স্কুল থেকে এসে তিন ভাইবোন হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। প্রত্যেকদিনই আম্মু এই সময়টাতে তাদের সাথে স্কুল নিয়ে কথা বলেন। আজকেও শুরু করলেন, “আজকে তোদের স্কুল কেমন হল?”

মিঠু বলল, “খুবই মজার আম্মু, খুবই মজার।”

আম্মু জানতে চাইলেন, “কেন কী হয়েছে?”

মিঠু এক চুমুক দুধ খেয়ে বলল, “আমাদের ক্লাসে একটা নতুন ছেলে ভর্তি হয়েছে। এই মোটা। সে প্রিন্সিপাল স্যারকে ভেবেছে দপ্তরি–” মিঠু কথা শেষ না করে হি হি করে হাসতে থাকে এবং বিষম খেয়ে নাক দিয়ে কয়েক ফোঁটা দুধ বের হয়ে আসে।

গাব্বু গভীর মনোযোগ দিয়ে মিঠুর দিকে তাকিয়ে থাকে। নাকের সাথে গলার যোগাযোগ আছে, আর গলা দিয়ে যাওয়া জিনিস নাক দিয়ে বের হতে পারে–এরকম একটা সম্ভাবনা আছে সে জানত। চোখের সামনে এত বড় একটা বৈজ্ঞানিক ঘটনা দেখেও সে চুপ করে রইল, বিষয়টা অন্যদের ব্যাখ্যা করে বোঝানোর চেষ্টা করল না, তার মনটা খারাপ তাই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

আম্মু বললেন, “প্রিন্সিপাল স্যারকে দপ্তরি ভেবেছে?”

“হ্যাঁ। ভর্তির কাগজ নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসে গিয়েছে, প্রিন্সিপাল স্যার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কী একটা কাজ করছিলেন, মোটা ছেলেটা বলল, এই যে দপ্তরি ভাই, প্রিন্সিপাল স্যার কই?” মিঠু কথা শেষ না করে আবার হি হি করে হাসতে থাকে।

আম্মু বললেন, “অনেক হয়েছে। এখন হাসি বন্ধ করে খা।”

তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর স্কুল কী রকম হয়েছে?”

টুনি বলল, “প্রত্যেকদিন যে রকম হয় সে রকম।”

আম্মু গাব্বুর দিকে তাকালেন, “তোর?”

গাব্বু একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার জন্যে বাসা যে রকম স্কুলও সে রকম।”

“তার মানে কী?”

“তার মানে হচ্ছে বাসায় তোমরা যে রকম সারাক্ষণ আমাকে জ্বালাও, স্কুলেও সে রকম সবাই আমাকে জ্বালায়।”

“আজকে তোকে কে জ্বালিয়েছে?”

“সবাই।” আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “সবাই?”

“হ্যাঁ। লিটন, রত্না, মিলি, রওশন ম্যাডাম, প্রিন্সিপাল স্যার–সবাই।”

“এতজন মানুষ তোকে একসাথে কেমন করে জ্বালালো? তুই কী করছিলি?”

“আমি কিছু করি নাই।”

টুনি বলল, “আম্মু, তুমি গাব্বুর কথা বিশ্বাস কোরো না। নিশ্চয়ই কাউকে দিয়ে সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করেছে। সেটা করতে গিয়ে কোনো ঝামেলা করেছে।”

“করি নাই।” গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “শুধু–”

“শুধু কী?”

“শুধু কেমন করে কাতুকুতু দিলেও কাতুকুতু লাগবে না সেইটা দেখতে চাচ্ছিলাম, তখন-তখন-”

“তখন কী?”

গাব্বু হতাশ হওয়ার মতো করে বলল, “নাহ্, কিছু না।”

“শুনি। বল।”

“রওশন ম্যাডাম এত ভালো ম্যাডাম–সেই ম্যাডামও আমার কথা বিশ্বাস করতে রাজি হলেন না। উল্টো আমাকে গাব্বু আবার কথা শেষ না করে থেমে গেল।

“উল্টো কী?”

“নাহ্, কিছু না।”

“কিছু না মানে? উল্টো তোকে কী?”

“এই উল্টাপাল্টা কথা।”

“কী উল্টাপাল্টা কথা?”

গাব্বুর সেই কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করল না, আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা কলা খেতে শুরু করল। আম্মু আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কী উল্টাপাল্টা কথা?”

গাব্বু কলার দিকে তাকিয়ে বলল, “কলার মাঝে পটাশিয়াম থাকে।”

আম্মু বললেন, “তার মানে তুই বলবি না?”

গাব্বু বলল, “কলাগাছকে মানুষ গাছ বলে। আসলে কলাগাছ কিন্তু গাছ।”

আম্মু হাল ছেড়ে দিলেন।

গাব্বু খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার পর আম্মু টুনিকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে স্কুলে? কিছু জানিস?”

টুনি বলল, “কী আর হবে? বাসায় যেটা হয় স্কুলেও নিশ্চয়ই সেটাই হয়েছে।”

মিঠু বলল, “ভাইয়ার এক্সপেরিমেন্ট। সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট।”

আম্মু জানতে চাইলেন, “কী এক্সপেরিমেন্ট?”

মিঠু ঠোঁট উল্টে বলল, “জানি না।”

ঠিক এরকম সময় পাশের ঘর থেকে ধুপ করে একটা শব্দ হল, মনে হল ভারী কিছু একটা নিচে পড়েছে। আম্মু চমকে উঠে বললেন, “কীসের শব্দ?”

টুনি বলল, “কীসের আবার! নিশ্চয়ই তোমার ছেলের কোনো সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট।–”

মিঠু বলল, “আমি দেখে আসি।”

মিঠুর পিছু পিছু টুনি আর আম্মুও গেলেন, গিয়ে দেখলেন গাৱঁ মেঝেতে কয়েকটা বালিশ রেখেছে, তারপর টেবিলের উপর উঠে সেগুলোর উপর লাফিয়ে পড়ছে। আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী হচ্ছে, গাব্বু, কী হচ্ছে এখানে?”

“কিছু না”-বলে গাব্বু আবার টেবিলের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ল। আম্মু বললেন, “কিছু না মানে? দেখতে পাচ্ছি তুই লাফাচ্ছিস আর বলছিস কিছু না।”

গাব্বু আবার টেবিলের উপর উঠে লাফ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বলল, “বলছি কিছু না। তার কারণ আমি কী করছি সেটা তোমাদের বলে লাভ নাই। তোমরা বুঝবে না।”

টুনি বলল, “বলে দেখ। বুঝতেও তো পারি।”

“সময় নষ্ট করে লাভ নাই। তোমরা বুঝবে না।”

আম্মু বললেন, “আমার বোঝার দরকার নাই। যদি এভাবে বানরের মতো লাফাবি তা হলে বাসার ভেতরে না–বাইরে। আর শুনে রাখ, লাফ দিয়ে যদি ঠ্যাং ভাঙিস তা হলে কিন্তু আমার কাছে আসবি না।”

গাব্বু বলল, “আমার ঠ্যাং পাস্টিকের না যে একটা লাফ দিলেই ভেঙে যাবে।”

“খুব ভালো কথা। কিন্তু লাফালাফি ঘরের ভেতরে না–বাইরে।”

গা টেবিল থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি বাইরে যাচ্ছি। তোমাদের যন্ত্রণায় আমি কিছু করতে পারি না। খালি একবার বড় হয়ে নিই তখন দেখি তোমরা আমাকে কীভাবে যন্ত্রণা দাও। আমার যা ইচ্ছা আমি তখন সেটা করব।”

মিঠু জানত চাইল, “বড় হয়ে তুমি কী করবে ভাইয়া? আরও উপর থেকে লাফ দেবে?”

গাব্বু বলল, “তুই সেটা বুঝবি না।”

তারপর পায়ে জুতো পরে সে গম্ভীর মুখে বের হয়ে এল।

.

মোটামুটি এই একই সময়ে রিফাত হাসান হোটেলের লবিতে এসে দাঁড়িয়েছেন, তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল, “স্যার, আপনার কী কিছু লাগবে? কোনো সমস্যা।

“সমস্যা তো বটেই!”

“আমরা কী কিছু করতে পারি?”

“মনে হয় না।”

“বলে দেখেন। আমরা কত কী করতে পারি জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।”

রিফাত হাসান ঘুরে গেটের দিকে দেখিয়ে বললেন, “ওই গেটে দেখেছেন কতজন সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে?”

রিসেপশনিস্ট মেয়েটা বলল, “দেখেছি। সবাই আপনাকে কাভার করার জন্যে এসেছে। কার আগে আপনাকে নিয়ে কত বড় স্টোরি করতে পারে সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতা! এটাকে বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা।”

“খ্যাতি থাকলে বিড়ম্বনা সহ্য করার একটা অর্থ আছে। আমাকে কেন? আমি ফিল্মস্টার না, রকস্টার না, ক্রিকেট প্লেয়ারও না! আমাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন?”

“স্যার, আপনি ফিল্মস্টার, রকস্টার কিংবা ক্রিকেট প্লেয়ার থেকে কোনো অংশ কম না। এই দেশের মানুষ জেনে গেছে আপনি এখানে এসেছেন, তিন দিন দেশে থাকবেন। আপনাকে নিয়ে অনেক কৌতূহল। শুধু আপনার খোঁজে আমাদের হোটেলে এত ফোন এসেছে যে আমাদের পিএবিএক্স ওভারলোড হয়ে যাওয়ার অবস্থা! স্যার, আপনি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ!”

“আমি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কি না জানি না, কিন্তু সকাল থেকে শুধু গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সাথে কথা বলছি! এখন আমি একটু নিজের মতো থাকতে চাই। হোটেলের গেটে সাংবাদিকেরা বাঘের মতো বসে আছে, বের হওয়ামাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়বে!”

রিসেপশনিস্ট মেয়েটা কী যেন একটা ভাবল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথায় যেতে চান স্যার?”

“যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাসা ছিল গেন্ডারিয়ার দিকে। ভাবছিলাম জায়গাটা একটু দেখব।”

“কাকে নিয়ে যাবেন?”

রিফাত হাসান মাথা নেড়ে বললেন, “কাউকে নিয়ে নয়। একা একা।”

মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, “একা একা? আপনি নিজে?”

রিফাত হাসান বললেন, “এতে অবাক হওয়ার কী আছে?”

“পারবেন?”

“না পারার কী আছে? আমি এই দেশের মানুষ না? আমি এখানে বড় হয়েছি, জীবনের ইম্পরট্যান্ট সময়টা এখানে কাটিয়েছি।”

“ঠিক আছে, আপনি যদি সত্যিই মনে করেন আপনি একা একা ঘুরতে পারেন তা হলে আমি আপনাকে বাইরে বের করার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”

“সত্যি? পারবেন?”

“হ্যাঁ। পারব। আমাদের হোটেলের পেছনে একটা সার্ভিস ডোর আছে, আপনি চাইলে আপনাকে আমি সেদিক দিয়ে বের করে দিতে পারি। কেউ জানবেও না, আপনার পিছুও নিতে পারবে না।”

রিফাত হাসানের চোখে-মুখে আনন্দের একটা ছাপ পড়ল। ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে বললেন, “ও! থ্যাংকু থ্যাংকু থ্যাংকু। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না!”

রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বলল, “ধন্যবাদ দিতে হবে না, অন্য একটা কিছু দিলেই হবে।”

“কী?”

“একটা অটোগ্রাফ। আপনি আমাদের হোটেলে উঠেছেন জানার পর থেকে আমার ছোট বোন আপনার একটা অটোগ্রাফের জন্যে আমার মাথা খারাপ করে ফেলছে! প্লীজ একটা অটোগ্রাফ দেবেন?”

রিফাত হাসান বললেন, “একটা কেন? আপনাকে দশটা অটোগ্রাফ দেব–আপনি শুধু আমাকে গোপনে বের হওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেন!”

রিফাত হাসান যখন এক টুকরো কাগজে একটা অটোগ্রাফ দিচ্ছেন তখন রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বলল, “আজকে আমার ছোট বোনের কাছে আমার স্ট্যাটাস কত বেড়ে যাবে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না!”

রিফাত হাসান কিছু না বলে একটু হাসলেন।

.

একটু পর সত্যি সত্যি রিসেপশনিস্ট মেয়েটি রিফাত হাসানকে বাইরে নিয়ে এল। বড় রাস্তায় এগিয়ে দিয়ে বলল, “এখন আপনি যেতে পারবেন?”

“অবশ্যই পারব।”

“আমার ধারণা খুব বেশি দূর যেতে পারবেন না। পাবলিক আপনাকে হেঁকে ধরবে।”

“ধরবে না। পাবলিক যেহেতু ফুটপাতে রাস্তাঘাটে আমাকে দেখতে আশা করে না তাই আমাকে দেখলেও চিনবে না।”

“না চিনলেই ভালো। গুড লাক।”

রিফাত হাসান মাথা নেড়ে সামনে এগিয়ে গেলেন।

সত্যি সত্যি কেউ তাকে চিনল না। তিনি রাস্তা ধরে হাঁটলেন, দুই পাশের দোকানগুলো দেখলেন। ফুটপাতে বসে থাকা হকারদের দেখলেন, মানুষের ভিড়ের সাথে মিশে রাস্তা পার হলেন, ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক দেখলেন। তারপর একটা স্কুটারের সাথে দরদাম করে তার শৈশবের এলাকাতে রওনা দিলেন।

স্কুটার থেকে নেমে চারিদিকে একবার তাকিয়ে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। স্কুটারের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমাকে ঠিক জায়গায় নামিয়েছেন তো?”

ড্রাইভার দাঁত বের করে হাসল, বলল, “জে স্যার। ঠিক জায়গায় নামিয়েছি।”

স্কুটারের ভাড়া মিটিয়ে রিফাত হাসান রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকেন, তার মনে হতে থাকে তিনি যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গায় হাঁটছেন। এই রাস্তা ধরে বগলে বইয়ের ব্যাগ চেপে ধরে অসংখ্যবার হেঁটে গেছেন, ব্যাপারটা তার বিশ্বাসই হতে চায় না। রাস্তাটা ছেলেবেলায় তার বিশাল মনে হত, এখন মনে হচ্ছে সরু একটা রাস্তা। একটা গলির মোড়ে রিফাত হাসান দাঁড়িয়ে গেলেন, এইখানে একটা ছোট দোকান ছিল, হাতে পয়সা থাকলে এই দোকান থেকে চুইংগাম কিনতেন। সেই দোকানটা নেই, তার বদলে এইখানে একটা শপিং পাজা। কী আশ্চর্য!

রিফাত হাসান আরও কিছুদূর হেঁটে গেলেন, সামনে একটা বিশাল মাঠ ছিল, যদি গিয়ে দেখেন মাঠটা নেই, চৌকোনা চৌকোনা কুৎসিত বিল্ডিং পুরো মাঠ ভরে ফেলেছে তা হলে তার মনে হয় দুঃখে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। রিফাত হাসান ভয়ে ভয়ে হেঁটে সামনে গিয়ে ডানদিকে তাকালেন এবং বুক থেকে একটা শ্বাস বের করে দিলেন। মাঠটা আছে, আগে যে রকম বিশাল তেপান্তরের মাঠের মতো মনে হত এখন সে রকম মনে হচ্ছে না। মাঠটা বেশ ছোট এবং রিফাত হাসানকে স্বীকার করতেই হবে, বেশ নোংরা। অবশ্যি আঠারো বছর পর এ দেশে এসে সবকিছুকেই নোংরা মনে হয় সেটা তিনি মেনেই নিয়েছেন। রিফাত হাসান হেঁটে এগিয়ে গেলেন, মাঠের মাঝখানে একটা গরু ঘাস খাচ্ছে। এক কোনায় বেশ কিছু ছেলে ক্রিকেট খেলছে। রিফাত হাসান মাঠের এক কোনায় দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকালেন, তাদের বাসাটা যেখানে ছিল সেখানে একটা কুৎসিত ছয়তলা ফ্ল্যাট। রিফাত হাসান আস্তে আস্তে মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন, চারিদিকে বড় বড় গাছ ছিল, এখন বেশিরভাগ গাছ নেই। মাঠের মাঝামাঝি গাছটা এখনো আছে। এই গাছটা তার প্রিয় গাছ ছিল। কতদিন এই গাছটার ডাল ধরে ঝপাঝাঁপি করেছেন। আর কী আশ্চর্য, গাছের পাশে লোহার বেঞ্চটাও এখনো আছে, রাত্রিবেলা এই বেঞ্চটাতে শুয়ে শুয়ে তিনি আকাশের তারা দেখতেন।

রিফাত হাসান গাছটার দিকে হেঁটে যেতে থাকলেন এবং তখন লক্ষ করলেন গাছের ডালে দশ-বারো বছরের একটা ছেলে, চোখে চশমা গায়ে লাল রঙের একটা টি-শার্ট। ছেলেটা ডালটাতে উঠে দাঁড়াল এবং তাকে অবাক করে ছেলেটা গাছ থেকে লাফ দিল। এত উঁচু থেকে কেউ সাধারণত লাফ দেয় না।

ছেলেটা নিচে পড়ে নিশ্চয়ই ব্যথা পেয়েছে, কারণ রিফাত হাসান শুনতে পেলেন সে যন্ত্রণার মতো শব্দ করছে। রিফাত হাসান তার কাছে ছুটে গেলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথা পেয়েছ, ব্যথা পেয়েছ তুমি?”

ছেলেটা উত্তর না দিয়ে আবার যন্ত্রণার মতো শব্দ করল। রিফাত হাসান কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “উঠতে পারবে? ধরব তোমাকে?”

ছেলেটা তখনো কথা বলল না, তার পায়ে যেখানে ব্যথা পেয়েছে সেখানে হাত বুলাতে লাগল। রিফাত হাসান বললেন, “কী হল? কথা বলছ না কেন?”

ছেলেটি পা-টাকে সোজা করার চেষ্টা করতে করতে বলল, “আমি অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলি না।”

ছেলেটি গাব্বু এবং এই বাক্যটি দিয়ে রিফাত হাসানের সাথে তার পরিচয়ের সূত্রপাত হল।

রিফাত হাসান গাব্বুর কথা শুনে হেসে ফেললেন, বললেন, “ও আচ্ছা! সেটা অবশ্যি ভালো। অপরিচিত মানুষের সাথে কথা না বলাই ভালো। পৃথিবীতে কতরকম মানুষ আছে, কী বল?”

গাব্বু এবারও কোনো কথা বলল না, উঠে দাঁড়িয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে হেঁটে লোহার বেঞ্চটাতে গিয়ে বসল। রিফাত হাসান জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথাটা কী একটু কমেছে?”

গাব্বু কথার উত্তর না দিয়ে হাত দিয়ে মুখটা জিপ করে বন্ধ করার মতো ভঙ্গি করল, ভঙ্গিটা খুবই স্পষ্ট, তার মুখ জিপ করে দেওয়া হয়েছে, সে কোনো কথা বলবে না। রিফাত হাসান বললেন, “ও আচ্ছা, মুখ বন্ধ? নো টক।”

গাব্বু মাথা নাড়ল। রিফাত হাসান বেঞ্চের একপাশে বসে বললেন, “আমি যদি আমার পরিচয় দিই, যদি কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারি আমি চোর ডাকাত ছেলেধরা না তা হলে কী কথা বলবে?”

“কীভাবে প্রমাণ করবেন?”

রিফাত হাসান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলেন, সেখান থেকে তার কার্ড বের করে গাব্বুর হাতে দিয়ে বললেন, “এই যে আমার কার্ড। এখানে আমার নাম লেখা আছে। আমার ইউনিভার্সিটির নাম–”

গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “যে কেউ কার্ড বানাতে পারে। আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে পড়ে, তার নাম বল্টু, সেও একটা কার্ড বানিয়েছে, কার্ডে কী লিখেছে জানেন?”

“কী?”

“ফেমাস ফিল্মস্টার।” গাব্বু মুখ গম্ভীর করে বলল, “সেই জন্যে কার্ডকে বিশ্বাস করা ঠিক না। তা ছাড়া—”

“তা ছাড়া কী?”

“এই যে মানিব্যাগটা আপনি বের করলেন, সেটা যে আপনার মানিব্যাগ তার কী প্রমাণ আছে?”

“মানে আমি অন্য কারও মানিব্যাগ নিয়ে এসেছি? পকেটমার?”

“আমি সেটা বলছি না, কিন্তু কোনো প্রমাণ তো নাই।”

রিফাত হাসান এই পাগলাটে ছেলেটার কথা শুনে মজা পেতে শুরু করেছেন। হাসি গোপন করে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, কোনো প্রমাণ নাই। যদি আজকের পত্রিকাটা থাকত তা হলে অবশ্যি প্রমাণ করতে পারতাম।”

গাব্বু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”

“আজকের পত্রিকায় আমার ছবি বের হয়েছে।”

রিফাত হাসানের কথা শুনে গাব্বু একটু সরে গিয়ে বসল। রিফাত হাসান জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল? তুমি একটু সরে গেলে কেন?”

“আপনি বলেছেন পত্রিকায় আপনার ছবি বের হয়েছে। সেই জন্যে। পত্রিকায় সবসময় মার্ডারার আর সন্ত্রাসীর ছবি বের হয়।”

রিফাত হাসান চোখ কপালে তুলে বললেন, “আমাকে দেখে কী মার্ডারার আর সন্ত্রাসী মনে হয়?”

গাব্বু কিছুক্ষণ রিফাত হাসানের দিকে তাকিয়ে রইল, চোখে চশমা, মাথায় আধপাকা চুল, মুখের কোনায় একটু হাসি, ঝকমকে চোখ। বলল, “নাহ্।”

রিফাত বিশাল একটা পরীক্ষায় পাস করেছেন সে রকম ভাব করে বললেন, “থ্যাংকু! তুমি যদি বলতে আমার চেহারা মার্ডারার আর সন্ত্রাসীর মতো তা হলে আমার খুব মন খারাপ হত।”

গাব্বু গম্ভীর গলায় বলল, “চেহারার উপরে মানুষের কোনো হাত নাই।”

“তা ঠিক।”

“আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দর চেহারা মিলির। আর মিলি হচ্ছে সারা ক্লাসের মাঝে সবচেয়ে পাজি।”

রিফাত হাসান মাথা নেড়ে বললেন, “ইন্টারেস্টিং।”

গাব্বু কোনো কথা বলল না এবং দুইজন চুপ করে বসে রইল। হঠাৎ রিফাত হাসানের কিছু একটা মনে পড়ল, সোজা হয়ে বসে বললেন, “ইউরেকা।”

গাব্বু রিফাত হাসানের দিকে তাকাল, রিফাত হাসান বললেন, “আমার কাছে একটা স্মার্ট ফোন আছে, সেটা দিয়ে ইন্টারনেট ব্রাউজ করা যায়। উইকিপিডিয়াতে আমার ওপর একটা পেজ আছে, আমি যদি সেখানে গিয়ে আমার পেজটা দেখাই তা হলে কী তুমি বিশ্বাস করবে?”

“ছবি আছে আপনার?”

“মনে হয় আছে।”

রিফাত হাসান পকেট থেকে তার স্মার্ট ফোন বের করে সেটাকে টেপাটেপি করতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণের মাঝেই উইকিপিডিয়াতে তার ছবিসহ একটা পেজ চলে এল। রিফাত হাসান দেখালেন, “এই দেখো আমার ছবি। এই দেখো ছবির নিচে আমার নাম, আমি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়াই তার নাম। দেখেছ?”

গাব্বু মাথা নাড়ল।

”এখন বিশ্বাস হয়েছে যে আমি ডাকাত কিংবা ছেলেধরা না?”

গাব্বু আবার মাথা নাড়ল।

”এখন আমরা কথা বলতে পারি?”

গাব্বু আবার মাথা নাড়ল, বলল, “পারি।”

রিফাত হাসান গাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার নাম রিফাত হাসান। আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। আমেরিকাতে যারা আছে তারা অবশ্যি কেউই আমার নামটা ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারে না। বলে ডিফাট।”

গাব্বু হাত মিলিয়ে বলল, “ড়িফাট?”

হ্যাঁ। ওরা ত উচ্চারণ করতে পারে না। আসলে শুনতেও পারে না। তুমি যদি বল বোতল ওরা শুনতে পায় বোটল।

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। সত্যি বললে ওরা শুনবে সট্যি!”

“কী মজা।”

রিফাত হাসান বললেন, “আমি তো আমার পরিচয় দিলাম, এখন তোমার পরিচয়টা জানতে পারি?”

“আমার নাম গাব্বু। আমার আরেকটা ভালো নাম আছে, সেটা অনেক লম্বা। গাব্বুটাই ভালো, মনে রাখা সোজা।”

“গাব্বু?”

“হ্যাঁ।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং নেম। তুমি যদি আমেরিকা যাও তা হলে তোমার নামটাও মনে হয় ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারবে না। বলবে ঘ্যাভু।”

“ঘ্যাভু?”

“হ্যাঁ। যাই হোক, এখন তুমি বল তুমি কেন এত উঁচু একটা গাছ থেকে লাফ দিয়েছ।”

“সেটা আপনি বুঝবেন না।”

“বুঝব না?”

“না।”

“কেন?”

গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “এটা হচ্ছে বিজ্ঞানের ব্যাপার। বিজ্ঞান না জানলে এটা বোঝা যায় না। আমি আব্বু, আম্মু, আপু সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কেউ বুঝতে পারে নাই। আপনিও বুঝবেন না।”

“বুঝতেও তো পারি।”

“উঁহু। অনেক কঠিন। এটা বুঝতে হলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, ভর, ওজন এইসব বুঝতে হয়।”

রিফাত হাসান কষ্ট করে মুখে গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন, “ও আচ্ছা, তা হলে আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করি তুমি কেন গাছের ওপর থেকে লাফ দিয়েছ?”

গাব্বু অবাক হয়ে রিফাত হাসানের দিকে তাকালেন, “আপনি আন্দাজ করবেন? করেন দেখি।”

রিফাত হাসান হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “ফ্রি ফলের সময় মানুষের নিজেকে মনে হয় কোনো ওজন নেই। তুমি তাই গাছ থেকে লাফ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছ ওজন না থাকলে কেমন লাগে।”

গাব্বু অবাক হয়ে রিফাত হাসানের দিকে তাকিয়ে রইল, চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “কী আশ্চর্য! আপনি কেমন করে আন্দাজ করলেন? আমি কত চেষ্টা করে কাউকে বোঝাতে পারি নাই, আর আপনি নিজে নিজে বুঝে গেলেন!”

“তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করে না?”

“না। উল্টো আমাকে নিয়ে ইয়ারকি করে।”

রিফাত হাসান মাথা নাড়লেন, বললেন, “আমি জানি। সায়েন্টিস্টদের কথা কেউ বুঝতে চায় না। তাদের জীবন খুবই কঠিন। আগে অবস্থা আরও অনেক খারাপ ছিল, পুড়িয়ে মেরে ফেলত। এখন অবস্থা একটু ভালো, আর পুড়িয়ে মারে না। বড়জোর গালাগাল দেয়।”

গাব্বু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, “না, অবস্থা বেশি ভালো হয় নাই। দুই-দুইবার আমার ল্যাবরেটরিটা নালায় ফেলে দিয়েছিল।”

“খুবই অন্যায় হয়েছে।”

“এক্সপেরিমেন্ট করার সময় একটু ভুল তো হতেই পারে। একটু আগুন লেগেছে, জানালার পর্দা অল্প একটু পুড়েছে। ব্যস! সবাই রেগেমেগে ফায়ার। আমার পুরা ল্যাবরেটরি নালায়। কত মূল্যবান কেমিক্যালস ছিল। ইশ!”

রিফাত হাসান সমবেদনার ভঙ্গি করে বলল, “ইশ! খুবই অন্যায় হয়েছে। খুবই অন্যায়।”

ঠিক এই সময় রিফাত হাসানের টেলিফোন বাজল, টেলিফোন করেছে ইউসুফ, ভয় পাওয়া গলায় বলল, “স্যার, আপনি কোথায়?”

রিফাত হাসান বললেন, “আমি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে ব্যস্ত আছি। তোমার সাথে একটু পরে কথা বলি?”

ইউসুফ বলল, “ঠিক আছে স্যার। ঠিক আছে।” সে টেলিফোন বন্ধ করে হোটেলের রিসেপশনিস্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে ব্যস্ত আছেন।”

মেয়েটি বলল, “গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তো গুরুত্বপূর্ণ কাজেই ব্যস্ত থাকেন। এত মানুষ দেখা করতে চাইছে সবাইকে তো সময়ও দিতে পারেন না। নিশ্চয়ই কাউকে সময় দিয়েছেন।”

“কে হতে পারে?” ইউসুফ মাথা চুলকালো।

”প্রাইম মিনিস্টার? প্রেসিডেন্ট?”

“বুঝতে পারছি না। কারও সাথে যোগাযোগ না করে একা বের হয়ে গেছেন, খুব দুশ্চিন্তা লাগছে।”

মেয়েটি অপরাধীর মতো বলল, “স্যারকে সার্ভিস ডোর দিয়ে বের করে দেওয়াটা মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হয় নাই। কী করব–এমনভাবে বলছিলেন যে না করতে পারলাম না।”

ইউসুফ চিন্তিত মুখে বলল, “ভেরি রিস্কি। স্যার যখন ইউরোপ যান তখন স্যারের প্রোটেকশনের জন্যে স্পেশাল স্কোয়াড থাকে, আর আমরা এখানে স্যারকে একা একা ছেড়ে দিলাম। স্যার স্কুটার রিকশা করে চলে গেলেন। কী সর্বনাশ!”

মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, “মনে হচ্ছে ভুলটা আমারই হয়েছে।”

“না, না, আপনার ভুল হয়নি। স্যার এডাল্ট মানুষ, কিছু একটা করতে চাইলে তো নিষেধ করতে পারি না। কাল থেকে পুলিশ স্কোয়াডের ব্যবস্থা করব। কোথায় আছেন কে জানে তা হলে এখনই পুলিশ নিয়ে যেতাম।”

“গুরুত্বপূর্ণ কোনো মানুষের সাথে যখন কথা বলছেন, মনে হয় নিরাপদেই আছেন।”

.

ঠিক এরকম সময় রিফাত হাসানের সাথে”গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির আলাপ খুব জমে উঠেছে।

গাব্বু জিজ্ঞেস করেছে, “আপনি কী করেন?”

রিফাত হাসান বলল, “বলতে পার আমিও তোমার লাইনের লোক। এই তোমার মতো একটু-আধটু বিজ্ঞানের কাজ করি।”

গাব্বু কিছুক্ষণ রিফাত হাসানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “বেশি সুবিধে করতে পারেন নাই। তাই না?”

রিফাত হাসান থতমত খেয়ে বললেন, “কেন? তোমার এটা কেন মনে হল?”

“সত্যিকারের সায়েন্টিস্টদের একটা চেহারা থাকে, আপনার সেই চেহারাটা এখনো আসে নাই।”

“সেটা কী রকম চেহারা?”

গাব্বু নিজের চুল এলোমেলো করে দেখিয়ে দিয়ে বলল, “লম্বা লম্বা উষ্কখুষ্ক চুল। আর বড় বড় মোছ।”

“তাই না কি?”

“হ্যাঁ। আইনস্টাইনের লম্বা লম্বা চুল। নিউটনের লম্বা লম্বা চুল, গ্যালিলিওর লম্বা লম্বা চুল। সব সায়েন্টিস্টদের লম্বা লম্বা চুল থাকে। আপনি যদি বড় সায়েন্টিস্ট হতে চান তা হলে লম্বা লম্বা চুল রাখা শুরু করে দেন।”

“ঠিক আছে। রিফাত হাসান রাজি হওয়ার ভঙ্গি করে বললেন, “তোমার কাছ থেকে অনেক বড় একটা জিনিস শিখে নিলাম। লম্বা চুল এবং সম্ভব হলে বড় বড় গোঁফ।” হঠাৎ করে তাঁর কিছু একটা মনে হল, মাথা ঘুরিয়ে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা, মেয়েরা তো সাধারণত লম্বা লম্বা চুল রাখে, তা হলে তারা কি আরও সহজে বড় বিজ্ঞানী হতে পারবে?”

গাব্বু ইতস্তত করে বলল, “সেইটা তো কখনো চিন্তা করি নাই। মনে হয় পারবে। কিন্তু চুল লম্বা হলেই তো হবে না, উষ্কখুষ্ক থাকতে হবে। মেয়েরা কখনো চুল উষ্কখুষ্ক রাখতে চায় না। সেইখানে মনে হয় সমস্যা হয়।”

রিফাত হাসান মুখে কষ্ট করে একটা গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন, “তুমি বিজ্ঞানের আর কী কী জানো?”

“অনেক কিছু জানি।”

“কয়েকটা বল দেখি।”

গাব্বু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “বিজ্ঞানের গবেষণা করার সময় আগে থেকে কাউকে সেটা বলবেন না।”

“কেন?”

“কারণ তারা গবেষণার কিছু বুঝে না, আর সেটা নিয়ে হাসাহাসি করে। আর যদি কাজ না করে তা হলে সারাক্ষণ টিটকারি মারবে। আমি একবার একটা রকেট বানিয়েছিলাম, সেটা কেন জানি উপরে না উঠে নিচে ডাইভ মেরেছিল, তারপর সেটা নিয়ে কী হাসাহাসি কী টিটকারি। দেখা হলেই বলে, এই গাব্বু, তোর রকেটের খবর কী? এখনো মাটির নিচে যায়?”

রিফাত হাসান বললেন, “খুবই অন্যায় কথা।”

গাব্বু হঠাৎ করে ঘুরে রিফাত হাসানকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

“আমি যখন ছোট ছিলাম তখন এখানে থাকতাম। তাই জায়গাটা আবার দেখতে এসেছি, কতটুকু আগের মতো আছে, কতটুকু পাল্টে গেছে।”

“আগের মতোন কী আছে?”

রিফাত হাসান মাথা নাড়লেন, বললেন, “না। মোটেও আগের মতোন নাই। চারিদিকে খালি বিল্ডিং আর বিল্ডিং। এই মাঠটার জন্যে এখনো চিনতে পেরেছি। তুমি যে গাছ থেকে লাফ দিয়েছ, আমিও এই গাছ থেকে লাফ দিতাম।”

“আপনাদের বাসাটা কোথায় ছিল?”

রিফাত সামনে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে ছয়তলা দালানটা দেখছ, ওখানে আগে ছোট একটা দুই তলা বিল্ডিং ছিল, আমরা সেইখানে থাকতাম। ডানপাশে একটা টিনের ছাদওয়ালা ছোট বাড়ি ছিল, এখন সেখানে ন-দশ তলা বিল্ডিং! থ্যাংক গড, এই মাঠটা এখনো খালি আছে।”

গাব্বু বলল, “বেশিদিন খালি থাকবে না। এইখানে না কী একটা বারো তলা শপিং কমপ্লেক্স হবে।”

রিফাত হাসান মাথা নেড়ে বললেন, “হাউ স্যাড! কী দুঃখের ব্যাপার।”

গাব্বু হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী নিয়ে গবেষণা করেন?”

“তুমি কী নিয়ে গবেষণা করো?”

“অনেক কিছু। যেমন মনে করেন, টিকটিকির লেজ পড়ে গেলে আরেকটা লেজ গজায়। তা হলে এমন কি হতে পারে আসল লেজটা পড়ার আগেই নতুন একটা লেজ গজালো! তার মানে তখন এক টিকটিকির দুই লেজ!”

রিফাত হাসান হাসলেন, বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং।”

“তারপর মনে করেন আমার আরেকটা গবেষণা হচ্ছে টেলিপ্যাথি নিয়ে। আপনি টেলিপ্যাথির নাম শুনেছেন?”

“শুনেছি। একজনের চিন্তা আরেকজনের মাথায় পাঠিয়ে দেওয়া।”

গাব্বুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, এই প্রথম সে একজন মানুষকে পেয়েছে যে নিজে থেকে টেলিপ্যাথি বিষয়টা জানে। এর আগে সবাইকে তার বিষয়টা বোঝাতে হয়েছে এবং কাউকেই সে আসলে বোঝাতে পারেনি এবং সবাই উল্টো তাকে এটা নিয়ে ঠাট্টা করেছে। গাব্বু উত্তেজিত গলায় বলল, “দুইজন যদি অনেকদূরে বসে একই সময় একইভাবে চিন্তা করে তা হলে একজনের চিন্তাটা আরেকজনের মাথায় পাঠানো যায়। চিন্তা করতে হয় এইভাবে-” বলে গাব্বু চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে দুই কান চেপে ধরে ভুরু কুঁচকে গভীরভাবে চিন্তা করার একটা ভঙ্গি করল।

রিফাত হাসান কষ্ট করে হাসি চেপে রেখে মুখে একটা গম্ভীর ভাব ধরে রেখে বললেন, “তুমি কি টেলিপ্যাথি করার চেষ্টা করে দেখেছ যে এটা কাজ করে?”

গাব্বু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কেমন করে পরীক্ষা করব? কাউকে রাজি করাতে পারি না। অনেক কষ্ট করে আপুকে রাজি করিয়েছিলাম। আপু চিন্তা না করে খালি হাসে। হাসলে কেমন করে হবে?”

টেলিপ্যাথি জাতীয় বিষয়গুলো যে আসলে বিজ্ঞানের বিষয় নয়, এগুলো যে বিজ্ঞানের নাম ব্যবহার করে অবৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রচার করার একটা চেষ্টা, বিষয়টা গাব্বুকে জানাতে গিয়েও রিফাত হাসান থেমে গেলেন। গাব্বুর এত উত্তেজনার মাঝে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিতে ইচ্ছে করল না, আধপাগল এই বাচ্চাটার মাঝে যদি সত্যিকারের একটা বৈজ্ঞানিক মন থাকে তা হলে সে নিজেই একদিন বিষয়টা বুঝে নেবে।

“এই জন্যে এখনো টেলিপ্যাথির গবেষণাটা শেষ করতে পারি নাই।” গাব্বু বলল, “কেউ টেলিপ্যাথি করতে রাজি হয় না।”

“এত ইন্টারেস্টিং গবেষণা তার পরেও কেউ রাজি হয় না?”

হঠাৎ করে গাব্বুর চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে, রিফাত হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি করবেন?”

রিফাত হাসান চমকে উঠলেন, “আমি?”

“হ্যাঁ। আপনি আর আমি।”

“আ-আ-আমাকে কী করতে হবে?”

“কিছু না, খুবই সোজা। প্রত্যেকদিন ঠিক রাত দশটার সময় আপনি চোখ বন্ধ করে কান চেপে ধরে চিন্তা করে আমাকে কোনো একটা খবর পাঠাবেন।”

“খবর–মানে ম্যাসেজ?”

“হ্যাঁ। আমিও পাঠাব। দেখব ম্যাসেজ যায় কি না।”

“ম্যাসেজটা গিয়েছে কি না সেটা কেমন করে বুঝব?” গাব্বু বলল, “ম্যাসেজটা পেলেই বুঝবেন সেটা গিয়েছে। না বোঝার কী আছে?”

“ও আচ্ছা।”

গাব্বু আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “করবেন এক্সপেরিমেন্ট?”

রিফাত হাসান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না যখন শুনলেন যে গাল্লুকে বলছেন, “ঠিক আছে!” আমেরিকায় তার ইউনিভার্সিটির বন্ধু-বান্ধব ছাত্রছাত্রী যদি এটা শুনে তা হলে তারা নিশ্চয়ই হাসতে হাসতেই মরে যাবে।

গাব্বু তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “রাত দশটা। প্রত্যেকদিন।”

প্রফেসর হাসান মাথা নাড়লেন, বললেন, “ঠিক আছে। যদি মনে থাকে।”

“আমি আপনাকে মনে করিয়ে দেব।”

“কেমন করে মনে করিয়ে দেবে?”

“কেন? টেলিপ্যাথি দিয়ে!”

রিফাত হাসান বললেন, “ও আচ্ছা! ঠিক আছে। হ্যাঁ মনে করিয়ে দিয়ো।”

ঠিক এরকম সময় দূরের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ শোনা যেতে লাগল। গাব্বু তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আজান পড়ে গেছে। যেতে হবে।”

“ঠিক আছে বিজ্ঞানী গাব্বু। যাও।”

গাব্বু যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “সবাই যদি আপনার মতো বিজ্ঞানের ব্যাপার-স্যাপার বুঝত, তা হলে কী যে ভালো হত!”

“সবাইকে দোষ দিয়ে আর কী হবে? সবাই তো আর তোমার কিংবা আমার মতো বিজ্ঞান করে না। কেমন করে বুঝবে?”

“আপনি কী নিয়ে গবেষণা করেন সেটা তো বললেন না?”

“আমার গবেষণা মোটেও তোমার মতো ইন্টারেস্টিং না। তোমার তুলনায় খুবই বোরিং। রীতিমতো হাস্যকর।”

গাব্বু উদারভাবে বলল, “তাতে কী আছে! তবু শুনি?”

রিফাত হাসান বললেন, “আমি এক্সেলেটর দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি। এক্সপেরিমেন্টের পর অনেক ডাটা পাওয়া যায়, সেই ডাটা এনালাইসিস করে একটা পার্টিকেল খুঁজি।”

“কেমন করে খোঁজেন?”

“পার্টিকেলটা থাকলে তার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকবে। ডাটাগুলোর মাঝে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজি।”

গাব্বু বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, “বুঝেছি।”

গাব্বুর কথা শুনে রিফাত হাসান থতমত খেয়ে গেলেন। তাঁর যে কাজ সেটা গাব্বুর মতো দশ-বারো বছরের বাচ্চার বোঝার কথা নয়। তাই একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বুঝেছ?”

“হ্যাঁ। আসলে আমিও এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম, একটু অন্যভাবে।”

গাব্বুর কথা শুনে রিফাত হাসান কৌতুক অনুভব করলেন, বললেন, “তুমিও এই রকম এক্সপেরিমেন্ট করেছ?”

“হ্যাঁ। অন্যভাবে।”

“কীভাবে?”

গাব্বু মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য নিয়ে এসে বলল, “আমাদের একজন স্যার আছেন, হাকিম স্যার। খুবই কড়া। সমাজপাঠ পড়ান। পরীক্ষার আগে সবাই চিন্তা করছে স্যার কী রকম প্রশ্ন করবেন। ক্লাসের সবাই স্যারের আগের প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে, সেগুলো দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করেছে স্যার এইবার

কী প্রশ্ন করবেন। আর আমি কী করেছি জানেন?”

“কী?”

“আমি করেছি ঠিক তার উল্টো।”

“উল্টো?”

“হ্যাঁ। হাকিম স্যার আগে কী প্রশ্ন করেছেন সেটা দেখার চেষ্টা না করে আমি দেখার চেষ্টা করলাম স্যার আগে কোন কোন প্রশ্ন করেন নাই! শুধু সেইগুলো পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি। চোখ বন্ধ করে এ পাস!”

রিফাত হাসান অবাক হয়ে দশ-বারো বছরের এই আধা পাগল ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, বাচ্চাটা ছেলেমানুষি ভঙ্গিতে তার সামনে হঠাৎ একটা আশ্চর্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এক্সপেরিমেন্টাল পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে তার আর তার দলের সবার জীবনের বড় একটা অংশ কাটে এক্সপেরিমেন্টের ডাটা ঘেঁটে। কেমন করে এই ডাটা বিশ্লেষণ করা হবে তার ওপর নির্ভর করে কত তাড়াতাড়ি তারা তাদের এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল প্রকাশ করতে পারেন। এই ছেলেটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে ডাটা বিশ্লেষণের একটা পদ্ধতি বলে দিয়েছে–এত সহজ এত চমৎকার একটা পদ্ধতির কথা তার মাথায় কেন আসেনি রিফাত হাসান সেটা ভেবে অবাক হয়ে গেলেন।

গাব্বু আকাশের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আমি যাই।” রিফাত হাসান বললেন, “দাঁড়াও গাব্বু। এক সেকেন্ড দাঁড়াও।”

গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু দাঁড়ানো যাবে না। আমাদের বাসার নিয়ম হচ্ছে আজান হওয়ার সাথে সাথে বাসায় রওনা দিতে হবে।”

“কিন্তু তোমার জানা দরকার তুমি আমাকে অসাধারণ একটা আইডিয়া দিয়েছ।”

“লাভ নাই।” গাব্বু হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “আমাকে বাসায় যেতেই হবে।”

রিফাত হাসান বললেন, “ডাটাতে একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য না খুঁজে আমরা এখন তোমার টেকনিক ব্যবহার করতে পারি। কোনটা নেই সেটা খুঁজতে পারি। অসাধারণ আইডিয়া।”

বিষয়টা নিয়ে গাবুকে খুব উত্তেজিত হতে দেখা গেল না। বলল, “আমার এখন যেতে হবে।”

“এক সেকেন্ড। প্লীজ।”

“উঁহু।” গাব্বু হাঁটতে হাঁটতে বলল, “বাসায় দুশ্চিন্তা করবে।”

রিফাত হাসান ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আমি যদি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চাই?”

“টেলিপ্যাথি–” গাব্বু গম্ভীর গলায় বলল, “টেলিপ্যাথি করে আমার কাছে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিবেন।”

রিফাত হাসান অবাক হয়ে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

.

০৬.

গাব্বু হেঁটে হেঁটে মাঠটা পার হয়ে ছোট রাস্তাটায় ওঠার পর দেখতে পেল উল্টোদিক দিয়ে টুনি আর মিঠু হেঁটে আসছে। গাব্বুকে দেখে টুনি বলল, “ঠিক আছিস? ঠ্যাং ভাঙে নাই তো?”

গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “ঠ্যাং ভাঙবে কেন?”

মিঠু বলল, “যদি গাছ থেকে লাফ দাও!”

টুনি বলল, “আম্মু আমাদেরকে পাঠিয়েছে তুই গাছপালা থেকে লাফাচ্ছিস কি না সেটা দেখার জন্যে।”

গাব্বু কোনো কথা না বলে হাঁটতে লাগল। টুনি বলল, “এতক্ষণ কী করছিলি?”

“কিছু না।”

“কিছু না মানে?”

“কথা বলছিলাম।”

“কার সাথে কথা বলছিলি?”

“এই তো একজনের সাথে।”

“কী নিয়ে কথা বলছিলি?”

“বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে।”

টুনি বলল, “তুই রাস্তাঘাটের মানুষের সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে কথা বলছিস?”

“মোটেও রাস্তাঘাটের মানুষ না। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।”

“ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের আর কাজ নাই তোর সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে কথা বলবে।”

গাব্বুর তর্ক করার ইচ্ছা করল না, তাই সে কোনো কথা বলল না। টুনি বলল, “কী নাম ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের?”

“ড়িফাট।”

“ড়িফাট? ড়িফাট কারও নাম হতে পারে না।”

গাব্বু বোঝানোর চেষ্টা করল, “আমেরিকানরা ডাকে ড়িফাট। আসল নাম অন্যকিছু।”

“আসল নাম কী?”

“জানি না, ভুলে গেছি।” তখন হঠাৎ করে গাব্বুর মনে পড়ল তার পকেটে একটা কার্ড আছে, বলল, “দাঁড়াও, আমার কাছে একটা কার্ড আছে।” গাব্বু পকেট থেকে কার্ডটা বের করে নামটা পড়ল, “প্রফেসর রিফাত হাসান।”

টুনি কেমন যেন চমকে উঠল, গাব্বুর হাত থেকে কার্ডটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে পড়ে একটা আর্তচিৎকার করল।

গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

টুনি কথা বলতে পারল না, তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়, নাক দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস বের হতে থাকে। দেখে মনে হয় বুঝি এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। গাব্বু ভয়ে ভয়ে বলল, “কী হয়েছে আপু?”

টুনি কেমন যেন তোতলাতে তোতলাতে বলল, “তু-তু-তুই বিজ্ঞানী রিফাত হাসানের সাথে কথা বলছিলি? বি-বিজ্ঞানী রি-রি রিফাত হাসান? রিফাত হাসান? রি-রি-রিফাত হাসান?”

গাব্বু থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “রিফাত হাসান কে?”

টুনি কেমন জানি খেপে উঠল, “তুই রিফাত হাসানকে চিনিস না? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক রিফাত হাসান? তিন দিনের জন্যে বাংলাদেশে এসেছেন!”

“ও।”

“কোথায় আছেন এখন?”

“ওই তত বেঞ্চে বসে আছেন!”

টুনি একটা চিৎকার করল, “বসে আছেন? এখনো বসে আছেন? কোথায়?” তারপর গাব্বুর উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে ছুটতে লাগল।

গাব্বু পেছনে পেছনে আসে, টুনি মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন বেঞ্চে?”

গাব্বু বলল, “ঐ তো ঐ বেঞ্চে ছিলেন।”

“এখন কই?”

“মনে হয় চলে গেছেন।”

“চলে গেছেন?” টুনি হাহাকারের মতো শব্দ করল, “চলে গেছেন?”

গাব্বু বলল, “আমার সাথে আরেকটু কথা বলতে চাচ্ছিলেন, আমি বললাম সময় নাই–”

টুনি কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে গেল, গাব্বুকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুই প্রফেসর রিফাত হাসানকে বলেছিস তোর কথা বলার সময় নাই? কথা বলার সময় নাই?”

গাব্বু বলল, “সময় না থাকলে আমি কী করব?”

টুনি দুই চোখ কপালে তুলে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল। সে এখনো গাব্বুর কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। টুনি গাব্বুকে ছেড়ে দিয়ে এদিক-সেদিক তাকায়, মাঠের পাশ দিয়ে রাস্তা পর্যন্ত ছুটে যায়, রাস্তার লোকজনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, তারপর হতাশ হয়ে ফিরে আসে।

বাসায় ঢুকেই টুনি চিৎকার করে বলল, “আম্বু আম্মু, তোমরা শুনে যাও, তোমাদের ছেলে কী করেছে।”

আব্বু আম্মু শঙ্কিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেছে?”

গাব্বুকে তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে হল। সবকিছু শুনে আব্বু বললেন, “তুই এত বড় একজন বিজ্ঞানীকে বললি যে তার সাথে কথা বলবি না? অপরিচিত মানুষের সাথে তুই কথা বলিস না?”

গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। তুমিই তো সবসময় বল অপরিচিত মানুষের সাথে কথা না বলতে।”

“তাই বলে প্রফেসর রিফাত হাসানের মতো এত বড় একজন বিজ্ঞানীর মুখের উপর সেই কথা বলে দিলি?”

“উনি আমার কথা শুনে কিছু মনে করেন নাই।”

“কেমন করে জানিস?”

“তখন আমাকে কার্ড দিলেন। আমি যখন বললাম, আমি কার্ড বিশ্বাস করি তখন–”

টুনি আর্তনাদ করে উঠল, “উনি তোকে একটা কার্ড দিলেন আর তুই বললি তুই সেই কার্ড বিশ্বাস করিস না?”

“সমস্যাটা কী? তখন স্মার্ট ফোনে ইন্টারনেট দিয়ে তার ওয়েবসাইট দেখালেন, তখন আমি বিশ্বাস করলাম।”

আম্মু বলল, “যখন বিশ্বাস করলি তখন বাসায় নিয়ে এলি না কেন?” গাব্বু বলল, “চিনি না শুনি না রাস্তার একজন মানুষকে বাসায় নিয়ে আসব?”

টুনি গাব্বুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “রাস্তার মানুষ? প্রফেসর রিফাত হাসান রাস্তার মানুষ?”

মিঠু বলল, “ভাইয়া, তুমি প্রফেসর রিফাত হাসানকে চিনতে পারলে না? টেলিভিশনে সবসময় দেখাচ্ছে।”

টুনি বলল, “নামটাও জানিস না? যখন কার্ডটা দিলেন তখন কার্ডের পেছনে একটা অটোগ্রাফ নিতে পারলি না?”

“অটোগ্রাফ?” গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “অটোগ্রাফ?”

“হ্যাঁ। চিন্তা করতে পারিস নিজের কার্ডের পেছনে তাঁর অটোগ্রাফ?”

“অটোগ্রাফ দিয়ে কী করব?”

টুনি হাত দিয়ে কপালে একটা থাবা দিয়ে বলল, “গাধাটা বলে অটোগ্রাফ দিয়ে কী করব! যদি শুধু বাসায় নিয়ে আসতে পারতি তা হলে ফটো তুলতে পারতাম। চিন্তা করা যায়? প্রফেসর রিফাত হাসানের সাথে ফটোগ্রাফ?”

মিঠু জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া, উনি তোমার সাথে কী নিয়ে কথা বলেছেন?”

“তুই বুঝবি না। বিজ্ঞানের ব্যাপার-স্যাপার।”

আব্বু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর সাথে বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেছেন?”

“হ্যাঁ। তোমরা তো আমার কোনো কথাই শুনতে চাও না। উনি সবকিছু শুনেছেন। আমার সব কথা বিশ্বাস করেছেন। টিকটিকির ডাবল লেজের আমার যে থিওরিটা আছে সেইটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন।”

টুনি জানতে চাইল, “তুই কেমন করে বুঝতে পারলি?”

“আমাকে বলেছেন।”

“কী বলেছেন?”

“বলেছেন তোমার সাথে বিজ্ঞানের থিওরিটা নিয়ে একটু কথা বলি।”

“আর তুই বলেছিস তোর সময় নাই?”

আম্মু মাথা নেড়ে বললেন, “হায় হায় হায়! এত বড় একজন মানুষ, এত বড় বিজ্ঞানী, তার সাথে তুই এত বড় বেয়াদবি করলি? এই দেশ নিয়ে কী একটা ধারণা নিয়ে ফিরে যাবেন! ভাববেন এই দেশের সব মানুষ বুঝি তোর মতো বোকা। কাণ্ডজ্ঞান নাই।”

আব্বু একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “এত বড় মানুষ, তুই তাকে চিনলি না?”

মিঠু বলল, “আমি পর্যন্ত চিনি।”

টুনি প্রফেসর রিফাত হাসানের কার্ডটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইখানে টেলিফোন নম্বরগুলো আমেরিকার। ইশ! যদি দেশের একটা মোবাইল নম্বর থাকত তা হলে ফোন করতে পারতাম। কোনোভাবে যদি একবার যোগাযোগ করা যেত।”

গাব্বু বলল, “আমার সাথে আজ রাতে যোগাযোগ হবে।”

একসাথে সবাই লাফিয়ে উঠল, “যোগাযোগ হবে?”

“হ্যাঁ।”

টুনি চিৎকার করে উঠল, “এতক্ষণ বলিসনি কেন? কীভাবে যোগাযোগ হবে?”

“টেলিপ্যাথি।”

যোগাযোগ শুনে যেভাবে সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, টেলিপ্যাথি শুনে সবার উত্তেজনা ঠিক সেইভাবে শেষ হয়ে গেল। টুনি হতাশ হয়ে বলল, “টেলিপ্যাথি? গাধা তুই একটা মোবাইল নম্বর নিতে পারলি না?”

গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “যখন টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ কাজ করা শুরু করবে তখন দেখো মোবাইল টেলিফোনের বিজনেসের বারোটা বেজে যাবে।”

মিঠু জিজ্ঞেস করল, “টেলিপ্যাথি দিয়ে মিসকল দেওয়া যাবে?”

গাব্বু বলল, “ধুর গাধা! তখন মিসকল দিতে হবে না।”

আব্বুকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, “উনি টেলিপ্যাথি বিশ্বাস করেন?”

গাব্বু মাথা চুলকে বলল, “এখনো হ্যাঁ না কিছু বলেন নাই। কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাপার-স্যাপার সবসময় পরীক্ষা করে দেখতে হয়। আমরা ঠিক করেছি প্রত্যেকদিন রাত দশটার সময় টেলিপ্যাথি করার চেষ্টা করব।”

টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “প্রত্যেকদিন?”

“হ্যাঁ।”

“গাধা তুই টেলিপ্যাথি না বলে টেলিফোন কেন বললি না?”

গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “টেলিফোন খুবই পুরনো জিনিস। দুইশ বছর আগে আবিষ্কার হয়েছে। টেলিপ্যাথি নতুন–এখনো আবিষ্কার হয় নাই।”

.

ঠিক এই সময় রিফাত হাসান হোটেলের রুমে বসে তার সহকর্মীদের কাছে একটা ই-মেইল পাঠাচ্ছিলেন। ই-মেইলটি এই রকম :

আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস জানানোর জন্যে তোমাদের কাছে এই ই-মেইলটি পাঠাচ্ছি। আমাদের পুরো সময়টি কাটে বিশাল পরিমাণ ডাটা এনালাইসিস করে, সেখান থেকে ছোট একটা সিগনেচার খুঁজে বের করতে আমাদের পুরো জীবনটা কেটে যায়। কাজটা কত সময়সাপেক্ষ সেটা তোমাদের থেকে ভালো করে আর কেউ জানে না।

আজ বিকেলে একজন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ডাটা এনালাইসিস করার একটা চমকপ্রদ উপায় দেখিয়ে দিয়েছে। পদ্ধতিটা খুবই সহজ, এক কথায় এইভাবে বলা যায়, কী আছে সেটা না খুঁজে কী নেই সেটা খোজা। এখানে বসে আমি ডাটাবেসে ঢুকতে পারছি না, যদি পারতাম তা হলে এক্ষুনি পরীক্ষা করে দেখতাম। তোমরা কেউ একজন ডাবল ব্রাঞ্চিং ডাটাতে কোথায় কোথায় পেয়ার প্রডাকশন নেই আমাকে জানাও।

তোমরা শুনে খুবই মজা পাবে, আমাকে যে এই চমকপ্রদ আইডিয়াটি দিয়েছে সে দশ-বারো বছরের পাগলাটে একটা ছেলে, তার নাম গাব্বু। এই বয়সেই সে খাঁটি বৈজ্ঞানিক। তার সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় সে আমাকে তার কো-পার্টনার করেছে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার উদ্দেশ্য শুনলে তোমাদের খুবই মজা পাওয়ার কথা, সেটি হচ্ছে টেলিপ্যাথি। হা হা হা।

রাত দশটার সময় তোমরা যদি আমাকে ফোন করে আবিষ্কার করো আমি ফোনটি ধরছি না তা হলে বুঝে নেবে আমি তার সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ করার এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত আছি। হা হা হা।

রাত দশটার সময় রিফাত হাসান যখন সত্যি সত্যি তার সব কাজ ফেলে রেখে গাব্বুর দেখানো পদ্ধতিতে চোখ বন্ধ করে দুই কানে হাত দিয়ে টেলিপ্যাথি করার চেষ্টা করছেন তখন গাব্বুও বাসা থেকে একই কাজ করছে। মিঠু খুব কাছে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে গাল্লুকে দেখছিল, গাব্বু কয়েক মিনিট চেষ্টা করে যখন চোখ খুলল তখন মিঠু জিজ্ঞেস করল, “হয়েছে ভাইয়া? টেলিপ্যাথি হয়েছে?”

গাব্বু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, “নাহ। আমি কোনো ম্যাসেজ পাই নাই, আমার ম্যাসেজটা পেয়েছেন কি না বুঝতে পারলাম না।”

“তুমি কী ম্যাসেজ পাঠিয়েছো?”

“ইম্পরট্যান্ট ম্যাসেজ। স্টপ। চুল দাড়ি মোছ ছাড়াও বড় বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব। স্টপ। উদাহরণ ডারউইন। স্টপ। মাথা ভরা টাক। স্টপ।”

মিঠু অবাক হয়ে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল