পুতুলরাণী হাপিস হয়ে যাওয়াতেই হাফ-খরচা হয়ে গেল নিতাই। কৌপিন ধরল, জটা রাখল। কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ। লোকে নাম দিল খ্যাপা নিতাই।

খ্যাপা নিতাই এখন ওই বসে আছে শিমুল গাছের তলায়। রক্তাম্বরের কোঁচড়ে পো-দেড়েক মুড়ি। সকাল থেকেই আজ রোদ আর বাতাসের বড় বাড়াবাড়ি। উত্তরে হাউড় বাতাস এসে কলকল করে কথা বলছে গাছের পাতার সঙ্গে, মাঝে মাঝে টানা দীর্ঘশ্বাস তুলে যাচ্ছে ডালপালায়। খসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শালের শুকনো পাতা। নিতাইয়ের চারদিকে থিরিক থিরিক নেচে নেচে কয়েকটা শালিখ আর কাক অনেকক্ষণ ধরে মুড়ির ভাগা চাইছে। এক মুঠ মুড়ি মুখে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ একটা ভাবনা এল মাথায়। সামনেই শালার হ্যাট মাথায় সাইকেলে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে মদন ঠিকাদার নতুন রাস্তা তৈরির কাজ তদারক করছে। দুরমুশ করা মাটির ওপর ইট সাজানো শেষ হয়েছে। এখন ঝুড়ি ঝুড়ি পাথরকুচি ঢালছে কামিনরা।

নিতাই ভাবল, শালারা করছেটা কী? তার হাঁ করা মুখের দরজায় কোষভরা মুড়ি থেমে ছিল অসাবধানে, অন্যমনস্কতায়। পাজি বাতাস এসে এক থাবায় বারো আনা মুড়ি উড়িয়ে নিয়ে ছড়িয়ে ফেলল চারদিকে। নিতাই বেকুবের মতো চেয়ে কাণ্ডটা দেখল, তারপর মুঠোভর যেটুকু মুড়ি ছিল তাও উড়িয়ে দিয়ে বলল, খা শালারা পঞ্চভূত!

বাকি মুড়ি কোমরে বেঁধে উঠে গেল নিতাই। সামনের গড়ানে জমি ধরে নেমে গিয়ে মদনের দু-তিন হাত পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোমরে হাত রেখে মাতব্বরের মতো উত্তর-দক্ষিণে টানা নতুন রাস্তাটার ঘেয়ো চেহারা দেখল। অবশ্য কাজ শেষ হলে এতটা ঘেয়ো দেখাবে না। তখন গাড়ি যাবে, মানুষ, গোরু, কুকুর হাঁটবে। গলা খাঁকারি দিয়ে সে খুব নরম গলায় বলল, মদনবাবু, এই এত এত রাস্তা তৈরি করা কি ভাল হচ্ছে?

মদন ঠিকাদার আলকাতরার মতো কালো, লম্বা। মস্ত গোঁফ আছে তার। ভীষণ রাগী চেহারা। একবার ফিরে তাকাল মাত্র। চোখে আগুন।

নিতাই তাতে ভয় খায় না। সেও সাধক, তান্ত্রিক। বলল, দুনিয়াময় যদি রাস্তাই বানায় মানুষ, কেবল বাড়িঘর বানিয়ে বানিয়েই যদি জায়গা ভরাট করে, তবে চাষবাসইবা হবে কোথায়, মানুষ খাবেই বা কী? কথাটা ভেবে দেখবেন একটু? আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি, একেবারে মুখ নই।

মদন একটি কথাও বাজে খরচ করে না। ভারী গম্ভীর মানুষ। যারা কম কথা বলে, যারা প্রয়োজনের চেয়েও কম কথা বলে তাদের লোকে কী জানি কেন একটু ভয় পায়। মদন কখনও কাউকে মারেনি ধরেনি, গালাগালও করেনি বড় একটা, তবু কুলি কামিন থেকে বন্ধুলোক পর্যন্ত তাকে একটু খাতির দেখিয়ে চলে। খ্যাপা নিতাইয়ের কথারও কোনও জবাব দেয় না মদন। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার কাজ দেখতে থাকে।

মদন জবাব না দিল তো বয়েই গেল নিতাইয়ের। কিন্তু সাহস করে একটা মস্ত তত্ত্বকথা যে মদন ঠিকাদারকে বলতে পেরেছে সে তাতেই ভারী খুশি হল। ফের ঢিবির ওপর উঠে শিমুলের ছায়ায় জমিয়ে বসল সে। একটা কাকের দিকে চেয়ে বলল, নিতাই কাউকে উচিত কথা বলতে ছাড়ে না, হ্যাঁ।

 

আজ সকালে খুব ঘন কুয়াশা ছিল। শেষ রাত থেকে বাঁদুরে টুপি আর তুষের চাদরে জাম্বুবান সেজে দক্ষিণের টানা বারান্দায় কাঠের ভারী চেয়ারখানায় বসে আছে শ্রীনাথ। তার চোখের সামনেই কুয়াশার আড়ালে রোগা-ভোগা ন্যাড়া মাথা কমজোরি সূর্যেব উদয় হল। তারপর অবশ্য কুয়াশা কেটে ঝা ঝা রোদ ফুটেছে। শ্রীনাথ টুপি আর চাদর খুলে ফেলেছে অনেকক্ষণ। বাগানে উবু হয়ে বসে বসে এ গাছ সে গাছের পায়ে ধরে, গায়ে হাত বুলিয়ে বাবা-বাছা বলে সেবা দিচ্ছে। রোদের তাপে আর পরিশ্রমে গেঞ্জি ভিজে ঘাম ফুটে উঠল। ফর্সা রং এখন টমেটোর মতো টুকটুকে। কনুই পর্যন্ত মাটি মাখা, সারা মুখে ধুলোবালি। শেষ শীতে পালঙের শিষ হঠাৎ লাফিয়ে ঢ্যাঙা হয়ে উঠেছে হাত দেড়েক। তারই আড়াল থেকে দেখতে পেল, বারান্দার সামনের দিকে কোণে একটা সাদা কাপ ডিশ দিয়ে ঢেকে রেখে গেছে কে যেন। দু হাতে তালি বাজিয়ে মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে আসে শ্রীনাথ। বারান্দার নীচে চায়ের কাপটার তলাতেই একটা মস্ত গো-হাড় কামড়াচ্ছে খ্যাপা নিতাইয়ের কুকুর ইস্পাত। ব্যাটা চায়ের কাপটা শুঁকেটুকে দেখেনি তো! চা রেখে গেছে, কিন্তু তাকে ডেকে দিয়ে যায়নি। শ্রীনাথ চায়ের কাঁপে জ্বর দেখার মতো হাত ছুঁইয়ে দেখল, নিমঠান্ডা। এর চেয়ে বেশি এ বাড়ির লোকের কাছে সে আশাও করে না। আস্তে আস্তে ঠান্ডা চা-ই খেয়ে নেয় শ্রীনাথ। অভিমান বা রাগ করে লাভ নেই। বউ, মেয়ে, ছেলে, এরা সবাই তার আপনজনই তো। আদরযত্ন করার ইচ্ছে থাকলে এমনিতেই করত। এখন এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে সে কিছুই আর নতুন করে ঢেলে সাজাতে পারবে না।

নিতাইয়ের কুকুরটা কুঁই কুঁই করে এখন তার পায়ের ফাঁকে মুখ গুঁজে আদর কাড়বার চেষ্টা করছে। গো-হাড় চিবোচ্ছিল, ঘেন্নায় পা তুলে বসে শ্রীনাথ। কিন্তু নেই-আঁকড়া কুকুরটা কি তাতে ছাড়ে? শ্ৰীনাথ বলল, হাড়টা তো এনে ফেলেছ বাপ, কিন্তু আবার যে সেটা বাইরে গিয়ে রেখে আসবে সে বুদ্ধি নেই। সাধে কি কুকুর বলেছে!

ফটক ঠেলে বদ্রী ঢুকল। গায়ে জহর কোট, পাজামা, হাতে ফোলিও ব্যাগ, চতুর গোঁফ। সোজা এসে রোদে-তাতা বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসল। ব্যাগ খুলে কাগজপত্র বের করতে করতে বলল, প্রমথবাবুর জমিতে বর্গা রেজিস্ট্রি হয়ে আছে। ওঠানো যাবে না। তবে বর্গার দরুন দাম কিছু ছাড়তে রাজি আছেন।

শ্রীনাথ বলে, আমি নিজে চাষ করাব। বর্গাদার দিয়ে হবে না।

সে আপনি করুন না! বর্গার আইন তো তাতে পালটে যাচ্ছে না। চাষ আপনি করালেও সেই তে-ভাগাই হবে। বর্গা পাকা খুঁটি।

শ্রীনাথ সবই জানে। গভীর শ্বাস ফেলে বলল, এ তো ধান চাষ নয়। আমি করব ভেষজের চাষ।

উকিলবাবুকে সব বলেছি। উনি বললেন, হওয়ার নয়।

বর্গাদার কে? দেখা করেছিলি তার সঙ্গে?

সে এক তেরিয়া ধরনের ছেলে। তবে বলছিল, প্রমথবাবুর কাছ থেকে হাজার পাঁচেক টাকা পেলে আদালতে গিয়ে বলবে যে, চাষ সে করত না। কিন্তু উকিলবাবু সেই ফঁদে পা দিতে নিষেধ করেছেন। ওরা যখন-তখন কথা পালটায়। টাকা খাওয়ার পর আদালতে দাঁড়িয়ে উলটো কথা বললে কিছু করার থাকবে না।

শ্রীনাথ খানিক ভেবে বলে, তুই বরং কোনও চাষির জমি দ্যাখ, যে নিজে চাষ করে। বর্গার গন্ধ যেন না থাকে।

বদ্রী মাথা নেড়ে বলে, সে দেখব। কিন্তু কাছে-পিঠে হবে না।

দুরেই যাব।

অনেক দূর হলেও যাবেন? সেখানে নিজে গিয়ে চাষ করানো মানেই স্থায়ীভাবে থাকা।

থাকতে তো হবেই।

চাষ করাবেন বলছেন, তার মানে তো আবার সেই বর্গার খপ্পরে পড়ে গেলেন।

চাষ করাব না। ভাবছি নিজেই করব।

হাল গোরু সব কিনবেন? তার ওপর বলদের দেখাশোনা, লাঙলের মেরামতি, আরও কত কী সব করতে হবে। চাকরি করে কি পারবেন অত সব?

পারব। চাকরি করার ইচ্ছে থাকলে আর জমি করতে যেতাম নাকি? ভেষজের চাষে লাভও যেমন, তেমনি লোকের উপকারও হবে।

বদ্রী চারদিক দেখে নিয়ে নিচু গলায় সাবধানে বলে, বউঠান সঙ্গে যাবেন বলে তো বিশ্বাস হয়। সেখানে একা থেকে অসুখে পড়লে?

শ্রীনাথ চায়ের খালি কাপটা প্লেটের ওপর উপুড় করে ঘোরাতে ঘোরাতে হেসে বলে, এখানে অসুখ করলেই বা দেখছেটা কে? এখানেও একা, সেখানেও একা। তুই দ্যাখ।

 

দুধের মধ্যে সর ভাসলে ভারী ঘেন্না পায় সজল। রোজ তার দুধ ছাঁকনিতে ভাল করে ছেঁকে দেওয়া হয়। আজও তাই দিয়েছিল মেজদি মঞ্জুলেখা। তবু এক কুচি সর কীভাবে রয়ে গিয়েছিল তাতে। ওয়াক তুলে খুব চেঁচামেচি করেছে সজল। তাইতেই মায়ের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছে মেজদি।

শোওয়ার ঘরের মস্ত বিছানাটা বলটান দিয়ে রাখা হয়েছে। পাহাড়-প্রমাণ উঁচু সেই বিছানা আর খাটের বাজুর মধ্যে যে খাজটুকু, সেইখানে উপুড় হয়ে পড়ে কাদছে মঞ্জুলেখা। মায়ের চিমটিতে তার ডান গাল ফুলে লাল হয়ে লঙ্কাবাটার মতো জ্বলছে। এই গাল নিয়ে সে লোকের সামনে বেরোয়। কী করে এখন? তাই এক পুকুর দুঃখের মধ্যে ড়ুবে কাদছে মঞ্জুলেখা। এ সময়ে খিচ করে চুলে একটা টান পড়ল। একবার। দু’বার। দূর থেকে সজল ছিপ ঘুরিয়ে বঁড়শি মারছে, চুলে। মুখটা তুলে মঞ্জুলেখা বলল, মরিস না কেন তুই?

সজল ছিপটা সামলে নিয়ে হি হি করে হেসে বলল, মাকে গিয়ে বলে দেব?

বল গে যা। কচু করবে।

যাচ্ছি তা হলে। বলব, মেজদি আমাকে বলেছে তুই মর।

সজল ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বিছানার খাঁজ থেকে উঠে পড়ল মঞ্জুলেখা। তাড়াতাড়ি এলো চুলে খোঁপা বেঁধে নিল। চুপিসারে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তারপর মস্ত বাগানের গাছপালার মধ্যে পালিয়ে গেল।

সজল মায়ের কাছে নালিশ করবে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল উঠোনে। উঠোন পেরিয়ে বান্নাঘরে যেতে যেতে আকাশের ঘন নীলের দিকে চাইল। দেখল শীতের অফুরান রোদে ঘর ছেড়ে বেরোনোর ডাক। আস্তে আস্তে শ্লথ হয়ে গেল তার পা।

বাগানের চারধারে শক্ত বেড়া আছে। উঠোনের চারধারে আছে নিচু ঘের-পাঁচিল। ফটক ঠেলে খ্যাপা-নিতাই ঢুকে এল। বাগান থেকে সদ্য তুলে আনা একটা মস্ত রাঙা মুলো তার হাতে। সঙ্গে ইত। চেঁচাতে চেঁচাতে বলছে, গরম রুটি ডাল আর কাঁচা মুলো… ডাল রুটি কাঁচা মুলো, এর

ওপর কথা হয় না।

নিতাইয়ের ওপর এ বাড়ির কেউ খুশি নয়। একটা বাড়তি লোক খামোখা ঘাড়ের ওপর বসে খায়, থাকে। মন করলে কিছু কাজে আসে, পাগলামি চাড়ান দিলে কেবল বসে বক বক করে। রোজ রাতে পুতুলরাণীর একটা ছবি আঁকে কাগজে। তারপর মন্ত্র পড়ে বাণ মারে।

নিতাইকে ভারী ভাল লাগে সজলের। এই একটা লোক যার কোনও সময়েই কোনও কাজ থাকে, যাকে যখন খুশি ডাকলেই পাওয়া যায়, যার কাছে মনের কথা যা খুশি বলা যায়। সংসারে আর সবাই ভারী ব্যস্ত, সকলেরই ভারী তাড়া, নিজের গম্ভীর বাবার কাছে কখনওই প্রায় ঘেঁষতে পারে না সে। সবচেয়ে ভালবাসে যে মা, সেও চৌপর দিন সংসারের হাজারও কাজে ব্যস্ত থাকে বলে তেমন পাত্তা দিতে চায় না। সে শুনেছে যখন তারা খুব গরিব ছিল তখন বড়দি চিত্রলেখাকে পুষ্যি নিয়েছিল মেজমাসি। বড়দি সেই মাসির কাছে এলাহাবাদে থাকে। তাকে ভাল করে দেখেইনি সজল। আর দুই দিদির সঙ্গে ভাল বনিবনা নেই সজলের। মেজদি আর ছোড়দি দুজনেই হিংসুটির হদ্দ। মা সজলকে কিছু বেশি ভালবাসে বলে ওরা তাকে সহ্য করতে পারে না। তবে ভয় পায়।

খ্যাপা নিতাইয়ের খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরের দিকে হন্যে হয়ে যেতে যেতে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সজলকে দেখে বলল, আজ মদন ঠিকাদারকে খুব বকে দিয়ে এসেছি। পালপাড়ার জমি গায়েব করে রাস্তা বানাচ্ছিল।

সজল সঙ্গ ধরে বলল, আজ কোথাও নিয়ে যাবে নিতাইদা?

নিতাই আড়চোখে চেয়ে বলে, যাবে কোথায়? চারদিকে ট্যাম-গোপাল বসে আছে। ধরবে।

হি হি করে হাসে সজল। ট্যাম-গোপালের গলায় মত্ত ঘ্যাঘ। তাই দেখে সজল ভয় পেত বরাবর। ওই ঘ্যাঘের জনাই গোপালের নাম হয়েছিল ট্যাম-গোপাল। তার নাম করে সজলকে এতকাল ভয় দেখিয়ে যা করার নয় তাই করিয়ে নিয়েছে বাড়ির লোক। কিন্তু সজল যে আর অত ছোট নেই তা সবাই এখনও তেমন বুঝতে পারে না। সে বলল, টাম-গোপালের সঙ্গে আমার কবে ভাব হয়ে গেছে। চালাকি কোরো না নিতাইদা, আজ নদীর ধারে কাঁকড়া খুঁজতে যাব।

হবে হবে।

বলে নিতাই রান্নাঘরমুখো হাঁটা দেয়। সঙ্গে ইস্পাত, হাতে মুলো।

বাগানে একটা ছোট্ট পুকুর আছে। গাছে জল দেওয়ার জন্য বাবা কাটিয়েছিল। এখন তাতে কিলবিল করে আমেরিকান কই মাছ। এ বাড়ির কেউ এই মাছ খায় না। সজলের কাজ না থাকলে এসে চুপচাপ ছিপ ফেলে মাছ ধরে। পরে লুকিয়ে সেগুলো বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। কাজ নেই বলে সজল ছিপ হাতে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসল। আটার টোপ ফেলে মাছের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

 

বদ্রী চলে গেলে শ্রীনাথ উঠল। অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে। বেশ একটু দেরিতেই যায়, রাত করে ফেরে।

বাইরের দিকে নিজের এই আলাদা ছোট্ট ঘরখানা শ্রীনাথের একার। এ ঘরে কদাচিৎ কেউ আসে। দাদা মল্লিনাথ এ বাড়ি বানিয়েছিল নিজের পছন্দমতো। এই ঘরটা ছিল ভাবন-ঘর। চিন্তা-ভাবনা করার জন্য যে বাড়িতে একটা আলাদা ঘর থাকা দরকার এটা একমাত্র তার মাথাতেই আসতে পারে যার মাথার স্কু কিছু ঢিলে। বলতে নেই মল্লিনাথের মাথার কলকবজা কিছু ঢিলেই ছিল। বেশি বয়স পর্যন্ত ব্যাচেলর থাকলে যা হয়। অবরুদ্ধ কাম গিয়ে মাথায় চাড়া দেয়, নারীসঙ্গহীনতায় মনটা হয় ভারসাম্যহীন। পৃথিবীতে মেয়ে এবং ছেলে এই দুই জাতের সৃষ্টি যখন হয়েছে তখন তার পিছনে একটা কারণও থাকার কথা। এককে ছেড়ে আর একের কি পুরোপুরি চলে? শেষ দিকটায় মল্লিনাথের খুব সেবা করেছিল শ্রীনাথের বউ তৃষা। সেই কৃতজ্ঞতাতেই মলিনাথ তার গোটা বাড়ি সম্পত্তি সব তাকে উইল করে দিয়ে গেল। আর সেই থেকেই এ বাড়িতে পর হয়েছে শ্রীনাথ।

মল্লিনাথের এই ছোট্ট ভাবন-ঘরে সে থাকে। তার জাগতিক যা কিছু আছে সব এই ঘরটুকুর মধ্যে। তাও সব কিছু তার নিজের নয়। ওই ইজিচেয়ারটা মল্লিনাথের। লেখার ডেসকটাও তারই। দিশি মিস্ত্রি দিয়ে বানানো মজবুত চৌকিটার মালিক অবশ্য শ্রীনাথ। কিন্তু বইয়ের আলমারিটা মল্লিনাথের। এই ঘরে এই বাড়িতে বাস করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তেই শ্রীনাথের মনে হয়, সে পরের ঘরে বাস করছে। প্রতি মুহূর্তেই সে বোধ করে, এ বাড়ির দখল নিয়ে তারা ঠকাচ্ছে কাউকে।

মল্লিনাথের বিষয়-সম্পত্তির দাবিদার আরও দু’জন আছে। শ্রীনাথের ছোট দুই ভাই দীপনাথ আর সোমনাথ। দীপ অন্য ধরনের মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটন ও অঘটনের দিকেই তার ঝোক, কে কোথায় কবিঘে জমি নিয়ে বসে আছে তা তার মাথাব্যথার বিষয় নয়। দীপ অতিশয় জটিল চরিত্রের মানুষ, তাকে একদম বুঝতে পারে না শ্রীনাথ। কিন্তু ছোট সোমনাথ জটিলতার ধার ধারে না। মানুষের সহজ সরল লোভ হিংসা প্রবৃত্তির বশে সে চলে। অর্থাৎ সোমনাথ খুবই স্বাভাবিক। উপরন্তু তার ভাবের বিয়ের বউ আর শাশুড়ি তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দেয়। সুতরাং, সে প্রথম-প্রথম এসে বড়দার সম্পত্তির ভাগ নিয়ে শ্রীনাথ আর তৃষার সঙ্গে একটা রফা করার কথা বলত। শ্রীনাথ এ সম্পত্তি চায় না, তার আগ্রহ বা কৌতূহল নেই। সে থাকত চুপচাপ। সোমনাথের সঙ্গে লড়ত তৃষা একা। কিন্তু একাই সে একশো। প্রথম-প্রথম সোমনাথ নরম গরম কথাবার্তায় তুতিয়ে পাতিয়ে সম্পত্তি ভাগ করাতে চাইত, পরে সে নরম ছেড়ে গরম হল। রবিবার বা ছুটির দিনে এসে সে তুমুল ঝগড়া বাঁধাত তৃষার সঙ্গে। প্রায় সময়েই সঙ্গে করে আনত তার অল্পবয়সি প্রায় বালিকা বউকে। সে বউটিও গলার জোরে কিছু কম যায় না। কোনও পক্ষকেই কোনওদিন হার মানতে বা ক্লান্ত হয়ে পড়তে দেখেনি শ্রীনাথ। ছুটির দিন এলে পারতপক্ষে সে নিজে আর এ বাড়িতে থাকত না। দূরে কোনও গ্রামগঞ্জে চাষ-আবাদ দেখার নাম করে চলে যেত।

খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই একদিন সোমনাথের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। গত বছর শীতকালে এক রবিবারে এসে সারা দিন সোমনাথ আর শমিতা থেকেছিল এ বাড়িতে। দফায় দফায় প্রবল ঝগড়াঝাটি হল দু’পক্ষে। সন্ধেবেলা যখন স্বামী-স্ত্রী কলকাতার ট্রেন ধরতে স্টেশনে যাচ্ছে তখন বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে দু’ শো গজ যেতে না যেতেই নির্জন রাস্তায় দুটো লোক এসে ধরল তাদের। একজন শমিতাকে রাস্তার ধারে ঝোপঝাড়ের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে গয়নাগাটি কেড়ে বদ মতলবে মাটিতে পেড়ে ফেলেছিল। অন্যজন লোহার রড দিয়ে চ্যাঙা-ব্যাঙা করে পিটিয়েছিল সোমনাথকে। হাতব্যাগ, ঘড়ি, মানিব্যাগ হাপিস করেছিল। শমিতা অবশ্য চরম লজ্জাকর ঘটনাটা ঘটতে দেয়নি। তার প্রবল প্রতিরোধ আর আঁচড় কামড়ে ধর্ষণকারী লুঠেরাটি নিবৃত্ত হয়। কিন্তু সোমনাথকে দিনতিনেক হেলথ সেন্টারে পড়ে থাকতে হয়েছিল। পুলিশ সেই ঘটনায় কাউকে আজও ধরতে পারেনি। সোমনাথকে যে লোকটা পিটিয়েছিল সে লোকটা নাকি ছিল বেশ লম্বা আর দশাসই চেহারার। আর শমিতাকে যে ধরেছিল সে নাকি ছিল নরম-সরম শরীরের ছোটখাটো মানুষ। দু’জনেরই মুখে ভুষো কালি মাখা ছিল বলে ওদের ভাল বর্ণনা দিতে পারেনি শমিতা আর সোমনাথ। তবে শমিতা বলেছে, তাকে যে ধরেছিল তার মুখে পচা মাছের মতো প্রবল এক দুর্গন্ধ পেয়েছে সে। কিন্তু এই অস্পষ্ট বিবরণ থেকে কাউকে চেনা মুশকিল। শ্রীনাথ অনেক ভেবেছে, কিন্তু এ অঞ্চলের কোনও মানুষকেই ওই দুই বদমাশ বলে মনে হয়নি। তবে সোমনাথ স্পষ্টই তাকে বলেছে, এ কাজ করিয়েছে তৃষা।

শ্রীনাথের কোনও পক্ষপাত নেই। তৃষা এ কাজ করালেও করাতে পারে। তৃষার হাতে লোকের অভাব নেই। ঘরামি, মাটিকাটা মজুর, রাজমিস্ত্রি, দালাল, পলিটিকসওয়ালা, পুলিশ দারোগা সকলের সঙ্গেই তৃষা সদ্ভাব রেখে চলে। শুধু ছিনতাই করার জন্যই যদি সোমনাথ আর শমিতাকে ধরেছিল ওরা তবে খামোখা সোমনাথকে অত মারল কেন? সোম্নাথ মার খাওয়ার পর অবশ্য শ্রীনাথ তৃষাকে ভাল করে লক্ষ করে দেখেছে। কোনও ভাবান্তর চোখে পড়েনি। কিন্তু শ্রীনাথ এও জানে, মুখের ভাবে ধরা পড়ার মতো কাঁচা মেয়ে তৃষা নয়। এই পুরো জমিজমা, সম্পত্তি একা হাতে সামলাচ্ছে তৃষা। সোমনাথ মার খেয়ে ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই দাদার সম্পত্তির ভাগ দাবি করে মামলা ঠুকেছে। সেই মামলাও একা চালাচ্ছে তৃষা। আদালতে গিয়ে উইলের প্রোবেট বের করেছে। উকিলের বাড়ি যাতায়াত করছে। দরকারমতো উকিলকে পরামর্শ দিচ্ছে। এরকম বউ থাকলে মেনিমুখো মানুষের গৌরব হওয়ার কথা।

ঘরে এসে গা থেকে ঘামে-ভেজা গেঞ্জিটা খুলে সেটা দিয়েই গা মুছে নিল শ্রীনাথ। প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে রইল একটু। মাথায় অজস্র চিন্তার ভিড়। কোনওটাই কাজের চিন্তা নয়। মল্লিনাথের এই ভাবন-ঘরের চারদিকেই অজস্র জানালা। আলোয় হাওয়ায় ঘরে ভাসাসি কাণ্ড। ভারী সুন্দর। কিন্তু সারাক্ষণ একটা অস্বস্তির কাটা বিধে থাকে শ্রীনাথের মনে। এ বাড়ি দাদা বানিয়েছিল, এখন এর মালিক তার বউ তৃষা। এসব তার নয়, সে এ বাড়ির কেউ নয়।

গোলপা একটা মুখ উঁকি দিল দরজায়। আবছা একটা ফেঁপানির শব্দ। আধবোজা চোখেই মুখখানা নজবে এল শ্রীনাথের। তার মেজো মেয়ে মঞ্জ।

শ্রীনাথ সোজা হয়ে বসে বলল, কী রে? কাঁদছিস নাকি?

কোনও জবাব নেই। খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে অবশেষে মঞ্জু আড়াল থেকে বেরিয়ে কপাটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। মুখ নিচু। খোলা চুল নেমে এসে খানিকটা আড়াল করেছে মুখখানা।

আগে ছেলেমেয়ের ওপর বড় মায়া ছিল শ্রীনাথের। বাড়ি ছেড়ে দূরে যেতে পারত না। এখন কে যেন আর বুকের মধ্যে তেমন ব্যাকুলতা নেই, টান নেই। ছেলেমেয়েদের দেখলে, হঠাৎ যেন মনে হয়, অন্য কারও ছেলেমেয়ে। আগে খুব মিশত ওদের সঙ্গে শ্রীনাথ, আজকাল গা বাঁচিয়ে থাকে। পারতপক্ষে ওরাও আজকাল তার কাছে ঘেঁষে না। মেয়ে দুটো তবু মাঝে মাঝে একটু-আধটু ডাক-খোঁজ করে, কিন্তু ছেলের সঙ্গে প্রায় পরিচয়ই নেই শ্রীনাথের। ছেলে সজল পুরোপুরি তার মায়ের সম্পত্তি। এইভাবে বন্ধনমুক্তি শ্রীনাথের খুব খারাপও লাগছে না।

শ্রীনাথ আর কিছু বলছে না দেখে মঞ্জু এলোচুল খোঁপায় বাঁধল, চোখ মুছল, তারপর খুব সংকোচে সাবধানি পায়ে ঘরে এসে চৌকির বিছানায় বসে বলল, তোমার এ ঘরের চাবিটা আজ আমাকে দিয়ে যাবে বাবা?

বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলে, কেন?

আমি এখানে দুপুরটা থাকব।

তাই বা থাকবি কেন? ঝগড়া করেছিস নাকি কারও সঙ্গে?

ভাই ভীষণ পাজি। সারাদিন মাকে নালিশ করে মার খাওয়ায়। আজও মা কীরকম মেরেছে দেখো। গাল এখনও ফুলে আছে দেখেছ?

দেখল শ্রীনাথ। তৃষা এরকমই মারে! শ্রীনাথ উঠে দড়ি থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে বলল, এ ঘরে তোকে খুঁজে পাবে না নাকি?

মঞ্জু সংকোচের গলায় বলে, ভাই তো তোমাকে ভয় পায়। এ ঘরে আসতে সাহস পাবে না।

এ কথায় একটু থমকাল শ্রীনাথ। এ বাড়ির কেউ তাকে ভয় পায় এটা নতুন কথা। সজল কে তাকে ভয় পায় তা বুঝতে চেষ্টা করেও পারল না। মাথাও ঘামাল না বিশেষ। বালতি মগ আর সর্ষের তেলের শিশি নিয়ে ঘবের পিছন দিকে টিউবওয়েলে যেতে যেতে বলল, চাবি রেখে দিস, কিন্তু জিনিসপত্র ঘাঁটিস না।

বিশাল উঠোন পার হয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় নিকোনো শানের মেঝেয় পরিপাটি গালচের আসনের সামনে বাড়া ভাত আর ঢাকা-দেওয়া জলের গেলাসটি সাজিয়ে রাখার দৃশ্যটি দেখলে তখনও তার সেই একটি কথাই মনে আসে। এ বাড়িতে সে বড় বেশি অতিথির মতো। তৃষার কাজ নয়, এ হচ্ছে রাঁধুনি বামনির যত্ন-আত্তি। পিছনে অবশ্য তৃষার হুকুম আছে। কিন্তু এক কালে গরিব অবস্থার সময়ে কলকাতার শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের ভাড়াটে বাসায় তৃষা নিজের হাতে বেঁধে তাকে খেতে দিত, তখনও কোনওদিন এত যত্নে ভাত বেড়ে দেয়নি।

তবে তৃষা ভাত বেড়ে না দিলেও আজ কাছেপিঠেই ছিল। শ্রীনাথ খেতে বসার পরই সামনে এসে বসে বলল, কতদিন হয়ে গেল বিলুর চিঠি এসেছে। প্রীতমবাবুর অত অসুখ, তোমার একবার দেখতে যাওয়া উচিত ছিল না? রোজই তো কলকাতা যাচ্ছ। একদিন অফিসের পর গিয়ে ঘুৱে আসতে কী হয়?

ভগ্নিপতির অসুখের খবর একটা কানে এসেছিল বটে শ্রীনাথের। অতটা গুরুত্ব দেয়নি। এখন বলল, কী অসুখ? খুব খারাপ কিছু নাকি?

তৃষা বলল, অত ভেঙে তো লেখেনি। শুধু লিখেছে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না পর্যন্ত।

শ্রীনাথ ভ্রু কোঁচকাল। কতকাল হল সে বিলুর খবর রাখে না? বছরখানেক হবে? তা হবে বোধহয়। গতবার বিলু ভাইফেঁাটায় ডেকেছিল। সেবারই শেষ দেখা। এবার ভাইফোটায় বিলুও ডাকেনি, শ্রীনাথেরও ব্যাপারটা খেয়াল হয়নি। কিন্তু প্রশ্নটা হল, এতকাল মায়ের পেটের বোনকে একেবারে ভুলে সে ছিল কী করে? শ্রীনাথ পাতের দিকে চোখ রেখেই বলল, চিকিৎসার ব্যবস্থা কী করেছে?

কী আবার করবে? স্বামীর অসুখ হলে স্ত্রীরা যেমন করে তেমনই ব্যবস্থা করেছে। নিজে গিয়ে দেখে এলেই তো হয়।

উদাস উদার গলায় শ্রীনাথ বলল, যাব।

আজই যেয়ো পারলে। দেরি করা ঠিক নয়।

আজই?–বলে ভাবল একটু শ্ৰীনাথ। কী হয়েছে তার আজকাল, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে। অভ্যস্ত জীবনের বাইরে এক পা হাঁটতে হলেও কেন যে জড়তা আসে।

কেন, আজ কি কোনও কাজ আছে?

শ্রীনাথ বলে, অফিস ছুটির পর বাসে ট্রামে বড্ড ভিড়। তার চেয়ে কোনও ছুটির দিনে–

তৃষা মাথা নেড়ে বলে, তা তুমি কি যাবে? ছুটির দিনে মানুষকে আলিস্যির ভূতে পায়। ব্যাপারটা ফেলে রাখলে আবার বছর গড়িয়ে যাবে। যেতে হলে আজই যাও। বিলুকে বোলো আমি মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে বড্ড ব্যস্ত। নইলে আমিও যেতাম।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়