দাওয়াতে দাঁড়িয়েই ঘটিভরা জলে আঁচাতে আঁচাতে খুব সাবধানে চোখের মণি বাঁয়ে সরিয়ে শ্রীনাথ তার বউ তুষাকে দেখল। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। বেশ লম্বা, প্রায় শ্রীনাথের সমান। গায়ে মেদ নেই, কিন্তু তেজালো একটা শক্তি-সামর্থ্যের ভাব আছে। গায়ের রং শ্যামলা। মুখখানাকে সুন্দর বলা যায়, কিন্তু একটু বন্যভাব আর লোভ আর হিংস্রতা মেশানো আছে। এ বাড়ির ঝি চাকর মুনিশ খামোখা ওকে ভয় খায় না। ভয় পাওয়ার মতো একটা থমথমে ব্যক্তিত্ব আছে তৃষার। এ মেয়ের বর হওয়া খুব স্বস্তির ব্যাপার নয়। শ্রীনাথ কোনওদিন স্বস্তি পায়নি। কী করে তবে এর কাছে স্বস্তি পেয়েছিল মল্লিনাথ? তুষার মুখে যে মধুর আত্মবিশ্বাস আর নিজের ধ্যানধারণার ওপর অগাধ আস্থার ভাব রয়েছে সেটা লক্ষ করলেই বোঝা যায়, সোমনাথ মামলায় হেরে যাবে। তৃষার সঙ্গে কেউ কখনও জেতেনি।

ভাবতে ভাবতে রোদে-ভরা উঠোন পেরোতে থাকে শ্রীনাথ। সোমনাথের দুরবস্থার কথা চিন্তা করতে করতে আপনমনে হাসে। চাকরির জমানো টাকা খরচ করে দেওয়ানি মামলা লড়তে গিয়ে ফতুর হয়ে যাচ্ছে বেচারা। তৃষার ধান-বেচা অগাধ টাকা তো ওর নেই। যখন মামলায় হারবে তখন মাথায় হাত দিয়ে বসবে। বেচারা! সোমনাথ মরিয়া হয়ে এমন কথাও বলে বেড়াচ্ছে মল্লিনাথকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সম্পত্তি বাগাবার জন্য তৃষা তার ভাসুরের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক। পাতিয়েছিল।

এ কথাও কি উড়িয়ে দিতে পারে শ্রীনাথ? রোদ থেকে বাগানের ছায়ায় পা দিয়েই সে থমকে দাঁড়ায়। অবৈধ সম্পর্কের কথাটা মনে হতেই তার শরীর গরম হচ্ছে। রক্তে উথাল পাথাল। সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কামভাব। আশ্চর্য এই, তৃষাকে সে সন্দেহ তো করেই, তার ওপর সেই সন্দেহ থেকে একটা তীব্র আনন্দও পায়।

পুকুরপাড়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে না? সজল কি? কয়েক পা এগিয়ে গেল শ্রীনাথ। চোখের দৃষ্টি এখন আগের মতো তীক্ষ্ণ নেই। তবু মনে হল সজল। মাছ ধরছে।

নিঃসাড়ে এগিয়ে যায় শ্রীনাথ।

জলের খুব ধারে দাঁড়িয়ে আছে সজল। সাঁতার জানে না। পাশে ঘাসের ওপর কম করেও পাঁচ-ছ’টা মাছ পড়ে আছে। কেউ খায় না। ধরছে কেন তবে?

খুবই রেগে গেল শ্রীনাথ। এমনিতেও তুষার আশকারা আর আদরে বেহেড এই ছেলেটাকে তেমন পছন্দ করে না শ্রীনাথ। একটু আগেই মঞ্জু বলছিল, মাকে বলে দিদিদের মার খাওয়ায়। ছেলেটা।

শ্রীনাথ আচমকা পিছন থেকে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে, কী করছ?

একটা মস্ত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। চমকে কেঁপে উবু হয়ে পড়ে যেতে যেতে কষ্টে সামলে নিল সজল। ভয়ে সাদা মুখ ফিরিয়ে তাকাল! তার সামনে খাড়াই পাড় ছিল। অন্তত সাত-আট ফুট নীচে জল। পড়লে খুব সহজে ওঠানো যেত না। পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে শ্রীনাথ একটু লজ্জিত হয়। ঠান্ডা গলায় বলে, মাছ ধরতে কে বলেছে?

সজল আস্তে করে বলে, কেউ বলেনি।

ছেলের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাসের দরুন কী বলবে তার ভাষা ঠিক করতে পারে না শ্রীনাথ। গম্ভীর মুখে বলে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। তুমি কি সাঁতার জানো?

না।

তা হলে পুকুরের ধারে আর কখনও এসো না।

ঘাড় কাত করে ভাল মানুষের মতো সজল বলল, আচ্ছা।

তারপর ছিপ গোটাতে লাগল।

শ্রীনাথ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তুমি মায়ের কাছে দিদিদের নামে নালিশ করো?

সজল সেই রকমই ভয়ার্ত মুখে বাবার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, না তো!

আজই করেছ।

সজল মৃদু স্বরে বলে, দুধে সর ছিল। তাই বলেছিলাম।

তুমি দুধের সর খাও না?

সজল মাথা নাড়ে। না।

শ্রীনাথ একটু হেসে বলে, সর তত ভাল। পুষ্টি হয়।

ঘেন্না লাগে।

শ্রীনাথ একটু চেয়ে থেকে কী বলবে ভাবে। তারপর খাস ছেড়ে বলে, যারা রোজ দুধ খায় তারা বুঝবে না একটুখানি ঘেন্নার সর কত ছেলের কাছে অমৃতের মতো।

সজল কথাটা হয়তো বুঝল না, কিন্তু টের পেল যে, বাবা তার ওপর খুশি নয়। তার মুখে-চোখে ডাইনি বুড়ি দেখার মতো অগাধ অসহায় ভয়। শ্রীনাথের মনে পড়ল, এক সময়ে ট্যাম-গোপালের নাম করলে সজল ভয় পেত খুব! আজ তার বাবাই তার কাছে সেই ট্যাম-গোপাল।

শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করে, আমার সম্পর্কে তোমাকে কি কেউ ভয় দেখিয়েছে?

না-তো!–তেমনি ভয়ে ভয়েই বলে সজল।

তবে ভয় পাচ্ছ কেন?

সজল হাতের ছিপটার দিকে চেয়ে থাকে মাথা নিচু করে।

শ্রীনাথ একটু মজা করার জন্য বলে, আমার তো শিং নেই, বড় বড় দাঁত নেই, থাবা নেই। তবে?

সজল এ কথায় একটুও মজা পেল না। তার মুখ রক্তশূন্য, চোখে কোনও ভাষা নেই। এই অসহায় অবস্থা থেকে ওকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই শ্রীনাথ বলে, যাও। তোমাকে কিন্তু আমি বকিনি। সাবধান করে দিয়েছি মাত্র। ওই মাছগুলো এখন কী করবে?

কিছু করব না।

বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলে, কিছু করবে না তো কি ফেলে দেবে? বরং খ্যাপা নিতাইকে দিয়ে। সে বেঁধে খাবেন। নইলে গরিব-দুঃখী কাউকে দিয়ে দিয়ে যাও।

সজল চলে গেলে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে ইস্পাতের আনা সেই গো-হাড়টা নজরে পড়ে শ্রীনাথের। কাঁচা হাড়। এখনও মাংস লেগে আছে। ঘেন্নায় গা বিরিয়ে ওঠে। আর সেই সঙ্গেই আবার গুপ্ত কাম-ভাবটা মাথা চাড়া দেয়।

ঘরটা হাট করে খোলা। মঞ্জু নেই। শ্রীনাথ তার ইজিচেয়ারে বসে খানিক বিশ্রাম করে। তারপর উঠে জামাকাপড় পরতে থাকে।

শ্রীনাথের চাকরিটা খুবই সামান্য। এত ছোট চাকরি যে, নিজেকে নিয়ে একটু অহংকার থাকে না। একটা মস্ত বড় নামী প্রেসে সে প্রুফ দেখে। বেতন যে খুব খারাপ পায় তা নয়। কিন্তু এ চাকরিতে কোনও কর্তৃত্ব নেই, উন্নতির সম্ভাবনা নেই, উপরন্তু সারা বছরই প্রচণ্ড খাটুনি।

তারা সব ক’জন ভাই-ই ছিল ভাল ছাত্র। শ্রীনাথ একান্ন সালে ফাস্ট ডিভিশনে অঙ্ক আর সংস্কৃতে লেটার পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করে। আই এস-সিতে লেটার না পেলেও ডিভিশনটা ছিল। বি এস-সিতে পাসকোর্সে ডিস্টিংশন পায়। কিছু লোক আছে যাদের পাথরচাপা কপাল। বি এস-সি পাশ করে কিছুদিন মাস্টারি করেছিল শ্রীনাথ। তখন মনে হত, একদিন নিশ্চয়ই সে এসব ছোটখাটো পরিমণ্ডল ছেড়ে মস্ত কোনও কাজ করবে। মফসসল ছেড়ে কলকাতাবাসী হওয়ার জন্য একদা মাস্টারি ছেড়ে প্রেসের চাকরিটা নিয়েছিল সে। তখনও ভাবত, এ চাকরিটা নিতান্তই সাময়িক। বড় চাকরি পেলে এটা ছেড়ে দেবে। সেই ছাড়াটা আর হয়ে উঠল না। একটা জীবন বড় কষ্টে কেটেছে। দাদা মল্লিনাথ ছিল মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু একটু খ্যাপাটে স্বভাবের দরুন এক চাকরি বেশিদিন করত না। তারপর একদিন খেয়ালের বশে মারকিনি কায়দায় র্যনিচ বা খামারবাড়ি বানিয়ে চাষবাস করে একটা বিপ্লব ঘটানোর জন্য এইখানে চলে এল। উন্মার্গগামী ও অসম্ভব সুপুরুষ মল্লিনাথকে ভালবাসত সবাই। সে বিবাহে বিশ্বাসী ছিল না, কিন্তু একটু হয়তো মেয়েমানুষের দোষ ছিল। প্রচণ্ড মদও খেত। খুব খাটত, অনিয়ম করত, শরীরের যত্ন নিত না। ছুটির দিনে শ্রীনাথ সপরিবারে বেড়াতে এলে মলিনাথ তাদের ছাড়তে চাইত না। তৃষাকে এটা ওটা রান্নার ফরমাশ করত। তৃষা সেই পাগল লোকটার মনস্তত্ত্ব বুঝতে পেরেছিল জলের মতো। স্বামীর চেয়েও বেশি যত্ন করত তাকে। এমনও হয়েছে ছেলেমেয়ে সহ তৃষাকে এখানে চার-পাঁচ দিনের জন্য রেখে কলকাতায় ফিরে গেছে শ্রীনাথ। সেই সব দিনের কথা ভাবতে চায় না সে এখন আর। ওই সব দিনগুলি তার বুকে বিশাল বিশাল গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। কালো রহস্যে ঢাকা গহ্বর সব। আজও সে একা বসে বসে সেই সব কথা ভাবে আর শিউরে ওঠে গা। তখন ব্যাপারটা অসংগত মনে হত না কেন যে! এখন মনে হয়, কী সাংঘাতিক ভুলটাই সে করেছিল। তখন গরিব ছিল সে। বড়ই গরিব। মলিনাথ দেদার সাহায্য করত। ছেলেমেয়েরা এখানে এলে ভাল খাওয়া পেত, পরিষ্কার জলবায়ু পেত। অন্য দিকটা তখন কিছুতেই চোখে পড়ত না শ্রীনাথের।

কাজে আজ মন লাগছিল না শ্রীনাথের। মাঝে মাঝে এক রকম হাঁফ ধরা একঘেয়েমির মতো লাগে। মাইনের টাকাটা এখন আর দিতে হয় না তৃষাকে, তার নিজের খাই-খরচও নেই। সুতরাং টাকাটা জমে বেশ মোটা অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। বদ্রী যদি খোঁজ দিতে পারে তবে সে নিজস্ব আলাদা জমি কিনে ভেষজের চাষ করবে। চাকরি করবে না, সারাক্ষণ দাদা মল্লিনাথের বাসায় বাস করার অপরাধবোধ থেকেও মুক্ত হবে।

প্রুফ রিডার হলেও প্রেসে তার কিছু খাতির আছে। খাতিরটা ঠিক তার নয়, পয়সার। সবাই জানে শ্রীনাথবাবুর পয়সা হয়েছে। সেই খাতিরটুকু মাঝে মাঝে ভাঙায় শ্রীনাথ। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টেনে-মেনে কাজ করে সুপারভাইজারকে গিয়ে বলল, আমার ভগ্নিপতির বড্ড অসুখ। একটু যেতে হবে।

সুপারভাইজার বোসবাবুর সঙ্গে খুবই খাতির তার। বোসবাবু হেসে-টেসে বলেন, গেলেই হয়। ভগ্নিপতির অসুখের কথাটা বোধহয় বিশ্বাস হল না বোসবাবুর। শ্রীনাথের মনে খিচ থেকে গেল একটু। বিশ্বাস না করলেও বোসবাবুকে দোষ দেওয়া যায় না। মাঝেমধ্যেই আলতু-ফালতু অজুহাত দেখিয়ে সে অফিস থেকে কেটে পড়ে।

বাইরে শীতের ক্ষণস্থায়ী বেলা ফুরিয়ে সন্ধে নেমে এসেছে। বেশ শীত। শরীরের মধ্যে সকাল থেকে জিয়োল মাছের মতো ছটফট করে দাপাচ্ছে অদম্য সেই কামের তাড়না। তৃষার সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতার দরুন শরীরের ব্যাপারটা বড় একটা হয়ে ওঠে না। তুষার প্রতি তার যেমন নিস্পৃহতা, তার প্রতি তুষারও তাই। কিন্তু তা হলে চল্লিশ-বিয়াল্লিশে তার পুরুষত্ব তো আর মরে যায়নি?

প্রীতমকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত, এটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনকে বোঝাল সে। এই মধ্য কলকাতা থেকে ভবানীপুর যে খুব একটা দূর তাও নয়। কিন্তু গণ-বিস্ফোরণে কলকাতার রাস্তাঘাট এত গিজগিজে, ট্রাম-বাসের এমনই আসন্নপ্রসবার চেহারা এবং এত ধীর তাদের গতি যে কোথাও যেতে ইচ্ছেটাই জাগে না।

ইচ্ছে-অনিচ্ছের মধ্যে খানিক হেঁটে সে গিরিশ পার্কের পিছনের এলাকায় চলে এল। এখানে সে যে নিয়মিত আসে তা নয়, তবে মাঝে মধ্যে কাম তাড়া করলে চলে আসে। মেয়েমানুষের দরদাম ঠিক করতে পারে না সে। যা চায় প্রায় দিয়ে দেয় এবং বোধহয় খুব ঠকে যায়। এ পর্যন্ত যে তিন-চারজন বেশ্যার কাছে সে গেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বিপজ্জনক মনে হয়েছে দানা নামে। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের একটি মেয়েকে। একটু বেশি কথা বলে, একটু বোকাও, কিন্তু কেমন একটু ধর্মভাব আছে তার।

সাড়ে পাঁচটাও বাজেনি ভাল করে। এটা ঠিক সময় নয়। তবু এ সময়টাই ভাল। অব্যবহৃত মেয়েদের পেতে হলে একটু আগে আসা ভাল।

এ পাড়াতেও গিজগিজ করছে লোকজন। বেশির ভাগই মতলববাজ লোক। মেয়ের দালাল, গুন্ডা, মাতাল, কামুক। সে এদেরই একজন, এ কথা ভাবতে তার অহংবোধে লাগে। কিন্তু বাস্তববোধ তার কিছু কম নয়। মুখটা রুমালে সামান্য আড়াল করে সে গলি থেকে আরও গহিন গলির অন্ধকারে ঢুকে যেতে লাগল।

দোতলা বাড়িটার ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হাঁফ ছাডে সে। কিছু ক্লান্তি আর উদ্বেগে শরীরটা অস্থির। বুকে হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দীনা তার ঘরের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখচোখের অবস্থা ভাল নয়। বোধহয় মন খারাপ। ওর একটা বছর দশ-বারোর মেয়ে আছে। তার কিছু হয়নি তো? হলে আজ জমবে না।

দীনা তাকে চিনতে পারল। ডাকতেই মুখ ফিবিয়ে ভ্রু কুঁচকে দেখল তাকে। তারপর ক্রু সহজ হয়ে গেল। বলল, অনেক দিন পর না?

তুমি ভাল আছ?–জিজ্ঞেস করে শ্রীনাথ।

ভাল আর কী? আসুন।

ভিতরে ঢুকে দীনা কপাট ভেজিয়ে দিয়ে বলে, কী কাণ্ড শুনবেন?

কী?

সে এক কাণ্ডই।

বলে দীনা হেসে ফেলে। দেখতে ভাল কিছু নয় মেয়েটা। সাদামাটা পেঁয়ো চেহারা। রং কালো। মাঝারি লম্বা, মাঝারি গড়ন। কিছু বৈশিষ্ট্য নেই। তাই খদ্দেরেরও বাঁধাবাঁধি নেই। হেসে ফের গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, খুব রাগ হচ্ছে আমার, হাসিও পাচ্ছে। দুটো স্কুলে-পড়া ছেলে এসেছিল আজ জানেন?

বটে?–শ্রীনাথ তেমন আগ্রহ দেখায় না। স্কুল কলেজের ছেলেরা আজকাল হরবখত বেশ্যাপাড়ায় যায়। কিছু অস্বাভাবিক নয়।

দীনা চৌকির বিছানায় বসে খুব চিন্তিত মুখে বলে, চৌদ্দ-পনেরোর বেশি বয়স নয়, গায়ে স্কুলের পোশাক পর্যন্ত রয়েছে। ঠিক দুপুরে কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দেখি দুই মূর্তি। প্রথমে ভেবেছিলাম পথ ভুল করে এসেছে বা জলতেষ্টা পেয়েছে বলে ঢুকে পড়েছে। তারপর দেখি তোতলাচ্ছে, আগড়ুম বাগড়ুম বলছে। বলতে গেলে ছেলের বয়সি। যখন বুঝতে পারলুম মতলব অন্যরকম, তখন এমন রাগ হল! বেঁটে ছাতাটা হাতের কাছে পেয়ে সেইটে দিয়ে পয়লা ছেলেটাকে দিলুম কষে ঘা কতক। দুটোয় মিলে এমন পড়িমরি করে পালাল না!

দীনা হেসে খুন হতে লাগল বলতে বলতে। তারপর ফের গম্ভীর হয়ে বলল, কিন্তু অন্য একটা কথা ভেবে ভারী ভয় হয়, জানেন! ভাবি, আজ না হয় তাড়ালুম। কিন্তু রোজ যদি ওরকম সব ছেলেরা আসে? একদিন হয়তো আর তাড়াব না।

শ্রীনাথ কিছু বিরক্ত হয়ে বলে, আজই বা তাড়ালে কেন? ওরা তো কারও না কারও কাছে যাবেই। মাঝখানে তোমার রোজগারটা গেল।

দীনা ঠোঁট উলটে বলে, ঝাঁটা মারি রোজগারের মুখে! বেশ্যা বলে কি ঘেন্নাপিত্তি নেই?

শ্রীনাথ দার্শনিকের মতো একটু হাসে। বেশ্যা বলে নয়, আজকাল এই দুনিয়ায় কোনও মানুষেরই ঘেন্নাপিত্তি খুব বেশিদিন থাকে না।

প্রীতমকে দেখতে যাওয়া হল না। বাড়ি ফিরতে বেশ একটু রাত হয়ে গেল শ্রীনাথের। স্টেশনে নেমে শীতে অন্ধকারে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, এই রাতে গিয়ে কোন অজুহাতে স্নানের জন্য গরম জল চাইবে। স্নান না করলেই নয়। যতবার বেশ্যাপাড়ায় গেছে ততবার ফিরে এসে স্নান করতেই হয়েছে তাকে। নইলে ভারী খিতখিত করে।

বাড়িটা ভারী নিঃঝুম। অন্ধকারে নিবিড় গাছপালার ছায়ায় আর কুয়াশায় যেন মিশে গেছে চারপাশের সঙ্গে। শুধু বাগানের মধ্যে এক জায়গায় শুকনো কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বেলে বসে আছে খ্যাপা নিতাই। প্রতিদিন এই নিশুত রাতে মাটিতে একটা শলা দিয়ে পুতুলরাণীকে আঁকে সে। তারপর মন্ত্র পড়ে বাণ মারে। এতদিনে বাণের চোটে পুতুলরাণীর মুখে রক্ত উঠে মরার কথা। কিন্তু শ্রীনাথ যতদূর জানে পুতুলরাণী গুসকরায় রসবড়া ভাজছে। মাঝখান থেকে এ ব্যাটাই তান্ত্রিক-মান্ত্রিক সেজে খ্যাপাটে হয়ে গেল।

নিতাই নাকি রে?–ডাকল শ্রীনাথ।

ডাক শুনে নিতাই উঠে আসে, কিছু বলছেন?

তোর আগুনটায় আমায় এক ডেকচি জল গরম করে দে তো!

গু মাড়িয়েছেন বুঝি? স্নান করবেন?

ঠিক ধরেছিস। আমার ঘর থেকে ডেকচি নিয়ে যায়। আর শোন, তোর কুকুরটা একটা গো-হাড় এনে ফেলেছিল এইখানে। ওটা তুলে ফেলে দিস।

বলে টর্চ জ্বেলে বারান্দার তলায় দেখাল শ্রীনাথ। হাড়টা পড়ে আছে এখনও।

নিতাই বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বাঁ হাতে হাড়টা তুলে নিয়ে বলল, দিচ্ছি ফেলে।

ব্যাটা চামার।–গাল দেয় শ্রীনাথ, এত রাতে হাড়টা ছুঁতে গেল?

নিতাই অন্ধকারে জটাজুট নিয়ে মিলিয়ে যায়। একটু বাদে ডেকচি নিয়ে ফিরে আসে।

এই শীতে খোলা জায়গায় টিউবওয়েলের ধারে গরম জলে স্নান করতে গিয়েও শীতে থরথরিয়ে কাপছিল শ্রীনাথ। স্নানের পর যখন গা মুছছে তখন হ্যারিকেনের সামনে একটা মস্ত ছায়া এসে পড়ল।

চোখ তুলে দেখল, তৃষা। আর একবার আপনা থেকেই কেঁপে উঠল শ্রীনাথ।

তৃষা গম্ভীর মুখে বলে, তুমি কি আজ সজলকে বকেছ?

আমি?–বলে ভাববার চেষ্টা করে শ্রীনাথ। ভেবে-টেবে বলে, বকিনি। তবে পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে মাছ ধরছিল। সাঁতার জানে না। বিপদ হতে পারে সাবধান করে দিয়েছিলাম।

তৃষা কোনও তর্ক করতে আসেনি। বিমর্ষ মুখে বলল, ছেলেটার বিকেল থেকে খুব জ্বর। ভুল বকছে। জ্বরের ঘোরে বার বার বলছে, বাবা বকেছে। বলেছে মারবে। ভীষণ মারবে।

বেকুবের মতো চেয়ে থেকে শ্রীনাথ বলে, মারব বলিনি তো! মারব কেন?

তৃষা একটু অবাক গলায় বলল, তুমি কি রোজ রাতে স্নান করো? সাধুটাধু হলে নাকি?

না। ওই নিতাইয়ের কুকুরটা একটা গোরুর হাড় এনে ফেলেছিল। সেটা পায়ে লেগেছে।

ও।–বলে তৃষা চলে গেল।

সজলকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত কি না তা বুঝল না শ্রীনাথ। বাবা হিসেবে হয়তো উচিত। কিন্তু সে তো ঠিক স্বাভাবিক বাবা নয়।

স্নান করে ঘরে ফিরে এসে বালতি রেখে দড়িতে গামছা টাঙাচ্ছে, এমন সময় মঞ্জু এল চুপিসারে।

বাবা!

আবার কী চাই?

ভাইয়ের জ্বর হয়েছে কেন জানো?

না তো। কেন?

ভাই বলেছে, তুমি নাকি ওকে আজ খুব মেরেছ। মারতে মারতে পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিলে। তাই!

শ্রীনাথ রাগে স্তম্ভিত হয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে বলে, সজল এ কথা বলেছে?

নিজের কানে শুনেছি বাবা। আমার সামনেই মাকে বলল।

আমি মেরেছি?

বলে দিশেহারা শ্রীনাথ নিজের দুটো হাতের দিকে যেন সন্দেহবশে চেয়ে দেখল একটু। তারপর রাগে গরগর করে বলল, আচ্ছা মিথ্যেবাদী ছেলে তো! ওকে চাবকানো দরকার।

শুনে খুশি হল মঞ্জু। বলল, আমাদের নামেও বলে।

থমথমে মুখে শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করে, ওর জ্বর এখন কত?

একশো চার। ওকে কিছু বলব বাবা?

না, এখন থাক। যা বলার আমিই বলব।

সেই রাগ নিয়েই গিয়ে রান্নাঘরে খেতে বসল শ্রীনাথ। সেই রাগ নিয়েই শুল রাত্রে। ঘুম আসতে চাইল না। পৃথিবীটা বড় পচে যাচ্ছে যে! সেই পচনের দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে স্পষ্ট। নিজের ছেলে জলজ্যান্ত এমন মিথ্যে কথাটা বলল কেমন করে?

শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল শ্রীনাথ। স্বপ্ন দেখল, সজল একটা মস্ত সুন্দর দিঘির ধারে মাছ ধরছে। আসলে মাছ নয়, পুকুর থেকে ছিপের টানে উঠে আসছে নানা রঙের ঘুড়ি। পিছন থেকে চুপিচুপি গিয়ে শ্রীনাথ ওর পিছনে দাঁড়াল। দেখল দিঘির জল খুব গভীর। সজল তার পিছনে বাবার উপস্থিতি টের পায়নি। শ্রীনাথ হাত বাড়িয়ে আচমকা সজলকে ঠেলে ফেলে দিল জলে।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়