০২.

ঝরঝর করে খানিকটা জল পড়ল কাঁধে। ব্লাউজের হাতটা ভিজে গেল। সীতা মুখ তুলে দেখে, ট্রামের জানালার খাঁজে জল জমে আসছে। ময়দানের দিক সাদা করে আর এক ঝাঁক বৃষ্টি আসছে। নড়বড়ে জানালাটা বন্ধ করতে একবার চেষ্টা করল সীতা। পারল না। এক ভিড় লোক তাকে দেখছে। সকলের চোখের সামনে দ্বিতীয়বার জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করতে তার লজ্জা করছিল। অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে বসে থাকে সীতা। ঝরঝর করে জল পড়তেই থাকে। সরে বসবে যে তার উপায় নেই, পাশে। মুশকোমতো এক পুরুষমানুষ বসে আছে। লোভী মুখচোখ, আড়ে আড়ে তাকিয়ে দেখছে।

কেনাকাটা করাটা সীতার একটা নেশার মতো। দরকার থাক বা না থাক, সীতা বরাবর দুপুরের দিকে প্রায়ই বেরিয়ে পড়ে। গড়িয়াহাটা বা নিউ মার্কেটে ঘুরে ঘুরে টুকটাক জিনিস কেনে, বেশি টাকার জিনিস নয়, সস্তা বাহারি চটি, হাতব্যাগ, স্টিলের ছাঁকনি বা চামচ, ডোনার কিংবা অন্য কোনও রূপটান। সংসারে কোনও জিনিস ফেলা যায় না। যখন সীতার সংসার ছিল তখন সব কিছুই কাজে লাগত। এখন তার নিজের সংসার বলে কিছু নেই। তবু নেশাটা রয়ে গেছে। দু পিস ব্লাউজের লন কাপড় কিনেছে। সে, একটা শাড়িতে লাগানোর ফল পাড়, এক কৌটো কাজল, ফাউন্ডেশন, ভাইঝির জন্য স্টিলের চেন-এ একটা ঝকমকে লকেট, এরকম আরও কিছু কাজ বা অকাজের জিনিস। এ সব তার কোলের ওপর জড়ো হয়ে আছে। তার ওপর ভ্যানিটি ব্যাগ আর ভাঁজ করা ছাতা। ব্যাগটা ছোট বলে সব জিনিস আঁটেনি। ব্লাউজপিত্রে প্যাকেটটা ভিজে যাচ্ছে। অস্বস্তিতে আবার চোখ তুলে জলের উৎসটা দেখে সীতা! বৃষ্টিও এসে গেল। ছাঁট আসছে।

পাশের লোকটা হঠাৎ ফিস ফিস করে বলে–জানালাটা বন্ধ করে দেব।

 সীতা ঘাড়টা একটু নাড়ল মাত্র।

লোকটা উঠে সীতার ওপর দিয়ে ঝুঁকে জানলাটা বন্ধ করতে চেষ্টা করে। সীতা লোকটার বগলের ঘেমো গন্ধ পায়। বুক পেট গুলিয়ে ওঠে তার। লোকটা জানলা বন্ধ করতে বেশ সময় নিতে থাকে। ততক্ষণ দমবন্ধ করে বসে থাকে সীতা। এবং নির্ভুল ভাবে টের পায়, লোকটা তার নিজের বুকটা হালকাভাবে তার কপালে ছোঁয়াল। জানলাটা বন্ধ করে হাতটা টেনে নেওয়ার সময় খুব কৌশলে সেই হাতটা সীতার কাঁধ স্পর্শ করে গেল। সীতা দাঁতে নীচের ঠোঁটটা চেপে ধরে নিজেকে সামলে নেয়। মেয়েদের শরীরের প্রতি পুরুষের দাবি-দাওয়ার শেষ নেই। হাঁটু, কনুই, হাত যা দিয়ে হোক একটু ছোঁয়ানো চাই।

জানলা বন্ধ করে লোকটা চেপে বসল। সীতা লোকটার প্রকাণ্ড ভারী ঊরুর ঘন স্পর্শ পেল। নিজের উরুতে। যতদূর সম্ভব জানলা ঘেষে বসল। ঘামতে লাগল। অস্বস্তি। জানলা বন্ধ, ফলে লোকের ঘামের গন্ধ, ভ্যাপসা গরম, পাশের লোকটার উরু, এবং ক্রমে কাঁধের স্পর্শ ও সীতাকে আক্রমণ করে। লোকটা বুঝে গেছে, সীত কিছু লবে না, সে লাজুক মুখচোরা মেয়ে। তাই লোকটা ট্রাম থেমে আবার চললেই ঝাঁকুনি লাগার ভান করে ঢলে পড়ছে সামান্য। আর কেউ কিছু টের পায় না, কেবল সীতা পায়। সে ঘামে লাল হয়, আর দাঁতে ঠোঁট কামড়ায়। এ সব নতুন নয় তবু সীতার ঠিক সহ্য হয় না।

ট্রামটা থেমে গেল। রেসকোর্স পার হয়ে ব্রিজটায় উঠবার মুখে। সামনে একটা ট্রাম বোধ হয় খারাপ। সময় লাগবে। ট্রামের ভেতরটা ক্রমে ভেপে পচে ফুলে উঠছে। পচে যাচ্ছে মানুষের শরীর। চারদিক থেকে চোরাচোখের আক্রমণ। পাশের লোকটা ঘেঁষে আসে। ঘাম। গরম। চমকা বৃষ্টিটা থেমে আবার রোদ উঠেছে বাইরে। বড় উজ্জ্বল রাংতারোদ।

সীতা ছোট্ট রুমালে মুখ, গলা মুছল। আর তখনই আবার লোকটার হাতে তার কনুই লাগে। সীতা আড়ষ্ট হয়ে নিজের কোলে হাত দুখানা ফেলে রাখে। অন্যমনস্ক থাকার জন্য সে একটা কোনও চিন্তা করার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। কোনও সুন্দর চিন্তা এলই না।

কেবলই ভেঙে যাওয়া সংসারের কথাই মনে পড়ছিল সীতার। দুটি ঘর ছিল তাদের। মাঝখানের দরজায় একটা হালকা আকাশি রঙের সাটিনের পর্দা। সন্ধেবেলা ঝোড়ো কলকাতার হাওয়া সেই পর্দাটিকে ওড়াত বারবার। টিউবলাইটের আলোয় দুঘরের কোথাও কোনও অন্ধকার ছিল না। এ ঘরে মেঝেয় উবু হয়ে বসে যত্নে পেয়ালায় চা ছাঁকতে ছাঁকতে সে দেখতে পেত ও ঘরে ক্লান্ত মনোরম চেয়ার এলিয়ে বসে আছে। শুধু শার্ট ছেড়েছে আর জুতোজোড়া। পরনে ফুল প্যান্ট, আর স্যান্ডো গেঞ্জি। চোখ বোজা। যতখানি ক্লান্ত তার চেয়ে বেশি ভান করত, সীতার একটু আদর-সোহাগের জন্য। আদর-সোহাগের বড় কাঙাল ছিল মনোরম। রোগ-ভোগা মানুষ একটু নেই-আঁকড়ে আর মাথাভরা চিন্তা-দুশ্চিন্তার বাসা। চা করতে করতে সীতা মাঝে মাঝে তাকাত। মায়া-মমতায় ভরে উঠত বুক। সেটা ঠিক প্রেম নয়, গাঢ় মমতা। করুণাও। সে যাই হোক, একভাবে না একভাবে তাদের জোড় মিলেছিল তো! মনোরমের সেই চা আর সীতার স্পর্শের জন্য অপেক্ষারত দৃশ্যটা মনে পড়ে।

দৃশ্যটা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে চেষ্টা করে সীতা। পারে না। কান্না পায়। কেবলই মনে পড়ে দুঘরের মাঝখানে পর্দা উড়ছে হাওয়ায়, ধু ধু করে জ্বলছে নীলাভ আলো। কোনওখানে অন্ধকার নেই। ও ঘরে তার ক্লান্ত কাঙাল স্বামী মনোরম। ভিতু খুঁতখুঁতে, অসম্ভব পরনির্ভরশীল।

সীতা শুনেছে এখন মনোরম বড় বড় চুল রাখে, লম্বা জুলপি, আর খুব আধুনিক পোশাক-টোশাক পরে। কেন এ সব করে মনোরম তা সীতা জানে না, কিন্তু তখন মনোরম ভাল পোশাক পরত না। সীতা কখনও ঝকমকে শার্ট বা প্যান্ট করে দিলে রাগ করত। ক্রপ করে ছোট্ট চুল রাখত মনোরম। তারা খুব অদ্ভুতভাবে শুত, মনোরমের স্বভাব ছিল সীতার বুকে মুখ গুঁজে শোওয়ার। ওই কদমছাঁট চুল খোঁচা দিত সীতার শরীরে। প্রথমে বিরক্ত হত সীতা। তারপর বুঝেছিল মানুষটা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে, জেগেও নানা ভয়ের উদ্বেগের চিন্তা করে। মনে মনে বড্ড একা অসহায় ছিল তার মানুষটা। তাই সীতাকে আঁকড়ে ধরত অমন। বুকে মাথা গুঁজে শুত, এবং সেই শোওয়ার মধ্যে কোনও যৌনকাতরতা ছিল না। ছিল নির্ভরশীলতা। তাই সীতা ওই কদমছাঁট চুলওলা মাথাটা বুকের মধ্যে ধরে রাখতে শিখেছিল। খোঁচা টের পেত না। এবং এমনই অভ্যাসের গুণ যে, ক্রমে ওভাবে মনোরম না শুলে তার অস্বস্তি হতে থাকত। ঘুমের মধ্যে কথা বলত মনোরম। কখনও চেঁচিয়ে উঠত ভয়ে। উঠে বসত। তারপর সীতাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মতো আকুলিব্যাকুলি করত। সীতা ঘুম ভেঙে বলত–আহা, বাট ষাট। এই তো আমি রয়েছি, ভয় কী? ঠিক যেমন শিশুকে মা ভোলায়। গানের গলা। ছিল না মনোরমের। কিন্তু প্রায়দিনই একটা গান সে গাইত। হঠাৎ হঠাৎ বাথরুমে শোওয়ার ঘরে। কিংবা খেতে বসে গেয়ে উঠত–জয় জগদীশ হরে…। একটাই লাইন মাত্র। সীতা হাসত–মোটে আধখানা লাইন ছাড়া আর কিছু জানো না? মনোরম কেমন বিষণ্ণ হেসে একদিন বলেছিল–ছেলেবেলায় ইস্কুলে এই গানটা ছিল আমাদের প্রেয়ার। মনে আছে, ইস্কুলে খুব লম্বা সাত-আট ধাপ সিঁড়ি ছিল, সেখানে সারি দিয়ে তিনশো ছেলে দাঁড়িয়ে ওই গান গাইতাম। যন্ত্রের মতো। গানের অর্থ কিছু বুঝতাম না। একদিন কী যে হল! অনেক দিন টানা বর্ষার পর সেদিন রোদ উঠেছে। বাহান্ন দিন টাইফয়েডে ভুগে সেদিন সকালে আমার দাদা মনোরময় মারা যায়। আগের রাতে দাদার বাড়াবাড়ি হওয়ায় আমাকে প্রতিবেশীদের এক বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের বাড়ি থেকেই সকালে খেয়েদেয়ে ইস্কুলে যাব বলে বেরিয়েছি, রাস্তায় পা দিয়েই শুনলাম, আমাদের বাড়ির দিক থেকে কান্নার রোল উঠেছে। যেই শুনলাম অমনি ইস্কুলের দিকে দৌড়োতে শুরু করলাম। দুকানে হাত চেপে দৌড়োচ্ছি, কাঁধের ঝোলানো বইয়ের ব্যাগটা টপাটপ ধাক্কা দিচ্ছে কোমরে, ঘেমে হাঁফিয়ে যাচ্ছি, তবু প্রথম মৃত্যু-অভিজ্ঞতার হাত থেকে আমি প্রাণপণে পালাতে লাগলাম। ইস্কুলে সেদিনও প্রার্থনার সারিতে দাঁড়িয়ে রোজকার মতো গাইছি–জয় জগদীশ হরে…। গাইতে গাইতে দেখি চোখ ভরে জল নেমেছে। চারদিকে আকাশ কী গভীর নীল, কত বড় সেই আকাশ। তার তলায় আমরা কতটুকু কু সব মানুষ! ছোট্ট মানুষ আমরা মস্ত আকাশের দিকে হাতজোড় করে গাইছি–জয় জগদীশ হরে… সেইদিনই যেন গানটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল। এখনও অন্য মনে কেবলই মনে পড়ে ওই লাইন। আধখানা। সবটা মনে নেই। গাইলেই বহুকালের পুরনো একটা রোদভরা আকাশ ঝুঁকে পড়ে চোখের ওপরে, কোথা থেকে যেন একটা আনন্দের, বিষাদের গভীর ঢেউ এসে আমাকে তুলে নেয় আমি যেন তখন পৃথিবীর ধুলোময়লা থেকে ওপরে উঠে ভাসতে থাকি। তাই গাই।

এক একদিন ঘুম ভেঙে অন্ধকারে উঠে ঝুম হয়ে বসে থাকত মনোরম। সীতা ঘুমের মধ্যে বুকের ভিতরে কদমছাঁট চুলওলা মাথাটা না পেয়ে অস্বস্তি বোধ করে চোখ মেলে খুঁজতে গিয়ে দেখেছে, অন্ধকারে মনোরমের হাত মুঠো পাকানো, শরীর শক্ত, চোয়াল দৃঢ়ভাবে লেগে আছে। সীতা জানত, ওর সেই ট্রেন দুর্ঘটনার কথা মনে পড়েছে।

তখন ও এক বিদেশি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। ফার্স্ট ক্লাসে উড়িষ্যা-বিহার ঘুরে বেড়াত। রোগা হলেও সুন্দর মুখশ্রী আর চালাকচতুর হাবভাবের জন্য, চমৎকার ইংরিজি বলার জন্যই অত ভাল চাকরি পেয়েছিল মনোরম। প্রায় হাজার টাকা মাইনে পেত, তার ওপর টি এ ছিল অনেক। সেবার উড়িষ্যা যাওয়ার সময়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটে মাঝরাতে। তখনও মনোরমের বিয়ে হয়নি সীতার সঙ্গে। কী হয়েছিল তা সঠিক জানত না সীতা। তবে মনোরম দীর্ঘদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ফিরে আসে। চাকরিটা যায়নি, তবে কোম্পানি তাকে প্রতিনিধির কাজ থেকে অফিসে নিয়ে আসে নিরাপদ একটু উঁচুদরের কেরানির চাকরিতে। মাইনে কমল না, কিন্তু টি এবন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু মনোরম ছটফট করত অন্য কারণে। ওই যে কলকাতা ছেড়ে প্রায়ই বেরিয়ে পড়া রাতের গাড়িতে, ভোরের আবছা আলোয় গাড়ির জানলা খুলে দক্ষিণ বিহার আর উড়িষ্যার টিলা, উপত্যকা, নদী, পাহাড় আর জঙ্গল দেখে এক অবিশ্বাস্য, অসহ্য আনন্দ, সেইটাই কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার কাছ থেকে। কোম্পানির বম্বের অফিসে কিছুদিন কাজ করেছিল মনোরম। ভাল লাগল না। আবার বিহার-উড়িষ্যার শ্বাসরোধকারী প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াবে, সন্ধ্যার আবছায়ায় পরেশনাথ পাহাড়ের পাদদেশে উশ্রী নদীর ছোট্ট পোলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে, ধারোয়ার তীরবর্তী টিলার গা বেয়ে উঠে যাবে আস্তে আস্তে, কয়লা খনির অঞ্চলগুলিতে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গভীর রাতে লরি ড্রাইভারের পাশে বসে দেখবে অন্ধকারের দ্রুতগামী সৌন্দর্য। অফিসের চাকরি সে সহ্য করতে পারত না। একটা নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি তখন আলুমিনিয়ামের তৈরি ছিটকিনি, দরজার নব, নানা রকম অ্যাঙ্গেল আর গৃহস্থালীর জিনিস তৈরি করছিল। তাদের রিপ্রেজেনটেটিভ হয়ে আবার বিহার-উড়িষ্যা ঘুরে বেড়াতে লাগল মনোরম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারল না, ট্রেন খুব জোরে চললে বা আচমকা ঝাঁকুনি লাগলে সে ঘুম ভেঙে আতঙ্কে উঠে বসত, অনেকক্ষণ বুক কাঁপত তার, ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকত। তখন চাকরি ছেড়ে সেই কোম্পানিরই এজেন্সি নিল সে।

দেখা হয়েছিল শিমুলতলায়। পুজোর ছুটিতে। প্রবাসে বেড়াতে গেলে বাঙালিদের ভাব হয়। তেমন হয়েছিল। সীতা তার আগে কখনও প্রেমে পড়েনি। সদ্যযুবতী, তখনও কৈশোরের গন্ধ গায়ে, তখনও শরীরে সেই আশ্চর্য স্বেদগন্ধ। ফুলের পাপড়ি ঝরে গিয়ে সদ্য ফলের গুটি ধরেছে। মনোরম পিছনে বনভূমি রেখে ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে আসছিল, একটু আনমনা, রুণ সুন্দর চিকন মুখশ্রী, বালকের মতো স্বভাব। তারা একসঙ্গে সকলের সাথে বনভোজন করতে গিয়েছিল। ইচ্ছে করে দলছুট হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল তারা। বিহারের তীব্র শীত সবে দেখা দিচ্ছে। একটা তিরতিরে নদী বয়ে যাচ্ছিল, স্বচ্ছ জল, জলে তাদের ছায়া। ছায়ায় বুকে মনোরম ইংরিজিতে বলেছিল–মেরিলি র্যাং দ্য বেল, অ্যান্ড দে ওয়্যার ওয়েড..কী চমৎকার টনটনে উচ্চারণ সেই ইংরিজির! নিস্তব্ধপ্রায় সেই শাল জঙ্গলের ভিতরে বয়ে-যাওয়া নদীর শব্দের সঙ্গে কবিতার শব্দগুলিকে কী করে যে মিলিয়ে দিয়েছিল মনোরম! সামনেই পাহাড় ছিল, ওপরে নীল আকাশ, পাখিও কি ছিল না, আর প্রজাপতি! কী সব যে ছিল সেখানে কে জানে! ছিল বোধ হয় কবিতার সেই ঘণ্টাধ্বনিও তাদের মনে, আর ছিল শরীরে সুন্দর গন্ধ ও রোমহর্ষ, ছিল জলে ভেঙে-যাওয়া তাদের ছায়া। এ সবই থাকে। থাকে না কি! নদীর জলে একটা পাথর ছুঁড়ে মনোরম বলল–তুমিও ছুঁড়ে দাও, ওইখানে। সীতা ছুঁড়েছিল। কী হয়েছিল তাতে? কিন্তু মনোরম হেসেছিল। সীতাও। বহু দূর থেকে বনভোজনের দলছুট মানুষজনের গলার স্বর আসছিল। পোড়া পাতার গন্ধ। তবু নিস্তব্ধতাই ছিল। তাদের কথা বলে যাচ্ছিল সেই কুলুকুলুধ্বনিময় স্বচ্ছ জলের নদী, গাছের পাতায় বাতাস, পাখির স্বর।

ভালবাসা কিনা কে জানে। তবে তারা কেউ কাউকে ছোঁয়নি, জাপটে ধরেনি, ওই নির্জনতা সত্ত্বেও। মনোরম শুধু বলেছিল–আমি এতদিন স্বপ্নের মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতাম।

–সে কেমন? সীতা তার তখনও না যাওয়া কৈশোরের কৌতূহল থেকে প্রশ্ন করেছিল।

ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রেমের শখ। এত বেশি শখ যে, ছেলেবেলা থেকেই আমি কাল্পনিক মেয়েদের সঙ্গে একা একা কথা বলি। সেই সব মেয়েদের একজন ছিল রিনা। কিন্তু রিনা ঠিক কাল্পনিক ছিল না। আমার আট-দশ বছর বয়সে আমি সত্যিই এক রিনাকে দেখেছিলাম। তারও বয়স ছিল আমার মতোই। পরিচয় ছিল না, কখনও কথা হয়নি, একবারের বেশি দেখা হয়নি, তার মুখ এখন আর আমার মনেও নেই। শুধু মনে আছে, এক বিয়েবাড়ির সিঁড়ির রেলিংয়ে ঝুঁকে সে বর বউয়ের কড়িখেলা দেখছিল। পরনে লাল ফ্রক, মুখখানা ঘিরে ফ্রিলের মতো চিনেছাঁটের চুল। বয়স্কা এক মহিলার গলা তলার হলঘর থেকে তার নাম ধরে ডেকে বলেছিল রিনা নীচে আয় না, অত লজ্জা কীসের! রিনা তার সুন্দর –কুঁচকে একটু চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচের ভিড়ের মধ্যে নেমে গিয়েছিল। এতদিন আগেকার সে ঘটনা, আর আমিও এত ছোট ছিলাম যে, সেই স্মৃতি একটু সুগন্ধের মতো মাত্র অবশিষ্ট আছে। কখনও মনে হয় সে ঘটনা ঘটেইনি, আমার মাথা তা কল্পনা করে নিয়েছে, অথবা আমি কখনও স্বপ্ন দেখেছিলাম। ওই উৎসবের বাড়ি আর.ওই মেয়ের কথা আমি অনেক ভেবেছি, কখনও সত্য কখনও কাল্পনিক মনে হয়েছে। তবে সেই নামটা কী করে মনে রয়ে গেছে, মনে রয়ে গেছে যে মেয়েটি বড় সুন্দর ছিল। আর সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি। কিন্তু তাতে আমার কোনও অসুবিধা হয় না। আমার মনে যে সব অচেনা মুখ ভেসে যায়, তাদের কাউকে কাউকে রিনা বলে মনে হয়। ওই নামে ডাকি, সাড়া পাই, ভালবাসা জেগে ওঠে, বিশ্বাস হয় কি?

না।

তবে তোমাকে বলি, আমার মেমবউয়ের কথা?

বউ? বলে ভীষণ উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে থেকেছিল সীতা।

-না না, আসলে সে কেউ না। আমাদের আলমারিতে ছিল পাথরের তৈরি এক মেমসাহেব পুতুল। তার গোলাপি গা, গোলাপি গাউন, হাঁটু পর্যন্ত সেই গাউনের ঝুল, চোখের তারা নীল। ছেলেবেলায় ঠাকুমা সেই পুতুলটা দেখিয়ে বলত–তোর বউ। আশ্চর্যের কথা, এখনও মাঝে মাঝে যখন কখনও আমার কাল্পনিক বউয়ের কথা ভাবি, তখন ঠিক সেই গোলাপি গা, সোনালি ফ্রক, নীল চোখ, মধুরঙের চুলওলা পুতুলটাই চোখে ভেসে ওঠে। হায়, তার বাস্তবতা নেই, তবু সে আমার মনের মধ্যে চলা ফেরা করে, ঘরদোর গুছিয়ে রাখে, গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আমার কাল্পনিক সভানের চুল আঁচড়ে দেয়, দিনশেষে জানলার ধারে বসে আমার অপেক্ষায় চেয়ে থাকে।

এখনও? আজও?

 মিটমিট করে হেসে মনোরম বলেছিল–ছেলেবেলায় আমি খুব অদ্ভুত ছিলাম। দরজা, জানালা, দেয়ালের সঙ্গে কথা বলতাম। কত সব কথা।

মানুষের সঙ্গেই আমার কথা হত কম। কিন্তু কথা হত কানার মানুষদের সাথে। রোজ যাদের দেখতাম, তাদেরই কাউকে কাউকে মনে মনে কুড়িয়েআনতাম,কানায় খেলবলে। আমাদের মফস্বল শহরের স্টেশনে একটা নির্জন সুন্দর ওভারব্রিজ আছে। সাধারণত লোকে হেঁটেই লাইন পার হয়, ওভারব্রিজ বড় একটা ব্যবহার করে না। আমাদের ওভারব্রিজটা তাই জনশূন্য পড়ে থাকত। আমি সন্ধেবেলায় ওখানে দাঁড়িয়ে প্রায়ই দুরের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমি যে-স্বপ্নের জগতে বাস করতাম সেখানে বাস করতে গেলে, চেনা লোক, বন্ধুবান্ধব, ঘনিষ্ঠ লোকজন এক বিষম বাধা। তাতে স্বপ্নের সুতো বারবার ছিঁড়ে যায়। আমারও তাই তেমন কেউ ছিল না, তাই আমারও অধিকাংশ বিকেল কাটত নিঃসঙ্গভাবে ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দূরের দিকে চেয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে। কল্পনার ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যেত। সেদিন সন্ধে সাতটার শেষ ট্রেন আমাদের ছোট স্টেশন ছেড়ে গেছে। ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম শূন্য প্ল্যাটফর্মে কিছু ছড়ানো মালপত্রের মাঝখানে একটি তোরঙ্গের ওপর মেয়েটি বসে আছে। উদ্বিগ্ন তার মুখচোখ। কাছাকাছি সময়ে আর ট্রেন নেই, পরের গাড়ি ভোরবেলায়।মেয়েটি যে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে কে জানে? আমি মাত্র এইটুকু দেখেছিলাম। আর মনে হয়েছিল মেয়েটি যেন আমার আবছাভাবে চেনা। এর বেশি আর বাস্তবে কিছু ঘটেনি, ঘটেছিল বোধহয় কল্পনায়।

মনোরমের আবার সেই হাসি, শব্দহীন, অর্থময়।

বলুন না! বলে শরীরের সুগন্ধ নিয়ে কাছাকাছি এগিয়ে গিয়েছিল সীতা। উন্মুখ পানপাত্রের মতো।

তারপর তাকে আবার দেখি আমাদের ফুলবাগানে, শীতকালের ভোরবেলায়। পাড়ার বাচ্চা মেয়েরা রোজ সকালে আমাদের বাগান থেকে ফুল চুরি করে নিয়ে যায়। একদিন রাতে ঘুম হয়নি, সারারাত ভয়ঙ্কর সব কল্পনার ছবি দেখেছি। কালে তো পেল আর খোলা বাতাসের জন্য আকুল ব্যাকুল হয়ে বেরিয়ে এলাম। বাগান তখন ঘন কুয়াশায় ঝিম মেরে আছে। আমি দেখলাম, বাগানের ফটকের কাছে একটি মেয়ে ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে। ও কি ফুলচোর? আমি সাড়া দিইনি, চেয়েছিলাম। সেও একদৃষ্টে আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ মৃদু হাসল। আমি ভয়ঙ্কর চমকে উঠে চিনলাম, এ সেই মেয়ে যাকে আমি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখেছিলাম এবং আরও আগে কবে থেকে যেন চেনা ছিল। সে হেসে এগিয়ে আসতে থাকেফটক পার হয়ে। আমি হিম হয়ে দাঁড়িয়ে, তার পরনে নীল শাড়ি, গলায় কাশ্মীরি স্কার্ফ জড়ানো, ঠিক যেরকম স্কার্ফ আমার মায়ের একটা আছে, নীল শাড়িটাও যেন চেনা। সে লাল সুরকির পথ দিয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে মিহি গলায় জিগ্যেস করল–এ বাসায় তুমি থাকো? আমি মাথা নেড়ে জানালাম–হ্যাঁ। সে হাসল–তোমাকে সেদিন দেখেছিলুম স্টেশনের ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়েছিলে। বিড়বিড় করে কী বকো তুমি বলো তো? তোমার ঠোঁট নড়ছিল। আমি হেসে মাথা নেড়ে বললাম-কী জানি, হবে হয়তো। সে এবার কাছে এগিয়ে আসে, খুব কাছে। বলে–আমি সেই ছেলেবেলায় কবে তোমাকে দেখেছিলাম, আর এখন তুমি কত বড় হয়ে গেছ। তুমি কেমন মানুষ হয়েছ তা তো জানি না! কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি খুব সৎ আর তোমার মনে খুব মায়া। আমি হাসলাম কী জানি! জানি না। সে বাগানের দিকে একবার ফিরে দেখে নিল, বলল-সৎ লোকেরা কখনও সুখী হয় না। তুমিও দুঃখী বোধ হয়। আর দেখছি তুমি তেমন সবল হওনি, দৃঢ়চেতা হওনি, তাই না? আমি মাথা নাড়ি-হ্যাঁ, ঠিক তাই। সে সুন্দর সকালের রোদের মতোই ফুটফুটে হাসি হাসল–ছেলেবেলার কবেকার এই পূরনো ভুলে যাওয়া মফস্বল শহরে এতদিন পর আমি আবার কেন এসেছি জান? তোমার জন্যই। বলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে–আসব তোমার কাছে, মাঝে মাঝে আসব। শুধু এই খুব অসময়ে দেখা হবে, যখন মানুষ ঘুমোয় কিংবা কেউ থাকে না কোথাও। অসময়ে মনে রেখো। বলতে বলতে সে পিছন ফিরল। আমাদের বাগানে গাছপালা ঘন, সারাদিন ছায়ায় অন্ধকার হয়ে থাকে। সে এইসব গাছগাছালির মায়াময় ছায়াচ্ছন্নতার ভিতরে চলে গেল। আর তাকে দেখা গেল না। আমি আবার ভোরবেলায় উঠলাম পরদিন। আমাদের কুয়াশায় আচ্ছন্ন বাগানে কেউ ছিল না। আমি সুরকির পথ ধরে বাগান থেকে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। ঝুম কুয়াশায় খুব ভোর-আলোর ভিতরে যতদূর চোখ যায় চেয়ে দেখলাম, সব শূন্য। সে নেই। তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে, এ ভুল। আমি আগের দিন ভোরে বাস্তবিক কাউকেই দেখিনি। সে আমার কল্পনা। ফিকে বিষাদে আমার মন ছেয়ে গেল। তবে আমার একটা সুবিধে এই যে আমার কিছু হারায় না। আমি কল্পনায় সব পেয়ে যাই। সেখানে সেও রয়ে গেল চিরদিনের মতো। ভাবতে ভাবতে আমি ভোর, শীতল, প্রায়ান্ধকার জনশূন্য রাস্তায় রাস্তায় অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। স্বপ্নের সেই মেয়েটি আমাকে কথা দিয়েও ভুলে গেছে বলে কোনও ক্ষোভ রইল না।-ইচ্ছে থাকলেও আমি রোজ রাতে একই স্বপ্ন দেখতে পারি কি? তবে দুঃখ কীসের? ফিরে এসে দেখি ফটকের কাছে আমার ছোট বোন মাধবীলতার আর্চের কাছে দাঁড়িয়ে, মা বারান্দায়। শুধু আমি সামান্য বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি, আমার বোনের পরনে চেনা নীল শাড়ি, আর মায়ের গলায় সেই কাশ্মীরি স্কার্ফ জড়ানো।

–এ তো স্বপ্ন!

–স্বপ্ন না থাকলে এই অতি সুকঠিন, বিবর্ণ বাস্তবতা নিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে থাকব? একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি, আমার মশারির এক ধার তুলে সে আমার দিকে ঝুঁকে চেয়ে আছে। আমার চেতনা জুড়ে তীব্র ভয় লাফিয়ে উঠল। বল-এর মতো লাফাতে লাগল আমার হৃৎপিণ্ড! সে মৃদু হাসল তুমি খুব দুর্বল? কেন? আমি জবাব দিলাম না। সেদিন তার পোশাক ছিল গোলাপি, তাতে জরির কাজ। সে স্নেহের একটি হাত আমার বুকের ওপর ফেলে রেখে ধীরে ধীরে বসল। আমি দেখলাম, সে সালোয়ার আর কামিজ পরে আছে। আমার স্মৃতি তার টানে আমাকে একবার অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে কী যেন দেখে নিতে বলল। আমি কিছুই মনে করতে পারলাম না। সে আবার মৃদু হেসে বলল–ছেলেবেলা থেকেই তুমি দুর্বল। তোমার মাথায় স্বপ্নের বাসা, তোমার মনে একরত্তি বাস্তবতা নেই। বলতে বলতে সে আরও ঝুঁকে পড়ে সামান্য তীব্ৰস্বরে বলল–আমাকে মনে পড়ে না তোমার? একদিন আমরা বনভোজনে গিয়েছিলাম ছেলেমেয়েরা। দলছাড়া হয়ে তুমি আর আমি পালালাম নদীর ধারে। তুমি ছিলে ভিতু, আমি সব সময়ে তোমাকে সাহস দিতাম। সেই নদীর ধারে আমি তোমাকে কবিতা শুনিয়েছিলাম। তুমি ছিলে বোকা, আসলে কবিতার ভিতর দিয়েই আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম যে, আমি তোমাকে…। তুমি ভয়ংকর অস্বস্তি আর অস্থিরতায় তার মানে বুঝবার চেষ্টা করেনি। তুমি বলেছিলে, পায়ে পড়ি ফিরে চলল। মনে পড়ে? আমি বললাম না। মনে পড়ে না। আবার সেই হাসি হাসল সে–দ্বিধামুক্ত, কোমল কিন্তু জীবনশক্তিতে ভরা। বলল–তুমি সব পেয়েও পেতে চাও না, কেবল পালাতে চাও স্বপ্নের ভিতরে। তাই আমাকে অনেক রাস্তা পার হতে হল। তার গলার স্বরে এবার আস্তে আস্তে আমার সামান্য সাহস ফিরে আসে। বললাম-কোথা থেকে এলে তুমি অত বাক্সবোঝা নিয়ে? রেল গাড়িতেই তুমি কি এসেছ? অনেক দূরে থাকো কি তুমি? না, ছেলেবেলার তোমাকে আমার মনে নেই। তুমি কি রিনা? কিবা আর কেউ, যাকে আমার মনে নেই? সে আমার মাথার বুটি নেড়ে দিল, বলল–তোমার সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। হায়! আমাকে তোমার মনে পড়ল না? অথচ কতদূর থেকে আমি এলুম শুধু তোমার জন্যই। কথা বোলো না, আমার হাত ধরে চুপ করে শুয়ে থাকো। শোনো, আমি তোমাকে একদিন আমাদের বাড়ির একটা গোপন কুঠুরির তালা খুলে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই ঘরে ছিল কাঠের একটা পুরনো সিন্দুক। তার ভেতরে ছিল অনেক কাগজপত্র, রহস্যময় অনেক পুরনো দলিল, অনেক চিঠি। তুমি আর আমি আমাদের নিষেধের ছেলেবেলায় এক দুপুরে বসে অনেক চিঠি পড়েছিলুম একসঙ্গে। সেইসব চিঠি ছিল আমার মা আর বাবার মধ্যে লেখা প্রেমপত্র। না ভুল বললাম, শুধু প্রেমপত্র নয়, সেগুলো বিয়ের পরে লেখা। কিছু সাংসারিক কথাও তার মধ্যে ছিল। পড়তে পড়তে, হাসতে হাসতে আমরা এক সময়ে দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে চুপ করে বসেছিলুম। সেই কাঠের সিন্দুকের ওপর অনেক পুরনো কাগজের গন্ধের মধ্যে। মনে পড়ে? তোমার মনে নেই, কেননা সে সবই অতি তুচ্ছ ঘটনা, খুব সামান্য, তাদের যত্ন করে আমিই মনে রেখেছি এতদিন। হায়! সে সব তুচ্ছ ঘটনা ছাড়া আমার আর কিছু নেই। তোমাকে সেইসব ফিরিয়ে দিতে এসেছি। দিয়ে গেলুম। আমি তার হাত মুঠো করে ধরে রইলুম। সে অন্ধকার ঘরের চারদিকে চাইল। বলল–এই ঘরে আর কে থাকে? ওই বিছানায় তোমার বুড়ি ঠাকুমা আর ছোট ভাই বোন, না? আর পাশের ঘরে তোমার মা বাবা, তাই না? আর এই ছোট্ট বিছানায় তুমি! সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল-সুন্দর সংসার তোমাদের। শান্ত পরিপাটি ভাল মানুষদের পরিবার। তোমাদের ঘরের আনাচে কানাচে সুন্দর সব স্বপ্নেরা ঘুরে বেড়ায়, প্রজাপতির মতো ওড়ে কল্পনা! এরকম পরিবারই আমি ভালবাসি। এতদিন হয়ে গেছে, এখন আর বলাই যায় না যে, আমি তোমাকে…! সে থেমে শুধু আমার দিকে চেয়ে রইল। ঘরে কোথাও আলো ছিল না, কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কামিজের কলারে জরি তার ঘাড়ের সুন্দর রঙের ওপর জ্বলছে। তার মেরুন ঠোঁট থেকে শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে যাচ্ছে ঘরের বাতাস। তার নরম হাত ক্রমশ গলে যাচ্ছে আমার হাতের মৃদু উত্তাপে। সে অনেকক্ষণ ওইভাবে বসে রইল। আমি তার দিকে চেয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে মৃদু গলায় বলল-ঘুমোও। যতক্ষণ ঘুমিয়ে না পড়ো ততক্ষণ বসে থাকব। তৎক্ষণাৎ আমি বললাম–তা হলে ঘুমোব না। এসো, দুজনে জেগে থাকি। সে তার দুটো আঙুল আমার চোখের ওপর রাখল, সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর জুড়ে নেমে এল সম্মোহন, ঘুমের এক ঢল।

নিথর হয়ে গল্পটা শুনেছিল সীতা। প্রায় কিশোরী বয়সি সে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করেছিল–সেই বনভোজনে কী কবিতা সে শুনিয়েছিল?

মনোরম তৃপ্তির হাসি হেসে একটা নুড়ি ছুঁড়ে দিল জলে, বলল–মেরিলি র্যাং দ্য বেল, অ্যান্ড দে ওয়্যার ওয়েড…।

সীতা মুখ নিচু করে ছিল তারপর। নদীটা তট অতিক্রম করে তার বুকে উঠে এল। তারপর বুক জুড়ে বয়ে যেতে লাগল। তখন দূরে দু-একটা কণ্ঠস্বর তাদের নাম ধরে ডাকছিল। তারা কেউ উত্তর দিল না। শুনতে পেল না।

সীতা মৃদুস্বরে বলল–এ সবই গল্প।

গল্পই! তোমাকে বলি, চপলা ছাড়া কোনও অনাত্মীয়া মেয়ের গা আমি কখনও দুইনি, ছোঁয়ার মতো করে। অনাত্মীয়াই বা বলি কী করে। চপলা আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়াই ছিল। আমরা দেশের বাড়িতে যখন যেতাম, তখন বাচ্চা ছেলেমেয়েদের একটা বেশ বড় দঙ্গল এক ঢালাও বিছানায় শুতাম। তখন প্রায়ই চপলা আমার মাথার বালিশে ভাগ বসাত। আমার অসতর্ক ঠোঁটে চুমু খেত, ভয়ে আমি কাঠ হয়ে থাকতাম। সঞ্জীবচন্দ্রের একটা উপন্যাসে ছেলেবেলায় আমি একটা প্রেমের ঘটনা পড়ি। নায়িকা তেলের প্রদীপ হাতে রাত্রিবেলায় নায়ককে দেয়ালের ছবি দেখাচ্ছে ঘুরে ঘুরে। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ নায়ক মুখ ফিরিয়ে বলল তোমার গায়ে কী আশ্চর্য সদগন্ধ। শুনে প্রদীপ ফেলে নায়িকা ছুটে পালিয়ে গেল। ওই কথা দীর্ঘকাল ধরে গুনগুন করে ওঠার মতো আমার মনে রয়ে গেছে, তোমার গায়ে কী আশ্চর্য সদগন্ধ। চপলার শরীরের গন্ধ মনে নেই। বোধহয় সে ঘামের তেলের, কচি ঠোঁটের মিলিত গন্ধ-কিশোরী বা বালিকার গায়ে বোধহয় ওইরকম গন্ধ থাকে। তবু এখনও যখন গভীর রাতে কল্পনায় চপলা চুপি চুপি মশারি সরিয়ে সেই ছেলেবেলার দেশের রাত্রির মতো কাছে আসে, তখন এখনও আমি ফিসফিস করে বলে উঠি–তোমার গায়ে কী আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ! চপলা প্রদীপ ফেলে পালায়।

এটুকু বলে মনোরম প্রতীক্ষায় চেয়েছিল।

 কী বলবে সীতা? তবে সে ইঙ্গিত বুঝেছিল। অবশেষে বলল–সে সব তো স্বপ্নে!

–স্বপ্নই। কিন্তু আর তো কখনও তাদের স্বপ্ন দেখব না।

–কেন?

মনোরম তীব্র হাতে আবার নুড়ি ছুঁড়ে মারল জলে, বলল–সে সব রেখে গেলাম ওইখানে। নদীতে। চপলা, রিনা, আর সব…

তবে কী থাকল?

–তুমি বলো তো?

–…

–আমি কি আর কখনও সেই আশ্চর্য গন্ধ পাব? পাব না বোধহয়, না?

 কৃত্রিম দুঃখে ভরা গলায় বলেছিল মনোরম।

কী জানি।

–তুমি বলো।

.

মনোরম স্পর্শ করেছিল তাকে, কী সাহস। অনেকক্ষণ বুক ভরে টেনেছিল বাতাস, নতুন ফোঁটা ফুলের গন্ধ যেমন নেয় লোকে ঠিক তেমনি। সীতার সুন্দর গন্ধ নিয়েছিল মনোরম। বলেছিল–আমি আর স্বপ্ন চাই না।

প্রবাসে, বিদেশে ছুটিতে যায় যুবক যুবতীরা। কাছাকাছি হয়, একটু রং ছোঁড়াছুড়ি করে। কলকাতায় পা দিয়ে সব ভুলে যায়। বাইরে থেকে ঘরে এসে যেমন বাইরের ধুলো হাত-পা থেকে ধুয়ে ফেলে লোক তেমনি ধুয়ে ফেলে স্মৃতি। কিন্তু সীতা ভোলেনি। ককাতায় ফিরেও।

সীতার দেওয়া টেলিফোন নম্বরটা হারিয়ে ফেলেনি মনোরমও। টেলিফোন করেছিল।

.

আজ বহুকাল বাদে বৃষ্টিতে-ঘোয়া ময়দান পেরিয়ে, ব্রিজ পেরিয়ে, ঢালু বেয়ে যখন নেমে যাচ্ছে। ট্রামগাড়ি, তখন সীতা স্পষ্ট সেই বহুকালের পুরনো টেলিফোনটা কানে তুলে শুনছিল কাঁপা কাঁপা একটা ভিতু গলা–আমি মনোরম। তুমি কি সীতা?

গায়ে কাঁটা দেয়। এখনও।

কলকাতায় তো সেই কনভূমি নেই, স্বচ্ছ জলের নদীটিও নেই। তবু মানুষ ইচ্ছে করলে মনে মনে সেই কনভূমি আর সেই নদী সৃষ্টি করে নিতে পারে। তারা নিয়েছিল।

ভালবাসা? হবেও বা। তখন মনোরম বড় ছন্নছাড়া, চাকরি ছেড়ে এজেন্সি নেওয়ার কথা মাঝে মাঝে বলে। সীতার বাবা ব্যাপারটা আন্দাজ করে বললও ছেলে এখনও লাইন পাচ্ছে না, ওর কি কোনও কেরিয়ার তৈরি হচ্ছে?

তবু বিয়ে হয়েছিল। যেসব ছেলেরা নিজেরা যেচে মেয়েদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব করে, তাদের কেমন যেন পছন্দ হয় না সীতার। মনোরমও করেনি। সীতা করেছিল প্রস্তাব।

তারা সুখী হয়েছিল কিনা তা ঠিক বুঝতে বা ভাবতে চেষ্টা করেনি সীতা। সে শুধু ধীরে ধীরে কদমছাঁট চুলওলা মাথাটাকে ক্রমে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখতে শিখেছিল। ভালবাসা কি ওইরকমই কিছু? আর একজনের ইচ্ছাকে নিজেরও ইচ্ছা করে নেওয়া? নাকি আরও বড় বিশাল কিছু?

সীতা ভেবে পায় না। আজও বড় মনে পড়ে, দুঘরের মাঝখানে নীল পদাটা উড়ছে ঝোড়ো হাওয়ায়, দুঘর উদ্ভাসিত আলো। এ ঘরে চা ছাঁকছে সীতা, ও ঘরে ক্লান্ত মনোর বসে আছে। অপেক্ষায়। কেবলই এই দৃশ্যটা মনে পড়ে। ঘরের আনাচে কানাচে সুখ তার অকুরের ডানা মেলেছিল কিনা কে জানে। তবু দৃশ্যটা বোধহয় আজ সুখী করে সীতাকে। দুবীও করে।

ট্রামগাড়ি অনেকক্ষণ ধরে থেমে থেমে চলে। রাস্তা যেন আর ফুরোয় না। বৃষ্টি থেমে গেছে কখন। শেষ বেলার রোদ উঠেছে। খোলা জানালা দিয়ে উদাসীন চেয়েছিল সীতা। পাশে বসা পুরুষ কিংবা মানুষের লোভী চোখের আক্রমণ আর টের পাচ্ছিল না সীতা।

.

একটা মেঘের স্তরের ভেতর সূর্য ডুবে গেল। সীতা বাড়ির রাস্তায় এসে পড়ল যখন, তখন হালকা অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে। একটু অন্যমনে হাঁটছিল, বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়ানো অপেক্ষারত মানুষটিকে সে প্রথমে লক্ষ করেনি। কাছাকাছি হতেই লোকটা তীব্র খাসের শব্দ করে ডাকলসীতা।

চমকে উঠে তাকিয়ে সে মজবুত কাঠামোর প্রকাণ্ড শরীরওলা মানসকে দেখতে পেল। মানস লাহিড়ি।

এক পা এগিয়ে এসে মানস বলে–এখন বাড়িতে ঢুকো না।

-কেন?

তা হলে আর বেরোতে পারবে না, আবার পারমিশানফারমিশান নিতে হবে। তার দরকার কী? চলো কেটে পড়ি, ঘুরে-টুরে একেবারে ফিরবে।

সেই জন্যই আপনি দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তায়

–সেই জন্যই। তোমাকে মাঝপথে ধরব বলে। চলল জিনিসগুলো আমাকে দাও–নিচ্ছি। কোথায় গিয়েছিলে?

–মাঝে মধ্যে বেরিয়ে পড়ি। এমনি ঘুরে এলাম একটু।

স্ট্যাক্সি নেব?

 সীতা হাসল। বলল স্ট্যাক্সি কেন? অনেক দূরের প্রোগ্রাম।

-না, না। কোনও প্রোগ্রাম নেই। যেখানে খুশি একটু যাব। কত কথা জমে আছে।

 দুজনে আবার বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। পাশাপাশি

-খড়্গপুরে গিয়েছিলাম কদিনের জন্য। মানস বলে।

জানি তো! সীতা হাসল।

 –জানো তো বটেই। কিন্তু এ কদিন তোমাকে না দেখে কীরকম কেটেছিল খঙ্গপুরে তা তো বলিনি।

সীতা মাথা নিচু করল একটু। কথা বলল না।

আমার শরীরে কোনও রোগ নেই, তবু এ কদিন আমার শরীর জ্বরজ্বর করেছে। মাথা ধরেছে। ইন্টার রেল ওয়েটলিফটিং-এ আমি ছিলাম একজন জাজ, কিন্তু জাজমেন্টও দিয়েছি আবোলতাবোল। কিছু ভাল করে লক্ষই করিনি। ভাবছি কী করে পাতিয়ালায় যাব। এইরকম তোমাকে ছেড়ে।

সীতা তেমনি মুখ নিচু করে থাকে।

-শুনছ?

হু।

–কিছু বলো।

 কী বলব?

কীভাবে যাব পাতিয়ালায়? ওখানে কোচদের ট্রেনিং তো অনেক সময় নেবে আরও। বঙ্গাপুরে মাত্র ক’দিনেই যা অবস্থা হয়েছিল…!

সীতা একটা শ্বাস ফেলল। কিছু বলল না।

–কিছু বলো।

 সীতা একটু সংকোচ বোধ করছিল। তবু বলল–এক বছর হতে আরও তিন মাস বাকি আছে। তারপর তো..

ঝকঝক করে ওঠে মানসের চোখ, সীতার দিকে ঝুঁকে বলে–তারপর কী?

 সীতা সুন্দর দাঁতে নীচের ঠোঁট কামড়াল।

মানস মুখটা সরিয়ে নিয়ে বলেও সব কে আর মানছে? তিন মাস আমি অপেক্ষা করতে পারছি না।

–তাই কি হয়?

–কেন হয় না?

–তিনটে মাস চলে যাবে দেখতে দেখতে।

–তিনটে মাস কিছু কম সময় নয় সীতা। আমরা ইচ্ছে করলে এই তিনটে মাস গেইন করতে পারি।

 –ও যদি বাধা দেয়?

–কে?

–ও। বলে মাথা নোয়ায় সীতা।

মনোরম?

হু।

-মনোরম! মনোরম কেন বাধা দেবে?

—যদি দেয়?

-কেন দেবে? ওর কোনও ইন্টারেস্ট তো আর নেই।

–নেই? ঠিক জানেন?

 মানস শব্দ করে হাসে।

নেই আমি জানি। তা ছাড়া মনোরম এখন ধ্বংসস্তূপ। জাস্ট এ হিপ অফ ডেব্রিস। বাধা দেওয়ার ক্ষমতা ওর আর নেই।

সীতা চুপ করে থাকে।

–আজকাল রাস্তায় রাস্তায় ফ্যাফ্যা করে বেড়ায়।

থাকগে। আমি শুনতে চাই না। সীতা বলে। থাক। আমিও ঠিক বলতে চাইনি। তবে এক সময়ে ও আমার বন্ধু ছিল। আই ফিল ফর হিম।

সহজেই পাওয়া গেল ট্যাক্সি। বড় রাস্তার মোড়েই সওয়ারি মামাচ্ছিল ট্যাক্সিটা। মানস চলো বলে দৌড়ে গিয়ে ধরল। ড্রাইভার কোথায় যাবেন? এবং তারপর, গাড়ি খারাপ আছে দাদা বলে এড়াতে চেয়েছিল। মানস কোনও কথাই গ্রাহ্য করল না। শান্ত হাতে দরজা খুলে সীতাকে আগে উঠতে দিল, তারপর নিজে উঠল। দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারকে বলল–গোলমাল কোরো না, যেদিকে বলছি সেদিকে যাবে, নইলে…ড্রাইভার ঘাড় ঘুড়িয়ে এক পলক দেখে নিল মানসকে, তারপর স্টার্ট দিল।

সীতা জানে, এ অবস্থায় মনোরম হলে ট্যাক্সিওয়ালাই জিতে যেত। মনোরম কিছুতেই এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ট্যাক্সি ধরতে পারত না।

মানস একটু ঘন হয়ে বসল। ট্রামে সেই মুশকো লোকটার মতোই অবিকল। তবে সীতা এবার সরে গেল না। মানসের একটু ভাঙা চৌকো মুখ, মাথায় পাতলা চুল, চমৎকার দুখানা হরিণ চোখে এক ধরনের মারাত্মক সৌন্দর্য আছে। ওর শরীরটা যেমন কর্কশ আর প্রকাণ্ড আর জোরালো, চোখ দুখানা তেমনই মায়াবী। কাজলের মতো টানা একটা রেখা আছে ওর চোখে, জন্মগত। কথা যখন বলে তখন বড় সুন্দর শোনায় ওর গলা, ঘোষণাকারীদের মতো।

হাত বাড়িয়ে নরম জোরালো পাঞ্জায় সীতার হাত ধরল মানস। সীতা কোনও সংকোচ বোধ করে না। কেবল একটা অস্বস্তি তার হয়। সেটা হাস্যকর অস্বস্তি। মনোরম খুব সিগারেট খেত। তাই যখনই মনোরমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হত সীতা, তখনই সিগারেটের গন্ধ পেত। সিগারেটের জন্য সে কম বকেনি মনোরমকে। কিন্তু গন্ধটা তার বুকে, শিরায়, সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। যেন পুরুষের গায়ে ওই গন্ধ থাকবেই। ওটাই বুঝি পুরুষের গন্ধ। মানস সিগারেট খায় না। ট্যাক্সিতে এত কাছাকাছি বসেও সীতা তাই পুরুষের সেই অমোঘ গন্ধটি পাচ্ছিল না। একটা কেমন অস্বস্তি হয় তার। পুরুষের সেই অমোঘ গন্ধটির জন্য সে উন্মুখ হয় বুঝি মনে মনে।

ব্যাপারটা কিছু নয়। সকলকেই যে এক রকমের হতে হবে তার কী মানে আছে! সীতার হাতখানা নিয়ে আঙুল আঙুলে আশ্লেষে খেলা করল মানস। সীতা বাধা দিল না। একজনের সঙ্গে বউ হয়ে থাকার অভ্যাস ছেড়ে আর একজনের বউ হওয়ার অভ্যাস রপ্ত করা সহজ নয়। এই নতুন অভ্যাসকে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল সীতা।

–কোথায় যাচ্ছি আমরা?

আগে কিছু খাই। বড্ড খিদে।

–জানি। খুব খিদে পায় আপনার।

 মানস হাসল। পরিতৃপ্তির সঙ্গে বলল–ঠিক ধরেছ। আমার শরীরটা যেমন প্রকাণ্ড, তেমনি আমার প্রকাণ্ড খিদে! সব রকম খিদে।

অর্থপূর্ণ হাসছিল মানস। সীতার খাটো ব্লাউজের তলায় পেট পিঠ খোলা। মানসের হাত সীতার করতল ছেড়ে উঠে এল কোমরে। নরম আঙুলে সে সীতার শরীরের মাংসে আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। মানস এতকাল এ সব করেনি। এখন বোধহয় ওর ধৈর্য ভেঙে যাচ্ছে। মুখের সামনে মাংস, তবু খাবে না, এ কী রকম। সীতা একটু হাসে। তার অনিচ্ছা হয় না। আর একটু ঘন হয়ে বসে মানসের শরীরের সঙ্গে। পেটের কাছে মানসের হাতটা চেপে ধরে রাখে এক হাতে। তার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। সে অভ্যাস করে নেবে। এই বড় চেহারার শক্ত মানুষটির কাছাকাছি বসে সে নির্ভরতা পাচ্ছিল।

মানস ফিসফিস করে বলল–আমাকে তুমি করে বলো।

বলব।

এখনই।

তুমি।

ব্যস, হয়ে গেল! বলে হাসল মানস।

 সীতা কিছু বুঝতে পারেনি, আচমকা খোঁপার নীচে তার ঘাড়টা চেপে ধরে মানস। অন্য হাতে থুতনি ধরে একপলকে মুখটা ফিরিয়ে নেয় তার দিকে। চুমু খায়। ছোট্ট চুমু, কয়েক সেকেন্ডের।

সীতা ছাড়া পেয়ে বলল-ট্যাক্সিতে? ওঃ মা।

-ও দেখছে না।

সীতা খুব আস্তে বলে–ওর সামনে আয়না রয়েছে।

–দেখলেই কী? আস্তে বলে মানস।

–কী ভাববে?

–কিছু ভাববে না। কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালাদের অভ্যাস আছে দেখে।

যাঃ! সীতা হাসল।

এবং মানস আর একবার কাণ্ডটা করল। এবার একটু এগোল মুখটা নিয়ে। তার মুখের লালাতে ঠোঁট ভিজে গেল সীতার। তবু ভালই লাগল। একটু কাঁটা হয়ে রইল সে, ট্যাক্সিওয়ালাটার জন্য। কিন্তু শরীরে এক ধরনের উত্তাপ ছড়িয়ে গেল। নতুন মানুষটিরই উত্তাপ। সীতা বুঝে যাচ্ছিল, সে পারবে। এরকম আত্মবিশ্বাসী, সাহসী, সরল ব্যবহারের মানুষ সে তো আগে দেখেনি। এর অভ্যাসকে নিজের অভ্যাস করে নেওয়া শক্ত নয়। সীতা জানে ট্যাক্সিওয়ালাটা দেখছে সবই, ভয়ে কিছু বলছে না। নিখুঁত চালিয়ে নিচ্ছে গাড়ি।

বড় রেস্তরাঁয় যাব না, কেমন? মানস বলে, স্বরে গাঢ় ভালবাসা।

যা তোমার খুশি।

বড় রেস্তরাঁয় ভিড় কথা হয় না।

 সীতা মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলে কথা তো হয়েই গেল।

কী কথা হল।

–এই যে, যা করলে, এটাও তো কথাই। মানস হাসল খুব। একটু অন্ধকার এখন। তাই মানসের হরিণ চোখজোড়া দেখতে পাচ্ছে না সীতা। দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব।

গড়ের ময়দান ছেড়ে চৌরঙ্গিতে পড়তেই রাস্তার আলো অপসৃয়মাণ উজ্জ্বলতা ফেলছিল গাড়ির মধ্যে। এই আলো, সেই আলো, লাল-সবুজসাদা। সেইসব আলোতে পলকে পলকে মুখখানা পালটে যায়। মানসের মুখ খুব কাছে। ভাল দেখা যাচ্ছে না। ভালবাসায় স্নেহে ওর মাথায় হাত রাখল সীতা। ওর হরিণ:চোখ একবার আলোকে স্পষ্ট, আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। সীতা নিবিড় চোখে দেখে।

চুল উঠে যাচ্ছে বুঝি? মানসের মাথার চুল নেড়ে সীতা বলল।

 –প্রায়। টাক পড়ে যাবে শিগগির। তার আগে টোপর না পরলে…

–টোপর? একটু অবাক গলায় সীতা বলে।

নয় কেন?

 টোপর পরা মানে তো সামাজিক বিয়ে, তা কি হবে?

 হবে না কেন? একটু অস্বস্তির গলায় মানস বলে।

সীতা হাসল একটু, বিষণ্ণ হাসিটি। বলল–তা কি হয়? কুমারী মেয়েরই সম্প্রদান হয়।

মানস হেলে পড়েছিল সীতার গায়ে, উঠে বসল।

না হয় রেজেস্ট্রিই হল। টোপর পরাটা না হয় এ জন্মে বাদ দিলাম।

 সীতা হঠাৎ তার চোখভরা জল টের পেয়ে আঁচল তুলল চোখে, বলল–টোপর পরার শখ থাকলে না হয় আমি সরে যাই…

কী বলে রে মেয়েটা? এঃ মা, কাঁদছ? বলে মানস দুহাতে তাকে টেনে নেয় এবং তখন মানসের শরীরের মাখনের মতো নরম এবং লোহার মতো শক্ত দুরকম পেশির অস্তিত্ব টের পায় সীতা।

কাঁদে না, কাঁদে না। টোপরটা তো ঠাট্টার কথা, আজকাল কেউ পরতেই চায় না। মানস আকুল গলায় বলে।

না। তা কেন? বিয়েতে আলো, সানাই, টোপর-সিথিমোর, কড়িখেলা এ সবের একটা আলাদা স্বাদ। অনেকে বিয়ে বলতে এ সব ভাবে। তুমিও ভাব।

–কে বলল?

–আমি জানি।

–আমার বয়স কত জান?

কত?

 –একত্রিশ। এ বয়সে যে রোমাঞ্চ-টোমাঞ্চ সব ঝরে যেতে থাকে। আমি স্বপ্ন দেখি না।

–শুভদৃষ্টির কথাও কখনও ভাব না?

–ও সব নিয়ে ভাববার সময় কোথায়?

–আর ফুলশয্যা?

তুমি ঠাট্টা করছ।

 না গো।

–শোনো, আমি বড্ড ব্যস্ত মানুষ। সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াই। তিন-চার বার ইউরোপ,ফার ইস্ট ঘুরেছি। অনেক দেখতে দেখতে আর অনেক ব্যস্ততার মধ্যে আমার ও সব সংস্কার কেটে গেছে। লক্ষ্মীটি, একদম ভেবো না। আমি সত্যি ঠাট্টা করছিলাম।

আর তখন সীতার ভাল লাগছিল খুব, মস্ত বুকে হেলান দিয়ে বসে থাকতে। সে মনে মনে হিরে করে দেখল, যদি মানসের একত্ৰিশ হয়, মনোরমের এখন ছত্রিশ এবং মানস তার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। সীতা কলকাতার রাস্তায় একটা বিজ্ঞাপনের হেডিং দেখেছে প্রায়ই-গেট ইওরসেলফ এ ইয়ং হাজব্যান্ড। সে কথাটা ভাবতে ভাবতে সে হঠাৎ আস্তে বললআই অ্যাম গেটি…

কী?

–এ ইয়ংগার হাজব্যান্ড। বলে হাসল সীতা, সম্মোহিতের হাসি।

 মানসের সাহসী ও সরল হাত একটু ওপরে উঠেছে তখন। বুকে।

ট্যাক্সিওয়ালা পার্ক স্ট্রিটের ট্রাফিক সিগন্যাল পার হয়ে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে বলল–কোথায় যাবেন?

চৌরঙ্গি মার্কেট। মানস ভেবে রেখেছিল জায়গাটা। চট করে বলল। ভাবল না। এবং যেখানে হাত ছিল সেখানেই রেখে দিল। সরাল না।

বড় অবাক করা সাহস ওর। সীতা ঠিক এরকমই চেয়েছিল।

সুরেন ব্যানার্জি রোডে ট্যাক্সি ছেড়ে ওরা ঢুকল চৌরঙ্গি মার্কেটে। ছোট্ট ছিমছাম একটা রেস্তরাঁ। খদ্দের নেই।

অনেক খাবারের অর্ডার দিল মানস। দইবড়া, চপ, ঘুগনি।

আর কী খাবে?

 –আরও? চোখ কপালে তোলে সীতা।

খাও না বলেই তুমি রোগা।

 সীতা মুখে রুমাল চেপে স্রোতস্বিনীর মতো হাসে-মেয়েরা অত খায় না মশাই।

কারও খাওয়া দেখলে তুমি ঘেন্না পাও না তো? অনেকে পায়।

যাঃ! যে খেতে পারে সে খাবে না কেন? ঘেন্নার কী?

আমার বাসায় তো বড় পরিবার। সেখানে অনেকে আছে যারা আমার খাওয়া দেখতে পারেনা।

–আমি পারব। ভয় নেই।

 সেই তৃপ্তির হাসিটা আবার হাসে মানস। চৌকো থুতনি আর চোয়ালে হাসিটা খুব জোরালো দেখায়। ঝকঝকে সাজানো দাঁত। মুখে খুব সুন্দর একটা সুস্থতার গন্ধ পেয়েছিল সীতা, চুমুর সময়ে। হরিণ চোখ, তাতে দীর্ঘ পাতা। এত জোরালো মুখে চোখ দুটো বড় বেমানান রকমের মায়াবী। বড় পরিবার কথাটা সীতার মনের মধ্যে নড়ছিল। একটু সময় নিল সে, বলল–বিয়ের পর তোমার পরিবারের কে কী বলবে?

বললেই শুনছে কে? আমি তো গভর্নমেন্টের ফ্ল্যাট পেয়েই গেছি তারাতলায়। অগাস্টে অ্যালটমেন্ট, তুমি তো জানো।

আলাদা থাকাটাই তো সব নয়। সম্পর্ক তো থাকবেই। আর যাতায়াতও।

 সব সম্পর্ক কেটে দিচ্ছি।

–কেন?

–কেটে না দিয়ে উপায় কী?

 সীতা আবার সংশয়ের যন্ত্রণা ভোগ করে বলে–কেন কেটে দিচ্ছ? আমার জন্যই তো।

ঠিক তা নয়। তবে তোমাকে নিয়ে আলাদা থাকতে চাই। একদম আলাদা আর একা।

–কেন? প্রশ্ন করেই আবার সীতার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। চোখে জল চলে আসতে থাকে। আজকাল তার এরকম হয়। ছন্নছাড়া, কারণহীন কান্না পায়। খুব কি বেশি অভিমানী হয়ে গেছে সে?

মানস তার হরিণ চোখ দুখানা সম্পূর্ণ মেলে চেয়ে থাকে। তারপর হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা সীতার একখানা হাত চেপে ধরে বলে–ও কী! সীতা!

মুখোমুখি বসে ছিল তারা। মানস উঠে সীতার পাশে এসে বসল, কাঁধের ওপর হাত রেখে বলল, কী হল হঠাৎ।

আমার জন্যই তুমি পরিবার ছাড়ছ তো!

–কে বলল?

ফলতে হয় না, টের পাওয়া যায়।

কিছু জানোনা। আমরা কি সুখী পরিবারে বাস করি? ছোট্ট বাসা, জায়গা নেই, রোজ ঝগড়াঝাঁটি, সে এক বিচ্ছিরি পরিবেশ। আমার মা বাবা নেই, শুধু দুই ভাই, তিন কাকা কাকিমা আর খুড়তুতো ভাইবোনদের সঙ্গে থাকি। পিছুটানও কিছুই না। ও সংসার তো একদিন ছাড়তে হতই। আমি অনেকদিন ধরে ঠিক করে রেখেছিলাম যে, বিয়ের পরই আলাদা হব; বিশ্বাস করো।

সীতা সামলে গেল। হাসলও একটু। বলল–আমার সব সময়ে কেন যে কান্না পায়!

-কেন কান্না পাবে? আমরা খুব সুখী হব, দেখো।

কী করে বুঝলে?

আবেগভরে মানস বলে–আমি তোমাকে সুখী করবই। প্রতিজ্ঞা।

হালকা হাসি হাসছিল সীতা, বলল–গায়ের জোরে?

সেকথার উত্তর না দিয়ে অন্য কথা বলে মানস–শুধু তোমার নামটা পালটে দেব।

-কেন?

ও নামে তোমাকে ডাকতে আমার ভাল লাগে না।

–কেন গো?

মনোরম ডাকত।

তাতে কী? মানুষের তো একটাই নাম, সবাই ডাকে।

–তাতে মজা নেই। আলাদা নামে ডাকলেই মজা।

নাম নিয়ে তুমি একটা কিছু ভেবেছ নিশ্চয়ই?

–ভেবেছি।

–কী?

–সীতা নামটার জন্যই তুমি অত দুঃখ-দুঃখী ভাব করে থাক। যেন চারধারে তোমার অশোকবন, রাক্ষসের পাহারা, যেন নির্বাসনে আছ।

অশোকবন’ কথাটায় একটা বিস্মৃতপ্রায় বনভূমির ছায়া সীতার চোখের ওপর দুলে গেল বুঝি? এক পলকের অন্যমনস্কতা কাটিয়ে সে বলল–ডেকো! যেনামে খুশি।

আমি ভেবে রেখেছি।

–কী?

মৌ।

সীতা একটু অবাক হয়ে আবার হেসে ফেলে–বেশ এক অক্ষরের নাম তো?

ভাল নয়?

তুমি যে নাম দেবে, তাই ভাল।

 না। তোমার পছন্দ হয়নি?

হয়েছে। ডাকলে কেউ ভুল করে শুনবে বউ বলে ডাকছ।

আসলে তো তাই ডাকা। মৌ মানে মধু।

–জানি।

বাংলার বধূ, বুকে তার মধু, পড়নি?

–জানি। সীতা স্মিতমুখে মুখ তুলে মানসের মুখে চেয়ে থাকে।

 নিঃশব্দ পায়ে হঠাৎ বেয়ারা খাবার রেখে যায়।

খাও। মানস গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলে।

–আর কি খিদে থাকে?

কেন?

থাকে না গো। ভেতরটা আনন্দে ফেটে পড়ছে।

 মানস খুব খুশি হয়। ভারী বোকার মতো হাসতেই থাকে। অকপট হাসি। একটু ঘন হয়ে আসে। সীতা ঘুগনির বাটিতে চামচ ডোবায়।

ঝাল। মানস বলল।

 ঝালই তো ভাল।

 –আমি ঝাল খেতে পারি না।

তবে তোমাকে রোজ শুকতুনি রেঁধে দেব।

–আমি খাই ফ্যানসুন্ধু ভাত, লাল আটার রুটি, খোসাসুদ্ধ তরকারি, কাঁচা সবজি।

 –ভিটামিন?

–ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ক্যালোরি। আমার কখনও অসুখ হয় না।

বলতে নেই।

 –কী?

–অসুখ হয় না বলতে নেই।

বলব না তা হলে।

সীতা ঘুগনির সুন্দর স্বাদ জিভে নিয়ে উজ্জ্বল চোখে মানসের দিকে তাকাল। সে সুখী হবে।

আমার শুধু একটা ভয়। সীতা মুখ টিপে বলল।

–কীসের ভয়?

আমার একটা অতীত আছে।

তাতে কী?

 –কোনওদিন যদি ও কিছু করে? যদি পিছু নেয়, যদি প্রতিশোধ নেয়?

ভ্রু কুঁচকে চেয়েছিল মানস। প্রবল হাতে হঠাৎ সীতার হাতটা চেপে ধরে বলল–তা হলে ও আমার হাতে শেষ হয়ে যাবে।

সীতা ততটা উদ্বেগে নয়, যতটা ঠাট্টার গলায় বলল–ভয় তোমাকেও।

-কেন?

–যদি কখনও তোমার মনে কিছু হয়?

তক্ষুনি আবেগে মানস প্রায় সীতাকে বুকে টেনে নিতে যাচ্ছিল। রেস্তোরাঁ বলে পারল না। কিন্তু তার মুখচোখ লাল হয়ে গেল উত্তেজনায়, আবেগে, ভালবাসায়। প্রায় বুজেযাওয়া গলায় বলল কোনওদিন না। তুমি এ সব কী বলছ? আমি তোমার জন্য তোমার জন্য বলতে বলতে কথা খুঁজে না পেয়ে মানস রুমাল বের করে মুখ মুছল।

পুরুষকে পাগল করার আয়ুধগুলি মেয়েদের প্রকৃতিদত্ত। এই প্রকাণ্ড মানুষটার শরীরে এখন আর হাড়গোড় নেই। একতাল পিণ্ডের মতো সীতার অভিমান, সংশয় আর ভালবাসার উত্তাপে গলে গলে যাচ্ছে। এখুনি সর্বস্ব দিয়ে দিতে প্রস্তুত। ও এখন সীতার জন্য দশদিন উপোস করতে পারে, খুন করতে পারে, যা খুশি করতে পারে।

সীতা সতর্ক হয়ে গেল। ওকে পাগল করার ইচ্ছে তার নেই। বরং গভীর মায়ায় সীতা বলল তোমার কথা আমাকে কখনও কিছু বল না।

মানস আস্তে আস্তে সহজ হয়ে বসল। রেডিয়োর ঘোষণাকারীর মতো গভীর ঘুমভাঙা সুন্দর গলায় বলল কী বলব! আমার ছেলেবেলা সুন্দর ছিল না। অল্প বয়সে বাবা মারা গেছে, আমরা দু ভাই আর মা কাকাদের কাছে ছিলাম। দুঃখে কষ্টেই। কাকারা খারাপ লোক নয়, কাকিমারাও ভাল ব্যবহার করেছে, কিন্তু মা আমাদের শাস্তি দেয়নি। স্বামী হারিয়ে মা বড় অভিমানী, খুঁতখুঁতে হয়ে গিয়েছিল। কাকিমাদের বা কাকাদের সঙ্গে একটু কিছু হলেই কাঁদত, বিলাপ করত, আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়, বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে। এইভাবেই মে কাকাদের আর কাকিমাদের ধৈর্য ভেঙে গিয়েছিল। ঝগড়াঝাটি অশান্তি। তাই মাকে নিয়ে আলাদা হব বলে ছেলেবেলা থেকেই চাকরির চেষ্টা করতাম। করেছিও চাকরি। খেলাধুলোয় ভাল ছিলাম বলে স্কুলের শেষ ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই চাকরি করেছি। আলাদা বাসা করার মতোটা পেমন, বকিছুটাকা আসত। এইভাবে বড় হয়েছি আর কী?

কখনও স্বপ্ন দেখনি তুমি?

কীসের স্বপ্ন।

–অনেকে তো অনেক রকম স্বপ্নটপ্ন দেখে।

একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল মানস। ভেবে ভেবে বলল–স্বপ্ন ছাড়া বোধহয় মানুষ নেই। আমিও কি দেখিনি? অলিম্পিকে যাব, সেনা আনব-এ খুব স্বপ্ন দেখতাম। হল না। ন্যাশনাল মিট-এ বার থেকে পড়ে যাই, তারপর আর জিমন্যাস্টিকসে ফিরে যাওয়া হল না।

কখনও মেয়েদের কথা ভাবনি?

 মান হাসে মানস,বলে–মেয়ে! তাদের চিন্তা করতে সাহসই পেতামনা। মা আর ভাইকে নিয়ে আলাদা একটা বাসা হবে, শুধু সেই চিন্তাই করতাম। মাত্র তো কয়েক বছর আগে রেলে চাকরি পেয়েছি। কিন্তু ততদিনে মা মরে গেছে ককাদের সংসারে কিছু টাকাপয়সা দিই বলে কাকারাও আর ছাড়েনি। রয়ে গেলাম। মেয়েদের চিন্তা প্রথম অহয় তোমাকে দেখে। মনোরম তো একটা ক্রিপল, ওর মনও সুস্থ নয়। ওর ঘরে তোমাকে দেখে আমার কী যে হত!

বলে আবার গাঢ় চোখে তাকায় মানস। হঠাৎ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে–তোমার কিছু হত না আমাকে দেখে?

সীতা অস্বস্তি বোধ করল একটু। না, হত না। মনোর বড় ভুল করেছিল ওই একটা জায়গায়। মানসকে দেখে কেন কিছু মনে হবেসীতার?তা তো সীতা সেই কদমছাঁট চুলওলা মাথাটাকে নিজের বুকের মধ্যে নিতে শিখে গিয়েছিল।

সীতা মৃদুস্বরে একটা মিথ্যে কথা বলল হত।

 বলে মুখ নামিয়ে নিল টেবিলের ওপর। টেবিলে গাঢ় সবুজ রঙের কচি তাতে তার আবছা মুখচ্ছবি, ও কি নদীর জলে তার ছায়া?

কী হত?

কী জানি! অত কি বলা যায়।

বলো না। আমি বুঝে নিয়েছি।

সীতা হাসল।

চলো, কোথাও যাই।

–কোথায়?

চলো না।

রাত হয়ে যাচ্ছে।

–তাতে কী? তোমাকে কেউ কিছু বলবেনা।

 সীতা চুপ করে বসে থাকে। মাথা নোয়ানো।

–ভয় পাচ্ছ? আমাকে একটা জীবন আমার সঙ্গেই তো থাকতে হবে।

 সীতা একটু চমকায়। ঠিকই তো? ভয়ের কী? বাধ্য মেয়ের মতো সে উঠল।

ট্যাক্সি ধরে তারা এল মস্ত একটা ক্লব ঘরে। বহু পুরনো আমলের প্রকাণ্ড ক্লাব, সাহেবরা তৈরি করেছিল। সামনে লন, তারপর পেটিকো, রিশেপনহল। মানসসীতার হাত ধরে নিয়ে গেল, কোথাও বাধা পেল না, কেউ চেয়েও দেখলনা। রাত প্রায় সাড়েনটা। ক্লাব ঘর প্রায় ফাঁকা। দুচারজন খুব দামি পোশাক পরা লোক গেলাস হাতে বসে আছে, চোখ নিমীলিত।

তারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। কেউ নেই। একটা ঘরে সারি সারি টেবিল টেনিসের টেবিল পাতা। সব বালি, কেবল একটা টেবিলে দুজন ক্লান্ত ছেলে একনাগাড়ে খেলে যাচ্ছে। খুটখাট-টিং শব্দ হচ্ছে। ঘরটা পেরিয়ে তারা আর একটা ঘরে এল। ফকা, আলো জ্বলছে। সুন্দর সাজানো ঘর।

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে মুখ ঘোরাল মানস। আর তখনই সীতা হঠাৎ বুঝতে পারল, মানস প্রকৃতিস্থ নেই। ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে, মুখে রওশ, ঠটিনহে। সীতার একটুও ভয় করল না।

মানস এগিয়ে এসে তার দুকাঁধ ধরে বলল-একটা কথা–

বলো।

 আমার কাছে মেয়েরা রহস্যই থেকে গেছে। মানসের গলা কাপল।

–জানি।

–আমি মেয়েদের কিছু জানি না। তাদের শরীর–তুমি আমাকে এই এক্সপিরিয়েন্সটা দেবে?

 নির্দ্বিধায় সীতা বলে দেব।

এখনই। দ্রুত দৌড়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে এল মানস।

পর মুহূর্তেই তারা পাগল হয়ে যাচ্ছিল। ডিভান না সোফা কে জানে, তার ওপর তারা ঘুর্ণি ঝড়ের মতো ওলটপালট খাছিল।

প্রথম কিন্তু সীতার এ তো প্রথম নয়। সে তো কুমারী নয়। তার রহস্য দেখেছিল প্রথম আর একজন। বনভূমি পিছনে রেখে একটা ঢাল বেয়ে নেমে এসেছিল এক কৃশ ও সুন্দর পুরুষ। বহুদিন, সে কি বহুদিন হয়ে গেল? সেই পুরুষ মনোরম না হয়ে মানস হতে পারত। হলে সে আজ কত সুখী হত।

ঝড়টা যখন তাকে ঘিরে ফেটে পড়ছে তখন সীতা আকুল শ্বাস টানছিল বার বার। কোথাও…কোথাও…কোথাও সামান্য একটু সিগারেটের গন্ধ নেই। নেই কেন? তার পিপাসায় সীতা শুকছিল মানসের মুখ, গাল, গলা, শ্বাস। না নেই। কিন্তু একটু সিগারেটের কণামাত্র গন্ধের জন্য বড় পাগল পাগল লাগছিল সীতার। সে অস্ফুট গলায় পেঁচিয়ে বলল–এ রকম নয়। না, না…

বসন খোলার মুহূর্তেই থেমে গেল মানস! একটু উদভ্রান্ত সে। কিন্তু চট করে নিজেকে সংযত করার অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী। ঘোলাটে চোখে সেসীতার দিকে চেয়ে বলে–না?

সীতা কষ্টে হাসল একটু। মাথা নেড়ে জানাল, না।

-কেন?

 সীতা উত্তর দিল না।

মানস একপলকে গায়ের র বেড়ে ফেলল। হাল। তা হলে থাক। আমার তাড়া নেই।

টিক টক টুং শব্দ আসছে। বলটা মেঝেতে লাফিয়ে পড়ল। গড়াল। একটা অস্পষ্ট গলা শোনা গেল–নাইন সিক্স..সাইড আউট। অবার টিক টিক শন।

যখন বেরিয়ে আসছিল তারা তখনও পাশের ঘরে সেই দুটি ক্লান্ত ছেলে ফাঁকা ঘরে একনাগাড়ে টেবিল টেনিস খেলে যাচ্ছে। টিকটক টিকটকটিক টক

আবার ট্যাক্সি। আবছা অন্ধকার। বাইরের আলো নানা রং ফেলে যাচ্ছে তাদের ওপর।

আমার তাড়া নেই।

সীতা একটু হাসল, স্নায়ুবিকালের হাসি।

মানস রাগ করেনি, একটু হতাশ হয়েছে বোধহয়। কিন্তু সে কিছু না। আবার বলল যখন নিমন্ত্রণ করে পাতপিড়ি পেড়ে খাওয়াবে, তখন খাব।

কী?

–তোমাকে।

সীতা হাসে।

–পাতিয়ালায় যাওয়ার আগে আমি বিয়ে কর সীতা।

আইন?

 দূর হোক গে।

সীতা শ্বাস টানে, একটা সুন্দর সিগারেটের গন্ধ আসছে কোথা থেকে। সীতা চেয়ে দেখে, ড্রাইভারের পাশে বসা অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটা একটা সিগারেট ধরিয়েছে। বুক ভরে বাতাস টানল সীতা।

বাড়ির সামনে নেমে যাওয়ার আগে সীতা হঠাৎ জিগ্যেস করল তুমি সিগারেট খাও না?

না। কেন?

–খাও না কেন?

মানস বুঝতে না পেরে বলে আমার কোনও নেশা নেই। সিগারেট খেলে দমের ক্ষতি হয়।

-খুব ক্ষতি।

মানস হাসল, বলল–কেন, সিগারেট খাওয়া তুমি পছন্দ কর?

মাঝে মাঝে খেয়ো, যদি খুব ক্ষতি না হয়।

 মানস সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল–খাব। আমার ঠিক সহ্য হয় না। তবে মাঝে মাঝে খাব, এবার থেকে। ঠিক আছে?

সীতা সুন্দর ভালবাসার হাসি হাসল। নেমে যেতে যেতে বলল–খেয়ো। মাঝে মাঝে।

কাল আসব যখন তোমার কাছে, তখন…

–আচ্ছা।

–যাই।

.

দাদার ঘরে তখনও মক্কেল আছে। আলো জ্বলছে। কথাবার্তা শুনতে পেল সীতা। সিঁড়িটা অন্ধকার। সীতা পা টিপে টিপে উঠে এল দোতলায়।

বারান্দায় আলো জ্বলছে। বউদি রেলিং থেকে ঝুঁকে আকাশ দেখছে। এ সময়টায় বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে বউদি রোজই সিঁড়ির মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ দাদা উঠে না আসে। দ্বিতীয় পক্ষের বউ, তাই এখনও স্বামীর জন্যে আগ্রহ শেষ হয়নি।

-ঠাকুরঝি এলে?

হু।

কত রাত হল। প্রায় সাড়ে দশটা।

–একটু ঘুরে এলাম। ঘরে ভাল লাগে না।

–কোথায়?

 –অনেক জায়গায়।

একা?

 সীতা ভ্রূ কোঁচকাল। বউদির বয়স কম। কৌতূহল বড্ড বেশি।

সীতা বলল–না। দুজন।

–আর কে?

–তুমি চিনবে না।

–তোমার ভাই ভীষণ সাহস।

 সীতা একটু বিরক্ত হয়ে বলল-বউদি, আমি সধবাও নই, কুমারীও নই, আমি হিসেবের বাইরের মানুষ। আমার জন্য কারও কিছু এসে যায় না।

তা অবশ্য ঠিক। বলে বউদি চুপ করে যায়। তারপরই হঠাৎ প্রসঙ্গটা ঝেড়ে ফেলে বলল দেখো না, বৃষ্টি এসে গেল প্রায়, তবু মক্কেলগুলো যাচ্ছে না।

এই ছেলেমানুষিটুকুর জন্যই বউদিটাকে খারাপ লাগে না সীতার। দাদার আগের পক্ষের একটা ছেলে, বিলু। দার্জিলিঙে স্কুলে পড়ে। দাদা ইচ্ছে করেই সরিয়ে দিয়েছে তাকে, যাতে সৎমায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকে। কিন্তু দরকার ছিল না। বিলুকে ভালই বাসে বউদি। প্রতি সপ্তাহে চিঠি দেয়। মা-মরা ছেলেটার জন্য কাঁদেও মাঝে মাঝে।

এ সময়ে বাড়িটা নিঃঝুম। বাবা তার ঘরে শুয়ে পড়েছে ন’টায়।

সীতার একটু ক্লান্তি লাগছিল। কিন্তু মনে কোনও অবসাদ নেই। সেখানে রঙিন আলো জ্বলছে।

ঘরে এসে টিউবলাইটটা জ্বালে সীতা। তার একার ঘর। ফাঁকা, নিঃঝুম চারদিক। কাপড় না-ছেড়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। একটু শুয়ে থাকে চোখ বুজে। ঝোড়ো বিকেলটার কথা মনে করার চেষ্টা করে। মাথাটা টিপটিপ করছে। অনেকদিন বাদে এত চুমুতে ঠোঁট ফুলে আছে সীতার। ভারী লাগছে, ডান গালে কামড় দিয়েছিল মানস, তার জ্বালা। চোখ বুজে একটু হাসে সীতা। গা এলিয়ে দেয়। পুরুষের মতো একটা প্রবল বাতাস আসে, ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরে। জলকণা মেশানো বাতাস। ঠাণ্ডা। আজ রাতে কিছু খাবে না সীতা, কাপড় ছাড়বে না, ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমোবে? না, ঘুম আসবে না ঠিক। আজ এতদিনের মধ্যে প্রথম মানস এতটা এগোল। শরীরের কাছে শরীরের কত কথা জমে থাকে। মুখ টিপে সীতা আবার হাসে। হঠাৎ ঝড়ে একটা জানালার পাল্লা ঠাস করে শব্দ করে। একটু চমকায় সে। জানালাটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত, কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। ঘর ভিজে যাচ্ছে হ্যাঁচলায়, ভিজুক গে। চোখ বুজে একটা ঝিমঝিমানির মধ্যে চলে যাচ্ছিল সীতা। হঠাৎ শুনতে পেল ফাঁকা হলঘরে দুজন ক্লান্ত ছেলে টেবিল টেনিস খেলছে। টিক-টকটিক-টক…টিকস্টক…।

চমকে চোখ মেলে চায় সে। ধুধু আলো জ্বলছে ঘরে। নীল পর্দা কি ওটা? নীলই তো! পর্দাটা উড়ছে হাওয়ায়। সীতা সমস্তটা মন নিয়ে উঠে বসে। পরদার ওপাশ কী?

কিছুনা। অন্ধকার। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে বারান্দা, তার রেলিং। অঝোর বৃষ্টি।

সীতা হাতমুখ ধুয়ে এসে বাতি নেবাল। দরজা দিয়ে শুয়ে পড়ল। নিঘুম চোখে তার মনে পড়ল, মনোরমের আর কিছুই নেই।

বিয়ের পরই চাকরি ছেড়ে সীতার নামে এজেন্সিটা নিয়েছিল মনোরম। হঠাৎ বাজারে নতুন ধরনের অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা দেখা দিয়েছিল। বড়লোক না হলেও ঢের টাকা রোজগার করেছিল সে। টাকা রাখত লকারে, আয়কর ফাঁকি দিতে সোনা কিনেছিল অনেক। জমি কিনেছিল। সবই সীতার নামে। ঠাট্টা করে বলত–আমি হচ্ছি সীতা ব্যানার্জির ম্যানেজার। সবাই তাই জানে।

সীতা কোনও খোঁজখবর রাখত না। মাঝেমধ্যে কাগজপত্র আর চেকে সই দিত, কার খুলতে তাকেই নিয়ে যেত মনোরম। ব্যাঙ্কে তারা লকার খুনবার যে কোড ব্যবহার করত তা ছিল লাভ। এখনও লকারটা সীতার নামেই আছে। মাঝে মাঝে সে যায় লকার খুলতে, এখনও। কোড বলে লাভ বলবার সময়ে কিছু কি মনে হয়?

ডিভোর্সের সময়ে সে ব্যবসাটা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল মনোরমকে। দাদা ছাড়তে দেয়নি। বলেছে, ও পুরুষমানুষ, ভবিষ্যতে আবার দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু তুই মেয়ে, তোর নামে কোম্পানি, ও কেউ না। এবং আইনমাফিক ম্যানেজারের চাকরি থেকে সীতা মনোরম ব্যানার্জিকে বরখাস্ত করে। তারপর থেকে দাদাই কোম্পানি দেখে, চালায়। লকারে টাকা, সোনা, যাদবপুরে সেন্ট্রাল রোড-এ জমি, সব নিয়ে সীতার কোনও ভাবনা নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, এভাবে মনোরমকে নিংড়ে না নিলেও হত।

বাইরে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির শব্দ হতে থাকে। আধোঘুমে সীতা শুনতে পায়, ফাঁকা ঘরে দুই ক্লান্ত খেলোয়াড়ের একটানা টেবিল টেনিস খেলার শব্দ। টিকটক…টিক-টক…টিক-টক…

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়