যখন আমাদের স্কুলে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হল এবং সেখানে এমন ব্যাপার ঘটল যেটা কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না

এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে নতুন ম্যাডাম বললেন, “সামনের সপ্তাহ থেকে আমাদের স্কুলে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হবে।”

ছেলেরা আনন্দের মতো শব্দ করল এবং মেয়েরা হতাশার মতো শব্দ করল। যখন শব্দ কমে এলো তখন ক্লাস নাইনের একটা মেয়ে বলল, “আমাদের জন্যে কী খেলা হবে ম্যাডাম?”

ম্যাডাম বললেন, “পরের বার আমরা মেয়েদের জন্যে আলাদা করে ক্রিকেট হ্যান্ডবল কিংবা অন্য কোনো খেলা শুরু করব। এবারে ছেলেদের সাথে খেলবে। ছেলে এবং মেয়ে মিলে যৌথ ক্রিকেট।”

সব ছেলেরা হইহই করে উঠল এবং বলার চেষ্টা করল যে মেয়েরা মোটেও ক্রিকেট খেলতে পারে না। মেয়েরা হইহই করে উঠল এবং বলার চেষ্টা করল যে ছেলেরা মোটেও তাদের খেলায় নেবে না। ম্যাডাম শান্তমুখে অভিযোগটা শুনে বললেন, “তোমরা যদি মনে কর আমি এই স্কুলের মাঠে খুব ভালো ক্রিকেট খেলা দেখতে চাই তা হলে জেনে রাখ সেটা সত্যি নয়। ভালো ক্রিকেট খেলা দেখতে চাইলে আমি শহরের স্পোর্টস ক্লাবকে বলতাম তাদের টিম নিয়ে এই মাঠে খেলতে-তারা তোমাদের থেকে অনেক ভালো ক্রিকেট খেলে। ঠিক কি না?”

ম্যাডাম কোন লাইনে কথা বলতে চাইছেন বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে সেটা ধরতে পারল না তাই তারা হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই বলল না। শেষ পর্যন্ত কী বলেন সেটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল। ম্যাডাম বললেন, “আমরা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করছি” থেমে গিয়ে হাত তুলে পুরো স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেখিয়ে বললেন, “তোমাদের খেলা দেখার জন্যে। ভালো হোক খারাপ হোক কিছু আসে যায় না। খেলাটা হতে হবে তোমাদের। বুঝেছ?” ছেলেমেয়েরা মাথা নাড়ল। ম্যাডাম বললেন, “আমি চাই তোমরা সবাই খেল এবং তোমাদের ভেতর যারা ভালো খেলতে পার তারা মিলে টিম তৈরি কর। সেই টিমে ছেলে আর মেয়ে দুইই থাকতে হবে।”

ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আমরা কেন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু করেছি কে বলতে পারবে?”

ক্লাস টেনের একজন ছেলে বলল, “বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম খুব ভালো। সেই জন্যে আমরাও যেন ভালো হতে পারি সেই জন্যে।”

“উঁহু। হয়নি।”

সুজন বলল, “ক্রিকেট খেলায় মারামারি কম হয়। সেই জন্যে।”

ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে বললেন, “কোন খেলায় মারামারি বেশি হয়?”

“ফুটবল খেলায়।” সুজন একগাল হেসে যোগ করল, “ক্রিকেট থেকে আমার ফুটবল খেলাটা সবসময় বেশি ভালো লাগে।”

“সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু ক্রিকেট খেলায় মারামারি কম হয় মোটেও সেই জন্যে আমরা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু করছি না। অন্য কারণ আছে।”

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “অন্য কী কারণ ম্যাডাম?”

ম্যাডাম বললেন, “মানুষের অনেক ধরনের বুদ্ধিমত্তা আছে, কিন্তু এই স্কুলে আমরা শুধু একটা বুদ্ধিমত্তার টেস্ট করি। সেটা হচ্ছে লেখাপড়ার বুদ্ধিমত্তার। লেখাপড়ার বাইরে অন্য যে বুদ্ধিমত্তা আছে আমরা সেগুলোর খোঁজ নিই না, সেগুলোর গুরুত্ব দেই না সেগুলো বাড়ানোরও চেষ্টা করি না। সেই বুদ্ধিমত্তাগুলো লেখাপড়ার মতোই গুরুত্বপূর্ণ–অনেক সময় লেখাপড়া থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা আস্তে আস্তে তোমাদের মাঝে সেই বুদ্ধিমত্তাগুলো খুঁজব। সেটা শুরু করছি একটা খেলা দিয়ে আস্তে আস্তে আমরা অন্য কিছুও করব। গান, কবিতা আবৃত্তি, সায়েন্স ফেয়ার, নাটক, ডিবেট, ছবি আঁকা, দাবা খেলা, স্পোর্টস, দৌড়ঝাঁপ, বই পড়া আমরা সবকিছু শুরু করব। দেখবে তোমাদের সবারই নিজস্ব একটা ক্ষেত্র আছে। আমরা যার যার ক্ষেত্রের নায়কদের খুঁজে বের করব–নায়িকাদের খুঁজে বের করব।”

সবাই যখন নায়ক নায়ক নায়িকা নায়িকা” করে চিৎকার করছে তখন সুজন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দুষ্টুমির একটা কম্পিটিশন থাকলে কী মজা হত। তাই না?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “তুই তা হলে শুধু স্কুলে না, ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবি।”

ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “ক্রিকেট টিম নিয়ে তোমাদের কোনো প্রশ্ন আছে?”

ক্লাস টেনের বড় একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, “ক্রিকেট টুর্নামেন্ট কী ক্রিকেট বল দিয়ে হবে না কী টেনিস বল দিয়ে?”

ম্যাডাম আমাদের ড্রিল স্যারের দিকে উত্তরের জন্যে তাকালেন। ড্রিল স্যার বললেন, “ছোট ছোট বাচ্চারাও খেলবে তাই শুরু হবে টেনিস বল দিয়ে।”

ছেলেদের ভিতর যারা ভালো ক্রিকেট খেলে তারা যন্ত্রণার মতো শব্দ করল।

.

দুপুরবেলা আমরা আঁখিকে নিয়ে তার ঝুনঝুন টেনিস বল দিয়ে সাতচাড়া খেলছি–এরকম সময় বজলু ঘাড়ে একটা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে হাজির। হাত তুলে বলল, “থাম।”

আমরা থামলাম। মামুন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

বজলু বলল, “ক্রিকেট টুর্নামেন্টের জন্যে টিম তৈরি করতে হবে।”

মামুন বলল, “আমরা কোনোভাবেই ক্লাস নাইনের সাথে পারব না। ওরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলে।”

রিতু বলল, “না পারলে নাই।”

সুজন বলল, “কারা কারা ভালো খেলে আমাকে বলে দিস। আমি ব্যবস্থা করে দেব।”

রিতু ভুরু কুঁচকে বলল, “কী ব্যবস্থা করবি?”

সুজন বলল, “খেলার সময় দেখবি তারা শুধু বদনা নিয়ে বাথরুমে যাচ্ছে আর বের হচ্ছে।“ ব্যাপারটা চিন্তা করেই সুজনের মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল।

বজলু বলল, “বাজে কথা বলে লাভ নাই। আমাদের টিম তৈরি করতে হবে, তারপর প্র্যাকটিস করতে হবে।”

মামুন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের ক্রিকেট টিম তৈরি করে লাভ নাই, আমাদের ক্লাসে কেউ ক্রিকেট খেলতে পারে না।”

বজলু বলল, “ভালো খেলতে হলে বেশি করে খেলতে হয়। তোরা কেউ ক্রিকেট খেলবি না, দিন রাত সাতচাড়া খেলবি তা হলে কেমন করে হবে?”

আমি বললাম, “ক্রিকেট টুর্নামেন্ট না হয়ে সাতচাড়া টুর্নামেন্ট হলে কেউ আমাদের সাথে পারত না।”

বজলু মুখ শক্ত করে বলল, “সাতচাড়া টুর্নামেন্ট হচ্ছে না। হচ্ছে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট।”

সুজন বলল, “আমরা নতুন ম্যাডামকে গিয়ে বলতে পারি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের বদলে সাতচাড়া টুর্নামেন্ট করতে।”

বজলু বলল, “বাজে কথা বলবি না।”

মামুন হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “টুর্নামেন্টে আমরা যে লাড্ড গাড়া, ক্লাস টুয়ের কাছে হেরে যাব। আমাদের ক্লাসে কেউ ক্রিকেট খেলতে পারে না।

বজলু বিরক্ত হয়ে বলল, “ভ্যাদর ভ্যাদর না করে খেলতে আয়।”

কাজেই আমাদের সাতচাড়া বন্ধ করে ক্রিকেট খেলা শুরু করতে হল। মামুনের কথা সত্যি আমাদের ক্লাসে বজলু ছাড়া আর কেউ ক্রিকেট খেলতে পারে না । যখন বল করতে বলা হয় তখন বলটি স্ট্যাম্প থেকে দশ হাত দূর দিয়ে যায়। যখন ব্যাট করতে হয় তখন ব্যাট ঘুরিয়ে মারার পর দেখা যায় বল তার জায়গাতেই আছে আমরা ব্যাটটা বলকে লাগাতেই পারিনি। আমরা অবশ্যি হাল ছাড়লাম না প্র্যাকটিস করতে লাগলাম।

পরের দিন খেলা শুরু করার আগে বজলু বলল, “খামোখা সবাইকে নিয়ে না খেলে টিম তৈরি করে ফেলি। যারা টিমে থাকবে তারা প্র্যাকটিস করুক।”

আমরা রাজি হলাম। সাতজনের টিমে কমপক্ষে তিনজন মেয়ে থাকতে হবে। রিতু আর শান্তা টিমে থাকতে রাজি হল কিন্তু আর কাউকেই রাজি করানো গেল না। সুমি বলল দূর থেকে একজন ছুটে এসে তার দিকে বল ছুঁড়ে দিচ্ছে দেখেই না কী তার বুক ধড়াস ধড়াস করে। মিতু বলল ব্যাডমিন্টন হলে সে খেলতে রাজি আছে কিন্তু ক্রিকেট খেলতে রাজি না। লিপি বলল রোদের মাঝে দৌড়াদৌড়ি করে ক্রিকেট খেললে তার মাথা ধরে যায়। মাধুরী ক্রিকেট খেলার কথা শুনে হাসতে হাসতেই গড়াগড়ি খেল। আমি তখন বললাম, “আঁখিকে নিয়ে নিই।”

সবাই অবাক হয়ে বলল, “আঁখি?”

“হ্যাঁ। আঁখি যখন ব্যাট করবে তখন ঝুনঝুন বলটা দিয়ে বল করলেই হবে।”

রিতু বলল, “আঁখি, তুই খেলবি?”

আঁখি বলল, “আমি জীবনে ক্রিকেট খেলি নাই।”

বজলু বলল, “কেউই খেলে নাই।”

আঁখি বলল, “এমনিতে আমি চেষ্টা করতে পারি কিন্তু টুর্নামেন্টে খেলা ঠিক। টুর্নামেন্টে আসল প্লেয়ারদের খেলা উচিত। আমাদের ক্লাসের প্রেস্টিজ।”

বজলু বলল, “আমাদের কোনো আসল প্লেয়ার নাই।”

মামুন বলল, “সব ভুয়া।”

আমি বললাম, “তুই ব্যাট নিয়ে দাঁড়া। আমরা বল করে দেখি তুই পারিস কি না।”

আঁখি ইতস্তত করতে লাগল, তারপরেও আমরা তাকে ব্যাটসহ দাঁড় করিয়ে দিলাম। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা হল একটু অন্যরকম কিন্তু আমরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। বজলু অন্যপাশ থেকে বল করতে গেল। প্রথম বলটা আঁখি মারার চেষ্টা করল না, মনে হল কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল ঝুনঝুন শব্দ করে বলটা কোন দিকে কত দূরে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বলটা আসতেই সে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে হঠাৎ ব্যাট ঘুরিয়ে মেরে বসল। সত্যি সত্যি ব্যাটটা বলে লেগে যায় আর বলটা ঝুনঝুন শব্দ করে রীতিমতো আকাশে উড়ে গেল। আমরা সবাই হাততালি দিতে লাগলাম, বজলু বলল, “ফাটাফাটি ব্যাটসম্যান! একেবারে ফাটাফাটি!”

আঁখি হেসে বলল, “ঝড়ে বক পড়েছে!”

রিতু বলল, “দেখি ঝড়ে কতো বক পড়ে।”

বজলু আবার বল করল, এবার আগের থেকে জোরে আর কী আশ্চর্য আঁখি সত্যি সত্যি আবার বলটাকে মেরে বসল। যদি সত্যিকারের খেলা হত তা হলে সেটা হত রীতিমতো বাউন্ডারি।

রিতু বলল, “ব্যস ব্যস হয়ে গেছে। আমরা টিম মেম্বার পেয়ে গেছি। আঁখি হবে তিন নম্বর মেম্বার।”

আঁখি মাথা নেড়ে আপত্তি করে বলল, “না না। এটা মোটেও ঠিক হবে না। একটা সত্যিকারের টুর্নামেন্টে আমি খেলব কেমন করে?”

আমি বললাম, “কেন? তুই খেললে সমস্যা কী?”

আঁখি বলল, “সেটা যদি তোরা না বুঝিস তা হলে আমি কেমন করে বোঝাব?”

রিতু বলল, “এত বোঝাবুঝির দরকার নাই। টুর্নামেন্টে আমাদের জেতারও দরকার নাই। আমাদের একটা টিম হলেই হল–আর কিছু চাই না।”

ড্রিল স্যার আমাদের টিমের নাম দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন, “আঁখি? আঁখি তোদের টিমে খেলবে?”

বজলু বলল, “জি স্যার?”

“কেমন করে খেলবে?”

“আঁখির একটা টেনিস বল আছে সেটা ঝুনঝুন শব্দ করে। আঁখি যখন ব্যাট করবে তখন সেটা দিয়ে বল করতে হবে।”

ড্রিল স্যার অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, বললেন, “না না। এটা হয় না। একটা মেয়ে চোখে দেখতে পায় না সে কেমন করে ক্রিকেট খেলবে? মেয়েটা ব্যথা পেয়ে যাবে।”

“না স্যার পাবে না।”

“তোদের ক্লাসে তো আরো মেয়েরা আছে। তাদের কাউকে টিমে নে।”

আমি বললাম, “না স্যার। আমরা অন্য মেয়েদের নিতে চাই না। আমরা আঁখিকে নিয়েই খেলতে চাই।”

আগে হলে ড্রিল স্যার এক ধমক দিয়ে বিদায় করে দিতেন। আজকাল কেউ সেটা করে না, ড্রিল স্যার বললেন, “আমি জানি না। ম্যাডামের সাথে কথা বলতে হবে।”

নতুন ম্যাডাম এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। শুধু তাই নয় বলে দিলেন আমাদের টিম যখন ফিল্ডিং করবে তখনো এই ঝুনঝুন বলটা দিয়ে খেলতে হবে। দুপুরবেলা যখন আমাদের টিম প্র্যাকটিস করছে তখন ম্যাডাম আমাদের দেখতে এলেন, বলটা খুব কৌতূহল নিয়ে দেখলেন। এটা আমার আইডিয়া শুনে এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি একজন আইনস্টাইন না হয় বিল গেটস! বলটা কীভাবে তৈরি করিয়েছি সেটাও শুনলেন, মুচি কোনো পয়সা নেয়নি শুনে যতটুকু অবাক হলেন তার থেকে বেশি খুশি হলেন। মাথা নেড়ে বললেন, “দেখেছ, সাধারণ মানুষেরা কতো সুইট?”

.

যেদিন আমাদের টুর্নামেন্ট শুরু হল সেদিন দুপুরের পর ক্লাস ছুটি হয়ে গেল। আমরা সব মাঠের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছি। প্রথম খেলা ক্লাস নাইনের সাথে ক্লাস টেনের। ক্লাস নাইনের দুইজন খুব ভালো ক্রিকেট খেলে কিন্তু কী কারণ কে জানে দুইজনেই খেলার শুরুতেই ক্যাচ তুলে আউট হয়ে গেল! এরপর তারা অনেক টেনেটুনে দশ ওভারে বাইশ রান করে অলআউট। ক্লাস টেন ব্যাট করতে এসে কিছুতেই রান করতে পারে না, আমরা ভেবেছিলাম তারা বুঝি হেরেই যাবে। কিন্তু ক্লাস নাইনের খুবই কপাল খারাপ, সোজা সোজা ক্যাচগুলো ধরতে পারল না। অনেকগুলো নো বল করল তাই শেষ পর্যন্ত ক্লাস টেন জিতে গেল।

ক্লাস সিক্স আর সেভেন মিলে একটা টিম, বিকেলবেলা তাদের সাথে আমাদের ক্লাস এইটের খেলা। টসে সিক্স সেভেন জিতে গিয়ে তারা ব্যাট করতে নেমেছে। দুইটা আলাদা আলাদা ক্লাস মিলে একটা টিম করেছে নিজেদের ভিতরে বোঝাবুঝি হয়নি! তা ছাড়া ক্লাস সেভেনের ছেলেমেয়েগুলো ক্লাস সিক্সের ছেলেমেয়েগুলোর উপর একটু মাতবরি করার চেষ্টা করল। তাই তাদের খেলা হল খুবই খারাপ। মাত্র বারো রানে তারা অলআউট। আমাদের বজলু আর আশরাফ খেলতে নেমে দুইজনই দুই ওভারে বারো রান করে ফেলল। এতো সহজে আমরা জিতে যাব বুঝতে পারিনি! পুরো স্কুলই জেনে গিয়েছে আঁখি আমাদের টিমে খেলবে, তার খেলা দেখার জন্যে সবাই অপেক্ষা করছিল কিন্তু তার ব্যাট করার জন্যে মাঠে নামতেই হল না।

পরের দিন আমাদের ফাইনাল খেলা। আমাদের খেলতে হবে ক্লাস টেনের সাথে। তাদের সাথে হেরে গেলেও আমাদের কোনো দুঃখ থাকবে না, আজকে ছোট ক্লাসের কাছে হেরে যাইনি। তাতেই আমরা খুশি!

বিকেলবেলা বাসায় যাবার সময় রাস্তার পাশে আমার সেই কম বয়সী মুচির সাথে দেখা। একটা পুরোনো চামড়ার স্যান্ডেল দুই পায়ে চেপে ধরে সে সেলাই করছে। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে মুখ তুলে তাকাল। আমাকে দেখে বলল, “কী খবর?”

“খবর ভালো।”

“তোমার সেই ঝুনঝুন বল কী আছে, না কী ফেটে গেছে?”

“না না ফেটে যায়নি। খুব ভালো কাজ করছে।”

“বাহ!”

আমি বললাম, “সেই বল দিয়ে আমরা এখন টুর্নামেন্ট খেলছি।”

“তাই না কি?”

“হ্যাঁ। যার জন্যে বলটা বানিয়েছিলাম সেও কালকে টুর্নামেন্টে আপনার তৈরি করা বলটা দিয়ে খেলবে।”

মানুষটি বলল, “বাহ্! বাহ! কে জিতেছে বলে যেও।”

আমি মাথা নাড়লাম, “বলব। বলে যাব।”

.

পরের দিন ফাইনাল খেলা নিয়ে আমাদের মাঠে প্রচণ্ড উত্তেজনা। মাঠের এক পাশে একটা টেবিলে একটা বড় আরেকটা ছোট কাপ রাখা হয়েছে। পাশে অনেকগুলো চেয়ার সেখানে স্যার-ম্যাডামরা বসেছেন। উপরে শামিয়ানা টানানো হয়েছে, এক পাশে ব্ল্যাকবোর্ডে স্কোর লেখার ব্যবস্থা। দেখে মনে হয় বুঝি রীতিমতো ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা!

খেলার শুরুতে দুই ক্লাসের টিম মাঠে গেল, নতুন ম্যাডাম আর ড্রিল স্যার তাদের সাথে হ্যান্ডশেক করলেন। দুই টিম মিলে লটারি করা হল, লটারিতে আমরা জিতে গেলাম, বজলু তখন ক্লাস টেনকে ব্যাট করতে দিল।

সুজন উইকেটকিপার, বজলু প্রথমে বল করবে। আশরাফ আর মামুন মাঠের ডান পাশে, রিতু আর আঁখি বাম পাশে। শান্তা উইকেটকিপারের পিছনে।

ড্রিল স্যার বাঁশি দিলেন, সাথে সাথে খেলা শুরু হল। ক্লাস টেনের বড় বড় দুজন ছেলে ব্যাট করতে এসেছে। বজলু বল করল, ব্যাটসম্যান ঘুরিয়ে মারল সাথে সাথে বাউন্ডারি! ক্লাস টেনের ছেলেমেয়েরা আনন্দে লাফাতে থাকে আমাদের মুখ চুন। বজলু আবার বল করল, ছেলেটা আবার ঘুরিয়ে মারল, আবার বাউন্ডারি হয়েই যেত শেষ মুহূর্তে আশরাফ ঠেকিয়ে ফেলল। তার মাঝে ছেলেটি দুই রান করে ফেলেছে। ক্লাস টেনের ছেলেমেয়েরা আবার লাফাতে থাকে। বজলু আবার বল করল, ছেলেটা আবার ঘুরিয়ে মারল, বল আকাশে উঠে যায়, এবারে নির্ঘাত ছক্কা! কিন্তু ছক্কা হল না আমাদের রিতু ক্যাচ ধরে ফেলল। তখন আমাদের আনন্দ দেখে কে, আমরা চিৎকার করে লাফিয়ে কুঁদিয়ে মাঠ গরম করে ফেললাম। ড্রিল স্যার বাঁশি বাজিয়ে আমাদের মাঠ থেকে বের করে দিলেন, আবার খেলা শুরু হল। বেঁটে মতোন একটা ছেলে ব্যাট করতে এসেছে, এতো তাড়াতাড়ি আউট হয়ে তারা এবারে খুব সাবধানে খেলতে লাগল।

আঁখি যেখানে ফিল্ডিং দিচ্ছে আমরা তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলাম। ঝুনঝুন বলটা যখন কাছে আসে তখন আঁখি তার শব্দ শুনতে পায়, যখন দূরে থাকে তখন সে কিছুই বলতে পারে না। আমরা আঁখির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছিলাম। যখন বলটা তার দিকে আসছে তখন চিৎকার করে তাকে সাবধান করি, বলি, “আঁখি আসছে, বল আসছে।” কিংবা বলি”একটু ডান দিকে” বা”একটু বাম দিকে!” আঁখি তখন ডানে বামে গিয়ে বলটা ধরে ফেলে। আঁখির কারণেই স্কুলের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে আমাদের পক্ষে। তাই আশরাফ বল করে যখন ক্লাস টেনের একটা ছেলেকে বোল্ড আউট করে ফেলল তখন পুরো স্কুল আনন্দে চিৎকার করে উঠে নাচানাচি করতে লাগল।

দশ ওভারের খেলা, পাঁচ ওভারে সাতাশ রান হল, এভাবে খেলা চললে ক্লাস টেন প্রায় ষাট রান করে ফেলবে। কিন্তু দেখা গেল ছেলেরা আউট হয়ে যাবার পর তাদের খেলা প্রায় শেষ হয়ে গেল। আমাদের টিমের মেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলে কিন্তু ক্লাস টেনের মেয়েরা একেবারেই লুতুপুতু। নিয়ম করে দেওয়া আছে যে প্রতি টিমে তিনজন মেয়ে থাকতে হবে সেই জন্যেই তাদের রাখা হয়েছে কিন্তু তারা একেবারেই খেলতে পারে না। আমাদের রিতু একাই বল করে দুজনকে বোল্ড আউট করে ফেলল। শেষ মেয়েটা যখন রানআউট হয়েছে তখন তাদের মোট রান বত্রিশ।

আমাদের ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে নামল বজলু আর রিতু। দুজনেই খুব ভালো খেলতে লাগল। আমরা চেঁচিয়ে মাঠ গরম করে রাখলাম। আমাদের স্কুলে এমনিতে বাইরের মানুষ আসতে পারে না, আজকে খেলা উপলক্ষে বাইরের মানুষকে আসতে দেওয়া হয়েছে। মাঠে তাই অনেক ভিড়। শুধু মানুষজন নয় ঝালমুড়ি চিনাবাদাম আর আমড়াওয়ালারাও চলে এসেছে। আমি হঠাৎ করে অবাক হয়ে দেখি মাঠের এক কোনায় আমার সেই কমবয়সী মুচি দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাছে খেলার খবর শুনে সেও তার কাজ বন্ধ করে খেলা দেখতে চলে এসেছে। আমাদের দলের কেউ রান করলেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠছে সে জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে। প্রথম দিকে আমরা খুবই ভালো খেলছিলাম কিন্তু মাঝামাঝি সময়ে আমাদের খেলায় ধস নামল। একজন মাঠে যায় আর আউট হয়ে ফিরে আসে। দেখতে দেখতে আমরা সবাই আউট হয়ে গেলাম, বাকি আছে শুধু আঁখি! আমাদের তখন মাত্র তেইশ রান হয়েছে। মাঠে আছে সুজন আর আঁখি। তারা দুজন মিলে দশ রান করতে পারবে সেরকম আশা নেই। ক্লাস টেনের একটা ছেলে দুর্দান্ত বল করে, সেই বলের সামনে দাঁড়ানোই মুশকিল।

আঁখি যখন মাঠে খেলতে নেমেছে তখন পুরো স্কুল তার জন্যে হাততালি দিতে থাকে। রিতু তাকে মাঠে নিয়ে স্ট্যাম্পের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। রিতু সেখানে দাঁড়িয়ে কান পেতে চারপাশে কী হচ্ছে শোনার চেষ্টা করল, তারপর খেলার জন্যে প্রস্তুত হল। বোলার ছুটে এসে বল করল, স্ট্যাম্প থেকে বেশ দূর দিয়ে বল এসেছে আঁখি তাই খেলার চেষ্টা করল না। পরের বলটা এলো একেবারে স্ট্যাম্পের সোজাসুজি, আঁখি শেষ মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করে তারপর ব্যাট ঘুরিয়ে মেরে বসে, আর কী আশ্চর্য সেটা বাউন্ডারি হয়ে গেল।

পুরো স্কুল আনন্দে চিৎকার করে উঠে। আমরা সবাই লাফাতে থাকি, ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো নাচতে থাকে। ক্লাস টেনের ছেলেমেয়েদের মুখ কালো হয়ে যায়, আঁখি যদি এভাবে বাউন্ডারি মারতে থাকে তা হলে তাদের সম্মানটা থাকে কেমন করে।

আমি হঠাৎ লক্ষ করলাম, ক্লাস টেনের সব ছেলেমেয়েরা আঁখির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। কেন দাঁড়িয়েছে প্রথমে বুঝতে পারিনি, বোলার বল করার সাথে সাথে আমি কারণটা বুঝতে পারলাম। আঁখি বল দেখতে পায় না তাকে খেলতে হয় ঝুনঝুন শব্দ শুনে। ক্লাস টেনের ছেলেমেয়েরা আঁখিকে সেই শব্দ শুনতে দিবে না, যখনই বল আসতে থাকে তখন তারা সবাই চিৎকার করতে থাকে শব্দ করতে থাকে। তাদের এই কাজকর্ম দেখে আমরা ছুটে ড্রিল স্যারের কাছে গিয়ে নালিশ করলাম, স্যার এসে তাদের নিষেধ করলেন কিন্তু কোনো লাভ হল না তারা শব্দ করতেই লাগল। মাঠ বোঝাই মানুষজন তাদেরকে শান্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়।

আঁখি অত্যন্ত বিপজ্জনক দুটি বল টিকে গেল। এই ওভারের শেষ বলটি যদি টিকে যায় তা হলে সুজন ব্যাট করতে পারবে। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে আছি। ক্লাস টেনের দুর্দান্ত বোলার বল করল, বলটা সোজাসুজি স্ট্যাম্পের দিকে যাচ্ছে, আঁখি শুনতে পাচ্ছে কী না আমরা জানি না। আমরা দেখলাম ব্যাট তুলে সে মেরে বসেছে, আর কি আশ্চর্য, ঝুনঝুন বলটা একেবারে আকাশে উঠে গেল। ক্যাচ ধরার জন্যে একটা লম্বা ছেলে ছুটছে কিন্তু বল একেবারে সীমানার বাইরে! অবিশ্বাস্য ব্যাপার আমাদের আঁখি ছক্কা মেরে দিয়েছে। আমরা জিতে গেছি। চিৎকার করতে করতে আমরা মাঠে ঢুকে গেলাম, আঁখিকে ঘাড়ে তুলে আমরা আনন্দে লাফাতে লাগলাম–আঁখি চিৎকার করতে লাগল, “ছেড়ে দে, আমাকে ছেড়ে দে। আমি পড়ে যাব তো!”

আমরা কেউ তার চিৎকারে কান দিলাম না!

খেলা শেষ, এখন পুরস্কার বিতরণী। আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমাদের নতুন ম্যাডাম পুরস্কার দিবেন। পুরস্কার দেবার আগে দুই একটা কথা বলতে হয় তাই ম্যাডাম হাত তুলে আমাদের থামালেন, তারপর কথা বলতে শুরু করলেন। ম্যাডাম বললেন, “আমরা অনেক ক্রিকেট খেলা দেখেছি কিন্তু আজকের খেলাটা ছিল একেবারে অন্যরকম, কেন তোমরা বলতে পারবে?”

আমরা চিৎকার করে বললাম, “আমরা জিতেছি সেই জন্যে!”

ম্যাডাম বললেন, “না। খেলায় তো একদল জিতবেই সেটা কখনো বড় কথা। আজকের খেলাটা অন্যরকম কারণ এই খেলায় এমন একজন অংশ নিয়েছে সাধারণভাবে তার এখানে অংশ নেবার কথা নয়। সেটা সম্ভব হয়েছে একটা বিশেষ ধরনের বলের জন্যে। কাজেই যে বলটা তৈরি করেছে তাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। সেই বলের আবিষ্কারক ক্লাস এইটের তিতু।” ম্যাডাম বললেন, “তিতু তুমি কোথায়? এখানে চলে এসো।”

আমাদের ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। আমি তার মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাডামের কাছে গেলাম। ম্যাডাম বললেন, “তোমরা সবাই এই ঝুনঝুন বলের আবিষ্কারক তিতুর জন্যে হাততালি দাও।” সবাই হাততালি দিতে থাকে। আমি দেখলাম দর্শকদের মাঝে দাঁড়িয়ে সেই কমবয়সী মুচিও হাততালি দিচ্ছে। তারও খুব আনন্দ হচ্ছে বলে মনে হল।

আমি ফিসফিস করে ম্যাডামকে বললাম, “ম্যাডাম যে মানুষটা এই বলটা তৈরি করেছে সেও এখানে আছে।”

“তাই না কি?”

“জি ম্যাডাম।”

“ভেরি গুড, তাকেও ডেকে নিয়ে আসি। নাম কী?”

“ম্যাডাম। সে কিন্তু মুচি।”

“আমি জানি। তাতে কী আসে যায়? নাম কী?”

“নাম তো জানি না।”

ম্যাডাম তখন দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদের তিতু এই বলের আবিষ্কারক, কিন্তু সেই আবিষ্কারকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন যিনি তিনিও আজকে এই মাঠে হাজির আছেন। তিনি নিজের হাতে এই বলটা তৈরি করেছেন, আমি তাকেও চলে আসতে অনুরোধ করছি।”

কমবয়সী মুচির মুখে প্রথমে অবিশ্বাস এবং তারপর ভয়ের ছায়া পড়ল। সে দর্শকদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রবল বেগে মাথা নাড়তে থাকে সে কিছুতেই আসবে না। অন্যেরা তখন রীতিমতো জোর করে ঠেলে তাকে সামনে নিয়ে এল। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার নাম কী?”

“নাম? আমার?”

“জি।”

“লালচান রাজবংশী।” আমি যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম নামটা বলতে রাজি হয়নি, আজকে তাকে বলতে হল!

ম্যাডাম বললেন, “আমি আজকে জনাব লালচান রাজবংশীকে আমাদের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ টিমের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে অনুরোধ করছি।”

মানুষটি নিজের কানকে বিশ্বাস করল না, সে ম্যাডামকে ফিসফিস করে বলল, “কী করছেন ম্যাডাম? আমি একজন মুচি। জুতা সেলাই করি।”

ম্যাডাম বললেন, “আপনি লালচান রাজবংশী, ঝুনঝুন বল মেকার। পুরস্কার তুলে দেন।”

লালচান রাজবংশী পুরস্কার তুলে দিল, যারা খেলোয়াড় তাদের গলায় মেডেল পরিয়ে দিল। ঠিক কী কারণ জানা নেই আমি দেখলাম মানুষটি খুব সাবধানে তার চোখ মুছছে! ক্যামেরাম্যানরা ছবি তুলল আর যতগুলো ছবি তোলা হল সবগুলোর ভিতরে আমি ঢুকে গেলাম, ম্যাডামের পাশে দাঁড়িয়ে আমি দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম।

আঁখির গলায় যখন মেডেল পরিয়ে দেওয়া হল তখন প্রচণ্ড হাততালিতে মাঠ ফেটে যাবার অবস্থা। সুজন হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, “সবার সেরা!”

আমরা বললাম, “আঁখি! আঁখি।”

আমরা বিশাল কাপটা নিয়ে স্কুলের মাঠে ঘুরতে থাকি। ছোট ক্লাসের ছেলেমেয়েদের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। তারা চিৎকার করতে থাকে, “আমার আপু তোমার আপু-”

“আঁখি আপু! আঁখি আপু!!”

.

০৮.

যখন আঁখি তার আব্বুর কাছ থেকে ক্রিকেট টিমের জন্যে একটা অসাধারণ উপহার আদায় করল

প্রত্যেকবারই ছুটির আগে আমি ছুটিতে কী কী করব তার একটা লম্বা লিস্ট করি, কোনোবারই সেই লিস্টের কোনো কিছুই করা হয় না। স্কুলের ছুটি শেষ হবার আগে প্রত্যেকবারই আমার মন খুঁতখুঁত করতে থাকে যে ছুটিতে কিছুই করতে পারলাম না। এইবার তাই বুদ্ধি করে ছুটির জন্যে কোনো কাজই রাখিনি, ঠিক করে রেখেছি এই ছুটিতে আমি কিছুই করব না, তা হলে ছুটি শেষ হবার পর মন খুঁতখুঁত করবে না। ম্যাডাম অবশ্যি প্রত্যেক ক্লাসের ছেলেমেয়েদের একটা বইয়ের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছেন, সবাইকে বলে দিয়েছেন ছুটিতে এই বইগুলো পড়তে হবে। গল্পের বই পড়া তো আর কাজ হতে পারে না তাই সেটা নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। লাইব্রেরি থেকে একজন একেকটা বই ইস্যু করে নিয়েছে। এখন ছুটির মাঝে আমরা নিজেরা নিজেরা বইগুলো নিজেদের ভিতরে বদলাবদলি করে নিচ্ছি। একদিন সুজনের সাথে বই বদল করতে গিয়েছি, গিয়ে দেখলাম সে মহা উত্তেজিত। আমাকে দেখে হাত-পা নেড়ে বলল, “জানিস কি হয়েছে?”

“কী হয়েছে?”

“আমরা যে ক্রিকেট খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম মনে আছে?”

আমি মাথা নাড়লাম, “মনে থাকবে না কেন?”

“আঁখির আব্লু সে জন্যে খুব খুশি হয়েছেন। খুশি হয়ে আঁখিকে বলেছেন আঁখি যেটা চাইবে সেটাই পাবে!”

“কী মজা! আঁখি কী চেয়েছে?”

“কী চেয়েছে সেটা শুনলে তুই ট্যারা হয়ে যাবি।”

আমি বললাম, “আমি কেন ট্যারা হব?”

সুজন বলল, “তুই বল দেখি আঁখি কী চেয়েছে?”

আমি মাথা চুলকালাম। জন্মদিনে তার বাসায় গিয়ে আমি দেখেছি তারা, অসম্ভব বড়লোক। একজন মানুষের যা যা দরকার তার সবই সেই বাসায় আছে। আঁখি বেচারি যেহেতু চোখে দেখতে পায় না তাই অনেক জিনিস সে ব্যবহার করতে পারবে না। আমি চিন্তা করে বললাম, “একটা হনুমানের বাচ্চা?”

সুজন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “হনুমানের বাচ্চা?”

“হ্যাঁ। হনুমানের বাচ্চা। ঠিকমতো ট্রেনিং দিলে সেটা আঁখির জন্যে কাজ করতে পারবে। ধর আঁখির একটা কলম দরকার, আঁখি বলবে, “এই গুলু-”

“গুল?”

“হ্যাঁ গুলু-হনুমানের নাম।”

সুজন কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, “হনুমানের নাম গুলু?”

“কেন? হনুমানের নাম গুলু হতে পারে না?”

সুজন কেন জানি আরো রেগে উঠল, বলল, “তোর নাম হওয়া উচিত গুলু।”

এবারে আমিও রেগে উঠলাম, বললাম, “কেন আমার নাম কেন গুলু হবে?”

“কারণ, তোর বুদ্ধি হচ্ছে হনুমানের মতো।” সুজন হাত-পা নেড়ে বলল, “আমি জিজ্ঞেস করলাম আঁখি তার আব্বুর কাছে কী চেয়েছে–আর তুই বললি হনুমান!”

আমি রেগে বললাম, “হনুমানের বাচ্চা!”

“ঠিক আছে হনুমানের বাচ্চা! একজন মানুষ যদি নিজে হনুমান না হয় তা : হলে সে হনুমানের বাচ্চার কথা বলতেই পারে না।”

আমার সাথে সুজনের একটা মারামারি লেগে যেত–কিন্তু ঠিক তখন সুজনের আম্মু আমাদের জন্যে নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন তাই মারামারিটা লেগে গেল না, আমরা নাস্তা খেতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।

নাস্তা খাওয়ার পর আমাদের মেজাজ একটু ঠাণ্ডা হল, তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আঁখি কী চেয়েছে তার আব্বুর কাছে?”

“আঁখি তার আব্বুকে বলেছে আমাদের পুরা ক্রিকেট টিমকে কক্সবাজার রাঙামাটি বান্দরবান নিয়ে যেতে!”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ।”

“তার আব্বু রাজি হয়েছে?”

“হবেন না কেন?” সুজন দাঁত বের করে হেসে বলল, “তার মানে আমি, বজলু, আশরাফ, মামুন, রিতু, শান্তা আর আঁখি কক্সবাজার রাঙামাটি আর বান্দরবান যাব। কী মজা!”

আমি চমকে উঠলাম, আমার নাম বলেনি! তখন মনে পড়ল সত্যিই তো আমি ক্রিকেট টিমে নাই-কিন্তু আমি যদি ঝুনঝুন বলটা আবিষ্কার না করতাম তা হলে কী আঁখি ক্রিকেট খেলতে পারত? তা হলে আমি কেন যেতে পারব না? কিন্তু আমাকে যদি নিতে না চায় তা হলে আমি কী করব?

সুজন ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে বলতে থাকে, “কী মজা হবে! আঁখির আব্বু সব ব্যবস্থা করে দিবে, আমরা এয়ারকন্ডিশান গাড়ি করে যাব, হাইফাই হোটেলে থাকব, হাম বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চপ কাটলেট এইগুলো খাব, ঘুরে বেড়াব। চিন্তা করেই আমার ঘুম হচ্ছে না!”

আমি শুকনো মুখে বললাম, “আঁখি তোদের সবার সাথে কথা বলেছে?”

“এখনো বলে নাই। তারিখটা ঠিক হলেই বলবে।”

“তোদের বাসা থেকে পারমিশান দিবে?”

সুজন চোখ কপালে তুলে বলল, “দিবে না কেন?”

আমি বললাম, “না–মানে ইয়ে–” কথাটা শেষ না করেই আমাকে থেমে যেতে হল। সত্যিই তো এরকম চমৎকার একটা ব্যাপার সেখানে যেতে বাসা থেকে পারমিশান দেবে না কেন?

আমি বাসায় ফিরে আসলাম খুবই মন খারাপ করে। আমি ইচ্ছে করলেই ক্রিকেট টিমে থাকতে পারতাম–মামুন আর আশরাফের থেকে আমি মোটেও খারাপ খেলি না কিন্তু তাদের অনেক বেশি আগ্রহ ছিল দেখে আমি তাদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন সেই জন্যে আমি পড়ে থাকব আর তারা রাঙামাটি, বান্দরবান আর কক্সবাজার বেড়াতে যাবে? পৃথিবীতে এর থেকে বড় অবিচার আর কী হতে পারে?

পরের কয়েকদিন আমি ছাড়া ছাড়াভাবে এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে নানা রকম খবর পেতে থাকি। সুজন যেটা বলেছে সেটা সত্যি। ক্রিকেট টিমের সবাইকে আঁখির আব্বু এক সপ্তাহের জন্যে রাঙামাটি, বান্দরবান আর কক্সবাজার নিয়ে যাচ্ছেন। কীভাবে কী করা হবে সেটা ঠিকঠাক করার জন্যে পরশুদিন সবাই আঁখিদের বাসায় যাবে কথাবার্তা বলতে। সবার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে–আমাকে কেউ কিছু বলেনি। যার অর্থ আমাকে ছাড়াই যাওয়া হবে। আমি ভাবলাম লজ্জার মাথা খেয়ে আমি আঁখিদের বাসায় গিয়ে আঁখির আবুকে বলি, “প্লীজ প্লীজ, আমাকে নিয়ে যান! আমি হয়তো ক্রিকেট টিমে নাই, কিন্তু আমি যদি ঝুনঝুন বলটা তৈরি করে না দিতাম তা হলে আঁখি ক্রিকেট খেলতে পারত না।” কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর সেটা করা যায় না। পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে আমার খুব অভিমানও হল–আমি না হলে কিছুই হত না-অথচ আমাকে ছাড়াই সবাই আনন্দ করতে যাচ্ছে। অন্য সবার কথা ছেড়ে দিলাম, আঁখি কি তার আব্বুকে একবারও বলতে পারে না যে আমাকে নিয়ে যাওয়া হোক?

আমি হিসেব করে বের করলাম কখন আঁখিদের বাসায় সবাই যাচ্ছে, সেই সময়টা আমি টেলিফোনের কাছাকাছি থাকলাম। মনে মনে আশা করতে লাগলাম হঠাৎ করে টেলিফোন বেজে উঠবে আর আঁখি ফোন করে বলবে, “তিতু তুই চলে আয়! তোকেও আমরা নিয়ে যাব।”

কিন্তু টেলিফোন বাজল না। রাতে সুজন ফোন করে বকবক করতে লাগল, “বুঝলি তিতু, আমরা রওনা দিব খুব ভোরে। সকালে নাস্তা করা হবে রেস্ট এরিয়াতে। ডিম পরোটা আর সবজি। সাথে গরম চা। দুপুরের খাওয়া হবে চিটাগাংয়ে। গাড়িতে সবরকম খাবার থাকবে। পনেরোজনের বিশাল গাড়ি। ড্রাইভারের পাশে বসবে জাবেদ আঙ্কেল। আমরা পিছনে। জাবেদ আঙ্কেল হচ্ছে আঁখির আব্বুর ডান হাত, সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেবে। জাবেদ আঙ্কেল ছাড়াও যাবে নিশাত আপু। নিশাত আপু হচ্ছে আঁখির কাজিন। মেডিকেলে পড়ে-হাফ ডাক্তার, আমাদের দেখে শুনে রাখবে। চিটাগাংয়ে একটা রেস্ট হাউজে আমরা লাঞ্চ করব–তারপর আবার রওনা। প্রথমে রাঙামাটি না কী প্রথমে বান্দরবান সেটা নিয়ে বিশাল আলোচনা হল, শেষে ভোটাভুটি। আমি বান্দরবান ভোট দিয়েছিলাম, ভোটে বান্দরবান জিতে গেল। হা হা হা!…” সুজন টানা কথা বলে যেতে থাকে আমি শেষের দিকে কিছু শুনছিলাম না, আমার চোখে শুধু পানি এসে যেতে থাকে।

খাবার টেবিলে আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেলাম, ভাইয়া বকবক করে গেল। আম্মু একসময় জিজ্ঞেস করলেন, “তিতু তুই এতো চুপচাপ তোর শরীর খারাপ না কি?”

আমি মাথা নাড়লাম, “না শরীর খারাপ না।”

ফুলি খালা বলল, “তিতুর কিছু একটা হয়েছে। কয়দিন থেকে চুপচাপ, খালি কী যেন চিন্তা করে।”

আম্মু আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে তিতু। বল আমাদের।”

আমি বললাম, “কিছু হয়নি। তারপর অনেক কষ্টে চোখের পানি লুকালাম। আমার মন খারাপ দেখে ভাইয়ার খুব আনন্দ হচ্ছে মনে হল, আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকায় আর খ্যাক খ্যাক করে হাসে।

খাওয়া শেষ করে আমি তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়েছি। চোখে ঘুম আসছে না, প্রচণ্ড অভিমানে আমার বুকটা প্রায় ভেঙে যাচ্ছিল আঁখি অন্তত একবার ফোন করে আমার সাথে কথা বলতে পারত।

ঠিক এরকম সময় ফোন বাজল, ফোন ধরল ফুলি খালা। তারপর আমার বিছানার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “তিতু, তুমি জাগা না ঘুম।”

আমি উঠে বসলাম, “কেন?”

“তোমার ফোন।”

“কে?”

“একটা মেয়ে। নাম আঁখি।”

আমি একবার ভাবলাম বলি, গিয়ে বলে দাও ঘুমিয়ে আছি। শেষ পর্যন্ত বললাম না, গিয়ে ফোন ধরলাম, “হ্যালো।”

অন্যপাশ থেকে আঁখি বলল, “তিতু?”

“হ্যাঁ।“

আঁখি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বুঝলি তিতু, যতবার চিন্তা করছি তুই যেতে পারবি না আমার মনটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমরা প্রোগ্রামটা চেঞ্জ করি-তুই তোর গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এলে তারপরে যাই–”

আমি বললাম, “গ্রামের বাড়ি? কীসের গ্রামের বাড়ি?”

আঁখি বলল, “তুই যে তোর ফ্যামিলির সাথে গ্রামের বাড়ি যাবি।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমি গ্রামের বাড়ি যাব?”

“হ্যাঁ। আমার আব্বু সেই যে ফোন করল, তোর ভাইয়ের সাথে কথা বলল। তোর ভাই বলল তোরা গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিস। তুই যেতে পারবি না–”

আমার মাথার মাঝে চন্ন করে রক্ত উঠে গেল। তার মানে ভাইয়া আঁখির আব্বুর সাথে মিথ্যা কথা বলেছে যেন আমি যেতে না পারি। আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম, তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললাম, “আমরা কোথাও যাচ্ছি না। আমরা এখানেই আছি।”

“তার মানে তুই যেতে পারবি?” আঁখি চিৎকার করে বলল, “আমাদের সাথে যেতে পারবি?”

“আবু আম্মু যদি রাজি হন-”

“সেটা আমাদের উপর ছেড়ে দে।” আমি শুনলাম আঁখি ”ইয়াহু” বলে একটা চিৎকার করল। তারপর চিৎকার করে তার আব্বুকে ডাকতে লাগল। আমি শুনতে পেলাম আঁখি উত্তেজিত গলায় তার আব্বুর সাথে কথা বলছে, কিছুক্ষণ পর আঁখির আব্বু ফোন ধরলেন, “হ্যালো তিতু?”

“জি চাচা।”

“তোমার আব্বু আম্মু কি জেগে আছেন?”

“জি চাচা জেগে আছেন।”

“একটু কি কথা বলা যাবে যে কোনো একজনের সাথে?” আমি উত্তেজিত গলায় বললাম, “যাবে চাচা। যাবে। আপনি একটু ধরেন।”

আমি প্রায় ছুটে গেলাম আব্বুর কাছে, যাবার সময় দেখলাম, ভাইয়া পড়ার টেবিলে বইয়ের উপর ঝুঁকে বসে পড়ার ভান করছে, কিন্তু তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে আসলে টেলিফোনে আমার প্রত্যেকটা কথা খুব মন দিয়ে শুনছে। তার চেহারার মাঝে একটা চোর চোর ভাব।

আব্বু এসে ফোন ধরলেন, আমি কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। আব্বু একটু কথা শুনেই বললেন, “না, না–আপনার কষ্ট করে আসতে হবে না, ফোনেই বলতে পারেন।”

আঁখির আব্বু মনে হল জোর করলেন, বাসায় এসে কথা বলতে চান। আব্বু তখন আর না করলেন না। আম্মুকে ডেকে বললেন, “তিতুর ক্লাসে আঁখি নামের যে মেয়েটা পড়ে তার আব্বু আসছেন।”

“এতো রাতে কেন?”

“ক্লাসের কয়েকজনকে নিয়ে চিটাগাং হিলট্রাক্সে বেড়াতে যাবে, তাই তিতুকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। আমাদের পারমিশানের জন্যে।”

“পারমিশানের কী আছে?” আম্মু বললেন, “সবাই মিলে বেড়াতে যাবে, ভালোই তো।”

আবু বললেন, “ভদ্রলোক খুব সিরিয়াস টাইপের। বললেন আপনার ছেলেকে নিয়ে যাব, পুরো ব্যবস্থাটা শুনেন যেন আপনাদের মনে কোনোরকম দুশ্চিন্তা না থাকে।”

“তাই বলে এতো রাতে?”

আব্লু ইতস্তত করে বললেন, “আমি ঠিক বুঝলাম না, বললেন কী যেন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, কেন জানি মনে করেছিলেন আমরা গ্রামের বাড়ি যাব তিতুকে নিয়ে। সেই জন্যে আমাদের বলা হয়নি–অন্য সবাই রেডি। তিতু না কি কী একটা বল তৈরি করে দিয়েছে তার মেয়েকে, সেই বল দিয়ে মেয়ে না কি ক্রিকেট পর্যন্ত খেলতে পারে। তাই তিতু ছাড়া যাবে সেটা না কি চিন্তাই করতে পারছেন না।”

আম্মু বললেন, “কিন্তু আমরা গ্রামের বাড়ি যাব সেই কথাটা কেন আসছে–”

আমি বলতে গেলাম, “ভাইয়া–” কিন্তু বললাম না, থেমে গেলাম। পুরো ব্যাপারটা মিটে যাক তারপর দেখা যাবে।

আঁখির আব্বু আর আম্মু দুজনেই চলে এলেন, আল্লু আর আম্মুর সাথে কথা বললেন, এমনভাবে কথা বললেন যে মনে হল আমি বুঝি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আর আমাকে যেতে দিয়ে আমার আব্বু আম্মু আঁখির আব্বু আম্মুকে কৃতার্থ করে দিলেন। কাজের কথা শেষ হবার পর অন্য গল্পগুজব হল, তারা আঁখিকে নিয়ে কথা বললেন, আগে কেমন মন খারাপ করে থাকত, আমাদের স্কুলে আসার পর কেমন হাসিখুশি থাকে এই রকম গল্প।

.

রাত্রে ঘুমানোর সময় যখন আশেপাশে কেউ নেই তখন আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাইয়া তুমি আঁখির আব্বুকে মিথ্যা কথা কেন বলেছিলে?”

ভাইয়া আমতা আমতা করে বলল, “আ-আ-আমি আসলে আসলে-” কথা শেষ না করে ভাইয়া থেমে যায়। আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলল, “প্লীজ তিতু তুই আম্বু আম্মুকে বলিস না। প্লীজ প্লীজ-আমি আর কোনোদিন করব না। খোদার কসম–”

আমি অবাক হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সারাটা জীবন ভাইয়া আমাকে জ্বালিয়ে গেছে, হঠাৎ করে আমি আবিষ্কার করলাম ভাইয়া আসলে খুবই দুর্বল অপদার্থ, ফালতু একজন মানুষ। তার উপর রাগ করে লাভ নেই, তার জন্যে বরং মায়া হতে পারে। আমার তখন হঠাৎ করে এই দুর্বল হতভাগা ভাইটার জন্যে এক ধরনের মায়া হল। আহা বেচারা!

.

পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই আমি আমার ক্লাসের সবার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম, তখন সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার সাথে কেউ যোগাযোগ করছিল না কারণ সবাই বুঝতে পেরেছিল আমি যেতে পারব না বলে নিশ্চয়ই আমার খুব মন খারাপ, এখন যদি অন্যেরা সেটা নিয়ে কথা বলে তা হলে আমার আরো মন খারাপ হবে। যে জিনিসটা কেউ ঠিক করে বুঝতে পারছিল না সেটা হচ্ছে আমাদের যদি আসলে গ্রামের বাড়ি যাবার কথা না থাকে তা হলে কেন ভাইয়া সেটা বলল। ভাইয়া চায় না আমি যাই সেই জন্যে এতো বড় মিথ্যা কথাটা বলেছে সেটা বলতে আমার লজ্জা হল তাই আমি আরেকটা ছোট মিথ্যা কথা বললাম। আমি তাদের বললাম, “এই ধরনের একটা আলোচনা হচ্ছিল ভাইয়া তারিখটা ভুলে গোলমাল করে ফেলেছে।”

তবে ভাইয়া আমাকে নিয়ে যে মিথ্যা কথাটা বলেছে বজলুর জন্যে সেটা সত্যি হয়ে গেল। বজলুর নানা খুব অসুস্থ, ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে মারা যাবেন তাই বজলুর বাসার সবাই তার নানাকে শেষ দেখার জন্যে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। বজলুকেও যেতে হবে। তার মানে সে আমাদের সাথে যেতে পারবে না। বজলুর সাথে কথা বলে বোঝা গেল মারা যাবার জন্যে এরকম একটা সময় বেছে নেবার জন্যে বজলু কোনোদিন তার নানাকে ক্ষমা করবে না।

বজলুর মতোই ফাটা কপাল হল আশরাফের। ঠিক এই সময়টাতে তার বোনের বিয়ে। তার উপর যদি ছেড়ে দেওয়া হত তা হলে সে নিঃসন্দেহে বোনের বিয়েতে হাজির না থেকে আমাদের সাথে রাঙামাটি, বান্দরবান আর কক্সবাজার যেত। কিন্তু এই বিষয়গুলো আমাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় না, বড়রা ঠিক করে, তাই আশরাফেরও যাওয়া হল না। দেখা গেল সব মিলিয়ে যাব আমরা ছয়জন, ছেলেদের মাঝে আমি, সুজন আর মামুন। মেয়েদের মাঝে রিতু, শান্তা আর আঁখি। আঁখির আব্বু খুবই গোছানো মানুষ, কবে কোথায় যাওয়া হবে, কোথায় থাকা হবে, সাথে কী নিতে হবে–সবকিছু কাগজে টাইপ করে লিখে দিয়েছেন। অন্যেরা আগেই সেই লিস্ট পেয়ে গেছে, সাথে যা যা নেওয়ার কথা

সেগুলো জোগার করে তারা রেডি হয়ে গেছে। আমি শেষ মুহূর্তে পেয়েছি কিন্তু সেই জন্যে আমার সেরকম কোনো সমস্যা হয়নি। লিস্টটি খুবই সহজ, নিজের জামা কাপড় ছাড়া তেমন কিছু নেই। বাকি যা কিছু লাগবে সবকিছু আমাদের জন্যে ম্যানেজ করে নেওয়া হবে।

আমি অবশ্যি নিজে খুঁজে খুঁজে কিছু জিনিস নিয়ে নিলাম। ছবি তোলার জন্যে আব্বুর ক্যামেরা, পড়ার জন্যে গল্পের বই, রোদ থেকে বাঁচার জন্যে বেস বল ক্যাপ, চোখে দেওয়ার জন্যে কালো চশমা, ছবি আঁকার জন্যে রং তুলি, লেখালেখি করার জন্যে কাগজ কলম, ভ্রমণের কাহিনী লেখার জন্যে ডাইরি, ছোটখাটো কাটাকুটি করার জন্যে ছোট চাকু, পেট খারাপ হলে খাবার জন্যে খাবার স্যালাইন, জ্বর সর্দি কাশির জন্যে প্যারাসিটামল, দাঁত ব্রাশ করার জন্যে টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, চুল আঁচড়ানোর জন্যে চিরুনি।

যেদিন রওনা দেব তার আগের রাতে আমার চোখে ঘুমই আসতে চায় না! শেষ পর্যন্ত যখন ঘুমিয়েছি তখন ঘুমটা হল ছাড়া ছাড়া, সারা রাত স্বপ্ন দেখলাম গাড়ি করে যাচ্ছি আর গাড়িটা থেমে যাচ্ছে, ধাক্কা দিয়ে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি সকলে মিলে!

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল