০৪.

পরদিন ভোরে ফারুখ বখত এবং ফরাসত আলি তাদের স্কুলের সামনে একটা বিশাল সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলেন। সাইনবোর্ডে বিরাট বড় করে লেখা :

পথচারী মডার্ন স্কুল

তার নিচে আরেকটু ছোট ছোট অক্ষরে লেখা :

এখানে বিনামূল্যে যে-কোনো শিশুকে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয়া হয়।

তার নিচে আরেকটু ছোট অক্ষরে লেখা :

শিশুদের বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, বিজ্ঞান এবং কম্পিউটার ব্যবহার ও প্রোগ্রামিং শেখানো হয়।

তার নিচে আরেকটু ছোট অক্ষরে লেখা :

শিশুদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেয়া হয়, চিকিৎসা ও খেলাধুলার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

তার নিচে আরেকটু ছোট অক্ষরে লেখা :

শিশুদের জাতি ধর্ম বর্ণ ও সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে বিশ্বমানবিকতায় উদ্বুদ্ধ করা হয়।

তার নিচে আরেকটু ছোট অক্ষরে লেখা :

শিশুদের পারিবারিক মূল্যবোধ নৈতিকতা এবং নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা দেয়া হয়।

সাইনবোর্ডের নিচে আর কিছু লেখার জায়গা নেই, যদি থাকত সেখানে যে আরও কিছু লেখা হত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সাইনবোর্ড লাগানো শেষ হওয়ার আগেই হারুন ইঞ্জিনিয়ার এসে হাজির হলেন, নাকের উপর চশমাটি ভালো করে বসিয়ে তিনি সাইনবোর্ডের পুরো লেখাটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে ভুরু কুঁচকে ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখতের দিকে তাকালেন। ফারুখ বখত একগাল হেসে বললেন, “ভালো হয়েছে না সাইনবোর্ডটা?”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা নেড়ে বললেন, “সাইনবোর্ডে এতসব করবে বলে লিখেছ কিন্তু তোমার মাস্টার হচ্ছে মাত্র একজন। মির্জা মাস্টার।”

ফরাসত আলি বললেন, “মির্জা মাস্টার একাই একশো।”

“আমি ওজনের কথা বলছি না!”

ফরাসত আলি থতমত খেয়ে বললেন, “আমি আসলে সেটা বলছিলাম না। মির্জা মাস্টার সাংঘাতিক ভালো মাস্টার, একাই সবকিছু পড়াতে পারেন–”

“কিন্তু ঐ যে কম্পিউটার সায়েন্সের কথা লিখেছ? চিকিৎসা, খাবার সেগুলি কে করবে?”

ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “তার জন্যে আমাদের লোক খুঁজে বের করতে হবে। সব বিষয়ের জন্যে একজন করে শিক্ষক, একজন ডাক্তার আর একজন বাবুর্চি।”

“বাবুর্চি?”

“হ্যাঁ, বাচ্চাদের জন্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার রান্না করতে হবে না?”

“এতসব করবে কখন?”

ফরাসত আলি বললেন, “কোনো চিন্তা করবে না। লটারিতে তিরিশ লাখ টাকা পেয়েছি, পুরো টাকাটা খরচ করা হবে এই স্কুলের পিছনে।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার চশমা খুলে তার কাঁচগুলি পরিষ্কার করতে করতে বললেন, “তা ঠিক।”

পরের দিনই খবরের কাগজে শিক্ষকদের জন্যে বিজ্ঞাপন দেয়া হল। এক সপ্তাহের মাঝে আবেদনপত্র জমা হতে শুরু করল এবং ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত তাদের ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলেন। ব্যাপারটি যত সহজ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল মোটেই তত সহজ হল না। যেমন ধরা যাক কম্পিউটারের শিক্ষকের কথা। প্রথমে যে এল তার চোখে কালো চশমা এবং মুখে সিগারেট। ফারুখ বখত বললেন, “আমাদের এটা বাচ্চাদের স্কুল, সিগারেট খাওয়া একেবারে বন্ধ করার চেষ্টা করছি।”

কালো চশমা চোখের মানুষটি সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “এটা বিদেশি সিগারেট। আমি দেশি সিগারেট খাই না।”

“দেশি-বিদেশি জানি না, আমাদের স্কুল কম্পাউন্ডে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ।”

শুনে লোকটা হে হো করে হেসে উঠল যেন তিনি খুব একটা মজার কথা বলেছেন। ফারুখ বখত তখন তার ইন্টারভিউয়ের খাতায় লোকটির নামের পাশে কাটা চিহ্ন দিয়ে লিখলেন ‘বাতিল’।

পরের মানুষটির মুখে এক ধরনের সবজান্তা সবজান্তা ভাব। ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি হাত ধরে খুব জোরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “স্কুলের বাচ্চাদের কম্পিউটার শেখানোটা খুব ভালো আইডিয়া।”

ফরাসত আলি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কম্পিউটার বিষয়ে অভিজ্ঞ?”

“বলতে পারেন। আমার বন্ধুর ছোটভাইয়ের একটা কম্পিউটার আছে, আমি কয়েকবার দেখেছি।”

“দেখেছেন?”

“হ্যাঁ।”

“কখনো ব্যবহার করেননি?”

“আপনাদের স্কুলে জয়েন করেই ব্যবহার করব।”

ফারুখ বখত মাথা নেড়ে বললেন, “বাচ্চা ছেলেদের কম্পিউটার ব্যবহার করা শেখাতে হবে, প্রোগ্রামিং করা শেখাতে হবে, আপনি কেমন করে সেটা করবেন?”

সবজান্তা চেহারার মানুষটা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “আপনারা ঠিক বুঝতে পারছেন না। আমি উপমন্ত্রীর ছোটভাইয়ের সাক্ষাৎ শালা”

ফারুখ বখত সবজান্তা মানুষটাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমরা তো শালা-সম্বন্ধীকে খুঁজছি না, কম্পিউটারের একজন মাস্টার খুঁজছি। আপনি এখন আসেন”

তারপর তিনি তার ইন্টারভিউয়ের খাতায় সবজান্তার নামের পাশে বড় করে লিখলেন ‘বাতিল’।

এর পরের যে-মানুষটি এল সে একেবারে সাদাসিধে চেহারার। ফারুখ বখত জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কম্পিউটার সম্পর্কে জানেন শোনেন?”

“কম্পিউটার?” লোকটা খুব অবাক হয়ে ফারুখ বখতের দিকে তাকাল।

”হ্যাঁ, কম্পিউটার।” ফারুখ বখত আরও অবাক হয়ে সাদাসিধে লোকটার দিকে তাকালেন।

সাদাসিধে লোকটা মাথা চুলকে বলল, “কম্পিউটার কী সেটা তো আমি জানি না। আমি ভাবছিলাম আপনারা জিরক্স করার কপি মেশিনের কথা বলছিলেন। সেটা আমি খুব ভালো করে জানি। উপরে কাগজটা দিয়ে ডানদিকে টিপি দিতে হয়। তখন কাগজটা কপি হয়ে বের হয়ে আসে।”

ফারুখ বখত হাসি চেপে বললেন, “কিন্তু আমরা তো জিরক্স করার কপি মেশিনের জন্যে মানুষ খুঁজছি না, আমরা খুঁজছি কম্পিউটার মাস্টার।”

তারপর তার নামের পাশে ছোট ছোট করে লিখলেন, ‘বাতিল’।

এইভাবে একজনের পর আরেকজন বাতিল হয়ে শেষ পর্যন্ত যে-মানুষটিকে নেয়া হল তার নাম মুহম্মদ মহসিন। তার বয়স বেশি না, দেখে মনে হয় বুঝি স্কুলের ছাত্র। সে কলেজে পড়তে পড়তে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাজারের কাছে কম্পিউটারের একটা দোকানে বসে কাজ শুরু করেছিল। কয়েকদিনের মাঝে আবিষ্কার করল কম্পিউটার কেমন করে ব্যবহার করতে হয় ব্যাপারটা সে খুব ভালো বোঝে। কম্পিউটারের দোকানের মালিকের সাথে তার কী-একটা গোলমাল হওয়ার পর সে চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে। কম্পিউটারগুলিতে সে কী করে এসেছে কেউ জানে না, কিন্তু প্রতি বুধবার বেলা এগারোটার সময় কম্পিউটারগুলি হঠাৎ মোটা গলায় সুর করে বলে–

জব্বার ভাই
চামড়া দিয়া জুতা বানাই

দোকানের মালিক জব্বার আলি ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করেন না। তিনি বুধবার বেলা এগারোটার সময় তার দোকান এক ঘণ্টার জন্যে বন্ধ করে দেন। শোনা যাচ্ছে তিনি তার কম্পিউটারগুলি বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সুবিধা করতে পারছেন না।

ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখতের মহসিনকে খুব পছন্দ হল। তখন তখনই তাকে তারা একটা চেক লিখে পথচারী স্কুলের কম্পিউটারের সব দায়িত্ব দিয়ে দিলেন।

কম্পিউটারের শিক্ষকের পর তাঁরা খেলাধুলার জন্যে একজন শিক্ষক খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন। ইন্টারভিউ দিতে প্রথম যে-মানুষটি এসে হাজির হল তাকে দেখে তাদের চোখ কপালে উঠে গেল। মানুষটি শুকনো হাড়জিরজিরে, গাল ভেঙে মুখের ভিতরে ঢুকে গেছে, চোখ গর্তের ভিতরে। মানুষটির গায়ের চামড়া এবং দাঁত হলুদ রঙের। ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে মানুষটি কাশতে শুরু করল, ফরাসত আলি আর ফারুখ বখতের মনে হতে লাগল কাশতে কাশতে এই চেয়ারেই মানুষটির দম আটকে পড়ে যাবে এবং এক্ষুনি স্ট্রেচারে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মানুষটি শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিল, তখন ফারুখ বখত ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কোন পোস্টে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?”

“কেন, খেলাধুলার শিক্ষক!”

“কিন্তু খেলাধুলার শিক্ষকদের অনেক শক্তসমর্থ হওয়া দরকার। দৌড়াদৌড়ি করতে হবে, পি.টি. স্পোর্টস, সাঁতার ফুটবল ক্রিকেট, আপনি কি পারবেন এইসব?”

মানুষটি কথা বলতে গিয়ে আবার কাশতে শুরু করল এবং কাশি শেষ হবার আগেই তার হাঁপানির টান শুরু হয়ে গেল। ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি দীর্ঘ সময় চুপ করে বসে রইলেন এবং মানুষটি শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “বছরের এই সময়টা আমি মোটামুটি ভালো থাকি, এই সময়ে কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু—”

ফারুখ বখত ইন্টারভিউয়ের খাতায় মানুষটির নামের পাশে বড় বড় করে লিখলেন, ‘বাতিল’।

এর পরে যে-মানুষটি এসে ঢুকল তাকে একটা ছোটখাটো দৈত্য বলে চালিয়ে দেয়া যায়, ঘরে ঢোকার সময় তার দরজায় মাথা ঠুকে গেল। তার বুকের সিনা দুই মিটারের এক সেন্টিমিটার কম না। হাতের মাংসপেশি দেখে মনে হয় বুঝি জীবন্ত কোনো প্রাণী কিলবিল করছে। ফারুখ বখত এবং ফরাসত আলি দুজনেই তাকে দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন।

মিনি দৈত্যটি তাদের সামনে চেয়ারে বসার পর ফরাসত আলি বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই খেলাধুলায় শিক্ষকের জন্যে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?”

“হাঁহ?”

ফরাসত আলি আবার প্রশ্নটি করলেন এবং মিনি দৈত্যকে খুব বিভ্রান্ত দেখা গেল। ফরাসত আলি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবার প্রশ্ন করলেন। এবারে মিনি দৈত্য সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “হাঁহ!”

ফারুখ বখত তাঁর বলপয়েন্ট কলমটা টেবিলে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, “ছোট বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করার ব্যাপারে আপনার কোনো অভিজ্ঞতা আছে?”

“হাঁহ?” ফারুখ বখত আবার প্রশ্নটি করলেন এবং মিনি দৈত্য আবার বলল, “হাঁহ?”

ফরাসত আলি অনেকক্ষণ চিন্তা করে এবারে জিজ্ঞেস করলেন, “ফুটবল ক্রিকেট ভলিবল এইসব খেলা আপনি জানেন?”

“হাঁহ?”

এতক্ষণে তারা দুইজনে বুঝে গেছেন এই বিশাল মানুষের শক্তিশালী দেহটির নিয়ন্ত্রণে যে-মস্তিষ্কটি আছে সেটি আকারে খুবই ছোট, লবণের চামচে দুই চামচের বেশি হবার কথা নয়। ছোট বাচ্চাদের খেলাধুলর দায়িত্বে এই মানুষটিকে রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। ফারুখ বখত তার নামের পাশে বড় বড় করে লিখলেন, ‘বাতিল’।

এরপর যে-মানুষটি ইন্টারভিউ দিতে এল সে খুব লম্বা নয় কিন্তু তার পেটা শরীর। মানুষটি শার্টের হাতা গুটিয়ে তাদের সামনে বসে দাঁত বের করে হেসে বলল, “কেমুন আছেন ওস্তাদ?”

ফারুখ বখত আর ফরাসত আলিকে এর আগে কেউ ওস্তাদ বলে ডাকেনি তাই তারা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভালো।”

ফরাসত আলি তার কাগজপত্র দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “খেলাধুলার ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা আছে?”

“কী বুলেন আপনি! জেইলখানায় আমার কাবাডি টিম ছিল চ্যাম্পিয়ান।” ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি দুজন একসাথে চমকে উঠে বললেন, “জেলখানায়?”

“হুঁ হুঁ।“

“জেলখানায় আপনি কী করতেন?”

“জেইলখানায় কী করে মানুষে? কয়েদ খাটে। হা হা হা!”

“কেন গিয়েছিলেন আপনি জেলে?”

“মার্ডার কেস।”

“মার্ডার কেস?”

মানুষটি পিচিক করে মেঝেতে থুতু ফেলে বলল, “খামাখা কোট কাঁচারী! জজ সাহেবের লাশ ফেলে দেয়া দরকার ছেল–”

ফরাসত আলি ঢোক গিলে বললেন, “আপনি জজ সাহেবকে খুন করার কথা বলছেন?”

লোকটা মনে হল একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “এত অবাক হচ্ছেন কেন? খুন খারাপি করেন নাই কুনোদিন?”

ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত কোনোদিন খুন-খারাপি করেননি শুনে লোকটা খুব অবাক এবং হতাশ হল। মেঝেতে পিচিক করে আরেকবার থুতু ফেলে বলল, “যার যেইটা লাইন।

ফারুখ বখত সাবধানে এই মানুষটির নামের পাশে বড় বড় করে লিখলেন, ‘বাতিল’!

খেলাধুলার শিক্ষক হিসেবে শেষ পর্যন্ত যাকে নেয়া হল সে কমবয়সী একটা মেয়ে। মেয়েটি হালকা পাতলা, চেহারার মাঝে একটা উদাস-উদাস ভাব। কথা বার্তা খুব সুন্দর করে বলে শুনলে মনে হয় কেউ বুঝি টেলিভিশনে খবর পড়ছে। মেয়েটিকে দেখে ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি মনে-মনে তাকে বাতিল বলে ধরে নিয়েছিলেন, তাদের ধারণা ছিল খেলাধুলার শিক্ষক হতে হবে গাট্টাগোট্টা একজন পুরুষ। যখন কথাবার্তা শুরু হল ফারুখ বখত বললেন, “খেলাধুলার ব্যাপার, বুঝতেই পারছেন ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, মেয়েদের

কমবয়েসী মেয়েটি–যার নাম রুখসানা হক, মিষ্টি করে হেসে বলল, “আপনি ভাবছেন মেয়েরা ছেলেদের মতো দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করতে পারে না?”

ফারুখ বখত থতমত খেয়ে বললেন, “না, ঠিক তা বলছি না।”

মেয়েটি আবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “আপনারা এক সেকেন্ড টেবিল থেকে সরে বসবেন?”

ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি ঠিক কী হচ্ছে বুঝতে না পারলেও টেবিল থেকে সরে দাঁড়ালেন। রুখসানা শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে দুইপা পিছিয়ে গেল। ডানহাতটা উপরে তুলে বামহাতটা সে নিজের সামনে ধরে দাঁড়াল। তারপর কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ সে গুলির মতো ছুটে আসে, ডানহাত দিয়ে টেবিলের মাঝখানে আঘাত করল আর সাথে সাথে টেবিলটা দুভাগ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। রুখসানা হাত ঝেড়ে শাড়িটা আবার ঠিক করে পরে ফারুখ বখতের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, “সস্তা কাঠ! পাটশলার মতো ভেঙে যায়।”

ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি মিনিটখানেক কথা বলতে পারলেন না। তারপর বললেন, “তুমি—মানে–আপনি, মানে–হাত দিয়ে–মানে তুমি—”

রুখসানা বলল, “থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট। বড় কথা হচ্ছে ব্যালেন্স, শরীরের উপর ব্যালেন্স রাখতে হয়। জোরটা দিতে হয় ঠিক যেখানে প্রয়োজন। ছেলে মেয়ে বলে কোন কথা নেই। ছেলেরা যেটা পারে মেয়েরাও সেটা পারে।”

“অবশ্যি অবশ্যি।”

“তাই খেলাধুলার শিক্ষক হতে হলে ছেলে হতে হবে সেরকম কোন কথা নেই।”

রুখসানা তার ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে আসি তাহলে।”

ফারুখ বখত বললেন, “কো-কো-কোথায় যাচ্ছেন?”

“চলে যাচ্ছি। আপনাদের কথাবার্তা শুনে বুঝে গেছি আপনারা মেয়েদের ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন না। শুধু সময় নষ্ট করে কি হবে?”

রুখসানা চলে যেতে যেতে দরজার কাছে থেমে বলল, “টেবিলটার জন্যে দুঃখিত। আপনারা তো লটারিতে অনেক টাকা পেয়েছেন, আরেকটা কিনে নেবেন?”

ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি কিছু বলার আগে দরজা খুলে রুখসানা বের হয়ে গেল।

সেকেন্ড দশেক পরে হঠাৎ ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তারপর দুজনে দুদ্দাড় করে ছুটতে ছুটতে রুখসানাকে রাস্তায় গিয়ে ধরলেন। একেবারে হাতজোড় করে বললেন, “প্লিজ রুখসানা প্লিজ, তুমি যেয়ো না!”

ফরাসত আলি বললেন, “তোমার মতো একজন দরকার আমাদের স্কুলে।”

ফারুখ বখত বললেন, “আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার ভারটা তুমি নাও!”

“যেভাবে তুমি করতে চাও, যা তুমি করতে চাও!”

“তুমি বলো তোমার কী লাগবে। এই মুহূর্তে তোমাকে চেক লিখে দেব।”

রুখসানা মিষ্টি করে হেসে বলল, “আপনারা এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, আপনারা যদি চান অবশ্যি আমি খেলাধুলার শিক্ষক হব! ছোট ছেলেমেয়েদের আমার খুব ভালো লাগে।”

কম্পিউটার আর খেলাধুলার শিক্ষক ছাড়াও তাঁদের একজন অঙ্ক আরেকজন বিজ্ঞানের শিক্ষক দরকার ছিল। অঙ্কের শিক্ষকটি তারা পেয়ে গেলেন খুব সহজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিটায়ার্ড অঙ্কের প্রফেসর, নাম ইদরিস আলি, সবাই ডাকে প্রফেসর আলি। ঘোর নাস্তিক মানুষ, অঙ্ক কষে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন ঈশ্বর বলে কিছু নেই। পুরো ব্যাপারটি নাকি শেষ পর্যন্ত একটা দ্বিমাত্রিক ইকুয়েশানে এসে শেষ হয়েছে। সেই ইকুয়েশানের দুইটি সম্ভাব্য উত্তর। একটি উত্তর সত্যি হলে ঈশ্বর আছে, আরেকটি সত্যি হলে ঈশ্বর নেই। এখন কোনটি সত্যি সেটা নিয়ে খুব সমস্যার মাঝে আছেন। পথচারী স্কুলের বাচ্চাদের অঙ্ক শেখানোর জন্যে অবিশ্যি সেটি কোনো সমস্যা নয়। কারণ ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত বারবার করে বলে দিয়েছেন এই স্কুলের বাচ্চারা হবে নতুন যুগের মানুষ, তার অর্থ নিজের ধর্মকে ভালোবাসবে এবং অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে। কাজেই ঈশ্বর আছে কি নেই এ-ধরনের গুরুতর বিষয় নিয়ে তাদের যেন বিভ্রান্ত করে দেয়া না হয়। প্রফেসর আলি খানিকক্ষণ তর্ক করে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছেন–তিনি তর্ক করতে ভালোবাসেন, প্রতিদিন ভোরে নাস্তা করার আগে কেন নাস্তা করতে হবে সেটা নিয়েও তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় আধঘণ্টা তর্ক করেন। প্রফেসর আলি বলেছিলেন পথচারী স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্যে তিনি কোনো বেতন নেবেন না, কিন্তু ফারুখ বখত আর ফরসত আলি বলেছেন, বেতন না নিলে কেউ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে না। তিনি শেষ পর্যন্ত অল্প কিছু বেতন নিতে রাজি হয়েছেন।

অঙ্কের শিক্ষক সহজে পেয়ে গেলেও বিজ্ঞানের শিক্ষক পাওয়া খুব সহজ হল। অনেকেই ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল কিন্তু কাউকেই ফারুখ বখত আর ফরাসত আলির পছন্দ হয় না। তারা হারুন ইঞ্জিনিয়ারকে অনেকবার অনুরোধ করলেন কিন্তু হারুন ইঞ্জিনিয়ার কিছুতেই রাজি হলেন না, ছোট বাচ্চাদের তিনি খুব ভয় পান, তাদের থেকে তিনি সবসময় অন্তত একশো হাত দূরে থাকতে চান। তিনি স্কুলঘরটা সোজা করে বসিয়েই চলে যাবেন, তাঁর নাকি ইতালি বা আমেরিকা কোথায় গিয়ে বছরখানেক কাজ করতে হবে। বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যাকে শেষ পর্যন্ত নেয়া হল তার নাম রাণু মুখার্জী, সবাই তাঁকে রাণুদিদি বলে ডাকে। তিনি স্কুল কলেজ পাস করেছেন অনেক আগে কিন্তু কখনো কোথাও কাজ করেননি, নিজের বাচ্চাদের মানুষ করেছেন। বাচ্চারা এখন কলেজে পড়ে তাই নিজের অনেক অবসর। এলাকার সবাই জানে তিনি খুব কাজের মানুষ, সবসময় কিছু-না-কিছু করছেন। তাঁর বাসায় ফুলের টবে নানারকম শবজি গাছ লাগানো। বিচিত্র সব শবজি, শসা এবং কুমড়া একত্র করে তৈরি হয়েছে শমড়া, জিনিসটা দেখতে কুমড়ার মতো বড় কিন্তু খেতে শসার মতো। টমেটো আর বেগুন দিয়ে তৈরি হয়েছে টমেন যেটা দেখতে খানিকটা বেগুনের মতো আবার খানিকটা টমেটোর মত। সেটা ব্যবহার করে বেগুনের টক রান্না করার সময় আলাদা করে আর টক দিতে হয় না, কারণ টমেগুন খেতে টক বেগুনের মতো। রাণুদিদির আরও নানাধরনের আবিষ্কার রয়েছে, সূর্যের আলো ব্যবহার করে পানি গরম করা কিংবা রান্না করা তার মাঝে একটা। বাসার ছাদে একটা বিরাট অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি ঝুলিয়ে একবার উপগ্রহ থেকে কিছু সিগন্যাল ধরেছিলেন। তিনি এখন বাসার নিচে অনেকগুলি ক্যাপাসিটর জড়ো করেছেন, বজ্রপাতের সময় সেই ক্যাপাসিটর চার্জ করে সেটা ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি বিজ্ঞানের জন্যে ভালো কোনো শিক্ষক না পেয়ে শেষ পর্যন্ত রাণুদিদির শরণাপন্ন হয়েছেন। প্রথমে রাজি হননি কিন্তু পথচারী স্কুলের কর্মকাণ্ড শুনে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন কয়েকদিন কাজ করে দেখবেন।

স্কুলের জন্যে একজন ডাক্তার খুঁজে পেতে খুব অসুবিধে হল। যে-ডাক্তারের কাছেই যান সে-ই বলে, আপনাদের উদ্দেশ্য খুব মহৎ, কিন্তু এর জন্যে তো ডাক্তারের দরকার নেই। সব সুস্থ-সবল ছেলে। ডাক্তারের তো কোনো কাজ থাকবে না, বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে যাবে!

ফরাসত আলি বললেন, “কিন্তু যদি অসুখ করে?”

“তখন যাবে ডাক্তারের কাছে।”

“যদি চেকআপ করাতে হয়?”

“তখন আসবে একজন ডাক্তার।”যদি হঠাৎ করে কানো অ্যাকসিডেন্ট হয়?”

ডাক্তারেরা মাথা চুলকে বলেন, “এমনভাবে স্কুলঘরটা তৈরি করবেন যেন কোনো অ্যাকসিডেন্ট না হয়। যদি তবু কিছু ঘটে যায় ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাবেন।”

ফারুখ বখত মনমরা হয়ে বললেন, “ভাবছিলাম স্কুলে সব সময় ডাক্তার থাকবে–”

ডাক্তারেরা মাথা নেড়ে বলেন, “কিছু দরকার নেই। একজন নার্স থাকলেই যথেষ্ট। বিলাত আমেরিকার স্কুলেও ডাক্তার থাকে না, শুধু একজন নার্স থাকে।”

শেষ পর্যন্ত তা-ই ঠিক হল, স্কুলে শুধু একজন নার্স থাকবে। খুঁজে-পেতে একজন নার্স পাওয়া গেল, ভদ্রমহিলা স্থানীয় খ্রিস্টান, নাম মার্থা রোজারিও। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, হাসিখুশি মহিলা, বাংলায় একটু উত্তরবঙ্গের টান রয়েছে। মাঝে মাঝে আমার’ বলতে গিয়ে হামার’ বলে ফেলেন। দীর্ঘদিন নানা হাসপাতালে কাজ করেছেন, প্রচুর অভিজ্ঞতা, সত্যিকারের ডাক্তার না থাকলেও কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। তা ছাড়া রাগী-রাগী চেহারার একজন ডাক্তার থেকে হাসিখুশি একজন মহিলা ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্যে ভালো।

স্কুলের কর্মচারীদের মাঝে যাকে সবচেয়ে সহজে পাওয়া গেল সে হচ্ছে বাচ্চাদের খাবার রান্না করার জন্য একজন বাবুর্চি। তার নাম চুনু মিয়া। সে স্কুল তৈরি করার সময় হারুন ইঞ্জিনিয়ারের ডান হাত ছিল। খুব কাছের মানুষ, এমন কোনো কাজ নেই যেটা করতে পারে না। স্কুলের নানারকম কাজকর্মে সে আগে থেকেই লেগেছিল, বাবুর্চির দরকার শুনে নিজেকে দাখিল করে দিল। তার বাবা এবং দাদা নাকি মুন্সিগঞ্জ এলাকার বিখ্যাত বাবুর্চি। সে নিজেও বিয়ে জন্মদিন বা বউভাত উপলক্ষে রান্না করতে যায়। শহরের কোনো কোনো অঞ্চলে তাকে লোকজন ওস্তাদ চুনু মিয়া বলে ডাকে।

ফারুখ বখত চুনু মিয়ার আবেদন শুনে বললেল, “এটা কিন্তু বাচ্চাদের স্কুল। এদের জন্যে কিন্তু কাচ্চি বিরিয়ানি রাঁধতে হবে না।”

চুনু মিয়া বলল, “কোনো অসুবিধা নাই। আমি ঢাকা শহরে সাহেবমেমদের বাসাতে কাজ করেছি, চপ-কাটলেটও তৈরি করতে পারি।”

ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “উঁহু। সাহেবি খাওয়া চলবে না।”

“কোনো সমস্যা নাই। দেশি খাবার রাঁধতে পারি। শিঙাড়া সমুচা নিমকি–”

ফারুখ বখত বাধা দিয়ে বললেন, “না না, শিঙাড়া সমুচা ভাজাভুজি চলবে না। আটার রুটি আর শবজি। সাথে ফলমূল আর কাঁচা শবজির সালাদ। সঙ্গে গোরুর দুধ এক গ্লাস।”

চুনু মিয়া খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল, “আটার রুটি বানানোর জন্যে বাবুর্চি লাগে?”

ফারুখ বখত মাথা নেড়ে বললেন, “লাগে। করতে পারলে বলো তোমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে দেব।”

“পারব স্যার। কোনো অসুবিধা নাই।”

সাথে সাথে চুন্নু মিয়ার চাকরি হয়ে গেল। সকালে দারোয়ান, স্কুল চলার সময় দপ্তরি, দুপুরবেলায় বাবুর্চি।

.

কয়েকদিনের মাঝেই সব কয়জন শিক্ষক নিয়ে স্কুলের কাজ শুরু হল। যেহেতু স্কুলঘরটা এখনও আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে, বিভিন্ন ক্লাসঘরে যাবার জন্যে কিছু মই লাগানো হয়েছে। শিক্ষকেরা মই দিয়ে উপরে-নিচে যাতায়াত করেন, ছাত্রদের মই লাগে না, এমনিতেই দেয়াল খামচে খামচে ক্লাসে উঠে যায়। কোন বয়সী বাচ্চাকে কী পড়ানো হবে মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে, সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে কাজ করছে। স্কুলটা মোটামুটি দাঁড়িয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত প্রায় রোজই এসে দেখে যান, তাঁদের নিজেদের স্কুলে বাচ্চারা পড়াশোনা করছে, দুপুরে নাস্তা করছে, বিকেলে মাঠে খেলছে দেখে তাঁদের বুক দশহাত ফুলে যায়।

স্কুলে বাংলা ইংরেজি পড়াতেন মির্জা মাস্টার, কয়দিন দেখে ফরাসত আলিও বাচ্চাদের ইংরেজি পড়ানো শুরু করেছেন। তাঁকে দেখে ফারুখ বখতও একটু সাহস পেয়েছেন, বাচ্চাদের জন্যে তাই পৌরনীতির একটা ক্লাস খোলা হয়েছে। ফারুখ বখত রাত জেগে পড়াশোনা করে দিনের বেলা ক্লাস নিচ্ছেন, বিষয়বস্তুটির জন্যেই কি না জানা নেই তার ক্লাসে ছাত্রদের খুব বেশি মনোযোগ নেই।

দেখতে দেখতে বেশ গরম পড়ে গেছে, দিনরাত ফরাসত আলির চুল-দাড়ি কুটকুট করে। প্রতি বছর অনেক আগেই তিনি সব কেটেকুটে ফেলেন, এ-বছর অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর না পেরে একরাতে তিনি তার নাপিতের দোকানে গিয়ে চুল-দাড়ি কামিয়ে পুরোপুরি মুসোলিনি হয়ে ফিরে এলেন। এই ব্যাপারটি নিয়ে আগে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি, কিন্তু এবারে গুরুতর সমস্যা হয়ে গেল।

পরদিন ফরাসত আলি স্কুলে গিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে, আগে তাকে দেখে সবাই একটা সালাম ঠুকে দিত, কিন্তু আজকে সালাম ঠোকা দূরে থাকুক এমনভাবে তার দিকে তাকাতে লাগল যেন তিনি খুব অন্যায় কাজ করে ফেলেছেন। তিনি যখন স্কুলের নতুন কম্পিউটার-ঘরটা দেখতে গেলেন হঠাৎ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। স্কুলের কম্পিউটার শিক্ষক মহসিন কম্পিউটার-ঘরে ঢুকে ফরাসত আলিকে দেখে চমকে উঠল। কাছে এসে গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে? এখানে কী করছেন?”

ফরাসত আলি বুঝতে পারলেন দাড়ি-গোঁফ-চুল সব কামিয়ে ফেলেছেন বলে মহসিন তাকে চিনতে পারছে না। একগাল হেসে বললে, “আমি ফরা–”

“পড়া?” মহসিন মাঝপথে থামিয়ে বলল, “আপনি পড়াশোনা করতে এসেছেন? দেখছেন না এটা বাচ্চাদের স্কুল! শুধু বাচ্চারা পড়াশোনা করছে। আপনি পড়তে চাইলে কলেজে যাবেন, ইউনিভার্সিটি যাবেন।”

ফরাসত আলি মাথা নেড়ে বললেন, “না, না আমি ফরাসত–”

“ফরাসত আলি সাহেবের সাথে দেখা করতে চাইলে এখানে এসেছেন কেন? এটা কম্পিউটার-ঘর। এখানে বাচ্চাকাচ্চারা কম্পিউটার ব্যবহার শিখে–”

“না না, আমি ফরাসত আলির সাথে দেখা করতে চাই না। আমি–”

“তা হলে আপনি এখানে কী করছেন? নিচে যান। স্কুল চলার সময় বাইরে থেকে লোকজন এলে স্কুলে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। যদি স্কুলটা দেখতেই চান অ্যাপয়ন্টমেন্ট করে আসবেন।”

ফরাসত আলি আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন মহসিন শুনল না, তাঁকে ঠেলে বের করে দিয়ে উপর থেকে চিৎকার করে চুনু মিয়াকে ডেকে বলল, “চুমু মিয়া, এই লোকটিকে এখান থেকে নিয়ে যাও। কম্পিউটার ঘরে ঘুরঘুর করছে।”

মহসিনের কথা শেষ হবার আগেই চুনু মিয়া দুই লাফে উপরে উঠে ফরাসত আলির হাত ধরে হিড়হিড় করে নিচে নামিয়ে নিল। বলল, “স্কুল চলার সময় এখানে বাইরের মানুষের কারফিউ। কেন এসেছেন আপনি?”

ফরাসত আলি আস্তে আস্তে রেগে উঠছিলেন, গলা উঁচিয়ে বললেন, “চুন্ন মিয়া–”

চুনু মিয়া তখন আরও রেগে গেল, চিৎকার করে বলল, “এত বড় সাহস আমার সাথে গলাবাজি। আমাকে চেনেন না আপনি? ফরাসত স্যার নিজে আমাকে বলেছেন স্কুল কম্পাউন্ডের মাঝে যেন একটা মাছি ঢুকতে না পারে, আর আপনি এত বড় একটা মানুষ ঢুকে গেছেন? কত বড় সাহস

ফরাসত আলি তখন আরেকটু রেগে গেলেন, বললেন, “মুখ সামলে কথা বলো চুনু মিয়া–”

“কেন? আপনাকে ভয় পাই নাকি আমি? কম্পিউটার ঘরে ঘুরঘুর করছেন, লাখ লাখ টাকার কম্পিউটার সেখানে, আপনার মতলব আমরা বুঝি না মনে করছেন? আপনাকে পুলিশে দেয়া দরকার–“

“পুলিশে? তোমার এত বড় সাহস! তুমি আমাকে পুলিশে দেবে?”

চুনু মিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস হল না? ঠিক আছে এই দেখেন—”

কিছু বোঝার আগে ফরাসত আলি আবিষ্কার করলেন চুনু মিয়া তাঁকে দুজন পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে এবং তারা কম্পিউটার-ঘরে সন্দেহজনক কার্যকলাপের জন্যে তাকে ধরে হাজতে পুরে ফেলেছে। ফরাসত আলি কয়েকবার পরিচয় দেবার চেষ্টা করলেন কিন্তু কোনো লাভ হল না। বলা যেতে পারে হঠাৎ করে ফরাসত আলির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

এদিকে স্কুলে ফারুখ বখত বারবার পায়চারি করছেন। সকালবেলা ফরাসত আলি একটা ইংরেজি ক্লাস নেন, তাঁর এখনও কোনো দেখা নেই। ক্লাসে শিক্ষক আসছে না ছাত্রদের জন্যে সেটা খুব খারাপ উদাহরণ–ফারুখ বখত অনেক ভেবেচিন্তে মহসিনকে ডেকে পাঠালেন। মহসিন তার কম্পিউটার-ঘরে তালা মেরে ফারুখ বখতের কাছে হাজির হল। ফারুখ বখত মহসিনকে বললেন, “মহসিন ফরাসত আলি আসেনি, আজকে তোমাকে ইংরেজি ক্লাসটা নিতে হবে।

মহসিন মাথা চুলকে বলল, “আমি?”

“হ্যাঁ। কোনো উপায় নেই, তাড়াতাড়ি যাও।”

“কিন্তু আমি কখনো ইংরেজি ক্লাস নিইনি।”

“তাতে কী আছে? তাড়াতাড়ি যাও।”

মহসিন চিন্তিত মুখে ক্লাসে হাজির হল। ছাত্রছাত্রীরা তাকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, “কম্পিউটার স্যার, কম্পিউটার স্যার!!”

মহসিন মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু এখন আমি তোমাদের ইংরেজি পড়াব।” ছাত্রছাত্রীরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “ইংরেজি ইংরেজি!!”

মহসিন বলল, “এখন বলো দেখি মাইক্রোপ্রসেসর কেমন করে বানান করে? হার্ড ড্রাইভ? র‍্যান্ডম এক্সেস মেমোরি?”

ছাত্রছাত্রীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। মহসিন হাসিমুখে বলল, “খুব সোজা, একেবারে পানির মতো সোজা। এম-আই-সি …”

একদিন ফারুখ বখত আবিষ্কার করলেন মহসিনকে ইংরেজি পড়াতে পাঠানো ঠিক হয়নি, এক্ষুনি অন্য একটা ক্লাসে কম্পিউটার শেখানোর কথা। তারা দল বেঁধে হাজির হয়ে গেছে, কী করবেন বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি অঙ্কের শিক্ষক প্রফেসর আলিকে ডেকে পাঠালেন। প্রফেসর আলি তার বইপত্র নিয়ে হাজির হলেন, ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”

“কী সমস্যা?”

“কম্পিউটারের ক্লাস, কিন্তু মহসিনকে পাঠিয়েছি ইংরেজি ক্লাস নেয়ার জন্যে। এখন কম্পিউটারের ক্লাস নেবার কেউ নেই।”

প্রফেসর আলি তর্ক করতে ভালোবাসেন, মুখ ছুঁচালো করে বললেন, “কেন পাঠালে মহসিনকে?”

“আর কেউ ছিল না আশেপাশে। এখন আপনাকে একটু কম্পিউটারের ক্লাসটা নিতে হবে।” ফারুখ বখত মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, “খোদার কসম!”

“খোদা বা ঈশ্বর বলে কিছু নেই!” ঘোর নাস্তিক প্রফেসর আলি মুখ শক্ত করে বললেন, “যার অস্তিত্ব নেই তার কসমে আমি বিশ্বাস করি না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে, পাউরুটির কসম।”

প্রফেসর আলি চোখ কপালে তুলে বললেন, “পাউরুটির কসম?”

“হ্যাঁ, পাউরুটির অস্তিত্ব নিয়ে তো আপনার মনে কোনো দ্বিধা নেই। পাউরুটির কসম আপনি এই ক্লাসটা নেন।”

প্রফেসর আলি আরও কিছুক্ষণ তর্ক করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কম্পিউটার-ঘরে হাজির হলেন। একটু পরে শোনা গেল তিনি বলছেন, “মনে করো এই ঘরে একটা দুই মিটার উঁচু তৈলাক্ত বাঁশ রয়েছে, আর তোমরা কম্পিউটারটা হাতে নিয়ে এই তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠছ। প্রতি সেকেণ্ডে তোমরা দশ সেন্টিমিটার উপরে ওঠ, কিন্তু পরের সেকেন্ডে পাঁচ সেন্টিমিটার পিছলে নেমে আস। বাঁশের উপরে উঠে যদি কম্পিউটারটা চালু করতে চাও কতক্ষণ সময় লাগবে?”

কালোমতন একজন বলল, “স্যার, বাঁশের উপরে উঠে কেন কম্পিউটার চালু করব? টেবিলের উপরেই ভাল–”

প্রফেসর আলিকে কম্পিউটারের ক্লাসে পাঠিয়ে ফারুখ বখত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে আঁতকে উঠলেন। এক্ষুনি অন্য একটা ক্লাসে প্রফেসর আলির অঙ্ক শেখানোর কথা ছিল, এখন কোনো অঙ্কের শিক্ষক নেই। তিনি মাথায় হাত দিচ্ছিলেন ঠিক তখন দেখতে পেলেন তাদের খেলাধুলার শিক্ষক রুখসানা গলায় একটা হুইসেল ঝুলিয়ে যাচ্ছে, ফারুখ বখত চিৎকার করে বললেন, “রুখসানা! রুখসানা!!”

রুখসানা ছুটে এল, “কী হয়েছে?”

“একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”

“কী ঝামেলা?”

“ক্লাস থ্রি সেকশান বি-এর এক্ষুনি অঙ্ক ক্লাস শুরু হবে, ক্লাস নেয়ার কেউ নেই। তুমি কি নিতে পারবে ক্লাসটা?”

“আমি? কিন্তু একটু পরেই আমার একটা ক্লাসের পি.টি. ট্রেনিং।”

“সেটা তখন দেখা যাবে। এখন তুমি ছুটে যাও এই ক্লাসে। দেরি কোরো।”

রুখসানা চিন্তিত মুখে অঙ্ক ক্লাসে ঢুকতেই ছাত্রছাত্রীরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, রুখসানাকে সবার খুব পছন্দ। নানারকম খেলাধুলা দৌড়ঝাঁপ সবকিছুতে রুখসানার খুব উৎসাহ, বাচ্চারা তাকে পছন্দ করবে বিচিত্র কী?

সবাই সমস্বরে বলল, “খেলা খেলা খেলা!” রুখসানা বলল, “না এখন খেলা না। এখন অঙ্ক।”

“অঙ্ক?” বলা বাহুল্য সব বাচ্চার মন-খারাপ হয়ে যায়।

“হ্যাঁ অঙ্ক। এই যে আমি ব্ল্যাকবোর্ডে তোমাদের দুইটি সংখ্যা লিখে দিচ্ছি। দুইটি সংখ্যাকে কখনো করবে যোগ কখনো বিয়োগ কখনো গুণ কখনো ভাগ।”

”কেমন করে বুঝব আমরা?”

“খুব সহজ।” রুখসানা হাসিমুখে বলল, “আমি যখন শূন্যে ডিগবাজি দেব তার মানে যোগ। যদি হাত দিয়ে পায়ের পাতা ছুঁই তার মানে বিয়োগ। যদি বুকডন দিই সেটা হবে গুণ আর যখন দুই হাত পাশে ছড়িয়ে লাফ দেব তার মানে ভাগ। তোমরাও করবে আমার সাথে। আর অঙ্কের উত্তরটি কাগজে লেখার দরকার নেই–

“তা হলে কেমন করে করব?”

“খুব সোজা! অঙ্কের উত্তরটি দেবে তোমরা লাফিয়ে। যদি উত্তর হয় দশ তা হলে দশবার লাফাবে। যদি হয় বারো তা হলে বারো বার লাফাবে–”

একটু পরেই শোনা গেল অঙ্ক ক্লাসে হুইসিল বাজছে এবং ছেলেমেয়েরা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে দৌড়ে ঝাপাঝাপি করে অঙ্ক করছে।

রুখসানাকে অঙ্ক ক্লাসে পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু এক্ষুনি একটা খেলাধুলার ক্লাস শুরু হবে, সেখানে কাকে পাঠানো যায় ফারুখ বখত ঠিক চিন্তা করে পেলেন না। আশেপাশে কেউ নেই, তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন, দেখলেন মির্জা মাস্টার তার বিশাল শরীর নিয়ে থপথপ করে হেঁটে আসছেন। ফারুখ বখত তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে গলা বের করে বললেন, “মির্জা মাস্টার!”

“কী হল?”

“ভিতরে ঢুকবেন না। বাইরে মাঠে থাকেন!”

“কেন?”

“আপনাকে একটা খেলাধুলার ক্লাস নিতে হবে।”

“আমার? কী বলছেন আপনি? একটু পরে আমার একটা বাংলা ক্লাস নেয়ার কথা।”

ফারুখ বখত মাথা নেড়ে বললেন, “তার কিছু-একটা ব্যবস্থা করা যাবে, এখন আপনি খেলাধুলার এই ক্লাসটা নেন। কোনো উপায় নেই।”

মির্জা মাস্টার আরও একটা-কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই ছাত্রছাত্রীরা হৈচৈ করতে করতে মাঠে এসে হাজির হয়েছে!

মির্জা মাস্টার চি চি করে বললেন, “ছাত্রছাত্রীরা, আমি এখন তোমাদের খেলাধুলা করাব।”

সব ছাত্রছাত্রী নিঃশ্বাস বন্ধ করে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বড় বড় চোখের ফুটফুটে একটা মেয়ে বলল, “আপনি?”

|”হ্যাঁ। প্রথমে শরীরটা একটু গরম করে নেয়া দরকার। শরীর গরম না করে খেলাধুলা শুরু করা ঠিক নয়।”

সব ছেলেমেয়ে মাথা নাড়াল, “না, ঠিক না।”

“কাজেই শরীর গরম করার জন্যে আমরা সবাই এখন স্কুলের মাঠের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছুটে যাব।”

“আ-আ-আপনিও?”

“আমিও।”

দিকে তাকিয়ে রইল।লন। তাঁর পিছুপিছু মাটিতে লম্বা হয়ে

উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের মাঝে হঠাৎ আশ্চর্য এক ধরনের নীরবতা নেমে এল। মির্জা মাস্টার যতদূর সম্ভব গলা উঁচিয়ে বললেন, রেডি ওয়ান টু থ্রি–”

ছাত্ররা তবু কেউ দৌড়ানো শুরু করল না, বিস্ফারিত চোখে মির্জা মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইল। মির্জা মাস্টার তখন নিজেই থপথপ করে তাঁর বিশাল দেহ নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন। তাঁর পিছুপিছু ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা।

খানিকক্ষণ পর দেখা গেল মির্জা মাস্টার মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন এবং তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তার হাত-পা ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

ফারুখ বখত বারবার নিজের ঘড়ি দেখছিলেন। এতক্ষণে ফরাসত আলির পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তার কোনো দেখা নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই মির্জা মাস্টারের একটা বাংলা ক্লাস নেবার কথা, কিন্তু তাঁকে পাঠিয়েছেন খেলাধুলার ক্লাস নেয়ার জন্যে, কাউকে এখনই দরকার। হঠাৎ তার রাণুদিদির কথা মনে পড়ল, বাংলা পড়াতে রাণুদিদির কোনো সমস্যা হবার কথা নয়।

রাণুদিদির বিজ্ঞান ক্লাস উপরের তলায়। মই বেয়ে উপরে উঠে গেলেন ফারুখ বখত। কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে একটা ছোট যন্ত্র দাঁড় করাচ্ছিলেন রাণুদিদি। ফারুখ বখতকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার ফারুখ সাহেব?”

“মহাসমস্যা রাণুদিদি।”

“কী সমস্যা?”

“এক্ষুনি ক্লাস টু সেকশান এর বাংলা ক্লাস শুরু হবে।”

“সেটা সমস্যা?”

“না। সেটা সমস্যা নয়। কিন্তু কোনো শিক্ষক নেই, সেটা হচ্ছে সমস্যা। আপনাকে ক্লাসটা নিতে হবে।”

“আমাকে?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু একটু পরে আমার বিজ্ঞান ক্লাস। আমি এই ভ্যান ডি গ্রাফ জেনারেটরটা দাঁড় করাচ্ছি, স্থির বিদ্যুতের উপর একটা লেকচার দেব।”

“সেটা যখন সময় হবে কিছু-একটা ব্যবস্থা হবে। এখন আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।”

রাণুদিদি ইতস্তত করে বললেন, “আমি পুরোটা প্রায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছি, এই সুইচটা টিপে একটু দেখতাম–”

“সময় নেই রাণুদিদি, ফারুখ বখত মাথা নাড়লেন।

”ঠিক আছে, তা হলে চলেন যাই।

একটু পরে দেখা গেল রাণুদিদি ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চোখে চশমাটা ঠিক করে বসিয়ে বললেন, “খোকাখুকুরা আজকে আমি তোমাদের বাংলা পড়াব।”

“বাংলা?”

“হ্যাঁ, বাংলা। বাংলা সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় দিকপালের নাম কী বলল দেখি?”

বাচ্চারা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে, “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”

“ভেরি গুড। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল আরও একজন মানুষের, তাঁর নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। তোমরা আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম শুনেছ?”

ছেলেমেয়েরা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। রাণুদিদি উৎসাহ নিয়ে বললেন, “আইনস্টাইন ছিলেন মস্ত বড় বিজ্ঞানী। তাঁর একটা খুব বড় আবিষ্কারের নাম স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি। সেই জিনিসটা কী কে বলতে পারবে?”

বাচ্চারা কোনো কথা না বলে চোখ বড় বড় করে রাণুদিদির দিকে তাকিয়ে রইল। রাণুদিদি হাসিমুখে বললেন, “স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি খুব মজার জিনিস। মনে করো তোমরা একটা রকেটে উঠেছ, রকেটের গতিবেগ আলোর গতিবেগের কাছাকাছি। সেই রকেটটা–”

রাণুদিদি বাংলা ক্লাস পড়াতে লাগলেন খুব উৎসাহ নিয়ে।

এদিকে ফারুখ বখত নিজের মাথার চুল প্রায় ছিঁড়ে ফেলছেন। এক্ষুনি বিজ্ঞান ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু সেই ক্লাসে পড়ানোর জন্যে রাণুদিদি নেই–তাঁকে বাংলা ক্লাসে পাঠানো হয়েছে। বিজ্ঞান ক্লাস শুরু হবার পরপরই পৌরনীতির ক্লাস, যেটা তাঁর নিজের নেয়ার কথা। ফারুখ বখত কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি নিজে বিজ্ঞান ক্লাসটা নিতে পারেন কিন্তু অন্য কাউকে পৌরনীতি ক্লাসটা নিতে হবে। অন্য কেউ বলতে বাকি রয়েছে মাত্র দুইজন। স্কুলের বাবুর্চি তথা দারোয়ান তথা দপ্তরি চুনু মিয়া এবং স্কুলের নার্স মার্থা রোজারিও। চুনু মিয়া খুব চৌকস মানুষ, সে যদি একটা ক্লাস পড়িয়ে ফেলতে পারে অবাক হবার কিছু নেই। তিনি একবার চেষ্টা করে দেখার চেষ্টা করলেন। জানালা দিয়ে মাথা বের করে চিৎকার করে ডাকলেন, চুনু মিয়া

চুনু মিয়া প্রায় সাথে সাথে ছুটে এল। ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “তুমি তো অনেক কাজের মানুষ।

চুনু মিয়া একগাল হেসে বলল, “আপনাদের দোয়া।”

“বাচ্চাদের একটা বিজ্ঞানের ক্লাস নিতে পারবে? বেশি কঠিন কিছু না, একটু আর্কিমিডিসের সূত্র–একটু নিউটনের সূত্র–”

চুনু মিয়া হাতজোড় করে বলল, মাপ করেন স্যার, “আমি মূর্খ মানুষ। পড়াশোনা করি নাই।”

“পড়াশোনা কর নাই?”

“না স্যার।”

ফারুখ বখত চোখ পাকিয়ে চুনু মিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চুনু মিয়া মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “মার্থা আপা অনেক শিক্ষিত মানুষ। মার্থা আপাকে নিয়ে আসি?”

ফারুখ বখত খানিকক্ষণ কী-একটা ভেবে বললেন, “ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি বিজ্ঞান ক্লাসটা নিতে। তুমি মার্থা আপাকে গিয়ে ডেকে আনো, বলো তাকে পৌরনীতি ক্লাসটা নিতে হবে।”

“পৌড়ানীতি?”

“পৌড়ানীতি না, পৌরনীতি।”

“ঐ একই কথা।” চুনু মিয়া এক গাল হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

ফারুখ বখত হাত দিয়ে মাথার চুলগুলি ঠিক করে রওনা দিলেন। বিজ্ঞান ক্লাসে ছেলেমেয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছিল। ফারুখ বখতকে ঢুকতে দেখে সবাই চুপ করে গেল, ঢ্যাঙ্গামতন একজন জিজ্ঞেস করল, “স্যার আপনি?”

“হ্যাঁ। আমি। আমি আজকে তোমাদের বিজ্ঞান পড়াব।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

“আপনি পারবেন?”

ফারুখ বখত ভুরু কুঁচকে বললেন, “পারব না কেন?”

“কী পড়াবেন স্যার আজকে?”

“আজকে আমি তোমাদের পড়াব বিদ্যুৎ। স্থির বিদ্যুৎ।” ফারুখ বখত সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার মতো ভঙ্গি করলেন। ছাত্রছাত্রী কেউ না হেসে ফারুখ বখতের দিকে তাকিয়ে রইল। ফারুখ বখত একটু কেশে বললেন, “বিদ্যুৎ কী তোমরা সবাই জান। বিদ্যুৎ মানে হচ্ছে ইলেকট্রিসিটি। ইলেকট্রিসিটি মানে হচ্ছে বিদ্যুৎ”এইটুকু বলে ফারুখ বখত বুঝতে পারেন তিনি বিদ্যুৎ সম্পর্কে আর কিছুই জানেন না। হঠাৎ করে তিনি কেমন জানি বিপন্ন রোধ করতে থাকেন। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল; তিনি কয়েকবার ঢোক গিললেন।

সামনে বসে থাকা সাদাসিধে চেহারার একটা মেয়ে বলল, “স্যার স্থির বিদ্যুৎ মানে কী?”

“স্থির বিদ্যুৎ মানে হচ্ছে যে বিদ্যুৎ স্থির। মানে যেটা নড়াচড়া করে না।”

“বিদ্যুৎ আবার নড়াচড়া করে কেমন করে?”

ফারুখ বখত চোখে অন্ধকার দেখলেন, একটু কেশে বললেন, “তোমাদের এখন স্থির বিদ্যুৎ দেখাব।”

“স্যার স্থির বিদ্যুৎ দেখা যায়?”

“এ্যাঁ–ইয়ে মানে মনে হয় দেখা যায়। তিনি তখন টেবিলের উপর রাখা ভ্যান ডি গ্রাফ যন্ত্রের কাছে গিয়ে বললেন, “এটার নাম ভ্যান-ভ্যান ভ্যান”

হঠাৎ করে তিনি নামটা ভুলে গেলেন, আর সব ছেলেমেয়ে খুশিতে হেসে ফেলল।”কী সুন্দর নাম, ভ্যান ভ্যান ভ্যান।”

ফারুখ বখত বুঝতে পারলেন যতই সময় যাচ্ছে ততই তিনি গোলমাল করে ফেলছেন। জোর করে আবার একটু হেসে বললেন, “এখন তোমাদের দেখাব স্থির বিদ্যুৎ।”

ফারুখ বখত গিয়ে ছোট ভ্যান ডি গ্রাফ যন্ত্রের মডেলটির সুইচ অন করে দিলেন, সাথে সাথে ঘড় ঘড় শব্দ করে সেটা চালু হয়ে গেল। কালো রঙের একটা বেল্ট ঘুরতে থাকে কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সামনে বসে থাকা একজন জিজ্ঞেস করল, “স্যার স্থির বিদ্যুৎ কোথায়?”

ফারুখ বখত মাথা চুলকালেন। তিনি নিজেও জানেন না স্থির বিদ্যুৎটি কোথায়, অনিশ্চিতের মতো ভ্যান ডি গ্রাফের মডেলটির কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর তিনি যেটা করলেন বিজ্ঞানের সত্যিকারের শিক্ষকরা সেটা করে না, ভ্যান ডি গ্রাফের উপরের বড় গোলাকার অংশটি একটু ছুঁয়ে দেখতে চাইলেন। উপস্থিত ছেলেমেয়েরা চমৎকৃত হয়ে দেখল ভ্যান ডি গ্রাফের গোলক থেকে বিশাল একটা বিদ্যুৎ ঝলক প্রায় বজ্রপাতের মতো ফারুখ বখতের দিকে ছুটে গেল এবং ফারুখ বখত বিকট চিৎকার করে ঘরের এক কোণায় ছিটকে পড়লেন। দেয়ালে তাঁর মাথা ঠুকে গেল, প্রথম তার চোখের সামনে নানা রঙের আলো খেলা করতে লাগল এবং শেষে হঠাৎ করে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।

যখন তার জ্ঞান হল তখন তিনি মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন, তাঁর মুখের উপর উবু হয়ে আছেন স্কুলের নার্স মার্থা রোজারিও এবং তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাসের সব কয়জন ছেলেমেয়ে, তাদের চোখেমুখে ঝলমল করছে হাসি। তাঁকে চোখ খুলতে দেখে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছোট মেয়ে বলল, “কী সুন্দর স্থির বিদ্যুৎ–এরকম আর দেখি নাই।”

কাছাকাছি আরেকজন বলল, “আরেকবার দেখাবেন স্যার?” মার্থা রোজারিও বললেন, “যাও ছেলেমেয়েরা সরে যাও। পিছনে যাও।”

ছেলেমেয়েরা একটু জায়গা করে দিল এবং তখন ফারুখ বখত কোনোরকমে উঠে বসলেন। কাছাকাছি কোথায় চুনু মিয়া দাঁড়িয়ে ছিল, এগিয়ে এসে বলল, “ভালো আছেন স্যার?”

ফারুখ বখত দেয়াল ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে চুনু মিয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। চুনু মিয়া একটু ঘাবড়ে গিয়ে দুর্বল গলায় বলল, “মার্থা আপাকে বলেছিলাম পোড়ানীতি পড়ার কথা–”

ফারুখ বখত মেঘস্বরে বললেন, “পোড়ানীতি না, পৌরনীতি–”

”ঐ একই কথা স্যার। মার্থা আপা রাজি হলেন না।”

মার্থা রোজারিও কাছেই ছিলেন, নরম গলায় বললেন, “সেই কবে পড়েছি, এখন তো আর মনে-টনে নেই। ইংরেজি হলে চেষ্টা করে দেখতাম।”

ফারুখ বখত একটু নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তা হলে পৌরনীতি আজ পড়া হবে না।”

মার্থা রোজারিও বললেন, “পৌরনীতির শিক্ষকটা কে ছিল?”

“আমি।”

“তাহলে আপনি কেন পড়াচ্ছেন না?”

“কারণ আমি বিজ্ঞান পড়াচ্ছি।”

“বিজ্ঞানের শিক্ষক?”

“রাণুদিদি। বাংলা পড়াচ্ছেন।”

“বাংলার শিক্ষক?”

”মির্জা মাস্টার। ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলা করাচ্ছেন।”

এই সময়ে চুনু মিয়া মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার। মির্জা স্যার মাটিতে শুয়ে আছেন। সব ছেলেমেয়েরা তাকে টেনে টেনে নিচ্ছে–”

মার্থা রোজারিও বাধা দিয়ে বললেন, “মির্জা মাস্টার কেন খেলাধুলা করাচ্ছেন? খেলাধুলার জন্যে রয়েছে রুখসানা!”

ফারুখ বখত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “রুখসানা আজকে অঙ্ক পড়াচ্ছে।”

“কেন? অঙ্কের শিক্ষক কোথায়?”

“অঙ্কের শিক্ষক প্রফেসর আলি ছাত্রদের কম্পিউটার শেখাচ্ছেন।”

“আর কম্পিউটারের শিক্ষক?”

“মহসিন। মহসিন আজকে ইংরেজি পড়াচ্ছে।”

“কেন?”

“ইংরেজি পড়ায় ফরাসত আলি, আজকে সে আসেনি, সেই জন্যেই তো এই গোলমাল।“

চুনু মিয়া একটু কেশে বলল, “স্যার একটা কথা–”

ফারুখ বখত একটা ছোট ধমক দিয়ে বললেন–”চুনু মিয়া তুমি একটু বেশি কথা বল। কাজের কথা বলছি তার মাঝে বিরক্ত করছ?”

“শুধু একটা ছোট কথা–খুবই ছোট।”

“কী কথা? তাড়াতাড়ি বলো।”

“মার্থা আপা বলেছেন তিনি ইংরেজি পড়াতে পারেন। যদি মার্থা আপাকে ইংরেজি পড়াতে দেন, তা হলে মহসিন স্যার–”

ফারুখ বখত চমকে উঠে বললেন, “চুনু মিয়া, তুমি শেষ পর্যন্ত একটা খাঁটি কথা বলেছ। মার্থা রোজারিও পড়াবেন ইংরেজি, তা হলে মহসিন শেখাবে কম্পিউটার, প্রফেসর আলি শেখাবেন অঙ্ক, খেলাধুলায় যাবে রুখসানা, মির্জা মাস্টার ফিরে আসবে বাংলায়–”

মার্থা রোজারিও বললেন, “সব সমস্যার সমাধান!”

চুনু মিয়া একগাল হেসে বলল, “আসলে স্যার আজকের দিনটাতেই কুফা লেগেছে, এইজন্যে এত গোলমাল।”

“কুফা কেন লাগবে?”

“কোনো কোনো দিন এরকম হয়। সকালে একজন মানুষ এসেছিল মাথা কামানো তার পরেই মনে হল গোলমাল–”

ফারুখ বখত হঠাৎ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “মাথা কামানো?”

“জি স্যার। চুল-দাড়ি সবকিছু কামানো–“

“কী করছিল সেই মানুষ?”

“ঘুরঘুর করছিল স্কুলে।”

“কোথায় সেই মানুষ?”

“বের করে দিয়েছি স্যার। আমার সাথে চোটপাট করেছিল তখন পুলিশে হাওলা করে দিয়েছি। থানায় ধরে নিশ্চয়ই শক্ত মার দিয়েছে এখন!” চুনু মিয়া দাঁত বের করে হাসল।

ফারুখ বখত ঘুরে চুনুমিয়ার দিকে তাকালেন, মেঘস্বরে বললেন, “মানুষটা কি ফরাসত আলি ছিল?”

“ফরাসত স্যার? চুনু মিয়া চোখ কপালে তুলে বলল, “ফরাসত স্যার হবে কেমন করে? স্যারের এত বড় চুল-দাড়ি–”

“তুমি জান না ফরাসত আলি গরমের সময় চুল-দাড়ি সব কেটে ফেলে পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যায়। জান না?”

চুনু মিয়ার মুখ প্রথমে ফ্যাকাশে হয়ে গেল, কিছুক্ষণেই সেখানে নীল এবং গোলাপি রঙের ছোপ দেখা গেল। তারপর হঠাৎ সে দড়াম করে মাথা ঘুরে নিচে পড়ে গেল।

মার্থা রোজারিও ছুটে গেলেন চুনু মিয়ার কাছে, বুকে পিঠে কান লাগিয়ে বললেন, “এখনও বেঁচে আছে।”

ফারুখ বখত বললেন, “থাকলে থাকুক, সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আগে দেখি ফরাসত আলিকে ছুটিয়ে আনতে পারি কিনা।”

ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে এসে চুনু মিয়াকে ঘিরে দাঁড়াল, কমবয়সী একটা মেয়ে হাসতে হাসতে বলল, “কী মজা হচ্ছে আজ! তাই না?

অন্য সবাই মাথা নাড়ল, সত্যিই আজকে খুব মজা হচ্ছে।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল