০৩.

আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ব।

আমি উল্টে রেখেছি বই, আলো নিবিয়ে দিয়েছি। এখন আর কাউকেই আমার কিছু বলার নেই। আমার মাথার নীচে একটিমাত্র শক্ত বালিশ, বিছানাটা একটু স্যাঁতসেঁতে, বেডকভারটা ময়লা। তা হোক, তাতে কিছু এসে যায় না। আমি এই একটু ভেজা ভেজা বিছানায়, ময়লা চাদরে ঠিক ঘুমিয়ে পড়ব।

শুভরাত্রি হে আমার টেবিল ল্যাম্প। হাতঘড়ি, বিদায়। বিদায় সিগারেট। কাল আবার দেখা হবে। বিদায়, জেমস বন্ড। কাল আবার দেখা হবে সমুদ্রের তীরে, বিকিনি-পরা ওই মেয়েটি কী যেন নাম তার পাশে। শুভরাত্রি হে আমার দেয়ালের ক্যালেন্ডারের ছবি। শুভরাত্রি হে আমার জানলার পাশে বকুল গাছ। রাত্রির আকাশ, বিদায়। আমি মনোরম, তোমাদের মনোরম। এক্ষুনি ঘুমিয়ে পদ্ধ। না, ভুল…ভুল বললাম; ঘুমের আগে এই যে একটু সময়–যখন সমস্ত শরীরে রিমঝিম করে নেমে আসছে চেতনাহীনতা, যখন শ্রাবণ জুড়ে কেবল ঝিঁঝি পোকার ডাক–তখন এই সময়টুকুতে আমি আর মনোরমনই, তখন আমি এক শিশু ছেলে, যার ডাকনাম ছিল ঝুমু। মা আর বাবার সেই ছোট্ট কুমু! বারো মাস অসুখে ভুগে যার রক্তহীন, সাদা, রোগা ডিগডিগে চেহারা। ডান হাতে মাদুলি, গলায় কবচ। এখন

আমি সেই ছোট্ট কুমু-একটু নির্বোধ, আর একটু অসহায়!..কেউ কিছু বলছ? না, আমার আর কিছুই দরকার হবে না। মানুষ ঠিক ঘুমিয়ে পড়ে। ওই তো ঘুম আসছে ডাকপিওনের মতো। সে আমাদের গলির মুখের ল্যাম্পপোস্ট পার হয়ে এল। হাইড্রাস্টের জল উপচে রাস্তা বুঝি একাকার! সে বেড়ালের মতো লাফ দিয়ে জলময় জায়গাটুকু পার হয়। এখন সে সদরে, রাস্তার মৃদু আলো ঠিক জ্যোৎস্নার মতো পড়ল তার অস্পষ্ট মুখে। শেষ হওয়া সিগারেটের অংশটুকু ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। উঠে আসছে নিঃশব্দে। দরজার বাইরে পাপোষে সে তার জুতোয় লেগে থাকা অন্ধকারের কণাগুলি মুছে নিচ্ছে। হাঁসের মতো গা ঝাড়া দিয়ে সেশরীর থেকে জলকণার মতো ঝেড়ে ফেলছে অন্ধকার। এখন সে ঘরের মধ্যে। বজি উলটে ঘড়ি দেখে সে বলল–ভাবনাচিন্তা করার সময় আর অল্পই আছে।

জানি, আমি তা জানি। আমার জানলার পাশে বকুলের ডালপালায় খেলছে বাতাস। কোন দূরের রাস্তায় নতুন করে চলে যাচ্ছে একজন একা রিকশাওয়ালা। কোথায় যেন ট্যাক্সির মিটার জলতরঙ্গের মতো টুংটাং ঘুরে গেল। বালিশের নীচে টিক টিক শব্দ করছে আমার হাতঘড়ি। বিদায় হে রাতের শব্দরা। হে কোমল অন্ধকার, শুভরাত্রি। শুভরাত্রি হে আমার জানালার আলো। শুভরাত্রি হে দেয়ালের অচেনা ছায়ারা। বিদায় হাতঘড়ি, বিদায় ক্যালেন্ডারের ছবি, বিদায় শেষ সিগারেট। স্বপ্ন ও বাস্তবের মতে দিনশেষে এখন আমি ঘুমিয়ে পড়ব। আসছে ঘুমের অন্ধকার তরঙ্গেরা। একের পর এক। বিদায় হে চিশতি। বিদায় বাস্তবতা। শুভরাত্রি হে স্বাবলম্বন। ওই আমার ঘুম, তার দীর্ঘ আঙুল বাড়িয়ে দিল আমার ভিতরে। সে বোতাম টিপে দিতে থাকে একে একে। আর আমার শরীরের ভিতরে যে অন্ধকার সেইখানেনীল লাল স্বপ্নের মৃদু আলোগুলি জ্বলে ওঠে। সেই আলোতে দেখা যায়, এক জনশূন্য বিশাল প্রেক্ষাগৃহ তার দেয়ালে দেয়ালে ফ্রেস্কোতে আঁকা আমার শৈশবের ছবি। পর্দার ওপাশে মঞ্চে কারা যেন আদাব টানাটানি করে দৃশ্যপট সাজাচ্ছে। পর্দা অকস্মাৎ সরে যায়। দেখা যায়, ঘাটের পৈঠার মত দীর্ঘ টানা কয়েকটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়িতে শ-তিনেক ছেলে দাঁড়িয়ে–গাইছে–জয় জগদীশ হরে…

বাইরে কি বৃষ্টি? বৃষ্টিই। ঝড়ের বাতাস দিচ্ছে। পাশ ফিরে শুল মনোরম। তার এলানো হাত পড়ে আছে বিছানায়। বিস্তৃত হাতখানা যতদূর যায় কিছুই স্পর্শ করে না। কেউ নেই। একটু ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে বিছানায় পড়ে আছে নিরুপায় হাতখানা। বাইরে ঝড়। কী অঝোর বৃষ্টি! মনোরম সেই বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল না। সে তখন তার শৈশবের স্বপ্ন দেখছিল।

কয়েকদিন বাদে মামার সঙ্গে কানোরিয়াদের বাড়িতে গিয়েছিল মনোরম। সেখানে কাঠের কাজ হচ্ছে। মনোরম কাঠ চেনে না, প্রতি সি এফটি কোনটার কত দাম তা জানে না। আসলে কাঠের ব্যবসায় তার মন নেই। এক একটা ব্যবসা আছে যার নো-হাউ জানতে বিস্তর সময় লেগে যায়। কাঠ হচ্ছে সেই ব্যবসা। পুরাতন বাড়ি ভাঙা হইতেছে–খবরের কাগজে এরকম বিজ্ঞাপন দেখলেই মামা সেখানে মনোরমকে নিয়ে যায়। কড়ি বরগা দেখেই ধরে ফেলে কোনটা কী কাঠ। সত্তর, আশি, কি একশো, দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ির অভাব নেই কলকাতায়। বিস্তর জমি নিয়ে হাতির মতো পড়ে আছে। বড় বড় ব র পুরনো আমলের। দু-তিন তলা সব বাড়ি, এখনকার দশতলার কাছাকাছি উঁচু। সে সব ভেঙে ন ধরনের মাল্টিস্টোরিড বাড়ি উঠছে, অফিস আর ব্যাঙ্ককে ভাড়া দেওয়ার জন্য। আটটা-দশটা ফ্লোর, নতুন ধরনের ঘ গ্যাজেটস, অ্যামেনিটিস। তাই পুরনো বাড়ি আর থাকছে না কলকাতায়। পুরনো বাড়ি, বিশেষ করে সাহেববাড়ি হলে তার কাঠ হবে আসল বার্মা-টিক, বাজারে পাওয়া যায় না। সত্তর থেকে দেড়শো বছরের কাঠ, রস মরে ঝুন হয়ে গেছে। চেরাইয়ের পর পালিশ করলে রঙিন কাঁচের মতো দেখায়। মামা বিস্তর নিলাম ডেকে গোল ভর্তি করেছে সেই দুর্লভ কাঠে। কাজেই বড়লোকদের বাড়ির কাজ হেসে-খেলে পায় মামা।

ওল্ড বালিগঞ্জে একটা নির্জন রাস্তায় বাড়ি। এখনও বাড়িটা শেষ হয়নি। কানোরিয়ারা বড়লোক সে তো জানা কথা। কিন্তু কতটা তা ঠিক জানা ছিল না মনোরমের। বাড়িটা দেখে তাক লেগে গেল। বেশি বড় নয়, বড়জোর পাঁচ সোয়া পাঁচ কাঠা জুড়ে একটা কংক্রিটের স্বপ্ন। সামনে একটা লন, একধারে টেনিস কোর্ট, সেটা পেরোলে থামহীন একটা গাড়ি বারান্দা-একটা বৃত্তাকার প্রকাণ্ড সিমেন্টের চাকতি শূন্যে ঝুলে আছে। বৈঠকখানার কোনও দরজাই যেন নেই, এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল পর্যন্ত চওড়া-চওড়ি হাঁ হয়ে আছে। দরজা নেই নয়। আছে। সে দরজা দেয়ালের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। চারিদিকে কাঁচ আর কাঁচ। ঘরের একদিকে মেঝেয় একটা মস্ত চৌবাচ্চার মতো ডিপ্রেশন। সেখানে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে। সেই জায়গাটায় নিখুঁত মাপে ভারী ‘কোজি’ সোফাসেট তৈরি করে বসানো হচ্ছে। ভেতরের দিকে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি একটা প্যাঁচ খাওয়া ঢাল হয়ে উঠে গেছে, সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ আলাদা আলাদা কংক্রিটের স্ল্যাব, জাবদা সিঁড়ি নয়। তিনতলা বাড়ির জন্য বানো হচ্ছে লিফট। ডানদিকে ঘুরে আরও একটু ভেতরে এগোলে দেখা যায়, ঘরের মধ্যেই ছোট্ট একটা মিনিয়েচার দীঘি–লিলিপুল। তার ওপরে একটা খেলাঘরের ব্রিজের মতো চমৎকার ব্রিজ। লিলিপুল-এর উপরে ছাদটা কাঁচের, প্রাকৃতিক আলো আসবার জন্য।

দেখাশুনো করছেন এক মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ার, তার পরনে সাদা লুঙ্গির মতো কাপড়, সাদা জামা, কপালে তিলক, পায়ে চটি। গম্ভীর এবং শান্ত মানুষ। মুখে কথা প্রায় নেইই। মামার হেডমিস্ত্রি আজ কাজে আসেনি, তার জন্য মামা তাকে বিস্তর কৈফিয়ত দিচ্ছিল এখনও জলশূন্য লিলিপুলের ধারে দাঁড়িয়ে। ইঞ্জিনিয়ার লোকটা হাতে ব্লু-প্রিন্ট দেখেছে, সামান্য কোঁচকানো, উত্তর দিচ্ছে না। উত্তর পেতে মামার সময় লাগবে বিবেচনা করে মনোরম উঠে এল উপরে, চমৎকার সিঁড়িটা বেয়ে। কোনটা ঘর, কোনটা প্যাসেজ, কোনটা বারান্দা কিছু বোঝা যায় না। সবটাই নিস্তব্ধ স্বপ্নদৃশ্যের মতো। এমনকী কত টাকা খরচ হচ্ছে বাড়িটায়, তারও কোনও হিসেব পায় না সে। চার-পাঁচ লাখ হতে পারে, বিশ-ত্রিশ লাখও হওয়া সম্ভব। আরও বেশি হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। এখনও সর্বত্র মেঝেয় মার্বেল ঘষা হয়নি, দেয়ালে পলেস্তারা পড়েনি। কোণের দুটো ঘর শেষ হয়েছে, সেখানে মিস্ত্রিরা কাঠের আসবাব বানাচ্ছে। মাঝারি বড়লোকেরা, বড় জোর প্রবর্তক বা আমার থেকে আসবাব কিনে আনে। এরা বাজারি আসবাব কেনে না। ঘরের মাপজোক আর ডিজাইন অনুযায়ী আসবাব তৈরি করিয়ে নেয়। মামা মোটে তিনটে শোওয়ার ঘর আর দরজা জানলার খানিকটা কন্ট্রাক্ট পেয়েছে। সেটাও বোধহয় বিশ-ত্রিশ হাজার টাকার।

মনোরমকে দেখে মিস্ত্রিরা কাজ থেকে চোখ তুলে তাকাল। তাদের চোখে ভয়।

 রাধু বলল কী হবে বাবু, হেডমিস্ত্রি আজ এল না।

মনোরম বাড়িটায় ঘুরে সব দেখে কেমন একরকমের হয়ে গিয়েছিল। একটা ছোট্ট জায়গায় এত টাকার কারবার দেখে মাথাটা গরম। একটু ঝেঝে বলল–তাতে কী? তোমরা কাজ জানো না!

জানি তো, কিন্তু সকালে আজ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব খুব রাগ করেছে। ভয়ে আমাদের হাত চলছে না। যদি এদিক ওদিক হয়ে যায়।

মনোরম কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বেরিয়ে এল। তিনতলায় উঠল ধীরে ধীরে। অনেক মানুষ খাটছে। কেউ বিড়ি খাচ্ছে না, গল্প করছে না। সব চুপচাপ। চারিদিকে একটা সম্ভ্রম আর ভয়-ভয় ভাব। রাজমিস্ত্রিরা কাজ করতে করতে চোরা-চোখে তাকে দেখল, যেন একটু বেশি মন দিয়ে কাজ করতে লাগল। বাড়ির মালিক কে তারা জানে না। মনোরমের পরনে স্ট্রাইপওলা বেলবটস, গুরু পাঞ্জাবি, চোখে রোদচশমা ইস্পাতের ফ্রেমে। মিস্ত্রিরা বুঝতে পারছেনা, এই লোকটা মালিকপক্ষের কেউ কিনা। মনোরম খানিকটা মালিকপক্ষের মতোই অবহেলার ভঙ্গিতে একটু ঘুরে দেখল চারদিক। এ তলায় ঘর বেশি নেই, যা আছে তার চারটে দেয়ালই ঘষা কাঁচের, মস্ত একটা রুফ গার্ডেনের প্রস্তুতি চলছে।

লিফট এখনও বসানো হয়নি। কুয়োর মতো গহরটা নেমে গেছে। চতুষ্কোণ, একটু অন্ধকার। দরজা নেই। মনোরম ফাঁকা জায়গাটায় মুখ বাড়িয়ে নীচে তাকাল। হাত-পা শিরশির করে উঠল তার। ভার্টিগো। এক পা পিছিয়ে এল। দেয়াল ধরে দাঁড়াল একটু। জিভটা নড়ছে মুখের ভিতরে। শরীরে একটা সংকোচন। একটা দুর্ঘটনার স্মৃতি কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকার করে দিল মাথা।

মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে তাকাল। কাঁচের ঘর এবং ছাদের বাগানের সুন্দর বিস্তারটি দেখল। মানুষ কত বড়লোক হয়। তিনতলা বাড়ির জন্য লিফট লাগায়, ছাদে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাগান তৈরি করে, ঘরের মধ্যে বানায় পদ্মসরোবর। ছোকরারা কেন বিপ্লবের কথা শহরের দেওয়াল জুড়ে লেখে, তার একটা অর্থ যেন খুঁয়ে পায় সে। ডিনামাইট সহজপ্রাপ্য হলে সেও একটা কিছু এক্ষুনি করত। পকেট হাতড়ে সে বের করল সস্তা সিগারেটের প্যাকেট। সীতা চলে যাওয়ার পর তার বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে এ পর্যন্ত মোট পাঁচ মাসের। দুশো কুড়ি টাকার দুঘরের ফ্ল্যাট পূর্ণ দাস রোডে। পুরনো বাড়িওলা একটা আশ্রমকে বাড়িটা দান করেছে। আশ্রমের লোকেরা দুদে বাড়িওলা নয়, তার ওপর ধর্মকর্ম করে, তাই ঠিক ঘাড়ে ধাক্কা দিচ্ছে না। কিন্তু গেরুয়াপরা সন্ন্যাসীরা প্রায়ই আসে আজকাল, দেখা করে যায়, মিষ্টি হেসে তার আর্থিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে। মনোরম তাদের ধর্মকথায় টেনে নিয়ে যায়। তারা অস্বস্তি বোধ করে।

পরিপূর্ণ ফুসফুসে সিগারেটের ধোঁয়া ভরে নিল মনোরম। মাথাটা ঝিম করে ওঠে। সমস্ত শরীর একটা রহস্যময় আনন্দে ভরে যায়। আকাশ টেরিলিনের মতো মসৃণ এবং নীল। শুধু এক কোণে ময়লা। রুমালের মতো একখণ্ড বেমানান মেঘ। রুফ গার্ডেনের রেলিঙে হাত রেখে মনোরম একটু দাঁড়িয়ে থাকে। দমকা বাতাসে দ্রুত পুড়ে যাচ্ছে সিগারেট। সে একটু শ্বাস ফেলে নেমে এল।

অনেকক্ষণ চেষ্টায় মামা মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ারটিকে কেবল মাথা নাড়ানোয় সফল হয়েছে। কথা ফোটেনি। দূর থেকে দৃশ্যটা দেখল মনোরম, লিফটের কুয়োর মধ্যে ছুঁড়ে দিল সিগারেট। এগোল।

–মাই নেফিউ। পরিচয় দিল মামা।

মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ার এক ঝলক তাকাল মাত্র, রিকগনাইজ করল না।

–টুমরো দি হেডমিস্ত্রি উইল ডেফিনিটলি কাম। ময়মনসিংহের অ্যাকসেন্টে ইংরেজিটা বলল মামা।

ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক একটু ভ্রূ কোঁচকাল মাত্র।

–অলরাইট? মামা জিজ্ঞেস করে।

 ভদ্রলোক হাতের প্ল্যানটার দিকে নীরবে তাকিয়ে একটা শ্বাস ছাড়ল।

 মামা রুমালে ঘাম মুছে মনোরমের দিকে তাকাল। মনোরম মামার মুখ দেখে বুঝতে পারে, এতক্ষণ মামার খুব খাটুনি গেছে।

লন ঘেষে মামার দিশি গাড়িটা দাঁড় করানো। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘন নীল রঙের জাপানি ক্রাউন গাড়ি, তার নীলাভ কাঁচের ভেতর দিয়ে ভেতরে চমৎকার মেয়ে শরীরের মতো নরম গদি দেখা যাচ্ছে। কী অ্যারিস্টোক্র্যাট তার ড্যাশবোর্ড আর হুইল। এয়ারকন্ডিশনড। মনোরম ঝুঁকে গাড়িটা একটু দেখল। ভারী পছন্দ হয়ে গেল তার।

মামা তার গাড়ির লক খুলতে খুলতে বলে-সাড়ে চারজন মানুষের জন্য এত ব্যাপার-স্যাপার।

কারা সাড়ে চারজন?

কানোরিয়ারা। বুড়োবুড়ি, ছেলে আর ছেলের বউ। আর বোধহয় একটা বাচ্চা।

–মোটে?

–তাও ছেলে আর ছেলের বউ চোদ্দোবার বিজনেস টুর আর হানিমুন করতে ইউরোপ আমেরিকা যাচ্ছে, বুড়োবুড়ির তীর্থ করাই বাই। থাকবেটা কে গুচ্ছের চাকরবাকর ছাড়া? ঝুমু, মাদ্ৰাজিরা কেমন লোক হয়?

–ভালই। জেন্টল।

–আমিও তো তাই জানি। কিন্তু এ লোকটাকে ঠিক বোঝা যায় না। বিশ মিনিট ধরে বোঝালাম, কিছু বুঝেছে কিনা কে জানে। তোকে নিয়েই হয়েছে আমার মুশকিল, ইংরিজিটা ভালই বলিস, কিন্তু বিজনেসটা একদম বুঝিস না। তোকে দিয়ে যে আমার কী লাভ হবে। ভেবেছিলাম, ইংরিজিটা তোকে দিয়ে বলিয়ে যদি ইমপ্রেস করা যায়, কিন্তু তুই বলবি কি? শুধু ইংরিজিতে কি কিছু হয়? একটু যদি বুঝতিস।

দিশি গাড়িটা চলছে। ক্রাউন গাড়িটার ছায়া এখনও মনোরমের চোখে ভাসে। দিশি গাড়িটায় বসে তার মনে হয় সে একটা ইঞ্জিন লাগানো মুড়ির টিনের মধ্যে বসে আছে।

মামার চেহারাটা লম্বা, সুভুঙ্গে, মাথা প্রায় গাড়ির ছাদে গিয়ে ঠেকেছে। একটু কুঁজো হয়ে বসে স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে। রোগা বলে গায়ের হাওয়াই শার্ট লটর পটর করে। প্যান্টে পাছার দিকটা টান হয় না মাংসের অভাবে। বছরখানেক আগে প্রথম স্ট্রোক হয়ে গেছে। এখন আর একা বেরোতে সাহস পায় না, মনোরমকে সঙ্গে নেয়।

কানোরিয়াদের নির্মীয়মাণ বাড়িটার কথা ভাবতে ভাবতে মনোরম হঠাৎ বলল-ওরা খুব বড়লোক।

কারা?

কানোরিয়ারা।

মামা মন দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে একটা গম্ভীর হু দিল।

তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ।

 হঠাৎ মামা তিক্ত গলায় বলে বাঙালির ছেলে যে কবে ব্যবসা শিখবে।

 মনোরম হাই তোলে। প্রসঙ্গটা আসছে।

–কিছুই তো পারলি না। এজেন্সি পেয়েছিলি, তা সে পরের তৈরি মাল বেচে কমিশন পেতিস। কাঠের কারবার তো তা নয়, এ হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাষ্ট্রি। কিন্তু তুই শিখছিস কোথায়?

শিখছি তো। সময় লাগবে।

-নন-বেঙ্গলিরা কলকাতায় ওইসব বাড়ি হাঁকড়াচ্ছে, গাড়ি দাবড়াচ্ছে। আর তোদের কেবল আলোচনা গবেষণা আর মেয়েছেলেদের মতো ছিচকাঁদুনে সেন্টিমেন্ট।

নেতাজি এলে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। বাঙালি জাগবে।

 কথাটা মামার প্রাণের কথা। কিন্তু মনোরমের মুখে শুনতে ঠিক প্রস্তুত ছিল না বলে, মামা রাস্তা থেকে চোখ টপ করে সরিয়ে একবার মনোরমের মুখ দেখে নেয়। ঠাট্টা কিনা তা বুঝতে চেষ্টা করে।

ঝুমু।

মনোরম মুখখানা স্বাভাবিক রেখেই বলে-উ!

–অবিশ্বাসের কী? বিনা প্রমাণে তো এতগুলো লোক ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না!

–কিন্তু কোনজন? শৌলমারির সন্ন্যাসী, না শোপবন্ধুনগরে যাকে দেখা গিয়েছিল সেই সাধু, নাকি রাশিয়াতে চিনা ডেলিগেটদের ছবিতে যে লোকটার আইডেন্টিফিকেশন নিয়ে কথা উঠেছিল, কিংবা নেহরুর অন্তিমশয্যার পাশে যাকে দেখা গিয়েছিল। কোনজন, সেইটেই প্রবলেম।

যে-ই হোক, তিনি আছেন। মামা একটু অধৈর্যের গলায় বলে। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলে–আর তিনি আছেন সন্ন্যাস নিয়ে।

–কী করে বুঝলে।

বার্মায় তখন তিনি খুব ব্যস্ত, সেই ব্যস্ততার মধ্যে তাঁর এক সঙ্গী তাঁর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে এক মন্দিরে নিয়ে যায়। মন্দিরে গিয়েই তিনি কাঁদতে থাকেন, তারপর মাটিতে গড়াগড়ি দিতে থাকেন, সঙ্গীকে তিনি পরে বলেছিলেন–জানোনা, মন্দির-উন্দির এখন আর আমি যাই না। হাতে অনেক কাজ, মন্দিরে গেলে আমার কাজ পড়ে থাকবে। কিছুই করতে পারব না। কাজ শেষ হোক, তারপর আমি তো সন্ন্যাস নেবই। সন্ন্যাস তাঁর রক্তে ছিল। আমার কাছে যে বই আর পত্রিকাগুলো আছে তা পড়ে দেখিস, প্রতি সপ্তাহে আমাদের একটা মিট হয়, যেতে পারিস।

–আমি অবিশ্বাস করছি না।

–তোমরা জাত-অবিশ্বাসী। তোমাদের জেনারেশন। অবিশ্বাসী বলেই তোমরা কোনও রিলেশন এস্টাব্লিশ করতে পার না। যে বয়সে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রবল ভালবাসা থাকার কথা, সে বয়সে তোমাদের বিয়ে ভেঙে যায়। দেশপ্রেম তোমাদের কাছে হাসিঠাট্টার ব্যাপার; ট্র্যাডিশন, মরালিটি এ সব তোমরা ভেবেও দেখ না। ডিসগাটিং।

মনোরম চুপ করেছিল।

একটা সিগারেটের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল মামা। মনোরমের দিকে একটা দশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলল–এক প্যাকেট গোডকে নিয়ে আয়।

–তোমার না সিগারেট বারণ?

–গোন্ডফ্লেক বারণ নয়। যা। তুই আমাকে অ্যাজিটেট করেছিস।

 মনোরম সিগারেট কিনে এনে দেখে মামা.ড্রাইভিং সিট থেকে সরে বসেছে। মাথা এলানো, চোখ বোজা। সিগারেট প্যাকেট আর খুচরো টাকা-পয়সা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল তুই চালা। আমার নার্ভ ঠিক নেই।

মনোরম ক্ষীণ একটু হেসে ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলে–কেন?

মামা তেমনি ঘাড় এলিয়ে চোখ বুজে সিগারেট খেল কিছুক্ষণ। আস্তে করে বলল–যা বুঝিস না তা নিয়ে কখনও ঠাট্টা করিস না।

মনোরম গাড়িটা চালাতে চালাতে বলে-মামা, যদি কেউ আসেই কোথাও থেকে, তবে সে এখনও আসছে না কেন? আমরা তো ঘোর বিপন্ন! যে-ই আসুক তার আসতে আর দেরি করা উচিত নয়।

-আসবে দেখিস। একদিন ভারতবর্ষ শাসন করবে সন্ন্যাসীরা।

মনোরম ভিতরে হাসল। বাইরে মুখখানা স্বাভাবিক।

 মামা আবার বলে বাঙালি বাঙালি করি, কারণ গত সাতাশ বছর কলকাতায় থেকে আমি কখনও এ শহরটাকে বাঙালির শহর বলে ভাবতে পারি না। এ শহরটায় কয়েকটা বাঙালি পকেট আছে মাত্র। যে সব জায়গায় ক্যাপিটাল আর বিজনেসের খেলা, সেখানে তারা কোথায়? ভাল বাড়ি, ভাল গাড়ি, ভাল ইন্ডাষ্ট্রি, তাদের কটা? এ সব তো নেই-ই, তার ওপর নেই আদর্শবোধ। খাওয়া-পরার ধান্ধায় ঘোর ক্ষতি নেই, তার সঙ্গে সমাজ সংসার নিয়ে একটু ভাববি তো! তুই কোন ভাষায় কথা বলিস, কোন দেশে বসত করিস, এগুলো নিয়ে ভাববি না? আমি তো জানি প্রতিটি মানুষ তার নিজের, পরিবারের, দেশের এবং দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী।

মনোরম চুপ করে থাকে। মামার বাঙালিপ্রেমটা পরিচিত মহলে বেশ বিখ্যাত ব্যাপার। দার্জিলিং যাওয়ার সময়ে একবার মামা স্টিমার পেরিয়ে মনিহারিঘাটে ট্রেনে উঠবার সময়ে পুরো একটা কম্পার্টমেন্টে কেবল বাঙালি বোঝাই করেছিল। ওই রোগা চেহারা, কিন্তু অসামান্য তেজ। দরজা জুড়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে মূর্তিমান দাঁড়িয়ে পথ আটকে ছিল মামা। কেউ উঠতে গেলেই প্রশ্ন–আপনি বাঙালি? ‘না’ বললে হটো, ‘হ্যাঁ’ বললে ওঠো। মনোরমের মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় যে, সে যে মামার কাঠগোলায় কাজ পেয়েছে, তা ভাগ্নে বলে ততটা নয়, যতটা বাঙালি বলে।

–তোর কত টাকা বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে বলছিলি? মামা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে।

–পাঁচ মাস।

তাতে কত দাঁড়াচ্ছে?

—-দুশো কুড়ি টাকা মাসে।

-এগারো শো?

–ও-রকম। তবে আপাতত অর্ধেকটা দিয়ে দিলে একটা আপস করে নেওয়া যায়।

–তা তুই ওখানে আছিস কেন এখনও? আমার বাড়িতে নীচের তলায় অনেকগুলো ঘর ফাঁকা।

 –কেন, ফাঁকা কেন? বাঙালি ভাড়াটে পাচ্ছ না?

–তা নয়। আগের ভাড়াটেরা এমনই গোলমাল ঝগড়াঝাঁটি পাকিয়েছিল যে সেই থেকে তোর মামির হার্ট খারাপ। ভাড়াটে বসাব না। প্রেস্টিজে না লাগলে চলে আয়।

–দেখি।

–দেখি কী? ভারী মালপত্রগুলো বেচে দে। একটা চৌকি আর দু-চারটে বাক্স হলেই তো তোর ঢের। একা মানুষ। আবার যদি কখনও সংসার-উংসার করিস তো সে তখন দেখা যাবে।

মনোরম উত্তর দেয় না।

কী হে? ইচ্ছে নেই? তোর মামি একটু কচালে মানুষ বটে, কিন্তু তোক খারাপ নয়। বড় জোর তোর বউয়ের ব্যাপারে দু-চারটে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করবে। তার বেশি কিছু না। একটা ঘরে পড়ে থাকবি নীচের তলায়, কেউ ডিসটার্ব করবে না। ছেলেটা তো মানুষ না, মডার্ন বাঙালি। পোশাক বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাবা মরলে গদিতে বসবে। মাথায় কোনও আদর্শ-ফাঁদর্শ নেই। খেলে বেড়ায়, জলসায় সিনেমায় যায়। তুই থাকলে তবু…

মামা চুপ করে কী একটু ভাবে। বলে–প্রেস্টিজে লাগলে গোলায় থাকতে পারিস। অফিস ঘরখানায় একজন অনায়াসে থাকতে পারে। অবাঙালিরা কত কষ্ট করে কলকাতায় থাকে। এক পশ্চিমা পানওয়ালাকে দেখেছিলাম, হ্যারিসন রোডে মোট বারো ইঞ্চি ডেপথের একটা খোঁদল ভাড়া নিতে পেরেছিল। দেয়ালের গায়ে সেই খোঁদলে কাঠফাট লাগিয়ে ওপরে দোকান, নীচে গেরস্থালি। রাতে ফুটপাথে রান্না করে খেত, শোয়ার সময়ে সেই বারো ইঞ্চি জায়গায় কাত হয়ে শুয়ে সামনে কাঠের তক্তা লাগিয়ে নিত পড়ে যাওয়ার ভয়ে। ওই ভাবে দোতলা বাড়ি করেছিল। তো তুই কেন একা মানুষ দু’ ঘরের অত ভাড়ার ফ্লাটে খামোখা থাকবি? টাকা নষ্ট। অন্য কারণেও ওই বাড়ি তোর ছাড়া উচিত।

-কেন?

–ওখানে থাকলেই পুরনো কথা মনে পড়বে, আর হা-হুঁতাশ করবি। বউমার কোনও খবর পাস?

না।

মামা একটা শ্বাস ফেলে বলে-বউ নিয়ে ভাবতে হবে, এ আমরা কখনও কল্পনাও করিনি। আমাদের ধারণা ছিল, বিয়ে হলেই বউ আত্মীয় হয়ে গেল, এক মরা ছাড়া আর কোনও ছাড়ান কাটান নেই। গায়ের চামড়ার মতো হয়ে গেল। পাত কুড়িয়ে খায়, হামলে পড়ে সংসার করে, উঙ্গে ঝগড়া করে, আবার মায়ের মতো ভালবাসে। বউ চলে যাবে, এ আবার কী কথা রে বাঙালির বাচ্চা?

দু-চার জায়গায় ঘুরে কাঠগোলায় ফিরতে বেলা গড়িয়ে গেল। মামার ছেলে বীরু বসে আছে। বাপের মতোই লম্বা তবে অতটা সুভুঙ্গে রোগা নয়। খেলাধুলো করে বলে ফিট চেহারা। মায়াদয়াহীন মুখ। মুখে হাসি নেই। গরম বলে জামা খুলে স্যান্ডো গেঞ্জি, ফুলপ্যান্ট পরে বসে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছে। একমাত্র বংশধর আর গম্ভীর প্রকৃতির বলে মামা ছেলেকে বড্ড ভয় পায়। ছেলেতে বাপেতে বড় একটা কথাবার্তা নেই। বীরুর নিজস্ব একটা ফিয়াট গাড়ি আছে, যেটা নিয়ে মাঝে মাঝে কয়েক দিনের জন্য হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে যায়। সে যাই করুক, ছেলেটির হিসেবি বুদ্ধি প্রখর। আর একটা প্রখর জিনিস হচ্ছে ব্যক্তিত্ব। কর্মচারীরা মামাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা ভক্তি করে, আবার মামার কাজে ফাঁকিও দেয়, চেয়েচিন্তে পাওনার বেশি টাকা আদায়ও করে। আর বীরুকে পায় ভয়।

মনোরমকে কী চোখে বীরু দেখে তা কে জানে! মনোরম তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। মনোরম যে বেশিদিন মামার কাঠগোলায় আড়াইশো টাকায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারি করবে না, এটা বীরু বোধহয় জানে। কাজেই সে মনোরমের প্রতি মনোযোগ দেয় না। কথাবার্তা হয়ই না বলতে গেলে। তারা যে মামাতো পিসতুতো ভাই, এ সম্পর্কটা বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই।

সামনের চালাঘরটাই আসলে অফিস। বুড়ো মানুষ ভূপতিচরণ ক্যাশ আগলে বসে থাকে। সামনে পিছনে কাঠ আর কাঠ। দাঁড় করানো, শোয়ানো তক্তা, বিম, টুকরো-টাকরা কাঠের দুর্ভেদ্য জঙ্গল। চালা পেরিয়ে অফিসঘর। নামে মাত্র অফিসঘর, ওটা আসলে মামার জিরোবার জায়গা। ওপরে টিন, কাঠের বেড়া। একটা মজবুত চওড়া বেঞ্চ, তাতে ডানলোপিলোর গদি পাতা, তোয়ালেস্টাকা বালিশ। প্রথম স্ট্রোকের পর এ সব ব্যবস্থা হয়েছে। পিছনে করাতকল থেকে ঘষটানো আওয়াজ আসছে। মিহিন, মিষ্টি শব্দটা মনোরমের বড় ভাল লাগে। ঘুম পেয়ে যায়!

মামা ভূপতিচরণের দিকে একবার তাকায়, ভূপতিচরণ হতাশার ভঙ্গিতে মাথাটা হেলায়। ইঙ্গিতটা মনোরম বুঝে গেছে আজকাল। তার মানে বীরু ক্যাশ থেকে আজও টাকা নিয়েছে। মামা ভিতরের ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে একবার মুখ ফিরিয়ে বলে-ঝুমু, তুই একটু ক্যাশ-এ বোস। ভূপতির সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে।

মনোরমকে ক্যাশ বুঝিয়ে দিয়ে ভূপতিচরণ উঠে গেল। মনোরম বসল। মুখোমুখি বীরু। কুঁচকে ফ্ল্যাট ফাইল খুলে কাগজপত্র দেখছে। একটা চূড়ান্ত অগ্রাহ্যের ভাব তার ভঙ্গিতে। চোখ তুলে তাকাল না। ভিতরের ঘরে এখন বীরুকে নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছে মামার আর ভূপতিচরণের মধ্যে। বীরু বোধ হয় সেটা জানে। কাগজ দেখতে দেখতেই তার মুখে একটা তাচ্ছিল্যের মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সেই ও বুঝে গেছে, পৃথিবীটা ওর একার।

কপাল। মামার ছেলেটা এ রকম না হলে মনোরম চাকরিটা পেত না। সীতা, চলে যাওয়ার পর তখনই একটা চাকরি না হলে মনোরমের চলছিল না। ল্যাং ল্যাং করে সারা কলকাতা ঘুরে বেড়াচ্ছিল মনোরম। সেই সময়ে একদিন গ্র্যান্ড হোটেলের উল্টোদিকে পার্ক করা গাড়িগুলো আস্তে, ধীরে হেঁটে হেঁটে দেখছিল সে। গাড়ি দেখা তার একটা পাস্টাইম। জেফির, অষ্টিন, কেমব্রিজ, হিলম্যান, প্যাকার্ড কত গাড়ি! দেখে দেখে ফুরোয় না। দেখতে দেখতে প্রতিটি মেকারের গাড়ি তার চেনা হয়ে গেছে। যে কোনও ছুটন্ত গাড়ি দূর থেকেই দেখে সে বলে দিতে পারে কোন মেকারের। নতুন কোনও গাড়ি কলকাতায় এসেছে কিনা তা দেখার জন্যই সে পার্কিং লট-এ ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ঠিক সে সময়ে একটা ভোঁতা মুখ, বৈশিষ্ট্যহীন দিশি গাড়ির ভিতর থেকে মামা ডাকল-ঝুমু।

চাকরি হয়ে গেল। আত্মীয়তা ঝরে গিয়েছিল অনেক আগেই। মা মারা গেছে বছর পনেরো, তারপর থেকে আর তেমন দেখাশুনা ছিল না। বড়লোক মামাকে এড়িয়েই চলত মনোরম বরাবর। কাজেই মামা যখন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াল এক ছুটির দুপুরে, তারপর বলল–আমার কারখানায় ঢুকে পড়। কাজটাজ শেখ! তখনই মনোরম বুঝে গিয়েছিল, এটা চাকরিই। মামা বস। তার আপত্তির কিছু ছিল না। ক’দিনের মধ্যেই সে বুঝে গিয়েছিল যে, সে আসলে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার-ট্যানেজার কিছু নয়। সর্বসাকুল্যে জনা ত্রিশেক মিস্তিরি, একজন ক্যাশিয়ার আর একজন ম্যানেজার নিয়ে কাঠের কারবার। কোম্পানি মামির নামে, ম্যানেজার মামা। আর কোনও স্টাফের দরকার হয় না। তবু মনোরমকে অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার করা হয়েছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত প্রথম স্ট্রোকের পর মামা একা ঘোরাঘুরি করতে ভয় পায়। দুনম্বর, মনোরমের চোস্ত ইংরিজি বলা। আর একটা কারণ হল বীরু। মামার একমাত্র সন্তান, একটু বেশি বয়সে হয়েছিল।

মামা প্রায়ই বলে বীরুর সঙ্গে তোর এখনও বন্ধুত্ব হয়নি ঝুমু?

বন্ধুত্ব! একটু অবাক হয়ে মনোরম বলেনা তো! হওয়ার কথাও নয়।

–কেন?

–কী করে হবে? আমার ছত্রিশ, ওর বড় জোর তেইশ। তা ছাড়া…

কী?

 বন্ধুত্বের দরকারই বা কী?

মামা শ্বাস ফেলে বলে-ঝুমু, তুই ওর সঙ্গে একটু কথাটথা বলিস। আমি চাই ওর সঙ্গে তোর বন্ধুত্ব হোক।

–এটাও কি চাকরির মধ্যে?

-তোর বড্ড খোঁচানো কথা। চাকরি আবার কী। মামাতো পিসতুতো ভাই তোরা, ভাবসাব থাকারই তো কথা!

-সব কিছু কি জোর করে হয়? বীরু অন্য ধরনের, আমি অন্য ধরনের।

–ও সব কোনও বাধা নয়। বন্ধুত্ব চাইলেই হয়।

–হয় না মামা।

–তুই তো খুব চালাক চতুর ছিলি বরাবর। তুই ঠিক পারবি।

মনোরম তখনই অবাক হয়েছিল। মামা স্পষ্টই চায় বীরুর সঙ্গে তার মেলামেশা হোক।

আবার একদিন মামা প্রসঙ্গটা তোলে-ঝুমু, তুই যদি আমার ব্যবসাটা বুঝে নিতিস, তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। তুই শিখে নিয়ে ওকেও শেখাতে পারতিস।

কার কথা বলছ?

–ওই হারামজাদা। ওকে আমি কিছু বুঝতে পারি না। কারবারটা আমার জলে যাবে।

বীরুর কথা বলছ? ও খুব চালাক, চিন্তা কোরো না।

 –চিন্তা করব না! বলিস কী?

–ও শিখে নেবে।

–অত সোজা নয় ঝুমু! এত ব্যাপারে ওর ইন্টারেস্ট ছড়ানো যে ও কনসেন্ট্রেট করতেই পারবে না। তাই তোকে বলি, তুই ওর সঙ্গে একটু মেলামেশা কর। ওকে একটু বোঝ। দ্যাখ যদি ফেরাতে পারিস। আলটিমেটলি আমি ম্যানেজারিটা তোকে দেব, বীরু থাকবে প্রপাইটার। তোর মামির সঙ্গে আমার কথা হয়ে আছে।

ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ওকে একটু সময় দাও। বয়স হলে ও ব্যবসায় মন দেবে।

ব্যস্ত হচ্ছি, আমার শরীরকে আমি ভয় পাই। একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে, আবার কখন কী হয়ে যায়। ওর জন্য চিন্তা করে করে আমি আরও শেষ হয়ে যাচ্ছি।

–এত চিন্তার কী?

মাসে দু-তিন হাজার টাকা ওর কীসে লাগে বল তো! কোথায় যায়, কী করে কিছু জানি না। সেইজন্যই চাইছিলাম তুই একটু দ্যাখ। তোর সেন্স অফ রেসপন্সিবিলিটি আছে। বহু লোক দেখেছিস, মিশেছিস। বীরুকে বুঝতে পারবি না?

মনোরম ব্যাপারটা সেই প্রথম গায়ে মাখে। মাসে দু-তিন হাজার টাকা একজন একা খরচ করে! আর সে নিজে ব্যারাট। বীকে তখনই সে মনে মনে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিল।

মাসে থোক হাতখরচ পায়, তার ওপর মামিও কিছু লুকিয়ে দেয়। তবু বীরু এসে ক্যাশ থেকে টাকা নেয়। নির্দ্বিধায় নেয়, কারও কাছে জবাবদিহি করার কথা ভাবেই না। ছেলেটার এই দ্বিধাহীন ব্যবহারেই বোধহয় মামা ওকে ভয় পায়। চোখে চোখ রাখে না।

–নিচ্ছে নিক, টাকাটা তো শেষ পর্যন্ত ওরই। এ কথা একদিন বলেছিল মনোরম মামাকে।

দ্যাখ ঝুমু, টাকা কারও নয়। যে রাখতে পারে তার লক্ষ্মী, যে ওড়ায় তার বালাই। এই বিতিকিচ্ছিরি চেহারার কাঠগোলার পেছনে কত লাখ টাকার কাজ হচ্ছে তা তো তুই বুঝিস। এত টাকা তো এমনি এমনি হয়নি। এর পেছনে আমার যেমন পরিশ্রম আছে, তেমনই আদর্শবোধও। বাঙালি ব্যবসা জানে না–এ অপবাদ আমি আমার জীবনে ঘুচিয়েছি। আর ওই হারামজাদা বাঙালি কথাটার অর্থই জানে না, ব্যবসার ব বোঝে না।

-তুমি বলো না ওকে।

বলব। আমি? ও আমাকে বাড়ির চাকরবাকরের বেশি কিছু মনে করে নাকি? আমার পারসোনালিটি নেই, আমি জানি। পারসোনালিটি ব্যাপারটা হচ্ছে স্ট্রং লাইকস অ্যান্ড ডিসলাইকস। আমি কী পছন্দ করি না, কী করি তা ওকে কোনওদিনই বোঝাতে পারিনি। ও যখন ছোট ছিল, তখন থেকেই ওর মুখের দিকে তাকালেই আমি বরাবর আত্মবিস্মৃত হয়েছি। অন্য ক্ষেত্রে আমার যাওবা একটু ব্যক্তিত্ব আছে, ওর কাছে কিছু নেই। আমারই দোষ। কিন্তু এখন কিছু আর করার নেই। যদি তুই কিছু করতে পারিস।

–কী করব?

–আমার ধারণা, ও খুব সেফ লাইফ কাটায় না। ওকে ওয়াচ করা দরকার, গার্ড করাও দরকার। কোনদিন কী বিপদ ঘটাবে।

-কী বিপদ?

কে জানে! আমি কী করে বলব? কিছুই জানি না, বলেছি তো। হঠাৎ তিন-চার দিনের জন্য না বলে উধাও হয়ে যায়। কখনও-সখনও একমাস কোনও খবর পাই না। ভেবে ভেবে আমার একটা অসহ্য আতঙ্ক তৈরি হয়ে গেছে। কেবলই মনে হয়, শিগগিরই হঠাৎ একদিন ওর বদলে ওর ডেডবডি লোকে ধরাধরি করে বয়ে এনে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবে…দুর্গা, দুর্গা…এ সব মনে হয় বলেই আমার স্ট্রোকটা হয়েছিল।

মনোরম বুঝতে পেরেছিল, তার দায়িত্ব বাড়ছে। একটা শ্বাস ফেলে বলল তুমি আমাকে কী করতে বলো?

–তুই ওকে মাঝে মাঝে ফলো কর।

 –ফলো? মাই গু-উ-ডনেস!

কুমু, ওকে ওয়াচ করা দরকার। অন্য উপায় নেই।

–ফলো করে কী করব?

দেখবি ও কী করে। যদি বিপদে পড়ে তো সামলাস।

 আমি?

 নয় কেন?

আমি পারব না মামা।

–কেন?

–আমি ঠিক..ঠিক সুস্থ নই। সেই অ্যাকসিডেন্টের পর আমারও আর আত্মবিশ্বাস নেই। কী যেন একটা হারিয়ে গেছে। আমি ভয় পাই।

–তবে বীরুর কী হবে ঝুমু? আমার যে তুই-ই সবচেয়ে ভরসা ছিলি।

–ফলো-টলো করা খুব রিস্কি মামা। বীরু টের পেলে?

বীরু টের পাবে? মামা চোখ বড় বড় করল।

পাবে না?

-তুই কি ভাবিস বীরু চারপাশটাকে লক্ষ করে? করলে আমি ভাবতাম নাকি? ও যখন গাড়ি চালায় তখন উন্মাদের মতো চালায়, আগুপিছু কিছু লক্ষ করে না। কারও তোয়াক্কা নেই, লক্ষ করবে কেন? তুই আমার গাড়িটা নিয়ে সেফলি ফলো করতে পারিস, ও কখনও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবেই না। গাড়ির নম্বর-প্লেট তো দূরের কথা, আস্ত গাড়িটাকেই ও নজর করবে না। আমি ওকে ফলো করে দেখেছি ঝুমু।

করেছ?

করেছি। কিন্তু পারি না। অত জোরে গাড়ি চালানোর নার্ভ আমার নেই। তা ছাড়া আফটার অল আমার ছেলে, তার সব কিছু ওয়াচ করতে আমার সংকোচ হয়। তোর তো তা নয়।

মনোরমের এই প্রথম মামার জন্য কষ্ট হয়েছিল খুব। যে লোকটা মনিহারিঘাটে একবার কামরার দরজা আটকে কেবল বাঙালি তুলেছিল গাড়িতে, তার সেই তেজ-টেজ বীরুর কাছে এসে কোথায় মিলিয়ে গেছে। নব্বই পারসেন্ট বাঙালির চাকরির জন্য যে লোকটা সব লড়াই করতে প্রস্তুত তার এ কেমন ব্যক্তিগত পরাজয়!

মনোরম নিমরাজি হয়েছিল। কাঠগোলায় বসে থাকার চেয়ে বরং একটু খোলা-আলো বাতাসে একা একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া, ব্যাপারটা ভাবতে ভালই।

একদিন বীরু ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। সামনেই দাঁড়ানো ওর ফিয়াটখানা। উঠল। গাড়িটা ছাড়তেই, মামা ভিতরঘর থেকে বেরিয়ে এসে চেঁচালকুমু, ফলো হিম! এই যে গাড়ির চাবি…মামা ছুঁড়ে দিয়েছিল চাবিটা।

মনোরম লুফে নিল। দৌড়ে গিয়ে মামার গাড়িটায় উঠে পড়ল। তখন উত্তেজনায় তার শিরা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বুকে স্কুটারের শব্দের মতো হুড়হুড় শব্দ। মামার ভোঁতা মুখওলা দিশি গাড়িটা ছাড়ল মনোরম। এবং বুঝতে পারল এ গাড়ি নিয়ে বীরুর বিদেশি ফিয়াট গাড়িটার পিছু নেওয়া বেশ শক্ত। তার ওপর বীরু তার ফিয়াট গাড়ির ইঞ্জিন মেকানিক দিয়ে হট-আপ করিয়ে নিয়েছে। স্পিডের জন্য।

লেকের ভিতর দিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউ হয়ে যাচ্ছে গাড়িখানা। ভোঁতা-মুখ দেশি গাড়িটায় বসে দাঁতে দাঁত চাপল মনোরম। জিভটা তখন ধড়াধড় ধাক্কা দিচ্ছে বন্ধ দাঁতে। ঘামছিল মনোরম। গাড়ির গতি বাড়তেই মনে পড়ল সেই দুর্ঘটনা…ছুটন্ত ট্রেন তার লাইন ছেড়ে অসহায় মাঠের মধ্যে নেমে যাচ্ছে লোভী, কাণ্ডজ্ঞানহীন, লুঠেরা মানুষেরা ফিস-প্লেট খুলে রেখেছিল, অপেক্ষা করছিল অন্ধকারে…একটা প্রলয় ঝড়ের মধ্যে ট্রেনের কামরার নিরাপদ প্রথম শ্রেণীর বার্থসুদ্ধ মনোরম হঠাৎ এরোপ্লেনের মতো উড়ে যাচ্ছিল। অন্ধকার হয়ে গেল মাথা। আবার ফিরে এল আলো। ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে বীরুর ফিয়াট।

ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিল মনোরম। দাঁতে দাঁত চেপে ভেবেছিল—নো মোর স্পিড ফর মি। আমি এখন একটা স্লো-মোশান ম্যান। জোকার।

মামা হতাশ হয়নি। বলেছিল–লেগে থাক। তুই-ই পারবি।

প্রথম প্রথম কয়েকবারই ব্যর্থ হল মনোরম। অলীক ছায়াছবির মতো মিলিয়ে যায় বীরু আর তার ফিয়াট। কলকাতার ভিড়ে ঠিক জাদুকরের মতো বীরু তার অদৃশ্য রাস্তা করে নেয়। মনোরম হতাশ হয়। এক রাতে স্বপ্ন দেখল, বীরু তার গাড়ি নিয়ে আশি-নব্বই মাইল বেগে ছুটছে একটা দেয়ালের দিকে, সুইসাইড করবে। মামার দিশি গাড়িখানা ঝকাং ঝকাং করে মুড়ির টিনের শব্দ করতে করতে চলেছে। গাড়ির রেডিয়োতে মামার আকুল স্বর শোনা যাচ্ছে, ওকে বাঁচা, ঝুমু-উ। কিন্তু গাড়ি চলছে না। স্বপ্নের মধ্যেই ইডিও-মোটর অ্যাকশন হচ্ছিল মনোরমের। বীরুর গাড়িটা দেয়ালের ওপর আছড়ে পড়ছে…ঠিক এই অবস্থায় ঘুম ভেঙে দেখল মনোরম, তার হাত দুটো সামনে বাড়ানো, একটা পা তোলা। স্বপ্নের মধ্যে সে চিৎকার করেছিল, সেই চিৎকারের শব্দ এখনও তার কানে লেগে আছে। যেন বা নিজের স্বপ্নের চিৎকারেই তার ঘুম ভেঙেছে।

মামার কিছু টাকা খরচ হল। মেকানিক দিয়ে পুরনো গাড়িখানা একটু হট-আপ করাতে হল। মেকানিক বলল–দিশি মেশিন, খুব বেশি স্পিড তুলবেনা।

তারপর একদিন প্রাণপাত করল মনোরম। গাড়ি চালানোর অভ্যাস গেছে বহুদিন। গেবালদের মোটর ট্রেনিং স্কুলে শিখেছিল। আশা ছিল, নিজের গাড়ি হবে একদিন। হয়নি। কাজেই অভ্যাসে মরচে পড়ে গেছে। তার ওপর দুর্ঘটনার স্মৃতি, ইডিও-মোটর অ্যাকশন, নড়ন্ত জিভ, সীতা! এতগুলো বাধা তার সব গতি কেড়ে নিচ্ছে আস্তে আস্তে। তবু সে একদিন বীরুকে ধরল এক দুপুরে। মামাদের বাড়ির সামনে থেকেই ফিয়াটখানা ছাড়ল। দশ গজ দূরে মনোরম মামার গাড়ির হুইলের পিছনে প্রকাণ্ড গোগো চশমা পরে বসে। গাড়িটা চলেছিল সেদিন। মনোরমের বুকে স্কুটার ডেকেছিল, মনে পড়েছিল সেই দুর্ঘটনা, জিভ নড়েছিল, সীতার জন্য দুঃখিত ছিল হৃদয়। ঘেমে নেয়ে গিয়েছিল সে। বীরুর মায়াবী ফিয়াট মুহূর্তে মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। একটু অবহেলায় কাত হয়ে বসেছে বীরু, ডান হাতে আলতো ছুঁয়ে রেখেছে হুইল, ঠোঁটে সিগারেট। চেষ্টাহীন সেই চালানো। বিদেশি মসৃণ গাড়িখানা সিল্কের অলীক রাস্তায় পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে। পিছনে দিশি গাড়িখানায় মনোরমের খাস গাঢ় ও দ্রুত হয়ে উঠছে তখন, ধোঁয়াচ্ছে গোঙানো ইঞ্জিন, ঘাম, স্বপ্ন ও স্মৃতির কুয়াশায় আচ্ছন্ন সম্মুখ। সে কী প্রাণপণে দিক ঠিক রেখেছিল মনোরম। ইনটুইশনের ওপর ভর করে বাঁক নিয়েছিল, কারণ বীরু হারিয়ে যাচ্ছিল প্রায়ই। এসপ্ল্যানেডেই যাচ্ছে বীরু–এই আন্দাজে চালিয়ে অবশেষে লেনিন সরণির মোড়ে ট্রাফিকে সে বীরুর গাড়ির দশখানা গাড়ির পিছনে থামল।

সেদিন বীরু খুব বেশি দূর যায়নি। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ে ঢুকে একটা চওড়া সম্ভ্রান্ত গলিতে গাড়ি দাঁড় করাল। অবহেলার ভঙ্গিতে নামল, দরজা লক না করে এবং গাড়িটার দিকে একবারও পিছু ফিরে না তাকিয়ে ঢুকে গেল একটা মস্ত দোকানে। ধীরে ধীরে দিশি গাড়িটাকে দোকানের সামনে আনল মনোরম। দেখল, রেডিয়ো আর গ্রামোফোনের খুব বড় দোকান। সামনে এপ্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত কাঁচ লাগানো দুটো শো-কেসে অজস্র রেডিয়ো, গ্রামোফোনের ডিসপ্লে। ঠিক গোয়েন্দার মতো সতর্ক চোখে তাকিয়ে রইল মনোরম। বাইরে দিনের আলো। কাঁচের গায়ে নানা রকম প্রতিবিম্ব পড়েছে। ওই সব প্রতিবিম্বের জন্য ভিতরটা ভাল দেখা যায় না। তবু প্রাণপণে লক্ষ করল মনোরম। ভিতরের মৃদু আলোয় দেখল, দোকানের ভিতরে আর একটা কাঁচের পার্টিশন আছে। সেই পার্টিশনের কাঁচের পাল্লা ঠেলে বীরুর লম্বা চেহারাটা ভিতরে ঢুকে গেল। ঝাঁয়-ঝিক ঝাঁয়-ঝিক ঝাঁয়-ঝিক করে একটা পপ মিউজিক বাজছে ভিতরে। রক্ত গরম করা বাদ্যযন্ত্র। শুনলেই হাত-পা নাচের জন্য দামাল হয়ে ওঠে। কাঁচের পাল্লাটা খুললেই গাঁক গাঁক করে শব্দটা বেরিয়ে আসছে। পাল্লাটা বন্ধ হলেই শব্দ মৃদু হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অবিরল শব্দটা হয়েই চলেছে।

মনোরম অনেকক্ষণ বসে সিগারেট পোড়াল। তারপর বীরু বেরিয়ে এল। একটা ধৈর্যহীন চাপা উত্তেজনাময় চেহারা তার, অসুখী, অতৃপ্ত। তার পিছনে কয়েকজন লোক ধরাধরি করে বয়ে নিয়ে এল একটা দামি সুন্দর স্টিরিও সিস্টেম। সেই জিনিসটা গাড়ির পিছনে তুলে আবার গাড়ি ছাড়ে বীরু। মনোরমের আবার সেই প্রাণান্তকর পিছু নেওয়া। রিচি রোডের একটা চমৎকার অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, তেমনি লক না করে, পিছু না ফিরে ঢুকে গেল ভিতরে। একটু পরে দুজন দারোয়ান-চেহারার লোক এসে দুটো বাক্সের মতো স্পিকার আর রেকর্ড প্লেয়ার সহ স্টিরিওটা নামিয়ে নিয়ে গেল। ধৈর্যশীল মনোরম ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রইল। বীরুর গাড়িটা হিম হতে লাগল। মনোরম দুবার পেচ্ছাপ করল, প্রায় দেড় প্যাকেট সিগারেট খেয়ে ফেলল। অনেক রাতে নেমে এল বীরু। শিস দিচ্ছে, একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বোধহয় কিছুটা মদ খেয়েছে। গাড়িতে উঠে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ঘুমের ঝিমুনি এসে গিয়েছিল মনোরমের। চটকা ভেঙে সোজা হয়ে বসল। রাত হয়ে গেছে। এত রাতে পিছু নিলে বীরু টের পাবে। ভাবল মনোরম। কিন্তু বীরু কিছু লক্ষ করেছে বলে মনে হল । একটা সিগারেট ধরিয়ে গাড়িটা ছাড়ল। তেমন স্পিড দিলনা এবার। আস্তে ধীরে বাড়ি ফিরে গেল। বীরু বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার আধ ঘণ্টা পর মনোরম দিশি গাড়িটা গ্যারেজে তুলে মামার দারোয়ানের হাতে চাবি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এল। সেই রাতে সাফল্যের আনন্দে তার ভাল ঘুম হয়।

পরদিন মামা সব শুনে জ কুঁচকে বলল–অ্যাপার্টমেন্ট হাউস? ওখানে ও করে কী?

কে জানে! চেনাশোনা কেউ থাকতে পারে।

–ভাড়া দেয়নি তো?

কে জানে।

–খোঁজ নে।

—আমি কি ডিটেকটিভ হয়ে যাচ্ছি মামা?

মামা চিন্তিত মুখ তুলে বলেছিল–তোকে এর জন্য না হয় কিছু বেশি টাকা দেব। ওকে দেখিস ঝুমু।

দেখেছে মনোরম। খোঁজ নিয়ে জেনেছে, অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটায় আটশো টাকা ভাড়ায় একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে বীরু। মাঝে মাঝে থাকে সেখানে। তার বেশি কিছু জানা যায়নি। মনোরম অনেক ভেবেছে, বুঝতে পারেনি, কেন বীরু নিজেদের অমন প্রকাণ্ড বাড়ি থাকতে এবং সেখানে অতগুলো খালি ঘর থাকতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছে। মামাও ভেবে পায়নি। দুজনে চিন্তিতভাবে দুজনের দিকে চেয়ে থেকেছে। মামা খাস ফেলে বলেছে ঝুমু, লক্ষ রাখিস। আমার একটাই সন্তান।

বীর কলেজের সামনেও অপেক্ষা করেছে মনোরম। বিশাল ইউনিভার্সিটি কলেজ। অনেকগুলো বিন্ডিং, করিডোর, মাঠ, ছেলেমেয়ে, ঠিক থৈ পাওয়া মুশকিল। তবু মনোরম ঘাপটি মেরে ঘুরেছে। কলেজের মাঠে, করিডোরে, দালানে। ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে, বীরু তাকে লক্ষ করেনি। এক দঙ্গল মেয়ের সাথে করিডোরে প্রায়ই আড্ডা দেয় বীরু। সকলের প্রতি সমান মনোযোগ। ক্ষতিকর কিছু নয়, একদিন শুধু কলেজ ভেঙে যাওয়ার পর মনোরম দেখেছিল, একটা ফাঁকা ক্লাশঘরের দরজার চৌকাঠে বীরু দাঁড়িয়ে। লম্বা শরীরটা ঝুঁকে আছে, দরজায় কাঠের ওপর হাত তুলে ভর রেখেছে শরীরের। ওর দীর্ঘ শরীরের আড়ালে একটা চৌখশ, সুন্দর, প্রায় কিশোরী মেয়ে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির বয়স এত কম, মুখে এমন একটা নিষ্পাপ ভাব যে, সহজেই যে কেউ প্রেমে পড়তে পারে। মনোরম দেখছিল, বীরু কথা বলতে বলতে ডান হাতে মেয়েটির বাঁ বগলের শর্ট স্লিভসের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে কাতুকুতু দিচ্ছে। মেয়েটি হেসে বলছে-যাঃ, রীতা এ কথা বলতেই পারে না।

-সত্যিই বলেছে, গৌরী প্রেগন্যান্ট।

রীতাটা মিথ্যুক।

 তা হলে সত্যিটা কী? তুমি প্রেগন্যান্ট নও?

–যাঃ! বলে মেয়েটি একটুমাত্র লাজুক ভাব করে খিলখিল হাসল। বলল–একদম ফ্রি আছি বাবা। ভয় নেই।

এইটুকু শুনেছিল মনোরম, সেদিন। ধৈর্যহীন, অতৃপ্ত যুবা বীরু চট করে হাতের ভরটা তুলে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, চলি।

মামাকে এটা জানানো যায় না। জানায়নি সে। বীরু যে ওই মেয়েটির সঙ্গে প্রেম করছে না, সেটা বোঝা গেল আর একদিন। অপরারে ফাঁকা ক্লাশঘরে বসে সে অন্য এক মেয়ের সাথে দ্বৈত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছিল। একটা উঁচু ডেস্কের দুধারে দুজন, ডেস্কের ওপর নামানো মাথা, থুতনিতে থুতনি ঠেকে আছে। অনুচ্চ স্বরে, আবেগভরে এবং সুন্দর গলায় দুজনে গাইছিল–অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ…সারাক্ষণই গানের মধ্যে তারা পরস্পরকে চুম্বন করছিল। দেখে ভারী উত্তেজিত হয়েছিল মনোরম। আগের দিনের সেই সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে তা হলে বীরু প্রেম করছে না? কেন করছেনা? কী সুন্দর মেয়ে, অনায়াসে মিস ক্যালকাটা জিতে যেতে পারে, অমন সুন্দর মেয়ে বীরু পাবে কোথায়! মেয়েটা ইচ্ছে করলে মনোরমকে সীতার দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে, আর বীরু ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। হায় ঈশ্বর! প্রেম করবি না তো ওর বগলে তুই কেন হাত দিলি বীরু। কেন জিজ্ঞেস করলি, ও প্রেগন্যান্ট কিনা। ঠাট্টা নয় তো? ঠাট্টা! এরকম ঠাট্টা কোনও মেয়েকে করা যায়, আর এরকম ঠাট্টা শুনে কোনও মেয়ে হাসে, মনোরম জানত না। মাথা গরম হয়ে গেল মনোরমের। তার সামনে একটা উত্তেজক নতুন জগতের ছবি ফুটে উঠেছিল।

দক্ষিণ কলকাতার একটা নামকরা গানের স্কুল থেকে একদিন চমৎকার শরীরওলা একটি মেয়েকে গাড়িতে তুলল বীরু। মনোরমের দিশি গাড়িটা প্রায় বীরুর ফিয়াটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালায়। ইচ্ছে করলে ওভারটেকও করতে পারে। মনোরম লক্ষ করে, মেয়েটার নিজের প্রকাণ্ড একখানা হাম্বার গাড়ি আছে। বীরুর গাড়িতে ওঠার আগে মেয়েটি নিজের গাড়ির ড্রাইভারকে গিয়ে নিচু স্বরে কী বলল গাড়িটা চলে গেল। মেয়েটা জিভ দিয়ে ওপর ঠোঁট চেটে বীরুর পাশে উঠে বসল, খোঁপা ঠিক করল। সহজ ভঙ্গি, বীরু তাকে নিয়ে এল তার অ্যাপার্টমেন্টে। দুজনে নেমে এগিয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা হঠাৎ থেমে বলল–ওই যাঃ! ব্যাগটা ফেলে এসেছি।

–তাতে কী হয়েছে?

দাঁড়াও না, নিয়ে আসি। ব্যাগটা না থাকলে বড় হেলপলেস লাগে।

 দৌড়ে গাড়ির সিট থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে মেয়েটা বীরুর সঙ্গে বাড়িটায় ঢুকে গেল। মাঝে মধ্যেই এটা হতে থাকে। মনোরম একান্তভাবে পিছু নেয়। এবং লক্ষ করে, মেয়েটার স্বভাবই হচ্ছে ব্যাগ ফেলে যাওয়া। কদিনই মেয়েটা ব্যাগ ফেলে গেল। দু-একবার মনে পড়তে ফিরে এল। অন্য কয়েকবার ব্যাগটা পড়েই রইল গাড়িতে। ওরা বাড়ি থেকে বেরোত অন্তত তিন-চার ঘণ্টা পরে। ওরা কী করে এতক্ষণ তা জলের মতো পরিষ্কার। অথচ মেয়েটা ভাড়াটে মেয়েমানুষ নয়। তার গাড়ি আছে, যে স্কুলে সে গান শেখে তা খুবই উঁচু জাতের, চেহারা বড়ঘরের মেয়ের মতো। তবে কি বীরু প্রেম করছে অবশেষে?মনোরম দিশি গাড়িটায় বসে ভাবত আর ঘামত।

সাহস বেড়েছিল মনোরমের। কৌতূহলও। মেয়েটা প্রায়ই ব্যাগ ফেলে যায়। একদিন মনোরম থাকতে না পেরে নেমে আসে। চারদিক চেয়ে দেখে। কেউ লক্ষ করে না। সোজা গিয়ে বীরুর লকনাকরা গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভিতরে ঢোকে। পুঁতে রঙের ব্যাগটা পড়ে আছে অবহেলায়। সে খোলে। প্রথমে কিছু সাধারণ জিনিস পায়। আইব্রো পেনসিল, লিপস্টিক, পাউডারের কেস, ফাউন্ডেশন, ক্লিপ, রাংতার প্যাকেট মাথা ধরার বড়ি, কয়েকটা ট্রাংকুলাইজার ট্যাবলেট এবং তারপরই বেরিয়ে আসে কন্ট্রাসেপটিভ ট্যাবলেটের একটা প্রায় খালি প্যাকেট। একুশটা ট্যাবলেট থাকে। তার মধ্যে মোটে দুটো অবশিষ্ট আছে। মনোরম সভয়ে নেমে আসে। দিশি গাড়িটায় বসে ক্রমান্বয়ে সিগারেট খায়।

গত শীতে পাঁচটা টেস্ট খেলাই দেখল বীরু। বাইরের টেস্ট খেলা দেখতে প্লেনে যাতায়াত করল কানপুর, মাদ্রাজ, দিল্লি, আর বম্বে। এলাহি টাকার কারবার। কজন ভারতীয় পাঁচটা টেস্ট খেলা দেখার ঝুঁকি নিতে পারে মনোরমের হিসেবে আসে না। শেষে টেস্ট খেলা দেখে ফেরার সময়ে একটা সিন্ধ্রি টিন-এজারকে পেয়ে গেল বীরু। ভারী সুন্দর, উগ্র এবং ছটফটে মেয়েটি। এক ঝলকে মেমসাহেব বললে ভুল হয়। পিঙ্গল চুল, মিনি স্কার্ট আর খয়েরি চোখের তারা। দমদমে বীরুকে আনতে গিয়েছিল মনোরম। মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল বীরু। মেয়েটির সঙ্গে তার বাবা ছিল। অ্যারিস্টোক্র্যাট চেহারা। বোঝা গেল মেয়েটির দানাপানির অভাব নেই। তিন-চার দিন পরেই বীরু তার অ্যাপার্টমেন্টে এনে তুলল তাকে। মেয়েটি খুব হাসছিল, মুখচোখ ঝলমল করছে খুশিতে। মনোরম বুঝতে পারে, এই মেয়েটিও জানে বীরু তাকে কোথায় নিয়ে যাবে এবং সেখানে কী হবে। জেনেও বিন্দুমাত্র ভয় নেই। মনোরম হাই তোলে। তার বিস্ময়বোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

কিছুদিনেই মনোরম বুঝতে পারে, বীরু তার আটশো টাকার অ্যাপার্টমেন্টের চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার করে। এবং কোনও মেয়েই বেশ্যা নয়। বাছাই, চমৎকার মেয়ে সব। কেউই রোগা বা মোটা নয়, গরিবঘরের নয়, হাঘরে নয়, বীরুর চেয়েও ঢের বড়লোকের বাড়ির মেয়েও আছে তার মধ্যে। এবং কারও সঙ্গেই বীরুর প্রেম নেই। এক একদিন এক দঙ্গল পুরুষ আর মেয়ে বন্ধু নিয়েও ও ঢুকে যায় অ্যাপার্টমেন্টে। ক্রমশ সাহসী মনোরম দিশি গাড়ি ছেড়ে ঢুকে পড়ে বাড়িটায়। লিফটে উঠে আসে ওপরে। মোজেইক মেঝের ওপরে নিঃশব্দে হেঁটে এসে বীরুর চমৎকার অ্যাপার্টমেন্টের ফ্লাশ-ডোরে কান রেখে শোনে। ভিতরে ঝিকঝই ঝিকঝাই ইও ইও ইও ইও টিরিকিটি টিরিকিটি টিরিকিটি ঝাঁই এরকম সব অদ্ভুত শব্দে স্টিরিও বাজছে। ঝনাৎ করে পড়ে ভেঙে গেল মদের গেলাশ। উদ্দণ্ড নাচের শব্দ। হো-হো চিৎকার। কণ্টকিত হয়েছে মনোরম। হঠাৎ দরজা খুলে ঢুকে যেতে ইচ্ছে হয়েছে উদ্দাম আনন্দিত ঘরখানার মধ্যে। পাপ হবে না, কেউ দোষ দেখবে না। ঢুকবে?

তক্ষুনি নড়ন্ত জিভটাকে টের পেয়েছে সে। মনে পড়ে সেই দুর্ঘটনা। মনে পড়ে বয়স, সীতা। ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। নিঃশব্দে নেমে এসেছে মনোরম। দিশি গাড়িটায় বসে সিগারেট টেনেছে।

ছেলেটার কোনও ক্লান্তি নেই। সারা শীতকাল একনাগাড়ে টেনিস খেলল একটা ক্লাবে। একটু দূর থেকে, পার্কের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মনোরম দেখে গেল টেনিস বলের এ কোর্ট থেকে ও কোর্ট যাতায়াত, আর পফ পফ শব্দ শুনল। ফার্স্ট ডিভিশন লিগে খেলে গেল ক্রিকেট। গ্রীষ্মে একটা দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাবে খোলা মাঠে জলে কাদায় ভূত হয়ে ফুটবল লাথিয়ে গেল। কোনও খেলাই খুব মন্দ খেলে না। কিন্তু কেমন একটু নিরাসক্ত উদাসীন ভাব। যেন কোনও কিছুতেই গা নেই।

ও কি নিরাসক্ত, সন্ন্যাসী? না কি পাষণ্ড? ইউ এস আই এস-এর সামনে ছাত্রদের একটা র‍্যালি ছিল, ভিয়েতনামের যুদ্ধের প্রতিবাদে। সেদিন একটা স্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনের মাউথপিস মুখের কাছে টেনে বীরু বক্তৃতা করল। প্রথমে ধীরে ধীরে ভিয়েতনামের যুদ্ধের কারণ ব্যাখ্যা করল, মার্কিন ভূমিকার পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিল, সিয়াটোর ভূমিকা ব্যাখ্যা করল, প্রসঙ্গত ইয়োরোপ এবং এশিয়ায় মার্কিন দুমুখো নীতির চমৎকার সমালোচনা করল, সমাজতন্ত্র কী এবং সমগ্র এশিয়ার অর্থনৈতিক মুক্তি কী ভাবে আসবে তা বলে গেল বিশুদ্ধ বাংলায়। বলতে বলতে থেমে গেল না, কিন্তু ভাবতে ভাবতে বলল, থেমে থেমে। ঝোড়ো আবেগ নেই, কিন্তু নিবেদনটি ভারী আন্তরিক। ও যে এত ভাল বাংলা জানে কে জানত তা? কিংবা রাজনীতির এত খবর রাখে, জানে ভূগোল ইতিহাস? দাঁড়াল ঠিক তরুণ এক বিদ্রোহীর মতো। এত সুন্দর ভঙ্গিটি!

সব রকমের জুয়া খেলে বীরু। সাট্টা থেকে ঘোড়দৌড়। ঘোড়দৌড়ের মাঠে একদিন মুখোমুখি পড়ে গেল মনোরম। অবিরল হারছিল বীরু। মুখে একটু বিরক্তির চিহ্ন দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু হতাশা বা ভেঙেপড়া ভাব ছিল না। রেজাল্ট ওঠা মাত্র হাতের টিকিট দুমড়ে ফেলে দিচ্ছিল। আবার লম্বা পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল কাউন্টারের দিকে। বীরু কিছুই দেখেনা–এই বিশ্বাসে মনোরম সেদিন তেমন আড়াল হয়নি। খোলাখুলি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঘোড়াদের স্টার্টিং পয়েন্টে হাঁটিয়ে নেওয়া হচ্ছে পঞ্চম রেস-এর আগে। রেলিং ধরে বীরু দাঁড়িয়ে ঘোড়া দেখল, তারপর হঠাৎ কাউন্টারে যাবে বলে ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখি।

একটু অবাক হল বীরু, সামান্য কৌতূহল দেখা গেল চোখে। ঘাবড়ে গেল না একটুও। বরং মনোরম ঘাবড়ে যাচ্ছিল।

বীরু একটু এগিয়ে এসে বলে তুমি খেল?

খেলি।

–দেখিনে তো কখনও!

গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে আসি না তো!

–আমি তো দুই স্ট্যান্ডেই খেলি। বলে মিষ্টি করে হাসল। বলল কী খেলছ এটায়?

–ঠিক করিনি।

—আমি ডাকুর ওপর অনেক টাকা খেলছি, কিন্তু হবে না, দিনটা খারাপ। কুড়িটা জ্যাকপট মিলিয়ে রেখেছিলাম। সবকটা গেছে ফিফথ রেস-এর মধ্যে।

কত হেরেছিস?

–হাজারের ওপর তো বটেই। এখনও হিসেব করিনি। তুমি?

–গোটা পঞ্চাশ।

 –মোটে? তুমি তো লাকি। আবার হাসল বীরু।

–আর খেলিস না।

–কেন? বীরু ভ্রূ তোলে।

খামোকা খেলবি। এক একটা দিন অনেকে কেবল হারে।

–আমি রোজ হারি! হারজিত তো আছেই। তবে এ রেসটার পর কেটে পড়ব। ভাল লাগছে না।

–আমিও।

–কোথায় যাবে?

–ঠিক নেই। মামার কাছে যেতে পারি।

–ঠিক আছে। একসঙ্গে ফিরব। আমার গাড়ি নেই, গ্যারেজে দিয়েছি, ট্যাক্সিতে ফেরা যাবে। সেটা জানত মনোরম। তাই একটু বিপদে পড়ল। তারও গাড়ি আছে। মামার দিশি গাড়িটা। বলল–আমার গাড়ি আছে।

অবাক হয়ে বীরু বলে নিজের গাড়ি?

না না, মামার গাড়িটাই। কয়েক ঘণ্টার জন্য চেয়ে এনেছি।

–বাবা দিল? কাউকে তো দেয় না।

–আমি তো বিজনেস টুর-এ আছি।

তাই বলো। নইলে দিত না।

রেস-এর পর তারা গাড়িতে এসে উঠল। বীরু গাড়িতে বসে চারদিকে চেয়ে গাড়িটা একটু দেখে বলে রদ্দি জিনিস।

-কী?

–এটা। গাড়িটা।

দিশি মাল, আর কত ভাল হবে।

তুমি তো ভালই চালাও।

 অভ্যেস।

–অভ্যেস কেন? বাবা তোমাকে দিয়েই সফারের কাজ করায় নাকি?

না, তা নয়। স্ট্রোকের পর নিজে চালাতে ভরসা পায় না, আমিই চালাই।

অঃ!

একটু চুপ।

বাবা তোমাকে কত দেয়?

–দেয় কিছু। আমার চলে যায়।

–তোমার একটা বিজনেস ছিল না?

ছিল। বেহাত হয়ে গেছে।

–শুনেছি, খুব রোজগার করতে?

–হত মন্দ না।

তা হলে এখন চলে যাচ্ছে কী করে? বাবা বেশি দেওয়ার লোক নয়।

 একা মানুষ তো, চলে যায়।

একা তো আমিও।

তুই একা কেন? মামা মামি কি হিসেবের মধ্যে নয়?

হলেও তারা ডিপেন্ডেন্ট তো নয়। বরং আমিই ডিপেডেন্ট। একা আমারই তো কত খরচ! গাড়িটা বাঁয়ে ঘুরিয়ে নাও, সামনের রাস্তায়।

-কেন?

–আমার একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে রিচি রোডে, যাব।

একটু চমকে গিয়েছিল মনোরম। ওর যে একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে সেটা জানতে মনোরমকে কত কষ্ট করতে হয়েছে আর সেই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য খবরটা ও কত সহজেই দিয়ে দিচ্ছে নিজে। বিন্দুমাত্র গোপন করবার চেষ্টা নেই। একটু হতাশ হয় মনোরম।

মনোরম গাড়ি ঘোরাল।

যাবে আমার অ্যাপার্টমেন্টে?

সেখানে তুই কী করিস?

অনেক কিছু। তবে বেশিরভাগ সময়ে বসে রেস্ট নিই, আর বই পড়ি। তুমি ড্রিঙ্ক করো?

–কী বলছিস?

—-ড্রিঙ্ক করো তো?

একটু ভাবল মনোরম। বলল-করি।

–আমার ফ্ল্যাটে একটা ছোট্ট বার আছে। যাবে? রেস-এর পর তোমার টায়ার্ড লাগছে না?

লাগছে।

–তা হলে চলো। ওল্ড স্মাগলার হুইস্কি খাওয়াব।

একটু চুপ।

-মামা জানে?

কী?

 –তোর যে একটা ফ্ল্যাট আছে!

–জানলে জানে। আমি তো লুকোইনি, আবার আগ বাড়িয়ে কিছু বলিওনি।

বলিসনি কেন?

–ওটা আমার একার জায়গা। আমার মেয়েবন্ধুরা আসে। ছেলেবন্ধুরা আসে। গেট-টুগেদার হয়। নাচ-গানও হয়। বাবা মা জানলে ওখানে হানা দিতে থাকবে। ফ্ল্যাট নেওয়ার উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হবে তা হলে।

–আমাকে তবে নিচ্ছিস কেন?

বীরু হাসে, বলে–এমনিই। রেস-এর মাঠে তোমাকে দেখে খুব মায়া হল। ভারী ছন্নছাড়া দেখাচ্ছিল তোমাকে। ভাবলাম হঠাৎ বিপাকে পড়ে বাবার চাকরি করছ, নিশ্চয় তুমি খুব সুখে নেই। তাই ভাবলাম, তোমার সঙ্গে একটু ড্রিঙ্ক করি।

মনোরম একটু হেসে বলল–তুই আমার ছোট ভাই, তা জানিস?

সম্পর্কটা এখন খুঁচিয়ে তুলবে নাকি?

না, না, এমনি বললাম।

 –আত্মীয়তা ব্যাপারটা আমি দু চোখে দেখতে পারি না। ওটার মধ্যে অনেক ভণ্ডামি আছে।

–কীরকম?

আত্মীয় বলেই অনেকে অনেকের কাছ থেকে কিছু সম্মান বা সুবিধে পায়, যেটা তাদের পাওনা নয়। সম্মান বা সুবিধে পাওয়ার জন্য মিনিমাম কিছু যোগ্যতা থাকা দরকার। কেবল আত্মীয়তা কখনও সেই যোগ্যতা হতে পারে না। সেইজন্য আমি গুরুজনটন মানি না।

মনোরম বুঝেছে, মাথা নাড়ল।

বীরু কী সুন্দর নরম ব্যবহার করছিল সেদিন! ভাবা যায় না। বীরু যে এত নরম এবং বিষয় স্বরে কথা বলতে পারে, তা কে জানত?

গোপনে গোয়েন্দার মতো দিনের পর দিন যে ফ্ল্যাটটার ওপর নজর রাখত মনোরম সেই ফ্ল্যাটে সেদিন সে অনায়াসে ঢুকল।

ফ্ল্যাটটা ভালই। এ সব ফ্ল্যাট যেমন হয়, তেমনি। তিনখানা ঘর, ডাইনিং স্পেসকাম-বৈঠকখানা, সবই আছে, কিন্তু আসবাবপত্র বেশি কিছু নেই। একটা বেশ বড় খাট, তাতে ফোম রবারের গদি, গদির ওপর মণিপুরি চাদরে ঢাকা বিছানা কুঁচকে আছে। চেয়ার টেবিলগুলো দামি কিন্তু যেখানে সেখানে ছড়ানো, মেঝে ভর্তি সিগারেটের শেষ টুকরো সব পড়ে আছে, টেবিলের ওপর ডাব্বাই অ্যাশ-ট্রে উপচে পড়ছে ছাই, দেশলাইয়ের কাঠি আর সিগারেটের টুকরোয়। মেঝের ওপর পড়ে আছে স্টিরিওটা। রেকর্ডের গাদা দুটো স্পিকারের ওপর রাখা। মেয়েলি হাতের স্পর্শ নেই। অজস্র বই চোখে পড়ে। সবই ইংরিজি। দর্শন, রাজনীতি থেকে ডিটেকটিভ বই পর্যন্ত। বৈঠকখানা ঘরের দেয়ালে বিল্ট-ইন ক্যাবিনেট খুলে গেলাস বের করে বীরু, আর হুইস্কির বোতল। বলে-ডাইলিউট করতে হলে ট্যাপ থেকে জল মিশিয়ে নাও। আমি নিট খাই, সোডা-ফোডার ঝামেলা নেই।

সন্ধে নাগাদ অনেকটাই মাতাল হয়ে গিয়েছিল মনোরম। কথা একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। পেটে পুরনো গ্যাসট্রিকের ব্যথা, খালি পেটে অ্যালকোহল পড়তে চিন চিন করে উঠছিল মাঝে মাঝে। ব্যথাটা কমাতেই বেশি খেল মনোরম।

–তোর মেয়ে বন্ধুরা এখানে আসে?

–আসবে না কেন?

একা?

একাও।

 আবার কিছুক্ষণ মদ খেল দুজন।

-বীরু।

উ।

–মেয়েবন্ধুদের মধ্যে কাকে তোর ভাল লাগে সবচেয়ে?

সবাইকে। অদ্ভুত মদির হাসি হাসে বীরু, বলে-কে ভাল নয় বলো! মেয়েরা সবাই এত ভাল, এত সিমপ্যাথেটিক। আই লাভ দেম।

কাউকে বেশি ভাল লাগে না?

কাউকে অন্য কারও চেয়ে বেশি ভাল লাগতে পারে। তবে সকলেরই আলাদা রকমের ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট আছে।

ধর, কারও সঙ্গে প্রেম করিস না?

–প্রেমই তো। শুধু আন্ডারওয়্যার পরে বসে ছিল বীরু বেতের গোল চেয়ারে। লম্বা পা দুখানা সামনে ছড়ানো। এমনভাবে প্রেমই তো বলল, যেন ভিয়েতনামে মার্কিন নীতির নিন্দে করছে।

–তোর গার্ল ফ্রেন্ডদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কে?

–কে সুন্দর নয়! হাসল বীরু-সবাই নিজের মতো করে সুন্দর। আমি একদম হারিয়ে যাই ওদের মধ্যে। আজকাল আমার এমন হয়েছে যে রাতে শুয়ে যদি কারও কথা ভাবি তা হলে ওর চোখ ওর মুখে এসে বসে, এর ঠোঁট তার মুখে চলে যায়। বিশেষ কাউকে মনে পড়ে না। সে এক ভারী ঝামেলা। শোওয়ার সময়ে বিশেষ একজনকে ভাবতে ইচ্ছে করে, পারি না।

কাকে?

রোজ তো একজনকে নয়!

–তোর বন্ধুদের মধ্যে একজন আছে না, গৌরী! মাতাল মনোরম বলে ফেলল।

একটু স্থির হয়ে যায় বীরু, তারপর বলে, জানলে কী করে?

মনোরম মনে মনে ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু ফেরার উপায় নেই।

খুব চালাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল–গৌরী তো কমন নাম! আন্দাজে টোপ ফেললাম একটা।

–আন্দাজে! বলে একটু হাসে বীরু, তারপর বিষণ্ণ মুখে বলে–আন্দাজে হলেও লাগিয়েছ ঠিক। গৌরী একজন আছে।

-সে আসে?

–আসবে কী, সে এখন নার্সিং হোমে!

–কেন?

–বড্ড বোকা মেয়ে। আজকাল কেউ যে অত বোকা আছে তা জানতাম না।

মনোরম ধৈর্যভরে পান করল আর একটুক্ষণ।

কী হয়েছে?

 –অ্যাকলেমশিয়া। তার ওপর ডানদিকটা পড়ে গেছে।

–সে সব তো বাচ্চাটাচ্চা হলে হয়।

তাই তো হয়েছে। প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চা একটা।

কী করে হল?

–যেমন করে হয়। আজকাল যে এমন বোকা মেয়ে আছে, কে জানত! প্রেগন্যান্সিটা কেবলই অস্বীকার করে যেত। অথচ আমরা জানতাম। আমার মতো ওর অনেক বিশ্বস্ত এবং সৎ বন্ধু ছিল। ও স্বীকার করলে আমরা খুব সেফলি ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতাম, কেউ জানত না। ও লজ্জায় কোনওদিন স্বীকার করেনি।

বাঁচবে?

চান্স কম। প্রচুর হেমারেজ হয়েছে। কোমায় পড়ে আছে। কথাটথা বলতে পারে না, জ্ঞানও ঠিক নেই। কাল থেকেই মনটা তাই খারাপ। মাঠ থেকেও সেজন্যই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।

-তুই ওকে ভালবাসিস না বীরু?

বাসি। বিশেষ করে আজ তো ওকেই ভালবাসছি। কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হওয়া তো ভালবাসাই, না?

–ও যদি বাঁচে?

–খুব ভাল হয় তা হলে। আমি একটা পার্টি দেব।

 বিয়ে করবি ওকে বীরু?

–বিয়ে? বীরু তাকায়। একটু ভাবে। তারপর বলে–ওকেই কেন করব?

বড় ভাল দেখতে মেয়েটা।

 –কোথায় দেখলে? একটুও বিস্মিত না হয়ে সাধারণভাবে প্রশ্ন করে বীরু।

-দেখেছি।

-হ্যাঁ, ভালই। বিয়ে ওকেও করতে পারি। কোনও প্রেজুডিস নেই।

–কে ওকে প্রেগন্যান্ট করল?

-কে জানে। যেই হোক, গৌরীর সাবধান হওয়া উচিত ছিল। ওরই দোষ। মুঠো মুঠো ট্যাবলেট বাজারে বিক্রি হয়! কত মেয়ে নিজেরাই গিয়ে কেনে। ওরই কেবল লজ্জা আর লজ্জা।

-তুই ওকে বিয়ে করিস বীরু।

–আগে বাঁচুক তো! তুমি কি আরও খাবে? খেয়ো না। গাড়ি নিয়ে যাবে তো, না খাওয়াই ভাল। আমি আজ বাড়ি ফিরছি না। আর একটু খেয়ে পড়ে থাকব।

বাড়িতে খবর দেব?

–না না, কোনও দরকার নেই। মাঝে মাঝে আমি ফিরি না, সবাই জানে। তুমি যাও।

শূন্য গেলাস রেখে মনোরম উঠে এসেছিল।

সেই একটা সুদিন এসেছিল। তার পরদিন থেকেই বীরু আবার আলাদা মানুষ। গ্রাহ্য করে না, তাকায় না। কথা তো নেই-ই, আবার একজন অচেনা মানুষ হয়ে যায় বীরু।

খুঁজে খুঁজে নার্সিং হোমটা বের করেছিল মনোরম। মেয়েটা বেঁচে গেছে। বীরু আবার গাড়ি দাবড়াচ্ছে। মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে অ্যাপার্টমেন্টে। ওর ঘরে উদ্দাম বেজে যাচ্ছে স্টিরিওতে নাচের বাজনা। মনোরমের কথা কি মনে রেখেছে বীরু? না ভুলে গেছে?

ও কি উদাসীন সন্ন্যাসী? ও কি পাষণ্ড?ওকে ঠিক বুঝতে পারে না মনোরম। একেই কি জেনারেশন গ্যাপ বলে? বীরুর পিছু নিতে নিতেই মনোরম তার পোশাক পালটে ফেলল। রাখল বড় চুল, জুলফি। দিশি গাড়িটা নিয়ে সে যেমন বীরুর ফিয়াটের সঙ্গে তার দূরত্বটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, তেমনি জেনারেশন গ্যাপটাও অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে।

.

সেই মায়াদয়াহীন মুখখানা! বীরু বসে আছে টেবিলের উল্টোদিকে। ফাইলপত্র ঘাঁটছে। মনোরম অস্বস্তির সঙ্গে চেয়ে ছিল।

ফাইলটা বন্ধ করে বীরু মুখ তুলল। হঠাৎ আতৃঙ্কিত আনন্দে মনোরম দেখে ও হাসছে।

-তোমার বউকে কাল দেখলাম।

–কে! কার কথা বলছিস?

—তোমার বউ সীতা।

সীতা! বউ! বউদি নয়? একটু অবাক হয় মনোরম।

-কোথায়?

নিউ মার্কেটে। শি হ্যাড কোম্পানি।

–ওঃ! তোকে চিনল?

 –এক-আধবারের দেখা, ঠিক চিনতে পারেনি। আমি চিনেছি। মেয়েদের মুখ আমার মনে থাকে।

–কথা-টথা বললি?

-হুঁ। সেইটেই একটা ভুল হয়ে গেল।

ভুল?

-চিনতে পেরেই হঠাৎ বউদি বলে ডেকে ফেলেছিলাম। খুব ঘাবড়ে গেল। তাই এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিলাম। একটু কষ্টে চিনল। দু-চারটে কথাবার্তা হল।

বউদি বলে ডাকলি?

তবে কী বলে? বউদিই তো হয়। ছাই সেটাও একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল।

–কেন?

সঙ্গে যে লোকটা ছিল, ওয়েলবিল্ট কেম্যান, সে লোকটা আমার দিকে ভীষণভাবে চেয়ে রইল। আমি বউদির সঙ্গে কথা বলছি, আর লোকটা অপলক চেয়ে আছে, যেন খেয়ে ফেলবে। যখন চলে আসছি তখন লোকটা আমাকে ডাকল, একটু আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল–আপনি ওকে বউদি ডাকলেন, কিন্তু ও এখন কারও বউ নয়, জানেন? আমিও ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিক। ক্ষমাউমা চেয়ে নিলাম। ও নিজেই বলল বরং ওকে নাম ধরে ডাকতে পারেন, কিংবা মিস সান্যাল বলে। আমি সেটাও মেনে নিলাম। চলে আসবার সময়ে তোমার এক্স বউকে ডেকে বললাম-সীতা চলি।

মনোরম কিছু শুনছিল না। শুধু বলল হু।

লোকটা রুস্তম টাইপের, আর খুব জেলাস। গায়ে অনেক মাংস, সাতটা বাঘে খেয়ে শেষ করতে পারে না।

কৌতুকভরে বীরু চেয়ে আছে মনোরমের মুখের দিকে। মনোরম মুখটা ফিরিয়ে নেয়। জিভটা সব সময়েই নড়ে, কিন্তু অভ্যাস বলে সব সময়ে মনোরম তা টের পায় না। এখন পেল। মুখের ভিতরে যেন একটা হৃৎপিণ্ড, অবিরল তার মৃদু শব্দ।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়