আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু

ভূমিকা

কিশোর আলোতে প্রথমে “টুনটুনি ও ছোটাচ্চু” নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম। বছর শেষে সেগুলো দিয়ে একটি বই লেখা হলো। আমি ভাবলাম, আমার কাজ শেষ-আর লিখতে হবে না কিন্তু আমার বাচ্চাকাচ্চা পাঠকেরা টুনটুনি এবং ছোটাচ্চুর গল্পের জন্যে এমন চাপ দিতে থাকলো যে, আমি আবার কিছু গল্প লিখলাম। বছর শেষে আবার একটা বই বের হলো, সেই বইয়ের নাম দিলাম “আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু” তখন ভাবলাম, এবারে সত্যি সত্যি লেখা শেষ–আর লিখতে হবে না! বাচ্চারা কিন্তু চাপ থামাল না, চাপ দিতেই থাকল, তখন বাধ্য হয়ে আবার লিখতে থাকলাম–সবাই যেন পড়তে পারে সে জন্যে এগুলো লিখেছি আমার ওয়েব সাইট www.mzi.rocks এ! বছর শেষে আবার বইটা বের হলো, এবারে নাম দিয়েছি “আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু” আশা করছি এবারে সত্যি সত্যি টুনটুনি ও ছোটাচ্চুকে নিয়ে লেখা শেষ!

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৩.০১.২০১৭

.

একজন দুর্ধর্ষ পেপার চোর

বড় চাচা এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আজকের পেপারটা কই?”

বড় চাচার প্রশ্নের কেউ উত্তর দিল না, কেউ উত্তর দিবে বড় চাচা সেটা অবশ্যি আশাও করেননি। বড় চাচা নরম টাইপের মানুষ, হাসি-খুশি থাকেন, গলা উঁচিয়ে কথা বলেন না, চিৎকার করেন না, তাই কেউ তার কথার উত্তর দেয় না! বড় চাচা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “দেখেছিস কেউ?”

বাচ্চারা মেঝেতে উবু হয়ে কী একটা খেলা খেলছিল, দেখে খুবই নিরীহ খেলা মনে হলেও হঠাৎ হঠাৎ সবাই মিলে মারামারি শুরু করে, দেখে মনে হয় পারলে বুঝি একজন আরেকজনের চোখ তুলে নেবে। তারপর আবার শান্ত হয়ে আঙুল দিয়ে কিছু একটা গুনতে থাকে। তারপর আবার মারামারি শুরু করে। ভয়ঙ্কর একটা মারামারি শেষ করে একজন বড় চাচার প্রশ্নের। উত্তর দিল, বলল, “না বড় মামা।”

বড় চাচাকে সবাই বড় চাচা বলে না, অনেকে বড় মামা বলে। কেউ কেউ বড় ফুপা ডাকে। তার মানে এই নয় যে সবাই সম্পর্ক ঠিক করে ডাকাডাকি করে–এই বাসায় যার যাকে যা ইচ্ছা সেটা ডাকে। বড় চাচার ছোট মেয়েটা তাকে মাঝে মাঝে বড় আব্বু ডেকে ফেলে।

বড় চাচা বললেন, “এই শান্ত, তোকে বলেছি না সকালবেলা পেপারটা তুলে এনে ভিতরে রাখবি?”

শান্ত সতর্ক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে কিছু একটা হিসাব করতে করতে বলল, “বলেছ।”

“তাহলে?”

“তাহলে কী?”

“তাহলে তুলে আনিস না কেন?”

“পেপার না দিলে আমি কোত্থেকে তুলে আনব? কালকেও পেপার দেয় নাই, আজকেও দেয় নাই।”

বড় চাচা একটু অবাক হয়ে বললেন, “কী বলছিস? পেপারওয়ালা পেপার দিচ্ছে না?”

কোনো একজন উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু বাচ্চারা আবার হুটোপুটি করে মারামারি শুরু করে দিল। অন্য কারো বাসা হলে এই মারামারি বন্ধ করার চেষ্টা করত, কিন্তু এই বাসায় কেউ চেষ্টা করে না, মারামারি শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করে। মারামারি শেষ হলো, তখন। একজন বলল, “না বড় মামা, পেপারওয়ালা পেপার দিচ্ছে না।”

বড় চাচা বললেন, “কী আশ্চর্য! পেপার দিবে না কেন?”

শান্ত বলল, “বড় চাচা, তুমি এ রকম পুরানা মডেলের মানুষ কেন?”

বড় চাচা ভুরু কুঁচকে বললেন, “পুরানা মডেল? আমি?”

“হ্যাঁ। তুমি। পুরানা মডেল।”

বাচ্চারা সবাই খেলা বন্ধ করে বড় চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ বড় চাচা (কিংবা বড় মামা কিংবা বড় ফুপা কিংবা বড় আব্বু) তুমি খুবই পুরানা মডেল।”

“হ্যাঁ। তুমি। পুরানা মডেল।”

“কেন আমি পুরানা মডেল?”

সবাই কিছু-না-কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শান্ত তার অভ্যাসমতো দাবড়ানি দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, “কারণ তুমি এখনও কাগজের পত্রিকা পড়ো। পৃথিবীতে কেউ কাগজের পত্রিকা পড়ে না। সবাই ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়ে।”

বড় চাচা মাথা চুলকালেন। সবাই তখন কথা বলতে শুরু করল। একজন বলল, “পত্রিকা পড়তে হবে কেন? টেলিভিশনের সামনে বসে থাকলেই সব খবর পেয়ে যাবে। বিজ্ঞাপন দেখবে, নিচে স্ক্রল করা খবর।”

আরেকজন বলল, “আসলে পড়তেও হয় না। বসে থাকলেই হয়। তুমি সব খবর শুনতে পাবে। দেখতেও পাবে।”

আরেকজন বলল, “ফেসবুক আরো ভালো। তোমার কাছে খবর আসতে থাকবে আর তুমি লাইক দিতে থাকবে।”

আরেকজন বলল, “যে খবর পত্রিকায় ছাপাতে সাহস পায় না সেই খবরও ফেসবুকে পাওয়া যায়। মনে নাই সেই দিন আমরা দেখলাম, কী ভয়ঙ্কর”

অন্যেরা তখন তাকে থামিয়ে দিল, তারা সবাই মিলে যে ভয়ঙ্কর ভিডিওটা দেখছে সেটা বড়দের জানার কথা নয়। একজন বলল, “বড় চাচা কিছু একটা পড়ে তোমার যদি পছন্দ না হয় ফেসবুকে তুমি যা ইচ্ছা বলে গালি দিতে পারবে।”

আরেকজন বলল, “মনে নাই সেই দিন শান্ত ভাইয়া কীভাবে একজনকে গালি দিল?”

শান্ত তার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, “চোপ।”

বড় চাচা তাদের সব কথা শুনলেন কি না বোঝা গেল না। কেমন যেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কিন্তু আমি খবরের কাগজ পড়তে চাই। নতুন একটা কাগজের ভাজ খুলে সেটার দিকে তাকাতে আমার কাছে ভালো লাগে। নতুন খবরের কাগজের একটা অন্য রকম গন্ধ আছে।”

বাচ্চারা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, শান্ত নাক কুঁচকে বলল, “গন্ধ?”

বড় চাচার ছোট মেয়ে শিউলি ফিসফিস করে বলল, “আব্বুর মনে হয় ব্লাড প্রেশার হয়েছে।”

অন্যেরা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, ব্লাড প্রেশার। নিশ্চয়ই ব্লাড প্রেশার।”

শান্ত বলল, “এই জন্যে বড় চাচার মাথা আউলে গেছে।”

বড় চাচার মাথা আউলে যাওয়া নিয়ে কাউকে অবশ্যি খুব ব্যস্ত হতে দেখা গেল না। তারা আবার খেলায় ফিরে গেল। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ গোনাগুনি তারপর হঠাৎ হুটোপুটি, চিৎকার, মারামারি।

কিছুক্ষণ পর টুনিকে বড় চাচার কাছে দেখা গেল। বড় চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হলো, তোদের মারামারি শেষ? সবাই ঠিক আছে তো?”

“এটা মারামারি না বড় চাচা। এটা একটা বোতাম নিয়ে খেলা। যে বোতামটা পায় সে সেটা ধরে রাখতে চায়, অন্যেরা সেটা কেড়ে নেয়। সেইটাই খেলা।”

বড় চাচা বললেন, “ও।” তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এখন বোতামটা কার কাছে আছে?”

“লিটুর কাছে ছিল, লুকিয়ে রাখার জন্যে গাধাটা মুখের ভিতরে রেখেছে। যখন কাড়াকাড়ি শুরু হলো তখন কোঁৎ করে গিলে ফেলেছে।”

বড় চাচা আঁতকে উঠে বললেন, “গিলে ফেলেছে? সর্বনাশ! এখন?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “এখন কিছু না। গাধাটা এর আগে আরেকবার যখন একটা এক টাকার কয়েন গিলে ফেলেছিল, তখন ডাক্তারের কাছে নিয়েছিল, ডাক্তার বলেছে চিন্তার কিছু নাই। বাথরুমের সাথে বের হয়ে আসবে।”

“বের হয়েছিল?”

“শান্ত ভাই বলেছে বের হয়েছে।”

“শান্ত কেমন করে জানে?”

টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “টাকা-পয়সার ব্যাপার শান্ত ভাইয়া সবচেয়ে ভালো জানে।”

বড় চাচা কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, টুনি বলল, “এই বোতামটা অনেক ছোট। লিটু গাধাটা হজম করে ফেলবে।”

“ডাক্তারের কাছে নিতে হলে বলিস।”

“বলব বড় চাচা।”

কথা শেষ করেও টুনি চলে গেল না, তখন বড় চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “আর কিছু বলবি?”

টুনি মাথা নাড়ল, তখন বড় চাচা বলল, “বলে ফেল।”

“তুমি পেপারওয়ালাকে ফোন করে একটু খোঁজ নিবে সে আসলেই বাসায় পত্রিকা দিচ্ছে কি না।”

বড় চাচার কাছে টেলিফোন নম্বর ছিল, ফোন করে জানা গেল পেপারওয়ালা নিয়ম করে প্রত্যেক দিন খুব ভোরে পেপার দিয়ে যাচ্ছে। টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “বড় চাচা, শান্ত ভাইয়াকে কোনো দায়িত্ব দিয়ে লাভ নাই। শান্ত ভাইয়ার মতো ফাঁকিবাজ মানুষ একজনও নাই। কাল থেকে আমি তোমার পেপার তুলে আনব।”

বড় চাচা বললেন, “তুই?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

বড় চাচা পুরান মডেলের মানুষ, টেলিভিশন না দেখে কিংবা কম্পিউটারে ডাউনলোড না করে সত্যিকারের পেপার পড়েন বলে টুনি মনে মনে বড় চাচাকে পছন্দ করে। ঠিক কী কারণ জানা নেই। নতুন পেপার খুলে তার ভেতর অন্য রকম একটা গন্ধ পাওয়াটাও তার কাছে মজার মনে হয়। কিন্তু এগুলো তো আর বলা যায় না, তাই সে এসব কিছুই বলল না, এমনভাবে মাথা নাড়ল যার মানে যা কিছু হতে পারে। এইভাবে কোনো কিছু না বলে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাঝে টুনি এক্সপার্ট।

পরদিন ভোরে বাসার সামনে সিঁড়ি থেকে পেপারটা আনতে গিয়ে টুনি আবিষ্কার করল সেখানে কিছু নেই। হয় পেপারওয়ালা পেপার দেয় নাই, তা না-হলে সে দেওয়ার পর কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। পেপারওয়ালাকে ফোন করার পর সে কসম কেটে বলল যে সে পেপারটা দিয়ে গেছে।

কাজেই পরের দিন টুনি ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেল। এলার্ম শুনে ঘুম থেকে উঠে জানালার কাছে বসে রইল। সে ঠিকই দেখল পেপারওয়ালা তার সাইকেলের পিছনে বোঝাই করে পেপার নিয়ে তাদের বাসার সামনে থেমেছে। সাইকেলটা থামিয়ে একটা পেপার নিয়ে তাদের সিঁড়িতে রেখে আবার সাইকেলে উঠে চলে গেল। টুনি তখন ঘুম ঘুম চোখে নিচে গিয়ে দরজা খুলে পেপারটা নিতে গিয়ে দেখে সেখানে কিছু নেই! পেপারটা এর মাঝে কেউ একজন নিয়ে গেছে। মুহূর্তে টুনির ঘুম ছুটে গেল–সে ডানে বামে তাকাল, কোথাও কোনো মানুষ নেই। কী আশ্চর্য! কে নিয়েছে পেপারটা?

রাত্রিবেলা বসার ঘরে দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশনে একটা সিরিয়াল দেখছেন, সেখানে খুব সুন্দরী দুইজন মহিলা নানা রকম শাড়ি-গয়না পরে চিৎকার করে ঝগড়া করতে করতে একজন আরেকজনের চুল ধরে টানাটানি করছে। ঝুমুখালা দাদির (কিংবা নানির) পায়ে রসুন ভাজা এক ধরনের তেল মাখিয়ে দিতে দিতে টেলিভিশনের দৃশ্যটা দেখে আনন্দে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। বড় চাচা খুবই বিরস মুখে একটা পুরানো ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন। বাচ্চারা চামচ টানাটানি করে কী একটা খেলা খেলছে তখন টুনি বসার ঘরে হাজির হলো। সে বড় চাচার কাছে গিয়ে বলল, “বড় চাচা, কোনো একজন চোর প্রত্যেক দিন সকালে তোমার পেপার চুরি করে নিয়ে যায়।”

টুনি সবাইকে শুনিয়ে কথাটা বলতে চায়নি কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি সবাই কথাটা শুনে ফেলল এবং সবাই ঘুরে টুনির দিকে তাকাল। শান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “কী বললি? আমাদের বাসা থেকে চোর পেপার চুরি করে নিয়ে যায়? এত বড় সাহস? আমি যদি চোর ব্যাটাকে খুন না করে ফেলি।”

ঝুমু খালা বলল, “কাল সকালেই আমি ঝাড় দিয়া পিটায়া খাটাশের বাচ্চা খাটাশকে সিধা করে ফেলব।”

যে সবচেয়ে ছোট সে বলল, “ধরে সোজা ক্রসফায়ার।”

আরেকজন বলল, “ধরে গণপিটুনি। সোজা গণপিটুনি।”

শুধু দাদি বললেন, “আহা বেচারা গরিব মানুষ। একটা পেপার চুরি করে আর কত পয়সাই বা পায়! নিতে চায় নিয়ে যাক!”

শান্ত চিৎকার করে বলল, “দাদি তুমি কী বললে? চোর চুরি করতে চাইলে চুরি করবে? বাসার দরজা খোলা রেখে সাইনবোর্ড লাগাব, চোর ভাইয়েরা, আসেন! চুরি করেন!”

শান্তর কথা শুনে বেশ কয়েকজন খুব আনন্দ পেল; তারা হা হা হি হি করে হাসতে লাগল। শান্ত রেগেমেগে বলল, “তোরা কি ভাবছিস আমি ঠাট্টা করছি?”

দাদি বললেন, “তোদের হয়েছেটা কী? একটা পেপার নিয়ে এত হইচই? এমন তো না যে কোহিনুর হীরা চুরি গেছে।”

ছোটদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী শাহানা বলল, “কোহিনুর হীরা চুরি গেলে কিছু করার থাকে না দাদি। ব্রিটিশেরা কোহিনুর হীরা চুরি করে নিয়ে গেছে না?”

প্রায় সবাই চোখ বড় বড় করে বলল, “তাই নাকি? কখন? কীভাবে? কোথায়? পুলিশ ধরে নাই?”

শাহানা বিরক্ত হয়ে বলল, “বহু দিন আগে। ব্রিটিশ আমলে, নিয়ে তাদের মিউজিয়ামে রেখে দিয়েছে।”

“তাই বল।”

একসাথে সবাই কোহিনুর হীরা চুরি নিয়ে কৌতূহল হারিয়ে ফেলল। সবাই আবার পেপার চুরিতে ফিরে এলো। শান্ত মুখ সুচালো করে বলল, “কীভাবে চোরটাকে ধরা যায় বল দেখি।”

দাদি বলল, “চোর ধরতে হবে না। একটা চিঠি লিখে টানিয়ে রেখে দে।”

“চিঠি?”

“হ্যাঁ।”

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “চিঠিতে কী লিখব?”

“মানুষটাকে অনুরোধ করবি, পেপার চুরি না করার জন্যে। লিখবি Iাকার দরকার থাকলে বলতে, দশ-বিশ টাকা দিয়ে দেব।” কথা শেষ করে দাদি ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাই না ঝুমু?”

দাদি যেটাই বলে ঝুমু খালা সেইটা সব সময় মেনে নেয়। একটু আগে ঝুমু খালা চোরকে ঝাড়পেটা করতে চেয়েছিল এখন দাদির সাথে সুর মিলিয়ে বলল, “আহা! গরিব মানুষ। টাকার কষ্ট অনেক বড় কষ্ট। ভালো করে মায়া করে একটা চিঠি লিখলেই আর চুরি করবে না।”

বসার ঘরে যারা ছিল তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগ বলল, চিঠি লিখলে সেই চিঠি পড়ে চোর আর পেপার চুরি করবে না। অন্য ভাগ বলল, চিঠি লিখে কিছুতেই চোরকে পেপার চুরি বন্ধ করানো যাবে না। চোর চোরই থেকে যাবে।

এই বাসায় সবাই অবশ্যি সবসময় দাদির (কিংবা নানির) সব কথা শুনে, তাই এইবারও দাদির কথা শোনা হলো। একটা কাগজ এনে সেখানে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা হলো :

প্রিয় পেপার চোর মহোদয়।

আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা গ্রহণ করিবেন। আমরা অত্যন্ত দুঃখ এবং বেদনার সহিত লক্ষ করিতেছি যে, গত কিছুদিন যাবৎ আপনি নিয়মিতভাবে আমাদের পেপার চুরি করিতেছেন। অনুগ্রহ করিয়া পেপার চুরি বন্ধ করিবেন, কারণ আমাদের অনেকেই শুধু যে পেপার পড়িতে না পারিয়া দেশ, সমাজ এবং জাতি সম্পর্কে তথ্য হইতে বঞ্চিত হইতেছে তাহা নহে, পেপার না পড়িতে পারিয়া মানসিকভাবে ভাঙিয়াও পড়িতেছে।

উল্লেখ্য যে, যদি আপনি কোনো প্রকার অর্থকষ্টের কারণে এই কার্য করিতে বাধ্য হইয়া থাকেন তাহা হইলে আপনি আমাদের সহিত যোগাযোগ করুন। আমরা আপনাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত।

বিনীত

এই বাসার সকল সদস্যবৃন্দ।

শান্ত এই চিঠিটা নিচে দরজার উপর লাগিয়ে দিতে নিয়ে গেল। চিঠিটা লাগানোর আগে সে নিচে আরো একটা লাইন যোগ করল। লাইনটি এ রকম :

বিশেষ দ্রষ্টব্য : বান্দরের বাচ্চা বান্দর, তোরে যদি ধরতে পারি পিটিয়ে তোর ঠ্যাঙ ভেঙে দিব। খোদার

কসম! পেপার চুরি বন্ধ করার এই পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে অবশ্যি ছোটাচ্চু সেদিন কিছুই জানতে পারল না। ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কাজের চাপ অনেক বেশি, মাঝে মাঝেই তার বাসায় আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। আজকেও তাই হয়েছে।

ছোটাচ্চু ঘটনাটা জানতে পারল পরের দিন, যখন চিঠিটা টানিয়ে দেবার পরও পেপার চোর পরের দিনের পত্রিকাটাও চুরি করে নিয়ে গেল!

বসার ঘরে তখন দাদি (কিংবা নানি) ঝুমু খালাকে নিয়ে সিরিয়াল দেখছেন। সেখানে সাজুগুজু করে থাকা একজন পুরুষ মানুষ সাজুগুজু করে থাকা আরেকজন মহিলাকে নাকি গলায় কিছু একটা বলছে, যেটা শুনে ঝুমু খালার চোখ ছলছল করছে। বড় চাচা (কিংবা বড় মামা) অন্যমনস্কভাবে একটা বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন। চাচি, খালা, মামা এবং অন্যেরা চা খাচ্ছেন কিংবা নিজেদের মাঝে রাজনীতি নিয়ে তর্ক করছেন। বাচ্চারা তাদের লেখাপড়া, হোমওয়ার্ক শেষ করে (কিংবা শেষ না করেই) বসার ঘরের মেঝেতে শুয়ে-বসে একজন আরেকজনকে জ্বালাতন করছে।

এই সময় ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে একটা বড় কেক আর সেটা দেখে বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখে বলল, “আজুকে ড্রাগ বাস্টিং কেসের বিল পেয়েছি, তাই ভাবলাম সবাই মিলে খাওয়ার জন্যে একটা কেক নিয়ে আসি।”

শান্ত বলল, “শুধু কেক?”

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “আর কী চাস?”

শান্ত বলল, “আমাদেরকে চায়নিজ খেতে নিয়ে যাও।”

আরেকজন বলল, “ধুর, চায়নিজ খেয়ে মজা নাই। পিঞ্জা খেতে নিয়ে যাও।”

আরেকজন বলল, “দুইটাই খাওয়া যায়।”

আরেকজন বলল, “তারপর আইসক্রিম–”

খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলতে থাকত কিন্তু তখন টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি জানো আমাদের বাসা থেকে প্রত্যেক দিন পেপার চুরি হয়ে যাচ্ছে?”

ছোটাচ্চু হাসতে হাসতে বলল, “তাই নাকি?” তারপর তার অফিসে কী হয়েছে সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকল। মনে হলো পেপার চুরির ঘটনাটা বুঝি কোনো ঘটনাই না!

টুনি ঠান্ডা গলায় বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি?”

ছোটাচ্চু বলল, “শুনেছি। বাসা থেকে পেপার চুরি হয়ে যাচ্ছে।”

 “তাহলে?”

“তাহলে কী?”

টুনি বলল, “তাহলে সেটা নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা হচ্ছে না?”

ছোটাচ্চু হা হা করে হাসল, বলল, “গত মাসে আমি হীরার নেকলেস চুরির একটা কেস ভ করেছিলাম মনে আছে?”

টুনি মাথা নাড়ল, মনে না রেখে উপায় নাই, ছোটাচ্চু সেটাতে হাজার রকম রং-চং লাগিয়ে গল্প করেছে। ছোটাচ্চু বলল, “আমি হীরার নেকলেস চুরির কেস সল্ভ করি, পেপার চুরি শুনে লাফানো কি আমাকে মানাবে বল?”

টুনি কোনো কথা বলল না। ছোট একজন বলল, “আসলে ছোটাচ্চু পেপার চোর ধরতে পারবে না। তাই না?”

“কী বললি?”

“দাদি ভেবেছিল চোরের কাছে চিঠি লিখলে চোর আর চুরি করবে না। তাই না দাদি?”

ছোটাচ্চু প্রথমে চোখ কপালে তুলল তারপর পেটে হাত দিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, তুমি তাই ভেবেছ? চোরকে চিঠি লিখলে চোর সেই চিঠি পড়ে ভালো হয়ে যাবে!” তারপর আবার হা হা করে হাসতে লাগল।

দাদি বললেন, “আমার মনে হয় চিঠির ভাষাটা একটু কঠিন হয়ে গেছে, আরেকটু সহজ ভাষায় লেখা উচিত ছিল।”

শান্ত যে চিঠির শেষে খুব সহজ ভাষায় আরেকটা লাইন লিখে দিয়েছিল, তারপরও যে কোনো কাজ হয় নাই সেটা সে আর কাউকে বলল না।

হাসতে হাসতে ছোটাচ্চুর চোখে পানি এসে গেল, তখন টুনি বলল, “তুমি এ রকম বোকার মতো হাসছ কেন ছোটাচ্চু? দাদি তো তবু চুরি থামানোর চেষ্টা করেছে। তুমি তো কিছুই করছ না!”

ছোট একজন বলল, “আসলে ছোটাচ্চু পেপার চোর ধরতে পারবে না। তাই না ছোটাচ্চু?”

ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি আল্টিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সি.ই.ও. দেশের প্রথম রেজিস্টার্ড প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি, আমি ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনালদের ধরি, আর তুই ভাবছিস আমি একটা ছিচকে পেপার চোরকে ধরতে পারব না?”

“তাহলে ধরো।”

“ঠিক আছে। আগামীকাল এই সময়ে এই জায়গায় পেপার চোরকে হাজির করা হবে।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “চোরকে কীভাবে ধরবে ছোটাচ্চু?”

“খুবই সোজা। বাসার দরজায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দেব। সবকিছু রেকর্ড হয়ে যাবে। ইনফ্রারেড ক্যামেরা, রাতের অন্ধকারেও কেউ যদি কিছু করে তারও ভিডিও উঠে যাবে। দেখি তোর পেপার চোর কেমন করে পেপার চুরি করে।”

ছোটাচ্চু তখন খুবই গম্ভীরভাবে পকেট থেকে তার দামি ফোনটা বের করে কোথায় জানি ফোন করে দিল, কাকে জানি বলল আজ রাতের মাঝে বাসার সামনে একটা ক্যামেরা লাগিয়ে দিতে। ছোটাচ্চু এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, টেলিফোন করে এ রকম কাজ করে ফেলতে পারে।

.

সত্যি সত্যি রাতের বেলা একজন এসে কী যেন একটা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। টুনি ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “আমরা এখন বাসার ভিতরে বসে ক্যামেরায় কী হচ্ছে দেখতে পারব?”

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “নাহ। এটা আসল সি.সি. ক্যামেরা না। একটা সাধারণ ভিডিও ক্যামেরা, ক্যামেরাটা খুলে টেলিভিশন না-হলে ল্যাপটপে দেখতে হবে। এখন সবাই দোয়া কর যেন কালকে পেপার চোর পেপার চুরি করে নিয়ে যায়। আমরা চোরের চেহারাটা দেখতে চাই!”

কাউকে আলাদা করে দোয়া করতে হলো না। সকালবেলা পেপারওয়ালা পেপার দিয়ে গেল, কিছুক্ষণের মাঝে পেপার উধাও হয়ে গেল। ক্যামেরাটা দরজার উপরে লাগানো আছে, সেখানে চোরের পুরো ভিডিও রেকর্ড করা আছে এখন শুধু দেখতে হবে কে সেই চোর!

বাসায় সবার মাঝে উত্তেজনা, কখন ছোটাচ্চু আসবে এবং কখন ভিডিওটা দেখা হবে। দিন আর কাটতে চায় না, শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা হলো, সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হলো। হোমওয়ার্ক শেষ হলো (কিংবা শেষ হলো না, কারণ শেষ করার চেষ্টাই করা হলো না)। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো, তারপর বসার ঘরে দাদিকে ঘিরে সবাই বসে ঘড়ি দেখতে লাগল। কয়েক মিনিট পর পর ছোটাচ্চুকে ফোন করা হতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত ছোটাচ্চু এসে হাজির হলো। ছোটাচ্চু বাসায় ঢোকার সময় দরজার ওপর থেকে ভিডিও ক্যামেরাটা খুলে এনেছে; এখন শুধু টেলিভিশন কিংবা ল্যাপটপে পুরো ভিডিওটা দেখা।

ছোটাচ্চু একটা তার বের করে টেলিভিশনের পিছনে লাগিয়ে সেটা তার ভিডিও ক্যামেরার সাথে লাগিয়ে নিল, তারপর কোথায় কী সুইচ টিপে দিতেই টেলিভিশনে ভিডিওটা দেখা যেতে শুরু হলো।

দরজার সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির সামনে হাঁটার পথ, তার সামনে রাস্তা। সকালবেলার দৃশ্য, রাস্তায় খুব বেশি মানুষ নেই, মাঝে মাঝে একজন-দুইজন হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ করে একটা রিকশা না-হয় সি.এন.জি.। সবাই ধৈর্য ধরে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছে এবং তখন শেষ পর্যন্ত পেপারওয়ালাকে দেখা গেল। সে বাসার সামনে তার সাইকেলটা থামাল, স্ট্যান্ডটা বের করে সাইকেলটা দাঁড় করাল তারপর পিছন থেকে একটা পত্রিকা বের করে বাসার সামনে সিঁড়িতে রাখল। তারপর সাইকেলের কাছে গিয়ে সেটা ঠেলে একটু সামনে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।

সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে পেপারটার দিকে তাকিয়ে থাকে, এক্ষুনি পেপার চোর আসবে, ঝট করে পেপারটা তুলে বের হয়ে যাবে। বসার ঘরে কোনো শব্দ নেই। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।

ঠিক তখন বাসার সামনে একটা কুকুর এসে দাঁড়াল। কুকুরটা ডানে বামে তাকাল, তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে খবরের কাগজটা মুখে কামড়ে ধরে খুবই শান্তভাবে হেঁটে নেমে গেল। কুকুরটার মাঝে কোনো তাড়াহুড়া নেই, কোনো উত্তেজনা নেই, দেখে মনে হতে থাকে বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক।

বাচ্চারা সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল, শান্তর গলা শোনা গেল সবচেয়ে উপরে, বলল, “ইয়া মাবুদ! এইটা তো দেখি একটা কুত্তা!”

কুকুরটা যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা গেল সবাই সেটার দিকে তাকিয়ে রইল, কুকুরটা হেলে-দুলে যেতে যেতে একসময় টেলিভিশনের স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল!

ছোটাচ্চু ভিডিওটা বন্ধ করে কেমন যেন বোকার মতো সবার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “একটা কুকুর!”

দাদি খুশি খুশি গলায় বললেন, “এই জন্যেই তো চিঠি পড়তে পারে নাই।”

বড় চাচা বললেন, “একটা কুকুর এতদিন থেকে আমার পেপার নিয়ে যাচ্ছে?”

বাচ্চাদের একজন বলল, “নিয়ে কী করে? পড়ে?”

আরেকজন তার মাথায় চাটি দিলে বলল, “ধুর গাধা! কুকুর পেপার পড়বে কেমন করে?”

“তাহলে কেন নিয়ে যায়?”

ঝুমু খালা তখন তার ব্যাখ্যা দিল, বলল, “একেক কুত্তার একেক রকম খেয়াল। খোঁজ নিয়া দেখো এই কুত্তার নিজের জায়গা আছে, সেইখানে সব পত্রিকা জমা করে রাখে।”

শান্ত জানতে চাইল, “কেন জমা করে?”

“মনে হয় বিছানার মতো করে তার উপরে ঘুমায়। মনে হয় কুত্তাটা জলা জায়গায় থাকে। সেইখানে পেপার দিয়ে জায়গাটা শুকনা রাখে।”

ঝুমু খালা অবশ্যি এখানে থেমে গেল না, কুকুরের সাইকোলজি নিয়ে আরো অনেকক্ষণ অনেক রকম কথা বলল।

টুনি ছোটাচ্চুকে বলল, “ছোটাচ্চু, ভিডিওটা আরেকবার দেখতে পারি?”

ছোটাচ্চু তখন ভিডিওটা আরো একবার চালু করল, সবাই মিলে তখন আরো একবার ভিডিওটা দেখল, প্রথমবারে যেটা দেখেছিল তার থেকে ভিন্ন কিছু কারো চোখে পড়ল না, শুধু টুনি সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। দেখা শেষ হবার পর টুনি আবার ভিডিওটা দেখল, তারপর আবার, তারপর আবার! অন্যেরা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল, শান্ত বলল, “তুই বন্ধ করবি? এই কুত্তাটাকে দেখতে দেখতে মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে।”

টুনি তখন ভিডিওটা দেখা বন্ধ করল।

বড় চাচা বললেন, “তাহলে আমার পেপার দেখার কোনো উপায় নাই? একটা নেড়ি কুকুর আমার পেপার পড়া বন্ধ করে দেবে?”

ছোটাচ্চু বলল, “যদি ক্রিমিনালটা মানুষ হতো আমি তোমার প্রবলেম সল্‌ভ করে দিতাম। ক্রিমিনাল যখন কুকুর তখন কীভাবে সেটাকে সল্‌ভ

করব আমি জানি না! এই দেশে কুকুরের বিরুদ্ধে কোনো আইন নাই।”

বড় চাচা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

ছোটাচ্চু বলল, “একটা বড় এলসেশিয়ান কুকুর নিয়ে আসতে পারি। বাড়ি পাহারা দেবে, ঐ নেড়ি কুকুর তখন ধারে-কাছে আসবে না।”

ছোট একজন বলল, “না, না, না, কুকুর আমার অনেক ভয় করে।”

শান্ত বলল, “কুকুরকে ভয় করার কী আছে? কাছে আসলে কষে একটা লাথি দিবি।”

ঝুমু খালা বলল, “কুকুর বান্ধা তাবিজ আছে। বাম হাতে কালা সুতা দিয়ে বাঁধতে হয়। কুকুর-বিড়াল কাছে আসবে না।”

বড় চাচা বলল, “তোমার তাবিজ বাসার দরজায় ঝুলিয়ে রাখা যায় না? তাহলেই তো কুকুর আসত না।”

ঝুমু খালা বলল, “খালুজান, আপনি চিন্তা কইরেন না। আমি সকালবেলা ঝাড় নিয়া বাসার দরজার কাছে বসে থাকমু। কুত্তার কাছ থেকে আমি যদি আপনার পত্রিকা উদ্ধার না করি তাহলে আমার নাম ঝুমু না।”

টুনি হেসে বলল, “তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠতেই পারো না ঝুমু খালা! আমরা সবাই মিলে ডেকেও তোমার ঘুম ভাঙাতে পারি না।”

ঝুমু খালা মাথা চুলকে বলল, “সেইটা অবশ্যি সত্যি কথা। কেউ যদি ঘুম থেকে তুলে দেয়–খালুজান আমাকে ডেকে তুলে দিতে পারবেন না?”

বড় চাচা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাকে যদি সকালে ঘুম থেকে তুলতেই হয় তাহলে আমি নিজে গিয়ে কেন খবরের কাগজটা নিয়ে আসব না?”

ঝুমু খালা বলল, “কিন্তু খালুজান আপনি তো আমার মতোন কুত্তাটারে ঝাড় দিয়ে পিটাতে পারবেন না, পারবেন?”

বড় চাচা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে আবার থেমে গেলেন।

রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে টুনি টুম্পাকে বলল, “টুম্পা তোকে একটা কথা বলি, কাউকে বলবি না তো?”

টুম্পা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল, বলল, “বল। কাউকে বলব না।”

“কুকুরটা কিন্তু নিজে নিজে বড় চাচার পেপার নিচ্ছে না। কেউ একজন কুকুরটাকে দিয়ে পেপার নেওয়াচ্ছে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি।”

“তুমি কেমন করে বুঝলে?”

“দেখলি না কুকুরটা কত যত্ন করে পত্রিকাটা নিল। প্রথমে নাক দিয়ে ঠেলে সিঁড়ির কাছে নিয়ে তারপর এক কোনায় কামড় দিল, যেন পত্রিকাটা নষ্ট না হয়।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি।” টুনি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, “আমার মনে হয় একজন মানুষ সকালবেলা একটা কুকুরকে দিয়ে সবার বাসা থেকে পত্রিকাগুলো জড়ো করে, তারপর বিক্রি করে।”

টুম্পা মাথা নাড়ল, সে টুনির সব কথা সব সময় বিশ্বাস করে।

টুনি বলল, “তা ছাড়া কুকুর কেন খামোখা পেপার নিয়ে যাবে? সে পেপার খেতেও পারে না, পড়তেও পারে না, গায়েও দিতে পারে না। কেউ একজন কুকুরকে ট্রেনিং দিয়েছে।”

টুম্পা আবার মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক বলেছ।”

টুনি বলল, “পেপার চোরটাকে ধরতে হবে, কুকুরকে ধরে লাভ নাই।”

“কেমন করে ধরবে?”

টুনি বলল, “চিন্তা করছি।”

তারপর গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে শুরু করল। টুনি যখন চিন্তা করে তখন তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না বলে টুম্পাও চুপচাপ পাশে গালে হাত দিয়ে বসে রইল।

এ রকম সময় ঝুমু খালাকে দেখা গেল একটা শলার ঝাটা নিয়ে যাচ্ছে। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে ঝাড় নিয়ে কই যাও ঝুমু খালা?”

“নিচে। দরজার কাছে রেখে দিব।”

“কেন?”

“সকালে উঠে যেন খুঁজতে না হয়। কুত্তাটাকে এমন ঝাড়পেটা দিমু যে এইটা আর এই জন্মে এই বাসায় আসবে না।”

“কিন্তু তুমি তো সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারো না।”

“মোবাইলে এলার্ম দিছি।”

“তুমি মোবাইলে এলার্ম দিতে পারো?”

“না। বড় খালুজান করে দিছে। কালকে কুত্তার জান শেষ।”

ঝুমু খালা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে থাকে। টুনি ফিসফিস করে বলল, “সর্বনাশ!”

টুম্পাও ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“কাল সকালে সত্যি সত্যি কুকুরকে ঝাড়পেটা করলে ঝামেলা হয়ে যাবে। ঝুমু খালাকে থামাতে হবে।” টুনি এক সেকেন্ড চিন্তা করল, চিন্তা করে বলল, “তুই নিচে যা। ঝুমু খালাকে কোনোভাবে ব্যস্ত রাখ।”

“তুমি কী করবে?”

“ঝুমু খালার ঘরে গিয়ে তার মোবাইলের এলার্ম এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়ে আসি।”

টুনি ঝুমু খালার ঘরের দিকে গেল আর ঝুমু খালাকে ব্যস্ত রাখার জন্যে টুম্পা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।

ঝুমু খালার ঘরে মোবাইলটা খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হলো না, টুনি কয়েক সেকেন্ডের মাঝে এলার্মের সময়টা এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিল। তারপর নিচে গেল দেখার জন্যে টুম্পা কীভাবে ঝুমু খালাকে ব্যস্ত রাখছে। নিচে গিয়ে দেখল টুম্পা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে আর ঝুমু খালা টুম্পার ডান পায়ের আঙুল ধরে টানাটানি করছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

টুম্পা কিছু বলার আগেই ঝুমু খালা ঝংকার দিয়ে উঠল, বলল, “এই বাসায় কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ আছে? নাই? সিঁড়ি দিয়ে মানুষ হেঁটে হেঁটে নামে, আর এই মেয়ে নামে ফাল দিয়ে দিয়ে–”

টুম্পা ফিসফিস করে বলার চেষ্টা করল, “ফাল না, শব্দটা হচ্ছে লাফ।”

ঝুমু খালা আরো জোরে ঝংকার দিল, বলল, “থাউক, আমারে আর বেঙ্গলি শিখাতে হবে না।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে? টুম্পা পড়ে গেছে?”

“হ্যাঁ। পড়ে ঠ্যাংয়ে ব্যথা পেয়েছে। মনে হয় রগে টান দিছে।” টুম্পা টুনির দিকে তাকাল, টুনি চোখ টিপে দিল তখন টুম্পা বলল, “ঝুমু খালা, রগে টান মনে হয় বন্ধ হয়েছে। এখন ব্যথা নাই।”

ঝুমু খালা বলল, “রগে টান পড়লে এত সহজে বেদনা কমে না। মনে হয় গরম তেল দিয়ে মালিশ করতে হবে।”

টুম্পা বলল, “করতে হবে না ঝুমু খালা।”

ঝুমু খালা টুম্পার পায়ের আঙুলে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, “তুমি বেশি কথা বোলো না, চুপ করে বসে থাকো।”

কাজেই টুম্পা চুপ করে বসে রইল আর ঝুমু খালা তার পায়ের আঙুল ধরে টানাটানি করতে লাগল। টুনি তাদেরকে সেই অবস্থায় রেখে উপরে উঠে গেল।

তিনতলায় গিয়ে সে শাহানাকে খুঁজে বের করল। তাদের বাসায় শাহানা হচ্ছে জ্ঞানী মানুষ। মন দিয়ে লেখাপড়া করে, পৃথিবীর সবকিছু জানে, কারো যখন কিছু জানতে হয় তখন সে শাহানার কাছে আসে।

টুনিও শাহানার কাছে এলো, শাহানা মোটা একটা বই পড়ছিল, বইটা নামিয়ে রেখে টুনির দিকে তাকাল। টুনি বলল, “শাহানাপু, তুমি কী ব্যস্ত?”

শাহানা বলল, “কী বলবি বলে ফেল।”

“মনে আছে একবার আমরা সবাই শিশু পার্কে গিয়েছিলাম। শান্ত ভাইয়ার কাছে একটা কোকের ক্যান ছিল, সেটা খুলতেই ভেতর থেকে সব কোক ফেনা হয়ে বের হয়ে শান্ত ভাইয়ার মুখ, পেট, বুক সব ভিজিয়ে দিয়েছিল?”

শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ মনে আছে। শান্ত হচ্ছে একটা গাধা, কোকের মাঝে কার্বন-ডাইঅক্সাইড ডিজভ থাকে। যদি গরম করা হয় সেটা বের হয়ে আসে, আঁকালেও বের হয়ে আসে। এমনিতে দিনটা ছিল গরম আর গাধাটা তার ক্যানটা ঝাঁকাঝাঁকি করেছে, তাই যখন খুলেছে পুরো ক্যানের কোক কার্বন-ডাইঅক্সাইডের চাপে বের হয়ে এসেছে–মনে আছে গাধাটার কী অবস্থা হয়েছিল?”

টুনি মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “একটা ছোট শিশি দিয়ে কি এ রকম কিছু করা সম্ভব?”

“কী রকম?”

“যে শিশিটা খুলতেই ভেতর থেকে সবকিছু হুস হুস করে বের হয়ে সবকিছু মাখামাখি করে ফেলবে?”

শাহানা সন্দেহের চোখে টুনির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

টুনি মাথা নিচু করে বলল, “প্লিজ শাহানাপু আজকে জিজ্ঞেস কোরো না। কালকে আমি নিজেই বলব।”

শাহানা একটু হাসল, বলল, “ঠিক আছে।” তারপর তার চশমা খুলে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল, তারপর বলল, “তোর সিক্রেট প্রজেক্টে তুই ঠিক কী করতে চাস আমি জানি না। ধরে নিচ্ছি কারো কোনো ক্ষতি না করে তাকে বোকা বানাতে চাস।”

টুনি বলল, “অনেকটা সে রকম।”

“তাহলে সবচেয়ে সোজা হচ্ছে কার্বন-ডাইঅক্সাইড। একটা ছোট শিশিতে একটু ভিনেগার আর খাওয়ার সোডা দিয়ে যদি ছিপিটা বন্ধ করিস তাহলে ভেতরে কার্বন-ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়ে প্রেশার তৈরি করবে। তাই ছিপিটা খুলতেই ভেতর থেকে সবকিছু বের হয়ে আসবে। ঠিক কোকের ক্যানের মতো। তবে–” বলে শাহানা থেমে গেল।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তবে কী?”

“কতটুকু ভিনেগারের সাথে কতটুকু খাওয়ার সোডা দিচ্ছিস সেটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। বেশি হয়ে গেলে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের প্রেশার অনেক বেশি হয়ে তোর শিশি ফেটে যেতে পারে, নিজে থেকে ছিপি খুলে যেতে পারে। কাজেই সাবধানে এক্সপেরিমেন্ট করে ঠিক পরিমাণটা বের করতে হবে।”

টুনি বলল, “বের করব শাহানাপু।”

শাহানা বলল, “দরকার হলে আমার কাছে নিয়ে আসিস, আমি এডজাস্ট করে দিব।”

টুনির মুখে এগাল থেকে ওগাল জোড়া হাসি ফুটে উঠল। সে শাহানার গালে চুমু দিয়ে বলল, “শাহানাপু, তুমি হচ্ছ বেস্ট থেকেও বেস্ট।”

কাজেই কিছুক্ষণের মাঝে শাহানার সাহায্য নিয়ে টুনি তার হাই প্রেশার শিশি তৈরি করা শিখে নিল। কাল সকালে পেপার দেবার পর এবং কুকুর এসে সেটা নিয়ে যাবার মাঝখানের কয়েক সেকেন্ড সময়ের মাঝে বাকিটা শেষ করতে হবে। সবকিছু আগে থেকে রেডি করে রাখলে সেটা অসম্ভব কিছু নয়।

টুনি তখন ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেল।

.

সকালবেলা এলার্ম শুনে টুনি লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল। আগে থেকে সবকিছু রেডি করে রাখা আছে, একটা ছোট শিশিতে একটু খানি খাওয়ার সোডা এবং হাজার পাওয়ারের ভয়ঙ্কর কটকটে লাল রং। এর মাঝে এক চামচ ভিনেগার দিয়ে কর্ক দিয়ে শিশিটা বন্ধ করতে হবে। সেটা সে করবে

একেবারে শেষ মুহূর্তে। টেবিলের উপর স্কচ টেপ রাখা আছে, এক টুকরা ছিঁড়ে শিশিটাকে খবরের কাগজের উপর লাগিয়ে দেবে। তাহলেই কাজ শেষ।

টুনি ঘুম ঘুম চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। পেপারওয়ালার সাইকেলটা দেখলেই সে কাজ শুরু করে দেবে। জানালার কাছে বসে থেকে থেকে টুনি যখন প্রায় অধৈর্য হয়ে গেল তখন সে পেপারওয়ালার সাইকেলটা দেখতে পেল। টুনি খুবই ধৈর্য ধরে তখন ভিনেগারের শিশি থেকে এক চামচ ভিনেগার শিশিতে ঢেলে নেয়। ভেতরে বিজবিজ করে ফেনা তৈরি হতে থাকে, টুনি তখন দেরি না করে কর্কটা শক্ত করে শিশিটার মুখে লাগিয়ে নেয়। তারপর এক টুকরো স্কচ টেপ ছিঁড়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। দরজার কাছে কান পেতে শুনল পেপারটা সিঁড়ির উপরে রেখে পেপারওয়ালা চলে যাচ্ছে।

টুনি তখন সাবধানে দরজা খুলে বের হয়, শিশিটা স্কচ টেপ দিয়ে পেপারটার উপরে লাগিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে লাফিয়ে উপরে এসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সে কুকুরটাকে দেখতে পেল। বাসার সামনে এসে একবার ডানে-বামে তাকাল তারপর শান্ত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে পেপারটা শুকে সেটা কামড়ে ধরে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। টুনি দেখার চেষ্টা করল আশেপাশে কোনো মানুষ আছে কি না, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না।

ঘণ্টা খানেক পরে ঝুমু খালাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলো। বড় খালু যে মোবাইলে এলার্ম পর্যন্ত দিতে পারে না সেটা নিয়ে সে যথেষ্ট হা-হুঁতাশ করল। এই মানুষটাকে একা একা ছেড়ে দিলে সে কী বিপদ ঘটাবে সেটা নিয়েও সে নানা রকম আশঙ্কা প্রকাশ করল।

সকালবেলা যখন এই বাসার সব বাচ্চাকাচ্চা স্কুলে যাবার জন্যে রেডি হয়েছে তখন টুনি সবাইকে উদ্দেশ করে বলল, “সবাই আজকে স্কুলে যাবার সময় চোখ-কান খোলা রাখবে।”

শান্ত বলল, “তোর কি ধারণা আমরা চোখ-কান বন্ধ রেখে হাতড়াতে হাতড়াতে এখানে-সেখানে বাড়ি খেতে খেতে স্কুলে যাই?”

টুনি শান্তর কথা না শোনার ভান করে বলল, “যদি দেখো কোনো মানুষের মুখ, হাত, শরীর লাল রঙে মাখামাখি তাহলে আমাকে জানাবে।”

“কেন?”

“সেটা আমি এখন বলব না। যদি দেখো তাহলে বলব।” শান্ত গরম হয়ে বলল, “এখন কেন বলবি না?”

“তোমার জন্যে। তুমি যদি জানো তাহলে তুমি মারপিট শুরু করে দিতে পারো সে জন্যে এখন বলব না। তোমার মেজাজ খুব গরম, আমি চাই না তুমি রাস্তা-ঘাটে মারামারি করো।”

শান্ত খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই কী বললি? কী বললি? আমার মেজাজ গরম? আমি মারামারি করি?”

টুনি খুবই শান্তভাবে বলল, “আমি এখন কিছুই বলব না। কিন্তু আজকে স্কুলে যাবার সময় কিংবা ফিরে আসার সময় যদি দেখো কোনো মানুষ লাল রঙে মাখামাখি হয়ে আছে তাহলে এসে আমাকে জানাবে।”

শান্ত বলল, “জানাব না কচু! আমার আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তোর জন্যে রাস্তাঘাটে রঙিন মানুষ খুঁজে বেড়াব। হাহ!”

বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে এসে শান্ত ছুটতে ছুটতে টুনির কাছে গেল, বলল, “টুনি টুনি, শুনে যা কী হয়েছে।”

“কী হয়েছে?”

“এই রাস্তার মোড় দিয়ে হেঁটে আসছি, দেখি একটা পিচ্চি-এই এতটুকু সাইজ! (শান্ত সাইজটা দেখাল, যেটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য না) মুখ, পেট, বুক টকটকে লাল রং। আমি ডাকলাম আর সাথে সাথে দিল দৌড়। পিছনে পিছনে একটা কুত্তা। সেটাও দৌড়! এখন বল ব্যাপারটা কী হয়েছে?”

টুনি চোখ ছোট ছোট করে বলল, “মানুষটা পিচ্চি?”

“হ্যাঁ, মনে হয় দুই বছর বয়স হবে।”

“দুই বছর বেশি ছোট, দুই বছরের বাচ্চা হাঁটতেই পারে না।”

শান্ত অধৈর্য হয়ে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। না-হয় আরো বড় হবে, পাঁচ-ছয় বছর, কিংবা সাত-আট বছর–”

“কিন্তু ছোট বাচ্চা? বড় মানুষ না?”

“হ্যাঁ ছোট বাচ্চা।”

শান্ত আরো অধৈর্য হয়ে বলল, “বল ব্যাপারটা কী?”

টুনি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, বলা যাবে না।”

শান্ত চিৎকার করে বলল, “বলা যাবে না মানে?”

“বলা যাবে না মানে বলা যাবে না। মানুষটা যদি একটা বড় মানুষ হতো তাহলে বলতাম। কিন্তু মানুষটা যেহেতু ছোট বাচ্চা এখন আর বলা যাবে না।”

“কেন ছোট বাচ্চা হলে বলা যাবে না?”

“তাহলে তুমি বাচ্চাটাকে ধরে আছাড় দিবে। বাচ্চাটার ঠ্যাঙ ভেঙে দিবে।”

শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কেন আমি একটা ছোট বাচ্চার ঠ্যাং ভেঙে দিব?”

“তুমি যদি কথা দাও বাচ্চাটাকে কিছু বলবে না তাহলে বলতে পারি।”

শান্ত বলল, “কথা দিলাম।”

“ভালো করে বলো, কসম খেয়ে বললো।”

ব্যাপারটা কী হয়েছে জানার জন্যে শান্তর এত বেশি কৌতূহল হচ্ছিল যে শেষ পর্যন্ত কসম খেল।

টুনি তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। শুনে পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। খুবই বিচিত্র কারণে এই দুর্ধর্ষ পেপার চোরের উপর কেউ আর সে রকম রাগ হলো না!

বিকেলবেলা টুনি টুম্পাকে বলল, “এই টুম্পা যাবি আমার সাথে?”

টুম্পা চকচকে চোখে বলল, “পেপার চোরের সাথে দেখা করতে?”

“হ্যাঁ।”

“যাব।”

“চল তাহলে।”

টুনি আর টুম্পা তখন পেপার চোরের সাথে দেখা করতে ঘর থেকে বের হলো। শান্ত যেখানে রংমাখা ছেলেটাকে দেখেছে সেখানে গিয়ে তারা এদিক-সেদিক তাকাল কিন্তু রংমাখা কোনো বাচ্চাকে খুঁজে পেল না। তখন তারা রাস্তার পাশে একটা ছোট চায়ের দোকানে হাজির হলো। যে মানুষটি চা তৈরি করছে তাকে জিজ্ঞেস করল, “আঙ্কেল, আপনি কি এখানে কোনো বাচ্চাকে চিনেন যে একটা কুকুর নিয়ে ঘুরে?”

“ও। গুল্লু? তারে কে চিনে না, সবাই চিনে! আজকে কী করেছে খোদায় জানে, তার সারা শরীরে রং। একেবারে লাল বান্দর।”

টুনি আর টুম্পা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, টুনি তখন মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, “গুল্লু কী করে আপনি জানেন?”

 “পত্রিকা বিক্রি করে। সবার পত্রিকা আট-দশ টাকা করে, গুল্লুর পত্রিকার অর্ধেক দাম! এই পোলা যে কোত্থেকে এত সস্তায় পত্রিকা আনে খোদা মালুম!”

টুনি বলল, “গুল্লুর সাথে কি একটু কথা বলা যাবে?”

“যদি তারে খুঁজে পাও, কথা বলো।”

“কোথায় পাব গুল্লুকে?”

মানুষটা এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর দূরে রাস্তার পাশে কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখিয়ে বলল, “ঐ পোলা-মাইয়াদের জিজ্ঞেস করে দেখো। এরা মাঝে মাঝে একসাথে খেলে।”

টুনি তখন টুম্পাকে নিয়ে বাচ্চাগুলোর কাছে গেল, তারা রাস্তার পাশে ফুটপাতে আঁকিবুকি করে কিছু একটা খেলছে। টুনি আর টুম্পাকে দেখে সবাই উৎসুক চোখে তাদের দিকে তাকাল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কি গুল্লুকে দেখেছ?”

বাচ্চাগুলো সাথে সাথে সতর্ক হয়ে গেল। তারা পথে-ঘাটে থাকে, তাদের একে অন্যকে দেখে রাখতে হয়। ভদ্রলোকেরা যখন তাদের খোঁজ করে তখন বুঝতে হবে কিছু একটা ঝামেলা আছে। প্রায় টুনির বয়সী একটা মেয়ে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী জন্যে?”

“এমনি। একটু কথা বলব।”

একজন ফিক করে হাসল, বলল, “আজকে আমাগো গুল্লু লাল বান্দর।”

টুনি বলল, “জানি। সেই জন্যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”

টুনির বয়সী মেয়েটা বলল, “হে মনে হয় কথা বলবে না।”

“না বললে নাই। কিন্তু যদি কথা বলতে চায় আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে প্লিজ? আমরা দুইজন ঐ যে সামনে দোকানটা দেখছ তার বাইরে যে বেঞ্চ আছে সেখানে বসে থাকব।”

“ঠিক আছে।”

টুনি আবার বলল, “ওকে বোলো কোনো ভয় নাই!”

মেয়েটা আবার মাথা নাড়ল।

তখন টুনি আর টুম্পা দুইজন দোকানটার সামনে বেঞ্চে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে থাকল। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী মনে হয় টুনি আপু, গুল্লু কি আসবে?”

টুনি বলল, “জানি না। দেখা যাক। এখন যেহেতু নামটা জেনে গেছি কোনো একদিন খুঁজে বের করে ফেলব। আজকে না আসলেও ক্ষতি নাই।”

মিনিট দশেক পর হঠাৎ করে টুনি আর টুম্পা দুজনেই দেখল একটা ছোট ছেলে গুটি গুটি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটির বয়স সাত আট বছরের বেশি হবে না, মাথার চুল এলোমেলো, একটা শার্ট, যার বোতাম খুব বেশি নেই এবং একটা কালো রঙের ঢোলা প্যান্ট। খালি পা। যেটা দর্শনীয় সেটা হচ্ছে তার সারা মুখে, বুকে এবং পেটে টকটকে লাল রং।

ছেলেটা একা আসছে না, তার পাশে পাশে হেঁটে আসছে একটা কুকুর। ভিডিওতে টুনি আর টুম্পা আগেই এই কুকুরটাকে দেখেছে। ছেলেটা একটা নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়িয়ে গেল, দেখে বোঝা যাচ্ছে বিপদ দেখলে যেকোনো সময়ে সে দৌড়ে পালাবে! টুনি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি গুল্লু?”

গুল্লু মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “কাছে আসো, তোমার সাথে কথা বলি।”

“কী কথা?”

“এই তো তুমি কেন পেপার চুরি করো এই সব কথা!”

টুনির কথা শেষ হবার আগেই গুল্লু এক দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, পিছন পিছন তার কুকুর!

টুম্পা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “আর আসবে না।”

টুনি বলল, “মনে হয় আসবে। দেখা যাক।”

টুনির ধারণা সত্যি। কিছুক্ষণ পর আবার গুল্লুকে দেখা গেল। এবারে আরো সতর্ক, কুকুরটাও তার সাথে সাথে সতর্ক। টুনি গলা উঁচু করে বলল, “কী হলো? চলে গেলে কেন?”

উত্তরটা যেহেতু অনুমান করা যায় তাই গুল্লু কোনো উত্তর দিল না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার মুখে, কাপড়ে রং লেগেছে কেমন করে?”

গুল্লু বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, ঠিক বোঝা গেল না। টুনি বলল, “কাছে এসে বলো।”

গুল্লু একটু কাছে এলো। টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার মুখে রং লেগেছে কেমন করে?”

“বোনের বিয়া ছিল। সেইখানে রং খেলছি।”

টুনি হি হি করে হাসতে শুরু করল, সাথে সাথে টুম্পাও। টুনি বলল, “মিছা কথা বলো কেন?”

গুল্লু মাথা নাড়ল, বলল, “মিছা কথা না।”

“আমি বলি কেমন করে রং লেগেছে?”

গুল্লু হা-না কিছু বলল না। টুনি বলল, “আজকে সকালে তোমার কুকুরটা দিয়ে তুমি আমাদের বাসা থেকে যে পেপারটা চুরি করেছ সেইখানে একটা শিশি ছিল। তুমি যখন শিশি খুলেছ তখন ভুস করে সব রং বের হয়ে তোমার মুখে-শরীরে লেগে গেছে!” কথা শেষ করে টুনি হি হি করে হাসতে থাকে, সাথে টুম্পাও।

গুল্লু আবার দৌড় দেবার জন্যে রেডি ছিল কিন্তু যেহেতু টুনির কথায় কোনোরকম অভিযোগ নেই এবং তার হাসিটা খুবই আন্তরিক তাই শেষ পর্যন্ত দৌড় দিল না।

মনে হলো পুরো ব্যাপারটার মজার বিষয়টা সেও ধরে ফেলেছে এবং সেও একটু হেসে ফেলল। টুনি বলল, “তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি। কিন্তু আমার আরো বেশি বুদ্ধি। ঠিক কি না?”

গুল্লু মাথা নাড়বে কি না বুঝতে পারল না, শেষে অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল।

টুনি বলল, “কাছে আসো। বসো। আমি তোমাকে কিছু করব না।”

গুল্লু এবারে টুনির কথা বিশ্বাস করে কাছে এসে দাঁড়াল। টুনি বেঞ্চের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলল, “বসো।”

গুল্লু বসল। টুনি আর টুম্পার পা কে কুকুরটা গুল্লুর পায়ের কাছে গুঁড়ি মেরে বসে। কুকুরটা কীভাবে জানি বুঝে গেছে এখানে কোনো বিপদ নেই। সে বেশ আরামে মাথাটা মাটিতে রেখে চোখ বন্ধ করল।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা কী করে?”

গুল্লু বলল, “নাই।”

“মা?”

“জানি না।”

“জানো না?”

গুল্লু মাথা নাড়ল, বলল, “বাড়িতে ছিল।”

“তুমি বাড়ি যাও না?”

গুল্লু মাথা নেড়ে জানাল সে বাড়ি যায় না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “থাকো কোথায়?”

 গুল্লু হাত নেড়ে বলল, “এই তো।”

“খাও কোথায়?”

“হোটেলে। কাম করলে খাইতে দেয়।”

“কী কাজ?”

“কাটাকাটি, ধোয়াধুয়ি।”

টুনি বুঝতে পারল আলাপটা খুব ভালো এগুচ্ছে না। তাই অন্যভাবে চেষ্টা করল। কুকুরটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কুকুরের নাম কী?”

“বাঘা।” বাঘা নিজের নাম শুনে চোখ খুলে তাকিয়ে একবার লেজ নেড়ে আবার চোখ বন্ধ করল।

“বাঘা তোমার বন্ধু?”

গুল্লু মাথা নাড়ল, দাঁত বের করে হাসল, বলল, “এখন কেউ আমার টেকা নিতে পারে না।”

“তোমার অনেক টাকা?”

গুল্লু লাজুক মুখে একটু হাসার চেষ্টা করল, তারপর কোমরে গুঁজে রাখা একটা টাকার বান্ডিল বের করে গুনতে শুরু করল। টুনি একটু পরেই বুঝতে পারল সে গুনতে পারে না, একটু পরে পরেই গুল্লুর হিসাব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

টুম্পা বলল, “আমার কাছে দাও, আমি গুনে দিই।”

গুল্লু প্রথমে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে টুম্পার দিকে তাকাল, তার চেহারা দেখে মনে হলো সে তার জীবনে এ রকম আজগুবি কথা শুনে নাই। তার টাকা আরেকজনের হাতে তুলে দিবে গোনার জন্যে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে টাকার বান্ডিলটা টুম্পার হাতে তুলে দিল-টুম্পা টাকাগুলো গুনে বান্ডিলটা ফেরত দিয়ে বলল, “তিনশ বাহান্নো টাকা।”

“পাঁচশ হতে আর কত বাকি?”

টুম্পা হিসেব করে বলল, “একশ আটচল্লিশ।”

গুল্লু মুখ সুচালো করে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “পাঁচশ টাকা তোমার কেন দরকার?”

গুল্লু টাকার বান্ডিলটা তার কোমরে খুঁজতে খুঁজতে বলল, “একটা বিজনেস শুরু করুম।”

“কীসের বিজনেস?”

“চা-গরম। ফেলাক্সে গরম পানি আর চায়ের কাপ দিয়া বিজনেস। মেলা লাভ।”

টুনি মোটামুটি হিংসার চোখে এই বিজনেসম্যানের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

বাসায় ফিরে আসতে আসতে টুনি বলল, “আমাদের গরম পানি রাখার

একটা বড় ফ্লাস্ক আছে না?”

টুম্পা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, শান্ত ভাইয়ের জন্মদিনের সময় কিনেছিল।”

“এটা কোনো কাজে লাগে?”

“না।“

“এইটা আমরা গুল্লুকে দিয়ে দেই না কেন?”

টুম্পা মাথা নাড়ল, “তুমি দিতে পারবে না। ঝুমু খালা দিতে দিবে না। ঝুমু খালা বাসার সব জিনিস আটকে রাখে।”

টুনি বলল, “তুই সেটা আমার উপর ছেড়ে দে!”

টুম্পা হাসি হাসি মুখে বলল, “তাহলে অবশ্যি অন্য কথা। তোমার বুদ্ধির সাথে কেউ পারবে না!”

পরদিন সকালে টুনি রান্নাঘরে গিয়ে ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু খালা, তুমি একটু সরো দেখি আমি পানি গরম করব।”

ঝুমু খালা চোখ কপালে তুলে বলল, “ছোট মানুষ রান্নাঘরে কেন? যাও বের হও।”

“কিন্তু আমার গরম পানি লাগবে।”

“আমি গরম করে দিব। তুমি বের হও।”

টুনি বলল, “কিন্তু ঝুমু খালা, আমার একটু পরে পরে লাগবে।”

“একটু পরে পরে? কেন?”

“আমি একটা সায়েন্স প্রজেক্ট করছি। স্কুলে নিতে হবে। একটা বোতলের মুখে একটা বেলুন লাগিয়ে বোতলটা যদি গরম পানিতে রাখো তাহলে বেলুনটা ফুলে ওঠে। কী হয় জানো তো? বোতলের ভিতরে যে বাতাস আছে–”

ঝুমু খালা টুনিকে থামিয়ে বলল, “আমার এত সাইন্স জানার দরকার নাই। যেইটুকু জানি তার যন্ত্রণাতেই বাঁচি না। রান্নাঘরের আগুনের মাঝে তোমার থাকার দরকার নাই, বের হও।”

“তাহলে আমার গরম পানি?”

“আমি কেতলিতে গরম করে দিব।”

“একটু পরে পরে গরম করে দিবে?”

ঝুমু খালা যখন সমস্যাটা সমাধান করার জন্যে চিন্তা করছে তখন টুনি তার মাথায় হঠাৎ করে বুদ্ধি আসার অনবদ্য অভিনয় করে বলল, “তার চাইতে একটা কাজ করলে কেমন হয়?”

“কী কাজ?”

“কেতলিতে পানি গরম করে তুমি বড় যে ফ্লাস্কটা আছে তার মাঝে রাখো, আমার যখন দরকার হবে তুমি ফ্লাস্কটা থেকে বের করে দিবে।”

ঝুমু খালা একটু চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে।”

তারপর তার অভ্যাসমতো একটু শাসন করে বলল, “এর পরে যখন সাইন্স পজিক করবা ঠান্ডা পানি দিয়া করবা, বুঝছ?”

টুনি বলল, “ঠিক আছে। আর শব্দটা সাইন্স পজিক না। সায়েন্স প্রজেক্ট।”

ঝুমু খালা ঝংকার দিল, “আমার এত কিছু জানার দরকার নাই। বিদায় হও।”

টুনি তখন খুব আনন্দের সাথে বিদায় হলো। তারপর টুম্পাকে খুঁজে বের করে তাকে ফিসফিস করে বলল, “আমি যখন বলব তখন ঝুমু খালাকে তুই রান্নাঘর থেকে বের করে নিয়ে যাবি, কিছুক্ষণ আটকে রাখবি। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।” টুনির উপর টুম্পার অগাধ বিশ্বাস, যখন সে ঝুমু খালাকে আটকে রাখবে তখন টুনি কী করবে সেটা জানতে পর্যন্ত চাইল না।

মিনিট দশেক পর টুনি টুম্পাকে সিগন্যাল দিল তখন টুম্পা নিজের ঘরে গিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, “ঝুমু খালা ও ঝুমু খালা–”

ঝুমু খালা এবং আরো কয়েকজন টুম্পার ঘরে ছুটে গেল। টুম্পা মেঝেতে বসে তার পা ধরে চিৎকার করছে। ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“আমার পায়ের রগে আবার টান পড়েছে।”

ঝুমু খালা বসে টুম্পার পা ধরে আঙুলগুলো টানতে টানতে বলল, “তুমি কী করছ?”

“কিছু করি নাই–শুধু চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে ঐ পর্দাটা সরাতে যাচ্ছিলাম–” টুম্পা পুরোপুরি অর্থহীন কথা বলতে থাকে, কথাগুলো যে অর্থহীন সেটাও কেউ বুঝতে পারল না!

ঠিক এই সময়ে টুনি বড় ফ্লাস্কের সব গরম পানি ঢেলে সেখানে ট্যাপের পানি ভরে রাখে। তারপর টুম্পার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে টুম্পা?”

টুম্পা বলল, “পায়ের রগে টান পড়েছে।”

টুনি টুম্পার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিতেই টুম্পা বলল, “মনে হয় রগটা একটু ঢিলা হয়েছে, ব্যথা কমেছে।”

ঝুমু খালা বিশাল একটা লেকচার দিতে শুরু করে, টুম্পা পুরোটুকু ধৈর্য ধরে শুনে!

মিনিট দশেক পর টুনি রান্নাঘরে গিয়ে ঝুমু খালাকে একটা বাটি দিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, এই বাটিতে গরম পানি দাও।”

ঝুমু খালা গরম কড়াইয়ে কিছু সবজি ছেড়ে দিয়ে টুনির বাটিটা হাতে নিয়ে ফ্লাস্ক থেকে পানি ঢেলে দিল। পানিটা দেখেই তার কেমন সন্দেহ হয়, হাত দিয়ে দেখে পানিটা মোটেও গরম নয়–একেবারে ঠান্ডা!

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা?”

“পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে!”

“ঠান্ডা হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ”

“কেন?”

ঝুমু খালা ফ্লাস্কটা খুলে ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল, “মনে হয় এইটা নষ্ট হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই চায়নিজ মাল। চায়নিজ মাল দুই দিনে নষ্ট হয়ে যায়। কত তাড়াতাড়ি পানি ঠান্ডা হয়ে গেল।”

টুনি বলল, “আবার একটু গরম পানি দিয়ে দেখবে?” ঝুমু খালা বলল, “ঠিক আছে দেখি।”

এইবার টুম্পার ব্যাক পেকের জিপার আটকে গেল। সেই জিপার খুলে দেয়ার জন্যে টুম্পা তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, “ঝুমু খালা ও ঝুমু খালা–”

ঝুমু খালা যখন সেই জিপার টানাটানি করে খুলছে তখন টুনি আবার ফ্রাস্কের গরম পানি ফেলে দিয়ে সেখানে ট্যাপের পানি ভরে রাখল। খানিকক্ষণ পর টুনি যখন গরম পানি আনতে গিয়ে দেখে পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে তখন ঝুমু খালার আর কোনো সন্দেহ থাকল না যে এই ফ্লাস্কটা নষ্ট হয়ে গেছে। চায়নিজ মাল কেনা যে খুবই বোকামি হয়েছে ঝুমু খালা সেইটা বারবার মাথা নেড়ে বলতে থাকল!

.

রাত্রে বসার ঘরে দাদির পায়ে রসুনে ভাজা গরম তেল মাখাতে মাখাতে ঝুমু খালা যখন বাসার সব খবর রিপোর্ট করছিল তখন বড় ফ্লাস্কটা নষ্ট হয়ে যাবার খবরটাও সে দাদিকে রিপোর্ট করল। টুনি ঠিক পাশেই বসেছিল, সে দাদিকে বলল, “দাদি এই নষ্ট ফ্লাস্কটা আমি নিই?”

“নে। কিন্তু নিয়ে কী করবি?”

“ভেতরে মাটি ভরে আঙর গাছ লাগাব!”

“আঙুর গাছ?” দাদি অবাক হয়ে বললেন, “আঙুরের গাছ পাওয়া যায় নাকি?”

“যদি না পাই তাহলে অন্য কিছু করব!”

পরদিন বিকালবেলা টুনি টুম্পাকে নিয়ে সেই “অন্য কিছু করার জন্যে বড় ফ্লাস্কটা নিয়ে বের হলো। রাস্তার মোড়ে একটু খোজাখুঁজি করতেই গুল্লু এবং বাঘাকে পাওয়া গেল। মুখের লাল রং একটু কমেছে কিন্তু পুরোপুরি ওঠেনি।

টুনি গুল্লুর দিকে ফ্লাস্কটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”

গুল্লু অবাক হয়ে বলল, “নিব? আমি?”

“হ্যাঁ।”

“কত টাকা?”

টুনি আর টুম্পা হেসে ফেলল। টুনি বলল, “তোমাকে টাকা দিতে হবে। এটা তোমাকে গিফট।”

গুল্লু তখন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফ্লাস্কটা হাতে নেয়। তাকে দেখে বোঝা যায় টুনি আর টুম্পা হঠাৎ যদি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে সে সেই ঝুঁকি নিতে রাজি না। ফ্লাস্কটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বলল, “সত্যি আমারে দিয়ে দিলা?”

“হ্যাঁ।”

“খোদার কসম?”

টুনি বলল, “খোদার কসম-তবে একটা শর্ত।”

“কী শর্ত?”

“আর কোনোদিন পেপার চুরি করতে পারবা না।”

গুল্লু দাঁত বের করে হাসল, বলল, “করমু না।”

“গুড।” টুনি বলল, “মনে রাখবা আমরা কিন্তু তোমার বিজনেস পার্টনার। তার মানে কি জানো?”

“কী?”

“আমাদের দুইজনকে ফ্রি চা খাওয়াতে হবে।”

 গুল্লু দাঁত বের করে হাসল, বলল, “খাওয়ামু।”

“আর বিজনেস করে যখন তুমি বড় হয়ে অনেক বড় বিজনেসম্যান হবে, বিল গেইটসের মতো একজন হবে তখন আমাদের দুইজনকে দুইটা গাড়ি কিনে দিতে হবে।”

টুনির সব কথা সে বুঝতে পারল না, বিল গেইটসটা কী সে ধরতে পারল না কিন্তু তারপরও তাকে নিরুৎসাহিত হতে দেখা গেল না। মাথা নেড়ে বলল, “দিমু। খোদার কসম।”

একেবারে ফার্স্ট ক্লাস চা!

টুনি আর টুম্পা ছোট বলে বাসায় তাদেরকে সব সময় চা খেতে দেয়া। হয় না। সেটা নিয়ে অবশ্যি এখন টুনি আর টুম্পার কোনো দুঃখ নেই। যখনই তাদের চা খেতে ইচ্ছে করে তারা মোড়ের দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসে, গুল্লু তখন তাদের চা খাওয়ায়।

একেবারে ফার্স্ট ক্লাস চা!

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল