লুডো টুর্নামেন্ট

মুনিয়া একটা লুডোর বোর্ড, তার ছক্কা আর খুঁটির বাক্স নিয়ে গিয়েছে টুম্পার কাছে। টুম্পা গভীর মনোযোগ দিয়ে কাগজ কেটে কেটে একটা প্রজাপতি বানাচ্ছিল। মুনিয়া তাকে বলল, “টুম্পা আপু, আমার সাথে লুডো খেলবে?”

টুম্পা বলল, “উঁহু। এখন খেলতে পারব না। দেখছিস না এই প্রজাপতিটা তৈরি করছি, তারপর এইটা রং করতে হবে, তারপর রং শুকাতে হবে। অনেক কাজ।”

মুনিয়া তখন গেল প্রমির কাছে, গিয়ে বলল, “প্রমি আপু তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”

প্রমি বলল, “কেমন করে খেলি, বলো! হোমওয়ার্ক এখনও শেষ হয় নাই যে।”

মুনিয়া তখন গেল শাহানার কাছে, শাহানাও বলল তার সময় নেই। মুনিয়া শান্তর কাছে যাবে কি না ঠিক করতে পারছিল না। কিন্তু যেহেতু দোতলার সিঁড়িতে তার সাথে দেখা হয়েই গেল তাই তাকে জিজ্ঞেস করল, “শান্ত ভাইয়া, তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”

শান্ত চিৎকার করে হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “কী বললি তুই? লুডো? তোর সাথে? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে যে তোর মতো একটা গেন্দা বাচ্চার সাথে বসে বসে এখন আমি লুডো খেলব? আমার কি কাজের অভাব পড়েছে? যা যা-ভাগ এখান থেকে!”

শান্তর কথা শুনে মুনিয়া কিছু মনে করল না। শান্ত সব সময় এইভাবেই কথা বলে। ভালোভাবে কথা বললেই বরং মুনিয়া অবাক হতো। মুনিয়া তখন গেল টুনির কাছে। টুনি বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিল, মুনিয়াকে দেখে বলল, “কী খবর মুনিয়া?”

মুনিয়া বলল, “টুনি আপু, তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?” টুনি মাথা চুলকে বলল, “লুডো? তোর সাথে?”

“হ্যাঁ।”

টুনি বলল, “লুডো খেলার মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই, পুরোটা হচ্ছে লটারি। অন্য কিছু খেলিস না কেন?”

“আমি অন্য কোনো খেলা পারি না।”

“আয় তোকে দাবা খেলা শিখিয়ে দেই। দাবা হচ্ছে বুদ্ধির খেলা।”

মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। আমি বুদ্ধির খেলা খেলতে চাই না। আমি লুডো খেলতে চাই।”

“কেন তুই বুদ্ধির খেলা শিখতে চাস না?”

মুনিয়া বলল, “আমার বুদ্ধি ভালো লাগে না।”

টুনি একটু অবাক হয়ে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এই বাসায় এখন সবচেয়ে ছোট হচ্ছে মুনিয়া, সে এখনই বুঝে গেছে বুদ্ধি বিষয়টা ভালো না!

টুনি বলল, “ঠিক আছে তোর সাথে আমি লুডো খেলব কিন্তু একটু সময় দে, বইটার খুব ইন্টারেস্টিং একটা জায়গায় এসেছি তো এইটা শেষ করে আসি।”

মুনিয়ার অপেক্ষা করার সময় নাই। সে তখন গেল ঝুমু খালার কাছে, গিয়ে বলল, “ঝুমু খালা তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”

ঝুমু খালা বলল, “অবশ্যই খেলব। লুডো আমার সবচেয়ে পছন্দের খেলা। আমি দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা লুডো খেলতে পারি। তবে সাপ-লুডো একটু ভয় লাগে। সাপ দেখলেই আমার শরীর কী রকম জানি ইজিবিজি করে।”

মুনিয়া বলল, “এইগুলো তো সত্যি সাপ না।”

“সত্যি হোক মিথ্যা হোক কিছু আসে-যায় না। সাপ দেখলেই শরীর ইজিবিজি করে।”

“তোমার কোনো ভয় নাই ঝুমু খালা, আমি সাপ-লুডো খেলব না।”

ঝুমু খালা খুশি হয়ে বলল, “চমৎকার!”

মুনিয়া বলল, “তাহলে বোর্ডটা এখানে পাতব? গুটি বসাব?”

ঝুমু খালা বলল, “মুনিয়া সোনা, আমাকে দুইটা মিনিটি সময় দাও। ডালটা বাগাড় দিয়ে ফেলি, ভাতটা নামিয়ে মাছগুলো ভেজে ফেলি–”

মুনিয়া হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল, সে জানে এতগুলো কাজ কোনোভাবেই দুই মিনিটে শেষ হবে না। তাই তখন সে দাদির (কিংবা নানির) কাছে গেল নালিশ করতে। দাদি বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন, তার পাশে একটা ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে বসে আছে। ছেলেটা দেখতে অনেক স্মার্ট আর চেহারা খুব সুন্দর। একটা কালো টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পরে আছে।

মুনিয়াকে দেখে দাদি জিজ্ঞেস করলেন, “মুনিয়া তোর মুখটা এত ভার কেন? কী হয়েছে?”

“দাদি, কেউ আমার সাথে খেলতে চায় না।”

“কেউ তোর সাথে খেলতে চায় না? এত বড় সাহস? সবগুলোকে ডেকে আন, খুন করে ফেলব সবগুলোকে আজকে।”

“সত্যি ডেকে আনব?”

“হ্যাঁ সত্যি।”

“সত্যি খুন করে ফেলবে?”

“সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? সবাইকে বল আমার একজন নাতি এসেছে, তার সাথে পরিচয়ও করিয়ে দেব।”

মুনিয়া তখন সবাইকে ডেকে আনল, দাদি তাদের সবাইকে খুন করে ফেলা হবে বলার পরও কাউকে সে রকম দুশ্চিন্তিত দেখা গেল না। দাদির এই নতুন নাতিটি কে এবং কোথা থেকে এসেছে সেটা জানার জন্যে সবার ভেতরেই একটু কৌতূহল।

দাদি তার নতুন নাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন, “এই যে এ হচ্ছে আমার ছোটবেলার বান্ধবী জোবেদার নাতি। জোবেদার নাতি মানে আমার নাতি।”

সবাই দাদির নাতিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মনে মনে এ প্লাস দিয়ে দিল। ছেলেটা স্মার্ট আর সুন্দর। জামা-কাপড়ও যথেষ্ট ভালো। এই বয়সের মেয়েরা খুব সুইট হয়, কিন্তু ছেলেরা কেমন যেন ভ্যাবলা ধরনের হয়ে যায়। কিন্তু এই ছেলেটা মোটেও ভ্যাবলা ধরনের নয়।

দাদি বললেন, “এর নাম মিশু।”

তারপর অন্যদের দেখিয়ে বললেন, “মিশু, এরা আমার নাতি-নাতনি। এদের থেকে খুব সাবধান, একজন থেকে আরেকজন আরো বেশি তাঁদড়।”

শান্ত আপত্তি করল, বলল, “দাদি কথাটা ঠিক বললে না তুমি। আমরা মোটেও তঁদড় না।”

দাদি বললেন, “ঠিক আছে। সেইটা নিয়ে আলোচনা না করলাম।” তারপর মিশুকে দেখিয়ে বললেন, “মিশু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে বলে এসেছে। অন্য কোথাও থাকতে চাইছিল, আমি বলেছি আমি থাকতে অন্য কোথাও কেন থাকবে? তাই এখন এই বাসায় কয়দিন থাকবে।”

প্রমি বলল, “মিশু ভাই, তুমি কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে?”

মিশু উত্তর দেবার আগেই দাদি বললেন, “মিশু যে কয়টা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে তার প্রত্যেকটাতে চান্স পেয়েছে। সবগুলোতে একেবারে প্রথম দিকে আছে, তার মানে হচ্ছে বাংলাদেশের যে কোনো ইউনিভার্সিটির যেকোনো সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারবে। তাই না মিশু?”

মিশু লাজুক মুখে মাথা নাড়ল, বলল, “আপনি এমনভাবে বলছেন যেন এইটা সাংঘাতিক কিছু। এটা এমন কিছু না, আমার থেকে আরও কত ভালো ছাত্রছাত্রী আছে।”

দাদি বললেন, “থাকলে থাকুক, তাদেরকে তো আর আমি চিনি না! আমি চিনি তোমাকে।”

দাদি বললেন, “দেখবেন আপনার নাতি-নাতনিরা আরো ভালো হবে!”

দাদি চোখ কপালে তুলে বললেন, “আমার নাতি-নাতনি? এরা কোনোদিন বই খুলে দেখে মনে করছ? বইয়ের সাথে এদের কারো কোনো সম্পর্ক নাই।”

টুনি আপত্তি করল, “কী বলছ দাদি? শাহানা আপু হচ্ছে জিনিয়াস। সায়েন্স ফেয়ারে দুইবার গোল্ড মেডেল পেয়েছে।”

“হ্যাঁ, শাহানাটাই কেবল একটু লেখাপড়া করে। যাই হোক, তোরা মিশুকে নিয়ে যা–কোথায় থাকবে কী সমাচার ঠিক করে দে।”

মুনিয়া তখন দাদিকে মনে করিয়ে দিয়ে বলল, “দাদি, তুমি বলেছিলে এদের খুন করবে। এরা কেউ আমার সাথে লুডো খেলতে চায় না।”

দাদির মনে পড়ল, মাথা নেড়ে বললেন, “ও হ্যাঁ। তোরা কেউ মুনিয়ার সাথে খেলতে চাস না কেন? বেচারি একটা লুডোর বোর্ড নিয়ে কতক্ষণ থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

সবাই একসাথে একটু যন্ত্রণার শব্দ করল। প্রমি বলল, “দাদি লুডো খেলার মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই, এইটা খেলার ইচ্ছা করে না।”

টুনি বলল, “আমি বলছিলাম মুনিয়াকে দাবা খেলাটা শিখিয়ে দেই।”

হঠাৎ করে মিশু বলল, “আমি একটা কথা বলি?”

সবাই থেমে গেল, মিশুর দিকে তাকিয়ে তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মিশু বলল, “তোমরা সবাই বলছ লুডো খেলার মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই। কিন্তু আমার মনে হয় আছে।”

শান্ত বলল, “আছে? যার ছক্কা বেশি পড়ে সে জিতে-এর মাঝে বুদ্ধিটা কোনখানে?”

মিশু হাসি হাসি মুখ করে বলল, “হ্যাঁ আছে। এর মাঝেও বুদ্ধি আছে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে তোমরা একটা লুডো টুর্নামেন্ট করো, আমিও সেখানে খেলি।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তুমি খেলে চ্যাম্পিয়ন হবে?”

মিশু হাসি হাসি মুখে বলল, “যদি চাই তাহলে হতে পারি।”

শান্ত চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তার মানে তুমি আমাদের সবাইকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছ?”

মিশু বলল, “আমি ঠিক চ্যালেঞ্জ শব্দটা ব্যবহার করতে চাই না কিন্তু বলা যায় তোমরা কোনোভাবে মনে হয় আমাকে হারাতে পারবে না।”

“সত্যি?”

মিশু মাথা নাড়ল, প্রমি বলল, “দেখা যাক।”

শান্ত বলল, “ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া। ছোটাচ্চুকে বলি স্পন্সর করতে। টুর্নামেন্টের নাম হবে ‘ছোটাচ্চু লুডো টুর্নামেন্ট। এন্ট্রি ফি পঞ্চাশ টাকা। আমি হব ইভেন্ট ম্যানেজার আর রেফারি। দাদি হবে চিফ এডভাইজার। ফাটাফাটি ইভেন্ট!”

মুনিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কিন্তু আমার সাথে কে খেলবে?”

কেউ তার কথার উত্তর দিল না। সবাই তখন লুডো টুর্নামেন্ট নিয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলতে শুরু করেছে।

.

শান্তর ঘরে মিশুর থাকার জায়গা করে দেয়া হলো। মিশু তার ব্যাক প্যাক থেকে বইপত্র বের করে বিছানায় রাখে। শান্ত বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল, সাইকোলজির একটা বই ধরতেই শান্ত বইটা তার হাত থেকে নিয়ে নিল, বলল, “এই বইটা তুমি দেখতে পারবে না।”

 “কেন?”

“এটা দিয়ে আমি ম্যাজিক দেখাই। এটা আমার ম্যাজিক বই।”

“ম্যাজিক বই?”

“হ্যাঁ।”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কী রকম ম্যাজিক বই?”

“এই দেখো–” বলে মিশু বইটা খুলে পৃষ্ঠা উল্টে দেখাল। শান্ত কোনো ম্যাজিক দেখল না। খুবই সাধারণ একটা বই, ভুরু কুঁচকে বলল, “কোথায় ম্যাজিক?”

“এই দেখো।” বলে শান্ত বইটার উপর আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন দিল। তারপর বইটা খুলতেই দেখে প্রত্যেক পৃষ্ঠায় একটা ক্রস আঁকা।

শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কী আশ্চর্য!”

মিশু জিজ্ঞেস করল, “কোনটা তোমার কাছে আশ্চর্য লেগেছে?”

“এক্ষুনি বইটাতে কিছু ছিল না এখন প্রতি পৃষ্ঠায় ক্রস।”

মিশু বলল, “ক্রস? কোথায় ক্রস?” বলে সে বইটা আবার খুলে দেখায়, প্রতিটি পৃষ্ঠা আগের মতো, কোনো ক্রস নেই? শান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, বলল, “আমাকে শেখাবে কেমন করে এই ম্যাজিকটা দেখাও।”

মিশু বলল, “সবাইকে সবকিছু শেখানো যায় না। কোনো কিছু ভালো করে শিখতে হলে তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়।”

.

হাত-মুখ ধুয়ে মিশুকে নিয়ে শান্ত নিচে নাস্তা খেতে এলো। ঝুমু খালা টেবিলে গরম গরম ডালপুরী আর চা দিয়েছে। সবাই ঝুমু খালার বিখ্যাত ডালপুরীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চা অবশ্যি সবার কপালে জুটে না–এই বাসায় একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত চা খাবার পারমিশন পাওয়া যায় না। ঝুমু খালার মন ভালো থাকলে মাঝে মাঝে এক-দুইজনকে বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে আধা কাপ চা তৈরি করে দেয়।

আজকে ঝুমু খালার মন নিশ্চয়ই ভালো ছিল তাই টুম্পাকে আধ কাপ চা দিয়েছে। টুম্পা খুবই গম্ভীর ভঙ্গিতে সেই চা খাচ্ছে, তখন মিশু টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার চায়ে একটু ম্যাজিক করে দিই?”

টুম্পা অবাক হয়ে বলল, “ম্যাজিক?”

“হ্যাঁ।”

শান্ত তখন চোখ বড় বড় করে হাত-পা নেড়ে নেড়ে বলল, “ও, তোরা কেউ জানিস না, মিশু ভাই আস্ত ম্যাজিশিয়ান। একেবারে জুয়েল আইচ!”

সবাই মিশুর দিকে ঘুরে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”

মিশু কিছু বলল না, শান্ত জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি মানে সত্যি! ডাবল সত্যি। একটু আগে বইয়ের উপরে আঙুল দিয়ে দাগ দিয়ে বইয়ের ভিতর ক্রস এঁকে ফেলেছে।”

টুম্পা বলল, “আমাদের দেখাবে?”

মিশু বলল, “অন্য সময় দেখাব। এখন বরং তোমাকে চায়ের ম্যাজিক দেখাই।”

“দেখাও।”

মিশু বলল, “ঠোঁটগুলো যতটুকু পারো ভেতরে নাও, তারপর চা খাও, দেখবে কী ম্যাজিক হবে! যত বেশি মুখের ভেতর নিতে পারবে তত বড় ম্যাজিক।”

সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল। টুম্পা তার ঠোঁট দুটো মুখের ভেতরে নিয়ে তার চায়ে চুমুক দিতে গিয়েই চিৎকার করে চায়ের কাপ ফেলে দিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে প্রায় কাঁদতে শুরু করে দিল।

সবাই ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”

টুম্পা হাত দিয়ে তার মুখটা ঢেকে রেখেছে। মিশু হা হা করে হেসে বলল, “কী আর হবে? কিছু হয় নাই! মুখে গরম চায়ের একটু ছ্যাঁকা খেয়েছে। মানুষের ঠোঁট গরম সহ্য করতে পারে, অন্য জায়গা পারে না, সেটাই দেখানো হলো!”

মিশুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দিকে কেউ নজর দিল না, টুনি টুম্পাকে হাত ধরে রান্নাঘরে নিয়ে গেল, ফ্রিজ থেকে এক টুকরো বরফ বের করে তার ঠোঁটে লাগিয়ে দিল যন্ত্রণাটা কমানোর জন্যে। মিশু তখনো দুলে দুলে হাসছে। ঝুমু খালা কোমরে হাত দিয়ে মিশুর দিকে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি মানুষটা তো ভালো না, ছোট বাচ্চাদের কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাও!”

মিশু হাসি হাসি মুখে বলল, “কষ্ট? কষ্ট কখন দিলাম? গরম চায়ে শুধু একটু ছ্যাকা খেয়েছে! একটু মজা করলাম আর কিছু না।”

ঝুমু খালা বলল, “এই বাসায় এই রকম মজা চলে না।”

মিশু তখনো হাসি হাসি মুখ রেখে বলল, “ঠিক আছে! এই বাসায় যে রকম মজা চলে সেটাই করা হবে এখন থেকে। সেটা হচ্ছে লুডো টুর্নামেন্ট! ঠিক আছে?”

সবাই মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা নাড়ল।

.

মিশু খুবই বুদ্ধিমান এবং লেখাপড়া জানা ছেলে, দেখতেও খুব সুন্দর, জামা কাপড় ভালো, কথা বলে খুব সুন্দর করে কিন্তু মানুষটা মনে হয় ভালো না, ঝুমু খালা সেটা টের পেয়েছে সবার আগে। অন্যরাও আস্তে আস্তে টের পেতে লাগল।

যেমন সন্ধেবেলা মিশু বাসায় এসে টুম্পাকে খুঁজে বের করে বলল, “টুম্পা তোমাকে বিকেলে গরম চা দিয়ে ছ্যাকা খাইয়েছি সে জন্যে আমার খুব খারাপ লাগছে। তোমার সাথে ভাব করার জন্যে আমি তোমার জন্যে একটা চকোলেট কিনে এনেছি। তুমি চকোলেট খাও তো?”

টুম্পা মাথা নাড়ল, চকোলেট তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। বড় হয়ে সে চকোলেটের ফ্যাক্টরি তৈরি করবে বলে ঠিক করে রেখেছে।

মিশু বলল, “আমি চকোলেটটা দিচ্ছি, কিন্তু তুমি তার আগে আমাকে একটা কাজ করে দিতে পারবে?”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কী কাজ?”

মিশু টুম্পার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল, “এই কাগজটা ভাঁজ করে দিতে পারবে?”

টুম্পা বলল, “পারব।”

তাহলে ভাঁজ করে দাও দেখি, “সাতবার ভাঁজ করবে।”

টুম্পা বলল, “সাতবার?”

“হ্যাঁ। সমস্যা আছে?”

টুম্পা বলল, “নাহ্।”

মিশু বলল, “তাহলে শুরু করে দাও, আমি চকোলেটটা বের করে রাখি। ভজ শেষ হলেই চকোলেট!”

টুম্পা কাগজটা মাঝখানে একবার ভাঁজ করল। তারপর আবার। তারপর আবার। ভাঁজ করার জন্যে কাগজটা মোটা হতে শুরু করেছে তাই আস্তে আস্তে কাজটা কঠিন হয়ে গেল। টুম্পা অনেক কষ্ট করে ছয়বার ভাঁজ করে আবিষ্কার করল কাগজটা সাতবার ভাঁজ করা অসম্ভব।

মিশু মুখের মাঝে একটা কপট দুশ্চিন্তার ভান ফুটিয়ে বলল, “কী হলো? থেমে গেলে কেন? করো।”

টুম্পা বলল, “করা যাবে না।”

মিশু বলল, “আহা-হা-তাহলে তো চকোলেটটাও তোমাকে দেয়া যাবে। তোমার জন্যে এনেছিলাম কিন্তু মনে হচ্ছে আমাকেই খেতে হবে!” বলে চকোলেটটার র‍্যাপার খুলে সত্যি সত্যি সে খেতে শুরু করল।

লজ্জায় আর অপমানে টুম্পার চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে ঘর থেকে প্রায় ছুটে বের হয়ে গেল। কাছেই দাঁড়িয়ে শান্ত পুরো ব্যাপারটা দেখেছে; সে মাথা নেড়ে বলল, “কাজটা ভালো হলো না।”

মিশু চকোলেটের বারে আরেকটা বড় কামড় দিয়ে বলল, “কোন কাজটা?”

“টুম্পাকে এরকম লজ্জা দিলে? বেচারি–”

“লজ্জা দিয়েছি? আমি? মোটেও না।”

“টুম্পা কেমন করে জানবে একটা কাগজ সাতবার ভাঁজ করা যায় না?”

“জানা উচিত ছিল। প্রতি ভঁজে কাগজের সংখ্যা ডাবল হয়ে যায়। সাত ভজ মানে চৌষট্টি পাতা–একশ আটাইশ পৃষ্ঠা! একশ আটাইশ পৃষ্ঠার একটা বই ভাঁজ করতে রাজি হওয়ার আগে চিন্তা করা উচিত ছিল।”

শান্ত বলল, “টুম্পা ছোট একটা মেয়ে–”

মিশু চকোলেটের শেষ টুকরোটা মুখে দিয়ে খুব তৃপ্তি করে চিবুতে চিবুতে বলল, “ঠিক আছে টুম্পা ছোট মেয়ে–কিন্তু তুমি তো ছোট না। তুমি কি রাজি আছ?”

শান্ত বলল, “কীসে রাজি আছি?”

“আমি যেটা বলব সেটা করতে রাজি আছ?”

শান্ত অবাক হয়ে বলল, “কী করতে বলবে?”

“খুব সোজা একটা কাজ। যদি করতে পারো তাহলে আমি তোমাকে একশ টাকা দিব। না পারলে তুমি আমাকে একশ টাকা দিবে।”

শান্ত সরু চোখে কিছুক্ষণ মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর বলল, “আমার কাছে এত টাকা নাই।”

“কত আছে?”

“দশ টাকা।”

“ঠিক আছে তুমি করতে পারলে আমি তোমাকে একশ টাকা দিব, না পারলে তুমি আমাকে দশ টাকা দিবে।”

“কাজটা কী আগে শুনি?”

মিশু বলল “তুমি তোমার এক পায়ের উপর দাঁড়াবে।”

শান্ত অবাক হয়ে বলল, “ব্যস?”

“হ্যাঁ। তবে কোথায় দাঁড়াতে হবে সেটা আমি বলে দেব। জায়গাটা যদি তোমার পছন্দ না-হয় তোমার দাঁড়াতে হবে না। দেখে-শুনে যদি রাজি হও তাহলেই শুধু দাঁড়াবে।”

“কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে?”

মিশু বলল, “এক সেকেন্ড।”

শান্ত বলল, “মাত্র এক সেকেন্ড?”

“হ্যাঁ। মাত্র এক সেকেন্ড।”

“ঠিক আছে, কোথায় দাঁড়াতে হবে দেখাও।”

মিশু বলল, “আগে সবাইকে ডেকে আনো। সবার সামনেই কম্পিটিশনটা হোক। পরে বলবে আমি বোকা পেয়ে তোমাকে ঠকিয়ে দিয়েছি।”

শান্ত গরম হয়ে বলল, “আমি বোকা না।”

মিশু বলল, “ঠিক আছে, তুমি বোকা না। তবে জেনে রাখো, বোকা না হওয়া এক জিনিস আর বুদ্ধিমান হওয়া অন্য জিনিস।”

শান্ত সরু চোখে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল। মিশু বলল, “যাও সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো! আমাদের কম্পিটিশনটা দেখুক।”

কিছুক্ষণের মাঝেই সব বাচ্চারা হাজির হলো। মিশু সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার আর শান্তর মাঝে এখন একটা প্রতিযোগিতা হবে। আমি শান্তকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়াতে বলব। সে যদি এক সেকেন্ড সেখানে এক পায়ে দাঁড়াতে পারে আমি তাকে দেব একশ টাকা। যদি না পারে সে আমাকে দেবে মাত্র দশ টাকা।”

মুনিয়া বলল, “আমিও এক পায়ে দাঁড়াতে পারি। এই দেখো–” বলে সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে গেল।”

মিশু হাসি হাসি মুখে বলল, “ভেরি গুড। যখন তোমার সাথে কম্পিটিশন হবে তখন তুমি দাঁড়াবে। এখন কম্পিটিশনটা হচ্ছে শান্তর সাথে।” মিশু শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “শান্ত, রেডি?”

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “রেডি।”

“তাহলে ঐ দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াও। ডান পায়ের ডান সাইডটা দেয়ালে লাগিয়ে বাম পাটা এক সেকেন্ডের জন্যে উপরে তুলবে। বেশি না, মাত্র এক সেকেন্ড!”

শান্ত হাসি হাসি মুখে গেল, ডান পায়ের ডান দিকের অংশটা দেয়ালের সাথে লাগাল এবং হঠাৎ করে সবাই দেখল শান্তর মুখটা কেমন যেন চিমশে মেরে গেল। মনে হচ্ছে ডান পায়ের উপর ভর দিয়ে সে বাম পাটা তুলতে পারছে না! এক সেকেন্ডের জন্যেও না! কী আশ্চর্য!

মিশু বলল, “কী হলো দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোলো বাম পা, ডান পায়ের উপর দাঁড়াও।”

শান্ত বোকার মতো একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “পারছি না!” তারপর শেষ চেষ্টা হিসেবে একটুখানি তুলে সাথে সাথে নামিয়ে ফেলল, বোঝাই যাচ্ছে সে দেয়ালের সাথে এক পা এবং শরীর লাগিয়ে অন্য পা তুলতে পারবে না।

মিশু হাত পেতে বলল, “দাও আমার দশ টাকা।”

শান্ত মুখটা কালো করে পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে মিশুকে দিল। টাকাটার জন্যে তার খুব দুঃখ নেই কিন্তু সবার সামনে সে যে বোকা বনেছে সে জন্যে তার খুবই লজ্জা লাগছিল।

শান্তর অবস্থা দেখে অন্য সবাই চেষ্টা করে আবিষ্কার করল দেয়ালের সাথে পা এবং শরীর লেগে গেলে কোনোভাবেই এক পায়ে দাঁড়ানো যায় না। মিশু মুখ গম্ভীর করে বলল, “পারবে না। এটা সম্ভব না। এক পায়ে দাঁড়ালে শরীরের সেন্টার অব গ্রেভিটি ব্যালেন্স করার জন্যে শরীরটা বাকাতে হয়। দেওয়াল থাকলে শরীর বাকানো যায় না, তাই এক পায়ে দাঁড়ানোও যায় না।”

মিশুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনেও কেন জানি কেউই খুব চমৎকৃত হলো না।

.

রাতে ঘুমানোর সময় মিশু শান্তকে জীবন সম্পর্কে একটু জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করল। বলল, “বুঝলে শান্ত, বেশি ভালো মানুষ হয়ে লাভ নাই। দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে ঠিক জায়গায় দুই নম্বরি করতে হয়।”

শান্ত উঠে বসল, “তুমি দুই নম্বরি করো?”

“করি না? সব সময় করি। করতে হয়। যেমন–মনে করো পরীক্ষার সময় তুমি খুব ভালো পরীক্ষা দিলে, কিন্তু অন্যরা তোমার থেকেও ভালো পরীক্ষা দিল, তাহলে তোমার লাভ কী? তাই পরীক্ষার সময় তোমার ভালো পরীক্ষা দেওয়া যেমন দরকার, অন্যদের পরীক্ষা খারাপ করে দেওয়া সমান। দরকার।”

“অন্যদের পরীক্ষা তুমি কেমন করে খারাপ করবে?”

“অনেক রকম উপায় আছে। তোমাকে সোজা একটা উপায় শিখিয়ে দেই। ক্যালকুলেটরে ডিগ্রি থাকে আর রেডিয়ান থাকে। ছেলেমেয়েরা সবসময় ডিগ্রিতে হিসাব করে। আমি কী করি জানো?”

“কী করো?”

“ওদের ক্যালকুলেটর নিয়ে সেটাকে রেডিয়ানে সেট করে দেই। তারা তো আর সেইটা জানে না, তাই যখন ত্রিকোণমিতি করে সব হিসাব তখন ভুল হয়ে বের হয়। পরীক্ষায় এত বড় গোল্লা পায়–” কথা শেষ করে মিশু আনন্দে হা হা করে হাসতে থাকে।

শান্ত ঠিক বুঝতে পারছিল না অন্যদের পরীক্ষায় গোল্লা পাইয়ে দেওয়াটা ঠিক কাজ হচ্ছে কি না। কিন্তু কেউ তো অস্বীকার করতে পারবে না মিশু ভাইয়া খুবই ভালো ছাত্র, ভর্তি পরীক্ষায় সবগুলো ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। কাজেই সে যে কাজগুলো করে সেটা নিশ্চয়ই সঠিক কাজ। তবু তার ভিতরে খচখচ করতে থাকে।

.

পরদিন লুডো টুর্নামেন্ট শুরু হলো। ছোট একটা টেবিলের দুই পাশে দুটি চেয়ার, সেখানে খেলোয়াড়রা বসবে। টেবিলে লুডোর বোর্ড। টেবিল ঘিরে দর্শকেরা বসে কিংবা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেবে। অনেক কষ্ট করে একশ টাকা জোগাড় করা হয়েছে। টুর্নামেন্টের বিজয়ীকে এই একশ টাকা নগদ দেয়া হবে। টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করার জন্যে দাদি (কিংবা নানি)-কে ধরে আনা হলো, দাদির সাথে ঝুমু খালাও চলে এসেছে। প্রথমে দাদিকে বলা হলো একটা বক্তৃতা দিতে। দাদি অবাক হয়ে বললেন, “বক্তৃতা? আমি?”

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ, তুমি।”

দাদি বললেন, “আমি কখনো বক্তৃতা দেই নাই। কেমন করে বক্তৃতা দিতে হয় জানি না।”

শান্ত বলল, “বক্তৃতা কেমন করে দিতে হয় কেউ জানে না! শুধু হাত উপরে তুলে গলা কাঁপিয়ে বলল, ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক।”

দাদি অবাক হয়ে বললেন, “ধ্বংস হোক? কে ধ্বংস হবে?”

“সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মেহনতি মানুষের শত্রু-এইসব।”

প্রমি শান্তকে ধমক দিয়ে বলল, “তুই চুপ করবি?” তারপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “লুডো খেলা নিয়ে কিছু একটা বলো।”

দাদি তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “মুনিয়া বেচারি লুডো খেলতে চাচ্ছিল, তোরা কেউ আগে খেলতে চাস নাই সে জন্যে মুনিয়ার মন খুব খারাপ ছিল। এখন তোরা খেলার আয়োজন করেছিস দেখে খুশি হলাম। দোয়া করি তোদের প্রতি দানে যেন বেশি করে ছক্কা ওঠে।”

দাদির বক্তৃতা শেষ হতেই সবাই জোরে জোরে হাততালি দিল। তখন প্রমি ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু খালা এখন তুমি একটা বক্তৃতা দাও।”

ঝুমু খালা এক কথায় রাজি। শাড়িটা কোমরে প্যাচিয়ে হাত নেড়ে বক্তৃতা শুরু করে দিল, “দেশবাসী ভাই-বোনেরা আপনাদের লাল সালাম (প্রচণ্ড হাততালি শোনা গেল)। এই বাসার পুলাপান কিছু পাগল কিছু আধা পাগল (আবার হাততালি) তারপরেও তোমরা একটা লুডু খেলার আয়োজন করেছ, সেই জন্যে লাল সালাম (আবার হাততালি)। আমি এইখানে ঘোষণা দিয়ে গেলাম লুডু খেলা চলার সময় আমি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তোমাদের চা-নাস্তা দিয়ে যাব।”

ঝুমু খালার কথা শেষ হবার পর এবারে শুধু হাততালি না, জঙ্গি স্লোগান শোনা গেল, “আমার খালা, তোমার খালা, ঝুমু খালা ঝুমু খালা।”

তারপর দাদি লুডোর বোর্ডের উপর একবার ছক্কাটা চাললেন, খেলার উদ্বোধন হয়ে গেল।

কার সাথে কে খেলবে খুব যত্ন করে সেটা তৈরি করা হয়েছে। তিনবার করে খেলা হবে তার মাঝে যে দুইবার জিতবে সে-ই হচ্ছে বিজয়ী। খেলা শুরু হওয়ার আগে মিশু জিজ্ঞেস করল, “এই লুডু টুর্নামেন্টে কে জিতবে বলে তোমাদের মনে হয়?”

কেউ কিছু বলার আগেই মুনিয়া হাত তুলে বলল, “আমি!”

“তুমি?”

মিশু বলল, “তুমি কেমন করে জানো তুমি চ্যাম্পিয়ন হবে?”

মুনিয়া বলল, “আমি খুব ভালো লুডো খেলতে পারি। আর আমি যখন চ্যাম্পিয়ন হব তখন আমি একশ টাকা পাব। আমার একশ টাকা দরকার।”

“এত ছোট মানুষ তুমি এত টাকা দিয়ে কী করবে?”

মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “বলব না।”

মিশু বলল, “মুনিয়া তুমি কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হবে না। শুধু শুধু আশা করে বসে থেকো না।”

মুনিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, “হব না?”

“নাহ্। চ্যাম্পিয়ন হব আমি। আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি।” মিশু মাথা নাড়ল, “লুডো খেলার মাঝে আমি হচ্ছি সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”

মুনিয়ার ছোট মুখটা একটু কালো হয়ে যায়। টুনি মুনিয়াকে সাহস দিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মিশু মুনিয়াকে বলল, “কিন্তু তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাকে আগেই তোমার জন্যে একশ টাকা বের করে দেব।”

মুনিয়া অবাক হয়ে বলল, “কোথা থেকে বের করবে।” “তোমার কাছেই আছে।” “আমার কাছে আছে?”

মিশু বলল, “হ্যাঁ। এই দেখো” বলে মুনিয়ার কানটা স্পর্শ করে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে আনে। সেটা দেখে মুনিয়ার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। তার কানের ভেতর পাঁচ টাকার এত বড় একটা কয়েন আছে সে কখনো জানত না।

মিশু বলল, “কয়েনগুলো রাখার জন্যে কিছু একটা দরকার।” দেখা গেল সে রেডি হয়ে এসেছে। কফি টেবিলের উপর রাখা একটা খালি কৌটা নিয়ে সেখানে ঝন করে পাঁচ টাকার কয়েনটা. ফেলে আবার মুনিয়ার অন্য কান থেকে আরেকটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করে আনে। তারপর নাক থেকে দুইটা কয়েন বের করে আনে। চোখ থেকে, চুল থেকে, ঘাড় থেকে কয়েন বের হতে থাকে আর মিশু কয়েনগুলো টিনের কৌটার মাঝে রাখতে থাকে। যখন মুনিয়ার শরীর থেকে বিশটা পাঁচ টাকার কয়েন বের হয়েছে

তখন মিশু বলল, “এই যে মুনিয়া একশ টাকা হয়ে গেছে। তোমাকে তোমার একশ টাকা দিয়ে দিই। সব কৌটার মাঝে জমা করে রেখেছি।”

মুনিয়া ব্যাপারটা বিশ্বাস করবে কী না বুঝতে পারছে না। কিন্তু অবিশ্বাসই বা করে কেমন করে? নিজের চোখে দেখেছে মিশু ভাইয়া তার কান থেকে, নাক থেকে কয়েনগুলো বের করছে। সে টুনির দিকে তাকাল, টুনি বলল, “মিশু ভাইয়ার কথা বিশ্বাস করিস না। এগুলো ম্যাজিক। হাতের কারসাজি। তোর সাথে ঠাট্টা করছে।”

মিশু গম্ভীর মুখে বলল, “মোটেও কারসাজি না। এই দেখো কয়েনগুলো কৌটার মাঝে আছে।” মিশু কৌটাটা ঝাঁকুনি দিতেই ভেতরে কয়েনগুলো ঝনঝন করে উঠল। তারপর কৌটার মুখে তার প্রাস্টিক ঢাকনাটা লাগিয়ে কৌটাটা তাকে দিয়ে বলল, “নাও। তোমার জন্যে।”

মুনিয়া আগ্রহ নিয়ে কৌটাটা নিল। মিশু বলল, “শুধু মুখটা খোলার সময় সাবধান।”

“কেন?”

“এটা খোলার সময় তুমি যেটা ইচ্ছা চিন্তা করতে পারো কিন্তু হাতির কথা চিন্তা করতে পারবে না। হাতির কথা চিন্তা করলেই কিন্তু কয়েনগুলো ভ্যানিশ হয়ে যাবে।”

“ভ্যানিশ হয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ।”

মুনিয়া কয়েকবার কৌটার মুখটা খুলতে গিয়ে থেমে গেল। প্রত্যেকবার খোলার সময় তাকে নিশ্চিত হতে হয় সে যে হাতির কথা চিন্তা করছে না, তখন হাতির কথা মনে পড়ে যায়।

টুনি মুনিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “মিশু ভাইয়া তোকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। এই কৌটার ভিতরে কিছু নেই। তুই খুলে দেখ।”

মুনিয়া শেষ পর্যন্ত কৌটাটা খুলে চিৎকার করে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ভিতরে একটা মরে শুকনো হয়ে থাকা টিকটিকি। কী ভয়ানক! একটু আগে শান্তর ঘরে জানালার ফাঁকে আটকে পড়ে মরে পড়ে থাকা এই টিকটিকিটা মিশু আবিষ্কার করে এখনই একটা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে!

মিশু দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই কৌটা খোলার সময় হাতির কথা চিন্তা করেছ তাই সব কয়েন ভ্যানিশ করে একটা মরা টিকটিকি চলে এসেছে!”

মুনিয়া বিষদৃষ্টিতে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল।

.

কিছুক্ষণের ভিতরে লুডো টুর্নামেন্ট শুরু হয়। মিশু ঘোষণা দিয়ে রেখেছে কেউ তাকে খেলায় হারাতে পারবে না। দেখা গেল তার কথা সত্যি। সে অবলীলায় প্রথম খেলাটা জিতে গেল। মনে হলো ছক্কাটা তার কথা শুনে, যখনই ছয়ের দরকার হয় একটা ছয় উঠে আসে। লুডো খেলায় এ রকম ছয়ের ছড়াছড়ি সে আগে দেখেনি!

দ্বিতীয় খেলার সময়ও দেখা গেল ঝটপট মিশুর সব খুঁটি বোর্ডে উঠে এসেছে, তারপর দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। টুনি তখন মিশুর খেলাটা ভালো করে লক্ষ করল এবং মিশুর জিতে যাওয়ার কারণটা কিছুক্ষণের মাঝেই আবিষ্কার করে ফেলল।

মিশুর কাছে দ্বিতীয় একটা ছক্কা আছে যেটা দেখতে হুবহু আসল ছক্কার মতোন। কিন্তু সেই ছক্কাটিতে কোনো পাঁচ নেই, পাঁচের বদলে সেখানে আরো একটি ছয় আছে। এই ছক্কাটি দিয়ে খেললে ছয় ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে ডাবল হয়ে যায়। মিশুর যখন ছয়ের দরকার হয় সে এটা দিয়ে খেলে। মিশু যেহেতু ম্যাজিক দেখায়, তার হাতসাফাই অসাধারণ। হাতের মাঝের লুকিয়ে রাখা ছক্কাটা কেমন করে বদলে দেয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও ধরা যায় না। ছক্কাটা যখন গড়িয়ে যায় তখন খুব ভালো করে তাকালে বোঝা যায় এই ছক্কার দুই পাশেই ছয়। টুনি মিশুকে ধরিয়ে দিবে কী না চিন্তা করল, কিন্তু মিশুর মতো ধুরন্ধর ছেলেকে শুধু ধরিয়ে দিলে হবে না, তাকে একটা শিক্ষাও দেয়া দরকার। টুনি তখন লুডো টুর্নামেন্ট থেকে উঠে উপরে গেল। শাহানা আপু ভরসা। যখন তার নিজের বুদ্ধিতে কুলায় না তখন সে শাহানা আপুর বুদ্ধি ধার নেয়।

শাহানা আপু খাতায় বিদঘুঁটে যন্ত্রের একটা ছবি এঁকে তার দিকে তাকিয়েছিল, টুনিকে দেখে বলল, “লুডো টুর্নামেন্ট কেমন চলছে?”

“ভালো, কিন্তু একটা সমস্যা আছে। তাই তোমার কাছে এসেছি।“

“কী সমস্যা?”

“মিশু ভাইয়া একটা দুই নম্বরি ছক্কা দিয়ে খেলছে।”

“দুই নম্বরি?”

“হ্যাঁ। এই ছক্কায় কোনো পাঁচ নেই। ছক্কার এই পিঠ আর ওই পিঠ দুই পিঠেই ছয়। সেটা চাললে বেশি ছয় ওঠে।”

“ধরিয়ে দিচ্ছিস না কেন?”

“ধরিয়ে দিলেই তো শেষ। আমি ধরিয়ে দেবার আগে মিশু ভাইয়াকে একটা শিক্ষা দিতে চাই। মিশু ভাইয়া মানুষটা ভালো না-মুনিয়াকে একটু আগে বোকা বানিয়ে হা হা করে হাসছে। যে মানুষ ছোট বাচ্চাদের জ্বালায় সেই মানুষ খুব ডেঞ্জারাস।”

শাহানা জিজ্ঞেস করল, “তুই কী করতে চাস?”

“আমাকে এমন একটা ছক্কা বানিয়ে দেবে যেটা দিয়ে যখন যেটা পেতে চাই সেটা পাব। ছয় চাইলে ছয় তিন চাইলে তিন। এক চাইলে এক।”

“কখন বানিয়ে দেব?”

“এই এক্ষুনি। বিকালের মাঝে টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যাবে তার আগে।”

শাহানা আপু হাসল, বলল, “এত তাড়াতাড়ি এই রকম ছক্কা বানানো সম্ভব না। মিশু ভাইয়ার মতো আরেকটা ছক্কা বানিয়ে নে।”

টুনি মাথা নাড়ল, “উঁহু। আমি মিশু ভাইয়ার নকল করতে চাই না। নতুন কিছু করতে চাই যেন মিশু ভাইয়া টের পায় যে তার থেকে বুদ্ধিমান মানুষ আছে যে তাকে ঘোল খাওয়াতে পারে।”

শাহানা আপা ঠোঁট সুচালো করে উপরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা কাজ করা যেতে পারে।”

টুনি হাতে কিল দিয়ে বলল, “আমি বলেছি না, তুমি চাইলেই পারবে। বলো কী করতে হবে।”

“যেহেতু মেঝেতে বোর্ড পেতে খেলা হচ্ছে না, একটা ছোট টেবিলের উপর রেখে খেলা হচ্ছে তাই এই বুদ্ধি কাজে লাগানো যায়।”

“কী বুদ্ধি বলো?”

আমার কাছে ছোট ছোট খুব পাওয়ারফুল চুম্বক আছে। নষ্ট হার্ড ড্রাইভ থেকে বের করেছি। একটা ছক্কা নিয়ে মাঝখানে গর্ত করে সেই চুম্বকটা ঢোকাতে হবে। কাজটা সহজ না কিন্তু সম্ভব। ছক্কাটা মাঝখান থেকে কেটে ভেতরে গর্ত করে সেখানে এই খুব ছোট বিন্দি চুম্বকটা ঢোকাতে হবে। তারপর আবার দুই অংশ জুড়ে দিয়ে পালিশ করে নিয়ে ছক্কার ডটগুলো নতুন করে এঁকে দিতে হবে।”

“তারপর কী করব?”

“এটাকে দেখতে ছক্কার মতো মনে হলেও এটা আসলে একটা পাওয়ারফুল চুম্বক। আরেকটা চুম্বক দিয়ে এটাকে কন্ট্রোল করা যাবে। মনে করো এমনভাবে ছক্কাটা তৈরি হলো যেন ছক্কাটার নর্থপোল যখন নিচের দিকে থাকবে তখন ছয় উঠবে। আর যখন সাউথ পোল নিচের দিকে থাকবে তখন এক উঠবে। এবারে কেউ যখন খেলার সময় ছক্কাটা মারবে, টেবিলের নিচে আরেকটা চুম্বক ধরবি, যদি সেই চুম্বকটার সাউথ পোল উপরের দিকে রাখিস তাহলে সেই সাউথ পোলের আকর্ষণে ছক্কাটার নর্থ পোল নিচের দিকে চলে আসবে অর্থাৎ ছয় উঠবে।”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি। আর যদি চুম্বকটা উল্টো করে ধরি তাহলে এক উঠবে।”

শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”

টুনি শাহানাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “প্লিজ, শাহানা আপু আমাকে এই ম্যাজিক ছক্কাটা বানিয়ে দাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

শাহানা বলল, “ঠিক আছে আমাকে ঘণ্টাখানেক সময় দে। ছক্কাটা বানাব কী দিয়ে সেটা আগে ঠিক করি।”

টুনি বলল, “আমার কাছে আরেকটা লুডো সেট আছে সেখানে একটা ছক্কা আছে, সেটা নিয়ে আসি?”

“যা নিয়ে আয়।”

টুনি ছুটে উপরে গিয়ে তার টেবিলের তাকের উপর থেকে লুডো সেটের ছক্কাটা নিয়ে আবার ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে এসে শাহানার হাতে ধরিয়ে দিল।

এখন যে ছক্কাটা দিয়ে টুর্নামেন্ট খেলা হচ্ছে এটা তার থেকে একটু বড়, দেখতেও অন্য রকম, ঠিক টুনি যে রকম চাইছিল।

.

নিচে তখন লুডো টুর্নামেন্ট খুব জমে উঠেছে। সব খেলোয়াড়দের দুই গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে এক গ্রুপে মিশুকে কেউ হারাতে পারেনি। সে নিশ্চিতভাবে ফাইনাল খেলবে। অন্য গ্রুপ থেকে ফাইনালে কে আসবে সেটা আগে থেকে বলা সম্ভব ছিল না কিন্তু অনুমান করা হচ্ছে যে মুনিয়া উঠে আসবে। মুনিয়া ভালো খেলছে সেটা নয়, সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মুনিয়াকে জিতিয়ে দিতে।

যখনই কেউ মুনিয়ার বিপক্ষে খেলছে তখনই সে ইচ্ছে করে ভুল চাল দিয়ে হেরে যাচ্ছে। লুডো খেলায় সেটা খুব সহজ, যখন একটা খুঁটি পেকে যাবার কথা তখন ভুল করার ভান করে দ্বিতীয়বার ঘুরিয়ে আনা যায়। শুধু তাই না মুনিয়া যেন কেটে ফেলতে পারে সে জন্যে ইচ্ছে করে তার সামনে বিপজ্জনকভাবে সবাই নিজের খুঁটি ফেলে রাখে। মুনিয়া ছোট মানুষ তাই সে বুঝতে পারছে না যে সবাই ইচ্ছে করে তার সাথে হেরে যাচ্ছে! তার ধারণা সে নিজেই অসাধারণ লুডো খেলে জিতে যাচ্ছে। সে খুবই খুশি।

টুনি গিয়ে শান্তকে খুঁজে বের করল, তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বলল, “শান্ত ভাইয়া তুমি একটা কাজ করে দেবে?”

“কত দিবি?”

টুনি মুখটা শক্ত করে বলল, “তুমি টাকা ছাড়া আর কিছু বুঝো না? কাজটা কী না শুনেই জিজ্ঞেস করলে কত দিব?”

“নিশ্চয়ই তোর কোনো একটা ফিচেল বুদ্ধির কাজ করতে হবে। টাকা ছাড়া হবে না।”

“আগে শুনে দেখো কী কাজ।”

“ঠিক আছে, বল।”

“আমি যখন বলব তুমি তখন লুডো খেলার এই ছক্কাটা কোনোভাবে গায়েব করে দেবে যেন আর কেউ খুঁজে না পায়।”

শান্ত চিন্তিত মুখে বলল, “তাহলে লুডো খেলবে কেমন করে? টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে না?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না, না টুর্নামেন্ট বন্ধ হবে না। আমার কাছে অন্য ছক্কা আছে।”

“তার মানে তুই ছক্কাটা বদলে দিতে চাস?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“এখন জানতে চেয়ো না, পরে বলব।”

“শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে। দশ টাকা।”

“আগে কাজ শেষ করে তারপর টাকা।”

“দিবি তো?”

“দিব। তুমি আর একটা কাজ করে দেবে?”

“কত টাকা?”

টুনি মাথা নাড়ল, “উঁহু, এটার জন্যে কোনো টাকা নাই। আমাদের টুর্নামেন্টের ছবি তুলে দাও। ছবি আর ভিডিও। মিশু ভাইয়া যখন খেলে তখন লুডো বোর্ডের ভিডিও!”

“লুডো বোর্ডের ভিডিও?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“পরে বলব।”

“ঠিক আছে।”

.

শাহানা বলেছিল তাকে ঘণ্টা খানেক সময় দিতে। কিন্তু সে আধা ঘণ্টার মাঝে ম্যাজিক ছক্কাটা তৈরি করে দিল। দেখে বোঝার উপায় নেই এই ছক্কার মাঝে এত ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে। চোখের কাছে নিয়ে খুব ভালো করে পরীক্ষা করলে বোঝা যায় এটা মাঝখানে কেটে আবার জোড়া দেয়া হয়েছে।

শাহানা টুনির হাতে ছক্কা আর একটা চুম্বক দিল। টুনির ধারণা ছিল চুম্বক মানেই একটা লোহার বার, এক পাশে লাল অন্য পাশে কালো রং করা। কিন্তু শাহানা দিল চ্যাপটামতো একটা ধাতব টুকরো, এইটা নাকি চুম্বক। তারপর সেটা শাহানার টেবিলের উপর পরীক্ষা করল, টেবিলের উপর ছক্কাটা ছেড়ে দিয়ে টুনি নিচে চুম্বকটা ধরতেই ছক্কাটা কেমন জানি লাফ দিয়ে ছয় উঠে গেল! যতবার পরীক্ষা করল ততবার ছয়! আবার চুম্বকটা উল্টে ধরতেই ছয়ের বদলে এক উঠতে লাগল। যতবার পরীক্ষা করল ততবার এক। আর যখন চুম্বকটা নিচে রাখে না তখন এই ছক্কাটা পুরোপুরি স্বাভাবিক একটা ছক্কা। টুনি খুশিতে শাহানাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল, “আপু তুমি একটা জিনিয়াস।”

শাহানা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল মুছে বলল, “একটা ছক্কাকে ইঞ্জিনিয়ারিং করতে জিনিয়াস হতে হয় না!”

.

টুনি তার ম্যাজিক ছক্কাটা নিয়ে যখন নিচে নেমে এসেছে তখন মুনিয়া আর শান্তর মাঝে সেমিফাইনাল খেলা হচ্ছে। অন্য গ্রুপের বিজয়ী হিসেবে মিশু জিতে এসেছে। এখন এই খেলাটিতে মুনিয়া জিতে গেলে সে মিশুর সাথে ফাইনাল খেলবে। সবাই মুনিয়ার পক্ষে, শান্ত নিজেও মুনিয়ার পক্ষে, যদিও সে সেটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। প্রত্যেকবার ছয় ওঠার পর সে আনন্দের ভান করে এমন চিৎকার, চেঁচামেচি, হইচই করতে থাকে যে মনে হয় সে বুঝি লটারিতে লক্ষ টাকা পেয়ে গেছে। মুনিয়াকে জেতানোর জন্যে সে তার পাকা খুঁটিগুলো তাকে খেতে দিচ্ছে কিন্তু প্রত্যেকবার তার একটা খুঁটি কাটা পড়লে সে যেভাবে চিৎকার করে আহাজারি করার ভান করতে থাকে যে দেখে মনে হয় খুঁটি নয় সে নিজেই বুঝি কাটা পড়েছে!

দেখতে দেখতে খেলা শেষ হয়ে গেল, মুনিয়া জিতে গিয়েছে এখন মিশুর সাথে ফাইনাল খেলা হবে। ঝুমু খালা এই মাত্র গরম গরম পিয়াজু ভাজা আর কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে সেগুলো খেল, তারপর ফাইনাল খেলা শুরু হলো। ছোট টেবিল ঘিরে দর্শকদের ভিড়, তার মাঝে টুনি তার চুম্বকটা টেবিলের নিচে ধরে উপরে ছক্কাটাকে নাচাতে পারবে।

খেলা শুরু হলো। প্রথম মুনিয়া চালল, একটা তিন উঠেছে। এরপর মিশু, টুনি লক্ষ করল খুব পাকা হাতে সে ছক্কাটা বদলে নিজের দুই নম্বরী ছক্কাটি দিয়ে খেলছে। সত্যি সত্যি ছয় উঠে গেল। সবাই একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল, শুধু টুনি শান্তভাবে বসে রইল, তার ভেতরে কোনো দুর্ভাবনা নেই। মিশু আরেকবার চালল, এবারে তিন উঠেছে। টুনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিশুর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট দেখতে পেল মিশু দুই নম্বরী ছক্কাটা বদলে আবার আগের ছক্কাটি দিয়ে দিয়েছে। টুনি তখন শান্তর দিকে তাকিয়ে ছক্কাটি গায়েব করে দেওয়ার ইঙ্গিত করল।

শান্ত হঠাৎ হুংকার দিয়ে বলল, এই পাজি বদমাশ বেয়াদব ছক্কাটাকে একটা শাস্তি দেয়া দরকার। কত বড় বদমাশ ছক্কা, মুনিয়ার উঠেছে তিন আর মিশু ভাইয়ার বেলায় একটা ছয় আরেকটা তিন! পাজির পা ঝাড়া–”

মিশু বলল, “ছক্কার উপর রাগ হয়ে লাভ নেই। এটা হচ্ছে ভাগ্য।”

শান্ত বলল, “ভাগ্যের খেতাপুড়ি।” তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে লুডো বোর্ড থেকে ছক্কাটাকে নিয়ে নিচে ফেলে সেটাকে পা দিয়ে লাথি দিতে থাকল। তাতেও তার রাগ কমল বলে মনে হলো না, তখন কোথা থেকে একটা হাতুড়ি বের করে ছক্কাটাকে এক হাতুড়ির আঘাতে টুকরো টুকরো করে ফেলল।

সবাই এত অবাক হলো যে বলার মতো নয়! প্রমি বলল, “শান্ত! তুই একটা পাগল নাকি? ছক্কাটাকে গুঁড়ো করে ফেললি? টুম্পা বলল, “এখন খেলবে কেমন করে?”

মুনিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “তাহলে আমরা খেলতে পারব না?”

টুনি বলল, “দুশ্চিন্তার কিছু নাই। আমার কাছে আরেকটা লুডোর সেট আছে সেখান থেকে ছক্কাটা নিয়ে আসি।”

প্রমি বলল, “যা, নিয়ে আয়।”

টুনি বলল, “আমার জায়গাটা যেন কেউ না নেয়।”

প্রমি বলল, “কেউ নেবে না।”

সবাই যখন শান্তর পাগলামো এবং নির্বুদ্ধিতা নিয়ে কথা বলছে টুনি তখন উঠে গেল এবং একটু পরেই ফিরে এলো। ছক্কাটা তার পকেটেই আছে কিন্তু কেউ যেন কিছু সন্দেহ না করে সে জন্যে উঠে গিয়ে ছক্কাটা আনার ভান করতে হলো।

টুনি ছক্কাটা বোর্ডের উপর রেখে বলল, “নে মুনিয়া খেল।”

মুনিয়া খেলার আগে মিশু ছক্কাটা হাতে নেয় এবং ঘুরিয়ে দেখে হঠাৎ করে তার মুখটা জানি কেমন হয়ে যায়। এই ছক্কাটা আগের ছক্কা থেকে একটু বড়, দেখতেও ভিন্ন। কাজেই সে আর হাতসাফাই করে নিজের দুই নম্বরী ছক্কা দিয়ে বদলে দিতে পারবে না! বদলে দিলেই সবাই ধরে ফেলবে। মিশু ছক্কাটা নিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে মিশু ভাইয়া?”

মিশু বলল, “না, মানে ইয়ে-না–মানে কিছু বলব না।”

টুনি মুনিয়াকে বলল, “মুনিয়া খেল।”

মুনিয়া ছক্কাটা ফেলার আগে টুনি তাকে থামাল, বলল, “মুনিয়া এক সেকেন্ড দাঁড়া। তোকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেই।”

“মন্ত্র?”

“হ্যাঁ। লুডো খেলার মন্ত্র। এই মন্ত্র পড়লে ছয় ওঠে।”

“যাহ্!” মুনিয়া অবিশ্বাসের শব্দ করল, বলল, “ছয় ফেলার মন্ত্র আবার আছে নাকি?”

“আছে। তুই চেষ্টা করে দেখ। আসল সোলেমানী জাদু বই থেকে শিখেছি।”

মুনিয়া এবারে মনে হয় একটু বিশ্বাস করল। জিজ্ঞেস করল, “কী মন্ত্র?”

টুনি বলল, “ছক্কাটা ফেলার আগে বলবি–

পাঁচ ঘষে ছয়, দুই নম্বরী ছক্কা
তুমি ভাব বুদ্ধি বেশি
আসলে তো ফক্কা!”

মুনিয়া একটু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “এইটা মন্ত্র?”

“হ্যাঁ। এইটা মন্ত্র আমার সাথে বল–”

মুনিয়া টুনির সাথে মন্ত্রটা বলল এবং ছক্কাটা ফেলল, সবাই দেখল ছক্কাটা বোর্ডের উপরে গড়িয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে একটা ডিগবাজি দিয়ে ছয় হয়ে গেল। দর্শকদের ভেতর থেকে বিশাল একটা আনন্দধ্বনি শোনা গেল।

টুনি আড়চোখে মিশুর দিকে তাকাল, দেখল মিশুর চেহারাটা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে একবারও সন্দেহ করেনি এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো তার চালাকিটা ধরতে পারবে। শুধু যে ধরে ফেলেছে। তা নয়, সেটা নিয়ে কবিতা বানিয়ে তাকে টিটকারি করছে। কী সর্বনাশ!

মুনিয়া আবার ছক্কা ফেলার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে; টুনিকে আবার মন্ত্রটা উচ্চারণ করতে হলো, মুনিয়া আবার টুনির সাথে সাথে মন্ত্রটা উচ্চারণ করল এবং ছক্কা ফেলল। ছক্কাটা আবার গড়িয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে কেমন জানি ব্রেক করে একটা লাফ দিয়ে ছয় হয়ে গেল। আবার বিশাল আনন্দধ্বনি, শুধু মিশু ছক্কার এই বিচিত্র আবরণ দেখে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।

তৃতীয়বার ছক্কা খেলার সময় টুনি তার চুম্বকটা সরিয়ে রাখল, এবারে একটা চার উঠল। মুনিয়া তার দুটো খুঁটি তুলে একটা চার চেলে ছক্কাটা মিশুর দিকে এগিয়ে দিল।

মিশু আড়চোখে সবার দিকে একবার তাকিয়ে ছক্কাটা ফেলল, ছক্কাটা গড়িয়ে যায় এবং সত্যি সত্যি একটা ছয় উঠে গেল। দর্শক এবারে একটু থিতিয়ে যায়। টুনি মুনিয়াকে বলল, “তুই আবার মিশু ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে মন্ত্রটা বল, দেখি কাজ করে কি না।”

মুনিয়া মিশুর দিকে আঙুল নেড়ে নেড়ে বলল—

“পাঁচ ঘষে ছয়, দুই নম্বরি ছক্কা
তুমি ভাবো বুদ্ধি বেশি
আসলে তো ফক্কা!”

মুনিয়ার মন্ত্রে কাজ হলো। দেখা গেল পরপর আরো দুটি ছয় উঠে তিন ছক্কার কারণে সব বাতিল হয়ে গেল। চতুর্থবার যখন খেলেছে তখন ছক্কাটা শুধু যে বিচিত্রভাবে লাফ দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে যে এক হয়ে গেল তা নয়, সেই অবস্থায় একটু ঘুরপাকও খেল। কাজেই মিশুর কপালে জুটেছে মাত্র এক।

সবাই আনন্দধ্বনি করল এবং আনন্দধ্বনি থামার পর মিশু শুকনো গলায় বলল, “কিছু একটা গোলমাল আছে।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী গোলমাল মিশু ভাইয়া?”

“ছক্কাটা ঠিকভাবে পড়ছে না। কেমন যেন—”

“কেমন যেন কী?”

মিশু বাক্যটা শেষ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, “না, কিছু।”

এতক্ষণে মন্ত্রটা অন্য সবাই শিখে গেছে কাজেই প্রতিবার দান চালার সময় সবাই সমস্বরে চিৎকার করে মন্ত্র পড়তে লাগল এবং প্রতিবার মুনিয়ার কমপক্ষে একটা করে ছয় উঠতে লাগল। শুধু তা-ই না, মন্ত্রটা মিশুর বিরুদ্ধে কাজ করছে তাই প্রত্যেকবার তার এক উঠতে লাগল।

মিশুকে প্রথমে একটু হতবাক, তারপরে বিষণ্ণ, শেষে রীতিমতো অসুস্থ দেখাতে লাগল। সে যেহেতু বুদ্ধিমান তাই কিছুক্ষণের মাঝেই কী হচ্ছে বুঝে গেল। কিন্তু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল না। একবার খুবই দুর্বলভাবে বলল, “ইয়ে-মানে-একটা জিনিস লক্ষ করেছ! আমার উঠছে শুধু এক আর মু-ি নয়ার উঠছে শুধু ছয়। এটা খুবই বিচিত্র। প্রোবাবিলিটির নিয়ম অনুযায়ী এটা সম্ভব না।”

টুনি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ মিশু ভাইয়া। এইবারের টুর্নামেন্টে সবই আজব। আমি লক্ষ করছিলাম তুমি যখন খেলছিলে একবারও পাঁচ ওঠে নাই। এইটা কি সম্ভব?”

মিশু আমতা আমতা করে বলল, “পাঁচ? মানে পাঁ পা পাঁচ?”

“হ্যাঁ। প্রোবাবিলিটির নিয়ম কি বলে মিশু ভাইয়া? পাঁচ না উঠে তার বদলে ছয় ওঠার প্রোবাবিলিটি কি সমান নাকি বেশি?”

উপস্থিত দর্শকেরা অবশ্যি টুনি এবং মিশুর এই আলাপে কোনো কৌতূহল দেখাল না। তারা মন্ত্র এবং মন্ত্রের ফলাফল দেখেই খুশি, এ রকম আসলেই হওয়া সম্ভব কি না সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।

কিছুক্ষণের মাঝেই মিশু খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল এবং দেখা গেল মুনিয়া যখন তার সবগুলো খুঁটি পাকিয়ে ফেলল তখনো তার সবগুলো খুঁটি ঘরের মাঝে আটকা পড়ে আছে, লুডো খেলার ইতিহাসে এ রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না!

নিয়ম অনুযায়ী পরপর দুইবার খেলায় জিততে হবে। কিন্তু প্রথমবার হারার পরই মিশু পরাজয় স্বীকার করে নিল। সে আর খেলতে চাইল না।

.

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আবার দাদিকে প্রধান অতিথি হিসেবে ধরে আনা হলো। দাদির সাথে ঝুমু খালাও চলে এসেছে। দুইটা চেয়ারে দুইজনকে বসানো হয়েছে। ঝুমু খালা দাদির পাশে চেয়ারে বসতে রাজি হচ্ছিল না তখন দাদি তাকে একটা ধমক দিলেন, বললেন, “দেখছ না বাচ্চারা একটা অনুষ্ঠান করছে তুমি তার মাঝে ঝামেলা করছ। যা বলছে শুনো।”

ঝুমুখালা তখন কাঁচুমাচু হয়ে দাদির পাশে বসল। সবাই তখন বক্তৃতা দিল, দাদি বক্তৃতা দেয়ার সময় বললেন, “দিন-রাত খালি খেললে হবে না, লেখাপড়াও করতে হবে। এই দেখিস না মিশু লেখাপড়া করে কত বড় হয়েছে–”

টুনি তখন হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদি একজন যদি লেখাপড়া করে চোর হয় সেইটা ঠিক আছে?”

দাদি বললেন, “ধুর! সেইটা ঠিক হবে কেন? লেখাপড়া করে চোর হবে কেন?

“যদি হয়?”

“না, না। ছিঃ।” দাদি জোরে জোরে মাথা নাড়ল। বলল, “লেখাপড়া করে কেউ যেন চোর না হয়।”

বক্তৃতা পর্ব শেষ হবার পর প্রথমে মিশুকে রানার্সআপের পুরস্কার হিসেবে একটা সার্টিফিকেট দেয়া হলো। সার্টিফিকেটের এক কোনায় লাল কলম দিয়ে কে যেন লুডো খেলার মন্ত্রটা লিখে রেখেছে। সেটা দেখে মিশুর কান পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল।

মিশুর পর মুনিয়াকে তার পুরস্কারের একশ টাকা তুলে দেয়া হলো। দর্শকদের চিৎকারে ঘর ফেটে যাবার অবস্থা।

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “মুনিয়া তুই এত টাকা দিয়ে কী করবি? আমাকে অর্ধেক দিয়ে দে।”

“না দিব না।” মুনিয়া মাথা নেড়ে বলল, “আমার লাগবে।”

“কেন লাগবে?”

“বলব না।”

শান্ত বলল, “বল। শুনি।”

“উঁহু বলব না।”

টুম্পা বলল, “আমি জানি। বলব?”

মুনিয়া গলা উঁচিয়ে বলল, “না। তুমি বলতে পারবে না আপু। ভালো হবে না কিন্তু।”

কাজেই টুম্পা সেটা বলতে পারল না। বলতে না পারলেও কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ কারণটা কীভাবে কীভাবে জানি সবাই জেনে গেছে। তাদের বাসার সামনের রাস্তাটি প্রতিদিন ভোরে একজন মহিলা ঝট দেয়। তার ছোট একটা বাচ্চা আছে, বাচ্চাটাকে পথের ধারে বসিয়ে রাখে। ধুলাবালির মাঝে নোংরা একটা শার্ট পরে সে বসে বসে চারিদিকে তাকায়, হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে। পথ থেকে নোংরা, ময়লা, সিগারেটের বাঁট তুলে মুখে দিয়ে দেয়। বাচ্চাটার জন্য মুনিয়ার খুব মায়া হচ্ছে। স্কুলে যাবার সময় তাকে পেলে মুনিয়া তার সাথে কথাবার্তা বলে। বাচ্চাটা ঢুলুঢুলু চোখে তার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ফিক করে হেসে দেয়। মুনিয়া এই বাচ্চার জন্য একটা সুন্দর জামা কিনতে চায়-খোঁজ নিয়ে জেনেছে সে জন্যে একশ টাকার মতো লাগবে। সেই জন্যেই তার টাকাটা দরকার!

মিশুর আরো কয়েক দিন থাকার কথা ছিল কিন্তু সেই দিন বিকালেই সে চলে গেল। শান্ত তাকে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। লুডো খেলার সময় আসলে কী কী ঘটেছে সেটা এতক্ষণে সবার কাছে জানাজানি হয়ে গেছে।

মিশুকে বিদায় দেবার আগে শান্ত বলল, “বুঝলে মিশু ভাইয়া, তুমি বলেছিলে না বেশি ভালো মানুষ হয়ে লাভ নাই? মাঝে মাঝে দুই নম্বরি হতে হয়। বলেছিলে না?”

মিশু কথা না বলে চুপ করে রইল। শান্ত বলল, “কথাটা ঠিক না। দুই নম্বরি হওয়া খুবই ডেঞ্জারাস।”

মিশু এবারেও কথা বলল না, মুখটা শুধু আরেকটু শক্ত হয়ে গেল। শান্ত বলল, “তোমার মাথায় যে রকম বুদ্ধি, আমাদের টুনির মাথাতেও সে রকম অনেক বুদ্ধি! একেবারে চিকন বুদ্ধি। তোমার থেকে বেশি। তুমি দুই নম্বরি কাজ করেছ দেখে তোমাকে টাইট করে ছেড়ে দিয়েছে। দিয়েছে কি না?”

মিশু হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলল না। শান্ত দার্শনিকের মতো বলল, “বুঝলে মিশু ভাইয়া। দুই নম্বরি মানুষ হওয়া ঠিক না! ধরা পড়লে মাইর খাওয়ার চান্স থাকে। মাইর মানে মাইর–উথাল-পাতাল মাইর। অস্থির মাইর! বেইজ্জতির চূড়ান্ত। বেইজ্জতি বলে বেইজ্জতি…।”

শান্তর কথা শেষ হওয়ার আগেই মিশু প্রায় লাফ দিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে গেল!

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল