গো-গো-গোল্ডেন ফাইভ

বসার ঘরে দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখছেন, বড়দের কেউ কেউ খবরের কাগজ পড়ছে, কেউ কেউ ঝুমু খালার তৈরি পায়েশের মতো চা খাচ্ছে, ছোটরা মেঝেতে উবু হয়ে বসে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলছে–তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। বাচ্চাদের একজন মাথা তুলে বলল, “তুমি আজকে কিছু আনো নাই?”

ছোটাচ্চু বলল, “কী আনব?”

“এই তো, চকোলেট না-হলে আইসক্রিম না-হলে কেক–”

আরেকজন বলল, “না-হলে পিজ্জা, না-হলে ফ্রায়েড চিকেন”

আরেকজন বলল, “না-হলে কাচ্চি বিরিয়ানি, না-হলে জালি কাবাব–”

আরেকজন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ছোটাচ্চু তখন ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, “চুপ কর দেখি। তোদের হয়েছেটা কী? সারাক্ষণ শুধু খাই খাই করিস? মাত্র কালকেই এত বড় একটা চকোলেট কেক আনলাম–”

শান্ত বলল, “মোটেই এত বড় না ছোটাচ্চু, আমি মাত্র চার স্লাইস খেয়েছি!”

একজন চোখ কপালে তুলে বলল, “চার স্লাইস!”

তখন বাচ্চারা কে বেশি সুইস খেয়েছে কে কম সুইস খেয়েছে সেটা নিয়ে নিজেরা নিজেরা ঝগড়া-ঝাটি করতে লাগল। ছোটাচ্চু একটা চেয়ার টেনে দাদির পাশে বসে অন্যমনস্কভাবে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে রইল। বোঝা যাচ্ছিল ছোটাচ্চু টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সেখানে কী দেখাচ্ছে সেটা দেখছে না। কিছু একটা চিন্তা করছে।

ছোটাচ্চু হঠাৎ করে মাথা তুলে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই টুনি।”

রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলায় টুনি এই মাত্র সেক্টর কমান্ডার হয়েছে, কাজেই সে অন্য কমান্ডারদের কাকে কী করতে অর্ডার দিবে চিন্তা করতে করতে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল।

ছোটাচ্চু বলল, “তুই আমার সাথে একটু দেখা করবি। আমার ঘরে।”

কথাটা এমন কিছু ভয়ানক কথা নয়, কিন্তু কী হলো কে জানে, হঠাৎ করে সব বাচ্চা খেলা বন্ধ করে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। শুধু যে তাকাল তা নয়, কঠিন চোখে আগুন ছড়িয়ে তাকাল।

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “কী হয়েছে? তোরা এভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেন?”

একজন বলল, “তুমি শুধু টুনির সাথে কথা বলতে চাও কেন?”

আরেকজন বলল, “আমাদের পছন্দ হয় না?”

আরেকজন বলল, “তুমি টুনিকে যেটা বলতে চাও সেইটা আমাদেরকেও বলতে হবে।”

সবাই তখন একসাথে চিৎকার করে বলল, “বলতেই হবে। বলতেই হবে।”

ঠিক তখন টেলিভিশনে একজন সাজুগুজু করে থাকা মহিলা খুবই কাঁদো কাঁদো গলায় আরেকজন ত্যালতেলে চেহারার মানুষকে কিছু একটা বলছিল, বাচ্চাদের চিৎকারের জন্যে দাদি সেটা শুনতে পেলেন না। দাদি (কিংবা নানি) খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, “এই! তোরা চিৎকার থামাবি? তোদের জ্বালায় শান্তিমতো একটা নাটক পর্যন্ত দেখতে পারি না।”

বাচ্চারা হয় দাদির কথা শুনল না কিংবা শুনলেও তাঁর কথায় কোনো গুরুত্ব দিল না। আরো জোরে চিৎকার করে বলল, “বলতে হবে। আমাদের সবাইকে বলতে হবে। এক্ষুনি বলতে হবে।”

দাদি আরো গলা উঁচিয়ে বললেন, “ভাগ এখান থেকে। দূর হ সবগুলো।”

সবাই তখন উঠে ছোটাচ্চুকে ধরে রীতিমতো টেনে টেনে তার ঘরে নিয়ে যেতে শুরু করল। শুধু টুনি সেই টানাটানিতে যোগ দিল না। সবার পিছনে পিছনে শান্ত মুখে হেঁটে হেঁটে ছোটাচ্চুর ঘরে গেল।

ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে বাচ্চারা ছোটাচ্চুকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে তার চেয়ারে বসিয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল, “বলো এখন, তুমি টুনিকে কী বলতে চাইছিলে। বলো।”

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “আরে! তোরা কী পাগল হয়ে গেলি নাকি? সব কথা সবাইকে বলতে হবে? আমি কি আলাদা করে টুনির সাথে একটু কথা বলতে পারব না?”

সবাই চিৎকার করে বলল, “না, পারবে না।”

“কী মুশকিল! তোদের যন্ত্রণায় আমাকে পাগল হয়ে যেতে হবে।”

একজন বলল, “তোমাকে পাগল হতে হবে না ছোটাচ্চু, তুমি আগে থেকে পাগল।”

ছোটাচ্চু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন টুনি এগিয়ে এসে বলল, “ছোটাচ্চু–”

বাচ্চারা টুনির কথা শোনার জন্যে চেঁচামেচি থামিয়ে চুপ করল। টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সি.ই.ও. হতে পারো কিন্তু তোমার মাথায় বুদ্ধি খুব বেশি নাই।”

ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললি তুই?”

“তুমি যদি শুধু আমার সাথে কথা বলতে চাও তাহলে সেটা গোপনে শুধু আমাকে বলতে হবে। সবার সামনে বললে হবে না। এখন দেরি হয়ে গেছে, সবাই জেনে গেছে, এখন যেটা বলতে চাও সেটা তোমাকে সবার সামনেই বলতে হবে। বলো, কী বলতে চাও।”

ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “যা ভাগ এখান থেকে। আমার কাউকেই আর কিছু বলতে হবে না।”

টুনি শান্ত গলায় বলল, “বলে ফেলো ছোটাচ্চু। এই বাসায় কোনো কিছু গোপন নাই, আমরা সবাই সবার সব কিছু জানি।”

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ গজগজ করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে, বলছি।”

সবাই আরেকটু এগিয়ে এসে ছোটাচ্চুকে ঘিরে দাঁড়াল। ছোটাচ্চু একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, “ফারিয়া একটা প্রজেক্ট করছে, সেটা ছেলে মেয়েদের বিজ্ঞান এবং গণিত-ভীতি নিয়ে। ফারিয়া সে জন্যে কয়েকটা স্কুলে একটা জরিপ চালাতে চায়, সেই জন্যে বলেছে টুনির সাথে একটু কথা বলবে।”

বাচ্চারা ছোটাচ্চুর কথা শুনে খুবই হতাশ হলো, একজন বলল, “এই কথা? এই রকম ফালতু একটা কথা বলার জন্যে তুমি এ রকম ঢং করেছিলে? ছোটাচ্চু, টুনি ঠিকই বলেছে, তোমার মাথায় কোনো বুদ্ধি নাই।”

আরেকজন বলল, “আয় যাই। রাজাকারের খেলাটা শেষ করি।”

শুধু টুনি বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু। তুমি ফারিয়াপুর সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিও। আমি ফারিয়াপুকে আমাদের স্কুলে নিয়ে যাব।”

ছোটাচ্চু শুকনো মুখে বলল, “ঠিক আছে।”

বাচ্চারা সবাই তখন বসার ঘরে ফিরে গেল রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলার জন্যে। চিৎকার, চেঁচামেচি, হইচইয়ের মাঝখানে একসময় যে টুনি খেলা থেকে উঠে এলো সেটা কেউ লক্ষ করল না।

ছোটাচ্চুর ঘরের দরজা খুলে টুনি ভিতরে ঢুকে ছোটাচ্চুর বিছানায় বসে বলল, “বলো ছোটাচ্চু, তুমি আমাকে আসলে কী বলতে চাইছিলে এখন বলো।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “তুই কেমন করে বুঝলি?”

“না বোঝার কী আছে? তুমি এখনও মিথ্যা কথা বলা শিখো নাই। তুমি যখন মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করো তোমার নাকটা একটু মোটা হয়ে যায়, ঠোঁট কাঁপে আর বাম চোখটা ছোট হয়ে যায়।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “না-না-নাক মোটা হয়ে যায়?”

টুনি বলল, “এখন সেগুলো চিন্তা করে লাভ নাই ছোটাচ্চু, যেটা বলতে চাও সেটা বলে ফেলো। একটু পরে অন্যেরা চলে আসবে। অন্য সবাই চলে আসলে তুমি তোমার কথা থামিয়ে দিও। তখন আমি ফারিয়াপুর প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলব, আসলে কী নিয়ে কথা হচ্ছে কেউ টের পাবে না।”

ছোটাচ্চু আরো কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা চুলকাল, তারপর বগল চুলকাল, তারপর গলা পরিষ্কার করে তাকে একটা কাহিনি বলল। কাহিনিটা এ রকম :

ছোটাচ্চু তার অফিসে বসে কাজ করছে তখন তাদের অফিসের সেক্রেটারি রঞ্জনা এসে জানাল একজন মহিলা তার সাথে দেখা করতে এসেছে। ছোটাচ্চু বলল, মহিলাকে পাঠিয়ে দিতে।

একটু পরেই মহিলা ছোটাচ্চুর অফিসে ঢুকল, মোটাসোটা নাদুসনুদুস মহিলা। ফর্সা, ঠোঁটে লিপস্টিক, বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের ভেতর। সব সময় ভুরু কুঁচকে থাকতে থাকতে ভুরুর উপর পাকাপাকিভাবে ভাঁজ হয়ে গেছে। দেখেই মনে হয় দুনিয়ার সবার উপরে খুবই বিরক্ত।

ছোটাচ্চু মহিলাকে তার সামনের চেয়ারে বসতে দিয়ে বলল, “বলেন ম্যাডাম আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি?”

মহিলা খুবই সন্দেহের চোখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আপনি ডিটেকটিভ?”

ছোটাচ্চু বলল, “আমি একা না, আমাদের একটা বড় টিম আছে।”

“আপনার বয়স এত কম, আপনি কী করবেন?”

ছোটাচ্চু বিরক্তি চেপে বলল, “বয়সটা তো ইস্যু না। আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারি কি না সেটা হচ্ছে ইস্যু! আমরা একটা রেজিস্টার্ড প্রফেশনাল অর্গানাইজেশন, আপনার যদি আমাদের পছন্দ না হয় আপনি আমাদের কাছে আসবেন না, অন্য কোথাও যাবেন!”

“আর তো কেউ নাই আপনারা ছাড়া।”

ছোটাচ্চু জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে বলল, “তা ছাড়া আমরা যে সব কেস নিই তাও তো নয়। পছন্দ না হলে আমরা কেস নিই না।”

মহিলা তার কুঁচকানো ভুরু আরো কুঁচকে বলল, “আমার কেসটা আপনারা নিবেন না?”

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, আমি সেটা বলিনি। আমি তো আপনার কেসটা এখনও জানিই না। বলেন আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি।”

মহিলা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনারা আমার মেয়েটাকে বাঁচান।”

“কী হয়েছে আপনার মেয়ের?”

মহিলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমি জানি না। মনে হয় ড্রাগস!”

ছোটাচ্চু আঁতকে উঠল, বলল, “ড্রাগস! কত বড় মেয়ে আপনার?”

“ক্লাস সেভেনে পড়ে। তেরোতে পা দিয়েছে।”

“এত ছোট মেয়ে ড্রাগস ধরেছে?”

“ধরেছে কি না জানি না, আমি সন্দেহ করছি।”

ছোটাচ্চু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “আপনি কেন সন্দেহ করছেন?”

“ড্রাগ এডিক্টের মতো ব্যবহার করে।”

“সেটা কী রকম?”

“কথা বলে না। একা একা থাকে। শুকিয়ে যাচ্ছে, কোনো কিছুতে মনোযোগ নেই। পড়ালেখা করতে চায় না। গত পরীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ হয় নাই।”

“গোল্ডেন ফাইভ?”

“হ্যাঁ”, মহিলা এবারে ফাঁসফাস করে কাঁদতে শুরু করল, বলল, “আপনি চিন্তা করতে পারেন, আমার মেয়ের পিছনে আমি এত সময় দেই আর সেই মেয়ের গোল্ডেন ফাইভ হয় না? তার জন্যে কতগুলো প্রাইভেট টিচার আর কোচিং রেখেছি আপনি শুনতে চান?”

ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল, মহিলা তখন বলতে শুরু করল, “সকালে ফৌজিয়া ম্যাডাম, দুপুরে তালুকদার স্যার, তারপর প্যারাগন কোচিং, রাত্রে বিল্লাহ স্যার–”

ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে বলল, “ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ের জন্যে এইটা একটু বেশি হয়ে গেল না?”

“বেশি?” মহিলা বেশ অবাক হলো, বলল, “অন্যরা কী করে শুনবেন?”

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, শুনতে চাই না।”

মহিলা বলল, “মেয়েটার গানের গলা ভালো, সেই জন্যে আমি গানের স্কুলে নেই, অন্যরা তো তাও নেয় না, তাদের সবকিছু বন্ধ। মেয়েটা এখন গানও গাইতে চায় না। আমি ভেবেছিলাম টেলিভিশনে গানের কম্পিটিশনে দিব কিন্তু যদি প্র্যাকটিস না করে কেমন করে কম্পিটিশন করবে?”

ছোটাচ্চু চুপচাপ বসে রইল আর মহিলা টানা কথা বলে গেল। যখন দম নেবার জন্যে একটু থেমেছে তখন ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আমাকে ঠিক কী করতে হবে?”

“খোঁজ নিয়ে বের করবেন মেয়েটা আসলেই ড্রাগ নেয় কি না। নিলে কী ড্রাগ নেয় আর কার কাছ থেকে সেই ড্রাগ কিনে।”

ছোটাচ্চু মহিলার কথাবার্তা শুনে প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিল এই মহিলার কেসটা নিবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিতে রাজি হলো। ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ে সত্যিই যদি ড্রাগ নেয়া শুরু করে তাহলে তাকে তো সাহায্য করা দরকার। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার মেয়ের নাম কী?”

“আইরিন। ভালো নাম মাহজাবিন বিনতে কায়েস।”

“মেয়ের ছবি আছে আপনার সাথে?”

“হ্যাঁ, নিয়ে এসেছি।” বলে ব্যাগ থেকে কয়েকটা ছবি বের করে ছোটাচ্চুর হাতে দিল। ছোটাচ্চু ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখল, ছবিতে ড্রাগ এডিক্ট হওয়ার কোনো চিহ্ন নেই। হাসি-খুশি একটা মেয়ে। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার হাজব্যান্ড কী করেন?”

“ব্যাংকে চাকরি করে।”

“আপনার হাজব্যান্ড কি জানেন আপনি আমাদের এজেন্সিতে এসেছেন?”

“না জানে না। আমার হাজব্যান্ড একেবারে অপদার্থ। সংসারের কোনো কাজকর্মে নাই। মেয়েটাকে মানুষ করার সব দায়িত্ব আমার।”

ছোটাচ্চু ইতস্তত করে বলল, “আপনার হাজব্যান্ডকে ব্যাপারটা জানালে হতো না?”

মহিলা মাথা নাড়ল, বলল “উঁহু, তাকে জানিয়ে লাভ নাই। যা করার আমাকেই করতে হবে।”

ছোটাচ্চু তখন একটা ফরম বের করে মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা ফিল-আপ করে অফিসে জমা দিয়ে যান।”

মহিলা ফরম ফিল-আপ করে কিছু এডভান্স টাকা জমা দিয়ে চলে গেল।

ছোটাচ্চু কাহিনিটা এতটুকু বলে থেমে গেল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে?”

ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, “আমাদের যে নতুন স্টাফ আছে তাদেরকে লাগিয়েছি। তারা আইরিনকে ছায়ার মতো ফলো করেছে কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই পায় নাই। মেয়েটা মাথা নিচু করে হেঁটে হেঁটে রিকশায় এক কোচিং সেন্টার থেকে আরেক কোচিং সেন্টারে যায়। ড্রাগের কোনো ব্যাপার যদি থাকে সেটা হয় কোচিং সেন্টারের ভিতরে, না-হয় প্রাইভেট টিউটরদের বাসায়। এখানেই আমরা আটকে যাচ্ছি, ভিতরে মেয়েটাকে ওয়াচ করতে পারছি না।”

টুনি সরু চোখে বলল, “সেই জন্যে আমাকে ডেকেছ?”

“হ্যাঁ।”

“আমাকে কী করতে হবে?”

“তুই ভিতরে গিয়ে মেয়েটাকে ওয়াচ করবি। কী করে না করে ওয়াচ করে আমাদের এসে বলবি।”

“আমি ভিতরে কেমন করে ঢুকব?” “দরকার হলে আমি তোকে ঐ কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেব।” টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “আমি? কোচিং সেন্টারে? কখনো না।”

“প্লিজ!” ছোটাচ্চু মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “প্লিজ টুনি, প্লিজ, এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নাই।”

“তাই বলে আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হব? বড় হলে আমার ছেলেমেয়েদের সামনে আমি কেমন করে মুখ দেখাব? তারা যদি জানে তাদের মা কোচিং সেন্টারে গেছে তাহলে লজ্জার চোটে তারা আত্মহত্যা করে ফেলবে না?”

ছোটাচ্চু কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “কিন্তু তুই তো আসলে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছিস না।”

ঠিক তখন কয়েকজন বাচ্চা ছোটাচ্চুর ঘরে এসে ঢুকল, ছোটাচ্চু সাথে সাথে কথা বন্ধ করে ফেলল। টুনি বলল, “না, আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছি না। কোচিং সেন্টারে ভর্তি না হয়ে আমি কীভাবে সেখানে ফারিয়াপুর জরিপ করব? আমাকে তো কোচিং সেন্টারে ঢুকতেই দিবে না।”

ছোটাচ্চু কী বলবে বুঝতে না পেরে আঁ আঁ ধরনের একটা শব্দ করল। টুনি বলল, “তুমি ফারিয়াপুকে বুঝিয়ে বলো যাদের কোচিং সেন্টারে যেতে হয়েছে তাদের জরিপ নিয়ে লাভ নাই। তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে। কাজেই আমরা যদি কোচিং সেন্টারে জরিপ না করি কোনো ক্ষতি হবে। ফারিয়াপু তার চল্লিশ পার্সেন্ট ডাটা এমনিতেই পেয়ে যাবে। তার সাথে বাকি ত্রিশ পার্সেন্ট যোগ করলে”

বাচ্চারা এই ঘরে বসে এই রকম বিরক্তিকর কথার কচকচানি শুনতে রাজি হলো না, তারা মুখ বিকৃত করে বের হয়ে গেল। টুনি আর ছোটাচ্চু তখন আবার আগের আলোচনায় ফিরে গেল, ছোটাচ্চু বলল, “তুই তো আর সত্যি সত্যি কোচিংয়ে ভর্তি হচ্ছিস না। তুই একটা মেয়েকে সাহায্য করার চেষ্টা করছিস!”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “তাতে কী আছে ছোটাচ্চু, সবাই জানবে আমি কোচিং করি! কোচিংয়ের খাতায় আমার নাম লেখা হয়ে যাবে। ছিঃ!”

ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে, তোকে একটা ভুয়া নামে ভর্তি করে দেব। কোচিংয়ের খাতায় তাহলে তোর আসল নাম উঠবে না।”

টুনি কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে চোখের চশমাটা ঠিক করে বলল, “ঠিক আছে তাহলে!”

.

পরদিন ছোটাচ্চুর সাথে টুনি বাসা থেকে বের হলো, অনেক সকাল হওয়ায় বাচ্চাদের বেশিরভাগ তখনো ঘুমে, তাই তারা সেটা টের পেল না। ছোটাচ্চু প্রথমে তাকে তার অফিসে নিয়ে আইরিনের ছবিগুলো দিল। ছবিগুলো ভালো করে দেখে টুনি তার ব্যাগের ভেতর সেগুলো ঢুকিয়ে নিল। ছোটাচ্চু তখন প্যারাগন কোচিং সেন্টারে ফোন করে একটু খোঁজখবর নিয়ে টুনিসহ সেখানে রওনা হলো।

টুনি ভেবেছিল কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্যে তারা টুনির কাগজপত্র দেখতে চাইবে কিন্তু সে রকম কিছু হলো না, মনে হলো কেউ টাকা দিতে রাজি হলেই তাকে তারা ভর্তি করে নেয়। আইডি কার্ড বানানোর জন্যে একটা ফটো চাইল, টুনি বলল, পরদিন নিয়ে আসবে। প্যারাগন কোচিং সেন্টারে টুনির নাম হলো তানিয়া জাহান, সংক্ষেপে তানিয়া।

টুনিকে কোচিং সেন্টারে ঢুকিয়ে ছোটাচ্চু চলে গেল, টুনি তখন আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকল। এই প্রথম সে একটা কোচিং সেন্টারে এসেছে। সে জীবনেও চিন্তা করেনি যে সে এ রকম একটা জায়গায় আসবে। একসাথে অনেকগুলো ঘরে ব্যাচে ব্যাচে কোচিং হয়। টুনি খোঁজখবর নিয়ে ক্লাস সেভেনের ঘরটাতে ঢুকল। সারি সারি গ্রাস্টিকের চেয়ার, সামনে একটা ডেস্ক। ডেস্কের উপর কলম দিয়ে এবং মার্কার দিয়ে কোচিংয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের নানা রকম মন্তব্য লিখে গেছে, ছবি এঁকে গেছে। সেগুলো পড়ে পড়েই মনে হয় সময়টা পার করে দেয়া যাবে। ঘরের সামনের দেওয়ালে একটা হোয়াইট বোর্ড ঝুলানো, পিছনে একটা শেলফ, ময়লা-বিবর্ণ গাইড বই দিয়ে ঠাসা, দেখেই মন খারাপ হয়ে যায়। ঘরের দেওয়াল ময়লা, কোনায় কোনায় মাকড়সার জাল। মেঝেতে চিপসের খালি প্যাকেট, বাদামের খোসা, নানা ধরনের লিফলেট, মনে হলো আধখাওয়া সিগারেটের একটা টুকরাও আছে। তবে ঘরটার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে তার বোটকা গন্ধ।

টুনি মাঝামাঝি একটা জায়গায় বসে, এখান থেকে দরজাটার দিকে তাকিয়ে কে আসছে সে দেখতে পারবে। ছেলে-মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। বেশিরভাগই একজন আরেকজনকে চিনে, নিজেদের ভেতর কথাবার্তা বলছে। টুনি সরাসরি কারো দিকে তাকাচ্ছিল না কিন্তু খুবই মনোযোগ দিয়ে কে কী নিয়ে কথা বলছে সেটা শোনার চেষ্টা করতে থাকে। বেশিরভাগ কথাবার্তাই ফেসবুক, স্ট্যাটাস, লাইক এই সব নিয়ে। একটা দুইটা হিন্দি সিনেমার নাম শোনা গেল। স্কুলের স্যার-ম্যাডামদের গালাগাল করাও মনে হলো এদের খুব প্রিয় একটা কাজ। টুনি যদিও আইরিন মেয়েটার ছবিগুলো খুব ভালোভাবে দেখে এসেছে কিন্তু যখন সামনাসামনি দেখবে তখন চিনতে পারবে কি না বুঝতে পারছিল না। চেনা মানুষের ছবি দেখে চেনা যায়, অপরিচিত মানুষকে ছবি দেখে সে রকম চেনা যায় না।

কিন্তু আইরিন দরজা দিয়ে ঢোকা মাত্র সে তাকে চিনতে পারল। মেয়েটার চেহারার মাঝে একধরনের উদাসীনতা, মনে হয় নিজের দিকে সে নজর দেয় না। জামা-কাপড় কেমন যেন অগোছাল। এলোমেলো চুল, চোখে চশমা। আইরিন ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা পিছনে চলে গেল। সবার পিছনে এক কোনায় টেবিলে ব্যাগ রেখে সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখল। টুনি তখন আইরিনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল। এখন সোজাসুজি তাকানো ঠিক হবে না। টুনি ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করল, খাতার মাঝখানে একটা ছোট চারকোনা আয়না টেপ দিয়ে লাগিয়ে এনেছে, আয়নাটা মেজ চাচির মেক-আপের কমপ্যাক্ট থেকে নেয়া। গাড়ির আয়নার মতো কনভেক্স মিরর হলে আরো ভালোভাবে অনেকটুকু জায়গা দেখা যেত, কিন্তু এখন এটা দিয়েই কাজ চলে যাবে, আইরিনের দিকে না তাকিয়েই সে আইরিনকে দেখতে পারবে। টুনি খাতাটা একটু নাড়াচাড়া করে আয়নার ভেতর দিয়ে আইরিনকে লক্ষ করতে থাকে। মেয়েটা এদিক-সেদিক তাকিয়ে যখন নিশ্চিত হলো কেউ তাকে লক্ষ করছে না, তখন সে পিছনের বইয়ের শেলফের কাছে গিয়ে গাদাগাদি করে রাখা ছেঁড়া, ময়লা, পুরনো গাইড বইগুলোর পিছনে হাত দেয়, মনে হয় সেখান থেকে সে কিছু একটা নেবে। কী হতে পারে সেটা? ড্রাগস?

ঠিক কী নেবে টুনি দেখতে পারল না কারণ ঠিক তখন তার পাশের মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখো আয়না দিয়ে?”

টুনি তার খাতায় লাগানো আয়নাটা লুকানোর কোনো চেষ্টা করল না, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “আয়নায় মানুষ কী দেখে?”

“চেহারা?”

“হ্যাঁ।” টুনি এবারে আয়নায় নিজের চেহারা দেখার ভান করে মেয়েটার দিকে তাকাল, বলল, “আমার আই শ্যাডোটা মুছে গিয়েছে, তাই না?”

মেয়েটা একবার টুনির দিকে তাকাল তারপর ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “তোমার এত বড় চশমা, আই শ্যাডো দেখাই যায় না।”

“বড় হলে আমি কন্টাক্ট লেন্স পরব।”

“কন্টাক্ট লেন্স? চোখের ভিতরে যেটা পরে?”

“ভিতরে না, উপরে।”

“ঐ হলো, একই কথা।” মেয়েটা কেমন জানি গা-ঝাড়া দিয়ে বলল, “কন্টাক্ট লেন্সের কথা চিন্তা করলেই আমার গা শিরশির করে।”

মেয়েটা হাসি-খুশি টাইপের, কথা বলতে পছন্দ করে। কিন্তু টুনি আজকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, কারো সাথে বন্ধুত্ব করে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। তাই সে আলাপ বন্ধ করার জন্যে ব্যাগের ভেতর থেকে রং পেন্সিলের বাক্স থেকে কালো পেন্সিলটা বের করে সেটা দিয়ে নিজের চোখের নিচে আই লাইনারের দাগ দেয়ার ভান করল, তারপর আয়নাটা ঘুরিয়ে সে আবার আইরিনের দিকে তাকাল, মেয়েটি ডেস্কে মাথা ঝুঁকিয়ে কিছু একটা পড়ছে। শেলফের পিছন থেকে কী নিয়েছে জানা গেল না।

ঠিক তখন, কোথায় জানি এলার্মের মতো একটা কর্কশ শব্দ হলো। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তখন একটু নড়েচড়ে বসল আর প্রায় সাথে সাথে দরজা দিয়ে কোচিংয়ের টিচার এসে ঢুকল–মনে হলো মানুষটা বুঝি দরজার পাশেই এলার্মের শব্দের জন্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিল! কমবয়সী চালবাজ ধরনের একজন মানুষ, তার হাতে ফটোকপি করা অনেকগুলো কাগজ। সে কাগজগুলো টেবিলের উপর রেখে ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের দিকে তাকাল, এতগুলো ছেলেমেয়ে দেখে তার মুখে একটা আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। গলা পরিষ্কার করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে তোমাদের স্বাগতম। সবাইকে লাল গোলাফের শুভেচ্ছা।” মানুষটা ‘প’ উচ্চারণ করতে পারে না। প্যারাগনকে বলেছে ফ্যারাগন, গোলাপকে বলেছে গোলাফ! কী বিচিত্র!

ঘরটা ছোট, হাঁটাহাঁটি করার জায়গা নাই, তার মাঝেই মানুষটা খুব কায়দা করে পায়চারি করার ভান করে থেমে গিয়ে বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য কী বলো?”

টুনির ইচ্ছে হলো বলে যে আপনারা প্যারাগনকে বলেন ফ্যারাগন! কিন্তু আসলেই তো আর সেটা বলা যায় না তাই সে চুপ করে রইল, অন্যেরাও বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, কিন্তু ঠিক কী বলল বোঝা গেল না। মানুষটা তখন নিজেই উত্তর দিল, বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মডেল টেস্ট! আমরা একটার ফর একটা মডেল টেস্ট নেই, যেন কোচিং সেন্টারের ছেলেমেয়েদের সব ফ্রশ্নের উত্তর মুখস্ত হয়ে যায়।”

টুনির মুখটা নিশপিশ করতে লাগল বলার জন্যে যে শব্দটা ফ্রশ্ন’ না, শব্দটা প্রশ্ন কিন্তু এবারেও সেটা বলতে পারল না! মানুষটা টেবিলের উপর থেকে ফটোকপি করা একটা কাগজ তুলে দিয়ে সেটা উপরে তুলে সবাইকে দেখিয়ে বলল, “এই যে দেখো মডেল টেস্টের ফ্রশ্ন! তোমরা যদি এই ফ্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করতে ফারো, তোমাদের গোল্ডেন পাইভ কেউ আটকাতে পারবে না।”

টুনি মনে মনে একটা নিশ্বাস ফেলল, মানুষটা শুধু যে প্রশ্নকে ফ্রশ্ন বলে তা নয়, ফাইভকে বলে পাইভ! কী ভয়ঙ্কর!

মানুষটা হাতের কাগজটা নাড়াতে নাড়াতে বলতে থাকল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টার থেকে আমরা সেটা গ্যারান্টি দেই। আমাদের গ্যারান্টি কঠিন গ্যারান্টি, গোল্ডেন না ফেলে টাকা পেরৎ!”

আবার ফেরতকে বলেছে পেরৎ! মানুষটা চোখ বড় বড় করে ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসে থাকা সবার দিকে তাকাল, মনে মনে হয়তো আশা করেছিল সবাই বুঝি হাততালি দিবে! কিন্তু কেউ কিছু বলল না।

মানুষটা মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করল, “আমরা লেখাড়া করি কী জন্যে?”

কেউ এবারেও কোনো কথা বলল না, সবাই মডেল টেস্ট দিতে এসেছে, সেটা দিয়ে চলে যাবে, কথাবার্তার মাঝে কারো উৎসাহ নেই। মানুষটা অবশ্যি হাল ছেড়ে দিল না, আবার জিজ্ঞেস করল, “বলো, আমরা লেখাড়া করি কী জন্যে?”

একজন খুবই অনিচ্ছার সাথে বলল, “শেখার জন্যে।”

মানুষটা মনে হলো ইলেকট্রিক শক খেয়েছে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “নো নো নো নো! শেখার জন্যে লেখাড়া করে বোকারা! অনেক কিছু শিখে বোকার মতো ঘরে বসে থাকে। বুদ্ধিমানরা লেখাড়া করে ফরীক্ষায় নম্বর ফাওয়ার জন্যে। শুধু ফরীক্ষায় তারা গোল্ডেন এ ফ্লাস ফায় না, জীবনের সব জায়গায় গোল্ডেন এ ফ্লাস ফায়। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা বেতনের চাকরি করে। দেশে-বিদেশে যায়। গাড়ি-বাড়ি থাকে। ভালো ঘরে বিয়ে হয়।” (বিয়ের কথা শুনে এক-দুইজন অবশ্যি ফিক করে হেসে দিল)

মানুষটা মুখ গম্ভীর করে বলল, “আর যারা শেখার জন্যে লেখাড়া করে তাদের কী হয়? তারা স্কুল-কলেজে চাকরি করে। মাসের শেষে কোনোবার বেতন ফায় কোনোবার বেতন ফায় না। ফ্রাইভেট টিউশনি করে।”

মাঝখান থেকে কে যেন বলে উঠল, “আপনার মতো?”

সবাই তখন হি হি করে হেসে ওঠে। মানুষটা রেগে উঠে বলল, “কে বলেছে? কে?”

কেউ উত্তর দিল না, শুধু হাসিটা কেমন জানি নিঃশব্দ একটা হাসিতে পাল্টে গেল। মানুষটার উৎসাহ হঠাৎ করে কেমন জানি একটু থিতিয়ে গেল, সে আর বক্তৃতা না বাড়িয়ে সবাইকে মডেল টেস্টের প্রশ্ন দিতে থাকে।

টুনি মাথা ঘুরিয়ে একবার আইরিনকে দেখল। ক্লাসে যে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে মনে হয় সে লক্ষই করছে না। একমনে মাথা গুঁজে কিছু একটা পড়ে যাচ্ছে। মডেল টেস্টের প্রশ্নটা পেয়েও সে সেটা সরিয়ে রাখল, মনে হলো উত্তর দেয়ার ইচ্ছাও নেই!

টুনি যদি মডেল টেস্টের উত্তর না দেয় কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু সে মোটামুটি মাথা খাঁটিয়ে মডেল টেস্টের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিছু সে জানে, সেগুলো নিয়ে সমস্যা নাই। যেগুলো জানে না সেগুলো সে লটারি করে ঠিক করল। অন্যদের শেষ করতে সময় লাগছে, টুনির মোটেই সময় লাগল না।

মডেল টেস্টের উত্তরগুলো নিয়ে মানুষটা সবাইকে সঠিক উত্তর লেখা একটা কাগজ দিয়ে মুখস্থ করতে লাগিয়ে দিল। কী ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার! সবাই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে যখন উত্তর মুখস্থ করছে তখন টুনি আবার পিছনে বসা আইরিনকে তার খাতায় লাগানো আয়না দিয়ে লক্ষ করল, সে এখনও গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, মুখস্থ করার দিকে তার কোনো আগ্রহ নেই।

শেষ পর্যন্ত আবার সেই কর্কশ এলার্মের মতো শব্দ হলো এবং সবাই তখন তাদের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। টুনিও উঠে আইরিনকে লক্ষ করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু ভিড়ের মাঝে তাকে দেখা গেল না। টুনি একটু অপেক্ষা করে, যখন ভিড় কমে গেল তখন দেখল আইরিন নেই। আগেই চলে গেছে। টুনি পেছনের শেলফে পুরানো গাইড বইগুলোর পিছনে কিছু আছে কি না হাত দিয়ে দেখতে চাইছিল কিন্তু তার সুযোগ পেল না। দুইজন ছেলে সেখানে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলা নিয়ে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যে আর নড়ার লক্ষণ নেই। টুনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কিন্তু ততক্ষণে অন্য ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা ঢুকতে শুরু করেছে। টুনি বাধ্য হয়ে তখন ঘর থেকে বের হয়ে গেট খুলে কোচিং সেন্টারের বাইরে এলো। রাস্তার উল্টা পাশে ছোটাচ্চু দাঁড়িয়ে আছে। টুনি ডানে-বামে তাকিয়ে রাস্তা পার হয়ে ছোটাচ্চুর কাছে যেতেই ছোটাচ্চু নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু দেখলি?”

টুনি বলল, “সে রকম কিছু না। শুধু”

“শুধু কী?”

“মেয়েটা ঘরটাতে ঢুকেই শেলফের বইয়ের পিছনে হাত দিয়ে কিছু একটা নিয়েছিল।”

ছোটাচ্চুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক লিড! কী নিয়েছে জানিস না?”

“উঁহু, দেখতে পারি নাই।”

“সমস্যা নাই, কালকে দেখবি। একটু আগে আগে চলে যাবি।”

“ঠিক আছে। কিন্তু—”

“কিন্তু কী?”

টুনি বলল, “এই কোচিং সেন্টারে যদি আমাকে কয়েক দিন যেতে হয় তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। কালকেই শেষ।”

ছোটাচ্চু বলল, “যদি কালকের মধ্যে কেস সলভ করতে পারিস তাহলে তো তোকে আর কোনোদিন যেতে হবে না।”

টুনি কোনো কথা না বলে চুপচাপ ছোটাচ্চুর সাথে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ছোটাচ্চু বলল, “অফিসে চল, তোকে নানা ধরনের ড্রাগস চিনিয়ে দিই। কাল যদি কিছু একটা পেয়ে যায় তাহলে যেন চিনতে পারিস।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে।”

ছোটাচ্চু মুখটা দার্শনিকের মতো করে বলল, “আমি বুঝতে পারি না, এই বয়সের বাচ্চারা কেমন করে ড্রাগস নেয়া শিখে যায়? কী সর্বনাশ!”

টুনি কোনো কথা বলল না।

.

পরদিন ছোটাচ্চু টুনিকে বেশ আগে প্যারাগন কোচিং সেন্টারে নামিয়ে দিয়ে গেল। টুনি ভেতরে ঢুকে তাদের ক্লাসের জন্যে ঘরটায় গিয়ে দেখে সেখানে অন্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বসে মডেল টেস্ট দিচ্ছে। একটু পরেই কর্কশ একটা শব্দ হলো এবং ছেলেমেয়েরা তাদের খাতা জমা দিতে বের হতে শুরু করল। ছেলেমেয়েরা কথা বলতে বলতে হাসাহাসি করতে করতে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে বের হচ্ছে, এই ফাঁকে টুনি ক্লাসের ভেতর ঢুকে ক্লাসের পিছনে শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পুরানো, ছেঁড়া, বিবর্ণ গাইড বইগুলো দেখার ভান করতে থাকে। আইরিন নামের মেয়েটা শেলফের পেছনে হাত দিয়ে সেখান থেকে কোনো একটা কিছু বের করে এনেছিল। টুনি একটা গাইড বই বের করার ভান করে পিছনে হাত দেয়। হাতে কিছু একটা লাগল, জিনিসটা ধরতেই বুঝে গেল একটা বই। টুনি বইটা বের করে আনে, বইটার নাম থ্রি কমরেডস, বইয়ের লেখকের নাম এরিখ মারিয়া রেমার্ক!

কী আশ্চর্য! মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ে আর সবাই সন্দেহ করছে সে ড্রাগস খায়! টুনি বইয়ের কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে দেখল, এই লেখকের আরো কয়েকটা বইয়ের নাম দেয়া আছে, একটা বইয়ের নাম, অল কোয়ায়েট ইন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট! টুনি এই বইটার নাম শুনেছে, লেখক নিশ্চয়ই বড় লেখক। বইটা জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা, লেখক নিশ্চয়ই জার্মান। একেবারে তার বয়সী এই ছোট মেয়েটা এত বড় বড় বই পড়ে আর তার মা ভাবছে সে বুঝি ড্রাগস খায়! কী আশ্চর্য! শুধু তা-ই না, তাকে ধরার জন্যে মেয়েটির মা ডিটেকটিভ লাগিয়েছে আর টুনি কী না ছোটাচ্চুর বুদ্ধি শুনে বই পড়া এই মেয়েটার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছে! কী লজ্জা! কী লজ্জা! টুনির একেবারে মরে যেতে ইচ্ছে করল।

টুনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে বইটা শেলফের পিছনে যেখানে পেয়েছিল সেখানেই রেখে দিল। তার কাজ শেষ, এখন সে চলে যেতে পারে, ছোটাচ্চুকে বলতে পারে আইরিন নামে মেয়েটি মোটেও ড্রাগ খাওয়া মেয়ে নয়। মেয়েটি বই পড়তে ভালোবাসে, বাসায় যেহেতু বই পড়তে দেয় না তাই যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ে। কিন্তু ছোটাচ্চু এক ঘণ্টা পর তাকে নিতে আসবে, আগে বের হয়ে গেলে তাকে না পেয়ে ছোটাচ্চু ঘ্যানঘ্যান শুরু করবে। তাকে এখন অপেক্ষাই করতে হবে। শুধু যে অপেক্ষা করতে হবে তা নয়, চালবাজ মানুষটার ভুল উচ্চারণে কথাবার্তা শুনতে হবে। কীভাবে ছেলেমেয়েগুলো এই ঘরটার মাঝে গাদাগাদি বসে দিনের পর দিন এ রকম একজন মানুষের কথা শুনে?

টুনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে পড়ল। একসময় ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করে। নিজেদের ভেতর কথা বলতে বলতে ঘরটার মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসতে থাকে। একসময় আইরিনও ঘরটাতে ঢুকল। ঘরের পিছনে শেলফের সামনে গিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে শেলফের পিছনে হাত দিয়ে তার বইটা বের করে আনল। তারপর ঘরের একেবারে কোনার সিটটাতে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে বইটি পড়তে শুরু করে। মনে হয় তার চারপাশে কী ঘটছে সে তা কিছুই শুনছে না–এখানে থেকেও সে এখানে নেই।

কিছুক্ষণ পর কর্কশ একটা এলার্মের মতো শব্দ হলো আর প্রায় সাথে সাথেই গতকালকের সেই চালবাজ মানুষটা এক গাদা কাগজপত্র নিয়ে হাজির হলো। টেবিলের উপর কাগজপত্রগুলো রেখে সে ঘরের মাঝে গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকাল, তারপর গলা

পরিষ্কার করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে তোমাদের লাল গোলাফের শুভেচ্ছা।”

টুনি একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবল যে মানুষের উচ্চারণ এত খারাপ সে কেন মুখ খুলে?

মানুষটার অবশ্যি উচ্চারণ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য কী বলো।”

কেউ কোনো কথা বলল না, মাছের মতো চোখের পাতি না ফেলে সবাই মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা বলল, “আমাদের কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমাদের মডেল টেস্ট। আমরা ফরতেক দিন মডেল টেস্ট নেই।”

টুনি অবাক হয়ে লক্ষ করল মানুষটা গতকাল যে কথাগুলো বলেছিল আজকেও সেই একই কথাগুলো বলছে! টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মতো, একই কথা একইভাবে প্রত্যেক দিন সবাইকে শোনানো হয়। কী আশ্চর্য। কোচিং সেন্টারে না এলে টুনি জানতেই পারত না এখানে কী হয়। টুনি মানুষটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ক্লাসের অন্যান্যদের লক্ষ করতে লাগল, কত রকম ছেলেমেয়ে, কত আশ্চর্য তাদের মুখের ভঙ্গি। মানুষটা তার বিচিত্র উচ্চারণে টানা কথা বলে যেতে লাগল, টুনি না শোনার চেষ্টা করে অন্যমনস্কভাবে বসে রইল।

“তানিয়া জাহান। তানিয়া–”

টুনি অন্যমনস্ক হয়ে ছিল বলে লক্ষ করেনি মানুষটা তাদের মডেল টেস্টের খাতাগুলো ফেরত দিচ্ছে। নাম ডাকা মাত্র সবাই তাদের খাতা নিচ্ছে কিন্তু তানিয়া জাহানের খাতাটি কেউ নিচ্ছে না এবং তখন টুনির মনে পড়ল এই কোচিং সেন্টারে তার নাম তানিয়া জাহান। সে হাত তুলে দাঁড়াল।

মানুষটা খাতা নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, “মডেল টেস্টের ফরীক্ষায় তোমার কী সমস্যা হয়েছে?”

টুনির ইচ্ছা হলো বলে, শব্দটা ফরীক্ষা না, শব্দটা হচ্ছে পরীক্ষা। কিন্তু সেটা বলল না, বলল, “আমার কোনো সমস্যা নাই।”

“তাহলে মডেল টেস্ট এত খারাফ করছ কেন? মাত্র চল্লিশ ফেয়েছ।”

টুনি বলল, “চল্লিশ অনেক নম্বর।”

মানুষটা প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে একশতে ফচানব্বই ফেলে ফাস। তোমাদের সবকিছু মুখস্ত করতে দিয়েছি না? মুখস্ত করলা না কেন? লেখাড়া মানেই মুখস্ত। মুখস্ত মানেই লেখাড়া।”

টুনি ভাবল বলে শব্দটা লেখাড়া না, শব্দটা লেখাপড়া এবং মুখস্থ মানেই লেখাপড়া কথাটা মোটেই সত্যি না। কিন্তু কিছু বলল না, একটু পরেই এখান থেকে চলে যাবে আর কোনোদিন আসতে হবে না, শুধু শুধু। এখন কথাবার্তা বাড়িয়ে লাভ নেই। টুনি হাসি হাসি মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

মানুষটা দুই হাত নেড়ে প্রায় নাচার মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, “তোমরা অন্য কোচিং সেন্টারে যাও, তারা তোমাদের উল্টাফাল্টা জিনিস মুখস্ত করতে দিবে। মুখস্ত করবে কিন্তু ফরীক্ষায় সেই জিনিস আসবে না। আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে কখনো সেইটা হয় না। যেটা মুখস্ত করবা সেইটাই ফরীক্ষায় ফাবে। গ্যারান্টি।”

টুনি এবারে আর চুপ করে থাকতে পারল না, বলল, “আংকেল, পরীক্ষায় কোনটা আসবে সেইটা আপনারা আগে থেকে কেমন করে জানেন?”

মানুষটা কেমন যেন একটু খাবি খেল, তারপর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “সবাই আমাকে স্যার ডাকে, তুমি আংকেল ডাকো, ব্যাফারটা কী?”

টুনি বলল, “কিন্তু আপনি তো আমার স্যার না। যারা পড়ায় তারা স্যার। আপনি তো পড়ান না। আপনি মডেল টেস্ট নেন। মুখস্থ করার জন্যে কাগজ দেন। আপনি আংকেল।”

মানুষটা আরেকবার খাবি খেল। বলল, “আমি আংকেল?”

“হ্যাঁ।” দেখা গেল টুনির সাথে সাথে আরো অনেকে মাথা নেড়ে বলল, “আংকেল! আংকেল!”

মানুষটা এবারে কেমন জানি থতমত খেয়ে গেল। টুনি তখন আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন করে আগে থেকে জানেন আমাদের পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে?”

মানুষটা আস্তে আস্তে কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, “তোমার এত কিছু জানার দরকার কী? আমরা কোন জায়গা থেকে ফরীক্ষার ফ্রশ্ন আনি সেইটা আমাদের ব্যাফার। তোমরা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছ, এখন চোখ বন্ধ করে আমাদের ফ্রশ্ন মুখস্ত করবে। বুঝেছ?”

টুনির কেমন জানি একটা জিদ চেপে গেল। সে ঠান্ডা গলায় বলল, “এক সেকেন্ড আংকেল।” তারপর ব্যাগের ভেতর থেকে তার একটু মোটা ধরনের বল পয়েন্ট কলম বের করে কলমটা অনেকটা মাইক্রোফোনের মতো করে মানুষটার দিকে ধরে বলল, “আংকেল। এখন বলেন।”

‘আংকেল’ এবারে কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। একটু ভয়ে ভয়ে কলমটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা কী?”

“মাইক্রো ভয়েস রেকর্ডার। আপনি যেটা বলবেন সেইটা রেকর্ড হয়ে যাবে। বলেন আংকেল।”

মানুষটা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “বন্ধ করো। এইটা বন্ধ করো।”

টুনি মানুষটার কথা না শোনার ভান করে বলল, “আংকেল, এখন আপনি বলেন, পরীক্ষার আগে সব প্রশ্ন আপনারা কেমন করে পেয়ে যান?”

মানুষটা হঠাৎ করে ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর কেমন যেন ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে শুট করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে ঘরের সব ছেলেমেয়ে টুনির দিকে তাকায়, প্রথমে কেউ কোনো কথা বলে না, তারপর হঠাৎ করে সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করে। টুনি চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল আইরিন পর্যন্ত তার বই পড়া বন্ধ করে টুনির দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণের ভেতরেই দরজা দিয়ে চালবাজ মানুষটা ফিরে এলো, এবারে সে একা না, তার সাথে আরো কয়েকজন আছে। একজন মোটাসোটা, আরেকজন হালকা-পাতলা, আরেকজন টিশটাশ মহিলা। চালবাজ মানুষটা টুনিকে দেখিলে বলল, “এই মেয়েটা।”

মোটাসোটা মানুষটা বলল, “এই মেয়ে, তুমি আমাদের ইনস্ট্রাক্টরদের কথা রেকর্ড করার চেষ্টা করছ কেন? তোমার ভয়েস রেকর্ডারটা আমাকে দাও।”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। দিব না।” তারপর মোটা বল পয়েন্ট কলমটা উপরে তুলে মাইক্রোফোনের মতো মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে ধরল। মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তখন টিশটাশ মহিলা বলল, “এই মেয়ে-তুমি নিজ থেকে যদি না দাও তাহলে আমাদের স্টাফ জোর করে তোমার কাছ থেকে এটা নিয়ে নেবে। তুমি আমাদের কোচিং সেন্টারে এসে আমাদের কথাবার্তা রেকর্ডিং করতে পারো না।”

টুনি বুঝতে পারল অবস্থাটা জটিল থেকে জটিল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু যেহেতু এটা শুরু হয়ে গেছে এখন থামার উপায় নাই। টুনি একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, “আন্টি, এটা ঠিক হবে না।”

টিশটাশ মহিলা বলল, “এটা ঠিক হবে না?” তুমি কেন বলছ এটা ঠিক হবে না মেয়ে?”

চালবাজ মানুষটা বলল, “এর নাম তানিয়া জাহান। তানিয়া।”

টিশটাশ বলল, “কেন এটা ঠিক হবে না তানিয়া?”

টুনি বলল, “আসলে এটা আমার আসল নাম না। এটা ছদ্মনাম।”

মানুষগুলো একসাথে বলল, “ছদ্মনাম?”

টুনি মাথা নড়ল, বলল, “আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে এখানে কী হয় সেটা ইনভেস্টিগেট করার জন্যে।”

সামনে দাঁড়ানো সবগুলো মানুষের চোয়াল একসাথে ঝুলে পড়ল। মোটাসোটা মানুষটা কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “কে-কে-কেন?”

“আমি জানি না। মনে হয় গভর্নমেন্ট থেকে দায়িত্ব দিয়েছে।”

মানুষগুলোর চোয়াল এমনিতে ঝুলে ছিল আরো ঝুলে পড়ার কোনো উপায় নাই, তাই এবারে জিভগুলো একটু বের হয়ে এলো। হালকা-পাতলা মানুষটা নাকি গলায় বলল, “গভর্নমেন্ট?”

টুনি উত্তর না দিয়ে তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির একটা কার্ড বের করে মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে এই যে কার্ডে ফোন নম্বর আছে ফোন করে দেখতে পারেন। ওয়েবসাইটটাও চেক করতে পারেন।”

টিশটাশ মহিলা কার্ডটা নিল, সবাই কার্ডটা ঝুঁকে পড়ে দেখল, তারপর নিজেদের ভেতর গুজগুজ-ফুসফুস করে নিচু গলায় কথা বলতে লাগল। তারপর একজন কার্ডটা নিয়ে বের হয়ে গেল, কিছুক্ষণ পর মুখটা কালো করে ফিরে এসে মাথা নাড়ল। টুনি বুঝতে পারল ছোটাচ্চুর সাথে ফোনে কথা বলে এসেছে, কী হচ্ছে ছোটাচ্চু কিছুই বুঝতে পারেনি কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে টুনি এখানে আছে।

মানুষগুলো নিজেদের ভেতর আরো কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর মোটাসোটা মানুষটা গলার মাঝে মধু ঢেলে বলল, “এই যে খুকি, মনে হয় আমাদের মাঝে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। আমাদের ইনস্ট্রাক্টর ঠিক কী বলতে চেয়েছেন, সেটা কীভাবে বলেছেন আর তুমি সেটাকে কীভাবে নিয়েছ এটা নিয়ে মনে হয় একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে।”

টুনি হঠাৎ করে বুঝে গেল মানুষগুলো ভয় পেয়েছে। সে এখন ইচ্ছে করলে যা খুশি তা-ই বলতে পারবে, আরো ভয় দেখাতে পারবে। তাই কলমটা মাইক্রোফোনের মতো নিজের মুখের কাছে ধরে বলল, “আংকেল এখানে সবাইকে বলেছেন আমাদের পরীক্ষায় কী আসবে সেটা মডেল টেস্ট করিয়ে আমাদের মুখস্থ করিয়ে দেবেন। একশ ভাগ গ্যারান্টি। আমি জানতে চেয়েছিলাম আংকেল আগে থেকে কেমন করে জানবেন কোনটা পরীক্ষায় আসবে! স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্ন তো গোপন।”

মোটাসোটা মানুষ চালবাজ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এটা বলেছ?”

চালবাজ মানুষ খাবি খেয়ে বলল, “না মানে ইয়ে আমি শুধু বলেছি ফ্রত্যেক দিন আমরা মডেল টেস্ট নেই–”

যে কথাটা বলার জন্যে গত দুই দিন টুনির মুখটা নিশপিশ করছিল শেষ পর্যন্ত সেটা বলেই ফেলল, “আংকেল আপনি বলছেন ফরতেক, আসলে উচ্চারণটা হচ্ছে প্রত্যেক।”

কয়েক সেকেন্ড ঘরের মাঝে কেউ কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ একজন হাসি চাপতে না পেরে নাক দিয়ে বিদঘুঁটে একটা শব্দ করে ফেলল। হাসি খুবই সংক্রামক একটা ব্যাপার, তাই সেটা শুনে আরেকজন, তারপর আরেকজন, তারপর ঘরের সবাই প্রথমে চাপা তারপর জোরে জোরে হাসতে শুরু করল। চালবাজ মানুষটা প্রথমে লাল তারপর নীল তারপর বেগুনি হয়ে গেল, তারপর বেগুনির মাঝে ছোপ ছোপ লাল আর নীল রং দেখা যেতে লাগল।

টুনি বুঝতে পারল সে এখন পর্যন্ত যেটুকু করেছে সেটা অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ছোটাচ্চু জানতে পারলে তার খবর হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। বড় কিছু অঘটন ঘটে যাবার আগে তার এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। টুনি তাই কিছুই হয়নি সে রকম একটা ভাব করে খুব ধীরে ধীরে তার ব্যাগের ভিতর তার খাতাপত্র ঢোকাল, তার মোটা কলমটা রাখল, তারপর ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু ঠিক কী বলবে কীভাবে বলবে বুঝতে না পেরে ইতিউতি করতে লাগল, খাবি খেতে লাগল।

টুনি ঘর থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে কোচিং সেন্টারের কুৎসিত বিল্ডিং থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এসে বুকের ভেতরে আটকে থাকা নিশ্বাসটা বের করে দিল। কোচিং সেন্টারে এইমাত্র নাটকটা করে আসা ঠিক হলো কি না সে এখনও বুঝতে পারছে না।

রাস্তায় পা দিয়ে সে মাত্র কয়েক পা হেঁটেছে তখন সে হঠাৎ শুনল পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ডাকছে, “এই যে, এই যে শোনো–”

টুনি ঘুরে তাকাল, দেখল আইরিন লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে হেঁটে আসছে। টুনি দাঁড়িয়ে গেল। আইরিন কাছে এসে বলল, “আমি কোচিং সেন্টারে ক্লাসটাতে ছিলাম, আমার নাম আইরিন।”

টুনি ভাবল বলে, আমি জানি! তোমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য আমি এই কোচিং সেন্টারে এসেছিলাম। কিন্তু সেটা বলল না। বলল, “আমার আসল নাম টুনি।”

“টুনি, তুমি আজকে কোচিং সেন্টারে যেটা করেছ সেটা এমনই আশ্চর্য ঘটনা যে আমি দেখে বেকুব হয়ে গেছি।”

টুনি চিন্তিত মুখে বলল, “কাজটা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছি না, মনে হয় বড় বড় মানুষদের সাথে বেয়াদবি করে ফেলেছি!”

“করলে করেছ। কিন্তু একেবারে সত্যি কথা বলেছ। তুমি আসলেই ডিটেকটিভ এজেন্সির মেয়ে? ডিটেকটিভ এজেন্সিতে এত ছোট মেয়ে কাজ করে?”

টুনি ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “আমার ছোটাচ্চুর এজেন্সি। সেই জন্যে মাঝে মাঝে ছোটাচ্চুর জন্যে কাজ করে দেই। ছোটাচ্চু অবশ্যি খুবই বিরক্ত হয়। আজকে এখানে কি হয়েছে শুনলে মনে হয় আমাকে খুনই করে ফেলবে।”

আইরিন মেয়েটা হঠাৎ হি হি করে হাসতে শুরু করল, হাসতে হাসতে কোনোমতে বলল, “ফরতেক–” তারপর আবার হাসতে শুরু করল, হাসি আর থামাতে পারে না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। হাসি নিশ্চয়ই খুবই ছোঁয়াচে একটা বিষয়, তাই আইরিনকে দেখে টুনিরও হাসি পেয়ে গেল। এখন সেও একটু একটু করে হাসতে শুরু করল।

অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে আইরিন বলল, “কত দিন পর আমি হাসলাম। হাসতে কেমন লাগে ভুলেই গিয়েছিলাম।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন তুমি হাসতে ভুলে গিয়েছ?”

আইরিন মাথা নাড়ল, বলল, “অনেক জটিল ব্যাপার তোমাকে বললেও তুমি বুঝবে না।”

টুনি বলল, “ও।” তারপর চুপ করে গেল। একজনকে নিজে থেকে কথা বলতে দিতে হয়। মেয়েটা মনে হয় নিজে থেকেই বলবে তাই টুনি তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

দুইজন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে আইরিন একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “আইসক্রিম খাবে?”

টুনি মাথা নাড়ল, “খাব।”

আইরিন বলল, “টেনেটুনে আমার একটা আইসক্রিমের পয়সা হবে, দুইজনে ভাগাভাগি করে খেতে হবে।”

টুনির কাছে কিছু টাকা আছে, ইচ্ছে করলে দুইজন মিলে দুইটা আইসক্রিম খেতে পারে কিন্তু টুনি কিছু বলল না। দুইজন মিলে একটা আইসিক্রম খেলে মেয়েটা তাড়াতাড়ি তার কাছে সহজ হবে, একধরনের বন্ধুত্ব হয়ে যাবে।

টুনির ধারণা সত্যি, মেয়েটা একটুখানি খেয়ে টুনির হাতে আইসক্রিমটা দিয়ে বলল, “আমি যখন কোচিংয়ে আসি আম্মু আমাকে দরকার থেকে একটা পয়সা বেশি দেয় না।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে না।”

টুনি বলল, “তবু শুনি।”

“আমার আম্মুর ধারণা আমাকে দরকার থেকে বেশি টাকা দিলে আমি সেটা দিয়ে ড্রাগস কিনে খাব।”

কথা শুনে চমকে যাবার মতো টুনি একটা অনবদ্য অভিনয় করল। আইরিন বলল, “আমার আম্মুর যন্ত্রণায় জীবন শেষ। জিপিএ ফাইভ ছাড়া আম্মু আর কিছু বুঝে না।”

টুনি বলল, “সত্যি?”

আইরিন বলল, “জিপিএ ফাইভ নিয়ে তোমার আম্মু তোমাকে জ্বালায়?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ। আমি কোন ক্লাসে পড়ি আমার আব্বু আম্মু মনে হয় ভালো করে জানেও না।”

“সত্যি?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “সত্যি।”

“তোমাকে প্রাইভেট পড়তে হয় না? কোচিং যেতে হয় না?”

টুনি বলল, “মাথা খারাপ? আমাদের বাসায় আমরা সবাই একসাথে থাকি। কেউ প্রাইভেট পড়ে না, কোচিংয়ে যায় না। বাসার নিয়ম হচ্ছে নিজে পড়লে পড়ো না পড়লে নাই।”

আইরিন প্রায় আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করল, “না পড়লে নাই?”

টুনি মাথা নাড়ল। আইরিন খুব লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার উপর কী ভয়ানক চাপ তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আব্বু বেশি কিছু বলে না কিন্তু আম্মু আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। আমার গল্প বই পড়তে ভালো লাগে। আমার আম্মু বাসা থেকে সব গল্পের বই সরিয়ে দিয়েছে।”

“সত্যি?”

আইরিন মাথা নাড়ল। বলল, “সত্যি। আমার গল্প বই পড়তে এত ভালো লাগে কিন্তু আমাকে পড়তে দেয় না। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি। চুরি করে পড়ি।”

টুনি কোনো কথা বলল না। আইরিন বলল, “ভোররাতে আম্মু ঘুম থেকে ডেকে তুলে, প্রথমে এক জায়গায় প্রাইভেট পড়তে পাঠায়, সেখান থেকে আরেক জায়গায়। স্কুলের পর কোচিং, রাতে আবার প্রাইভেট। পরীক্ষার পর খুনের আসামির মতো আমাকে একটা একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে দেখে। আমার পড়ালেখা থেকে মন উঠে গিয়েছে, পড়তে ইচ্ছা করে না। পরীক্ষা দিতেও ভালো লাগে না। গত পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয় নাই তাই আম্মুর কী রাগ! পারলে আমাকে খুন করে ফেলে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা উঠতে-বসতে শুধু খোটা দিয়ে কথা।”

দুইজন কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে যায়। তারপর আইরিন বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলে টুনি আমি কি ঠিক করেছি?”

“কী ঠিক করেছ?”

চুল কেটে ছেলে সেজে শার্ট-প্যান্ট পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব।”

টুনি ভয়ানক চমকে উঠল, বলল, “পালিয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ, পালিয়ে যাব। একটা টেম্পুর হেল্পার হয়ে জীবন কাটিয়ে দিব। ভালো না আইডিয়াটা?”

টুনি মাথা চুলকাল, বলল, “ইয়ে মানে আমার মনে হয়—”

আইরিন বলল, “আমি এখনও কাউকে বলিনি আমার প্ল্যানটা। তোমাকেই প্রথমে বললাম।”

টুনি বলল, “থ্যাংকু।”

আইরিন অনেকটা নিজের মনে বলল, “আমি জানি কেউ যদি আমার প্ল্যানটা শুনে ভাববে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মাথা খারাপ হয় নাই। আমি যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে না যাই তাহলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আম্মুর অত্যাচারে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবেই যাবে। খোদার কসম।”

টুনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আইরিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি জানো আমার আম্মু কি করেছে?”

“কী করেছে?”

“আমি ড্রাগ খাই কি না দেখার জন্যে আমার পিছনে লোক লাগিয়েছে। পারলে ডিটেকটিভ লাগিয়ে দেবে।”

টুনি খুব অস্বস্তির সাথে নিজের মাথা চুলকে এদিক-সেদিক তাকাল। মেয়েটা যদি শুধু জানতে পারে তার মা ডিটেকটিভ সতি সত্যি লাগিয়ে দিয়েছে আর সে হচ্ছে সেই ডিটেকটিভ তাহলে মনে হয় মেয়েটা হার্টফেল করেই মরে যাবে!

দুজনে তখন হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানের সামনে এসেছে, টুনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “চলো আরেকটা আইসক্রিম খাই!”

“আরেকটা?”

“হ্যাঁ, আমার কাছে টেনেটুনে একটা আইসক্রিমের দাম হয়ে যাবে। আবার ভাগাভাগি করে খাব। আলাদা আলাদা খাওয়ার থেকে ভাগাভাগি করে খেতে বেশি মজা।”

আইরিন বলল, “ঠিকই বলেছ।”

তারপর তারা আরেকটা আইসক্রিম কিনে দুইজন ভাগাভাগি করে খেতে খেতে হাঁটতে থাকে। আইরিন বলল, “আমার পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যানটা কেমন মনে হচ্ছে?”

টুনি বলল, “মনে হয় ভালোই। তবে–”

“তবে কী?”

“এটা হোক প্ল্যান বি।”

“প্ল্যান বি?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আগে প্ল্যান এ কাজে লাগানো যাক। সেটা যদি কাজ না করে তখন প্ল্যান বি-তে যাবে।”

“প্ল্যান এ তাহলে কী হবে?”

“তুমি একটু আগেই বলেছ।”

আইরিন বলল, “আমি বলেছি?”

টুনি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, বলেছ।”

“কী বলেছি?”

“তুমি বলেছ তুমি যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে না যাও তাহলে পাগল হয়ে যাবে।”

“হ্যাঁ বলেছি। আসলেই পাগল হয়ে যাব।”

টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “তাহলে পাগল হয়ে যাচ্ছ না কেন? পাগল হয়ে যাও।”

“পাগল হয়ে যাব?”

“হ্যাঁ। ভান করো পাগল হয়ে যাচ্ছ।”

আইরিন কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হঠাৎ করে বুঝতে পারল টুনি কী বলছে। তার চোখ দুটো প্রথমে বড় বড় হয়ে গেল, সেখানে অবিশ্বাস, তারপর হঠাৎ করে তার সারা মুখ হাসির দমকে কেঁপে উঠল। শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে টুনির পিঠে একটা থাবা দিয়ে বলল, “হায় খোদা! তোমার মাথায় এত দুষ্টু বুদ্ধি!”

টুনি বলল, “না, আইরিন এটা দুষ্টু বুদ্ধি না। বড়দের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে একটা রাস্তা। বড়রা আমাদের বুঝতে পারে না তো, তাই মাঝে মাঝে এ রকম একটা-দুইটা বুদ্ধি বের করতে হয়।”

“তুমি আগেও এ রকম করেছ?”

টুনি মাথা নাড়ল, “করেছি। নিজের জন্যে করতে হয় নাই, অন্যদের জন্যে করেছি। যে রকম আজকে একটু আগে–”

“একটু আগে কী?”

“ঐ যে কোচিং ক্লাসে মাইক্রো ভয়েস রেকর্ডার দিয়ে রেকর্ড করেছি।”

আইরিন চোখ কপালে তুলে বলল, “ঐটা ভুয়া?”

“হ্যাঁ।”

“ডিটেকটিভ এজেন্সি? সেটাও ভুয়া?”

“না, ওটা সত্যি। আমার ছোটাচ্চুর আসলেই একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে। তবে ছোটাচ্চু কোচিং সেন্টারের দুই নম্বরি কাজকর্ম দেখার জন্যে আমাকে পাঠায় নাই।”

“তাহলে কী জন্যে পাঠিয়েছে?”

টুনি হঠাৎ করে বিপদে পড়ে গেল। ইচ্ছা করলেই সে বানিয়ে একটা উত্তর দিতে পারে, আইরিন কোনোদিন সেটা ধরতে পারবে না। কিন্তু যে মেয়েটার সাথে আইসক্রিম ভাগাভাগি করে খেতে খেতে বন্ধুর মতো গল্প করে করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে প্ল্যান এ দাঁড়া করাচ্ছে, তার সাথে কেমন করে মিথ্যা কথা বলে? তাই সে সত্যি কথাটাই বলল, “আইরিন, আমার এসাইনমেন্টটা তোমাকে বলা যাবে না।”

আইরিন হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টুনির দিকে তাকাল তারপর মেঘ স্বরে বলল, “তুমি আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে গিয়েছ? ঠিক কি না? আমার আম্মু তোমার ছোটাচ্চুকে আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে পাঠিয়েছে। সত্যি কি না বলো?”

টুনি ইচ্ছে করলেই হেসে কথাটা উড়িয়ে দিতে পারত কিন্তু সেটা করল না। অপরাধীর মতো মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি।”

আইরিন কয়েক সেকেন্ড টুনির দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি তাহলে আমার উপরে গোয়েন্দাগিরি না করে চলে যাচ্ছ কেন?”

ধরা যখন পড়েই গিয়েছে তখন সত্যি কথা বলাটাই ভালো। টুনি বলল, “আমার যা জানার দরকার জেনে গিয়েছি।”

“কী জেনেছ?”

“তুমি মোটেও ড্রাগ খাও না। লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ো। এখন পড়ছ এরিখ মারিয়া রেমার্কের লেখা থ্রি কমরেডস। একশ বাহান্ন পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়া হয়েছে। কোচিং ক্লাসের পিছনের শেলফের দ্বিতীয় তাকের পিছনে তুমি বইটা লুকিয়ে রাখো।”

আইরিন চোখ কপালে তুলে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “তুমি কেমন করে জানো?”

“কোচিংয়ের ঘরটাতে বসে বসে তোমাকে লক্ষ করেছি। খুবই সোজা। আজকে তুমি আসার আগে শেলফের পিছনে বইটা দেখেছি। একশ বাহান্ন পৃষ্ঠাটা ভাজ করা ছিল।”

টুনি কথা শেষ করে আইরিনের দিকে তাকাল তারপর বলল, “তুমি কী আমার উপর রাগ হয়েছ?”

আইরিন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, তোমার উপর রাগ হয়ে কী করব। রাগ হচ্ছে আমার আম্মুর উপর। আমাকে এইটুকু বিশ্বাস করে না। দেখেছ?”

টুনি আইরিনের পিঠে বন্ধুর মতো হাত রেখে বলল, “প্লিজ, তুমি আমার উপর রাগ হয়ো না। চলো এক জায়গায় বসে তোমার প্ল্যান এ ঠিকমতো রেডি করি, যেন কোনোদিন তোমার প্ল্যান বি পর্যন্ত যেতে না হয়। তোমার প্ল্যান বি খুবই ডেঞ্জারাস।”

আইরিন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “চলো।”

.

রাত্রে দাদির (কিংবা নানি) বসার ঘরে সবাই বসে নিজের কাজকর্ম করছে। এক কোনায় বসে বাচ্চারা খেলছে। ঝুমু খালা ট্রেতে করে তার বিখ্যাত পায়েশের মতো চা নিয়ে এসেছে, সবাই কাড়াকাড়ি করে সেটা খাচ্ছে, তখন ছোটাচ্চু বসার ঘরে ঢুকল। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বাঘের মতো গর্জন। করে বলল, “টুনি কই?”

টুনি বাচ্চাদের মাঝেই ছিল, চি চি করে বলল, “এই যে এইখানে।”

“এক্ষুনি আমার ঘরে আয়। তোর সাথে কথা আছে।”

কোচিং সেন্টারে গোলমাল পাকিয়ে বের হওয়ার পর টুনির সাথে আর ছোটাচ্চুর দেখা হয় নাই। তার মাঝে এত কিছু ঘটে গেছে যে ছোটাচ্চু রেগে যেতেই পারে। টুনির বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকে, কিন্তু সে খুবই শান্ত ভঙ্গিতে ছোটাচ্চুর পিছু পিছু তার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। বাচ্চারা সবাই উঠে দাঁড়াল তারপর তারাও লাইন বেঁধে টুনির পিছু পিছু ছোটাচ্চুর ঘরে রওনা দিল।

ছোটাচ্চু তার ঘরে ঢুকে পিঠ সোজা করে চেয়ারে বসল, তারপর বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি টুনিকে ডেকেছি। তোদের কাউকে ডাকিনি। তোর বের হ।”

বাচ্চারা কেউ বের হবার কোনো লক্ষণ দেখাল না। যে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। ছোটাচ্চু আবার গর্জন করল, “কী বলছি, কথা কানে যায় না? বের হ সবাই। গেট আউট।”

বাচ্চারা নড়ল না, ছোটাচ্চুর কথা না শোনার ভান করে দাঁড়িয়ে রইল। টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি যেটা বলতে চাও সবার সামনে বলে ফেলো। এই বাসায় সবাই সবকিছু জানে। কোনো গোপন জিনিস নাই।”

ছোটাচ্চু আস্তে আস্তে আরো রেগে উঠল, তারপর কঠিন গলায় বলল, “আজ সকালে কেন প্যারাগন কোচিং সেন্টার থেকে ফোন করে তোর কথা আমার কাছে জানতে চাইল? কেন?”

ছোটাচ্চু কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “কোচিং সেন্টার? ইয়াক থুঃ। ছি ছি ছি। ঘেন্না ঘেন্না। বমি করে দেই। টুনি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছে? হায় হায় হায়!”

টুনি বলল, “আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই নাই। ছোটাচ্চুর একটা কেস সলভ করার জন্যে ছোটাচ্চু আমাকে পাঠিয়েছিল।”

বাচ্চারা তখন একটু শান্ত হয়। একজন বলল, “তাই বলো!”

আরেকজন বলল, “ভিতরে কী রকম টুনি আপু? লোকজন কি চাবুক নিয়ে থাকে?”

“ব্রেন নষ্ট করার জন্য কী জানি ওষুধ খাওয়ায় সেইটা কি সত্যি?”

“যারা যায় তার নাকি আস্তে আস্তে জম্বির মতো হয়ে যায়?”

ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা তোদের ফালতু কথা বন্ধ করবি?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, তুই আমাকে বল, আজকে সন্ধেবেলা প্যারাগন কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমার সাথে টাকার বস্তা নিয়ে দেখা করতে এসেছে? কেন আমাকে বলছে গভর্নমেন্টকে রিপোর্ট না দিতে, তাহলে আমাকে সেই টাকার বস্তা দিয়ে দিবে! তুই কী করেছিস? কী বলেছিস তাদের?”

শান্ত আনন্দে চিৎকার করে বলল, “টাকার বস্তা? কোথায় ছোটাচ্চু টাকার বস্তাটা? আমাদেরকে দেখাও!”

আরেকজন বলল, “কত টাকা ভিতরে? গুনেছ?”

শান্ত বলল, “আমাদেরকে দাও ছোটাচ্চু, গুনে দেই! খোদার কসম এক টাকাও সরাব না।”

ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা কি ভেবেছিস আমি দুই নম্বরি মানুষ? কেউ টাকার বস্তা নিয়ে আসলেই আমি সেটা নিয়ে নেব?”

শান্ত বলল, “ঠিক আছে তুমি না নিলে, আমাদেরকে দিয়ে দাও! কী বলিস তোরা?”

বাচ্চারা মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু আরো রেগে উঠল বলল, “তোরা তোদের ফালতু কথা থামাবি?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি, তুই বল। কী হয়েছে?”

টুনি বলল, “ছোটাচ্চু। কিছুই হয় নাই। তুমি আইরিনকে ওয়াচ করার জন্য পাঠিয়েছ, আমি ওয়াচ করেছি। মেয়েটা খুবই সুইট। কোনোরকম সমস্যা নাই, গল্প বই পড়তে ভালোবাসে। বইয়ের শেলফে মোটেও ইয়াবা লুকিয়ে রাখে না, গল্পের বই লুকিয়ে রাখে। থ্রি কমরেডস, এরিখ মারিয়া রেমার্কের বই। এরিখ মারিয়া রেমার্ক চিনেছ তো? যে অল কোয়ায়েট ইন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট লিখেছিল।”

ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, “আমাকে তোর এরিখ মারিয়া রেমার্ককে চিনাতে হবে না। যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে। প্যারাগন কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমাকে টাকা ঘুষ দিতে চায়?”

টুনি হাত নেড়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো করে বলল, “ওটা কিছু না।”

“কিছু না মানে? কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমার কাছে টাকার বস্তা নিয়ে আসবে? কী করেছিস তুই?”

টুনি মাথা নাড়ল, “কিছু করি নাই। শুধু–”

“শুধু কী?”

“যে লোকটা মডেল টেস্ট নেয় তার উচ্চারণ খুব খারাপ। প্যারাগনকে বলে ফ্যারাগন, গোলাপ ফুলকে বলে গোলাফ পুল, প্রত্যেককে বলে ফরতেক–”

বাচ্চারা হি হি করে হাসতে থাকে তখন ছোটাচ্চু তাদেরকে একটা মেগা ধমক দিল, “চুপ করবি তোরা?”

বাচ্চারা চুপ করল। ছোটাচ্চু, “উচ্চারণ খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে?”

টুনি মাথা নাড়ল, “কিছু হয় নাই। কিন্তু যখন বলল, পরীক্ষার আগেই তারা পরীক্ষার প্রশ্ন দিয়ে দেবে–”

“তাই বলেছে?”

“না। বলেছে ফরীক্ষার ফ্রশ্ন–মানে পরীক্ষার প্রশ্ন।”

“তখন তুই কী করেছিস?”

“তখন আমি ভান করেছি তার কথা রেকর্ড করেছি। যখন আমার ভুয়া ভয়েস রেকর্ডার কেড়ে নিতে চেয়েছে তখন তোমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কথা বলে একটু ভয় দেখিয়েছি।”

বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, “ঠিক করেছে। টুনি ঠিকই করেছে। একশ বার!”

শান্ত বলল, “প্যারাগন কোচিং সেন্টারকে জ্বালিয়ে দিতে হবে।”

আরেকজন বলল, “জ্বালো জ্বালো। আগুন জ্বালো।”

অন্যেরা বলল, “ধ্বংস হোক। ধ্বংস হোক।”

তখন সবাই চিৎকার করে উঠল, “ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক।”

ছোটাচ্চু আরেকটা মেগা ধমক দিল, “চুপ করবি তোরা?”

বাচ্চারা চুপ করল তখন ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে এখন আমি কী করব?”

টুনি হাত উল্টে বলল, “তোমার ইচ্ছা!”

তারপর খুবই শান্ত ভঙ্গিতে ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হয়ে এলো। বাচ্চারাও তার পিছু পিছু বের হয়ে এলো। শান্ত চিৎকার করে বলল, “টুনি টুনি টুনটুনি–”

অন্যেরা চিৎকার করে বলল, “লাল গুলাফের শুভেচ্ছা!” তারপর সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল।

ছোটাচ্চুর ঘরে যখন এসব ঘটছে তখন আইরিনের বাসায় সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হতে শুরু করেছে।

আইরিনের আম্মু টেবিলে খাবার দিয়ে গলা উঁচু করে আইরিনকে খেতে ডাকলেন। আইরিন তার ঘরে, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। তখন আম্মু আবার ডাকলেন, এবারেও আইরিন কোনো জবাব দিল না। তখন আইরিনের আব্বু ডাকলেন, “আইরিন মা, খেতে আয়।”

এবারেও কোনো জবাব না শুনে আম্মু আর আব্বু দুইজনেই তার ঘরে গেলেন। দেখলেন আইরিন তার পড়ার টেবিলে পিঠ সোজা করে বসে আছে, হাতে একটা বই ধরে রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। আম্মু আইরিনের পিঠে হাত দিয়ে ডাকলেন, “আইরিন।”

আইরিন কেমন যেন ভয়ানকভাবে চমকে উঠে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী? কী? কী হয়েছে? কী হয়েছে আম্মু?”

আম্মু বললেন, “খেতে ডাকছি, শুনিসনি?”

“না আম্মু, অঙ্কটা মুখস্থ করছিলাম। শুনি নাই।”

“পরে মুখস্থ করবি। আয় খেতে আয়।”

আইরিন উঠে দাঁড়াল, তারপর অনেকটা রবোটের মতো হেঁটে হেঁটে খাবার টেবিলে গিয়ে পিঠ সোজা করে বসে রইল। চোখটা আধ-খোলা, ঠোঁট নড়ছে, কিছু একটা বিড়বিড় করে বলছে।

আম্মু আর আব্বু অবাক হয়ে আইরিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আব্বু বললেন, “খেতে বসেছিস, এখন খা, মা।”

আইরিন বলল, “খাব আব্বু।”

আম্মু প্লেটে ভাত দিলেন। আইরিন ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল, একটা একটা করে ভাত গুনতে লাগল।

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন “কী করিস?”

আইরিন গোনা থামিয়ে বলল, “কিছু করি না।”

আম্মু প্লেটে সবজি দিলেন। একটা বড় পাবদা মাছ দিলেন, আইরিনের পছন্দের মাছ। আইরিন সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে মাছটা খেতে গিয়ে থেমে গেল। মাথা নিচু করে প্লেটের সাথে প্রায় মাথাটা ছুঁইয়ে মাছের মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু ধমক দিয়ে বললেন, “কী করিস?”

“দেখো আম্মু। মাছটা কেমন করে তাকিয়ে আছে দেখেছ?”

আম্মু আবার ধমক দিয়ে বললেন, “মাছ আবার তাকিয়ে থাকে কেমন করে? খেতে বসেছিস খা।”

আইরিন মাছটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল, ডানে-বামে মাথাটা নাড়াল, তারপর খেতে শুরু করল। আম্মু ধমক দিলেন, বললেন, “ঢং করবি না। ঠিক করে খা।”

আব্বু বললেন, “আহ্, কেন বকছ! মেয়েটাকে খেতে দাও।”

আইরিন খাওয়া শেষ করে আবার টেবিলে বসে দুলে দুলে অঙ্ক মুখস্থ করতে লাগল। রাত বারোটার সময় আম্মু এসে দেখলেন তখনো আইরিন গুনগুন করে কিছু একটা পড়ছে। আম্মু নরম গলায় বললেন, “যা, এখন ঘুমাতে যা।”

আইরিন বলল, “আর দুইটা অঙ্ক মুখস্থ করে নিই আম্মু।”

আম্মু বললেন, “এখন ঘুমা, অনেক সকালে উঠতে হবে।”

“তাহলে আরেকটা অঙ্ক মুখস্থ করি? মাত্র একটা?”

“না। এখন ঘুমা।”

“পরে যদি গোল্ডেন ছুটে যায়?” কথা শেষ করে আইরিন কেমন জানি শিউরে উঠল।

আম্মু বললেন, “এখন ঘুমা।”

আইরিন তখন বাধ্য মেয়ের মতো ঘুমাতে গেল। এক দিনের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে।

.

পরের দিন স্কুল থেকে এসে আইরিন ব্যাগটা ঘরে রেখে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। আম্মু এসে বললেন, “কী হয়েছে? শরীর খারাপ?

“না আম্মু। একটু মনে মনে রিভিশন দিচ্ছি।”

“যা, গোসল করে খেতে আয়।”

আইরিন উঠে বাথরুমে গেল এবং আম্মু সাথে সাথে শাওয়ারের শব্দ শুনতে পেলেন। আম্মু অবাক হয়ে সাবধানে বাথরুমের দরজায় উঁকি দিলেন, দেখলেন স্কুলের পোশাক পরে আইরিন শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ঝরঝর করে পানি তার চুল মাথা বেয়ে কাপড় ভিজিয়ে পড়ছে। আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “কী করছিস তুই? কী করছিস?”

আইরিন জানতে চাইল, “কী করছি?”

“স্কুল ড্রেস পরেই গোসল করছিস?”

আইরিন অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকাল, তারপর জিভে কামড় দিয়ে বলল, “হায় হায়! কী বোকা আমি!”

আইরিন শাওয়ার থেকে বের হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু দেখলেন তার হাতে মার্কার দিয়ে লেখা গোল্ডেন ফাইভ! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হলো, হাতে গোল্ডেন ফাইভ লিখেছিস কেন?”

“যেন ভুলে না যাই। গোল্ডেন ফাইভ পেতেই হবে। তাই না আম্মু?”

আম্মু দুর্বল গলায় বললেন, “হ্যাঁ। পেতে হবে।”

আইরিন গলা উঁচিয়ে বলল, “পেতে হবে না। পেতেই হবে।”

আইরিনের পরিবর্তনটা খুবই স্পষ্ট। সারাক্ষণই বিড়বিড় করে কিছু একটা মুখস্থ করছে। কথা বললে একেবারে শুনতে পায় না। কয়েকবার ডাকাডাকি করলে হঠাৎ শুনতে পায় এবং তখন ভীষণভাবে চমকে ওঠে। খেতে বসলে অন্যমনস্কভাবে খেতেই থাকে। রাতে ঘুমায় না। বাসায় সব আলো জ্বালিয়ে হাতে একটা বই নিয়ে মুখস্থ করতে করতে সারা ঘরে ঘুরে বেড়ায়। বিড়বিড় নিজের মনে কথা বলে। একদিন গভীর রাতে রান্নাঘরে টুকটাক শব্দ শুনে আম্মু গিয়ে দেখেন বিশাল একটা ডেকচিতে পানি চাপিয়ে আইরিন সেখানে চাল দিয়ে পানি গরম করছে। আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “কী করছিস আইরিন?”

“ভাত রান্না করছি।”

“কেন?”

প্রশ্নটা শুনে আইরিন খুব অবাক হয়ে গেল, বলল, “কেন আম্মু? ভাত রান্না করতে হবে না?”

আম্মু বললেন, “না তোকে ভাত রান্না করতে হবে না। ঘুমুতে যা।”

আইরিন বলল, “ঘুমাতে পারি না আম্মু।”

“ঘুমাতে পারিস না?”

“না, ঘুমালেই স্বপ্ন দেখি পরীক্ষা দিচ্ছি আর একটা প্রশ্নের উত্তরও মনে পড়ছে না। সব ভুলে গেছি। তখন মনে হয় গোল্ডেন ফাইভ হবে না। তখন ভয়ে ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম আসে না।”

আম্মু বললেন, “তোকে কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।” •

আইরিন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, আম্মু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না। আমার কিছু হয় নাই। আমি ভালো আছি, একদম ভালো আছি। আমার কোনো ঝামেলা নাই আম্মু। আমি ভালো আছি।”

আম্মু তখন আইরিনকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেন। আইরিন লম্বা হয়ে চোখ খোলা রেখে শুয়ে থাকে।

.

সকালবেলা ডাইনিং টেবিলে আম্মু দেখলেন আইরিনের চোখ লাল (চোখ সাবান দিয়ে একটু ডলে দিলেই চোখ লাল হয়ে যায়। চোখের নিচে কালি (মার্কারের কালো রং হাতে লাগিয়ে চোখের নিচে ঘষে লাগানো হয়েছে) চুল এলোমেলো (হাত দিয়ে খিমচে খিমচে চুল এলোমেলো করা হয়েছে), চোখের দৃষ্টি উদ্ৰান্ত এবং ডান হাতটা একটু একটু কাঁপছে (এই দুটো অভিনয়)। আম্মু ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “কী হয়েছে আইরিন?”

আইরিন জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “কিছু হয় নাই আম্মু। কিছু হয় নাই।”

“রাতে ঘুম হয়েছে?”

“হ্যাঁ আম্মু হয়েছে। শুধু”

“শুধু কী?”

“শুধু সারারাত স্বপ্ন দেখেছি।”

“কী স্বপ্ন দেখেছিস?”

“পরীক্ষা হচ্ছে আর আমি কোনো উত্তর মনে করতে পারছি না। তখন–”

“তখন কী?”

“কলম দিয়ে যেটাই লিখি লেখা হয় গোল্ডেন ফাইভ। আমি কাগজের পাতায় শুধু লিখছি গোল্ডেন ফাইভ গোল্ডেন ফাইভ–”

আম্মু মুখ কালো করে বললেন, “গোল্ডেন ফাইভ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে?”

“ঠিকই বলেছ আম্মু।”

আইরিন বলল, “এত বাড়াবাড়ি করার কিছু নাই। কিন্তু–”

“কিন্তু কী?”

“আমি যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি লেখা আছে গোল্ডেন ফাইভ।”

আইরিন মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, তারপর বলল, “না আম্মু, এখন দেখছি না।”

আম্মু বললেন, “না দেখলেই ভালো।”

.

আইরিন স্কুলে যাবার পর আম্মু তার ঘরে গিয়ে চমকে উঠলেন, সারা দেওয়ালে মার্কার দিয়ে লেখা, গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ!

হঠাৎ করে আম্মু কেমন জানি অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। মনে হতে থাকে মেয়েটাকে চাপ দিয়ে বুঝি তার একটা বড় সর্বনাশ করে ফেলেছেন। আইরিনের বিছানায় বসে আম্মু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।

রাত্রে ছোটাচ্চু টুনিকে বললেন, “টুনি তোর মনে আছে তোকে আইরিন নামে একটা মেয়েকে ওয়াচ করার জন্যে একটা কোচিং সেন্টারে পাঠিয়েছিলাম?”

“মনে আছে ছোটাচ্চু।”

“সেই মেয়েটার খুব সিরিয়াস সমস্যা।” টু

নিকে খুব দুশ্চিন্তিত মনে হলো না। বলল, “কী সমস্যা?”

“মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যাচ্ছে?”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। তার মা আমাকে ফোন করেছিল। মেয়েটার ভয়াবহ অবস্থা।”

“কেন? কী করে?”

“প্রথমে দিন-রাত শুধু অঙ্ক মুখস্থ করত। তারপর দেখা গেল ঘুমাতে পারে না। তারপর–”

টুনি হাত তুলে বলল, “দাঁড়াও, আমি বলি। তারপর সারা রাত লাইট জ্বালিয়ে সারা বাসায় বই মুখস্থ করতে করতে ঘুরে বেড়ায়। স্কুলের পোশাক পরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। রাত্রেবেলা বড় ডেকচিতে ভাত রান্না করে, ঘরের দেওয়ালে লিখে রাখে গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ!”

ছোটাচ্চু হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন, কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “তু-তু-তুই কেমন করে জানিস?”

“কারণ এইটা হচ্ছে প্ল্যান এ। এরপর আইরিন সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করবে। কাউকে চিনবে না। আরো আছে। শুনতে চাও?”

“তার মানে আইরিনের আসলে কিছু হয়নি! পুরোটা অভিনয়?”

টুনি মাথা নাড়ল, “পুরোটা প্ল্যান এ। সে নিজে যেটা প্ল্যান করেছিল সেটা অনেক ডেঞ্জারাস। সেটা এখন প্ল্যান বি। অনেক বুঝিয়ে তাকে প্ল্যান এ’তে রাজি করিয়েছি। যদি এই প্ল্যান কাজ করে তাহলে প্ল্যান বি’তে যেতে হবে না। বুঝেছ?”

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, “তুই ভয়ঙ্কর ডেঞ্জারাস!”

“না ছোটাচ্চু আমি ডেঞ্জারাস না। তোমরা–বড় মানুষেরা হচ্ছ। ডেঞ্জারাস।”

“তুই কেমন করে এটা করলি? বেচারি মায়ের অবস্থা কী তুই জানিস? হাউমাউ করে কাঁদছে।”

টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি সব ঠিক করে দাও। মা’কে বোঝাও যেন আর কখনো গোল্ডেন ফাইভের জন্যে চাপ না দেয়। বোঝাও যেন আইরিনকে নিজের মতো করে লেখাপড়া করতে দেয়, গল্পের বই পড়তে দেয়, প্রাইভেট কোচিং থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। বোঝাও তাহলে আইরিন ঠিক হয়ে যাবে।”

ছোটাচ্চু তখনো হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। আবার বিড়বিড় করে বলল, “টুনি! তুই সাংঘাতিক ডেঞ্জারাস।”

টুনি কথা না শোনার ভান করে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি এখনই আইরিনের আম্মুকে ফোন করো। এক্ষুনি।”

ছোটাচ্চু ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে করছি।”

.

দুই দিন পর সবাই বসার ঘরে বসে আছে, দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশনে বাংলা সিরিয়াল দেখছেন। বড় চাচা খবরের কাগজ পড়ছেন। কয়েকজন চাচি-খালা রাজনীতি নিয়ে তর্ক করছেন, ঝুমু খালা ডালপুরী ভেজে এনেছে, বাচ্চারা সেগুলো কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে, ঠিক তখন ছোটাচ্চু বিশাল একটা কেক নিয়ে হাজির হলো। বাচ্চারা আনন্দে হই হই করে উঠল। কেকটা নিয়ে টানাটানি করতে থাকল। একজন বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু, থ্যাংকু!”

ছোটাচ্চু বলল, “আমাকে থ্যাংকু দিতে হবে না। থ্যাংকু যদি দিতে চাস আমার একজন ক্লায়েন্টকে থ্যাংকু দে। আইরিন নামে একটা মেয়ের মা এই কেকটা নিয়ে এসেছে।”

কেকটাকে বাক্স থেকে বের করতে করতে একজন জিজ্ঞেস করল, “কেন কেক এনেছে আইরিনের মা?”

“লেখাপড়ার প্রচণ্ড চাপে মেয়েটার নার্ভাস ব্রেক ডাউনের মতো হয়েছিল। আমি তখন মাকে কয়েকটা আইডিয়া দিলাম, সেই আইডিয়া মতো কাজ করার পর মেয়েটা পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে!”

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কী আইডিয়া দিয়েছিলে ছোটাচ্চু?”

“পড়াশোনার কোনো চাপ না দিতে। যেটা পছন্দ করে সেটা করতে দিতে। বইয়ের দোকানে গিয়ে অনেকগুলো গল্পের বই কিনে সেগুলো পড়তে দিতে, প্রাইভেট কোচিং এসব থেকে সরিয়ে নিতে। এই রকম কয়েকটা আইডিয়া।”

শান্ত বলল, “এইগুলো তো সবাই জানে-আমিও দিতে পারতাম।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “আইরিনের মা সবগুলো আইডিয়া শুনেছে?”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “সব। মেয়েটাকে নিয়ে অফিসে এসেছিল। হাসি-খুশি সুইট একটা মেয়ে। তোর মতো বড় বড় চশমা। হাতে মোটা একটা বই।”

টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার মুখটা একটু নামাবে?”

“কেন?”

“আগে নামাও।”

ছোটাচ্চু মুখটা নামাল তখন টুনি ছোটাচ্চুর দুই গালে দুইটা চুমু দিয়ে বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু।”

একজন জিজ্ঞেস করল, “কী জন্যে থ্যাংকু টুনি?”

টুনি কিছু বলার আগেই শান্ত বলল, “কী জন্যে আবার! এত বড় একটা কেক এনেছে সেই জন্যে। তাই না টুনি?”

টুনি ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, ছোটাচ্চু খুব সাবধানে কেউ যেন দেখতে পায় সেভাবে টুনির দিকে তাকিয়ে একটু চোখ টিপে দিল। টুনি তখন শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। কেকটার জন্যে। এইটা আমার সবচাইতে ফেভারিট কেক!”

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল