হ্যাকার

বসার ঘরে দাদি বসে টেলিভিশন দেখছেন, কী কারণে তার পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা এবং সেটা নিয়ে ঝুমু খালার উৎসাহের সীমা নেই। কী একটা গাছের পাতা হেঁচে ঝুমু খালা দাদির পায়ে মাখিয়ে দিয়েছে সে কারণে দাদির শরীর থেকে ঝাঁঝালো একধরনের গন্ধ বের হচ্ছে। বসার ঘরে যে-ই ঢুকছে ঝুমু খালা তাকেই তার এই টোটকা ওষুধের গুণগান শুনিয়ে যাচ্ছে। বলছে, “এই যে খালার পায়ে ধানকুচি গাছের পাতা ঘেঁচে দিছি, এই ওষুধ হচ্ছে ধন্বন্তরী।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “ধন্বন্তরী মানে কী?”

ঝুমু খালা মাথা চুলকে বলল, “ধন্বন্তরী মানে হচ্ছে ওষুধের বাবা ওষুধ।”

দাদি তখন একটু শুধরে দিলেন, বললেন, “ভালো ডাক্তার হচ্ছে। ধন্বন্তরী।”

ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “একশবার। ওষুধের বাবা ওষুধ হচ্ছে। ডাক্তার। ধন্বন্তরী ডাক্তার।”

মুনিয়া বলল, “কিন্তু দাদির শরীর থেকে কেমন যেন শুঁটকি মাছের মতো গন্ধ বের হচ্ছে।”

ঝুমু খালা বলল, “এই গন্ধ হচ্ছে চিকিৎসা। যত ভালো চিকিৎসা তত বেশি গন্ধ। খালারে জিজ্ঞেস করে দেখ তার পায়ের ব্যথা কমেছে কি না। জিজ্ঞেস করো।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “দাদি, তোমার পায়ের ব্যথা কমেছে?”

দাদি কী আর বলবেন, মাথা নাড়লেন, “মনে হয়ে কমছে।”

ঝুমু খালা বলল, “কাগজ আনন, লিখে দেই। কাল সকালে খালা যদি এই ঠ্যাং দিয়ে লাথি মেরে একটা থান ইট গুঁড়া করতে না পারেন তাহলে আমার নাম ঝুমু না।”

“তাহলে তোমার নাম কী ঝুমু খালা?”

ঝুমু খালা আবার মাথা চুলকাল, “তাহলে আমার নাম–তাহলে আমার নাম–”

ঝুমু খালার অবশ্যি নামটা বলতে হলো না, তার আগেই ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। বাচ্চারা তাকে দেখে হতাশার মতো একটা শব্দ করল, বলল, “ছোটাচ্চু। হায় হায়!”

ছোটাচ্চু বলল, “কী হয়েছে?”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “তুমি আজকে কিছু আনো নাই?”

“কী আনব?”

“এই তো, কেক, না-হয় পিজা, না-হয় ফ্রাইড চিকেন–”

টুম্পা যোগ করল, “না-হলে চকলেট না-হলে আইসক্রিম–”

ছোটাচ্চু বলল, “তোদের হয়েছে কী? সারাক্ষণ খালি খাই খাই করিস? বাসায় কি তোদের খেতে দেয় না?”

ঝুমু খালা ঝংকার দিয়ে বলল, “খেতে দেই না মানে? খাবার টেবিলে কেউ কিছু খায়? সবজি ভালো লাগে না, মাছে গন্ধ, ভর্তা ঝাল, মুরগি নরম, গোশত শক্ত, ডাল পাতলা–এরা কেউ কিছু খায়? খাবার জিনিস কিছু খায় না। খাওয়ার মধ্যে খালি আসইক্রিম আর কেক! তা যদি না-হয় তাহলে মনে হয় বাতাস খায়। বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকে!”

টুম্পা বলল, “ঝুমু খালা, আমরা এখন বাতাসও খেতে পারব না। বাতাসে শুঁটকি মাছের গন্ধ।”

টুম্পার কথা শুনে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে। ছোটাচ্চু এদিক সেদিক কে বলল, “ঠিকই তো বলছিস। ঘরে গন্ধ কীসের?”

টুম্পা বলল, “ঝুমু খালার ধন্বন্তরী ওষুধ। দাদির পায়ে লাগিয়েছে। কালকে দাদি এই পা দিয়ে লাথি মেরে থান ইট গুঁড়া করবে! তাই না দাদি?”

দাদি কিছু বলার আগেই ঝুমু খালা বলল, “একশবার। কাগজ আনো, লিখে দেই।”

শান্ত আবার শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু ছোটাচ্চু তোমার কাজটা ঠিক হচ্ছে না। খাওয়া-দাওয়া কিছু আনো না–”

ছোটাচ্চু বলল, “শুধু খাই খাই করবি না। খাওয়ার বাইরেও একটা দুনিয়া আছে।”

“কী আছে?”

“এই দেখ।” বলে ছোটাচ্চু তার পকেট থেকে একটা কার্ড বের করল।

সবাই কার্ডটা দেখার জন্যে এগিয়ে যায়। টুনি জিজ্ঞেস করল, “এটা কীসের কার্ড?”

“পেইন্টিং এক্সিবিশান। আমার এক বন্ধু আছে, তার একক চিত্র প্রদর্শনী।”

শান্ত বলল, “বুঝেছি। মডার্ন আর্ট। আগা-মাথা কিছু নাই। তাই না ছোটাচ্চু?”

ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলবি না। আগা-মাথা কেন থাকবে না?”

শান্ত বলল, “আমি একবার গিয়েছিলাম, সব ছবি কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং, কোনো আগা-মাথা নাই। কিছু বুঝি নাই।”

টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, ছবি বোঝার চেষ্টা কোরো না, ভালো লাগলে দেখবে ভালো না লাগলে দেখবে না। ধরে নেবে তুমি এই লাইনের মানুষ না। সবাই সব লাইনের মানুষ হয় না।”

শান্ত বলল, “সেইটা ঠিক বলেছিস। আমি এই লাইনের মানুষ না।”

ছোটাচ্চু বলল, “তোরা কে কে আমার বন্ধুর আর্ট এক্সিবিশনে যেতে চাস?”

টুনি বলল, “আমি।”

টুনির দেখাদেখি টুম্পা বলল, “আমি।”

সাথে সাথে মুনিয়া বলল, “আমি।”

শান্ত বলল, “চা-নাস্তা খাওয়ালে আমিও যেতে পারি।”

ছোটছু বলল, “ঠিক আছে কালকে বিকালে রেডি থাকিস, আমি নিয়ে যাব।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে।”

.

পরের দিন বিকালবেলা ছোটাচ্চুর দেখা নেই, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে টুনি ছোটাচ্চুকে ফোন করল, ছোটাচ্চু তখন খুব ব্যস্ত হয়ে বলল, “কী সর্বনাশ! আমি কি বলেছিলাম তোদের নিয়ে আর্ট এক্সিবিশন দেখতে যাব?”

টুনি ঠান্ডা গলায় বলল, “হ্যাঁ, ছোটাচ্চু। আমরা তোমার জন্যে সেজেগুঁজে অপেক্ষা করছি!”

ছোটাচ্চু বলল, “বুঝলি টুনি, আমি একটা খুবই জরুরি কাজে আটকা পড়ে গেছি। একটা খুবই ইম্পরটান্ট কেস এসেছে, আমি না থাকলে হবেই না।”

টুনি তার গলার স্বর একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা করে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি আমাদেরকে বলেছ আমাদের নিয়ে যাবে, আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করে অপেক্ষা করছি।”

ছোটাচ্চু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কিন্তু ইমার্জেন্সি তো ইমার্জেন্সি।”

টুনি বলল, “মোটেও ইমার্জেন্সি না। সত্যি কথাটা বলো যে তুমি ভুলে গেছ।”

“হ্যাঁ, মানে ইয়ে সেটাও একটু হয়েছে–” ছোটাচ্চু গলার স্বর হঠাৎ করে পাল্টে বলল, “তোরা একটা কাজ কর।”

“কী কাজ?”

“তোরা একটা সি.এন.জি. করে আমার অফিসে চলে আয়, আমি কাজ শেষ করে তোদেরকে নিয়ে এক্সিবিশানে চলে যাব।”

টুনি বলল, “আমরা চলে আসব?”

“হ্যাঁ চলে আয়।”

টুনি বলল, “আচ্ছা দেখি।” তারপর টেলিফোনটা রেখে দিল।

শান্ত বলল, “আমার আর কাজ নাই? আমি কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং দেখার জন্যে এখন আন্ডা-বাচ্চাদের নিয়ে সি.এন.জি. করে ছোটাচ্চুর অফিসে যাই? আমার এত ঠ্যাকা পড়ে নাই।”

টুম্পা বলল, “কাগের ঠ্যাং না কাকের ঠ্যাং?”

“একই কথা।”

মুনিয়া বলল, “আসলেই কাকের ঠ্যাং?”

শান্ত বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ পুরো কাকের ঠ্যাং। ছোটাচ্চুকে একটু খুশি করার জন্যে যেতে রাজি হয়েছিলাম। আসলে কি যেতে চাই নাকি? কক্ষনো যেতে চাই না।”

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “যেতে চাও না?”

শান্ত বলল, “খবরদার তোরাও যাবি না। গেলেই দেখবি বড় মোটা মোটা ফর্সা ফর্সা মানুষেরা পাঞ্জাবি পরে ঢং করে লম্বা লম্বা কথা বলছে! তোদের কোনো পাত্তাই দিবে না। উল্টো ধমক দেবে, বলবে, এই বাচ্চা এখানে কী করো? সরে যাও।”

“সত্যি?”

“একশ ভাগ সত্যি।”

আর্ট এক্সিবিশানের এই ভয়ংকর বর্ণনা শুনে মুনিয়া পিছিয়ে গেল। মুনিয়াকে পিছিয়ে যেতে দেখে টুম্পাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলল, তখন বাকি থাকল শুধু টুনি। টুনির যে খুব যেতে ইচ্ছে করছিল তা নয় কিন্তু ছোটাচ্চুকে ঠিক লাইনে রাখার জন্যে টুনি ঠিক করল সে একাই যাবে। তাদের বাসার কাছের বাস স্ট্যান্ড থেকে একটা বাসে করে খুব সহজে ছোটাচ্চুর অফিসে যাওয়া যায়।

কাজেই কিছুক্ষণের মাঝেই টুনি ছোটাচ্চুর অফিসে পৌঁছে গেল, এখানে সে আগে অনেকবার এসেছে। অফিসের সবাই তাকে চিনে। রঞ্জনা তাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, “আরে আমাদের বড় ডিটেকটিভ চলে এসেছে! আমাদেরকে কি ভুলে গেছ নাকি?”

টুনি বলল, “না রঞ্জনাপু, তোমাদেরকে মোটেই ভুলিনি। ছোটাচ্চু আমাদের নিয়ে আসে না।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। আজকে কি হয়েছে জানো? ছোটাচ্চু বলেছে আমাদের বাসা থেকে নিয়ে আসবে, তারপর ভুলে গেছে।”

রঞ্জনা হি হি করে হেসে বলল, “আমাদের অফিসে সব সময় এটা হয়। এখানে সবাই সবসময় সবকিছু ভুলে যায়।”

টুনি বলল, “ছোটাচ্চুর অফিসে কেউ আছে?” “হ্যাঁ, একটা ফ্যামিলি আছে। তুমি ভিতরে যাও, কোনো সমস্যা নেই।”

টুনি তখন ছোটাচ্চুর অফিসের দরজা খুলে তার অফিসে উঁকি দিল। ছোটাচ্চু একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উল্টোপাশে গদি আঁটা একটা চেয়ারে খুব কায়দা করে বসে আছে, টেবিলের সামনে কমবয়সী একজন পুরুষ আর মহিলা, পাশের চেয়ারে ছয়-সাত বছরের একটা ছেলে, সে খুবই বিরক্ত মুখে বসে আছে।

ছোটাচ্চু টুনিকে দেখে মুখে খুব একটা ভাব ফুটিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “ও, টুনি এসেছিস?”

ছোটাচ্চুর ভাব দেখে টুনির হাসি পেয়ে গেল কিন্তু টুনি হাসল না, সেও গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ, ছোটাচ্চু আমি এসেছি।”

“আয়। অন্যেরা কই?”

“আর কেউ আসেনি।”

“আর কেউ আসিনি? কী আশ্চর্য! আর্টে কারো ইন্টারেস্ট নেই?”

এটা এমন কিছু আশ্চর্য না কিন্তু ছোটাচ্চু ভান করল সে খুবই অবাক হয়েছে। গম্ভীর মুখে বলল, “ঠিক আছে টুনি, তুই একটু অপেক্ষা কর, আমি এই ফ্যামিলির সাথে একটু কথা বলে নেই।”

টুনি মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”

তারপর ছোটাচ্চুর অফিসের অন্য পাশে বসে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে সেটা দেখার ভান করে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল তারা কী নিয়ে কথা বলছে। তার এরকম কথা শুনতে খুব মজা লাগে।

ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ, আপনারা জানি কী বলছিলেন?”

মহিলাটি বলল, “জি, আমি বলছিলাম যে আমাদের কাছে খুবই আজব মেসেজ আসতে শুরু করল।”

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আজব মানে কী রকম?”

অনেকটা এ রকম, “ফেসবুক করা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই? কিংবা ফেসবুকে সময় নষ্ট না করে একটা বই পড়ো। কিংবা, ফেসবুক না আসল বুক? আসল বুক আসল বুক। এই রকম ম্যাসেজ।”

ছোটাচ্চু বলল, “ও, আচ্ছা, কোনোরকম ভয়-ভীতি দেখায় না?”

“না। কিন্তু আমাদের যথেষ্ট বিরক্ত করেছে। তখন আমরা এই মানুষটাকে ব্লক করে দিলাম, ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে সরিয়ে দিলাম। এক-দুই দিন শান্তিতে ছিলাম তারপর আবার শুরু হলো। নতুন একটা ফ্রেন্ড কিন্তু বোঝা গেল একই মানুষ। আমাদের জ্বালাতন শুরু করল, মাঝে মাঝে একটু ভয়ও দেখায়, বলে, ফেসবুক বন্ধ না করলে তোমাদের উপর মহাবিপদ হবে, সাবধান।”

ছোটাচ্চু বলল, “আপনারা কি আসলেই অনেক ফেসবুক করেন?”

এবারে পুরুষ মানুষটা বলল, “তা একটু করি। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। বাসায় আসার পর একটু রিলাক্সেশন।”

ছোটাচ্চু বলল, “কী করেন ফেসবুকে?”

“এই তো স্ট্যাটাস দেই, শেয়ার দেই। লাইক দেই। ছবি আপলোড করি। সেলফি আপলোড করি।”

“দুজনেই?”

“জি।”

মহিলাটি বলল, “আমার ফ্রেন্ড বেশি ওর থেকে।”

মানুষটা একটু রেগে গেল, বলল, “তুমি একজন মহিলা, মহিলার ফ্রেন্ড বেশি হবে না। তুমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেই সবাই এক্সেপ্ট করে।”

“তুমি ঠিক করে রিকোয়েস্ট পাঠাও, না করেছে কে?”

পুরুষ আর মহিলাটা ঝগড়া শুরু করে দিচ্ছিল, তখন ছোটাচ্চু তাদের থামিয়ে দিল, বলল, “আপনারা দিনে কত ঘণ্টা ফেসবুক করেন?”

“সাত-আট ঘণ্টা হবে।”

ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “সাত-আট ঘণ্টা?”

“হ্যাঁ। ল্যাপটপ তো খোলা থাকে। একটু পরে পরে দেখি নতুন ছবিতে লাইক পড়েছে কি না। বুঝতেই পারেন নেশার মতো হয়ে গেছে।”

ছোটাচ্চু বলল, “তাহলে তো সমস্যাটা আপনাদের। সবরকম কাজকর্ম বন্ধ করে যদি শুধু ফেসবুক করেন তাহলে কেমন করে হবে?”

মহিলাটা বলল, “আমরা কী করি না করি সেটা আমাদের ব্যাপার, অন্যেরা সেখানে নাক গলাবে কেন? আমরা আপনার কাছে এসেছি অন্য ব্যাপারে। মানুষটা কে বের করে দেন। যতই চেষ্টা করি এই মানুষটাকে খসাতে পারছি না। ব্লক করে দিলে নতুন একাউন্ট থেকে জ্বালাতন শুরু করে।”

ছোটাচ্চু বলল, “মেনে নেন। মানুষটা তো খারাপ কিছু করে না, আপনাদেরকে ফেসবুক না করার জন্যে উপদেশ দিচ্ছে, ভালো উপদেশ। খুব ভালো উপদেশ।”

“কিন্তু মানুষটা কে সেটা বের করতে চাই। কীভাবে কীভাবে জানি আমাদের সব খবর জেনে যায়। আপনার এখানে আসার আগে আমাদের কি লিখেছে জানেন?”

“কী?”

“লিখেছে আমাকে ধরার জন্যে টিকটিকির কাছে যাচ্ছ? টিকটিকির বাবার সাধ্য নাই আমাকে ধরবে! হা হা হা।”

“তাই লিখেছে? টিকটিকি?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, এই মানুষটা জানল কেমন করে?” ছোটাচ্চু মাথা চুলকাল, বলল, “ইন্টারেস্টিং! সব খবর জেনে যায়।”

টুনি চোখের কোনা দিয়ে এই আজব পুরুষ এবং মহিলা দুজনকে দেখল। পাশে তাদের ছোট বাচ্চাটা বিরস মুখে বসে আছে, তাদের বাবা-মায়েরা কী নিয়ে কথা বলছে সেটা নিয়ে কোনো কৌতূহল নেই, মুখে রাজ্যের বিরক্তি। বাচ্চাটার জন্যে তার খুব মায়া লাগল, টুনি ভাবল তাকে এই জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে তার সাথে একটু কথাবার্তা বলা যাক।

সোফা থেকে উঠে গিয়ে সে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে বলল, “তুমি কী আমার সাথে আসবে?”

বাচ্চাটা কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। বোঝাই গেল সে এখান থেকে ওঠার জন্যে এক পায়ে খাড়া। বাবা-মায়ের কথাবার্তা তার স্নায়ুর বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাচ্চাটাকে নিয়ে কিছু একটা দেখা। বেচারা একেবারে বোর হয়ে যাচ্ছে।”

টুনি মনে মনে বলল, “বোর নয়। বলো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”

ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হতে হতে টুনি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

ছেলেটা বলল, “রাফী।” টুনি এবারে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়ো।”

“তোমার স্কুলটা ভালো?”

ছেলেটা হা-সূচকভাবে মাথা নাড়ল।

“তোমার স্কুলের স্যার-ম্যাডামেরা বকা দেয়?”

ছেলেটা না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। বোঝা যাচ্ছে যতটুকু সম্ভব কম কথা বলে কাজ চালিয়ে নিতে চায়।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কিছু খাবে?”

ছেলেটা না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কোনো ড্রিংকস খাবে? কোক, পেপসি?”

এবারে হা-সূচকভাবে মাথা নাড়া। টুনি রঞ্জনাপুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রঞ্জনাপু, তোমাদের অফিসে কি কোক না হলে পেপসি আছে?”

রঞ্জনা কম্পিউটারে কাজ করছিল, মনিটরের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে বলল, “থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। আমাদের ফ্রিজ বোঝাই জাংকফুডে। আমরা জাংকফুড ছাড়া কিছু খাই না। কিচেনের ফ্রিজ থেকে নিয়ে নাও।”

টুনি ছেলেটাকে বলল, “চলো, তোমাকে কোল্ড ড্রিংকস দিই। ছেলেটা রঞ্জনার কম্পিউটার মনিটরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। টুনির কথা শুনল বলে মনে হলো না। টুনি তখন আবার ডাকল, “রাফী–”

ছেলেটা মনে হলো কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, তারপর টুনির পিছু পিছু কিচেনের দিকে হেঁটে যেতে লাগল।

টুনি এর আগে কোনো অফিস দেখেনি, তাই অফিস কী রকম হয় জানে না। ছোটাচ্চুর অফিসে একটা কিচেন আছে, সেই কিচেনে ফ্রিজ আর মাইক্রোওয়েভ আছে। টুনি ফ্রিজ খুলে একটা কোকের বোতল বের করে রাফীকে খানিকটা ঢেলে দিল, নিজে খানিকটা নিল। চুকচুক করে কোক খেতে খেতে টুনি আবার ছেলেটার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল, জিজ্ঞেস করল, “তোমার আরো ভাই-বোন আছে?”

ছেলেটা কথা না বলে খাওয়া চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। টুনির প্রশ্নের উত্তরে না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল।

“তুমি একা?”

এবারে হা-সূচকভাবে মাথা নাড়া।

“তার মানে তোমার আব্বু-আম্মুর পুরো আদরটা তুমি পাও?”

“পাও না?”

আবার না-সূচক।

“কেন পাও না?”

“আব্বু-আম্মু সারাক্ষণ ফেসবুক করে।” এই প্রথম ছেলেটি একটা পুরো বাক্য বলল। বাক্যটি যেভাবে উচ্চারণ করল বোঝা গেল আব্বু-আম্মুর এই কাজটি তার মোটেও পছন্দ নয়।

টুনি কী বলবে বুঝতে পারল না, বলল, “ও!” তারপর চুপ করে গেল, ছেলেটার সাথে আর কথা বলার চেষ্টা করল না।

কোক খাওয়া শেষ করে দুজনে কিচেন থেকে বের হয়ে আসে। রঞ্জনা তখনো ভুরু কুঁচকে কম্পিউটারের মনিটরটির দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে। রাফী নামের ছোট ছেলেটা সোজা রঞ্জনার দিকে হেঁটে গেল। রঞ্জনার পিছনে দাঁড়িয়ে সে কম্পিউটার মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন যখন কম্পিউটারে কাজ করে তখন যে পিছনে দাঁড়িয়ে তার মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না মনে হয় সেটা এই বাচ্চাটা শিখেনি। সে কোনোরকম ভান না করে সোজাসুজি বেশ কৌতূহল নিয়ে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

টুনি দেখল মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থেকে রঞ্জনা কেমন একটা যন্ত্রণার মতো শব্দ করল।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রঞ্জনাপু?”

“আমি করতে পারছি না।”

“কী করতে পারছ না?”

“নেট থেকে ফাইলটা নামাতে পারছি না। ফরমে ভেঙে যাচ্ছে।”

বিষয়টা কী টুনি বুঝতে পারল না তাই সে কিছু বলল না। কিন্তু রঞ্জনার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাফী নামের স্বল্পভাষী ছেলেটা বলল, “তোমার ওএস পুরানা। আপডেট না করলে পারবে না।”

রঞ্জনা এবং টুনি দুইজন একসাথে ছেলেটার দিকে তাকাল, এইটুকুন ছেলে একেবারে বড় মানুষের মতো কথা বলছে! রঞ্জনা জিজ্ঞেস করল, “কী বললে তুমি?”

“তোমার ওএস পুরানা।”

“ওএস মানে কী?”

“অপারেটিং সিস্টেম।”

“তুমি কেমন করে জানো?”

“আমি জানি।” বলে সে চুপ করে গেল।

রঞ্জনা জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করতে হবে?”

“নতুন ওএস ডাউনলোড করো। তোমাদের নেট অবশ্যি স্লো। সময় লাগবে।”

টুনি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকাল, এইটুকুন ছেলে এত কিছু কেমন করে জানে! শুরুতে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে শুধু মাথা নেড়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এখন টকটক করে কথা বলছে!

রঞ্জনা বলল, “তার মানে এখন আমি কিছু করতে পারব না?”

বাচ্চা ছেলেটা কিছুক্ষণ মুখ সুচালো করে কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “একটা প্লাগ ইন আছে, ডাউনলোড করে দেখতে পারো। নিজে নিজে ইনস্টল করতে পারবে না?”

রঞ্জনা মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। আমি খালি কম্পিউটারের সুইচ অন করতে পারি আর প্রোগ্রামের উপর কার্সর রেখে ক্লিক করতে পারি।”

রাফী জিজ্ঞেস করল, “আমি করে দিব?”

“তুমি?”

“হ্যাঁ। করে দিব?”

রঞ্জনা একটু ইতস্তত করে বলল, “ঠিক আছে। করে দাও।”

“কাউকে বলবে না তো?”

রঞ্জনা অবাক হয়ে বলল, “কী বলব না?”

“এই যে আমি করে দিচ্ছি।”

“তুমি যদি চাও তাহলে বলব না।”

রঞ্জনা তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, রাফী তখন সেই চেয়ারে বসল, তারপর ঝড়ের বেগে মাউস আর কি-বোর্ডে হাত নাড়তে শুরু করে দেয়। টুনি হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

.

মিনিট দশেক পর রাফী যখন কাজ শেষ করে এনেছে তখন টুনি রাফীর কাছে গিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “তোমার আব্বু আর আম্মুর ফেসবুকে তুমি ঐ মেসেজগুলো পাঠাও? তাই না।”

রাফী এক সেকেন্ডের জন্যে কাজ থামিয়ে টুনির দিকে তাকাল। টুনি গলা নামিয়ে বলল, “কোনো ভয় নাই। কাউকে বলে দিব না।”

“খোদার কসম?”

“খোদার কসম।”

রাফী এবার একগাল হাসল, বলল, “হ্যাঁ। ম্যাসেজ পাঠিয়ে কোনো লাভ হয় নাই। এখন কী করব জানো?”

“কী?”

“তাদের ল্যাপটপের ওএস ক্র্যাশ করিয়ে দেব। একটা ফাটাফাটি ম্যালওয়ার আছে–”

.

আরো মিনিট দশেক পর রাফীর আব্বু-আম্মু বের হয়ে এলো। রাফী তখন টুনির সাথে বসে কিচেনে তার দ্বিতীয় গ্লাস কোক খাচ্ছে।

ছোটাচ্চু কিচেনে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “টুনি, বাচ্চাটাকে ছেড়ে দে। বাসায় যাবে।”

“ঠিক আছে ছোটাচ্চু।”

“এখানে তো কোনো খেলনা নেই, বাচ্চাটাকে কেমন করে ব্যস্ত রাখলি?”

“সমস্যা হয়নি। রঞ্জনা আপু অনেক সাহায্য করেছে।”

“গুড।”

রাফী তার আবু-আম্মুর পিছু পিছু অফিস থেকে বের হয়ে গেল। টুনি দেখল মুখটি খুবই বিরস। ভালো করে লক্ষ করলে অবশ্যি বিরস মুখের আড়ালে কৌতুকের চেহারাটাও বোঝা যায়।

.

ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে তার বন্ধুর পেইন্টিং এক্সিবিশানে যাওয়ার সময় বলল, “বুঝলি টুনি, দেশে সাইবার ক্রাইম খুব বেড়ে গেছে।”

টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “সাইবার ক্রাইম?”

“হ্যাঁ। মানে কম্পিউটারের ক্রাইম। আমাদের কাছে রোজ এক-দুইজন ক্লায়েন্ট আসে। আজকে যে রকম এসেছিল।”

টুনি কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা এটা সামাল দিতে পারি না। সামাল দিতে হলে কম্পিউটার এক্সপার্ট দরকার। অনেক বেতন দিয়ে এক্সপার্ট নিতে হবে।”

টুনি একবার ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কাছে খুব ভালো একজন এক্সপার্ট আছে। তোমার দরকার লাগলে বোলো।”

ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “সিরিয়াসলি একটা কথা বললাম আর তুই সেটা নিয়ে ইয়ারকি শুরু করলি! তোর কাছে এক্সপার্ট আছে মানে? কী বলিস?”

টুনি তাড়াতাড়ি বলল, “না, ছোটাছু, কিছু না। কিছু বলি নাই। কিছু বলি নাই।”

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল