যখন আমরা আঁখিকে শিখিয়ে দিলাম কেমন করে একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাফেরা করতে হয়

খুব ভোরে আম্মু আমাকে ডেকে তুললেন। অন্য যে কোনোদিন হলে আমি অনেক ধরনের গাইগুই করতাম, “আর পাঁচ মিনিট”

“আর এক মিনিট” বলে বিছানায় ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতাম, আজকে তার কিছুই করলাম না। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। তাড়াতাড়ি উঠে বাথরুমে গেলাম, দাঁত ব্রাশ করে গোসল করে রেডি হয়ে গেলাম। ফুলি খালা রুটি টোস্ট আর ডিম পোচ করে দিলেন। অন্য যে কোনোদিন হলে খাওয়া নিয়ে কমপক্ষে আধা ঘণ্টা ঘ্যানঘ্যান করতাম, আজকে কিছুই করলাম না, গপগপ করে খেয়ে ফেললাম।

কিছুক্ষণের মাঝে বাসার সামনে একটা গাড়ি এসে হর্ন দিল, আমি সাথে সাথে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম। ভাইয়া ঘুমিয়ে থাকল না হয় ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। আল্লু ঘুম ঘুম চোখে বাইরে এসে বললেন, “সাবধানে থাকিস।”

আম্মু আমার সাথে গাড়ি পর্যন্ত এলেন, গাড়ির দরজা খোলা ভেতরে সবাই বসে আছে। আমার ব্যাগটা পিছনে রাখা হল, আমি সামনের সিটে বসলাম। আম্মু বললেন, “সাবধানে থাকিস। দুষ্টুমি করিস না।”

আমি বললাম, “করব না আম্মু।”

আম্মু তখন আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “ফি আমানিল্লাহ্।”

তখন অন্য সবাই তাদের মাথা এগিয়ে দিয়ে বলল, “চাচি আমাকে! চাচি আমাকে!”

আম্মু তখন সবার মাথায় হাত রেখে বললেন, “ফি আমানিল্লাহ্।” তারপর দরজা বন্ধ করা হল, ড্রাইভার স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। অন্য সবাইকে আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে, আমি শেষ জন। আমাকে তুলে নেবার পর গাড়ি সত্যি সত্যি চিটাগাংয়ের রাস্তায় রওনা দিল।

আমি ভালো করে ভেতরে তাকালাম, ড্রাইভারের পাশে বসেছেন আঁখির আব্বুর ডান হাত জাবেদ চাচা। পিছনে বসেছেন নিশাত আপু। আমরা ছয়জন মাঝখানে। জাবেদ চাচা কাজের মানুষ, কাজের মানুষেরা মনে হয় কথা কম বলে। তাই জাবেদ চাচা মুখে তালা মেরে বসে থাকলেন। নিশাত আপু মোটাসোটা নাদুসনুদুস একজন মেয়ে। যারা মোটাসোটা নাদুসনুদুস হয় তারা সাধারণত হাসিখুশি হয়, নিশাত আপুও হাসিখুশি। আমরা ছয়জন ভ্রমণের উত্তেজনায় এত হইচই করছিলাম যে নিশাত আপু আমাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা না করে আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। যারা মোটাসোটা নাদুসনুদুস তাদের মনে হয় ঘুম অন্যদের থেকে বেশি। একটু পর দেখলাম গাড়ির সিটে মাথা রেখে মুখে মিটিমিটি হাসিসহ নিশাত আপু ঘুমিয়ে পড়েছেন।

গাড়ি ছাড়তেই সুজন বলল, “আমি কিন্তু জানালার পাশে বসব।”

রিতু বলল, “ঠিক আছে। তোর ইচ্ছে করলে তুই গাড়ির ছাদেও বসতে পারিস।”

আঁখি বলল, “উঁহু। কেউ গাড়ির ছাদে বসে যেতে পারবে না। সেফটি ফাস্ট।”

আমি বললাম, “খামোখা চেষ্টা করে লাভ নেই। সুজনকে যতই বোঝানোর চেষ্টা কর সে কোনো একটা ঝামেলা করবেই।”

মামুন বলল, “সুজন যদি বেশি দুষ্টুমি করে আমরা ওকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাব।”

শান্তা বলল, “আমরা তখন গাড়ি করে যাব আর সুজন গাড়ির পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আসবে।”

দৃশ্যটা কল্পনা করে আমরা সবাই হি হি করে হাসতে থাকি। সুজন হাসল সবচেয়ে জোরে জোরে। আঁখি হাসতে হাসতে বলল, “উঁহু। কাউকে গাড়ি থেকে নামানো যাবে না। সেফটি ফাস্ট।”

রিতু বলল, “সুজনকে নামিয়ে দিলেই গাড়ির সেফটি বেশি হবে। তুই কী বেশি সেফটি চাস না কী কম সেফটি চাস?”

আঁখি বলল, “আমরা সুজনকেও চাই, সেফটিও চাই!”

এইভাবে কথা বলতে বলতে আমাদের গাড়ি এগুতে থাকে। আমরা এতো ভোরে রওনা দিয়েছি–এখনো চারিদিকে ঠিকমতো আলো হয়নি, কিন্তু তার মাঝেই লোকজন কাজকর্ম শুরু করেছে। চায়ের দোকানগুলো খুলছে, চুলোয় আগুন দিচ্ছে। মাথায় বোঝা নিয়ে মানুষজন যাচ্ছে। রাস্তার পাশে হকাররা খবরের কাগজ ভাগাভাগি করছে, রিকশা নিয়ে রিকশাওয়ালারা বের হয়েছে। এক কথায় দেখেই বোঝা যায় শহরটা জেগে উঠছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আঁখি এর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। শুধু যে দেখতে পাচ্ছে না তা নয় কখনোই দেখতে পাবে না। দেখতে না পেলে কেমন লাগে বোঝার জন্যে মাঝে মাঝে আমি চোখ বন্ধ করে থাকি কিন্তু কিছুক্ষণের ভিতরে আমি ছটফট করতে থাকি, আমাকে চোখ খুলে ফেলতে হয়। আঁখি দিনের পর দিন এভাবে কাটিয়ে দিচ্ছে চিন্তা করে হঠাৎ আমার ওর জন্যে অন্য এক রকম মায়া হতে থাকে। আমি জানি আঁখি সবকিছু সহ্য করতে পারে কিন্তু কেউ ওর জন্যে মায়া করলে সেটা সহ্য করতে পারে না, সে চায় সবাই তাকে অন্য সবার মতোন দেখুক। আমরা সবাই সেটা বুঝে ফেলেছি তাই তাকে সবসময় অন্য সবার মতোন দেখি, কখনোই আলাদা করে দেখি না। অন্তত সেরকম ভান করি।

রাস্তার একপাশ থেকে হঠাৎ একজন মানুষ দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হল, ড্রাইভারকে এক মুহূর্তের জন্যে গাড়িকে ব্রেক কষে মানুষটাকে বাঁচাতে হল, আমরা সবাই একটা ঝাঁকুনি টের পেলাম, আঁখি বলল, “কী হল?”

আমি বললাম, “একটা ছাগল রাস্তা পার হতে চেষ্টা করেছে।”

মামুন বলল, “ছাগল না। মানুষ।”

আমি বললাম, “যে মানুষ এভাবে গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয় সে মোটেও মানুষ না। সে আসলে ছাগল।”

ঠিক তখন সত্যি সত্যি একটা ছাগল হেলতে দুলতে রাস্তার মাঝখানে চলে এল, ড্রাইভারকে আবার ব্রেক কষে পাশ দিয়ে যেতে হল, আবার আমরা সবাই একটা ঝাঁকুনি টের পেলাম। আঁখি আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”

আমরা তার কথার উত্তর না দিয়ে হি হি করে হাসতে লাগলাম। আঁখি বলল, “কী হল? হাসিস কেন?”

“আবার একটা ছাগল রাস্তা পার হতে চেষ্টা করছে।”

“এর মাঝে হাসির কী হল?”

মামুন বলল, “এটা সত্যিকারের ছাগল, যেটা চার পায়ে হাঁটে।”

আমরা তখন মাঝে মাঝে আঁখিকে ধারাবর্ণনা দিতে থাকি। যেমন আমি বললাম, “আমাদের পাশ দিয়ে একটা বাস যাচ্ছে। বাসের পিছনের জানালা দিয়ে মাথা বের করে একজন টিশটাশ মহিলা হড়হড় করে বমি করছে।”

রিতু বলল, “ছিঃ তিতু! তোর এগুলো বলার দরকার কী?”

“যা দেখছি সেটাই বলছি। চোখ আছে বলে খালি আমাদের এই সব দৃশ্য দেখতে হবে, আঁখিকে দেখতে হবে না সেটা হতে পারে না।”

আঁখি হি হি করে হেসে বলল, “দে, দে, ওকে বলতে দে।”

উৎসাহ পেয়ে আমি বললাম, “আমরা এখন শহর থেকে বের হয়েছি। রাস্তার দুই পাশে ধান খেত, খাল, গাছপালা এগুলো দেখা যাচ্ছে। একজন মানুষ তার গেঞ্জিটা ওপরে তুলে ভুড়িটা বের করে সেটা চুলকাতে চুলকাতে দাঁত ব্রাশ করছে। কেন একই সাথে ভুঁড়ি চুলকাতে হবে আর দাঁত ব্রাশ করতে হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দাঁত ব্রাশ করা খুবই জরুরি কাজ কিন্তু কেন সেটা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে করতে হবে সেটাও আমি জানি না।”

একটু পরে বললাম, “একজন মানুষ বদনা নিয়ে ছুটছে। এই যে সে মাঠের পাশে বসে গেল। সে এখন কী করছে সেটা বলতে চাই না”

শান্তা আর রিতু গুম গুম করে আমার পিঠে কিল দিয়ে বলল, “অসভ্য অসভ্য!”

একটু পরেই এই ধারাবর্ণনা দেওয়াটা আমাদের মাঝে একটা খেলার মতো হয়ে গেল। সবচেয়ে সুন্দর করে দিতে পারে রিতু, সে বলে, “আমাদের রাস্তাটা এখন ডান দিকে একটু বেঁকে গেল, সূর্যটা বাম দিকে সরে এসেছে। সূর্যটা এখনো কমলা রংয়ের, মনে হয় বিশাল মসুরের ডাল। সামনে থেকে দৈত্যের মতো একটা ট্রাক আসছে, এই যে, হুঁশ করে পাশ দিয়ে চলে গেল। মনে হচ্ছে সামনে একটা নদী। নদীতে পানি টইটম্বুর, এতো সকালেও একটা নৌকা হেলতে দুলতে যাচ্ছে। নদীর দুই ধারে সবুজ ধান খেত। সবুজ রংয়ের মাঝে যে এতো রকম শেড থাকতে পারে কে জানতো। কোনো কোনো ধান খেত হালকা সবুজ কোনোটা গাঢ়। টুকটুকে লাল রংয়ের ফ্রক পরা ছোট একটা মেয়ে কালো রংয়ের বিশাল একটা ষাঁড়কে নিয়ে যাচ্ছে। ষড়টার শিংগুলো ভয়ংকর, মনে হয় চলন্ত ট্রাককে গেঁথে ফেলবে, কিন্তু এই ছোট মেয়েটার কোনো ভয়ডর নেই। সে বিশাল ষাঁড়টাকে নিয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বাজে রকমের একটা বাস আমাদের ওভারটেক করতে চাচ্ছে, শুধু হর্ন দিয়ে যাচ্ছে। সামনে দিয়ে আরো গাড়ি আসছে এখন ওভারটেক করা যাবে না কিন্তু বেয়াদপ বাসটা ওভারটেক করে ফেলছে, কী ভয়ংকর! আমাদের ড্রাইভার চাচা অবশ্যি খুবই সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছেন। এই যে এখন আমরা ছোট বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, বাজারে অনেক রকম সবজি। এখনো বাজার শুরু হয়নি সবাই আসছে চারিদিক দিয়ে। বাজারের কাছে একটা বাসস্ট্যান্ড, সেখানে লাল শাড়ি পরা একটা বউ! ইশ, কী সুন্দর বউ! একেবারে সিনেমার নায়িকার মতো। এতো সুন্দর বউটার হাজব্যান্ডটা একটু ভ্যাবলা ধরনের। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান চুলকাচ্ছে…”

রিতু যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ বলে যেতে পারে। আমাদের মাঝে সবচেয়ে খারাপ ধারাবর্ণনা দেয় সুজন। সে বলে, “এ্যা ইয়ে আমরা এখন সামনে যাচ্ছি। হা সামনে যাচ্ছি। একটা সিএনজি ওভারটেক করলাম। এ্যা-এখন যাচ্ছি। সামনে যাচ্ছি। আরেকটা সিএনজি ওভারটেক করলাম। এ্যা এ্যা যাচ্ছি। দূরে আরেকটা সিএনজি সেটাকেও ওভারটেক করব। এ্যা ওভারটেক করলাম। এখন সামনে যাচ্ছি। এ্যা সামনে যাচ্ছি!…”

.

ঘণ্টা দুয়েক পরে হঠাৎ জাবেদ চাচা ড্রাইভারকে বললেন, “রতন, গাড়ি থামাও।”

“এখানে?”

“হ্যাঁ। সামনে রেস্ট এরিয়া। সবাই একটু রেস্ট নিবে, চা নাস্তা খাবে।”

রতন ড্রাইভার বলল, “এক্ষুনি?”

জাবেদ চাচা বললেন, “হ্যাঁ। স্যার বলে দিয়েছেন প্রতি দুই ঘণ্টা পরে থামতে হবে, একটু রেস্ট নিতে হবে। তোমার চা খেতে হবে।”

“আমার লাগবে না স্যার, আরো এক দেড়শ কিলোমিটার যেতে পারব।”

“না না।” জাবেদ চাচা মাথা নাড়লেন, “এই বাচ্চাকাচ্চার দায়িত্ব আমার। তুমি একটু পরে পরে থামতে থামতে যাবে। আমি কোনো রিস্ক নিব না।”

কাজেই ড্রাইভার একটা রেস্ট এরিয়াতে থামল। পিছনে নিশাত আপু একেবারে কাদার মতো ঘুমাচ্ছিলেন, গাড়ি থামতেই আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলেন। বললেন, “কোথায় থেমেছি? রেস্ট এরিয়াতে?”

আমরা মাথা নাড়লাম। নিশাত আপু হাসি হাসি মুখে বললে, “গুড! সবাই নাম। একটু হাত-পা ছড়িয়ে নেওয়া যাক। বাথরুম ব্রেকফাস্ট সব সেরে ফেলা যাক।”

আঁখি নামতে নামতে জিজ্ঞেস করল, “আশেপাশে কী অনেক মানুষ?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ একটা বাস থেকে নামছে।”

আঁখি একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে?”

“অনেকেই।”

“আমাকে দেখে আহা উঁহু করছে?”

“এখনো করছে না। এখনো বুঝতে পারছে না।”

আঁখি বলল, “যা বিরক্ত লাগে আমার! হোয়াইট কেনটা খুলতেই সবাই বুঝে যাবে আর আহা উঁহু শুরু করবে।”

আঁখির কথা সত্যি, সে যেই মুহূর্তে তার ভাঁজ করা সাদা লাঠিটা খুলে হাতে নিয়েছে সাথে সাথে সবাই মাথা ঘুরিয়ে আঁখির দিকে তাকাল। আমরা দেখলাম চাপা গলায় আঁখিকে নিয়ে কথা বলছে। আমরা যখন ভেতরে গিয়ে বসেছি তখন বোকা ধরনের একজন বয়স্কা মহিলা হেঁটে আমাদের কাছে এসে বলল, “এই মেয়ে চোখে দেখে না? অন্ধ?”

আমাদের ইচ্ছে হল মহিলাটার টুটি চেপে ধরি, কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর কারো টুটি চেপে ধরা যায় না তাই দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, “না, দেখতে পায় না।”

“আহারে! কী কষ্ট।”

আমরা কিছু বললাম না।

”তোমাদের কী হয়?”

“বন্ধু।”

বন্ধু শুনে মহিলাটা কেমন জানি বিরক্ত হল, কেন বিরক্ত হল বুঝতে পারলাম না। বলল, “বাবা কী করে?”

আঁখির বাবা কী করে আমি ভালো করে জানি না, কিছু একটা উত্তর দিতে হয় তাই বললাম, “র্যাব। মাঝে মাঝে ক্রসফায়ার করে।”

“ও আচ্ছা। র‍্যাব!” মহিলা একটু ঘাবড়ে গেল তারপর গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে আঁখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “মা, তুমি এই জিন্দেগিতে কিছু না পেলে কী হবে, আখেরাতে তুমি সব পাবে! অন্ধ মানুষের দোয়া আল্লাহ্ কবুল করে।”

মহিলা চলে যাবার পর আঁখি বলল, “মিথ্যা কথা।”

“কী মিথ্যা কথা?”

“অন্ধ মানুষের দোয়া আল্লাহ্ কবুল করে।”

“কেন?”

“আমি দোয়া করেছিলাম এই মহিলার মাথায় যেন ঠাঠা পড়ে। পড়ে নাই।”

আমরা হি হি করে হাসতে লাগলাম, রিতু বলল, “আরে গাধা এইটা তো বদ দোয়া! বদ দোয়া কবুল করে কেউ তো বলে নাই।”

আমাদের টেবিলে নানারকম খাবার দিয়ে যায়। সকালে খেয়ে বের হয়েছি তারপরেও বেশ খিদে লাগছে। আমরা বেশ উৎসাহ নিয়ে খেতে শুরু করলাম, শুধু আঁখি পানির বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে বলল, “বুঝলি, এই জন্যে আমি বাসা থেকে বের হতে চাই না।”

কী বলতে চাইছে সেটা আমরা ঠিকই বুঝতে পারছিলাম তারপরেও রিতু জিজ্ঞেস করল, “কী জন্যে?”

“এই যে আমাকে দেখেই আহা উঁহু শুরু করে দেয়! আমার এত বিরক্ত লাগে কী বলব। আমার কী ইচ্ছে করে জানিস?”

“কী?”

“আমি এমনভাবে বের হব যে কেউ আমাকে দেখে বুঝতে পারবে না যে আমি দেখতে পাই না, আর আমাকে দেখে আহা উঁহু করবে না।”

আমি বললাম, “সেটা আর কঠিন কী? তুই তোর লাঠিটা ব্যবহার করিস না তা হলেই কেউ বুঝতে পারবে না।”

“হ্যাঁ! আর হাঁটতে গিয়ে বাদুড়ের মতো এখানে সেখানে ধাক্কা ধুক্কা খাই!”

“খাবি না। আমরা তোর কাছে থাকব। তোকে সবকিছু বলে দেব। দেখ চেষ্টা করে।”

আঁখি কয়েক সেকেন্ড কী যেন চিন্তা করল তারপর বলল, “ঠিক আছে। দেখি চেষ্টা করে। কিন্তু মনে রাখিস আমি যদি আছাড় খেয়ে পড়ে দাঁত ভাঙি তা হলে কিন্তু তোরা দায়ী থাকবি।”

আমি বললাম, “আছাড় খাবি না। আমরা কাছাকাছি থাকব তোকে পড়তে দিব না।”

আমরা যখন আবার গাড়িতে ফিরে যাচ্ছিলাম তখন আঁখি তার ভঁজ করা লাঠিটা খুলল না। সেটা হাতে নিয়ে হেঁটে যাওয়া শুরু করল। রিতু তার একটু সামনে, আমি তার একটু পিছনে। আমি ফিসফিস করে তাকে বলে দিতে লাগলাম, “সামনে দরজা। তারপর সিঁড়ি। তিনটা সিঁড়ি এক দুই তিন। সোজা সামনে, ডান দিকে মানুষ, বাম দিকে সরে যা।“

সামনে একটা বাস থেমেছে, সেখান থেকে মানুষজন নামছে, তারা আমাদের দিকে একনজর তাকাল কিন্তু কেউ আগের মতো ঘুরে তাকাল না! রিতু বলল, “খুব ভালো হচ্ছে আঁখি, কেউ তোকে সন্দেহ করছে না। শুধু একটা জিনিস তোর ঠিক করতে হবে।”

“কী জিনিস?”

“তুই সবসময় এক দিকে তাকিয়ে থাকিস। তোকে এদিক-সেদিক তাকাতে হবে। সব মানুষ খামোখা এদিক-সেদিক তাকায়। যখন কারো সাথে কথা বলবি তখন তার দিকে তাকাবি।”

আঁখি বলল, “ঠিক আছে।”

আমরা আঁখিকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে এসে উঠলাম, কেউ একবারও আঁখির দিকে ঘুরে তাকাল না।

সবাইকে নিয়ে আবার গাড়ি ছেড়ে দিল। আবার আমরা আঁখির জন্যে ধারা বিবরণী দিতে লাগলাম। দুই ঘণ্টা পর আবার গাড়ি থামল তখন আবার আঁখি স্বাভাবিক মানুষের মতো নেমে এল, আমরা সাবধানে তাকে হটিয়ে নিয়ে গেলাম, কেউ তার দিকে ঘুরে তাকাল না, কেউ আহা উঁহু করল না!

.

আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছলাম দুপুরবেলা। একটা গেস্ট হাউসে বলে রাখা ছিল, আমরা সেখানে গিয়ে উঠেছি। দুপুরে খাওয়ার জন্যে নানা রকম আয়োজন। সারা রাস্তা আমরা খেতে খেতে এসেছি, পেটে খিদে নেই। তারপরেও আমাদের ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে হল। খাওয়ার পর সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার আমরা রওনা দিয়ে দিলাম।

সাধারণত গাড়ি ছাড়তেই নিশাত আপু সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, এবারে কেন জানি আর ঘুমালেন না। পিছনে বসে বসে আমাদের গল্পগুজবে মাঝে মাঝে যোগ দিতে লাগলেন। রিতু গুছিয়ে কথা বলতে পারে তাই সে নিশাত আপুর সাথে নানা বিষয়ে কথা বলতে থাকে। ডাক্তারি পড়া কি কঠিন, যখন লাশ কাটতে হয় তখন কি ভয় করে, যদি কোনো রোগী মারা যায় তখন কি মন খারাপ হয় এ ধরনের নানা রকম প্রশ্ন! শান্তা জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি আগে বান্দরবান গিয়েছেন?”

নিশাত আপু হেসে বললেন, “কতো বার! আমার কিছু করার না থাকলেই বান্দরবানে চলে আসি।”

সুজন জিজ্ঞেস করল, “বান্দরবানে কি বান্দর আছে?”

“আছে। আগে আরো অনেক বেশি ছিল, এখন কমে গেছে।”

মামুন সুজনকে বলল, “তুই যখন যাবি, তখন আবার একটা বেড়ে যাবে।”

আমরা সবাই হাসলাম, সুজনও হাসল, বলল, “ঠিকই বলেছিস, আমার সবসময় মনে হয় মানুষ না হয়ে যদি বান্দর হয়ে জন্মাতাম তা হলে কী মজাটাই হত! সারা দিন এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফাতে পারতাম!”

রিতু বলল, “তুই মন খারাপ করিস না। আমরা তোকে রেখে আসব। তুই মনের সুখে এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফাতে পারবি?”

আমি নিশাত আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, “বান্দরবানে আমরা কোথায় থাকব?”

“নতুন একটা রিসোর্ট তৈরি হয়েছে সেখানে। ছোট চাচা, মানে আঁখির আব্বুর একজন বন্ধু তৈরি করেছেন। পাহাড়ের উপর একেবারে ছবির মতোন। নিচে তাকালে দেখা যায় শঙ্খ নদী।”

সুজন বলল, “খাওয়া দাওয়া?”

“সেখানেই হবে। খুব মজার খাবার তৈরি করে। আমি যতবার যাই ততবার খেয়েদেয়ে আরো মোটা হয়ে আসি!”

সুজন জিজ্ঞেস করল, “জঙ্গলে বাঘ ভালুক আছে?”

“গভীর জঙ্গলে নিশ্চয়ই বন্য পশুপাখি আছে। আমরা যেখানে থাকব সেখানে নেই। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

শান্তা জিজ্ঞেস করল, “আমরা সেখানে কী করব?”

“তোমাদের ইচ্ছা। শঙ্খ নদীতে নৌকা করে গভীরে যেতে পার। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি করে ঘুরে বেড়াতে পার। কিছু করার ইচ্ছে না করলে রিসোর্টের বারান্দায় চুপচাপ বসে থেকে জঙ্গলের শব্দ পাখির ডাক শুনতে পার।”

আঁখি বলল, “সেটাও যদি করার ইচ্ছা না করে তা হলে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমাতে পারিস!”

আমরা হি হি করে হাসলাম, সুজন বলল, “ইস! আমরা এতো দূর থেকে ঘুমানোর জন্যে এসেছি না কি?”

.

আমরা যখন বান্দরবানে আমাদের রিসোর্টে পৌঁছেছি তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। পাহাড়ি রাস্তায় একেবারে গভীর জঙ্গলে অনেক দূর যাবার পর আমরা একটা বড় গেটের সামনে থামলাম। পাহাড় কেটে সিঁড়ি করা হয়েছে, সেই সিঁড়ি ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা উপরে উঠে গেলাম। ভালো জামাকাপড় পরা একজন কমবয়সী মানুষ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল, আমাদের দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল, “এসো এসো, সবাই এসো। আমরা অনেকক্ষণ থেকে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি। ভেবেছিলাম তোমরা আরো আগে পৌঁছবে!”

জাবেদ চাচা বললেন, “আমরা খুব ধীরে সুস্থে এসেছি ম্যানেজার সাহেব। কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো করিনি। স্যার বলে দিয়েছিলেন প্রতি দুই ঘণ্টা পর থামতে।”

“সেটাই ভালো।” ম্যানেজার সাহেব বললেন, “তোমরা এসো তোমাদের রুমগুলো দেখিয়ে দিই। তোমাদের ছয়জনের জন্যে আমি সবচেয়ে ভালো ঘরগুলো রিজার্ভ করে রেখেছি। একেবারে পাহাড়ের উপর দুইটা রুম, তিনজন তিনজন করে ছয়জন। এসো আমাদের সাথে।

আমরা ম্যানেজারের পিছনে পিছনে হেঁটে যেতে থাকি। আঁখি রিতুকে ধরে হাঁটছে, আমি আঁখির পিছনে। রিসোর্টের দুইজন মানুষ পিছনে পিছনে আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে আসতে থাকে। আমরা গাছগাছালি ঢাকা একটা পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে মনে হয় আরো একটা পাহাড়ের উপর উঠে গেলাম। সেখানে কাঠের একটা বাসা, দুইপাশে দুইটা রুম। ম্যানেজার সাহেব রুমগুলো খুলে বললেন, একটাতে তিনজন অন্যটাতে তিনজন, নিজেরা নিজেরা ঠিক করে নাও কে কোথায় থাকবে।”

রিতু একটা ঘরে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “আমরা এইটাতে থাকব।”

কাজেই আমি সুজন আর মামুন অন্যটা নিয়ে নিলাম। হোটেলের মানুষগুলো আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে এসেছে। তারা সেগুলো আমাদের রুমে পৌঁছে দিয়েছে। আঁখি জিজ্ঞেস করল, “নিশাত আপু আর জাবেদ চাচা, আপনারা কোথায় থাকবেন?”

ম্যানেজার সাহেব বললেন, “পাশের রকে। তোমাদের কোনো ভয় নেই গাছপালায় আড়াল হয়ে আছে কিন্তু জোরে ডাক দিলেই শুনতে পাবে।”

“আর ড্রাইভার চাচা?”

“তাকে নিয়েও তোমার চিন্তা করতে হবে না। নিচে তার জন্যেও থাকার জায়গা আছে। তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে যাও, আমাদের নিচে ডাইনিং রুমে খাবার দিলে তোমাদের ডেকে নেব। আজকের মেনু স্যার টেলিফোনে ঠিক করে দিয়েছেন। কাল থেকে তোমরা বলবে কোন বেলায় তোমরা কী খেতে চাও।”

ম্যানেজার সাহেব আমাদেরকে রেখে নিশাত আপু আর জাবেদ চাচাকে নিয়ে চলে গেলেন। আমরা নিজেদের রুমে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলাম। বাথরুমে সাবান শ্যাম্পু টুব্রাশ টুথপেস্ট এমনকি দাড়ি কামানোর জন্যে রেজর পর্যন্ত আছে। আমাদের দাড়ি গজায়নি বলে ব্যবহার করতে পারব না! সবার জন্যে ধবধবে সাদা পরিষ্কার টাওয়েল। তিনটা বিছানা তিন দিকে। চাঁদরগুলোও ধবধবে সাদা। বড় কাঁচের জানালা, ভারী পর্দা। সুন্দর একটা টেবিল। ঘরটার মেঝে মনে হল কাঠ দিয়ে তৈরি, ঘরের বাইরে বড় বারান্দা সেখানে খুব সুন্দর হেলান দেওয়া চেয়ার।

কিছুক্ষণের মাঝেই আঁখি, রিতু আর শান্তাও বের হয়ে এলো। আমরা তখন পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। এক পাশে বড় ডাইনিং রুম, সেখানে আমাদের জন্যে আলাদা করে একটা টেবিল সাজানো হয়েছে। নিশাত আপু আর জাবেদ চাচা আগেই সেখানে বসে আছেন। ডাইনিং রুমের মাঝে আলাদা আলাদা টেবিলে আরো অনেকে বসে আছে। কেউ খাচ্ছে, কেউ খাবারের জন্যে অপেক্ষা করছে, কেউ খেয়ে গল্পগুজব করছে। আমাদের দিকে সবাই একনজর তাকিয়ে নিজেদের মাঝে ব্যস্ত হয়ে গেল। কেউ দ্বিতীয়বার ঘুরে তাকাল না। আঁখি একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো হেঁটে এসেছে, চেয়ারে বসেছে গল্পগুজব করছে কেউ সন্দেহ করল না যে সে অন্যরকম।

আঁখি ফিসফিস করে বলল, “বুঝলি? এই জীবনে প্রথম কেউ আমাকে দেখে আহা উঁহু করছে না! কী মজা।”

আমি গলা নামিয়ে বললাম, “দেখিস, কেউ বুঝতেই পারবে না।”

আমরা অনেক সময় নিয়ে খেলাম। তারপর নিজেদের রুমে ফিরে গেলাম। বারান্দায় চেয়ারগুলোতে বসে আমরা নিচু স্বরে গল্প করতে থাকি। আকাশে অপূর্ব একটা চাঁদ উঠেছে আর তার নরম জোছনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাতাসে গাছের পাতা শিরশির করে নড়ছে। বহু দূর থেকে কোনো একটা বুনো প্রাণীর ডাক শুনলাম। মাথার উপর দিয়ে অনেকগুলো পাখি কেমন যেন দুঃখী গলায় ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল।

আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। আঁখি প্রথমে গুনগুন করে তারপর নিচু গলায় গান গাইতে শুরু করল, “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে–”। কী সুন্দর তার গলা।

আঁখি তো জোছনা দেখছে না তা হলে কেমন করে জানল আমরা জ্যোৎস্না রাতে বনে এসেছি?

.

১০.

যখন সবকিছুই ঠিক ঠিক চলছিল কিন্তু না বুঝেই আমরা একটা খুব বড় বিপদে পা দিয়ে ফেললাম

খুব সকালে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ বুঝতে পারলাম না আমি কোথায়। হঠাৎ করে মনে পড়ল তখন আমি উঠে বসে চারিদিকে তাকালাম। রাত্রিবেলা উজ্জ্বল আলোতে ঘরটাকে এক রকম লেগেছিল, সকালের আবছা আলোতে আবার অন্যরকম লাগছে। আমি বিছানা থেকে নেমে অন্য দুটি বিছানায় শুয়ে থাকা মামুন আর সুজনকে দেখলাম। প্রত্যেকটা মানুষের মনে হয় ঘুমানোর নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। মামুন দুই হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়েছে–সুজন ঘুমিয়েছে একেবারে গুটিসুটি মেরে। আমি তাদেরকে ঘুম থেকে না জাগিয়ে বাইরে বারান্দায় গিয়ে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম। চারিদিকে অনেক গাছ, সেই গাছে হাজার হাজার পাখি কিচিরমিচির করছে। আমি নিচে তাকালাম, অনেক নিচ দিয়ে একটা নদী এঁকেবেঁকে যাচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই শঙ্খ নদী। পাহাড় জঙ্গল নদী কোথাও কোনো মানুষ নেই। নির্জন সুনসান দেখে কী অবাক লাগে।

আমি চুপচাপ অনেকক্ষণ বসেছিলাম তখন খুট করে শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি দরজা খুলে ঘুম ঘুম চোখে রিতু বের হয়ে আসছে। আমাকে দেখে বলল, “তুই এখানে বসে আছিস? কতক্ষণ থেকে?”

“ঘুম ভেঙে গেল, তাই বসে আছি।”

রিতু বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওমা! কী সুন্দর।”

“হ্যাঁ, খুব সুন্দর।”

”সবচেয়ে সুন্দর কোন জিনিসটা, বল দেখি?”

“কোনটা?”

“কোনো টেম্পো গাড়ি নাই। মানুষজন নাই। চিৎকার চেঁচামেচি নাই।”

আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “ঠিকই বলেছিস।”

রিতু কিছুক্ষণ আমার পাশে চুপচাপ বসে থেকে বলল, “এই হোটেলটা কি সুন্দর দেখেছিস?”

আমি বললাম, “হোটেল না! এইটা হচ্ছে রিসোর্ট!”

“দুইটার মাঝে পার্থক্য কী?”

আমি বললাম, “জানি না। মনে হয় হোটেল হচ্ছে বড়লোকদের জন্যে আর রিসোর্ট হচ্ছে আরো বেশি বড়লোকদের জন্যে।”

রিতু হাসল। বলল, “হ্যাঁ এখানে সবকিছুর মাঝে একটা বড়লোক বড়লোক ভাব। কালকে রাতে যখন আমরা খাচ্ছি তখন নিশ্চয়ই কয়েক হাজার টাকা বিল হয়েছে!”

“আমাদের এই ঘরগুলোও নিশ্চয়ই এক দিনে কয়েক হাজার টাকা ভাড়া।”

রিতু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস। বড়লোকেরা কীভাবে থাকে সেটা একটু আন্দাজ হল!”

আমরা হি হি করে হাসলাম।

.

কিছুক্ষণের মাঝে অন্যেরাও ঘুম থেকে উঠে গেল, তখন সবাই মিলে হইচই করে বাথরুমে গিয়ে রেডি হতে থাকি। আমরা যখন স্কুলে একজন আরেকজনকে দেখি তখন একভাবে দেখা হয়, আর যখন এভাবে একসাথে থাকি তখন অন্যভাবে দেখা হয়। যেমন মামুন হচ্ছে আমাদের মাঝে সায়েন্টিস্ট মানুষ, তার হওয়ার কথা ভুলাভালা টাইপের কিন্তু সে হচ্ছে সবচেয়ে চটপটে। সুজন হচ্ছে দুষ্টু নাম্বার ওয়ান তার হওয়ার কথা সবচেয়ে চটপটে সে হচ্ছে সবচেয়ে ঢিলে! বাথরুমে ঢুকলে বেরই হতে চায় না।

এর মাঝে একসময় নিশাত আপু এসে আমাদের খোঁজ নিয়ে গেলেন। বলেছেন আটটার ভিতরে ডাইনিং হলে চলে আসতে, নাস্তা খেয়ে আমরা বের হব। আমরা আটটার আগেই সবাই ডাইনিং রুমে চলে এসেছি। ভোরবেলা অনেকে নাস্তা করেই বের হয়ে যাবে। সকালেও আঁখি ঠিক স্বাভাবিক মানুষের মতো হেঁটে এসেছে। আমরা এবারে আরেকটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম, রিসোর্টের ম্যানেজার নিশ্চয়ই আঁখির ব্যাপারটা জানে কিন্তু কোন জন আঁখি ধরতে পারছেন না। রিতু তখন দুষ্টুমি করে ভান করতে লাগল সে দেখতে পায় না। কোনো কিছু ধরার আগে একটু হাত বুলিয়ে জিনিসটা দেখে সোজা একদৃষ্টে একদিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলার সময় কারো দিকে তাকায় না! ম্যানেজার সাহেব তখন ধারণা করে নিলেন রিতুই হচ্ছে আঁখি। ডাইনিং টেবিলে খাবার দেওয়ার সময় তখন রিসোর্টের সবাই মিলে রিতুর যত্ন করতে লাগল!

নাস্তা করেই আমরা বের হয়ে গেলাম। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছিল, জাবেদ চাচা গাড়িতে ওঠার আগে ড্রাইভার চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন, “রতন, পাহাড়ি রাস্তায় তুমি গাড়ি চালাতে পারবে তো? অসুবিধে হলে বল, তা হলে আমরা লোকাল ড্রাইভার নিয়ে একটা চান্দের গাড়ি ভাড়া করে নিই!”

ড্রাইভার চাচা এমনভাবে হেসে উঠলেন যে তার থেকে বোঝা গেল কেউ তার জীবনে এরকম হাস্যকর কথা বলেনি। তিনি থাকতে আরেকজন গাড়ি চালাবে সেটি কিছুতেই হতে পারে না। এ ধরনের একটা কথা বলাই তার জন্যে বড় ধরনের অপমান।

আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসেছি। আগের মতোন ড্রাইভারের পাশের সিটে জাবেদ চাচা। পিছনে নিশাত আপু। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি যেতে থাকে। আমরা শহরে মানুষ হয়েছি কখনো বনজঙ্গল দেখিনি, রাস্তার দুই পাশে জঙ্গল দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। পাহাড়ি রাস্তা, কখনো উঁচু কখনো নিচু হঠাৎ হঠাৎ দূরে একটা নদী চিকচিক করে ওঠে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই।

একটা বড় টিলাঘরে যাবার সময় হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে বেশ কিছু পুলিশ মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে। তারা হাত তুলে আমাদের গাড়ি থামাল। কঠিন চেহারার একজন মিলিটারি গাড়ির ভিতরে আমাদেরকে একনজর দেখে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবেন?”

জাবেদ চাচা বললেন, “এখনো জানি না, বাচ্চাগুলো যতদূর যেতে চায়।”

নিশাত আপু বললেন, “কোনো সমস্যা?”

মিলিটারি মানুষটা কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ির ভিতরে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল।

এরকম সময় কমবয়সী আরেকজন মিলিটারি এল, তাকে দেখে কঠিন চেহারার মানুষটা একটা সেলুট দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার মানে কমবয়সী এই মানুষটা নিশ্চয়ই অফিসার। নিশাত আপু তখন জানালা দিয়ে মাথা বের করে বললেন, “এখানে কী কোনো কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা?”

কমবয়সী অফিসারটি বলল, “না! আপনাদের কোনো সমস্যা না।”

“তা হলে আপনাদের সমস্যা?”

অফিসারটি হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমাদের তো সবসময়ই সমস্যা। আমাদের কাজই হল সবাইকে সন্দেহ করা, সবার গাড়ি চেক করা।”

রিতু জানালা দিয়ে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কী চেক করেন?”

“এই তো! কেউ ড্রাগস নিচ্ছে কি না, আর্মস নিচ্ছে কি না এই সব দেখি।”

রিতু হেসে বলল, “আমরা এসব কিছু নিচ্ছি না।”

অফিসারটি বলল, “জানি! তবু দেখতে হয়। এটাই হচ্ছে আমাদের ডিউটি!” তারপর হাত নেড়ে ড্রাইভারকে চলে যেতে বলল।

আঁখি বলল, “আহা বেচারা।”

শান্তা জিজ্ঞেস করল, “কেন আহা বেচারা?”

“এই যে এরকম একটা সুন্দর জায়গায় থাকে, কিন্তু তাদের কাজটা হচ্ছে সবাইকে সন্দেহ করা!”

আমরা মাথা নাড়লাম, আঁখি ঠিকই বলেছে।

.

গাড়ি করে ঘুরে ঘুরে আমরা উপরে উঠতে থাকি। আমাদের মতো আরো অনেকে বেড়াতে এসেছে, মাঝে মাঝেই তারা পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছে। আমরাও একটা সুন্দর জায়গায় গাড়ি থামালাম। এক পাশে পাহাড়ি ঢাল তাই আঁখিকে শান্তা ধরে রাখল। আমরাও কিছু ছবি তুলোম, নিশাত আপুর কাছে একটা ভিডিও ক্যামেরা, সেটা দিয়ে ভিডিও করলেন।

আমরা আবার গাড়িতে উঠেছি, আবার গাড়ি করে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি পথের পাশে একটা জায়গায় অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, অনেক মানুষের ভিড়। শান্তা জিজ্ঞেস করল, “ওখানে কী হচ্ছে?”

নিশাত আপু বললেন, “একটা ছোট বাজারের মতোন। পাহাড়ি মানুষদের হাতে তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি হয়।”

রিতু বলল, “আমরা থামি?”

নিশাত আপু বললেন, “ঠিক আছে।”

আমরা গাড়ি থেকে নেমে আবিষ্কার করলাম, মানুষের ভিড় ঠেলে আমরা যেতে পারব কিন্তু আঁখির বেশ অসুবিধে হবে। সে চোখে দেখতে পায় না বলে তাকে সবকিছু হাত বুলিয়ে দেখতে হয়। এখন যে ঠেলাঠেলি হচ্ছে হাত বুলানো দূরে থাকুক ভালো করে কেউ চোখ দিয়েও দেখতে পাবে না! জাবেদ চাচা বললেন, “সকালে এখানে খুব ভিড় হয়। তোমরা বিকালের দিকে এসো তখন নিরিবিলি ঘুরে দেখতে পারবে।”

আমরা রাজি হয়ে গেলাম। বান্দরবানের পাহাড়ে এসে কারো ভিড় ঠেলাঠেলি করতে ইচ্ছে করছে না।

প্রায় তিন ঘণ্টা পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করে আমরা টের পেলাম আমাদের বেশ খিদে পেয়েছে। নিশাত আপু বললেন, “চল এখন রিসোর্টে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে নিই!”

লাঞ্চের কথা শুনে খিদেটা এক মুহূর্তে চাগিয়ে উঠল। খানিকটা দূরে না কী একটা জলপ্রপাত আছে, আমরা আপাতত সেটা না দেখেই ফিরে আসতে শুরু করি। পেটে খিদে থাকলে কোনো কিছুই ভালো লাগে না, কোনো কিছুই সুন্দর দেখায় না।

আসার পথে আবার পুলিশ মিলিটারির দলটা আমাদের গাড়িকে থামাল। এবারে আগের অফিসারটি নেই। তাই আবার জাবেদ চাচাকে আমাদের নিয়ে একটু প্রশ্ন করল। আমাদের একনজর দেখে গাড়ির ভিতরে একটু চোখ বুলিয়ে আমাদের ছেড়ে দিল।

রিসোর্টে পৌঁছে প্রথমেই আমরা ধড়াস করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মামুন বলল, “ঘুরে বেড়ানোর সময় কেউ কোনো কাজ করে না। কিন্তু কেমন পরিশ্রম হয় দেখেছিস?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ! বান্দরবান এখনো শুরুই করিনি। রাঙামাটি কক্সবাজার বাকি, এখনই টায়ার্ড হলে কেমন করে হবে?”

সুজন বিছানায় উঠে বসে বলল, “কে বলেছে টায়ার্ড হয়েছি। মোটেই টায়ার্ড হইনি! কী মজা হচ্ছে দেখেছিস? কোনো কিছু নিজেদের করতে হচ্ছে না। খাওয়ার সময় খাওয়া, ঘুমের সময় ঘুম! এই দেখ সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানাটা উল্টাপাল্টা করে গেছিলাম, বাথরুমটা নোংরা করে গেছিলাম কেউ এসে বিছানাটা বানিয়ে দিয়েছে, বাথরুমটা পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে করে দিয়েছে! কেউ বকা দিচ্ছে না, টেবিল পরিষ্কার করতে দিচ্ছে না। যা ইচ্ছে তাই করতে পারি! কী মজা।”

মামুন উঠে বসে বলল, “আসলেই! এবারে বেশি মজা হচ্ছে। আরেকবার বেড়াতে গিয়েছিলাম সাথে বড় মানুষেরা ছিল তারা সবসময় ধমক দিচ্ছে, এটা করো না সেটা করো না। এবারে সেগুলো নাই।”

সুজন বলল, “ইচ্ছে হলে বরং আমরাই ধমক দিয়ে দিতে পারব।”

আমিও তাদের সাথে সাথে মাথা নাড়লাম, কিন্তু আমি আগে কখনোই একা একা কোথাও যাইনি। অনেক মজা আর অনেক আরাম হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমার মাঝে মাঝেই আম্মুর কথা মনে হচ্ছে। সেটা অবশ্যি ওদেরকে বলা যাবে না তা হলে আমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই হাসাহাসি করবে।

ডাইনিং রুমে খাবার টেবিলে বসে খাবারের জন্যে অপেক্ষা করছি তখন নিশাত আপু জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই মজা করছ তো?”

“করছি।” শান্তা একটু থেমে বলল, “তবে মাঝে মাঝেই বাসার কথা মনে হচ্ছে।” আমি বললাম, “আমারও!”

“সেটা খুবই স্বাভাবিক। তোমরা প্রত্যেকদিন একেবারে নিয়ম করে বাসায় কথা বলবে। ঠিক আছে?”

“বলব।”

“যখন কথা বলার ইচ্ছে করবে আমাকে বলবে।”

সুজন বলল, “বজলুর সাথে কথা বলে দেখি, ওর নানার কী খবর।”

আঁখি বলল, “আহা বেচারা।”

নিশাত আপু বললেন, “বজলুর টেলিফোন নম্বর আছে কারো কাছে?”

শান্তা বলল, “আছে।” তারপর ব্যাগ থেকে ছোট একটা নোট বই বের করে বজলুর আব্বুর টেলিফোন নম্বর বের করে নিশাত আপুকে দিল। নিশাত আপু ফোন ডায়াল করে টেলিফোনটা সুজনকে ধরিয়ে দিলেন। ফোনে কথা বলার একটু ভদ্রতা আছে সুজন তার ধারেকাছে গেল না, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, “বজলু আছে?”

একটু পর বজলু ফোন ধরল, সুজন জিজ্ঞেস করল, “তোর নানা মারা গেছেন?”

সুজনের কথা বলার ধরন দেখে আমরা রীতিমতো চমকে উঠলাম। অন্য পাশ থেকে বজলু কী বলেছে শুনতে পেলাম না কিন্তু শুনলাম সুজন অবাক হয়ে বলছে, “এখনো মারা যান নাই! মনে হচ্ছে মারা যাবেন না। ভালো হয়ে যাবেন। কী সর্বনাশ!”

সুজনের কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম। সুজন নিশাত আপুকে ফোনটা দিয়ে বলল, “বজলুর খুবই মন খারাপ।”

“কেন?”

“নানা মারা যাবেন সেই জন্যে বজলু আসতে পারল না। এখন ওর নানা না কী ভালো হয়ে যাচ্ছেন! বজলু খুবই বিরক্ত।”

রিতু কিছুক্ষণ সুজনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুই কি সবসময় এভাবে কথা বলিস?”

সুজন অবাক হয়ে বলল, “কীভাবে কথা বলি?”

শান্তা জিজ্ঞেস করল, “তুই জানিস না তুই কীভাবে কথা বলিস?”

“জানব না কেন? এই যে কথা বলছি।”

রিতু বলল, “না সুজন তোর কথা বলার ধরন ভালো না। তোকে সুন্দর করে কথা বলা শিখতে হবে।”

সুজন মুখ শক্ত করে বলল, “আমাকে তোদের কথা বলা শিখাতে হবে না। আমি অনেক সুন্দর করে কথা বলি।”

ঠিক তখন টেবিলে খাবার দিতে শুরু করল আর আমরা খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাই সুন্দর করে কথা বলার ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল। অনেক ভালো ভালো খাবার, চিকেন টিকিয়া, শিককাবাব, পোলাও, সবজি, ঘন ডাল, খাবার পর দই এবং মিষ্টি।

খাওয়া শেষ করে নিশাত আপু বললেন, “বেশি খেয়ে ফেলেছি। এখন বিছানায় শুয়ে টানা ঘুম দিতে পারলে হত।”

রিতু বলল, “আপনি ঘুমান নিশাত আপু।”

“না, না–তোমরা বিকেলে ঐ মার্কেটে যাবে মনে নাই। জাবেদ চাচাকেও শহরে যেতে হবে। তোমাদের সাথে যেতে পারবেন না।”

আমি বললাম, “আমরা নিজেরা নিজেরা যেতে পারব।”

শান্তা বলল, “ড্রাইভার চাচা থাকবেন। আমরা তো অন্য কোথাও যাচ্ছি –মার্কেটে যাব একটু দেখব তারপর চলে আসব। আপনার কষ্ট করে আমাদের সাথে যেতে হবে না।”

নিশাত আপু তার পরেও খুঁতখুঁত করতে লাগলেন, “না না, চাচা একশবার বলে দিয়েছেন তোমাদেরকে যেন একা ছাড়া না হয়।”

আঁখি হি হি করে হেসে বলল, “আমরা ছয়জন একা হলাম কেমন করে?”

সুজন বলল, “সাথে ড্রাইভার চাচা।”

নাদুসনুদুস মোটাসোটা মানুষের ঘুম খুব প্রিয়, তাই নিশাত আপু শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন। আমাদেরকে গাড়িতে তুলে অনেক রকম উপদেশ দিয়ে নিশাত আপু ঘুমাতে গেলেন। ড্রাইভার চাচা আমাদের ছয়জনকে নিয়ে রওনা দিলেন মার্কেটে।

আমরা গাড়িতে চেঁচামেচি করে যেতে থাকি। বেসুরো গলায় গান গাইতে থাকি, সেই গান শুনে আঁখি হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়। রাস্তায় আবার সেই পুলিশ আর মিলিটারির ব্যারিকেড-এবারে আমরা সকালের অফিসারটাকে পেয়ে গেলাম। আমাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, “তোমরা আবার?”

আমরা বললাম, “জি।”

“কোথায় যাচ্ছ?”

“মার্কেটে।”

“যাও।”

রিতু জিজ্ঞেস করল, “আপনি গিয়েছেন মার্কেটে?”

অফিসারটি হাসল, “ঘুমানোর সময় পাই না–আর মার্কেট!”

“আপনার কিছু লাগবে মার্কেট থেকে?”

অফিসারটি হাসল, “না, মা লাগবে না।”

ড্রাইভার চাচা তখন গাড়ি ছেড়ে দিল। রিতু কতো সহজে সুন্দর করে কথা বলতে পারে, এই কথাটাই যদি আমি বলতাম কী বেখাপ্পা শোনাতো। আর সুজন যদি বলত তা হলে নির্ঘাত একটা মারামারি লেগে যেত।

জাবেদ চাচার কথা সত্যি। এখন মার্কেটে সেরকম ভিড় নেই। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর মেয়েরা একটু কেনাকাটা করল। সুজন শুধু একটা তামাক খাবার বাঁশের পাইপ কিনল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কেন কিনেছিস? তুই কি পাইপ খাস?”

“বড় হয়ে খাব তাই কিনে রাখলাম।” এই কথার আর কী জবাব দেওয়া যায়?

.

আমরা যখন ফিরে আসছি তখন একটা মোড় ঘুরতেই দেখলাম পথের মাঝে একটা ভ্যান উল্টে পড়ে আছে, রাস্তায় কয়েকটা টুকরি, টুকরিতে শাকসবজি, কিছু শাকসবজি টুকরিতে কিছু রাস্তায় পড়ে আছে। ভ্যানের পাশে একজন বুড়ো মতো মানুষ হতাশভাবে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। শান্তা বলল, “আহা বেচারা।”

আঁখি বলল, “কী হয়েছে?”

“একজন বুড়ো মানুষের ভ্যান উল্টে তার শাকসবজি রাস্তায় পড়ে গেছে!”

তখন আঁখিও বলল, “আহা বেচারা।

বুড়ো মানুষটা আমাদের গাড়ি দেখে হাত তুলল, ড্রাইভার চাচা গাড়ি থামিয়ে বললেন, “কী হল?”

“আমার সবজিগুলো একটু তুলে পৌঁছে দেবেন?”

ড্রাইভার চাচা কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আমরা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গাড়ি থেকে নেমে সবজিগুলো টুকরিতে তুলে দিলাম। রিতু জিজ্ঞেস করল, “আপনি ব্যথা পেয়েছেন?”

বুড়ো মতোন মানুষটা একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “একটু পেয়েছি। তারপর গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভ্যানটা তো গেছে সবজিগুলো বাজারে নেওয়া দরকার, তোমাদের গাড়ি করে একটু পৌঁছে দেওয়া যাবে মা?”

রিতু বলল, “আমাদের হোটেল পর্যন্ত যেতে পারেন।”

মানুষটা বলল, “তা হলেই হবে। আমি বাকিটা নিয়ে যেতে পারব।”

ড্রাইভার চাচা কেন জানি পুরো ব্যাপারটাতে খুবই বিরক্ত হলেন, কিন্তু আমরা বুড়ো মানুষটাকে তার সবজিসহ তুলে নিলাম। মানুষটা বারবার বলতে লাগল, “বুড়ো মানুষ, শরীরে আর জোর পাই না। তোমরা তুলে না নিলে কী করতাম কে জানে! আজকাল মানুষের মনে দয়া মায়া নাই।”

যখন গাড়ি ছেড়েছে তখন বুড়ো মানুষটা সবজির টুকরিগুলো ধাক্কা দিয়ে সিটের নিচে ঠেলে দিতে লাগল। আমি বললাম, “সিটের নিচে ঢুকাতে হবে না। বাইরে থাকুক।”

বুড়ো মানুষটা বলল, “না, না, একটু চোখের আড়াল করে দিই। তোমাদের এতো সুন্দর গাড়িতে এই শাকসবজি, আলু, কদু দেখতে কি ভালো লাগবে?”

আমরা মানুষটাকে বোঝাতে পারলাম না যে সবজির টুকরি বাইরে থাকলে কিছুই আসে যায় না!

আমরা যখন বেশ অনেক দূর চলে এসেছি তখন হঠাৎ করে বুড়ো মানুষটা কেমন জানি চমকে উঠল, একবার নিজের কোমরে হাত দিল তারপর এদিক সেদিক কী একটা খুঁজতে লাগল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”

“আমার ব্যাগ।”

“কী ব্যাগ?”

“টাকা-পয়সার ব্যাগ-মনে হয় ওখানে পড়ে গেছে!” মানুষটা কেমন জানি ব্যস্ত হয়ে গেল, “ড্রাইভার সাহেব! গাড়িটা একটু থামান।” ড্রাইভার চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, “কেন?”

“আমাকে নামিয়ে দেন, আমার ব্যাগ ফেলে এসেছি।”

রিতু বলল, “আপনার সবজির টুকরি?”

“গাড়িতে থাকুক। আমার লোক গাড়ি থেকে নিয়ে নেবে।”

ড্রাইভার চাচা গাড়ি থামালেন, বুড়ো মানুষটা হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নেমে গেল। বেচারা গরিব মানুষ, এখন তার টাকার ব্যাগটা খুঁজে পেলে হয়।

ড্রাইভার চাচা বিরক্ত হয়ে বুড়ো মানুষটাকে একটা গালি দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। একটু সামনেই আবার পুলিশ ব্যারিকেড, অনেকগুলো গাড়ি থামিয়ে চেক করছে। গাড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে দেরি হত। কিন্তু মিলিটারির সেই অফিসারটা আমাদের দেখল। বলল, “মার্কেটিং করেছ?”

“জি। করেছি।”

“গুড। যাও। তোমরা চলে যাও।

ড্রাইভার চাচা অন্যদের পাশ কাটিয়ে চলে এলেন। আমরা যখন আমাদের রিসোর্টের কাছে এসেছি তখন হঠাৎ দেখলাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বুড়ো মানুষটা হাত নাড়ছে। ড্রাইভার চাচা গাড়ি থামালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি না পিছনে গেলেন, এখন সামনে চলে এসেছেন কেমন করে?”

বুড়ো মানুষটাকে তার উত্তর দেবার জন্যে খুব বেশি আগ্রহ দেখা গেল না, হাত নেড়ে বলল, “ঐ তো একজনকে পেয়ে গেলাম, হোন্ডায় নামিয়ে দিল!”

ড্রাইভার চাচা বললেন, “দেখলাম না তো কোনো হোন্ডা।”

বুড়ো মানুষটা বলল, “খুলেন, খুলেন, টুকরিগুলো দেন।” বলে নিজেই দরজা খুলে তার টুকরিগুলো নিতে থাকে।

সুজনকে হঠাৎ কেমন জানি উত্তেজিত দেখায়। সে কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। আমি তার দিকে তাকালাম, এর আগে কখনো দেখিনি যে সুজন কোনো কথা বলতে গিয়ে থেমে গেছে। বুড়ো মানুষটা একা নয়, হঠাৎ করে কোথা থেকে বেশ অনেকগুলো মানুষ জড়ো হয়েছে, তারা সবাই মিলে খুব তাড়াতাড়ি টুকরিগুলো নামিয়ে নিল। কাছেই একটা”চান্দের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, সেটাতে তুলে গাড়িটা দ্রুত সামনের দিকে চলে যায়।

ড্রাইভার চাচা গজগজ করতে করতে বললেন, “আমরা তার মাল সামান এনে দিলাম, সেই জন্যে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিল না, সেটা খেয়াল করেছ?”

আমরা আসলে সেটা খেয়াল করিনি, ড্রাইভার চাচার কথা শুনে মনে হল তার কথা সত্যি। আমরা যখন প্রথম গাড়িতে সবজির টুকরিগুলো তুলেছি তখন বুড়ো মানুষটার খুবই কাঁচুমাচু ভাব ছিল, যখন টুকরিগুলো নামানোর সময় হল তখন বুড়ো মানুষটার হাবভাব রীতিমতো রুক্ষ। তবে সেটা নিয়ে আমরা বেশি মাথা ঘামালাম না, একটা মানুষকে বিপদের সময় সাহায্য করেছি সেটাই বড় কথা। সেই মানুষের যদি দ্রতা বা কৃতজ্ঞতা না থাকে আমরা কী করব?

রিসোর্টের সামনে গাড়ি থামল, প্রথমে মামুন নামল। তারপর আঁখি, তারপর রিতু আর শান্তা। আমি যেই নামতে যাব সুজন তখন খপ করে আমার হাত ধরল। আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী হয়েছে সুজন?”

সুজন তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “শ-স-স-স।”

আমি গলা নামিয়ে বললাম, “কী হয়েছে?”

সুজন ফিসফিস করে বলল, “বুড়ো মানুষটার সবজির টুকরিতে কী ছিল জানিস?”

“কী?”

“এই দেখ।” সুজন তার ব্যাকপেকের মুখটা খুলে দেখাল, আমি তাকিয়ে দেখলাম সবুজ রংয়ের গোল মতোন একটা জিনিস। আমি ভালো করে তাকালাম, তারপর ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম, “গ্রেনেড!”

“হ্যাঁ।”

“তুই কেমন করে পেলি?”

“হাত দিয়ে দেখছিলাম কী আছে, দুটি সরিয়েছি।”

“কেন?”

সুজন ঢোক গিলে বলল, “জানি না।”

আমি সুজনের দিকে আর সুজন আমার দিকে তাকিয়ে রইল!

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল