পরদিন সকালে মাথায় ঠাণ্ডা পানি না ঢেলেও গাব্বুকে ঘুম থেকে তুলে ফেলা গেল। বাথরুমে গিয়ে গাব্বু টুথপেস্ট দিয়ে মুখ ধোয়া যায় কি না পরীক্ষা করে দেখল। পাশে টুনি দাঁড়িয়ে ছিল, অন্যদিন হলে চিৎকার করে বাসা মাথায় তুলে ফেলত, আজকে কিছুই করল না। নাস্তা খাওয়ার সময় গাব্বু যখন পানির গ্লাসে চায়ের পাতা ফেলে সারফেস টেনশনের একটা ছোট এক্সপেরিমেন্ট করে ফেলল, তখনো কেউ তাকে কিছু বলল না।

নাস্তা খেতে খেতে আব্বু খবরের কাগজ পড়ছিলেন, হঠাৎ মাথা তুলে বললেন, “এই যে, রিফাত হাসানের ছবি।”

সবাই ঘুরে তাকাল। প্রথম পৃষ্ঠায় নিচের দিকে তার হাসিমুখের একটা ছবি। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী লিখেছে আব্বু?”

মিঠু বলল, “ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে সেইটা কি লিখেছে?”

টুনি মুখ ভেংচে বলল, “আর ভাইয়া যে তার সাথে একশ রকম বেয়াদবি করেছে সেটা লিখেছে?”

আব্বু হাসলেন, বললেন, “না সেইগুলো কিছু লিখেনি। লিখেছে যে আজকে বিকেলে চলে যাবেন!”

টুনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ইশ! একটুর জন্যে দেখা হল না।”

.

স্কুলে পৌঁছানোর পর গাব্বু তার ব্যাগটা জানালার কাছে রেখে যখন বের হবে তখন শুনল তাদের ক্লাসের মিলি আর লিটন ঝগড়া করছে। গাব্বু এ ধরনের ঝগড়াঝাটিকে কোনো গুরুত্ব দেয় না, কিন্তু আজকে গুরুত্ব দিল। কারণ ঝগড়ার বিষয়বস্তুটা বিজ্ঞানবিষয়ক। গাব্বু শুনতে পেল লিটন বলছে উত্তল লেন্স দিয়ে কোনোকিছু ছোট দেখা যায়, আর মিলি বলছে বড় দেখা যায়। এরকম বৈজ্ঞানিক একটা আলোচনায় পাশে দাঁড়িয়েও সে অংশ নেবে না সেটা তো হতে পারে না।

গাব্বুকে দেখে লিটন আর মিলি দুজনেই থেমে গেল, কারণ তারা দুজনেই জানে গাব্বু এই আলোচনাটাকে টেনে এত লম্বা করে ফেলবে যে তারা সেখান থেকে আর বের হতে পারবে না। গাব্বু বলল, “তোদের সমস্যাটা কী?”

লিটন তাড়াতাড়ি বলল, “কোনো সমস্যা নাই।”

মিলিও মাথা নাড়ল, “নাই। সমস্যা নাই।” তারপর দুইজনই ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে যেতে শুরু করল।

গাব্বু বলল, “আমি তোদের কথা শুনেছি। উত্তল লেন্স দিয়ে কোনোকিছুকে বড় দেখা যায় না ছোট দেখা যায় সেটা জানতে চাচ্ছিস।”

মিলি বলল, “এখন আর জানতে চাচ্ছি না।” তারপর ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেল।

গাব্বু পেছন পেছন হেঁটে গিয়ে বলল, “উত্তল লেন্স হচ্ছে কনভেক্স লেন্স। কনভেক্স লেন্স দিয়ে একটা জিনিস বড়ও দেখা যায়, আবার ছোটও দেখা যায়।”

মিলি এবার দাঁড়িয়ে গেল, ভুরু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে বলল, “একটা লেন্স দিয়ে একইসাথে একটা জিনিস বড় আর ছোট কেমন করে দেখা যাবে? আমার সাথে ফাজলেমি করিস?”

“মোটেই ফাজলেমি করছি না। বড় দেখা যায় যদি জিনিসটা ফোকাল লেংথের ভেতরে থাকে। ফোকাল লেংথের বাইরে হলে ছোট হতে পারে।”

মিলিকে লেন্স নিয়ে উৎসাহী হতে দেখা গেল না, সে হেঁটে চলে গেল। লিটন জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”

“হ্যাঁ। ক্যামেরায় ছবি তোলে কীভাবে? কনভেক্স লেন্স দিয়ে। আমরা আমাদের চোখে দেখি কেমন করে? কনভেক্স লেন্স দিয়ে।”

লিটন বলল, “ও।”

“টেলিস্কোপের অবজেক্টিভ লেন্স সবসময় কনভেক্স লেন্স দিয়ে তৈরি করতে হয়। আইপিস কনভেক্সও হতে পারে, কনকেভও হতে পারে।”

লিটন বলল, “ও।”

“আইপিস যদি কনভেক্স হয় সেই টেলিস্কোপে সবকিছু উল্টো দেখা যায়।”

লিটন বলল, “ও।”

“আমাদের বাইনোকুলার আমরা সোজা দেখি। তার মানে কী?” গাব্বু লিটনের উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল না, নিজেই বলে দিল, “তার মানে হচ্ছে বাইনোকুলারের আইপিস হচ্ছে কনকেভ লেন্স।”

লিটন বলল, “ও।” গাব্বু বলল, “আমার ব্যাগে লেন্স আছে। দেখবি?”

লিটন দুর্বলভাবে বলল, “দেখা।”

গাব্বু তখন তার ব্যাগ খুলে সেখান থেকে লেন্স খুঁজে বের করতে থাকে। ব্যাগে শুধু লেন্স নয়, সেখানে দুই ধরনের চুম্বক, কয়েলের তার, কয়েকটা ব্যাটারি, কাঁচের স্লাইড, ক্রু ড্রাইভার, এলইডি, লিটমাস পেপার, ফিল্মের কৌটা, ভিনেগার, শুকনো পোকামাকড়-এরকম অনেক কিছু আছে। গাব্বু যখন লেন্সটা খুঁজে বের করছে তখন লিটন কেটে পড়ার একটা সুযোগ পেল, বলল, “গাব্বু তুই খুঁজে বের কর। আমি আসছি।” তারপর সেও সটকে পড়ল।

গাব্বু শেষ পর্যন্ত তার লেন্সটা খুঁজে পেল, লেন্সটা সে জানালার ওপর দাঁড় করিয়ে লিটনকে খুঁজতে বের হল। সে তখনো জানতো না এই লেন্সটা তার কপালে কত বড় বিপদ ডেকে আনবে।

ক্লাসরুম থেকে বের হয়েই গাব্বু দেখল রবিন মাঠে পড়ে আছে এবং তাকে ঘিরে ছোট একটা ভিড়। রবিন একটু দুষ্টু টাইপের, সারাক্ষণই ছোটাছুটি করছে এবং আছাড় খেয়ে পড়ে ব্যথা পাচ্ছে। কাজেই তার জন্যে এটা মোটেই নতুন ব্যাপার না। গাব্বু কাছে গিয়ে দেখে আসলেই তাই, পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে, নাক-মুখ কুঁচকে যন্ত্রণার শব্দ করছে।

রত্না বলল, “নাক চেপে ধর তা হলে ব্যথা কমে যাবে।”

মিলি বলল, “ঠাণ্ডা পানি খাইয়ে দে।”

লিটন বলল, “গরম সরিষার তেল দিলে ব্যথা কমবে।”

গাব্বু এরকম অবৈজ্ঞানিক কথা শুনে খুবই বিরক্ত হল, কাছে গিয়ে বলল, “ব্যথা কী? ব্যথা হচ্ছে নার্ভ দিয়ে ব্রেনে পাঠানো একটা অনুভূতি। তাই ব্যথা কমানোর একটাই উপায়, সেটা হচ্ছে নার্ভ দিয়ে ব্যথার অনুভূতিটা পাঠাতে বাধা দেওয়া।”

মিলি বলল, “সেটা কীভাবে করা যায়? কক্ষনোই করা যাবে না।”

গাব্বু গম্ভীর হয়ে বলল, “অবশ্যই করা যায়। এই নার্ভ দিয়ে সবরকম অনুভূতি যাচ্ছে। কাজেই পায়ে আরও অনেক রকম অনুভূতি তৈরি করতে হবে যেন সবগুলো পাঠাতে গিয়ে ব্যথার অনুভূতিটা কমে যায়।”

“কীভাবে?”

“হাত বুলাতে থাক। সবচেয়ে সোজা।”

রবিন এমনিতেই হাত বুলাচ্ছিল, এবারে আরও কয়েকজন হাত বুলিয়ে দেয়। গাব্বু গম্ভীর গলায় বলল, “রবিন? ব্যথা কমেছে না?”

রবিন মাথা নাড়ল। গাব্বু রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে বলল, “দেখেছিস?”

মিলি ঠোঁট উল্টে বলল, “কচু।”

গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস করলি না? আয় কাছে আয়। দেখাই।”

মিলি জিজ্ঞেস করল, “কী দেখাবি?”

“তোর হাতটা দে।”

মিলি হাতটা এগিয়ে দেয়, গাব্বু খপ করে হাতটা ধরে সেখানে একটা চিমটি দিল, সাথে সাথে মিলি”আউ আউ” করে চিৎকার করে লাফাতে থাকে। গাব্বু এমন কিছু জোরে চিমটি দেয়নি, কিন্তু মিলি এমন ভাব করতে লাগল যে সে ব্যথায় মরে যাচ্ছে।

গাব্বু বলল, “যেখানে চিমটি দিয়েছি সেখানে হাত বুলা, দেখবি ব্যথা কমে যাবে। নার্ভ দিয়ে–”

মিলি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, “কচু। এত জোরে চিমটি দিয়েছিস, এই দেখ লাল হয়ে গেছে–”

গাব্বু দেখল, মোটেও সেরকম লাল হয়নি। মিলির গায়ের রঙ ফর্সা আর ফর্সা গায়ের রঙ হলে অল্পতেই লাল হয়। গাব্বু বলল, “লাল হওয়া মানে বুঝেছিস তো? তার মানে রক্ত জমা হচ্ছে।”

মিলি পা দাপিয়ে বলল, “কচু।” তারপর রেগেমেগে চলে গেল।

তাপস নামে একটা ছেলে পুরো ব্যাপারটা দেখেনি, সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

লিটন বলল, “গাব্বু মিলিকে চিমটি দিয়েছে।”

তাপস অবাক হয়ে বলল, “কেন? মিলিকে চিমটি দিল কেন?”

রত্না বলল, “ব্যথা দেওয়ার জন্যে।”

তাপস আরও অবাক হল, “ব্যথা দেওয়ার জন্যে? গাব্বু কেন মিলিকে ব্যথা দিচ্ছে?”

গাব্বু বলল, “আমি মোটেও মিলিকে ব্যথা দেই নাই। আমি মিলিকে দেখাচ্ছিলাম নার্ভের ভেতর দিয়ে ব্যথার অনুভূতি যাওয়ার সময় কীভাবে সেটাকে কমানো যায়।”

“কীভাবে?”

“তোর হাতটা দে।”

তাপস তার হাত বাড়িয়ে দিল, গাব্বু সেটা ধরে এক জায়গায় চিমটি দিল। তাপসও”আউ” করে ছোট একটা চিৎকার করল, কিন্তু মিলির মতো লাফঝাঁপ শুরু করে দিল না। গাব্বু তখন তাকে দেখাল কেমন করে ব্যথার ওপর হাত বুলিয়ে ব্যথা কমানো যায়।

তাপসের দেখাদেখি আরও কয়েকজন তখন গাব্বুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। সবাই যে গাব্বুর কথা বিশ্বাস করল তা না, সেটা নিয়ে গাব্বু অবশ্যি মাথা ঘামাল না। সে অনেকদিন থেকে দেখেছে, বিজ্ঞানের আবিষ্কার সবাই ব্যবহার করে কিন্তু অনেকেই বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করে না। তাদের ক্লাসেই অনেক গাধা আছে যারা ডারউইনের বিবর্তন বিশ্বাস করে না, ভাগ্যিস গাব্বুর গায়ে সেরকম জোর নেই আর সে খুব মারপিট করার মানুষ না, তা না হলে ক্লাসে এই নিয়ে খুনোখুনি হয়ে যেত।

.

আজকের দিনটি অন্যরকম। কারণ ক্লাসরুমের দরজার আড়ালে গাব্বু একটা গগাবদা মাকড়সা পেয়ে গেল, বহুদিন থেকে সে একটা বড় মাকড়সা খুঁজছে। ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার নামে এক ধরনের বিষাক্ত মাকড়সা আছে যার কামড় খেলে মানুষ মরে পর্যন্ত যায়, কিন্তু এই দেশের মাকড়সা সেরকম না। মাকড়সার আটটা পা, চোখও অনেকগুলো, বিষয়টা সে এখনো নিজে ভালো করে দেখেনি।

গোবদা মাকড়সাটা একবারও সন্দেহ করেনি যে কেউ তাকে ধরে ফেলবে, তাই সেটা পালানোর চেষ্টা করল না, গাব্বু খপ করে সেটাকে ধরে ফেলল। গাব্বুর হাতের মাঝে মাকড়সাটা কিলবিল করতে লাগল, ছুটে পালানোর চেষ্টা করল, গাব্বু ছাড়ল না। পথে-ঘাটে এরকম মহামূল্যবান জিনিস পেলে সেগুলো রাখার জন্যে তার ব্যাগে নানারকম শিশি বোতল কৌটা থাকে, কাজেই গাব্বু ক্লাসরুমে ঢুকে তার ব্যাগের কাছে গেল। ঠিক তখন তার সাথে রত্নার দেখা হল এবং গাব্বু বুঝতে পারল সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ পেয়েছে।

রত্না মাকড়সাকে অসম্ভব ভয় পায়। ছোট থেকে ছোট মাকড়সা দেখেও সে ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে, গাব্বু যে গোবদা মাকড়সাটাকে ধরেছে সেটা দেখলে রত্না নির্ঘাত হার্টফেল করবে। গাব্বু যে মাকড়সাটাকে ধরে রেখেছে রত্না তখনো সেটা দেখেনি। গাব্বু মাকড়সা ধরে রাখা হাতটা পেছনে রেখে জিজ্ঞেস করল, “রত্না, তুই পাইয়ের মান কত পর্যন্ত জানিস?”

“পাই?”

“হ্যাঁ।”

“বেশি না, তিন দশমিক এক চার পর্যন্ত।”

“তুই কি আরও বেশি জানতে চাস?”

রত্না ঠোঁট ওল্টাল, বলল, “আমি কিছু মনে রাখতে পারি না।”

“আমি তোকে দশমিকের পর নয় ঘর পর্যন্ত শিখিয়ে দেব।”

“কীভাবে?”

“তুই শিখতে চাস কি না বল?”

রত্না মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”

গাব্বু তখন মাকড়সা ধরা হাতটা রত্নার সামনে নিয়ে আসে, আর রত্না আতঙ্কে রক্তশীতল করা একটা চিৎকার দিল। রত্নাকে দেখে মনে হল সে বুঝি ভয়ের চোটে মারাই যাবে, পেছনে ছুটে যেতে গিয়ে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

গাব্বু মাকড়সাটাকে রত্নার নাকের সামনে ধরে বলল, “তিন দশমিক এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ চার।”

রত্না চিৎকার করে ওঠে। গাব্বু ঠাণ্ডা গলায় বলল, “চিৎকার করবি না, আমি কী বলি মন দিয়ে শোন, তিন দশমিক এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ চার… তিন দশমিক এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ চার…”

মানুষ যেভাবে মন্ত্র পড়ে গাব্বু সেইভাবে দশমিকের পর নয় ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান উচ্চারণ করতে লাগল। ক্লাসের সবাই কিছুক্ষণ এই বিচিত্র দৃশ্যটি দেখল, তারপর গাব্বুকে টেনে সরিয়ে নিয়ে রত্নাকে উদ্ধার করল।

গাব্বু তার ব্যাগে একটা কৌটার মাঝে আধমরা মাকড়সাটাকে রেখে কৌটার মুখ বন্ধ করল। ফারিয়া মুখ বিকৃত করে জিজ্ঞেস করল, “কী করছিস? এই মাকড়সাটাকে কৌটার মাঝে ঢুকালি কেন?”

“পালব।”

“পালবি? মাকড়সা পালবি?”

“হ্যাঁ।”

“এর মাঝে ছিঃ এর কী আছে?”

“মাকড়সাও একটা পালার জিনিস হল?”

“তুই যদি তোর শরীরে কোটি কোটি ব্যাক্টেরিয়া পালতে পারিস তা হলে আমি একটা মাকড়সা পালাতে পারব না?”

ফারিয়া রেগেমেগে বলল, “আমি কখনো আমার শরীরে ব্যাক্টেরিয়া পালি না।”

“পালিস।”

“পালি না।”

“সবাই পালে। মানুষের শরীরে যতগুলো কোষ তার থেকে অনেক বেশি আছে ব্যাক্টেরিয়া।”

“সত্যি?” ফারিয়া অবাক হয়ে বলল, “আমাদের শরীরে ব্যাক্টেরিয়া থাকে?”

“হ্যাঁ, ভালো ভালো ব্যাক্টেরিয়া আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।”

ফারিয়া বলল, “তাই বলে মাকড়সা তো থাকে না–” তারপর মাথা ঝটকা দিয়ে চলে গেল এবং ফারিয়া যখন মাথা ঝটকা দিল তখন গাব্বু দেখল ফারিয়ার মাথায় কত লম্বা চুল। হাইগ্রোমিটার বানানোর জন্যে সে যদি একগোছা এরকম লম্বা চুল পেত কী চমৎকার হত। সে ফারিয়ার পিছু পিছু গেল, “ফারিয়া। ফারিয়া।”

“কী হয়েছে?”

“তোর কী সুন্দর লম্বা চুল।”

ফারিয়া জানে তার সুন্দর লম্বা চুল, মেয়েরা সেটা সবসময় লক্ষ করে, কিন্তু কোনো ছেলে কখনো সেটা লক্ষ করেনি। ফারিয়া অবাক হল যে শেষ পর্যন্ত সেটা একটা ছেলের চোখে পড়েছে এবং কী আশ্চর্য সেই ছেলেটা হচ্ছে গাবু!

ফারিয়া একটু লাজুক ভঙ্গিতে হেসে বলল, “হ্যাঁ। আমার চুল অনেক লম্বা।”

“আমাকে একটু দিবি?”

ফারিয়া গাব্বুর কথা ঠিক বুঝতে পারল না, বলল, “কী দিব?”

“তোর চুল।”

“চুল? চুল দিব? চুল কীভাবে দেয়?”

“কেটে?”

গাব্বু তার সুন্দর লম্বা চুল লক্ষ করেছে শুনে একটু আগে তার ভেতরে যে একটু ভালো অনুভূতি হয়েছিল, এখন তার পুরোটা দূর হয়ে সেখানে একটা খাট্টাভাব তৈরি হল। ফারিয়া রেগেমেগে বলল, “তুই জানিস যে তোর মাথা খারাপ?”

“দে না। প্লীজ। একটু।”

“দূর হ।”

গাব্বু দূর হল না, সে ফারিয়ার পিছনে লেগে রইল, আর শেষ পর্যন্ত ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ফারিয়া তাকে কয়েকটা চুল দিতে রাজি হল। সাথে সাথে গাব্বু এক দৌড়ে তার ব্যাগ থেকে একটা কাঁচি নিয়ে চলে আসে।”

ফারিয়া চোখ কপালে তুলে বলল, “কাঁচি কেন?”

“চুল কাটার জন্যে।”

“কতগুলো কাটবি?”

“বেশি না, গুনে গুনে দশটা।”

চুল গুনে গুনে কাটা যায় কি না সেটা এখনো কেউ জানে না এবং আট নম্বর চুলটা কাটার সময় ফারিয়া আবার মাথায় একটা ঝটকা দিল আর তখন তার মাথার একগোছা চুল কাটা পড়ল।

ফারিয়ার মাথায় অনেক চুল, কাজেই যেখানে একগোছা চুল কাটা পড়েছে সেই জায়গাটা সহজেই ঢেকে রাখা যায় কিন্তুচুল একটু সরালেই ফাঁকা জায়গাটা চোখে পড়ে। ফারিয়ার মেজাজ যা খারাপ হল সেটা বলার মতো না, কিন্তু তখন কী করবে!

ক্লাসের ঘণ্টা পড়ার পর রত্না ভয়ে ভয়ে ক্লাসে ঢুকল। গাব্বু তার ব্যাগের ভেতর একটা জ্যান্ত মাকড়সা রেখে দিয়েছে, সেটা চিন্তা করেই তার বুক ধুকধুক করছে। গাব্বুর বেঞ্চ থেকে অনেক দূরে গিয়ে বসে সে চিৎকার করে বলল, “গাব্বু, তোকে আমি খুন করে ফেলব।”

গাব্বু একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

“তুই জানিস না কেন? তুই জানিস না আমি মাকড়সাকে ভয় পাই? আমাকে মাকড়সা দিয়ে ভয় দেখাস?”

গাব্বু আরও একটু অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো ভয় দেখানোর জন্যে মাকড়সা দেখাইনি। মানুষ ভয় পাওয়ার সময় তার সামনে যেটা হয় সেটা মনে রাখে। সেই জন্যে দশমিকের পর নয় ঘর পাইয়ের মান বলছিলাম, লক্ষ করিসনি?”

পাইয়ের মান নিয়ে রত্নার খুব একটা মাথা ব্যথা দেখা গেল না। সে হিংস্র গলায় বলল, “আমি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নালিশ করব।”

গাব্বু বলল, “কিন্তু কিন্তু–”

“আমি থানায় তোর বিরুদ্ধে মামলা করব।”

গাব্বু বলল, “কিন্তু আমি–”

“তোর আব্বু-আম্মুর কাছে নালিশ করব।”

গাব্বু বলল, “আসলে হয়েছে কী জানিস, মানুষের ব্রেনের মাঝে-”

ভয় পেলে মানুষ কেমন করে সেটা মনে রাখে বিষয়টা গাব্বু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার মাঝে ক্লাসে রওশন ম্যাডাম ঢুকে গেলেন বলে সে আর ব্যাখ্যা করতে পারল না।

ক্লাস শুরু হওয়ার পর গাত্তু হঠাৎ করে বুঝতে পারল একদিনের জন্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বেশি হয়ে গেছে, সত্যি সত্যি যদি রত্না কিংবা ফারিয়া কিংবা মিলি কিংবা আর কেউ স্যার-ম্যাডাম কিংবা প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করে দেয় তা হলে সে বিপদে পড়ে যাবে।

গাব্বু তখনো জানত না যে সে আসলে বিপদে পড়ে গিয়েছে।

.

০৮.

সকালবেলা গাব্বু ক্লাসরুমে মিলি আর লিটনকে কনভেক্স লেন্স নিয়ে জ্ঞান দান করছিল এবং বিষয়টা হাতে কলমে দেখানোর জন্যে তার বিশাল লেন্সটা জানালার ওপর রেখে তাদের খুঁজতে গিয়েছিল। বাইরে নানা ধরনের উত্তেজনার কারণে তার আর লেন্সটার কথা মনে নেই। ধীরে ধীরে বেলা হয়েছে এবং সূর্যটা উপরে উঠেছে এবং মনে হয় ঠিক গাব্বুকে বিপদে ফেলার জন্যেই বিশাল কনভেক্স লেন্সের ঠিক ফোকাল পয়েন্টে জানালার পর্দাটা বসানো হয়েছে।

রওশন ম্যাডামের ক্লাস যখন মাঝামাঝি পৌঁছেছে ঠিক তখন সূর্যের আলো কনভেক্স লেন্সের কারণে কেন্দ্রীভূত হয়ে জানালার পর্দায় আগুন লাগিয়ে দিল। সস্তা সিনথেটিক কাপড়, কিছু বোঝার আগে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতে করতে বের হয়ে আসে, গাব্বু সাথে সাথে বুঝে গেল কী হয়েছে, তাই লেন্সটা না নিয়ে সে বের হতে চাইছিল না, কিন্তু তাকেও ঠেলে বের করা হল। মাঠে সব ছেলেমেয়েরা গাল্লুকে ঘিরে দাঁড়াল, চিৎকার করে বলল, “গাব্বু! তুই এখন কী করেছিস? কী করেছিস বল।”

এরকম একটা আগুন যে গাব্বু ছাড়া আর কেউ লাগাতে পারে না সেটা নিয়ে কারও মনে এতটুকু সন্দেহ ছিল না। গাব্বু আমতা আমতা করতে করতে বলল, “আমার কনভেক্স লেন্সটা জানালার ওপর রেখেছিলাম। মনে হয়, মনে হয়”

সূর্যের আলোকে কেন্দ্রীভূত করে আগুন ধরিয়ে ফেলার মতো তাপ সৃষ্টি করে ফেলা যায় বিজ্ঞানের এত সুন্দর বিষয়টা কারও চোখে পড়ল না। মাঠে সব ছেলেমেয়েরা যখন চেঁচামেচি করছে ঠিক তখন দেখা গেল গাব্বুদের ক্লাসরুমের আগুন নিভিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার বের হয়ে আসছেন, ডান হাতে যে জিনিসটা ধরে রেখেছেন গাব্বু দূর থেকেই সেটাকে চিনতে পারল, তার বড় কনভেক্স লেন্সটা, যেটা সে জানালার উপর রেখে এসেছিল।

খাটো প্রিন্সিপাল লম্বা লম্বা পা ফেলে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন, লেন্সটা উপরে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কার?”

এমনভাবে জিজ্ঞেস করলেন যে শুনে মনে হল হাতে যেটা ধরে রেখেছেন সেটা একটা গ্রেনেড কিংবা মেশিনগান কিংবা আধা কেজি পটাশিয়াম সায়নাইড।

গাব্বু বলল, “আমার।” নিজের জিনিসটা নেওয়ার জন্যে সে হাত বাড়াল, প্রিন্সিপাল স্যার লেন্সটা ফেরত না দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন, “ও! আমাদের রেগুলার ক্রিমিনাল! তোমার?”

“জি স্যার।”

“ঘরে আগুন লাগানোর জন্যে জানালায় ফিট করেছ?”

“না স্যার। মিলি আর লিটন কনভেক্স লেন্স নিয়ে কথা বলছিল-”

“খবরদার।” প্রিন্সিপাল স্যার খেঁকিয়ে উঠলেন, “নিজের বদমাইশির সাথে অন্যদের জড়াবে না। আর কী কী করেছ তুমি?”

“কিছু করি নাই স্যার।”

“নিশ্চয়ই করেছ। বল কী করেছ?”

“কিছু করি নাই।”

প্রিন্সিপাল স্যার এবারে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকালেন, বললেন, “কী করেছে তোমরা বল।”

কেউ কোনো কথা বলল না। প্রিন্সিপাল স্যার এবার ধমক দিয়ে বললেন, “কী করেছে বল?”

লিটন একটু ইতস্তত করে বলল, “গাব্বু তো একটু পাগল কিসিমের, তাই সবসময়েই কিছু না কিছু করছে।”

“কী করেছে?”

“এই তো–”

“এই তো মানে?”

মিলি বলল, “যেমন চিমটি কাটা–”

প্রিন্সিপাল স্যার চিৎকার করে বললেন, “চিমটি কেটেছে? এই মিচকি শয়তান চিমটি কাটে? কত বড় সাহস? আর কী করে?”

গাব্বু আবিষ্কার করল প্রিন্সিপাল স্যার ধমকাধমকি করে কিছুক্ষণের মাঝে ফারিয়ার চুল কাটা থেকে শুরু করে রত্নাকে মাকড়সা দিয়ে ভয় দেখানো পর্যন্ত সবগুলো ঘটনা বের করে ফেললেন। তার মুখে এবারে কেমন যেন একটা আনন্দের ছাপ পড়ল, তার মুখের দুই পাশের ধারালো কেনাইন দাঁত দুটো বের করে হিংস্র মুখে বললেন, “মিচকে শয়তান! তোমার দিন শেষ! ফিনিস।”

গাব্বু বলল, “আ-আমার?”

“হ্যাঁ। তোমার কত বড় সাহস, তুমি আমাকে হাইকোর্ট দেখাও? এখন আমি তোমাকে হাইকোর্ট দেখাব।”

গাব্বু বলল, “হাইকোর্ট? আমাকে?”

প্রিন্সিপাল স্যার মাথা ঝাঁকালেন, কিন্তু যেহেতু তার গলা নেই, শরীরের ওপর মাথাটা সরাসরি বসানো, তাই মাথাটা খুব বেশি নড়ল না। সেই অবস্থায় হিস হিস শব্দ করে বললেন, “আমি তোমার বাবা-মা’কে ডেকে পাঠাচ্ছি, তারপর তাদের হাতে তোমাকে তুলে দিব। তারা তোমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন।”

গাব্বু বলল, “যা ইচ্ছা?”

“হ্যাঁ। যা ইচ্ছা।”

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল