ে মারামারি করার আগে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে যেও। বুঝেছ?”

দুইজনেই পিটপিট করে ম্যাডামের দিকে তাকাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন ম্যাডাম?”

ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তার কারণ আমি ডাক্তার না। আমার কোনো চেম্বার নাই। আমি চিকিৎসা করি না। আমি ভিজিট নেই না।”

সুজন মাথা চুলকে বলল, “আপনি ডাক্তার না?”

“না।”

“কিন্তু অফিসে লেখা আছে ডক্টর রাইসা–”

“সেটা লেখা আছে তার কারণ আমি একটা পি-এইচডি করেছি। কেউ পি-এইচডি করলে তাকে ডক্টর বলে।”

রিতু মাথা নেড়ে বলল, “ও বুঝেছি! বিএ এমএ যেরকম সেরকম পি-এইচডি।”

“হ্যাঁ।” ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, “সেরকম।”

“ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যেরকম ডক্টর সেরকম ডক্টর–”

ম্যাডাম হেসে ফেললেন, বললেন, “হ্যাঁ। তবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বড় মানুষ। জ্ঞানী মানুষ–তার সাথে আমার তুলনা কর না, সেটা ঠিক হবে না।”

রিতু আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ম্যাডাম তার আগেই সুজন আর বজলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন তোমরা দুইজন বল তোমাদের কী বলার আছে?”

কারো কিছু বলার নেই। দুইজনেই বোকার মতোন একটু হাসার চেষ্টা করল। ম্যাডাম বললেন, “একজন আরেকজনের সাথে হ্যান্ডশেক করে বল, আমি দুঃখিত। আমি আর কোনোদিন মারামারি করব না। বল।”

দুজনেই একটু গাঁইগুই করে শেষে একজন আরেকজনের হাত ধরে বলল, “আমি দুঃখিত। আমি আর মারামারি করব না।”

.

কয়েকদিনের মাঝেই আমাদের নতুন ম্যাডাম অনেক বিচিত্র বিচিত্র কাজ করে ফেললেন। কিন্তু সবচেয়ে বিচিত্র কাজটার কথা আমরা জানলাম মাসখানেক পরে।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল