০৫.

ফরাসত আলিকে থানা থেকে উদ্ধার করে আনার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। চুনু মিয়া কয়েকদিন আড়ালে আড়ালে ছিল–কিন্তু ফরাসত আলি নেহায়েৎ ভালো মানুষ–চুনু মিয়ার উপরে সেরকম রেগে যাননি বলে সে এখনও চাকরিতে বহাল আছে। পথচারী স্কুলের কাজকর্ম মোটামুটি ভালোই চলছে, যারা পড়াচ্ছে বা কাজ করছে সবাই তাদের কাজে বেশ অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। ঠিক এরকম সময়ে একটা চিঠি এল। হলুদ রঙের খামে একটা সরকারি চিঠি। খামটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই কিন্তু ভিতরের চিঠিটা পড়ে ফারুখ বখত আর ফরাসত আলির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

চিঠির উপরে নানা ধরনের সংখ্যা, তারিখ এবং কটমটে লেখা, সরকারি চিঠিতে যেরকম থাকে। কাগজের মাঝামাঝি জায়গা থেকে চিঠি শুরু হয়েছে। ওপরে সম্বোধন নেই, তার বদলে লেখা, যাহার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। চিঠিটা এরকম।

এতদ্বারা জানানো যাইতেছে যে, গণপূর্ত বিভাগে স্থানীয় এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ চিকিৎসক আইনজীবী এবং সরকারি কর্মচারীবৃন্দ এই মর্মে অভিযোগ করিয়াছেন যে অত্র অঞ্চলে একটি বেআইনি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হইয়াছে। শিক্ষাদানের পটভূমিকায় এই প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে একটি বিপজ্জনক স্থান এবং ছাত্রছাত্রীদের প্রাণের উপর হুমকিস্বরূপ।

কেন এই বেআইনি প্রতিষ্ঠানটিকে অত্র অঞ্চল হইতে সম্পূর্ণরূপে অপসারিত করা হইবে না, পত্রপাঠমাত্র সেই সম্পর্কে অত্র বিভাগকে অবহিত করিবার জন্য নির্দেশ দেয়া হইতেছে।

চিঠি এইখানে শেষ, তার নিচে নানা ধরনের সংখ্যা এবং চিহ্ন এবং একজন মানুষের স্বাক্ষর। স্বাক্ষরটি ইংরেজি বাংলা বা আরবি যে-কোনো ভাষায় হতে পারে–দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই।

চিঠি পড়ে ফারুখ বখত বললেন, “সর্বনাশ!”

ফরাসত আলি কিছু না বলে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরকম সময়ে তিনি দাড়ি চুলকাতে থাকেন, এখন সে-চেষ্টা করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন মুখমণ্ডল চাঁছাছোলা এবং তখন তিনি নিজের দাড়ি এবং চুলের জন্যে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, “কী লিখেছে চিঠিতে?”

ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “ঠিক বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে খুব খারাপ চিঠি।”

ফরাসত আলি বললেন, “আমাদের দেশে বাংলা ভাষা চালু হয়ে গেছে না? সরকারি চিঠি বাংলায় লেখার কথা না?”

ফারুখ বখত গম্ভীর গলায় বললেন, “এটা বাংলা চিঠি।”

“বাংলা নাকি?” ফারুখ বখত অবাক হয়ে বললেন, “তা হলে কিছু বুঝতে পারলি না। কেন?”

“সরকারি চিঠি পড়ে কিছু বোঝা যায় না!”

“আবার পড় দেখি! আস্তে আস্তে পড়িস।”

ফারুখ বখত আস্তে আস্তে পড়লেন, কয়েকটা শব্দ এবারে আগের থেকে বেশি বোঝা গেল কিন্তু তবু অর্থ পরিষ্কার হল না। তারা আন্দাজ করলেন কিছু একটা জিনিস বেআইনিভাবে করা হচ্ছে।

ফরাসত আলি চিঠিটা নিয়ে আরও কয়েকবার পড়লেন এবং ধীরে ধীরে হঠাৎ চিঠির অর্থ পরিষ্কার হতে শুরু করল। এই এলাকার কোনো কোনো মানুষ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে পথচারী স্কুল খুব বিপজ্জনক কাজেই স্কুলটা তুলে দেয়া হোক। তাঁদের এরকম চমৎকার একটা স্কুলের বিরুদ্ধে কেউ যে অভিযোগ করতে পারে সেটা ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত বিশ্বাস করতে পারলেন না। তারা অনেকক্ষণ চিঠির দিকে মনমরা হয়ে তাকিয়ে রইলেন, শেষে ফারুখ বখত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এই স্কুলের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছে তারা হচ্ছে শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক আর সরকারি কর্মচারী। আমরা যদি পালটা একটা চিঠি পাঠানোর চেষ্টা করি যেখানে একজন করে শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক আর সরকারি কর্মচারী লিখে দেয় যে স্কুলটা খুব ভাল তা হলে কেমন হয়?”

ফরাসত আলি বললেন, “আইডিয়াটা মন্দ না। কিন্তু পাব কোথায় এরকম মানুষ?”

“কেন, আমাদের রইসউদ্দিন হচ্ছে অঙ্কের প্রফেসর, তাকে শিক্ষাবিদ বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। অ্যাডভোকেট আব্বুল করিমকে আইনজীবী বলে চালিয়ে দেব। ডাক্তার তালেব আলি হবে চিকিৎসক আর আমাদের কাস্টমসের এমাজউদ্দিন হবে সরকারি কর্মচারী। কী বলিস?”

ফরাসত আলির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, মাথা নেড়ে বললেন, “তা-ই তো, এই সহজ জিনিসটা আমার আগে মনে হয়নি। কী আশ্চর্য!”

ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “লটারির টিকেট নিয়ে যে-ব্যাপারটা হয়েছিল সেটা কি মনে রেখেছে নাকি কে জানে!”

ফরাসত আলি হাত নেড়ে বললেন, “ধুর, এসব কি কেউ মনে রাখে নাকি? তা ছাড়া আমার কতদিনের বন্ধু। আমাদের বিপদে সাহায্য করবে না?”

“তা তো করবেই। নিশ্চয়ই করবে।”

“তা হলে চল যাই, কবে যাবি?”

“আজ বিকালেই চল।”

সেইদিনই বিকালবেলা তারা তাদের বন্ধুর বাসায় রওনা দিলেন। অঙ্কের প্রফেসরের বাসায় গিয়ে দেখলেন কেউ নেই, সেখান থেকে গেলেন ডাক্তার তালেব আলির বাসায়। দরজায় শব্দ করতেই কাজের মেয়েটি দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল, “কাকে চান?”

“ডাক্তার সাহেব আছেন?”

“জি আছেন। আসেন আমার সাথে।”

মেয়েটার পিছুপিছু একটা ঘরে ঢুকে দেখেন সেখানে ডাক্তার তালেব আলির সাথে আছে প্রফেসর রইসউদ্দিন, অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম আর কাস্টমসের এমাজউদ্দিন। চারজন মাথা কাছাকাছি রেখে কী-একটা গল্প করতে করতে খিকখিক করে হাসছিলেন। এই দুজনকে দেখে তাঁরা ভূত দেখার মতো চমকে

উঠলেন। প্রফেসর রইসউদ্দিন বললেন, “তো-তো তোমরা?”

“হ্যাঁ।” ফারুখ বখত একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললেন, “অনেকদিন খোঁজখবর নেই তোমাদের।”

ফরাসত আলি দাড়ি চুলকাতে গিয়ে থুতনি চুলকে ফেলে বললেন, “স্কুল নিয়ে খুব ব্যস্ত, অন্য কিছুতে সময় পাই না।”

তাঁর বন্ধুরা কিছু না বলে মাছের মতো চোখে তাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফরাসত আলি কিছু বলার না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা ভালো আছ?”

তার বন্ধুরা কথা না বলে মাথা নাড়লেন, সম্ভবত ভালোই আছে। তারপর আবার সবাই চুপ করে বসে রইলেন, বোঝা গেল তাদের মাঝে কথাবার্তার বিশেষ কিছু নেই।

এভাবে বেশ খানিকক্ষণ সময় কেটে যাবার ফারুখ বখত ঠিক করলেন কাজের কথা শুরু করবেন। একটু কেশে বললেন, “আমরা একটু কাজে তোমাদের কাছে এসেছি।”

“কী কাজ?”

“তোমরা তো নিশ্চয়ই জান আমরা গরিব বাচ্চাদের জন্যে একটা স্কুল খুলেছি, তাদের বেশির ভাগ এমনিতে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় বলে নাম দিয়েছি পথচারী স্কুল। বাচ্চাদের ফ্রি পড়ানো হয়, খাওয়া দেয়া হয়, দরকার হলে চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জান?”

“কী?”

“কিছু মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।”

ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এরকম একটা ভালো জিনিসের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে পারে!”

ফারুখ বখত বললেন, “পৃথিবীতে কত বিচিত্র ধরনের মানুষ আছে! এরা নিশ্চয়ই হিংসুটে মামলাবাজ বদমাইশ আর খচ্চর প্রকৃতির।”

হঠাৎ করে রইসউদ্দিন, আবু তালেব, এমাজউদ্দিন আর আব্বুল করিম অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বসলেন। ফারুখ বখত বললেন, “মানুষগুলির দেখা পেলে ঘুষি মেরে মনে হয় দাঁত খুলে নিতাম, কিন্তু দেখা পাওয়া মুশকিল। এরা পিছন থেকে চাকু মারে।”

ফরাসত আলি বললেন, “যা-ই হোক বদমাইশ মানুষ নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, আমরা এসেছি অন্য কাজে।”

অনেকক্ষণ পর অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম একটা কথা বললেন, “ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজ?”

“যারা অভিযোগ করেছে তাদের মাঝে আছে একজন শিক্ষাবিদ, একজন আইনজীবী, একজন ডাক্তার আর একজন সরকারি কর্মচারী। তোমরা চারজনও ঠিক সেরকম। এখন তোমরা যদি একটা পালটা চিঠি লিখে বল আসলে স্কুলটাতে কোনো সমস্যা নেই। চমৎকার স্কুল, এলাকার গরিব শিশুদের উপকার হচ্ছে, তা হলে হয়তো সরকারি লোকজনের মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হবে।”

ডাক্তার তালেব আলি একটা ম্যাচ বের করে সেটা দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বললেন, “কত দেবে?”

ফারুখ বখত অবাক হয়ে বললেন, “কত কী দেবে?”

“টাকা।”

“টাকা?”

“হ্যাঁ, তিরিশ লাখ টাকা শুধু তোমরা দুইজন মিলে উড়িয়ে দিচ্ছ, আমাদের কিছু দেবে না?”

ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালেন। প্রফেসর রইসউদ্দিন মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, তোমাদের জন্যে একটা কাজ করে দেব, টাকা দেবে না? টাকা ছাড়া কাজ হয় আজকাল?”

ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। শেষে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কত চাও?”

“দশ লাখ।”

“দশ লাখ?”

“হ্যাঁ।” অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম মাথা নাড়লেন।

“একটা চিঠি লিখে দেবার জন্যে দশ লাখ? কবিগুরু সঞ্চয়িতা লিখেও দশ টাকা পাননি।”

“সেটা তোমাদের বিবেচনা।”

ফারুখ বখত উঠে দাঁড়ালেন, মাথা নেড়ে বললেন, “না, এই ধরনের কাজ টাকাপয়সা দিয়ে করানো ঠিক না। দশ লাখ দূরে থাকুক দশ টাকা দিয়েও করানো ঠিক না। শহরে আরও অনেক মানুষ আছে তারা খুশি হয়ে চিঠি লেখে দেবে।”

রইসউদ্দিন মুখ বাঁকা করে হেসে বললেন, “অন্য মানুষের চিঠি আর আমাদের চিঠির মাঝে একটা পার্থক্য আছে।”

“কী পার্থক্য?”

“অভিযোগের প্রথম চিঠিটা লিখেছিলাম আমরা।”

“তোমরা!” ফরাসত আলি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরা?”

“হ্যাঁ। এতগুলি টাকা এইভাবে নষ্ট করছ চোখে দেখা যায় নাকি? একটা দুইটা মিনিবাস কিনে রাস্তায় নামিয়ে দিতে, তা না করে স্কুল দিয়েছ! তাও যদি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল হত বড়লোকের বাচ্চাদের জন্যে তা হলেও একটা কথা ছিল!”

ফারুখ বখত বললেন, “ঘুষি মেরে তোমাদের চারজনের দাঁত খুলে নেওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমি ভায়োলেন্স পছন্দ করি না তাই কিছু করলাম না।”

ফরাসত আলি বললেন, “মাথা-গরম করে লাভ নেই। আয় যাই এখান থেকে।”

তারা ঘর থেকে বের হবার আগেই কাস্টমসের অফিসার এমাজউদ্দিন বললেন, “যাবার আগে একটা কথা শুনে যান।”

“কী?”

“কালকে আপনাদের স্কুল তদন্ত করতে আসবে।”

“কালকে?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি কেমন করে জান?”

“পুরো ব্যাপারটা আমরা দাঁড় করালাম আর আমি জানব না? হে হে হে। যা-ই হোক, হাতে নগদ ক্যাশ টাকা রেখো।”

“নগদ ক্যাশ টাকা?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“কেন সেটা এখনও জান না? তোমার নাক টিপলে মনে হয় এখনও দুধ বের হয়।”

ফারুখ বখত ফরাসত আলির হাত ধরে টেনে বললেন, “আয় যাই এখান থেকে।”

অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম বললেন, “আমার কথাটা একটু ভেবে দেখলে পারতে হে. খরচ কম পড়ত।”

ডাক্তার তালেব আলি বললেন, “একটা স্কুল উলটো করে দাঁড় করিয়ে রেখেছ, তদন্ত করতে এসে সেটা যখন দেখবে তোমাদের কোনো উপায় আছে বের হবার?”

প্রফেসর রইসউদ্দিন হিহি করে হেসে বললেন, “স্কুলের মেঝে উঠে গেছে আকাশে, দরজাগুলি আড়াআড়ি, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল বের হয়ে এসেছে দেয়াল থেকে, ফাজলেমির তো একটা মাত্রা থাকা দরকার!”

এমাজউদ্দিন নাক দিয়ে ফোৎ করে একটা শব্দ করে বললেন, “আর সেই স্কুলের ছাত্র কারা? এলাকার যত গুণ্ডাপাণ্ডা বখা ছেলেপিলে। রিকশাওয়ালার ছেলে! চোর-চামারের ছেলে। ছেঃ!”

ফারুখ বখত ফরাসত আলির হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে এলেন। রাস্তায় নেমে ফরাসত আলি বললেন, “আসলে তুই ঠিকই বলেছিলি।”

“কী?”

“ঘুষি মেরে দাঁতগুলি ভেঙে দেয়া উচিত ছিল।”

.

সন্ধ্যেবেলা ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি খুব মন-খারাপ করে তাদের ঘরে বসেছিলেন। এখনও তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না যে কোনো মানুষ শুধুমাত্র হিংসা করে তাদের এত সুন্দর একটা স্কুলের পিছনে লাগতে পারে। তারা যখন বসে বসে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলছিলেন ঠিক তখন হারুন ইঞ্জিনিয়ার এসে হাজির হলেন, তাঁদের এভাবে বসে থাকতে দেখে বললেন, “কী হল, তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে ছেলে মরে গেছে?”

ফরাসত আলি লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “অবস্থা অনেকটা সেরকমই।”

“কেন? কী হয়েছে?”

ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত তখন পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেন। সব শুনে হারুন ইঞ্জিনিয়ার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে এত চিন্তা করার কী আছে?”

“চিন্তা করার কিছু নেই? কী বলছ? যদি স্কুল বন্ধ করে দেয়?”

“স্কুল ঠিক করে ফেলো, তা হলে বন্ধ করবে না। উলটো স্কুল সোজা করে বসিয়ে ফেলো–আমি কতদিন থেকে বলছি!”

“সময় কোথায়? কালকেই আসবে তদন্ত করতে।”

“অনেক সময় আছে। এক রাতে পুরো স্কুল খুলে আমরা লাগিয়ে দেব। মনে নেই আগেরবার কীরকম একটা ঝড়ের রাতে পুরো স্কুল বসিয়ে দিয়েছিলাম? সেই তুলনায় আজকে কী চমকার রাত! পরিষ্কার জোছনা। দেখতে দেখতে কাজ শেষ হয়ে যাবে।”

“সত্যি পারবে? সত্যি?” উত্তেজনায় ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি উঠে দাঁড়ালেন।

“না পারার কি আছে! এখন তো কাজ আরও সহজ। ইচ্ছে করলে নিচের ক্রুগুলি খুলে পুরো স্কুলঘরটা নামিয়ে দেব। এক ঘণ্টায় কাজ শেষ।”

“তাহলে আর সময় নষ্ট করে কাজ নেই, চলো কাজ শুরু করে দিই।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার উঠে দাঁড়ালেন, “চলো। চুনু মিয়াকে ডেকে আনতে হবে, সাথে মহসিন আর রুখসানা। দুজনেই খুব কাজের মানুষ। তোমরা সবাইকে নিয়ে যাও। আমি কিছু যন্ত্রপাতি, চার্জার লাইট, কপিকল, নাইলনের দড়ি এইসব নিয়ে আসছি।”

ঘণ্টাখানেকের মাঝেই জোছনারাতে সবাই কাজ শুরু করে দিলেন। কয়েকটা চার্জার লাইট জ্বালানো হয়েছে। এক পাশে একটা কেরোসিনের চুলায় বড় কেতলিতে পানি গরম হচ্ছে চা তৈরি করার জন্যে। কাছাকাছি কোথাও একটা ক্যাসেট-প্লেয়ারে ভাওয়াইয়া গান হচ্ছে, কাজ করার সময় এরকম গান চমৎকার শোনায়।

হারুন ইঞ্জিনিয়ার বগলে কিছু কাগজ নিয়ে কাজকর্ম দেখছেন, অন্য সবাই কাজ করছে। প্রথমে ভেবেছিলেন পুরো স্কুলঘরটাই কাত করে নামিয়ে নেবেন, সাতপাঁচ ভেবে সেটা না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একটা একটা করে ঘর খুলে নেয়া হচ্ছে, কপিকলে বেঁধে সাবধানে সেটা নামিয়ে নেয়া হচ্ছে, তারপরে ঠেলেঠুলে সেটাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে মাটিতে পাকাঁপাকিভাবে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। অসংখ্য বড় বড় স্কু, মস্ত বড় রেঞ্জ দিয়ে খুলে ফেলছে সবাই, আবার নতুন জায়গায় গিয়ে লাগিয়ে ফেলছে। সত্যিকারের কাজ খুব বেশি নয়, কিন্তু নানারকম খুঁটিনাটি ব্যাপার হয়েছে, এইসব খুঁটিনাটির ব্যাপারেই সময় বেশি চলে যাচ্ছে। হারুন ইঞ্জিনিয়ারের হিসেবে রাত একটার মাঝে কাজ শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল, কিন্তু কাজ শেষ হতে হতে ভোররাত হয়ে গেল।

সারারাত কাজ করে কারও গায়ে আর কোনো জোর অবশিষ্ট নেই। বাসায় ফিরে গিয়ে যে যেখানে জায়গা পেল শুয়ে টানা ঘুম।

ফারুখ বখত কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েই উঠে পড়লেন, আজ তার স্কুল তদন্তের জন্যে লোক আসার কথা। সেই লোকজন আসার আগেই তিনি স্কুলে চলে যেতে চান। দাড়ি কামিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে তিনি ফরাসত আলিকে ডেকে তুললেন। তারপর দুজন কিছু খেয়ে গরম দুই কাপ চা খেয়ে স্কুলে ছুটলেন।

এতদিন স্কুলটা খাড়া উপরে উঠে গিয়েছিল, এখন সেটা নিচে নেমে এসেছে বলে দেখতে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিন্তু স্কুলঘরগুলি দেখাচ্ছে চমৎকার, দেখে কে বলবে এটা এক রাতের কাজ? ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত অবাক হয়ে দেখলেন, এই সাতসকালেই সবাই এসে হাজির হয়েছে। মহসিন তার কম্পিউটারগুলি ঠিক করে সাজিয়ে রাখছে। চুনু মিয়া হাতে ন্যাকড়া নিয়ে ঘরের দরজা-জানালা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছে। রুখসানা কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে দুটি গোলপোস্ট বসাচ্ছে, কিছুদিনের মাঝেই ফুটবলের সিজন শুরু হবার কথা।

স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এল একটু পরেই, তাদের খাড়া স্কুল হঠাৎ চিত হয়ে শুয়ে আছে দেখে তারা এত অবাক হল বলার নয়। ছোট বাচ্চারা নতুন কিছু খুব পছন্দ করে তাই তাদের খুশি দেখে কে। নতুন ধরনের স্কুল সবাই ছোটাছুটি শুরু করে দিল।

স্কুলকে ঠিক করে বসাতে দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন মির্জা মাস্টার। মই বেয়ে বেয়ে ক্লাস ঘরে ওঠা এবং আড়াআড়ি দরজা দিয়ে খুব সাবধানে ক্লাস ঘরে ঢুকতে এবং বের হতে হতে তিনি ত্যক্তবিরক্ত হয়ে গেছেন। স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকও খুব খুশি হলেন, খাড়া উপরে উঠে যাওয়ার স্কুলঘরটা সবসময়েই দুলতে থাকত, ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হওয়া খুব সহজ নয়।

স্কুলের তদন্ত করার জন্যে সরকারি অফিসার এলেন বেলা এগারোটার দিকে। তখন ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত দুজনেই বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের সাইনবোর্ডটা নতুন এক জায়গায় লাগাচ্ছিলেন। স্কুলটি এখন আর খাড়া লম্বা হয়ে উঠে যাচ্ছে না বলে সেটাকে উঁচু বাঁশে করে উপরে ঝুলিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। সরকারি অফিসারটিকে ফারুখ বখত এবং ফরাসত আলিকে চেনেন না, কিন্তু সাথে রইসউদ্দিন, তালেব আলি, আব্বুল করিম আর এমাজউদ্দিনকে দেখে চিনে ফেললেন। তারা যখন স্কুলঘরের কাছে এসেছে তখন তাদের মুখ মাছের মতো করে একবার খুলছে এবং বন্ধ হচ্ছে। গতকালকে বিকালেও তারা দেখেছে স্কুলটি উলটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এখন ম্যাজিকের মতো সোজা হয়ে গেছে! নিজের চোখকেও তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। সরকারি অফিসার এদিকে-সেদিকে তাকিয়ে এমাজউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোথায় সেই স্কুল?”

এমাজউদ্দিন তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “এ-এ-এ এইটাই সেই স্কুল।”

“এটা উলটো কোথায়? এটা তো ঠিকই আছে।”

“তা-তা-তা তাই তো দেখছি। কা-কা-কা কাল বিকালেও উলটো ছিল।”

সরকারি অফিসার চোখ পাকিয়ে এমাজউদ্দিনের দিকে তাকালেন, রেগে গিয়ে বললেন, “আমার সাথে মশকরা করেন?”

“না স্যার, ম-ম-ম মশকরা না! সত্যিই ছিল। কালকেই উলটো ছিল। খো খো-খো খোদার কসম!”

“চুপ করেন।“ সরকারি অফিসার প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে বললেন, “আল্লাহ খোদাকে টেনে আনবেন না এখানে। গাঁজা খেয়ে হাঁটাহাঁটি করেন, নাকি চোখে দেখেন না?”

ধমক খেয়ে এমাজউদ্দিন একেবারে কুঁকড়ে গেলেন, দেখে মনে হতে লাগল মাটির মাঝে মিশে যেতে চাইছেন কোনোভাবে। সরকারি অফিসার তখন অন্য তিনজনের দিকে তাকালেন, চোখ পাকিয়ে বললেন, “আপনাদের কী বলার আছে?”

রইসউদ্দিন মাথা চুলকে বললেন, “ঠিক বুঝতে পারছি না, কিছু একটা গোলমাল আছে কোনোখানে।”

“গোলমাল তো আছেই, সেটা তো আমি জানি। নিজের চোখে দেখছি। চমৎকার একটা স্কুলের পিছনে লেগেছেন সবাই মিলে–অভিযোগ করে দিলেন স্কুলটা খাড়া আকাশে উঠে গেছে। এত সুন্দর স্কুল দেখেছেন আগে?”

ডাক্তার তালেব আলি বারকয়েক চেষ্টা করে বললেন, “আ-আ-আমরা মিথ্যা কথা বলছি না স্যার, সত্যিই স্কুলটা উলটো ছিল।”

“চুপ করেন–” সরকারি অফিসার বাজখাই গলায় একটা ধমক দিয়ে বললেন, “স্কুলঘর কি কেউ রাতারাতি শুইয়ে দিতে পারে? সেটাই আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?” অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম ঢোক গিলে বললেন, “স্যার, আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখেন।”

“চুপ করেন আপনি,” সরকারি অফিসার প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, “আমি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করব না অন্যের কথাকে বিশ্বাস করব? আমি কি আপনাদের মতো গাঁজা খেয়ে হাঁটাহাঁটি করি?”

অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম মাছের মতো খাবি খেতে লাগলেন। সরকারি অফিসার পকেট থেকে কী একটা কাগজ বের করে সেখানে ঘসঘস করে কী লিখে চোখ তুলে চারজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি দেখে নেব আপনাদের চারজনকে। হিংসা করে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমাকে হেড অফিস থেকে টেনে এনেছেন। আমাকে ভেবেছেন কী আমার সময়ের কোনো দাম নেই? আমি কি আপনাদের মতো চব্বিশ ঘণ্টা চুকলামি করে বেড়াই? নাকি লাফাংরামি করে বেড়াই?”

চারজন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সরকারি অফিসার হুংকার দিয়ে বললেন, “আপনাদের আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।”

এইরকম সময় ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি একটু এগিয়ে এলেন। সরকারি অফিসার চোখ পাকিয়ে বললেন, “আপনারা আবার কারা?”

ফারুখ বখত একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “আমরা এই স্কুলটা চালাই, একটু ভিতরে এসে দেখতে চান স্যার? চালচুলোহীন বাচ্চারা কী সুন্দর পড়তে শিখেছে! একটু বড় যারা কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করতে পারে। ইংরেজি পড়তে পারে।”

সরকারি অফিসার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চারজনকে দেখিয়ে বললেন, “এই চারজন গাঁজাখোর মানুষের সাথে কথা বলে আমার দিনটাই নষ্ট হয়ে গেছে, হলে সত্যি আমি যেতাম।”

“ভিতরে গেলে আপনার দিনটা হয়তো ভালো হয়ে যাবে।”

“নিশ্চয়ই যাবে, অবশ্যিই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু এই নিষ্কর্মা মানুষগুলির কথায় এতদূর থেকে এখানে এসে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে, আজকে আর আসতে চাই না। আরেকদিন সময় নিয়ে আসব।”

“অবশ্যই আসবেন স্যার।”

সরকারি অফিসার লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে গিয়ে একটা জিপে উঠে চলে গেলেন।

রইসউদ্দিন, তালেব আলি, আব্বুল করিম আর এমাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতে লাগলেন। দেখে মনে হতে লাগল তারা পারলে একজন আরেকজনকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবেন।

ফারুখ বখত মুখ টিপে হেসে বললেন, “তোমরা যখন জেলের ভাত খেয়ে ফিরে আসবে তোমাদের কোনো চাকরিবাকরি থাকবে না। যদি কাজ চাও আমার কাছে এস। আমাদের স্কুলের দারোয়ানের চাকরি দিয়ে দেব!”

ফরাসত আলি সাধারণত ঠাট্টা-তামাশা করেন না, আজকে তিনিও লোভ সামলাতে পারলেন না, বাম চোখটা একটু ছোট করে বললেন, “মানুষ যেরকম করে লেখে, কুকুর হইতে সাবধান’–আমরা সেরকম করে লিখে দেব, ‘জেলফেরত হইতে সাবধান।

ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত একে অন্যকে জাপটে ধরে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলেন, কিন্তু অন্য চারজন তার মাঝে এতটুকু রসিকতাও খুঁজে পেলেন না।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল